বিভীষিকার প্রহর

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৮/২ – বিভীষিকার প্রহর – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

এক

লম্বা, গা ছমছমে পথটা ধরে হেঁটে চলেছি আমি। চারপাশ থেকে

ঘিরে রেখেছে বড় বড় গাছ।

আমি এখানে একা।

আমার বন্ধুরা কোথায় গেল?

‘কিশোর?’

‘মুসা?’

চিৎকার করে ডাকলাম।

কিন্তু ফিরে এল শুধু আমার ডাকের প্রতিধ্বনি।

কেউ জবাব দিল না।

মরিয়া হয়ে আবার চারপাশে তাকালাম।

কাউকে দেখলাম না।

নেই ওরা।

গায়ে কাঁপুনি শুরু হলো আমার।

সামনে উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল। মোড়ের কাছে।

কীসের আলো?

জানি না! হয়তো এখান থেকে, এই জঘন্য ভয়াল জগৎ থেকে বেরোনোর পথ।

আলোর দিকে এগোলাম।

হাসির শব্দ শোনা গেল! অট্টহাসি!

‘কিশোর! মুসা!’ চিৎকার করে আবার ডাকলাম।

এবারও কোন জবাব পেলাম না।

আশ্চর্য! গেল কোথায় ওরা? আমিই বা এখানে এলাম কী করে? ছিলাম তো শহরের সবচেয়ে আধুনিক শপিং মলটাতে! সেখান থেকে এসে পড়েছি এই ঘন বনে! কী করে?

জোরাল একটা কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, ‘রবিন! রবিন মিলফোর্ড! আমার হাত থেকে মুক্তি নেই তোমার। হাহ্ হাহ্ হাহ্!’

‘না, ছাড়ো আমাকে! রেহাই দাও! কী চাও তুমি?’ আতঙ্কিত চিৎকার দিয়ে চারপাশে তাকালাম।

‘রবিন! রবিন! অ্যাই, রবিন!’

আরেকটা কণ্ঠ। বহুদূর থেকে আসছে। তবে অনেক মোলায়েম, স্নেহ আর মায়াভরা পরিচিত কণ্ঠ।

‘রবিন, ওঠো!’

চোখ মেললাম। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চারপাশে তাকালাম। আমার শোবার ঘরে, আমার বিছানায় শুয়ে আছি। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সকাল সাতটা তিরিশ। স্কুলে যাবার সময় হয়েছে।

‘আবার একটা বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন দেখেছ, তাই না?’ মা বলল।

‘হ্যাঁ।’ বিছানায় উঠে বসে, আড়মোড়া ভেঙে দেহের জড়তা আর মাথা থেকে দুঃস্বপ্নের রেশ তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।

মা হেসে বলল, ‘আসলে তোমার মধ্যে সৃজনশীলতা আছে, কল্পনার ক্ষমতা অনেক বেশি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, কোন একদিন বড় লেখক হবে, কিংবা চিত্র পরিচালক।’

হাত-মুখ ধুয়ে এসে, স্কুলে যাবার পোশাক পরতে পারতে মা’র কথাটা নিয়ে ভাবলাম। কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, দুঃস্বপ্নগুলো অতিমাত্রায় বাস্তব হয়ে ওঠে আমার। সব সময়ই দেখি ভয়াল কোনও বিপজ্জনক জায়গায় রয়েছি, আজকের এই শপিং মলটার মত। মা হয়তো ঠিকই বলেছে। আমার অতি কল্পনা হয়তো একদিন আমাকে বিখ্যাত করে তুলবে।

মা, বাবা আর আমার এগারো বছরের খালাত বোন নিনার সঙ্গে টেবিলে নাস্তা খেতে বসলাম। টেবিল ঘিরে বসলাম। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে নিনা। এবারের জন্মদিনটা আমাদের সঙ্গে কাটাবে। ওর বাবা-মা বিশেষ কাজে দেশের বাইরে চলে গেছে, ফিরতে কিছুদিন দেরি হবে। নিনার মা তাই মেয়েকে বোনের কাছে, অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে রেখে গেছেন।

বাবা কাগজ পড়ছে, নাস্তার টেবিলে সবসময় যা করে থাকে। আর মা সবার প্লেটে খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। আমার স্কুলে যাবার তাড়া, তাই গপ্‌প্ গিলে চলেছি। অনর্গল কথা বলছে নিনা, একটা মুহূর্তের জন্যও মুখ বন্ধ রাখতে পারে না ও।

‘স্কুলে যদি ম্যাডাম জিজ্ঞেস করেন, বড় হয়ে আমি কী হতে চাই,’ নিনা বলছে, ‘বলব, অ্যারোপ্লেনের পাইলট হব।’

‘আর তোমার সেই প্লেন থেকে দশ হাত দূরে থাকব আমি,’ জবাব না দিয়ে পারলাম না। কোনমতে খাবারগুলো নাকেমুখে গুঁজে, তিন ঢোকে গ্লাসের দুধ শেষ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ‘আমি যাই,’ বলে প্রায় ছুটে বেরোলাম বারান্দায়।

‘রবিন,’ আমার পিছন পিছন বেরিয়ে এল মা।

‘কী, মা?’ পায়ে স্কেটস বাঁধলাম। প্ল্যাস্টিকের হেলমেট মাথায় দিলাম। হাঁটুতে পরলাম নি-প্যাড। তারপর স্কুল ব্যাগটা পিঠে বেঁধে নিলাম। বয়ে নেয়ার সুবিধের জন্য বড় একটা ব্যাকপ্যাককে স্কুলব্যাগ বানিয়েছি। স্কেটিং করতে খুব ভাল লাগে আমার। হাঁটার চেয়ে অনেক দ্রুত চলা যায়। প্রতিদিন তাই স্কেট করেই স্কুলে যাই, আসি। ‘আগামী কাল কী, মনে আছে তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে মা জিজ্ঞেস করল।

‘তা আর থাকবে না,’ জবাব দিলাম। ‘আগামী কাল শনিবার, সারাদিন স্কেটিং করে বেড়াতে পারব।’

‘কাল নিনার জন্মদিন।’

‘তো আমি কী করব?’ জবাব দিলাম। ‘আগামীকাল বারোয় পা দিচ্ছে ও। বড় হয়েছে, এখন থেকে তাই বড়দের মত আচরণ করতে বোলো ওকে।’

‘একটা উপহার আনতে হবে ওর জন্য,’ আমার খোঁচাটা এড়িয়ে গেল মা।

‘উপহার? কী উপহার?

‘পুতুল কী রকম ভালবাসে ও, জানো তুমি। নতুন একটা সুপার কিড এভিয়েটর ডল পেলে ভীষণ খুশি হবে। টিভিতে ওই পুতুলের বিজ্ঞাপন দিলে যেভাবে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে।’

‘কিন্তু আমাকে হাতখরচের টাকা যা দাও, তা থেকে তো এভিয়েটর ডল হবে না।’

‘নাও,’ আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল মা। ‘এবার হবে।’

‘কোথায় পাওয়া যায় ওই পুতুল?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘ওয়েভারলি মলে। দোকানটার নাম ডল এম্পোরিয়াম।’

‘কিন্তু, মা, আজ তো আমার বেসবল প্র্যাকটিস আছে, স্কুল ছুটির পর। পাঁচটার আগে শেষ করতে পারব না। আর তারপর শপিং মলে যেতে তো রাত হয়ে যাবে?’

‘রবিন, তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি আমি,’ গম্ভীর স্বরে মা বলল। ‘নিনা আমাদের মেহমান। নিজের বাড়ি ফেলে আমাদের এখানে জন্মদিন পালন করতে এসেছে। বুঝলাম, বাধ্য হয়েই। কিন্তু ওর জন্য একটা পুতুল কিনতে যাওয়াটা কি এতই কষ্টের? তোমার জন্মদিনে ও তোমাকে কী পাঠিয়েছিল, ভুলে গেছ?’

‘না, ভুলিনি। আমার স্কেটের চাকার জন্য এক কৌটা তেল।’

‘ও যে তোমার জন্মদিনের তারিখটা মনে রেখেছে, এটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।’

‘আমারও লেগেছিল। কিন্তু ওই তেল কেনার জন্য ওকে কষ্ট করে শপিং মলে যেতে হয়নি, তা-ও আবার স্কুল ছুটির পর, বেসবল প্র্যাকটিসের কথা নাহয় বাদই দিলাম; পাড়ার দোকান থেকেই কিনেছিল। স্কেটের চাকায় সেলাই মেশিনের তেল দিলেই হয়, আর এসব তেল যে কোন স্টেশনারি দোকানে পাওয়া যায়।’

‘তোমাকে তো এত কথা বলতে বলিনি,’ রান্নাঘরের দিকে মুখ ফেরাল মা। চুলায় কিছু বসিয়ে এসেছে বোধহয়। ‘পুতুলটা কিনে আনবে, ব্যস। আর হ্যাঁ, কাল একটা জন্মদিনের পার্টি দিচ্ছি আমরা, মনে রেখো। কোথাও আবার স্কেটিং প্রতিযোগিতায় চলে যেয়ো না।’

‘ঠিক আছে,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম। জানি, একবার যখন পুতুল এনে দিতে বলেছে আমাকে মা, যেতেই হবে আমাকে, না গিয়ে পারব না। উহ্, মা-টা বড় নাছোড়বান্দা!

খারাপ হয়ে গেছে মেজাজটা। সামনের দরজা খুলে ঘরের বাইরে পা রাখলাম। হঠাৎ বিকট এক চিৎকার। ধড়াস করে উঠল বুকের ভিতর। ফিরে তাকিয়ে দেখি, ভয়ঙ্কর চেহারার একটা প্রাণী বেরিয়ে আসছে পাশের ঝোপ থেকে।

দুই

এতই ভয় পেলাম, পিছাতে গিয়ে উল্টে পড়লাম।

খিলখিল হাসি শোনা গেল। ঝোপ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল নিনা। হাতে ধরা কুৎসিত চেহারার পুতুল। ঝোপের ভিতর থেকে এমনভাবে বাড়িয়ে রেখেছিল, হঠাৎ দেখে আমি ভেবেছি ভয়ঙ্কর কোনও প্রাণী।

‘সুন্দর দেখতে, তাই না?’ পুতুলটা আমার চোখের সামনে নাচিয়ে হেসে বলল নিনা

উঠে দাঁড়ালাম। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘দেখো, এসব বিশ্রী রসিকতাগুলো বাদ দিতে পারলে ভাল হয়। এত হাসির কিছু নেই। যা করলে, সেটা অতিরিক্ত ছেলেমানুষী। মনে রেখো, কাল থেকে বয়েস এক বছর বেড়ে যাচ্ছে তোমার। সত্যি বলতে কী, এই বয়েসে পুতুল নিয়ে খেলাটাও মানায় না আর!’

‘তুমি আসলে আমাকে হিংসে করো, নিনা বলল, ‘এত রকমের পুতুল নেই তো তোমার, তাই।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে রওনা হলো ও। বাড়িতে ঢোকার আগে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘পুতুলের মত ভাল খেলনা আর নেই।’

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগলাম। তারপর প্যান্টে লাগা ময়লা আর কুটো ঝেড়ে ফেলে স্কুলে রওনা হলাম।

আমাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লাম। দূরে শপিং মলের এগারো তলা বিল্ডিংটা চোখে পড়ল। বড় বড় কালো কাঁচ দিয়ে তৈরি সামনের দেয়াল। দেখলেই কেন যেন গা ছমছম করে আমার। মনে হতে থাকে, এর মধ্যে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরোনো যায় না; একবার ঢুকলেই গিলে নেবে চিরকালের জন্য। হয়তো আমার অতিকল্পনা—ওই যে বললাম, কিছুদিন থেকে হচ্ছে; এতদূর থেকে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়েও গায়ে কাঁটা দিল আমার। আগে এরকম হতো না। তবে কখনোই ওখানে যেতে ভাল লাগে না আমার, যদিও ছোটদের আকৃষ্ট করার জন্য নানারকম ব্যবস্থা রয়েছে ওটার ভিতরে, অসংখ্য লোভনীয় জিনিসও কিনতে পাওয়া যায়।

স্কেটিং করে চলেছি। আমাদের স্কুলটা যেমন আধুনিক, তেমনি অনেক বড়। প্রাইমারি, হাই স্কুল, এমনকী কলেজও আছে—এইচ এস সি পর্যন্ত পড়ানো হয়।

স্কুলে পৌছলাম। স্কেটিং করেই ঢুকলাম গেট দিয়ে। স্কুলের প্রধান বারান্দার কাছে এসে থামলাম।

সামনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দেখা হয়ে গেল আমার বন্ধু কিশোরের সঙ্গে।

‘বেসবল প্র্যাকটিসে থাকছ তো?’ জিজ্ঞেস করলাম ওকে।

‘নিশ্চয়ই,’ কিশোর বলল।

একসঙ্গে ক্লাসে ঢুকলাম দুজনে। হাত তুলে ডাকল আমার আরেক বন্ধু মুসা। ওর কাছে গিয়ে বসলাম। আমি মাঝখানে, একপাশে কিশোর, অন্যপাশে মুসা। স্কুল শুরুর ঘণ্টা পড়ল। আমাদের ক্লাস টিচার মিস্টার টমাস ক্লাসে ঢুকে হাজিরা খাতা দেখে আমাদের নাম ডাকলেন।

আমার নাম ডাকা হতেই, ‘ইয়েস সার’ বললাম। তারপর ফিসফিস করে কিশোরকে বললাম, ‘কাল নিনার জন্মদিন। তাই প্র্যাকটিসের পর আমাকে শপিং মলে যেতে হবে। আমার সঙ্গে যাবে?’

‘প্র্যাকটিসের পর?’ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কিশোর। ‘পাঁচটা বেজে যাবে। না ভাই, পারব না, বাড়িতে কাজ আছে। ঠিক সাড়ে-পাঁচটায় হাজির থাকতে বলে দিয়েছে চাচী। সরি।’ আরেক পাশ থেকে মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘ওই শপিং মলে যেতে এখনও ভয় পাও তুমি, তাই না, রবিন?’

‘না, ঠিক ভয় না! তবে কেমন অস্বস্তি লাগে,’ জবাব দিলাম। ‘ঢুকলেই গা ছমছম করে। আগেও তো কতবার গেছি, এমন হয়নি। মাথামোটা গার্ডগুলো চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকে—দেখে মনে হয় যেন শুধু আমার দিকেই।’

কিশোর বলল, ‘আসলে ওই স্বপ্ন দেখাটাই তোমার কাল হয়েছে। দানবের দুঃস্বপ্ন।’

‘হ্যাঁ, বিড়বিড় করল মুসা। ‘রবিনের আর দোষ কী। ওরকম ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলে আমিও ভয় পেতাম।’

শপিং মলের দানবের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রথম ঘণ্টাটা পার হয়ে গেল, বলতে পারব না। ক্লাসে সার কী পড়িয়েছেন, কিছুই শুনিনি। পিছন দিকের একটা সিটে বসেছি আমি। তাই বোধহয় আমার অন্যমনস্কতা সার খেয়াল করেননি। ঘণ্টা পড়ার শব্দে যেন চমকে বাস্তবে ফিরলাম। এরপর ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস, আমার খুব প্রিয় সাবজেক্ট।

হাতে খাতার বোঝা নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন মিস কলিনস। ধড়াস করে টেবিলের ওপর রাখলেন সেগুলো। পুরো ক্লাসে চোখ বোলালেন একবার। তারপর বললেন, ‘আমি তোমাদের খাতাগুলো দেখেছি। সবচেয়ে ভাল রচনা যারা লিখেছ, তার কয়েকটা এখন ক্লাসে পড়ে শোনাতে হবে।’

‘খাইছে, কাকে প্রথম ধরবেন ম্যাডাম?’ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল মুসা।

আমি ঘাবড়ালাম না। কারণ, জানি, আমি খারাপ লিখিনি। স্কেটিং-এর ওপর রচনা লিখতে দেয়া হয়েছে আমাকে, আমার প্রিয় বিষয়। খুব ভাল করে মন দিয়ে লিখেছি। স্কেটিং একটা খুব ভাল ব্যায়াম, কীভাবে দেহমনের উন্নতি করে, এসব কথা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি। তবে মাথায় আর হাঁটুতে নি-প্যাড না পরে কোনমতেই স্কেটিং করা উচিত হবে না, জোর দিয়ে বলেছি একথা। অ্যাক্সিডেন্ট করলে হেলমেট মাথা রক্ষা করবে, আর নি-প্যাড হাঁটু। গল্পের মত করে লিখেছি রচনাটা। একটা কিশোর বয়েসী ছেলে কীভাবে স্কেটিং করে সারা আমেরিকা ভ্রমণ করেছে, সেটার কল্পিত কাহিনি।

যাই হোক, প্রথমেই আমার দিকে তাকালেন মিস কলিনস। ‘রবিন, তোমার লেখাটাই প্রথম পড়ো। তোমারটা সবচেয়ে ভাল হয়েছে।’

উঠে দাঁড়িয়ে সিটের সারির মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে সামনে এগোলাম। ম্যাডামের ডেস্কের কাছে এসে তাঁর বাড়িয়ে ধরা খাতাটা হাতে নিয়ে ক্লাসের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। খাতার ওপর বড় করে একটা ইংরেজি ‘এ’ অক্ষর লিখে দিয়েছেন ম্যাডাম। তারমানে সর্বোচ্চ গ্রেডটাই দেয়া হয়েছে আমাকে।

পাতা ওল্টালাম। খাতার দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে এল আমার। আমি শিরোনাম লিখেছিলাম : ‘স্কেটিং করে আমেরিকা ভ্রমণ’। কিন্তু আমার হাতে ধরা খাতাটায় লেখা : ‘শপিং মলের দানব’।

রোমশ দেহ ও বড় বড় লাল চোখওয়ালা ভয়ঙ্কর চেহারার একটা দানব কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। কালো কাঁচের দেয়ালওয়ালা শপিং মলটার সামনে দাঁড়ানো ওটা!

তিন

ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। কেউ কথা বলছে না। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার রচনা শোনার অপেক্ষা করছে। আমি তো এদিকে ভয়ে পাথর।

‘কী হলো, রবিন, পড়ছ না কেন?’ ম্যাডাম বললেন। ‘পড়ো!’

‘ম্যাডাম, এই রচনা আমি লিখিনি,’ ঢোক গিলে বললাম।

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ‘তুমি লেখনি মানে? এটা তোমার হাতের লেখা, আমি ভাল করে চিনি।’

‘কিন্তু আমি তো লিখেছি স্কেটিঙের ওপর, একটা ছেলে কীভাবে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়ালো। জঘন্য একটা শপিং মলের গল্প লিখিনি।’

‘রবিন, ভাল করে খাতার দিকে তাকিয়ে দেখো,’ এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন ম্যাডাম, যেন আমি মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে আসা কোনও প্রাণী। ‘স্কেটিঙের গল্পই লিখেছ তুমি।’

খাতার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে আমার। জোর করে চোখ নামালাম আবার। অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই লেখা রয়েছে : ‘স্কেটিং করে আমেরিকা ভ্রমণ’। লেখকের নামের জায়গায় আমার নাম—রবিন মিলফোর্ড।

আবার কি আমার অতিকল্পনা আমাকে হ্যালুসিনেশন দেখিয়েছে? আবার জেগে জেগে শপিং মলের দুঃস্বপ্ন দেখেছি? তবে হাতের খাতাটায় আবার স্বাভাবিক শিরোনাম দেখে স্বস্তি বোধ করলাম।

জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করলাম।

পড়া শেষ হলে সবাই প্রশংসা করল।

‘সত্যিই খুব ভাল হয়েছে, রবিন,’ মিস কলিনস বললেন। ‘আমেরিকার সমস্ত জায়গায় নিশ্চয় যাওনি তুমি, অথচ এই লেখার মাধ্যমে সারা দেশ ঘুরিয়ে এনেছ আমাদের। একজন সাংঘাতিক স্টোরি টেলার তুমি, কল্পনাশক্তি অসাধারণ।’

মৃদু হেসে নিজের সিটে ফিরে এলাম।

এরপর বাকি দিনটা নিরাপদেই কেটে গেল, অস্বস্তিকর আর কিছু ঘটল না। স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছি কেবল, তারপরই এমন একটা ঘটনা ঘটল, রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম।

বেসবল প্র্যাকটিস সেরে বাথরুমে ঢুকেছি। শাওয়ারে গোসল সেরে, শরীরের ঘাম ধুয়ে নেয়ার জন্য। তাড়াহুড়ো করছি, কারণ এখান থেকে বেরিয়ে শপিং মলে যেতে হবে।

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে ভিজতে লাগলাম। খানিকক্ষণ শরীর ভিজিয়ে নিয়ে সাবান মাখাচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ করলাম, বাষ্পে ভরে যাচ্ছে ঘরটা।

বেসিনে ঠাণ্ডা-গরম, দুই রকম পানিরই ব্যবস্থা আছে। নিশ্চয় গরম পানির কলটা খুলে দিয়েছে কেউ। তবে কখন ঢুকল, কে ঢুকল, কিছু লক্ষ করিনি।

ভীষণ গরম হয়ে গেছে বাথরুমের বাতাস। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেশে উঠলাম।

‘অ্যাই, কল কে খুলেছ?’ চিৎকার করে বললাম, ‘বন্ধ করো!’

কেউ জবাব দিল না। বদ্ধ জায়গায় প্রতিধ্বনি তুলল আমার চিৎকার। যেন আবারও দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। স্বপ্নের সেই জোরাল কণ্ঠটাকে কথা বলতে শুনলাম, কানের কাছে যেন গমগম করে উঠল, ‘রবিন! রবিন মিলফোর্ড! আমার হাত থেকে মুক্তি নেই তোমার। হাহ্ হাহ্ হাহ্!’

চার

আরও ঘন হচ্ছে বাষ্প।

দম আটকে আসছে আমার।

মরিয়া হয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসানো বেসিনের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে প্রচণ্ড গরম হয়ে গেছে ঘরের বাতাস।

মোচড় দিলাম ‘হট’ লেখা কলটার চাবিতে।

কিন্তু বন্ধই তো রয়েছে ওটা!

পানিও পড়ছে না!

তাহলে ঘর গরম হলো কীভাবে?

আর বাষ্পই বা এলো কোথা থেকে।

ধীরে ধীরে কমে গেল বাষ্প, পরিষ্কার হয়ে এল বাতাস।

পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মেঝেতে বসে পড়লাম। হাঁপাচ্ছি আর দম নিচ্ছি।

চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই। মস্ত গোসলখানাটায় আমি একা।

কয়েক সেকেণ্ড বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে, গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে।

লকার রুমের দিকে এগোলাম।

দৌড়ে আসছেন আমাদের বেসবল কোচ মিস্টার জোনস। ‘রবিন!’ চিৎকার করে বললেন তিনি। ‘তুমি ভাল আছো তো?’

‘আছি, সার।’ লকার থেকে আমার কাপড়গুলো বের করে পরতে পরতে বললাম।

‘সত্যি ভাল আছো?’ শঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন সার।

‘কেন, সার, ভালই তো আছি।’

‘যাক, বাঁচা গেল!’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘আমাদের কেয়ার-টেকার বলল, গরম পানি সাপ্লাই দেয়ার পাইপটা নাকি ফেটে গেছে বাথরুমের ভিতর। বাষ্প বেরোনোর কথা। বাইরে থেকে চাবি বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে আমি তোমাকে বাথরুমে ঢুকতে দেখেছি। ওর কথা শুনে তাই ছুটে এসেছিলাম, তোমাকে সাবধান করে দিতে।’

‘বাষ্প বেরিয়েছিল, সার, তবে আমার কোন ক্ষতি হয়নি। একটু দমবন্ধ লাগছিল অবশ্য।

‘ভাগ্যিস তোমার কোন ক্ষতি হয়নি। নাহ্, এসব ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে এরপর থেকে। কেয়ারটেকারকে ভালমত বলে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। ভাগ্য ভাল, শাওয়ার দিয়ে গরম পানি বেরোয়নি। তাহলে তো পুড়ে মরতে!’

গরম পানির পাইপ ফাটলে বাষ্প বেরোতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে ওই অদ্ভুত হাসির কী সম্পর্ক, বুঝতে পারলাম না। হাসি আর কথা যে শুনেছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরেকটা কাকতালীয় ব্যাপার, পাইপ ফাটার আর সময় পেল না, আমি যখন বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছি, ঠিক তখন ফাটল কেন?

ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে নিয়ে খেলা করছে। আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে। কিংবা তারচেয়ে খারাপ কিছু করতে চাইছে। ভাবনাটা মনে চেপে রাখলাম। কোচকে জানালাম না। বললে হয়তো আরও অনেকের মত তিনিও আমার অতিকল্পনাকেই দায়ী করবেন।

আর কিছু না বলে, চুপচাপ কাপড় পরে হাঁটতে শুরু করলাম। বেরিয়ে এলাম স্কুলের সামনের দরজা দিয়ে। সূর্য ডুবছে। পশ্চিম আকাশে বিশাল একটা আগুনের গোলার মত।

আমার স্কেট পায়ে দিলাম। হাঁটুতে নি-প্যাড লাগিয়ে মাথায় হেলমেট পরলাম। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে বাঁধলাম। তারপর স্কেটিং করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়লাম।

শপিং মলটা নতুন, মাত্র কয়েক বছর আগে বানানো হয়েছে। শহরের একপ্রান্তে, স্কুল থেকে মাইলখানেক দূরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়ল বিল্ডিংটা।

দূর থেকেও ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। অনেক বড়, ঝকঝকে পরিষ্কার, প্রচুর বাতি, কিন্তু তবু ওটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল আমার। কালো কাঁচ লাগানো থাকায় দূর থেকে কেমন অবাস্তব লাগছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে ভিনগ্রহবাসীদের বিশাল একটা স্পেসশিপের মত। বাইরে থেকে দেখে মনেই হয় না ওখানে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আমি জানি—আমার ধারণা—ওটার গভীরে কোনখানে সাংঘাতিক কিছু ঘটছে। আমি আরও জানি, আমার অপেক্ষায় রয়েছে অশুভ কোনও দানব, যেটা বার বার আমার স্বপ্নে দেখা দেয়। আমার মন বলছে, আমার ক্ষতি ওটা করবেই। তাই তৈরি থাকতে হবে আমাকে, যাতে সময় এলে ওটার মোকাবেলা করতে পারি।

শপিং মলের প্রধান প্রবেশপথের সামনে পৌছে মন থেকে এসব কথা দূর করে দিতে চাইলাম। পা থেকে স্কেট দুটো খুলে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরলাম। তারপর ঢুকে পড়লাম গেট দিয়ে ভিতরে।

আমি ঢোকার সময় নীল ইউনিফর্ম পরা একজন গার্ড ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।

সবখানেই ক্রেতার ভিড়। দোকানের ভিতরে, বাইরে, বারান্দায়, সব জায়গায় আছে। কেউ ঢুকছে, কেউ বেরোচ্ছে, কেউ কেউ এসকেলেটরে চড়ে ওপরে উঠছে, কিংবা নীচে নামছে। গ্রেগ জনসনের ‘ডল এম্পোরিয়াম’টা পাঁচতলায়।

এলিভেটরের সামনে অনেক লোক লাইন দিয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য এসকেলেটরকেই বেছে নিলাম।

উঠে পড়লাম তাতে। দ্রুত আমাকে দোতলায় পৌঁছে দিল ওটা। নেমে, পরের এসকেলেটরে চড়ে উঠলাম তিনতলায়। আবার নেমে আরেকটায় চড়ে চারতলায়। আবার এসকেলেটর বদল করলাম। এসময় লক্ষ করলাম, এই এসকেলেটরটাতে আমি একা। আর কেউ নেই। পাঁচ তলায় উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ খুব দ্রুত চলতে শুরু করল ওটা।

এটাও কী আমার কল্পনা? না সত্যিই ঘটছে?

ভারসাম্য হারালাম। হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে একটা পাশ ধরে ফেলার চেষ্টা করলাম। রোলার কোস্টারের চেয়ে দ্রুত চলছে এসকেলেটর।

সামনেই পাঁচতলা। ভয়ঙ্কর গতিতে সেদিকে এগোচ্ছে এসকেলেটর। চিৎকার করে উঠলাম। এত দ্রুত চলছে, নামার সুযোগ দেবে না, আমাকে স্রেফ ছুঁড়ে ফেলে দেবে পাঁচতলার ল্যাণ্ডিং-এ।

পাঁচ

শক্ত করে ফেললাম দেহটাকে। এসকেলেটর আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেললে ডিগবাজি খেয়ে পায়ের ওপর খাড়া হয়ে নামার চেষ্টা করব। কিন্তু পিঠে বাঁধা ব্যাকপ্যাকটা ঝামেলা করবে, জানি, তবু চেষ্টা করে দেখতে হবে।

ওপরে পৌঁছে গেছি।

দেহটাকে শক্ত করে রেখেছি।

এসকেলেটর আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়ার অপেক্ষায় আছি।

আচমকা কোনরকম জানান না দিয়ে থেমে গেল ওটা! এ রকম কিছু ঘটার জন্য তৈরি ছিলাম না। উড়ে গিয়ে ল্যাণ্ডিং-এর ওপর পড়লাম। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে, একটা বিজ্ঞাপনের ডিসপ্লের ওপর পড়লাম। স্ট্যাণ্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা বিজ্ঞাপনের বোর্ডটাকে নিয়ে কাত হয়ে পড়লাম বারান্দায়। একটা দোকানের সামনে।

মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, রুক্ষ চেহারার টাকমাথা একজন ছোটখাট মানুষ দোকানের কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

হাসার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ালাম। ভান করলাম, যেন কিছুই হয়নি। বিজ্ঞাপনের বোর্ডটাকে তুলে আগের মত খাড়া করে রাখলাম। টেনেটুনে কাপড়-চোপড় ঠিক করতে লাগলাম।

আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে লোকটা, যেন আমি একটা আজব প্রাণী। নিশ্চয় গেঁয়ো ভূত ভাবছে আমাকে। হয়তো ভাবছে, এসকেলেটরে চড়তেও জানি না আমি।

ফিরে তাকালাম এসকেলেটরটার দিকে। চলছে ওটা। স্বাভাবিক গতিতে।

মাথা ঝাড়া দিলাম। ফিরে তাকালাম দোকানের কাঁচের ভিতর দিয়ে। লোকটাকে দেখলাম না। দোকানের সাইনবোর্ডের ওপর চোখ পড়ল। লেখা রয়েছে : ডল এম্পোরিয়াম। হয়তো ওই লোকটাই গ্রেগ জনসন, অবাক দৃষ্টিতে যে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

লম্বা দম নিলাম। ঢুকে পড়লাম দোকানে। আমি ছাড়া আর দুজন ক্রেতা আছে। একজন মহিলা, সঙ্গে ছোট একটা ছেলে। নতুন কোনও কম্পিউটার গেম এসেছে কি না খোঁজ নিচ্ছেন। আর বছর পনেরো বয়েসের এক কিশোরী গানের সিডি বাছাই করছে।

পুতুল রাখা হয় যেখানে, সেদিকে তাকালাম। হঠাৎ পিছন থেকে কথা শোনা গেল, ‘পুতুল লাগবে, ইয়াং ম্যান?’

চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। সেই লোকটাই, সেই টাকমাথা। শার্টের বুকপকেটে একটা ধাতব চৌকোনা প্ল্যাস্টিকের ট্যাগ লাগানো, তাতে লেখা : গ্রেগ জনসন, দোকান মালিক। বুকে এভাবে নিজের নাম-পরিচয় লেখা ট্যাগ ঝোলানো এই শপিং মলের নিয়ম। লোকটার দু’চোখের শাণিত দৃষ্টি চিরে ঢুকে যাচ্ছে যেন আমার মগজে। এবং যতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, একটিবারের জন্য চোখের পলক ফেলতে দেখলাম না লোকটাকে।

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলাম। ‘একটা সুপার কিড এভিয়েটর ডল কিনতে এসেছি।’

আমার ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না লোকটা। ‘কেন, পুতুল তোমার খুব পছন্দ নাকি? পুতুল জমাও?’ কথা বলার সময় মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না ওর।

‘না, আমার বোন জমায়। আগামীকাল ওর জন্মদিন। ওকে একটা পুতুল উপহার দিতে চাই।’

‘ও। তবে তোমার জন্য খারাপ-ভাল দুরকম খবরই আছে, লোকটা বলল। ‘খারাপ খবরটা হলো, আজ আমাদের স্টকে একটা এভিয়েটর ডলও নেই। আর ভাল খবরটা হলো, কাল অনেকগুলো পুতুল আসছে, অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। কাল দুপুর নাগাদ এলে পেয়ে যাবে।’

এই ভয়ানক শপিং মলে কাল আবার আসতে হবে শুনে দমে গেলাম। জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম দরজার দিকে। বেরোনোর আগে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। দোকান থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হলো, গ্রেগ জনসন আর ওর দোকানে অদ্ভুত কিছু একটা রয়েছে।

এবার আর ওপরে ওঠার এসকেলেটরটার দিকে না গিয়ে নীচে নামে যেটা, সেটার দিকে এগোলাম। বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছি। প্রায় ছ’টা বাজে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার বয়েসী যারা, স্কুলে পড়ে, কখন বাড়ি চলে গেছে, এতক্ষণে রাতের খাবার খেতে বসেও গেছে নিশ্চয় কেউ কেউ।

এসকেলেটরের কাছে এসে থামলাম। পা রাখার আগে ভাল করে দেখে নিলাম। স্বাভাবিক গতিতে চলছে। কিন্তু আমি পা রাখতেই আমচকা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল।

‘এসকেলেটর নষ্ট হয়ে গেছে, আপাতত আর চলবে না,’ পিছন থেকে বলল একটা কণ্ঠ। ফিরে তাকালাম। কথা বলল যে লোকটা, ওকে কোথায় যেন দেখেছি। হয়তো আমার কোনও দুঃস্বপ্নে। বড় বড় ধারাল শ্বদন্ত নেই বটে ওর, ঠেলে বেরোনো বড় বড় চোখ, সবুজ চামড়া, কিংবা গা ভর্তি লোমও নেই—কিন্তু চেহারাটা অবিকল আমার স্বপ্নে দেখা শপিং মলের দানবটার মত লাগছে।

গায়ে শপিং মলের ইউনিফর্ম, বুকের কাছে ট্যাগ ঝোলানো। তাতে লেখা : হিরাম স্কারপিনি, মেকানিক, ওয়েভারলি মল।

ওর পরিষ্কার টলটলে চোখ আমাকে দেখছে। এক পা পিছিয়ে গেলাম। যে ব্যাপারটা বেশি অবাক করল, তা হলো খেলনার দোকানের মালিকের মতই এই লোকটার চোখেও পলক পড়ছে না। ‘এলিভেটরে চড়ে নীচে যেতে হবে তোমাকে।’

‘ঠিক আছে,’ বলে এসকেলেটর থেকে উঠে এলাম ল্যাণ্ডিং-এ।

ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। আমার দিকে পিছন ফিরে একটা টুল বক্সের ওপর ঝুঁকল। সেটা থেকে একটা রেঞ্চ বের করল। ‘যাও, সাবধানে যেয়ো।’ আমাকে বলল ও। আমার দিকে তাকাল না। হাসল। শিউরে উঠলাম। দুঃস্বপ্নের সেই অদ্ভুত হাসি!

বারান্দা ধরে এগোলাম। এলিভেটরটা রয়েছে আরেক মাথায়। তাড়াহুড়া করে হেঁটে চললাম। শপিং মলের এই ফ্লোরে এখন আমি ছাড়া আর কোন কাস্টোমার নেই। অন্য সময় হলে অবাক লাগত, এত তাড়াতাড়ি সবাই শপিং মল থেকে চলে গেল? কিন্তু এখন বাড়ি ফেরা নিয়ে এত বেশি অস্থির আমি, ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।

এলিভেটরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এলিভেটর আসার বোতাম টিপলাম। দশ সেকেণ্ড অপেক্ষা করার পর দরজা খুলল। কেউ নামল না। শূন্য এলিভেটর।

আমি একা এলিভেটরে চড়লাম।

বোর্ডের বোতামের সারির দিকে তাকালাম। সবচেয়ে নীচের বোতামটার নীচে লেখা ‘জি’। তারমানে, ‘গ্রাউণ্ড’।

বোতাম টিপতে হাত বাড়ালাম। হঠাৎ করেই যেন অদৃশ্য একটা হাত ধাক্কা দিয়ে আমার হাতটা ‘জি’-এর কাছ থেকে সরিয়ে দিল | অবাক হয়ে দেখলাম, ‘এইচ’ লেখা একটা বোতাম টিপছি, প্যানেলে যে আছে ওটা, চোখেই পড়েনি আগে।

‘এইচ’ দিয়ে কী হয়?

কোথায় যাবে এখন এলিভেটর?

বোতামটা আমাকে দিয়ে কে টেপাল?

ছয়

তীব্র গতিতে নীচে নেমে চলল এলিভেটর। আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে চলে এসেছে। প্রতিটি ফ্লোর পার হচ্ছি, আর আরও বেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছি। কিছুই করতে পারছি না। আমার হাতটাকে অনড় করে দিয়েছে কে যেন।

‘এইচ’ বোতামটা টিপেছি আমি। কে, কেন টিপিয়েছে আমাকে দিয়ে, জানি না। গ্রাউণ্ড ফ্লোর পার হয়ে আরও নীচে নামতে লাগল এলিভেটর। ‘বি’ লেখা বোতামটা টিপটিপ করে জ্বলতে-নিভতে শুরু করল। মনে হলো বেযমেন্ট, অর্থাৎ মাটির নীচের ঘরে নেমে যাচ্ছি।

‘জি’ দিয়ে ‘গ্রাউণ্ড’, ‘বি’ দিয়ে ‘বেযমেন্ট’, কিন্তু ‘এইচ’ দিয়ে কী হয়? হঠাৎ কেউ আমার মনের ভিতর যেন ঢুকিয়ে দিল জবাবটা : ‘এইচ’ মানে ‘হোম’। তবে কী অদ্ভুত কোনও উপায়ে এই এলিভেটর দিয়ে ক্রেতাদেরকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়? নাহ্, অসম্ভব! এলিভেটর কখনও কারও বাড়িতে যেতে পারে না।

হঠাৎ করেই এলিভেটরের ভিতরের আলো কমে গেল। গতি কমতে কমতে থেমে গেল এলিভেটর। কিন্তু দরজা খুলল না।

‘এই যে, কেউ আছেন!’ চিৎকার করে ডাকলাম। ‘কেউ শুনছেন?’

সাড়া এল না। দরজা খুলল না। প্রায় অন্ধকার একটা এলিভেটর-কারের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। বেরোব কী করে এখান থেকে?

হঠাৎই ‘এইচ’ লেখা বোতামটা উজ্জ্বল হয়ে গেল আবার। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে এলিভেটরের দরজা।

হঠাৎ তীব্র আলো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল যেন চোখে। অন্ধ করে দিল আমাকে। দুঃস্বপ্নে দেখা সেই রকম আলো, আজ ভোরেই যা দেখেছি।

‘কে ওখানে?’ কপালে হাত রেখে তীব্র সাদা আলো আড়াল করে চেঁচিয়ে উঠলাম। চলে গেল আলোটা। চারপাশে তাকালাম।

যা দেখছি, সবই অবাস্তব লাগল। মনে হলো, আবার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব, আমি ভাল করেই জানি। বাস্তবে ঘটছে ঘটনাটা।

বিষণ্ন, একটা ভূতুড়ে বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মস্ত বড় একটা বট গাছের কাছে। এলিভেটরটা দেখতে পাচ্ছি না। পিছন থেকে কর্কশ অট্টহাসি শুনে চমকে গেলাম।

ফিরে তাকালাম। টাকমাথা, বেঁটে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। থ্যাবড়া নাক, কোঁচকানো বুড়োটে চামড়া, নিষ্পলক চোখ। চেনা চেনা লাগছে।

‘আমাদের স্বর্গে স্বাগতম, রবিন,’ বলল আজব মানুষটা।

স্বর্গ! শপিং মলের তৈরি নতুন কোনও থিম পার্ক নাকি এটা? ছোটদের আকষর্ণ করার কৌশল? যেটাই হোক, জায়গাটা ভয় ধরায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

‘শুনুন,’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে, ‘আমার নাম জানলেন কী করে?’

আবার হেসে উঠল অদ্ভুত লোকটা। আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। একটা বাক্সের দিকে হাত বাড়াল। ‘আমি জানি তুমি পুতুল খুঁজছ।’ বাক্স থেকে বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘চলবে এটাতে?’

আমার নাকের কাছে ধরে রেখেছে জিনিসটা। ভীষণ কুৎসিত চেহারার একটা পুতুল। হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল পুতুলটা। আমার দিকে হাত বাড়াল। অট্টহাসি হেসে বলল, ‘স্বাগতম, রবিন।’

পিছিয়ে গেলাম। ধাক্কা খেলাম গাছের গায়ে। পুতুল কথা বলে! জীবনে শুনিনি! তা ছাড়া আমার যে পুতুল দরকার, এই অদ্ভুত লোকটা জানল কী করে? কেন চেনা চেনা লাগছিল লোকটাকে, এতক্ষণে বুঝলাম। ওকে দেখতে অনেকটা ডল এম্পোরিয়ামের মালিক গ্রেগ জনসনের মত লাগছে। দোকানেও ঠিক স্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু অনেক বেশি অদ্ভুত আচরণ করছে এখানে।

‘কী হচ্ছে বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করলাম। ভয়ে বার বার কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। ‘এখানে তো আসতে চাইনি আমি। আমি নামতে চেয়েছিলাম গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।’

গ্রেগ জনসনের চেহারার লোকটা এক পা এগোল আমার দিকে। ওর হাতের পুতুলটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। উড়ে এল আমার দিকে।

সমস্বরে কথা বলে উঠল ওই লোক আর পুতুলটা, ‘এই স্বর্গটা তোমার ভাল লাগবে, রবিন। আমাদেরকে তুমি সহযোগিতা করবে। তোমাকে যা করতে বলা হবে তা-ই তুমি করবে!’

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘুরে দৌড় দিয়ে পালাতে চাইলাম। কিন্তু বট গাছটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। ওটার মস্ত শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম।

হঠাৎ গাছের গায়ে দরজা তৈরি হলো। খুলে গেল হাঁ হয়ে। ভিতরে এলিভেটর-কারটা দেখলাম। গ্রেগ জনসনের দানব আর পুতুলটা আমাকে ধরার আগেই লাফ দিয়ে এলিভেটরে উঠে পড়লাম। খালি এলিভেটর, আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মৃদু আলো জ্বলছে। ‘ইমার্জেন্সি’ লেখা বোতামটা টিপে দিলাম। কিছুই ঘটল না। তারপর ‘জি’ বোতামটা চোখে পড়ল। মনে মনে খোদাকে ডাকতে ডাকতে আঙুল রাখলাম ওটাতে। টিপে ধরে রাখলাম। ঝাঁকি দিয়ে চলতে শুরু করল এলিভেটর।

সাত

এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই একটা মুহূর্ত দেরি না করে লাফিয়ে পড়লাম বাইরে। শপিং মলে লোকের ভিড়। এটা আরেক আশ্চর্য! কখনও দেখছি, মানুষজন কেউ নেই, আমি একা। আবার কখনও প্রচুর লোকজন। কোনটা স্বাভাবিক?

বেশি ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। নতুন বিপদ হাজির হবার আগেই। সোজা দৌড় দিলাম গেটের দিকে। বাইরে এসে স্কেট দুটো বের করে দ্রুত পরে ফেললাম। ছুটলাম বাড়ির দিকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছে স্বস্তি পেতে চাই।

বাড়ি ফিরে দেখি রাতের খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে মা, বাবা ও নিনা।

‘এত দেরি করলে যে?’ মা জিজ্ঞেস করল। ‘আমার তো দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জলদি হাতমুখ ধুয়ে এসো। খাবার এখনও গরম আছে। বেড়ে দিই।’

কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না আমার। বললাম, ‘আমি খেয়ে এসেছি, মা।’

আমার দিকে তাকিয়ে আছে মা। ‘খেয়েছ? কোথায়?’

‘শপিং মলে হট ডগ খেয়েছি। পেট ভর্তি হয়ে আছে।’

মাথা ঝাঁকাল মা। তবে আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না। এতক্ষণে চোখ পড়ল আমার হাতের দিকে। ‘পুতুল কোথায়?’

এবার কী জবাব দেব? দোকানে আজ পুতুল নেই। দোকানদার বলেছে, আগামীকাল দুপুরে আসবে। কিন্তু সত্যি কথাটা বললে কাল আবার আমাকে শপিং মলে যেতে হবে, জোর করে পাঠাবে মা, অথচ আমি কোনমতেই যেতে চাই না।

‘ওদের কাছে এভিয়েটর ডল নেই,’ জবাব দিলাম। ‘শেষ হয়ে গেছে।’ আগামী দিন আসার কথাটা চেপে গেলাম।

কিন্তু মা এত সহজে ভোলার পাত্র নয়। বলল, ‘শেষ হয়ে গেছে, আসবে। এত চাহিদা যে জিনিসের, সেটা না এনে বসে থাকবে না। কাল দুপুরে গেলেই পেয়ে যাবে, আমি বললাম, দেখো।’

‘কী জানি, হয়তো পাব,’ ভ্রূকুটি করলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মা। ‘রবিন, কিছু হয়েছে নাকি? পুতুলের টাকাটা খরচ করে ফেলেছ? নাকি হারিয়ে ফেলেছ?’

‘না, মা, টাকা আছে,’ বের করে দেখালাম। ‘আসলে, কাল আমি শপিং মলে যেতে চাই না।’

‘কিন্তু যেতে হবে তো,’ মা বলল। পার্স থেকে আরও কিছু টাকা বের করে দিল। ‘এই নাও। পুতুল ছাড়াও আরও দুটো জিনিস আনতে হবে।’

‘কী?’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

‘ফ্রেডসন’স আই কেয়ার থেকে আমার চশমাটা আনতে হবে। ফ্রেম কিনে কাঁচ লাগাতে দিয়ে এসেছিলাম, কাল ডেলিভারি দেয়ার কথা। আর প্রেশার কুকারের একটা ওয়াশারও আনতে হবে, ওখানকার একটা দোকানে ছাড়া পাওয়া যায় না—অনেক জায়গায় খুঁজেছি।’

আমার হাতে আরও কিছু টাকা দিল মা।

‘মা, এতগুলো কাজ আমাকে দিয়ে করাবে?’

‘এত কাজ কোথায় দেখলে? একটা পুতুল, একটা চশমা, আর একটা ওয়াশার; ভারিও নয়, ছোট একটা ব্যাগের মধ্যেই ধরে যাবে। এত গাঁইগুঁই করছ কেন? শপিং মলে যেতেই বা এত আপত্তি কীসের?’

‘কী জানি, জানি না!’ বিরক্তকণ্ঠে বললাম। ‘হয়তো শপিং মলে যাওয়া, বাজারসদাই, এসব আমার ভাল লাগে না!’

‘ভাল না লাগলেও যেতে হবে,’ মা বলল। ‘অনেক কাজই ভাল লাগে না আমাদের, তা-ও করতে হয়। বাজার করা নিয়ে এত বিরক্ত হলে চলে না। আমি তো সব সময় থাকব না। কখনও না কখনও তোমার নিজের বাজার নিজেকেই করতে হবে।’

বাসনপেয়ালা ধুতে চলে গেল মা। মনে মনে স্থির করলাম, কাল শপিং মলে যদি যেতেই হয় আমাকে, একা যাব না। কিশোর আর মুসাকে সাথে নিয়ে যাব। ওদের অন্তত বোঝাতে হবে, শপিং মল সম্পর্কে আমার ভয়টা অমূলক কিংবা অতিকল্পনা নয়। ‘এইচ’ লেখা বোতাম, খেলনার দোকানের মালিক গ্রেগ জনসনের মত দেখতে দানবটা, কিংবা জ্যান্ত পুতুল কোনটাই আমার কল্পনা নয়।

ওপরতলায় এসে কিশোর আর মুসাকে ফোন করলাম। পরের দিন দুপুরবেলা আমার সঙ্গে শপিং মলে যেতে রাজি হলো দুজনেই। অনেকটা স্বস্তি পেলাম। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতের প্রথম দিকটায় ভালই ঘুম হলো। তারপর শুনলাম সেই ভয়ঙ্কর অট্টহাসি!

ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। হাসিটা থেমে গেছে। নিশ্চয় স্বপ্নে দেখেছি। চোখ বুজলাম। আবার শোনা গেল হাসি। না শোনার ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। লাভ হলো না। থেকে থেকেই শোনা যেতে থাকল অট্টহাসি। মনে হলো, বাইরে বা অন্য কোথাও নয়, আমার মগজের ভিতরেই হেসে চলেছে কেউ।

বাকি রাতটা বিছানায় গড়াগড়ি আর ছটফট করে কাটালাম। বুঝে গেছি, শপিং মল রহস্যের একটা কিনারা না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি। ভোরের দিকে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এবং যথারীতি দুঃস্বপ্ন দেখলাম।

আট

দুপুর ঠিক বারোটায় স্কেটিং করে পৌঁছলাম শপিং মলের প্রধান ফটকের কাছে। আজ শনিবার, তাই প্রচুর ভিড়। একেবারে ঠাসাঠাসি অবস্থা। কেন যে এখানে এত ভিড় করে লোকে, বুঝি না। কোনও জিনিসের দাম তো কম নেয় না। জেনেশুনেও বেশি দাম দিয়ে যেন ঠকতে আসে। যেন পতঙ্গের মত এর আলোর আকর্ষণে ছুটে আসে এই মানুষগুলো।

স্কেট দুটো খুলে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরলাম। হেলমেটটা মাথা থেকে নামিয়ে ফিতেয় ঝুলিয়ে রেখে দিলাম। বুকের দিকটায় গলার কাছে ঝুলে রইল ওটা।

ভিতরে ঢুকলাম। গার্ডের পাশ কাটালাম, আগের দিনও এই লোকটাই পাহারায় ছিল। একটা মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে চোখ ফেরাল। আরকেড এরিয়ায় কিশোর আর মুসা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সময় কাটানোর জন্য কম্পিউটার গেম খেলছে ওরা।

‘স্পেশাল কী জিনিস দেখাতে এখানে এনেছ আমাদের?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। লেজার ম্যান-এর গেমটা সবে শেষ করেছে ও। পয়েন্ট পেয়েছে ১,০০,০০০।

‘নিজের চোখেই দেখো,’ আমি বললাম।

‘এখন এখান থেকে সরলে আর খেলার চান্স পাব না, ফিরে এসে দেখব এক মাইল লম্বা লাইন হয়ে গেছে,’ কিশোর বলল।

‘আমি যা দেখাতে এনেছি, সেটা দেখলে কম্পিউটার গেমের কথা

আর মনে থাকবে না তোমাদের,’ আমি বললাম।

‘কোথায় যেতে হবে?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। ‘চলো, এসকেলেটরে করে যাই। এসকেলেটরে চড়তে এলিভেটরের চেয়ে ভাল লাগে আমার।’

‘না, যা দেখাতে চাই, সেটা দেখতে এলিভেটরে করেই যেতে হবে,’ আমি বললাম।

আগের দিন যে এলিভেটরটায় চড়েছিলাম, সেটার কাছে নিয়ে এলাম ওদেরকে। শপিং মলে এত লোকের ভিড়, কিন্তু এলিভেটরের কাছে কেউ নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে আগেও অদ্ভুত লেগেছে, বলেছি।

‘ভালই হয়েছে,’ মুসা বলল। ‘লাইনে দাঁড়াতে হলো না। সেন্টারে তো লাইন ছাড়া কথা নেই।’ আবার জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘কী দেখাবে, বলো তো?’

‘একটু অপেক্ষা করো, দেখতেই পাবে,’ আবারও একই জবাব দিলাম।

এলিভেটর এল। দরজা খুলে গেল।

শূন্য এলিভেটর। একজন লোকও নেই ভিতরে।

মুসা বলল, ‘আশ্চর্য! এখানে কি সবাই এসকেলেটরে চড়ে? এলিভেটরে কেউ ওঠে না?’

মুচকি হেসে বললাম, ‘আশ্চর্যের এখনই দেখেছ কী। আরও কত কিছু বাকি।

কিশোর ও মুসাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আর কেউ উঠল না। শুধু আমরা তিনজন।

দরজাটা লেগে গেল।

বোতামের সারির কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।

বললাম, ‘এইচ লেখা বোতামটা টেপো। তাহলেই শুরু হয়ে যাবে খেল।’

‘টিপতে পারলে তো খুশিই হতাম,’ কিশোর জবাব দিল। ‘কিন্তু এইচ লেখা বোতাম কই?’

প্যানেলের দিকে তাকালাম। বোতামের সারিতে ‘এইচ’ লেখা বোতামটা খুঁজছে আমার চোখ।

কিন্তু নেই!

গেল কোথায়?

আশ্চর্য!

নয়

‘বললাম তো, ছিল ওখানে!’ বোতামের সারির ঠিক যেখানটায় বোতামটা ছিল, সেখানে হাত বোলালাম। ‘তোমাদের কী ধারণা, আমি বানিয়ে বলেছি, পুরো ব্যাপারটা আমার কল্পনা?’

‘বানিয়ে গল্প লিখে তুমি ফার্স্ট হয়েছ,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল। ‘সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছ। হয়তো বেশি কল্পনা করতে করতে এমনভাবেই কল্পনার জগতে ঢুকে পড়ো, বাস্তবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো। হতে পারে না এরকম?’

জবাব খুঁজে পেলাম না। এলিভেটরের ভিতরের আয়নায় দেখলাম, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। রীতিমত একটা গাধা মনে হচ্ছে নিজেকে। কী জবাব দেব, বুঝতে পারছি না।

‘আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী?’ মুসা বলল। বোতাম টিপল ও।

খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। বেরিয়ে এলাম তিনজনে।

‘আমি আরকেডে যাচ্ছি,’ কিশোর বলল। লাইন হয়তো এখনও তেমন লম্বা হয়নি। তাড়াতাড়িই সুযোগ পেয়ে যাব আবার।’

‘তুমি কী করবে, রবিন?’ আমার মুখচোখের অবস্থা দেখে সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল মুসা।

‘মা কয়েকটা জিনিস নিতে বলে দিয়েছে,’ বোতামটা না পাওয়ায়, বন্ধুদের দেখাতে না পারায় খুব হতাশ লাগছে আমার। ‘সেগুলো কিনতে যাব।’

‘ঠিক আছে, যাও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রুবিনা’স হট ডগে চলে এসো,’ কিশোর বলল। ‘ওখানে লাঞ্চ খাব। তারপর প্লে এরিয়ায় গিয়ে রাইডে চড়ব। নতুন কয়েকটা রাইড এসেছে শুনলাম।’

ওরা ফিরে গেল ওদের আরকেডে, আমি রওনা হলাম জিনিসপত্র কিনতে। এবার আর এলিভেটরে চড়লাম না। এসকেলেটরের দিকে এগোলাম। ভাবতে ভাবতে চলেছি। হয়তো কিশোরের কথাই ঠিক। অতি কল্পনা করতে করতে এখন কল্পনার জগতেই বেশির ভাগ সময় ঘুরে বেড়াই আমি। মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি হয়তো। মাকে বলে একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার কথাও ভাবলাম। তারপর দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজের কথায় মন দিলাম। প্রথমে মা’র চশমাটা নিতে হবে, তারপর প্রেশার কুকারের ওয়াশার, সবশেষে নিনার পুতুল।

দোতলায় ওঠার এসকেলেটরে চড়লাম। চশমার দোকানটা ওখানেই। কোন ঝামেলা করল না এসকেলেটর। নেমে সোজা এসে দোকানে ঢুকে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম।

‘কি লাগবে, বলো?’ জিজ্ঞেস করল কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো মহিলা।

রশিদ বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘চশমার কাঁচ লাগাতে দিয়ে গেছে মা, আজ দেয়ার কথা।’

‘এক মিনিট,’ বলে রশিদটা নিয়ে চলে গেল মহিলা। ফিরে এল ঠিক এক মিনিট পরেই। হাতে একটা ছোট বাক্স। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি টাকা দিলাম। কিছু ভাঙতি পাব। ক্যাশ রেজিস্টারে লিখতে লাগল মহিলা। কত টাকা বিল হয়েছে, আমি ওকে কত দিয়েছি, কত টাকা ভাঙতি পাব, সব খুঁটিয়ে লিখছে। ভাঙতি টাকার জন্য অপেক্ষা করছি আমি।

‘দেরি হবে?’ আমার পিছন থেকে ধমকে উঠল একটা অধৈর্য কণ্ঠ। ‘আমার তাড়া আছে, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’

‘এক মিনিট, সার,’ মহিলা বলল। ‘এই যে, হয়ে গেছে।’ একটা বাক্স থেকে আমাকে ভাঙতি টাকা বের করে দিল মহিলা। টাকা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটার ওপর চোখ পড়তে ← থমকে দাঁড়ালাম। পরনে প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট। চামড়ার রঙ সবুজ, ঠেলে বেরোনো লাল চোখ, আর দুই কান থেকে বেরিয়ে থাকা বড় বড় লোম!

দশ

একপাশের দেয়ালের দিকে সরে গেলাম। ওখানে শোকেসে সাজানো চশমা দেখার ভান করলাম। আসলে লোকটার ওপর নজর রাখছি। ও কী করে দেখতে চাইছি। দোকানে আমি ছাড়া আর কোন ক্রেতা নেই। শুধু আমরা তিনজন—আমি, ওই মহিলা, আর লোকটা।

কাউন্টারের ওপর একটা চশমা রাখল ও। ঠিকমত নাকে বসে না, তাই ফ্রেমটা ঠিক করে দিতে হবে। ধমক খেয়েও হাসিমুখে কথা বলছে মহিলা, যেন কিছুই হয়নি।

আজব লোকটা বেরিয়ে গেলে কাউন্টারের সামনে ফিরে এলাম। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনি কে?’

আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল মহিলা। ‘ও, তুমি এখনও বেরোওনি। ভাঙতি টাকা তো দিয়ে দিলাম, আর কোনও সমস্যা?’

সমস্যা তো বটেই। বিরাট সমস্যা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ওই ভদ্রলোককে দেখেছেন?’

‘দেখব না কেন? আমাদের কাস্টোমার। মিস্টার ওয়েভারলি। তা ছাড়া এই শপিং মলের মালিকও তিনিই।’

‘এই শপিং মলের মালিক?’ নিজের কানে প্রতিধ্বনির মত শোনাল যেন আমার কথাগুলো। মনে হলো, পা দুটো রবার হয়ে গেছে আমার। হাঁটু ভাঁজ হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ‘দেখতে কি সব সময়ই ওরকম উনি?’

‘কী রকম? আজ শনিবার, ব্যস্ততা বেশি, তাই সাধারণ কাপড়চোপড় পরেছেন।’

‘আমি তাঁর পোশাকের কথা বলছি না। চামড়ার রঙ এমন কেন? মনে হয় যেন এই পৃথিবীর মানুষ নন, অন্য গ্যালাক্সি থেকে এসেছেন!’

আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল মহিলা। ‘বেশি বেশি সাইন্স ফিকশন সিনেমা দেখো তুমি, তাই না? সেজন্যই মানুষকে ভিনগ্রহের মানুষ কল্পনা করো। আমি তো তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না।’

একজন কাস্টোমার ঢুকল দোকানে। আমাকে মহিলা বলল, ‘তোমার কাজ তো শেষ, এখন তুমি যেতে পারো। হ্যাঁ, শোনো, বাড়ি গিয়ে মাকে বলো, তাড়াতাড়ি যেন ভাল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান। কিংবা চোখের ডাক্তারও দেখাতে পারো। আমাদের এখানেও ডাক্তার বসেন, তাঁকেও দেখাতে পারো। চোখ খারাপ হলেও উল্টোপাল্টা দেখবে।’ তারপর হেসে স্বাগত জানাল নতুন কাস্টোমারকে।

ঘুরে দরজার দিকে রওনা হলাম।

বাইরে এসে চারপাশে তাকালাম। সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু খটকাটা গেল না আমার। বার বার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটছে এই শপিং মলকে ঘিরে।

চশমা নিয়েছি। এখন প্রেশার কুকারের ওয়াশার কিনতে হবে। তারপর নিনার পুতুল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেনাকাটাগুলো সেরে পালাতে হবে এখান থেকে।

প্রেশার কুকারের দোকানটা চারতলায়। আবার এসকেলেটরে চড়লাম। দুইবার এসকেলেটর বদলে চারতলায় পৌছলাম। প্রেশার কুকারের দোকানে ঢুকলাম। সেলসম্যানকে প্রেশার কুকারের ওয়াশার দিতে বললাম।

সেলসম্যান একজন তরুণ। ওয়াশার এনে দিল। এই লোকটাও রেজিস্টারে বিল লিখতে লাগল। রেজিস্টারটা দেখতে পাচ্ছি। যেখানে সংখ্যাগুলো লেখা হয়, তা-ও চোখে পড়ছে।

তাকিয়ে আছি। আমার চোখের সামনে ক্যাশ রেজিস্টারটা একটা চেহারায় রূপ নিতে শুরু করল। মুখ, চোখ, দাঁত। মাথায় বড় বড় সবুজ লোম গজাচ্ছে। লিখে চলেছে সেলসম্যান। রেজিস্টারের পরিবর্তনটা যেন চোখেই পড়ছে না ওর!

রেজিস্টারটা নড়ছে, জ্যান্ত প্রাণীর মত। তারপর হাসতে লাগল। আমার বহুবার শোনা সেই অট্টহাসি।

এই সময় আমার পিছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ‘জোসেফ, কেমন আছো?’

‘আরে, স্কারপিনি, কী খবর?’ তরুণ সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল।

ফিরে তাকালাম। দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে চমকে উঠলাম। সেই লোকটা, শপিং মলের মেকানিক, যার বুকে ট্যাগে লেখা রয়েছে হিরাম স্কারপিনি। কাল আমাকে এসকেলেটর থেকে নামিয়ে দিয়েছিল।

লেখা শেষ করে আমার কাছ থেকে বেল্টের দাম নিল জোসেফ। ওয়াশারটা প্যাকেট করে দিল

আবার তাকালাম হিরাম স্কারপিনির দিকে। এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁটে পাতলা এক চিলতে অদ্ভুত হাসি, আন্তরিক নয় মোটেও। ফিরে তাকালাম ক্যাশ রেজিস্টারটার দিকে। আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে ওটা, সবুজ মুখটা গায়েব।

বেল্টের প্যাকেটটা নিয়ে পা বাড়ালাম দরজার দিকে। হিরাম স্কারপিনির পাশ দিয়ে বেরোনোর সময় ওর হাসি শুনলাম। জোরাল সেই অট্টহাসি!

এগারো

নিনার পুতুল কেনা বাকি এখনও। ওটা কিনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াব না। সোজা বেরিয়ে যাব এই শপিং মল থেকে। কোনদিন কোনও কারণেই আর ফিরে আসব না এখানে। কিশোর আর মুসাকে বলে যাব, আমার মাথা ধরেছে, বাড়ি চলে যাচ্ছি, ওদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারব না। একবার গেটের বাইরে বেরোতে পারলেই হয়—নিজেকে বললাম—স্কেট পরে এমন ছোটা ছুটব, পিছন ফিরে তাকাব না আর।

আবার এসকেলেটরে চড়লাম। উঠে এলাম পঞ্চম তলায়। গ্রেগ জনসনের দোকানে ঢুকলাম। ভয় পাচ্ছি। ‘এইচ’ ফ্লোরে ওকেই কি দেখেছিলাম? পুতুলের দোকানের ছোটখাট এই টাকমাথা মানুষটিই কি নীচতলায় দানবে পরিণত হয়েছিল? নাকি পুরো ব্যাপারটাই আমার কল্পনা?

কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা। দোকানে গ্রেগ জনসনকে না দেখে তিনি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম। মহিলা জানাল, হঠাৎ করেই মিস্টার জনসন অসুস্থ হয়ে পড়ায় দোকানে আসতে পারেননি। আমার কী চাই, জিজ্ঞেস করল।

‘আমি একটা এভিয়েটর ডল চাই,’ মহিলাকে বললাম। ‘কাল এসেছিলাম, পাইনি। মিস্টার জনসন আজ দুপুরে আসতে বলেছেন। আজ নাকি পুতুল আসবে।’

হাসিমুখে মহিলা বলল, ‘এসেছে তো।’

পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেল ও। ফিরে এল হাতে একটা বাক্স নিয়ে।

‘আজ আমার কাজিনের জন্মদিন,’ মহিলাকে বললাম। ‘উপহার দেব। রঙিন কাগজ দিয়ে প্যাক করে দিলে ভাল হয়।’

‘নিশ্চয়ই,’ মহিলা বলল।

ঠিক এ সময় অতিরিক্ত উজ্জ্বল হয়ে গেল দোকানের আলো। কয়েক মুহূর্ত পর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।

‘বাতির আলো এত বাড়ল কেন?’ ভীত চোখে চারপাশে তাকাতে লাগলাম।

‘ও কিছু না, ভোল্টেজ বেড়ে গিয়েছিল,’ মহিলা বলল। ‘শপিং মলের ইলেকট্রিশিয়ান বলেছে ওয়্যারিঙে নাকি গোলমাল হয়েছে। সেটা ঠিক করছে। বলেছে, মেরামতের সময় মাঝে মাঝে এ রকম হতে পারে।’

রঙিন কাগজ দিয়ে পুতুলের বাক্সটা সুন্দর করে মুড়ে দিল ও।

‘কী, আলোর সমস্যা নেই তো আর?’ সামনের দরজার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ। পরিচিত মনে হওয়ায় ফিরে তাকালাম। মেকানিক হিরাম স্কারপিনি।

‘না, নেই,’ মহিলা জবাব দিল। ‘হঠাৎ আলো কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল, তারপর ঠিক হয়ে গেছে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল স্কারপিনি, সেই অদ্ভুত হাসি। পুতুলের বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।

কিশোর আর মুসাকে কী বলব ভাবতে ভাবতে নীচে নামার এসকেলেটরে পা রাখতে যাব, পিছন থেকে বলে উঠল পরিচিত কণ্ঠ, ‘এসকেলেটর নষ্ট।’

ফিরে তাকালাম। এসকেলেটরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে হিরাম স্কারপিনি। আমার পিছন পিছন এসেছে।

আমি তাকাতেই আবার বলল, ‘চলে না। অচল হয়ে গেছে।’

‘কাল না দেখলাম ঠিক করলেন?’ আমি বললাম।

‘করেছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি। সমস্যা রয়েই গেছে। এসব একদিনে মেরামত করা যায় না,’ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হিরাম স্কারপিনি বলল। ‘এলিভেটরে চড়ে যাও।’

এই একটা কাজই আমি আর করতে চাই না—এলিভেটরে চড়ে নীচে নামা। ‘না, আমি এলিভেটরে চড়ব না, সিঁড়ি দিয়ে নামব।’

‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল লোকটা। ‘পারবে না। সিঁড়ির মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিস্ত্রিরা রঙ করছে ওখানে।’

অসহায় ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, নীচে নামতে হলে এলিভেটর ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার।

‘এলিভেটরকে তুমি ভয় পাও, তাই না?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল লোকটা। যেন আমার ভয় দেখে মজা পাচ্ছে।

জবাব না দিয়ে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম।

এলিভেটরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। একমাত্র আমিই আছি। আর কেউ নেই। অথচ আজ শনিবারের ভিড়ের দিন। দুপুরের খাবার সময়। এলিভেটরের সামনে লাইন থাকার কথা। কারণ খাবারের দোকানগুলো সব নীচে

বোতাম টিপলাম। এলিভেটর এল। দরজা খুলল। কেউ নেই ভিতরে। ঢুকব কি না দ্বিধা করছি, কে যেন আমার পিঠে ধাক্কা দিয়ে এলিভেটরের ভিতরে ঠেলে দিল।

লেগে গেল দরজাটা। দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোও নিভে গেল।

গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে এলিভেটরের ভিতরটা!

বারো

শান্ত, মসৃণ কণ্ঠের কথা শোনা গেল এলিভেটরের স্পিকারে, ভয় পেয়ো না। বৈদ্যুতিক সিসটেমে গণ্ডগোল হয়েছে। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে। প্যানেলে এইচ লেখা বোতামটা টিপে দাও, প্লিজ। তারপর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকো।’

হালকা, মৃদু আলো জ্বলে উঠল। কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকালাম। ফিরে এসেছে ‘এইচ’ লেখা বোতামটা।

যত খুশি নির্দেশ দিতে থাকুক স্পিকারে, মরে গেলেও আমি ওই বোতাম টিপব না।

কিন্তু কে যেন আমাকে দিয়ে জোর করেই বোতাম টেপাল। সেই অদৃশ্য হাতটাই হবে হয়তো, যেটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে এলিভেটরের ভিতর ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।

নড়ে উঠল এলিভেটর। নামতে শুরু করল।

মনে হলো যেন অনন্তকাল ধরে নেমেই চলেছি।

নেমে যাচ্ছি শপিং মলের নীচে, পাতালে।

তারপর হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল এলিভেটর।

সব কিছু স্তব্ধ। নিথর। অখণ্ড নীরবতা।

তারপর সেই মসৃণ কণ্ঠটা আবার বলল স্পিকারে, ‘তোমার শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেছ, রবিন। ভাল থাকো। ‘

দরজা খুলে গেল। আগেরবারের মতই তীব্র আলো পড়ল চোখে।

দুই হাতে চোখ ঢাকলাম।

আলো কমে এলে আবার যখন হাত সরালাম, দেখি সেই আজব বুনো অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছি। এলিভেটরকার থেকে কখন বেরোলাম, কীভাবে বেরোলাম, জানি না। কী ঘটে দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম না। ঘুরে দাঁড়ালাম, বট গাছের ফোকর দিয়ে এলিভেটরে ঢোকার জন্য। এখানে থাকতে চাই না আমি।

কিন্তু কোথায় গাছ?

নেই ওখানে!

‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করলাম। বনের অন্য কোনও অংশে চলে এসেছি হয়তো আমি। এখান থেকে বেরোনোর একটাই উপায়, বট গাছের ফোকর দিয়ে এলিভেটরে ঢোকা। তবে তার আগে গাছটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

সরু কাঁচা রাস্তা দেখে সেটা ধরে হেঁটে চললাম। আমার চারপাশে বড় বড় গাছ, কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। সবগুলোই তো দেখতে এক রকম, এর মাঝে সেই বিশেষ গাছটাকে খুঁজে বের করব কী করে? তারপর মনে পড়ল, যে গাছের ফোকর দিয়ে বেরিয়েছি, সেটার গোড়ায় মস্ত শিকড় রয়েছে। যাতে হোঁচট খেয়েছিলাম।

এগিয়ে চললাম। আমার দুই চোখের দৃষ্টি সেই শিকড় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর ওই বিশেষ গাছটাকে। এই ভয়ানক বনে কোনও রাক্ষুসে প্রাণী নেই তো, যে আমাকে ধরে খাওয়ার জন্য ওত পেতে রয়েছে? তবে এখন পর্যন্ত কোনও প্রাণী দেখিনি।

‘কী, রাস্তা খুঁজছ, রবিন?’ চিঁ-চিঁ করে ওপর থেকে কথা শোনা গেল।

থমকে দাঁড়ালাম। ওপরে তাকিয়ে দেখি, গাছের ডালে বসে কী যেন খাচ্ছে গ্রেগ জনসনের চেহারার সেই প্রাণীটা।

‘কী-কী চান আপনি?’ কোনমতে তুতলে বললাম। ‘আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে কেন? এখান থেকে বেরোব কী করে?’

‘হাঁটতে থাকো,’ হেসে বলল ও। ‘ঠিক পথেই এগোচ্ছ। শীঘ্রি তোমার পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে যাবে।’ হেসে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল ভূতুড়ে গ্রেগ জনসন। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁচা মাংস খাচ্ছে ও। ঠোঁটের কোণ বেয়ে লাল রস গড়াচ্ছে। রক্তের মত। শিউরে উঠলাম। তাড়াতাড়ি পা চালালাম ওখান থেকে সরে আসার জন্য।

একটা দোরাস্তার মাথায় পৌছলাম। কোন দিকে যাব এখন? ডানে, না বাঁয়ে?

‘ডানে যাও, ডানে!’ বলে উঠল একটা অদৃশ্য রাগত কণ্ঠ।

অবাক হয়ে চারপাশে তাকালাম, কে কথা বলে দেখার জন্য। যাকে দেখলাম, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হলো আমার।

শপিং মলের সেই দারোয়ান, আমি ঢোকার সময় প্রতিবারেই যে কটমট করে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভুতুড়ে গ্রেগ জনসনের মত এ-লোকটাকেও ভূতুড়ে লাগছে। হাত, মুখ, আর গায়ের চামড়া ফুলে উঠেছে, বড় বড় ফোঁড়ার মত। চুলগুলো সব জট পাকানো। এমনিতেই চেহারাটা ভাল না ওর, এই আজব ভূতুড়ে জগতে আরও বেশি ভয়ানক, বিকৃত লাগছে।

‘ডানের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও!’ ধমকে উঠল সে। ‘অন্য কাস্টোমারদের পথ আটকিয়ো না!’

কোথায় অন্য কাস্টোমার? একটা লোককেও তো দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেহটাই বিকৃত হয়ে যায়নি লোকটার, মনে হলো মগজটাও বিগড়ে গেছে।

এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। দ্রুত ডানের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটা। সামনের একটা পাহাড়ের দিকে।

গাছের দিকে যাচ্ছি, না আরও কোনও ভয়ঙ্কর জায়গায় চলেছি, জানি না। পিঠের ব্যাকপ্যাকটা টেনেটুনে সোজা করলাম।

‘আমার সামনে থেকে সরো!’ হঠাৎ গর্জে উঠল একটা কণ্ঠ। ‘আমি ব্যস্ত মানুষ! আমাকে যেতে দাও!’

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, শপিং মলের মালিক মিস্টার ওয়েভারলি। সারা মুখে বড় বড় লোম। অদ্ভুত চেহারার একটা মোটর সাইকেলে বসে রয়েছে। সামনের পাহাড় থেকে নেমে আসা রাস্তা ধরে এসেছে। কখন এসেছে, বলতে পারব না। আসতে শুনিনি মোটর সাইকেলটাকে।

তেরো

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মিস্টার ওয়েভারলি। লাফ দিয়ে বাঁয়ে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলাম ওকে। আমার প্রায় গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল ওর মোটর সাইকেল।

ওর কুৎসিত রোমশ মুখটার দিকে তাকিয়ে গা ঘিঘিন্ করতে লাগল।

‘মনে হয় পথ হারিয়েছ?’ শান্ত, ঠাণ্ডা একটা মহিলাকণ্ঠ কানে এল।

ফিরে তাকালাম। একটা গাছের অন্ধকার, ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে মহিলা।

‘কে আপনি?’ ঢোক গিলে কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। কথা বেরোতে চাইছে না গলা দিয়ে।

‘এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে?’ মহিলা বলল। ‘এই তো, একটু আগেই তো দেখা হলো আমাদের।’

ছায়া থেকে আলোয় বেরোল ও। চিনতে পারলাম। গ্রেগ জনসনের দোকানের সেই মহিলা। একই পোশাক পরা রয়েছে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। বড় বড় দাঁত দেখা যাচ্ছে। চোখা চোখা, ধারাল। দোকানে এমন দাঁত দেখিনি। স্বাভাবিক ছিল। আর চুলের জায়গায় চুলও নেই এখন, অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে, রূপকথার মেডিউসার মত। লম্বা সরু সরু আঙুলের মাথায় বড় বড় নখ।

একটা গাছের নীচে পার্ক করে রাখা একটা ছাতখোলা ভ্যান গাড়ি দেখিয়ে মহিলা বলল, ‘ওই গাড়িতে করে তোমাকে তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে আমাকে। প্লিজ, ভ্যানে উঠে বসো। যাত্রাটা খুব আরামের হবে, কথা দিতে পারি।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু জানি, কোন লাভ নেই। যে আমার পিছে লেগেছে, সে আমাকে খুঁজে বের করবেই।

দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী ঘটে। হয়তো পালানোর সুযোগ পেয়েও যেতে পারি। ভেবে, চুপচাপ ভ্যানের পিছনে উঠে বসলাম। মহিলা বসল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। ‘সিটবেল্ট পরো, প্লিজ। এটা এখানকার নিয়ম। কড়াকড়িভাবে নিয়ম মেনে চলি আমরা।’

বাহ্, দারণ কথা শুনলাম! এরা এখানে নিয়ম মেনে চলে! একটা ছেলেকে বাড়ি যেতে না দিয়ে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে আসাটা কোন নিয়মের মধ্যে পড়ে?

বেল্ট পরলাম।

চাকায় গড়িয়ে না চলে আচমকা এক লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল গাড়িটা। হেলিকপ্টারের মত সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে।

চেঁচিয়ে উঠলাম। পড়ে যাওয়ার ভয়ে গাড়ির কিনার খামচে ধরলাম। এতক্ষণে বুঝলাম, কেন সিটবেল্ট বাঁধার জন্য চাপাচাপি করা হয়েছে।

চোদ্দ

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ ইঞ্জিনের গর্জন আর বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। এরোপ্লেনের মত উড়ে চলেছে ভ্যান গাড়িটা।

কিন্তু জবাব দিল না মহিলা। হয় আমার কথা শোনেনি, নয়তো ইচ্ছে করেই জবাব দেয়নি। অনেক ওপরে উঠে নাক সোজা হলো গাড়ির। মাটি থেকে হাজার ফুট ওপর দিয়ে সোজাসুজি উড়ে চলল। কীভাবে ঘটছে এই অদ্ভুত কাণ্ডটা, শপিং মলের মাটির নীচে, মাথায় ঢুকছে না আমার। একমাত্র কল্পনাতেই সেটা সম্ভব। কিংবা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে।

নীচে তাকালাম। বড় বড় গাছে ঢাকা ঘন বন। মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। সামনে খানিকটা জায়গা দেখলাম, বন কেটে সাফ করা।

‘এক মিনিটের মধ্যেই নামব আমরা, তৈরি হও, প্লিজ, মহিলা বলল। ওকে মহিলা না বলে দানব-মহিলা বলাই ভাল। ওর মাথার দিকে তাকাতে চাইছি না পারতপক্ষে, তবুও চোখ চলে যায়। কিলবিল করেই চলেছে সাপগুলো। হেলান দিয়ে বসলাম। মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। মাথা গরম করে ফেললে কিংবা ভয়কে মগজটা গ্রাস করতে দিলে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারব না। পালানোর সুযোগ পাব না।

হেলিকপ্টারের মত সরাসরি মাটিতে গাড়ি নামাল দানব-মহিলা। এত আস্তে, আর নিখুঁতভাবে, কোন ঝাঁকুনিই টের পেলাম না।

গাড়ি থেকে নামল ও। সিটবেল্ট খোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আটকে গেছে ওটা

‘নোড়ো না, প্লিজ। তোমার জন্য পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত বসেই থাকতে হবে তোমাকে।’ বলে আমাকে একা রেখে তাড়াহুড়া করে চলে গেল দানব-মহিলা। ভয়ানক অসহায় লাগছে আমার। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে মরতে শপিং মলে এসেছিলাম! মা যতই বলুক, কোনমতেই আসা উচিত হয়নি আমার। তারপর মনে হলো, আচ্ছা স্বপ্ন দেখছি না তো? দুঃস্বপ্নে ঘটছে না তো ঘটনাগুলো?

নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম। ব্যথা লাগল। না, বাস্তবেই ঘটছে এসব। কিন্তু কীভাবে ঘটছে—এসব তো কেবল রূপকথার রাজ্যে কিংবা পরীর দেশেই সম্ভব—হাজার ভেবেও বুঝতে পারলাম না।

ফিরে এল দানব-মহিলা।

‘নেমে এসো,’ বলল ও।

‘পারছি না তো, আমার সিটবেল্ট আটকে গেছে,’ জবাব দিলাম।

আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি বাকল্স খুলে খসে পড়ল বেল্টটা। উঠে দাঁড়ালাম। পা ঝাড়া দিলাম। লাফিয়ে নামলাম মাটিতে।

‘এদিকে, প্লিজ,’ দানব-মহিলা বলল। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আমাকে খোলা জায়গাটা দিয়ে। দূরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল।

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমাদের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে,’ দানব-মহিলা জবাব দিল।

‘এই মালিকটি কে?’

‘ওঁর সঙ্গে দেখা হলেই বুঝবে।’

চুপ হয়ে গেল দানব-মহিলা। আর একটি কথাও বের করতে পারলাম না ওর মুখ থেকে।

নীরবে হেঁটে চলেছি আমরা। মস্ত এক মাঠের ওপর দিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বন কেটে তৈরি করে মাটি সমান করা হয়েছে, ইদানীং।

বাড়িটার দিকে এগোচ্ছি আমরা। সাদা রঙ করা, ছোট একটা বাড়ি। প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি। অদ্ভুত এক ধরনের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে দেয়ালগুলো থেকে, মনে হলো ভিতর থেকে আসছে আলোটা। কোনও দরজা-জানালা দেখলাম না বাড়িটার।

‘মালিক, আমরা এসেছি,’ বাড়িটার কাছে এসে ওটার দিকে তাকিয়ে দানব-মহিলা বলল।

একটা দরজা খুলে গেল। তারপর দ্রুত মিলিয়ে গেল পুরো বাড়িটা। যেন আলো দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, সুইচ অফ করে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।

দানব-মহিলা যাকে ‘মালিক’ বলে ডাকল, সে বসে আছে একটা সিংহাসনের ওপর। পরনে ঢোলা আলখেল্লা। মাথায় সোনার মুকুট। আলোয় ঝলমল করছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ও। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার রাজ্যে, তোমার নতুন বাড়িতে স্বাগতম, রবিন।’

হেসে উঠল ও।

ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই ‘মালিক’ শপিং মলের সেই মেকানিক, ছোটখাট মানুষটি, যার নাম হিরাম স্কারপিনি।

পনেরো

অন্যদের মত হিরাম স্কারপিনির চেহারার কোন পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল, তা-ই আছে। ভাবলাম, ওপরের মানুষের জগতের মতই এখানকার জগতেও মনিব কিংবা মালিক হলে তাকে কোন কিছু বদলাতে হয় না। সে নিজের ইচ্ছেয় খেয়ালখুশিমত চলতে পারে।

‘কী ঘটছে ভেবে খুব অবাক হচ্ছ, তাই না? নিশ্চয় ভাবছ, তুমি যা দেখছ, তোমার বন্ধুরা কেন সেসব দেখছে না?’ হিরাম স্কারপিনি বলল।

আমি ওকে স্কারপিনিই বলব, মালিক বলতে রাজি নই।

আবার খোলা জায়গাটা ধরে হেঁটে চলেছি আমরা। কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছে শপিং মলের মালিক মিস্টার ওয়েভারলি। আমাদের পিছন পিছন আসছে যেন বডিগার্ড হয়ে। ধমক ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলছে না হিরাম স্কারপিনি। আর বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটা পালন করার জন্য পাগল হয়ে উঠছে ওয়েভারলি

‘হ্যাঁ, কী ঘটছে জানার জন্য সামান্য কৌতূহল তো হচ্ছেই,’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

‘খুব সহজ,’ স্কারপিনি বলল। ‘শপিং মলে আমাকে তুমি কী করতে দেখেছ? মেকানিকের কাজ। ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ। যন্ত্রপাতি তদারকির কাজ। অন্যের কর্মচারী, চাকর। অথচ আগে আমি কারও চাকরি করিনি, আমার নিজের দোকান ছিল, ইলেকট্রিকের দোকান।

‘আপনার নিজের দোকান?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘কী হয়েছে ওটার?’

‘ওটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে। সোজা কথায়, আমাকে আমার জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, রবিন। সব কিছুই করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। মিস্টার ওয়েভারলির মত প্রভাবশালী আর টাকাওয়ালা কিছু মানুষ আমাকে তুলে নিয়ে স্রেফ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছে।’

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম ওয়েভারলির দিকে। আমাদের ঠিক পিছনেই রয়েছে। যন্ত্রের মত হাঁটছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, মালিক তো দূরের কথা, একেবারে গোলাম বনে গেছে। কোন ক্ষমতাই নেই আর ওর।

‘ওয়েভারলি আর ওর ক্ষমতাশালী চ্যালারা আমাকে আমার জায়গা থেকে তাড়িয়েছে, আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ও আমার মত আরও কয়েক ডজন ছোট ব্যবসায়ীর ভাত বন্ধ করেছে ওরা, পেটে লাথি মেরেছে। আমাদের জায়গা কেড়ে নিয়ে সেখানে বিশাল শপিং মল বানিয়েছে।’

‘ও, আপনাদের জায়গাতেই শপিং মল বানিয়েছে ওরা,’ সহানুভূতির সঙ্গে বললাম।

‘হ্যাঁ, রবিন, তুমিই একমাত্র আমার দুঃখ বুঝলে!’ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল স্কারপিনি। ‘এখন আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, সমান সমান হয়ে গেছে। কাজ যে আমি শুরু করেছি, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছ।’ ওয়েভারলির দিকে ফিরে ধমকে উঠল, ‘ তাই না, ওয়েভারলি?’

‘হ্যাঁ, মালিক, হ্যাঁ,’ তাড়াতাড়ি মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলে জবাব দিল ওয়েভারলি। ওর কণ্ঠস্বর, ওর চোখের চাহনি, সব কেমন যেন নিষ্প্রাণ। রোবট বানিয়ে দেয়া হয়েছে যেন লোকটাকে। যেন ওর মগজটাকে দখল করে নিয়েছে স্কারপিনি।

‘আমি যা করেছি, রবিন, সেটা করতে বহু সময় লেগেছে আমার। অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে। কষ্ট করতে হয়েছে। শপিং মলের সমস্ত ওয়্যারিংকে আমি রি-ওয়্যারিং করেছি। নতুন এক ধরনের কারেন্ট সাপ্লাই করেছি সেই নতুন তারের ভিতর দিয়ে, জানা না থাকলে ধরতেই পারবে না কেউ। একমাত্র আমি পারব, আমার বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে। প্রচণ্ড শক্তিশালী ওই কারেন্টের রশ্মি মগজে ঢুকলে ব্রেইনওয়েভ বদলে যায়। বোধবুদ্ধি লোপ পায়, চিন্তার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার গোলামে পরিণত হয়।’ ওয়েভারলির দিকে তাকাল স্কারপিনি। ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠল, ‘তাই না, ওয়েভারলি, তুমি এখন আমার কুত্তা না?’

‘হ্যাঁ, মালিক, হ্যাঁ!’ তাড়াতাড়ি মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করে জবাব দিল ওয়েভারলি।

বুঝলাম, ক্ষমতা এখন সত্যি সত্যি স্কারপিনির হাতে চলে গেছে। ওয়েভারলির ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। আরও যাদেরকে গোলাম বানিয়েছে ও, তারাও নিশ্চয় ওয়েভারলির পক্ষ নিয়ে ওয়েভারলিকে সহায়তা করেছে, স্কারপিনির ক্ষতি করেছে।

‘হুঁ, বুঝলাম,’ মাথা ঝাঁকালাম আমি। ‘ওদের অফিস আর দোকানের ভিতর বিশেষ কারেন্ট প্রবাহিত করে ওদের মগজ ধোলাই করেছেন, ওদের গোলাম বানিয়েছেন, কিন্তু ওদের চেহারার এই দুর্গতি কেন? সেটা বদলালেন কীভাবে?’

‘এটা আমি ইচ্ছে করে করিনি,’ জবাব দিল স্কারপিনি। ‘ওই কারেন্টের সাইড-এফেক্ট, অর্থাৎ, প্রতিক্রিয়া। আমি জানতাম না এমন হবে। তবে হওয়াতে আমি খুশিই হয়েছি। যেমন শয়তান ওরা, ওদের উপযুক্ত শাস্তি। আমার প্রতি যে ভয়ঙ্কর অন্যায় আচরণ করেছে ওরা, সেটাই এখন ওদের চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে।’

চারপাশে তাকালাম। আবার ঘন বনের প্রান্তে চলে এসেছি। শান্ত থাকার ভান করছি, তবে মনে প্রচণ্ড ভাবনার ঝড় চলেছে আমার। স্কারপিনির জায়গা দখল করে সেখানে শপিং মল বানানোয় ওর প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে লোকটা উন্মাদ। কারণ, আমাকেও ধরে নিয়ে এসেছে। আমি তো ওর কোন ক্ষতি করিনি। এই উন্মাদটার কবল থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছি মনে মনে। পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে ওয়েভারলি। ঘুরে যে পিছন ফিরে দৌড় দেব, তারও উপায় নেই। যদিও জানি, এই অদ্ভুত ফ্যান্টাসির জগতে শুধু দৌড় দিয়ে পালাতে পারব না স্কারপিনির হাত থেকে।

‘আপনার যুক্তি ঠিকই আছে, মিস্টার স্কারপিনি,’ আমি বললাম। জ্বলে উঠল ওর চোখ, বোধহয় আমি নাম ধরে ডাকাতেই। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বললাম, ‘সরি, মালিক, আমি আপনাকে রাগাতে চাইনি।’ চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার স্কারপিনির। বললাম, ‘এই লোকগুলো নাহয় আপনার ব্যবসার ক্ষতি করেছে, কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। আপনার সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই আমার। এমনকী আপনাকে ভাল করে চিনিও না আমি।’

হাসল স্কারপিনি। ‘না, রবিন, তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই। বরং তুমি আমার জন্য একটা বিরাট সম্ভাবনা।’

‘সম্ভাবনা?’ বুঝতে পারলাম না।

‘তোমার স্কুলের রেকর্ড দেখেছি আমি, রবিন। তোমার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে, গল্প বলার ট্যালেন্ট, খুব ভাল স্টোরি টেলার তুমি। গুছিয়ে গল্প বলতে পারো। বুঝলাম, তুমি আমার কাজে লাগবে। তাই তোমার ওপর নজর রাখতে শুরু করলাম। একদিন সবাই যখন তোমরা তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে, তোমার বেডরুমে ঢুকে তোমার টেবিল ল্যাম্পের বাল্বটা বদলে আমার তৈরি একটা স্পেশাল বাল্‌ব্‌ লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। সেটা জ্বাললেই তোমার মগজের ওয়েভলেংথে ঢুকতে থাকে স্পেশাল কারেন্ট, তোমার কল্পনাকে বাড়িয়ে দেয়, অদ্ভুত সব জিনিস কল্পনা করতে থাকো। স্বপ্নে তো বটেই, অনেক সময় জেগে থেকেও ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাও। উদ্ভট সব জিনিস দেখতে থাকো।’

এতক্ষণে পরিষ্কার হলো রহস্য। বুঝলাম, কিছুদিন থেকে হঠাৎ করে কেন এভাবে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। জেগে থাকলে হ্যালুসিনেশন দেখি। শপিং মলের আরও কয়েকজনের মত আমিও স্কারপিনির উদ্ভাবিত ইলেকট্রিক যন্ত্রের শিকার। তবে ওদের মত আমাকে রোবট বানায়নি স্কারপিনি, আমার মগজ দখল করে আমার চিন্তাভাবনাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেনি।

‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘আমার ওপর আপনার কারেন্ট পরীক্ষা করতে গেলেন কেন?’

হাসল স্কারপিনি। কেমন অস্থির দেখাল হাসিটা। পাগলের হাসি। ‘রবিন, একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, আধুনিক যে সব শপিং মলগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে জিনিস বিক্রির পাশাপাশি নানারকম ‘আকর্ষণ’ থাকে, মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য। যে যত বেশি বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারে, তার শপিং মল তত বেশি চলে। আমারটাকে আমি সেরা বানাতে চাই। তুমিও সেখানে অংশ গ্রহণ করবে। তোমার বিনোদন শোটার নাম দেব আমি রবিন শো!’

‘মানে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আমাকে শপিং মলের আকর্ষণ বানাবেন! লোকের বিনোদনের বস্তু বানাবেন আমাকে! তারমানে পুতুল বানিয়ে গেটের কাছে দাঁড় করিয়ে রাখতে চান?’

‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল স্কারপিনি। হাসল। ‘পুতুল না, হিউম্যান স্টোরি মেশিন! ছোটদের প্রধান আকর্ষণ হবে তুমি। বাবা-মা’রা তাদের বাচ্চাদের এই স্টোরি মেশিন দেখাতে নিয়ে আসবে। অনর্গল গল্প বলে যাবে তুমি। দারুণ আকর্ষণীয়, অদ্ভুত সব গল্প। শোনার জন্য ভিড় জমাবে ছেলেমেয়েরা, বাকি শপিং মলগুলোর ব্যবসা লাটে উঠবে!’

‘আপনি পাগল, মিস্টার স্কারপিনি!’ আর না বলে পারলাম না। ‘উন্মাদ!’

আমার কথায় রাগ করল না স্কারপিনি। বোঝানোর চেষ্টা করল আমাকে, ‘তুমি হবে একটা মস্ত হিট, রবিন! ভেবে দেখো। আমার মেশিন থেকে আরও একটু কারেন্ট সরাসরি তোমার মগজে প্রবাহিত করে দিলে দুনিয়ার সেরা গল্পকার হয়ে যাবে তুমি। সারা শহরের ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়বে তোমার গল্প শোনার জন্য। তুমি ওদের ভয়ের গল্প শোনাবে, ভূতের গল্প শোনাবে, ছোটরা যত ধরনের গল্প শুনতে পছন্দ করে, সব শোনাবে। আতঙ্কিত, বিমোহিত করে দেবে ওদের। নেশাগ্রস্ত করে ফেলবে। তোমার গল্প শোনার জন্য পাগল হয়ে যাবে ওরা। রোজ ছুটে চলে আসবে তোমার কাছে। রাতে শপিং মল যখন বন্ধ থাকবে, গল্পগুলো তুমি কম্পিউটারে কম্পোজ করে লিখে ফেলবে। সেসব ছেপে বই বানিয়ে বাজারে ছাড়ব আমি। বিখ্যাত হয়ে যাবে তুমি। আর আমি হব কোটি কোটি টাকার মালিক!’

‘মনে হচ্ছে এখন আমার যাওয়া উচিত,’ স্কারপিনির আমাকে বিখ্যাত বানানোর পরিকল্পনা আমার মনে দাগ কাটতে পারল না। বরং আরও আতঙ্কিত করে তুলল। এক কদম পিছিয়ে গেলাম। ‘মা চিন্তা করবে। জরুরি জিনিস কিনতে শপিং মলে পাঠিয়েছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি না গেলে শেষে পুলিশকেও ফোন করতে পারে।’

পুলিশের কথায় কোনরকম ভাবান্তর হলো না স্কারপিনির। বলল, ‘না, রবিন, অন্য কোথাও আর যাওয়া হবে না তোমার। এখন থেকে এটাই তোমার আসল বাড়ি। এখানেই থাকবে চিরকাল।’ ওয়েভারলির দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, হাঁ করে দেখছ কী? এদিকে এসো! ঠেকাও একে!’

মুহূর্তে স্কারপিনির পাশে চলে এল ওয়েভারলি। ওর হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা পিস্তলের মত জিনিস।’

‘বলুন, মালিক,’ ওয়েভারলি বলল।

‘মনে হচ্ছে, আমাদের এই কিশোর বন্ধুটির আরও খানিকটা মগজ ধোলাই দরকার,’ স্কারপিনি বলল। ‘অলটার লেখা বোতামটা টিপে দাও!’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার আবিষ্কৃত ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক-গান। অনেক কাজ হয় এটা দিয়ে। তার মধ্যে একটা হলো, মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে পরিবর্তন করে দেয়া। যাতে সে আর তার নিজের ভাবনায় চলতে না পারে।’

আতঙ্কিত চোখে ইলেকট্রিক গানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

গানের পাশে লাগানো কয়েকটা বোতামের একটা টিপল ওয়েভারলি। তারপর নলটা পিস্তলের মত তুলে ধরে তাক করল আমার কপালের দিকে। ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে আঙুল!

ষোলো

ঝপ করে মাটিতে বসে গড়িয়ে সরে গেলাম একটা ঝোপের ভিতর। লুকিয়ে পড়লাম।

‘মিস করলে তো, গাধা কোথাকার!’ প্রচণ্ড রাগে ধমকে উঠল স্কারপিনি। ‘জলদি ধরো! কোনমতেই যেন পালাতে না পারে!’

হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে লাগলাম ঝোপের সারির ভিতর দিয়ে। স্কারপিনি, ওয়েভারলি, গ্রেগ জনসন আর দানব-মহিলা, সবাই খুঁজছে আমাকে। চারজনের হাতেই এখন একটা করে ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক গান।

আতঙ্কিত হয়ে কোনমতেই এখন মগজ গরম করা চলবে না, নিজেকে বোঝালাম। পালানোর উপায় বের করতে হবে।

ঝোপের ভিতরে ভিতরে ওদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা সরে এলাম। হামাগুড়ি দিতে দিতে ক্লান্তি লাগছে। সামান্য জিরিয়ে নেয়ার জন্য ঘন ঝোপের আড়ালে একটা গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে বসলাম। একইসঙ্গে ভাবতে লাগলাম, পালানোর উপায়। বট গাছটার কথা মনে পড়ল। ওটার কাছে যেতে হবে আমাকে, যেভাবেই হোক। ওটা খুঁজে বের করতে হবে। ওটার ভিতরের এলিভেটরে চড়তে না পারলে ওপরের জগতে যেতে পারব না আমি।

ঘাড়ে হাত বোলালাম। ব্যাকপ্যাকের ভিতর স্কেট দুটো চাপ দিচ্ছে পিঠে

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে গেলাম।

স্কেট!

তাই তো! এগুলো পরে ছুটতে থাকলে আমার সঙ্গে দৌড়ে পারবে না ওরা। তা ছাড়া দূর থেকে ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক গান দিয়ে আমাকে নিশানা করাটা তখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাবে ওদের জন্য।

স্কারপিনির কথা শোনা যাচ্ছে। কাছে চলে আসছে ওরা। জুতো জোড়া খুলে রাখলাম। ব্যাকপ্যাক থেকে স্কেট আর নি-প্যাড বের করে পরলাম। গলার কাছে ঝুলছে হেলমেটটা। সোজা করে বসালাম মাথায়।

তারপর উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে রয়েছে গ্রেগ জনসন। এখনও দেখেনি আমাকে।

জানি, পারব না, তবু ঝোপ থেকে চুপি চুপি ওর চোখ এড়িয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলাম।

কিন্তু পারলাম না। ঠিকই দেখে ফেলল আমাকে।

গ্রেগ জনসনের চিৎকার শোনা গেল, ‘ওই যে, ওই যে ও, মালিক।’

‘ট্রিগার টেপো, ট্রিগার টেপো, গাধা কোথাকার!

মুখ ফিরিয়ে পলকের জন্য দেখলাম, ইলেকট্রিক গান তুলে আমাকে নিশানা করছে গ্রেগ জনসন।

সতেরো

মাটি থেকে টান দিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে গ্রেগ জনসনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম।

থ্যাক করে ওর পেটে গিয়ে লাগল ব্যাগটা। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে ইলেকট্রিক গানটা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ও।

‘কী, খুব ব্যথা লাগল! আর বদলাতে আসবেন মানুষের মগজ?’ রাগে চেঁচিয়ে বললাম।

লাফ দিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে গ্রেগ জনসনের পাশ দিয়ে স্কেটিং করে ছুটলাম। আমার দিকে নজর দেয়ার অবস্থা নেই ওর। পেট চেপে ধরে গোঙাচ্ছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু হয়ে ছোঁ দিয়ে মাটি থেকে তুলে নিলাম ইলেকট্রিক গানটা। ব্যাকপ্যাকটা তুলতে যাব, এ সময় কানে এল চিৎকার। তোলার আর সময় পেলাম না। ওটা নিতে না পারলে নিনার পুতুল, মা’র চশমা আর প্রেশার কুকারের ওয়াশারটা যাবে। তবে ওসব জিনিস আবার কিনতে পারব। কিন্তু প্রাণটা খোয়ালে আর ফেরত পাব না।

পাহাড়ের দিকে ছুটলাম। পাশের একটা গাছের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল দানব-মহিলা। হাতের ইলেকট্রিক গানটা তুলে ধরে আমি কাছে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল।

গ্রেগ জনসনের ইলেকট্রিক গানটা দু’হাতে চেপে ধরে উঁচু করলাম। ছোটা বন্ধ করলাম না।

স্কেটিং করে যত দ্রুত সম্ভব ছুটছি। দানব-মহিলার কাছাকাছি চলে এসেছি। আরেকটু গেলেই গায়ের ওপর পড়ব। আমাকে লক্ষ্য করে বৈদ্যুতিক রশ্মি ছুঁড়তে শুরু করল ও।

মাথা নিচু করে, এদিকে সরে, ওদিকে সরে ওর নিশানা ব্যর্থ করে দিতে লাগলাম। ইলেকট্রিক গানের নল দিয়ে বেরোনো কিছু রশ্মি আমার হেলমেটে লেগে ফসকে গেল। আমার মাথায় ঢুকল না।

দানব-মহিলার পাশ কাটানোর সময় হা-হা করে হাসলাম। স্কেটিং করে চলে এলাম অন্যপাশে। ইলেট্রিক গানের কারেন্ট সামান্যতম প্রভাব ফেলতে পারেনি আমার মগজে। ঢোকেইনি, প্রভাব ফেলবে কী। তাতে সাহস ফিরে পেয়েছি। বাতাসের গতিতে ছুটে চলেছি স্কেটিং করে। আমার মগজ এখন পরিষ্কার। ঠিকমত ভাবতে পারছি। মুক্তির গন্ধ পাচ্ছি।

তবে এখনও অনেক দেরি আছে। প্রথমে সেই বট গাছটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। হাজারও গাছ রয়েছে এই এলাকায়। সঠিক গাছটা খুঁজে পেতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। কিংবা আরও বেশি সময়। গাছটা না পেলে বেরোতে পারব না।

সরু কাঁচা রাস্তার একটা বাঁক পেরোলাম। আর, হঠাৎ করেই, সামনে দেখা গেল ওটা। মস্ত, ফুলে ওঠা, বড় বড় শিকড়। আমার জন্য এখন সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য।

ছুটে এলাম গাছটার কাছে। ঠেলা দিলাম গাছের গায়ে। ভাবলাম, আগের বারের মতই খুলে যাবে। কিন্তু কিছুই ঘটল না।

‘এলিভেটরের দরজা তখনই খোলে, রবিন, আমি যখন চাই,’ পিছন থেকে শোনা গেল একটা মোলায়েম, ভীতিকর কণ্ঠ।

ফিরে তাকালাম। এগিয়ে আসছে স্কারপিনি। হাতে একটা যন্ত্ৰ। নিশ্চয় ওর উদ্ভাবিত যন্ত্র। ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক গান দিয়ে গুলি করে আমার কিছু করতে পারেনি দানব-মহিলা, নিশ্চয় দেখেছে ও। তাই আরও শক্তিশালী যন্ত্র নিয়ে এসেছে।

‘তুমি কিন্তু মোটেও সহযোগিতা করছ না, রবিন,’ মৃদু অভিযোগের সুরে বলল স্কারপিনি। ‘তুমি আমাকে হতাশ করেছ। কাজেই আমি তোমাকে শাস্তি দেব। এই যন্ত্রের রশ্মি তোমার মগজে সামান্য একটুখানি ঢুকিয়ে দিলেই সারা জীবনের জন্য আমার গোলাম হয়ে যাবে তুমি। আমার প্রতিটি নির্দেশ পালন করে চলবে। যখন যা বলব, নির্দ্বিধায় করবে।’

হেসে উঠল স্কারপিনি। যন্ত্রটা উঁচু করে ধরল। আমার ওপর লক্ষ্য স্থির করছে। গাছের গায়ে জোরে জোরে কিল মারতে লাগলাম। কিন্তু দরজাও খুলল না, এলিভেটরও এল না। নিজেকে বাঁচানোর মাত্র একটা সুযোগ আছে আর, বুঝতে পারলাম। কাজটা করতে যদিও ভাল লাগবে না আমার। কিন্তু করতে হবে। স্কারপিনি আমাকে বাধ্য করে ফেলেছে।

স্কারপিনির যন্ত্রটার গায়ে একটা টেলিস্কোপের মত জিনিস লাগানো। সেটার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আমাকে নিশানা করছে ও।

গ্রেগ জনসনের কাছ থেকে নেয়া ব্রেন-অলটারিং গানটা হাতেই রয়েছে আমার। উঁচু করে ধরলাম। তারপর স্কারপিনি ওর যন্ত্রের বোতাম টেপার আগেই ওকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপলাম।

আঠারো

পিস্তলের নলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল এক ঝলক রশ্মি। মুহূর্তে সাদা আভায় ঢেকে গেল স্কারপিনির মুখ। পলকে চোখের দৃষ্টি বদলে গেল ওর, নিষ্প্রাণ শূন্য দৃষ্টি দেখা গেল চোখে। হাত থেকে খসে পড়ল যন্ত্রটা। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে প্রচণ্ড এক আর্ত চিৎকার দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। দৌড়ে ঢুকে গেল বনের ভিতরে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম। কতক্ষণ যে দম বন্ধ করে রেখেছিলাম জানি না। গাছের গায়ে হেলান দিলাম। আমার কাঁধের চাপ লাগতেই খুলে গেল দরজা। এসে গেছে এলিভেটর। হাতের ইলেকট্রিক গানটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লাম এলিভেটরে। ‘জি’ বোতামটা টিপে দিলাম। দ্রুত উঠতে শুরু করল এলিভেটর। বোতামের প্যানেলের দিকে তাকালাম। ‘এইচ’ বোতামটা নেই। আবার উধাও হয়ে গেছে।

পুরো একটা মিনিট লাগল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে উঠতে। থেমে দাঁড়াল এলিভেটর। দরজা খুলল। বেরিয়ে এলাম শপিং মলের নীচতলার বারান্দায়। আর কোন খারাপ অনুভূতি নেই এখন।

চারদিকে লোকের ভিড়।

‘এই, রবিন!’ পরিচিত কণ্ঠের ডাক শোনা গেল।

ফিরে তাকালাম। হাত নাড়ছে কিশোর। পাশে দাঁড়ানো মুসা। একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে রয়েছে ওরা। হেসে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। আর ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে দ্বিধা নেই আমার।

উনিশ

আরাম করে বসে হট ডগ আর স্যাণ্ডউইচ খেলাম। তারপর বললাম, আমি জিনিস কিনতে যাচ্ছি।

‘তখন না একবার কিনতে গেলে?’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল কিশোর। ‘এতক্ষণ তাহলে কোথায় কাটিয়ে এলে?’

জবাব দিলাম না।

আমার পায়ের দিকে আঙুল তুলল ও। শপিং মলের ভিতরেও স্কেট পরে আছো কেন? তোমার ব্যাকপ্যাক কোথায়? তোমার জুতো?’

‘নিশ্চয় কোথাও ফেলে এসেছি,’ বললাম।

আমার জবাব শুনে ভ্রূকুটি করল কিশোর। মুসার দিকে তাকাল। স্কেট দুটো খুলে নিলাম। ‘মুসা, তোমার ব্যাকপ্যাকে বাড়তি জুতো কিংবা স্যাণ্ডেল-ট্যাণ্ডেল আছে? দাও তো পরি। রাতে যখন নিনার জন্মদিনের পার্টিতে আসবে, তখন ফেরত দেব।’

আমি জানি, মুসা একজোড়া বাড়তি কাপড়ের জুতো রাখে ওর ব্যাগে। ব্যায়াম করার সময় পরে।

জুতো বের করে দিল ও। আমার চেয়ে ওর পা বড়, তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারব।

জুতো পরে, আমার দুই বিস্মিত বন্ধুকে হাঁ করিয়ে রেখে, রওনা হলাম। দরজা দিয়ে বেরোনোর আগে ফিরে তাকালাম। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ওরা, নিশ্চয় ভাবছে, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মুচকি হেসে বেরিয়ে এলাম।

সোজা এগোলাম এসকেলেটরের দিকে। একের পর এক এসকেলেটর বদলে উঠে এলাম পঞ্চম তলায়। পকেটে টাকা আছে। তাই আরেকটা এভিয়েটর ডল কিনতে অসুবিধে হলো না। তবে গ্রেগ জনসনের দোকানে ঢুকে কী অবস্থা দেখতে পাব, সেটা ভেবে কিছুটা ভয় ভয় লাগল। নতুন কোনও বিপদে পড়তে চাই না।

ডল এম্পোরিয়ামের দিকে ঢোকার সময় সতর্ক রইলাম। সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই ছুটে পালাব। আশপাশে কয়েকজন কাস্টোমারকে দেখলাম। আগেরবারের মত নির্জন নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলো আমার কাছে। যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়লাম দোকানের ভিতর।

তাকে রাখা একটা এভিয়েটর ডল দেখলাম।

‘কী লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ।

ফিরে তাকালাম। গ্রেগ জনসন! মুখে কথা সরছে না আমার। তাকিয়ে আছি। শেষবার যখন দেখা হয়েছে, আমার ছুঁড়ে দেয়া ব্যাকপ্যাকের আঘাতে ব্যথায় পেট চেপে ধরে কাতরাচ্ছে ও। এত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হলো কী করে!

‘কী খুঁজছ? এভিয়েটর ডল?’ আমাকে পুতুলটার দিকে তাকাতে দেখেছে নিশ্চয় গ্রেগ জনসন। হেসে বলল, ‘নিতে পারো। এ পুতুলের খুব চাহিদা। প্রচুর বিক্রি হয়।’

গ্রেগ জনসনের আচরণে মনেই হলো না, এর আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। চিনতেই পারল না যেন আমাকে। ওর ভাবসাবও আমূল বদলে গেছে। আন্তরিক, হাসিখুশি ভঙ্গি। সাবলীল কথাবার্তা।

আমিও হাসলাম। স্কারপিনিকে রশ্মির আঘাত হানার পর নিশ্চয় এমন কিছু ঘটেছে, গোলামদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ও। আর তাতে স্বাভাবিক হয়ে গেছে গ্রেগ জনসন।

তবু ভয় গেল না আমার। তাই বেশি দেরি করতে চাইলাম না। তাড়াতাড়ি একটা পুতুল কিনে নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।

তারপর প্রেশার কুকারের ওয়াশার যে দোকানে পাওয়া যায় সেটাতে ঢুকলাম। সেই মহিলা দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের ওপাশে, একটু আগেও যে দানব হয়ে ছিল। কিন্তু এখন ওর উষ্ণ হাসি দেখে মনেই হলো না, কিছুক্ষণ আগে ইলেকট্রিক গান হাতে আমাকে গুলি করার জন্য তাড়া করেছিল ও। গ্রেগ জনসনের মতই এই মহিলাও যেন চিনতে পারল না আমাকে। আচরণও খুব স্বাভাবিক। আর মাথার চুলের জায়গায় চুলই আছে, সাপ নয়।

একটা ওয়াশার কিনে বেরিয়ে এলাম। তারপর ঢুকলাম চশমার দোকানে। নতুন একটা ফ্রেম নিলাম, অবিকল সেটার মত, মা যেটা রেখে গিয়েছিল। চশমায় কাঁচ লাগাতে সময় লাগবে। আমাকে বসতে বলল মহিলা। বসতে আপত্তি নেই আমার, কিন্তু সমস্যাটা হলো, মা’র চোখের পাওয়ার কত, সেটা জানব কীভাবে? মহিলাকে বললাম, আগের চশমাটা হারিয়ে ফেলেছি। প্রেসক্রিপশন আনতেও ভুলে গেছি। তার খাতায় পাওয়ার লেখা আছে কি না, দেখতে অনুরোধ করলাম।

রেজিস্টার দেখে সহজেই বের করে ফেলল মহিলা। পনেরো মিনিটের মধ্যেই কাঁচ লাগিয়ে দিল চশমার কারিগর। ছোট পলিথিনের ব্যাগে চশমা, বেল্টের প্যাকেট, আর পুতুলের বাক্স ভরে নিয়ে হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম।

দুই-দুইবার একই জিনিস কিনতে গিয়ে আমার হাতখরচ থেকে জমানো সমস্ত টাকা খরচ করে ফেললাম। তবে তাতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার। বেঁচে ফেরার আনন্দে মশগুল হয়ে আছি। এসকেলেটরের দিকে এগোলাম।

শপিং মলের ইউনিফর্ম পরা একজন মেকানিক পিছন ফিরে স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে কাজ করছে। স্কারপিনি না তো! পিছন থেকে তো লোকটাকে স্কারপিনির মতই লাগছে!

বুকের ভিতর কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল আমার। ঘুরে দৌড় দেয়ার কথা ভাবলাম। কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহল এসকেলেটরের দিকে টেনে নিয়ে গেল আমাকে।

স্কারপিনি কি আমাকে চিনতে পারবে? নাকি আর সবার মতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, আমাকে আর চিনতে পারবে না?

এসকেলেটরের কাছে চলে এসেছি, হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বসল লোকটা। চোখাচোখি হলো আমাদের।

না, ও স্কারপিনি নয়। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় পিছন থেকে স্কারপিনির মত লাগছিল। এ অন্য লোক। বয়েসও অনেক কম। আগে কখনও দেখিনি একে। এসকেলেটর মেরামত করছে।

‘এসকেলেটর তো চলবে না এখন,’ লোকটা বলল আমার দিকে তাকিয়ে। ‘স্ক্রু ঢিলে হয়ে আছে। সেগুলো টাইট করে তারপর চালু করব আবার। এলিভেটর দিয়ে নামো। ইচ্ছে করলে সিঁড়ি দিয়েও নামতে পারো।’

‘আপনি কি এখানে নতুন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘আগে তো কখনও দেখিনি।’

‘হ্যাঁ, নতুন,’ হেসে জবাব দিল লোকটা। ‘আজই জয়েন করলাম।’

আগের মেকানিক স্কারপিনির কী হয়েছে?’

শ্রাগ করল ও। ‘ওর কোন খবর নেই। কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে। কিন্তু কাজ তো আটকে থাকতে পারে না। তাই আমাকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে।’

লোকটার বুকে লাগানো ট্যাগে নাম লেখা রয়েছে : জর্জ ডেনভার।

‘নাহ্, সিঁড়ি দিয়েই নামি,’ জর্জকে বলে ঘুরে দাঁড়ালাম। এই শপিং মলের এলিভেটরে চড়ার সাহস আর আমার নেই। যদিও আমি নিশ্চিত, এবার আর কোন বিপদ ঘটবে না। ‘এইচ’ লেখা বোতামটাও আর দেখতে পাব না। তবু এলিভেটরে চড়লাম না। সিঁড়ি দিয়েই চার তলায় নামলাম। সেখান থেকে এসকেলেটরে চড়ে গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।

গেট দিয়ে বেরোনোর সময় শপিং মলের গার্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আগেরবারের মত কটমট করে তাকাল না। একবার তাকিয়েই অন্যদিকে চোখ ফেরাল ও।

গেটের বাইরে এসে জুতো খুলে স্কেট পায়ে দিলাম। জুতোগুলো পলিথিনের ব্যাগে রাখতে গিয়ে আরেকটা ব্যাকপ্যাকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। আগেরটা কোনওদিন আর খুঁজে পাব না। কয়েকদিন পরেই আমার জন্মদিন। মা’র কাছে উপহার হিসেবে একটা ভাল ব্যাকপ্যাকের আবদার করব। আরেকটা পুরানো ব্যাকপ্যাক আছে আমার আলমারিতে, ততদিন সেটা দিয়ে চালিয়ে নিতে পারব।

রোদ ঝলমলে দিন। আকাশের দিকে তাকালাম। সাদা, পাতলা মেঘের ছোট ছোট খণ্ড পেঁজা তুলোর মত ভেসে চলেছে। চমৎকার আবহাওয়া। স্কেটিঙের জন্য আদর্শ দিন।

বাড়ি রওনা হলাম। অদ্ভুত এক আনন্দ মনে। মগজে জোর করে ঢোকানো স্কারপিনির ইলেকট্রিক স্রোতের প্রবাহ কেটে যাওয়ায় আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে ব্রেইনওয়েভ। মনের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়, অতিকল্পনা সব কেটে গেছে। অনেক দিন পর আবার শান্তি লাগছে। স্কেটিং করে মহাআনন্দে ছুটে চললাম রাস্তা ধরে, আচরণে কোনরকম অস্বাভাবিকতা নেই, জড়তা নেই; আমার মত একজন কিশোরের যা করা উচিত, তা-ই করছি।

এখন বাড়ি ফিরে প্রথমেই যে কাজটা করতে হবে আমাকে, আমার ঘরের টেবিল ল্যাম্পের বাল্বটা বদলে ফেলা। যাতে আবার ওটা আমার মগজের স্বাভাবিক ব্রেইনওয়েভ বদলে দিয়ে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখাতে না পারে।

***

1 Comment
Collapse Comments

Very nice. It will be a pleasure if you also add volume 131,135 and 141. I appreciate your work.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *