জিন্দালাশ ভার্সেস তিন গোয়েন্দা

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৮/২ – জিন্দালাশ ভার্সেস তিন গোয়েন্দা – কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন – তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

প্রথম প্রকাশ: ২০১০

এক

রবিনের টেরেসা নানু হোটেলের সামনে, সাইডওয়কে তাঁর পেইন্ট বক্সটা রাখলেন।

ওরা লুইজিয়ানার নিউ অর্লিয়েন্সে এসেছে। রবিনের নানু পেইন্টিং কোর্সে অংশ নেবেন, এবং তিনি কিশোর, রবিন আর মুসাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে।

‘তুমি আজকে কী আঁকবে, নানু?’ প্রশ্ন করল রবিন। টেরেসা নানু ওর নানুর বোন।

নীল পোশাক পরেছে আজকে রবিন। এমনকী মোজা আর স্নিকার্সও নীল।

‘এখনও জানি না,’ টেরেসা নানু বললেন, ‘আর্ট টিচার বলবেন। এই ব্যালকনিওয়ালা পুরানো বিল্ডিংগুলোর কোনওটার ছবি আঁকতে পারলে ভাল লাগত।’

‘আমাদেরকে সাথে করে এনেছেন বলে আবারও ধন্যবাদ,’ কিশোর বলল।

‘আর আমাদেরকে আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে জ্যাককে ভাড়া করেছেন বলেও আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য,’ যোগ করল মুসা।

‘ওয়েলকাম,’ টেরেসা নানু বললেন। ‘ও আজ তোমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’

‘আমরা হাইকে যাচ্ছি,’ বলল মুসা।

‘জঙ্গলে বাস করে এমন এক কমিউনিটির সাথে দেখা হবে আমাদের,’ জানাল রবিন। ‘ও বলেছে ওখানকার লোকেরা নাকি কুঁড়েঘরে বাস করে, ইলেকট্রিসিটি ছাড়া!’

‘বাহ, ইন্টারেস্টিং তো!’ টেরেসা নানু বললেন। ‘ওহ, এই যে জ্যাকের ভ্যান। তোরা এনজয় কর। লাঞ্চে দেখা হবে!’

টেরেসা নানু এক বগলের তলায় পেইণ্ট বক্স গুঁজে হাঁটা দিলেন। একটা ভ্যান কার্বে এসে থামল। ওটার সারা গায়ে গাছ-পালা, লতা-পাতা আর ফুল আঁকা। এক পাশে এক এলিগেটরের ছবি। ওটার মুখ দিয়ে চলকে বেরিয়ে আসছে ‘গেটর গাইড’ শব্দগুলো।

বুট, শর্টস আর টি-শার্ট পরা লম্বা এক লোক লাফিয়ে নামল ভ্যান থেকে। মাথার চুল সাদা আর গায়ের চামড়া কালো তার।

‘কি, তোমরা হাইকের জন্যে রেডি?’ জিজ্ঞেস করল।

‘হাই, জ্যাক!’ ছেলেরা বলে উঠল। মুসা আর রবিন ভ্যানের পিছনে উঠে বসল। জ্যাক বসল চালকের আসনে। কিশোর বসল সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে।

‘বেল্ট বেঁধে নাও!’ জ্যাক বলল।

ছেলেরা যখন সিট বেল্ট বাঁধছে তখন জ্যাক কিশোরের হাতে একটা বাগ স্প্রে দিল।

‘আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে অনেক পোকা,’ বলল ও।

ছেলেরা ওদের বাহু আর পায়ে স্প্রে করে নিল, ওদিকে ব্যস্ত শহর ভেদ করে ভ্যান নিয়ে এগিয়ে চলল জ্যাক। কিশোর দেখল অনেক লোক জগিং করছে, কুকুরদের নিয়ে হাঁটছে, কিংবা সাইডওয়কের ছোট ছোট টেবিলে বসে নাস্তা সারছে।

‘আমরা আজকে দারুণ সুন্দর এক বনের ভিতর দিয়ে হাইক করব,’ গাড়ি চালানোর ফাঁকে ছেলেদেরকে বলল জ্যাক। ‘আর আমি যাদের কথা বলেছিলাম তাদের সাথে পরিচিত হব।’

‘ওরা আর সবার মত শহরে থাকে না কেন?’ রবিনের জিজ্ঞাসা। ‘সবাই শহুরে জীবন পছন্দ করে না,’ ব্যাখ্যা করল জ্যাক। ‘যাদের সাথে আজ তোমাদের দেখা হবে তারা মান্ধাতা আমলের জীবন ভালবাসে। তারা নিজেরাই নিজেদের ফসল ফলায়, শিকার করে কিংবা মাছ ধরে।’

‘খাইছে, ওরা টিভি আর কম্পিউটার মিস করে না?’ মুসার প্রশ্ন।

হেসে উঠল জ্যাক।

‘ছেলে-মেয়েরা শহরের স্কুলে যায়, কাজেই তারা হয়তো ওগুলো চেনে,’ বলল ও।

‘কিন্তু ইলেকট্রিসিটি ছাড়া ওরা রান্না করে কীভাবে?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘আগুন জ্বেলে,’ জ্যাক বলল। ‘বেশিরভাগই কাদামাটি আর পাথরের তৈরি চুলো ব্যবহার করে।’

কিশোর কল্পনা করল ওর চাচা-চাচী বাড়ির বাইরে রান্না করছে। মৃদু হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।

রাস্তাটা সরু হয়ে এল। মেটে রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে শুরু করল ভ্যান। রাস্তার পাশে লম্বা গাছের সারি। ডাল-পালা থেকে চুইয়ে পড়ছে ধূসর সবুজ স্প্যানিশ শ্যাওলা। খোলা জানালা দিয়ে পাখিদের কলতান কিশোরের কানে আসছে। সে সঙ্গে মিষ্টি, স্যাতসেঁতে গন্ধ টের পাচ্ছে নাকে।

এসময় জ্যাকের সেলফোন বাজতে শুরু করল। ভ্যানটাকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে মিনিট খানেক কথা বলল ও।

‘আমার বেগমসাহেব,’ ফোন ছাড়ার পর ছেলেদেরকে বলল ও। ‘আমাদের প্রথম বাচ্চা যে কোন দিন জন্মাতে পারে।’

‘খাইছে! দারুণ ব্যাপার!’ বলে উঠল মুসা। জ্যাক ভ্যান চালাতে লাগল। ‘আপনি কি ছেলেটাকে হাইকে নিয়ে যাবেন?’

‘বাচ্চাটা মেয়েও হতে পারে, মুসা,’ বলল নথি।

‘ছেলেই হোক আর মেয়ে, ও অবশ্যই হাইকার হবে,’ দাঁত বের করে হেসে বলল জ্যাক।

শীঘ্রি রাস্তার এক টুকরো ফাঁকা জায়গায় ভ্যান পার্ক করল জ্যাক। পিছনে পড়ে রয়েছে রোদ ঝলমলে মেটে রাস্তাটা। সামনে গাছ, শ্যাওলা আর ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আঁধার এক দেয়াল।

ছেলেরা আর জ্যাক ভ্যান থেকে বেরিয়ে এল। বাতাস ভাপসা। ওদের মুখের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে খুদে খুদে পোকা।

জ্যাক এক কাঁধে ঝুলিয়ে নিল প্যাকটা। এবার এক পিতলের ফলক দেখিয়ে দিল। ধাতব ফলকটায় লেখা: ওল্ড ফরেস্ট ট্রেইল।

ট্রেইল এখান থেকে শুরু হয়েছে,’ বলল ও। ‘মাটিতে গাছের শিকড় আছে। সাবধান!

‘খাইছে, সাপ-টাপ নেই তো?’ প্রশ্ন করল মুসা। চট করে জ্যাকের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘থাকতে পারে,’ জ্যাক বলল। ‘কিন্তু আমরা ওদেরকে দেখব না। আমাদের পায়ের শব্দ পেলেই সরে পড়বে ওরা।’

এক সারিতে এগোচ্ছে ওরা। জ্যাক সবার সামনে, ওর পায়ে পায়ে মুসা। রবিন অনুসরণ করছে মুসাকে, আর কিশোর রয়েছে সবার শেষে। ট্রেইলটা সংকীর্ণ, এবং গাছ-পালাকে পাক খেয়ে এগিয়েছে। মুখের কাছে শ্যাওলা ঝুলছে। গাছের শিকড় ওদেরকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। চারদিকে পোকা-মাকড়ের ভন-ভন শব্দ।

কিশোরের শরীরে ঘাম দেখা দিয়েছে। ও লক্ষ করল ডানে-বাঁয়ে আরও কয়েকটা সরু ট্রেইল চলে গেছে। একটার দিকে চেয়ে রয়েছে এসময় হঠাৎই হোঁচট খেল ও, হাত আর হাঁটুর উপর ভর দিয়ে পড়ে গেল।

‘তুমি ঠিক আছ তো?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল জ্যাক।

কিশোর মুখ তুলে চাইতেই দেখতে পেল ছোট এক সাইন পেরেক দিয়ে গাছের গুঁড়িতে গাঁথা। কে যেন লাল অক্ষরে তিনটে শব্দ লিখে রেখেছে ওটায়:

সাবধান!

জিন্দালাশের এলাকা।

দুই

সাইনটার দিকে চেয়ে রইল ওরা। খানিকটা রং চুইয়ে পড়েছে, ফলে শব্দগুলোকে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে রক্ত ঝরে পড়ছে। বাহুর লোম দাঁড়িয়ে গেল কিশোরের।

‘খাইছে! জিন্দালাশের এলাকা?’ প্রায় ফিসফিস করে বলল মুসা। ‘এর মানে কী?’

‘কে জানে,’ বলল জ্যাক। ‘এই নোটিশটা আগে দেখিনি। আমি তো প্রায়ই এখানে হাইকারদের নিয়ে আসি।’ সাইনটার দিকে কাছিয়ে গেল জ্যাক। ‘পেরেকটা নতুন,’ বলল। ‘দেখো, এখনও মরচে ধরার সময় পায়নি।’

‘দেখে মনে হচ্ছে রক্ত দিয়ে লেখা, বলল কিশোর।

জ্যাক একটা অক্ষর স্পর্শ করল।

‘না, লাল রং।’

‘কিন্তু কে এখানে লাগাল এটা?’ নথির প্রশ্ন।

শ্রাগ করল জ্যাক।

‘হয়তো কেউ মজা করেছে, টুরিস্টদের ভয় দেখানোর জন্যে, ‘ বলল ও। ‘গুজব শুনেছি গাঁয়ের কাছে গোরস্থানে নাকি কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।’

ঢোক গিলল মুসা।

‘খাইছে, কী ধরনের অদ্ভুত ঘটনা?’ জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু লোক শপথ করে বলছে তারা একটা জিন্দালাশ দেখেছে। জিন্দালাশ, মানে জম্বিরা ভুডু ধর্মের অংশ। এখানে কেউ ভুডু চর্চা করে কিনা জানা নেই আমার, তবে অনেকেই বিশ্বাস করে। এসো, এগোই।’ বলল জ্যাক।

ছেলেরা জ্যাককে অনুসরণ করছে, কিশোর জিন্দালাশ সম্পর্কে বলা জ্যাকের কথাগুলো উল্টেপাল্টে ভেবে দেখল। শরীর শিউরে উঠল ওর।

আরও ক’মিনিট নিঃশব্দে হাইক করল ওরা। অন্ধকারাচ্ছন্ন ট্রেইলটা চওড়া হয়ে এক আলোকিত ফাঁকা জমিতে রূপ নিল। কিনারা ঘিরে প্রায় গোটা বিশেক কুঁড়ে অর্ধবৃত্ত তৈরি করেছে। প্রতিটা কুঁড়ের একটা করে বারান্দা, বাগান, আর অগ্নিকুণ্ড রয়েছে।

কুঁড়েগুলোর দেয়াল কাঠের গুঁড়ি, ডাল-পালা আর কাদার প্রলেপ দিয়ে তৈরি। ছাদগুলো বানানো হয়েছে টিনশীট, ডাল আর চওড়া পাতা দিয়ে।

ফাঁকা জমিটার মাঝখানে বড়সড় এক বাড়ি। অন্যগুলোর চাইতে আকারে এটা প্রায় চারগুণ। কিশোর খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই অসংখ্য বসার আসন দেখতে পেল। ওর মনে হলো এটা গ্রামবাসীদের কোন ধরনের মিলনায়তন।

‘হাহ, আজব ব্যাপার,’ বলল জ্যাক। ‘কেউ এখানে নেই।’

চারধারে চাইল কিশোর। বাগানে কিংবা বারান্দায় কেউ নেই। কুঁড়েগুলোর পিছনের গাছ-গাছালি থেকে শব্দ করছে শুধু পোকা- মাকড় আর পাখিরা।

‘জিন্দালাশ হয়তো সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে,’ ফিসফিস করে বলল মুসা। কিশোরের পিঠে খোঁচা দিল।

‘ভয় পেয়ো না,’ বলল রবিন।

কিশোর জ্যাকের বাহুতে আলতো চাপড় দিল।

‘ওখানে কে যেন আছে,’ আঙুল তাক করে বলল।

লম্বা এক মহিলা এক কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার ধূসর চুল নেমে এসেছে কোমর অবধি। পরনের পোশাকটা দেখে মনে হলো বাসায় তৈরি। খালি পা।

‘হ্যালো, মির্না,’ চেঁচিয়ে বলল জ্যাক। ‘এরা কিশোর, মুসা আর রবিন। ছুটি কাটাতে এসেছে। আর সবাই কোথায়?’

মির্না নামের মহিলাটি ছেলেদের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। তার কুঁড়ের বাঁ দিকে সরু এক ট্রেইল। সেদিকে ইশারা করল। ‘ওরা সবাই ওখানে, কবরগুলো দেখছে,’ জানাল। জ্যাক তার আঙুল লক্ষ্য করে চাইল।

‘গোরস্থানে? কেন?’ প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়ল মিনা।

‘নিজে গিয়ে দেখো,’ বলল। ‘খুব খারাপ ভুডু।’ এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হেঁটে ঢুকে গেল কুঁড়ের ভিতরে।

‘কী হচ্ছে এখানে?’ প্রশ্ন করল গোয়েন্দাপ্রধান।

‘জানি না, চলো গিয়ে দেখি,’ বলল জ্যাক।

জ্যাক ছেলেদেরকে পিছনে নিয়ে মির্নার বাগানের পাশ দিয়ে পা চালাল। সূর্যালোকিত জমি ছেড়ে বনভূমির আবছায়া অন্ধকারে প্রবেশ করল ওরা।

ক’মিনিট বাদে, ছোট এক গোরস্থানে এসে পৌঁছল। পুরানো এক লোহার বেড়া ঘিরে রেখেছে ওটাকে। এক গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়া শ্যাওলা বেড়ার একাংশ ঢেকে দিয়েছে। গোরস্থানের ভিতরে জনা ত্রিশ লোক দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ চেঁচাচ্ছে। ক’জন কাঁদছে।

‘কী করছে ওরা?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘দেখি,’ বলল জ্যাক। দলটার কাছে হেঁটে গেল ও। ওকে অনুসরণ করল ছেলেরা। এক বৃদ্ধের পাশে একগাদা লাল মাটি। তার উপরে হাঁটু গেড়ে বসল জ্যাক। ওদের দু’জনের সামনে, মাটিতে গভীর দুটো গর্ত।

‘এই সপ্তাহে দুটো কবর চুরি গেছে,’ বৃদ্ধ বলল জ্যাককে। ‘আমার বউ আর আমি ভয় পাচ্ছি। ও এখানে আর থাকতে চাইছে না। বলছে জিন্দালাশের আশপাশে বাস করা সম্ভব নয়।’

তিন

জ্যাক উঠে দাঁড়াল। হাঁটু থেকে লাল মাটি ঝেড়ে ফেলল।

‘সময়টা ভাল নয়, ছেলেদেরকে বলল। ‘চলো পানির কাছে যাই।’

সরু এক ট্রেইল ধরে ওদেরকে নিয়ে চলল সে। এক উপকূলের কাছে বালিময় এক ফাঁকা জায়গায় শেষ হয়েছে ওটা।

‘লোকটা বলছিল জিন্দালাশেরা কবরগুলো লুট করেছে,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু আমি তো জানতাম জিন্দালাশের গল্প সত্যি নয়!’

‘আমি জিন্দালাশ-ফিন্দালাশ বিশ্বাস করি না,’ জ্যাক বলল। ‘এর পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে।’

‘কিন্তু কবরগুলো খুঁড়ল কে?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘জানি না,’ বলল জ্যাক।

‘কবরচোর আর ওই সাইনটা যে লাগিয়েছে সে হয়তো একই লোক,’ বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল জ্যাক।

‘হতে পারে,’ বলল। পানির দিকে একটা হাত দোলাল। ‘খুব সুন্দর সিনারি, তাই না?’

পানি নীল আর স্থির। উপকূলের ওপ্রান্তে, উঁচু-উঁচু দালান, দ্বীপের বুকে দাঁড়িয়ে আছে যেন।

‘ওই নৌকাগুলো কার?’ মুসা জিজ্ঞেস করল জ্যাককে। ক’গজ দূরে, সৈকতে কটা কাঠের নৌকা রাখা।

‘গ্রামবাসীদের,’ জ্যাক বলল। ‘ওরা মাছ আর কাঁকড়া ধরে।’

‘এটা কি আটলান্টিক মহাসাগর?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘না, গালফ অভ মেক্সিকোর একটা শাখা,’ বলল জ্যাক। কটা দ্বীপের দিকে তর্জনী তাক করল। ‘গালফ ওদিকে গিয়ে আটলান্টিকের সাথে মিশেছে, ফ্লোরিডার কাছে।’

পানির কিনারা ধরে ছেলেদের নিয়ে হাইক করল জ্যাক। অগভীর পানিতে লম্বা পায়ের নীল হেরন হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওদের ছায়া দেখলেই পালাচ্ছে ছোট ছোট মাছ। জ্যাক ছায়ায় শুয়ে থাকা এক হরিণ দেখাল।

‘কী সুন্দর এখানটা,’ বলল রবিন। ‘আর কী নির্জন!’

‘হ্যাঁ,’ বলল জ্যাক। ‘আমি এখানে জমি কিনে বাড়ি বানাতে চাই।’

প্যাক খুলে ছোট চার বোতল পানি বের করল ও। এক গুঁড়িতে বসে পানিতে চুমুক দিল ওরা, হেরনদের মাছের খোঁজে তল্লাশী চালাতে দেখল।

পানির ওপাশে, দূরের বাড়িগুলোর গায়ে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সূর্য।

‘আজ রাতে এখানে ক্যাম্প করলে কেমন হয়?’ জ্যাক জানতে চাইল। ‘আমরা ক্যাম্পফায়ারে সাপার রেঁধে নিতে পারি।’

‘খাইছে! দারুণ হবে!’ বলে উঠল মুসা।

‘নানুকে লাঞ্চের সময় জিজ্ঞেস করব,’ বলল নথি। ‘আমি জানি নানু আপত্তি করবে না!

‘বাহ! তবে তো কথাই নেই। তোমাদেরকে ড্রপ করার পর কিছু সদাইপাতি করতে হবে আমার,’ জ্যাক বলল।

পানি পানের পর, জ্যাক ওদেরকে দেখিয়ে দিল কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন পাখিদের বাসা চিনতে হয়। শিখিয়ে দিল কীভাবে পয়জন আইভি চেনা যায়। কিছু উদ্ভিদ থেকে কীভাবে চা আর ওষুধ বানায় তাও জানাল।

ঘড়ি দেখল জ্যাক।

‘তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে,’ বলল ও। ‘চলো, শহরে ফেরা যাক।’

‘আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে,’ বলল মুসা। ‘হোটেলে ফেরা পর্যন্ত টিকব কিনা কে জানে!’

হেসে উঠল কিশোর।

‘হেরনদের মত কাঁচা মাছ ধরে খেলেই পারো,’ বলল ও।

.

আধ ঘণ্টা পরে, ছেলেরা টেরেসা নানুর সঙ্গে মিলিত হলো হোটেলের বাইরের রেস্তোরাঁয়। টেরেসা নানু ব্যালকনিতে এক ছাতার নীচে বসে রাস্তার দিকে চেয়ে রয়েছেন।

‘নানু, আমরা আজকে জ্যাকের সাথে ক্যাম্পিঙে যাই?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘নিশ্চয়ই,’ নানু জবাব দিলেন। এসময় ওয়েটার এল ওদের টেবিলে।

সবাই চীযবার্গার আর লেমোনেড অর্ডার দিল। খাবারের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে টেরেসা নানুকে জিন্দালাশের সাইন আর কবরচোরদের কথা জানাল ওরা।

‘লাশ চুরি করবে কে?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘ইতিহাসে দেখা যায় মানুষ নানান কারণে কবর লুট করে, ‘ টেরেসা নানু ব্যাখ্যা করলেন। ‘কখনও সখনও ডাকাতরা লাশের সাথে কবর দেয়া মূল্যবান জিনিসপত্রের লোভে কবর খোঁড়ে। কয়েকশো বছর আগে এক বিখ্যাত পেইন্টার লাশ চুরি করত, যাতে মাস্‌ল্ আর হাড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে। সে চাইত তার পেইণ্টিং যেন একদম রিয়েল হয়।’

‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা।

কাছের এক টেবিলে, সুট-টাই পরা দু’জন লোক বরফ চা পান করছিল। কিশোর লক্ষ করল তাদের একজন ওদের টেবিলের দিকে মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছে। কিশোরের মনে হলো, লোকটা টেরেসা নানুর কথা শোনার চেষ্টা করছে।

এসময় ওয়েটার খাবার নিয়ে এল। খাওয়ার সময় ওরা কেউ আর লাশ-টাশ নিয়ে কথা বলল না।

এরপর আবার যখন কিশোর মুখ তুলে চাইল, দেখতে পেল লোক দুটো চলে গেছে।

চার

চারটের সময় হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিল ছেলেরা। ক’মিনিট বাদে উদয় হলো জ্যাকের ভ্যান।

পিছনের দরজাগুলো খুলল জ্যাক।

‘বড় দেখে একটা তাঁবু এনেছি, তোমরা তিনজনই এঁটে যাবে,’ বলল ও।

‘আপনি ঘুমোবেন কোথায়?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘এখানে,’ জ্যাক ওদেরকে গোটানো এক দড়ির দোলনা দেখাল।

ওরা সবাই ভ্যানে উঠে পড়ল। জ্যাক রাস্তায় শেষ বিকেলের ট্রাফিকের সঙ্গে যোগ দিল।

‘আমরা কোথায় ক্যাম্প করব?’ কিশোর প্রশ্ন করল। পিছনে বসেছে ও। সামনে জ্যাকের সঙ্গে মুসা আর রবিন।

‘পানির কাছে হলে কেমন হয়?’ জ্যাক বলল। ‘কাল সকালে তোমাদেরকে এলিগেটরের বাসা দেখাতে নিয়ে যাব।’

‘ওরা বাসা বাঁধে?’ বলল মুসা। ‘পাখিদের মতন?’

‘পাখিদের মতন না। মা এলিগেটর মাটিতে ডিম পেড়ে গাছ- পালা দিয়ে ঢেকে রাখে,’ ব্যাখ্যা করল জ্যাক।

ট্রেইলের মাথায় ভ্যান পার্ক করল জ্যাক। ওরা চারজনে বইল, তাঁবু, জ্যাকের দোলনা, আর দুটো ছোট ফুড কুলার।

এবার ভিন্ন এক ট্রেইল ধরে উপকূলে পৌঁছল ওরা, এবং শীঘ্রি পৌছে গেল পানির কাছের ফাঁকা জমিটায়।

‘নৌকাগুলোর কাছে সব জড় করো,’ বলল জ্যাক। ‘সন্ধ্যা লাগার আগেই তোমাদের তাঁবু খাটিয়ে ফেলব।’

মুসা উল্টানো এক নৌকার তলা দিয়ে উঁকি দিল।

‘এখানে কোন এলিগেটর নেই, ঠিক না, জ্যাক?’ প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, জায়গাটা বেশি খোলামেলা,’ বলল ও। ‘তবে প্রায়ই রাতে শিকার করে ওরা। আঁধার হয়ে গেলে পানিতে দুটো হলদে স্পট খোঁজ কোরো। এলিগেটরের চোখ আলো রিফ্লেক্ট করে, কাজেই ক্যাম্পফায়ারের আলোয় ওদের দেখা যাবে।’

জ্যাক আর ছেলেরা তাঁবু খাটাচ্ছে, ওদের ছায়া দীর্ঘতর হলো। শীঘ্রি গাছ-পালার আড়াল নিল সূর্য।

তাঁবু খাটানোর পর, দুটো গাছের মাঝখানে দোলনা টাঙাল জ্যাক। ছেলেদেরকে কটা কন্টেইনার দিল ও।

‘এগুলোতে পানি ভরো,’ বলল।

‘খাইছে! আমাদেরকে লবণ পানি খেতে হবে?’ প্রশ্ন করল মুসা। ‘না, রাত হলে ক্যাম্পফায়ার নেভানোর জন্যে পানি লাগবে,’ ব্যাখ্যা করল জ্যাক। ‘আমি বোতলে করে খাওয়ার পানি নিয়ে এসেছি।’

ছেলেরা পানির কাছে হেঁটে গেল, ওদের তাঁবু থেকে মাত্র বিশ ফীট দূরেই পানি।

মুসা ওর জগ ভরার জন্য ঝুঁকতেই, কিশোর একটা হাত রাখল ওর কাঁধে।

‘ওটা কি এলিগেটর? দুটো চোখ দেখতে পাচ্ছি!’ ফিসফিস করে বলল।

‘নাহ্, ডাল-টাল হবে,’ বলল মুসা।

রবিন যোগ দিল।

‘কিন্তু…কিন্তু ওই ডালটা তো দেখি তোমার দিকে সাঁতরে

আসছে!’

‘হা-হা, ভেরি ফানি,’’ বলল মুসা। জ্যাকের হাতে জগটা তুলে দিল।

‘ওই গাছটার পাশে পানিটা রাখো,’ বলল জ্যাক। বালির বুকে এক গর্ত খুঁড়ল। পাথর আর ভেজা বালি দিয়ে দেয়াল বানাল ওটার পাশে।

ছেলেরা এবার মরা ডাল খুঁজে পেতে সাহায্য করল ওকে। একটু পরেই ওরা আগুন ঘিরে বসে পড়ল। নাচুনে অগ্নিশিখায় প্রত্যেকের মুখের চেহারা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। কিশোর জিন্দালাশ আর এলিগেটরের কথা ভাবল। আগুনের আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসল ও।

‘ওকে, কে কে হট ডগ, লেমোনেড আর মার্শম্যালো চাও?’ প্রশ্ন করল জ্যাক।

‘আমরা সবাই!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

জ্যাক কুলার দুটো খুলে রাজ্যের খাবার বের করতে লাগল।

ছেলেরা তাদের ডগ গরম করে আগুনের পাশে বসে খাচ্ছে। ওদের যখন মার্শম্যালো খাওয়া শেষ, আকাশে তখন তারা ফুটেছে। গোল থালার মত চাঁদটা খানিক ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। গালফে টিপ-টিপ করে জ্বলছে কিছু আলো।

সবার আগে হাই তুলল কিশোর। এরপর সবাই হাই তুলতে লাগল। বালি দিয়ে জ্বলন্ত অঙ্গার ঢেকে দিল ওরা। গর্তের ভিতরে পানি ঢালল জ্যাক।

‘ঘুমিয়ে পড়ো, বলল ও। ছেলেরা গুড়ি মেরে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভিতরে।

‘তোমরা সামনের দিকে ঘুমাতে পারো,’ বলল মুসা। তাঁবুর দূরপ্রান্তে গুড়ি মেরে চলে গেল ও।

‘কেন?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘তুমি তো সব সময় দরজার কাছে ঘুমাও।’

মুসা শার্ট খুলে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করল।

‘হ্যাঁ, কিন্তু এখানে যদি এলিগেটর ঢোকে,’ বলল ও, ‘তা হলে আগে তোমাকে আর রবিনকে খাবে!’

পরে, কিশোর আচমকা উঠে বসল তাঁবুর ভিতরে। একটা শব্দে জেগে গেছে ও। কান পেতে শুনল, তারপর যিপারের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। গাছ-পালার মাঝ দিয়ে চাঁদের আলো ছায়া ফেলেছে ওদের ক্যাম্পসাইটে।

কিশোর এবার খুদে এক বাতি চলে বেড়াতে দেখল বনভূমির ভিতরে। ওর প্রথমে মনে হলো জোনাকি দেখেছে। কিন্তু ও জানে জোনাকিরা সোজাসুজি চলে না। মুসা আর রবিনকে জাগিয়ে দিল ও। দু’জনেই চোখ ঘষে, কিশোরের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে তাঁবুর মুখের কাছে বসল।

আলোটা তখনও রয়েছে ওখানে, গাছ-পালার গায়ে লাফাচ্ছে।

‘কী হতে পারে ওটা?’ ফিসফিস করে বলল রবিন।

‘ফ্ল্যাশলাইট,’ জবাব দিল কিশোর।

‘এই মাঝ রাতে কে চোরের মত ঘুরে বেড়াবে?’ মুসার প্রশ্ন।

কিশোর হাত বাড়িয়ে তাঁবুর ফ্ল্যাপটা টেনে খুলল।

‘চলো গিয়ে দেখি,’ বলল।

‘মনে হয় জ্যাককে জাগানো দরকার,’ মুসা বলল। ‘এটা সেই জিন্দালাশটা হতে পারে!’

‘আমার ধারণা জিন্দালাশেরা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে ঘোরে না,’ বলল কিশোর।

সরু এক পথ ধরে ধীর পায়ে আলোটা লক্ষ্য করে এগোল তিন গোয়েন্দা। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ। এই আলো ঢেলে দিচ্ছে তো এই আবার নেই।

ওদের চোখের সামনে দূরের আলোটা একবার উধাও হচ্ছে, তারপর আবার জ্বলে উঠছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে।

ওরা এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখানে তিনটি ট্রেইল পরস্পরকে ভেদ করে গেছে। ওরা ডানে-বাঁয়ে কিংবা সোজা যেতে পারে।

‘এখন কোনদিকে?’ রবিনের জিজ্ঞাসা।

‘মাঝখানেরটা দিয়ে গেলে মনে হয় আলোটার কাছে যাওয়া যাবে,’ বলল কিশোর।

‘খাইছে, রাস্তাটা সোজা গোরস্থানে গেছে!’ ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল মুসা।

‘আমরা মনে হয় কবরচোরকে ফলো করছি!’ ককিয়ে উঠল রবিন।

‘তাড়াতাড়ি করলে আমরা ওকে ধরতে পারব!’ বলল কিশোর। ‘আমি কাউকে ধরছি না!’ সাফ জানিয়ে দিল মুসা।

‘চলো এগোনো যাক,’ বলল কিশোর। আমরা কোন কিছু জানতে পারলে ফিরে গিয়ে জ্যাককে ডেকে তুলব। ও সেলফোনে পুলিস ডাকবে।’

ছেলেরা পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল। মুসা ঠিকই বলেছিল। ট্রেইলের শেষে, চাঁদের আলোয় কবরফলক চমকাতে দেখল কিশোর।

ছেলেরা বিশাল এক ওক গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল, গোরস্থান থেকে ত্রিশ ফীট দূরে। চাঁদের আলো বেড়া আর কবরফলকগুলো স্পর্শ করেছে। শূন্য কবরদুটোর পাশে স্তূপাকারে মাটি রাখা। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই।

‘আমি মনে হয় ভুল ভেবেছিলাম, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ‘আমি শিয়োর ছিলাম-’

হঠাৎই কিশোরের মুখে হাতচাপা দিল মুসা। কিশোর শুনতে পেল সভয়ে আঁতকে উঠল রবিন।

একটা ফাঁকা কবর আলোকিত! ছেলেরা দেখতে পেল, দুটো হাত বেরিয়ে এল, তারপর গর্তের কিনারা চেপে ধরল।

এবার একটা মাথা উদয় হলো। মানুষটা যে-ই হোক মুখে ফ্ল্যাশলাইট ধরা। আলোর রশ্মির পাগলা নাচনের মধ্য দিয়ে এক ছায়ামূর্তি নিজেকে টেনে তুলল কবর থেকে।

নিঃশব্দে মাটিতে বসে পড়ল কিশোর, মুসা আর রবিন।

পাঁচ

কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা লম্বা। পরনে কালো পোশাক। মুখটা ছায়ার আড়ালে, তবে চাঁদের আলোয় মাথার চুল রূপালী দেখাচ্ছে। লোকটাকে পরিচিত লাগল কিশোরের চোখে।

প্যান্টের পা থেকে লাল মাটি ঝাড়ল লোকটা। এবার কব্জির উপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল, ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল ঘড়িটা। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হারিয়ে গেল গাছ-গাছালির আড়ালে।

‘কে-কে ওটা?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘নিঃসন্দেহে জিন্দালাশ নয়,’ বলল রবিন। ‘জিন্দালাশ ঘড়ি পরে না। ফ্ল্যাশলাইটও সাথে রাখে না।’

‘কবরের মধ্যে কী করছিল তাই ভাবছি,’ কিশোর বলল। ‘গিয়ে দেখব নাকি?’

‘খাইছে, না!’ হিসিয়ে উঠল মুসা। ‘গোরস্থানে ছোঁক-ছোঁক করছি এ-ই অনেক। কবরে নামা সম্ভব নয়!

‘চলো, জ্যাককে গিয়ে বলি,’ বলল রবিন।

ক্যাম্পসাইটে ফিরে এল ছেলেরা। জ্যাককে দোলনায় শুয়ে থাকতে দেখে স্বস্তিবোধ করল কিশোর।

‘এখন জাগানোর দরকার নেই। সকালে বলা যাবে, কিশোর।

ছেলেরা পা টিপে টিপে জ্যাকের পাশ কাটাল, তারপর গুড়ি মেরে তাঁবুতে ঢোকার জন্য হাঁটুতে ভর দিল।

‘ইন্টারেস্টিং কিছু দেখলে?’ জ্যাক আচমকা প্রশ্ন করল। ওরা তিনজনই চমকে উঠল।

‘আপনি জেগে আছেন?’ কিশোর বলল।

দোলনায় উঠে বসল জ্যাক।

‘আমার ঘুম খুব পাতলা,’ বলল সে। ‘কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

‘আপনার সাথে কথা আছে,’ রবিন বলল। ‘গোরস্থানে একজনকে দেখেছি!’

‘তাই?’ দোলনা থেকে লাফিয়ে নামল জ্যাক। ওর পরনে কালো সোয়েট পোশাক। হাতা উপরে তুলে ঘড়ি দেখল। ‘এই মাঝরাতে গোরস্থানে কী করছিলে তোমরা?’

‘কেন জানি ঘুম ভেঙে যায় আমার,’ বলল কিশোর। ‘জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো দেখে আমরা ঠিক করি ফলো করব।’

কিশোর চেয়ে রইল জ্যাকের দিকে। গোরস্থানে একটু আগে দেখা লোকটার সঙ্গে মিল আছে জ্যাকের। দু’জনেই লম্বা, পরনে কালো পোশাক। দু’জনের চুলই সাদা এবং হাতে ঘড়ি।

‘এক লোককে কবর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি!’ মুসা বলল। ‘ওটা জিন্দালাশ ছিল না, কারণ হাতে ঘড়ি ছিল, তাই না?’ বন্ধুদের উদ্দেশে বলল শেষের কথাগুলো।

কিশোরের দৃষ্টি স্থির হলো জ্যাকের মুখের উপর। জ্যাকের উপর গুপ্তচরগিরি করেনি তো ওরা? খালি কবরে জ্যাক কী করবে?

‘আপনার কি মনে হয় লোকটা কবরচোর?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘ও কি মাটি খুঁড়ছিল?’ জ্যাক জানতে চাইল।

‘জানি না,’ বলল মুসা। ‘আমরা বেলচা-টেলচা কিছু দেখিনি।’

মুসা কিশোরের দিকে আঙুল তাক করল।

‘ও কবরে নামতে চেয়েছিল, আমি দিইনি!’

‘ঠিক করেছ,’ মুসাকে বলল জ্যাক। ‘কিন্তু আমাকে না জানিয়ে জঙ্গলে বের হওয়াটা বোকামি হয়ে গেছে। এরকম আর কোরো না, কেমন?’

মাথা ঝাঁকাল ছেলেরা।

‘ঠিক আছে, কিন্তু লোকটা কে হতে পারে?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।

জ্যাক হাত-পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসল দোলনা ঝোলানো দুটো গাছের একটায়।

‘আমার অনুমান? গ্রামের একজন লোক গোরস্থান পাহারা দিচ্ছিল। ওরা মনে হয় পাহারাদার নিয়োগ করেছে, কবরচোররা যাতে আর কবর লুট করতে না পারে,’ বলল জ্যাক।

‘কিন্তু সে কবরে নেমে কী করছিল?’ মুসা জানতে চাইল।

শ্রাগ করল জ্যাক।

‘কোন ধারণা নেই,’ স্বীকার করল ও। ‘এখন এসব বাদ দিয়ে ঘুমালে কেমন হয়?’

জ্যাক নিজেকে টেনে তুলল দোলনায়। ছেলেরা গুড়ি মেরে তাঁবুতে ঢুকল, এবং কিশোর চেইন টেনে বন্ধ করে দিল ওটা। একটু পরে, চিত হয়ে শুয়ে তাঁবুর ছাদের দিকে চেয়ে রইল ও।

কিশোর মনে করার চেষ্টা করল ফ্ল্যাশলাইট অনুসরণ করার আগে জ্যাকের দোলনার দিকে ভাল করে চেয়েছিল কিনা। ওরা যখন বেরোয় তখন জ্যাক ওখানে ছিল কিনা জানে না কিশোর।

ঢোক গিলতে চেষ্টা করল ও, কিন্তু মুখের ভিতরটা কেমন শুকনো ঠেকল। কবরচোর কি ওদের তাঁবুর ঠিক বাইরেই দোলনায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে?

সে রাতে ভাল ঘুম হলো না গোয়েন্দাপ্রধানের।

ছয়

তাঁবুর বাইরে কারও গান শুনে ঘুম ভাঙল কিশোরের। উঁকি মেরে দেখতে পেল জ্যাক কুলার দুটো খুলছে।

সূর্যের আলো পানিতে তেরছাভাবে পড়ে, গালফকে সোনা রঙে রাঙিয়েছে। সূর্যের সঙ্গে মিষ্টি গন্ধ নিয়ে একটা বাতাস এসেছে। চমৎকার এক সকাল। কিশোরের খিদে পেয়েছে।

কিশোর স্নিকার্স পরার সময়, গত রাতের কথা ভাবল। হেসে উঠল ও। কবরে যে নেমেছিল সে জ্যাক হতে পারে না। কোনভাবেই না।

কিশোর মুসা আর রবিনকে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিয়ে জাগাল, এবার ফ্ল্যাপের চেইন খুলে তাঁবু ত্যাগ করল।

জ্যাকের পরনে এখন আবার শর্টস আর টি-শার্ট।

‘অ্যাই,’ কিশোরের উদ্দেশে চেয়ে হাসল সে। ‘আমার কাছে ফল আর জুস আছে। খিদে পেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, পেট গুড়-গুড় করছে,’ বলল কিশোর।

‘আমারও!’ বলে ওদের সঙ্গে যোগ দিল মুসা। এরপর বেরিয়ে এল রবিন।

জ্যাক খাবার বয়ে নিয়ে গেল এক ফ্ল্যাট-বটম নৌকার কাছে। ওটাকে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করবে। খাওয়ার সময় সাগরের পানির দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করল ওরা।

‘দেখো,’ বলল জ্যাক, তীরের দিকে আঙুল তাক করল। পানির কিনারায় বসে এক মা কাঠবিড়ালি আর দুটো ছানা। হাত-মুখ ধুয়ে ফের গাছে ফিরে গেল ওরা।

‘এলিগেটরের বাসা কখন দেখব আমরা?’ মুসা প্রশ্ন করল।

ঘড়ি দেখল জ্যাক।

‘শীঘ্রি। তবে আগে মির্নার সাথে দেখা করব। কোন অসুবিধে নেই তো?’ প্রশ্ন করল। ‘কালকে ওকে চিন্তিত মনে হলো।’

‘অসুবিধে কীসের?’ বলল কিশোর। ‘কিন্তু তাঁবু আর এগুলো কী করব?’

‘পরে দেখব, বলল জ্যাক।

‘মিনাকে কি বলবেন কাল রাতে আমরা কী দেখেছি?’ রবিন প্রশ্ন করল।

জ্যাক ক’মুহূর্ত নীচের ঠোঁট কামড়াল।

‘আমার ধারণা মত ওটা যদি গ্রামবাসীদের কেউ হয়ে থাকে তবে মির্না জানবে,’ বলল সে। কিন্তু আমি অবশ্যই ঘটনাটা তাকে জানাব।’

ওরা এবার ছোট্ট গ্রামটার দিকে হাইক করে চলল। মির্নাকে পাওয়া গেল, বাগানের আগাছা সাফ করছিল।

জ্যাকের দিকে মুখ তুলে চাইল সে।

‘সবাই গোরস্থানে,’ বলল।

‘দেখতে এলাম তুমি কেমন আছ,’ জ্যাক বলল তাকে। বারান্দার কিনারায় বসল মির্না। পিঠ খাড়া করে হাত থেকে মাটি ঝাড়ল।

‘আমার বন্ধু বো এখান থেকে চলে যেতে চায়। লুট হওয়া একটা কবর ওর বাবার,’ জ্যাকের দিকে চকিতে চাইল ও। ‘আমিও ভয় পাচ্ছি।’

ঠিক এসময় জ্যাকের সেল ফোন বেজে উঠল।

ও জবাব দিল, শুনল, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, আমি একটু পরেই আসছি।’

‘আজকেই বাচ্চা হবে?’ কিশোর প্রশ্ন করল।

‘জানি না, তবে আমার বউ বলছে ওর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, বলল জ্যাক। ‘ডাক্তারের কাছে যেতে চায়। তোমাদেরকে হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে কোন অসুবিধে নেই তো? পরে তোমাদেরকে তুলে নেব ওই এলিগেটরের বাসা দেখার জন্যে।’

‘ওরা আমার সাথে থাকতে পারে,’ প্রস্তাব করল মির্না। ‘তুমি বউয়ের সাথে দেখা করোগে যাও। তুমি না ফেরা পর্যন্ত ওরা এখানেই থাকুক।’

‘কি, থাকবে?’ জ্যাক প্রশ্ন করল।

‘নিশ্চয়ই,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু আপনি আমার নানুকে জানিয়ে দিয়েন। পেইন্টিংয়ের সময় সাথে সেল ফোন রাখেন তিনি।’

মাথা ঝাঁকাল জ্যাক।

‘আমি ভ্যান থেকে তাঁকে ফোন করব,’ বলল।

ট্রেইল ধরে জগিং করে ফিরে চলল সে।

‘এক ঘণ্টার মধ্যে দেখা হচ্ছে!’ কাঁধের উপর দিয়ে চেঁচাল। ‘আমি বরং আগাছাগুলো সাফ করে ফেলি,’ মির্না বলল। পোশাকটা একটু তুলে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বাগানে বসল। পায়ের তলা কালো হয়ে গেছে মাটি লেগে।

‘মিনা, আপনাদের কোন লোক কি গত রাতে গোরস্থান পাহারা দিতে গিয়েছিল?’ গোয়েন্দাপ্রধানের প্রশ্ন।

মহিলা বসে পড়ল।

‘কেন জিজ্ঞেস করছ?’

‘আহ্…জ্যাক জিজ্ঞেস করত, কিন্তু ভুলে গেছে,’ বলল কিশোর।

মাথা নাড়ল মির্না।

‘আমি জানি না। আমি বাগানে কাজ করি, তোমরা না হয় চারপাশটা একটু ঘুরে দেখো,’ বলল সে।

‘যদি হারিয়ে যাই?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

‘তা হলে আমি গিয়ে তোমাদের খুঁজে নেব,’ মির্না বলল। পকেটের গভীরে হাত ভরে ফিতে লাগানো একটা হুইস্ল্ বের করল। ‘আমার নাতি-নাতনীরা এখানে বেড়াতে এলে এটা ব্যবহার করে,’ বলে হুইসলটা ঝুলিয়ে দিল মুসার গলায়।

‘আপনার নাতি-নাতনীরা এখানে থাকে না?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়ল মির্না।

‘আমার ছেলে পরিবার নিয়ে এখান থেকে চলে গেছে,’ নিজের সাদামাঠা কুঁড়ের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

এক গোছা লেটুসের ভিতর থেকে একটা আগাছা টেনে বের করল মির্না।

‘যাও, খেলা করোগে,’ বলল।

ছেলেরা মির্নার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফাঁকা জমিটার কিনারে হেঁটে এল।

‘আমি গোরস্থানে যেতে চাই,’ রবিন বলল।

‘খাইছে! কেন?’ মুসার প্রশ্ন।

‘তোমার কৌতূহল জাগছে না?’ জিজ্ঞেস করল রবিন। ‘নাকি তোমার বিশ্বাস কাল রাতে আমরা সত্যিই একটা জিন্দালাশ দেখেছি?’

‘জানি না এবং জানতে চাইও না,’ বলল মুসা। ‘ভীষণ ভয় পেয়েছি আমি।’

‘আরে, এখন তো দিনের বেলা, এত ভয়ের কী আছে? কে কবরে নেমেছিল সে ব্যাপারে আমরা হয়তো কোন ক্লু পেয়ে যেতে পারি, ‘ কিশোর বলল।

‘ঠিক আছে, যাব, কিন্তু আমাকে কবরে নামতে বোলো না!’ বলল মুসা।

গোরস্থানে যাওয়ার পথটা খুঁজে নিল ছেলেরা। ওখানে পৌছে দেখে জনা বারো গ্রামবাসী হাঁটুতে ভর দিয়ে ফাঁকা কবর দুটোর পাশে বসা। সবার মাথা নোয়ানো, এবং কারও মুখে কথা নেই।

‘ওরা মনে হয় প্রার্থনা করছে,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর 1 ‘এসো এগোই।’

লোহার বেড়া অনুসরণ করে নিঃশব্দে এগোল ওরা।

সরু আরেকটি পথের সামনে চলে এল, অপর যে পথটা মির্নার কুঁড়ের দিকে গেছে এটি তার উল্টোদিকে।

পথটায় উঁকি দিল মুসা। ওর এক হাতে মির্নার হুইসল।

‘কী আছে ওখানে?’ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল।

‘সেটাই তো জানতে চাই,’ বলল রবিন।

এক সারিতে এগোল ওরা। সবার আগে রবিন, মুসা ওর ঠিক পিছনে-এজন্য রবিন একটু পরে হঠাৎই থেমে দাঁড়ালে প্রায় ওর গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল ও।

‘কী?’ রবিনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল কিশোর।

রবিন মুখে কিছু বলল না। মাটির দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে।

এবার কিশোর আর মুসাও দেখতে পেল। ভেজা ভেজা লাল কাদার উপরে প্রকাণ্ড এক পায়ের ছাপ আবিষ্কার করেছে রবিন

‘খাইছে!’ গুঙিয়ে উঠল মুসা। ‘জিন্দালাশের পা!’

সাত

‘ওই যে দেখো, আরেকটা!’ বলে উঠল কিশোর, পথের সামনের দিকে আঙুল ইশারা করল। ‘আরও একটা!’

‘কার পায়ের ছাপ তাই ভাবছি,’ রবিন বলল। হাঁটু গেড়ে বসে একটা আঙুল রাখল ছাপের মধ্যে। ‘এগুলো পায়ের পাতার ছাপ। কবরের ওই লোকটা খালি পা ছিল কিনা মনে আছে?’

শ্রাগ করল কিশোর। ছাপের পাশে নিজের পা রাখল।

‘আমার পায়ের প্রায় দ্বিগুণ!’

‘এসো এগুলোকে ফলো করি,’ বলল রবিন।

‘খাইছে,’ প্রায় ককিয়ে উঠল মুসা। ‘তুমি পাগল নাকি?’

‘তুমি জানতে চাও না এগুলো কার ছাপ?’ কিশোর প্রশ্ন করল। ‘কবরচোরের হতে পারে!’

‘এসো,’ বলে আবারও আগে বাড়ল রবিন।

ওরা ট্রেইল ধরে হাঁটছে, মাটি গাঢ় লাল থেকে বাদামি হয়ে প্রায় কালো হয়ে এল। নরম মাটিতে পদচিহ্ন খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না ওদের।

মুসা হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। বাতাসে নেকড়ের মতন নাক উঁচু করল।

‘খাবারের গন্ধ পাচ্ছি,’ বলল ও।

‘কীসের? হট ডগের?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

মাথা নাড়ল মুসা।

‘মশলাদার কিছুর,’ বলল ও। ‘চিনির মত!

‘জঙ্গলে চিনি?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর। ‘এখানে কোথাও রেস্টুরেন্ট থাকতে পারে।’

এসময় আচমকা থমকে দাঁড়াল রবিন। ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল।

‘শশশ! শোনো!’ হিসিয়ে উঠল ও।

ক’সেকেণ্ড পরে ওরা সবাই কুঠার চালানোর শব্দ পেল। শব্দটা হয়েই চলেছে।

ওরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল। রবিন হেঁটে চলল, অন্যরা অনুসরণ করল।

আলোকিত এক ফাঁকা জমিতে গিয়ে শেষ হয়েছে ট্রেইলটা। তিন গোয়েন্দা দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক চোখে চেয়ে রইল। সামনে ছোট এক কেবিন। বাতিল জিনিসপত্র যেমন, পুরানো টিন, বেমানান বোর্ড, প্লাস্টিকের শীট, এমনকী গাড়ির জং ধরা এক হুড দিয়ে তৈরি।

বিশাল এক গাছ ছায়া দিচ্ছে বাড়িটাকে। এক ডাল থেকে ঝুলছে এক টায়ারের দোলনা। এখানে ছোট ছেলেপিলে থাকতে পারে, ভাবল কিশোর।

ওদের দিক পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ানো লম্বা এক লোক। হাতে কুঠার। মাথার চুল সাদা। পরনে লম্বা প্যান্ট আর লম্বা-হাতা শার্ট। প্যান্টের নীচে লম্বা-লম্বা পা রয়েছে অনুমান করল কিশোর।

লোকটা কুঠার মাথার উপরে তুলে নামিয়ে আনল এক গুঁড়ির উপরে। ভাঙা টুকরো দুটো তোলার জন্য ঝুঁকতেই, দেখতে পেল ছেলেরা লক্ষ করছে ওকে।

কিশোর চমকিত। ও বয়স্ক কোন লোক হবে মনে করেছিল। কিন্তু ওদের দিকে চেয়ে থাকা মুখটা মসৃণ। লোকটার চোখজোড়া বাদামি আর উষ্ণ। বয়স জ্যাকের কাছাকাছি।

‘হ্যালো,’

লোকটা বলল। কণ্ঠস্বর গভীর আর মৃদু। ‘তোমরা কি হারিয়ে গেছ?’

কিশোর মুখ খুলল।

‘না, আমরা… ঘুরে বেড়াচ্ছি,’ বলল ও।

‘কিছু খাবে? খিদে পেয়েছে?’ লম্বা লোকটা প্রশ্ন করল।

কাঠের গাদার পিছনে, গর্তের মধ্যে আগুন জ্বলছে।

অগ্নিশিখার উপরে কালো এক লোহার পাত্র চড়ানো, মশলাদার

খাবারের গন্ধে ম-ম করছে বাতাস।

‘আমরা এইমাত্র নাস্তা করে এসেছি,’ বলল রবিন। ‘তারপরও জিজ্ঞেস করেছেন বলে ধন্যবাদ, মিস্টার। ‘

‘আমার নাম বায়রন,’ লোকটি বলল।

‘আমি রবিন, আর এরা আমার বন্ধু কিশোর আর মুসা,’ বলল রবিন।

এক গাছের নীচে এক ইজেল দৃষ্টি কাড়ল কিশোরের।

‘আপনার আঁকা ছবি দেখতে পারি?’ প্রশ্ন করল ও।

‘ওকে,’ বলল বায়রন, মুখের চেহারা লাল।

ইজেলের কাছে হেঁটে গেল তিন বন্ধু। প্রাচীন এক লোহার বেড়া এঁকেছে বায়রন। বেড়ার উপরে এক গাছের ডাল থেকে ঝুলছে ধূসর স্প্যানিশ শ্যাওলা। চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে, মৃদু আভায় আলোকিত করে তুলেছে দৃশ্যটাকে। বেড়ার ওপাশটা ফাঁকা।

‘এখনও শেষ হয়নি,’ বায়রন কিশোরের পিছন থেকে বলে, চমকে দিল গোয়েন্দাপ্রধানকে।

এত লম্বা লোক এতটা নিঃশব্দে হাঁটে কীভাবে? ভাবল কিশোর।

আট

‘আপনার ছবি তো দারুণ!’ বলে উঠল রবিন। ‘আমার টেরেসা নানু ও ছবি আঁকতে ভালবাসে।’

বায়রন মৃদু হাসল। মুখের চেহারা রক্তবর্ণ। ছোট বাগানটার দিকে হেঁটে গেল।

‘তোমরা স্ট্রবেরি ভালবাস?’ প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ!’ বলল মুসা, এবং ছেলেরা বায়রনকে অনুসরণ করল। বাগানটা পরিপাটি করে সারি দিয়ে সাজানো। ছোট এক গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা এক বেলচা আর এক আঁকশি। টমেটো, লেটুস, শসা আর অচেনা কয়েক পদের সব্জী দেখতে পেল কিশোর। বাগানের এক কোনা স্ট্রবেরির চারা দিয়ে ঠাসা।

বায়রন তিন গোয়েন্দাকে ফল খেতে বলল। বাগানে সাবধানে ঢুকল ওরা। উজ্জ্বল, লাল বেরি ছিঁড়ে নিতে লাগল।

হঠাৎ ওরা হুস করে এক শব্দ শুনল, এবং প্রকাণ্ড এক পেঁচা উড়ে এল গাছ থেকে। পাখিটা বায়রনের কব্জির উপর বসে হাত থেকে একটা স্ট্রবেরি তুলে নিল।

‘এর নাম বিল,’ বলল বায়রন।

‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা। ‘দারুণ!’

বায়রন ওর বাহু বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে।

‘চাইলে আদর করতে পারো,’ সগর্বে বলল।

মুসা যখন বিলের গায়ে হাত বুলাচ্ছে, তখন রবিন কিশোরের বাহুতে খোঁচা দিল। কিশোর ওর দিকে চাইল, ক’ফীট দূরে রাখা বেলচাটার দিকে ভ্রূ দেখাল ও।

বেলচার কিনারাগুলোতে লাল কাদা মাখা।

বায়রন বিলকে বয়ে নিয়ে গেল সুপ পটের কাছে। ছেলেরা ওকে চামচে করে কিছু তুলে নিয়ে পাখিটাকে খাওয়াতে দেখল।

‘লাল মাটিটা গোরস্থানের মাটির মত!’ ফিসফিস করে বলল রবিন।

‘তাতে কী?’ আরেকটা স্ট্রবেরি তুলে নিয়ে বলল মুসা।

‘বায়রন হয়তো কবর খুঁড়ছিল,’ বলল রবিন, গলা খাটো রাখল। ‘এই বাগানের মাটি কালো, লাল নয়!’

মুখের সামনে থেমে গেল মুসার হাত। চোখ বুজে গিয়ে পরমুহূর্তে আবার খুলে গেল।

‘তার মানে…কাল রাতে কবরস্থানে হয়তো ও-ই গিয়েছিল!’

‘আস্তে!’ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। ‘আমি শিয়োর শুধু কবরস্থান নয়, এই এলাকার আশপাশেও লাল মাটি রয়েছে। কাল জ্যাকের ভ্যানের মেঝেতেও একই রঙের মাটি দেখেছি আমি।’

মুসা বায়রনের দিকে চোরা চাউনি হানল, লোকটা এখনও বিলকে খাওয়াচ্ছে।

‘কাল রাতে দেখা লোকটার মাথার চুল বায়রনের মত সাদা ছিল,’ ফিসফিস করে বলল। ‘আর ওর লম্বা লম্বা পাগুলো দেখো। গোরস্থানের কাছে যে পায়ের ছাপগুলো আমরা দেখেছি সেগুলো হয়তো ওরই।’

‘কোন প্রমাণ নেই,’ বলল কিশোর। নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল। কাল রাতে চাঁদের আলোয় দেখা জ্যাকের কথা মনে পড়ল ওর। জ্যাকের মাথার চুল সাদা দেখাচ্ছিল, ঠিক গোরস্থানের রহস্যমানবটির মত।

‘আমি অন্য চিন্তা করছি,’ শান্ত কণ্ঠে যোগ করল কিশোর।

ঠিক এসময় বায়রন মুখ তুলে চেয়ে ওদের উদ্দেশে হাসল।

‘আমার টায়ারে দোল খাবে?’ প্রশ্ন করল।

‘ন-না, ধন্যবাদ,’ রবিন বলল। ‘আমাদের ফিরতে হবে।’

বায়রন বিলকে ছুঁড়ে দিল বাতাসে এবং ওটা গাছ-পালার আড়ালে উধাও হয়ে গেল। এবার বায়রন ছেলেদের দিকে হেঁটে এসে পেল্লায় একটা হাত বাড়িয়ে দিল।

‘তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগল,’ বলল সে।

কিশোর বায়রনের হাত ঝাঁকিয়ে দিল।

‘আমাদেরও ভাল লেগেছে,’ বলল ও।

ট্রেইলের দিকে পা বাড়াল ওরা। বায়রন আর ওর কেবিন চোখের আড়াল হতেই দৌড় শুরু করল তিনজনে। পাঁচ মিনিট বাদে, থমকে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল মির্নার ছোট্ট কুঁড়ের সামনে।

মির্না বারান্দায় বসে শর্টস ও টি-শার্ট পরা এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল।

‘ভাল লাগল তোমাদের?’ প্রশ্ন করল মির্না।

‘হ্যাঁ!’ বলল মুসা। ‘বায়রন নামে লম্বা এক লোক আর তার পেঁচার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের।’

‘উনি আমাদেরকে ওঁর আঁকা পেইন্টিং দেখিয়েছেন,’ বলল রবিন। ‘উনি খুব ভাল আঁকেন।’

মাথা ঝাঁকাল মির্না।

‘প্রকৃতি থেকে রং তৈরি করে বায়রন,’ বলল। ‘বেরি জড় করে, শিকড় খোঁড়ে, যা পায় আরকী। ওগুলোকে মিশিয়ে আলাদা আলাদা রং তৈরি করে।’

মির্না মহিলার সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দিল

‘লুসি জ্যাকের বন্ধু,’ বলল। ‘ও তোমাদেরকে গাড়িতে করে হোটেলে পৌঁছে দেবে।’

লুসি ছেলেদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।

‘জ্যাক ওর বউয়ের কাছে হাসপাতালে,’ জানাল। ‘মনে হচ্ছে বাচ্চাটা আজকেই হবে।’

মির্নাকে বিদায় জানিয়ে লুসিকে ট্রেইল ধরে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা। খানিক দূর যেতেই এক লোককে ওদের দিকে আসতে দেখল। গাঁয়ের দিকে হন্তদন্ত হয়ে আসছে সে।

লুসি আর ছেলেদের দেখে থমকে দাঁড়াল লোকটা। তার মুখের চেহারা ঘর্মাক্ত আর লাল।

‘এপথ দিয়ে কি গ্রামে যাওয়া যায়?’ প্রশ্ন করল।

লোকটির মাথায় স্ট্র হ্যাট, পরনে ড্রেসি প্যান্ট আর স্ট্রাইপড শার্ট। তার ব্রিফকেস আর চকচকে কালো জুতো জঙ্গলে বেমানান দেখাচ্ছে।

হ্যাট পরে থাকা সত্ত্বেও লোকটিকে ঠিকই চিনতে পারল কিশোর। গতকাল হোটেলের রেস্তোরাঁয় ওদের কাছাকাছি বসেছিল সে। জঙ্গলে কী করছে লোকটা?

‘হ্যাঁ, সোজা চলে যান পাঁচ মিনিট,’ বলল লুসি। এবার যোগ করল, ‘কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ,’ বলে হনহন করে পা চালাল লোকটা।

‘আজব তো,’ লোকটা চলে গেলে বলল লুসি। খলখল করে হাসল। ‘লোকটা সেলসম্যান হলে কিছু বিক্রি করতে জান কাবার হয়ে যাবে ওর!’

হেঁটে চলল ওরা। জিন্দালাশের চিহ্নটা পেরোনোর সময় কিশোর লুসিকে ওটার কথা জিজ্ঞেস করল।

‘আমার কোন ধারণা নেই এর মানে কী, কিংবা কে এটা এখানে পুঁতেছে,’ বলল লুসি।

‘জ্যাকের ধারণা কেউ ঠাট্টা করেছে,’ বলল নথি।

‘ব্যাপারটা মজার নয়,’ বলল লুসি। ‘এখানে যারা বাস করে তাদের অনেকেই জিন্দালাশে বিশ্বাস করে।’

নয়

লুসি ছেলেদেরকে নামিয়ে দিলে, ওরা হোটেলে ঢুকে পড়ল।

‘বায়রনের ব্যাপারে কী করব আমরা?’ মুসার প্রশ্ন। ‘ আমার ধারণা ও ওই কবরগুলো খুঁড়েছে, এবং কাল রাতে গোরস্থানে আমরা মনে হয় ওকেই দেখেছি!’

‘চলো উপরে গিয়ে কথা বলি,’ শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।

এলিভেটরে চড়ল ওরা। ওদের তলায় ওঠার পর, রবিন নানুর সঙ্গে যে রূমটায় থাকছে সেটার তালা খুলল।

‘আমার যা ধারণা তা হলো এই,’ কার্পেটে বসে বলল কিশোর। ‘কাল রাতে গোরস্থানে আমরা যে লোকটাকে দেখেছি সে হয়তো কবর দুটো খুঁড়েছে, কিন্তু শিয়োর তো হতে পারছি না।’

মুসা আর রবিন ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়ল।

‘আমরা এ-ও জানি না যাকে দেখেছি সে বায়রন কিনা,’ বলে চলল কিশোর।

‘আমার ধারণা বায়রন। আর কে হবে?’ বলল মুসা।

‘যদি জ্যাক হয়?’ কিশোর জবাব চাইল। ‘ও লম্বা এবং ওর মাথার চুল গোরস্থানের লোকটার মত সাদা।’

‘জ্যাক? কিন্তু ও তো দোলনায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল,’ বলল নথি।

‘আমরা যখন বেরোই তখন কি ওকে দেখেছিলাম?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল। ‘আমরা যখন ঘুমিয়ে ও হয়তো তখন গোরস্থানে গেছিল এবং আমাদের আগে হয়তো ক্যাম্পসাইটে ফিরে এসেছে।’

মুসা মাথা নাড়ল।

‘জ্যাক কবরে নামতে যাবে কেন?’ জিজ্ঞেস করল।

‘জানি না,’ বলল কিশোর। ‘তবে বায়রন কেন নামবে তাও জানি না।’

‘সাদা চুলের আরেকজনের কথা মনে পড়ছে আমার,’ বলল রবিন।

কিশোর আর মুসা ওর দিকে চাইল।

‘লুসির সাথে থাকার সময় ট্রেইলে যাকে দেখেছি,’ বলল রবিন। ‘মাথায় হ্যাট ছিল, কিন্তু মাথার চুল অনেকটা ধূসর সাদাটে।’

‘আরও একটা ব্যাপার আছে,’ কিশোর বলল। ‘কালকে আমরা যখন টেরেসা নানুর সঙ্গে বসে লাঞ্চ করছিলাম তখন ও আর আরেকজন লোক রেস্টুরেন্টে বসে ছিল!’

‘তো?’ বলল মুসা।

‘আমরা যখন জিন্দালাশ নিয়ে কথা বলছিলাম তখন ওদেরকে খুব আগ্রহী দেখাচ্ছিল,’ বলল কিশোর।

হেসে উঠল মুসা।

‘জিন্দালাশের কথায় সবাই আগ্রহী হবে।’

ঠিক এসময় ছেলেরা হলওয়ে থেকে মৃদু এক থপ শব্দ শুনতে . পেল। জমে গেল ওরা। ডোরনবের দিকে চেয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুরছে ওটা।

দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল এবং টেরেসা নানু ভিতরে পা রাখলেন।

‘কী ব্যাপার রে?’ পেইন্ট বক্স রেখে প্রশ্ন করলেন তিনি। ‘ভূত দেখেছিস নাকি?’

‘নানু, তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছ!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘আমি? আমি নিরীহ এক বুড়োমানুষ! তো জ্যাকের সাথে রাত কেমন কাটল?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘দারুণ, নানু,’ বলল রবিন। ‘আমরা জানার চেষ্টা করছি কবরগুলো কে লুট করল।’

টেরেসা নানু বিছানায় বসে পা ঝাড়া দিয়ে স্যাণ্ডেল খুললেন।

‘আমি কি কোন সাহায্য করতে পারি?’ প্রশ্ন করলেন।

রবিন টেরেসা নানুকে রাতে গোরস্থানে যাওয়া এবং এক লোককে

কবর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখার কথা খুলে জানাল।

‘বলিস কী! জ্যাক জানে?’ বললেন নানু।

‘হ্যাঁ,’ জানাল কিশোর। ‘ও বলল গাঁয়ের কোন পাহারাদার হবে হয়তো।’

‘কিশোরের ধারণা লোকটা জ্যাক,’ বলল মুসা।

‘আমি বলিনি ওটা জ্যাক,’ বলল কিশোর। ‘বলেছি হতে পারে। গোরস্থানের লোকটা লম্বা ছিল, মাথায় সাদা চুল, গায়ে কালো কাপড়। ঠিক জ্যাকের মতন।’

‘এবং ঠিক বায়রনের মত,’ বলল মুসা।

মুসার দিকে চাইলেন টেরেসা নানু।

‘এই বায়রনটা কে?’ প্রশ্ন করলেন।

‘জ্যাক আজ সকালে ওর বউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার সাথে দেখা হয় আমাদের,’ বলল রবিন।

‘হ্যাঁ, জ্যাক আমাকে ফোন করে জানায় তোরা গাঁয়ে মিনা স্যাঞ্চেজ নামে এক মহিলার কাছে থাকবি,’ ওর নানু বললেন। কিন্তু তোরা ঠিক করিস গোরস্থানটা দেখতে যাবি, তাই না?’

‘আমরা সূত্র খুঁজতে চেয়েছিলাম,’ বলল রবিন। কিন্তু গাঁয়ের লোকজন সব ভিড় করে ছিল ওখানে, তাই আমরা কিছু পায়ের ছাপ ফলো করি। ওগুলো আমাদেরকে জঙ্গলের মধ্যে এক কেবিনের কাছে নিয়ে যায়। ওখানে আমরা বায়রন আর ওর পেঁচার দেখা পাই।’

‘আমার মনে হয় আমরা বায়রনকেই গোরস্থানে দেখেছিলাম, ‘ বাধা দিয়ে বলল মুসা। ‘ও মনে হয় কফিনগুলো চুরি করেছে, কারণ গোরস্থানের মত লাল মাটি লেগে ছিল ওর বেলচায়!’

সবশেষে, রবিন পথে দেখা হওয়া লোকটার কথা জানাল ওর নানুকে।

‘ওই লোকটা হতে পারে,’ বলল ও। ‘ওর মাথার চুলও সাদা, এবং লোকটাকে গ্রামের ব্যাপারে খুব আগ্রহী দেখাল।’

কিশোর উল্লেখ করল একটা লোক গতকাল ওদের কাছাকাছি বসে লাঞ্চ করছিল।

‘আমার ধারণা আমরা কী বলি শোনার চেষ্টা করছিল,’ বলল ও। ‘যাকগে। তোমরা তিনজন লোকের কথা বলেছ যারা লম্বা এবং যাদের মাথার চুল সাদা,’ টেরেসা নানু বললেন। ‘তাদের একজন গত রাতে দেখা তোমাদের সেই লোকটা হতে পারে। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না ওই গোরস্থানে ওদের কারও এত আগ্রহ কীসের।’

‘আমার এই মাত্র একটা কথা মনে হলো,’ বলল কিশোর। ‘আমরা যখন জ্যাকের সাথে হেঁটে পানির কাছে যাই তখন ও বলেছিল ও ওখানকার একটুকরো জমি কিনতে চায়।’

সবার দৃষ্টি কিশোরের উপর স্থির।

‘জ্যাক নিজেই যদি সাইনটা লাগিয়ে থাকে আর কবর খুঁড়ে গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে?’ কথার খেই ধরল কিশোর। ‘ওরা ভয় পেয়ে চলে গেলে ও হয়তো সস্তায় ওদের জমি কিনতে পারবে।

দশ

‘আমার এখনও ধারণা কাজটা বায়রনের,’ বলল মুসা। তিনটে আঙুল তুলল ও। ‘এক, ওর বেলচায় লাল মাটি। দুই, বিশাল পায়ের ছাপগুলো হয়তো ওর। তিন, ও একজন পেইন্টার, কাজেই ও হয়তো ওই সাইনটা এঁকে থাকতে পারে।’

‘বায়রন ছবি আঁকে?’ টেরেসা নানু প্রশ্ন করলেন।

‘আমরা একটা মাত্র ছবি দেখেছি,’ বলল রবিন, ‘তবে কাজটা প্রশংসা করার মত।’

টেরেসা নানু স্যাণ্ডেলের দিকে হাত বাড়ালেন।

‘জ্যাক কবর চুরির সাথে জড়িত ভাবতে পারছি না আমি, ‘ বললেন তিনি। ‘কিন্তু আমি এই বায়রনের সাথে দেখা করতে চাই!’

হোটেলের সামনে এক ট্যাক্সি থামাল ওরা। কিশোর ড্রাইভারকে বলল ওরা ওল্ড ফরেস্ট ট্রেইলে যেতে চায়।

‘বসো!’ বলল মহিলা ড্রাইভার, শেষ বিকেলের যানবাহনের ভিড় ভেদ করে মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল ট্যাক্সি।

দশ মিনিট বাদে, টেরেসা নানু ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন।

‘আমাদেরকে এক ঘণ্টা পর তুলে নিতে পারবেন?’ প্রশ্ন করলেন।

‘নিশ্চয়ই,’ জানাল ড্রাইভার। হাত নেড়ে চলে গেল।

টেরেসা নানু সামনের অন্ধকার, ঘন বনভূমির দিকে চাইলেন।

‘তোরা শিয়োর এখানে ট্রেইল আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন।

মুসা তাঁকে প্লাকটা দেখাল।

‘সাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না!’ সাহসের সঙ্গে বলল।

‘তুমি না বললে সাপের কথা মাথাতেই আসত না!’ টেরেসা নানু বললেন।

এবার ট্রেইল হাইক করার সময় সবার সামনে থাকল মুসা। জিন্দালাশের সাইনটার সামনে এসে থেমে দাঁড়াল ওরা।

‘ব্যাপারটা অদ্ভুত,’ টেরেসা নানু বললেন। ‘কেউ একজন চায় লোকে ভাবুক এখানে জিন্দালাশ আছে।’

‘কাজটা যে কবর খুঁড়েছে তারই!’ বলল রবিন।

মাথা ঝাঁকালেন টেরেসা নানু।

‘আমারও তাই মনে হয়।’

ওরা হাইক করে শীঘ্রি মির্নার গাঁয়ে পৌঁছে গেল। আশপাশে কাউকে দেখতে পেল না ওরা।

‘দেখো, ওরা সবাই বড় কুঁড়েটায়,’ বলল কিশোর। তর্জনী তাক করল সবচাইতে বড় বাসাটার দিকে।

দরজাটা খোলা। বেঞ্চিতে লোকজনকে বসে থাকতে দেখা গেল। কে যেন জোরাল গলায় কথা বলছে।

‘ওরা মনে হয় মীটিং করছে,’ বলল রবিন। ‘হয়তো খোঁড়া কবরগুলো নিয়ে কথা বলছে।’

‘বায়রনের কেবিন কি এখান থেকে অনেক দূরে?’ টেরেসা নানু জানতে চাইলেন।

‘না,’ বলে আঙুল নির্দেশ করল কিশোর। ‘ওই ট্রেইলটা চলে গেছে গোরস্থানের দিকে, তারপর ছোট এক পথ ধরলে বায়রনের কুটির।’

তিন বন্ধু টেরেসা নানুকে ট্রেইল ধরে নিয়ে চলল। ছোট্ট গোরস্থানটার কাছে থামল তারা।

‘কবরগুলো খুঁড়তে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে,’ মন্তব্য করলেন টেরেসা নানু, ফাঁকা গর্ত দুটোর পাশে লাল মাটির স্তূপ-সেদিকে ইঙ্গিত করলেন।

‘দেখো, নানু, বায়রনের বেলচায় আমরা এই একই মাটি দেখেছি,’ বলল নথি।

‘হ্যাঁ, তবে আমার ধারণা লাল মাটি অন্যখানেও পাওয়া যায়,’ টেরেসা নানু বললেন।

হেঁটে চলল ওরা। ক’মিনিট বাদে বায়রনের কেবিনের পিছনে গাছ-পালার জটলায় থেমে দাঁড়াল সবাই।

‘ওরা কোথায়?’ ফিসফিস করে বলল রবিন। উঁকি দিল এক গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে।

‘ওর দরজায় গিয়ে টোকা দিলেই তো হয়,’ ওর নানু বললেন।

খিলখিল করে হেসে উঠল মুসা।

‘ওর ঘরে দরজা আছে কিনা কে জানে,’ বলল।

‘এসো,’ বলল কিশোর। সূর্যালোকে পা রাখল। কেবিন ঘুরে এগোল ওরা চারজন।

হাতে ব্রাশ নিয়ে ইযেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বায়রন। ইয়েলের ট্রেতে ছোট ছোট রঙের জার সারি দিয়ে রাখা।

‘হাই, বায়রন,’ বলল কিশোর।

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল বায়রন। ওর চিবুকে সাদা রঙের ফোঁটা লেগে রয়েছে। ছেলেদেরকে দেখে মুখে চওড়া হাসি ফুটল।

‘ইনি আমার টেরেসা নানু,’ রবিন জানাল বায়রনকে।

বায়রন একটা কাপড় তুলে নিল রং মোছার জন্য। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’

‘আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি,’ উষ্ণ হেসে বললেন টেরেসা নানু। ‘আপনার পেইন্টিংটা দেখতে পারি?’

লজ্জা পেল বায়রন।

‘বাসায় আরও ভাল ভাল ছবি আছে,’ জানাল।

ওরা সবাই বায়রনের ছবিগুলো দেখল। আজ সকালের পর থেকে বায়রন আরও কিছু যোগ করেছে। বেড়ার ভিতরে কবরফলক এঁকেছে ও। কিশোর এবার লোহার বেড়াটাকে চিনতে পারল।

ওটা গোরস্থানের বেড়া।

‘আপনি দারুণ ছবি আঁকেন,’ টেরেসা নানু বললেন বায়রনকে।

‘এটা গোরস্থান, তাই না?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল বায়রনকে।

 লম্বা লোকটি সায় জানাল।

‘আমার ওখানে ভাল লাগে,’ বলল।

‘প্রায়ই যান নাকি ওখানে?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘বিল রাতের বেলা ইঁদুর ধরে,’ বায়রন বলল। ‘আমি কখনও কখনও ওর সাথে যাই। গোরস্থানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। কী শান্ত জায়গাটা! খুব ভাল লাগে।’

‘কাউকে কখনও গোরস্থানে খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেখেছেন?’ কিশোর জানতে চাইল।

হঠাৎই মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল বায়রনের। ব্রাশটা নামিয়ে রাখল সে।

‘আমি ওটা চুরি করিনি,’ বলল ও।

‘কী?’ প্রশ্ন করল রবিন।

বায়রন কেবিনে গিয়ে ঢুকল এবং একটু পরে হাতে কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে এল। ওটা পুরুষদের চামড়ার ওয়ালেট।

‘গত সপ্তাহে গোরস্থানের পাশে বসে ছিলাম। আঁধারে শিকার করছিল বিল,’ বায়রন বলল। ‘দুটো লোক এসে কবর খুঁড়ল। কফিনগুলো বয়ে নিয়ে গেল তারা। ওরা চলে যাওয়ার পর মাটিতে এটা কুড়িয়ে পাই আমি। ওরা ফিরবে মনে করে রেখে দিয়েছি, কিন্তু ওরা আর আসেনি।’

‘খাইছে! তারমানে গত রাতে লোকটা গোরস্থানে তার ওয়ালেট খুঁজছিল!’ বলে উঠল মুসা।

টেরেসা নানু ওয়ালেটটা নিয়ে ভিতরে চাইলেন।

‘বাহ্, বিজনেস কার্ডে লোকটার ছবিও আছে দেখছি,’ বললেন। সাদা কার্ডটার দিকে চাইল ছেলেরা।

জে ফ্রিস্ক নামটা কালো, বড় হরফে লেখা। নামের নীচে লেখা: ল্যাণ্ড ডেভেলপার। সঙ্গে ফোন নম্বর আর ই-মেইল ঠিকানাও রয়েছে।

নামের পাশে ছোট্ট এক ছবি। যে লোকটিকে ওরা পথে অতিক্রম করেছিল তার।

‘বুঝেছি,’ বলল কিশোর। ‘এই লোকটা কবর খুঁড়ে গ্রামবাসীদের ভয় দেখাতে চেয়েছে, তারা যাতে জমি বেচে দেয়!’

‘এবার সব কিছু খাপে খাপে মিলে গেল!’ মুসা বলল। ‘এই ফ্রিস্ক লোকটাই জিন্দালাশ! ও-ই সম্ভবত সাইনটা বসিয়েছে!’

‘এখন কী করা?’ কিশোরের প্রশ্ন।

টেরেসা নানু ঝট করে সেল ফোনটা বের করলেন। ইনফর্মেশনে ডায়াল করে বললেন, ‘নিউ অর্লিয়েন্স পুলিস ডিপার্টমেণ্ট, প্লিজ।’

এগারো

পরদিন সকালে, নাস্তার পর ছেলেদের তুলে নিল জ্যাক। রবিন আজকে গোলাপী পোশাক পরেছে।

‘দেখে মনে হচ্ছে সূর্য উঠছে,’ জ্যাক বলল ওকে।

‘ধন্যবাদ, জ্যাক,’ রবিন বলল। ‘তোমার বাচ্চা জন্মেছে?’

‘হ্যাঁ!’ গর্বিত বাবা বলল। ‘ছোট্ট সুন্দর এক মেয়ে। রবিনা আর ওর মা এখন ঘুমোচ্ছে, কাজেই আমরা এখন এলিগেটরের বাসা দেখতে যাব।’

আধ ঘণ্টা পরে, পানির কাছে ঝোপটার মধ্যে ঝুঁকে বসে থাকতে দেখা গেল তিন গোয়েন্দাকে। জ্যাক বিনকিউলার নিয়ে এসেছে, এবং ওরা পালা করে মা এলিগেটরকে দেখছে।

লম্বা নাকটা বাসার দিকে তাক করে আধো পানিতে শুয়ে রয়েছে ওটা। গেটরটার রুক্ষ চামড়া কালচে-সবুজ, ট্রাকের টায়ারের মত এবড়োখেবড়ো।

‘কোন বাচ্চা তো দেখছি না,’ ফিসফিস করে বলল মুসা।

‘এখনও ডিম ফোটেনি,’ বলল জ্যাক, গাছ-পালার দিকে তর্জনী নির্দেশ করল। ‘ওই স্তূপটা ওর বাসা। ডিমগুলো ভিতরে লুকানো আছে।’

‘ও বাসায় বসে তা দিচ্ছে না কেন?’ প্রশ্ন করল রবিন। ‘ডিমগুলো তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’

‘পচা গাছ-পালা ডিমগুলোকে গরম রাখে,’ ব্যাখ্যা করল জ্যাক। ‘মা গেটর পানির দিকে লক্ষ রাখছে যদি কোন খাবার সাঁতরে যায়।’

অতিকায় মা গেটর কাঠের গুঁড়ির মত নিথর পড়ে রয়েছে। মুখ সামান্য খোলা, মাঝে মধ্যে চোখ পিটপিট করছে।

‘কবরগুলো কে চুরি করেছে সেটা বের করে কাজের কাজ করেছ তোমরা,’ বলল জ্যাক। ‘গাঁবাসী কফিনগুলো আবার কবর দিয়েছে এবং অনুষ্ঠানটা উদ্‌যাপন করেছে। পুলিসরা দুই ডেভেলপারকে ধরেছে জেরা করার জন্যে। ওরা আর মানুষকে ভয় দেখাতে পারবে না।’

‘আপনার কি ধারণা গ্রামবাসী তাদের জমি বেচবে?’ কিশোর প্রশ্ন করল।

‘শেষ পর্যন্ত হয়তো বেচত,’ জ্যাক বলল। ‘লুট হওয়া কবরগুলো যদি ওদেরকে ভয় দেখাতে না পারত তবে বদমাশরা হয়তো অন্য রাস্তা ধরত। ওরা লোভী লোক। এখানে হাইরাইজ বানাতে চেয়েছিল।’

‘বায়রন যদি ওর পেঁচাকে নিয়ে বের না হত তা হলে লোকগুলোকে দেখতে পেত না,’ বলল মুসা। ‘কিংবা ওই ওয়ালেটটাও খুঁজে পেত না।’

মৃদু হাসল জ্যাক।

‘বায়রন মির্নাকে বলেছে ওর বাবা-মা ওকে আট বছর বয়সে ত্যাগ করার পর থেকেই একা ও। কখনও স্কুলে যায়নি, জঙ্গলেই বেড়ে উঠেছে। মির্নার কুঁড়ের কাছে মিনা আর গ্রামবাসীরা ওকে একটা কুঁড়ে বানিয়ে দিচ্ছে। ও এখন থেকে ওদের সাথে থাকবে।’

‘বায়রন আমার নানুকে ওর একটা পেইন্টিং উপহার দিয়েছে, ‘ বলল রবিন। ‘নানু ওটা এক আর্ট গ্যালারির মালিককে দেখিয়েছে। উনি বলেছেন বায়রন নাকি ছবি বেচে লালে লাল হয়ে যাবে!’

ঠোঁটে আঙুল রাখল জ্যাক।

‘শোনো,’ ফিসফিস করে বলল।

বাসা থেকে চড়া, কর্কশ ডাক আসছে শুনতে পেল ওরা।

‘এবার দেখো,’ বলল জ্যাক।

মা এলিগেটর স্তূপের দিকে সরে যাচ্ছে। ওখানে পৌছনোর পর গাছ-পালার সবচাইতে উঁচু স্তরটা আঁচড়ে সরিয়ে দিল।

পঁচিশ-ত্রিশটা সবুজ-হলুদ এলিগেটর তাদের ডিম ফুটে বেরিয়ে আসছে। নিজেদেরকে কিলবিল করে মুক্ত করার পর, এঁকেবেঁকে মার দিকে এগোল ওরা।

‘ভাল করে দেখো,’ আস্তে করে বলল জ্যাক।

মা এলিগেটর মাটিতে শরীর পেতে দিয়ে মুখ হাঁ করল। ছানাগুলো হাঁচড়েপাঁচড়ে তার নীচের চোয়াল গলে ঢুকে পড়ল সোজা মুখের ভিতরে!

‘খাইছে, খেয়ে ফেলবে নাকি?’ মুসার প্রশ্ন।

হেসে উঠল জ্যাক।

‘না, এভাবেই এলিগেটর আর কুমীররা তাদের বাচ্চাদের রক্ষা করে,’ বলল ও। ‘মার মুখের ভেতরে ওরা নিরাপদ।’

‘কীসের থেকে রক্ষা করে?’ নিজের পালা এলে বিনকিউলারে চোখ রেখে বলল রবিন।

‘এলিগেটরের ছানা খাওয়ার মত অনেক শত্রু আছে,’ বলল জ্যাক। ‘রেকুন, পোসাম, হেরন, আরও অনেক। মা যখন ভাববে এখন নিরাপদ, তখন মুখ হাঁ করে ছানাদের বের করে দেবে।’

ওরা চারজন নিঃশব্দে পিছু হটে ট্রেইলের দিকে পা বাড়াল।

‘উম, লাঞ্চের কথা শুনে আমার খিদে পেয়ে গেছে,’ হাইক করার সময় বলল মুসা।

‘মুসা, কেউ লাঞ্চের কথা বলেনি,’ বলল কিশোর। দাঁত বের করে হাসল মুসা। ‘এই তো বললে!’ বলে উঠল ও।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *