আমাজনের ভয়ঙ্কর!

ইমতিয়াজ মাহমুদ রচিত ‘সবুজ আতঙ্ক’ কাহিনিটি তিন গোয়েন্দা সিরিজে রূপান্তর করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব।
তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৮/২ – আমাজনের ভয়ঙ্কর! – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

এক

এ কাহিনি তখনকার, যখন মুসা ভূত ছাড়া আর কিছুকে একটুও পাত্তা দিত না।

.

‘আর কতদূর, আণ্টি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।

‘হ্যাঁ, আর কতদূর, আম্মু?’ একই প্রশ্ন ফায়েজারও।

‘এই তো এসে পড়েছি,’ জবাব দিলেন শাহানা। গভীর মনোযোগে স্পিড-বোট চালাচ্ছেন তিনি।

‘একদম একা হয়ে যাব আমরা!’ বলল মুসা। ‘সত্যিই দারুণ হবে!’

সায় দিল ফায়েজা, ‘সত্যিই তা-ই।’ কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো একটু যেন দ্বিধায় পড়েছে।

ঝিরঝিরে বাতাস। সে হাওয়ায় দুলছে বিশাল আমাজনের জল। ঘোলাটে পানির নীচে রয়েছে মানুষখেকো কুমির আর পিরানহার ঝাঁক, ভাবলে যে-কারও গলা শুকিয়ে আসবে। ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে চলেছে স্পিড-বোট।

বোটে মানুষ বলতে তিনজন আরোহী – প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী শাহানা আক্তার, তাঁর মেয়ে পাঁচ বছরের পিচ্চি ফায়েজা তাবাস্সুম ও বড় বোনের ছেলে, মুসা আমান।

বোটে আরও রয়েছে কিলার, বিশাল এক অ্যালসেশিয়ান। পাটাতনে আরাম করে বসে এদিক-ওদিক দেখছে ও, ফায়েজার কোলে থুতনি রেখে মাঝে মাঝে ‘হাউফ্’ বলে মনোযোগ আকর্ষণ করছে।

দেখতে দেখতে ম্যানুয়াস শহর পিছনে পড়ে গেল। চারপাশে সবুজ বাঁকা রেখা। ওটাই ভয়ঙ্কর আমাজন জঙ্গল। স্পিড-বোট ওদিকে চলেছে। শাহানা আক্তার লস অ্যাঞ্জেলেস ইউনিভার্সিটির একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেণ্ট নিয়ে আমাজনে এসেছেন।

এ সুযোগে তাঁর সঙ্গে জুটে গেছে মুসা। স্কুল ছুটি। রবিন গেছে আয়ারল্যাণ্ডে আত্মীয়-বাড়ি বেড়াতে, কিশোর গেছে চাচা-চাচীর সঙ্গে বাংলাদেশে। রকি বিচে মুসা একা কী করবে? আব্বু-আম্মুও আফ্রিকায় একটা কনফারেন্সে গেছেন। বাড়িতে শুধু কাজের মেয়েটি আর ও। শেষে মুসা আণ্টিকে বলেছে, উনি যেন ওকে সঙ্গে নেন।

ছোট বোন ফোনে অনুরোধ করছে বলে মুসাকে ছেড়েছেন মিসেস রাফাত। তবে পই-পই করে বলে দিয়েছেন, ও যেন জঙ্গলে একা একা না ঘোরে।

গতকাল শাহানা আক্তার ফায়েজা ও মুসাকে নিয়ে প্লেনে করে ম্যানুয়াস এয়ারপোর্টে নেমেছেন। হোটেলে রাতটা কাটিয়ে সকালে রওনা হয়ে গেছেন আমাজন জঙ্গলের উদ্দেশে।

অধ্যাপিকা শাহানা আক্তার দু’বছর আগে বিমান দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়েছেন। তারপর মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন বিজ্ঞান- চর্চায়। বড় মেয়েটি স্কুলের হোস্টেলে থেকে, ছোটটাকে সারাক্ষণ সঙ্গেই রাখেন। ‘ স্বামীর মৃত্যুর পর এখন তাঁর বেঁচে থাকার প্রেরণা—শুধুই কাজ!

আমাজনে বিশেষ এক ধরনের ঘাস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবেন শাহানা। তিনি ধারণা করছেন ওই ঘাস দিয়ে অতি কম খরচে অত্যন্ত উন্নত মানের সার তৈরি হবে।

ব্রাজিল ও স্বদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী অনুমোদন পেয়েছেন শাহানা। এক্সপেরিমেন্ট করতে হলে যেতে হবে আমাজাদের বিশেষ এক দুর্গম অঞ্চলে। সেজন্য স্পিড-বোট চালনা শিখতে হয়েছে তাঁকে, সঙ্গে নিতে হয়েছে অস্ত্র—একটা থ্রিটু পিস্তল। এ ছাড়া বেশ কিছুদিন চলবার মত খাবার ও পানি রয়েছে বোটে।

বনের গভীরে একটা ফরেস্ট বাংলো রয়েছে, মাঝে মাঝে ওখানে ফোর্স নিয়ে অবস্থান করেন ফরেস্ট অফিসার। এখন কেবিনটা বসবাসের উপযোগী রাখবার কথা দুঃসাহসী ইয়ারুনাদের।

পনেরো দিন সেখানে কাটাবেন শাহানা।

একটা মানচিত্রে বাংলোর অবস্থান দেখানো হয়েছে, তাই ওটা বারবার দেখছেন তিনি।

একঘণ্টা পর আমাজন নদীর একটা শাখা-নদীতে ঢুকল স্পিড- বোট। ঢেউ অনেক কমে গেল। তারওপর এখন ভাটার সময়। পানির গভীরতা বেশি নয়।

একটু পর সরু হয়ে গেল শাখা-নদী, দু’দিক থেকে চেপে এল আমাজনের ঘন গাছপালা। দু’তীরে সবুজের সমারোহ। নানান সুরে ডাকছে হরেক জাতের বিচিত্র সব পাখি। গাছের ডালে ডালে অসংখ্য বানর। মুসা একবার একটা হরিণ দেখল, পানি খেতে এসে স্পিড- বোটের আওয়াজ পেয়েই পালিয়ে গেল জঙ্গলের ভিতর। কিলার পারলে বোট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিছনে ছোটে, কিন্তু মুসা ওকে ঘাড় ধরে জোর করে বসিয়ে রাখল।

এগিয়ে চলেছে স্পিড-বোট। শাহানা গতি অনেক কমিয়ে দিলেন, মানচিত্র দেখলেন। দু’পাশে কিছু খাল। ওগুলো জঙ্গলের ভিতর গিয়ে ঢুকেছে। কয়েকটা খালের মুখ পার হয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া একটা খালে ঢুকল বোট।

এ এমন এক এলাকা যেখানে লোকবসতি নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে বনের এত বিজনেও ঢোকে টাপাজো, কোয়াহিয়া আর ইয়ারুনা উপজাতির লোক। ওরা আসে গাছ কাটতে, শিকার করতে বা মধুর খোঁজে। অনেকে মারাও পড়ে জাগুয়ার বা কুমিরের আক্রমণে।

আমাজন এমন এক অরণ্য যেখানে একমুহূর্ত অসতর্ক হলে স্রেফ মৃত্যু।

ভাইয়ের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে ফায়েজা, কিলারের পিঠে হাত রেখে অবাক বিস্ময় নিয়ে চারপাশের ঘন জঙ্গল দেখছে। ভয় পেয়েছে, নইলে এতক্ষণে প্রশ্নের খই ফুটত ওর মুখে। নিশ্চয়ই ভাবছে, এখুনি হালুম করে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে মানুষখেকো জাগুয়ার। তার পর তো…

ছোট একটা ঘাটে ঠেকল স্পিড-বোট। উঠে দাঁড়ালেন শাহানা, দড়ি নিয়ে নেমে গেলেন। খুঁটির সঙ্গে বোট বেঁধে বললেন, ‘এসে পড়েছি। কাছেই আমাদের বাংলো। মুসা, মালপত্র নামাতে আমাকে সাহায্য করো। আর, ফায়েজা, চুপটি করে কিলারকে নিয়ে বসে থাকো।’

মাথা নাড়ার সুযোগও পেল না ফায়েজা, তার আগেই একটা খরগোশ দেখে বোট থেকে নেমে পড়ল কিলার, ঘেউ-ঘেউ করে তেড়ে গেল। কে ধরে কাকে! এ হলো আমাজনের অভিজ্ঞ পাখোয়াজ খরগোশ, কয়েক লাফে গিয়ে ঢুকে পড়ল গর্তে।

কিছুক্ষণ গর্তটা পাহারা দিল কিলার, তারপর লাজুক চেহারা নিয়ে ফায়েজার পাশে এসে বসল। চোখ তুলে চাইল না, যেন গভীল চিন্তায় ডুবে গেছে। ফায়েজা হাসছে দেখে কয়েকবার ঘেউ-ঘেউ করল, নিজের সম্মান ফিরে পাওয়ার চেষ্টায়।

এদিকে শাহানা আণ্টি আর মুসা মালপত্র নামাতে শুরু করেছে। কয়েকটা বড় পুটুলি নামাল মুসা। খাবার আর রাঁধবার সরঞ্জাম নামল বোট থেকে। অপ্রশস্ত একটা পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে বনের ভিতর, সেটা ধরে এগোলেন শাহানা। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল কাঠের তৈরি বাংলো। খুব বড় নয়, তবে সুন্দর। নিরাপদও মনে হলো।

কাঠের বাংলোটা অনেকগুলো খুঁটির উপর মাটি থেকে ছ’ফুট উঁচুতে তৈরি। চওড়া একটা মই বেয়ে সামনের বারান্দায় উঠতে হয়। দেখে মনে হলো মাঝে মাঝে এখানে আসেন ফরেস্ট রেঞ্জাররা। ইয়ারুনারা বাড়িটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।

এটাই আগামী পনেরো দিনের জন্য শাহানা আণ্টি, মুসা ও ফায়েজার একমাত্র আশ্রয়।

শাহানা আণ্টি ও মুসা পাঁচবার যাওয়া-আসা করল, তারপর বোট খালি হলো। চারপাশ দেখে নিলেন শাহানা। হাতের ইশারায় বললেন, এবার সবাইকে নিয়ে বাংলোয় গিয়ে উঠবেন। তাঁর সঙ্গে চলল মুসা ও ফায়েজা। পিছনে কিলার।

থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে বনে। একটা পাখিও ডাকছে না। বাঁদরগুলো হুল্লোড় করছে না। মুসা শিকারের বইয়ে পড়েছে জঙ্গলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে এমন হয়।

তেমন কিছু কি ঘটতে চলেছে?

চা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল জলাভূমি। ওখানে অগভীর পানি। সাগরে জোয়ার এলে আমাজনের এদিকে পানি বাড়ে। অসংখ্য নলখাগড়া জন্মেছে। বিপজ্জনক। কুমির থাকতে পারে ওখানে। মুসা জানে, ভয়ানক, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করবেন আন্টি। ওর দায়িত্বও কম নয়। ফায়েজার উপর চোখ রাখতে হবে। কোনও বিপদ হলে সাধ্যমত মোকাবিলা করতে হবে। তবে ভরসার কথা যে কিলার রয়েছে। দরকার পড়লে হিংস্র জাগুয়ারের সঙ্গেও লড়াই করবে। ফায়েজাকে খুব ভালবাসে কুকুরটা, ওর কোনও বিপদ হলে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

আর ও নিজে তো আছেই, ভাবল মুসা।

কিন্তু ও কি জানে কীসের মোকাবিলা করতে হবে ওকে?

জানে না, গোটা পরিবারের দায়িত্ব ওর একার কাঁধে এসে চাপবে।

দুই

‘এসে পড়েছি,’ বাংলোর প্রথম ঘরে ঢুকলেন শাহানা।

‘দারুণ জায়গা, তা-ই না?’ বলল মুসা। ‘দু’সপ্তাহ এখানে থাকছি

আমরা। দারুণ মজা হবে, তা-ই না?’

‘এই আমাজনের গভীরে মজা?’ মৃদু হাসলেন শাহানা। ‘ক’জন এই বয়সে এরকম সুযোগ পায়, আণ্টি?’

‘তা ঠিক,’ শুকনো গলায় বললেন শাহানা।

ফায়েজা বলল, ‘আম্মু, আমি ইয়ে করব।’

‘বাইরে টয়লেট পাবে,’ বললেন শাহানা। ‘একটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। নীচে গামলা থাকবে। চলো, ব্যবস্থাটা তোমাকে দেখিয়ে দিই।’

‘কমোড নেই?’ আপত্তির সুরে বলল ফায়েজা।

‘আহ্, ফায়েজা,’ বিরক্ত হলেন শাহানা। ‘এমন নাক উঁচু ভাব করে না তো।’

মনে মনে বলল মুসা, কয়টা মেয়ে আমাজনের এত গভীরে এসেছে, ফায়েজা? একবার ভাবো, কুমির আর জাগুয়ারের সঙ্গে মোলাকাত হবে!’

আণ্টি ফায়েজাকে নিয়ে বারান্দা হয়ে নেমে গেলেন। এক পাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা টয়লেট, ওখানে গিয়ে ঢুকলেন।

মুসা বাংলোর ভিতরটা ঘুরে দেখতে লাগল। সামনে ছোট একটা বারান্দা। দরজা খুললে মাঝখানে বড় একটা ঘর। ওটাই বোধহয় লিভিংরুম। আসলে ওটাই একমাত্র বড় ঘর। এ ছাড়া আছে একটা কিচেন আর ছোট দুটো বেডরুম।

লিভিংরুমে পুরানো একটা ছেঁড়া সোফা সেট। মাঝখানে একটা টেবিল। ওটার উপর হারিকেন। কারেন্টের কোনও ব্যবস্থা নেই। হাত-মুখ ধোওয়ার পানি বাইরে থেকে যোগাড় করতে হবে। নিজেদের বাড়িটার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে মুসার মনে পড়ল, এখানে ফোনও নেই। ওরা যেন এক পলকে আদিম যুগে ফিরে গেছে।

বেডরুমের জানালা দিয়ে টয়লেট দেখা যায়, ছোট আর নড়বড়ে। ঘরে একটা ছোট ড্রেসার আছে, সেখানে দু’ ভাই-বোনের কাপড় রাখার ব্যবস্থা। দু’পাশে দুটো চৌকি, তাতে একটা করে তোশক। এটাই শোবার ব্যবস্থা। মাঝখানে একটা টেবিল। তার উপর একটা মোমবাতি রাখা। সন্ধের পর আলোর ব্যবস্থা বলতে এ-ই!

মুসার মনে হলো অন্তত একশো বছর পিছনে ফিরে গেছে। ও আছে গভীর অরণ্যে, কোনও পর্তুগিজ জলদস্যুর হাতে বন্দি!

এলাকাটা সত্যিই জনমানবহীন। বনের মাঝে কুটির। জলাভূমিতে কুমির, ডাঙায় জাগুয়ার আর সাপ!

জঙ্গলের গাছগুলো দেখলে মনে হয়, কেমন যেন অন্যরকম!

বাংলোর ছাদে সূর্যের আলো পড়ে না। ওরা যে পথ দিয়ে বাংলোয় এসেছে, অন্ধকার সেখানেও থাবা পেতে আছে। জলাভূমির উপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। দুটো জায়গার আলোর তফাৎ এত বেশি যে কী রকম যেন লাগে।

শাহানা আণ্টি আসবার পথে নানান গাছের ব্যাপারে মুসাকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। জঙ্গল মুসার ভাল লাগে, কিন্তু গাছের নাম ওকে মোটেই কৌতূহলী করে না। বিশেষ করে ঘাসের কথা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। পড়া না করলে টিচাররা গরু-টরু আর ঘাস- টাস নিয়ে যা সব বলেন…

‘শোনো, মুসা,’ শেষে অন্যপথ ধরেছেন শাহানা। ‘সাধারণ গাছ বাদ যাক, কিন্তু এই ঘাস থেকে যদি উন্নত মানের সার তৈরি করতে পারি, আমাদের অনেক টাকা হবে। তখন তোমাকে একটা দারুণ ফেরারি গাড়ি কিনে দেব।’

‘সত্যিকারের?’ জানতে চেয়েছে মুসা। ‘আমার নিজের গাড়ি?’

‘নিশ্চয়ই!’ জোর দিয়ে বলেছেন শাহানা। পরমুহূর্তে আগের প্রসঙ্গে ফিরেছেন, ‘তো এই যে ঘাস, এটাতে এমন কেমিকেল আছে যে দারুণ সার হবে। অনেক ফসল ফলানো যাবে। মানুষের খাবারের অভাব দূর হবে। দুনিয়ার বিরাট উপকার, বুঝলে তো?’

দুনিয়ার উপকার, কথাটা মুসার ভাল লেগেছে। জিজ্ঞেস করেছে, ‘বিশেষ ঘাস আপনি পাবেন কোথায়? কোথায় জন্মেছে সে ঘাস?’

‘এখানেই, আশপাশেই। এই জলাভূমিতে ওই ঘাস পাব আশা করছি। যদি পাই, গোটা আমাজনের চেহারা পাল্টে যাবে। ঘাসের চাষ করবে তখন মানুষ। এই এলাকা আর বিরান পড়ে থাকবে না। লোকজন মেশিনপত্র নিয়ে আসবে, ঘাস কাটা হবে, আবার চাষও চলবে।’

‘তাতে এই এলাকা নষ্ট হয়ে যাবে না? মেশিন আমাজনের ক্ষতি করবে না?’

‘বড় ধরনের কোনও ক্ষতি হবে না তাতে। এটা বিরাট বড় অঞ্চল, কিন্তু ক্ষতি একেবারে হবে না, তা-ও নয়। তবে কিছু পেতে হলে বদলে কিছু দিতে হয়। এই ক্ষতিটা মেনে নিতে হবে। মনে রেখো, মুসা, আমি যদি সফল হই, দুনিয়ার মস্ত উপকার হবে। এখনকার মত মূল্যবান গ্যাস খরচ করে সার তৈরি করতে হবে না। অতি কম খরচে পাওয়া যাবে উন্নতমানের অফুরন্ত জৈবিক সার।’

আণ্টি পৃথিবীর উপকারের কথা ভাবছেন, খুশি হয়ে হেসেছে মুসা। শাহানাও হেসেছেন।

দু’জনকে হাসতে দেখে ফায়েজাও।

কিন্তু ওরা জানে না আমাজনকে কলুষিত করতে চাইলে মহাবিপদ নেমে আসবে!

.

আধঘণ্টা পর রাবারের বুট পরে জলাভূমির দিকে চলে গেলেন শাহানা। ফায়েজাকে মুসার দায়িত্বে রেখে গেলেন। সঙ্গে এক গাদা টেস্ট টিউব আর যন্ত্রপাতি নিয়েছেন তিনি। দেখতে দেখতে গাছের আড়ালে চলে গেলেন। তাঁকে আর দেখা গেল না।

অসহ্য গরম পড়েছে। বাংলোর ভিতরে বসেও দরদর করে ঘামছে মুসা ও ফায়েজা। বিরাট জিভটা বের করে হ্যাহ্-হ্যাহ্ করে হাঁপাচ্ছে কিলার।

কিছুক্ষণ পর মুসা আর বসে থাকতে পারল না। ফায়েজা আর কিলারকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। শাহানা যেদিকে গেছেন সেদিকে এগোল ওরা। জলাভূমির কিনারায় এসে দাঁড়াল। শাহানাকে দেখা গেল, হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে।

ঠিক তখনই মুসার নজরে পড়ল ওটা।

জলাভূমির পানিতে ছোট ছোট কুতকুতে দুটো চোখ! চোখের পিছনে বিরাট সরু এক মাথা! তার পিছনে ওটার লম্বাটে শরীর! শেষে লম্বা লেজ!

কুমির!

বিরাট!

আন্টির ঠিক পাঁচ গজ পিছনে!

সোজা এগিয়ে আসছে!

‘শাহানা আণ্টি, পালান!’ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা, ‘কুমির, আন্টি!’

পালাতে চাইলেন শাহানা, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে!

শাহানার পায়ের কাছে চলে এসেছে কুমির! ঘেউ-ঘেউ করে উঠল কিলার।

আর বড়জোর এক সেকেণ্ড, তারপর কুমিরের খাবার হবেন শাহানা আণ্টি!

তিন

জলাভূমির পানিতে দ্রুত এগিয়ে আসছে ওটা!

‘কুমির!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আঙুল তুলে ওটা দেখাল।

ফায়েজা ভালমত বুঝতে পারছে না কী ঘটছে। তবে এটুকু বুঝেছে, মুসা ভাই খুব উত্তেজিত। আম্মু পানি ভেঙে ছপছপ করে ছুটে আসছেন তীরের দিকে। কাঁদতে শুরু করল ফায়েজা।

একটানা ঘেউ-ঘেউ করছে কিলার।

শাহানাকে দেখে মনে হলো দিশে হারিয়ে ফেলেছেন,

কী করবেন বুঝছেন না। তারপর কুমিরটা দেখতে পেলেন। আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।

আণ্টিকে দেখছে মুসা। কুমিরটার গতিপথ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন শাহানা। কিন্তু কুমিরটা ততক্ষণে তাঁর পায়ের কাছে চলে এসেছে।

শাহানার পায়ে নাক দিয়ে গুঁতো দিল। এবার যা করল সেটা কোনও কুমির করতে পারে বলে ধারণা ছিল না মুসার।

ধাক্কা মেরে স্রেফ সরে গেল এক পাশে। ভাসতে ভাসতে সামনের দিকে চলল।

বড় করে দম নিলেন শাহানা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাসতে শুরু করলেন। ‘সত্যিই বড় মজার কাণ্ড!’ বললেন।

‘আণ্টি, আপনি কী বলছেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। ‘পানি থেকে উঠে আসুন! আপনি হাসছেন, কুমিরটা আরেকটু হলে আপনাকে খেয়ে ফেলত। আবার আসতে পারে!’

হাসির ফাঁকে বললেন শাহানা, ‘ওটা কুমির নয়, মুসা, ওটা পুরানো একটা কাঠের গুঁড়ি। পানিতে ভাসতে ভাসতে কোত্থেকে যেন এসেছে।

‘কিন্তু দেখতে তো একদম কুমিরের মত!’

‘আমিও বোকা বনে গিয়েছিলাম,’ স্বীকার করলেন শাহানা। ‘পানির ভেতরে সত্যি কুমিরের মত লাগছিল। কিন্তু ওটার চোখ দুটো নকল। কাঠের গুঁড়ির গায়ে দুটো গুটলি। ডালগুলো দেখতে ঠিক লেজের মত মনে হয়েছে।’

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা। আন্টির মত হাসতে পারছে না। গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ। ভাবতেও গায়ে কাঁপুনি ধরছে। ওটা সত্যি করেই তো কুমির হতে পারত। তা হলে এ চোখের সামনে আণ্টির মৃত্যু দেখতে হতো, কিছুই করতে প খারাপ কিছু হয়নি দেখে কান্না থামাল ফায়েজা। কিলারও চুপ করল। ঘাসের নমুনা নিয়ে ধীরেসুস্থে তীরে উঠলেন শাহানা। বললেন, ‘কুমির সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। তবে হ্যাঁ, ক্ষুধার্ত কুমির কী করবে, তা বলা যায় না। সেজন্যই অত ভয় পেয়েছি। বড়দের বিপদের ভয় কম। সহজে ওরা আক্রমণ করে না বলেই জানি। ওদের তো এখানে খাবারের অভাব নেই। প্রচুর মাছ আছে। হরিণও ধরে খায় মাঝে মাঝে।’

‘তা হলে কি কুমির আমি ভয় পাব না?’ জিজ্ঞেস করল ফায়েজা। ‘কুমির আমার কিছু করবে না?’

‘তা ঠিক নয়, তাড়াতাড়ি করে বললেন শাহানা। ‘খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। ক্ষুধার্ত কুমির সাঙ্ঘাতিক চালাক হয়।’

মুখ শুকিয়ে গেল মুসার। আণ্টি যে-কোন সময় জলাভূমিতে কুমিরের খপ্পরে পড়তে পারেন! ও নিজে একটু অসতর্ক হলে? ছোট্ট ফায়েজা কী করতে কী করে বসবে, তার ঠিক নেই! ওকে চোখের আড়ালে যেতে দেয়া যাবে না। গভীর এই জঙ্গলে যে-কোনও সময় যে-কোনও বিপদ ঘটতে পারে।

কুমির ছাড়াও জাগুয়ার আর সাপের ভয় তো আছেই!

মুসার মনে হলো, ফায়েজার দায়িত্ব ওর উপর বর্তেছে। আণ্টি থাকবেন তাঁর এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে। তিনি জন্তু-জানোয়ারের হামলা থেকে ওদেরকে রক্ষা করতে পারবেন না।

নিজেকে মুসার বিরাট একজন অভিযাত্রী বলে মনে হলো। ও এই দুর্গম গহীন অরণ্যে অনেকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। সবাইকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেন ওরই কর্তব্য।

শাহানা আণ্টি এক্সপেরিমেন্ট করতে আবারও জলার দিকে চলে গেলেন।

গরম পড়েছে অসহ্য। দম বন্ধ করা পরিবেশ। শ্বাস আটকে আসতে চায়। ক্লান্তি বোধ করছে মুসা। জীবনে কোনওদিন এত গরম লাগেনি। সূর্যের আলো জঙ্গলে যেখানে পড়েছে, সেসব জায়গা থেকে রীতিমত ভাপ উঠছে।

জলাভূমি যেখানে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে, ওখানে চোখ রাখলে বোঝা যায় না, কোথায় পানির শেষ, আর কোথায় আকাশের শুরু!

ফায়েজাকে নিয়ে সোজা বাংলোয় ফিরল মুসা। এরপর থেকে বাইরে তেমন একটা বেরল না। কড়া নজর রাখল কিলার আর ফায়েজার উপর।

আণ্টির জন্যও দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। কী হতো যদি ওই কাঠের গুঁড়ি সত্যি সত্যি কুমির হতো?

ওই জলাভূমিতে যখন তখন বিপদ ঘটতে পারে।

এমন বিপদ ঘটতে পারে, যেটা ওদের শেষ করে দেবে।

চার

আমাজনে মুসার প্রথম রাত এল নীরব বিভীষিকার মত। সূর্য ডুবে যেতেই ঝপ্ করে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। সেইসঙ্গে শুরু হলো নানারকম আওয়াজ। এত রকমের জন্তুর ডাক মুসা আগে কখনও শোনেনি। একটা আওয়াজ ভয় ধরিয়ে দিল। মনে হলো, তীব্র ব্যথায় কাঁদছে মানুষের বাচ্চা। ফেউ ডাকছে। মুসা শুনেছে, জাগুয়ার কাছাকাছি থাকলে ওগুলো ওভাবে ডাকে। নিরীহ প্রাণীদের সতর্ক করে দেয়। নইলে যে-কোন সময়ে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটতে পারে।

জাগুয়ার কি বাংলোর ধারেকাছে এসেছে?

একেকটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনে আর চমকে যায় মুসা। ফায়েজা নিশ্চিন্তে আছে। এতই ক্লান্ত, সন্ধ্যা নামতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘেউ-ঘেউ করে উঠছে।

‘চুপ কর, কিলার,’ ধমকে কুকুরটাকে চুপ করাতে চাইছেন শাহানা, কাজ হচ্ছে না।

ওটার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করল মুসা।

বাইরে থেকে প্যাচার অশুভ ডাক ভেসে আসছে।

বড় ঘরটায় বসে আছে ওরা। ফায়েজা সোফায় কাত হয়ে ঘুম। একটা বই থেকে শেক্সপিয়ারের কবিতা পড়ছেন শাহানা। কেরোসিনের আলোয় ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি দূর হয়নি। দেয়ালে পড়ছে অদ্ভুত সব ছায়া। মনে হয় ভুতুড়ে কিছু নড়ছে বুঝি।

রাত নামার পরও গরম কমেনি মোটেও। ঘামছে ওরা দরদর করে।

একটু পর মুসা বলল, ‘চারপাশে এত আওয়াজ! মন দমে যায়।’

শাহানা ভাবলেন মুসা ভয় পেয়েছে, বললেন, ‘দুশ্চিন্তা কোরো না, মুসা, এগুলো বনের স্বাভাবিক শব্দ। আমরা সভ্যতা থেকে অনেক দূরে বটে, কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই। বুকে সাহস রাখো।’

‘ভয় পাইনি,’ বলল মুসা। ‘মনটা কেমন যেন করছে। আমরা বাড়ি থেকে কত দূরে!’ আণ্টির দিকে চাইল ও। ‘রাতে জাগুয়ার আক্রমণ করলে?’

‘করবে না,’ জোর দিয়ে বললেন শাহানা। ‘বাংলোর ভেতরে আমরা নিরাপদ।’ আরেকটা বই হাতে নিলেন তিনি। বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা। পড়তে শুরু করলেন।

স্বর্গের বাগানে গিয়েছিলাম আমি!

সেখানে দেখেছি, যা আগে কখনও দেখিনি!

সেখানে সেই সেথায় প্রার্থনালয় উঠেছে!

যেখানে সবুজের মাঝে আমি খেলতাম শৈশবে…

হঠাৎ করে পড়া থামিয়ে দিলেন শাহানা। বাংলোর ছাদে উপর ধুপ করে কি যেন পড়ল। চমকে গেলেন তিনি, বইটা বন্ধ করে রাখলেন।

টিনের চালে জোরে আওয়াজ হয়েছে। খুব জোরে। যেন ভারী কোনও জন্তু লাফ দিয়ে চালের উপর উঠেছে। হয়তো এখনই ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে!

দম! দম! দড়াম! দমাদম!

‘আণ্টি, কী হতে পারে ওটা?’ ঢোক গিলে বলল মুসা। আস্তে করে শাহানার কাছ ঘেঁষে বসল।

‘বুঝতে পারছি না, মুসা!’ গলা কেঁপে গেল শাহানার। ‘কী হতে পারে?’

‘ভারী কিছু। ভেতরে ঢুকতে চাইছে! বড় কোনও জন্তু!’

কিলার উত্তেজিত হয়ে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। ঘুম ভেঙে চোখ পিটপিট করে চাইল ফায়েজা। শাহানার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। উঠে বসল। কাঁদতে শুরু করল।

‘ও কিছু না, ফায়েজাকে অভয় দিলেন শাহানা। মুসার দিকে তাকালেন। ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, কোনও বিপদ হবে না আমাদের।’ হাত তুলে শাসালেন। …কিলার, চেঁচানি থামা, নইলে দেব এক চড়!’

শুনল না কিলার। ছাদের দিকে মুখ তুলে ঘেউ-ঘেউ করতে লাগল।

‘কোনও জন্তু হঠাৎ করে ছাদে উঠে পড়েছে, এখন নামার চেষ্টা করছে,’ বললেন শাহানা। ‘আমরা যতটা ভয় পেয়েছি, তার চেয়ে কম ভয় পায়নি ওটা। দাঁড়াও, আমি টর্চ নিয়ে বাইরে বের হয়ে দেখি।’

আণ্টির কথায় আপত্তি জানাল মুসা, ‘বাইরে? সেটা কী ঠিক হবে? বিপদ হতে পারে। জন্তুটা হয়তো আপনার উপর হামলে পড়বে।’

টিনের ছাদে আওয়াজ বন্ধ হয়নি, যেন টিন ভেঙে ফেলবে।

ধম! ধম! ধমাৎ! ধমাধম!

‘খামোকা ভয় করছ, মুসা,’ ভীত স্বরে বললেন শাহানা। টর্চের দিকে হাত বাড়ালেন। ওটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে এগোলেন দরজার দিকে। ‘দেখছি আমি কী এমন আওয়াজ করে!’

‘তা হলে আমিও যাই,’ বলে সোফা ছাড়ল মুসা। আন্টির বিপদ হবে, আর ও বসে থাকবে? সেটা হতে পারে না। একা আণ্টিকে কিছুতেই যেতে দেবে না ও। শাহানার হাত ধরল মুসা। ‘কই, চলুন বাইরে।’

‘চলো তা হলে ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা। ‘ঠিক আছে, দেখা যাক কী আছে।’

দরজা খুললেন শাহানা, তবে আগে বের হলো মুসা। ওর হাতেও ছোট একটা পেন্সিল টর্চ।

দরজা বন্ধ করার আগে শাহানা বললেন, ‘যেখানে আছ সেখানেই থাকবে, ফায়েজা। আমরা এক্ষুণি আসছি। কিলার, চিৎকার থামা!’

দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর পাশাপাশি বারান্দায় দাঁড়াল দু’জন, তারপর মই বেয়ে নেমে উঠানে। অন্ধকারে টর্চের আলো একটা সরু রেখা তৈরি করল। এ আলোয় সামান্য জায়গা দেখা গেল।

বাংলোর কাঠের দেয়াল দেখা গেল। নোংরা, ছাতা পড়া, পুরানো। টর্চের আলো টিনের চালে পড়ল। জং-পড়া টিনের জং না ধরা অংশগুলো চকচক করে উঠল।

জন্তুটাকে শীঘ্রি দেখা যাবে, ভাবল মুসা। উত্তেজিত। ভয় চলে গেছে। একবার মনস্থির করলে ভূত ছাড়া আর কিছুকে ভয় পাবার বান্দা নয় সে।

বোধহয় জাগুয়ার চালে উঠেছে। অন্য কিছুও হতে পারে। যা হয় হোক, ভয় পায় না মুসা।

চালের উপর আলো পড়তেই হঠাৎ করে আওয়াজটা বন্ধ হলো। কিছু দেখতে পেল না মুসা। শাহানার চোখেও পড়ল না কিছু। জাগুয়ার নেই। অন্য কোনও জন্তুও নেই। কিচ্ছু না!

ভুতুড়ে কাণ্ড?

ব্যাঙের ডাক ছাড়া চারপাশে কবরের নিস্তব্ধতা।

অন্ধকার চারপাশ। আকাশের তারাও দেখা যায় না। টর্চের আলোয় কিছুই দেখা গেল না। বাংলোর উপরে ঝুঁকে থাকা গাছের ডালগুলোতেও কিছু নেই।

খালি ডাল। অন্তত দশটা হবে। ঝুঁকে আছে বাংলোর চালের উপর। অন্ধকারে ওগুলো দেখতে কেমন রহস্যময় লাগছে, যেন অশুভ কিছুর প্রতিনিধিত্ব করছে।

পাঁচ

মুসার দিকে তাকালেন শাহানা, কিন্তু কিছু বললেন না।

কোনও কথা হলো না, সোজা বাংলোর ভিতরে এসে ঢুকল দু’জন। ভিতরে ঢুকে টর্চ নেভালেন শাহানা। মুসা লক্ষ করল, আন্টির হাত কাঁপছে।

ফায়েজাকে তিনি এক গ্লাস দুধ খাইয়ে শান্ত করলেন। একটু পরই ঘুমিয়ে পড়ল ফায়েজা। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এল মুসা।

এদিকে শাহানা কিলারের জন্য একটা পাত্রে পানি ঢেলেছেন। পরিবেশ এতই গরম যে অ্যালসেশিয়ান দানব সর্বক্ষণ হাঁপাচ্ছে, একটু পর পর চুকচুক করে পানি খাচ্ছে। আজ রাতে মুসার খাটিয়ায় একবার উঠবার সুযোগ পেলে নির্ঘাত পেশাব করে বিছানা নষ্ট করবে।

মুসাকে এতদিনে এই প্রথম বড় হবার স্বীকৃতি দিলেন আণ্টি। কিছু বললেন না ওকে। সান্ত্বনা নয়, অভয় নয়, কোনও কথাই না। তিনি বুঝে গেছেন, ওকে কিছু বলতে হবে না, ও নিজেই জানে কোথায় কী বিপদ হতে পারে। মুসাকে শুধু বললেন, ‘চিন্তা করে ছুটির মজা নষ্ট কোরো না। বলো দেখি কী অত ভাবছ?’

‘আমি বুঝতে পারছি না চালের ওপর ওটা কী হলো,’ বলল মুসা। ‘কী ওরকম জোর আওয়াজ করল? কেনই বা তাকে দেখা গেল না? চালের ওপর তো কিছুই ছিল না!’

‘নিশ্চয়ই কোনও জন্তু। বাঁদর হতে পারে। আমরা যখন আলো ফেললাম, হয়তো ওটা গাছের ডালগুলোর আড়ালে লুকিয়ে নেমে গেছে। এমন কী আমাজনের জাগুয়ারও মানুষখেকো হয়ে না পড়লে মানুষকে আক্রমণ করে না।’

‘আমার তা মনে হয় না, আণ্টি। চালের ওপর যদি কোন জন্তু থাকত, ওটার পালানোর আওয়াজ পেতাম। অন্য কিছুতে করেছে অমন আওয়াজ।’

‘অন্য কিছু? অন্য কিছু কী? অমন আওয়াজ কে করবে?’

‘জানি না,’ স্বীকার করল মুসা। ওর মাথায় কিছু খেলছে না। মনের কথাটা বলল, ‘এখানে ভুতুড়ে কিছু আছে, আণ্টি। জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। এক কাজ করা যায়, আমরা যদি ঘাসের নমুনা নিয়ে এখান থেকে চলে যাই? অন্য কোথাও এক্সপেরিমেন্ট করলে ফলাফল, মিলবে না? ‘

মাথা নাড়লেন শাহানা। ‘কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে আমাকে। তার জন্যে তাজা ঘাস দরকার। চেষ্টা করে দেখেছি, অন্য জমিতে লাগালে ঘাসগুলো মারা যায়। এখান থেকে যাওয়া চলবে না আমাদের, মুসা। খারাপ যতই লাগুক, আমাদের মাথায় রাখতে হবে আমরা পৃথিবীর জন্যে কাজ করছি। আমি সফল হলে… না, মুসা, এখান থেকে যাওয়া চলবে না আমাদের।’

চুপ করে রইল মুসা। আণ্টি এমনই, মনস্থির করে ফেললে তাকে আর ফেরানো যায় না।

‘ওটা বিড়াল জাতীয় প্রাণী,’ বললেন শাহানা, ‘নিশ্চয়ই ভুল করে চালের ওপর উঠে পড়ে। ওটা নিশ্চয়ই বারবার এমন ভুল করবে না। আগামীকাল আমি প্রায় সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকব। তুমি সাবধানে থেকো। ফায়েজা আর কিলারের দায়িত্ব তোমার ওপরই ‘থাকল। আমার কাজের চাপ কমে গেলে তোমাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারব। তখন আমরা স্পিড-বোট নিয়ে ঘুরতে বেরুব। অনেক জায়গায় যাব, পিকনিক করব, মজা করব।’

খুশিতে হেসে ফেলল মুসা। ‘আন্টি, আমাকে স্পিড-বোট চালাতে দেবেন?’

‘যদি আস্তে চালাও,’ রাজি হয়ে গেলেন শাহানা। ‘এখন যাও, শুয়ে পড়ো, রাত অনেক হলো। অনেক ভোরে উঠতে হবে কিন্তু। তখন আমি জলাভূমিতে যাব। …আর …দুশ্চিন্তা কোরো না। বাংলোর ভেতর কিছু হবে না। আশা করি বনের ভেতরেও বিপদ ঘটবে না আমাদের। আল্লাহ্ আছেন, যাও, ঘুমিয়ে পড়ো, মুসা।’

আন্টির কপালে চুমু দিয়ে শোবার ঘরে এসে ঢুকল মুসা। ভাবনা ওকে পেয়ে বসেছে।

কী ওরকম আওয়াজ করল? কিছুই তো দেখা গেল না! আন্টি ভয় পেয়েছেন। তিনি কী কিছু লুকাতে চাইছেন? সরকারী সংস্থা কয়েকবার তাঁকে মিটিঙে ডেকেছে। তারা কী তথ্য দিয়েছে? ভীতিকর কিছু? কেন এই দুর্গম অঞ্চলে আসতে হলো ওদের? আন্টির মুখে একবার শুনেছে, টাপাজো, কোয়াহিয়া ও ইয়ারুনারা এই এলাকা এড়িয়ে চলে।

বেশ। কিন্তু কেন?

এখানে ভয়ের কী আছে?

মুসার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না বেড়াল জাতীয় প্রাণী চালে উঠেছে। অমন আওয়াজ করবে? মন থেকে শঙ্কা দূর করতে চাইল। হয়তো দুশ্চিন্তার কারণেই দরদর করে ঘামছে।

দাঁত ব্রাশ করল ও, ড্রেসারের উপর হাতঘড়ি রেখে শুয়ে পড়ল। বাইরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, সেই সঙ্গে তান জুড়েছে কয়েকটা কোলা ব্যাঙ। ওদের ঘ্যাঙর-ঘ্যাং আওয়াজে কেমন যেন অলসতা আছে। একটা জোনাকী জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকল। মিটমিট করে আলো জ্বেলে উড়ে বেড়াল কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে গেল। সরু মোমবাতি জ্বলছে। হলদে ভৌতিক আলো ছড়িয়ে আছে। দূরে ডেকে উঠল শেয়াল। চিৎকার ছাড়ল একটা বানর, তারপর ভেসে এল জাগুয়ারের হুঙ্কার। তারপর সব চুপচাপ। এমন কী ঝিঁঝি আর ব্যাঙের ডাকও থেমে গেছে। চারদিকে নিঃসীম নীরবতা কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল মুসা।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতে মনটা ফুরফুরে লাগল ওর। দিগন্তে লালচে আলো ছড়িয়ে উঠছে সূর্য। সে-আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুরি করে ঘরে এসে পড়েছে। মনেই হয় না জঙ্গলটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক।

রান্নাঘর থেকে আণ্টির নাস্তা তৈরির শব্দ ভেসে আসছে। ভউ- ভউ করে দু’বার ডেকে উঠল কিলার। মুসা চেয়ে দেখল, ফায়েজা এখনও ঘুমে কাদা। ড্রেসারের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রূ কুঁচকে উঠল ওর।

ড্রেসারের উপর ঘন সবুজ কী যেন লেপ্টে আছে। ঘড়িটা নেই! জিনিসটা সবুজ আঠালো কিছু।

রাতে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে কিছু! ঘড়িটা নিয়ে গেছে।

কী সেটা?

কিলার আঠালো জিনিসটার দিকে এগোল। বিষাক্ত কিছু হতে পারে!

ছয়

‘কিলার, ওখান থেকে সর্,’ চিৎকার করল মুসা।

ঘরঘর আওয়াজ করছে কিলার। তাকিয়ে আছে সবুজ পদার্থটার দিকে। রাতের সেই আগন্তুক এসেছিল বলে প্রচণ্ড রেগে গেছে। শোঁকার জন্যে এগোতেই, মুসার চিৎকারে ফিরে তাকাল।

‘আণ্টি!’ ডাকল মুসা।

পরের হাঁকে ঘুম ভেঙে গেল ফায়েজার। ঘেউ-ঘেউ করে উঠল কিলার। মুসার ডাকে আতঙ্কের ছোঁয়া চিনতে ভুল হয়নি শাহানার, তিনি দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলেন।

ঘরের ভিতর হুলস্থূল লেগে গেল।

শাহানা সবুজ জিনিসটা পরীক্ষা করতে এগোতেই, কিলার খেপে উঠল! এগোতে দেবে না।

এদিকে ফায়েজা জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, আম্মু? কী হয়েছে?’ সবুজ জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে ও। ‘ওটা কী, আম্মু?’

‘এখনও জানি না, সোনা,’ জবাব দিলেন শাহানা। কিলারের কলার ধরে আটকে ধরলেন। ‘ওটা এক্ষুণি দেখছি। …কিলার! চুপ কর্ বলছি!’

‘আঠালো কিছু,’ বলল মুসা। ‘রাতে ঘরে ঢুকেছিল। আমি যখন ঘুমাতে যাই, তখনও জিনিসটা ছিল না। ড্রেসারের ওপর ঘড়িটা ছিল, নিয়ে গেছে।’ নিজেকে প্রশ্ন করল ও, ‘কী ঢুকেছিল যে কিলারও টের পেল না?’

‘কিলারকে ধরে রাখো, মুসা, নির্দেশ দিলেন শাহানা, ‘ওটা কি দেখছি।’

কিলারের কলার পাকড়ে ধরল মুসা, সামনের ঘরে নিয়ে এল। ওকে রেখে এক দৌড়ে আবারও ঘরে ঢুকল, ভিতর থেকে দরজা আটকে দিল। পিছনে কিলারের প্রতিবাদ শোনা গেল। কুকুরটা একটানা ঘেউ-ঘেউ করছে, দরজায় আঁচড় কাটছে।

‘কোন্ প্রাণী এরকম সবুজ আঠা রেখে যেতে পারে, আণ্টি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা। ‘জিনিসটা কেমন যেন গন্ধ ছড়ায়। শুঁকলে মনে হয় কাটা গাছের কাঠের গন্ধ!’

‘জিনিসটা কী, আম্মু?’ জিজ্ঞেস করল ফায়েজা।

ড্রেসারের উপর ঝুঁকে পড়লেন শাহানা, সাবধানে জিনিসটা পরখ করে দেখলেন। দু’তিনবার গন্ধ শুঁকলেন, তারপর হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন।

‘ইয়াক্!’ মুখ বিকৃত করল মুসা। ‘ছোঁবেন না, আণ্টি! ওটা কী আল্লাহ্ জানে!’

ভাইয়ের অনুকরণে চেহারা বিকৃত করল ফায়েজা।

‘জানি না এটা কী,’ চিন্তিত স্বরে বললেন শাহানা। ‘নিশ্চিত হতে হলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’ হাবভাব দেখে মনে হলো তাঁর বিজ্ঞানী মনটা কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। ‘তবে এগুলো বিপজ্জনক নয়। বিষাক্ত তো নয়ই। অর্গানিক সাবস্ট্যান্স। কোনও জানোয়ার এ জিনিস ফেলে যায়নি।’

‘কী করে জানলেন, আণ্টি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।

‘কম্পোজিশনটা দেখে। এক ধরনের গাছ থেকে এসেছে। খুবই ইন্টারেস্টিং!’ সবুজ আঠালো তরলটা কাছ থেকে দেখলেন তিনি। ‘আগে কখনও এমন জিনিস দেখিনি। একটু স্যাম্পল পরীক্ষা করলে কোন্ গাছ থেকে এসেছে জানা যাবে।’ মুসার দিকে চাইলেন। ‘চিন্তার কিছু নেই।’

চিন্তা না করে উপায় কি, মনে মনে বলল মুসা। রাতে সবার অজান্তে ঘরে ঢুকেছে রহস্যময় জিনিস, ঘড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে। যাবার আগে এই সবুজ আঠা ফেলে গেছে। পরেরবার ফায়েজাকে তুলে নিয়ে যাবে না, তার ঠিক কী!

মুসাকে নিশ্চুপ দেখে শাহানা বললেন, ‘আমার ধারণা খাবারের খোঁজে রাতে খরগোশ জাতীয় প্রাণী ঘরে ঢুকেছিল। ওটার মুখে সম্ভবত কোন গাছ ছিল। আবার এমনও হতে পারে, ঘরে ঢোকার আগে এই সবুজ জিনিসগুলোর ওপর গড়াগড়ি করে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে এই আঠালো জিনিস। জন্তুটা বোধহয় কৌতূহলী হয়ে তোমার ঘড়ি মুখে তুলে নিয়ে গেছে। বিশ্বাস হতে না চাইলেও বন্য প্রাণী অনেক অদ্ভুত কাণ্ডই করে।’

‘কিন্তু তা-ই যদি হয়,’ যুক্তি খুঁজছে মুসা, ‘জন্তুটা যখন ঘড়ি নিয়ে গেল তখন মুখের গাছটা ফেলে গেল না কেন?’

‘ভাল বলেছ,’ প্রশংসা করলেন শাহানা। ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ধরো, ওটা যদি ডাল মুখে না নিয়ে আসে? হয়তো এটার ওপর গড়াগড়ি করে তারপর ঘরে ঢুকেছে। আবার এমনও হতে পারে, ঘরে দুটো জন্তু ঢুকেছিল। একটা তোমার ঘড়ি নিয়ে গেছে, আরেকটা গাছ নিয়ে ফিরেছে? …ঘটনা যা-ই হোক, দুশ্চিন্তা করার মত কিছু ঘটেনি।’

আণ্টি নিজে চিন্তিত, তা ঠিকই বুঝতে পারল মুসা। ও নিজেও রহস্যের জবাব খুঁজছে। ভাবছে কিশোর হলে এখন কী করত? নিজের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করল না ও। ওকে বিচলিত দেখলে আণ্টি চিন্তা করবেন, তাতে কাজের ক্ষতি হবে।

শাহানা নিজের ঘরে চলে গেলেন, একটু পর ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ব্যাগ নিয়ে এলেন। সবুজ জিনিসটা একটু তুলে নিলেন, একটা টেস্ট টিউবে ভরে রাখলেন। সাবান পানি দিয়ে ড্রেসারটা মুছলেন। পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না উপরটা। এখনও জায়গায় জায়গায় সবুজ আঠা লেগে রইল। মেঝেতে যেটুকু পড়ল সেগুলোও সেঁটে গেল।

‘মেঝের ওখানে পা দিয়ো না,’ সাবধান করলেন শাহানা, ‘এখনও জিনিসটা খুবই আঠালো।’

ফায়েজা পোশাক পাল্টাতে পাশের ঘরে চলে গেল। এই ফাঁকে নিজের গেঞ্জিটা পাল্টে নিল মুসা। একসঙ্গে রান্নাঘরে বসে নাস্তা সারল ওরা। মুসা শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে, নইলে কিলার আঠায় আটকে যেতে পারে।

ওরা সবাই ডিম ভাজা, রুটি, পনির আর চা শেষ করে বাংলোর বাইরে চলে এল। আগে আগে চলল কিলার। সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল ওরা খালের পাড়ে। ওদের স্পিড-বোট ঘাটে বাঁধা, মৃদু ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। মুসার মনে হলো, এক্ষুণি যদি এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যেতে পারত ওরা, খুব ভাল হতো। এখানে থাকতে ওর মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। মন বলছে, কী যেন একটা বিপদ মাথার উপর ঘনিয়ে আসছে।

খালের পাড় ধরে অনেক দূর হাঁটল ওরা। শাহানা নানা পাখি চেনালেন মুসা আর ফায়েজাকে। দেখালেন কীভাবে গাছ বেয়ে পালিয়ে যায় কাঠবিড়ালী আর গিরগিটি

‘ওই গাছটা দেখছ?’ ফেরার পথে একটা লালচে গাছ দেখালেন। ‘ওটা একটা চিরহরিৎ গর্জন গাছ। সাধারণত এধরনের গাছ দেখা যায় লবণাক্ত অঞ্চলে। গাছের কাণ্ডের কাছে মাটি থেকে যে কাঠির মত জিনিসগুলো বেরিয়ে আছে, ওগুলো আসলে গাছের শেকড়। …আর ওইটা দেখছ? ওটা ট্র্যাভেলার্স পাম ট্রী। আসলে পাম গাছ নয়, কিন্তু পাম গাছের মত দেখতে। আসলে কলা গাছের জাত। এটার পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়া যায় না। মজার ব্যাপার জানো, পাতাগুলোর ভেতরে মিষ্টি পানি থাকে। তৃষ্ণার্ত পথিক এ গাছের পাতা ছিঁড়ে তেষ্টা মেটাতে পারে।’

‘তা-ই!’ আসলে বলার জন্য বলা, কিছুই ভাল লাগছে না মুসার। কখন কী বিপদ ঘটে যায় সে আশঙ্কায় মনটা সতর্ক হয়ে আছে ওর। এখন যদি একটা জাগুয়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে? যদি গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত কোনও বিষাক্ত সাপ ছোবল মারে?

একঘণ্টা পর বাংলোতে ফিরল ওরা। কোনও বিপদ ঘটেনি বলে স্বস্তির শ্বাস ফেলল মুসা। শাহানা জানালেন, বাকি দিন মুসার দায়িত্বে ফায়েজা থাকবে, উনি জলাভূমিতে উনি জলাভূমিতে এক্সপেরিমেন্ট করতে যাবেন।

ব্যাপারটা ভাবতে ভাল লাগল না মুসার, কিন্তু কিছু বলল না। সর্বক্ষণ বিপদের চিন্তা করে মনটাই কেমন যেন গেছে ওর। তাই কিছু বলে আণ্টিকে বিরক্ত করল না।

মুসার মনোভাব শাহানা ঠিকই বুঝেছেন। যাবার আগে বললেন, ‘মনে রেখো, তুমি যদি লক্ষ্মী ছেলের মত থাকো, কালকে তোমাকে স্পিড-বোট চালাতে দেব। সারাদিন ঘুরব আমরা, পিকনিক করব।’

‘ঠিক আছে, আণ্টি, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না,’ মুখে জোর করে হাসি টেনে আনল মুসা। ‘আমরা বাংলো ছেড়ে কোথাও যাব না।’

‘ফায়েজার উপর চোখ রেখো,’ বললেন শাহানা।

মুসা ও ফায়েজা দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে শাহানাকে বিদায় জানাল। কিলার শাহানার পিছন পিছন ছুটে জলাভূমির তীর পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এল। আণ্টি চলে যেতেই বড় একা লাগল মুসার। ভয়ও লাগছে এতোবড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। মনটাকে শক্ত করল ও।

পিচ্চি ফায়েজার সমস্ত দায়িত্ব এখন ওর একার। ভয় পেলে চলবে কেন। বিপদ এলে বুদ্ধি দিয়ে তার মোকাবিলা করতে হবে।

কী করবে কিছুক্ষণ ভেবে পেল না মুসা, তারপর বুদ্ধি করে ফায়েজাকে একটা ছবির বইয়ে রং করার দায়িত্ব দিল। ও ব্যস্ত থাকুক। ছবিতে রং করতে খুব ভালবাসে ফায়েজা। একবার মন বসে গেলে দুনিয়ার আর কিছু খেয়াল থাকে না ওর। সময়টা ওর ভালই কাটবে। আণ্টির কবিতার বই নিয়ে বারান্দায় চলে এল মুসা, পাশে কিলার। চেয়ার টেনে বসে গরমে ঘামতে ঘামতে কবিতা পড়তে শুরু করল মুসা। বাপরে! কবিতার মধ্যে দাঁত ফোটানো যায় না! কিন্তু সময় পার করবে এমন কিছুই তো আর নেই!

আজকে গতকালের চেয়ে গরম বেশি পড়েছে। সূর্য যতই উপরে উঠছে, তাপের প্রকোপ বাড়ছে তত। গোটা জঙ্গল যেন তাতানো কড়াই! মাটি থেকে ভাপ উঠছে! এক ফোঁটা বাতাস নেই। একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। থমথম করছে পরিবেশ। মাঝে মাঝে একটা গানের পাখি টুই-টুই করে ডাকছে।

বিশাল অ্যালসেশিয়ানটা মুসার পাশে বসে জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে, একটু পর পর বাংলোর ভিতরে গিয়ে পানি খেয়ে আসছে। একমনে ছবিতে রং করছে ফায়েজা। এরই মধ্যে একবার ওকে টয়লেট করিয়ে এনেছে মুসা।

উইলিয়াম ব্লেক, রবার্ট ফ্রস্ট আর এডগার অ্যালান পো’র কবিতা পড়তে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মুসা। মনটা তেতো হয়ে গেল কিছু বুঝতে না পেরে। এ কী রকম কবিতা! খানিকক্ষণ কসরতের পর ঘুম চলে এল চোখে, চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।

একটু পর চমকে উঠল। বাংলোর পিছন থেকে খচমচ করে আওয়াজ আসছে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে শব্দ। জঙ্গলের শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে যেন’ আসছে!

মানুষ না আর কিছু?

বিপজ্জনক কোনও জন্তু নয় তো?

হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল মুসার। ঘাড়ের কাছের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠেছে মন।

সভ্য জগৎ থেকে অনেক দূরে আছে ওরা। এখানে তো মানুষ থাকার কথা নয়!

তা হলে কী ওটা?

বন্য কোনও জন্তু? বড় কিছু?’

হঠাৎই দেখা গেল তাকে। বাংলোর কোনা ঘুরে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। ভয়ানক কুৎসিত চেহারা। মুখভরা দাড়ি। এক চোখের উপর কালো কাপড়ের পট্টি। এক হাতে দুলছে এক মস্ত কুঠার। কোমরে চকচকে ভোজালি গোঁজা। হাসতেই তার বড় বড় হলুদ দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। সারির মাঝখানে উপর-নীচে দুটো করে দাঁত নেই, মুখের চৌকো কালো গহ্বরটা দেখা যাচ্ছে।

মুসাকে দেখেই শয়তানী হাসি ফুটল লোকটার মুখে! এমন ভাবে তাকাল যে গলা শুকিয়ে গেল মুসার। কসাইরা গরু জবাই করবার আগে গরুর দিকে ওভাবে তাকায়। যেন দেখছে, গায়ে মাংস আছে কি না!

ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘যাক, খাবার পাওয়া গেল!’

সাত

ভয়ে মুসার মুখ দিয়ে অজান্তে অস্ফুট চিৎকার বের হলো, লাফ দিয়ে কিলারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল কিলার। দাঁত আর মাড়ি বের হয়ে এসেছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

কী করা উচিত এখন? ব্যস্ত হয়ে ভাবতে চাইল মুসা।

দৌড়ে গিয়ে বাংলোর ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে? কিন্তু ওই দরজায় ছিটকিনিই তো নেই!

ফায়েজার হাত ধরে বনের ভিতর দৌড় দেবে? পালানোর চেষ্টা করবে?

ফায়েজা বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারবে না। তা ছাড়া, ওর দৌড়ের গতিও কম। ওকে কোলে তুলে বেশিক্ষণ ছুটতে পারবে না ও।

উন্মাদ লোকটাকে বলবে নাকি যে ওর মাংস তেমন ভাল না? মোটেই স্বাদ নেই! তাতে লাভ হবে কোনও? পাগলটাকে দেখে জন্ম- জন্মান্তরের বুভুক্ষু মনে হয়!

পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে!

মুসাকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি আরও চওড়া হলো।

‘ভয় পেয়ো না,’ অবশেষে বলল সে। ‘গত তিনবছরে আমি কোনও বাচ্চা খাইনি। তুমি বড় বেশি ঢ্যাঙা। তা ছাড়া আমার এমন পাকা ছেলে খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কচি পেলে অবশ্য…’

চট্ করে পিছনে তাকাল মুসা। ঘরের মধ্যে ফায়েজা আছে!

এবার সশব্দে হেসে উঠল লোকটা। গলার গভীর থেকে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল। মনে হলো কুলকুচি করছে। হাসি দেখে মনে হলো এই মাত্র দুনিয়ার সেরা কৌতুকটা বলেছে সে!

‘অ্যাই ব্যাটা কুকুরের বাচ্চা, চিৎকার থামা!’ নোংরা একটা পুরুষ্টু হাত বাড়িয়ে দিল সে কিলারের দিকে।

কী আশ্চর্য, কিলার হাতটা একবার শুঁকেই ঘেউ-ঘেউ বন্ধ করে লেজ নাড়তে শুরু করল!

‘এই তো, লক্ষ্মী ছেলে,’ বলল পাগল। ‘আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। নাকি করব? অ্যা? হাহ্ হাহ্ হাহ্!’

‘কি-কি… কে আপনি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা। ভয়ে বুক কাঁপছে। কিলারও এখন আর সাহায্যে আসবে না। কোনও মিথ্যে বলে পাগলটার হাত থেকে পার পাওয়া যাবে কি না, ভাবার চেষ্টা করল।

এমন একটা কিছু বলতে হবে যাতে ওদের ক্ষতি না করেই চলে যায়। গলা খাঁকারি দিল মুসা, তারপর গম্ভীর চেহারা করে বলল, ‘আমার আণ্টি পুলিশ আনতে গেছে। গতরাতে এখানে ঝামেলা হয়েছিল। এক্ষুণি চলে আসবে সবাই।’

ফিক করে হেসে দিল লোকটা। ‘আচ্ছা! তা হলে তোমার আন্টি পুলিশ ডাকতে গেছে, না? তবে তো তাকে বহুদূর যেতে হবে। স্পিড-বোট না নিয়ে গেল কী করে? জেনে রাখো, পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোনও পুলিশ নেই। চাপা ছাড়ো হে খোকা, তোমাদের ওসব জারিজুরি আমার ভালই জানা আছে।’ কুঠারটা কাঁধে ঝোলাল সে। ‘শোনো খোকা, ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘কে আপনি? এখানে কী করছেন?’

‘আমি? আমি কানা ক্যানারেঞ্জ। মানে রেভারেও ক্যানারেঞ্জ স্টিভেনসন। যাজক। আদিবাসী মানুষগুলোকে ধর্মের দিকে টেনে আনা আমার কাজ। ম্যানুয়াস শহরে সবাই কানা ক্যানারেঞ্জ বলেই চেনে। আমার আরেকটা পরিচয়, আমি জীববিজ্ঞানী। নানা প্রাণীর স্বভাব নিয়ে গবেষণা করি।’ একটু থামল সে, তারপর বলল, ‘গবেষণা করতে গিয়েই চোখটা গেছে আমার। একটা ভালুক খুবলে নিয়েছিল।’

‘ভালুক? খুবলে নিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ভালুক। খুবলেই তো নিল। সে এক বিরাট কাহিনি। মন ভাল থাকলে কোনওদিন সে কাহিনি তোমাকে বলতেও পারি।’ ক্যানারেঞ্জ স্টিভেনসন হাত তুলে বাংলোর পিছন দিকটা দেখালেন। ‘আমি ওদিকে থাকি। তিন মাইল দূরে আমার ছাপরা।’

মাথা চুলকাল মুসা, কী বলবে ভেবে পেল না।

‘দশ বছর ধরে আমি আমাজনে গবেষণা করছি,’ বললেন যাজক। ‘গতরাতে দেখলাম এই বাংলোয় মানুষ এসেছে, তা-ই চলে এলাম। হাজার হলেও তোমরা আমার প্রতিবেশী।’

‘এই বনের মাঝে থাকেন আপনি?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। ‘খারাপ লাগে না? এত বিপদ চারধারে। বনের জাগুয়ার, পানিতে কুমির, গাছে সাপ!’

‘কী যে বলো হে, খোকা,’ একগাল হাসলেন স্টিভেনসন। ‘দুনিয়ায় এর চেয়ে দারুণ জায়গা আর আছে নাকি! তবে সেটা বুঝতে হলে তোমাকে আগে চিনতে হবে বনের সৌন্দর্য। আমি তো সভ্যতার ওপর বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভার্সিটিতে একই বিষয়ে দিনের পর দিন ক্লাস নিতে নিতে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। শেষে চাকরি ছেড়ে দিলাম, যাজক তো আগেই ছিলাম, এবার এখানে এসে প্রাণে বেঁচে গেলাম। এখানে ফালতু মানুষ এসে জ্বালাতন করে না। সভ্যতা মানেই ধ্বংসের শুরু।’

‘সভ্যতা মানে ধ্বংসের শুরু? অবাক হলো মুসা। ‘সভ্যতা তো সবকিছু সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্যেই!’

আন্টির এক্সপেরিমেন্টের কথা মনে পড়ল ওর। সভ্যতার জন্যই গবেষণা করছেন তিনি। তাঁর গবেষণা সফল হলে এই বন আর বন থাকবে না। মানুষ আসবে, ঘাস চাষ হবে, বিরাট বিরাট ফ্যাক্টরি তৈরি হবে, সেসব ফ্যাক্টরিতে সার তৈরি হবে, পৃথিবীর উন্নতি হবে—মানুষ উপকৃত হবে।

‘এই সভ্যতা প্রকৃতিকে শেষ করে দেয়, তা জানো?’ বললেন প্রফেসর। মাথা নাড়লেন দুঃখের সঙ্গে। ‘এই যে বন, এর কত গুরুত্ব বোঝো? এই বন না থাকলে দেশ মরুভূমি হয়ে যাবে—তখন মানুষ চাষবাস করতে পারবে না, দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরবে। স্বয়ং ঈশ্বর সেজন্যে গাছপালাকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। যদি কেউ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যায়, আখেরে তাকে পস্তাতেই হবে। … যা বলছিলাম,’ বলে চললেন তিনি, ‘দুনিয়ার মানুষের অবিবেচনায় বিরক্ত হয়ে শেষে আমি জঙ্গলে চলে এসেছি। দিনগুলো সুন্দর কাটছে এখানে, বিরক্ত করবে এমন কেউ নেই। …মানুষ শুধু কী চেনে জানো? টাকা আর টাকা। আর কিছু নয়। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, নিজের সর্বনাশ করে, তার পরও তার চাই শুধু টাকা! কী হবে এত টাকা টাকা করে? খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে হলে মানুষের খুব বেশি কিছু লাগে না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের চাহিদার শেষ নেই। অভাব তা-ই কোনদিন মেটে না মানুষের। আসল ব্যাপার কি জানো? মানুষ আসলে সভ্য হয়নি। সভ্য হলে মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট থাকত।’

চমৎকার করে কথা বলেন প্রফেসর। হাঁ করে শুনছে মুসা। বারবার ওর মনে হলো, আণ্টির এক্সপেরিমেন্ট আমাজনকে বদলে দেবে। সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারালে তাতে মানুষের মঙ্গল নেই।

প্রফেসর যেন ওর মনের কথা পড়ছেন। বললেন, ‘আমি জান দিয়ে দেব, কিন্তু মানুষের হাতে এই অরণ্য নষ্ট হতে দেব না। কেউ যদি এই জঙ্গলের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তার চরম সর্বনাশ করতেও বাধবে না আমার। স্রেফ খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলব।’

কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠছেন তিনি। চোখ গরম করে মুসার দিকে তাকালেন, যেন মুসাই আসল কালপ্রিট, বন ধ্বংস করতে এসেছে। ‘আমার অনেক বন্ধু আছে। তাদের অনেকে সরকারী বড় বড় পদে আছে। আমি খবর পেয়েছি, শীঘ্রি আমাজনকে বদলে দেবার পরিকল্পনা করা হবে। তা-ই যদি হয়, আমি একাই সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব।’ স্টিভেনসন কোমরে হাত দিয়ে ভোজালি স্পর্শ করলেন। ওটার ফলা এতই ধারাল যে, এক পলকে ওটা দিয়ে মানুষকে কুচি কুচি করা যাবে।

মুসার মনে হলো মানুষটার রক্তলাল চোখ থেকে আগুন বেরিয়ে আসছে। সে দৃষ্টি স্বাভাবিক মানুষের মত নয়। বদ্ধ উন্মাদের দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি। মুসা ঢোক গিলল, উনি কি জানেন আণ্টি আমাজনকে বদলে দেবার পক্ষে কাজ করছেন?

এই লোক যদি সত্যিই টের পেয়ে যান, ওরা কেউ এই জঙ্গল থেকে জীবিত ফিরবে না!

আট

স্টিভেনসন ভোজালি বের করে ধারালো ফলায় হাত বুলালেন, তারপর মৃদু গলায় বললেন, ‘আমি এটা সব সময় সঙ্গে রাখি। বলা যায় না কখন কী কাজে লেগে যায়।’ তাকিয়ে আছেন তিনি মুসার চোখে, যেন মনের ভিতরটা পড়ছেন!

‘আশা করি এখানে আপনার ওটা ব্যবহার করতে হবে না,’ ঢোক গিলে বলল মুসা, বুকের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ।

‘এখানে? এই বাংলোয়? না, বাছা, এখানে এটার দরকার পড়বে না।’ হাসলেন যাজক। ‘এখানে এমন কেউ নেই যাকে আমি কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলতে চাইব।’

ভোজালিটা আবার কোমরে গুঁজলেন তিনি। ‘তুমি এই বয়সেই বড় বেশি চিন্তা করো,’ মুসাকে বললেন। ‘তোমার বয়সে বাচ্চাদের ছুটোছুটি করা উচিত। অন্য কেউ হলে হয়তো ব্যাং তাড়া করত, বা গাছে উঠে মজা করত। মাছও ধরত হয়তো। এমন রোদেলা দিনে কেউ ঘরে বসে থাকে নাকি! যাও, বাইরে থেকে এক চক্কর ঘুরে এসো, মজা পাবে।’

‘ভাল লাগে না,’ স্বীকার করল মুসা নির্দ্বিধায়। ‘আপনি যে কী করে এই বনে একা পড়ে আছেন, অবাক লাগছে। আমার তো আসার পর থেকেই দম বন্ধ হবার জোগাড়। মনে বলছে কবে ফিরব, আর কবে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।’

‘আর আমি মানুষের ওপর বিরক্ত হয়ে জঙ্গলে চলে এসেছি,’ হাসলেন প্রফেসর। ‘এই মুক্ত আকাশ, এই মুক্ত বাতাস, এই বন্য নিষ্কলুষ প্রকৃতি—চমৎকার লাগে আমার কাছে। ভার্সিটির কোয়ার্টারে যখন থাকতাম, মনে হতো দম বন্ধ হয়ে মরব। তা-ই চলে এসেছি।’

‘আপনার আর কেউ নেই?’

‘নাহ্!’ আপন মনে হাসলেন স্টিভেনসন। বোঝা গেল এই বিপজ্জনক এলাকায় থাকতে পেরে তিনি ভীষণ আনন্দিত।

লোকটাকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাগল না হলে জঙ্গলে থাকে কেউ! হয়তো বদ্ধ উন্মাদ, কিন্তু বোঝা যায় না সহজে। হয়তো যে-কোন সময় রূপ পাল্টে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফায়েজা ঘরের ভিতর একা ছবিতে রং করছে। লোকটা যদি সত্যিই আক্রমণ করে? আণ্টি ওকে ফায়েজার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন!

চট্ করে একবার বাংলোর দরজার দিকে চাইল মুসা। ফায়েজা মনোযোগ দিয়ে রং করছে। স্টিভেনসন হয়তো জানেও না ও ছাড়াও বাংলোর ভিতর আরেকজন আছে। মুসা ঠিক করল, যত দ্রুত সম্ভব লোকটাকে বিদায় করার চেষ্টা করবে।

‘খুব খুশি হয়েছি আপনি দেখা করতে এসেছেন,’ বলল মুসা, ‘কিন্তু…’

‘না, না, এ কিছু নয়।’

‘আসলে হয়েছে কী, আণ্টি আসার আগে আমাকে কিছু কাজ সেরে রাখতে হবে। আমি যদি এখন যাই, তা হলে কি সেটা অভদ্রতা হয়ে যাবে?’ মিথ্যে বলল মুসা। ‘আন্টি শীঘ্রি চলে আসবে।’

‘তোমার আণ্টি তা হলে শীঘ্রি আসবে, না?’ ভ্রূ কুঁচকালেন তিনি। উদাস একটা ভঙ্গি। ‘হয়তো আসবে, হয়তো আসবে না। প্রতিবেশী হিসেবে দেখা করতে এসেছি, কিন্তু বুঝতে পারছি তুমি চাও আমি তাড়াতাড়ি চলে যাই। মাত্র তো পরিচয় হলো। আমার ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে বেশ করে আরও অনেক গল্প করব। তা ছাড়া, এখানে এসেই আমার ভাল লাগতে শুরু হয়েছে।’

এ দেখি কিছুতেই যেতে চাইছে না, চিন্তিত হয়ে ভাবল মুসা।

‘না, না, আসলে আমি আপনাকে বিদায় করতে চাইছি না, ‘ মিথ্যে বলল আবারও। ‘আসলেই কিছু কাজ জমে আছে। তা ছাড়া, এই গরমে কেমন যেন অসুস্থও লাগছে। মাথাটা খুব ধরেছে। কেমন যেন. বমি-বমি লাগছে। মনে হয় জ্বরও আসছে। এখন একটু শুয়ে থাকলে ভাল লাগবে।’

‘বোধহয় আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব,’ বললেন স্টিভেনসন। ‘একটা পুটুলিতে আমি গাছগাছড়া রাখি। ছোটখাটো অসুখ সারিয়ে দিতে এসবের জুড়ি নেই। থাকছি তা হলে আমি। তোমার পাশে এখন কারও থাকা দরকার।’ পকেট থেকে কাপড়ের একটা পুটুলি বের করলেন তিনি।

আগেই মুসা বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, কিন্তু আমি বরং এখন একটু শুয়ে থাকি, তা হলেই ভাল লাগবে।’ একটু থেমে বলল, ‘থাকতে চাইছেন বলে অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমি আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না। কত কাজ ফেলে এসেছেন আপনি! চিন্তা করবেন না, একটু বিশ্রাম নিলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব।’

গোমড়া মুখ করলেন স্টিভেনসন। বোঝা গেল মনে বেশ চোট পেয়েছেন। বললেন, ‘প্রতিবেশীর প্রতি ন্যায্য আচরণ করছ না তুমি, খোকা। বলো, এখানে কথা বলার মত মানুষ আমি পাই? ইংরেজি জানা মানুষ হিসেবে তোমাকে অনেক দিন পর পেয়েছিলাম। ইচ্ছে

অনেক গল্প করব, কিন্তু তুমি যখন আমাকে ভাগিয়ে দিতে চাহছ…. ঠিক আছে, তোমাকে আর বিরক্ত করব না। তা হলে চললাম আমি।’ পা বাড়িয়েও আবার থামলেন। ‘যাব, না থাকব?’

‘আমার শরীরটা ভাল লাগছে না,’ বলল মুসা। ‘পরে না হয় আপনার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করব। তখন অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমরা এখানে সারা সপ্তাহ আছি। এখন একটু বিশ্রাম না নিলে মরেই যাব।’

কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর। ‘তা হলে যাই। যেখানে আমার উপস্থিতি কেউ পছন্দ করছে না, সেখানে থাকা ঠিক নয়। … সত্যি, তুমি আমাকে অবাক করলে। জঙ্গলের ভেতর তোমার বয়সী ছেলে আমার মত জীববিজ্ঞানীকে পেলে কত প্রশ্ন করত, আর তুমি সত্য- মিথ্যা বলে আমাকে তাড়িয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ।’ বাংলোর কোনার কাছে গিয়ে ঘাড় ফেরালেন তিনি। ‘সাবধানে থেকো, এলাকাটা বিপজ্জনক। আমিও কয়েকদিন আশপাশেই থাকব। যদি কোন সাহায্য দরকার হয়, গলা ছেড়ে ডাকতে লজ্জা কোরো না।’ বাংলোর পিছনের জলাভূমির তীর নির্দেশ করলেন আঙুল তুলে। ‘ওদিকে আধ মাইল দূরে আমার আরেকটা ছাপরা আছে। গেলেই আমাকে পাবে। চেঁচিয়ো। আশপাশেই থাকি আমি।’

‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে,’ মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বলল মুসা। ওর বুকের উপর থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেল। বাংলোর দরজার দিকে পা বাড়াল। জানে, একা ও কোনদিনও স্টিভেনসনের ধারেকাছে ভিড়বে না। কোন সাহায্যের দরকার হলেও না।

প্রফেসরের পায়ের আওয়াজ দূরে চলে গেল। লোকটা চলে যেতে এতক্ষণ পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল মুসা, ‘কিলার, আমার সঙ্গে আয়,’ বলে দরজার দিকে এগোল। ঘুরে দেখল পিছনে কোনও শব্দ নেই।

কিলার নেই! কোথায়?

‘কিলার!’ গলা চড়িয়ে ডাকল মুসা। বুড়ো লোকটার সঙ্গে চলে গেল? ওর তো কোথাও যাওয়ার কথা নয়!

‘কিলার!’

ঘেউ-ঘেউ করে ছুটে আসার কথা কিলারের। কিন্তু দেখা নেই। ফায়েজার হাত ধরে বাংলোর চারপাশ একবার ঘুরে এল মুসা। শিস বাজাল।

ডাকল ফায়েজাও।

‘কিলার!’

আসছে না কুকুরটা।

কিলারের স্বভাব মোটেই এমন নয়। দূরে কোথাও যাওয়ার কথা নয় ওর। তা ছাড়া, যেখানেই থাকুক, ডাকলেই ছুটে আসে।

ভয় পেল মুসা। মনের মাঝে কু ডাকছে। আণ্টির আসতেও অনেক দেরি।

নিশ্চয়ই কিলারের কিছু হয়েছে!

স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে কুকুরটা এই গহীন জঙ্গলে। পনেরো মিনিট পার হলো চরম উৎকণ্ঠায়, ফিরল না কিলার।

জাগুয়ার খেয়ে নিল?

কুমির?

সাপে কেটেছে?

যা-ই ঘটুক না কেন, আওয়াজ তো হওয়ার কথা। কোনও সাড়াশব্দ না করেই অদৃশ্য হয়ে গেছে কিলার!

নয়

ফায়েজা কাঁদতে শুরু করল।

‘আম্মু কই! আম্মু কোথায় গেল! আম্মু! আম্মু!’

মুসা বুঝতে পারছে, ও যে ভয় পেয়েছে, সেটা স্পষ্ট টের পেয়েছে ফায়েজা। সেজন্যই আরও বেশি কাঁদছে। নিজেকে শান্ত করল মুসা। এখন মাথা গরম করার সময় না। ফায়েজাকে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি, ফায়েজা। আমরা কিলারকে খুঁজে পাব। ও বোধহয় মজা করে ব্যাং তাড়া করছে।’ নিজের কথা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না মুসা। ‘আণ্টি এখন নেই, কিন্তু একটু পর চলে আসবে। ততক্ষণ এসো, আমরা কিলারকে খুঁজি। মনে করো আমরা কিলারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি, কেমন?’

মাথা দুলিয়ে সায় দিল ফায়েজা, মুসার কথা পছন্দ হয়েছে।

হাত ধরাধরি করে সরু পথটা ধরে কয়েক শ’ গজ এগিয়ে গেল ওরা। কিলারকে ডাকল। কুকুরটার দেখা নেই।

বাংলোয় ফিরে এল ওরা। মুসা বারবার ডাকতে লাগল।

কিলারের কোনও জবাব নেই।

মুসা বুঝল, মাত্র একটা জায়গা খোঁজা বাকি আছে। সেখানে ও যেতে চায় না, কিন্তু না গিয়ে আর কোনও উপায় নেই।

জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে হবে। ঘন এই জঙ্গল। মোটা মোটা গাছ আর লতা-পাতা দিয়ে বোঝাই। সূর্যের আলো মাটিতে এসে পড়তে পারে না। আছে নানা হিংস্র জন্তু।

কিলার বোধহয় জঙ্গলে ঢুকেছে। তারপর পথ হারিয়ে ফেলেছে, ফিরতে পারছে না। ওকে খুঁজে বের করতে হবে।

বাংলোর ভিতর ফায়েজাকে নিয়ে এল মুসা, ভাবছে ভাগ্যিস ফায়েজার কিছু হয়নি। ছবি রং করার বই ধরিয়ে দিল ও ফায়েজাকে। অনেকক্ষণ এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ফায়েজা, সে সময়ে কিলারকে খুঁজে বের করবে মুসা।

‘এখানে বসে থাকবে, ফায়েজা,’ নির্দেশ দিল মুসা। ‘যা-ই ঘটুক, বাংলো ছেড়ে বেরবে না। আণ্টি বা আমি না আসা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকলে কী হবে, জানো? বাড়ি ফিরে তোমাকে চকলেট কিনে দেব।’

ঘাড় দোলাল ফায়েজা। চকলেট ওর খুব প্রিয়। চকলেট যখন পাওয়া যাবে, কথা মত বসে থাকবে ও।

মুসা জঙ্গলের দিকে পা বাড়িয়ে মনে মনে একটা সুরা আউড়ে নিল। ইচ্ছে করছে না যেতে, কিন্তু মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও যেতে হবে। যেতে হবে কিলারের জন্য।

গহীন জঙ্গল। পথ নেই কোনও। গাছের মাঝ দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে এগোতে হলো। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। মাইলের পর মাইল এই একই জঙ্গল।

জঙ্গলের ভিতর গরম আরও বেশি। দরদর করে ঘামছে মুসা, শ্বাস আটকে আসছে।

হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি হতে পারে, সে-ভয় তো আছেই। বেশি ভয় সাপের কথা ভেবে।

এখনও বেশি ভিতরে ঢোকেনি মুসা। জঙ্গলে ঢুকবার আগে শেষবারের মত কিলারের নাম ধরে ডাকল। মনে আশা: বিশাল কুকুরটা এক্ষুণি লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসবে।

‘কিলার!’

সাড়া নেই কোনও। চারপাশে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। সেই স্তব্ধতা ভেঙে ডেকে উঠল একটা ডাহুক পাখি। জবাব দিল একটা তক্ষক সাপ।

এগিয়ে চলেছে মুসা, জানে না কোনদিকে চলেছে। ফিরে যেতে পারবে কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়। কী হবে যদি ও নিজেও হারিয়ে যায়? চিন্তাটাকে প্রশ্রয় দিল না মুসা। ভয় পেলে মনের জোর নষ্ট হয়। পুরুষ মানুষদের ভয়কে জয় করা উচিত।

যতই ভিতরে ঢুকছে, ততই ঘন হচ্ছে জঙ্গল। ভিতরে আলো প্রায় ঢোকেনি বললেই চলে। চারপাশে আবছা অন্ধকার। সূর্যের রশ্মি গাছের পাতার সামান্য কয়েকটা ফাঁক দিয়ে নীচে নেমেছে। সে- আলো স্পষ্ট দেখবার জন্য যথেষ্ট নয়।

দু’হাতে সামনে থেকে ডাল সরিয়ে এগোতে হচ্ছে। মুসার মাথার চারপাশে ভিনভিন করে উড়ছে মাছির দল। এক ঝাঁক মশাও এসে হাজির। পিনপিন আওয়াজ করছে, ঘুরে ঘুরে উড়ছে ওর মাথার চারপাশে।

কিলারের নাম ধরে বারবার ডাকছে মুসা। মোটা একটা গাছ পাশ কাটিয়ে থমকে দাঁড়াল মুসা। কিলারের গলায় বাঁধা কলার একটা লতাগাছের সঙ্গে আটকে আছে!

ওটা হাতে নিয়ে এগোল ও। মন বলছে সামনেই কোথাও আছে কিলার। কলার যখন পাওয়া গেছে, কিলারও ওদিকে আছে।

কুকুরটার হলোটা কী! এতক্ষণে ওর সাড়াশব্দ পেয়ে ছুটে আসার কথা। আসছে না কেন?

সূর্যের আলো এক জায়গায় জঙ্গলের ভিতর এসে পড়েছে। ওখানে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল মুসা। আগে কখনও এমন দৃশ্য দেখেনি।

কিলারকে আর খুঁজবার দরকার নেই। যা দেখেছে তাতে ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল মুসার, অজান্তেই আটকে ফেলল শ্বাস।

একটা গাছের গোড়ায় পড়ে আছে অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা। নিথর। কোনও নড়াচড়া নেই। বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে না।

‘কিলার!’ অস্ফুট স্বরে ডাকল মুসা।

নড়ল না ওটা একচুল। বন্ধ চোখ খুলল না।

মারা গেছে কিলার। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। গলায় পেঁচিয়ে আছে এক মোটা লতা-গাছ।

শ্বাস আটকে মারা গেছে কিলার!

কে মারল?

সে কোথায়?

সে কি মুসাকেও শেষ করে দেবে?

কাছেই অপেক্ষা করছে?

সন্ত্রস্ত চোখে চারপাশ দেখল মুসা। থমথমে পরিবেশ।

কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই।

দশ

কিলারের পাশে গিয়ে বসল মুসা, এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত দিয়ে স্পর্শ করল। শরীরটা এখনও গরম। বেশিক্ষণ হয়নি খুন হয়েছে।

চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না মুসা। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছল। বুঝতে পারছে না এমন কি ঘটল যে কিলারকে খুনই করতে হলো? জঙ্গলের ভিতর কে খুন করল কিলারকে?

কেন?

আণ্টি হলে এখন কী করতেন, ভারবার চেষ্টা করল মুসা। নিজেকে প্রশ্ন করল। জবাবও পেল। আণ্টি হলে চিন্তা করতেন, আগে এ বিষয়ে আরও তথ্য দরকার।

মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। নিজেকে বলল মুসা, মাথা ঠাণ্ডা করো! দিশেহারা হলে চলবে না। যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে হবে।

কিলারের শরীরটা ভাল করে দেখল মুসা।

মুখের ভিতর কিছু নেই। লতা-গাছটা সরিয়ে দেখল। লতা পেঁচিয়ে যাওয়ায় গলায় গভীর দাগ বসেছে। কে লতা পেঁচিয়ে শ্বাস ক মারল কিলারকে? প্রচণ্ড শক্তি ছিল কিলারের। ওকে যে মেরেছে সে নিশ্চয়ই বিশালদেহী।

প্রফেসর স্টিভেনসনের কথা মনে পড়ল মুসার। লোকটার গায়ে বোধহয় কিলারকে মারার মত জোর আছে। এই জঙ্গলের ভিতর সে ছাড়া আর কেউ নেই। এটা তারই কাজ, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছল মুসা। কিন্তু কেন করল, তার কোনও জবাব খুঁজে পেল না।

হয়তো এই স্টিভেনসন বদ্ধ উন্মাদ, নইলে প্রফেসারি ছেড়ে একা এই গহীন বনে বাস করে? হয়তো একে একে ওদের সবাইকে শেষ করবে! হয়তো সেই পরিকল্পনাই এঁটেছে! হয়তো সে জানে আণ্টি আমাজনকে বদলে দিতে এক্সপেরিমেন্ট করছেন!

একটা কথা মনে করে শিউরে উঠল মুসা।

বাংলোয় ফায়েজা একা!

একেবারে একা!

উন্মাদটা হাসতে হাসতে ওকে খুন করতে পারবে!

চোখের পানি মুছল মুসা, মনটা শক্ত করে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে ফিরে চলেছে। কিছুদূর যাওয়ার পর অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো ওর। মন বলল, এটা ভিন্ন কোনও দিক! যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে যাচ্ছে না!

ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করল। কিছু বোঝা গেল না। পরিষ্কার বুঝল মুসা, পথ হারিয়েছে ও। ঠাণ্ডা ঘাম নামতে শুরু করল পিঠ বেয়ে।

এখন?

ভাঙা ডাল বা ছেঁড়া পাতা দেখে দিক ঠিক করতে হবে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না।

হাঁটতে শুরু করল মুসা। একটু পর মনে হলো, একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সবদিকই দেখতে এক রকম। বড় বড় সব গাছ। সূর্যের আলো নীচে নামছে না। সামান্য আলোয় জঙ্গলটাকে ভুতুড়ে লাগছে। একটা আওয়াজ নেই কোথাও। একটা পাখিও ডাকছে না।

হারিয়ে গেছে মুসা।

কোনদিকে বাংলো, তা ওর জানা নেই। ঘোর জঙ্গলের মাঝে ও একা। ফায়েজার জন্য কী করবে ও? নিজের জন্যই তো কিছু করতে পারবে না!

ওদিকে খুনের মত্ত নেশায় বিনা বাধায় ঘুরছে বদ্ধ উন্মাদ এক প্রফেসর। সে হয়তো এতক্ষণে বাংলোর কাছে পৌঁছে গেছে। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে! ফায়েজাকে খুন করবে!

আবার এমনও হতে পারে, লোকটা এখনও জঙ্গলের ভিতর, এগিয়ে আসছে ওর দিকে!

খুন করতে!

এগারো

গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো মুসার। জোর করে কান্না আটকে রাখল। বুঝতে পারছে, হয় ফায়েজা সাঙ্ঘাতিক বিপদে পড়েছে, নয়তো ও নিজে বিপদের মুখে পড়েছে।

যে করে হোক বাংলোয় ফিরতে হবে। ফিরতে হবে দ্রুত। কিন্তু কী করে? কোন্‌দিক থেকে জঙ্গলে ঢুকেছিল, তার কোনও চিহ্ন নেই! চোখে কিছুই পড়ছে না।

চারপাশে আবছা অন্ধকার। পাতার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে চিকন সূর্যরশ্মি মাটিতে পড়ছে। জঙ্গলের ভিতরটা এত অন্ধকার কেন? এত গরম লাগছে যে মনে হয় ওকে সবুজ এক আভেনে ঢুকিয়ে সেদ্ধ করা হচ্ছে।

একটা গাছের ডালে বসে মুসার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল এক বাঁদর, ডাল ধরে ধরে চলে গেল অন্য গাছে। দূর থেকে পাখি ডাকল। ওগুলো নিশ্চয়ই জলাভূমির কাছে। ওদিকে যেতে পারলে হয়তো পথ খুঁজে পাবে ও। আওয়াজ লক্ষ্য করে এগোল।

পিছনে একটা শুকনো ডাল ভাঙার আওয়াজ পেল। ডালটার উপর ভারী কিছু পা দিয়েছে।

ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠল মুসার। সাহস করে ফিরে চাইল। কাউকে দেখতে পেল না। নেই কিছু ওদিকে। তা হলে আওয়াজটা করল কে?

সোজা দৌড় দিল মুসা, জানে না কোনদিকে চলেছে। শুধু বুঝতে পারছে, এখান থেকে সরে যেতে হবে।

সামনের জঙ্গল আরও গহীন। গাছগুলো গায়ে গায়ে লেগে আছে। যেখানে একটু জায়গা পেয়েছে সেখানেই গজিয়েছে ঝোপঝাড়। কোনও কোনওটায় তীক্ষ্ণ কাঁটা! শার্টের কাপড় আটকে যাচ্ছে কাঁটায়! ছাড়াতে গিয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে এগিয়ে আসছে আততায়ী!

নিজেকে সবুজের মাঝে বন্দি বলে মনে হলো মুসার।

যেন সবুজ একটা খাঁচায় পুরে দেয়া হয়েছে ওকে।

সবুজ কবর!

এতই গরম যে শ্বাস নিলে গলা জ্বলে উঠছে। মন বলছে দম আটকে মরেই যাবে ও।

হঠাৎ ওর মনে হলো, একটা গাছের ডাল ওর দিকে এগিয়ে আসছে! ঘাড়ের কাছে পাতার স্পর্শ পেল। গাছগুলো কি সত্যি নড়ছে? কিলারের মত মরতে হবে ওকেও?

কী ভাবছে এসব পাগলের মত? জঙ্গলের আটকা পড়ে, বা গরমে মাথা খারাপ হয়ে গেল ওর?

খুব ক্লান্ত লাগছে ওর। মন বলছে, আর এক পাও এগোতে পারবে না। ধপ করে বসে পড়তে ইচ্ছে হলো। মনের জোরে সামনে বাড়ল মুসা। ওকে এগিয়ে যেতেই হবে।

ডানদিকে আরেকটা ডাল ভাঙল না? কোনও বন্য জন্তু?

সামনে হয়তো ফাঁকা জায়গা আছে। জঙ্গল থেকে বেরতে পারলে বাঁচা যায়। পথ খুঁজে না পেলেও ভাল লাগবে। অন্তত দম বন্ধ হয়ে আসবে না। তা ছাড়া, কপাল ভাল হলে বাংলোয় ফেরার পথও পাওয়া যেতে পারে।

ঝোপঝাড় ভেঙে এগোল মুসা। মনে হলো ঝোপগুলো ওকে এগোতে বাধা দিচ্ছে। গায়ের জোর খাটিয়ে সামনে বাড়ল ও।

বেশ কিছুক্ষণ পর জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। সামনে সূর্যের আলো বেশি। সত্যি, সামনে একটা ফাঁকা জায়গা আছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে চলার গতি বাড়াল মুসা। পরক্ষণে স্বস্তি উবে গেল মন থেকে। বুঝতে পেরেছে এখানে ও একা নয়।

লাফ দিয়ে ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কানা স্টিভেনসন!

লোকটার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। দাঁতের চৌকো ফোকরটা কালো দেখাল। হাতে সেই ক্ষুরধার ভোজালি, সূর্যের আলোয় ঝিকঝিক করছে! লোকটা ওটা মাথার উপর তুলেছে! সরাসরি মুসার ঘাড় লক্ষ্য করে নেমে এল চকচকে ফলা!

উন্মাদটা তার দ্বিতীয় শিকার পেয়ে গেছে!

শিকারটা আর কেউ নয়—মুসা নিজে!

বারো

ভীত চিৎকার বের হলো মুসার গলা দিয়ে।

‘না!’

নিচু হয়ে ভোজালির ফলাটাকে এড়াতে চাইল মুসা। বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে! সময় মত সরতে পারল না!

ভোজালি বাতাসে শিস কেটে ছুটে আসছে!

ঠিক মুসার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল!

একইসঙ্গে স্টিভেনসন মুসাকে আঁকড়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের পিছনে নিয়ে গেলেন।

নীচের দিকে চেয়ে থমকে গেল মুসা। প্রফেসর আসলে ওকে লক্ষ্য করে ভোজালি চালাননি! ভয়ঙ্কর এক কেউটে সাপ লক্ষ্য করে চালিয়েছেন। সাপটা মুসার ঠিক মাথার উপরে একটা ডালে ছিল। আরেকটু হলেই ছোবল দিত ঘাড়ে!

শরীরটা দু টুকরো হয়ে গেছে। অল্প অল্প নড়ছে এখনও। মুখ বারবার হাঁ করছে আর বন্ধ করছে!

‘সর্বনাশ!’ বলে উঠলেন প্রফেসর। ‘আরেকটু হলেই মারা পড়তে! আমার তো মনে হয়েছিল তুমি শেষ!’ বড় করে শ্বাস নিলেন তিনি, ভোজালিটা কোমরে গুঁজে রাখলেন। সাপটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল-কেউটে এটা। সাঙ্ঘাতিক বিষাক্ত। এখন থেকে চোখ- কান খুলে রেখে চলবে। যদি ডোরাকাটা রংচঙে সাপ দেখো, ধরে নেবে ওটা বিষাক্ত। সেক্ষেত্রে দশ হাত দূর দিয়ে ভাগবে।’

মুসার মুখে কথা জোগাল না। প্রফেসর ওর জীবন বাঁচিয়েছেন। মানুষটাকে কী না ভেবেছে! কী ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, ভেবে পেল না ও। এখন বুঝতে পারছে, প্রফেসর নন, বদ্ধ উন্মাদ সেই খুনী অন্য কেউ!

‘প্রফেসর,’ বলল মুসা, ‘জানি না কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব। আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।’

‘ও কিছু নয়, বাছা,’ বললেন স্টিভেনসন। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর আওয়াজ শুনতে পেয়ে বুঝলাম কেউ আছে এখানে। বুঝলাম তুমি ছাড়া আর কেউ না। হয়তো পথ হারিয়ে বিপদে পড়েছ, তা-ই অনুসরণ করলাম। পথ হারিয়েছ?’

‘জি।’ লজ্জায় মুসার চেহারা বেগুনী হয়ে গেল। ‘আপনি আমাকে বলতে পারেন আমাদের বাংলোটা কোন দিকে?’

‘নিশ্চয়ই! আমার পেছন পেছন এসো, এক্ষুণি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।’ মুসার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। ‘এই দেখো দেখি আমি কী রকম মানুষ! এখন পর্যন্ত তোমার নামই জানা হয়নি। নাম কী তোমার, বাছা?’

‘মুসা,’ নিজের নাম বলল ও, তারপর যোগ করল, ‘আর আমার ছোট বোনের নাম ফায়েজা।’

‘তা হলে একটা ছোট বোনও আছে তোমার? ভাল। খুবই ভাল। আমার কোন ভাই-বোন ছিল না।’ বুক পকেট থেকে একটা পাতার বিড়ি বের করলেন প্রফেসর। আগুন ধরিয়ে কষে টান দিলেন। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। ‘খাবে নাকি একটা বিড়ি?’

‘আমি খাই না,’ বলল মুসা। ‘আপনারও খাওয়া উচিত নয়। জিনিসটা খুব ক্ষতিকর।’

‘তা বটে। একদিন হুটুস করে ছেড়ে দেব। কী বলো? ….ঠিক আছে, চলো তা হলে, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। আমার ঠিক দু’পা পেছনে থাকবে। জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ। আরেকটা কথা, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে বাছা বলে ডাকব। নাম ধরে ডাকতে আমার সব সময় ভাল লাগে না।’

ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল মুসা, বুঝতে পারছে প্রফেসর মানুষটা একটু পাগলাটে হলেও আসলে খারাপ নন।

হাঁটতে শুরু করে ভদ্রলোককে জানাল মুসা, কীভাবে ওদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর মারা গেছে।

মলি একটু শুনেই থমকে দাঁড়ালেন প্রফেসর, ঘুরে দাঁড়িয়ে লালচে

চোখে মুসাকে দেখলেন। গম্ভীর হয়ে গেছে চেহারা।

একটা লতা পেঁচানো ছিল কুকুরটার গলায়?’ ভীষণ চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘জি। শ্বাস আটকে মেরেছে।’

‘খুব খারাপ কথা… খুবই… খুবই খারাপ কথা। যা ভাবছি তা যদি হয়ে থাকে, তো ভীষণ বিপদ আসছে সামনে!’

মাটির দিকে তাকালেন প্রফেসর। খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বুলালেন। কালো পট্টিটা সরিয়ে চোখের কোণের চামড়াও চুলকালেন কিছুক্ষণ, তারপর মুসাকে সঙ্গে আসতে হাতের ইশারা করে পা বাড়ালেন।

এগিয়ে চলল ওরা ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।

‘আমাকে বলুন কিলারের কী হয়েছে,’ প্রফেসর চুপ করে আছেন দেখে বলল মুসা। ‘কেন বললেন ভীষণ বিপদ আসতে পারে?’

‘এই এলাকা সম্বন্ধে একটা গুজব চালু আছে। আমি কখনও বিশ্বাস করিনি, কিন্তু এখন আর ততটা নিশ্চিন্ত লাগছে না।’

‘কী গুজব?’

‘ইয়ারুনারা বলে। গাছ কখনও কখনও প্রতিশোধ নেয়।’

‘প্রতিশোধ নেয়?’ অজান্তেই প্রফেসরের গায়ের কাছে সেঁটে এল মুসা। ওদের চারদিকেই অসংখ্য বড় বড় গাছ।

‘ওরা তা-ই বলে। অনেকদিন আগে কয়েকজন ইয়ারুনা এই জঙ্গলে গাছ কাটতে এসেছিল। তারা শুধু প্রয়োজনীয় গাছ কাটেনি, মনের আনন্দে যে গাছ সামনে পেয়েছে, সবই কেটেছে। বিরাট একটা এলাকার বন ওরা তছনছ করে দিয়েছিল বিনা কারণে। ওরা জানত না যে গাছ প্রতিশোধ নেবে। যে নৌকো করে ওরা এসেছিল, সেটাও তো গাছেরই তৈরি। ওরা ফেরার সময় ওই নৌকো খালের পানিতে ডুবে গেল। জঙ্গলে এসে উঠল ইয়ারুনারা। তারপর ওরা আর গ্রামে ফিরতে পারেনি। কয়েকদিন পর আরও কয়েকজন ইয়ারুনা ওদের খুঁজতে এসে দেখল, সবাই মারা গেছে। ওদের গলায় পেঁচানো ছিল মোটা মোটা লতা-গাছ। শ্বাস আটকে মারা হয়েছিল ওদের।’বড় গাছের ডালের বাড়িতে থেঁতলে গিয়েছিল সবার শরীর। খুন করার আগে পিটিয়ে লোকগুলোর হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছিল। সে নাকি ছিল এক বীভৎস দৃশ্য। পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হলো লাশগুলো। খুঁজতে আসা ইয়ারুনারা ফিরে গেল গ্রামে। ওরাই এই গল্প প্রচার করল। তারপর থেকে ইয়ারুনারা পারতপক্ষে এদিকের গহীন বনে আর আসে না।’

তেরো

‘কিন্তু কিলার তো ওদের কোনও ক্ষতি করেনি! ওকে কেন মরতে হলো?’

মুসার প্রশ্নে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। ‘জানি না কেন মরতে হলো। হয়তো ও গাছের গায়ে আঁচড় কাটছিল, বা কামড়ে কোনও ডাল ভেঙেছিল। জানি না। তা ছাড়া আমি এখনও ইয়ারুনাদের ওই কিংবদন্তী পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস আসে না যে গাছ আক্রোশ ভরে মানুষ বা জীব-জন্তু ধরে খুন করবে।’

হাঁটতে হাঁটতে ইয়ারুনাদের কিংবদন্তী মন থেকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করল মুসা। এ সত্যি হতে পারে না। স্রেফ গুজব। মিথ্যে গল্প। গাছ কখনও এমনভাবে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু বার বার মনে পড়ছে কিলারকে শ্বাস আটকে মারা হয়েছে। ওদের উপরও যে হামলা হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

অনেক ভাবে নিজেকে বুঝ দিতে চাইল মুসা। মন থেকে গুজবটা মুছে ফেলতে পারল না। যদি সত্যি…

একটা মোটা লতা মুসার গলায় পেঁচিয়ে গেল। ওটা ছাড়াতে গিয়ে রীতিমত যুঝতে হলো ওকে। শিউরে উঠল মুসা। মনে মনে বলল, এটা কাকতালীয় নয়। লতাটা সত্যি ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেছিল।

আরেকটা লতা ওর হাতে আটকে গেল।

এবার ভীত স্বরে প্রফেসরকে ডাকল মুসা।

ফিরে তাকালেন তিনি, আস্তে করে লতাটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে দিলেন।

‘ভয় পেয়ো না, মুসা, ও কিছু নয়। বড় বেশি চিন্তা করো তুমি। গাছপালা তোমাকে মারতে পারবে না। জঙ্গলে এলে এমনভাবে লতাপাতা তো গায়ে লাগেই। সাবধানে এগোও।’

লজ্জা পেল মুসা। ও যে ভয় পেয়েছে, বুঝে গেছেন প্রফেসর।

প্রফেসরের এক পা পিছনে থাকল ও। মনে হলো হাঁটছে তো হাঁটছেই, পথ আর শেষ হবে না।

শেষপর্যন্ত জঙ্গল শেষ হলো। সামনে সূর্যের আলো দেখা গেল।

স্বস্তিতে ছেয়ে গেল মুসার মন। ভাবল, ও যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।

গরম আরও বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে বাতাসে পানির পরিমাণ। তবুও মুসার মনে হলো, এতক্ষণ পর ও সত্যি করে শ্বাস নিতে পারল। এখনও বেঁচে আছে বলে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিল। ভয়ঙ্কর এই আমাজন আরেকটু হলে ওর কবরস্তান হতো।

মুসা স্পষ্ট বুঝল, প্রফেসর আরেকবার ওর জীবন বাঁচালেন। ‘আমরা এসে পড়েছি,’ বললেন তিনি। ‘ওই সামনেই তোমাদের কুটির। ভয় কমেছে তোমার?’

‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে,’ বলল মুসা। ‘সত্যি আপনি না থাকলে কোনওদিনও ফিরতে পারতাম না। আমার জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি। আমার সঙ্গে আসুন। আমাদের সঙ্গে প্যাকেট করা দুধ আর কমলার রস আছে, আমার সঙ্গে খাবেন।’

‘আবার তাড়িয়ে দিতে চাইবে না তো?’

‘না-না, ছিহ্! তা ছাড়া আপনার গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে।’

প্রফেসর খুশি হয়ে হাসলেন। বাংলোর সামনে পৌঁছে বললেন, ‘আজ নয়, হয়তো কালকে গল্প করতে আসব। আজকে বিকেলে আমার মাছ ধরতে যেতে হবে। বাড়িতে আর মাছ নেই। যাই তা হলে।’ হাত নাড়লেন ভদ্রলোক। ‘সাবধানে থেকো, মুসা। আমি জলাভূমিতে চলেছি, কাজেই তোমার ওপর নজর রাখতে পারব না।’

‘জি, সাবধানে থাকব,’ লজ্জা পেয়ে মাথা নামাল মুসা।

বাংলোর কোনার দিকে পা বাড়ালেন প্রফেসর, কোমরে দুলছে রক্তাক্ত ভোজালি। জলাভূমির পাড় দিয়ে নিজের ছাপরার দিকে চলেছেন। ওখান থেকে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন মাছ ধরতে। পিছন থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল মুসা, প্রফেসর দেখলেন না।

মুসা ভাবল, প্রফেসর বড় ভাল মানুষ। মই বেয়ে বারান্দায় উঠে দরজার কাছ থেকে ডাকল ও, ‘কই, ফায়েজা, আমি এসে গেছি।’

জবাব দিল না ফায়েজা। হয়তো ছবির বই নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

লিভিং রুমে ঢুকে ফায়েজাকে খুঁজল মুসা। এখানে নেই। মাটিতে ছেঁড়া কার্পেট। ওটার উপর ছবি রং করার বই।

ব্যস্ত হয়ে এক এক করে সব ঘর খুঁজল মুসা। ফায়েজা কোনও ঘরে নেই!

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল মুসার।

কিলার মারা গেছে সেটাই যথেষ্ট খারাপ! এখন ফায়েজা গেল কোথায়?

ফায়েজা। ওর ছোট্ট মিষ্টি বোন!

বাইরে বেরিয়ে এল মুসা, বাংলোর চারপাশ দেখল।

নেই ফায়েজা!

‘ফায়েজা! ফায়েজা!’

জোরে জোরে ডাকল মুসা, গলা কাঁপছে।

কোনও সাড়া নেই।

জলাভূমিতে ডুবে গেল নাকি! কুমিরে নিল? ওর পিছন পিছন ফায়েজাও জঙ্গলে ঢোকেনি তো!

কিলারের করুণ পরিণতি মনে আসতেই শিউরে উঠল মুসা।

ফায়েজাও কি…

অন্তত দশবার বাংলোর ভিতর-বাইরে খুঁজল মুসা। মনে মনে প্রার্থনা করছে, হঠাৎ দেখবে ফায়েজা ফিরে এসেছে।

বৃথা আশা। ফায়েজা ফিরল না।

ছবি রং করার বইটার দিকে তাকাতেই নতুন একটা জিনিস চোখে পড়ল মুসার। আগে খেয়াল করেনি।

বইয়ের দু’পাতার মাঝখানে পড়ে আছে ওটা। সবুজ! আঠালো! একটা লতার ডগাও ছিঁড়ে পড়ে আছে!

গাছ!

চোরাগাছ ঢুকেছিল বাংলোর ভিতর!

ফায়েজাকে গাছ নিয়ে গেছে?

কিলারকে ওই লতা-গাছই শ্বাস আটকে মেরেছে?

ফায়েজাকেও সেজন্যেই নিয়ে গেল?

বুকের ভিতরটা ধকধক করছে মুসার।

কোথায় এখন ফায়েজা?

চোদ্দ

বাংলো থেকে বেরিয়ে এল মুসা, দৌড়াতে শুরু করল। কী করবে, কোথায় যাবে, বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝছে বাংলো থেকে বেরিয়ে ফায়েজাকে খুঁজতে হবে।

‘ফায়েজা! ফায়েজা!!’

জঙ্গলের কিনারায় চলে এল মুসা। ফায়েজার কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। যে পথে বাংলোয় আসতে হয় সেটা ধরে এগোল ও। গাছ, লতার ঝাড় আর ঝোপের ফাঁকে দেখছে বারবার।

‘ফায়েজা! ফায়েজা!!’

দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ডানদিকে খসখস আওয়াজ শুনতে পেল। থমকে দাঁড়াল মুসা, তারপর দ্রুত ঢুকল গাছের ফাঁক গলে। জঙ্গল এখানে ঘন। কয়েক পা এগোতেই সূর্যের আলোর রেখা অদৃশ্য হলো।

আওয়াজটা এখনও আসছে। কিছু একটা নড়ছে জঙ্গলের ভিতর। পাতার সঙ্গে পাতা ঘষা খাওয়ার খসখসে আওয়াজ!

‘ফায়েজা!’ চেঁচাল মুসা। ‘ফায়েজা, তুমি কি ওখানে?

জবাবে অস্ফুট একটা জড়িত কণ্ঠ শুনল মুসা। বুঝতে দেরি হলো না আওয়াজটা ওর বোনই করেছে।

জঙ্গলের ভিতর ফাঁদে পড়ে আটকে গেছে ফায়েজা!

আর কিছু চিন্তা না করে দৌড় দিল মুসা। দুটো গাছের মাঝে ঘন মাকড়সার জাল, সেগুলো জড়িয়ে গেল ওর মুখে। অত্যন্ত আঠালো। চোখ খুলতে পারল না মুসা। দু’হাতে ডলে চোখ থেকে মাকড়সার জাল সরাল। একটা কালো বিরাট মাকড়সা ওর বাম কাঁধের উপর বসেছে। গলা বেয়ে উঠতে শুরু করল। হাতের ঝাপটায় ওটাকে ফেলে দিল মুসা।

ফায়েজা চিৎকার করতে চেষ্টা করছে বোধহয়। গলার আওয়াজটা কেমন চাপা শোনাল, যেন কেউ ওর মুখ চেপে ধরেছে। মনে হলো ওর গলা টিপে ধরেছে কেউ!

ঝোপ ভেঙে সামনে বাড়ল মুসা। কাঁটা আটকে গেল শার্টে। হাত-পা ছড়ে গেল। থামল না মুসা। ঝোপ ওকে এগোতে বাধা দিল। সে বাধা তুচ্ছ করে এগোল ও। কাঁটার জ্বলুনি পাত্তা দিল না।

ফায়েজাকে যে করে হোক উদ্ধার করতে হবে।

সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘন ঝোপ। যেন ওকে এগোতে দেবে না।

মনে হলো ওগুলো নড়ছে!

মুসার মন বলল, ইয়ারুনাদের কিংবদন্তী আসলে মিথ্যে নয়!

গাছের গায়ে জড়ানো লতা মুসার হাতে জড়িয়ে গেল। মনে হলো আস্তে আস্তে চেপে বসছে লতাগুলো। গায়ের জোরে লতা ধরে টানল মুসা। ছিঁড়ে গেল ওটা। ও সামনে বাড়ল।

একটা ঝোপ পার হতেই ফায়েজার গলা স্পষ্ট শুনতে পেল। ‘ভাইয়া, ভাইয়া, বাঁচাও!’ চিৎকার করতে চাইল ফায়েজা। আওয়াজ পরিষ্কার হচ্ছে না। সাহায্য চাইছে প্রাণপণে।

লতা-গাছ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ফেলেছে। দ্রুত ওকে উদ্ধার করতে হবে, নইলে সব শেষ!

লতায় জড়িয়ে আছে ফায়েজা। ওর কাছে যখন পৌঁছতে পারল মুসা, ততক্ষণে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ। হাঁপাল ও হাপরের মত।

কয়েকটা লতা-গাছ ফায়েজার পা আর কব্জি পেঁচিয়ে ধরেছে। আরেকটা মোটা লতা গলায় জড়ানো। অল্প-অল্প নড়ছে লতাগুলো!

গলা পেঁচিয়ে ধরা লতার বাঁধন আরও শক্ত হচ্ছে! এরপর শ্বাস আটকে দেবে। তখন ফায়েজাকে অসহায় ভাবে মরতে হবে, যেমন মরেছে কিলার!

পনেরো

ভয়ে আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে এল মুসার।

জঙ্গল ফায়েজাকে খুন করছে, অথচ ওর কিছুই করার নেই!

নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা এল মুসার। ইচ্ছে হলো ছুটে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যায়। চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করে দিল ও, মনে মনে ধমক দিল নিজেকে। ফায়েজার আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখ আর ব্যথায় বিকৃত চেহারা দেখছে ও। হঠাৎ করেই কর্তব্য সচেতন হয়ে উঠল মুসা, সামনে বেড়ে পাগলের মত লতা ছেঁড়ার চেষ্টা করল।

গলায় পেঁচানো মোটা লতাটার গায়ে দাঁত বসিয়ে দিল। শিউরে উঠে ফায়েজার গলা ছেড়ে একটা গাছের গায়ে জড়িয়ে গেল লতাটা, যেন জ্যান্ত সাপ!

ফায়েজা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। এমন ভাবে হাত-পা ছুঁড়ছে যে মনে হলো জেদ করে কাঁদছে।

মুসা আর ফায়েজা, দু’জনই পাগলের মত লতার বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাইছে। বেশ কিছুক্ষণ লতা ছেঁড়ার পর ফায়েজা কিছুটা ছাড়া পেল। ফায়েজা পা থেকে শেষ লতাটা ছাড়িয়ে নিয়েই বাংলো লক্ষ্য করে দৌড় দিল। মুসা জানত না ফায়েজা এত দ্রুত দৌড়াতে পারে। পিছনে ছুটল ও।

জঙ্গলের ঝোপ আর লতা-গাছগুলো পথের সামনে চলে আসছে! ওগুলো সরিয়ে ছুটে চলল দু’জন! মোটা এক গাছের নিচু ডাল বাড়ি দিল মুসার মাথায়!

পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে ফায়েজার পিছু নিল ও।

দু’মিনিট পেরোনোর আগেই বাংলোর পঞ্চাশ ফুট দূরে পৌঁছে গেল ওরা।

‘দৌড়াও, ফায়েজা,’ চিৎকার করল মুসা। ‘আরও জোরে দৌড়াও। সোজা বাংলোর ভিতর গিয়ে ঢুকবে! দৌড়াও!’

পথের দু’পাশের ঝোপ আর লতা-গাছ চেপে আসতে শুরু করেছে! মোটা গাছগুলো ডাল নামিয়ে আনছে! কয়েকটা লতা-গাছ সাপের মত কিলবিল করতে করতে এল, ওদের পা লক্ষ্য করে আসছে!

ওগুলো এড়িয়ে ছুটল দু’জন।

আর পারছে না ফায়েজা। দৌড় না থামিয়েই ওকে কোলে তুলে নিল মুসা, পথের মাঝখানে সরে এল।

ঠিক মাঝ পর্যন্ত আসছে না লতাগুলো। যে দু’একটা ডাল সামনে চলে আসছে, সেগুলোকে ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছে মুসা।

পথের উপর সূর্যের আলো পড়েছে খানিক। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুনের দল!

ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মুসা। ঘামে ভিজে গেছে ওর পোশাক।

কিন্তু থামছে না ও, গোঁয়ারের মত এগিয়ে চলেছে বাংলোর দিকে। গন্তব্যে পৌঁছাতেই হবে যে করে হোক!

বাংলো আর বিশ ফুট দূরে, কিন্তু পায়ে পা বেধে আছাড় খেল মুসা। ওর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ফায়েজা, ব্যথায়-আতঙ্কে কেঁদে উঠল।

গাছের আওতার মধ্যে চলে গেছে ওরা!

আর বড়জোর কয়েক সেকেণ্ড, আবার জড়িয়ে ধরবে লতা গাছ!

মোটা গাছের ডালের বাড়িতে হাড়গোড় ভেঙে যাবে!

ওদের জঙ্গলের গভীরে টেনে নিয়ে খুন করা হবে!

আসবে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাময় মৃত্যু!

ষোলো

লম্বা একটা লতা এগিয়ে আসছে, দেখল মুসা। ওটা একবার ধরতে পারলে ওকে জঙ্গলের ভিতর টেনে নিয়ে যাবে! সেক্ষেত্রে মৃত্যু নিশ্চিত!

শরীরে জোর পেল না মুসা। বামপাশে কয়েক গড়ান দিল। লতার আওতার বাইরে যেতে চাইল। পারলও! উঠে দাঁড়িয়ে ফায়েজাকে তুলে নিতে লাফিয়ে এগোল! একটা ঝোপ ফায়েজাকে আটকে ফেলেছে! ওটা ফায়েজাকে শক্ত করে ধরার আগেই হাত দিয়ে ঝোপ সরিয়ে দিল মুসা, ফারিয়াকে টেনে বের করে নিল। ওকে বুকে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল আবার। মনে হলো ফুসফুস ফেটে যাবে।

বাংলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছে আর পারল না মুসা, ফায়েজাকে নামিয়ে দিয়ে বসে পড়ল। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিল। কাঁদছে ফায়েজা, বারবার করে খালাকে ডাকছে।

‘আম্মু! আম্মু! আম্মু!’

বুড়ো আঙুল মুখে পুরে চুষছে ফায়েজা। ভীষণ ভয় পেলে বা বিচলিত বোধ করলে এমন করে।

মাথার ভারী ভাবটা কেটে যাওয়ার পর আকাশের দিকে তাকাল মুসা। বুকটা শুকিয়ে গেল অশুভ চিন্তায়। মাথার উপর মড়াখেকো কুৎসিত পাখিগুলো ঘুরে ঘুরে উড়ছে। শকুন! অশুভ! মৃত্যুর গন্ধ পায় ওরা! অপেক্ষা করছে অসীম ধৈর্য নিয়ে!

মুসা বুঝতে পারছে পাখিগুলো অপেক্ষা করছে। গলা শুকিয়ে গেল ওর। স্পষ্ট টের পেল, ওরা মরবে সেই অপেক্ষাতেই রয়েছে ওগুলো।

উঠে দাঁড়াল মুসা। ‘চলো, ফায়েজা, বাংলোর ভেতরে যাই! জঙ্গল বা জলাভূমির তুলনায় বাংলোর ভেতরে বিপদ কম!’

ফায়েজার হাত ধরে বারান্দায় উঠল ও, সামনের ঘরে ঢুকে পড়ল। ছবির বইটা চোখে পড়ল। এখনও বইয়ের উপর পড়ে আছে সবুজ লতা আর আঠালো পদার্থ।

‘ফায়েজা, তোমাকে গাছ ধরল কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল মুসা। ‘কীভাবে কী হলো বলতে পারবে?’

আস্তে করে মাথা নাড়ল ফায়েজা, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ‘আম্মু! আম্মুর কাছে যাব!’ বিড়বিড় করে বলল।

‘আণ্টি এখনই চলে আসবেন, ফায়েজা,’ সান্ত্বনা দিল মুসা। ‘সত্যি চলে আসবে একটু পর। এবার বলো কী ঘটেছে। আমার জানা দরকার। বাইরে গেলে কীভাবে? গাছের মাঝে আটকা পড়লে কী করে? একা একা বাইরে গিয়েছিলে, না গাছ ঢুকেছিল ঘরের ভেতর?’

মাথা নাড়ল ফায়েজা।

‘তুমি বাইরে যাওনি? তা হলে এমন হলো কী করে? গাছ তোমাকে ধরল কী করে?’

‘গাছ,’ অবশেষে বলল ফায়েজা। ‘গাছই আমাকে টেনে নিয়ে গেছে!’

তা হলে একটা গাছ বাংলোর ভিতরে ঢুকে ফায়েজাকে টেনে নিয়ে গেছে? এটা এখন নিশ্চিত! এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাংলোর ভিতরে ওরা নিরাপদ নয়!

দু’এক কথায় ফায়েজা জানাল, লতা-গাছ ওকে ধরে অন্য গাছের কাছে নিয়ে গেছে, তারপর সব গাছ মিলে ওকে মারার চেষ্টা করছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারল মুসা, বাংলো ছাড়তে হবে ওদের। এখান থেকে এখনই সরে যেতে হবে।

গাছ যদি একবার ফায়েজাকে নিয়ে যায়, আবারও পারবে না কেন! এবার ওদের দু’জনকেই ধরবে!

কিন্তু যাবে কোথায় ওরা? কোন্ জায়গা নিরাপদ? চারদিকে তো গাছেরই রাজত্ব!

একটা চিন্তা মাথায় আসতে দু’আঙুলে চুটকি বাজাল মুসা। হ্যাঁ,

প্রফেসরের কাছে যাওয়া যায়। তিনি ওদের সাহায্য করতে পারবেন।

কাঁদছে ফায়েজা।

মুসা ওর হাত ধরে বেরিয়ে এল বাংলো থেকে, বাংলোর কোনা ঘুরে এগোল।

জলাভূমির তীর ঘেঁষে এগোল ওরা। গাছের আওতার বাইরে থেকে হাঁটছে। গাছগুলো ডাল বাঁকা করছে, কিন্তু আপাতত বিপদের সম্ভাবনা দেখল না মুসা। ভাবতে চেষ্টা করল, প্রথমে কিলার, তারপর ফায়েজা, তারপর ওর ওপর হামলা করেছে গাছগুলো। কিন্তু কেন? কী চায় ওরা? কেন ওদের ক্ষতি করতে চাইছে?

মনের কাছে কোনও জবাব পেল না।

প্রফেসর হয়তো ওগুলোর আচরণের কারণ বলতে পারবেন।

কিছুক্ষণ পর ছাপরার সামনে পৌছে গেল ওরা।

বাইরে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল মুসা, ‘প্রফেসর স্টিভেনসন! আপনি কি ভেতরে আছেন? বিপদে পড়ে এসেছি। আপনার সাহায্য দরকার। প্রফেসর স্টিভেনসন!’

ওই তরফ থেকে কোনও জবাব নেই।

তিনি কী বলেছিলেন সেটা এতক্ষণে মনে পড়ল মুসার। মাছ ধরতে যাবেন প্রফেসর। তার মানে তাঁর কাছ থেকে কোনও সাহায্য মিলবে না।

মুসা সিদ্ধান্ত নিল, বাংলোয় না ফিরে ছাপরার দরজার সামনে অপেক্ষা করবে। প্রফেসর ফিরলে তাঁকে জানাবে কী ঘটছে। তিনি ঠিক করবেন কী করা যায়।

প্রফেসরের ছাপরার অবস্থা করুণ। ছাদ বেঁকে ভেঙে পড়ার দশা। ছাপরার তুলনায় ওদের বাংলোটা রাজপ্রাসাদ বলে মনে হলো মুসার।

তবে জায়গাটা নিরাপদ। সবচেয়ে কাছের গাছটাও কয়েকশো গজ দূরে। বেঁচে থাকতে হলে এখন গাছের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। এ জায়গাটা অপেক্ষা করার জন্য ভাল।

আপাতত বেঁচে থাকার চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তা নেই মুসার। ভাবছে, এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে পারলে জীবনে আর কিছু চাওয়ার থাকবে না ওর। মন বলল, স্পিড-বোটে চেপে জঙ্গল ছেড়ে এক্ষুণি চলে যায়। তা সম্ভব না বলে আফসোস হলো। আণ্টি জানলে নিশ্চয়ই ওদের নিয়ে রওনা হয়ে যেতেন। এক্সপেরিমেন্টের চেয়ে মানুষের জীবন অনেক মূল্যবান।

একবার আমাজন ছেড়ে যেতে পারলে জীবনে আর এমুখো হবে না, ভাবছে মুসা। তারপর যা দেখল তাতে মনে হলো এত সহজে জঙ্গল ছেড়ে যেতে পারবে না। ভয়ে শিউরে উঠল ও।

এ কী!

এও কি সম্ভব!

ভয়ঙ্কর!

আসছে বিপদ!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে বাধল মুসার।

এগিয়ে আসছে গাছগুলো! ঝোপগুলোও আসছে! শেকড় টেনে টেনে এগিয়ে আসছে!

আসছে ওরা! আসছে! এগিয়ে আসছে! খসখস আওয়াজ করছে,

আসছে!

এতো দ্রুত আসছে যে মুসা ভাল করে কিছু বোঝার আগেই ওদের বাংলোর দিকে যাওয়ার পথ জঙ্গলে ছেয়ে গেল!

বাংলোর দিকে যাবার আর কোনও উপায় নেই!

কোনও দিকেই যাওয়ার উপায় নেই! পালাবার পথ নেই কোনও! সবদিক থেকেই আসছে গাছ! শুধু একদিক বাকি। জলাভূমি! ওদিকটা ফাঁকা!

জলাভূমির দিকেই যাবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল মুসা।

আর কোনও উপায় নেই!

ফায়েজা কি পারবে পানিতে নামতে?

পারতেই হবে! আর উপায় নেই! দরকার পড়লে সাঁতরে যেতে হবে! বাড়ির সামনের পুকুরে ফায়েজাকে এই কদিন আগে সাঁতার শিখিয়েছে বাবা। ফায়েজা সাহস করলে ঠিকই সাঁতরাতে পারবে।

ফায়েজার হাত ধরে ছাপরার পিছনে চলে এল মুসা, দ্রুত হাতে ফায়েজার জুতো খুলে ফেলল, নিজেরটাও খুলল, তারপর পানিতে নেমে পড়ল। হাঁটু পানি মাত্র।

‘চলো, ফায়েজা, সাঁতার কাটি আমরা। কী, মজা হবে না?’ মুসার গলা শুকিয়ে গেছে।

মাথা দুলিয়ে পিছনে এগোল ফায়েজা।

তীর থেকে সামান্য দূরে গিয়েই ওগুলো চোখে পড়ল মুসার। ওর মনে হলো বাঁচার কোনও উপায় নেই ওদের।

কুমির!

দুটো!

বিরাট!

দ্রুত পানি কেটে আসছে!

কালো দুটো মাথা আর লেজের খানিকটা ভেসে আছে। সরসর করে চলে আসছে ওদের দিকে! কুমিরগুলোর হিংস্র লোলুপ চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে!

পশ্চিমে কুমির, বাকি তিনদিকে খুনে গাছ!

এবার প্রফেসর নেই যে ওদের বিপদে সাহায্য করবেন।

‘বাঁচাও!’ চেঁচাল মুসা। মনে আশা, কেউ না কেউ হয়তো চিৎকার শুনতে পাবে, এগিয়ে এসে সাহায্য করবে।

কেউ সাড়া দিল না!

নেই কেউ!

‘বাঁচাও!’

সতেরো

এত জোরে সাহায্য চেয়েছে যে মুসার মনে হলো, গলা চিরে গেছে।

কেউ এল না সাহায্য করতে।

আশপাশে কেউ থাকলে তবে তো আসবে!

ওদের চারপাশে ঘনিয়ে আসছে নিশ্চিত মৃত্যু!

ভয় পেয়েছে ফায়েজা, কাঁদতে শুরু করল।

মুসা জানে, কাঁদার সময় নেই এখন। বিচলিত হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। জলাভূমিতে থাকা চলবে না। আবার জঙ্গলও ভয়ানক।

কী করবে ওরা?

ফায়েজাকে পিঠে তুলে নিয়ে হাঁটু-পানি ভেঙে সামনে বাড়ল মুসা। ছোট লাঠির মত একখণ্ড কাঠ পেয়ে তুলে নিল হাতে। অস্ত্র বলতে এখন এটাই।

কুমির দুটো এগিয়ে আসছে।

সামনে পানি গভীর। ঝপ্ করে ডুবে গেল ওরা! পরমুহূর্তে ভেসে উঠল। ফায়েজাকে সামনে ঠেলে দিল মুসা। ‘সাঁতরাও, ফায়েজা! সোজা সামনে সাঁতরে যাও। আমি আসছি তোমার পেছনে।’

পানি কেটে এগোল ফায়েজা।

এক শ’ গজ দূরে একটা ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে গাছ নেই।

কিন্তু এক শ’ গজ এখন চাঁদের চেয়েও দূর!

নলখাগড়ার ভিতর দিয়ে কুমির দুটো এগিয়ে আসছে! গতি ক্রমেই বাড়ছে! এখনও ডুব দেয়নি। ডুব দেয়া মানে সর্বনাশ। শিকার ধরার জায়গা ঠিক করে ফেললে তখনই ডুব দেয় কুমির। তারপর পানির নীচ দিয়ে এসে হামলা করে।

পানিতে কুমিরের সঙ্গে পারবে না, মরতেই হবে! ঘুরে দাঁড়াল মুসা। হাতের দণ্ডটা বাগিয়ে ধরেছে। বিনা যুদ্ধে হার মানতে রাজি নয়!

একটা কুমির ফায়েজার দিকে চলেছে। ওটা পাশ কাটানোর সময় সুযোগ ছাড়ল না মুসা, নাকের উপর দড়াম করে লাঠির বাড়ি দিল। ঝট করে ঘুরে গেল কুমির—ওর দিকে!

হাঁ করে তেড়ে এল এবার। আবার ওটার নাকে বাড়ি দিল মুসা, পরক্ষণে চোখে খোঁচা মেরে বসল।

ব্যথায় শিউরে উঠল কুমির, দেহটা আছড়াল। যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে ঘুরে সরসর করে রওনা হয়ে গেল। অদ্ভুত শত্রুকে আক্রমণের শখ মিটে গেছে।

দ্বিতীয় কুমির কাছে চলে এসেছে। লেজ নেড়ে গতি বাড়িয়ে আসছে। মুখটা হাঁ করা। বড় বড় হলদে দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল মুসা।

কুমিরটা একেবারে কাছে চলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ও। ওটার চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পেল। মাত্র এক ফুট দূরে এসে ডুব দিল। মুসাকে পানির নীচে টেনে নেবে।

মুসা পানিতে আধ ডোবা হলো, কাঁপা হাতে কুমিরটার চোয়ালে লাঠিটা ভরে দিল। হাঁ করা চোয়ালে আটকে গেছে লাঠি। মুখ বন্ধ করতে পারল না কুমির। হিসহিস করে উঠল। রাগে লেজ আছড়াল পানিতে। জোর এক কামড়ে লাঠি ভেঙে ফেলল। মড়াৎ!

এক পলকের জন্য ফায়েজাকে দেখল মুসা, তীরের কাছে চলে গেছে ও। ক্ষণিকের জন্য অন্তরে স্বস্তি পেল মুসা।

কুমিরটার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। বোধহয় লাঠির চোখা মাথা গালের মাংস কেটে দিয়েছে। আক্রমণ করল না ওটা, সঙ্গীর পিছু নিয়ে চলে গেল।

মস্ত শ্বাস ফেলল মুসা। সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে।

এবারের মত বেঁচে গেছে ওরা!

তীরে উঠে ফায়েজার পাশে কাদার মধ্যে বসল ও, হাঁপিয়ে গেছে। দু’জনের জামাকাপড় থেকে ঝরঝর করে ঝরছে পানি।

‘দারুণ দেখিয়েছ, ফায়েজা,’ প্রশংসা করল মুসা। ‘সত্যি খুব সাহস আছে তোমার। বাড়ি ফিরে তোমাকে চকলেট কিনে দেব।’

‘আম্মুর কাছে যাব,’ দাবির সুরে বলল ফায়েজা।

ওকে দোষ দিতে পারল না মুসা। ওরও মন বলছে আণ্টি এলে খুব ভাল হতো। এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনও পথ হতো। একা অসহায় লাগছে ওর।

আকাশের দিকে তাকাল, শকুনগুলো এখনও উড়ছে। খাবারের আশা ছাড়েনি। গোল, রক্তলাল সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। এখনও প্রচণ্ড তাপ বিলাচ্ছে।

‘আণ্টি শীঘ্রি বাসায় ফিরবেন,’ সান্ত্বনা দিল মুসা। ‘চলো, আণ্টি বোধহয় এরইমধ্যে ফিরে এসেছেন।’

মনে মনে প্রার্থনা করল, ওর ধারণা যেন সঠিক হয়।

জীবনে কোনওদিন এত ক্লান্ত হয়নি ও। ফায়েজার অবস্থাও ভাল নয়। এখনও হাঁপাচ্ছে।

হাত ধরাধরি করে বাংলোর দিকে ফিরল ওরা। পথে কয়েকটা ঝোপ ওদের ধরতে চাইল। ওগুলো ভেঙে এগোতে হলো।

গাছের সারি জলাভূমির দিকে অনেক সরে এসেছে। এখন আর তীর দিয়ে গেলে জঙ্গল খুব দূরে নয়! গাছগুলো ঝুঁকে সামনে চলে আসতে চাইছে।

তীরের কাছাকাছি থাকতে হবে ওদের। মাঝে মাঝে অল্প পানিতেও নামল ওরা। ঝুঁকে আসা গাছ এড়াল।

কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ের পর আত্মবিশ্বাস জন্মেছে মুসার। ওর মনে হলো, লতা-গাছের আক্রমণও ঠেকাতে পারবে। একবার বাংলোর ভিতরে ঢুকতে পারলে আর অসুবিধা হবে না।

তা ছাড়া, আণ্টি শীঘ্রি ফিরবেন। ওরা এই বিপজ্জনক জঙ্গল থেকে চলে যাবে। স্পিড-বোট তো আছেই!

বাংলোর কী পরিবর্তন হয়েছে সেটা এতক্ষণে চোখে পড়ল মুসার।

স্পিড-বোট যে জেটিতে থাকে, সেখান থেকে বাংলোয় যাওয়ার পথ আর নেই! ফাঁকা জায়গাটা ভরে গিয়েছে গাছে! ঝোপ-লতা-গাছ জড়াজড়ি করে মিশে দেয়াল তুলে দিয়েছে যেন!

বাংলোর চাল সবুজ লতায় ঢেকে গেছে।

মা আস্তে আস্তে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আসছে জঙ্গল! চারপাশ থেকে ওদের ঘিরে ফেলবে!

মুসা বুঝল, জঙ্গল ওদের গিলে নেবে—বাইরের দুনিয়ার কেউ জানবে না ওদের কী হয়েছে। সবাই ভাববে ওরা গহীন গভীর আমাজনে হারিয়ে গেছে।

ওদের লাশও খুঁজে পাবে না কেউ!

আঠারো

সবুজ গাছপালা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই। মুসা ভাবল, বাংলোর চার দেয়ালের ভিতর কিছুটা নিরাপত্তা আশা করা যায়।

অনেক বেশি ক্লান্ত ফায়েজা। দৌড়াতে পারবে না। ওকে কোলে তুলে নিল মুসা, দৌড়ে বাংলোর দিকে এগোল। লতাগুল্মের বাধা এড়িয়ে বারান্দায় উঠল, চলে গেল দরজার কাছে।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। মোটা এক লতা ফায়েজার হাত পেঁচিয়ে ধরেছে!

মুসা আর লতা-গাছের মধ্যে টানাটানির লড়াই শুরু হলো। হাতের ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ফায়েজা। আরও জোরে টান লাগাল মুসা বোনের কান্নায় কান দিল না।

পিছলে গেল লতার বাঁধন। ফায়েজার হাত মুক্ত হয়ে যেতেই দেরি করল না মুসা, সামনের ঘরে ঢুকে পড়ল। ফায়েজাকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়েই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল, লতাগাছ থ্যাপ্ করে দরজায় বাড়ি খেল।

‘আম্মুর কাছে যাব! আম্মু! আম্মু!’ কাঁদছে ফায়েজা।

‘আসবে আম্মু, ফায়েজা, কেঁদো না,’ সান্ত্বনা দিল মুসা। ‘আমিও চাই আণ্টি তাড়াতাড়ি আসুন। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মত শান্ত হও তো। ওই গাছগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে হবে আমাদের। আন্টির জন্যে অপেক্ষা করব আমরা। উনি বলতে পারবেন কী করা উচিত।’

চালের উপর গাছ নড়াচড়ার আওয়াজ শুনল মুসা। লতা-গাছগুলো সাপের মত মোচড় খেয়ে দীর্ঘ হচ্ছে! বোধহয় জানালা দিয়ে ভিতরে ঢোকার মতলব!

চাল থেকে ঝুলছে লতা-গাছ। ঝোপগুলো জানালার কাছে চলে এসেছে! একটা লতা জানালা দিয়ে ঢুকতে শুরু করল!

গাছের দল বাংলোটা ঘিরে ফেলছে!

ফাঁদে পড়ে গেছে মুসা আর ফায়েজা। অসহায়! শাহানার শোবার ঘরে কী যেন পড়ে গেল। ঝনঝন করে শব্দ হলো। কাউচে বসে কাঁদছে ফায়েজা। ওকে রেখে দৌড়ে ওই ঘরে গেল মুসা। দরজার কাছ থেকে এক নজর দেখেই বুঝল, বিপদ বাড়ছে ওদের! গাছের আক্রমণের গতি বেড়ে গেছে!

কয়েকটা লতাগুল্ম বাংলোর ভিতরে ঢুকে পড়েছে!

মোটা এক গাছের সরু লতানো ডাল জানালা গলে ঢুকে পড়েছে! ড্রেসারের উপর রাখা মাটির ফুলদানী ধাক্কা খেল, মেঝেয় পড়ে গেল। লতা-গাছ ও মোটা গাছের কয়েকটা ডাল আন্টির ঘর পেরিয়ে এসেছে, সামনের ঘরের দিকে আসছে!

মোটা গাছের ডালগুলো মটমট করে ভাঙল মুসা, লতা-গাছের উপর জানালা বন্ধ করে দিল। লতা-গাছ ছিঁড়ে পড়ে গেল। মনে হলো কেউ কুঠার দিয়ে কেটেছে ওগুলো।

একটা ডাল জানালায় বাড়ি খেল। কিন্তু খুলল না জানালা। মনে হলো গাছ জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে পারবে না!

ঠিক তখনই মুসার মনে পড়ল, বাংলোয় আরও জানালা আছে! প্রত্যেকটা জানালা খোলা! ঢুকে পড়তে পারে গাছ!

সামনের ঘরে ফিরল মুসা। সোফায় গুটিসুটি মেরে বসেছে ফায়েজা। লতা-গাছ আসবার আগেই জানালা দুটো বন্ধ করে দিল মুসা।

সমস্ত জানালা বন্ধ করে দেয়ায় বাংলোর ভিতরটা আগুনের মত গরম ঠেকল। গাছের হাত থেকে বাঁচতে হলে ওদের গরম সহ্য করতে হবে। এখন ওদের কাঠের বাংলো গাছের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পারলে হয়!

মুসার মন বলল, ওরা আপাতত নিরাপদ। এতক্ষণে একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলল ও।

কিন্তু হঠাৎ বাংলোর পিছন দিক থেকে দড়াম করে আওয়াজ হলো। যেন ভারী কিছু মেঝেতে পড়েছে!

মুসা শিউরে উঠল। ফায়েজা আর ওর শোবার ঘর? ওটার জানালাটা বন্ধ করা হয়নি!

‘ফায়েজা, চুপ করে বসে থাকো, নির্দেশ দিল ও। ‘এখান থেকে নড়বে না।’

দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকল মুসা। তিনটে লতা-গাছ ভেতরে ঢুকে পড়েছে!

বিরাট লতা এগুলো। আরও দীর্ঘ হচ্ছে, ঢুকে পড়ছে ঘরের আরও ভিতরে! প্রতি সেকেণ্ডে এক ইঞ্চি করে সামনে বাড়ছে!

ড্রেসারটাকে পেঁচিয়ে ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিয়েছে, সেই শব্দ পেয়েছে মুসা। লতাগুলো এখন ওর দিকে এগিয়ে আসছে!

ওগুলোর সঙ্গে যুঝবে, নাকি দরজা বন্ধ করে সামনের ঘরে আশ্রয় নেবে, ভাবল মুসা। পালাবে, নাকি পালাবে না? বুঝতে পারছে, এরপর ঘরে ঢুকবে বড় গাছের ডাল। ওগুলো শোবার ঘরের পলকা দরজা অনায়াসে ভাঙবে। সত্যি যদি বড় গাছের ডাল ঢোকে, ফায়েজা আর ওর বাঁচার কোনও আশা নেই!

লতাগুলোর বিরুদ্ধে এখনই লড়াই করা উচিত! জানালা বন্ধ করে দিতে পারলে… হাতে বাড়তি সময় পাওয়া যাবে!

বিছানার পাশ দিয়ে দৌড় দিল মুসা, জানালার দিকে এগোল! লতা-গাছ ওকে পেঁচিয়ে ধরলেই সব শেষ! জানালা সজোরে বন্ধ করলে লতা-গাছ কাটা পড়বে! কিন্তু ওর আশা পূরণ হলো না। জানালার কাছে যেতেই আটকা পড়ল! মেঝেয় পড়ে থাকা সবুজ আঠালো জিনিসগুলো বাম পা আটকে দিয়েছে!

নড়তে পারল না মুসা!

মারাত্মক আঠা!

অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

‘বাঁচাও!’

স্পষ্ট বুঝল, এবার আর রক্ষা নেই!

লতা-গাছগুলো ঘুরতে শুরু করেছে। সরসর করে ওর দিকে আসছে!

ওগুলোর কবল থেকে বাঁচবে সেই সাধ্য মুসার নেই! পা নড়াতে পারছে না!

উনিশ

একটা ট্র্যাভেলার্স পাম গাছ জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকল। অসংখ্য পাতা ওটার ডাল পেঁচিয়ে আছে। আন্টির কথাগুলো মনে পড়ল মুসার। উনি বলেছিলেন প্রতিটা পাতার ভিতরে বিশুদ্ধ পানি থাকে। বাঁচবার আশা জেগে উঠল ওর মনে। পাতা ছিঁড়ে মেঝেতে পানি ফেললে? আঠার হাত থেকে পা ছাড়াতে পারবে? অন্তত চেষ্টা তো করা যায়!

পানি আর সাবান দিয়ে ড্রেসারের উপর থেকে আঠা পরিষ্কার করেছিলেন আণ্টি!

ওরও চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী! ওকে শ্বাস আটকে মারতে এগিয়ে আসছে লতা-গাছ। হারানোর কিছু নেই ওর।

ট্র্যাভেলার্স পামের বড় একটা পাতা ছিঁড়ে নিল মুসা, পানিটুকু পায়ের পাতার উপর ফেলল। সেই সঙ্গে পা মেঝের সঙ্গে ঘষল। আঠা থেকে সরে আসতে চাইল।

পাম গাছের একটা পাতা ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল। হাতের টানে পাতাটা ছিঁড়ে ফেলল মুসা, পা ঘষে চলেছে পাগলের মত। বুঝল, হাতে সময় নেই! লতাগাছ এখনই ওকে পেঁচিয়ে ধরবে!

পানি দেয়ায় কাজ হচ্ছে। পা নাড়তে পারল ও শেষ পর্যন্ত।

কিন্তু হাতে সময় কই?

দেরি হয়ে গেছে!

মোটা একটা লতা ওর বুক পেঁচিয়ে ধরল! ওকে জানালা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর টান দিল! পেঁচিয়ে ধরল আরও দুটো লতা! এবার আর রক্ষা নেই!

ওগুলো হিড়হিড় করে মুসাকে জানালার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে!

হাল ছেড়ে দিল মুসা। বুঝেছে, বাঁচার আর কোনও আশা নেই!

ঠিক তখনই খচ করে একটা শব্দ হলো!

ঠিক জানালার সামনে পড়ে গেল মুসা।

প্রফেসর স্টিভেনসন! ফিরে এসেছেন তিনি, কুঠারের কোপে লতাগুলোকে কেটে দিয়েছেন!

গাছের ডালে কোপ মারতে মারতে চিৎকার করে বললেন, ‘দৌড় দাও, মুসা! সামনের ঘরে চলে যাও! অপেক্ষা করো ওখানে!’

মুসার বাঁ পায়ে এখনও আঠা, কিন্তু মেঝে থেকে পা ওঠাতে পারল। সামনের ঘরে চলে এল, ফায়েজার পাশে সোফায় এসে বসল। জানালার কাঁচের ওপাশটা প্রায় ঢেকে দিয়েছে লতাগুল্ম!

ওদের শোবার ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল! কুঠার হাতে প্রফেসর ভিতরে ঢুকলেন, থমথম করছে চেহারা। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বলো তো, মুসা, কী করেছ তুমি? গাছ নষ্ট করছিলে? ডাল ভাঙছিলে ইচ্ছে মত? এমন তো হবার কথা নয়!’

‘আমি কিছু করিনি,’ বলল মুসা। ‘কেন এসব ঘটছে তা-ও জানি না! গাছগুলো হঠাৎ আমাদের ওপর হামলা করেছে! আমি কোনও গাছের ক্ষতি করিনি!’

‘বিনা কারণে এমন হতে পারে না,’ বললেন স্টিভেসন। ‘অনেক দিন ধরে এখানে আছি, এমন বিটে ঘটনা আগে দেখিনি। নিজের চোখে যদি না দেখতাম, কেউ শপথ করে বললেও বিশ্বাস করতাম না। এখন আমাকে জানতে হবে কেন…’

কাচ ভেঙে পড়ার ঝনঝন আওয়াজে থেমে গেলেন প্রফেসর।

প্রথমে ভাঙল মুসাদের শোবার ঘরের জানালার কাঁচ!

একই ঝনঝন আওয়াজ এবার ভেসে এল শাহানার শোবার ঘর থেকে!

কী ঘটছে দেখতে দৌড়ে গেলেন প্রফেসর। মুহূর্ত পরে ফিরে এসে বললেন, ‘গাছ, মুসা! ওগুলো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে! আমি ডাল কাটতে চললাম! তোমরা এখান থেকে নড়বে না!’

‘কিন্তু প্রফেসর,’ প্রতিবাদ করল মুসা। ‘গাছ তো আপনাকেও ধরবে! মেরে ফেলবে! একা আপনি এত গাছের সঙ্গে পারবেন না!’

‘আমি এখনও গাছের এমন বড় কোনও ক্ষতি করিনি যে আমাকে ধরতে আসবে,’ শান্ত গলায় জানালেন তিনি। ‘ওরা আমার ওপর খেপে ওঠার আগে খানিকটা সময় পার। যা বলছি করো। এখানে অপেক্ষা করবে।’

পরবর্তী কয়েক মিনিট প্রফেসরের কুঠারের আওয়াজ শোনা গেল। দুই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে যেসব গাছ ঢুকেছে, সেগুলো পাগলের মত কাটলেন তিনি। একটু পর ঘর দুটোর দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে এলেন। হাঁপাচ্ছেন।

‘পাতলা কাঠের দরজা বেশিক্ষণ গাছদের ঠেকাতে পারবে না, জানালেন। ‘এত দ্রুত গাছের ডাল ঢুকছে যে ভয় লেগে গেছে আমার। একটা বুদ্ধি বের করতে হবে, নইলে বাঁচব না আমরা।’

‘আমাদের কী করার আছে, প্রফেসর?’ হতাশ গলায় বলল মুসা। গলা কাঁপছে ওর। লক্ষ করল হাঁটু দুটোও কাঁপছে। পরিশ্রমে, না ভয়ে, তা বুঝল না।

ফায়েজা আবার কাঁদছে।

‘চিন্তা কোরো না, ফায়েজা,’ ভরসা দেয়ার চেষ্টা করল মুসা। ‘কিছু হবে না আমাদের।’

‘আম্মুর কাছে যাব,’ কাঁদতে কাঁদতে বলল ফায়েজা।

‘কিছু একটা ঘটেছে যে-কারণে গাছের দল খেপেছে,’ জোর দিয়ে বললেন প্রফেসর, যেন নিজের সঙ্গেই আলাপ করছেন। ‘এমনিতে এমন হবার কথা নয়।’ মুসার দিকে চাইলেন। ‘চিন্তা করে দেখো তো, মুসা। তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছ যে-কারণে জঙ্গল তোমাদের খুন করতে চাইছে।’

বাইরে একটা শব্দ হলো।

কেউ আসছে!

প্রফেসর লতা-গাছের কারণে জানালা দিকে কিছু দেখতে পেলেন না। দরজাটা খুললেন, সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকল এক মোটা গাছের ডাল! ওটার উপরই দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। ভিতরে যে অংশটা রয়ে গেল, সেটা কুঠারের এক কোপে কেটে দিলেন।

দরজার তলা দিয়ে সরু একটা লতা ভিতরে ঢুকল, সাপের মত এঁকেবেঁকে এগিয়ে এল! মুসা আর ফায়েজা যে সোফায় বসেছে সেটার দিকে আসছে!

ভীত চোখে তাকিয়ে থাকল ফায়েজা, কাঁদতে ভুলে গেছে।

লতাটা এক কোপে কেটে দিলেন প্রফেসর। আরও লতাগুল্ম ঢুকল। ওগুলো কচাকচ কাটলেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘এদের এভাবে কতক্ষণ ঠেকাতে পারব, বুঝতে পারছি না। অবস্থা সুবিধের মনে হচ্ছে না।’

একের পর এক লতা ঢুকছে আর কুঠার চালিয়ে কাটছেন তিনি। ঘেমে নেয়ে গেছেন। কোপ মারার সময় মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছেন। ‘হুপ্! হুপ্!

শোবার ঘরের দরজার তলা দিয়ে গাছের ডাল ঢুকতে শুরু করেছে! সোফার দিকে এগিয়ে আসছে! সামনের ঘরে একটা জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ল! হিলহিল করে ভিতরে ঢুকল একগাদা লতা!

পাগলের মত কুঠার নামিয়ে আনছেন প্রফেসর, তারই ফাঁকে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘জান নিয়ে দৌড় দেয়ার জন্যে তৈরি হয়ে যাও, মুসা! ফায়েজাকে নিয়ে যেভাবে পারো পালাবে! আমি গাছগুলোকে এখানে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করব! জঙ্গল জিতে গেছে, এখানে থাকলে আমাদের সবাইকে মরতে হবে!’

বিশ

পাগলের মত ঘুরে ঘুরে গাছের ডাল কাটছেন প্রফেসর। চারপাশ থেকে গাছের ডাল আর লতা ভিতরে ঢুকছে! এক জায়গার ডাল কাটতে না কাটতেই অন্য দিক থেকে আসছে আক্রমণ! পরিশ্রম করে কোনও লাভ হচ্ছে না!

দরদর করে ঘামছেন প্রফেসর, হাঁপাচ্ছেন পরিশ্রমে।

হঠাৎ দরজার নীচে দিয়ে ভিতরে ঢোকা সমস্ত গাছের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল! বাংলোর দরজাটা খুলে গেছে! ভিতরে ঢুকলেন শাহানা আক্তার। তাঁর হাতে তিনটে টেস্ট টিউব। তাতে রূপালি তরল। তারই খানিকটা তিনি লতাগাছগুলোর উপর ছিটিয়ে দিলেন। ওগুলো সঙ্গে সঙ্গে নিথর হয়ে গেল। জিনিসটা বোধহয় অ্যাসিড জাতীয়। যেখানে পড়েছে সেসব জায়গা শুকিয়ে যাচ্ছে।

‘আণ্টি!’ মুসা সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘আম্মু!’ দৌড়ে গিয়ে শাহানাকে জড়িয়ে ধরল ফায়েজা।

দরজাটা বন্ধ করে দিলেন শাহানা, তারপর ফায়েজার চুলে বিলি কেটে দিলেন।

‘মুসা, ফায়েজা! তোমাদের জন্যে খুব চিন্তায় ছিলাম। পথ করে আসতে পারছিলাম না বাংলোয়, তা-ই…’ টেস্ট টিউব দেখালেন, ‘পারদ দিয়ে গাছ মেরে ভেতরে ঢুকতে হলো। এ যেন সত্যিকার একটা দুঃস্বপ্ন। মরে যাওয়া গাছের জায়গায় নতুন গাছ চলে আসছে!’

এতক্ষণে প্রফেসর স্টিভেনসনকে দেখতে পেলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন কড়া গলায়, ‘কে আপনি? আপনিই এসব পাগলামির জন্যে দায়ী? কেন ক্ষতি করতে চাইছেন আমাদের?’

‘উনি প্রফেসর স্টিভেনসন,’ তথ্য জোগাল মুসা। ‘জীব-বিজ্ঞানী। উনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। উনি না থাকলে আমরা এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতাম।’

শাহানা আক্তার কিছু বলবার আগেই তাঁর দিকে তর্জনী তুললেন প্রফেসর। তাঁর চেহারায় গনগনে রাগের ছাপ।

‘তা হলে আপনিই দায়ী!’ অভিযোগের সুরে বললেন তিনি। ‘আপনিই আমাজন ধ্বংস করতে এসেছেন? কী করেছেন আপনি! নিরীহ গাছগুলো খুনি হয়ে গেল কেন? আপনি নিজেকে বিজ্ঞানী মনে করেন?

‘কী যাতা বলছেন,’ শাহানা আক্তারকে কিছুটা হতভম্ব দেখাল। ‘আমি আমাজনের কোনও ক্ষতি করিনি। খামোকা করব কেন?’

ঠিক তখন গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারল মুসা।

গাছদের এই আচরণের জন্য আসলে আণ্টিই দায়ী! ওঁর গবেষণা দায়ী।

ঠিকই বলেছেন প্রফেসর।

আণ্টির এক্সপেরিমেন্টের কথা মনে পড়েছে ওর। তাঁর এক্সপেরিমেন্ট সফল হলে এই জঙ্গল আর থাকবে না। মানুষ আসবে, ঘাস চাষ করবে, বিরাট বিরাট ফ্যাক্টরি তৈরি হবে, সেসব ফ্যাক্টরিতে সার বানানো হবে, পৃথিবীর উন্নতি হবে—মানুষ উপকৃত হবে… কিন্তু জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাবে!

মুসা বলে উঠল, ‘আপনার এক্সপেরিমেন্ট, আণ্টি! ঘাস থেকে সার বানানোর পরিকল্পনা! আমি বুঝতে পেরেছি! আপনি সফল হলে এখানকার জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছগুলো সেজন্যেই আক্রমণ করছে! ওরা লড়ছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে!’

‘তা অসম্ভব, মুসা,’ বললেন শাহানা। ‘এ স্রেফ অসম্ভব। এর পেছনে কোনও যুক্তি নেই। তা ছাড়া ওরা জানবে কী করে আমি কী কাজে এখানে এসেছি?’

‘আপনিই তো সেদিন বললেন আমাদের। ওরা কোনও ভাবে টের পেয়ে গেছে, বুঝে ফেলেছে আপনার উদ্দেশ্য।’

‘অসম্ভব! তা কী করে হয়? গাছগুলো ইংরেজি জানে? আমার কথা ওরা বুঝবে কী করে?’

‘আপনি কি পাগল নাকি!’ খেপাটে গলায় বললেন প্রফেসর। ‘আপনি ভেবেছেন গাছ কেটে ঘাসের চাষ চালু করবেন? ভেবেছেন লোকজন এসে জঙ্গল নষ্ট করবে, জঙ্গলের প্রাণীদের আবাসভূমি শেষ করে দেবে, আর ওরা তা নীরবে সহ্য করবে? জীবিত সবকিছুরই বংশবৃদ্ধির অধিকার আছে! আজকে কেউ আপনার ছেলে-মেয়েদের মেরে ফেলতে চাইলে আপনি বাধা দেবেন না? গাছরাও ঠিক তা-ই করছে! নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাল রাখতে মারমুখী হয়ে উঠেছে! জঙ্গল চায় না মানুষ অবিবেচকের মত ধ্বংসলীলায় মেতে উঠুক! এতে আখেরে মানুষেরও চরম সর্বনাশ হবে!’

শাহানা আক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। কী যেন ভাবছেন। মনে মনে প্রফেসরের কথায় সায় না দিয়ে পারলেন না।

‘এসব গাছের সারের কোনও প্রয়োজন নেই,’ বললেন প্রফেসর। ‘এমনিতেই ভাল আছে। এখন চিন্তা করে দেখুন কীভাবে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আপনার পারদ তো প্রায় শেষ দেখছি। জঙ্গলে গাছের শেষ নেই। ওগুলোর হাত থেকে কীভাবে বাঁচবেন, কিছু ভেবেছেন?’

কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন শাহানা, তারপর আস্তে করে মাথা নাড়লেন। ‘কোনও বুদ্ধি আসছে না। কী করা উচিত, আপনি বলতে পারেন?’

মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ‘আমি জীববিজ্ঞানী। উদ্ভিদের ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না।’

বাইরে মরিয়া হয়ে উঠেছে গাছগুলো। ঢুকতে চাইছে ঘরে।

হঠাৎ শাহানা আক্তারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘প্রফেসর, একটু আগেই আপনি কী বলেছেন মনে আছে? আপনি বলছিলেন আমার সন্তানদের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমি বাধা দেব? মাতৃত্বের কথা বলছিলেন আপনি! এক কাজ করলে কেমন হয়? আমিও তো মা! আমি যদি গাছদের জানাই ওদের সন্তানদের কোনও ক্ষতি করা হবে না? যদি কথা দিই? ওরা কি একজন মায়ের কথা বিশ্বাস করবে না?’

প্রফেসর চুপ করে থাকলেন। কী বলবেন ভেবে পেলেন না। এভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? তবে এ ছাড়া আর কোন বুদ্ধিও তাঁর মাথায় আসছে না।

‘চলুন, বাইরে যাই আমরা,’ বলে দরজা খুললেন শাহানা। ফায়েজাকে কোলে তুলে নিলেন।

শাহানাকে অনুসরণ করে বাংলো থেকে বের হলো মুসা। ওর পিছনে কুঠার উঁচিয়ে আসছেন প্রফেসর।

ওদের বের হতে দেখে গাছগুলোর ডাল বাঁকা হতে শুরু করেছে! লতাগুলো নড়েচড়ে উঠল! পকেট থেকে ছোট কয়েকটা টেস্ট টিউব বের করলেন শাহানা। ওগুলোর ভিতরে সবুজ ঘাসের নমুনা। ওগুলো উঁচিয়ে ধরলেন তিনি, বললেন, ‘শোনো তোমরা। আমি তোমাদের জঙ্গল নষ্ট করতে আসিনি। এই ঘাস যে-কোন জমিতে ফলানো সম্ভব। আমাজনকে নষ্ট করতে আসিনি আমি। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাজনের কিছুটা ক্ষতি হবে। কিন্তু তার আসলে কোনও প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস করতে পারো আমাকে। আমি একজন মা। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেখলে কেমন লাগবে, তা আমি ভালই বুঝি। আমি কথা দিচ্ছি, আমার দ্বারা তোমাদের কোনও ক্ষতি হবে না।’

হঠাৎ করেই গাছের নড়াচড়া থেমে গেল। লতাগুলো স্বাভাবিক লতার মত নিথর! ঝোপগুলো এগিয়ে আসছিল, থেমে গেছে! গরম বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে গাছগুলো। চমৎকার সবুজের সমারোহ চারদিকে।

ফায়েজাকে কোল থেকে নামিয়ে পাশে দাঁড় করিয়েছেন শাহানা। ওর হাত ধরে আছেন শক্ত করে। গাছগুলোর প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই, চোখে শঙ্কা।

একটা লজ্জাবতী গাছ শুধু এগিয়ে এল। লজ্জাবতীটা এসে ফায়েজার হাত ছুঁলো। ওটার পাতা গুটিয়ে গেল না। একটুক্ষণ তিরতির করে কাঁপল গাছটা, তারপর ফিরে গেল আগের জায়গায়! ওটাকে নিজের জায়গায় ফিরতে দেখে সামনে বেড়ে আসা গাছগুলো ফিরে যেতে শুরু করল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে এলো সব, বাংলোর সামনে একটা গাছ, ঝোপ বা লতা থাকল না!

‘আণ্টি, ওরা বিশ্বাস করেছে,’ বলে উঠল মুসা।

‘আমরা জানে বাঁচলাম,’ বললেন প্রফেসর। শাহানার দিকে চাইলেন। ‘আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন? প্রকৃতি নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে মানব জাতিও ধ্বংস হবে!’

আস্তে করে মাথা দোলালেন শাহানা। ‘আমি জঙ্গল পরিষ্কার করার ব্যাপারে যা ভেবেছিলাম, সেজন্যে আসলেই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ভবিষ্যতে আমি গবেষণা করব কীভাবে গাছের আরও উন্নতি করা যায়।’ ছলছল করে উঠল তাঁর চোখ। ‘প্রফেসর স্টিভেনসন, আমার সন্তানদের বাঁচিয়েছেন বলে আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। এই ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারব না।’

ফোকলা দাঁতে হাসলেন প্রফেসর। ‘আপনাকেও ধন্যবাদ। আশা করি আপনার ভবিষ্যৎ এক্সপেরিমেন্ট দুনিয়ার বনাঞ্চলকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে।’

প্রফেসর থামতেই শাহানা আক্তারের হাত আঁকড়ে ধরল ফায়েজা। ‘আম্মু, আমি আর এখানে থাকব না।’

মুসার চোখেও অনুরোধ।

আস্তে করে মাথা দোলালেন শাহানা। ‘ঠিক আছে। বিকেল হয়ে গেছে, তবুও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আজকেই ফিরব আমরা। মুসা- ফায়েজা, জলদি করে জিনিসপত্র গোছাতে হবে। …প্রফেসর, আপনি দুপুরে খেয়েছেন? আসুন আমাদের সঙ্গে হালকা কিছু খাবেন।’

এক গাল হাসলেন স্টিভেনসন। ‘কতদিন ভালমন্দ কিছু খাই না! নিশ্চয়ই খাব। চলুন, আমি আপনাদের গোছগাছ করায় সাহায্য করতে পারব।’

সবাই ওরা বাংলোর ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

পশ্চিমে হেলে পড়েছে সূর্য। সে-আলোয় আমাজনকে অপূর্ব দেখাল! অপরূপ প্রকৃতি, পাখিরা গাছের নীড়ে ফিরছে! কুউ-কুউ করে ডেকে উঠল একটা কোকিল।

.

এক ঘণ্টা পর খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মুসা-ফায়েজা ও শাহানা আক্তারকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন প্রফেসর।

স্পিড-বোট ছাড়তেই ঝিরঝির করে বাতাস বইল। খালের দু’পাড়ে দুলছে গাছগুলো, ওরা যেন প্রশান্ত চিত্তে বিদায় দিল মুসাদের।

ম্যানুয়াস শহরের দিকে এগিয়ে চলল স্পিড-বোট। হুইল মুসার হাতে!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *