২.১০ প্রত্যাশিত সংবাদ

১০

প্রত্যাশিত সংবাদ—বহুপূর্বেই প্রত্যাশিত—ভীষ্ম যে এখনও, এই বয়সেও দশ দিন এমন প্রচণ্ড যুদ্ধ করবেন, করতে পারবেন এবং তার মধ্যে তিনচারটি রাত্রিও সঙ্কুল যুদ্ধ—তা আশা করেননি তত্রাচ তাঁর পতনের সংবাদ শুনে বিস্মিতই বোধ করলেন কর্ণ। বহুক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস হতে চাইল না—চর বা দূতকে পুনরক্তি করতে হ’ল।

অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য—এইটেই মনে হতে লাগল বার বার, এই শব্দটিই পুনঃ পুনঃ আঘাত করতে লাগল ওঁর ধারণা ও চিন্তাশক্তিকে ।

হিমালয় পর্বত দ্রবীভূত হয়ে সাগরে পরিণত হয়েছে অথবা সপ্ত সমুদ্র শুষ্ক হয়ে মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে—এমনি কোন সংবাদ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মুখে শ্রবণ করলে মনে যেমন বিহ্বলতা দেখা দেয়, তেমনিই একটা সৰ্বেন্দ্রিয়-শিথিল- করা বিহ্বলতা জাগল মনে।

অথচ কেন যে এমন অবিশ্বাস্য তা তিনি জানেন না, বলতে পারবেন না।

চরমুখে নিত্য শুধু নয়, প্রহরে প্রহরে–বস্তুত দণ্ডে দণ্ডে যুদ্ধের সংবাদ পাচ্ছিলেন। কখনও বা তেমন উত্তেজক ঘটনাপ্রবাহ দেখা দিলে আরও অল্পকাল ব্যবধানে। কুরুপক্ষনিয়ন্তা দুর্যোধনও ওঁর জন্য বহুসংখ্যক চর নিযুক্ত করেছিলেন, কর্ণর নিজস্ব চরও কিছু ছিল। তারা ক্রমাগত, প্রায় চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছিল, অর্থাৎ একজন যখন রণক্ষেত্র থেকে নির্গত হচ্ছে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে নিয়ে—তখন আর একজন সেখানে পৌঁছে গেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ জন শিবির বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে আসছে।

ফলে কোন তথ্যই অনবগত ছিলেন না কর্ণ। এ কদিনই ভীষ্ম আশ্চর্য অসংঘটিতপূর্ব যুদ্ধ করেছেন, এতাবৎ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন যুদ্ধের অবতারণা কুত্রাপি হয়নি, কিন্তু তবু ক্রমাগত কৌরবপক্ষ ক্ষীয়মাণ হয়েছেন। দুর্যোধনের কয়েক ভ্রাতা বিনষ্ট হয়েছে, শকুনির ছয় ভ্রাতা গেছেন—আরও বহু রথী নিহত বা সাংঘাতিক আহত হয়েছেন। পাণ্ডব পক্ষেও অগণিত পদাতিক, সাধারণ রথী এং কিছু কিছু বিশিষ্ট যোদ্ধা হত হয়েছেন—তার মধ্যে বিরাটের তিন পুত্রই প্রধান–তবু সামগ্রিক ভাবে পাণ্ডবপক্ষই অধিকতর শক্তিশালী ও অপেক্ষাকৃত অল্প-ক্ষতিগ্রস্ত বোধ হচ্ছে। এটা সাধারণ ধারণা, কোন হিসাবের ফল নয়। কৌরবপক্ষে এখনও প্রবীণ ও বিচক্ষণ মহারথীদের সংখ্যা কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি কর্ণ এতাবৎ-কাল রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হলেও ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, অলম্বুষ, শল্য, দুর্যোধন, দুঃশাসন এঁরাও যোদ্ধা হিসাবে নিতান্ত অবজ্ঞেয় নন—সকলেই মহা শস্ত্রজ্ঞ, রণকুশলী মহাবীর যোদ্ধা ভীষ্ম, দ্রোণ তো অপরাজেয় বলেই গণ্য হন, তবু কুরুপক্ষের মনোবল যে ক্রমশই ভেঙে পড়ছে—তা সাধারণ সৈনিকদের বা বিভিন্ন সরবরাহকারক, প্রহরী, সেবক প্রভৃতি অন্যান্য কর্মীদের হতাশামিশ্রিত কথোপকথন, ভয়ার্ত বিলাপ থেকেই পরিস্ফুট হচ্ছে।

চরমুখে সে সকলের প্রতিটি সংবাদ পাচ্ছেন অঙ্গাধিপতি। তিনি নিজেও রাত্রে যুদ্ধের অবহার ঘোষিত হলে একাকী অন্ধকারে কৌরব-শিবিরে ঘুরে বেড়ান, পরিশ্রান্ত ক্ষতবিক্ষত সৈনিক বা অপর কর্মীরা তাঁকে অত লক্ষ্য করে না, জনারণ্যে মিশে থাকেন—কিন্তু অবস্থা সম্যক লক্ষ্য করতে বা এদের মনোভাব অবগত হতে তাঁর কোন অসুবিধা হয় না। পাণ্ডবপক্ষ সংখ্যার বিচারে এদের থেকে পরাক্রান্ত না হলেও তারা অজেয় তাদের আক্রমণ বা প্রহার সহ্য করার শক্তি সমধিক—এই কথাই সকলের মুখে মুখে। তারা অমর একথাও রটনা করছে কেউ কেউ, কে জানে এর মূলে পাণ্ডবদেরই প্রচারকৌশল সক্রিয় কিনা, হয়তো বাসুদেবেরই চক্রান্ত এটা। অন্তত একটি তথ্য দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট—বাসুদেব যে পক্ষের উপদেষ্টা ও সহায়, সে পক্ষেরই জয় অবশ্যম্ভাবী, তাদের পরাভূত করা যাবে না, এই ধারণা কৌরবপক্ষের যোদ্ধৃ সাধারণের মনে বদ্ধমূল। তাতেই হতাশা ও আতঙ্ক এত প্রকট। এখন যেটুকু আশা তাদের সঞ্জীবিত ক’রে রেখেছে তা হচ্ছে—এই, হয়ত চরম সর্বনাশের পূর্বে—দুর্যোধনও এ সত্য সম্বন্ধে সচেতন হবেন এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করবেন।

কিন্তু কর্ণ উত্তমরূপেই জানেন, এটা দুরাশা। যাঁরা দুর্যোধনের অন্তরঙ্গ তাঁরা সকলেই অবগত আছেন—দুর্যোধন উচ্চ বৃক্ষচূড়ের মতো হয়ত বা ভেঙে পড়বেন কিন্তু বেত্রদণ্ডের মতো বাতাসের বেগে মাথা নত করবেন না। তাঁকে এ যুদ্ধের অনিবার্য ফলাফল সম্বন্ধে সচেতন করার প্রয়াস অনেকেই পেয়েছে ইতিপূর্বে, এখনও পাচ্ছেন। এই কদিনের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখে তিনি বিচলিত হচ্ছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, প্রায় প্রত্যহই সেজন্য কটু ভাষায় ভীষ্মকে অনুযোগের ছদ্মাবরণে তিরস্কার করছেন, পরোক্ষে তাঁকেই দায়ী করছেন—কর্ণকে বিদ্বিষ্ট ও এই যুদ্ধে বিমুখ ক’রে তোলার জন্য বিশেষত— ওঁর ধারণা কর্ণ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে এমন বিপর্যয় ঘটত না—কিন্তু সন্ধির প্রস্তাবের কোন আভাসমা পাওয়া যায় নি ওঁর আচরণে বা বাক্যে। ভীষ্মের সতর্কোক্তি বা স্পষ্টভাষণেও ওঁর চিন্তা সে পথ অবলম্বন করে নি। ভীষ্ম প্রত্যহই যথাশক্তি, তাঁর বয়সের অনুপাতে, কল্পনাতীতরূপ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করছেন, অমানুষিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছেন— তবে যা মৃত্যুর মতোই অমোঘ ও দুর্নিবার তাকে প্রতিহত করবেন কি করে? সে কথা তিনি পূর্বেও বলেছেন, এখনও প্রতিদিনই দুর্যোধনের চেতনাগোচর করার চেষ্টা করছেন— যে পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন, যে পক্ষে সত্য, ধর্ম ও ন্যায়, সে পক্ষ পরাজিত হবে না, দুর্যোধনের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী ও আসন্ন

দুর্গ্রহ-কবলিত ব্যক্তি কখনোই সদুপদেশে কর্ণপাত করে না। অন্ধ যেমন সু-উজ্জ্বল দিবালোক দেখতে পায় না, চক্ষুপীড়াক্রান্ত ব্যক্তি যেমন সূর্যালোক সহ্য করতে পারে না—দুর্ভাগ্যচালিত ব্যক্তিও তেমনি সুস্পষ্ট সত্যকে দুর্বুদ্ধি দ্বারা বিচারদৃষ্টির সম্মুখে আবরিত রাখে। ভীষ্ম প্রাণপণেই যুদ্ধ করছেন, অপর রথীদেরও প্রযত্নের সীমা নেই—তবু কৌরবপক্ষ ক্রমশই যে হীনবল হয়ে পড়ছে তাও অনস্বীকার্য। ভীম ক্রমাগতই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের একে একে শমনসদনে প্রেরণ করছেন। এমন কি একদিন স্বয়ং দ্রোণাচার্য অবিরাম বৃষ্টিপাতের মতো তাঁকে শরবর্ষণে আহত ক’রে ধার্তরাষ্ট্রদের রক্ষার চেষ্টা করা সত্বেও কোন ফল হয় নি, সে সমস্ত নিশিতশায়কবর্ষণ পুষ্পবৃষ্টির মতোই অগ্রাহ্য ক’রে ভীমসেন নিজ কার্য সমাধা করেছেন।

ক্ষতি অবশ্য পাণ্ডবপক্ষেও হয়েছে—বিরাট পুত্রত্রয় ছাড়াও একটি প্রধান ক্ষতি—উলূপীগৰ্ভজাত অর্জুনপুত্র ইরাবানের মৃত্যু। ইরাবান বীর্যে শৌর্যে অর্জুনের উপযুক্ত পুত্র। তদুপরি সে পার্বত্য প্রদেশের অধিবাসী, তাদের যুদ্ধ করার পদ্ধতি অন্যরূপ, কৌশল ও চাতুর্যে পূর্ণ। সেসব রীতি সমতল দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত বা অজ্ঞাত শুধু নয়— বিস্ময়করও বটে। এদের কাছে তা কতকটা ইন্দ্রজালের মতো প্রতীয়মান মনে হয়, এরা মায়াযুদ্ধ মনে করে। সেই হেতু ইরাবান কৌরবদের সমূহ ক্ষতি করছিলেন। বিপদ দেখে দুর্যোধন অনার্য নৃপতি অলম্বুষের শরণাপন্ন হন—তিনি ছাড়া এসব প্রায়-ঐন্দ্রজালিক রহস্য আর কেউ বুঝবেন না। দুজনেই সমান যোদ্ধা—অলম্বুষ বয়স্ক, ধূর্ততায় পরিপক্ক তিনিই শেষ পর্যন্ত ইরাবানকে বধ করেন।

অবশ্য এর ফল কৌরবদের পক্ষে ভাল হয় নি। ভীমসেনের সেই প্রথমা স্ত্রী অনার্যা হিড়িম্বার গর্ভজাত পুত্র ঘটোৎকচ মহাবলিষ্ঠ মহাবীর যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে, তার স্বজাতীয় সেনাবাহিনীও দুর্ধর্ষ, তারা আম-মাংস আহার ক’রে যুদ্ধ করে —অগ্নিপক্ব খাদ্যের জন্য অপেক্ষা করে না—আর রণক্ষেত্রে হস্তী অশ্বের মৃতদেহ তো অগণন—দুইই সমান সুস্বাদু। ইরাবানের মৃত্যুসংবাদে ঘটোৎকচ ক্রদ্ধ হয়ে যেন প্রলয় তাণ্ডবে মত্ত হলেন, যথেচ্ছ কুরুসৈন্য সংহার ক’রে বেড়াতে লাগলেন। দ্রোণ জয়দ্রথ প্রভৃতি মহারথীরা প্রাণপণে বাধা দেওয়া সত্বেও তাকে অবদমিত বা সে প্রতিহিংসাজাত মৃত্যুমহোৎসব থেকে বিরত করতে পারলেন না।

ক্রুদ্ধ হয়েছেন অর্জুনও, ক্রদ্ধ ও শোকার্ত। তিনিও যেন বিশ্বধ্বংসী মূর্তি ধারণ ক’রে অরাতি নিধনে প্রবৃত্ত হলেন। ইতিমধ্যে ঘটোৎকচের অনুচরগণ এক সময় সুকৌশলে রটনা ক’রে দিল যে দ্রোণ শল্য অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন, দুর্যোধনের দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহ নিয়ে তাঁর সারথি পলায়ন করেছে। ফলে সৈন্যরা ভীত এবং প্রাণরক্ষার আশা বিসর্জন দিয়ে পলায়ন করতে লাগল। ভীষ্ম প্রভৃতি প্রধানগণ অবশ্যই উচ্চরবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে এ সংবাদ সর্বৈব মিথ্যা—কিন্তু সেসব সান্ত্বনা ও আশ্বাসবাক্য নিজেদেরই হাহাকার রবে অশ্রুত হয়ে গেল—কারও কর্ণগোচর হ’ল না। শেষে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্ত পর্বতপ্রমাণ এক হস্তীতে আরূঢ় হয়ে ঘটোৎকচকে প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন, তাতেও কুরুপক্ষ বিশেষ কোন উৎসাহ বোধ করল না। অগত্যা, বাধ্য হয়েই সম্মানরক্ষার্থে সেদিনের মতো বিরাম ঘোষণা করতে হ’ল।

.

এই পরাজয়ে প্রমাদ গণনা ক’রে সেই সন্ধ্যাতেই দুর্যোধন ও শকুনি কর্ণর সঙ্গে মিলিত হলেন। দুর্যোধন সক্ষোভে ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগপূর্বক বললেন, ‘বন্ধু অঙ্গাধিপতি, নিশ্চয়ই অদ্যকার এই শোচনীয় এবং লজ্জাজনক পরিস্থিতির কথা তোমার শ্রুতিগোচর হয়েছে। এখন তো মৃত্যুবরণ করা ব্যতীত আমার মানরক্ষার কোন উপায় দেখি না। তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু, তুমি বলো এখন আমার কর্তব্য কি!’

কর্ণ বললেন, ‘কুরুরাজ, শোক করো না।—উপায়ান্তর না সন্ধান ক’রে শুধু বিলাপ করা কেবল স্ত্রীলোকেরই শোভা পায়।… ভীষ্ম রণে বিরত হলেই আমি সসৈন্যে এসে তোমার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেব এবং পাণ্ডবদের পরাজিত ও বন্দী বা নিহত করব। ভীষ্ম মহাধনুর্ধর কিন্তু তিনি পাণ্ডবদের প্রতি অপরিসীম মমতাপরায়ণ। এখন তোমার একমাত্র করণীয় হচ্ছে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে বিনয়বচনে যুদ্ধে নিবৃত্ত করা বা অস্ত্রত্যাগ করতে বলা। তা কি পারবে? সহস্র হলেও তিনি তোমার গুরুজন।

দুর্যোধন এই পরামর্শই শ্রেয় বোধ করলেন। তিনি সাড়ম্বর রাজবেশে সজ্জিত ও রক্ষীপরিবৃত হয়ে অশ্বারোহণে প্রধান সেনাপতির আবাসের দিকে যাত্রা করলেন। এ যাত্রার কারণ অনুমান ক’রে উৎসুক সৈনিক ও কর্মচারীর দল তাঁকে বেষ্টন করছিল। বেত্রহস্তে সে জনসমাবেশকে দ্বিখণ্ডিত ক’রে রক্ষীরা তাঁকে নিরাপদে ভীষ্মের বস্ত্রাবাসে নিয়ে গেল।

ভীষ্মের সম্মুখে গিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে দুর্যোধন বললেন, ‘আপনি ও আচার্য দ্রোণ উপস্থিত থাকতেও পাণ্ডবরা শনৈঃ আমার ভ্রাতৃগণকে বধ করছে। শুনেছি আপনি রণাঙ্গনে অস্ত্র ধারণ করলে স্বয়ং পুরন্দরও যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেন না। আপনি আমাকে রক্ষা করুন। দেবেন্দ্র যেমন পুরাকালে দানব সৈন্য মথিত ও বিনষ্ট করেছিলেন আপনি সেইভাবে পাণ্ডবদের বিমর্দিত করুন। আপনি আমাকে পূর্বে বহুবার আশ্বাস দিয়েছেন—পাণ্ডব পাঞ্চাল কেকয় সকলকে বধ করবেন, সে সত্য এখন রক্ষা করুন। আর যদি আমার প্রতি বিদ্বেষ বা পাণ্ডবদের প্রতি অত্যধিক স্নেহবশত তাদের রক্ষা করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তো আপনি গৃহে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম করুন, আমি কর্ণকে আহ্বান করি।’

ভীষ্ম অতিরিক্ত ক্রুদ্ধ, বিরক্ত ও দুর্যোধনের কঠোর বাক্যে দুঃখিত হলেন বলেই বোধ করি সহসা কোন উত্তর দিলেন না। অষ্ট দিবস ক্রমাগত অরুণোদয় থেকে সূর্যাস্ত কাল পর্যন্ত—কখনও বা সারাদিন-রাত্রি যুদ্ধ করছেন। এক লহমার জন্য তাঁর হস্ত বা বাহু বিশ্রাম পায় না, দেহের কোন রোমকূপ বোধ করি অক্ষত নেই সাধারণ যোদ্ধাদের শর বর্মে প্রতিহত হয়—কিন্তু অর্জুন বা সাত্যকির অস্ত্র বর্ম ভেদ ক’রে চর্মে প্রবেশ করে। তিনি অপরিসীম ক্লান্ত। ইচ্ছা নেই সত্য কথা, তবু তিনি ধর্মরক্ষার জন্য প্রাণপণেই যুদ্ধ করেছেন বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রদর্শন করেন নি, জ্ঞানত পাণ্ডবপক্ষকে অব্যাহতি দেন নি—এমন কি তাদের বোধ করি নিঃশ্বাস গ্রহণেরও অবসর দেন নি–বৃদ্ধ বয়সে এতখানি সেবার এই পুরস্কার! তিনি যে মদমজ্জানির্মিত মানবদেহধারী—তাঁর যে ক্লান্তি আছে, অবসাদ আছে, তাঁরও পেশী-স্নায়ুর বিশ্রাম প্রয়োজন—বিশেষ এই বয়সে–সে কথা এই স্বার্থান্ধদের একবারও মনে পড়ে না, আশ্চর্য!

।বেশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে অসহ ক্রোধ কথঞ্চিৎ প্রশমিত হলে ঈষৎ করুণ হাস্য দেখা দিল তাঁর অধরপ্রান্তে। তিনি ধীরে ধীরে মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘দুর্যোধন, তুমি জানো না কাকে কী ভাবে বাক্যশল্য বিদ্ধ করছ! আমি আমার যথাসাধ্য যুদ্ধ করছি—বরং বলা উচিত সাধ্যের অতীত। বস্তুত এ-ই আমার শেষ যুদ্ধ, আমি তোমার জন্য এই যুদ্ধে প্ৰাণ আহুতি দিতে চলেছি। কিন্তু যা অসম্ভব তাকে সম্ভব করব কেমন ক’রে? পূর্বেও বলেছি পঞ্চপাণ্ডব অপরাজেয়—এখনও তাই বলছি। আমি তাদের বধ করতে পারব এমন আশ্বাস কখনও দিই নি। পাণ্ডবরা যে দুর্জয় বীর তা কি তুমিই জানো না—তাদের পরাক্রমের স্বাদ কি ইতিমধ্যেই বিস্মৃত হয়েছ? তুমি যখন গন্ধর্বদের হাতে লাঞ্ছিত ও বন্দী হয়েছিল, তোমার বীর ভ্রাতারা ও বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ তখন কোথায় ছিল? অর্জুন এসে দয়া ক’রে গন্ধর্বরাজকে পরাস্ত না করলে এতদিন গন্ধর্বকারাগৃহেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হত না কি? বিরাটনগরে উত্তরগোগৃহে অর্জুন একাকী আমাদের সকলকে জয় ক’রে যখন বাহক উত্তরকে দিয়ে আমাদের বস্ত্র ও উষ্ণীষ হরণ করিয়েছিল তখন তোমার ও কর্ণের স্পর্ধা বা আস্ফালন কোথায় ছিল? নিজের শক্তি না বুঝে এই মহাযুদ্ধের আয়োজন করেছ, এখন আমার কাছে ক্রন্দন করলে কি হবে? পূর্বে আমাদের কোন উপদেশে কর্ণপাত করেছিলে? আসন্ন-মৃত্যু ব্যক্তির বিপরীত বুদ্ধি হয়— তোমারও সেই অন্তিমকাল আসন্ন তাই এমন দুর্বুদ্ধি হয়েছে। যাও, গৃহে ফিরে যাও, যে কদিন জীবিত আছ, সুখনিদ্রা ভোগ করো। আমাকে উত্যক্ত করতে এসো না।’

তারপর ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, ‘যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধ জয় না ক’রে অস্ত্রত্যাগ করতে বা রণভূমি থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে আমি অভ্যস্ত নই। আমাদের কাছে তা মহাপাপও। অমি যুদ্ধই করব। হয় ওপক্ষের সকলকেই বধ করব পঞ্চপাণ্ডব ব্যতীত—নয় তো নিজেই নিহত হবো। এই আমার প্রতিজ্ঞা। তবে পাঞ্চালদের শিখণ্ডীর সঙ্গে যুদ্ধ করব না তা তুমি উত্তমরূপেই জানো। কারণ সে পূর্বে স্ত্রীলোক ছিল, অধুনা দৈবের বিচিত্র ইচ্ছায় পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। স্ত্রী, বৃদ্ধ, অশক্ত, শরণাগত এবং অনস্ত্র ব্যক্তিকে আমি কখনও প্রহার করি না। এখন যাও, শুনে যাও—কাল আমি এমন যুদ্ধ করব, যুগান্তর পরেও লোকে সসম্ভ্রমে সভয়ে যার আলোচনা করবে।’

.

ভীষ্ম তাঁর বাক্য রক্ষা করেছিলেন। এমন লোমহর্ষণকারী যুদ্ধ ইতিপূর্বে কোথাও কেউ করেছে বলে জানা নেই। উভয়পক্ষই সেদিন প্রাণপণে যুদ্ধ করেছেন কিশোর অভিমন্যুর যুদ্ধ প্রত্যক্ষ ক’রে বোধ করি স্বয়ং দেবেন্দ্রও বিস্ময় বোধ করতেন। তবু অপরা পর্যন্ত যা দেখা গেল—পাণ্ডবপক্ষেই লোকক্ষয় বেশী হয়েছে। কৌরবেরা সেটাকেই নিজেদের জয়লাভ বিবেচনা করে সন্ধ্যাকালে সেদিনের মতো অবহার ঘোষিত হলে ঘন ঘন হর্ষধ্বনি ও ভীষ্মের জয়ধ্বনিতে সাধুবাদে আকাশ-বাতাস অনুরণিত ও মুখর করে তুলল।

এরা যেমন সহর্ষ, পাণ্ডবশিবির সেই পরিমাণই বিমর্ষ হয়ে রইল।

যুধিষ্ঠির তাঁর স্বভাব মতো প্রথম কিছুকাল বিলাপ ক’রে নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে দিতে বললেন, ‘আমি বুদ্ধির দোষে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হতে বসেছি। এখনও বোধ করি সময় আছে, বাসুদেব তুমি আমাকে অনুমতি দাও, আমি বনগমন করি। তাহলে হয়ত পাণ্ডবপক্ষের কিছু লোক অব্যাহতি পাবে। আমার একমাত্র আশঙ্কা, এভাবে পশ্চাদপদ হলে ক্ষত্রিয়-ধর্ম অনুসারে পতিত হবো, নচেৎ নিশ্চয়ই প্রতিনিবৃত্ত হতাম।’

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘আপনি অকারণে বিচলিত হবেন না। ভীষ্ম অমর নন, কৌরবদের পাপও পুঞ্জীভূত হয়ে ধর্মের আসন বিচলিত করেছে। তাদের ধ্বংস ও মৃত্যু সদ্য-আসন্ন, অনিবার্য। তবু, আপনি যদি আদেশ করেন, অর্জুন যদি তাঁর অক্ষমতা স্বীকার করেন, আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে অস্ত্রধারণ করি। আমি একাই তাদের সকলকে নিহত করতে পারব। এ আমার বৃথা আস্ফালন বা শূন্যগর্ভ অহঙ্কার প্রকাশ নয়—সহজ ও সত্য ভাষণ মাত্র। তদ্ব্যতীত অর্জুন আমার সম্বন্ধী, সখা ও শিষ্য, আমার প্রাণতুল্য—তার ইষ্টসিদ্ধির জন্য আমি সব করতে পারি।’

অর্জুন লজ্জিত হয়ে ব্যাকুলভবে বারম্বার বাসুদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন, যদি কোন শৈথিল্য প্রকাশ পেয়ে থাকে তা সংশোধন ও তার প্রায়শ্চিত্তের প্রতিজ্ঞা করলেন যুধিষ্ঠিরও বললেন, ‘না, তা হবে না। আমাদের সামান্য স্বার্থের জন্য তোমাকে ধর্মচ্যুত করব না কিছুতেই। অন্য কোন পরামর্শ দাও।’

বাসুদেব স্বল্পকাল মাত্র নীরব থেকে বললেন, ‘আপনার স্মরণ থাকা উচিত, ভীষ্ম আমাদের কয়েকদিন পরে আর একবার যেতে বলেছিলেন—তাঁর বধোপায় বলে দেবেন বলে, মৃত্যু-ইচ্ছা হয়েছে কিনা তাও জানাবেন। চলুন আমরা তাঁরই শরণাপন্ন হই।’

এই পরামর্শই সকলের সমীচীন বোধ হ’ল। সময় অল্প, তখনই তাঁরা সেই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন।

না, রাজযোগ্য আড়ম্বর সহকারে নয়, বরং অতি দীনভাবে—অস্ত্র ধর্ম রক্ষী সব ত্যাগ করে—তাঁরা পদব্রজে, পাদুকা পর্যন্ত বাহিরে রেখে, বিনতভাবে কৃতাঞ্জলিপুটে ভীষ্মের বস্ত্রাবাসে প্রবেশ করলেন। প্রবেশাধিকার সম্পর্কিত ইঙ্গিত বাক্য বাসুদেব সংগ্রহ করেই রাখেন—প্রতি প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায়—তা না হলেও যুধিষ্ঠিরকে বাধা দেবার চিন্তা রক্ষীদের মনে আসত না।

এঁদের আগমনে ভীষ্মের ললাট-কুঞ্চনরেখা ও ভ্রূভঙ্গী থেকে কিছু পূর্বের বিরক্তি ও তিক্ততা অপসারিত হয়ে প্রসন্নতা

প্রকাশ পেল। তিনি প্রণত পাণ্ডবদের ও বসুদেবপুত্রকে দৃঢ় বাহুপাশে বদ্ধ ক’রে বেশ সরবেই অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন। বললেন, ‘বৎসগণ সুস্বাগতম। তোমাদের দেখে বহুদিন পরে মনে নির্মল আনন্দ লাভ হ’ল। তোমাদের এই আকস্মিক শুভাগমনের হেতু বিস্তার করে বলো। বলো তোমাদের কি প্রিয়সাধন করব? অকুণ্ঠিতচিত্তে বলো। যদি দুষ্কর কর্ম হয়—তোমাদের প্রীতির জন্য তাও করব।’

ভীষ্ম যথার্থ আন্তরিকতার সঙ্গে স্নেহ-কোমল লঘু কণ্ঠে এই আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করলে যুধিষ্ঠির সাহস সঞ্চয় ক’রে করজোড়ে বললেন, ‘পিতামহ, আজ একান্ত বিপন্ন হয়েই আপনার কাছে এসেছি। আপনি আর কয়েকদিন এভাবে যুদ্ধ করলে মনে হয় সমগ্র সৃষ্টি লোপ পাবে। আমরা কি ভাবে তাহলে যুদ্ধে জয়ী হবো, প্রজারা কি ক’রে রক্ষা পাবে। ধর্মের মর্যাদাই বা কী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? আপনার বিক্রম কোনমতেই আমাদের সহ্য হচ্ছে না। আপনার অবিরাম বাণবর্ষণের মধ্যে আমরা তিলার্ধ ছিদ্রও দেখতে পাই না। আপনার ধনু অবিরাম মণ্ডলাকারে আবর্তিত হয়। কখন বাণ নেন, কখন জ্যা কর্ষণ ক’রে তা ত্যাগ করেন, পুনশ্চ কখনই বা তূণীর হতে শর সংগ্রহ করেন—আমাদের দৃষ্টিতে অসাধ্য তা লক্ষ্য করা। তাই আজ অনন্যোপায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি, আপনিই বলে দিন— কেমন ক’রে আমরা জয়ী হবো।’

ভীষ্ম ধীরভাবে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য শুনে হাসলেন একটু! স্নিগ্ধ সপ্রীতি হাসি—অনুকূল মনোভাবেরই পরিচায়ক। বললেন, ‘তুমি যে আমার বধোপায় আমাকেই জিজ্ঞাসা করতে এসেছ—এতেই বুঝেছি তোমার জয় এবং কল্যাণ সুনিশ্চিত। একথা সত্য, আমি শরাসন গ্রহণ ক’রে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে আমাকে পরাজিত করা শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন ব্যতীত কারও পক্ষে সম্ভব নয়। পরন্তু তাঁদের পক্ষেও তা অনায়াসসাধ্য হবে না। অতএব আমাকে অতি সত্বর ভূপাতিত করার জন্য যত্নবান হও। অর্জুনকে বলো আমাকে যদৃচ্ছ প্রহার করতে। তার প্রকৃষ্ট উপায় শোন—পূর্বেও বলেছি দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী প্রথমে স্ত্রীলোকরূপেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পরে পুরুষে রূপান্তরিত হন, তাঁর রথধ্বজও অমাঙ্গলিক চিহ্নযুক্ত— অতএব আমি কোনক্রমেই তাঁর প্রতি শরবর্ষণ করব না। তাঁর রথ সম্মুখে রেখে তোমরা সকলে মিলে ক্রমাগত আমাকে শরবিদ্ধ করো, তাতেই আমি একসময় অপারগ অক্ষম হয়ে পড়ব।’*

[* ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল, অস্ত্রহীন, ভূপাতিত, অহত, বর্ম ও ধ্বজবিহীন, পলায়মান, মরণাপন্ন স্ত্রী, স্ত্রীনামধারী বিকলেন্দ্ৰিয়, এক পুত্রের পিতা, নীচাচারী এবং যার ধ্বজায় অমঙ্গল চিহ্ন—এমন ব্যক্তির সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করবেন না।]

ক্ষণকাল মাত্র নীরব থেকে মহাত্মা ভীষ্ম পুনশ্চ বললেন, ‘বৎসগণ, তোমাদের কল্যাণ হোক, তোমরা জয়লাভ করো, এ বিশ্বে ধর্মের শাসন প্রবর্তিত হোক, দরিদ্র দুর্বল প্রজাগণ অধার্মিক শাসকদের অযথা নিপীড়ন থেকে মুক্তিলাভ ক’রে স্বচ্ছন্দে নিজেদের মতো জীবনযাত্রা নির্বাহ করুক। আমারও আর জীবনবহনের ইচ্ছা নেই। প্রাণধারণের মূল্য শোধ করতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাপিষ্ঠের দাসত্ব করতে হয়েছে—কিন্তু আর না। কেশব, আমার ইচ্ছাও তুমি পূর্ণ করেছ, তুমি ধন্য। তোমার জয় হোক।’

তাঁকে ভক্তিভরে, সম্ভবত শেষবারের মতো প্রমাণ জানিয়ে, পাণ্ডবরা অপরাধবোধ-ভারাক্রান্ত চিত্তে বস্ত্রাবাসের বাহিরে এলেন। সকলেরই দৃষ্টি বাষ্পাচ্ছন্ন, ফলে উচ্চাবচ প্রান্তরভূমি অতিক্রমের সময় পদে পদে আঘাত পেতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির সক্ষোভে বললেন, ‘ক্ষাত্রধর্মে ধিক! বংশের বৃদ্ধতম ব্যক্তি, স্নেহশীল পিতামহ—তাঁর কাছ থেকে উপায় জেনে নিয়ে তাঁকে বধ করতে হচ্ছে, এর থেকে নৃশংসতা আর কি হতে পারে! যে ব্যক্তি সস্নেহে আশীর্বাদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে প্রসন্ন ঔদার্যে নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দেন—একান্ত পামর ছাড়া তাকে কেউ হত্যা করে না। আমাদের সেই কাজই করতে হচ্ছে। প্রব্রজ্যাধারী তপস্বীরাই সুখী—তাঁদের কদাপি এমন গর্হিত কার্যের প্রয়োজন হয় না।‘

অর্জুন কপোলবাহিত অশ্রুচিহ্ন অপনোদনের চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘বন্ধু, পিতৃকুলে যাঁর নিকট থেকে সর্বাধিক স্নেহ লাভ করেছি, তাঁকে কেমন ক’রে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করব! জয়লাভ থাক, আমাদের এ রাজ্যে প্রয়োজন নেই—আমরা বনেই সুখে ছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই।’

শ্রীকৃষ্ণ কঠিনকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘বহুলোকের মৃত্যুর দায় ইতিমধ্যে তোমাদের এই রাজ্যলাভ প্রত্যাশার উপর বর্তেছে—স্ত্রী-জনোচিত বিলাপ শোভা পায় না। ফাল্গুনী, তুমি ক্ষত্রিয়, এ যুদ্ধে জয়লাভ করবে এই প্রতিজ্ঞা ক’রে এখানে এসেছ। ভীষ্মকে নিপাতিত না করলে যুদ্ধে জয়লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। তাঁকে বধ করতেও তুমি বাক্যবদ্ধ। তুমি ক্ষণিকের জন্য মোহান্ধ হয়েছ নইলে ভেবে দেখতে—জন্মমৃত্যু সমস্তই ভাগ্য স্থির করেন, পরমায়ু জন্মলগ্নেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাঁর যেমন ভাবে যে সময়ে মৃত্যু নির্দিষ্ট আছে, সেই সময় সেই ভাবেই হবে, কেউ তার অন্যথা করতে পারবে না। সর্বাধিক বুদ্ধিমান বৃহস্পতি বলে গেছেন, ‘নানা-সদগুণান্বিত ব্যক্তিও আততায়ী হলে, তার দ্বারা তোমার অনিষ্ট হবার বা প্রাণসংশয়ের কারণ উপস্থিত হলে তাকে নিহত করতে দ্বিধা করবে না।’…পরন্তু ক্ষত্রিয়ের ধর্মই এই— অসূয়ারহিত ভাবে শত্রু বধ করবে, এবং প্রাণপণে প্রজা রক্ষা করবে। সেই ধর্ম পালন করো।’

.

ভীষ্মের উপদেশমতো পরদিন প্রাতে শিখণ্ডীকে পুরোভাগে রেখে পাণ্ডবরা ভীষ্মকে বেষ্টন করে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করলেন। ভীষ্ম শিখণ্ডীকে দেখে ঈষৎ হাস্যসহকারে বললেন, ‘তুমি যতই আমাকে অস্ত্রাঘাত করো— তোমাকে আমি প্রত্যাঘাত করব না। কারণ তুমি স্ত্রীলোক হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলে, আমার কাছে আজও তাই আছ।’

শিখণ্ডী অল্পবয়সোচিত স্পর্ধাসহকারে বলতে গেলেন, ‘তুমি দেব যক্ষ রক্ষ সকলেরই অজেয় হতে পারো, কিন্তু আজ আমার হাতে তোমার পরিত্রাণ নেই।’

ভীষ্ম যেন তাঁকে অপ্রতিভ করতেই স্নেহ-মধুর হাস্যে দক্ষিণহস্তে অভয়মুদ্রা ক’রে অপর যোদ্ধাদের সংহারে প্রবৃত্ত হলেন। কিছু পরে, যুদ্ধরত অবস্থাতেই যুধিষ্ঠিরকে ইঙ্গিতে আহ্বান করে—তিনি নিকটে এলে বললেন, ‘তোমরা আমাকে নিপাতিত করো, আমি সক্ষম ও রথারূঢ় থাকতে কর্তব্যে অবহেলা করতে পারব না।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে প্রবোধিত ও প্রবুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন, ‘ধনঞ্জয়, তুমি শীঘ্র যথাশক্তি পিতামহকে আঘাত করো— নচেৎ অকারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হবে, উনিও নিস্কৃতি পাবেন না। উনিই যে কেবল অপরকে আঘাত করছেন তা তো নয় –এই ক্লান্তিকর অবিরাম হত্যাকাণ্ড ওঁকেও শ্রান্ত বিমর্ষ ও জীবনে বীতস্পৃহ ক’রে তুলেছে। সেই কষ্টকর অবস্থা থেকে ওঁকে উদ্ধার করো।’

যুদ্ধ এই এক বিশেষ বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত দেখে, পাণ্ডবদের অভিপ্রায় বুঝে কৌরবপক্ষের মহারথীরাও ভীষ্মকে রক্ষা করবার জন্য সেইখানে সমবেত হলেন। ভীষ্ম পাণ্ডবদের যতই আশ্বাস দিন, তাঁর ধনুঃশর তখনও শ্রান্ত কি ক্ষান্ত হয় নি। বোধ হয় অর্জুনও বিগতরাত্রির সেই আবেগজনিত দুর্বলতা মন থেকে মুছে ফেলেছেন। তিনি সাক্ষাৎ কালান্তর যমের মতোই সংহার মূর্তি ধারণ করলেন। সেই দ্রুত ও অবিরাম অনবসন্ন অস্ত্রবর্ষণের মধ্যেই শিখণ্ডীকে ডেকে বললেন, ‘তুমি নিরস্ত থেকো না, প্রাণপণে ওঁকে শরবিদ্ধ করো। আজ যদি আমরা ভীষ্মকে নিহত বা নিরস্ত্র করতে না পারি—লজ্জার শেষ থাকবে না।’

অর্জুন নিজেও শত্রুপক্ষের অপর যোদ্ধাদের বধ করার মধ্যে মধ্যেই ভীষ্মকে লক্ষ্য ক’রে তীক্ষ্ণতর অস্ত্রগুলি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সে আঘাত ভীষ্মকে নির্ঘাতভাবে আহত করতে লাগল, তার ফলে বর্মের মধ্য দিয়েই রুধিরক্ষয় হতে লাগল। ভীষ্মের প্রসন্নতা তখনও অব্যাহত, দুঃশাসনকে উদ্দেশ্য ক’রে মৃদুহাস্যে বললেন, ‘পুত্র অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা সার্থক, আর কেউই আমাকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে পারত না। এসব কোন তীরই শিখণ্ডী বা ধৃষ্টদ্যুম্ন কি সাত্যকির নয়, ওদের অস্ত্র বর্মেই প্রতিহত হয়, অর্জুনের তীর বর্ম দেহচর্ম দুইই ভেদ করে। এমন বাহুবল ও অস্ত্রত্যাগকৌশল একমাত্র অর্জুনই করতে পারেন।’…

দুর্যোধন অবসন্ন ও খিন্ন হয়ে ভীষ্মকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘দাবানল যেমন তৃণ হতে বনস্পতিসকল নির্বিচারে দগ্ধ করে, অর্জুন তেমনিই আমার পক্ষের সকলকে রথী-পদাতিক নির্বিশেষে নিধন করছেন। ভীম প্রভৃতি অপর রথীরাও কম নিপীড়ন করছেন না। আপনি রক্ষা করুন।’

ভীষ্ম তিক্তকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমার সৈনাপত্যে প্রতিদিন অপরপক্ষের অন্যূন দশ সহস্র ব্যক্তি নিহত হবে, সে প্রতিজ্ঞা অদ্যাপি রক্ষা করেছি। আজই আমার যুদ্ধের শেষ দিন, হয় আজ আমি কুরুক্ষেত্রে শয্যা নেব, নতুবা পাণ্ডবরা পরাজিত নিহত হবে। তবে সম্ভবত তোমার কাছে আমার যে ঋণ— তোমার অন্ন গ্রহণ করেছি—সে ঋণ আজ আমার মৃত্যুতেই শোধ হবে।’

ভীষ্ম অতঃপর যেন আরও উগ্র হয়ে উঠলেন। চতুর্দিকে আহতদের আর্তনাদ, মুমূর্ষুর অন্তিম যন্ত্রণাধ্বনি শ্রুত হতে লাগল। সমস্ত আকাশ শরজালে মেঘমেদুর অপরাহ্নের মতো দিবালোককে অস্পষ্ট বিলুপ্ত ক’রে দিল। মনে হ’ল ভীষ্ম নন—সাক্ষাৎ শিবই প্রলয় তাণ্ডবে মত্ত হয়েছেন।

ভীষ্মের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ভীম প্রভৃতি চার পাণ্ডব, অর্জুন, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ, সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ এবং প্রধান সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন একযোগে ভীষ্মকে লক্ষ্য ক’রেই শুধু অস্ত্রক্ষেপ করতে লাগলেন। অপরপক্ষও নিষ্ক্রিয় কি উদাসীন রইল না। কিন্তু গাণ্ডীবী অর্জুন যেখানে অখণ্ড মনোযোগে যুদ্ধ করছেন সেখানে তারা কি বা কতটুকু বাধা দিতে পারে?

এমনকি আচার্য দ্রোণও তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের এই যুদ্ধ দেখে প্রমাদ গণলেন। অপত্যস্নেহবশত তিনি একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামাকে এই কয়দিন যুদ্ধের বিপজ্জনক অংশ থেকে দূরে রাখছিলেন, আজ তাকে নিকটে আহ্বান ক’রে বললেন, ‘ভীষ্ম ও অর্জুন আজ যেভাবে দ্বৈরথ যুদ্ধে বদ্ধ হয়েছেন তাতে আমি শঙ্কিত বোধ করছি, আমার চিত্ত অবসন্ন হচ্ছে, আমি যেন চতুর্দিকে নানা দুর্নিমিত্ত দেখতে পাচ্ছি। পাণ্ডবরা শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে যুদ্ধ করছেন, ভীষ্ম কদাচ ওকে অস্ত্রাঘাত করবেন না অর্জুন যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ— বোধকরি দেবগণেরও অজেয়। আজ এই যুদ্ধে প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটবে। বৎস, পরাশ্রিত পরভৃত ব্যক্তিদের নিরাপদ দূরত্বে থেকে প্রাণরক্ষার সময় এ নয়—আশ্রয়দাতার ঋণ শোধের চেষ্টাই অবশ্যকরণীয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ক্রদ্ধ হয়েছেন, কৌরবদের সর্বনাশ অনিবার্য। তবু আমাদের কর্তব্য আমরা করব। তুমি যতদূর সম্ভব অর্জুনের দৃষ্টি কি তাঁর গতিপথ পরিহার ক’রে অন্য রথীদের নিবারণ করো। বিশেষ ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমসেনকে ঐ স্থল থেকে যদি কিছু দূরে নিয়ে যেতে পারো, দুর্যোধনের মহৎ উপকার হবে। আমি স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকে প্রতিহত করব।’

কিন্তু যাঁকে রক্ষা করার জন্য প্রয়াস–সেই পিতামহ ভীষ্ম দশদিনব্যাপী যেন এই বিরাট নরমেধযজ্ঞে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। জীবনে আর কিছুমাত্র রুচি ছিল না, অভীপ্সা ছিল না এ যুদ্ধে জয়লাভেরও। প্রাণধারণ, সুখদুঃখ–এ যুদ্ধের ফলাফল—সমস্ত কিছু সম্বন্ধেই উদাসীন। তিনি পুনশ্চ যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ্য করে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘বৎস, আমার এ যুদ্ধে অত্যন্ত বিরাগ দেখা দিয়েছে। তুমি অর্জুনকে বলো যতশীঘ্র সম্ভব আমাকে নিহত করুক। সে ছাড়া এ কার্য আর কারও সাধ্যায়ত্ত নয়।’

যুধিষ্ঠিরের মুখে এই বার্তা পেয়ে অর্জুন দ্বিগুণ ও প্রচণ্ড বেগে আক্রমণের গতি বর্ধিত করলেন। তিনি বার বার ভীষ্মের ধনু ছেদন করতে ভীষ্ম অন্য অস্ত্র নিক্ষেপের চেষ্টা পেলেন, অর্জুন চোখের নিমেষে তাও প্রতিহত করলেন।

নানা বিচিত্র ও শক্তিশালী মারণাস্ত্রসমূহ যখন অর্জুনের ক্ষিপ্রতা ও প্রচণ্ডতর অস্ত্রনিক্ষেপের ফলে বিনষ্ট হতে লাগল তখন ভীষ্ম বুঝলেন এবার তাঁর বিরত হবার কাল সমাগত, অন্তিম সময় আসন্ন। তাঁর যোদ্ধা জীবনের এইবার পরিসমাপ্তি। তিনি ধীরভাবে শান্ত সস্মিত হাস্যে ইষ্টদেবী গঙ্গাকে স্মরণ ক’রে ধনুঃশর ত্যাগ করলেন। কিন্তু তখনই অবতরণ কি রণক্ষেত্র ত্যাগের চেষ্টা করলেন না, স্থির হয়ে রথেই বসে রইলেন।

এ পক্ষের শরবর্ষণে অবশ্য ছেদ নেই। উপযুক্ত অবসর বা সুযোগ বুঝে শিখণ্ডী প্রভৃতি বহু যোদ্ধা উৎসাহিত হয়ে অধিকতর বেগে অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাতে ভীষ্মকে বিশেষ বিচলিত দেখা গেল না, সেসব শর তাঁর বর্মেই বাধা পেল, কিন্তু অর্জুনের শর সাংঘাতিক, তাঁর নিক্ষেপণের শক্তিও অনন্যসাধারণ তা অনায়াসে বর্ম ভেদ ক’রে দেহে বিদ্ধ হতে লাগল। ভীষ্ম পুনশ্চ ঈষৎ হাস্য ক’রে দুঃশাসনকে দেখালেন, ‘এই যেসব বজ্রতুল্য মর্মভেদী বাণ বর্ম ভেদ ক’রে দেহে বিদ্ধ হয়ে এই রক্তক্ষরণের কারণ হচ্ছে—এ সবই অর্জুনের। এতকাল তিনি প্রীতিবশত আমাকে এভাবে প্রহার করা থেকে বিরত ছিলেন মনে হচ্ছে এবার আমার অন্তিমকাল আসন্ন।’

কথাগুলি প্রসন্ন ঔদার্যেই বলা। প্রীতির অভাব নেই, জীবনের আসক্তি বা মমতা তো নেইই—তথাপি, নিরবচ্ছিন্ন এই প্রহারযন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে ভীষ্ম একসময় চর্ম ও খড়্গা নিয়ে দ্বৈরথ সমরের উদ্দেশ্যে রথ থেকে অবতারণের চেষ্টা করতে গেলেন—কিন্তু তার পূর্বেই অর্জুন তাঁর সে চর্মও খণ্ড খণ্ড ক’রে দিলেন। এবার যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে তাঁর পক্ষীয় বীরগণ চারিদিক থেকে ওঁকে বেষ্টন ক’রে অস্ত্রবর্ষণ আরম্ভ করলেন। তাঁদের প্রচণ্ড তেজ প্রতিরোধে অসমর্থ কৌরবরা

ভীষ্মকে রক্ষা করার আশা ত্যাগ ক’রে আত্মরক্ষার্থ নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলেন … তখন এঁদের যদৃচ্ছ শরাঘাতের অবাধ অবসর। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াল—ভীষ্মের দেহে এক আঙ্গুল পরিমিত স্থানও অক্ষত রইল না।

মানবদেহধারী মাত্রেরই দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি সীমাবদ্ধ— ভীষ্মও আর সহ্য করতে পারলেন না। অবিরাম রক্তক্ষরণে দুর্বল ও অবসন্ন হয়ে রথ থেকে ভূমিতে পড়ে গেলেন।

যতই কেননা সকলে এই পরিণতি আশঙ্কা বা আশা ক’রে থাক—ঘটনাটার তাৎপর্য সম্পূর্ণ মস্তিষ্কায়ত্ত হতে এবং বিশ্বাস করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল—প্রায় অর্ধদণ্ডকাল। একটা সশব্দ দীর্ঘায়ত দীর্ঘনিঃশ্বাস গ্রহণের সঙ্গে নেমে এল একটা অদ্ভুত অবর্ণনীয় নীরবতা—তারপর সেই প্রশ্বাস ধীরে ধীরে বহির্গত হ’ল—যেন সেটুকু শব্দও করতে কারও সাহস হচ্ছে না—মনে হচ্ছে মানবোত্তর এই মানবের এই মহামহিমায় পতনের গুরুত্ব লাঘব করা হবে তাতে।

এ কী হ’ল! এও কি সম্ভব! এ কি তারা সত্যই দেখছে!

হিমালয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তাদের চক্ষের সম্মুখে বালুকারাশিতে রূপান্তরিত হলে বা সে স্থলে বিশালবিপুল সমুদ্রতুল্য হ্রদ দেখা দিলেও বোধ করি এতটা বিস্ময় বোধ হত না, অথবা বিপুল তরঙ্গোচ্ছ্বাসে সমুদ্রজল পর্বতপ্রমাণ হয়ে যদি স্তম্ভিত হয়ে থাকত— তাহলেও না।

ভীষ্ম! ভীষ্মর মৃত্যু ঘটল! এখনও যদি শেষ নিঃশ্বাসটুকু বহির্গত না হয়ে থাকে—শীঘ্রই হবে। আর বীর যোদ্ধার যুদ্ধে অক্ষমতা তো মৃত্যুরও অধিক। সেই ভীষ্ম! লোকে বলে যাঁর ইচ্ছামৃত্যু, যিনি যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব দেব মানব সকলেরই অজেয়—তিনি নিজেরই পৌত্রদের শরাঘাতে বিকল হয়ে ভূমিশয্যা গ্রহণ করলেন! এও কি সত্য হতে পারে!

এই অস্বাভাবিক নীরবতার পরই শোনা গেল বহুযোজনব্যাপী রণভূমিতে অগণিত যোদ্ধাদের হা হা বিলাপ শব্দ। কৌরবপক্ষে তো বটেই, পাণ্ডবপক্ষেও অনেকে প্রকাশ্যেই রোদন করতে লাগলেন। একমাত্র ভীম ব্যতীত কেউই কোন হর্ষোল্লাস প্রকাশ করলেন না—সকলেরই অন্তরে এক বিপুল ব্যথা অনুভূত হতে লাগল। ভীষ্ম শুধু ত্যাগীশ্রেষ্ঠ, যোগীশ্রেষ্ঠ, যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ তাই নন—তিনি জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ, মানবশ্রেষ্ঠও। এ ব্যক্তি সকলের উপকারী, সকলের প্রতি স্নেহশীল— স্বার্থলেশহীন ঔদার্যমূর্তি। তিনি যে সকলের প্রিয় সকলের শ্রদ্ধেয়। যাঁরা তাঁকে ভূপাতিত করলেন—তাঁরাই তো এ জয়ে কেউ সুখী নন, অকারণ অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন।

হাহাকার শব্দে ক্রন্দন ক’রে কক্ষকুট্টিমে ললাটাঘাত করতে লাগলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। দ্রোণ রথের উপরই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। যুদ্ধের অবহার কাউকে ঘোষণা করতে হ’ল না। আপনিই—যেন অব্যক্ত এক অন্তরাদেশে, অনুচ্চারিত অলিখিত সম্মতিচুক্তিতে তা বন্ধ হয়ে গেল।

.

এই মহাপতনের পর এই রাজ্যজয়েচ্ছা, এই ক্ষুদ্রস্বার্থসংঘাত নিতান্ত তুচ্ছ ও অর্থহীন বলে বোধ হ’ল সকলের। এই মহাপতন-সংবাদে বিজয়সংবাদ-প্রত্যাশায় প্রতীক্ষমাণ দূরস্থ পাণ্ডব রাজপরিবারের পুরললনাদের মন এবং মুখ বিষাদের কৃষ্ণছায়ায় অবগুণ্ঠিত হ’ল। কৌরবপক্ষে ততোধিক। তাঁরা এক অজ্ঞাত আতঙ্কে স্তব্ধ প্রস্তরীভূত হয়ে রইলেন, প্রাণের লক্ষণ বলতে রইল শুধু কপোলবাহিত অশ্রুধার অবিরল নিঃশব্দ বর্ষণ। কিংবা, অজ্ঞাত বলাও হয়ত ভুল যে অমঙ্গলাশঙ্কা উচ্চারণ করতে সাহস হ’ল না, হয় নি—সেই পরিণতি বা পরিণামের সম্পূর্ণ না হোক, অস্পষ্ট একটা আকার কি তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন না?

সে সংবাদ তাই কর্ণকেও সুখী বা উল্লসিত না ক’রে—তাঁর পক্ষে এক অবিশ্বাস্য জাড্যে—অনড় ক’রে দিল।

এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেও প্রত্যয় হয় না—অপরের মুখে শ্রুত সংবাদ তো বিশ্বাস করার কথাও নয়। বিহ্বলতা সেই কারণেই। ।।

১১

অবশেষে এসময় বিশ্বাস করতে হয় বৈকি?

উপর্যুপরি বার্তাবাহক আসছে একই সংবাদ নিয়ে। সকলেরই মুখ বিষাদকালিমাচ্ছন্ন, কারও বা চক্ষু অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ। তারা যেন নিজেদেরই অপরাধী বোধ করছে। সে সংবাদ দেবার সময়—ঐ মহান ব্যক্তির মহাপতনের সংবাদ—বারে বারে নিজেদের শিরে করাঘাত করছে।

না, বিশ্বাস না করাতে পারার মতো আশ্রয় বা আশ্বাস কোথাও নেই।

দুর্যোধনের সন্ত্রাসার্ত আহ্বান এসে পৌঁচেছে ইতিমধ্যেই। এখনই কৌরব শিবিরে যাত্রা করতে হবে। নূতন সেনাপতি বৃত হবেন আজ রাত্রেই। অদ্যকার এ দুর্ঘটনা সকলের মন যতই গুরুভারাক্রান্ত ক’রে রাখুক—কৌরবদের বিজয়াশায় যতই ভয়াবহ জিজ্ঞাসাচিহ্ন অঙ্কিত হোক তাদের মনে—যুদ্ধ আর বন্ধ হবে না, বন্ধ করা যাবে না প্রত্যুষেই আবার সেই ক্লান্তিকর মৃত্যুলীলা আরম্ভ করতে হবে।

আরও অনেক সংবাদ পেলেন কর্ণ।

অত্যল্পকাল মধ্যে বহু সংবাদবাহক এসে পৌঁছল সেইসব বার্তা নিয়ে।

ভীষ্ম মৃতকল্প অবস্থায় আছেন, কিন্তু মৃত্যু হয়নি তাঁর। তিনি নাকি এখনই দেহত্যাগ করবেন না। সূর্য উত্তরায়ণে না গমন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।

এ তিনি করতে পারেন।

এই যোগীবর মৃত্যু ও শারীরিক অনুভূতিকে ইচ্ছাধীন করেছেন। কামার্ত পিতার বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য যখন নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, বাসনা কামনা, সিংহাসন—ইহজীবনের যা কিছু ভোগ মানুষের কাম্য সব আহুতি দিয়েছিলেন— কিম্বদন্তী, সেই সময়ই লজ্জিত অনুতপ্ত অথচ কামনার কাছে অসহায় পিতা আশীর্বাদ করেছিলেন—মৃত্যু তাঁর ভৃত্যবৎ আয়ত্তাধীন থাকবে। তবে ঋষিরা বলেন, ওঁর মতো ঊর্ধ্বরেতা শুদ্ধচিত্ত যোগীর পক্ষে মৃত্যুকে ইচ্ছাদাস করা এমন কিছু কঠিন বা বিস্ময়কর নয়।

আরও শুনলেন অঙ্গাধিপতি।

সমস্ত শরীর অগণ্য শরবিদ্ধ হওয়ায় ভীষ্মের দেহ ভূমিস্পর্শ করে নি। বস্তুত সেই সব নিশিত শরের উপরেই তিনি শয়ান আছেন। দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠির উভয়েই প্রবীণ অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসক আহ্বান করেছিলেন, ক্লান্ত কিন্তু সস্মিত হাস্যে ভীষ্ম সে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন, ‘অবিলম্বে এঁদের প্রাপ্য সম্মানদক্ষিণা দিয়ে নিজ নিজ স্থানে পাঠিয়ে দাও। পেশী মেদ বা স্নায়ুর অনুভূতি আর আমাকে কায়িক ক্লেশে কাতর করতে পারবে না। বরং এ আমার গৌরবশয্যা, সর্বতোভাবে প্রকৃত যোদ্ধার উপযুক্ত। এই বীরশ্লাঘ্য অন্তিম শয্যা থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না। তদ্ব্যতীত চিকিৎসায় সুস্থ হলে আবারও যুদ্ধের প্রশ্ন উঠবে—সে অভিরুচি আমার নেই। এ সময় তোমরা এই বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রীর সামান্য স্বাচ্ছন্দ্যচিন্তা নিয়ে অযথা ব্যস্ত হয়ো না–বস্তুত এ আমার সুখশয্যাই। শুধু মস্তক কেউ শরবিদ্ধ করে নি, শ্রদ্ধা বা মমতাবশত, একটা উপাধানের ব্যবস্থা ক’রে দাও।’

তাঁর বাক্যের সম্যকার্থ কেউ বুঝতে পারেন নি। সকলেই ব্যস্ত হয়ে চতুর্দিকে রথ ও অশ্বারোহী প্রেরণ ক’রে কোমল সুখদ রেশমাবৃত উপাধান উপস্থিত করেছিলেন। ভীষ্ম এঁদের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে শুধু বলেছিলেন, ‘আঃ! অর্জুন, অর্জুন কোথায় গেল? যে শয্যা রচনা করেছে সে ই উপাধান দিক।’

বাসুদেবের ইঙ্গিতে অর্জুন অবনতবদনে নিকটে গিয়ে তিনটি শরের উপর পিতামহের মস্তক রক্ষা করলেন। ভীষ্ম পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে যেন কতকটা স্বগতোক্তিই করলেন, ‘এই লোকের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে দুর্যোধন জয়ী হতে চায়! ধিক!

তারপর বললেন, ‘বড় তৃষ্ণা। অর্জুন, আমি এখন জীবন ও মৃত্যুর মধ্যস্থলে—জীবিতদের মধ্যে গণ্য নই, পরলোকে পৌঁছই নি। তুমি আমাকে এ অবস্থার উপযুক্ত পানীয় দাও।’

তাও নাকি দিয়েছেন অর্জুন।

এই বিষণ্ণ, পরিণাম-চিন্তা-ভারাক্রান্ত অবস্থাতেও কর্ণ যুগপৎ ঈর্ষার এক গোপন দংশনজ্বালা এবং–কৃতী পুরুষের উপযুক্ত ঔদার্যে, অপরের সত্যকার কীর্তিতে মুগ্ধ প্রশংসাবোধও অনুভব না ক’রে পারলেন না।

অর্জুন পিতামহের এই অনুজ্ঞা তাঁর যোগ্য ভাবেই পালন করেছেন। তীক্ষ্ণ এবং শক্তিশালী কয়েকটি দিব্য আয়ুধে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে পাতালবাহিনী ভোগবতীর স্রোতধারা একটি ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত নির্ঝরিণী রূপে উপরে আনয়ন করেছেন। সেই ভূগর্ভ-উৎসারিত অমৃতোপম বারি একেবারেই ভীষ্মর মুখমধ্যে এসে পড়েছে— কোন পাত্রের আবশ্যক হয় নি। ভীষ্মর পিপাসা শান্ত ও তৃপ্ত হলে অর্জুনই আবার সেই উৎসমুখ রুদ্ধ ক’রে দিয়েছেন।

বলিহারি! বলিহারি! কর্ণ বার বার উচ্চারণ করেছেন নিজের মনেই।

ভাগ্যের পরিহাসে ও নিষ্ঠুর চক্রান্তে প্রতিরথী প্রতিদ্বন্দ্বী না হলে এই অনুজের কীর্তিতে আজ যথার্থ গৌরবানন্দ অনুভব করার কথা।

ভীষ্ম অতঃপর শেষবারের মতো, আর একবার দুর্যোধনকে বোধ করি সতর্ক করতে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘বৎস, অর্জুনের মধ্যে বীর্যের সঙ্গে বুদ্ধি মিলিত হয়েছে—সেই জন্যই সে অপরাজেয়। তোমরা তাকে পরাজিত করতে পারবে না। বিশেষ পাণ্ডবদের শৌর্য ও শিক্ষা ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত লোকোত্তর বুদ্ধি ও মানবদুর্লভ প্রজ্ঞাসম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সহায়। তিনি একাই এ ভারতভূমি নিঃক্ষত্রিয় করতে পারেন—কিন্তু জনশিক্ষার নিমিত্তই সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবদের দ্বারা একবার দিগ্বিজয়* করিয়েছেন এবার এ যুদ্ধে তাদের জয়ী ক’রে মদোদ্ধত, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতর, অত্যাচারী, লোভী ও কলহপরায়ণ ক্ষত্রিয় নৃপতিদের ধ্বংস করবেন। আমি এখনও অনুরোধ করছি—সৎ পরামর্শ গ্রহণ করো—আমার মৃত্যুতেই এ বিবাদের অবসান হোক। পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি ক’রে তাদের প্রাপ্য অর্ধরাজ্য প্রত্যর্পণ করো, তারা ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে বসবাস করুক। শত্রুর পরিবর্তে মিত্র ও আত্মীয় রূপে তাদের লাভ করলে তোমরাও সুখে ও নির্বিঘ্নে রাজসুখ ভোগ করতে পারবে। তারা সহায় থাকলে রাজ্যসীমা বর্ধিত করাও আদৌ দুরায়াসসাধ্য থাকবে না।’

[*রাজসূয় যজ্ঞের প্রাক্কালে।]

দুর্যোধন এ কথার কোন উত্তর দিলেন না, অবশ্য সেই নীরবতাতেই ভীষ্ম উত্তর লাভ করলেন। বুঝলেন, কোন রোগীর শিয়রে যখন শমনদূতের আগমন ঘটে, তখন তার ঔষধ ও সুপথ্যে অরুচি হয়। দুর্যোধনের কাল পূর্ণ হয়েছে, সে এ হিতকর বাক্যের মূল্য উপলব্ধি করতে পারবে না। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন ক’রে তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করলেন।

ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত হ’ল। যেন মহামানবের মহাধনুর্ধরের এ পতনদৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সূর্যদেব অন্ধ যবনিকার অন্তরালে অন্তর্হিত হলেন। একসময় এল রাত্রি, সে রাত্রিও গভীর থেকে গভীরতর হ’ল। এই মহাশ্চর্য অবিশ্বাস্য সংবাদ লোকমুখে বিস্তার লাভ করতে দূরদূরান্তর থেকে তীর্থযাত্রীর মতো রথী-মহারথী-পদাতিক-নির্বিশেষে যোদ্ধা, গৃহস্থ ও কুলনারীরা আসতে লাগলেন। কুমারী কন্যারা তাঁর দেহে মঙ্গলমাল্য, গন্ধপুষ্প ও লাজাঞ্জলি বর্ষণ করতে লাগল। এল সকল জাতি ও বর্ণের সাধারণ প্রজারা—যুদ্ধক্ষেত্রের বিভীষিকা ও অবর্ণনীয় আতঙ্ক উপেক্ষা ক’রে। নট বাদ্যকর গায়ক কথক ভৃত্য মৃত্তিকাখনক সূপকার ক্রীতদাস-দাসী ও অন্যান্য কর্মীরা সকলেই রোদন করতে করতে এসে তাঁর পদধূলি নিল। কৌরব ও পাণ্ডব উভয়পক্ষের বীরগণ অস্ত্র বর্ম ত্যাগ ক’রে এই শোকতীর্থে অনায়াসে সমবেত হলেন। ঘনিষ্ঠভাবে একত্রে তাঁরা কুরুপিতামহকে প্রণাম জানালেন, প্রদক্ষিণ করলেন।

ভীষ্ম উত্তরায়ণ পর্যন্ত জীবনধারণ করবেন, নিশ্চয় তার বহুপূর্বে এ যুদ্ধের অবসান ঘটবে—তত্রাচ যে কয়দিন যুদ্ধ চলে, ভ্রান্তিকর প্রচণ্ড প্রমত্ততা থেকে সাংঘাতিক ভাবে আহত বৃদ্ধকে রক্ষা করা প্রয়োজন। যুদ্ধের গতি এক এক সময় বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়, যদি যুযুধান কোন বৃহৎ অংশ এই দিকে এসে পড়ে তখন কারও পক্ষে ওঁর কথা স্মরণে রেখে সতর্ক হওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন যেন পরস্পরের অকথিত সম্মতি নিয়ে নিজ নিজ খনকদের আহ্বান ক’রে একত্রে ভীষ্মের চতুর্দিকে বিশাল ভূমিখণ্ড শূন্য রেখে তার বাহিরে পরিখা খননের কার্যে নিযুক্ত করলেন। অতি বিস্তীর্ণ-স্থানব্যাপী এক দ্বীপের আকার ধারণ করল সে স্থান। অতটাই ব্যবধানের প্রয়োজন ছিল—আগ্নেয়াস্ত্র প্রভৃতি অকস্মাৎ এসে পড়া বিচিত্র নয়।

অবশেষে একসময় দর্শনার্থীদের আগমনস্রোত মন্দীভূত হয়ে এল। শেষ রাত্রির তারকারাও যেন মহাপুরুষকে প্রণাম নিবেদন ক’রে দিগন্তের পথে প্রস্থানের উদ্যম করলেন। পূর্বাকাশ অরুণাভ হওয়ার পূর্বেই সে আলোকদূতের আবির্ভাববার্তা পাওয়া গেল দূর বৃক্ষচূড়ে দুই-একটি পক্ষীর সদ্যজাগরণ-কাকলিতে। কদিনের যুদ্ধের অস্বাভাবিক কোলাহলে রণৎকারে অধিকাংশ বন্য পশুপক্ষীই পলায়ন করেছে, শুধু দু-একটি দুঃসাহসী বায়স তখনও তাদের বাসস্থানের মায়া ত্যাগ করতে পারে নি, কোনমতে প্রাণধারণ ক’রে আছে, যেন প্রতিদিন দিবসদেবতার শুভাগমনের মাঙ্গলিক বার্তা ঘোষণার জন্য। তৃতীয় প্রহরের যামঘোষণাও সমাপ্ত হয়েছে কিছু পূর্বে। আরও দণ্ডকাল মধ্যে সব কোলাহলই স্তিমিত, ক্রমশ নীরব হ’ল। ভীষ্মও এবার শ্রান্তিতে ও শান্তিতে দুই চক্ষু বন্ধ করলেন।

তবে বেশীক্ষণ বিশ্রাম বোধ করি তখনও তাঁর ভাগ্যে ছিল না, পুনশ্চ তাতে ব্যাঘাত ঘটল।

কার স-সন্তর্পণ মৃদু পদধ্বনিতে বিস্মিত ভীষ্ম কষ্ট ক’রে চক্ষু উন্মীলন করলেন আবার। দুর্বলতায় ও রক্তক্ষরণে দৃষ্টি আচ্ছন্ন, দেখেও ঠিক বুঝতে পারলেন না—এ আগন্তুক কে।

‘কে?’ প্রশ্নই করলেন তিনি।

ক্ষীণকণ্ঠে—তবু সেই সামগ্রিক নিস্তব্ধতার মধ্যে তা শোনায় কোন বাধা রইল না। যে এসেছে সে আরও নিকটে এল, বাষ্পগাঢ় স্বরে বলল, ‘পিতামহ, যে ব্যক্তি চিরদিন আপনার নয়নপথে পতিত হওয়ামাত্র আপনার অন্তরে বিদ্বেষ ও বিরক্তি জাগ্রত করত—আমি সেই অধিরথ-সূতপুত্র—রাধেয় কর্ণ।’

চারিদিকে সতর্ক রক্ষীর দল রাখা হয়েছে, বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে ভীষ্মকে রক্ষা করার জন্য, কর্ণ তাদের সকলেরই পরিচিত। এঁদের অহি-নকুল সম্পর্কের কথাও সুপরিজ্ঞাত— সুতরাং তাদের কৌতূহল স্বাভাবিক, তারা সাগ্রহে এগিয়ে এল, উৎকর্ণ হয়ে—ভীষ্ম তা ভাল ক’রে না চেয়েও যেন দেখতে পেলেন। ইঙ্গিতে তাদের আদেশ করলেন—শ্রুতিসীমার বাহিরে, একেবারে সদ্য-কর্তিত পরিখার ধারে গমনের জন্য। তারপর কর্ণকে সস্নেহে আমন্ত্ৰণ জানালেন, ‘ভ্রাত, ওখানে, অত দূরে নয় তুমি আমার নিকটে এসো, আমার বুকের কাছে।’

তারপর বিমূঢ় কর্ণ সামীপ্যে এলে দক্ষিণহস্ত প্রসারিত ও আলিঙ্গনের মতো আবেষ্টন ক’রে নিকটে এনে কোমল কণ্ঠে বলেন, ‘কর্ণ, আমি তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি নি কোনদিন, তবে বিরক্ত হয়েছি। তুমি মহাবীর, মহান ও মহৎ–আমরা একই গুরুর শস্ত্রশিষ্য। তোমার শৌর্য ও বীর্যের পরিমাণ আমার অবিদিত নেই। তুমি একাই স্বীয় বাহুবলে রাজ্য জয় ক’রে স্বাধীন সার্বভৌম নৃপতিরূপে সর্বজনের সম্ভ্রমের পাত্র হয়ে থাকতে পারতে অনায়াসে। তোমার মতো যোদ্ধাকে এক পাপিষ্ঠের অধীনে ভিক্ষালব্ধ রাজ্যখণ্ডে করদরাজা হিসাবে তার চাটুকারশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত দেখে—যে রাজ্য ন্যায়ত ও ধর্মত তার নয়—আমার ক্রোধ উপস্থিত হত। তাই তোমাকে নিত্য ধিক্কারে উদ্বোধিত ও আত্মসচেতন করতে চেয়েছি—যাতে তোমার নিজের শক্তি সম্বন্ধে অবহিত হয়ে নিজের প্রাপ্য মর্যাদার আসন গ্রহণ করতে পারো একদিন। কপট দ্যূতসভায় তোমার আচরণ খুব গর্হিত এবং অশালীন—তবে সেও যে আমার মতোই অপরকে উদ্বুদ্ধ উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে, তা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝেছিলাম, তাই ক্ষমাও করেছি। আমি অকৃতদার, কুমার—এবং নিঃসংশয়ে বলতে পারি এই দীর্ঘজীবনে সে কৌমার্য ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ করি নি একবারও—তবু মানবচরিত্র সম্বন্ধে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তোমার— তোমাদের অন্তরের কথা ও ব্যথাও অনুমান করতে পারি।… কর্ণ, আর একটা কথা—তুমি রাধেয় নও, তুমিও কৌন্তেয়। তুমিই মাতা কুন্তীর জ্যেষ্ঠ সন্তান, সেহেতু জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবও। এ তথ্য কি তুমি অবগত আছ?’

বহু আয়াসে কণ্ঠস্বর শ্রুতিগম্য ক’রে কর্ণ উত্তর দিলেন, ‘আছি। প্রথমে বাসুদেব পরে পাণ্ডবজননী স্বয়ং সে কথা আমাকে জানিয়েছেন।’

‘তাহলে তোমার প্রাপ্য স্থান তুমি অধিকার করছ না কেন? কেন এই যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম চিন্তা করছ না? এখনও সময় আছে, পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে তোমার প্রাপ্য রাজ্য তুমি জয় ক’রে নাও। তুমি অদ্যাপি এ যুদ্ধে যোগ দাও নি, এখনও অনায়াসে জ্যেষ্ঠপাণ্ডব হিসাবে ও পক্ষে চলে যেতে পারো।’

‘আপনি কেন পারেন নি পিতামহ? আপনার কিসের ঋণ ছিল দুর্যোধনের কাছে? যে সামান্য বেতন গ্রহণ করছেন তা দেওয়া হয়েছে কুরুবংশের রাজস্ব থেকে। সে সিংহাসন, সে রাজস্ব ধর্মত যুধিষ্ঠিরেরই প্রাপ্য।–তাই না? আপনি এই তর্কগ্রাহ্য অনিঃসন্দেহ ঋণের জন্য এই ভাবে অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করে প্রাণ আহুতি দিলেন—তবে আমি কোন বিচারে সর্বনাশের সম্মুখে পতিত জেনেও সে হতভাগ্য আশ্রয়দাতাকে ত্যাগ করব?…জন্মলগ্নে জননী আমাকে মৃত্যু অবধারিত আশা ক’রেই নদীগর্ভে ত্যাগ করেছিলেন, সেদিন যে অধিরথ এবং রাধা সেই স্পষ্টত অজ্ঞাত পরিচয় কামজ সন্তানকে তুলে এনে জীবনদান করেছেন, যথার্থ পুত্রের মতোই লালনপালন করেছেন—আজ তাঁদের সে ঋণ, পরিচয় অস্বীকার করলে চরম কৃতঘ্নতা প্রকাশ হবে না কি? আর সেদিন এই স্পষ্টত নীচ-কুলোদ্ভব অখ্যাত অবজ্ঞাত তরুণকে যে ঘোর অবমাননা থেকে রক্ষা ক’রে বন্ধু বলে অঙ্কে স্থান দিয়েছিল—সে দুর্যোধন লোভী, ঈষী, অহঙ্কারী, পাপপরায়ণ হোক— আমার সে অত্যাজ্য। আমি ধর্মশাস্ত্র বিশেষ অধ্যয়ন করি নি, কিন্তু আমার হৃদয়ের শাস্ত্র অন্তত এই কথাই বলে। পিতামহ, এক রক্তের সহজ আকর্ষণ অহরহ আমাকে অর্জুনের দিকে আকর্ষণ করেছে—কিন্তু সেভাবে তাকে লাভ করতে পারি নি, ফলে সে আকর্ষণ বৈরীভাবে তার কথা চিন্তা করিয়েছে। বস্তুত আমার জননীই তাকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত ক’রে ঈর্ষার পাত্র ক’রে তুলেছেন। সহজাত প্রগাঢ় প্রীতি নির্গমনের পথ খুঁজে না পেয়ে বিদ্বেষের সুরায় রূপান্তরিত হয়ে উন্মত্ত করে তুলেছে। এখন সেখানে আমার স্থান কোথায়? এতদিনের মনোভাব কি কেউই আমরা ভুলতে পারব? না, তা আর হয় না। আপনি আশীর্বাদ করুন—এ হতভাগ্য মন্দ-ভাগ্যদের দলে থেকেই যেন চিরপ্রবঞ্চিত জীবন অবসান করতে পারে—উপকারী বন্ধুকে ত্যাগ করার মতো দুর্মতি তার না হয়।’

ভীষ্ম গাঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ধন্য, ধন্য! আর আমার কোন বক্তব্য নেই। কর্ণ, আমি তোমাকে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ করছি—নিষ্কামচিত্তে পুণ্যকামনায় ধর্মযুদ্ধ ক’রে তুমি স্বর্গে যাও। দুর্যোধন যা-ই ক’রে থাকুন, তাঁর পাপ তোমাকে স্পর্শ করবে না—তুমি জীবনেও যেমন মহান, মৃত্যুতে তেমনি মহান থাকবে।’

কর্ণ নীরবে তাঁর পাদযুগলে নিজের শিরস্পর্শ ক’রে সাশ্রুনেত্রে বিদায় নিলেন।

১২

কর্ণর ধারণা ছিল—বিগত প্রায় মাসান্তকালে, তিনি বাসুদেবের মনের সীমা ও তল পেয়ে গেছেন—কিন্তু কুরুক্ষেত্রের এই কয়দিনের বিচিত্র ঘটনাসমূহ তাঁর মনে প্রবল এক উদভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তিনি কি সত্যই ওঁর মানসিক গতির সঠিক পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন?

ভীষ্মের নিকটে গমন, অকস্মাৎ তাঁকে আক্রমণ করার অভিনয়, পরে তাঁর মৃত্যুকৌশল তাঁর মুখ থেকে উচ্চারণ করানো—এসব তো তুচ্ছ। আরও যেসব বিস্ময়কর দুর্বোধ্য আচরণ ওঁর—তার যেন কোন অর্থই খুঁজে পান না কর্ণ সহজ বাহ্যিক অর্থে নিলে যাদবকুলে শ্রেষ্ঠ এই ব্যক্তিকে অতি নীচাশয় বলেই মনে হয়—তবু, তাতেও তো সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আর যেটুকু দেখেছেন তিনি শ্রীকৃষ্ণকে, শুনেছেন তার ঢের বেশী, তাতে তো অসাধারণ শুধু নয়, লোকোত্তর চরিত্রের মহামানব বলেই বোধ হয়। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য কোন নীচ প্রবৃত্তি বা বুদ্ধিকে প্রশ্রয় দেবার মানুষ তো তিনি নন।

তবে?

ভীষ্মপতন-রাত্রে কর্ণ চলে আসার অব্যবহিত পরেই শ্রীকৃষ্ণ পুনশ্চ একা ভীষ্ম সমীপে গিয়েছিলেন, কৌতূহলী রক্ষীদল প্রসাদাৎ সে কথোপকথনের কিছু অংশ অবগত হতেও অসুবিধা ঘটে নি। আসন্ন অবশিষ্ট যুদ্ধের ফলাফল সম্ভাবনাদি বিষয়েই আলোচনা করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। কুরুপক্ষে কার কি পরিমাণ শক্তি, কে কে কোন সব মহাদিব্যাস্ত্র আয়ত্ত ও করায়ত্ত ক’রে অপেক্ষা করছেন এই যুদ্ধে নিজ নিজ চিহ্নিত শত্রুদের বিনাশ করার জন্য—এইসব তথ্যই তাঁর জিজ্ঞাস্য বা সংগ্রহণীয় ছিল। ।

মহামানব ভীষ্ম অবশ্য এসব গূঢ় গোপনীয় তথ্য তাঁর কাছে প্রকাশের পূর্বে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব প্রবল যুক্তিতে সে সঙ্কোচ— বীরধর্মের স্বাভাবিক সংস্কার নিঃশেষে নির্মূল করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘হে মহাত্মা আপনি জাগতিক অর্থে এখন মৃতই। আপনার অসাধারণ যোগবলে ও চারিত্রিক শুদ্ধতায় আপনি প্রাণকে ইচ্ছাধীন করেছেন বলেই এই জরাজীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত, রক্তশূন্য-প্রায় দেহখানাকে ত্যাগ করেন নি, সূর্য উত্তরায়ণ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। তথাপি সে দেহও ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ ক’রে নেই, ইহজগতের খাদ্য বা পানীয় কিছুই গ্রহণ করছেন না। উভয় পক্ষই সর্বসম্মতিক্রমে চতুর্দিকে বিশাল ভূমির ব্যবধান ও অতল পরিখার দ্বারা রণভূমি থেকে দূরে রেখেছে। এখন আপনি কোন পক্ষেরই নন, ইহসংসারের বন্ধন উন্মোচন করার সঙ্গে সঙ্গে আপনি সাংসারিক শর্ত-বিবেচনাদির বন্ধন থেকেও মুক্ত হয়েছেন। দুর্যোধনের নিকট যেটুকু ঋণ ছিল বলে আপনার বিশ্বাস সে ঋণ বহুগুণ কুসীদসহ শোধ করেছেন। এখন আপনার এসব তথ্য প্রকাশ করতে বাধা কি? বিশেষ আমি যখন রণচিকীর্ষ নই, প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করব না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!’

তবু ভীষ্ম তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন যে এসব তিনি অপর কারও কাছে মৌখিক বা লিখিত ভাবে প্ৰকাশ করবেন না। তখন ভীষ্ম নিঃসঙ্কোচে ও নিশ্চিন্ত হয়ে কিছু গোপনীয় তথ্য শ্রীকৃষ্ণর কাছে প্রকাশ করেছেন। তবে সেগুলি এতই মৃদুকণ্ঠে বলেছেন যে দূরস্থিত প্রহরীদের তা শ্রুচিগোচর হয় নি।

ভীষ্মর এ আচরণে কর্ণও কোন দোষ ধরতে পারেন নি। সত্যই তিনি পার্থিব জগৎ থেকে অপসৃত, এ সংসারের কোন নীতি বা নিয়মে তাঁকে বিচার করা যায় না। তাঁর প্রতি কর্ণর শ্রদ্ধা যে আন্তরিক, তা কুরুশিবিরে যোগদানের সময়—প্রথম সসৈন্যে প্রবেশকালেই—কুরুপক্ষীয় সকলের হর্ষ ও জয়ধ্বনির সময়ই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি এই সম্বর্ধনার উত্তরদান প্রসঙ্গে সাশ্রুনেত্রে এই কথাই বলেছিলেন, ‘ধৃতি, বুদ্ধি, পরাক্রম, শাস্ত্রজ্ঞান, সত্য, স্মৃতি, বীরের সমস্ত লক্ষণ, আশ্চর্য শস্ত্রজ্ঞান, সন্নতি, প্রিয়ভাষিতা, কৃতজ্ঞতাবোধ ও অসূয়ারাহিত্য নিজ গাত্রচর্মের মতোই যাঁকে সর্বদা বেষ্টন ক’রে থাকত, সেই শত্রুনিপাতক বিপক্ষবীরহন্তা মহাবীর ভীষ্ম আজ যখন অক্ষম হয়ে শরশয্যা গ্রহণ করেছেন তখন আর কারও জীবন বা শৌর্য সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা নেই। বন্ধুগণ, কে জানে আজিকার সূর্যাস্তকালে তোমাদের কতজনকে অর্থ, পুত্র, পৃথিবী, এই মহান কুরুবংশর জন্য শোক করতে হবে, কতজনের সে শোক প্রকাশেরও সাধ্য বা অর্থ থাকবে না—অর্থাৎ তাঁরাও নিপাতিত হবেন!’

কতকটা এই গভীর শ্রদ্ধা ও প্রীতিবশতই, কতকটা যদি কোনক্রমে ভীষ্ম-কৃষ্ণ সংবাদের কোন গুহ্য তত্ব অবগত হতে পারেন এই আশায়, সেদিন প্রাতে যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে কর্ণ আরও একবার ভীষ্মসকাশে গিয়েছিলেন। তাঁকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ ক’রে বলেছিলেন, ‘পিতামহ, আমি কর্ণ, আমি আপনাকে প্রণাম ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে এসেছি। আপনার অপেক্ষা ধর্মদৃঢ়, বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত, যুদ্ধবিদ্যাপারঙ্গম ব্যক্তি আর দ্বিতীয় কেউ নেই—এ সংসারে বিধাতার বিচিত্র বিধানে, অথবা যথার্থ সুকৃতির ফল মানুষ ভোগ করতে পারে না, সেইজন্যই আজ আপনি ভূপাতিত, শরশয্যায় শায়িত, তবু আপনি এই বর্তমান কালের নরশ্রেষ্ঠ তাতে সন্দেহ নেই। আপনি আশীর্বাদ করুন—আমি রণশৌণ্ড পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করছি।’

ভীষ্ম অতিকষ্টে তাঁর শ্লথ নেত্রচর্ম উন্মোচন ক’রে কর্ণর প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করলেন। বললেন, ‘বৈরীদুঃসহবীর্য কর্ণ, তুমি নিষ্কামচিত্তে ধর্মপালন নিমিত্ত যুদ্ধযাত্রা করছ—স্বয়ং ঈশ্বরই তোমাকে আশীর্বাদ করবেন। আমি তোমাকে স্নেহ ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। দেখ এ পৃথিবীতে যৌনসম্বন্ধ অপেক্ষা সাধুসম্বন্ধ অধিক দৃঢ়,—তুমি সেই সম্বন্ধেই কৌরবদের নিকট-আত্মীয় এবং রক্ষাকর্তা, সেই বিবেচনাতেই কুরুসন্তানগণকে রক্ষা করো, তাদের নিঃশক্র করার চেষ্টা করো— তোমার মঙ্গল হোক।’

কর্ণ কুরুপিতামহর এই সস্নেহ আচরণ ও আশীর্বাদে শান্ত হৃষ্টচিত্তে ফিরেছিলেন, কিন্তু কোন কোন মূল্যবান তথ্য শ্রীকৃষ্ণের গোচর হয়েছে তার আভাসমাত্র সংগ্রহ করতে পারেন নি। প্রত্যক্ষভাবে সে প্রশ্ন করতেও তাঁর সাহস হয় নি। যে বিশ্ববিধ্বংসী ভয়ঙ্কর অস্ত্রটি তিনি এতদিন সযত্নে লালন করছেন—অর্জুনবধের মানসে–সে অস্ত্রের কথা পিতামহ অবশ্যই জানেন, এ সম্বন্ধে কোন সংবাদই তাঁর অজ্ঞাত নয়—শ্রীকৃষ্ণ কি সেই গোপন মারণাস্ত্রের কথা অবগত হয়েছেন? সে ই ওঁর প্রবল দুশ্চিন্তা।

অবশ্য—এ ভূভারতে কোন কিছুই কি শ্রীকৃষ্ণের অজ্ঞাত আছে!

এক এক সময় কর্ণ এই কথাটা চিন্তা করতে গিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন, কেমন যেন একটা আতঙ্ক অনুভূত হয়। অপ্রাকৃত বিরাট সীমাহীন রহস্যময় কিছু দর্শন করলে সাধারণ মানব যেমন অভিভূত ভীতিগ্রস্ত হয়— তেমনই।

শুধু কি তাঁর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাই লোকোত্তর! তাঁর আচরণগুলিই কি কম বিস্ময়কর, কম দুর্বোধ্য!

প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি ভগদত্তবধের সময় তিনি যে-কার্য করেছেন, তা আপাতদৃষ্টিতে আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়, কারণ তা তাঁর পৌনঃপুনিক ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞার সম্পূর্ণ বিরোধী।

দুর্যোধন সেদিন যুদ্ধের প্রাক্কালে দ্রোণাচার্যকে বলেছিলেন, ‘আপনি যে কোনরূপে হোক যুধিষ্ঠিরকে জীবিতাবস্থায় বন্দী ক’রে দিন!’

দ্রোণ প্রথমটা ভেবেছিলেন, শুভ-বুদ্ধি, শ্রদ্ধা বা প্রীতিবশতই যুধিষ্ঠিরকে বধ করতে দুর্যোধন অনিচ্ছুক। এটুকু বিবেকবিবেচনা যে এখনও দুর্যোধনের আছে, এতেই তৃপ্ত হয়েছিলেন দ্রোণাচার্য, যার সেবা করতে বাধ্য হয়েছেন সেই ব্যক্তির এইটুকু সুবুদ্ধি ও ভদ্র আচরণে। তিনি সেইজন্য সাধুবাদও দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে ভুল ভাঙতেও বিলম্ব হয় নি। কারণ পরক্ষণেই মনের গূঢ় পাপ-অভিসন্ধি নিজেই প্রকাশ ক’রে ফেলেছেন দুর্যোধন, বলেছেন, ‘যুধিষ্ঠিরকে বধ ক’রে কোন লাভ নেই, তার ভ্রাতারা অধিকতর হিংস্র হয়ে উঠবে, এবং দ্বিগুণ বিক্রমে যুদ্ধ করবে। ওকে বন্দী করতে পারলে মুক্তিপণ রূপে পুনশ্চ দ্যূতক্রীড়ায় আমন্ত্রণ করব, আবার সর্বস্ব জিতে নিয়ে দীর্ঘকালের জন্য বনবাসে পাঠাব। তাহলে আর যুদ্ধ করার প্রয়োজন থাকবে না।’

এ মনোবৃত্তিতে কুটিলতায় ঘৃণাবোধ করবারই কথা—বিশেষ যখন মনে হয় এই বৃদ্ধবয়সে এই প্রভুরই সেবা করতে হচ্ছে—কিন্তু দুর্যোধনের সম্বন্ধে বুঝি আর ঘৃণাও জাগে না মনে।

দ্রোণ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বৎস, অর্জুন আমার কেন বোধ করি স্বয়ং রুদ্রেরও অজেয়। সে যে সকল অস্ত্র আয়ত্ত ও সংগ্রহ করেছে তা তোমার পক্ষীয় কোন ধনুর্ধরেরই নেই। অর্জুন নিকটে উপস্থিত থাকতে যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করা আমার পক্ষেও সাধ্যাতীত। চেষ্টা করো তাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্যস্ত রাখতে—তাহলে হয়ত যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করা সম্ভব হবে।’

সেই পরামর্শমতোই এক বিপুল বাহিনী অগ্নিতে আহুতি দিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’ল যে তারা হয় অর্জুনকে বধ করবে নতুবা তার হস্তে নিহত হবে। অর্জুনের বিনাশ না ঘটা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ ত্যাগ বা গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে না এবং অন্নজল স্পর্শ করবে না।* ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার বাহিনী ও শ্রীকৃষ্ণপ্রদত্ত নারায়ণী সেনার এক বিপুল অংশ মিলিত ভাবে এই প্রতিজ্ঞা ক’রে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান জানাল।

[* সেকালে এ রীতি প্রচলিত ছিল, এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা ক’রে যারা যুদ্ধযাত্রা করত, তাদের বলা হত সংশপ্তক। ]

অর্জুন বিপন্ন বোধ করলেন বৈকি! যুধিষ্ঠিরের রক্ষাবিধানে অসমর্থ ক’রে তোলার জন্যই যে এই চক্রান্ত তা তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু বীরধর্মকেও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিশেষ তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করলে তিনি কদাচ তা উপেক্ষা করবেন না—বহুকাল হতেই এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সত্যজিৎ নামে এক পাঞ্চালবীরের উপর যুধিষ্ঠিরের পার্শ্বরক্ষার ভার দিয়ে

—যতশীঘ্র সম্ভব এদের বিনাশ ক’রে ফিরে আসবেন ধর্মরাজকে এই আশ্বাস দিয়ে সংশপ্তকদের দিকে ধাবিত হলেন। তারাও রণক্ষেত্রের একান্তে দক্ষিণ দিকে সমবেত হয়েছিল—যাতে যুধিষ্ঠিরাদি থেকে ওঁকে বহুদূরে নিয়ে যেতে পারে।

‘যতশীঘ্রসম্ভব’ এ শব্দসমষ্টি একটা অস্পষ্ট সান্ত্বনা মাত্র, তাতে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা প্রকাশ পায় না। তবে হয়ত সান্ত্বনাদাতার একটা ধারণা থাকে সে কালটুকু সম্বন্ধে। কিন্তু অর্জুন এই বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েই বুঝলেন তাঁর কল্পিতকালে এদের বিনষ্টি তাঁরও সাধ্যাতীত। তিনি যত বড় বীরই হোন, যত ভয়ঙ্কর অস্ত্রই তাঁর আয়ত্তে থাকুক— দৃষ্টি-সীমাতীত এই যোদ্ধা সমুদ্রকে নিহত করা কয়েকদণ্ড কি এক প্রহরকালেরও কর্ম নয়।

অর্জুন অবশ্য যুধিষ্ঠিরের অসহায় অবস্থা স্মরণ ক’রে প্রাণপণে যুদ্ধ ক’রে সাক্ষাৎ কৃতান্তের মতোই মৃত্যুমূর্তিতে বিচরণ করতে লাগলেন, সাংঘাতিক অস্ত্রসমূহ—যাদের শক্তি ভয়াবহ ও বহুবিস্তৃত, ব্যাপক—চিন্তা ক’রে ক’রে সেই সকল অস্ত্রই প্রয়োগ করতে লাগলেন, তত্রাচ সেই রণদুর্মদ সৈন্য-সমুদ্রের আয়তন খর্বিত হল না, তাদের হতোদ্যম কি পশ্চাৎপদ হবারও কোন লক্ষণ দেখা গেল না।…

ইতিমধ্যে দ্রোণ নিশ্চেষ্ট হয়ে নেই। যুধিষ্ঠিরের দিকেই লক্ষ্য বুঝতে পেরে ভীম প্রচণ্ড বিক্রমে তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু দ্রোণও সেদিন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি একা দশজন মহাযোদ্ধার সমান যুদ্ধ করতে লাগলেন। সত্যজিৎ তো গেলেনই, শেষে এমন অবস্থা হ’ল যে পাঞ্চালবীরগণ প্রায় সকলেই দ্রোণের সেই প্রচণ্ড আক্রমণে নিপাতিত হলেন, তাঁকে বাধা দিতে এক ভীম ছাড়া কেউ রইল না।

দুর্যোধন আহ্লাদিত হয়ে কর্ণকে বললেন, ‘আচার্যদেব আজ সত্যই সংহারমূর্তি ধারণ করেছেন। এখন আমাদের উদ্দেশ্য-সিদ্ধির বাধা তো দেখছি একমাত্র ভীম, সেই-বা আর কতক্ষণ দ্রোণের এ পরাক্রম সহ্য করবে!’

কর্ণ তাঁর মূঢ়তায় ঈষৎ করুণার হাসি হেসে বললেন, ‘তুমি আবাল্য দেখেও ভীমকে কিছুমাত্র চিনতে পারো নি। সে পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করার পাত্র নয়। তাছাড়া পাণ্ডবপক্ষীয় অপর বীরগণও নিশ্চয় আবার এসে পড়বেন। রণহস্তী যত দুর্ধর্ষই হোক, একপাল কোক্‌-এর* কাছে সে অসহায়। আমাদের এখন অবিলম্বে আচার্যর পৃষ্ঠ ও পার্শ্বরক্ষা করতে যাওয়া উচিত।’

[* নেকড়ে বাঘ।]

দ্রোণের এই অসহায় অবস্থা অনুমান করেছিলেন ভগদত্তও। তিনি সিংহনাদ সহকারে তাঁর বিরাট হস্তীবাহিনী নিয়ে দ্রোণের পার্শ্বরক্ষা অভিলাষে দ্রুত এগিয়ে এলেন। তাঁর নিজস্ব বাহন মহাহস্তীটিও বিখ্যাত, অসংখ্য যুদ্ধে সে সগৌরবে ভগদত্তকে বহন করেছে। প্রবাদ সে স্বয়ং ইন্দ্রবাহন ঐরাবতের বংশধর, সে বাহন মাত্র নয়, সেও এক যোদ্ধা।

ভগদত্ত যাতে দ্রোণের সঙ্গে মিলিত হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠির পাঞ্চালবীরগণসহ মধ্যপথেই তাঁকে বাধা দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভগদত্ত ও তাঁর অপরাজেয় হস্তিবাহিনী সেদিন যেন এক মহাপ্রলয়ের অবতারণায় সঙ্কল্পবদ্ধ। প্রাগজ্যোতিষপুরের পার্বত্য সেনাবাহিনী ও পর্বতসদৃশ এই হস্তিযূথ সেদিন এমন প্রচণ্ড যুদ্ধ করল যে দণ্ডকাল মধ্যে পাণ্ডবপক্ষের বহু বিশিষ্ট ধনুর্ধর নিহত হলেন, পাঞ্চাল সৈন্যরা ‘কালান্তক যমই হস্তীপৃষ্ঠে অবতীর্ণ’ এই ধারণায় চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করতে লাগল।

হস্তীর গর্জন বহু দূরে সেই অগণিত অস্ত্র ঝনৎকারের মধ্যেও অর্জুনের শ্রুতিগোচর হ’ল।

অর্জুন চিন্তিত হয়ে অবিরাম যুদ্ধের মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘এ গভীর বৃংহিত ধ্বনি ভগদত্তের বাহন ব্যতিরেকে আর কোন হস্তীর হতে পারে না। এ হস্তী লৌহ এবং অগ্নিতে কাতর হয় না। ধর্মরাজ আজ নিশ্চিত বিপন্ন, তুমি সত্বর উত্তর রণাঙ্গনে রথ নিয়ে চল।’

কিন্তু তখনও চতুর্বিংশতি সহস্র সংশপ্তক তাঁর পথ রোধ ক’রে আছে। তারাও পণবদ্ধ, তাদের নিহত না ক’রে অর্জুন পাদমেকং যেতে পারবেন না। উপরন্তু সুশর্মা প্রভৃতি অর্জুনরথের অশ্ব এবং সারথিকেও এমন ভাবে তীক্ষ্ণ শায়ক বর্ষণে জর্জরিত ক’রে তুললেন যে অশ্বগুলি তো কাতর হয়ে পড়লই স্বয়ং বাসুদেব ক্ষতবিক্ষত ও স্বেদাক্ত হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণের জন্য তাঁর দৃষ্টিও আচ্ছন্ন হয়ে এল।

বিপন্ন অর্জুন যুধিষ্ঠিরের নিরাপত্তার জন্য সংশয়াচ্ছন্ন বলেই বোধ করি ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। বিপক্ষীয়রা সেই সুযোগই গ্রহণ করেছে। তিনি এবার ক্রদ্ধ হয়ে এক অকল্পনীয় অশ্রুতপূর্ব কার্য করলেন। শত্রুপক্ষের সেই বিরাট বাহিনীর উদ্দেশ্যে সূর্যতুল্য তেজস্বী, প্রায়-বিশ্ব-বিধ্বংসী এক বিষম ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। বহুদূরে নিক্ষেপের ফলে তাঁদের খুব ক্ষতি হ’ল না কিন্তু সে অস্ত্রের প্রলয়ঙ্কর বহ্নিবন্যায় কয়েক সহস্র সংশপ্তক সেনা নিহত হ’ল, অবশিষ্ট অধিকাংশ মুমূর্ষু বা অচেতনভাবে নিশ্চল হয়ে পড়ল। তাদের হস্তী, অশ্ব, রথ, এমন কি প্রান্তরস্থ চতুষ্পার্শবর্তী বৃক্ষলতাসমূহও সে অগ্নিধূম ও তজ্জনিত প্রবল বাত্যায় ছিন্নভিন্ন দগ্ধ বা নিহত হ’ল।

সেই অবসরে দ্রুত অশ্বচালনা ক’রে শ্রীকৃষ্ণ পথবর্তী অগণ্য পদাতিককে দলিত চক্রপিষ্ট ক’রে রথ ভগদত্তর সম্মুখে নিয়ে গেলেন।

অর্জুনের আর অর্ধদণ্ড বিলম্ব হলেই মহাবিপদ–বুঝি বা মহা সর্বনাশই হত। ভীম একাকীই কৃতান্ততুল্য ভগদত্তর সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধে নিরত। এ ক্ষেত্রে বিপক্ষ শুধু ভগদত্তই নন, তাঁর মেঘপর্বতসদৃশ হস্তীটিও শত্রুদলনে তৎপর। অমিতবীর্য ভীমসেনের পক্ষেও তাকে নিস্তেজ বা নিষ্ক্রিয় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষে এক সময় বিপর্যস্ত হয়ে তিনি ওর বিশাল উদরাবলম্বনে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে সময় তাঁকে দেখতে না পেয়ে ‘হায়, ভীমসেন নিহত হলেন’ পাণ্ডবসৈন্য মধ্যে এই হাহাকার ধ্বনি উঠেছিল। সেই সংকটকালে কিশোর অভিমন্যু মহাবিক্রমে ভগদত্তর সম্মুখীন না হলে হয়ত এই বিলাপের কারণ সত্য হয়ে উঠত।

দূর থেকে ফাল্গুনীকে প্রলয়দেবতা মহারুদ্রের মতো শত্রুসৈন্য বিমর্দিত বিমথিত ক’রে তাঁর দিকে বেগে ধাবমান দেখে ভগদত্ত এঁদের ছেড়ে অর্জুনের দিকেই হস্তী চালনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ভয়ঙ্কর মূর্তিতে অগ্রসর হতে দেখে সে আক্রমণের প্রচণ্ড বেগ পরিহার করতে সুকৌশলে প্রায় বিদ্যুৎবেগে রথঅশ্বের গতিমুখ পরিবর্তন ক’রে ভগদত্তের দক্ষিণ ভাগে এসে গেলেন। তখন অর্জুনের পক্ষে পশ্চাৎ দিক থেকে গজ ও গজারোহীকে বধ করা এক নিমেষের কাজ—কিন্তু এ সুযোগ নেওয়া বা পশ্চাৎদিক থেকে অস্ত্র প্রয়োগ করা যোদ্ধার অযোগ্য বলেই তিনি তা থেকে বিরত রইলেন।

ভগদত্ত বহুবিধ অস্ত্রে প্রস্তুত হয়েই সেদিন রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ধনু গদা তোমর ভল্ল প্রভৃতি সাধারণ অস্ত্ৰ তো ছিলই, কয়েকটি সজীব অস্ত্রও সঙ্গে এনেছিলেন—প্রাগজ্যোতিষপুরের বিখ্যাত কৃতান্তদূত তুল্য অজগর সর্প। এরা অনায়াসে বৃহদাকার জন্তু ও প্রমাণাকৃতি মানুষকে জীবন্ত গলাধঃকরণ করে, অথবা তাদের বেষ্টন ক’রে অস্থিসকল চূর্ণ ক’রে কদমবৎ পিণ্ডে পরিণত করে।

ভগদত্ত সেই সকল ভীষণাকৃতি ভীষণকর্মা মহানাগ নিয়োগ করলেন। তারা সাধারণ অস্ত্রাঘাতে কাতর কি বিচলিত হয় না, পরন্তু ক্রদ্ধ হয়ে উঠে অস্ত্রবর্ষণকারীর প্রাণঘাতী হয়। এঁদের মধ্যে সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক নাগটিকে প্রয়োগ করলেন তিনি ধনঞ্জয়ের উদ্দেশে। অপর শূরগণ তার সুবিশাল অথচ তড়িৎগতি দেহ, ভয়ঙ্কর গর্জন ও মূর্ছা- আনয়ন-কারী নিঃশ্বাসেই বিহ্বল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল, বীভৎস মৃত্যু আসন্ন জেনেও অপসারণের শক্তি রইল না তাদের কিন্তু অর্জুন অনায়াসে সহাস্য বদনে বিদ্যুৎত্বৎ-গতিতে তাকে দশটি সুতীক্ষ্ণ শায়কে বিদ্ধ করে বধ করলেন।

অতঃপর ভগদত্ত ও অর্জুনের মধ্যে যে যুদ্ধ হল তা অবর্ণনীয়।

ভগদত্ত ইচ্ছাপূর্বকই যেন রথীকে উপেক্ষা ক’রে সারথি ও বাহকদের বিব্রত অস্থির ক’রে তুললেন। অর্জুনের রথের অশ্ব-অষ্টক বিখ্যাত, এদের শক্তি সহিষ্ণুতা ও শিক্ষা তুলনাহীন, অর্জুনের বিশেষ প্রিয়—এদের ও বাসুদেবকে বধ করতে পারলে অর্জুন নিবীর্য ও হতোদ্যম হয়ে পড়বেন, তখন তাঁকে বন্দী করা সহজসাধ্য হবে— বোধ করি এই ছিল তাঁর ধারণা। কিন্তু এ অন্যায় ও যুদ্ধরীতি-বহির্ভূত আক্রমণের ফল হল বিপরীত। শ্রীকৃষ্ণকে রুধিরাক্ত-দেহ ও প্রিয় অশ্বগুলিকে শরবিদ্ধ দেখে নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন অর্জুন, এবং অবিলম্বে ভগদত্তবধে কৃতসংকল্প হলেন।

ভগদত্ত তাঁর সে অবিশ্বাস্য রকমের প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে একে একে তাঁর শেষ সময়ের সঞ্চয়

সমস্ত বহুপ্রাণহন্ত্রী মারণাস্ত্রগুলিই নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু অর্জুন বহুগুণ শক্তিধর অস্ত্র প্রয়োগ তার সবগুলিই প্রতিহত ক’রে ভগদত্ত ও তাঁর বাহন মহাহস্তীকে বিপর্যস্ত ও অস্ত্রজর্জরিত ক’রে তুললেন। হস্তীটি এসে তাঁর রথের উপর পদ রেখে রথ চূর্ণ ও রথীকে শুণ্ডবেষ্টনে বন্দী করার চেষ্টা করল, সে পদচাপ সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই যন্ত্রণাদায়ক এক অস্ত্র প্রয়োগে তাকে কাতর ও উন্মত্তবৎ অস্থির ক’রে তুললেন।

এবার ভগদত্ত প্রমাদ গণনা করলেন। এতাবৎ সাক্ষাৎ সমরে অবতীর্ণ না হওয়ার জন্য অর্জুনের শিক্ষা ও শক্তি সম্বন্ধে ধারণা ছিল না তাঁর। তিনি ব্যাকুল হয়ে উদ্ধার চিন্তা করতে স্মরণ হল, তাঁর পূর্বপুরুষ-সংগৃহীত অসুররাজ প্রদত্ত এক অমোঘ দিব্যাস্ত্র আছে। চরম সংকটকালে তা প্রয়োগ করার কথা। সে অস্ত্র সামান্য রথীর উপর বিনিয়োগ করলে বহু লোক এমন কি তাঁর নিজেরও সর্বনাশ হবার কথা। সেই কারণেই তাঁর পূর্বপুরুষরা তা কোন দিন ব্যবহার করেন নি। কিন্তু এক্ষণে সেই চরম সংকটকাল উপস্থিত এবং জগতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তাঁর প্রাণনাশে উদ্যত এই বিবেচনায় ভগদত্ত সেই মহাস্ত্র গ্রহণ করলেন।

তার সূর্য-সদৃশ তাপে ও দীপ্তিতে নিমেষ কাল মাত্রে চতুষ্পার্শ্বস্থ সমস্ত সেনা ও যোদ্ধারা হতচেতন হয়ে পড়লেন, অনেকেই অন্ধ হয়ে গেলেন। উল্কার মতো গতিশীল, শত ভাস্করের মতো প্রদীপ্ত প্রজ্বলিত সেই অস্ত্র চতুর্দিকে দুঃসহ তেজ বিকীরণ করতে করতে অর্জুনের দিকে ধাবিত দেখে শ্রীকৃষ্ণ অকস্মাৎ এক বিচিত্র ও কিছুপূর্বেও অচিন্তিত কর্ম করলেন। পলকপাতমাত্র কালে তিনি অশ্ববলগা ত্যাগ ক’রে এক লম্ভে রথে আরোহণ ক’রে অর্জুনকে আচ্ছাদিত করলেন ও নিজের বহু রমণীইন্সিত প্রশস্ত বক্ষে সেই অস্ত্রের আঘাত গ্রহণ করলেন। দেখা গেল সেই প্রজ্বলন্ত ভীষণকর্মা মহাঅস্ত্রও তাঁর অঙ্গে কোন ক্ষতি করতে পারল না, পরন্তু সেই পরমস্পর্শেই যেন নিস্তেজ ও নির্বাপিত হয়ে গেল।

এর পর ভগদত্ত-বধে কোন বাধা থাকার কথা নয়, রইলও না।

কিন্তু ঘোর শত্রু-নিপাত অনায়াসসাধ্য হওয়াতেও অর্জুনের মনে আনন্দ রইল না। তিনি সক্ষোভে অনুযোগ করলেন, ‘বাসুদেব, তুমি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোন অংশগ্রহণ করবে না, বার বার এ দৃঢ় সঙ্কল্প ঘোষণা করা সত্বেও সে প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলে কেন? আমি যুদ্ধে অপারগ হয়ে পড়েছি? বিশেষ ভগদত্ত আমার সঙ্গেই যুদ্ধ করছিল—তার অস্ত্রাঘাত থেকে আমাকে আবরিত করায় বীরসমাজে আমি চিরকালের মতো হাস্যাস্পদ হলাম।’

শ্রীকৃষ্ণ ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘বন্ধু, অহঙ্কারের মতো শত্রু বীরগণের খুব অল্পই আছে। অহঙ্কার বিনষ্ট না হলে শৌর্য কেন—কোন শিক্ষাই সম্পূর্ণ হয় না। তুমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তাতে সন্দেহ নেই, তাই বলে যদি তোমার এ ধারণা হয়ে থাকে তুমি সর্বতো ও সর্বথা অপরাজেয়—তাহলে বুঝতে হবে শৌর্য তোমার যেমনই হোক, বুদ্ধি কিছুমাত্র নেই … আর, তুমি বিলক্ষণ জান, আমি উত্তম কারণ ভিন্ন আপাতগর্হিত কোন কার্য করি না। এত বড় প্রতিজ্ঞা যখন ভঙ্গ করেছি তখন তোমার বোঝা উচিত ছিল—তার কারণও তেমনিই সুবৃহৎ। তুমি কি বিশ্বের তাবৎ মহাঅস্ত্র প্রয়োগ সংহরণ বা প্রতিরোধের রহস্য আয়ত্ত করেছ? মূঢ়, এই অস্ত্র বিশ্বত্রাস নরকাসুর নির্মাণ করিয়েছিলেন, দেবতাদের জয় করার উদ্দেশ্যে। তাঁর কাছ থেকে ভগদত্তর পিতা ওটি লাভ করেন। চরমসংকটকালে প্রয়োগ করবেন বলে ভগদত্ত এতদিন সংগোপনে ওটি লালন করেছেন। কথিত আছে মহাবৈষ্ণবী-মন্ত্রে ওটি পরিশোধিত— সেই কারণেই সাধারণ যোদ্ধাগণের অপ্রতিরোধ্য। আমি কোনদিন প্রয়োজন হতে পারে এই বোধ ক’রেই বহুযত্নে এ অস্ত্রের প্রভাব বিনষ্ট করার কৌশল আয়ত্ত করেছি। সেইজন্যই আমি তোমাকে আবরিত ক’রে ওটির সংঘাত গ্রহণ করলাম—নতুবা তুমি কেন, কর্ণ, দ্রোণ এমন কি ভীষ্মেরও ক্ষমতা নেই ঐ অস্ত্রের বেগ ও তেজ সহ্য ক’রে জীবিত থাকেন … অর্জুন, স্মরণ রেখো তোমার শৌর্যাভিমানের অপেক্ষা তোমার প্রাণ—তথা আমার উদ্দেশ্যসিদ্ধি আমার কাছে অধিক মূল্যবান।’

১৩

এ-ই যথেষ্ট, তবু—বাসুদেবের দুর্বোধ্য আচরণের এও একমাত্র উদাহরণ নয়।

কর্ণ সব চেয়ে বিস্মিত হন অভিমন্যুবধের সামগ্রিক ঘটনাতেই।

অভিমন্যু শ্রীকৃষ্ণের ভাগিনেয়, প্রিয়তম বন্ধুর পুত্র। তার শৌর্যে-বীর্যে কান্তিতে ব্যবহারে শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ প্রিয়। তার সম্বন্ধে সদা-সচেতন, সদা-সতর্ক থাকার কথা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এমন ভাবেই আচরণ করলেন যেন তার মৃত্যুর কিছুমাত্র আশঙ্কা ছিল না, যেন এ পরিণতি তিনি পূর্বে অনুমান করতে পারেন নি।

অথচ, দ্রোণ যে সেদিন চক্রব্যূহাকারে সৈন্যসজ্জা করবেন তা শ্রীকৃষ্ণ—এবং অর্জুনও—নিশ্চিত জানতেন। শত্রুশিবিরে কোন মন্ত্রণা গৃহীত হওয়া মাত্র তার সংবাদ অপরপক্ষের গোচরস্থ হয়। এই চক্রব্যূহে প্রবেশ ও নির্গমনের রহস্য পাণ্ডবপক্ষে একমাত্র অর্জুনই অবগত আছেন—এ তথ্যও শ্রীকৃষ্ণের অজ্ঞাত নয়। অর্জুন একদিন যুদ্ধকৌশল প্রসঙ্গে বাসুদেবের সম্মুখেই চক্রব্যূহ ভেদ করার পদ্ধতি অভিমন্যুকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্গমনের কৌশল পর্যায়ে পৌঁছনোর পূর্বেই বালক অভিমন্যু নিদ্রাতুর হয়ে গৃহকুট্টিমের যে অংশে নকশা অঙ্কিত ক’রে ওঁকে দেখানো হচ্ছিল— তার ওপরই শুয়ে পড়েন। পরে আর অর্জুন সে শিক্ষা সমাপ্ত করার অবসর বা সুযোগ পাননি। তত প্রয়োজনও বোধ করেন নি। ।

সেদিন প্রত্যুষকালে যুদ্ধারম্ভের প্রাক্কালেই যখন সংশপ্তক নারায়ণী সেনারা অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান ক’রে রণক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমি থেকে বহুদূরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য বাসুদেব নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি যদি সে সময় একবার অর্জুনকে সচেতন ক’রে দিতেন তাহলে অন্তত এক দণ্ডকাল অপেক্ষা ক’রে অভিমন্যুকে সে জটিল ব্যূহ থেকে নিষ্ক্রমণের অথবা ভীমসেনকে প্রবেশের কৌশল বিবৃত ক’রে বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারতেন।

কিন্তু বাসুদেব কিছুই করেন নি, প্রশান্ত উৎফুল্ল মুখেই অর্জুনের রথাশ্ব চালনা করেছিলেন দূর দক্ষিণদিগন্তের দিকে অভিমন্যুবধে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন কর্ণ, তার জন্য তাঁর লজ্জা ও আত্মগ্লানির অবধি নেই, তবে নিতান্ত নিরুপা হয়েই শকুনি ও দুঃশাসনের অতিগর্হিত, সর্বপ্রকার-রণনীতিবিরুদ্ধ মন্ত্রণা অনুমোদন করতে হয়েছিল তাঁকে। নতুবা সেদিন সূর্যাস্তের পূর্বেই বোধ করি বালক অভিমন্যুর নিকট কৌরবপক্ষকে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করতে হত। হয়ত বা মৃত্যুও। সেদিন দ্রোণাচার্য দুর্যোধন কর্তৃক কর্কশ ভাষায় ধিকৃত হয়ে পাণ্ডবপক্ষকে হতমান করার দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়েছিলেন। চক্রব্যূহ রচনা সেই সঙ্কল্পেরই ফল। এ ব্যূহে প্রবেশ ও নির্গমনের রহস্য অর্জুন ছাড়া পাণ্ডবপক্ষে কেউই জানেন না— এই জ্ঞানেই দ্রোণ নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁরই নির্দেশে সংশপ্তকরা অর্জুনকে বহুদূরে নিয়ে গেছে, আর কার সাধ্য আছে এ ব্যূ ভেদ করার!

দ্রোণাচার্য অভিজ্ঞ দুরদর্শী-–তবু অভিমন্যুর কথাটা হিসাবে ধরেন নি।

অবশ্য তাই বলে তিনি গোপন ব্যূহদ্বার অরক্ষিতও রাখেন নি, ধৃতরাষ্ট্রজামাতা সিন্ধুদেশাধিপতি মহাবল জয়দ্রথ, দ্ৰোণ স্বয়ং, অশ্বত্থামা, দুর্যোধনের বহু ভ্রাতা, শকুনি, শল্য ও শত্রুত্রাস-ভূরিশ্রবা—এতগুলি মহাশূর সেই ব্যূহদ্বার রক্ষা করছিলেন। যুধিষ্ঠির এত জানতেন না, এই শোচনীয় পরিস্থিতি অনুমানও করতে পারেন নি। তিনি এই বিশ্বাসেই অভিমন্যুকে সে ব্যূহদ্বার ভেদ করার আদেশ দিয়েছিলেন যে, দ্বারের সন্ধান পেলে ভীমসেন প্রভৃতি মহাপরাক্রান্ত বীরদের অভিমন্যুর অনুসরণে কোন বাধা থাকবে না। অভিমন্যু এত কিছুই ভাবেন নি, জ্যেষ্ঠ পিতৃব্যের আদেশ মাত্রে সেইদিকে অশ্বচালনা করেছিলেন এবং অল্পায়াসেই পথরক্ষক বীরদের পরাজিত ক’রে অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন।

প্রবেশ করলেন কিন্তু অভিমন্যু একাই।

ভীম যুধিষ্ঠির সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন এঁরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘তুমি শুধু আমাদের প্রবেশপথ পর্যন্ত পৌঁছে দাও,

তারপর যা করণীয় তা আমরাই করব। নিষ্ক্রিয় হয়ে অর্জুনের প্রত্যাগমন পর্যন্ত অপেক্ষা ক’রে কৌরবদের অস্ত্রবৃষ্টির লক্ষ্য হয়ে থাকলে অথবা কৌরবদের হস্তে বন্দী কি নিহত হলে আমাদের শুধু নয়, অর্জুনের লজ্জা ও অবমাননার শেষ থাকবে না। জীবিত বা মুক্ত থাকলেও সে মুখ নিয়ে আমরা অর্জুনের সম্মুখে দাঁড়াতে পারব না।’

কিন্তু কার্যকালে তাঁরা কিছুই করতে পারলেন না, অভিমন্যু অনায়াসে ভিতরে প্রবেশ করলেও অপর কোন পাণ্ডবই পারলেন না। ব্যূহদ্বার-রক্ষীরা—বিশেষ জয়দ্রথ—যেন সাক্ষাৎ রুদ্রদেবতা-অনুপ্রেরিত হয়ে এমন প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করলেন যে, এঁদের পক্ষে সেই সঙ্কীর্ণ ব্যূহদ্বার ভেদ ক’রে ভিতরে যাওয়া সম্ভব হ’ল না।

অভিমন্যু প্রথমে অতটা লক্ষ্য করেন নি। পরে একসময় দেখলেন সমগ্র কুরুবাহিনীর সম্মুখে তিনি একা, তাঁর জ্যেষ্ঠতাত খুল্লতাতগণ অথবা মাতুলবংশীয়রা কেউই তাঁর অনুগমনে সক্ষম হন নি।

সে ক্ষেত্রে সকৌশলে ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কার্য হত— কিন্তু সে উপায় তাঁর জানা ছিল না। তবু তিনি অর্জুনেরই পুত্র, পলায়ন বা পরাজয় শব্দ তাঁর অজ্ঞাত। কিছুমাত্র হতোদ্যম না হয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ ক’রে যেতে লাগলেন। শেষে এমন হ’ল যে, ঐ কিশোর বালকের নিকটেই বোধ করি আজ কৌরববাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে, এমনি আশঙ্কা হতে লাগল।

একেবারে অনন্যোপায় হয়েই শকুনির পরামর্শ মতো কৌরবদের সপ্ত মহারথ চারিদিক থেকে ঘিরে ঐ কমলকোরকের ন্যায় অর্ধস্ফুটিত-যৌবন বালককে বধ নয়—তাঁরা হত্যাই করলেন।

মহাপাপ, অমার্জনীয় অপরাধ তাতে সন্দেহ নেই, তবে সেদিন সে কার্য তাঁদের বাধ্য হয়েই, আত্মরক্ষার্থ করতে হয়েছিল। মৃত্যুত্তর কালে ধর্ম কি বিচার করবেন তা তাঁরা জানেন না—কিন্তু শাস্ত্রে আছে আত্মরক্ষার জন্য অকরণীয় কিছুই নেই—তাঁদের দিকে এ-ই একমাত্র সান্ত্বনা রইল।

.

সে যা-ই হোক, কর্ণর মূল প্রশ্ন অনুত্তরিতই থেকে যাবে বোধ হয়—শ্রীকৃষ্ণ সব জেনেও এই বালককে হত্যা করালেন কেন?

তিনি যে এ সম্ভাবনা অবগত ছিলেন বা অনুমান করতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ—সংশপ্তকদের বিধ্বস্ত ক’রে অর্জুন যখন সন্ধ্যাকালে শিবিরে প্রত্যাবর্তন করছেন তখন চতুর্দিকে নানাবিধ দুর্লক্ষণ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন, ‘বাসুদেব, চারিদিকে এত অমঙ্গলসূচক লক্ষণ দেখছি কেন? ভয়ানক সব উৎপাত চিহ্ন, গৃধ্রগণ পশ্চিম আকাশ আচ্ছন্ন করেছে, শূন্য মণ্ডলে যেন রক্ত বৃষ্টি হচ্ছে, আমার বাম অঙ্গ ঘন ঘন স্পন্দিত হচ্ছে, শরীর অবসন্ন বোধ হচ্ছে— বাতাসে যেন এক হাহাকার ধ্বনি শুনছি। ধর্মরাজ জীবিত আছেন তো? পাষণ্ডরা তাঁকে বন্দী করে নি তো?

এই উৎকণ্ঠাকুল প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ নিতান্ত নিরুদ্বিগ্ন ভাবে বলেছিলেন, ‘না, না। সে আশঙ্কার কারণ নেই। তোমার ভ্রাতারা জীবিত ও সুস্থই আছেন। তাঁদের কেউ বন্দীও করে নি। অন্য কোন সামান্য ক্ষতি বা বিপদ হয়ত হয়েছে।’

তাঁর এই উক্তি পরে পাণ্ডব শিবিরে বার বার উচ্চারিত ও আলোচিত হয়েছে। তাঁর অসামান্য ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি— মানবোত্তর প্রজ্ঞা—অপ্রত্যক্ষ অশ্রুত ঘটনা সম্বন্ধে এই অলৌকিক জ্ঞান—সাধারণ সৈনিকদের একটা অস্পষ্ট আতঙ্ক ও পাণ্ডবদের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। অনুযোগও করেছেন ভীমসেন। বাসুদেব যখন সবই জানতেন, কিছুই যখন তাঁর অগোচর নয়, কোন ভবিষ্যৎ ঘটনাই, ত্রিকালজ্ঞ বলে তাঁকে অভিহিত করাই উচিত—তখন তিনি এ সর্বনাশ ঘটতে দিলেন কেন!

এই ‘কেন’র উত্তর সেদিন বাসুদেব দেন নি।

এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজে পান নি কর্ণও।

এক-একবার এক অদ্ভুত অস্বাভাবিক ধারণা মনে আসে—কিন্তু সেও তো অবিশ্বাস্য। মনে হয় এও কি সম্ভব, এমন কি শ্রীকৃষ্ণের পক্ষেও?

মনে হয়—বাসুদেব ভারতের তাবৎ ক্ষাত্রশক্তি তথা রাজশক্তির ধ্বংসে দৃঢ়সঙ্কল্প। সেইজন্যই তাঁর এই মহাযুদ্ধের এই বিপুল বিস্তৃত নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন। হ্যাঁ, এ যে তাঁরই সুনিশ্চিত আয়োজন তাতে বর্তমানে আর কর্ণের কোন সংশয় নেই। সেই হতভাগ্যের দল—হতভাগ্যই বলবেন অঙ্গাধিপতি তাদের, কারণ শ্রীকৃষ্ণ যাদের বিনাশে কৃতায়োজন, তাদের স্বয়ং পুরন্দরও রক্ষা করতে পারবেন না তাঁর অমানুষী শক্তি, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দেখে তাই মনে হয়—সেই সকল ক্ষত্রিয় রাজবংশ মধ্যে তাঁর নিজ জ্ঞাতিকুল—যাদব বৃষ্ণি অন্ধক—এঁরাও আছেন। অবশ্য, যদি সত্যই অনাচারী অত্যাচারী পাপনিমগ্ন ঐ শক্তি ধ্বংস ও নির্মূল করতে হয় তাহলে এদেরও অব্যাহতি দেওয়া উচিত নয় কোন মতেই, তা কৰ্ণ স্বীকার করতে বাধ্য। শ্রীকৃষ্ণের বিরাট ব্যক্তিত্বের ছত্রছায়ায় নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে করতে এরা অধঃপতনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁচেছে। কামচরিতার্থতা, কুৎসিত ভোগোন্মত্ততা ব্যতীত কোন আনন্দই জানে না তারা। নারী সুরা দ্যূতক্রীড়া এই তাদের ব্যসন, যথেচ্ছাচার তাদের ধর্ম। কদর্য জীবন সম্ভোগই তাদের জীবনের পরিপূর্ণতা, জীবনের লক্ষ্য। বিখ্যাত বীরগণের অপত্যরা আজ অপরিমিত সুরাপান, যৌনসম্ভোগ (তার নানা কদর্য পন্থা উদ্ভাবনেই সমস্ত বুদ্ধি বুঝি নিঃশেষিত) ও কর্মহীন জীবনযাত্রায় বীর্যহীন, সাহসহীন, আদর্শহীন।

মনে হয় বাসুদেব তাদেরও বধ্যরূপে চিহ্নিত ক’রে রেখেছেন মনে মনে, নিঃশব্দ দণ্ডাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু অভিমন্যুর মতো দুর্জয় বীর জীবিত থাকতে তার মাতুল বংশের সংহার সম্ভব হবে না বুঝেই তাঁর এই নির্মম ঔদাসীন্য…

বাসুদেবের কার্যকলাপের অর্থ এবং চিন্তাকল্পনার বুঝি তল পান না তাঁর অন্তরঙ্গ সুহৃৎ ও প্রিয় পাণ্ডবরাও।

.

পুত্রশোকাতুর অর্জুন যখন নিতান্ত প্রাকৃত জনের মতোই ক্রন্দন, হাহাকার, নিন্দা-গঞ্জনা-ধিক্কার প্রকাশ ও বিলাপের পর ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করলেন যে পরদিন সূর্যাস্তের পূর্বেই তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন নতুবা অগ্নিতে প্রবেশ ক’রে প্রাণত্যাগ করবেন— তখন কৌরব শিবিরেও আপৎকালীন বিশেষ মন্ত্রণাসভা আহূত হবে এ খুবই স্বাভাবিক। অর্জুন বলেছেন এ প্রতিজ্ঞা পালন করতে না পারলে শুধু যে আত্মহত্যা করবেন তাই নয়—কঠোর শপথবাক্য উচ্চারণ করেছেন—পরলোকেও যেন তাঁর আত্মা শান্তি না পায়। পৃথিবীর তাবৎ ঘৃণ্য কার্যের পাপ যেন তাঁকে আশ্রয় করে, তিনি যেন অনন্ত নরক ভোগ করেন।

অর্জুন এমনিতেই অপরাজেয়—অমর দেবতাদেরও অবধ্য, ত্রাস স্বরূপ। তিনি শস্ত্রপাণি হ’লে সমস্ত পৃথিবী ত্রস্ত থাকে। এমন অবস্থায় তাঁর এই কঠিন প্রতিজ্ঞা শুনেই জয়দ্রথ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুআশঙ্কায় মুমূর্ষুবৎ হয়ে পড়লেন, কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘হে কুরুরাজ, হে অপরাপর রাজন্যবর্গ, আপনাদের কল্যাণ হোক, অদ্য এই দণ্ডেই রণস্থল ত্যাগ করাই আমার প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায়। দূর কোন নির্জন অরণ্যে গিয়ে আত্মগোপন করা ছাড়া আর তো আমার অব্যাহতির কোন পথ দেখতে পাচ্ছি না!’

দ্রোণাচার্য প্রভৃতি সকল বীরগণ প্রায় সমস্বরে তাঁকে আশ্বাস দিলেন, কৌরবদের তখনও পর্যন্ত যে বিপুল সৈন্য ও অগণন মহারথী জীবিত আছেন—পরের দিন সূর্যাস্ত অবধি—পাণ্ডবদের পরাজিত বা নিহত কি বিপর্যস্ত করার চেষ্টা না ক’রে কেবলমাত্র জয়দ্রথকে রক্ষা করারই চেষ্টা করবেন, সকলে তাঁকে ঘিরে থাকবেন নিশ্ছিদ্রমানবপ্রাচীর রচনা ক’রে …এতেই, অর্থাৎ যদি জয়দ্রথকে রক্ষা করতে পারেন, তাঁদের শত্রুজয়-উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে, কারণ অর্জুন অগ্নিতে প্রাণত্যাগ করলে পাণ্ডবপক্ষেরা হীনবল ও মনোবলহীন হয়ে পড়বে।

এ পক্ষের বিশ্বস্ত চরমুখে ও পক্ষের এই প্রতিক্রিয়া বা প্রতিরোধ-সঙ্কল্প এঁদের শ্রুতিগোচর হতে বিলম্ব ঘটল না। দিকদাহকারী ক্রোধ ও অপরিমেয় শোকের মধ্যেও অর্জুন ঈষৎ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দ্রোণাচার্যের শক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে তাঁর ধারণায় কোন ভ্রান্তি বা অবাস্তবতা ছিল না, নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অযথা স্ফীত ধারণাও না। ঐ বর্ষীয়ান যোদ্ধা এখনও বহু তরুণ বীরের মিলিত শক্তি অপেক্ষাও অধিক শৌর্য ও বীর্যের অধিকারী। তিনি যথার্থ মনঃসংযোগ বা প্রাণপণ চেষ্টা করলে একা সব্যসাচী অর্জুন কেন, সমুদয় পাণ্ডবপক্ষের যুক্তসামর্থ্যরও সাধ্য নেই তাকে প্রতিহত করে।

শোকাবেগ ও প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে প্রতিজ্ঞা করা এক কথা,—তা কর্মে রূপায়িত করা অন্য। এবং এক্ষেত্রে তা খুব অনায়াসসাধ্য হবে না…

দুশ্চিন্তার মধ্যেই কখন ক্লান্ত চক্ষু তন্দ্ৰায় নিমীলিত হয়েছে তা অর্জুন জানেন না, সুতরাং স্বপ্নকে প্রত্যক্ষ ঘটনা বলেই বোধ হয়েছে। দেখছেন তিনি ও শ্রীকৃষ্ণ শূন্যমার্গে প্রায় মনোবেগে কোথায় চলেছেন নিমেষকাল মধ্যে অনন্ত মহাকাশ অতিক্রম ক’রে কৈলাসে দেবাদিদেব শিবের নিকট উপস্থিত হলেন, মহাদেবকে পূজা ও স্তবে তুষ্ট ক’রে তাঁর কাছে পাশুপত অস্ত্ৰ—যা একমাত্র প্রলয়কালেই ব্যবহার করেন শিব, যার সংহারশক্তির বেগ সহ্য করতে পারে এমন কিছু নেই এ ব্ৰহ্মাণ্ডে—তাই প্রাপ্ত হলেন।…

নিদ্রার মধ্যেই নিশ্চিন্ত ও তুষ্ট হয়েছেন অর্জুন। ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁর নিদ্রাও ভঙ্গ হয়েছে। প্রফুল্ল চিত্তে এই আশ্চর্য স্বপ্নবৃত্তান্ত বাসুদেবকে শোনাতে যাবেন—সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর কপিধ্বজ রথের পাশেই শ্রীকৃষ্ণর শিখীধ্বজ রথ তাঁর বায়ুগতি অশ্বচতুষ্টয়-যোজিত অবস্থায় প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। কেবল তাই নয়, বাসুদেবের বিখ্যাত ভয়ানক অস্ত্রসমূহ—কৌমুদকী গদা, চক্রান্ত্র, ধনুঃশর, ভল্ল, শক্তি, পাশ প্রভৃতিও স্তূপীকৃত। এমন কি আসনের উপর শ্রীবৎসচিহ্নলাঞ্ছিত রাজছত্রও শোভা পাচ্ছে।

অর্জুন যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয়ে দারুককে প্রশ্ন করলেন, ‘দারুক, এ কী? বাসুদেবের নিজ রথ প্রস্তুত কেন?’

দারুক রহস্যময় হাস্যে উত্তর দিলেন, ‘প্রভুর ইচ্ছা। কাল রাত্রে যাদবশ্রেষ্ঠ বাসুদেব কিঞ্চিমাত্রও নিদ্রা যান নি। তৃতীয় প্রহরের প্রথম দণ্ডেই স্কন্ধাবার হতে নির্গত হয়ে এসে আমাকে এই নির্দেশ দিলেন। বললেন, পার্থ যে অসমসাহসিক এবং ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেছেন তা তাঁর পক্ষেও বোধ করি রক্ষা করা কঠিন হবে। অথচ তা রক্ষা করতে না পারলে তাঁর মৃত্যুবরণ ব্যতীত গতি থাকবে না। তিনি আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, তাঁর এই অকাল ও শোচনীয় মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারব না। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই আমি স্বয়ং সমস্ত কৌরবকুল বিনষ্ট করে ওঁকে জয়দ্রথ বথের সুযোগ দেব।’

স্বপ্নমধুর রাত্রিশেষের তৃপ্তি ও নিশ্চিন্ততা মুহূর্তে অপমানবোধের তিক্ততায় বিলীন হ’ল। এ ব্যবস্থা যেমন তাঁর সম্বন্ধে স্নেহ ও ব্যাকুলতাবোধের পরিচায়ক— তেমনি তাঁর শক্তি সম্বন্ধে অনাস্থারও।

তিনি ঈষৎ বিরস মুখেই শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘এ ভাবে তুমি বার বার নিজের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ক’রে আমাকে নিমিত্তের ভাগী করছ কেন? না হয় প্রতিজ্ঞারক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আমার মৃত্যুই ঘটত! সে আমি তত ক্ষতিকর মনে করি না, তোমাকে যদি লোকে মিথ্যাবাদী বা কপটাচারী বলে—সে বেদনা আমার পক্ষে মৃত্যুর অধিক দুঃসহ।’

শ্রীকৃষ্ণ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওঁর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘রথ প্রস্তুত রাখা এবং রথীর যুদ্ধ করা এক বস্তু নয়। আমি বিনা প্রয়োজনেই তোমাকে বীর সমাজে হেয় ক’রে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব—এমন কথা ভাবছ কেন? বরং… আমি প্রস্তুত আছি—এই তথ্য শত্রু-শিবিরে যে মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তাতেই তোমার উদ্দেশ্য অনেকটা সিদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।… বন্ধু, অযথা বীরত্বাভিমানে মনোকষ্ট ভোগ করা অনেক সময় কার্যসিদ্ধির প্রবল বাধা হয়ে ওঠে । তেমন সংকটকাল উপস্থিত হলে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা শুধু বলের বা শস্ত্রজ্ঞানের উপর নির্ভর ক’রে নিশ্চিন্ত থাকেন না, ছল ও কৌশলেরও আশ্রয় নেন—এবং বীর সমাজে সে ব্যবস্থা নিন্দনীয় নয়। আর সত্যিই যদি শেষ পর্যন্ত তেমন দুৰ্লগ্ন উপস্থিত হয়, তোমার প্রতিজ্ঞারক্ষা অসম্ভব হয়ে ওঠে— আমি অবশ্যই আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে দ্বিধা করব না।’

কে জানে এ বার্তা চরমুখে কৌরব শিবিরে পৌঁছবে জেনেই বাসুদেব এ কথা বলেছিলেন কিনা, সবটাই নাটকীয় অভিনয়—অথবা এ তাঁর আন্তরিক সত্যভাষণ।

কে জানে, দিনশেষে সূর্যাস্তের পূর্বেই যে একখণ্ড আকস্মিক কৃষ্ণ মেঘ—যা নিতান্তই অসাময়িক—এসে রাহুগ্রস্থ অবস্থার মতো সূর্যকে আবৃত ও দিবালোক আচ্ছন্ন ক’রে মিথ্যা সন্ধ্যার সৃষ্টি করেছিল—যার জন্য জয়দ্রথ ও তার রক্ষীগণ উৎফুল্ল হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য সকল সতর্কতা বিসর্জন দেওয়ায় অর্জুনের পক্ষে জয়দ্রথ বধ সম্ভব হ’ল—তার মধ্যে বাসুদেবের কোন কৌশল বা জাদু ছিল কিনা!

তবু, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ক’রে এক পক্ষ অবলম্বন পূর্বক যুদ্ধ করা বা যুদ্ধের আয়োজন করা বীরধর্মবিরোধী হলেও তেমন নীচ বা গর্হিত নয় যেমন শ্রীকৃষ্ণ ভূরিশ্রবা বধ কালে করলেন।

জয়দ্রথ বধের কিছু পূর্বে সূর্য তখন প্রায় অস্তাচলগামী—অর্জুন একাগ্রমনে শুধু জয়দ্রথের সমীপবর্তী হওয়ার কথা চিন্তা করছেন, প্রাণপণে সেই দিকেই অগ্রসর হতে চাইছেন—এবং দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ প্রভৃতি বাধা দেবার চেষ্টা করছেন সর্বপ্রযত্নে, দ্রোণের প্রয়াস দুর্যোধনের অনুরোধ অনুযায়ী কোন মতে যুধিষ্ঠিরের চতুষ্পার্শ্বস্থ রক্ষকগণকে অপসারিত, পরাজিত বা নিহত ক’রে তাঁকে বন্দী করতে। সেই সময় সাত্যকিও প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। যাদব অন্ধক বা বৃষ্ণিকুলের বীরগণের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের পরই শিনিপুত্র সাত্যকির স্থান। সাত্যকির প্রচণ্ড আক্রমণ প্রায় দুঃসহ হয়ে উঠেছে, সেই সময় স্বয়ং ভীমসেন কর্ণের নিকট পরাজিত লাঞ্ছিত ও আহত হয়ে পড়েছিলেন, কর্ণ তখন ইচ্ছা করলে অনায়াসেই ভীমকে বধ করতে পারতেন, কেবল কুন্তীর কাতরতা স্মরণ ক’রেই সামান্য বিদ্রুপের পর অব্যাহতি দিলেন।

তখন ভীমের রথ চূর্ণ, অশ্ব ও সারথি মৃত, রথের সঙ্গে অস্ত্রসকলও বিনষ্ট। অগত্যাই তিনি এসে সাত্যকির রথে আশ্রয় নিলেন।

এই দুই দুর্ধর্ষ বীরকে একত্র হ’তে দেখে সাধারণ যোদ্ধারা প্রমাদ গণে পশ্চাদপদ হতে চাইবেন এ স্বাভাবিক। অবস্থা বুঝে শত্রুর এই শক্তি বৃদ্ধির আতঙ্ককর জনরব নিবারিত করতেই ভূরিশ্রবা দ্রুত সেদিকে এগিয়ে এলেন। ভূরিশ্রবা কুরুবংশীয় ধার্তরাষ্ট্রদের নিকট জ্ঞাতি, নিজ মহাপরাক্রান্ত শূর তো বটেই—কৌরবপক্ষের যবন কিরাত কাম্বোজ সেনাগণের বিশেষ প্রিয়, তারা ওঁকে বীরের আদর্শ জ্ঞান করে।

ভূরিশ্রবার সাত্যকি সম্বন্ধে বিশেষ বিদ্বেষ ও উষ্মার কারণ ছিল। সাত্বতবংশীয় শিনি যখন বসুদেবের জন্য দেবকের কন্যা দেবকীকে বলপূর্বক হরণ ক’রে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ভূরিশ্রবার পিতা সোমদত্ত বাধা দিতে এলে উভয়ে যা বাহুযুদ্ধ হয় তাতে শেষ পর্যন্ত সোমদত্ত পরাজিত ও ভূপাতিত হলে শিনি তাঁকে পদাঘাত করেন। মৃত্যুর অধিক এই অপমান সোমদত্ত বিস্মৃত হন নি, তা ভূরিশ্রবাও স্মরণে রেখেছিলেন।

সাত্যকি তখন অবিরাম যুদ্ধের ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, সুযোগ বুঝে ভূরিশ্রবা সর্বশক্তি প্রয়োগে তাঁকে আক্রমণ করলেন। অচিরেই পরস্পরের শরে পরস্পরের রথ অশ্ব বিনষ্ট হ’ল—তখন ভূরিশ্রবা বাহুযুদ্ধমানসে সাত্যকির ভগ্নরথে আরোহণ ক’রে তাঁকে ভূতলে নামিয়ে আনলেন এবং শীঘ্রই সাত্যকিকে পরাভূত ক’রে সবলে পদাঘাত করলেন। সে আঘাতে কিছুক্ষণের জন্য সাত্যকি অনড় ও মূর্ছিতবৎ হয়ে গেলেন। কিন্তু অপমানের শেষ হলেও শত্রুর শেষ হয় নি— এই কথা স্মরণ ক’রে ভূরিশ্রবা বামহস্ত কেশবদ্ধ রেখেই সাত্যকির মস্তক ছেদনের জন্য দক্ষিণ হস্তে খড়্গা উত্তোলন করলেন।

তখন আর বিন্দুমাত্র কাল-হরণের অবকাশ নেই। আর হয়ত পলক মাত্র মধ্যে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। নিতান্ত – সাত্যকির অন্তত সামান্য চেতনা ফিরে আসার জন্য ভূরিশ্রবা অপেক্ষা করছেন ব’লেই—ভূপাতিত নিরস্ত্র ও অচেতন শত্রুকে বধ করার রীতি নেই—কয়েক লহমা মাত্র বিলম্ব করছেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাড়না করলেন, ‘কী করছ পার্থ, কিসের জন্য অপেক্ষা করছ! এখনই ওর দক্ষিণ হস্ত ছেদন কর! আর সময় নেই।

তবু অর্জুনের দ্বিধা যায় না। বললেন, ‘কিন্তু ও যে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ রত, আমি কেমন ক’রে আঘাত করি।’ শ্রীকৃষ্ণ তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠলেন, ‘কাল যখন এই ব্যক্তিই অপর কপট নীতিবিগর্হিত যুদ্ধকারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিরস্ত্র রথবিহীন বর্মবিহীন বালক অভিমন্যুকে বধ করেছিল—তখন কোন রণনীতি রক্ষিত হয়েছিল? যুদ্ধে বিজয়লাভই নীতি, ন্যায়, ধৰ্ম!’

অভিমন্যুর অসহায় মৃত্যু—ব্যাধহস্তে চতুর্দিকে সারমেয়তাড়িত ও পরিবৃত শূকরের ন্যায়—স্মরণ ক’রেই আর দ্বিধা

করলেন না, তরস্বী অর্জুন এক পলকপাতের পূর্বেই ক্ষুরাগ্রশাণিত শায়কে ভূরিশ্রবার দক্ষিণ হস্ত ছেদন করলেন।

অর্জুনের দিক থেকে সম্ভবত এ আক্রমণ আশঙ্কা করেন নি ভূরিশ্রবা। কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে থেকে ধিক্কারের সুরে বললেন, ‘তুমি এত বড় বীর হয়ে এই অন্যায় এবং নৃশংস কাজ করলে! আমি তো তোমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত ছিলাম না। এ ক্ষাত্রধর্ম শূরধর্ম তোমাকে কে শিখিয়েছিলেন–দ্রোণ কৃপ—না স্বয়ং ইন্দ্ৰ! ধিক!

চতুর্দিকে আরও অগণিত কণ্ঠে এই ‘ধিক ধিক’ শব্দ উঠেছিল, এমন কি পাণ্ডব-হিতৈষীরাও বিমর্ষচিত্তে বলাবলি করছিলেন, ‘এমন ভাবে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে রত এক বীরকে এভাবে অক্ষম ক’রে দেওয়া উচিত হয় নি। অন্তত পূর্বেই সতর্ক করে দেওয়া কর্তব্য ছিল!’

অর্জুন যেন সেইসব সমালোচকদের শুনিয়েই উচ্চকণ্ঠে ভূরিশ্রবাকে বললেন, ‘গতকাল তোমরা যে যুদ্ধে ছয়-সাতজন মহারথ মিলে একা নিরস্ত্র, বর্ম-চর্ম-রথহীন ক্লান্ত বালক অভিমন্যুকে বধ করেছিলে–সে যুদ্ধ তোমাদের কে শিখিয়েছিল, কোন গুরু, কোন মহারথী? এখনও নিরস্ত্র ভূপাতিত শত্রুকে বধ করতে উদ্যত হয়েছিলে–সে ই বা কোন ক্ষাত্রধর্ম অনুযায়ী আচরণ? তোমাদের অনিন্দ্য ন্যায়-নীতি-ধর্মবোধ এই সময়গুলোয় কোথায় ছিল ভূরিশ্রবা!’

ভূরিশ্রবা মাথা নত করলেন, তারপর নীরবে নিজের কর্তিত দক্ষিণ হস্ত ক্ষমা-প্রার্থনার ভঙ্গীতে অর্জুনের পায়ের দিকে নিক্ষেপ ক’রে বাম হস্তে নিজের তূনীরের শরগুলি বিছিয়ে আসনের মতো তাতেই উপবেশন করলেন এবং অবিরাম রক্তক্ষরণে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর প্রতীক্ষায় ঈশ্বরচিন্তা করতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে ক্রদ্ধ সাত্যকির সচেতনতা ফিরে এসেছে, তিনি উঠে সেই ভূরিশ্রবার পরিত্যক্ত খড়্গা তুলে নিয়ে তাই দিয়েই ধ্যানস্থ ভূরিশ্রবার মস্তক ছিন্ন করলেন।

সাত্যকিও অবশ্য এই নীতিবিগর্হিত কার্যের জন্য অভিমন্যুবধেরই আশ্রয় নিলেন, তথাপি যে অধিকাংশ বীরই তাঁর আচরণে ক্ষুণ্ণ হলেন—এমন কি তাঁর স্বপক্ষীয় ও জ্ঞাতিবান্ধবরাও–সে বিষয়ে সন্দেহ রইল না।

অর্জুন লজ্জিত হয়ে বিমূঢ় ভাবে শ্রীকৃষ্ণের মুখের দিকে চাইলেন—দেখলেন সে প্রশান্ত দিব্যদ্যুতি-উজ্জ্বল মুখে অনুতাপ বা লজ্জার লেশমাত্র চিহ্ন নেই, বরং তাঁকে তৃপ্ত ও প্রসন্নই দেখাচ্ছে।

এসব আচরণ গর্হিত ও নীতিবিরুদ্ধ হতে পারে—তাঁর সম্বন্ধে চিন্তা করলে দুর্বোধ্য তো বটেই—তত্রাচ, ঘটোৎকচ বধের সময় তিনি যা করলেন, যে নির্মমতা, যে প্রায়-পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করলেন—তার কোন তুলনা নেই।

অর্জুনের সঙ্গে কখনও না কখনও দ্বৈরথ সমরে অবতীর্ণ হতে হবে—আর সেইটেই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এখন—সেইজন্য কর্ণ একটি অব্যর্থ সাংঘাতিক অস্ত্র এতদিন লালন করেছিলেন। তাঁর সর্বপ্রকার আত্মচিন্তাহীন দানে— বা দানযজ্ঞে তুষ্ট ও বিস্মিত এক মহাপুরুষ তাঁকে এই অস্ত্র দান করেন। দাতা বলেই দিয়েছিলেন—’এ অস্ত্র অব্যর্থ ও অমোঘ, কোন পার্থিব প্রাণীর সাধ্য নেই এ অস্ত্রাঘাত প্রতিরোধ করতে পারে বা আঘাত সহ্য ক’রে জীবিত থাকতে পারে। তবে এ অস্ত্র যার প্রতি নিক্ষিপ্ত হবে সে যত বড় শূর, শক্তিমান বা শস্ত্রকুশলী হোক—তাকে বধ ক’রেই এ অস্ত্রর শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে, পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না কোনমতেই।’

ইতিমধ্যে বহু সংকহূর্ত সমাগত হওয়া সত্বেও কর্ণ এ অস্ত্র প্রয়োগের লোভ সম্বরণ করেছেন, জীবনের সেই প্রত্যষকাল থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুনকে বধ করবেন বলেই এ অস্ত্র আর কারও উপর প্রয়োগ করেন নি।

জয়দ্রথ বধের পর অপমানিত, ক্রুদ্ধ, প্রতারিত কৌরবগণ সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলেও যুদ্ধ বন্ধ করলেন না, স্নান আহার বা বিশ্রাম না ক’রেই শত্রুক্ষয় ক’রে যেতে লাগলেন। হয়-ও হস্তীপৃষ্ঠে প্রদীপ জ্বালা হ’ল, পদাতিক সৈন্যগণ অসংখ্য মশালে যুদ্ধভূমি আলোকিত করলেন। প্রথম দিকে অর্জুনের বিক্রমে কুরুপক্ষীয়রা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছিল—তা লক্ষ্য ক’রে দুর্যোধন দ্রোণ ও কর্ণকে উত্তেজিত করার জন্য বললেন, ‘আপনারাই এ নৈশযুদ্ধের আয়োজন করলেন, অথচ অসহায় ক্লান্ত ক্ষুধার্ত সেনাগুলিকে রক্ষার কোন ব্যবস্থা করছেন না। বাড়বাগ্নির সম্মুখে শুষ্ক তৃণগুচ্ছের অবস্থা হয়েছে তাদের। এই যদি আপনাদের শক্তির পরিচয় হয়—তাহলে বলুন, যুদ্ধ বন্ধ ক’রে আমি অরণ্যবাসে যাই অথবা প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করি।’

ধিকৃত কর্ণ ও দ্রোণ অতঃপর যেন জীবনপণ ক’রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন, তাঁদের নেতৃত্বে সঞ্চারিত-সাহস অপর যোদ্ধারাও সর্বশক্তি প্রয়োগে পুনশ্চ নূতন উদ্যমে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। এবার পাণ্ডব সৈন্যের ভীত, ছত্রভঙ্গ হবার পালা। অর্জুন তাদের আর্ত ত্রস্ত দৃষ্টি ও পলায়নের কালে অব্যক্ত হতাশাসূচক ধ্বনি শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘বাসুদেব, কর্ণ আমাদের বাহিনী নিঃশেষিত করছেন, তুমি শীঘ্র তাঁর সম্মুখে রথ নিয়ে চল।’

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অনিন্দ্য ললাটের ঘর্মমোচন ক’রে বললেন, ‘না। কর্ণ এই সুযোগই খুঁজছেন, আমি এখন তোমাকে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করতে প্রস্তুত নই। তাঁর কাছে এক সর্বসংহারকারী অস্ত্র আছে, আমি জানি সে অস্ত্র যার প্রতি নিক্ষেপিত হবে তার মৃত্যু অনিবার্য, কোন মরদেহধারী মনুষ্য বা প্রাণীই তার আঘাত সহ্য করতে পারবে না। জীবন- তুচ্ছ-করা এক আশ্চর্য পুণ্যকর্মে কর্ণ এই দিব্যাস্ত্র লাভ করেছেন, আমি চাই এ অস্ত্র পূর্বে আর কারও উপর প্রয়োগ করা হোক। তারপর তুমি তাঁর সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে অবতীর্ণ হয়ো।’

অর্জুন কি একটা বুঝে প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন, বোধ হয় বলতে চাইছিলেন যে এই ভাবে নিশীথ সমরে পাণ্ডবপক্ষ বিপর্যস্ত হচ্ছে, কর্ণ সাক্ষাৎ কালান্তক যমের মতো যেন মৃত্যু বর্ষণ ক’রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন—এমতাবস্থায় তাঁর নিষ্ক্রিয় থাকার অপেক্ষা লজ্জাকর আর কি হতে পারে!

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তার পূর্বেই বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কর্ণ আজ যে ভাবে সর্বশক্তি নিয়োজিত ক’রে যুদ্ধ করছেন তাতে তুমি ও ঘটোৎকচ ছাড়া কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারবে না। আমি ঘটোৎকচকেই আহ্বান করছি।’

বিস্মিত, হয়ত বা ঈষৎ-ক্ষুব্ধ ধনঞ্জয়ের কণ্ঠ ভেদ ক’রে একটি মাত্র শব্দই বহির্গত হ’ল, ‘ঘটোৎকচ!’

‘হ্যাঁ, ঘটোৎকচ।’ কণ্ঠে অতিরিক্ত জোর দেন বাসুদেব, ‘কর্ণর সঙ্গে আজ প্রতিরণে অবতীর্ণ হ’তে পারেন এমন মাত্র দুজনকেই দেখছি! তুমি আর ঘটোৎকচ। সে অশিক্ষিত অনার্য রাক্ষসজাতীয় বলে তাকে অবজ্ঞা করো না। তোমার মতো নানা প্রকার মারণাস্ত্র তার কাছে নেই সত্যকথা, কিন্তু সে মহা বীর। কিশোর ভীমের ঔরসে রাক্ষসকন্যা হিড়িম্বার গর্ভে তার জন্ম–ভূমিষ্ঠ কাল থেকেই সে মহাপরাক্রান্ত। উপরন্তু সে ঐন্দ্রজালিক, নানা প্রকার মায়াযুদ্ধ জানে, জলে ও আকাশে অন্তরীক্ষে তার অবাধ গতি। ভীমবিক্রম এই ভীমতনয় তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তোমাদের অনুরক্ত। তোমাদের বিন্দুমাত্র সেবা করতে পেলে সে নিজেকে কৃতকৃতার্থ বোধ করে। আমি তাকেই আহ্বান করছি।’

আর বাদানুবাদের অপেক্ষা করলেন না বাসুদেব, দ্রুত ঘটোৎকচ সমীপে রথ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘পুত্র ঘটোৎকচ, অঙ্গাধিপতি আজ কৃতান্তমূর্তি ধারণ করেছেন, দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা শল্য প্রভৃতি বিখ্যাত কুরুপক্ষীয় বীরগণও অক্লান্ত ভাবে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করছেন—ফলে পাণ্ডবসৈন্যরা এক্ষণে ভীত, ত্রস্ত ও পলায়নপর। শিশিরকালীন গোবৎসের মতো, উত্তর সমীরে আন্দোলিত তৃণরাশির মতো তারা আতঙ্কে কম্পমান। অর্জুন আজ সারাদিন সুরাসুরেরও বিস্ময়- উৎপাদক যুদ্ধ ক’রে অতিশয় ক্লান্ত, এখন যদি তুমি পাণ্ডবপক্ষকে না রক্ষা করো তাহলে প্রভূত সর্বনাশ হবে আমাদের

ঘটোৎকচ স্বীয় বীর্য ও শিক্ষা প্রদর্শনের এই উত্তম এবং শ্লাঘ্য সুযোগ পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, পিতৃব্য ও বাসুদেবকে প্রণাম ক’রে ত্বরিত গতিতে নিজের রাক্ষসীয় চমূসহ কর্ণ-আক্রমণে উদ্যত ও অগ্রসর হলেন। বলে গেলেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আজ আমি কর্ণকে এ ভূপৃষ্ঠ থেকে অপসারিত ক’রে আপনাদের বিজয়ের পথ নিশ্চিত ও সুগম ক’রে দেব। ‘

অতঃপর দুজনে যে যুদ্ধ বাধল—তেমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ কেউ কখনও দেখে নি। ঘটোৎকচ যে কত বড় বীর, যোদ্ধা ও রণকৌশলী তা পাণ্ডবরাও এতদিন উপলব্ধি করেন নি। তাঁর বাহিনীও সম্মিলিত কৌরব শক্তির অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল । ঘটোৎকচ নিজে তো শুধু কর্ণই নয় কৌরবপক্ষের অপরাপর মহারথদের কাছেও মহাভয়ের কারণ হয়ে উঠলেন।

শেষে, কৌরবপক্ষকে দ্রুতক্ষীয়মাণ ও একান্ত সন্ত্রাসগ্রস্ত হতে দেখে দুর্যোধন আর স্থির থাকতে না পেরে কর্ণকে

গিয়ে বললেন, ‘বন্ধু, বোধ হচ্ছে আজই কৌরবদের অন্তিম দিন সমাগত, ঘটোৎকচের আক্রমণ আর কয়েকদণ্ড অব্যাহত থাকলে আমাদের পক্ষে আর একজনও জীবিত থাকবে না। তুমি তোমার গোপন রক্ষিত ইন্দ্রায়ুধ প্রয়োগ করে অচিরে ঐ রাক্ষসটাকে বধ করো, নতুবা তোমার আমার কারও নিস্তার নেই!’

এ অনুরোধ মস্তিষ্কগোচর হতে কর্ণের কিছু সময় লাগল। তিনি বিস্মিত বিহ্বল ভাবে দুর্যোধনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘সেই অস্ত্র ওই রাক্ষসটার ওপর প্রয়োগ করব! যা আমি এতকাল সহস্র বিপর্যয়েও কোন যোদ্ধার ওপর প্রয়োগ করি নি, অর্জুন নিধনের জন্য সযত্নে লালন করেছি! সে অস্ত্র হস্ত চ্যূত হলে অর্জুনকে তো কোনমতেই বধ করা যাবে না!’

‘অদ্যকার এ সর্বনাশা যুদ্ধে পরিত্রাণ পেলে অর্জুনের কথা চিন্তা করা যাবে। অভিমন্যুর মতো কোন অবসরে একাকী পার্থকে সকল মহারথী মিলে বেষ্টন ক’রে তাকে বধ করব। তুমি এখন এই প্রত্যক্ষ ধ্বংস থেকে আমাদের রক্ষা করো দুর্যোধন দীন অনুনয়ের ভঙ্গীতে কথাগুলি বললেন, তাঁর কণ্ঠে মৃত্যুর আতঙ্ক প্রকাশ পেল।

কর্ণ একবার যেন অসহায় ভাবে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন। সত্যই ঘটোৎকচ যেন সাক্ষাৎ কৃতান্তের মতো রণক্ষেত্রে অবিরাম মৃত্যু বর্ষণ ক’রে যদিচ্ছ বিচরণ করছেন, তাঁকে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা—তাঁর সম্মুখে যাওয়ারও কারও সাধ্য নেই। সমস্ত কৌরব সেনাবাহিনী এমন কি সেনানায়করাও তাঁর এই অমানুষিক পরাক্রমে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সকলেরই এই এক কথা—স্বয়ং মৃত্যু এই মায়াদেহ ধারণ ক’রে রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছেন।

কর্ণর নিজেরও রথ ভগ্ন, সারথি নিহত, অশ্বগণ মুমূর্ষু—এবার হয়ত তাঁরই পালা। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সেই দিব্যাস্ত্র গ্রহণ করলেন। সর্বজীবের অসহনীয়, কৃতান্ত-রসনার মতো লেলিহান, উল্কার মতো প্রদীপ্ত ও প্রজ্বলন্ত সেই অস্ত্রের তেজে ও তাপেই চতুর্দিকের বহু যোদ্ধা বিমূঢ় ও মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, অনেক দুর্বল ব্যক্তি প্রাণ হারাল।

সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্র তাঁর প্রতি সমুদ্যত দেখেই ঘটোৎকচ মায়াবলে বিশাল দেহ ধারণ ক’রে বাধা দিতে গেলেন কিন্তু জ্বলন্ত অস্বাভাবিক-উত্তপ্ত অগ্নির সম্মুখে শুষ্ক পত্রের মতো সে মায়া ভস্মীভূত হয়ে গেল—সে অস্ত্র তাঁকে সংহার করল।

এমন ভয়ঙ্কর শত্রুবধে কৌরবপক্ষে বিপুল উল্লাসধ্বনি উঠবে—এ স্বাভাবিক ঠিক সেই কারণেই পাণ্ডবপক্ষে হাহাকার ওঠার কথা—উঠলও তাই এমন কি স্থিতধী যুধিষ্ঠির, মৃত্যুভয়লেশহীন ভীমসেনও তাঁদের প্রতি একান্ত প্রীতি ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন এই তরুণ বীরের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হলেন। সাধারণ মানবের মতোই বিলাপ ও অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন বহু মৃত্যুর কারণ ও দ্রষ্টা, সদ্যপুত্রবিয়োগবিধুর স্বয়ং অর্জুনও এই পুত্রোপম স্নেহভাজন বীরকে রক্ষা করতে না পারার গ্লানিতে শিরে করাঘাত করতে লাগলেন—কিন্তু, কিমাশ্চর্যমতঃপরম—তিনি সেই দুঃসহ দুঃখের মধ্যেই পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, বাসুদেব অশ্ববল্গা ত্যাগ করে রথের উপর উদ্দণ্ড নৃত্য, বাহ্বাস্ফোট ও মধ্যে মধ্যে জয়োল্লাসসূচক গর্জন করছেন।

অর্জুন তাঁর এই হীনরুচি-প্রকাশক উল্লাসে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘বাসুদেব, আমাদের এতবড় ক্ষতি, এমন পরাজয় ও আত্মীয়বিয়োগ তোমার কাছে আনন্দের কারণ হ’ল!…তুমি কোন পক্ষের বন্ধু—আমি এই ক্ষণে ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছি না!’

বালকের নির্বুদ্ধিতায় যেমন বয়স্ক অভিভাবকরা সপ্রশ্রয় অবহেলা প্রদর্শন করেন, সেইরূপ হাস্যের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ‘নির্বোধ, আমি তোমাদের বন্ধু ও হিতৈষী বলেই এত আনন্দ করছি। এই অব্যর্থ অস্ত্র কর্ণ তোমার জন্য রেখেছিলেন, এ অস্ত্র প্রয়োগ করলে পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ্য ছিল না তোমাকে রক্ষা করে। তবে এ অস্ত্র একামী, একজনকে মাত্র বধ ক’রে নিজেও বিনষ্ট ও ভস্মীভূত হয়। সুতরাং এই অস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ায় তোমার জয়ের পথই নিরঙ্কুশ হ’ল, অতঃপর আর কর্ণবধে কোন বাধা রইল না।

‘শক্তিগর্বী ধনঞ্জয়, স্মরণ রেখো—পৃথিবীতে তোমার সমকক্ষ আরও অনেক বীর ছিল, এবং এখনও আছে। তোমাকে আমিই অপরাজেয় করতে চেয়েছি—এতদিনের পাপজীর্ণ মদোদ্ধত ক্ষাত্রশক্তি বিনষ্ট ক’রে জনসাধারণের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই কারণেই তোমার সমস্ত সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারিত করেছি। জরাসন্ধকে বধ করিয়েছি শিশুপাল ও একলব্যকে নিজে বধ করেছি। এরা জীবিত থাকলে নিশ্চিত আমাদের শত্রুপক্ষে অর্থাৎ কৌরবপক্ষে যোগ দিত, সেক্ষেত্রে তোমার পক্ষেও দুরূহ হয়ে উঠত কৌরবদের পরাজিত করা। এই ঘটোৎকচ নিহত হতে শুধু যে তোমার জয়রথ-চক্রপথ অবারিত হ’ল তাই নয়—সম্ভাব্য মহাশত্রুও অপসারিত হ’ল। ঘটোৎকচ মহাশক্তিমান কিন্তু তামসিক বুদ্ধিসম্পন্ন, তামসিক পরিবেশে বাস করত। ভবিষ্যতে সে যে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রবল শত্রু হয়ে উঠত না তাই বা কে বললে!

‘এবং শোন অর্জুন, এই অবসরে আরও একটি গূঢ় তথ্য তোমাকে অবগত করাই। অভিমন্যুর এই অসহায় মৃত্যুও আমার অননুমিত ছিল না। পরন্তু অবিদিত ছিল না বললেই ঠিক বলা হয়—কারণ আমার অনুমান এ পর্যন্ত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় নি। তথাপি আমি তোমাকে সতর্ক করি নি বা অভিমন্যুকে রক্ষা করার চেষ্টা করি নি, তার কারণ— অভিমন্যুতে তোমার শৌর্য ও বীর্যের পূর্ণ লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল, শিক্ষা ও নিয়মিত অভ্যাস কালে সে তোমার অপেক্ষাও দুর্ধর্ষ শূরে পরিণত হত। তার মাতুল বংশের প্রতি তার মমতাও স্বাভাবিক, সে জীবিত থাকতে যাদবকুল ধ্বংস করা সম্ভব হত না। অথচ এই ভারতখণ্ডে যে সকল বংশ বা কুল অনর্জিত সম্পদ ভোগের কারণে অলস, লক্ষ্যহীন, উন্নতিচিন্তাহীন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়েছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণামে জীবনযাত্রার ধারণায়, আচরণে, কামনা- বাসনায়—যে ক্লেদ গ্লানি কলুষ, কুৎসিত বদভ্যাসসকল, হেয় সম্ভোগমত্ততায় যে বিপুল অনাচার, সীমাহীন পাপ ও অকারণ দম্ভ, অন্ধ অসূয়া ইত্যাদি পুঞ্জীভূত হয়েছে—আমার পিতৃকুল—বৃষ্ণি অন্ধক যাদব, আমার আত্মীয় ও জ্ঞাতিরাও তার সমান অংশভাগী। প্রকৃত ধর্মরাজ্যস্থাপন করতে হলে তাদের সম্পূর্ণ বিনষ্টি প্রয়োজন। এবং সে নাশকার্যে আমি কৃতসঙ্কল্প।’

১৪

শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য কৌরববাহিনীর পরিচালনাভার গ্রহণ করার পর যে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অভূতপূর্ব পরাক্রম প্রকাশ করেছিলেন—কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মহান ইতিহাসেও তার দৃষ্টান্ত বিরল। এমন কি, দুর্যোধনের মনে হতে লাগল, এরূপ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, এরূপ অপরিমেয় শত্রুনাশ মহাত্মা ভীষ্মের সৈনাপত্যকালেও সম্ভব হয় নি। দ্রোণ যে ঐকান্তিকতার সঙ্গে কৌরবগণের শ্রেয় এবং পাণ্ডবদের ক্ষতি সংঘটন ক’রে চলেছিলেন সে বিষয়ে উভয় পক্ষে কারও সংশয়মাত্র ছিল না। যুদ্ধের অবহার ঘোষণা তো প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল—দিবারাত্রি সমান হয়ে পড়েছিল সেই যুযুধান সেনাদের কাছে। আর সর্বাপেক্ষা শক্তি ও শৌর্য প্রদর্শন করেছিলেন পঞ্চাশীতি-বর্ষীয় বৃদ্ধ দ্রোণাচার্যই—পাণ্ডবপক্ষীয় সাধারণ যোদ্ধাগণের কাছে তিনি কালান্তক কৃতান্তের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

অধিকন্তু সে যুদ্ধ, সে শত্রুক্ষয়ের ভয়াবহ অবস্থা প্রায় তুঙ্গে উঠেছিল পঞ্চম দিনেই। সকলকার মনে এই সংশয়ই দেখা দিচ্ছিল যে পাণ্ডবপক্ষের বুঝি এ যাত্রা আর রক্ষা নেই, স্বয়ং ধর্মও শস্ত্রগুরু দ্রোণের কবল থেকে তাঁদের রক্ষা করতে পারবেন না।

কিন্তু বিজয়লক্ষ্মী যখন প্রায় কৌরবদের বরণ করতে চলেছেন, সিদ্ধি যখন তাঁদের করায়ত্ত বলে কল্পনা করতে আরম্ভ করেছেন দুর্যোধন, ঠিক সেই মুহূর্তেই কি যে হ’ল–দ্রোণাচার্য অকস্মাৎ ধনুঃশর ত্যাগ ক’রে বিহ্বল শূন্য দৃষ্টিতে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন মনে হ’ল তাঁর বাহ্য বা ঐহিকজ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে চারিদিকের এই নারকীয় পরিবেশ—মৃত্যুদূতের নিঃশব্দ খলখল হাসি, যমভগিনীর প্রসারিত লোলুপ রসনা, অস্ত্র-ঝনৎকারের মারণসঙ্কেত—গলিত শবের পূতিগন্ধ, আহতের মুমূর্ষুর আর্তনাদ–এর কোন কিছুই আর তাঁর অনুভূতিগোচর নয়, এই সমস্ত পরিবেশ, কুরুক্ষেত্র রণভূমি, আত্মীয়কলহ ও জ্ঞাতিনাশ—এর সমস্ত ইতিহাস সম্বন্ধেই তিনি সম্পূর্ণ অনবহিত, উদাসীন, হয়ত বা অচেতন।

এর কারণ কি ঐ চিরসত্যবাদী সত্যতপস্বী যুধিষ্ঠির-উচ্চারিত মিথ্যা শব্দ কয়টি?—পাণ্ডবদের সর্বনাশ প্রত্যক্ষ ও অনিবার্য দেখে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যে মিথ্যা বলতে তাঁকে অনুরুদ্ধ ও প্ররোচিত করেছিলেন? অশ্বত্থামা নামক একটি হস্তীর মৃত্যুতে যেন দৈবের স্পষ্ট নির্দেশ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বাসুদেব, যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে আকুলভাবে মৃত্যুপথযাত্রী সমগ্ৰ পাণ্ডববাহিনীর পক্ষ থেকে অনুনয় ক’রে বলেছিলেন, দ্রোণাচার্য-সম্মুখে শুধু এই দুটি শব্দ উচ্চরণ করতে—’অশ্বত্থামা হত!’ যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন এ অকল্পনীয়, দ্রোণাচার্য তাই হয়ত এই অবিশ্বাস্য বাক্যও বিশ্বাস ক’রে পুত্রশোকে কাতর হয়ে পড়বেন। এমন কি অকারণ বুঝে অস্ত্রত্যাগও করতে পারেন। সেই একমাত্র অবসর, কৌরব সেনাপতির আক্রমণের প্রচণ্ডতা থেকে এতটুকু বিরতি লাভ ক’রে নিজ শক্তি সংহত করা, আত্মবিশ্বাসে ফিরে আসা।

যুধিষ্ঠিরও চূড়ান্ত সর্বনাশের সম্মুখে এ অনুরোধ অবহেলা করতে পারেন নি। বিবেককে বুঝিয়েছিলেন—অশ্বত্থামা নামক এক জীব তো হত হয়েছেই—সুতরাং পূর্ণ মিথ্যা বলা হবে না। তবু শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ বিবেকের দংশন বাঁচতে অস্ফুটকণ্ঠে আরও দুটি শব্দ ঐ বার্তার সঙ্গে যোগ করেছিলেন—’ইতি গজ’! কিন্তু তিনি বেশ জানতেন যে সে সামান্য শব্দ দ্রোণের কর্ণগোচর হবে না, যাতে না হয় তিনি সেই ভাবেই বলেছেন। সুতরাং মিথ্যা মিথ্যাই—আত্মপ্রতারণায় তাকে সত্য, এমন কি অর্ধ-সত্যও করা যায় না। নিজের কাছেই অপমানিত হলেন যুধিষ্ঠির—এতদিন পরে এই সত্য তাঁর কাছে পূর্ণালোকে উদ্ভাসিত ও প্রতিষ্ঠিত হ’ল—মানবদেহ ধারণ করলে মিথ্যাচার ও মিথ্যাকথন অনিবার্য, সে দুর্দশা থেকে কারও মুক্তি নেই।

কিন্তু উনি যে ভাবেই বলুন, সত্যই কি দ্রোণ তা বিশ্বাস করেছিলেন?

লোকে বলে—তখনও সকলের বিশ্বাস হয়েছিল যে–বিশ্বাস ক’রেই একমাত্র- পুত্র-শোকাতুর বৃদ্ধ যুদ্ধ ও জীবনে বীতস্পৃহ হয়েছিলেন। জয় পরাজয় শৌর্য বীর্য গৌরব লজ্জা সব কিছুই অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল—অস্ত্রত্যাগ ক’রে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

কিন্তু তা কেমন ক’রে হবে? দ্রোণাচার্য জানতেন তিনি জীবিত থাকতে অশ্বত্থামার মৃত্যু সম্ভব নয়। নিজে গণনা করেছেন, বহু জ্যোতিষী এ কথা বলেছে। ক্রোধে বিলাসী ও বিবেকহীন তাঁর এই সন্তান দীর্ঘকাল জীবিত থেকে স্বীয় স্বভাবের মূল্য শোধ করবে এ তো তিনি জানতেনই।

তবে?

তাঁর এ-অদ্ভুত আচরণের হেতু কি?

এই হেতুটাই কোনমতে কারও বুদ্ধি বা কল্পনাগোচর হয় নি, সেদিনও না, তার পরেও বহুদিন না।

সুদ্ধমাত্র বুঝি সত্যব্ৰতী যুধিষ্ঠিরের চিরকলঙ্ক-চিহ্ন হিসাবেই ঐ গজমৃত্যু-সংবাদের দ্ব্যর্থবাহক শব্দ দুটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন মহাভারতকার, তিনিও একবার চিন্তা করেন নি, অশ্বত্থামার মৃত্যুও যেমন সম্ভব নয়—তেমনি সে কথা বিশ্বাস করাও দ্রোণের পক্ষে অসম্ভব।

আসলে এই মুহূর্তে মন তাঁর বহু দূরে চলে গিয়েছিল, আজ থেকে বহুকাল অতীতে। সে অতীত যেন আজ এই মুহূর্তে পুরাতন, বিস্মৃতপ্রায় অপকীর্তির—পাপই বলা উচিত—মূর্তি পরিগ্রহ ক’রে অকস্মাৎ তাঁর দৃষ্টির সম্মুখে বর্তমান কাল ও পরিবেশের মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি ক’রে দেখা দিল।

ভদ্র শিক্ষিত লোকের জ্ঞানকৃত অপরাধের স্মৃতি ও অন্যায়বোধ চিরস্থায়ী দুষ্ট ব্রণের মতো লেগে থাকে তার মনে। এই ধরনের গোপন ক্ষত মানুষ সাবধানে সন্তর্পণে আচ্ছাদিত রাখে বস্ত্রাবৃত শবের মতো—কিন্তু তার যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পায় না। বরং তা আরও পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে—কাউকে জানিয়ে দেখিয়ে একটু সান্ত্বনা কি সহানুভূতি লাভ করতে পারে না বলে।

স্থবির মহাগুরু দ্রোণাচার্যেরও সেই অবস্থা হয়েছে। একটা গোপন প্রবল অপরাধ-বোধ এই দীর্ঘকাল ধরে কর্কট রোগের ক্ষতের মতোই নিরন্তর পীড়া দিচ্ছে তাঁকে। না পারছেন কোন প্রায়শ্চিত্ত ক’রে তা থেকে অব্যাহতি পেতে, আর না পারছেন কাউকে সেই লজ্জাকর অপরাধের কথা—সেই সঙ্গে নিজের নিরুপায়তার কথা—জানিয়ে কিছু সান্ত্বনা বা পরামর্শ লাভ করতে।

কাউকে জানাতে পারছেন না—কারণ জানাবার মতো নয়।

কেউ কেউ জানে ঠিকই, কিন্তু কালক্রমে অসংখ্য ঘটনার ধূলিঝঞ্ঝায় সে স্মৃতি চাপা পড়ে গেছে—আজ আবার নূতন ক’রে তা স্মরণ করিয়ে দিলে চারিদিক থেকেই হয়ত একটা প্রবল ধিক্কার ও নিন্দার তরঙ্গ উঠবে। সে সময় ওঠে নি দীর্ঘকাল পূর্বের মানুষের বিবেক অন্যভাবে প্রভাবিত হত বলেই নয়—সে সময় এখনকার অনেকেই বালক ছিল, ঘটনার পূর্ণ অর্থ তাদের কাছে প্রতিভাত হয় নি, অথবা আচরণটাকে এত দোষণীয় বা নিন্দনীয় বলে বুঝতে পারে নি। কিন্তু আজ এই পরিণত বিচারবুদ্ধির বয়সে সে কথা স্মৃতিপথে উদিত হলে সকলেই তাঁর নিন্দায় মুখর হয়ে উঠবে, সঘৃণ দৃষ্টিতে তাকাবে তাঁর দিকে। এমন কি যার জন্য এ কাজ তিনি করেছিলেন–হয়ত সে পর্যন্ত ও

অবশ্য, তার জন্যেই কি ঠিক তিনি করেছিলেন?

যতবার কথাটা তিনি মনকে বোঝাতে গেছেন—ততবারই তাঁর বিবেক তাঁকে বিদ্রুপ করেছে, ব্যঙ্গশাণিত হয়ে উঠেছে তার রসনা।

হয়ত আজ কাউকে অকপটে খুলে বলতে পারলে, মানুষের নিন্দা মাথা পেতে নিলে কিছুটা শান্তি পেতেন, প্রায়শ্চিত্ত হ’ল বলে মনে করতেন। হায় রে, এই বয়সেও মানসিক দুর্বলতা, মিথ্যা প্রতিষ্ঠার মোহ ত্যাগ করতে পারেন নি, সেই মোহই তাঁর মুক্তির পথ রুদ্ধ করেছে। ধীরে ধীরে, দীর্ঘকাল-ক্রমে এই যে অগণিত মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধার একটি আসন গড়ে উঠেছে—শুধু কৌরবরা বা পাণ্ডুপুত্ররা নয়, দেশ-বিদেশের নৃপতি ও ক্ষত্রবীররা তাকে সম্ভ্রম-বিস্ময়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন—সেই আসন, সে শ্রদ্ধা হারাতে সাহস হয় নি তাঁর, তাই পারেন নি নিজের বিচার করতে, সযত্নে রচিত মিথ্যা খ্যাতির সিংহাসন থেকে নেমে এসে অপরাধীর নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াতে।

অপরাধ অনেক।

অবিচার বললেও ভুল বলা হবে, অন্যায়ই করেছেন তিনি।

সশ্রেণীর কোন লোককে—সম্ভ্রান্ত উচ্চকুলোদ্ভব কারও সঙ্গে এ আচরণ করলেও এতটা দোষাহ হত না হয়ত। অশিক্ষিত পদানত নীচকুলোদ্ভবের সঙ্গে এই প্রবঞ্চনা করা আরও অন্যায় হয়েছে—বিশেষত যে তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে, সেই শিষ্যোপম তরুণ কিশোরকে এমনভাবে প্রতারিত ক’রে তার সর্বনাশ সাধন করা যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাম্য, একান্ত আকাঙ্ক্ষিত, তার সাধনার সবচেয়ে বড় সিদ্ধি, তা থেকে তাকে চিরকালের মতো বঞ্চিত করা, জীবনের সকল সফল সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করা।

অথচ সে বেচারী কোন অপরাধই তো করে নি। না তাঁর কাছে, না অপর কারও কাছে। একমাত্র অপরাধ তার, নীচ কুলে জন্মেও যোদ্ধা হবার উচ্চাশা করেছিল।

তবু, সেও রাজপুত্র। নীচ বংশে জন্ম হলেও একলব্যর পিতা হিরণ্যধনু রাজাই ছিলেন—নিষাদ বা ব্যাধদের রাজা। কিন্তু শুধু নীচ-কুলোদ্ভব বলেই কি তাকে এমন নির্দয় শাস্তি দিয়েছিলেন সেদিন, তার উচ্চাভিলাষকে এমনভাবে নির্মূল, সিদ্ধির অণুমাত্রসম্ভাবনা-শূন্য করেছিলেন?

তাহলে তো তবু একটা সান্ত্বনা দিতে পারতেন নিজেকে—নিজের বিবেককে। তিনি উচ্চবর্ণের লোক, ব্রাহ্মণ—তিনি তাঁর ধারণা এবং সংস্কারমতোই কাজ করেছেন—এইটুকু সমর্থন করতে পারতেন নিজের কুকর্মের।

না, তিনি এ কাজ করেছিলেন সেদিন—জ্ঞানতই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দুরন্ত অভিমান–গোপন প্রতিহিংসাস্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য।

একলব্য যেদিন স্নানান্তে বল্কল পরিহিত হয়ে পুষ্প দূর্বা মধু দুগ্ধ ও মৃগ-মাংস প্রভৃতি অর্ঘ্য নিয়ে করজোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর শিষ্যত্ব প্রার্থনা করেছিলেন, সেদিন তাকে তিনি নীচকুলোদ্ভব, নীচ বৃত্তি বা জীবিকার মানুষ—এই যুক্তি দেখিয়েই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন—যদিচ ন্যায়ত সে অধিকারও তাঁর ছিল না। তিনি বর্ণগুরু, তিনি শিক্ষক— তাঁর কাছে সকলেই সমান, বিশেষ কিশোর একলব্য ব্রহ্মচারী নিষ্পাপ–তা তার মুখের দিকে চেয়েই বুঝেছিলেন।

তবু তাতে অত দোষ হয় নি। লোকাচারের অছিলা একটা ছিল। কিন্তু তারপর যেটা করলেন সেটাই অমার্জনীয় অপরাধ। চিরদিন, যাবচ্চন্দ্রাকমেদিনী—এই অপযশ ঘোষিত হবে, ঐ লোকটার, ঐ চণ্ডালটার সুকৃতি আর তাঁর কুকীর্তি। যতদিন একটি লোকও অবশিষ্ট থাকবে মনুষ্য সমাজের চিহ্নরূপে, ততদিনই এই অপকীর্তি, এই জঘন্য স্বার্থবুদ্ধির কাহিনী প্রচারিত হবে। অথচ একলব্যের মতো ভক্ত তো তাঁর কেউ ছিল না সেদিন। সেদিন কেন—আজই বা কে আছে? এই দীর্ঘকালের মধ্যে এমন কোনও শিষ্য কি তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করেছে? একজনও না। এই তো–যে পাণ্ডবদের জন্য, যে অর্জুনের জন্য তিনি এই কদর্যতম অন্যায়াচরণ করলেন, সুদ্ধমাত্র তাকে খুশী করার জন্য—সেই পাণ্ডবরা, সেই অর্জুনই তো তাঁকে বধ করার জন্য আজ বদ্ধপরিকর।

.

সেদিনের কথাটা আজও স্পষ্ট মনে আছে। চিরদিনই থাকবে। মনের পটে অগ্নি-অক্ষরে লেখা আছে সে ছবি।

কুমারদের নিয়ে গভীর অরণ্যে শিকারে গিয়েছিলেন—শিকার-পারদর্শিতা রাজকুমারদের শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ— স্বভাবতই শিকারী সারমেয় ছিল সঙ্গে। কর্দমলিপ্ত চীরবাস-পরিহিত, তপঃকৃশ-তনু জটাধারী কৃষ্ণকায় একলব্যকে দেখে একটি কুকুর তার স্বধর্মানুযায়ী উত্তেজিত হয়ে উচ্চরব করতে করতে তার দিকে ধেয়ে গিয়েছিল তপস্যায় বাধাপ্রাপ্ত বিরক্ত একলব্য আশ্চর্য ক্ষমতার সঙ্গে ধ্বনি-ব্যাদিত মুখ-গহ্বরে পর পর সাতটি তীর বিঁধে তাকে নীরব ক’রে দিয়েছিল ভীত সারমেয়টি অস্ফুট একটা আর্তনাদ করতে করতে সেইভাবে কুমারদের কাছে ফিরে এলে এই আশ্চর্য

শরনিক্ষেপ-দক্ষতা সকলেরই দৃষ্টিগোচর হ’ল। বিস্ময়ের সীমা রইল না কারও–বিস্ময়, আর তার সঙ্গে একটা মুগ্ধ সম্ভ্রমবোধ। তার মধ্যেই অভিমানে স্ফুরিতাধর হয়ে কিশোর অর্জুন বললেন, ‘আচার্যদেব, আপনি আমাকে আশ্বাস—শুধু আশ্বাস কেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সমগ্র সসাগরা ধরণীতেই আমাপেক্ষা দক্ষ কোন ধনুর্ধর থাকবে না, আমিই হব শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ সরল বিশ্বাসে আপনার উপর নির্ভর ক’রে আত্মতৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু আজ সকলের সামনে, বিশেষ এইসব বিদেশী কুমারদের কাছে—সে তৃপ্তি বিনষ্ট, সে গর্ব চূর্ণ হ’ল–অপরিসীম লজ্জা পেলাম।’

বিস্মিত দ্রোণও বড় কম হন নি। এ কৃতিত্ব বোধ করি তাঁরও কল্পনাতীত। তাই তিনি এদের বলার অপেক্ষা রাখেন নি। তৎক্ষণাৎ আহত সারমেয়টির পিছু পিছু সেই গভীরতর অরণ্যদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়েছিল তাতে আনন্দে গর্বে বুক ভরে ওঠারই কথা। ।

প্রত্যাখ্যাত নিষাদ-রাজতনয় একলব্য সেই জনমানবহীন অরণ্যে গুরুরূপে তাঁরই মৃন্ময় মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ক’রে একাগ্রমনে, তপস্যার মতো ক’রে শস্ত্রাভ্যাস করছে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের সাধারণ নিয়মে যে তৃপ্তি ও আনন্দ বোধ করার কথা—তিনি তা করতে পারেন নি, করার উপায়ও ছিল না বুঝি। কারণ তাঁর মনে প্রতিশোধ-সঙ্কল্পই সর্বাগ্রগণ্য। তিনি তৎক্ষণাৎ হিসাব করতে বসেছিলেন যে, একলব্য যত বড় সুকৌশলী যোদ্ধাই হোক, একক তার দ্বারা তাঁর কার্যসিদ্ধি হবে না। অন্যদিকে অর্জুন তথা কৌরবরা সহায় থাকলে অনায়াসে তা হতে পারবে। এতগুলি রাজকুমার আর কৌরবদের বিপুল সৈন্যবাহিনী—এদের সামনে দ্রুপদ দাঁড়াতেও পারবেন না, যুদ্ধ তো দূরের কথা। অথচ দ্রুপদকে পদানত অপমানিত করার জন্যই তাঁর এই সাধনা, এই ক্ষত্রিয়দের কাছে দাসত্ব স্বীকার।

দ্রুপদ তাঁর বাল্যবন্ধু, এই দাবিতেই একদা কপর্দকশূন্য, অভাবে ও অনশনতাড়িত দ্রোণ তাঁর সভায় গিয়েছিলেন, সামান্য কিছু বৃত্তির আশায়—যাতে অবশিষ্ট জীবন অন্নান্বেষণে বিব্রত না থেকে ব্রাহ্মণোচিত কার্যে অতিবাহিত করতে পারেন।

কিন্তু রাজা দ্রুপদ, সিংহাসনোপবিষ্ট ধনী দ্রুপদ বন্ধুকে স্মরণ করতে পারেন নি, সামান্য ভিক্ষুকের মতোই আচরণ করেছিলেন দ্রোণের সঙ্গে।

সেই জ্বালাই বিস্মৃত হতে না পেরে দ্রোণের শস্ত্রতপস্যা আরম্ভ। তারই পূর্ণ সিদ্ধি কুরুবংশের শস্ত্র-শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠা

তিনি কুমারদের কাছে শিক্ষা-সমাপ্তির দক্ষিণা পূর্বেই জানিয়ে রেখেছিলেন, দ্রুপদের পরাজয়, অবমাননা। আজ কি সে সমস্ত হিসাব ও পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে? না, তা কল্পনা করাও তাঁর সাধ্যাতীত, তাই নিতান্ত নীচ স্বার্থপরের মতো, চণ্ডালাধিক চণ্ডালের মতো ঐ বীর উদার মহান চণ্ডালপুত্রের কাছে গুরুদক্ষিণা দাবি করেছিলেন—তার দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি—এবং সেও অম্লানবদনে তা দিয়েছিল।

স্বার্থে অন্ধ হয়ে হিসাবটা করেছিলেন বলেই সেদিন কতকগুলো কঠিন রূঢ় সত্য তাঁর মনে পড়ে নি। একলব্যর কাছে গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করা মানেই তার শিষ্যত্ব স্বীকার ক’রে নেওয়া। তাহলে ইতিপূর্বে তার জন্ম, বংশ ও বৃত্তির দোহাই দিয়ে তাকে যে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেটা আজ মিথ্যাচরণ বলে প্রমাণিত হয়। আরও একটা কথা মনে পড়া উচিত ছিল সেদিন—একলব্য যা-ই বলুক আর যা-ই করুক, তিনি যখন জানতেন যে কোনদিন কোন কালে এক নিমেষের জন্যও অণুমাত্র শিক্ষাও তাকে দেন নি, তখন তার কাছে গুরুদক্ষিণা চাওয়া মানেই অন্যায় প্রতিগ্রহ করা, প্রত্যবায়ভাগী হওয়া। এও এক রকমের প্রতারণা, পরস্বাপহরণ।

কিন্তু সেদিন নিজের স্বার্থবুদ্ধিতে ও প্রতিহিংসাস্পৃহায় অন্ধ ও বধির হয়েছিলেন। বিবেকের অনুশাসন শোনার মতো, জাজ্বল্যমান সত্য প্রত্যক্ষ করার মতো অবস্থা ছিল না।

চির-অবনত চিরপদদলিত নিষাদরা কিন্তু এই অবিচার বা অত্যাচার নির্বিচারে স্বীকার করে নিতে পারে নি। একলব্য তাদের আশা-ভরসা, একলব্য তাদের জাতির প্রত্যক্ষ মুক্তিদূত। ওকে কেন্দ্র ক’রে তাদের অনেক কল্পনা, অনেক উচ্চাশার স্বপ্ন। এইভাবে সে আশা-আকাঙ্ক্ষায় বঞ্চিত, প্রতারিত হয়ে তারা বিষম উত্তেজিত হয়ে উঠল, প্রবল আলোড়ন উঠল নিষাদসমাজে।

কেউ বললে, ‘আর আমরা ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখব না। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে আজ থেকে আমাদের সম্পূর্ণ অসহযোগ।’ কেউ বা বললে, ‘এবার থেকে যেন ওদের পাদুকার চর্ম আর ভোজ্যের মাংস নিজেরাই সংগ্ৰহ ক’রে নেয়—সেই সঙ্গে অসিযুদ্ধের চর্মও। ওদের সঙ্গে ব্যবসায়ে আমাদের প্রয়োজন নেই। বনের ফল আর বন্য পশুর মাংস খেয়ে আমরা সুখেই থাকব। ওরা আমাদের সাহায্য না নিয়ে কেমন ক’রে বাঁচে তাই দেখব।’

সেদিন একলব্যই ওদের শান্ত ও নিরস্ত করেছিল। জনে জনে মিনতি করে বলেছিল, ‘তিনি যে আমার শিষ্যত্ব স্বীকার ক’রে নিয়েছেন সে ই আমার সৌভাগ্য। কৃতার্থ হয়েছি আমি। আমাদের—চণ্ডালদের এর চেয়ে জয়লাভ আর কি হতে পারে? কুরুবংশের শস্ত্রশিক্ষক, ব্রাহ্মণ, গুরু ভার্গবের অস্ত্রজ্ঞানের উত্তরাধিকারী—তিনি আমার কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করেছেন, এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর তো আমি কিছু ভাবতেই পারি না। আমি তৃপ্ত ও প্রসন্ন মনেই দক্ষিণা দিয়েছি, কোন ক্ষোভ কি অতৃপ্তি নেই সেজন্য। এই উপলক্ষ ক’রে যদি কোন বিরোধ বাধে, তাহলেই আমি বরং দুঃখ পাব।… আরও চিন্তা করো—তারা প্রবল, সব দিক দিয়েই আমাদের থেকে শক্তিশালী, তারা যদি আমাদের আচরণকে স্পর্ধা মনে ক’রে তার প্রত্যুত্তর দিতে আসে—এক নিমেষেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। ক্ষতি তো হবেই— অপমানেরও সীমা থাকবে না। তোমরা এই দুর্বুদ্ধি ছাড়, গুরুর যদি কৃপা থাকে—আমি বাম হস্তেই শর নিক্ষেপ ক’রে যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারব।’

চর মুখে উত্তেজনা প্রশমনের এই সংবাদ লাভ ক’রে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন দ্রোণ, এ নিয়ে আর অধিক চিন্তা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি।

.

সহসা এক রূঢ় আঘাতে যেন তাঁর সুখনিদ্রা ভেঙে গেল।

কপট-দ্যূতসভাতেই প্রথম সচেতন হয়ে উঠলেন তিনি।

বহুদর্শী, জীবনে বহু-আঘাত-সহ্যকরা দ্রোণাচার্য সেই একদিকে ক্রুদ্ধ, অপরদিকে ব্যঙ্গ-চপল কোলাহলের মধ্যেই শুনতে পেলেন মৃত্যুর ভয়ঙ্কর পদধ্বনি—স্পষ্ট দেখতে পেলেন ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের অবিমৃষ্যকারিতার, নির্বুদ্ধিতার ফল।

ওরা নিশ্চিত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। সেইসঙ্গে ওঁরও সেই পরিণাম অবশ্যম্ভাবী। পাণ্ডবদের সেই প্রথম জীবনের অজ্ঞাতবাসকালেই ওঁরা ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন গ্রহণ করেছেন—জানিয়েছেন আনুগত্য। তারপর, পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে বিবাহ ক’রে ফিরে এলে রাজ্য ভাগ হয়েছে, পাণ্ডুপুত্রদের জন্য নূতন রাজধানী স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ সেই পুরাতন হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রদেরই বেতনভুক থেকে গেছেন। সুতরাং যুদ্ধ বাধলে এই পাপপক্ষেই যুদ্ধ করতে হবে তাঁকে, অর্থাৎ পাণ্ডবদের বিপক্ষে। আর সেক্ষেত্রে—

সেক্ষেত্রে কি হবে তা দ্রোণ জানেন। মৃত্যু অনিবার্য। এই মূঢ় দাম্ভিক দুর্যোধনের সাধ্য নেই শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের পরাজিত করে।

চঞ্চল হয়ে উঠলেন দ্রোণ। শুধু অনুতাপ আত্মগ্লানিতেই নয়, আতঙ্কেও অস্থির হয়ে পড়লেন। আতঙ্ক নিজের জন্যও তত নয়—যত অশ্বত্থামার জন্য। অবশেষে আর স্থির থাকতে না পেরে খুঁজে খুঁজে একদা নিষাদরাজ একলব্যের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

বিস্মিত একলব্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে সসম্ভ্রমে তাঁর অভ্যর্থনা করল। আদর-আপ্যায়নের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করল না—গুরুকে ইষ্টদেবতার পূজার মতো ক’রেই আবাহন জানাল। নূতন অজিনাসনে বসিয়ে নদীর জলে পাদপ্রক্ষালন করে পুষ্পচন্দন দূর্বা সুগন্ধি- তৈল মধু প্রভৃতি অর্ঘ্য দান করল, ধূপ-দীপে আরতি ক’রে ফল, দুধ ও মধু নিবেদন করল ভোজ্য হিসাবে। ব্রাহ্মণ ও আর্য–এর বেশি কিছু গ্রহণ করতে পারবেন না এখানে, তা একলব্য জানে। তারপর নতজানু হয়ে বসে দুই হাত জোড় করল, ‘আদেশ করুন, আপনার কি প্রয়সাধন করতে পারি।’

আজ আর বৃথা কোন বাগাড়ম্বর করলেন না দ্রোণাচার্য। তাঁর যা অনুমান আর আশঙ্কা—খুলে বললেন সব। ধৃতরাষ্ট্র- তনয়দের পরিণাম তিনি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন, সেইসঙ্গে নিজেরও।

একলব্য সব শুনে কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থেকে একটু ম্লান হেসে বললে, ‘প্রভু, যদি সত্য বলে মনে আঘাত দিই, সে আঘাত আমাকেও সমানভাবে আহত করবে—এই ভেবে ক্ষমা করবেন। আমার দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠ যদি আপনি দয়া ক’রে গ্রহণ না করতেন, কি আমাকে শিষ্যত্ব গ্রহণে বিমুখ না করতেন—তাহলে আমার আজ আপনার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব হত, আর আপনার কৃপায় স্বয়ং দেবেন্দ্ররও সাধ্য হত না আপনার কোন অনিষ্ট করে। কিন্তু আজ পাণ্ডবদের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে এমন একজনকেও তো দেখছি না।’

দ্রোণ অবনত মস্তকে বললেন, ‘তবু শুনেছি তুমি অঙ্গুলিত্রের সাহায্যে অজেয় ধনুর্ধর হয়ে উঠেছ—।

‘একটু ভুল শুনেছেন বোধ হয়। অপরের কাছে অজেয় হলেও গাণ্ডীবী অর্জুনের কাছে নয়। অঙ্গুলিত্রে আর অঙ্গুলিতে একটু প্রভেদ থাকবে বৈকি। আপনি শস্ত্রশাস্ত্রপারঙ্গম—এ বিষয়ে আপনার হিসাবে কিছু ভুল হয় নি। অর্জুনই আজ সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর ‘

মাথা আরও হেঁট হয়ে এল দ্রোণাচার্যের। অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইলেন তিনি। তারপর ঈষৎ লজ্জা…লিত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে একলব্য?’

একলব্য দু হাত নিজের কান ঢাকলেন। বললেন, ‘সামান্য মিথ্যাচরণকে এত বড় ক’রে দেখছেন কেন? বস্তুত আমার কাছে আপনার কোন অপরাধই থাকতে পারে না দেবতা। সুতরাং যখন অপরাধই হয় নি—তখন ক্ষমার প্রশ্নই বা উঠবে কেন?’

দ্রোণ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠে ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে প্রশ্ন করলেন, ‘মিথ্যাচরণ? আমি মিথ্যাচরণ করেছি! সে কি! সেইটেই তো মিথ্যা কথা।’

একলব্য একটু হাসলেন। তারপর সবিনয়েই বললেন, ‘ক্ষমা করবেন দেব, আপনি যদি একটু ভেবে দেখেন কথাটা —তাহলে অত বিস্ময়বোধ করবেন না। আপনি যেদিন অর্জুন প্রমুখ রাজকুমারদের নিয়ে আমার সন্ধানে আসেন, সেদিন আমার কাছে কী চাইবেন তা পূর্বেই স্থির করে নিয়েছিলেন জানতেন যে তাতে আমার সর্বনাশ হবে, আমার যা একান্ত কাম্য তা থেকে চিরদিনের জন্য আমাকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছেন, আমার সমস্ত জীবন ব্যর্থ ক’রে দিচ্ছেন—কিন্তু সে কথার আভাস-মাত্র না দিয়ে শুধুই গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন। অতি সাধারণ ভাবে—যাতে আমি কোন সন্দেহ না করি, প্রতিশ্রুতি দিতে দ্বিধা না করি। এইটেই কি মিথ্যাচরণ হ’ল না?’

দ্রোণের কণ্ঠতালু শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। তিনি যেন আর কোনমতেই চোখ তুলে একলব্যের দিকে চাইতে পারছিলেন না। তবু, ঈষৎ জড়িতকণ্ঠে আড়ষ্ট রসনাকে কোনমতে সক্রিয় ক’রে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি—তুমি জানতে আমি কি চাইব?’

‘সঙ্গে অভিমান-ম্লানমুখ অর্জুনকে দেখেই অনুমান করতে পেরেছিলাম।’

‘তবু—তবু দ্বিধা করো নি, সতর্ক হও নি—আগে জানতে চাওনি আমি কি চাইব?’

‘আপনাকে যেদিন থেকে গুরুত্বে বরণ করেছি, সেদিন থেকেই তো আপনার আদেশ সম্বন্ধে দ্বিধা কি সংশয়ের কোন অধিকার রাখি নি। সে পথ কোথাও উন্মুক্ত ছিল না। আমার জীবন, কীর্তি, ভবিষ্যৎ—এই গুরুদক্ষিণা আপনি চাইবেন তা বুঝেও আমার আর কি উপায় ছিল সেদিন ঐ প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বলুন!’

আর সহ্য করতে পারলেন না কুরুবংশ-শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। স্থির হয়ে বসে থাকতেও না। একলব্যর নিরুত্তেজিত শান্ত শ্রদ্ধাবিনম্র কথাগুলির প্রতিটি শব্দই তাঁর কর্ণে অগ্নিশলাকার মতো প্রবেশ করছিল, মনে শুধু নয়, সমগ্র দেহেও বৃশ্চিক-দংশনজ্বালা অনুভব করেছিলেন। এবার লগুড়াহত জন্তুর মতোই অস্থির হয়ে উঠে সে স্থান ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে বিদায়-সম্ভাষণ কি আশীর্বাদ করার কথাও মনে রইল না তাঁর।

.

বহু দিনের কথা। সার্ধ ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্বের ঘটনা।

তবু আজও এই কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানে, চতুর্দিকের অগণিত শত্রুসৈন্যের মধ্যে বসেও উভয় পক্ষের হাহাকার, শোকোচ্ছ্বাস ও হর্ষধ্বনির মিশ্রিত কোলাহল সত্বেও—যেন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন সে কথাগুলো। আজও অনুভব করছেন সেই তীব্র বিষদাহ।

আজও শুনছেন। নতুন এক কণ্ঠস্বর আজ কানে আসছে, অদ্যাবধি যা কোনদিন শোনেন নি। তাঁর বিস্মৃত বিবেক যেন মনের রুদ্ধদ্বার ঠেলে সেই প্রত্যন্ত দেশে এসে বলছে, ‘মিথ্যাচরণ! সে কি শুধু ঐ একবার? অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষার দিন মহাবীর কর্ণ যখন এসে অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন, সেদিন তুমিই কি সম্বন্ধী কৃপাচার্যকে দিয়ে জন্মর প্রশ্নটা তোলাওনি—কর্ণ নিদারুণ আঘাত পাবে, লজ্জিত হবে জেনেও? তারপর কুন্তীর অসুস্থতার অজুহাত পেয়ে পরীক্ষা বন্ধ ক’রে দিতে পেরে কি আশ্বস্তবোধ করো নি? ভাল ক’রে ভেবে দ্যাখো। কর্ণের কান্তি, সহজাত দিব্য কবচকুণ্ডল দেখে কি তুমি বুঝতে পারো নি—ঐ কিশোর ক্ষত্রিয় তো বটেই, নিশ্চয়ই কোন দেবপুরুষের অংশে জন্মগ্রহণ করেছে? তখন কেন তুমি তাকে অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে দাও নি। ‘

দ্রোণ কান পেতে শোনেন মনের গোপন অন্তঃপুরে বিবেকের এই কঠোর সত্য কথাগুলি, আর মনের মধ্যেই মিলিয়ে নেন তার যথার্থতা।

হ্যাঁ, মিথ্যাচরণ ছিল বৈকি। তা আজ আর অস্বীকার করবেন না। তার আগেই আধার উপযুক্ত জেনে তিনি অর্জুনের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছেন, তাঁকে যদি অপরাজেয় শস্ত্রধর ক’রে দিতে পারেন—সে তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করবে, যেমন ক’রেই হোক। একচক্ষু হরিণের মতো শুধু এই দিকটাই দেখেছেন—সার্থক শিষ্য একলব্য বা কর্ণও যে তাঁর এইটুকু প্রিয়সাধন করতে পারত অনায়াসে, তাঁর আদেশ মাত্রে, অতটা ভেবেও দেখেন নি।

মনের আগোচরে পাপ নেই। বিবেক আজ অনেক কথাই বিস্মৃতির অতল থেকে উদ্ধার ক’রে এনে তাঁর চিত্তবুদ্ধির সামনে মেলে ধরছে।

দ্রুপদের অবহেলা বা নিজের দারিদ্র্য—তিনি ব্রাহ্মণ, ঋষির পুত্র–অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারতেন, মানুষের স্বভাব বুঝে দ্রুপদকে ক্ষমা করতে পারতেন, করাই উচিত ছিল। করলে তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কারের উপযুক্ত কাজ হত—কিন্তু তিনি সাধারণ কামানুদাস মানবের মতোই কামিনীর মনোরঞ্জন করার জন্য, স্ত্রীর বৃথা অভিমান দূর করার জন্যই চিরজীবন উচ্চাশার তরুমূলে অব্রাহ্মণ-জনোচিত উপায়ের বারিসিঞ্চন করেছেন, ন্যায়-অন্যায় বোধ বিসর্জন দিয়ে, নিজের সংহত সকল শক্তি সার দিয়েছেন। দ্রুপদের অবহেলা, পুত্রবন্ধুদের বিদ্রুপ দ্রোণকে তত বাজে নি, যত বেজেছে তাঁর স্ত্রী কৃপীকে। তারই তাড়নায় দ্রোণ সামান্য ধনসম্পদের কাঙাল হয়ে ছুটে গেছেন ভগবানের অংশস্বরূপ মহামানব মহর্ষি পরশুরামের কাছে, তিনি প্রচুর ধনরত্ন সকলকে বিতরণ করে নিঃস্ব হবেন এই সংবাদ পেয়ে। তারপর পার্থিব ঐশ্বর্যে ধনী হয়ে দ্রুপদকে স্পর্ধা জানাবেন—এই ইতর রিপু, ইতর মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার আশায়।

এই সম্পদ নিজের শক্তিতে আহরণ করবেন এ মনোবল ছিল না—তাই ভিক্ষুকবৃত্তি নিয়েই ছুটে গিয়েছিলেন ভার্গবের কাছে। তারপর সেখানে গিয়ে যখন শুনেছেন যে, যা কিছু ধনরত্ন ছিল ইতিমধ্যেই তা বিতরিত হয়ে গেছে, শুধু অস্ত্রগুলি পড়ে আছে, তখন সেইগুলিই যাচঞা ক’রে নিয়ে এসেছেন—তা প্রয়োগ প্রত্যাহারের পদ্ধতিজ্ঞান সুদ্ধ।

কিন্তু সে বিত্তের মূল্য দ্রুপদ বোঝেন নি। তিনি বাল্যের দরিদ্র ক্রীড়াসঙ্গীর সঙ্গে পুনঃ-সৌহার্দ্য স্থাপন করতে রাজী হননি—রূঢ় ব্যবহারে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন ক্রদ্ধ দ্রোণ সাধারণ নীচকুলোদ্ভব মানুষের মতোই প্রতিজ্ঞা করেছেন এই অস্ত্র সম্বল ক’রেই, নিজের এই শস্ত্রবিদ্যার সহায়তাতেই দ্রুপদকে বাধ্য ও অবনত করবেন তাঁর কাছে। সেই প্ৰতিজ্ঞা রাখতেই প্রথম যাকে সুপাত্র ও যোগ্য বলে মনে হয়েছে তার সঙ্গেই চুক্তি করেছেন–অর্জুনের সঙ্গে। সেই চুক্তি অনুযায়ী অর্জুনকে অপরাজেয় রাখতেই একটির পর একটি অন্যায় ক’রে গেছেন, জেনেশুনে, সজ্ঞানে।

না, আর বিলম্ব নেই। মহাপাপের মহাপ্রায়শ্চিত্তের কাল প্রত্যাসন্ন। সেজন্য কোনও ক্ষোভও নেই তাঁর। কোন অভিযোগ নেই ভাগ্যের কাছে।

এবার একলব্যকে দেখার পর থেকে, তার লোকোত্তর মহৎ চরিত্রের পরিচয় পেয়ে—তার সেই অবিশ্বাস্য অক্রোধ অহিংস, সর্বপ্রকার প্রতিশোধস্পৃহাহীন আচরণ ও সভক্তি বিনম্র কথাবার্তায় নিজের কলুষিত মনের ছবিটা যেন কদর্যতর চেহারা নিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মনে, নিজের পাপের বোঝাটা আরও দুঃসহ গুরুভার ব’লে মনে হচ্ছে।

বিধাতার অভিসম্পাত কিছুটা যে ফলেছে তা তো সুপ্রত্যক্ষ। অশ্বত্থামা, যার দুঃখ দূর করার জন্যই পাণ্ডবদের এত তোষামোদ করা, মিথ্যা ও অসদাচার—সে সত্যই অমানুষ হয়েছে। ভ্রূর, ক্রোধী, স্বার্থপর, চপলমতি। ব্রাহ্মণের শিক্ষা সংস্কার বিবেচনা স্থিরবুদ্ধি কিছুই সে পায় নি। নিহত না হোক—পাণ্ডবদের হাতে যে মৃত্যুর অধিক লাঞ্ছনা ভোগ করবে তাতে অণুমাত্র সন্দেহ নেই।

তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও কি সে অভিসম্পাত ফলবে না!

কিছুই বাকি থাকবে না—কড়ায়-গণ্ডায় নিজের দুস্কৃতির মূল্য শোধ দিতে।

তবু এই যুদ্ধে পরাজয় ও পতন অবশ্যম্ভাবী জেনেও অথবা জেনেই দ্রোণাচার্য যেন সাক্ষাৎ কালান্তক যমের মতো ক্ষত্রিয়-ধ্বংসকারী, ভার্গব পরশুরামের মতো প্রচণ্ড যুদ্ধ করছিলেন। সে-মৃত্যুন্মত্ততা দেখে মনে হতে লাগল—নিয়তিকে একেবারে সামনে দেখে, যমরাজ প্রস্তুত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝেই—তিনি সম্পূর্ণরূপে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেছেন, মরীয়া হয়েই এই মরণ-মহোৎসবে মেতেছেন।

তাঁর মনে হতে লাগল, ব্রহ্মলোকবাসী মহর্ষি ও দেবর্ষির দল তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়র পার্শ্বে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁকে ধিক্কার দিচ্ছেন, এই ভাবে—নিতান্তই সাধারণ মানুষের উপর সহস্র লক্ষ নরবিধ্বংসী ভয়ঙ্কর অস্ত্রপ্রয়োগের জন্য—নিন্দা ক’রে বলছেন, অস্ত্র ত্যাগ ক’রে এবার ঈশ্বরচিন্তায় মন দিতে, মহাপ্রয়াণের জন্য প্রস্তুত হ’তে। মনে হ’ল তাঁর সহজাত বিবেক তাঁর অন্তর থেকে সানয়নে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু তিনি কোনরূপ ভ্রূক্ষেপ করলেন না। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধের পঞ্চম দিনে সন্ধ্যার পরও বিরতি ঘোষণা করলেন না যুদ্ধের, মধ্যরাত্রে কয়েকদণ্ড মাত্র বাদে সমস্ত রাত্রিই যুদ্ধ চলল। পাণ্ডবপক্ষ গত চৌদ্দ দিনে যত না হীনবল হয়েছিলেন, মনোবল হারিয়েছিলেন—এই এক দিন-রাত্রির যুদ্ধে তার কয়েকগুণ হারালেন, রথী-মহারথী পদাতিক কত যে নিহত হ’ল তার ইয়ত্তাই নেই। সবাই বলতে লাগলেন আর এক প্রহরও যদি এইভাবে দ্রোণ যুদ্ধ করেন, তাহলে পাণ্ডবদের পরাজয়ের আর কিছুই বাকি থাকবে না।

তখন অগত্যাই শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে পাণ্ডবদের মিথ্যার সাহায্য নিতে হ’ল। পুত্র সম্বন্ধে তাঁর অসাধারণ দুর্বলতা জানা ছিল, ভীম তাই সেই স্থানটিতেই মর্মান্তিক আঘাত দিলেন, কাছে গিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘অশ্বত্থামা তো নিহত হয়েছে। আর কেন যুদ্ধ করছেন, কার জন্যে?’

আজকের এই হত্যাতাণ্ডব, নররক্তের এই ঘূর্ণির মধ্যে তাঁর এতকালের অপরাধবোধ আত্মগ্লানি এমন কি কুকর্মের স্মৃতিও যেন ভুলে বসেছিলেন দ্রোণ, সেইসঙ্গে একলব্য এবং অবমানিত দ্রুপদের যজ্ঞ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মবৃত্তান্তও। অথবা তার এই বাস্তব চেহারাটা কল্পনা করতে পারেন নি। তাই অশ্বত্থামার মৃত্যু সম্ভব নয় জেনেও ক্ষণকালের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। বিশ্বাস হ’ল না ঠিক, তবু একটা আশঙ্কাতে অবশ হয়ে গেল মন— সেই সঙ্গে দেহও। একবার এমনও মনে হ’ল—যে বিরক্ত ব্রহ্মর্ষিরা তাঁকে এতক্ষণ অস্ত্রত্যাগের পরামর্শ দিচ্ছিলেন—তাঁরাই হয়ত ওঁর অবাধ্যতায় রুষ্ট হয়ে এই অঘটন ঘটালেন।

তবু এমন কি যুধিষ্ঠিরের দ্বারা সে সংবাদ সমর্থিত হওয়া সত্বেও হয়ত এমনভাবে যুদ্ধবিমুখ হতেন না, যদি না অকস্মাৎ ঐ নিষাদ রাজপুত্র এমন প্রায়-জীবন্ত মূর্তিতে মানসদৃষ্টিতে এসে আবির্ভুত হত।

আর তার ফলেই তাঁর প্রায়-অবশ হস্ত থেকে ধনু খসে পড়ল। যখন অস্ত্র ত্যাগ ক’রে স্থির হয়ে ইহলৌকিক সকল

ইষ্টানিষ্ট কার্যকারণ থেকে অপসৃত করিয়ে নিয়ে ব্রহ্মচিন্তায় মনকে সংহত করার চেষ্টা করছেন—সেই সময় অকস্মাৎ একটি দৃশ্য তাঁর মানসচক্ষুর সামনে ভেসে উঠল।

দেখলেন একলব্য—মহর্ষি একলব্যকে শঙ্খ ঘণ্টা দুন্দুভি-নিনাদ সহকারে তাবৎ ব্রহ্মর্ষি ও সুরলোকবাসী দেবতারা প্রত্যুদগমন ক’রে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছেন—আর একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তি, দ্রোণাচার্যের মতোই যার অবয়ব ও আকৃতি, কাতরভাবে ভৈরবতাড়িত হয়ে তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছে। আরও দেখলেন, একলব্য কড়জোড়ে বার বার সেই লোকটিকেই প্রণাম জানাচ্ছেন এবং কাতরকণ্ঠে বলছেন—ওঁকেও আসতে দিন, ওঁকে ছেড়ে আমি স্বর্গে যাব না।’

এক লহমা হবে বোধ হয়। বিদ্যুৎ-চমকেই মনে পড়ল কথাটা। কিন্তু তখন আর ফেলে-দেওয়া-অস্ত্র তুলে নিয়ে নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রবৃত্তি হ’ল না।

অবসরও পেলেন না অবশ্য।

ধৃষ্টদ্যুম্ন তার মধ্যেই তাঁর রথে উঠে খড়্গা উদ্যত করেছে।

দ্রোণ তেমনি চোখ বুজে থেকেই শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘একলব্য, একলব্য–তোমার ঋণ কি শোধ হ’ল? প্রায়শ্চিত্ত কি সম্পূৰ্ণ হ’ল আমার? এতদিনের আত্মদহন যজ্ঞে কি জীবনের পূর্ণাহুতি পড়ল?’

কিন্তু প্রতিশোধের হোমাগ্নিতেই যার জন্ম—পিতৃবধের প্রতিহিংসায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন সে কথা শুনতে পেলেন না। পেলেও অর্থ বুঝতে পারতেন না।

১৫

অকস্মাৎ কর্ণ যেন কেমন বিহ্বল—হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। দুর্বলতা? ক্লান্তি? অবসাদ? অবিরাম রক্তক্ষয়ী প্রাণক্ষয়ী সংগ্রামে অনীহা? জীবনেই বিরক্তি?

কী যে তা কর্ণও ঠিক বুঝতে পারছেন না। সে অবসরও তো নেই। যুদ্ধ প্রায় চরম পর্যায়ে পৌঁচেছে। হয়ত আর কয়েক দণ্ডের মধ্যে চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যাবে—কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্র অথবা কনিষ্ঠ পুত্র কোনটি জীবিত থাকবে, কোনটি গতাসু হবে—কে জয়ী হবে কে পরাজয়ের কলঙ্ক নিতে বাধ্য হবে!

এই চরম-মুহূর্তটিরই তো প্রতীক্ষা কর্ণর—আজীবন বলা হয়ত সঙ্গত হবে না—আকৈশোর। পৃথানন্দন এ পৃথিবীর সর্বোত্তম ধনুর্ধর, সর্বশ্রেষ্ঠ বীর—এই কথা শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত, ঈর্ষার বিষে জর্জরিত। এক এক সময়—যখন অর্জুনের এই অকারণ অপ্রমাণিত বিপুল স্তুতি শুনেছেন ইতিপূর্বে, দুর্ভাগ্য-সৃষ্ট এই অপ্রতিকার অসহায় অবস্থায় মৃত্যু- ইচ্ছা দেখা দিয়েছে মনে। কখনও গোপনে গিয়ে তাঁকে দ্বৈরথ সমরে শক্তি পরীক্ষায় আহ্বান করার দুর্নিবার ইচ্ছা জেগেছে। এখন তো, ওদের বন গমনের পর থেকে, অবিরত শুনছেন অর্জুন অপরাজেয়—সুর নর রক্ষ যক্ষ গন্ধ — সকলকারই। তাই যদি হয়, কর্ণর প্রাণধারণের আর কোন প্রয়োজন বা অর্থ নেই, অবিলম্বে মৃত্যুই শ্রেয়।

অথচ, কৈশোর থেকেই, বার বার চেষ্টা করেছেন নিজের শিক্ষা নিজের শৌর্য প্রমাণ করতে, উভয়ের মধ্যে সত্যই কে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর তা অবিসম্বাদীরূপে প্রমাণ করতে। এমনই দুর্দৈব, আর দুর্দৈব তো বটেই, দৈব তো জন্মমূহূর্ত থেকেই তাঁর শত্রু—নিজের যোগ্যতার প্রমাণের সুযোগই পান নি। প্রথম বয়সে কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা-পরীক্ষাগারে—যেখানে কুরুবংশীয় রাজপুত্ররা ছাড়াও বহু নৃপতিপুত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন, দ্রোণাচার্যের শিষ্যরূপে–সেখানে শুধু তিনিই সে সুযোগ লাভে বঞ্চিত হয়েছেন, লাঞ্ছিতও কম হন নি। ঐ ব্ৰাহ্মণ দুটো—দ্রোণ ও কৃপ তাঁকে প্রবঞ্চিত করেছে, এমন কি প্রতারিত করেছে বলাও চলে। আরও একবার, কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে তরুণ বয়সে বালার্কদ্যুতি শালপ্রাংশু মহাভুজ অঙ্গাধিপতি স্বয়ম্বর সভায় নারীচিত্ত জয়ের লোভে নয়—স্বয়ম্বরের শর্ত শুনে নিজের শস্ত্র-জ্ঞানের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণের জন্যই গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও সে সুযোগে বঞ্চিত হয়েছেন—ভাগ্যরূপিণী এক নারীর দ্বারা।

দ্রৌপদী, কৃষ্ণা। একই সঙ্গে তাঁর প্রাণের আনন্দ, চিত্তের প্রদাহ। শুধু কৌরব নয়—তাঁরও বুঝি মৃত্যুরূপিণী যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা ঐ নারী।

কৃষ্ণার জন্যই—কৃষ্ণার অবর্ণনীয়, ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য লাঞ্ছনা ও অপমানে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে–ভদ্রবংশীয়, ভদ্রপদবীধারী, এমন কি বোধ করি অশিক্ষিত বর্বর ব্যক্তির পক্ষেও নিন্দার্হ গর্হিত আচরণ করেছেন তিনি, সুরাপানম নিষাদ বা রাক্ষসদের মতো কুবাক্য উচ্চারণ করেছেন আর তার ফলে পাণ্ডবদের মন বিষতিক্ত ক’রে তুলে তাদের চরম শত্রুতে পরিণত করেছেন।

তাতেও শেষ হয় নি। আর, এই চরম মুহূর্তে, চূড়ান্ত ভাগ্যপরীক্ষাকালে আবারও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর সর্বক্ষণের ভাবনার সঙ্গে জড়িত এই নারী।

প্রস্তুত, হ্যাঁ, প্রস্তুতই ছিলেন। জীবনের প্রতি কোন আসক্তি বা মোহ তাঁর নেই, অর্জুনকে পরাজিত না করতে পারলে এ জীবন ধারণের কোন অর্থও নেই। গতরাত্রিতে আসন্ন সর্বনাশভীত দুর্যোধনকে তিনি বৃথা আশ্বাসও দেন নি, সর্ব প্রকারেই ভ্রান্তিহীন আয়োজন সম্পন্ন করেছেন অদ্যকার যুদ্ধের জন্য। এমন কি তাঁর গুপ্তচর যখন সেই সন্ধ্যারাত্রেই এসে সংবাদ দিল যে সে কীলক নামে এক মাংস-সরবরাহকারীর মুখে সদ্য শুনে এসেছে, শ্রীকৃষ্ণ ঐ পাণ্ডবদের বলেছেন, তাঁর সমকক্ষ সারথি কৌরবশিবিরে একজনই আছেন—বোধ করি কোন কোন বিচারে দক্ষতরও—তিনি মহারথ শল্য শল্য অপেক্ষা অশ্বচালনাভিজ্ঞ ব্যক্তি সমগ্র ভারতখণ্ডেই বিরল, তিনি যদি কর্ণর সারথ্য গ্রহণ করেন তাহলেই কিছু সঙ্কট দেখা দেবে, নতুবা পরদিনের যুদ্ধে কর্ণর পতন অনিবার্য—তখন দুর্যোধনকে দিয়ে সেই অসাধ্য সাধনও করেছেন—শল্যকে বিস্তর স্তবস্তুতিতে তুষ্ট ও শান্ত ক’রে অদ্যকার যুদ্ধে সারথ্য গ্রহণে সম্মত করিয়েছেন। অবশ্য কে জানে এর মধ্যে চতুরশ্রেষ্ঠ বাসুদেবের কোন চক্রান্ত আছে কিনা, কারণ শল্য এক সাংঘাতিক শর্ত করেছেন, তিনি কর্ণকে যে কোন কটূক্তিই করুন, পাণ্ডবপক্ষের যত প্রশংসাই করুন—কর্ণ কোন প্রতিবাদ করতে পারবেন না। করলে সেই মুহূর্তে শল্য বলগা ত্যাগ করবেন।

আজ বুঝতে পারছেন অঙ্গাধিপতি, এ শর্ত করা উচিত হয় নি। এও এক নিদারুণ ভ্রান্তি তাঁর। শল্য হয়ত তাঁর ভাগিনেয়দের কল্যাণার্থেই—ক্রমাগত বিদ্রুপবাণে জর্জরিত ক্রদ্ধ ক’রে তুলবেন। যুদ্ধ শান্ত স্থিরমস্তিষ্কের কার্য, উত্যক্ত চিত্ত—অভ্যস্ত, বহুদিনের আয়ত্ত অস্ত্রও স্মরণে আনতে দেয় না।

কিন্তু এ বিহ্বলতা, উদভ্রান্তি কি শুধু সেই কারণেই? অথবা শক্তিশালী পাণ্ডবদের—পাণ্ডবদের শৌর্য বীর্য সম্বন্ধে তাঁর কোন মিথ্যা ধারণা বা মূঢ় তাচ্ছিল্য নেই—অদ্যকার প্রতিজ্ঞা শ্রবণেই কি তিনি ভয়ার্ত হয়েছেন! কৃষ্ণা তাঁর মৃত্যুরূপিণী কি শুধু সেই কারণেই?

হায় রে! তাই যদি হত!

বিঘ্ন দেখা দিয়েছে আজ শেষ রাত্রি থেকেই।

ঐ নারীর চিন্তাই, আজ এই প্রথম, তাঁর ইষ্টচিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, যা তাঁর জ্ঞান হওয়া অবধি সুদীর্ঘ জীবনে কখনও হয় নি। অথচ এই পূজা ধ্যান স্মরণ মননই তো তাঁর শক্তির ও মানসিক শান্তির উৎস I

প্রত্যূষে প্রাতঃকৃত্যস্নানাদি সমাপনান্তে অনন্যচিন্ত্য, একান্তচিত্ত হয়ে দিবসাধিপতির ধ্যান ও পূজা করা তাঁর আবাল্য অভ্যাস, অবশ্যকৃত্য। কেন, তা তিনি জানেন না। বোধ হয় যেন জন্মসূত্রের কোন বন্ধনে উনি বদ্ধ সূর্যের সঙ্গে। নতুবা ভাল ক’রে জ্ঞান হওয়ার পূর্বেও কেন এই আকর্ষণ বোধ করবেন উনি?

চিরদিনই করেন এই পূজা ধ্যান। এই সময় কোন বাহ্যজ্ঞানই থাকে না তাঁর। কায়মনোবাক্য প্রণতির সঙ্গে অন্তরের সমস্ত ব্যথাবেদনা, সকল আঘাতের ইতিহাস ইষ্টচরণে নিবেদন ক’রেই তিনি সুস্থ ও নিশ্চিন্ত হন। অবসরকালে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সূর্য শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত এইভাবেই ইষ্টচিন্তায় মগ্ন থাকেন তিনি, কখনও এর ব্যতিক্রম হয় না।

অবশ্যই যুদ্ধকালে তা সম্ভব হয় না। সেই কারণেই রজনীর তৃতীয় যামার্ধেই শয্যাত্যাগ ক’রে—গতকাল তো দ্বিতীয় প্রহরের শেষেই বিশ্রাম করতে গেছেন, মাত্র কয়েক দণ্ড শয়ান অবস্থায় ছিলেন, নিদ্রা তো হয়ই নি, তন্দ্রার আভাসমাত্রও নামে নি তাঁর অক্ষিপল্লবে—আসলে ঐ অবিশ্বাস্য স্বল্পাবসরে, অপরিসীম ক্লান্ত অবস্থাতেও তিনি সেই মৃত্যুরূপিণীর চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন—প্রাতঃকৃত্যস্নানাদি সম্পন্ন ক’রে যথারীতি অন্ধকার আকাশতলে পূর্বাস্য অবস্থায় ইষ্টচিন্তার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আজ এই প্রথম তাঁর ইষ্টচিন্তা অন্য সর্বচিন্তাবিরহিত একান্তচিত্ত হয়ে উঠতে পারে নি, তাঁর পূজা-ধ্যানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অশান্ত উদ্বিগ্ন উদ্বেলিত মন ইষ্টের পদপ্রান্তে সংহত বা একাগ্রনিমগ্ন করতে পারেন নি।

না, কোন ইতর চিন্তা নয়, কলুষিত কামনার স্পর্শ নেই তাতে। সুন্দরী রমণী সম্বন্ধে সমর্থ পুরুষের যে চিন্তা স্বাভাবিক তা নয়। এ অন্য ভাবনা। এ যা, তার বুঝি কোন অভিধা দেওয়া যায় না।

শাসক, নৃপতি, প্রধানামাত্য বা যোদ্ধৃ বাহিনীর সর্বাধিনায়কদের বিশ্বস্ত গুপ্তচর নিয়োগ ও প্রয়োগ, তাদের সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে মিলিত হয়ে তাদের আহরিত সংবাদ জ্ঞাত হওয়া—অবশ্যকর্তব্য। স্বাভাবিক সময়েও তা প্রয়োজন, যুদ্ধাদি আপৎকালে অপরিহার্য। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা জ্ঞাত না হলে নিজেদের কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করা কঠিন, অনেক সময় বিশেষ প্রচেষ্টা বা সঙ্কল্পও ব্যর্থতায় পরিণত হয়। লজ্জা বা অপমানের শেষ থাকে না।

অঙ্গাধিপতির সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত, করিৎকর্মা ও চতুর চর বিচিত্রবুদ্ধি।

পাণ্ডব শিবিরের কোন আলোচনা এমন কি সামান্য কথোপকথনও তার সংগ্রহ করতে অসুবিধা হয় না, এমন কি বহু সময় বক্তার সে বাক্য উচ্চারণের দণ্ড-দশমাংশকালের মধ্যে তার কর্ণগোচর হয়। তার পাদুকা লোমাবৃতচর্মের, তার অশ্বপদতলেও লৌহক্ষুরের পরিবর্তে তেমনই চর্ম-পাদুকার ব্যবস্থা তার গতিবিধি তড়িতুল্য, বায়ুবেগও সে গতির কাছে তুচ্ছ, কৃষ্ণবস্ত্রাবৃত এই চর নিঃশব্দচারী, ছায়ামূর্তির মতোই প্রায় অদৃশ্য।

প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব নেই বলে, বিচিত্রবুদ্ধি শত্রুশিবিরেই নানা প্রকারের, নানা পদবীর চর রেখেছে, উপযুক্ত পারিতোষিকের লোভে তারা নিমেষকালমধ্যে সকল সংবাদ ওকে পৌঁছে দিয়ে যায়। অশ্বরক্ষক, দ্বারপাল, ব্যক্তিগত সেবক এমন কি জলসংগ্রাহক, কাষ্ঠ ও খাদ্যসরবরাহকারীরাও অনেকে তার বেতনভুক। যারা তার কর্মীশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়, তারাও অতিরিক্ত পুরস্কারের লোভে সাগ্রহে নানা বিচিত্র সংবাদ বহন ক’রে আনে ওর কাছে। সেসব বার্তা পৌঁছে দেবার স্থানও পূর্ব-নির্ধারিত আছে, তাই কোন কারণেই বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।

প্রতিদিনই বিচিত্রবুদ্ধি শয়নের পূর্বে একবার এসে সর্বশেষ সংবাদ কর্ণর গোচর করে যায়। কালও সে এসেছিল, এই সময়টা প্রশস্ত বস্ত্রাবাসের কেন্দ্রস্থলে এক ব্যাঘ্রচর্মাবৃত কাষ্ঠাসনে বসে কর্ণ ক্ষতস্থানে ঔষধ-প্রলেপ লাগাতে লাগাতে তার বক্তব্য শ্রবণ করেন–কেন্দ্রবিন্দুতে উপবেশনের কারণ কোন অপরপক্ষীয় গুপ্তচর না তাঁদের কথোপকথনের মর্ম জ্ঞাত হতে পারে—কালও তাই শুনেছেন। বিচিত্রবুদ্ধি পাণ্ডবশিবিরের সকল প্রকার উদ্যোগ আয়োজন পরিকল্পনা, এমন কি সাধারণ কথোপকথনেরও সারাংশ শুনিয়ে গেছে। অবশ্য এর বহু অংশ পূর্বেই জ্ঞাত হয়েছেন কর্ণ—বিপক্ষদল কিভাবে ব্যূহ সন্নিবেশ করবে, কে কে ব্যূহের কোন ভাগ রক্ষা করবে কে কে শুদ্ধমাত্র সর্বাধিনায়ক অর্থাৎ কর্ণকেই লক্ষ্য করবে—কী কৌশলে বিব্রত করবে তাঁকে–এ সংবাদ অবগত হয়েই কর্ণ নিজের ব্যূহ গঠনের আদেশ-নির্দেশে গোপন পরিবর্তন করেছেন।

সুতরাং এখন নূতন সংবাদ বেশী ছিল না। যা ছিল সামান্য সংবাদে কর্ণ তৃপ্ত হতে পারেন নি। অথবা একটি বিশেষ প্রশ্নের জন্য বহু পূর্ব থেকেই উদগ্রীব হয়ে আছেন, নিজের অন্তরের লজ্জা ও কুণ্ঠাতেই সে প্রশ্ন করতে ইতস্তত করেছেন, এতক্ষণ কতকটা অন্যমনস্ক হয়েই শুনেছেন বিচিত্রবুদ্ধির সাধারণ সংবাদ সকল। শেষ পর্যন্ত বিচিত্রবুদ্ধি একই সঙ্গে প্রলেপকার্য ও সংবাদ নিবেদন সমাধা ক’রে বিদায় নেবার উদ্যোগ করছে দেখে যেন অতিকষ্টে সকল দ্বিধা অপসারিত ক’রে সেই অনাবশ্যক ও অশোভন প্রশ্নটিও ক’রে বসেছেন, ‘আচ্ছা, ওঁদের মানে আর্যা মহিষীদের—পাণ্ডব পুরললনাদের শিবিরে কী সব আলোচনা হচ্ছে–আমি সেনাপতি হয়েছি শুনে তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া— সেসব সংবাদ কিছু সংগ্রহ করেছ নাকি বিচিত্রবুদ্ধি?’

প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হাস্য করেছে বিচিত্রবুদ্ধি। করজোড়ে অকারণেই একটা আনত নমস্কার ক’রে জানিয়েছে—সে সংবাদও সে রাখে। বস্তুত এই কুরুক্ষেত্র রণভূমির বাইরে বিশযোজন বহিচক্রেও কোথায় কি ঘটছে, কে কি আলোচনা করছে তার কোনটাই বিচিত্রবুদ্ধির অজ্ঞাত নয়। আর, এই সেবাকার্যেই তো সে তার জীবন ক্ষয় ক’রে আনল! এ সুদ্ধমাত্র তার বৃত্তি নয়, বিপুল এক ব্যবসায়। সে অভিজ্ঞ ধীবরের মতোই সংবাদ সংগ্রহের স্বর্ণ-রৌপ্য-আসক্তি-নির্মিত বেষ্টনীজাল নিক্ষেপ ক’রে, এবং যথাসময়ে সেই জাল আকর্ষণ ক’রে সংবাদগুলি আহরণ ক’রে এবং মূল্য বুঝে তার মধ্য থেকে নির্বাচিত তথ্যগুলি স্মৃতির পেটিকায় কুঞ্চিকাবদ্ধ ক’রে রাখে। তাই প্রভুর আদেশমাত্রে সেগুলি তাঁর শ্রুতিগোচর করতে অসুবিধা হয় না।

বিচিত্রবুদ্ধি কি কর্ণের চিত্তান্তঃপুরে অতিসংগোপন অতিপেলব ছায়াকার চিন্তারও সংবাদ রাখে? নচেৎ অপর পাণ্ডব- নারীদের নীরস ও নিষ্প্রয়োজন কথোপকথনের সারমর্ম দ্রুত শেষ ক’রে পাণ্ডবদের প্রধানা মহিষীর মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন ও সবিস্তার বর্ণনা করবে কেন?

খুবই উৎকণ্ঠিত হয়েছেন পট্টমহাদেবী দ্রৌপদী।

খুবই বিচলিত হয়েছেন।

মৃত্যুঞ্জয় পিতামহ ভীষ্ম বা সর্বশস্ত্রপারঙ্গম দ্রোণাচার্য এ পক্ষের সর্বাধিনায়ক পদে অভিষিক্ত হয়েছেন শুনে এত উদ্বিগ্ন হন নি তিনি—এবার যতটা হয়েছেন।

পরন্তু আজ প্রথম রাত্রে অর্জুন যে পরদিবস কর্ণ বধের কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছেন—তা শুনেও নাকি বিশেষ আশ্বস্ত বা উৎফুল্ল হতে পারেন নি। অথচ কে না জানে—এ পর্যন্ত তৃতীয় পাণ্ডবের এই ধরনের প্রতিজ্ঞা কোন ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয় নি! প্রত্যুত পট্টমহাদেবীর এতাবৎকালের সমস্ত দুঃখ-বেদনা অপমানবোধ—এই বিগত দিনের অগণিত শোক ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর অদ্যকার দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা।

তিনি নাকি তাঁর এক সপত্নীর কাছে আক্ষেপ ক’রে স্পষ্টই বলেছেন, ‘তোমরা জান না অঙ্গাধিপতি গাণ্ডীবধন্বা তৃতীয় পাণ্ডব সম্বন্ধে কী বিপুল ঈর্ষা ও অন্ধ বিদ্বেষ পোষণ করেন! রণশাস্ত্রনিপুণ হিসাবে হয়ত দুজনে সমান অভিজ্ঞ, সমান কেন ধনঞ্জয় অবশ্যই কর্ণ অপেক্ষা অধিকতর বীর, অধিকতর শস্ত্রাভিজ্ঞ, রণবিদ্যা-বিশারদ—তত্রাচ মানুষ যখন ঈর্ষায় জ্ঞানশূন্য হয়, অন্ধক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে তখন তার অসাধ্য কিছুই থাকে না। উন্মাদের বল সাধারণ বলশালী ব্যক্তি অপেক্ষা অনেক অধিক। তাছাড়া বিদ্বেষ ও অসূয়া ন্যায়নীতিবিগর্হিত যুদ্ধরীতি প্ররোচিত করে।

সে সপত্নী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এহেন বিদ্বেষের কারণ কি মহাদেবী? পৃথিবীতে এত যোদ্ধা এত মহারথী থাকতে ফাল্গুনীর উপরই বা এত আক্রোশ কেন?

দ্রৌপদী ললাটে করাঘাত ক’রে উত্তর দিয়েছিলেন—উদগত অশ্রুতে কণ্ঠ বাষ্পাচ্ছন্ন—অতিকষ্টেই বলেছিলেন, ‘ভগ্নী, আমি অভাগিনীই বুঝি এর মূল। জন্মাবধিই আমি অশান্তির কারণ হচ্ছি। বিদ্বেষে আমার জন্ম—এই মহারণই তো আমার সেই জন্মলগ্নের ফল। দ্রোণাচার্যের নিকট পরাজিত অপমানিত হয়ে আমার পিতা দ্রুপদ প্রতিহিংসামানসে তপস্যা ও যজ্ঞ করেছিলেন—তার ফলেই আমাদের জন্ম। আমার ও ধৃষ্টদ্যুম্নর। প্রতিহিংসা থেকে দুর্বুদ্ধির ফলে কলহ বিবাদ যুদ্ধ হয়।…মহামনা কর্ণ আমার স্বয়ম্বর সভায় যে অপমানিত হয়েছিলেন—সে অকারণ অবমাননার ক্ষোভ যদি আজও না বিস্মৃত হতে পেরে থাকেন তো তাঁকে কিছুমাত্র দোষ দেওয়া যায় না। সত্যই তো, সেদিন তাঁর প্রতি রীতিমতো অবিচারই করা হয়েছিল—সেদিন তিনি আমাদের মিথ্যাচরণ ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্যই তাঁর অপেক্ষা শৌর্যে- বীর্যে মহত্বে বহুলাংশে হীন রাজন্য সমাজে উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন।’

‘তার অর্থ?’ শ্রোত্রীর কৌতূহল প্রবলতর হয়ে ওঠে ।

‘আমার পিতা প্রধানত অর্জুনের জন্যই পরাজিত ও হতমান হয়েছিলেন, তাই তাঁর একান্ত বাসনা ছিল অর্জুনই তাঁর জামাতা হয়। সেই উদ্দেশ্যেই সাধারণ মানবের তথা রাজন্যবর্গেরও দুঃসাধ্য, দুঃসাধ্য কেন অসাধ্য পণ রেখেছিলেন স্বয়ম্বরের। সুকঠিন সে লক্ষ্য ভেদ করা, বোধ করি তদপেক্ষাও কঠিন সেই বজ্রতুল্য কর্মকে জ্যা যোজনা করা। সে ধনু পিতার নির্দেশে ও অনুরোধে বিশ্বকর্মাতুল্য যন্ত্রশিল্পী বহুদিন ধরে নির্মাণ করেছিলেন। এ তথ্য—তথা পিতার গোপন আকূতি আমি জানতাম। আমিও পিতার মুখেই অর্জুনের শৌর্যবীর্য অস্ত্রপ্রয়োগ নৈপুণ্যের প্রশংসা শুনতে শুনতে তাঁর সেই একান্ত আকাঙ্খিত পাত্র অ-দৃষ্ট অপরিচিত মহাবীরকে কামনা করেছি। আমারও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল— অর্জুন ভিন্ন কেউই ঐ শরাসনে জ্যা রোপণ করতে পারবেন না, লক্ষ্য ভেদ তো অসম্ভব।

‘মনে মনে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত ছিলাম—তাই সমাগত সুবিখ্যাত নৃপতির দল, স্ব-প্রচারিত অপরাজেয় মহাবীর সব একে একে যখন পিতার নির্দেশে বিশেষভাবে নির্মিত সেই ধনুতে জ্যা রোপণ করতে এসে ব্যর্থমনোরথ, হতমান ও দর্শকদের হাস্যাস্পদ হয়ে নতমুখে নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন আমি কৌতুকই অনুভব করছিলাম। তারই মধ্যে অকস্মাৎ যখন কর্ণ স্বীয় আসন থেকে উত্থিত হয়ে লক্ষ্যভেদ মঞ্চে আরোহণ করলেন, তখন বক্ষে হিমভাব বোধ করলাম একটা। সুগঠিত ব্যায়ামপুষ্ট বলিষ্ঠ দেহ, সুন্দর আননে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, অরুণাভ উজ্জ্বল কান্তি— যেন সাক্ষাৎ তরুণ সূর্যদেব এসে উদিত হলেন স্বয়ম্বর সভায়।…ওঁকে আসতে দেখেই আমি প্রমাদ গণেছিলাম—পরে যখন স্মিতহাস্যের সঙ্গে সেই বজ্রকঠিন ধনু আনত ক’রে অনায়াসে তাতে জ্যা রোপণ করলেন—তখন আর আমার জ্ঞান রইল না। বেশ বুঝলাম এ কার্য যিনি করতে পারেন—যত দুঃসাধ্যই হোক—লক্ষ্যভেদও তাঁর নিকট দুরূহ হবে না। তখন আমি যেন সমস্ত শোভনতা-অশোভনতা, সত্য-মিথ্যা, কর্তব্য-অকর্তব্যবোধ, সব হারিয়ে ফেললাম। ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক পুনঃপুনঃ প্রচারিত স্বয়ম্বর শর্তের স্মৃতিও মনে রইল না। কারও সঙ্গে পরামর্শ করা কি পিতার মত নেওয়ারও অবসর ছিল না—আমি বিচলিত দিশাহারা হয়েই বলে ফেললাম—’আমি প্রাণ থাকতেও ঐ সামান্য সারথি-পুত্রকে বরণ করব না, নীচজাতীয় লোকের গলায় মালা দেওয়া অপেক্ষা আত্মহত্যাও শ্রেয়। কর্ণ যদি লক্ষ্য ভেদ করেন আমি প্রায়োপবেশনে অথবা জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ ক’রে মৃত্যুবরণ করব।

‘সুপর্ণা, বাক্য আর অক্ষ একবার নিক্ষেপ করলে আর কোনমতেই তাকে প্রতিসংহার করা যায় না। এ যে সুকঠিন মর্মান্তিক কথা আমি বললাম, কী নিদারুণ আঘাত দিলাম ঐ বালাকদ্যুতি মহাবীরকে, তা শব্দ কয়টি কণ্ঠ থেকে নিঃসারিত হওয়া মাত্র বুঝতে পেরেছি। বিশেষ যখন চারিদিক থেকে—তবু জনসাধারণের, দর্শকদের সৌজন্যবোধ সহানুভূতি আছে, সেদিকটা অনেকাংশে সংযত–কিছু-পূর্বে-অপদস্থ-রাজন্যসমাজে উচ্চ হাস্যরোল উঠল। সেই নির্লজ্জ কাপুরুষদের ব্যঙ্গহাস্যে ও আমার প্রাণান্তক বাক্যবাণের আঘাতে অঙ্গাধিপতির বালারুণবর্ণ অঙ্গারাভা ধারণ করল, হস্তও মুষ্ঠিবদ্ধ হ’ল একবার কিন্তু সে নিমেষকাল মাত্র তারপরই আত্মসম্বরণ করলেন। তিনি আমার প্রগলভতা, অকারণ

বেদনাদায়ক বাক্য—সর্বোপরি প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অপরাধও অনায়াসে উপেক্ষা করলেন, প্রতিবাদে একটি রূঢ় বাক্যও তাঁর কণ্ঠ ভেদ ক’রে উচ্চারিত হ’ল না। বরং একবার ঊর্ধ্বাকাশে মধ্যগগনগত দিনমণির দিকে নেত্রপাত ক’রে মধুরতর উদার হাস্যের সঙ্গেই ধনু জ্যামুক্ত ক’রে সেটি সযত্নে বেদীর উপর নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘থাক বরাঙ্গনে, আমার জন্য তোমার প্রাণত্যাগের প্রয়োজন হবে না। তুমি দীর্ঘজীবিনী হও।’

‘সে-হাসি আমি লক্ষ্য করেছিলাম সুপর্ণা, সে হাসির স্মৃতি আমার বুকে আমার দুষ্কৃতি কণ্টক হয়ে বিঁধে আছে। সে হাসি ক্রন্দন অপেক্ষাও করুণ, মৃত্যু অপেক্ষাও শীতল—দুর্ভাগ্যের অপেক্ষাও কঠিন। তার জন্য অদ্যাপি অনুশোচনা ও আত্মগ্লানির অবধি নেই আমার।…না, আমি কর্ণকে পতিত্বে বরণ করতে পারতাম না সত্য কথা— কিন্তু বক্তব্যটা নম্রভাবে ঘাতসহ ভাষায় প্রকাশ করা চলত, হয়ত একটা মধুর মিথ্যারও আশ্রয় নিতে পারতাম।…অবশ্য এ আমার অনভিজ্ঞতারই ফল। কয়েকটি কথা, কয়েকটি বহুব্যবহৃত শব্দ দ্বারা গঠিত বাক্য যে মানুষকে এমন আঘাত করতে পারে— বাক্য যে সকল পরিচিত জ্ঞাত অমোঘ অস্ত্র অপেক্ষাও যন্ত্রণাদায়ক মর্মান্তিক হতে পারে—সেদিন কর্ণর মুখের দিকে চেয়েই প্রথম বুঝলাম। সে আঘাত কি কর্ণ ক্ষমা করতে পারেন! সেই কারণেই—বিশেষ, অর্জুনের জন্যই আমার বরমাল্য রক্ষা করছিলাম বুঝেই—তাঁর এত আক্রোশ, অর্জুন সম্বন্ধে এত ঈৰ্ষা!’

সপত্নী সুপর্ণা তবু কিছু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, ‘আপনি বড় বেশী দুশ্চিন্তা করছেন মহাদেবী, অমঙ্গলের দিকটাই শুধু দেখছেন। আপনি যতটা অনুমান করছেন এতটা বিদ্বেষ হয়ত তাঁর সত্যই নেই!’

এবার হাসলেন পাঞ্চালী, শিশুর মতো প্রবোধ দেবার প্রয়াস দেখলে যেমন বয়স্করা হাসেন তেমনই। বললেন, ‘নিশ্চিত না বুঝলে আমি এতটা বিচলিত হতাম না—সুপর্ণা। ভীম অর্জুন যার স্বামী, বাসুদেব যার সখা—সে সাধারণ শত্রুতার ভয়ে বিচলিত হবে এমন ভাবছ কেন? আর কর্ণকেও সামান্য শত্রু ভেবো না। সহজাত বর্ম নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, স্বয়ং জামদগ্ন্যের কাছে তাঁর অস্ত্রশিক্ষা। কেবলমাত্র ভীষ্ম ও অর্জুন ব্যতিরেকে তাঁর সমকক্ষ ধনুর্ধর কেউ নেই। আর তাঁর বিদ্বেষ? না, সেও অনুমান নয়। আমি আকাশে আলিম্পন রচনা ক’রে তাকে সমতলভূমি কল্পনা করি না। তুমি কপট-দ্যূতসভায় সহস্র ইতর পুরুষের দৃষ্টির সম্মুখে আমার সে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা দেখ নি— তাই ঠিক উপলব্ধি করতে পারছ না সবটা। কর্ণ যে কী পরিমাণ জ্বালা বহন করছেন এখনও–সে পরিচয় সেইখানেই পাওয়া গিয়েছিল। কর্ণর মতো বীর, কর্ণর মতো অদ্বিতীয় দাতা—উদার ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তি যিনি পূর্ব-উপকার স্মরণ ক’রে কোন কারণেই পামর দুর্যোধনকে তার বিপদের দিনে ত্যাগ করতে সম্মত হন নি—তিনি সেদিন ঐরূপ চরম অশালীন, বর্বর ইতর জনোচিত আচরণ করবেন কেন? যে লোকটা সব দিক দিয়েই মহৎ না হোক, মহান—সে অমন নীচের মতো ব্যবহার করবে কেন?’

দ্রৌপদী অতঃপর সেদিনকার সমস্ত ঘটনা, কর্ণর আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। সেসব কুবাক্য, কুৎসিত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ পুনরায় যেন নূতন ক’রে অনুভব করলেন তিনি। বলতে বলতে তাঁর চিত্রার্পিতের ন্যায় সুন্দর ললাট ও কপোল তপ্ত অঙ্গার বর্ণ ধারণ করেছে—তাঁরও অন্তরের জ্বালা বুঝি দীর্ঘদিনেও কিছুমাত্র প্রশমিত হয় নি–বর্ণনা দিতে গিয়ে মর্মান্তিক দুঃখে বেদনায় তাঁর কণ্ঠ রুক্ষ, দৃষ্টি বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে, তবু সবই বলেছেন। প্রতিটি তথ্য, কর্ণ- ব্যবহৃত প্রতিটি দুঃশব্দই তাঁর মনে আছে যে!

তার পর বলেছেন, ‘না ভগ্নী, এ যুদ্ধে বিন্দুমাত্র মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না এ যুদ্ধে পাণ্ডবরা জয়লাভ করলেও সুখী হতে পারবে না—প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ হবে মাত্র। কিন্তু তাও কি হবে আদৌ? আজ প্রত্যুষকাল থেকেই আমার দক্ষিণাঙ্গ স্পন্দিত হচ্ছে, বাম নেত্রের নিম্নপক্ষ অবিরাম কাঁপছে—চতুর্দিকে শুধুই যেন অশুভ চিহ্ন দেখছি। এ সবই আত্মীয়বিয়োগ সূচনা করে!

এই পর্যন্ত বিবৃত ক’রে বোধ করি নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজনেই ক্ষণকালের জন্য নীরব হয়েছেন বিচিত্রবুদ্ধি। কিন্তু কর্ণ তাঁকে বিশ্রাম করার অবকাশ দেন নি, ইতিপূর্বের সমস্ত সতর্কতাজনিত ঔদাসীন্য বিসর্জন দিয়ে সাগ্রহে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছেন, ‘বলো, বলো—ক্ষান্ত হয়ো না, বলো আরও কি বলেছেন পাণ্ডবমহিষী!‘

আরও বলেছেন বৈকি কৃষ্ণা!

সুকেশী, নীলোৎপলবর্ণা, পদ্মপলাশলোচনা—পৃথিবীর সর্বোত্তমা সেই দ্রৌপদী—না, কৃষ্ণা নামটাই বেশী প্রিয় কর্ণর— বলেছেন, ‘আমার আজ পরিতাপের সীমা নেই সুপর্ণা, প্রকৃতপক্ষে এই লোকক্ষয়কারী, আত্মীয়বান্ধববিনাশকারী যুদ্ধে আমিই পাণ্ডবদের প্ররোচিত করেছি এদের ইচ্ছা ছিল না, আমার জন্যই তাঁদের এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হয়েছে।…আমি সুদ্ধমাত্র নিজের বিপদের কথাই চিন্তা করছি না ভগ্নী। এই রাত্রি প্রভাতে হয় আমরা নতুবা কর্ণের মহিষীগণ বিধবা হবেন। এত কাল ঠিক নিজের বৈধব্যাশঙ্কা করি নি—জানতাম পিতামহ ভীষ্ম বা দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের বধ করবেন না—এখন সে আশ্বাসটুকুও নেই।…তাই, আমার মনোভাব দিয়েই অঙ্গরাজমহিষীদের আশঙ্কা অনুভব করতে পারছি। হায়! এখনও যদি এ যুদ্ধ বন্ধ করা যেত! এখনও যদি চৈতন্য হ’ত ক্ররমনা দুর্যোধনের। এখনও ধৃতরাষ্ট্র একেবারে নির্বংশ হন নি, তাঁদের ও আমাদের পক্ষেও কিছু কিছু বীর, বিশিষ্ট নৃপতি জীবিত আছেন। এঁরাও যদি রক্ষা পেতেন!’

তারপর অল্পকাল মৌন থেকে, অতি ধীরে প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে বলেছেন কৃষ্ণা, ‘সম্ভব হলে–এ যুদ্ধ বন্ধ হলে আমি নিজে গিয়ে কর্ণর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে আসতাম। তিনি ক্ষমা করবেন না জানি—করা সম্ভব নয়—তবু আমার তো কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত হত! আমি জানি আমার ভর্তা ধর্মরাজও এ কার্যে বাধা দিতেন না।…কিন্তু তা কি আর সম্ভব হবে!’

এই ব’লে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছেন পাণ্ডবমহিষী।

কর্ণ চক্ষু মুদিত ক’রে সেই দৃশ্য কল্পনা করার, মনে মনে সেই চিত্র অঙ্কিত করার চেষ্টা করলেন।

সেই সুন্দর অতিসুন্দর, নীলপদ্মের মতো আয়ত দুটি চোখ থেকে মুক্তারাজির মতো অনুশোচনাশ্রু, বেদনাশ্রু ঝরে পড়ছে সেই সুডৌল মসৃণ ললাটে আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কা কয়েকটি উদ্বেগরেখার সৃষ্টি করেছে—দেবগণেরও ঈপ্সিত সেই আনন আজ বেদনায় বিকৃত।

কর্ণ অস্থির হয়ে উঠলেন।

তাঁর বক্ষে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছেন কেন?

১৬

আরও বহু কথা বলে গেল বিচিত্রবুদ্ধি।

আরও বহু তথ্য, বহু সংবাদ পরিবেশন করল।

অন্যান্য অন্তঃপুরিকাদের নানা মন্তব্য, নানা খেদোক্তি ও দম্ভোক্তি।

সে সব কথা শোনেন নি আর অঙ্গাধিপতি। সে সব মূল্যহীন সংবাদ কর্ণে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করে নি।

তিনি আচ্ছন্ন অভিভূত ভাবে বসে একটি কথাই শুধু চিন্তা ক’রে যাচ্ছেন।

কৃষ্ণা ব্যথিত হয়েছেন। কৃষ্ণা আসন্ন অমঙ্গলের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়েছেন। অশ্রু বিসর্জন করছেন। শুধু কর্ণের মহিষীদের বৈধব্যের কথাই চিন্তা করছেন না, নিজের বৈধব্যের সম্ভাবনাও একেবারে মন থেকে বিদায় দিতে পারছেন না। তার মানে পরোক্ষে ওঁর শক্তি স্বীকার ক’রে নিচ্ছেন। কর্ণর শৌর্য, রণদক্ষতা যে কারও থেকে কম নয় তা উপলব্ধি করেছেন। পরন্তু অঙ্গাধিপতির মহিষীদের জন্য চিন্তিত, তাদের সম্ভাব্য বৈধব্যের কথা চিন্তা ক’রে তাঁর বেদনার সীমা নেই—এ-সংবাদ কি একটি মাত্র বার্তাই বহন ক’রে আনে না যে, তিনি কর্ণ সম্বন্ধে তীব্র বৈর ও প্রচণ্ড প্রতিহিংসাস্পৃহা ভুলে গেছেন—অন্তত এখন আর এই পিশাচটার, এই বর্বরটার মৃত্যু কামনা করছেন না?

তবু এও তুচ্ছ। এত সংবাদের মধ্যে একটি তথ্য—অঙ্গরাজ্যের বিগত দীর্ঘ জীবনের অত্যুত্তম অংশ যে দুঃসহ জ্বালার মধ্যে দিন কাটিয়েছে—এতদিনের সেই দাহ শীতল করেছে। সেই বার্তার অমৃতসিঞ্চনে সহানুভূতিরূপ দিব্যৌষধির প্রলেপে দুঃপ্রশমনীয় বিষক্ষতের অসহ-যন্ত্রণা উপশমিত হয়েছে। কথাটা শোনার পর থেকে মন একটি কৃতজ্ঞতাস্নিগ্ধ বেদনায় আপ্লুত হয়ে এসেছে, একই সঙ্গে অপরিসীম আনন্দ ও দুস্তর লজ্জা বোধ করছেন। ইচ্ছা করছে এই সংবাদ কোন সু-উচ্চ পর্বতশীর্ষ থেকে সগৌরবে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন দেশ থেকে দেশান্তরে এই আশ্চর্য ইতিহাস প্রচার করেন—কৃষ্ণা, ওঁর নিভৃত অন্তর-বাসিনী সেই দিব্যাঙ্গনা ওঁর প্রতি অবিচারের জন্য, মিথ্যাচরণের জন্য অনুতপ্ত কর্ণর অমার্জনীয় ব্যবহার ও নীচ-জনোচিত বাক্যপ্রয়োগের জন্য ধিক্কার বা অভিশাপ না দিয়ে সেই ইতরতম কার্যের সঙ্গত কারণ চিন্তা ক’রে নিজেকেই দায়ী করছেন, নিজের সেই রূঢ় ও অন্যায় আচরণকেই তার কারণ রূপে উপস্থাপিত করছেন—কর্ণর আচরণকে প্রতিশোধ-প্রচেষ্টা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন।…

বহু—বহুদিন বুঝি কর্ণর হৃদয় এই সংবাদটুকুর জন্যই তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল, আশা করতে সাহস হয় নি, তবু অসম্ভব অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যও তো মানুষ কল্পনা করে—তাতেই যেটুকু সুখ, সেইটুকুই অনুভব করার চেষ্টা করেছেন কর্ণ। ওঁর আচরণ সমর্থন করবেন অগ্নিসম্ভবা অগ্নিসদৃশা তেজস্বিনী সেই নারী, বা তার যাথার্থ্য বুঝবেন—এতটা দুরাশা কেন পোষণ করবেন কর্ণ—কৃষ্ণার করুণাও প্রার্থনা করেন নি। মনের নিভৃত গোপন প্রকোষ্ঠে বসে কল্পনার স্বপ্নতন্তুতে বয়ন করেছিলেন এই সুদুর্লভ সৌভাগ্যই, হয়ত সেইসঙ্গে একটা অসঙ্গত অসম্ভব আশাও মনে দেখা দিয়েছিল—মানবহৃদয় যখন কোন আশা করে তখন তো জমা-খরচের যোগ-বিয়োগ অন্তে, নিজের এতটা প্রাপ্য হয় কিনা, এতটা আশা করা সঙ্গত কিনা বুঝে করে না—উনিও তাই আশা করেছিলেন, কামনা করেছিলেন—ওঁর অন্তরের আবেগ ও আরতি নিজের অনুভূতি দিয়ে গ্রহণ করুন কৃষ্ণা, তাকেই প্রায়শ্চিত্ত বলে গ্রহণ ক’রে ক্ষমা করুন।

তাই হয়েছে—ক্ষমা করতে পেরেছেন কিনা কর্ণ তা জানেন না, তবে ওঁর ব্যথা তিনি বুঝেছেন—এতে উনি তৃপ্ত, প্রসন্ন। অধিকতর আনন্দিত, পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হতেন কর্ণ—যদি আরও একটি কথা, সত্য ইতিহাস কৃষ্ণাকে—ওঁর ভ্রাতৃবধূকে জানিয়ে যেতে পারতেন। হ্যাঁ—ওঁর ভ্রাতৃবধূই। এ কথা কেউ না জানুক জননী কুন্তী জানেন, চতুরশিরোমণি কৃষ্ণও জানেন। একদিন কৃষ্ণাও অবশ্যই জানবেন। জানবেন—এ চিন্তা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটি স্নিগ্ধ কৌতুক- রসে মন ভরে গেল কর্ণর—দ্রৌপদী যে দিবারাত্র পার্থ-পার্থ করেন—কর্ণও পার্থ। যদি ওঁর জন্মলগ্ন থেকেই বিরূপ গ্রহ না ওঁকে প্রবঞ্চিত করতেন, নিজের জননী না ওঁকে পরিত্যাগ করতেন—তাহলে পাণ্ডবদের এ রাজছত্র ওঁর মস্তকোপরিই শোভা পেত এবং কৃষ্ণাও ওঁর কণ্ঠলগ্ন হয়ে ওঁকে ‘আর্যপুত্র’ ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করতেন।

এই সব চিন্তা ও কল্পনা—সত্যে ও আকৃতিতে মেশানো চিত্র, চিন্তাতন্ময়তা—অবশিষ্ট সারারাত্রিই তাঁকে মুগ্ধ মোহগ্রস্ত ক’রে রেখেছিল। নিশান্তেও সে মোহের অবসান ঘটে নি।

এই চিত্রজাল-বয়নে, এই প্রণয়কল্পনা-প্রসূত ভাবাবেগেই তাঁর সর্বাপেক্ষা ক্ষতি হয়ে গেছে আজ প্রত্যুষে ইষ্টচিন্তায় মন দিতে পারেন নি।

সেজন্য যত আত্মগ্লানি বোধ করেছেন, যত ব্যাকুল হয়ে মনকে শাসন ক’রে প্রতিদিনের মতো ইষ্টচিন্তায় তদগতচিত্ত হতে চেয়েছেন ততই যেন আরও উদভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, আরও চিত্তবিক্ষেপের কারণ ঘটেছে। এমন কি এই কল্পনা- মাধুর্য আস্বাদন ও কর্তব্যবোধের দ্বন্দ্বের মধ্যে পূর্বাকাশ অরুণরাগরঞ্জিত হয়েছে, আরও অনেকক্ষণ পরে ঊষার লোহিত আস্তরণ অপসারণ ক’রে স্বয়ং সূর্যদেব দেখা দিয়েছেন, কর্ণ অভ্যাসবশত সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, অভ্যাসবশতই কৃতাঞ্জলিপুটে মন্ত্র উচ্চারণ ক’রে স্বাগত জানাতে চেয়েছেন—কিন্তু কোনটাই প্রতিদিনের মতো সার্থক ও চিত্তপরিপূর্ণকর হয়ে উঠতে পারে নি।

ব্যর্থ—হ্যাঁ ব্যর্থই হয়েছিলেন তিনি আজ ইষ্টপূজায়। জীবনে এই প্রথম, অন্তত জ্ঞান উন্মেষের পর এই প্রথম কিন্তু আজই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন ছিল ইষ্টদেবতার চরণে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করার, হয়ত বা মৃত্যুর পূর্বে তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণেরও

কিন্তু শুধু কি ইষ্ট চিন্তাই ব্যর্থ হয়েছে আজ? শিক্ষা, দীক্ষা, ক্ষাত্রধর্ম এতদিনের আশা ও অবিচার-বোধের প্রতিকার- প্রচেষ্টা—সবই কি ব্যর্থ হতে চলেছে না! এ কী হ’ল তাঁর!

গতকাল পর্যন্ত অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় ও অনমনীয় ছিলেন কর্ণ।

এ জিঘাংসা নয়, এ সুচিন্তিত বিচার। অন্তত কর্ণ তাই মনে করেন।

কপট দ্যূতসভায় পাঞ্চালীর অবর্ণনীয় লাঞ্ছনায়—মানব-জাতির ইতিহাসে বোধ করি অতীতে ও ভবিষ্যতে, এ শ্রেণীর অমানুষিক লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের এই একটিই মাত্র উদাহরণ—ক্রোধে, ক্ষোভে, আত্মধিক্কারে, লজ্জায় উন্মত্ত কর্ণ বহু চেষ্টা করেছেন অর্জুনের পৌরুষ জাগ্রত করতে, যাতে সে তখনই এই পাশাখেলার স্বরূপ প্রকাশ ক’রে, এ মিথ্যার ক্রুরতার প্রাসাদ চূর্ণবিচূর্ণ ক’রে, ধার্তরাষ্ট্র ভ্রাতাগণকে দলিত বিমর্দিত নিহত ক’রে সহধর্মিনীর এই অবমাননার শোধ নেয়। তার জন্য প্রলয় আহবের অবতারণা করলেও সেই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কর্ণ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুনকে সাধুবাদ দিতেন।

কিন্তু তৃতীয় পাণ্ডব তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গের ন্যায় শীতল ও অনড় হয়ে রইলেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি অবিচলিত বশ্যতা দেখিয়ে। যদি তাই হয়, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ওঁকে পণ রেখে পাশা নিক্ষেপ ক’রে পরাজিত হয়েছেন, অর্জুনের তখন আর তাঁর নিকট বশ্যতার কোন কারণ ছিল না। তিনি তখন ন্যায়ত দুর্যোধনের দাস। তাঁর বিদ্রোহ প্রভুর বিরুদ্ধে ক্রীতদাসের বিদ্রোহ মাত্র। এবং দাসের প্রতিও অমানবিক পৈশাচিক ব্যবহারের অধিকার প্রভুর নেই। সে বিদ্রোহে কোন পাপ হত না। সর্বোপরি অর্জুন ক্ষত্রিয়—ক্ষাত্রধর্মই হচ্ছে শিশু, নারী, অসহায় দুর্বল শক্তি, অত্যাচারিতকে রক্ষা করা। সে ধর্ম অন্তত রক্ষা হত তখন সংহারমূর্তি ধারণ করলে। সে মৃত্যুমহোৎসবে সম্ভবত ওঁরও মৃত্যু ঘটত, তাতেও দুঃখ বোধ করতেন না কর্ণ।

কিন্তু তা হয় নি। কিছুই করেন নি অর্জুন। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণার আকুল অসহায় মর্মভেদী ক্রন্দনে–যে ক্রন্দন ও বিলাপের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু প্রতিটি শব্দ কর্ণর বক্ষে মৃত্যুর অধিক বেজেছে, যাতে পাষণ্ড কপটাচারী ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত বিচলিত হয়েছেন—পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর বলে খ্যাত অর্জুনের বুকে তা কোন তরঙ্গ জাগাতে সক্ষম হয় নি।

না, কিছুই করেন নি গাণ্ডীব-ধন্বা, অখিল ভূমণ্ডলের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ও যোদ্ধা অর্জুন।

তখনও না, বনগমনের সময়ের দুর্যোধন, দুঃশাসন ও কর্ণর বর্বরাধিক ঘৃণ্য আচরণে বা ব্যঙ্গোক্তিতেও না। এমন কি, অঙ্গাধিপতি শুনেছেন—মৎস্যরাজগৃহে পাঞ্চালী যখন রাজশ্যালক শক্তিমদমত্ত কীচক কর্তৃক নিগৃহীতা হয়েছিলেন, তখন ভীম ছদ্ম পরিচয় ব্যক্ত হওয়ার মহাদাশঙ্কা পরিহার ক’রে সে নিগ্রহের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু নপুংসকবেশী নপুংসকচিত্ত অর্জুন তখনও নির্বিকার অনুৎকণ্ঠিত চিত্তে সম্ভবত অসমৃতবসনা অন্তঃপুরিকাদের নৃত্যশিক্ষা দিয়ে চলেছেন

সেইদিন সেই লজ্জাজনক সংবাদ পাওয়ার দিন থেকেই কর্ণ অর্জুন নিধনে দৃঢ়-সঙ্কল্প। তিনি যে কোনদিন প্ৰকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পেলেন না, সে অবিচার—ভাগ্যেরই বঞ্চনা বোধে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন—কিন্তু কৃষ্ণার সম্বন্ধে এই ঔদাসীন্য, তার প্রতি এই ব্যবহার মার্জনা করতে প্রস্তুত নন।

সেই হিসাব চুক্তি করার দিন আজ এসেছে।

সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার দিন।

এতদিন পরে নিয়তির পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ, ইন্দ্রিয়গোচরীভূত হয়েছে। কাল পর্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন কর্ণ—যে-কোন প্রকারে হোক অর্জুনকে বধ করবেন, অন্তত আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। পাণ্ডবজননীর কাছে তিনি অবশিষ্ট চার অনুজের প্রাণরক্ষা সম্বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধনঞ্জয় সম্বন্ধে তেমন কোন আশ্বাস দেন নি। সেদিক থেকে বিবেকের কাছেও তিনি মুক্ত।

কিন্তু কাল রাত্রিতে তাঁর এই জীবনেই যেন এক জন্মান্তর ঘটে গেছে। সঙ্কল্প কল্পনা সব বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। যেন এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে বহুদিনের সযত্নরচিত প্রাসাদ চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। বিচিত্রবুদ্ধির বিচিত্র সংবাদ তাঁর মনোজগতে বিচিত্রতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

কৃষ্ণা ভীতা, সম্ভাব্য বৈধব্যের চিন্তায় আর্ত। তাঁর সেই যুগল পদ্মপলাশনেত্রে অশ্রুর বন্যা জেগেছে, ঘন পদ্মের নিবিড় কৃষ্ণ প্রাচীর প্লাবিত ভগ্ন ক’রে প্লাবন নেমেছে— সুচারু কপোলে, রাজহংসী-বিনিন্দিত কণ্ঠে আর সেই উর্বশীরও- ঈর্ষা-জাগ্রতকারী বক্ষে। কল্পনায় সেই অশ্রুর প্রতিটি বিন্দুকে অনুসরণ করেছে কর্ণর মন, সে অশ্রু-উৎসের ব্যথায় নিপীড়িত নিষ্পেষিত হয়েছে।

প্রায় অবিশ্বাস্য সম্ভাবনাতেই এতটা কাতর হয়েছেন কৃষ্ণা, সত্য সত্যই বৈধব্য ঘটলে—

শিহরিত হয়ে উঠলেন কর্ণ। কিছুক্ষণের মতো যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল সে চিত্র কল্পনা ক’রে। মনে হ’ল কে যেন বজ্রকঠিন হস্তে উত্তপ্ত লৌহশলাকায় তাঁর হৃৎপিণ্ড উৎপাটিত করতে চাইছে।

না, সে তিনি পারবেন না। তিনি অন্তত পারবেন না কৃষ্ণার বৈধব্য ঘটাতে। সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।

‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো কৃষ্ণা’, মনে মনে বললেন মহাবীর ও মহানহৃদয় কর্ণ, ‘তোমার ললাটের সিন্দূর-বিন্দু চিরদিন অক্ষয় ভাস্বর থাক! মণিবন্ধের ঐ অলঙ্কার অনন্তকাল চিরায়তীর গৌরব বহন করুক। তোমার মুখশ্রী থাক অম্লান, চির- উজ্জ্বল, তোমার দৃষ্টি থাক চিরপ্রসন্ন। হতভাগ্য কর্ণ চিরদিন চিরবঞ্চিতের দলেই আছে, চিরকালই থাক। তার ব্যথা, তার আচরণের আপাত-দুর্বোধ্য গোপন অব্যক্ত কারণ— তার সমস্ত ব্যর্থতা সমস্ত বঞ্চনার ইতিহাস তার সঙ্গে চিতাভস্ম বিলীন হয়ে যাক। সে ইতিহাস না কোন দিন তোমার ঐ আনন্দিত সুখ-প্রসন্ন চোখে বিষাদবাষ্পর কারণ ঘটায়। কর্ণর দুর্ভাগ্য কর্ণরই থাক। অর্জুন থাকুন চিরবিজয়ী, চিরগৌরবের অধিকারী। তাতে আজ আর কোন ক্ষোভ বোধ হচ্ছে না। তুমি দুর্ভাগা কর্ণকে ক্ষমা করেছ—পরাজয়ের মধ্যেও এইটুকুই তাকে গৌরবমুকুটে ভূষিত করুক, তার অনন্ত পথযাত্রার পাথেয় হোক।’

এতটা চিন্তা করেছেন কর্ণ, মন এক অতীতের বিস্মৃতলোকে চলে গিয়ে যেন স্বপ্নের মধ্যে অল্প সময়ে তাঁর দীর্ঘ জীবনের চলচ্চিত্র দেখছিল এতক্ষণ, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুমাত্র ছিল না, অকস্মাৎই সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হ’ল–রূঢ় বাস্তবে নেমে এলেন,–সেই কঠোর একটা আঘাতে নিদ্রোখিতের মতোই সচকিত হয়ে উঠলেন।

সে আঘাত এল তাঁর মহামান্য সারথির নিকট থেকেই—শল্যরই বিদ্রুপশল্যে বাস্তব অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন কর্ণ।

‘কী সূতপুত্র, মৃত্যুভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লে নাকি?…তা বেশী বিলম্ব আর নেই। মৃতারোহী অশ্ব আর পরিচালকহীন সৈন্যবাহিনী—এরা দ্রুত পলায়নের পথ দেখবে এই তো স্বাভাবিক। তুমি এদিকে বিহ্বল চিত্তে পলায়নের স্বপ্ন দেখছ, ওদিকে কৌরবপক্ষ মহাকালের দ্রংষ্টার স্পর্শ পাচ্ছে। যুদ্ধশেষের আর স্বল্পই বিলম্ব আছে, মনে হচ্ছে অদ্যই কুরুক্ষেত্র ভূমি মহাশ্মশানে পরিণত হবে, সেখানে সর্বাত্মক মৃত্যুর নীরবতা নেমে আসবে।’

বিলম্ব নেই তা কর্ণও জানেন। তিনিও নিহত হবেন—এ পরিণাম সম্ভাবনা মাত্র ছিল কিছুকাল পূর্বে, তখন ভেবে রেখেছিলেন অর্জুননিধনের পরই তিনি স্বীয় রাজ্যে ফিরে যাবেন, অতঃপর দুর্যোধন জয়লাভ করুন বা না করুন, সে তিনি বুঝবেন, কর্ণর কোন দায়িত্ব থাকবে না। উনি চিরদিনের মতো অস্ত্রত্যাগ ক’রে অবশিষ্ট জীবন ভ্রাতৃবধের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। কিন্তু এখন তো তিনি পরাজয় বরণের জন্যই কৃতসঙ্কল্প।

তাই তিনি সস্মিত হাস্যে প্রশ্ন করলেন, ‘এর অর্থ?’

অর্থ যা, তাও জানাতে বিলম্ব হ’ল না শল্যর।

দুটি মর্মঘাতী দুঃসংবাদ দিলেন তিনি।

কুরুবংশের অনিবার্য ধ্বংসরূপ চরম পরিণাম যে আসন্ন এ তারই উপক্রমণিকা।

ভীম আহত ক্ষতবিক্ষত রথঅশ্বহীন ভূপাতিত দুঃশাসনের কণ্ঠ সবলে পদদলিত ক’রে শাণিত কৃপাণে তার বক্ষ বিদীর্ণ করেছেন এবং অঞ্জলি ভরে সেই রক্ত পান ক’রে উন্মাদের মতো আনন্দে নৃত্য করেছেন। অতঃপর তার মস্তক ছেদন ক’রে কণ্ঠের শোণিত লেহন করতে করতে বলেছেন, ‘এতদিনে নিরপরাধিনী একবস্ত্রপরিহিতা রজস্বলা দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, প্রকাশ্যে সভামধ্যে বস্ত্রহরণের অবমাননার পরিশোধ হ’ল। আজ আমার কাছে স্তন্য, মধু, ঘৃত, বিশুদ্ধ মাধ্বী সুরা, দুগ্ধ, দধি প্রভৃতি যাবতীয় দিব্য পানীয় অপেক্ষাও এই রক্ত সুস্বাদু বোধ হচ্ছে।’

এই ভয়ঙ্কর ও রাক্ষসীয় দৃশ্য দেখে অশ্বত্থামা সাশ্রুলোচনে দুর্যোধনের কর ধারণ ক’রে বলেছেন, ‘বন্ধু, এখনও সময় আছে, এই সর্বনাশা যুদ্ধ বন্ধ করো। তুমি অনুরোধ করলেই যুধিষ্ঠির সম্মত হবেন, এখনো যে কয়জন আত্মীয় সুহৃৎ পুত্র ভ্রাতা আছে তাদের নিয়ে শান্তিতে না হোক নিরাপদেই সুখে রাজত্ব করতে পারবে। আমি জানি কর্ণরও কিছুমাত্র রুচি নেই এ যুদ্ধে, সে বিনাপ্রতিবাদে অঙ্গদেশে প্রত্যাগমন করবে। এখনও সুযোগ আছে কুরুবংশের পিণ্ডরক্ষা করার।‘

দুর্যোধনও আকুল হয়ে রোদন করছিলেন, তবু তার মধ্যেও বললেন, ‘বন্ধু, অবসর আর নেই। তুমি ভীমের এই বাক্যগুলি শুনলে না? ওরা সেদিনের সে অবমাননা ভোলে নি, তার শোধ না ওঠা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না। আর আমারও জীবনে বিন্দুমাত্র রুচি নেই। নির্বান্ধব জীবনটার জন্য শান্তি ভিক্ষা করতে পারব না।’

এই সংবাদই কর্ণর বিহ্বলতা অপনোদনের পক্ষে যথেষ্ট—কিন্তু আরও একটি বিশেষ সংবাদ তখনও দেন নি শল্য। অতঃপর সেই সর্বশেষ শেলাঘাতটি করলেন।

কর্ণর পুত্র বৃষসেন এইমাত্র অর্জুনের হস্তে নিহত হয়েছেন।

১৭

আঘাতটা সহ্য ক’রে সচেতন ও সক্রিয় করে উঠতে কয়েক পল সময় লাগল বৈকি! তার পরই কর্ণর মুখ কেমন একপ্রকার কৌতুক-হাস্যরঞ্জিত হয়ে উঠল। শল্য সে- হাস্যের অর্থ অনুধাবন করতে পারলেন না, পারার কোন কারণ ও নেই, তিনি এটাকে মর্মান্তিক দুঃসংবাদে সাময়িক মস্তিষ্ক-বিকৃতি বোধ ক’রে ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। কর্ণ যে কিছু পূর্বে মৃত্যুবরণের জন্যই দৃঢ়সঙ্কল্প হয়েছেন এবং এ সংবাদ যে সেই ইচ্ছারই পরিপোষক—তা শল্য জানবেন কেমন ক’রে? বিধাতা যে কর্ণর এ সঙ্কল্প অনুমোদন করেছেন, ভাগ্য যে এই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যুর দণ্ডাদেশ স্বাক্ষর করেছেন—এ তো তারই সঙ্কেত মাত্র। পৃথিবীর বন্ধন একে একে শিথিল হচ্ছে, এ জীবনের মমতাবন্ধন জীর্ণ হতে জীর্ণতর হচ্ছে। বাঁচার ইচ্ছা থাকলে—যতই সাময়িক আবেগে ‘শত্রুবধ করবেন না’ এই প্রতিজ্ঞা করুন, যথাস্থানে নিজের শিক্ষা ও আয়ত্ত-অস্ত্ৰ তার কাজ ক’রে যাবে। সেই ইচ্ছাই আর রইল না।

সকল মানবের শ্রেষ্ঠ আশ্রয় ও সহায় জননী তাঁর জন্মকালের মহাশত্রু, শস্ত্রগুরু ভার্গব তাঁর একান্ত গুরুপ্রীতির জন্য সাংঘাতিক অভিসম্পাত-রূপ পুরস্কারদাতা, চরম সঙ্কটকালে কর্ণ সে জ্ঞান বিস্মৃত হবেন এই কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন একমাত্র যে নারী তাঁর জীবন সার্থক করতে পারত সে প্রথম যৌবনেই তার দেব-ইচ্ছায়-জন্ম-গৌরব, রাজবংশীয়া-ক্ষত্রিয়বংশীয়ার সম্মান বিস্মৃত হয়ে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ক’রে সমস্ত জীবন ব্যর্থ, মরুভূমি ক’রে দিল। জীবন সম্বন্ধে বন্ধন, আসক্তি, ঈপ্সা জন্মমুহূর্ত থেকেই ক্ষয় হচ্ছে। তবু আত্মজ, সন্তান, উত্তরাধিকারী সম্বন্ধে যে মমতা ও আশা থাকতে পারত তাও এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ নির্মল হ’ল। বিধাতা ও তাঁর ইষ্টদেবতা জীবনপ্রভাতেই সর্বনাশের পথ প্রশস্ত ক’রে দিয়েছিলেন—এবার ভাগ্য এই জীবন-সায়াহ্নে মৃত্যুর পথ প্রশস্ত ক’রে দিলেন।

কর্ণর এ তিক্তকৌতুক-হাস্য সেই কারণেই। ভাগ্যের কি ব্যগ্রতা তাঁকে অপসারণের জন্য! বলিহারি!

নিজের এই প্রবলতম মানসিক ঝঞ্ঝার মধ্যেও শল্যর ভ্রূকুটি তাঁর দৃষ্টি এড়ায় নি। তিনি বললেন, ‘না, জীবনে বহু দুঃখ সহ্য করেছি মদ্ররাজ, বহু দুঃসহ আঘাত। আজ এই সামান্য সংবাদে আমার জ্ঞানলোপ পাবে এমন আশঙ্কা করবেন না। আপনি এবার রথ দ্রুত অর্জুনের কাছে নিয়ে চলুন। আপনার অনুমান অভ্রান্ত, যুদ্ধশেষের আর অধিক বিলম্ব নেই, আজ সূর্যাস্তের পূর্বেই হয় আমি না হয় অর্জুন ইহলোক ত্যাগ করবে।’ তারপর শল্য অশ্বচালনা আরম্ভ করলে আবারও মৃদু তিক্তহাস্যে বললেন, ‘আমি ভাবাবেগ-প্রাবল্যে, বিভিন্ন পরস্পর-বিরোধী চিন্তায় মনে মনে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি তা সত্য, তবে বিহ্বল হই নি, আমার মস্তিষ্কের সহজ চিন্তাপ্রক্রিয়াও নষ্ট হয় নি। কিছু পূর্বে যে আপনি ভাগিনেয় যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার জন্যই আমাকে সদুপদেশ দিয়েছিলেন, তা অনুভব করতে আমার অসুবিধা হয় নি, তথাপি আমি যে আপনার পরামর্শই গ্রহণ করেছিলাম তার কারণ যুধিষ্ঠিরকে বধ করার বা বন্দী করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না বলেই।’

শল্যর মতো রূঢ়ভাষী ও কর্ণশক্তিনাশে বদ্ধপরিকর ব্যক্তিও লজ্জিত হলেন, ক্ষণকালের জন্য মস্তকও অবনত করতে হ’ল তাঁকে।

কথাটা স্মরণ আছে বৈকি।

যুদ্ধারম্ভে যথারীতি সংশপ্তকরা তাদের রণকৌশল-অনুযায়ী অর্জুনকে অন্যত্র ব্যস্ত ও ব্যাপৃত রাখছে দেখে দুর্যোধনও তাঁর অনুগত দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার একবার প্রায়-অন্তিম চেষ্টা করলেন। প্রথম ধর্মরাজকে প্রচণ্ড আক্রমণে আহত ও বিপর্যস্ত করলেন অশ্বত্থামা। তাঁকে বিপন্ন দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাণ্ডব-পক্ষীয় বীরগণ তাঁর রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন কিন্তু অশ্বত্থামার বিক্রমে তাঁরাও যথেষ্ট সুবিধা করতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির অশ্বত্থামার তেজ সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণের জন্য রণস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

তবে সে বেশীক্ষণ নয়। ক্রদ্ধ ধৃষ্টদ্যুম্নে একা দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁর সে আক্রমণে কুরুরাজের রথ নষ্ট হয়ে গেল দেখে কর্ণ সিংহবিক্রমে এসে ধৃষ্টদ্যুম্নের সম্মুখীন হলেন, তাঁর প্রচণ্ড শক্তিতে পাঞ্চাল সৈন্যদের সিংহের সামনে মৃগযূথের মতো দুর্দশা হ’ল ওদিকে ভীমসেন একাই বাহীল্ক কেকয় মদ্র ও সিন্ধু দেশের মিলিত বিপুল বাহিনীর সঙ্গে তখন যুদ্ধ করছেন, তাঁর পক্ষে ধৃষ্টদ্যুম্নের রক্ষার্থ আসা সম্ভব নয়। এই দুরবস্থার সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির দ্রাবিড় ও অন্ধ্র দেশের নৃপতিবৃন্দ এবং নিজেদের পঞ্চপুত্র, নকুল সহদেব সাত্যকি প্রভৃতি বীরগণ পরিবৃত হয়ে পুনশ্চ রণক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমিতে অবতীর্ণপূর্বক কর্ণকে আক্রমণ করলেন।

কার্য বা প্রচেষ্টাটা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে দুঃসাহসিক তাতে সন্দেহ নেই, বোধ করি একটু নির্বুদ্ধিতার পরিচায়কও। বহুদূর থেকেও অবস্থা লক্ষ্য ক’রে অর্জুন এদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন কিন্তু প্রবল বাধা পেলেন গুরুপুত্র অশ্বত্থামার কাছে। বোধ হয় গুরুপুত্র বলেই অশ্বত্থামার প্রতি প্রথমটায় যথেষ্ট শক্তি প্রয়োগ করেন নি অর্জুন, শেষে বাসুদেবের তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ- কশাঘাতে সচেতন হয়ে উঠলেন, এবং উপর্যুপরি কয়েকটি ভল্লের আঘাতে তাঁর রথ ও অস্ত্রবাহী শকট নষ্ট করলেন। অশ্বত্থামাও অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। সারথি তাঁর প্রাণনাশের সম্ভাবনা দেখে সেই সংজ্ঞাহীন দেহ বহন ক’রে পলায়ন করল।

অশ্বত্থামা-রূপ বাধা অপসারিত হ’ল বটে, তবে ইতিমধ্যে বহু সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তখন আর যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না, কারণ তার মধ্যেই তিনি রণস্থল ত্যাগ করেছেন—পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছেন বলাই উচিত।

ঘটনাটা এই।

যুধিষ্ঠির তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছেন দেখে কর্ণ প্রথমটায় হাস্য সম্বরণ করতে পারেন নি। তবে ধর্মরাজ যতই রণ-অপটু হোন, তাঁর পক্ষীয় বীরগণ উপেক্ষীয় নন। কিন্তু ইতিমধ্যে দুর্যোধন প্রভৃতি কৌরব বীরগণ এসে কর্ণর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য কোন প্রকারে যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করা। বিপদ বুঝে ভীম ওদিক থেকে এসে পড়লেন, নকুল সহদেব ও স্বপক্ষীয় যোদ্ধাগণকে সংহত ক’রে যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টন ক’রে রইলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই কর্ণর প্রচণ্ড তেজ সহ্য করতে পারলেন না, তিনি মায়াবীর মতো দৃষ্টিশক্তি সীমার অতীত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অস্ত্র বর্ষণ করতে লাগলেন। পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যরা হাহাকার ও আর্তনাদ করতে করতে চতুর্দিকে ধাবিত হ’ল। অতঃপর কর্ণ ভল্লের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের বক্ষ বিদ্ধ করলেন, সে আঘাতে দুঃসহ যন্ত্রণায় তাঁর মুষ্ঠি শিথিল হয়ে ধনুক পড়ে গেল, তিনি মূর্ছিতের ন্যায় রথে বসে পড়ে সারথিকে পশ্চাদপসরণের ইঙ্গিত করলেন।

সুযোগ বুঝে দুর্যোধনের দল বন্দী করার জন্য তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করবে এ স্বাভাবিক। বাধা দেবার লোকও বিশেষ নেই, কতিপয় পাঞ্চাল যোদ্ধা ছাড়া। সাংঘাতিক বিপদ আসন্ন দেখে নকুল সহদেব কোনমতে তাঁর দুই দিক রক্ষা ক’রে দ্রুত শিবির প্রত্যাগমনের চেষ্টা করতে লাগলেন।

কর্ণও চক্রপথে এসে তাঁর পথ রোধ ক’রে আবারও যুধিষ্ঠিরকে শরাহত করলেন। নকুল সহদেব তাঁদের ক্ষীণ শক্তির সর্বাত্মক প্রয়োগে কর্ণকে আহত করলেন বটে তবে তাতে কর্ণর শক্তি হ্রাস পেল না অণুমাত্রও, পরন্তু তিনি পুনশ্চ ভল্লাঘাতে যুধিষ্ঠিরকে আহত ও তাঁর শিরস্ত্রাণ নষ্ট করলেন। নকুল ও যুধিষ্ঠির দুজনেরই রথাশ্ব নিহত হ’ল— তাঁরা এসে সহদেবের রথে আশ্রয় নিলেন।

পাণ্ডবপক্ষের সর্বনাশ আসন্ন বুঝে শল্য কর্ণকে বললেন, ‘সূতপুত্র, তোমার দেখছি আপৎকালে বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে। তুমি অর্জুনকে সন্ধান না করে নিরীহ গোবেচারী যুধিষ্ঠিরের জন্য অযথা শক্তিনাশ, অস্ত্রনাশ ও কালক্ষয় করছ কেন? এর পর কি শ্রান্ত দেহে অর্জুনের সম্মুখীন হবে? দেখ, দুর্যোধন অর্জুন-বধের জন্যই বেশী ব্যগ্র, সেই জন্যই তোমাকে সযত্নে পোষণ ও তোষণ করছেন। অর্জুন যদি জীবিত থাকেন যুধিষ্ঠিরকে বধ ক’রে তাঁর কি ইষ্টলাভ হবে? ঐ দ্যাখো, ভীমসেন দুর্যোধনের প্রাণনাশে উদ্যত হয়েছেন। আগে তাঁকে রক্ষা করবে চলো।’

এ কথা বলতে বলতেই তিনি কর্ণর রথাশ্ব অন্য দিকে চালিত করেছিলেন, যাতে সেই অবসরে যুধিষ্ঠির নিজ শিবিরের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে পারেন।

কর্ণ তাঁর অভিপ্রায় বুঝেও বাধা দেন নি। শুধু সামান্য একটি হাস্যরেখা তাঁর অধরপ্রান্তকে বঙ্কিম ক’রে তুলেছিল। গর্ভধারিণীকে প্রদত্ত আশ্বাসবাক্য তিনি বিস্মৃত হন নি।

পুত্রশোকার্ত কর্ণ তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন।

তিনি যে এবার এক চূড়ান্ত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন তা শ্রীকৃষ্ণ অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাই অর্জুন যখন রণক্ষেত্রের কুত্রাপি যুধিষ্ঠিরের ধ্বজপতাকা না দেখতে পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে ক্ষণকালের জন্য শিবিরে প্রত্যাবৃত্ত হলেন তখন তিনি নিজের সারথি দারুককে দিয়ে নূতন ব্যাঘ্রচর্মাবৃত রথে তাঁর নিজস্ব ইরম্মদগতি অশ্বচতুষ্টয় যোজনা ক’রে সেই রথেই অর্জুনের কপিধ্বজপতাকা ও অস্ত্রাদি স্থানান্তরিত করিয়েছিলেন—অর্থাৎ অর্জুন সূর্যোদয়-আভাসে প্রভাতকালীন নব যুদ্ধ- সজ্জার মতোই নবীন উদ্যমে এই চিরকালীন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতে চললেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অকল্পনীয় ইতিহাসে নূতন এক অভূতপূর্ব অধ্যায় সংযোজিত হতে চলেছে বুঝে যোদ্ধারা যেন নিজ বিপদের কথাও বিস্মৃত হয়ে উদগ্রীব ভাবে সে যুদ্ধ দেখতে লাগলেন মনে হ’ল যেন ইন্দ্র-বৃত্রাসুর যুদ্ধে যেমন দুই পক্ষের সমর্থক স্বর্গ-মর্ত্য- রসাতলের সমস্ত অধিবাসীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সে যুদ্ধ দর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন—আজও তেমনি তাঁরা অন্তরীক্ষে এসে রুদ্ধনিঃশ্বাসে এ যুদ্ধ দেখছেন।

এই দ্বৈরথ যুদ্ধে প্রথম দিকে কর্ণ প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন। সে আক্রমণে পাণ্ডবপক্ষের বহু যোদ্ধা ও পদাতিক সৈন্য হতাহত হল, এমন কি অর্জুনও দেহের বহুস্থানে শরবিদ্ধ হলেন। কর্ণর এই তেজে ও ক্ষিপ্রতায় ভীম বিরক্ত হয়ে অর্জুনকে বললেন, ‘কর্ণ তোমাকে আহত করল, তুমি এখনও কিছুই করতে পারলে না? তুমি যদি ক্লান্ত হয়ে থাকো তো বল, আমিই গদাঘাতে তাকে বধ করি।’

শ্রীকৃষ্ণও বললেন, ‘অর্জুন, তোমার সকল সাংঘাতিক অস্ত্রই অঙ্গাধিপতি অনায়াসে প্রতিহত করছেন, তুমি কি আজ মোহগ্রস্ত হলে? না দুর্বলতা বোধ করছ? কৌরবদের মুহুর্মুহু উল্লাসধ্বনিও কি তোমার কর্ণগোচর হচ্ছে না? তুমি যদি না পারো তো বল আমিই সুদর্শন চক্রান্ত্র প্রয়োগ করি!

অর্জুন ক্ষুব্ধ ও ক্রব্ধ হয়ে—ইতিপূর্বে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র কর্ণ পরশুরামদত্ত অস্ত্রে নষ্ট করেছিলেন তা দেখেও—আর এক ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন, সেও যখন কর্ণের অস্ত্রে প্রতিহত হ’ল, তখন তিনি পুনশ্চ এক মহাশক্তিশালী বহুনাশা ব্ৰাহ্ম অস্ত্র ত্যাগ করলেন, প্রজ্বলন্ত উল্কার মতো সে অস্ত্র থেকে অসংখ্য অস্ত্র বহির্গত হয়ে অগণিত শত্রুসৈন্য বধ করল।

কিন্তু এই সময়ই এক দুর্ঘটনা ঘটল। ক্রোধ থেকে সতর্কতাবুদ্ধি বিনষ্ট হয়, অর্জুনও এমন ভাবে বার বার সবলে গাণ্ডীবধনু আকর্ষণ করতে লাগলেন যে এক সময় তাঁর জ্যা বা তন্ত্রী ছিন্ন হয়ে গেল। এবং সেই সুযোগে, নূতন জ্যা রোপণ করার অবসরে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে কর্ণ অসংখ্য শায়কে ক্ষতবিক্ষত ক’রে দিলেন। কৃষ্ণার্জুন নিহত হয়েছেন মনে ক’রে দূরস্থিত কৌরবপক্ষীয় দর্শকরা উল্লাসে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে লাগল।

তবে সে ভ্রম দূর হ’তেও অধিক বিলম্ব ঘটল না। অর্জুন গাণ্ডীবে নূতন জ্যা সংযোজিত ক’রে পুনশ্চ এতাদৃশ ক্ষিপ্রহস্তে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন যে, সেই শায়কে আচ্ছন্ন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বলে বোধ হতে লাগল। সারথি শল্য আহত হলেন এবং কর্ণর চক্ররক্ষক পাদরক্ষক অগ্র ও পৃষ্ঠরক্ষক বীরগণ সকলেই নিহত হয়ে রণভূমি আশ্রয় করলেন।

সেই সময় আর এক নাটক ঘটল।

নাগরাজ তক্ষকের পুত্র অশ্বসেন—যাঁর মাতা খাণ্ডবদাহের সময় অর্জুনের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি মাতৃবধের প্রতিশোধকল্পে কর্ণের অলক্ষ্যে নাগদেশের সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক অস্ত্র ওঁর তূণীরে রক্ষা করলেন এবং কর্ণ না দেখেই যখন অভ্যস্ত হস্তে পশ্চাদস্থ তূণীর থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করছিলেন তখন এক সময় সে অস্ত্র তার হাতে ধরিয়েও দিলেন।

সে অস্ত্রের শক্তি অপর কেউ না হোক শ্রীকৃষ্ণ অবগত ছিলেন। দূর থেকে কর্ণ তা নিক্ষেপ করছেন দেখে তিনি অনন্যোপায় হয়ে আশ্চর্য কৌশলে অশ্বগুলিকে জানু সংকোচন করিয়ে বসিয়ে দিলেন এবং তাঁর অমানুষিক শক্তিতে পায়ের চাপেই রথের চক্রগুলি এক বিঘৎ পরিমাণ মাটিতে বসে গেল। ফলে অস্ত্র এসে অর্জুনের বিখ্যাত মণিময় স্বর্ণকিরীট দগ্ধ করল বটে, তাঁকে নিহত বা আহত করতেও পারল না।

এ কোন অস্ত্র? কর্ণ বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখতেই চোখে পড়ল, গর্বিত-হাস্যমুখ অশ্বসেন। তিনি এবারে নিজের কৃতিত্ব জানিয়ে যেন আশ্বাস দিয়েই বললেন,’হতাশ হবার কারণ নেই, আমার আর এক অস্ত্র দিচ্ছি, এতেই নিশ্চয় অর্জুনকে বধ করতে পারবে!

কর্ণ বললেন, ‘তোমার প্রয়াসের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যদি আমার অস্ত্রবলে অর্জুনকে পরাভূত বা বধ করতে না পারি—তাকে বধ করার কোন প্রয়োজন নেই। অপরের সাহায্যে যুদ্ধ করার থেকে তার কাছে পরাস্ত হওয়াও বাঞ্ছনীয়। সে আমার সহযোদ্ধা। তুমি কে? তুমি তো তার ভয়ে ভীত হয়ে অপরের সাহায্য নিতে এসেছ। তুমি তোমার স্বস্থানে প্রত্যাগমন কর, তোমার কল্যাণ হোক!’

অশ্বসেন কর্ণর এই নির্বুদ্ধিতায় হতাশ হয়ে দুই স্কন্ধের এক বিচিত্র ভঙ্গি ক’রে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার চেষ্টা দেখলেন। অধিক বিলম্ব হলে অর্জুনের হাতেই নিহত হবার ভয় আছে—এ তিনি জানতেন। ওঁর ঐ সারথিটা সর্বজ্ঞ, তাঁকে চিহ্নিত ক’রে দিতে কতক্ষণ?… আর তাই হ’ল—শ্রীকৃষ্ণ সংক্ষেপে ওঁর ধূর্ততা ও শত্রুতার কথা বিবৃত ক’রে অঙ্গুলিনির্দেশে অশ্বসেনকে দেখিয়ে দিলেন–অর্জুনও তাঁকে নিমেষপাতমাত্রে বধ করলেন। সেই অবসরে শ্রীকৃষ্ণ একাই সুরাসুরেরও বিস্ময়কর শক্তিতে রথের চাকা ধরে রথকে আবার উপরে উঠিয়ে নিলেন।

এইবার অর্জুন যেন বিজয়লক্ষ্মীকে নিজের শক্তিবলে পাণ্ডবপক্ষে আকর্ষণ করলেন। তড়িৎ- ত্বরিত গতিতে কর্ণকে ঘটনাটা বুঝবার অবকাশ না দিয়ে—অসংখ্য শরাঘাতে অর্জুন তাঁর কিরীট, বর্ম প্রভৃতি খণ্ড-বিখণ্ড ক’রে ফেললেন এবং

কর্ণকে সাংঘাতিক ভাবে আহত করলেন। কর্ণ সে আঘাতে ক্ষণকালের জন্য মর্মান্তিক বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়লেন, তাঁর বিমূঢ়-অবশ হাত থেকে ধনু খসে পড়ল। তিনি স্বীয় বক্ষস্থল দুই হাতে চেপে ধরে মদ্যপের ন্যায় টলতে লাগলেন । তাঁর যে অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে, জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো কম্পিত হতে দেখেই তা বোঝা গেল।

অর্জুন স্বভাবতই তাঁর এই অবস্থা দেখে ক্ষণকালের জন্য পুনরাঘাত থেকে বিরত হলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ জানেন, এই মহাধনুর্ধর যোদ্ধার শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় নি। তিনি অর্জুনকে তাড়না করলেন,’ফাল্গুনী, এ কি করছ? তোমার কি মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল? প্রবল বিপক্ষ ক্ষণকালের জন্য দুর্বল হয়ে পড়লে তাকে শক্তি পুনরুদ্ধারের অবসর দিতে নেই— যুদ্ধবিদ্যার এ প্রাথমিক নীতিও তুমি বিস্মৃত হলে! তুমি এ সুযোগ হেলায় হারিও না, নতুবা কর্ণ কিঞ্চিন্মাত্র সুস্থ হয়ে উঠলেই আবার পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ আরম্ভ করবেন!

অর্জুন বাসুদেবের তিরস্কারে মমতা পরিত্যাগ ক’রে সেই অবস্থাতেই কর্ণর প্রতি পুনঃপুনঃ শরবর্ষণ রতে লাগলেন। কর্ণও মর্মান্তিক আঘাতের তীব্রতা ও বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে পুনশ্চ শরাসন গ্রহন করলেন।

কিন্তু ঠিক সেই সময়েই যেন দৈব পাণ্ডবদের প্রতি প্রসন্ন হওয়াতেই আর এক ঘটনা ঘটল। কর্ণের বামদিকের রথচক্র অকস্মাৎ ভূমিতে প্রোথিত হয়ে গেল। কর্ণর মনে পড়ল এক ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ‘কাল পূর্ণ হলে অন্তিম যুদ্ধে তোমার রথচক্র ভূপ্রবিষ্ট হবে, তুমি রথী অবস্থায় আর যুদ্ধ করতে পারবে না।’

আর, সে কথা স্মরণের সঙ্গে সঙ্গেই আর একটি অভিশাপও স্মৃতিপথে দেখা দিল, গুরু ভার্গবের অভিশাপ—অন্যায় অভিশাপ, এখনও কর্ণের তাই ধারণা—’তুমি আমার কাছে প্রকৃত পরিচয় গোপন ক’রে যে অস্ত্র লাভ করেছ, সর্বাপেক্ষা সংকটকালে সে অস্ত্রসমূহের একটিও তোমার স্মরণ থাকবে না।’

রথচক্র ভূমিপ্রবিষ্ঠ হ’ল—তবে কি তাঁর কাল পূর্ণ হয়েছে? মৃত্যুকাল সমাগত? তবে কি এতকাল সযত্নে যেসব অস্ত্র সংরক্ষণ করেছেন অর্জুনবধের জন্য—তা আর তিনি স্মরণ করতে পারবেন না।’

এই সম্ভাবনার চিন্তাতেই—মৃত্যুর আশঙ্কা নয়—পরাজিত ও অপমানিত হওয়ার আশঙ্কাতেই তিনি যেন অস্থির হয়ে উঠলেন, লম্ভ দিয়ে রথ থেকে নেমে খড়্গা হস্তে অর্জুনের দিকে ধাবিত হতে গেলেন—

আর ঠিক সেই মুহূর্তে, তাঁর মানসদৃষ্টির সম্মুখে স্পষ্ট উজ্জ্বল ভাবে ফুটে উঠল, সুরনরবন্দিতা সর্বজন-ঈপ্সিতা এক অনন্যা নারীমূর্তি—সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী—তাঁর দুই আশ্চর্য চক্ষুতে বাষ্পবারি টলমল করছে, তাঁর সেই বোধ-করি তপস্বীশ্রেষ্ঠ-মহাদেবেরও-মোহ আনয়নকারী দৃষ্টিতে করুণ মিনতি ।

না না, এ কি করছেন তিনি!

তিনি তো মৃত্যুবরণের জন্যই সঙ্কল্পবদ্ধ।

অসি ত্যাগ ক’রে সেই ভূপ্রাণেথিত রথচক্রেই পৃষ্ঠ সংরক্ষণ ক’রে বসে পড়লেন কর্ণ, ইষ্টকে স্মরণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

আবারও হয়ত অর্জুন দ্ধিধাগ্রস্ত হতেন। বোধ করি সেটা লক্ষ করেই কর্ণ অর্জুনকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ‘তৃতীয় পাণ্ডব, তোমাকে তো বীর বলেই জানতাম, যথার্থ বীরগণ কখনও দুর্দশাগ্রস্ত বিপক্ষের প্রতি অস্ত্রক্ষেপ করেন না। দেখছ আমার একটি রথচক্র ভূমিগ্রস্থ হয়েছে, তুমি আমাকে তা পুনরুদ্ধারের অবসর না দিয়ে অধর্ম যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে কেন?’

অর্জুনকে সে অনুযোগের উত্তর দেবার অবসর না দিয়েই শ্রীকৃষ্ণের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, ‘কর্ণ, আজ তুমি বিপাকে পড়ে ধর্ম স্মরণ করছ, এতকাল এ ধর্মবুদ্ধি কোথায় ছিল? নীচ ব্যক্তি বিপদে পড়লে দৈবের দোষ দেয়, বিপক্ষের ছিদ্র অন্বেষণ করে—কদাচ নিজ কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে না। তুমি যখন একবস্ত্রা রজস্বলা দৌপদীকে সভাস্থলে আনয়নে অনুমোদন জানিয়েছিলে শকুনি যখন অধর্ম দ্বারা পাণ্ডবদের সর্বস্ব অপহরণ করছিল, নীরবে তা

তাকিয়ে দেখছিলে ও উৎফুল্ল বোধ করছিলে—তখন ধর্মের কথা তোমার স্মরণ হয় নি কেন? যখন তোমার জ্ঞাতসারে দুর্যোধন অসংখ্য অন্যায় আচরণ করেছে তখন তুমি ধর্মের নির্দেশ মান্য ক’রে তাকে ত্যাগ করো নি কেন? তোমরা সপ্তমহারথী মিলে নিরস্ত্র আহত বালক অভিমন্যুকে যখন বধ করেছিলে—তখন তোমার এ ধর্মবুদ্ধি কোথায় ছিল!’

এই অনুযোগে—বিশেষ অভিমন্যুর প্রসঙ্গে—কর্ণ লজ্জায় অধোবদন হলেন।

এ-ই প্রকৃষ্ট অবসর মহাশত্রু নিপাতের। বাসুদেব অর্জুনকে সে ইঙ্গিত করতে ধনঞ্জয় একেবারে অস্বীকৃতির ভঙ্গী প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘নিরস্ত্র শত্রুকে বধ করার জন্য যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা করি নি। বিশেষ কর্ণর মতো যোদ্ধাকে এভাবে বধ করলে ত্রিভুবন আমার অযশ কীর্তন করবে, মনে করবে সম্মুখ ধর্মযুদ্ধে তাকে পরাজিত করতে অক্ষম বলেই অধর্মযুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছি।’ আহত, অবসন্ন, আশাশূন্য মৃত্যুপথযাত্রী কর্ণর সে উত্তর শোনার কোন অসুবিধা ঘটল না। অর্জুন যে সত্যই মহাবীর সে সম্বন্ধে তাঁর সংশয়মাত্র ছিল না। অর্জুন ত্যক্তাস্ত্রবিপক্ষকে কদাচ বধ করবেন না তিনি জানতেন—শ্রীকৃষ্ণর শত তাড়নাতেও না—তাই তিনি সেই অবস্থাতেই ধনু তুলে নিয়ে অর্জুনকে লক্ষ ক’রে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র যোজনা করলেন। তিনি যথার্থ অস্ত্রপ্রয়োগশিল্পী, ইচ্ছাপূর্বক অস্ত্র ব্যর্থ হতে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়—সুতরাং অর্জুন কোন প্রকার বাধা দেবার পূর্বেই সে অস্ত্র তাঁর ওপর এসে পড়ল, তবে বাসুদেবের অতিক্ষিপ্র রথমুখ সঞ্চালনের ফলে তাঁর বক্ষে আঘাত করতে পারল না—বাহুতে বিদ্ধ হ’ল!

আর দ্বিধা ও সংকোচের কারণ রইল না। অর্জুন বজ্রাগ্নি সমতুল্য তেজস্বী এক অস্ত্রে কর্ণর মস্তক ছেদন করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন মনে হ’ল কৌরবপক্ষের সঙ্গে অন্তরীক্ষে, জলে স্থলে সর্বত্র এক হাহাকার ধ্বনিত হ’ল, সে হাহাকার দূর থেকে দূরান্তরে—সুদূর দিগন্তসীমা অতিক্রম ক’রে যেন কোন অমর্ত্যলোক পর্যন্ত প্রসারিত হ’ল, মনে হ’ল স্বয়ং সূর্যদেবও বেদনায় ম্লান হয়ে গেলেন—অর্জুনের মনে হ’ল তাঁর রথের নিচে মেদিনীও কেঁপে উঠল ।

আর তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, এক নিরাকার নির্বস্তু তেজোপিণ্ড কর্ণের কর্তিত দেহ থেকে নির্গত হয়ে মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে উত্থিত হয়ে ক্রমে সূর্যমণ্ডলের জ্যোতিপুঞ্জে বিলীন হ’ল।

হয়ত কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন বলেই তিনি দেখতে পেলেন না, শ্রীকৃষ্ণ নীরবে দক্ষিণ হস্তে আশীর্বাদের মুদ্রা করলেন।

১৮

মহামানী, মহাদাম্ভিক, মহা-ঈর্ষী এবং মহাবলী ধার্তরাষ্ট্র-জ্যেষ্ঠ রাজা দুর্যোধন বিদায় নেবার পূর্বে এক ঈষৎ-উচ্চ মৃত্তিকাস্তূপে আরোহণ ক’রে কুরুক্ষেত্র রণভূমির দিকে তাকালেন—শেষবারের মতো।

এই স্তূপটি থেকেই তিনি যুদ্ধারম্ভের পূর্বদিনে এইভাবে তাকিয়ে দেখেছিলেন। সেদিন গর্বে আনন্দে আশায় বুক ভরে গিয়েছিল। নিজের বাহিনীর বিশালতা ও যোদ্ধাবৃন্দের বীরখ্যাতির বিপুলতায় নিজের জয়লাভ সম্বন্ধে কোন সংশয় ছিল না। সেদিন সম্মুখে ছিল নিজ্ঞাতি-কণ্টক রাজত্বের সুখস্বপ্ন, ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের উচ্চাশা।

আর আজ?

বস্তুত এই মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের অবসান ঘটেছে—তিনি নিজে জীবিত থাকা সত্বেও। অবসান ঘটেছে গত কালই—মহাবীরাগ্রগণ্য কর্ণর মৃত্যুতে। সে সত্য কৌরবপক্ষের স্বল্পাবশিষ্ট যোদ্ধা ও সাধারণ সৈনিকরাও অনুভব করেছিল। তারা—যাঁর কাছে প্রার্থীকে অদেয় কিছুই ছিল না, জীবন ধন মান কিছুই না—দানবীর আশ্রিতবৎসল কপাটবক্ষ কর্ণর পতন-সংবাদ পেয়েই পলায়নতৎপর হয়ে উঠেছিল। দুর্যোধন অনেকানেক বক্তৃতা ক’রে ও নানাবিধ আশ্বাস দিয়ে, তাদের কাপুরুষতাকে ধিক্কার দিয়ে, মৃত্যু যে প্রাণীমাত্রেরই অপরিহার্য পরিণতি সে-কথা স্মরণ করিয়েও— পাণ্ডবদের হাত থেকে কোনক্রমেই তারা নিস্তার পাবে না তা জানিয়ে—তাদের ফেরাতে বা পুনঃসঙ্ঘবদ্ধ করতে পারেন নি। আতঙ্কে উন্মাদ তারা—স্থির হয়ে তাঁর বাক্য শ্রবণ করবে কে?

ক্ষোভে, দুঃখে, অবমাননাবোধে, হতাশায় উন্মত্ত রাজা দুর্যোধন, কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের প্রধান নায়ক, জ্ঞানশূন্যবৎ একাই যুদ্ধ করেছিলেন কিছুক্ষণ, বোধ করি নিজের প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার সঙ্কল্পেই। শেষে মদ্ররাজ শল্য, অশ্বত্থামা প্রভৃতি স্বপক্ষীয় বীরগণের পরামর্শে ও নির্বন্ধ-আতিশয্যে শান্ত হয়ে ভগ্নচিত্তে, ক্ষতবিক্ষত রুধিরাপ্লুত দেহে শিবিরে প্রত্যাবর্তন করতে সম্মত হলেন। এঁরা বুঝিয়ে বললেন, ‘এখন এই নিদারুণ বিভ্রান্তিকর মৃত্যুভয়ের মধ্যে কোন যুক্তি সেনাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করবে না। পরন্তু সন্ধ্যাও সমাগত, এখন শিবিরে ফেরো। বিশ্রামের পর ওরাও পুনশ্চ রণক্ষেত্রে পরস্পর-সান্নিধ্যের-নিরাপত্তায় ফিরে আসবে, তুমিও অবস্থা বুঝে, কী ভাবে যুদ্ধ করবে আদৌ যুদ্ধ করবে কিনা—তখন স্থির করো।’

অগত্যা শিবিরে ফিরেছিলেন দুর্যোধন। তার পূর্বে ‘হা বন্ধু, হা কর্ণ, হা কৌরবসহায়’ বলে বিলাপ করতে করতে একবার কর্ণর কবন্ধ ও ছিন্নমুণ্ডর দিকে দৃষ্টিপাত না ক’রে পারেন নি। তখনও কর্ণর দেহ বা সেই অনিন্দ্য মুখ কিছুমাত্র বিকৃত হয় নি। যেন মৃত্যুমালিন্য বা রক্তশূন্যতাজনিত পাংশু বিবর্ণতা এই যথার্থ যোদ্ধার দেহ স্পর্শ করতে সাহস করে নি। সে দেহ প্রবল ঝটিকা-নিপাতিত পর্বতখণ্ডের ন্যায়, ঝঞ্ঝা-উৎপাটিত সুবিশাল বনস্পতির ন্যায়, যজ্ঞাবসানের অঙ্গারাবশিষ্ট নির্ঘুম অগ্নির ন্যায়, অস্তগতভাস্করবিম্বের ন্যায় শোভমান।

একবার মাত্র এই মহান করুণ দৃশ্যের দিকে চেয়েই দুর্যোধন একটি অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করলেন। ইচ্ছা হ’ল ইতর ব্যক্তিদের মতো ভূলুণ্ঠিত হয়ে হাহাকার-রবে ক্রন্দন করেন। তিনি ললাটে করাঘাত করতে করতে একবার পশ্চিম দিগন্তের দিকে চেয়ে দেখলেন। মনে হ’ল ভগবান সূর্য তাঁর রক্তবর্ণ কিরণ দিয়ে তাঁর এই একান্ত ভক্তের রক্তাক্ত দেহ স্পর্শ ক’রে সেই রক্তে নিজদেহ রঞ্জিত হওয়ায় স্নান করার জন্যই সুদুর পশ্চিমসাগরে অবগাহন করতে গেছেন। আর, তাঁর এই মহৎ, ভক্ত সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার লজ্জাই যেন অস্তদিগন্তে প্রতিফলিত হয়ে তখনও তা আরক্তিম ক’রে রেখেছে। সে লজ্জারক্তাভা আরও বহুক্ষণ এই আকাশে এমনি ভাবে সূর্যের অক্ষমতা ও অপযশ ঘোষণা করতে থাকবে।

দুর্যোধনকে অতঃপর তাঁর শুভার্থীগণ একপ্রকার বলপ্রয়োগেই সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন…

পরদিন অরুণোদয়কালে ওঁদের প্রথম শস্ত্র ও শিক্ষাগুরু বৃদ্ধ কৃপাচার্য আর একবার কুরুরাজকে সুবুদ্ধি দেবার চেষ্টা করলেন, ‘বৎস, এখনও সময় আছে, এখনও নিবৃত্ত হও। ভেবে দেখ আমরা, তোমার স্বপক্ষীয় যারা অদ্যাপি জীবিত আছি তাদের সকলেরই মনোবল বিনষ্ট হয়েছে। কে যুদ্ধ করবে, আমাদের পরিচালিতই বা করবে কে? এখনও যদি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর, তোমার অল্প যে কয়জন পুত্র বা ভ্রাতা অদ্যাপি জীবিত আছে, তাদের নিয়ে জীবনযাপন করতে পারো—যেটুকু রাজ্যখণ্ড পাবে তার তুমিই নিঃসপত্ন অধীশ্বর হয়ে থাকতে পারবে। আর তাহলে এই সামান্য- সংখ্যক অবশিষ্ট যোদ্ধারাও পরিত্রাণ পায়। একমাত্র ধর্মবোধেই তারা তোমাকে পরিত্যাগ করে নি, সে কৃতজ্ঞতাতেও তাদের অব্যাহতি দেওয়া তোমার কর্তব্য।’

দুর্যোধন বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি যথার্থ হিতৈষীর মতোই পরামর্শ দিচ্ছেন। গত পরশু অশ্বত্থামাও দিয়েছিল— কিন্তু মুমূর্ষুর যেমন ঔষধ হণে বিতৃষ্ণা জাগে আমারও সেই অবস্থা উপস্থিত হয়েছে। এ উপদেশ শ্রেয় জেনেও তা গ্রহণ করতে পারছি না। ভেবে দেখুন—এতগুলি লোকের মৃত্যুর কারণ হয়ে আজ যদি আমি নিজের প্রাণরক্ষার জন্য সন্ধি প্রার্থনা করি–লোকে আমাকে ক্লীব ভেবে অপযশ করবে না? আর, এতকাল প্রবল প্রতাপে সদর্পে রাজত্ব করার পর অপরের অনুগ্রহে দীনভাবে কোনমতে জীবনযাপন করায় শ্রেয় কি? তদ্ব্যতীত চিন্তা ক’রে দেখুন—পাণ্ডবরাই কি এতদিনের বৈর, এত অনিষ্টাচরণ, এত অবমাননা ভুলতে পারবে? ভীমের প্রতিজ্ঞা আছে আমাকে বধ করবেন— দ্রৌপদীর সে লাঞ্ছনা তিনি ভুলতে পারেন নি সুভদ্রা আমার পতনের দৃশ্য দেখবেন এই আশাতেই বুক বেঁধে অনন্য- পুত্রশোক সহ্য করেছেন তাঁরা কি এত সহজে ক্ষমা করবেন? আর যাঁরা আমার পক্ষে যুদ্ধ করতে এসে প্রাণ দিয়েছেন —তাঁদের স্বজনদের কাছেই বা আমি মুখ দেখাব কেমন ক’রে? না, গুরুদেব, জীবনে আর আমার রুচি নেই বরং এতকাল যে দর্প অবলম্বন ক’রে ছিলাম সে দর্প অক্ষুণ্ণ রেখে সম্মুখ-যুদ্ধে বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করাই আমার পক্ষে শ্রেয়।’

অতএব যুদ্ধই স্থির।

কিন্তু সেনাপতি ব্যতীত যুদ্ধ সম্ভব নয়।

এবার কাকে সেনাপতি পদে বরণ করা হবে?

দুর্যোধন প্রথমে অনুরোধ করলেন অশ্বত্থামাকে।

অশ্বত্থামা সম্মত হলেন না। বললেন, ‘দেখ, মদ্ররাজ শল্য স্বীয় ভাগিনেয়দের উপেক্ষা ক’রে তোমার পক্ষে যোগ দিয়েছেন, এবং ধর্মমতোই যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তিনি মহাবীর ও মহাবলশালী—আমার মনে হয় তাঁকে সেনাপতি পদে বরণ করা তোমার কর্তব্য।’

অতঃপর দুর্যোধন শল্যর শিবিরেই গেলেন। কৃতাঞ্জলিপুটে সাশ্রুলোচনে বললেন, ‘মাতুল, আমাকে রক্ষা করুন। আপনিই কুরুসৈন্যের পরিচালনভার গ্রহণ করুন।

শল্য এ প্রস্তাবে প্রীত হয়ে দুর্যোধনকে আশ্বাস দিলেন যে, তিনি অবশ্যই প্রাণপণে যুদ্ধ করবেন ও পাণ্ডবপক্ষকে পরাভূত করবেন, দুর্যোধন যেন নিশ্চিন্ত থাকে। তিনি নিজের সমস্ত শক্তি ও মন প্রয়োগ করলে দেবেন্দ্ররও সাধ্য নেই তাঁকে প্রতিহত করে। কর্ণ চিরকাল কৃষ্ণ ও অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ ও অপরাজেয় বীর মনে ক’রে এসেছেন। কিন্তু কৃষ্ণার্জুন যত চেষ্টা করুন—তাঁর জয়লাভে কেউই বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। অপিচ ও পক্ষে এমন কোন বীর নেই যে শক্তিতে ও শিক্ষায় তাঁকে পরাভুত করতে পারে।

তদনুসারে বিধিমতে শল্যর অভিষেক ক্রিয়া হ’ল। আবারও শীর্ণকায় কৌরবশিবিরে জয়ধ্বনি উঠল। মদ্রদেশীয় বীরগণ সিংহনাদ ও দামামা ধ্বনি করতে লাগলেন।

চরম দুঃসময়ে অকস্মাৎ এ আনন্দধ্বনির কারণ পাণ্ডব-শিবিরে পৌঁছতে বিলম্ব হ’ল না। শল্যর আশ্বাস ও আস্ফালন- বাক্যে যুধিষ্ঠির কিছু চিন্তিতও হয়ে পড়লেন, ঈষৎ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বাসুদেবের মুখের দিকে তাকালেন।

শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হাস্যে বললেন, ‘হ্যাঁ, শল্য যে দুর্ধর্ষ বীর তাতে সন্দেহ নেই, দৈহিক বলে তিনি ভীমার্জুনের সমকক্ষ তো বটেই—হয়ত তাঁদের অপেক্ষাও বলশালী। তদ্ব্যতীত এঁরা অদ্যকার যুদ্ধে অতীব ক্লান্ত। আমার মনে হয় তাঁর আক্রমণ প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আপনারই গ্রহণ করা সঙ্গত। সত্য আপনার বর্ম সদৃশ, ধর্ম আপনার নিত্য রক্ষক—আপনি চেষ্টা করলে অনায়াসে শল্যকে বধ করতে পারবেন। শল্যকে পরাজিত করার অর্থ কুরুক্ষেত্রে নরমেধ যজ্ঞে পূর্ণাহুতি প্রদান —এ গৌরব আপনিই গ্রহণ করুন।’

প্রথমটা এ সংবাদ সকলেরই অবিশ্বাস্য বোধ হয়েছিল, বিশেষত কৌরবদের কাছে। তাঁদের ধারণা হ’ল—এবার যুধিষ্ঠিরের পতন অনিবার্য, অর্থাৎ বিজয়রূপ তীরভূমির একেবারে নিকটে এসেও পাণ্ডবদের ভাগ্যতরণী নিমজ্জিত হতে চলেছে। তাঁরা কথাটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ক’রে এত হতাশার মধ্যেও বেশ কিছুটা যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।

কৌরবরা অতঃপর মন্ত্রণা ক’রে স্থির করলেন যে তাঁরা কেউ সেদিন এককভাবে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, একত্রিত হয়েই যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করবেন। সেনাপতি শল্য সেই ভাবেই ব্যুহ রচনা করলেন। তিনি মদ্র ও অঙ্গদেশীয় বীরদের নিয়ে ব্যূহের পুরোভাগে, ত্রিগর্ত দেশীয় সৈন্য নিয়ে কৃতবর্মা বামে, কৃপাচার্য শক ও যবন সৈন্য নিয়ে দক্ষিণে, অশ্বত্থামা কাম্বোজ সৈন্যসহ পশ্চাদভাগে রইলেন, যাতে দুর্যোধন ও তাঁর জীবিতাবশিষ্ট ভ্রাতাগণ মধ্যস্থলে নিরাপদে থাকতে পারেন।

কিন্তু পাণ্ডবপক্ষ সেদিন যুদ্ধের প্রারম্ভক্ষণ থেকেই কৃতান্তমূর্তি ধারণ করলেন। বস্তুত প্রত্যুষকাল অতিক্রান্ত না হতেই কর্ণপুত্রগণ ও শল্যের এক পুত্র নিহত হ’ল ভীমের ভীমকান্তি গদাঘাতে নিমেষকালমধ্যে শল্যের রথ ভগ্ন ও সারথি নিহত হ’ল, শল্য কৃপাচার্যের রথে আরোহণ করতে বাধ্য হলেন।

যুধিষ্ঠির পূর্বরাত্রের আলোচনা বিস্মৃত হন নি। বাসুদেবের পরামর্শ আদেশ বলেই গ্রহণ করেছিলেন। ইঙ্গিতও। ধর্মরাজ একেবারে কিছু নির্বোধ নন, তিনিই রাজা, তাঁরই রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এত বড় যুদ্ধে –তিনি যদি কোন বিশেষ বিক্রমচিহ্ন এর ইতিহাসে রাখতে না পারেন—অন্তত একজনও উল্লেখ্য বীরকে বধ ক’রে—তাহলে ভবিষ্যতে জনসমাজে উপহাসের পাত্র হয়ে থাকবেন।

তিনি সেই ইঙ্গিত স্মরণে রেখেই এবার বিভিন্ন-অস্ত্রসম্ভার-সজ্জিত-রথে আরোহণ ক’রে শল্যর সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে প্রবৃত্ত হলেন।

এবং—শল্যর আত্মরক্ষা ও প্রতিযোদ্ধাকে নিহত করার প্রাণপণ প্রয়াস সত্বেও অতি অল্পকালমধ্যে তাঁকে বধ করলেন।

যিনি মাত্র দুই প্রহর পূর্বেও অপরিমাণ স্পর্ধা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেকে ভীম-অর্জুনের অপেক্ষা অনেক বড় যোদ্ধা বলে পুনঃপুনঃ ঘোষণা ক’রে এসেছেন চিরকাল, এত অল্পসময়মধ্যে তাঁর পতন ঘটতে কৌরববীরগণের মনোবল সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে, তাঁরা ভগ্নোৎসাহ হবেন, জয়ের আশা একেবারেই ত্যাগ করবেন—এ স্বাভাবিক। আশা তো ছিলই না, যেটুকু কল্পনামাত্র-ভরসা ক্ষীণমূল আশায় নিজেদের প্রবোধ দিয়েছিলেন তা দিগন্ততাড়িত ক্ষুদ্র স্বর্ণাভ মেঘখণ্ডের মতোই দূর শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে—তাকে আর কোনমতেই অবলম্বন করা যাবে না।

তখন আর নূতন সেনাপতি বরণের সময় ছিল না।

দুর্যোধনপক্ষে যে সামান্য সংখ্যক সৈন্য ও কতিপয় যোদ্ধা তখনও জীবিত ছিল তারা প্রাণরক্ষার চিন্তায় পলায়নের উপায় অন্বেষণে ব্যস্ত। দুর্যোধনের কণ্ঠ থেকেও আর আশ্বাসের বা উৎসাহের স্বর নির্গত হচ্ছিল না, তিনি নিজে যুদ্ধ ক’রে তাদের মনে পুনঃ সাহস সঞ্চারের একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে তাঁরই সম্মুখে ভীম অবশিষ্ট ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের বধ করলেন। রণদুর্মদ শাল্ব দুর্যোধনের ভৈরবাকৃতি হস্তীতে আরোহণ ক’রে সাড়ম্বরে রণক্ষেত্রে এসেই ধৃষ্টদ্যুম্নের ভল্লাঘাতে নিহত হলেন—পর্বতপ্রমাণদেহ ভয়ঙ্কর হস্তীটিও আহত হয়ে গর্জন করতে করতে পলায়ন করল সহদেবের হাতে শকুনি ও তার পুত্র উলুক নিহত হ’ল–অর্জুন ত্রিগর্ত দেশীয় সমস্ত যোদ্ধাদের বিনষ্ট করলেন।

এইভাবে শল্যের পতনের প্রহরকালমধ্যেই কৌরবপক্ষের সম্পূর্ণ পরাভব ঘটল। ধৃতরাষ্ট্র-সন্তানদের মধ্যে এক দুর্যোধন ব্যতীত আর কেউই রইল না। বেশ্যাগর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেওয়ায় রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনিই এখন অবনত মস্তকে সাশ্রুনেত্রে কৌরব-অন্তঃপুরিকাদের নিয়ে হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন।

অর্থাৎ সেদিনের অপরাকাল সায়ংকালে পর্যবসিত হওয়ার পূর্বেই কৌরবপক্ষের রাজলক্ষ্মী চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন।

দুর্যোধন চূড়ান্ত দুঃসময়ের জন্য এক চরম ব্যবস্থাও চিন্তা ক’রে রেখেছিলেন বৈকি।

এটা স্বেচ্ছাচারী নৃপতিদের ও যুদ্ধনিরত শক্তিবর্গের অবশ্য-শিক্ষণীয়। অদ্যাপি এর ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কুরুক্ষেত্র সংলগ্ন হ্রদসদৃশ বিশাল জলাশয় দ্বৈপায়নের সলিল-রেখার সঙ্গে একীভূতপ্রায় ভূভাগে একটি গুহা খনন করানো ছিল। অতিশয় বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা এই কার্য সম্পূর্ণ করিয়ে খনকদের দূর দেশে প্রেরণ করেছিলেন—যাতে এ সংবাদ কোনক্রমেই পাণ্ডব-গুপ্তচররা না সংগ্রহ করতে পারে। গুহার মধ্যে শয়নের জন্য তৃণ ও সামান্য পরিমাণ শুষ্ক খাদ্যও সঞ্চিত ছিল। এবার যখন আর কোন অবলম্বন কোথাও দৃষ্টিগোচর হ’ল না তখন সর্বাগ্র এই গোপন আশ্রয়টুকুর কথাই মনে পড়ল দুর্যোধনের। ভগ্নদেহ, ভগ্নমন নিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন হতমান গতসর্বস্ব কুরুরাজ সেই দিকেই যাত্ৰা করলেন, গোপনে—উৎসুক দৃষ্টি পরিহার করতে করতে। অবশ্য সকলেই যখন নিজেকে রক্ষা করতে উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত তখন তাঁর পরিণামের জন্য কৌতূহলী হবে কে?

এ আশ্রয় তখন একান্ত প্রয়োজন ছিল। কারণ মুখে যতই বলুন, এভাবে জীবনধারণ করা অপেক্ষা মৃত্যুই শ্ৰেয় — পরাজিত হয়ে বাঁচার অপেক্ষা মৃত্যুবরণ করা সহস্রগুণে বাঞ্ছনীয়—ঠিক এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের অনুসন্ধানী ব্যগ্র দৃষ্টির সম্মুখে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারলেন কৈ? এখনও মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশাতীত আশা জাগছে—একটু বিশ্রাম ক’রে সামান্য মাত্র সুস্থ হয়ে নিতে পারলে—জয়লাভ না হোক—ভীমকে বধ ক’রে তাঁর ভ্রাতাদের মৃত্যুর শোধ নেওয়া হয়ত অসাধ্য হবে না।

সেই ক্ষীণ, প্রায় অদৃশ্য, মরীচিকাতুল্য আশাকেই মনে মনে লালন ক’রে তিনি দ্বৈপায়নের সেই জলসম্পদাম- আবরিত গুপ্ত আশ্রয়ে প্রবেশ করলেন।

তবু কুরুক্ষেত্রের পূত রণভূমি থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে একবার কোন উচ্চ ভূখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজের পূর্ব গৌরবের মহাশ্মশান ও দুর্বুদ্ধি কুকীর্তির স্থাবর ইতিহাসের দিকে চেয়ে না দেখে কি মহামানী শক্তি- উন্মত্ত রাজা দুর্যোধন চলে যেতে পারেন?

না, তা সম্ভব নয়।

অবশ্যই দেখেছিলেন।

কিন্তু এ কী দেখলেন! হে ঈশ্বর, হে কুরুবংশের ইষ্টদেবতা, হে দুর্যোধনের ভাগ্যবিধাতা—এই দৃশ্য দেখবার জন্য কি তুমি দুর্যোধনের আশা ও আকাঙ্ক্ষাকে এমন তীব্র এমন অন্ধ ক’রে তুলেছিলে!

শ্মশান? না শ্মশান নয়, কবন্ধ-শব-কপালময় এক—বোধ করি সৃষ্টিকর্তারও অকল্পনীয়—মরুভূমি।

যেদিকে যত দূর দৃষ্টি যায়—শুধু শব, আর শব। পূর্ণাঙ্গ মৃতদেহ, কর্তিত মুণ্ড, কবন্ধ। নর অশ্ব হস্তী,–কোনটা সদ্যমৃত কোনটা গলিত, কোনটায় বা পচন আরম্ভ মাত্র হয়েছে। মরুভূমিতে নিত্য ঝটিকাময় বাতাসের শব্দের মতোই ঐ শবস্তূপের অন্তরালে বা শবদেহভারপিষ্ট মুমূর্ষুর আর্তনাদ প্রেতিনীর হাহাকারের মতো শব্দ তুলেছে।

দৃশ্য কি শুধুই বীভৎস? না বর্ণাঢ্যও বটে।

সুবর্ণপট্টিবিশিষ্ট পরিঘ, পরশু, কাঞ্চনপটসম্বন্ধ গদা, সুবর্ণ-অঙ্গদ বিভূষিত ধনু, কনকোদ্ভাসিত খড়া, মণিমাণিক্যখচিত ছত্র, চামর, অলঙ্কারশোভিত দেহ, সুবর্ণবলয়যুক্ত হস্তখণ্ড, বিচিত্রবর্ণ-সমুজ্জ্বল গজপৃষ্ঠআস্তরণ, ধ্বজা, পতাকা, মুকুট, মণিমুক্তাময়-মধ্যমণি-নিবদ্ধ হার, শিরোভূষণ, শিরস্ত্রাণ, অঙ্গদ, নানাবিধ অলঙ্কার তৎসহ রুধির–নরাশ্বমাতঙ্গ দেহ-নিঃসৃত বিপুল রুধির, কিছু বা শুষ্ক কিছু বা সদ্যপাতিত, কোথাও স্রোতসদৃশ, কোথাও সরোবর-সৃষ্টিকারী। এই বহুবর্ণসমারোহবিশিষ্ট রণক্ষেত্র যেন রক্তবস্ত্র রক্তমালা-মণিমাণিক্যবিভূষিতা সর্বজনগমনীয়া বারাঙ্গনার মতো প্রতীয়মান হ’ল সেই মুহূর্তে দুর্যোধনের কাছে। তিনি শিহরিত হয়ে উঠে নিজের হস্তে দুই চক্ষু আবরিত করলেন।

অতঃপর নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হ’তে হ’তে বাষ্পাকুলনেত্র নতমস্তক কুরুরাজ লগুড়াহত সর্পের ন্যায় দ্বৈপায়নের সেই বিবরমধ্যে প্রবেশ করলেন।

দৃষ্টি আচ্ছন্ন ছিল বলেই লক্ষ্য করলেন না—এক পিশাচদর্শন মাংসভারবাহী নিষাদ তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে নিঃশব্দে তাঁকে লক্ষ্য ও অনুসরণ করছে।

১৯

পাণ্ডবরা তখন সর্ব সাধ্যানুসারে দুর্যোধনেরই অনুসন্ধান করছিলেন। স্বপক্ষ শিবিরের কর্মীদের মধ্যে পারিতোষিক প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করিয়েছেন, পলায়নপর কুরুসৈন্যদের ভিতরও সে পুরস্কার ও ক্ষমার আশ্বাস প্রচার ক’রে দেওয়া হয়েছে। নিজেরাও তো বহুদূর পর্যন্ত ঘুরে দেখেছেন। হস্তিনাপুরের দিকে সকল সম্ভাব্য পথে পূর্বেই চর নিয়োগ করা হয়েছিল। শেষে একপ্রহর অতীত হওয়াতে, কোথাও কোন সন্ধান না পেয়ে চিন্তিত মনে এতগুলি মৃত্যুর জন্য সর্বাধিক দায়ী ব্যক্তিটিকে শাস্তি দিতে না পারার ক্ষোভ নিয়ে শ্রান্তদেহে তাঁরা যুধিষ্ঠিরের স্কন্ধাবার গৃহে এসেই সমবেত হলেন। এবং কোন সংবাদ যদি আসে, আনয়নকারীকে সেই কর্মকেন্দ্র-গৃহেই প্রেরণের নির্দেশ দিয়ে তাঁরা বর্মাদি ত্যাগ না ক’রেই সামান্য বিশ্রাম করতে লাগলেন।

কীলক নিষাদ মাংসভার নিয়ে এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। প্রতিদিনই বিস্তর মাংস প্রয়োজন হয়। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মৃগ ও শূকরের মাংস ভীমসেন একাই আহার করেন। সুতরাং কীলক ও তার অনুচরদের প্রবেশ সংকেত পূর্বাহ্নেই জানিয়ে রাখা হয়। তারা আসে, সূপকারদের নিকট চুক্তি বা পূর্বাহ্নের নির্দেশমতো মাংস বুঝিয়ে দিয়ে মূল্য নিয়ে চলে যায়। কর্তাদের গৃহের দিকে তার যাওয়ার কোন কারণ থাকে না।

কিন্তু আজ দেখা গেল কীলকের আচরণ কিছু ভিন্নপ্রকার—এবং একটু কৌতূহলোদ্দীপকও

সে নিজের মাংসভারদণ্ডের দুটি বোঝা নামিয়ে রেখে অনুচরদের চুক্তি ও নির্দেশমতো মাংসের পরিমাণ তৌল ক’রে বুঝিয়ে দিতে বলে পাণ্ডবপক্ষীয় প্রধানদের শিবিরের দিকেই এল।

কাশদণ্ড, তৃণ এবং বস্ত্র দ্বারা প্রস্তুত এই সাময়িক আবাস–এর বাহিরে ও ভিতরে কোন আড়ম্বর বা বিলাসের আয়োজন নেই, প্রয়োজনমতো স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা আছে। আর আছে প্রতিটি গৃহের বাহিরে বিশেষ গৃহস্বামীর বিশেষ চিহ্নলাঞ্ছিত ধ্বজা।

সেইগুলি লক্ষ্য করতে করতেই ধীরে ধীরে কুটিরগুলি অতিক্রম করছিল কীলক, এইবার এক চক্রচিহ্নিত পতাকার কাছে এসে গতি বন্ধ করল কীলক।

হ্যাঁ, এটি নিশ্চয় বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণর—তার স্বয়ষ্কৃত প্রভুর আবাস।

এ পর্যন্ত নির্বাধায় এলেও গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে গিয়ে দ্বারপালকের কাছে বাধা পেল। যে চিহ্ন ওর কাছে আছে তা শিবিরে প্রবেশ করবার দ্বারকাধীশের গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করার স্বতন্ত্র অনুমতি চাই। বিশেষ ওর মতো ক্ররবদন, সুরারক্তচক্ষু, মললিপ্তদেহ আমমাংসরুধিরগন্ধ পিশাচাকৃতি নিষাদকে তো তারা প্রবেশ করতে দিতে পারেই না। ।

কিন্তু উদ্ধত ক্রুদ্ধ কীলক কিছু উত্তর দেওয়ার পূর্বেই গৃহমধ্য থেকে তার অতি পরিচিত গম্ভীর মধুর কণ্ঠের আদেশ ধ্বনিত হ’ল, ‘ওকে ভিতরে আসতে দাও দ্বাররক্ষী, আমি ওরই প্রতীক্ষা করছি। বিশেষ সংবাদ দিতে এসেছে নিষাদ।’

বলতে বলতেই বুঝি—অন্তর্যামী এই মানুষটি দ্বার-আচ্ছাদক বহুমূল্য পীতবর্ণ আস্তরণ অপসারিত করে ওর সম্মুখে দেখা দিলেন, ‘এসো কীলক। কল্যাণ হোক তোমার। সংবাদ পেয়েছ তাহ’লে?’

কীলকের বারবারই মনে হয়, এই ব্যক্তিটি সম্বন্ধে তার বিস্ময়ের সর্বশেষ সীমা পার হয়েছে সে—আর ওঁর কোন আচরণে বা বাক্যে যে বিস্মিত হবে না—বারবারই সে ভ্রমভঙ্গের কারণ ঘটে। সে ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে বলল, ‘তুমি তো আমাকে কোন সংবাদ সংগ্রহের ভার দাও নি!’

‘অনাবশ্যক বলেই দিই নি।’ সেই অত্যাশ্চর্য চক্ষু দুটিতে এক মায়ামাধুর্যময় কৌতুক হাস্য ফুটে উঠল, ওষ্ঠপ্রান্তে পরিতোষ ও পুরস্কারের আভাস শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি কুরুরাজের অনুসরণ করবে, তাঁর প্রতি দৃষ্টি রেখেছ। আর, তিনিও অপরের দৃষ্টি পরিহার করতেই সতর্কতা অবলম্বন করেন—তোমার অস্তিত্বের কথা তাঁর কল্পনাতেও আসবে না।…এখন বলো, সংবাদ কি? কুরুরাজ কোথায় কি ভাবে আছেন?’

কীলক তার অভ্যস্ত, অনলঙ্কৃত কোমলতালেশহীন ভাষায় একেবারে আসল প্রসঙ্গে আসে, ‘ঐ লোভী লোকটা দ্বৈপায়ন সরোবরের পাড়ে একটা গুহায় গিয়ে প্রবেশ করেছে, একাই। মনে হয় আগেই এ গুহা খনন করানো ছিল, আত্মরক্ষা আত্মগোপন বা পলায়নের কালে কাজে লাগতে পারে বলে।’

‘তাঁর কী অবস্থা দেখলে!’

‘খুব দুর্বল, প্রতিটি পদক্ষেপেই কী হচ্ছে তা বোঝা যায়। তবে মুমূর্ষু নয়, তাহলে অত ভারী গদা বহন ক’রে আসতে পারত না। বা ঐ খাড়া পাড় বেয়ে জলের সীমান্তে গুহায় পৌঁছতে পারত না।’

শ্রীকৃষ্ণ আশীর্বাদের মুদ্রা করলেন, বললেন, ‘তোমার কাছে পূর্ণ সংবাদই পাবো জানতাম, পেলামও। তুমি প্রয়োজনীয় সকল তথ্যই লক্ষ্য করেছ। তুমি সে গুহা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবে তো?’

‘পারব। চিহ্নিত ক’রে এসেছি পথ, গাছের গায়ে দাগ কেটে কেটে।

পাণ্ডবরা কেউই তাঁদের রণবেশ পরিত্যাগ করেন নি তখনও। শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনের গুপ্ত আবাসের সন্ধান সংগ্রহ করেছেন এ সংবাদ শ্রবণের অর্ধদণ্ডকাল মধ্যেই তাঁরা বিশ্রাম-ক থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ রথে আরোহণ করলেন। ক্লান্ত রথাশ্বসকল ইতিমধ্যেই বিশ্রাম, গাত্রমার্জনা ও খাদ্যপানীয় গ্রহণের ফলে সুস্থ হয়ে উঠেছে, নূতন অশ্বযোজনার প্রয়োজন হ’ল না।

যুধিষ্ঠির অধিক সংখ্যক রথী নিলেন না—নেবার মতো বিশেষ কেউ আর অবশিষ্টও ছিল না। পঞ্চপাণ্ডব, শিখণ্ডী, সাত্যকি, পাণ্ডবদের পঞ্চপুত্র, উত্তমৌজা, যুধামন্যু—এবং কিছু পাঞ্চাল সৈন্য নিয়ে তখনই দ্বৈপায়ন হ্রদ অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে বাসুদেব শুধু অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘তুমি অগ্রণী হয়ো না, মধ্যমপাণ্ডব দুর্যোধন- নিপাতনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে সুযোগ তাঁকে দেওয়া উচিত। তদ্ব্যতীত সে অপর সকল আয়ুধ বর্জন ক’রে কেবলমাত্র গদা নিয়েই দ্বৈপায়নের আশ্রয়গহ্বরে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ তার সঙ্গে দ্বৈরথ করতে হলে গদা নিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। গদাযুদ্ধে তুমি তার সমকক্ষ নও, এমন কি ভীমসেনের পক্ষেও মুষলপাণি দুর্যোধনকে পরাস্ত করা কঠিন।

পাণ্ডবরা হ্রদের সমীপবর্তী হওয়ার পূর্বে কৌরব পক্ষের অবশিষ্ট তিন রথীও—অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা— দুর্যোধনের এই অভয়াবাসের সংবাদ পেয়েছিলেন। সংবাদ দিয়েছিলেন রাজকীয়-সংবাদ-সংগ্রহক সঞ্জয়। যুদ্ধের পূর্ব থেকেই ইনি অন্ধ অসহায় ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিলেন। যুদ্ধের আয়োজন, দুই যুদ্ধমান পক্ষ্যের মনোভাব, আলোচনা ও বিতর্কাদি, গুপ্ত মন্ত্রণার যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব—অর্থের বিনিময়ে বা অন্য প্রকারে–সে সকল সংবাদ বা তথ্য জ্ঞাত হয়ে ইনি নিয়মিতভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে জানাচ্ছিলেন। সেদিন শল্য শকুনি প্রভৃতির পতনের পর দুর্যোধনকে গোপনে রণক্ষেত্র থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে দেখে দূর হতে তাঁর অনুসরণও করেছিলেন। নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমিতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, দৈবাৎ ধৃষ্টদ্যুম্নের দৃষ্টিপথে পতিত হওয়ায় তাঁরা ওঁকেও বধ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু অপরাপর যোদ্ধারা—বিধিমতো-নিযুক্ত সংবাদ-সংগ্রহক বধযোগ্য নয় —এ-কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় নিবৃত্ত হলেন।

অশ্বত্থামা প্রমুখ তিন বীরও ব্যাকুলচিত্তে দুর্যোধনের অন্বেষণ ক’রে ফিরছিলেন।

সঞ্জয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে সংবাদ পেলেন এবং সেই স্থানে গিয়ে দুর্যোধনের উদ্দেশে আহ্বান ক’রে আশ্বস্ত ও উত্তেজিত করার চেষ্টায় বললেন, ‘রাজন, এখনও তো আমরা জীবিত আছি, আপনি গুহামধ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হোন, শার্দূলের পক্ষে পেচকবৃত্তি শোভা পায় না। আমরা আপনার সঙ্গে থেকে আপনার হয়ে যুদ্ধ ক’রে অবশ্যই শত্রুনাশ করব এবং আপনার সিংহাসন নিষ্কণ্টক করব। আপনি এতে কিছুমাত্র সন্দেহ রাখবেন না। ‘

তাঁরা আরও বললেন, ‘পাণ্ডবদের সৈন্যগণ প্রায় সকলেই নিহত হয়েছে, যারা জীবিত আছে তাদের মধ্যেও অধিকাংশ আহত, অথবা অতিরিক্ত পরিশ্রান্ত। এ-ই প্রকৃষ্ট অবসর, আপনি এই জাড্য পরিহার ক’রে পুনশ্চ রণবেশে সজ্জিত হয়ে নূতন রথে আরূঢ় হোন, আমরা আপনাকে বেষ্টন ক’রে থাকলে কারও সাধ্য নেই আপনাকে বন্দী বা বধ করে। আসুন এই সুযোগ গ্রহণ ক’রে আমরা প্রচণ্ড তেজে পাণ্ডবদের আক্রমণ ও বিনষ্ট করি।’

অশ্বত্থামা অধিকতর আস্ফালন প্রকাশ ক’রে বললেন, ‘যাবতীয় পুণ্যকর্মের নামে শপথ ক’রে বলছি আমি, অবশ্যই অদ্য আপনার শত্রু ও আমার পিতৃহন্তা পাণ্ডবদের বধ করব, কারও সাধ্য নেই তাদের রক্ষা করে। আপনি এখনই তৎপর হোন।’

ক্লান্ত বিমর্ষ দুর্যোধন গুহামুখে এসে বললেন, ‘আপনারা যে বিমুক্ত, জীবিত ও সুস্থ আছেন, এই আমার পরম ভাগ্য। কিন্তু তত্রাচ আপনারা অবশ্যই শ্রান্ত, আমিও সাংঘাতিকভাবে আহত, ক্ষতবিক্ষত। ওরা বিজয়লাভে প্রমত্ত, সেই হেতু মনোবলে বলীয়ান। এই অবস্থায় এখনই যুদ্ধযাত্রা ক’রে কোন শ্রেয় লাভ হবে না। অদ্য রাত্রিটা বিশ্রাম করতে দিন— অবশ্যই রজনী প্রভাতে আপনাদের সঙ্গে শত্রুনাশে যাত্রা করব। ‘

ইত্যবসরেই দূরগগনাগত জলদগর্জনের ন্যায় পাণ্ডবদের অভিযানবার্তা আভাসিত হ’ল। তাঁদের রথধ্বজসমূহ দৃষ্টিগোচর হতেও বিলম্ব হল না।

মহাস্পর্ধী অশ্বত্থামা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘মহারাজ পাণ্ডববাহিনী পুনঃসজ্জিত হয়ে এই পথেই আসছে। আপনার কল্যাণ হোক, আমাদের অনুমতি দিন আমরা এ স্থান ত্যাগ করি।…আপনিও সত্বর গুহামধ্যে প্রবেশ করুন।’

পাণ্ডবরা যে তাঁর গুহার অবস্থান সঠিক অবগত আছেন—এমন আশঙ্কার অণুমাত্রও দুর্যোধনের চিন্তা-কল্পনায় ছিল না। কিন্তু এখন দেখলেন এবং দেখে চমকিত হলেন—পাণ্ডবশকট যেন অভ্রান্ত গণনার সাহায্যেই সে-স্থান নির্ণয় ক’রে অমোঘ নিয়তির মতোই সেখানে এসে গতি বন্ধ করল।

তবু তখনও, অকুস্থলে পৌঁছেও, পলায়িত লুক্কায়িত পরিশ্রান্ত ও আহত শত্রুকে তখনই যুদ্ধে আবাহন করা সঙ্গত হবে কিনা, সে বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের মনে সঙ্কোচ ছিল। বাধাও বিস্তর, সরল প্রাচীরগাত্রের মতোই সরোবরের পাড় বেয়ে নামা—সশস্ত্র সবর্ম মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, রথ পৌঁছানো তো অকল্পনীয়। এখানে নৌকারও ব্যবস্থা নেই, প্রয়োজন হয় না বলেই নেই—সুতরাং দুর্যোধন স্বেচ্ছায় না হ্রদতটে উঠে এলে তাঁকে বধ করা যায় কি প্রকারে?

যুধিষ্ঠির চিরকালের অভ্যাসমতো বিপন্ন দৃষ্টিতে বাসুদেবের মুখের দিকে চাইলেন।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘মহারাজ, কপটকে বা মায়াবীকে কাপট্য অথবা মায়াবলম্বনেই বধ করতে হয়। মহাত্মা বামন ছলনা দ্বারাই বলিকে বধ করেছিলেন হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপুকেও অস্বাভাবিক উপায়ে বধ করতে হয়েছে বৃত্রাসুর কৌশলের দ্বারাই নিহত হয়েছে রাবণ কুম্ভকর্ণের সময়ও এর অন্যথা হয় নি। ক্রিয়াকৌশল দ্বারাই পুরাকালে মহাবল বিপ্রচিত্ত, মহাসুর তারক, মায়াবী ইল্বল বাতাপি, ত্রিশিরা, সুন্দউপসুন্দ প্রভৃতিও নিহত হয়েছে। মনুষ্যসমাজেও অনেকানেক মহাবলী ভূপাল এই প্রকারের ক্রিয়া-কৌশলেই নিহত হয়েছেন। আপনিও সেই উপায় অবলম্বন ক’রে ক্ররকর্মা পাপিষ্ঠ দুর্যোধনকে প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করুন। সে অতিশয় অহঙ্কারী, তার অহঙ্কারে আঘাত লাগলেই ক্রুদ্ধ হবে আর সেক্ষেত্রে অবশ্যই তার শ্রেয়বুদ্ধি অপগত হবে।’

সংশিতব্রত যুধিষ্ঠির অতঃপর দ্বিধাশূন্যচিত্তে সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবাক্যেই স্বকার্যসাধনে তৎপর হলেন। উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘হে দুর্যোধন, এ আমরা কি দেখছি! তুমি নিজ বংশ তথা সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস ক’রে নিজ জীবনরক্ষার জন্য গন্ধমূষিকের মতো গোপন গহ্বরে প্রবেশ করেছ! তোমার সেই অপরিমাণ দর্প, দুর্জয় অভিমান কোথায় গেল? সেই পরধনলিপ্সা? বুঝলাম তোমার শৌর্য বীর্য সাহস কোনকালেই ছিল না, বান্ধবরা নিহত হওয়ামাত্র নিজে জম্বুকবৃত্তি অবলম্বন ক’রে গোপন আশ্রয়ে প্রবিষ্ট হয়েছ। কিন্তু যে অকারণ সংগ্রামের আয়োজন করেছ তার সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত তোমার আত্মরক্ষা বা বিশ্রামের অধিকার নেই। চতুর্দিকে এই সমস্ত পিতা পুত্র ভ্রাতা মাতুল বয়স্য ও বান্ধবদের মৃত্যুর কারণ হয়ে যদি কাপুরুষের মতো নিজের জীবন রক্ষা করো—পরে মনুষ্যসমাজে আত্মপরিচয় দেবে কি ক’রে? জানলাম তোমার শূর পরিচয় মিথ্যা শূর ব্যক্তি কখনও পলায়ন করে না। তুমি আত্মপ্রকাশ ও যুদ্ধ করো, ক্ষমতা থাকে আমাদের পরাস্ত ক’রে সুখে রাজ্যভোগ করো।’

দুর্যোধন এই বাক্যপ্রহারজ্বালা আর সহ্য করতে পারলেন না। জলজ শম্পদামের অন্তরাল হতেই উত্তর দিলেন, ‘কুন্তিপুত্র, আমি প্রাণভয়ে আত্মগোপন করি নি রথহীন, তূণহীন হয়ে—পৃষ্ঠরক্ষক অস্ত্ররক্ষক ও সারথি নিহত হওয়ায় ক্ষণেক বিশ্রাম নিতেই এসেছি এখানে। রাত্রিপ্রভাতে আমি নিজেই তোমাদের যুদ্ধে আহ্বান করব, এই স্বল্পকাল ধৈর্য অবলম্বন করো।’

বোধ করি ওঁর এই কাপুরুষতাতেই যুধিষ্ঠির অধিকতর ক্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। ব্যঙ্গতিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘শত্রুনাশ না ক’রে বিশ্রাম গ্রহণ আমরা অধর্ম বোধ করি। তুমি কোটর থেকে বহির্গত হও–এখানে এবং এক্ষণেই আমরা যুদ্ধ শেষ করতে ইচ্ছা করি। তোমার অভিলাষমতো রথ অশ্ব তূণ ও অস্ত্র তুমি সংগ্রহ করো অথবা আমাদের নিকট হতেই গ্ৰহণ করো।’

পুনশ্চ দুর্যোধনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘দেখ আমার আর যুদ্ধে প্রবৃত্তি নেই। পুত্র, ভ্রাতা, সমস্ত স্বজন, দ্রোণের মতো স্নেহশীল আচার্য, কর্ণের মতো বন্ধু হারিয়ে শ্মশানে রাজত্ব করায় লাভ কি? বিশাল এ পৃথিবীর আধিপত্য তোমাদেরই ছেড়ে দিলাম, তোমরা এই নিঃক্ষত্রিয় জ্ঞাতিবন্ধুহীন মরুভূমিতে রাজত্ব করার গৌরব উপভোগ করো, তোমাদের কল্যাণ হোক—আমি অজিনবাস অথবা চীরবস্ত্র পরিধান ক’রে বনগমন করছি।’

যুধিষ্ঠিরের কণ্ঠ তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠল, ক্রোধে ও বিতৃষ্ণায়। বললেন, ‘আজ এতকাল পরে, এতগুলি লোকের রুধিরস্রোত সন্তরণ ক’রে এসে–তোমার কাছ থেকে রাজ্যখণ্ড দানস্বরূপ নিয়ে ভোগ করব এমন প্রবৃত্তি আমাদের নেই, সে রাজ্য শূকর-বিষ্ঠার চেয়েও ঘৃণ্য। আর, আজ তুমিই বা অনীশ্বর, সসাগরা অবনী দান করতে চাও কোন স্পর্ধায়?…পৃথিবীতে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই, আমরা এই সামান্য কুরুরাজ্যেই তৃপ্ত, তবে তাও দানস্বরূপ নেব কেন? আমাদের প্রাপ্য আমরা বাহুবলে তোমাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েই গ্রহণ করব। তোমাকে যুদ্ধে পরাস্ত না ক’রে পলায়নে প্রশ্রয় দিলে ক্ষাত্রধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ বলে আমাদের অপযশ ঘোষিত হবে। তুমি প্রাণভয়ে পক্ষীকাকলির মতো অসংলগ্ন প্রলাপ বকছ, গহ্বারান্তর থেকে সব কথা শ্রুতিগোচরও হচ্ছে না। যদি যথার্থ ক্ষত্রিয়সন্তান হও, কুরুবংশে জন্মগ্রহণ ক’রে থাক—প্রকাশ্যে এসে যুদ্ধ করো।’

মহামানী অতিদর্পী দুর্যোধন এ প্রকার কটুবাক্য কখনও শোনেন নি, চিরদিন একাধিপত্যই কামনা ক’রে এসেছেন, সেইভাবেই জীবন যাপন ক’রে এসেছেন আকৈশোর কারও তর্জন কি ভর্ৎসনা শুনতে, কারও পরামর্শ বা মতানুসারে চলতে অভ্যস্ত নন। সুতরাং যতই ক্লান্ত বা দেহে-মনে অবসন্ন হোন, জয়দৃপ্ত পাণ্ডবদের এই তর্জন ও আস্ফালন সহ্য করতে পারলেন না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ ক’রে বললেন, ‘পাণ্ডবপুত্রগণ, তোমরা সুহৃদ্বন্ধু ও অস্ত্রপাণি রথীবৃন্দে পরিবৃত, আমি একাকী ও অস্ত্রশূন্য। সকলে যদি আমাকে একসঙ্গে আক্রমণ করো, চিরদিন তোমাদেরই অপকীর্তি ঘোষিত হবে। আমি বর্মকবচবিহীন, শ্রান্ত, ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ। তোমরা এই রাত্রিটা অপেক্ষা করো, প্রভাতে উঠে—নিশাবসানে যেমন ভগবান মরীচিমালী তাঁর তেজঃপুঞ্জ দ্বারা নক্ষত্রসকলকে বিলুপ্ত করে, আমিও তেমনিই—একে একে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে সকলকে বিনষ্ট করব।’

যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ‘আজ যে বিবেচনা আমাদের কাছে প্রত্যাশা করছ সে বিবেচনা তুমি কখনও আমাদের প্রতি প্রয়োগ করেছ কি? তোমার বুদ্ধি এখনও হিংসাত্মক, স্বীয় কৃতকর্মের জন্য কিছুমাত্র অনুতপ্ত নও। আমরা একত্রে তোমাকে আক্রমণ করলেও তা নিন্দার্হ হত না, অভিমন্যুবধের যৎকিঞ্চিৎ প্রত্যুত্তর হত মাত্র। কিন্তু আমরা সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ইচ্ছুক নই। যদি একে-একেই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও, তবে এখনি গুপ্তস্থান থেকে বহির্গত হও এবং যার সঙ্গে ইচ্ছা দ্বৈরথ সমরে প্রবৃত্ত হও।’

অতঃপর দুর্যোধনের পক্ষে আর অন্ধ গহ্বরে আত্মগোপন ক’রে থাকা সম্ভব নয়। বাক্যকশাঘাতে অনভ্যস্ত রাজা সুবর্ণবলয়মণ্ডিত বিপুলকায় গদা হস্তে ক্রদ্ধ মহানাগের মতো ঘন ঘন সগর্জন নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে তাঁর গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে এলেন।

এ দৃশ্যে কিছু সাধারণ সৈন্য ও দর্শক কৌতুক অনুভব করবে—এ স্বাভাবিক। তারা করতালি সহকারে বিদ্রুপ প্রকাশ করল। তাতে ক্রুদ্ধতর দুর্যোধন বললেন, ‘পথকুক্কুরদের এই স্পর্ধিত উল্লাস অসহ্য। পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, তুমি এখনই যুদ্ধের আয়োজন করো। তবে তোমার ধার্মিক বলে খ্যাতি আছে, অবশ্যই সকলে একসঙ্গে আমাকে আক্রমণ করবে না—আশা করি। একে একে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে তোমাদের সকলকে শমনসদনে প্রেরণ করতে বিলম্ব হবে না।’

যুধিষ্ঠিরের চিরপ্রশান্ত অধরেও বিরক্তির বক্ররেখা দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘সুযোধন, তোমার মুখে ধর্মের অছিলা ভ্রষ্ট-চরিত্রা নারীর শেষ বয়সে ধর্মাচরণের মতো বোধ হচ্ছে। লোকে মহাকষ্টে পতিত হলে ধর্মকে স্মরণ করে, নিরাপদ থাকলে পরলোকের দ্বার আচ্ছাদিত মনে হয়। আবারও তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিই, তোমরা সকলে একত্র হয়ে যখন নিরস্ত্র বালক অভিমন্যুকে বধ করেছিলে তখন তোমার এই ধর্মবুদ্ধি কোথায় ছিল? আমরা ক্ষাত্রধর্ম পালন করেছি—সে ধর্ম অতিশয় ভ্রূর, নির্মম ও নির্ঘন। তত্রাচ, অনুগ্রহ করেই বলছি, তুমি নিশ্চিন্ত মনে বর্মশিরস্ত্রাণাদি পরিধান ক’রে প্রস্তুত হয়েই একক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছা যুদ্ধ করো—হয় সে হত হোক, নয় তুমি হত হয়ে স্বর্গগমন করো। তুমি সেই একজনকে পরাজিত করতে পারলেই এ যুদ্ধে বিজয়ী বলে গণ্য হবে, এবং এ রাজ্য লাভ করতে পারবে।’

চিরপ্রশান্ত চির-অনুদ্বিগ্ন বাসুদেবের এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি উদ্যত ক্রোধ দমন বা শিষ্টাচারেরও প্রয়াস পেলেন না, নিম্ন অথচ তিক্তকণ্ঠে বললেন, ‘মহারাজ, আপনি এ জীবনে বার বার নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ ক’রে নিজের এবং ভ্রাতা ও স্বজনগণের অশেষ ক্লেশের কারণ হচ্ছেন। সেই দ্যূতসভা থেকেই নির্বুদ্ধিতার জন্য আপনার ভ্রাতাগণ এবং সাধ্বী দ্রৌপদী যে অমানুষিক ক্লেশ সহ্য করছেন তা ভুলে গেলেন! ঐ পাাপিষ্ঠটা যদি এখন আপনাকে বা নকুল সহদেবকে যুদ্ধে আহ্বান করে? শুষ্ক পত্র যেমন দাবানলের সম্মুখে নিমেষে ভস্মসাৎ হয় তেমনিই অবস্থা হবে না কি আপনাদের?…একমাত্র যে গদাযুদ্ধে ওর সম্মুখীন হ’তে সক্ষম সে ভীমসেন। তথাপি, সেও বৈর-নির্যাতনকল্পে গত ত্রয়োদশ বৎসর স্থ±ল বৃক্ষকাণ্ড বা লৌহনির্মিত মূর্তির সঙ্গে গদাযুদ্ধাভ্যাস করেছে বটে কিন্তু শিক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেনি। ভীম দুর্যোধন অপেক্ষা অধিক বলশালী কিন্তু দুর্যোধনের শিক্ষা সমধিক ও সুসম্পূর্ণ। স্বয়ং বলদেব তাকে সযত্নে শিক্ষা দিয়েছেন। ভীমসেনের পক্ষেও তাকে একক পরাজিত করা কঠিন হবে।…এ আপনি কি করলেন? এক বিশাল রক্তনদী পার হয়ে এসে, সেই নদীর তীরে তরী ডোবাতে চান—ইচ্ছা ক’রে?’

ভীম তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘বাসুদেব, তুমি চিন্তিত হয়ো না, আমি ওকে এত বিচারের বা সতর্কতা অবলম্বনের অবকাশই দেব না। ও প্রস্তুত হ’লে আমিই সর্বাগ্রে ওকে আক্রমণ করব। ওর শিক্ষা যতই উত্তম হোক— আমার গদা ওর গদা অপেক্ষা প্রায় অর্ধাধিকগুণ গুরুভার। আমি ওর মতো পরিশ্রান্তও নই।’

ততক্ষণে দুর্যোধন মণিমাণিক্যখচিত সুবর্ণ-শিরস্ত্রাণ ও লৌহময় বর্ম পরিধান ক’রে প্রস্তুত হয়েছেন। অতঃপর তিনি পাণ্ডবপক্ষের দিকে সম্যক অবলোকনের পর সমরথী নির্বাচনের পূর্বেই ভীমসেন তাঁর সুবিপুল গদাহস্তে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। সগর্জনে বললেন, ‘এসো এসো, আর আমার বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না। দ্রৌপদীর অবমাননা ও লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেবার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করছি, সুখশয্যায় শয়ন করি নি। মূঢ়, তোমার ও তোমার কপটাচারী পিতার অপরিমাণ দুষ্কৃতির কথা স্মরণ ক’রে শাস্তিগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হও। তোমাদের জন্য আমরা বিনা অপরাধে অকারণে বহু ক্লেশ সহ্য করেছি—তোমাদের জন্যই আমাদের বৃদ্ধ দেবতুল্য পিতামহ আজ শরশয্যায় শায়িত, আমাদের স্নেহময় শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, কর্ণ প্রভৃতি বীরগণ, তোমার বীর ভ্রাতা ও পুত্রগণ এবং অগণিত নৃপতি সসৈন্যে কালকবলিত হয়েছেন। তুমি কুলনাশন নরাধম, তোমাকে এই গদাঘাতে নিহত করতে না পারা পর্যন্ত আমার আর শান্তি নেই।’

এইদিন অপরাহ্নে বহু তীর্থ ভ্রমণ ক’রে বাসুদেবের অগ্রজ বলদেবও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি কোন পক্ষকেই সমর্থন করবেন না এই প্রতিজ্ঞা ছিল, তত্রাচ তাঁর দুই শিষ্যের এই মরণপণ যুদ্ধ দেখার কৌতূহল স্বাভাবিক। তাই যুদ্ধ এখনই আসন্ন সংবাদ পেয়ে শিবিরে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারেন নি, সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিই বললেন, ‘এই দ্বৈপায়ন হ্রদ কুরুক্ষেত্রর অন্তর্গত নয়। বহুবীরের ধর্মযুদ্ধে কুরুক্ষেত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে, সেখানে গিয়েই যুদ্ধ করা ভাল।’

সেই উপদেশ অনুসারে অনন্তর ওঁরা পদব্রজে কিছুদূর গিয়ে পুনশ্চ কুরুক্ষেত্রে প্রবেশ ক’রে একটি বিস্তৃত ও উন্মুক্ত চতুষ্কোণ ক্ষেত্র নির্বাচন করলেন।

অতঃপর দুজনের ঘোরতর ও ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। দেখা গেল বাসুদেবের পর্যবেক্ষণ শক্তি, সংবাদ-তথ্য- সংগ্রহদক্ষতা অমানুষী—অনৈসর্গিক বললেও বোধ করি অনৃতভাষণ হয় না—অনুমানও অভ্রান্ত। একমাত্র শারীরিক বল ব্যতিরেকে দুর্যোধন ভীম অপেক্ষা সকল বিষয়েই শ্রেষ্ঠ। বহুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর উভয়েই পরিশ্রান্ত হলেন কিন্তু জয়- পরাজয় কিছুই নির্ণীত হ’ল না।

বাসুদেব নির্মিমেষ নেত্রে এই যুদ্ধের প্রতিটি আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ, আঘাত ও প্রত্যাঘাত লক্ষ্য করছিলেন। দুই রণোন্মত্ত বৃষভের মতোই এঁরা একবার পশ্চাদপসরণ ও পরমুহূর্তেই পরস্পরের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন। তার মধ্যেই উভয়ের শক্তি ও শিক্ষার পার্থক্য তাঁর দৃষ্টিবিচ্যুত হয় নি। তিনি নিম্নকণ্ঠে অর্জুনকে বললেন, ‘দুর্যোধনের শিক্ষা, দক্ষতা এবং যত্ন ভীম অপেক্ষা বহুগুণে উন্নত, ভীম কোনক্রমেই ন্যায়যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন না, অন্যায় বা রীতিবিরুদ্ধ যুদ্ধেই দুর্যোধনকে পরাস্ত করতে হবে। যুধিষ্ঠির হঠকারিতা ও নির্বুদ্ধিতার দ্বারা আমাদের ঘোরতর বিপদে নিক্ষেপ করেছেন, তিনি বলেছেন কোন একজনকে পরাজিত ও নিহত করতে পারলেই দুর্যোধন সমগ্রভাবে জয়ী হয়েছেন বলে স্বীকৃত হবেন। এক্ষেত্রে আমাদের আর কালবিলম্ব করা উচিত নয়। আপৎকালে কোন আচরণই ন্যায়বহিভূত নয়—এই মতোই আমাদের চলতে হবে। ভীমসেন অত শূরধর্মের রীতি বিবেচনা না ক’রেই দ্যূতসভায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যুদ্ধকালে তিনি দুর্যোধনের ঊরু ভঙ্গ করবেন—এক্ষণে সেই প্রতিজ্ঞাই পালন করুন।’

এই বলে তিনি অর্জুনকে অনুপ্রেরিত করলে অর্জুন সুকৌশলে ভীমের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে নিজের বাম ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন।

তখন যুযুধান দুই মহাবীরই পরিশ্রান্ত হয়ে নিঃশ্বাস সঞ্চয়ের জন্য ক্ষণেক স্থির হয়ে রণে বিরতি দিয়েছিলেন। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে এবার ভীম অকস্মাৎ অতর্কিত আক্রমণ পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। তাতে প্রথমটা বিশেষ সুবিধা হয় নি, বরং তিনিই একবার দুর্যোধনের গদাপ্রহরে রক্তাক্ত দেহে প্রায় মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর কিছুক্ষণ সেইভাবে নির্জীব ও নিশ্চল পড়ে থাকার পর উঠে পুনরায় আক্রমণ করতে গেলে—সর্পের আক্রমণ আশঙ্কায় যেমন ময়ূরী বা নকুল লম্ভ দিয়ে শূন্যে উঠে তার বিস্ফারিত ফণায় অব্যর্থ নখরাঘাত করে, সেইভাবেই দুর্যোধন লাফিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে ভীমের মস্তকে গদাঘাত করার চেষ্টা করলেন, আর ভীম নিমেষপাতমাত্রে সেই অবস্থানের সুযোগ নিয়ে শূন্যস্থ দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত ক’রে দুটি ঊরুই ভঙ্গ করলেন। দুর্যোধন সম্পূর্ণ বলহীন ও তীব্র যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে সশব্দে ভূমিতে পতিত হলেন। তাঁর আর পুনরুত্থানের সম্ভাবনা রইল না।

এই আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়ে বিমূঢ় দর্শকবৃন্দের বোধ হ’ল আকাশ থেকে ধূলি ও রক্তবৃষ্টি হতে লাগল, চারিদিকে অশরীরী প্রেত ও পিশাচগণ খলখল ধ্বনি করতে লাগল,–মনে হ’ল কুরুক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ কবন্ধ যেন তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ উপভোগ করতে অর্ধগলিত দেহেই উঠে নৃত্য শুরু করল।

অবশ্যই ভীমের এ ধরনের কোন অলৌকিক ঘটনা দৃষ্টিগোচর হ’ল না। সার্ধ-ত্রয়োদশ বর্ষের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হওয়াতেও তাঁর ক্রোধ যেন প্রশমিত হয় নি—এইভাবে বলে উঠলেন, ‘আমাদের শত্রু অপসারণের জন্য কপট দ্যূতক্রীড়া বা অগ্নিসংযোগ-বিষপ্রয়োগে হত্যার শরণ নিতে হয় না, নিজশক্তিই যথেষ্ট। পাষণ্ড, রজস্বলা দ্রৌপদীকে নিপীড়ন ও আমাকে ‘ষণ্ড’ নামে অভিহিত ক’রে বিদ্রুপে নৃত্য করার কথা স্মরণ হয় কি? এবার তার ফল ভোগ করো।’

এই বলে তিনি বাম পদ দিয়ে সবলে দুর্যোধনের মস্তকে পদাঘাত করলেন এবং সেই পদদ্বারাই সর্বাঙ্গ বিমর্দিত করতে লাগলেন।

তাঁর এই প্রাকৃত ইতরজনোচিত আচরণে উপস্থিত বীরগণ বিরক্ত হয়ে উঠলেন। যুধিষ্ঠির বলপূর্বক ভীমের জানু আকর্ষণে তাঁকে সরিয়ে এনে তিরস্কার করলেন, ‘ভীম, তুমি সৎ বা অসৎ উপায়ে দীর্ঘকালের বৈরিতার প্রতিশোধ নিয়েছ—তা নিয়ে আর বাগাড়ম্বর করার আবশ্যক নেই। কোনমতে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছে—এখন ক্ষান্ত হও। রাজা দুর্যোধন কয়দিন পূর্বেও একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিপতি ছিলেন, তোমার জ্ঞাতিভ্রাতা—কোন অবস্থাতেই তাঁর অবমাননা করা তোমার শোভা পায় না—বিশেষ এখন তিনি হতপ্রায়, এ আচরণের প্রত্যুত্তর দেবার সামর্থ্য নেই। এঁকে পদাঘাত করা নীচ ও কাপুরুষের কার্য হয়েছে।’

তারপর বাষ্পাকুল নেত্রে দুর্যোধনকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘ভ্রাত, তুমি নিজ কর্মেরই ফল ভোগ করছ, অনর্থক দুঃখ বা ক্ষোভ ক’রো না। তোমার জন্যই তোমার স্বজন-বান্ধবরা নিহত হয়েছেন। তবু তুমি শ্লাঘ্য-মৃত্যু লাভ করেছ। আমরা জীবিত থেকে কেবলই দুঃখ ভোগ করব।’

এই সময় আর এক বিপদ উপস্থিত হ’ল।

দুর্যোধন স্বীয় বুদ্ধি ও শিক্ষার আগ্রহের জন্য চিরদিনই বলদেবের অধিক প্রিয়। ওঁর এই পতনে ও অপমানে নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বললেন, ‘ভীমসেন ধর্মযুদ্ধে দুর্যোধনকে নিপাতিত করতে পারেন নি। একে বাহুবল তো বলেই না। নাভির নিম্নে গদাঘাত করা যুদ্ধনীতিবিরুদ্ধ। আমি ঐ নরাধমকে বধ ক’রে এর সমুচিত শিক্ষা দেব।’

এই বলে তিনি সবেগে ভীমের দিকে ধাবিত হলেন।

শ্ৰীকৃষ্ণ বিনয়াবনত ভাবে অথচ সবলে তাঁকে বাহুবদ্ধ ক’রে প্রতিনিবৃত্ত করলেন, বললেন, ‘আর্য, আপনি জানেন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা ক্ষত্রিয়দের প্রধান ধর্ম। দ্যূতসভায় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে বাম ঊরুতে বসার অশালীন ইঙ্গিত করায় ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যুদ্ধে ওঁর ঊরুভঙ্গ করবেন। ভীম সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা ক’রে স্বীয় ধর্ম বা সত্য রক্ষা করেছেন মাত্র। আরও দেখুন, পাণ্ডবরা আমাদের নিকট-আত্মীয়, তারও অধিক— আমাদের মিত্র ও সহায়। তাঁদের উত্থানে আমাদেরও উত্থান–আমরা নিরাপদ হবো। দুর্যোধন তাঁদের কি পরিমাণ নিপীড়িত করেছে তা আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন—সেক্ষেত্রে সেই বৈর-প্রতিশোধে সামান্য একটু কৌশল অবলম্বন এমন কিছু দোষাবহ হয় নি। আপনি ক্রদ্ধ হলে পাণ্ডবরা নিশ্চয় বিনষ্ট হবে—কিন্তু তা উচিত হবে না।’

বলদেব নিরস্ত হলেও অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ‘তুমি সুবিধামতো ন্যায়ধর্মের যে- ব্যাখ্যা করছ সে সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই না—তবে তুমি এটা খুব অসৎ আদর্শ স্থাপন করলে, কালক্রমে ক্ষাত্রজনের যুদ্ধশাস্ত্রের যেসব রীতি প্রচলিত আছে তা লোপ পাবে, মনুপুত্রগণ যুদ্ধে পশু বা পিশাচগণের মতো আচরণ করবে। তাতে দুঃখই বৃদ্ধি পাবে। আর ভীম যে অধর্মাচরণ করলেন তা সকলের নিকটই বিসদৃশ বোধ হয়েছে। দুর্যোধন পূর্বে যাই করুন, এখানে সরল ও ন্যায়সঙ্গত ভাবে যুদ্ধ করেছেন—ইনি স্বর্গলাভ করবেন এটা সুনিশ্চিত।’

বিরক্ত বলদেব সেই মুহূর্তেই রণস্থল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে একেবারে দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করলেন, কোনমতেই এখানে বিশ্রাম বা পাণ্ডব-শিবিরে আতিথ্য গ্রহণে সম্মত হলেন না।

অতঃপর—যাঁরা ধর্ম-অধর্মের অত সূক্ষ্ম নীতি অবগত নন সেইসব পাণ্ডবপক্ষীয়গণ সিংহনাদ ও ভীমের প্রশংসাসূচক জয়ধ্বনি করতে লাগলেন এবং সুযোগ পেয়ে দুর্যোধনকে তাঁর পূর্বকৃত অন্যায় আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে কটুবাক্যে ধিক্কার ও গালাগালি দিতে লাগলেন। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টায় বললেন, ‘নির্জিত নির্জীব শত্রুকে উষ্ণবাক্যে ধিকৃত করা উচিত নয়। শত্রুর পতনেই বৈরর শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দুর্যোধন ইতিপূর্বেই নিহত হয়েছেন—যখন সুহৃদগণের গুরুজনের পরামর্শ লঙ্ঘন করেছেন প্রত্যুত তখনই এঁর মৃত্যু ঘটেছে। মৃত ব্যক্তিকে গালি দিয়ে লাভ কি?’

গালাগালি সহ্য হয়েছিল, বাসুদেবের এই করুণা সহ্য হ’ল না। দুর্যোধন অতিকষ্টে শেষকালে শেষবারের মতো দুই বাহুতে ভর দিয়ে অর্ধোত্থিত হয়ে বললেন, ‘কংসের ক্রীতদাসপুত্র, অন্যায় যুদ্ধে আমাকে পরাজিত ক’রে ক্ষত্রিয় সমাজে মুখ দেখাতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? তুমিই ভীমসেনকে নাভির নিম্নে আঘাতে প্ররোচিত করেছ, তুমি অর্জুনকে কি বলছিলে তা আমি লক্ষ্য করেছি। তুমিই শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে ভীষ্মবধের পরামর্শ দিয়েছিলে, অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ দিয়ে দ্রোণবধও তোমারই কুকীর্তি, অসহায় কর্ণকে আঘাত করার উপদেশও তোমার। তোমার কূটনীতিতেই অন্যায় যুদ্ধ ক’রে পাণ্ডবরা জয়ী হয়েছেন, নইলে ওঁদের সাধ্য ছিল না।’

শ্রীকৃষ্ণ শান্ত অথচ কঠিন কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের গর্বান্ধ পুত্র, মনুষ্যের সঙ্গে আচরণেই মনুষ্যত্বর প্রশ্ন ওঠে, যে ক্ষাত্রধর্ম যথাবিহিত পালন করে তার প্রতি আচরণেই ক্ষাত্রধর্মের নিয়ম পালিত হয়। ভীষ্ম পাণ্ডবদেরও পিতামহ, তত্রাচ তিনি তোমার প্রীতিকামনায় তাদের অনেক অনিষ্ট করেছেন—তাঁর পতন সেই কারণেই দ্রোণ স্বধর্ম ত্যাগ ক’রে তোমার আদেশে যুদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন, তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে বধ করেছেন। অর্জুন বহু সুযোগ পেয়েও কর্ণকে বধ করেন নি, নচেৎ বিরাট নগরে উত্তর গোগৃহের যুদ্ধেই তিনি—শুধু তিনি কেন—তুমি ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা সকলেই নিহত হতে। অর্জুন নীচ কার্য করেন না বলেই সেযাত্রা রক্ষা পেয়েছ। তুমি অতিরিক্ত লোভ ও অপরিমাণ শক্তিমত্ততায় নিজেই নিজের এবং নিজবংশ নাশের কারণ হয়েছ। মনুষ্য মাত্রেই এই জন্মেই কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। তুমিও তাই করছ মাত্র। এক্ষণে পরকে গালি দিও

না, তাদের উপর দোষারোপও করো না—নিজের কর্মের কথা স্মরণ ক’রে নির্মোহ শান্ত চিত্তে স্বর্গে গমন কর।’

দুর্যোধন সক্ষোভে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ ক’রে বললেন, ‘আমি সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়ে পূর্ণ ক্ষাত্রধর্ম রক্ষা করেছি। সেজন্যই স্বর্গে যাব। কিন্তু তুমি! তুমিও তোমার কৃতকর্মের, ভারতের সমগ্র ক্ষাত্রশক্তি-নাশরূপ মহাযজ্ঞের ফল ভোগ করবে—আজ মৃত্যুর পূর্বে এই কামনাই ক’রে যাচ্ছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *