২.০১ পাঞ্চজন্য – দ্বিতীয় খণ্ড

পাঞ্চজন্য – দ্বিতীয় খণ্ড

উৎসর্গ
রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের প্রবীণ সন্ন্যাসী পরম পূজনীয় স্বামী রঘুবরানন্দজীর করকমলে

বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বক্তব্য অতি শান্ত ও স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, বক্তব্যের গুরুত্ব হিসেবে অতি সংক্ষেপেও—কিন্তু তাতেও সে সভা কিছুকালের জন্য নিশ্চল ও নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

যুধিষ্ঠির দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁদের জীবনের সকল সংকটকালে বাসুদেবের উপদেশ নির্দেশ পরামর্শে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এক্ষেত্রেও নিরুপায় বিমূঢ়তায় তাঁরই মুখাপেক্ষী হবেন, এ স্বাভাবিক। তিনি দ্রুপদ-পুরোহিতের দৌত্য, সঞ্জয়ের প্রতিদৌত্য, তাঁদের অভিলাষ ও আশার বিবরণ জানিয়ে বাসুদেবের দিকেই জিজ্ঞাসুনেত্রে চেয়েছিলেন। কিন্তু তবু ঠিক এ উত্তর ও আশ্বাস আশা করেন নি।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘রাজাধিরাজ, সঞ্জয়-দৌত্যের বিবরণ আমি পূর্বেই অবগত হয়েছি। আপনার অভিপ্রায় ও বক্তব্যও শুনলাম। আপনার মন ও বুদ্ধি চিরদিনই ধর্মকে আশ্রয় ক’রে আছে, আজও তা থেকে আপনি বিচ্যুত হতে চান নি, সে আচরণ আপনার মর্যাদা বৃদ্ধিরই অনুকূল। কিন্তু অপরপক্ষের মতি কেবল শত্রুতারই অনুবর্তন করছে। তারা বিনা আয়াসে অপরিমাণ ঐশ্বর্য ও প্রভূত শক্তি লাভ করেছে, তাদের লুব্ধতা বেড়েই যাবে এও স্বাভাবিক। তারা বিনাযুদ্ধে কিছুই প্রত্যর্পণ করবে না। বিশেষ ইতিমধ্যেই তারা যে রকম বলসঞ্চয় করেছে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রভৃতি বীরগণ তো তাদেরই বেতনভুক—তারা একটু স্পর্ধিত ও জয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছে, তাতেও সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। তেমনি আপনার পক্ষেও দীনতা প্রকাশের কোন হেতু নেই। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সন্ন্যাসগ্রহণ বা ভিক্ষাজীবী হওয়া অধর্মাচরণ বলেই গণ্য হয়। দীনভাব অবলম্বন ক’রে জীবনাতিপাত করা আপনার পক্ষে অকর্তব্যও। আপনি সমুচিত বিক্রম প্রকাশ ক’রে বৈরীনাশ ও নিজ রাজ্য পুনরধিকার করুন। উদ্যোগ আয়োজন সেইভাবেই চলতে থাকুক—তবে আপনার মনোভাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই আমি নিজেই আর একবার কৌরবসভায় যাবো সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে । তবে তাতে শত্রুমনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন হবে, এমন আশা রাখবেন না।’

আলোচনা বা মন্ত্রণা-সভা বসেছিল পাণ্ডবশিবিরে। মৎস্যদেশের এক প্রান্তে উপপ্লব্য নগর—এইখানেই আপাতত পাণ্ডবরা বাস করছেন। মৎস্য-রাজ বিরাটই এই ব্যবস্থা করেছেন, রাজচক্রবর্তীর পক্ষে অপর রাজ্যের রাজধানীতে বা তাঁদের প্রাসাদে বাস করা মর্যাদাহানিকর। সেটা বুঝেই, অভিমুন্যর বিবাহের পূর্বেই বিরাট এখানে ওঁদের বসবাসের ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছেন। বিরাট-দুহিতা উত্তরার সঙ্গে সুভদ্রাতনয় অভিমুন্যর বিবাহোৎসবও এখানেই সম্পন্ন হয়েছে। বিরাট আসন্ন প্রয়োজন বুঝে হস্তী অশ্ব রথ—যৌতুক হিসাবে এই সবই বেশী দিয়েছেন। তাঁদের আত্মপ্রকাশের সংবাদ পেয়ে চারিদিক থেকে পাণ্ডবদের আত্মীয়, কুটুম্ব, বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরাও এখানেই সমবেত হয়েছেন। ফলে কিছুদিন পূর্বেকার কণ্টক গুল্ম আচ্ছাদিত প্রস্তরাকীর্ণ রুক্ষ প্রান্তর জনসমাকীর্ণ ও পাণ্ডবশক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

কৌরবদের সঙ্গে পাণ্ডবদের অথবা বলা উচিত যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে শঠ সৌবলের দ্বিতীয়বারের দ্যুতক্রীড়ায় শর্ত ছিল— যাঁরা পরাজিত হবেন, তাঁরা সপরিবার রাজ্য, রাজশক্তি ও সম্পদাদি সমস্ত ত্যাগ করে দ্বাদশ বৎসরের জন্য অরণ্যবাস করবেন এবং তার পরও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবেন। এইখানেই পণের সমাপ্তি নয়—আরও শর্ত ছিল। এই ত্রয়োদশ বৎসর-মধ্যে তাঁদের উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া গেলে পুনশ্চ দ্বাদশ বৎসর বনবাস করতে হবে।

যুধিষ্ঠির যে আবারও পরাজিত হবেন সে তো প্রায় পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের মতোই অবধারিত ছিল। সুতরাং পাণ্ডবদেরই অজিন-চর্ম সম্বল ক’রে বনে যেতে হয়েছিল। তারপর—সে দ্বাদশ বৎসর অতিক্রান্ত হলে—তাঁরা যুধিষ্ঠিরের এককালীন বয়স্য, প্রাক্তন সূপকার, অশ্বপাল,—ইত্যাদি পরিচয়ে বিভিন্ন সময়ে—মৎস্যরাজসভায় এসে কর্মপ্রার্থনা করেছিলেন ও তা পেয়েও ছিলেন। দ্রৌপদী এসে সৈরিন্ধ্রী* পরিচয়ে মহিষীর সহচরীরূপে কর্মগ্রহণ করলেন। বললেন, তিনি পাণ্ডবমহিষী কৃষ্ণার সেবিকা ছিলেন, প্রসাধনকর্মে নিযুক্ত থাকতেন ও অবসর সময়ে কাব্যপাঠ কৌতুককাহিনী বর্ণনা ইত্যাদি দ্বারা মনোরঞ্জন করতেন। ভীম বল্লভ নামে রন্ধনশালায়, নকুল গ্রন্থিক নামে অশ্বশালায় ও সহদেব তন্ত্রিপাল নামে রাজার গোশালায় অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন। অর্জুন অলঙ্কার ইত্যাদির দ্বারা ভূষিত হয়ে নপুংসক এই পরিচয়ে রাজঅন্তঃপুরের নৃত্যশিক্ষক নিযুক্ত হলেন, নাম বললেন বৃহন্নলা। তার পূর্বে তাঁরা সারথি, পাচক, পরিচারিকা ইত্যাদি সহ পুরোহিত ধৌম্যকে রাজা দ্রুপদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের অগ্নিহোত্র বা যজ্ঞাগ্নি। সেইখানে তাঁদের প্রতিনিধিরূপে ধৌম্যই প্রতিদিন যজ্ঞ করবেন। রথ ও সারথিদের নিয়ে ইন্দ্রসেন দ্বারকায় চলে গেল।

[* উচ্চস্তরের পরিচারিকা, যাঁরা কেবল রন্ধনাদি ও প্রসাধনে সাহায্য করেন, কোন নীচকর্ম করেন না। কতকটা সখী বা সহচরীর মতো বাস করেন। ]

পাঞ্চাল গমনের পূর্বে ধৌম্য এঁদের রাজকর্মচারীদের যোগ্য আচরণ সম্বন্ধে যে অমূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি মন দিয়ে শুনে তার গুরুত্ব অনুভব ক’রে সেই মতো চলায় কোন অসুবিধা হয় নি।*

[* ’যতই প্রিয় পাত্র হও, কখনও সেই অহঙ্কারে রাজার যান, বাহন, আসন ও শয্যা ব্যবহার করতে যেও না। রাজা বিজ্ঞাসা না করলে কখনও উপদেশ বা পরামর্শ দিও না। রাজসকাশে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন ক’রে মৌন থাকাই বিধেয়। কখনও রাজপ্রণয়িনীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করতে যেও না। যারা রাজার অহিতাচারী ও শত্রু, কখনও তাদের সঙ্গে মিত্রতা করবে না বা একান্তে কথোপকথন করবে না। অতি সাধারণ কাজও রাজার অনুমতি নিয়ে করবে। রাজার পুত্র ভ্রাতা বা মন্ত্রীও রাজার মর্যাদা লঙ্ঘন করলে রাজা তাদের ক্ষমা করেন না। মিথ্যা কথা বলো না, রাজাকে একদিকে দেবতা অপরদিকে সাক্ষাৎ অগ্নির মতো জ্ঞান করবে। তিনি যে কাজে নিয়োগ করবেন, তা যত তুচ্ছ বা অবমাননাকরই হোক –অভিমান, কোপ ত্যাগ ক’রে সাবধানে করবে। প্রভু নিযুক্ত কার্যের ফলাফল, কোন সংবাদ বা পরামর্শ জানতে চাইলে যা প্রিয় ও হিতকারী তাই বলবে, দুটির একত্র সংঘটন অসম্ভব হলে যা হিতকারী তাই বলবে। বাক্যসংযম অভ্যাস করবে, রাজার দক্ষিণ বা বাম ভাগে বসবে—পশ্চাৎভাগ দেহরক্ষীদের জন্য নির্দিষ্ট। কথা বলার সময় অধিকমাত্রায় হস্তপদ সঞ্চালন করবে না, উচ্চকণ্ঠে কথা বলবে না, বায়ু বা নিষ্ঠীবন নিঃশব্দে ত্যাগ করবে। বিশেষ-কৌতুকজনক কোন আলোচনা হলেও উন্মত্তর ন্যায় হাসবে না। রাজা মিথ্যা বললেও জনসমাজে তা প্রকাশ করবে না। উৎকোচ নেবে না, রাজপ্রদত্ত যানবাহন অলঙ্কারাদি নিত্য ব্যবহার করলে রাজা প্রসন্ন থাকবেন। রাজার দৃষ্টি-সীমার মধ্যে ও কখনও কারও সঙ্গে নিভৃতালাপ করবে না। নিজের শক্তি বা বিদ্যার অহঙ্কার করবে না, রাজাদেশ পালনের সময় রাজার অধিকার বিষয়ে প্রশ্ন করবে না।’ ইত্যাদি— ]

অশান্তি কিছু হয়েছিল কৃষ্ণাকে নিয়েই। রাজশ্যালক কীচক ছিলেন অতিশয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, প্রকৃতপক্ষে তিনি এ দেশের শাসকের শাসক ছিলেন তিনি কৃষ্ণার রূপ দেখে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ওঁকে সম্ভোগ করতে চেয়েছিলেন, বাধা পেয়ে রাজার সম্মুখেই ওঁকে অপমান এমন কি পদাঘাত পর্যন্ত করতে দ্বিধা করেন নি। অসহায় রাজা তাতে বাধা দিতে পারেন নি, শেষে ভীমসেনই একদা অবগুণ্ঠনবতীরূপে অন্তঃপুরে এসে তাঁকে বধ ক’রে দলা পাকিয়ে সে আপদ দূর করেন।

অধিকতর অশান্তির কারণ হয়েছিল কৌরবরাই। কিন্তু একবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করবেন কি লজ্জা পাবেন—বিধাতা যেন সে ধাতুতে গঠন করেন নি ওদের। পাণ্ডবরা বনে অশেষতর ক্লেশ অনুভব করছেন তা সহজেই অনুমেয়। তবু তাঁদের দুর্দশা চোখে না দেখা পর্যন্ত যথেষ্ট তৃপ্তিলাভ হচ্ছিল না। মহারাজচক্রবর্তী অজিনধারী হয়ে তৃণশয্যায় শয়ন করছেন—এই দৃশ্য দেখার জন্য তাঁরা অধীর হয়ে উঠলেন। পাণ্ডবরা সে-সময় দ্বৈত বনে এসে বাস করছিলেন, নিকটেই কৌরবদের ঘোষপল্লী। গো গণনার নাম ক’রে মিথ্যা বলে ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে সেই বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু দৈব বিরূপ, সেই দিনই পর্বতবাসী গন্ধর্বরা এসেছিলেন সেখানে, অরণ্য-বিহার করতে। এঁরা যেমন শক্তিশালী তেমনি মায়াযুদ্ধে নিপুণ। গন্ধর্বরা প্রথমে নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলেন, অরণ্যান্তরে যেতে, কিন্তু নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে অতিমাত্রায় নিশ্চিত মদোদ্ধত কৌরবরা তাতে কর্ণপাত করেন নি, ফলে যুদ্ধ। কর্ণ যুদ্ধে যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছিত ও আহত হয়ে অপরের রথ আশ্রয় ক’রে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন, দুর্যোধন প্রভৃতি সকলেই গন্ধর্বদের হাতে পরাজিত ও বন্দী হলেন।

তখন অবশিষ্ট ভীত সৈন্যরা, অপরাপর ভৃত্য, বারাঙ্গনা ও মন্ত্রীদের দল এসে পাণ্ডবদের শরণাপন্ন হলেন। সংবাদ শুনে ভীমসেন প্রথমটায় উল্লসিত বোধ করেছিলেন, ‘আমাদের কাজ গন্ধর্বরাই সম্পন্ন করল’ বলে আনন্দ প্ৰকাশ করেছিলেন কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারে তাঁর জ্ঞান হ’ল। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘জ্ঞাতিদের মধ্যে কলহ বিবাদ হয় সে স্বতন্ত্র কথা, সে বিবাদের মীমাংসা নিজেদের মধ্যে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এখানে কুলমর্যাদার প্রশ্ন। বহির্শত্রুর কাছে তাদের লাঞ্ছনার অর্থ আমাদেরই লাঞ্ছনা। দুর্যোধন যা-ই করুন, একই বংশের সন্তান আমরা, সে কথা বিস্মৃত হয়ো না। বিশেষ গন্ধর্বরাজ কুরুভ্রাতাদের সঙ্গে পুরনারীদেরও বন্দী করেছেন। উদাসীনবৎ নিষ্ক্রিয় থেকে এ অবমাননা সহ্য করা আমাদের একেবারেই উচিত নয়। তা ছাড়াও—কুরুপক্ষীয়গণ দীনভাবে আমাদের শরণ গ্রহণ করেছেন— এই তো যথেষ্ট প্রতিশোধ, নয় কি? যাও, তোমরা চার ভাই গিয়ে যুদ্ধ ক’রে দুর্যোধনদের মুক্ত করে আনো।’

অগত্যা তাঁরা বর্মচর্ম ধারণ ক’রে রথারূঢ় হয়ে গন্ধর্বরা যেখানে বিহার করছিলেন অরণ্যের সেই অংশেই গেলেন। কৌরবসৈন্যরা ওঁদের দেখে জয়ধ্বনি করে উঠল! গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনেরই বরং বিস্ময়ের সীমা রইল না। পাণ্ডবরা তাঁর মিত্র, অর্জুনকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। তিনি বললেন, ‘আমি তো তোমাদের প্রিয়সাধন করছি ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিলাম, তোমরা আবার ওদের হয়ে যুদ্ধ করতে এসেছ কেন?

অর্জুন বললেন, ‘আপনি মহাভ্রম করেছেন। যারা যোদ্ধা ও বীর—নিজেদের অপমান ও ক্ষতির প্রতিশোধ নিজেরাই গ্রহণ না করলে তাদের তৃপ্তি হবে না। আমাদের শত্রু আমরাই নাশ করব—নইলে যুদ্ধবিদ্যা আয়ত্ত করাই তো ব্যর্থ হয়। আর তারা আমাদের জ্ঞাতি, তাদের রক্ষা করা আমাদের কুলধর্ম। মহারাজ-চক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের অনুরোধ আপনি ওদের মুক্তি দিন।’

চিত্রসেন যুধিষ্ঠিরের সম্মানরক্ষায় বিলম্ব করেন নি। তৎক্ষণাৎ কুরুভ্রাতাদের তাঁর সম্মুখে উপস্থিত ক’রে মুক্তি

দিলেন ও ওঁদের যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানিয়ে অর্জুনকে আলিঙ্গন ক’রে বিদায় নিলেন। যুধিষ্ঠির নতবদন দুর্যোধনের পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, ‘তুমি নিশ্চিন্ত চিত্তে গৃহে ফিরে যাও। এর জন্য মনে কোন গ্লানি রেখো না। তবে এমন দুঃসাহসের কাজ আর করো না।’

দুর্যোধন মৃত্যুর অধিক দুঃসহ এই অপমানে লজ্জায় দুঃখে বিদীর্ণ-চিত্তে ওঁকে প্রণাম ক’রে প্রায় অবশভাবে রথে উঠলেন। কিছুদূর গিয়ে এক নদীতীরে নেমে আর নাকি যেতে চান নি, প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প প্রকাশ করেছিলেন—শেষ পর্যন্ত শকুনি, দুঃশাসন ও কর্ণের বিস্তর অনুনয় ও অসংখ্য যুক্তির প্রয়োগে কিছুটা সান্ত্বনা লাভ ক’রে গৃহে ফিরেছিলেন।

অতঃপর জ্ঞাতিদের দুঃখ দর্শনে আনন্দলাভের সাধ বিসর্জন দিলেও এই ত্রয়োদশ বর্ষ অতিক্রান্ত হওয়ার শেষে আরও একবার কৌরবদের পাণ্ডবহস্তে লাঞ্ছিত ও নির্জিত হতে হয়েছিল—তবে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।

কৌরবরা অবশ্য ইত্যবসরে পাণ্ডবদের সন্ধান-প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি করেন নি! ধূর্ত সমাচার-সংগ্রহ-কৌশলী অভিজ্ঞ চরদের প্রচুর অর্থ ও অন্য সহায় দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল—বহু নব নব কর্মীও নিযুক্ত করা হয়েছিল আশাতীত পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে। কোথায় কোথায় পাণ্ডবদের আত্মগোপন ক’রে থাকা সম্ভব তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না। এক এক জন এক এক প্রকার উপদেশ-নির্দেশ দিতেন, সেই ভাবেই চর প্রেরণ করা হত। যেমন কৃপাচার্য বলতেন, ‘পাণ্ডবরা যে দেশে থাকবেন তাঁদের পুণ্যপ্রভাবে সেখানকার সুখ সমৃদ্ধি ও শ্রী অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। কোন দেশ অকস্মাৎ শক্তি ও সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়ে উঠছে তোমরা সেই সন্ধান করো।’

কিন্তু বৎসরকাল দ্রুত অতিক্রান্ত হয়ে এল, শেষের দিকে সন্ধান-চেষ্টা তীব্রতম ক’রে তোলা সত্বেও তা সফল হল না। তৎপরিবর্তে নূতন এক অভিযান তথা অপমান বরণে প্রবৃত্ত হলেন এঁরা। পাপ পাপেরই সহায়তা প্রার্থনা করে ত্রিগর্ত দেশের রাজা সুশর্মার বুদ্ধি ও মতি কৌরবদের মতির পথ ধরেই চলে। তিনি এসে এঁদের সংবাদ দিলেন, সেই কীচক ও তাঁর ভ্রাতারা এক অজ্ঞাত গন্ধর্বর* হাতে নিহত হয়েছেন। কীচক অত্যন্ত পাষণ্ড অত্যাচারী ছিলেন, অধার্মিক ও ক্রর —তেমনি অসমসাহসিক যোদ্ধা ও শূরও ছিলেন। তাঁর একদল মহাপরাক্রান্ত, পাপকর্ম-সহচর ছিল, এরা অপর দেশ থেকে যদৃচ্ছ সম্পদ লুণ্ঠন করে আনত, কিন্তু অপরের মৎস্যদেশ উৎসাদনে সাহসী হত না। এখন বিরাট অসহায়। অথচ বিরাট রাজার গোধন অনিঃশেষ,—ওঁর নামের সঙ্গে সমতা রেখেই যেন সে গোশালা বিরাট, বিপুল, একটা ছোটোখাটো রাজ্যের মতো। দুর্যোধনের বাহিনীর সঙ্গে ত্রিগর্তের বাহিনী যুক্ত হলে তার সবটাই হরণ করা যেতে পারে। দুর্যোধনের সম্পদভূষা চিরঅতৃপ্ত, নিত্যবর্ধমান। পাণ্ডবদের অপরিমেয় ঐশ্বর্য করায়ত্ত হওয়া সত্বেও যেন তাঁর আশা মেটে নি। তিনি এ প্রস্তাবে উল্লসিত হয়ে উঠলেন—গুরুজনদের সুচিন্তিত পরামর্শ বা নিষেধ শুনবেন এমন পাত্র তিনি নন—এবং তখনই কর্ণ, সৌবল ও দুঃশাসন প্রভৃতি অন্তরঙ্গ-সহ সুশর্মার সঙ্গে অকারণ পরস্বাপহরণ-পরিকল্পনা চূড়ান্ত ক’রে ফেললেন। স্থির হ’ল আগামী কৃষ্ণা সপ্তমীতে সুশর্মা মৎস্যগোগৃহের দক্ষিণভাগ আক্রমণ করবেন। সংবাদ পেয়ে বিরাট অবশ্যই সদল-বলে বাধা দিতে যাবেন, সেই অবসরে পরদিন প্রভাতেই দুর্যোধন-বাহিনী উত্তরগোগৃহে গিয়ে পড়বে।

[* সৈরিন্ধ্রী বলেছিলেন, তাঁর গন্ধর্ব স্বামী এক বিশেষ কারণে অজ্ঞাতবাসে আছেন কিন্তু তিনি সর্বদাই তাঁর সংবাদ রাখেন— কোন বিপদ হলেই এসে ত্রাণ করবেন বা কেউ অপমান করলে দুর্বৃত্তকে শাস্তি দেবেন।]

পরিকল্পনায় কোন ত্রুটি ছিল না, ওঁরা সব দিকই বিবেচনা করেছিলেন কেবল বিরাট রাজের বিভিন্ন কার্যভারপ্রাপ্ত নবনিযুক্ত পাঁচটি কর্মচারীকে হিসাবে ধরেন নি। ধরেন নি—তার কারণ তাদের অস্তিত্বই জানতেন না। বিরাট যে যুদ্ধ- যাত্রার সময় তাঁর বয়স্য, দ্যুতক্রীড়ার সহচর কঙ্ক অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইবেন এবং তাঁর পরামর্শেই গ্রন্থিক বল্লভ তন্ত্রিপালকে, তা কে জানত! সুশর্মা কীচককেই জানতেন, একাধিকবার তার উপদ্রব সহ্য করতে হয়েছে— এই চারজন অপরিচিত যোদ্ধার নাম পরিচয় কিছুই তার জানা ছিল না। এদের শৌর্যে রণনৈপুণ্যে, সৈন্য পরিচালনার অভিজ্ঞতায় যেমন তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না, তেমনি শোচনীয় ভাবেই পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। পিছনে রেখে গেলেন অগণিত মৃত সৈন্য ও সেনানায়ক।

এসব সংবাদ দুর্যোধন পান নি। পাওয়ার কথাও নয়। তিনি পূর্বনির্দিষ্ট সময়েই উত্তরগোগৃহে যাত্রা করলেন। সে দুর্দৈব-বার্তা বহন ক’রে যখন ভীতসন্ত্রস্ত গোসেবকরা বিরাট পুরীতে পৌঁছল, তখন কিশোর রাজকুমার উত্তর ভিন্ন কেউ নেই সেখানে। কৌরবদের পরাক্রমের কথা তাঁর অবগত হওয়ার কথা নয়—ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অশ্বত্থামার বীরত্ব কাহিনী দূরশ্রুত রূপকথা মাত্র—সুতরাং তিনি অকুতোভয়ে অন্তঃপুরে আস্ফালন ক’রে বেড়াতে লাগলেন, যদি একজন ভাল সারথি থাকত তো তিনি একাই যুদ্ধ ক’রে কৌরবদের বিতাড়িত করতেন।

সে খেদোক্তি সৈরিন্ধ্রীর কর্ণগোচর হতে কোন বাধা ছিল না। তিনি আশ্রয়দাতার এই বিপদের কথা শ্ৰবণ পর্যন্তই বৃহন্নলার কথা চিন্তা করছিলেন, এখন সুযোগ পেয়ে, কুমারের অজ্ঞতায় স্বতোত্থিত কৌতুক-মৃদু-হাস্য অধরকোণেই সম্বরণ ক’রে নিয়ে তাঁকে গিয়ে জানালেন, নৃত্যশিক্ষক বৃহন্নলা ইতিপূর্বে প্রয়োজনের সময় দু-চার বার মহারথ অর্জুনের সারথ্য করেছেন, রাজকুমার তাঁকে সারথি করতে পারেন।

উত্তর বিস্মিত ও বিস্ফারিত নেত্রে বললেন, ‘কিন্তু ও তো নপুংসক, নারীবেশধারী। ও রথ চালাবে কি?’ ‘বললাম তো—এ-কার্য ইতিপূর্বে একাধিকবার করেছে, বেশ পারবে। আপনি বলেই দেখুন না।’

বৃহন্নলাবেশী অর্জুন বোধ করি এই সুযোগই সন্ধান করছিলেন, তাঁর বীরের বাহু বহু দিন—বৎসরকাল ধনুঃশর ধারণের আনন্দস্বাদ বা বিলাসোপভোগে বঞ্চিত, যুদ্ধযাত্রার জন্য যৎপরোনাস্তি অধীর ও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রথম প্রথম দু-একবার ত্রাস ও অজ্ঞতার ভান করে, পুরস্ত্রী-মধ্যে হাস্যরোলের তরঙ্গ তুলে, সম্মত হয়ে গেলেন। উত্তর যা যুদ্ধ করবেন তা তিনি তো জানতেনই, যুদ্ধ তাঁকেই করতে হবে। তিনিও তাই চান। এই সুযোগে গত দ্বাদশ বৎসর একাগ্র ভাবে, তপস্যার মতো ক’রে আরও যেসব রণকৌশল আয়ত্ত করেছিলেন, সংগ্রহ করেছিলেন নব নব অধিকতর শক্তিশালী অস্ত্রক্ষেপণের শিক্ষা—তার কিছু পরিচয় কৌরবদের পরিবেশন না করা পর্যন্ত শান্তিলাভ করতে পারছিলেন না ।

অর্জুনের অনুমানই নির্ভুল প্রতিপন্ন হ’ল। দূর থেকে সেই দৃষ্টি-সীমাতীত সমুদ্রের মতো বিশাল কৌরববাহিনী দেখে উত্তরের কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে গেল, মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত ও হস্তপদ কম্পিত হতে লাগল। তিনি তখনই বৃহন্নলাকে রথের অশ্ব গৃহাভিমুখী করতে আদেশ দিলেন। কিন্তু বৃহন্নলা তো প্রত্যাবৃত্ত হতে আসেন নি। তিনি বিবিধ-সান্ত্বনা-বাক্যে রাজকুমারকে উৎসাহিত করার অভিনয় করতে করতে রথ ক্রমাগত সেই সমূহ-বিপদ—সাক্ষাৎ যমদ্বারের দিকেই চালনা করতে লাগলেন। উত্তর অনন্যোপায় দেখে রথ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে পলায়নের চেষ্টা দেখলেন।

এবার বৃহন্নলা স্বমূর্তি ধারণ করলেন। ছুটে গিয়ে বজ্রমুষ্ঠিতে উত্তরের কেশ ধারণ ক’রে নিজের পরিচয় দিলেন। এবং যথোচিত অভয় ও আশ্বাস দিয়ে উত্তরকে সারথির কাজ করতে বলে নিজে ধনুঃশর ধারণ করলেন। যে শমীবৃক্ষে ওঁদের নিজস্ব অস্ত্রাদি গুপ্ত রাখা হয়েছিল— সৌভাগ্যক্রমে সেটা উত্তরগোগৃহেরই সন্নিকট, সেখান থেকে ওঁর ভুবনবিখ্যাত গাণ্ডীবধনু ও অক্ষয় তূণীর সংগ্রহ করতেও অসুবিধা হ’ল না।

এবার কৌরবদের চমকিত ও সন্ত্রস্ত হওয়ার পালা।

এ জ্যা রোপণ, ধনুর এই গম্ভীর টঙ্কার, তীর নিক্ষেপছলে ভীষ্ম দ্রোণকে প্রণাম ও কুশল প্রশ্ন—চিনতে বিলম্ব হ’ল না। একটিই মাত্র ব্যক্তি আছে যার দ্বারা এ সম্ভব। নারীবেশী এ ক্লীব কে–তা এমন কি দুর্যোধন ও কর্ণও বুঝতে পারলেন। এঁরা তিন-চারজন প্রথমটা খুব উৎসাহিত হয়েও উঠেছিলেন। অজ্ঞাতবাসের নির্দিষ্টকাল মধ্যেই অর্জুন দেখা দিলেন, অতএব আবারও দ্বাদশ বর্ষের জন্য বনে যেতে হবে পাণ্ডবদের— এই কল্পনা ক’রে কিন্তু ভীষ্ম তিথি-নক্ষত্রের বিচিত্র গতিবিধির হিসাব করে দেখিয়ে দিলেন, ত্রয়োদশ বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েও দ্বাদশদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ কথা পাণ্ডবরাও জানতেন, নকুল পূর্বেই এ গণনা করেছিলেন।*

[* ভীষ্ম কহিলেন, কালচক্রে কলা, কাষ্ঠা, মুহূর্ত, দিবারাত্রি, পক্ষ, মাস, ঋতু, বর্ষ, গ্রহ ও নক্ষত্র সকল যোজিত আছে। এইরূপে কালবিভাগ দ্বারা সে চক্র প্রবর্তিত হইতেছে। গ্রহগণ-সম্বন্ধীয় গতির কালাতিরেক ও নক্ষত্রপুঞ্জের ব্যতিক্রম অর্থাৎ চন্দ্র সূর্য কর্তৃক লঙ্ঘন প্রযুক্ত, প্রতি পঞ্চম বর্ষে দুই মাস করিয়া অধিক হইয়া উঠে।
—মহাভারত, বিরাটপর্ব]

শিক্ষা পেলেন দুর্যোধন রীতিমতোই। বিখ্যাত বীরেরা একদিকে, তৎসহ এক অনীকিনী সৈন্য, অপরদিকে অর্জুন একা। কিন্তু প্রহরকালের মধ্যেই তাঁরা ক্ষত-বিক্ষত অবসন্ন হয়ে পড়লেন। প্রাণ যে রক্ষা পেল সেটা নিতান্ত অর্জুনের অনুগ্রহে। শেষে হতোদ্যম অপমানিত লাঞ্ছিত দুর্যোধনকে পশ্চাদপসরণেরই আদেশ দিতে হ’ল। বিজয়ী উত্তর অক্ষতদেহে রাজপুরীতে ফিরে এলেন।

এবার আর পরিচয় দেবার কোন বাধা রইল না। পাণ্ডবরা তাঁর আশ্রয়ে ছিলেন জেনে বিরাট যেমন গর্ব তেমনি আনন্দ বোধ করতে লাগলেন। অর্জুনের পরিচয় পেয়ে ও উত্তরগোগৃহ-যুদ্ধে তাঁর কৃতিত্বের কথা শুনে বিরাট তাঁর সঙ্গে কন্যা উত্তরার বিবাহ প্রস্তাব করলেন। কিন্তু অর্জুন সম্মত হলেন না। বললেন, ‘এক বর্ষকাল নারীবেশে আপনার অন্তঃপুরে বাস করেছি, কুলঅন্তঃপুরিকারা সহজভাবে আমার সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। বিশেষ আপনার কন্যাকে আমি নৃত্যগীত শিক্ষা দিয়েছি। এখন তাকে বিবাহ করলে লোকে নানা সন্দেহ করবে, আমার দুর্নাম এবং আপনার সম্ভ্রমহানি ঘটবে। শিষ্যা ছাত্রী কন্যার মতোই। আমি তাকে স্ত্রী নয়—আমার পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করলাম। আমার পুত্র অভিমুন্য বৃষ্ণিবংশীয় বাসুদেবের ভাগিনেয়, সুভদ্রার গর্ভজাত। এখন তার ষোড়শ বর্ষ বয়স, গত ত্রয়োদশ বৎসর সে শ্রীকৃষ্ণের গৃহেই বাস করেছে, তার শিক্ষার কোন ত্রুটি রাখেন নি তিনি। এই বয়সেই সে দুর্ধর্ষ বীররূপে গণ্য হয়েছে। অতিশয় কান্তিমানও। সর্বাংশেই সে উত্তরার উপযুক্ত। আপনি তার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিলে একই বিবাহে পাণ্ডব ও যাদবগণ আপনার আত্মীয়ে পরিণত হবে।’

এ প্রস্তাবেই সম্মত হতে হ’ল বিরাটকে। অর্জুনকে জামাতা রূপে লাভ করার গৌরবেই তাঁর লোভ বেশী ছিল, তবু অর্জুনের এ বিবাহ না করার যুক্তিও যে প্রবল—তাও তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।

এ বৈবাহিক সম্বন্ধ ও পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস-পূর্তির সংবাদ দ্বারকায় পৌঁছতে, সেখানের সম্মতি আসতে, বিবাহের আয়োজন—উভয় পক্ষেরই—সমাপ্ত হতে, যাদবদের উপপ্লব্যে উপনীত হতে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হ’ল। যেখানে অশ্ব ও রথই দ্রুততম বাহন ও যান, সেখানে সময়ের হিসাব সেইভাবেই অনুমান করতে হয়, বিবাহের দিনও সেই ভাবেই স্থির হয়েছিল। অন্ধক ও বৃষ্ণিপ্রধানরা উপযুক্ত যৌতুক, আত্মীয় বান্ধব অনুচর দাসদাসী, মাতুল-প্রদেয় বস্ত্র, অলঙ্কার, তৈজস, অশ্ব, রথ, হস্তী প্রভৃতি সহ এসে পৌঁছবারও দুইপক্ষ কাল পরে বিবাহ-উৎসব সম্পন্ন হ’ল। কারণ অকস্মাৎ এতগুলি লোকের অভ্যর্থনা বা আতিথ্য বিরাটের পক্ষে গুরুদায়িত্ব বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। অভিজ্ঞ পাণ্ডবরা তাঁর সাহায্যার্থে অগ্রসর না হলে হয়ত তিনি সে কর্তব্য সম্যক পালন করতেও পারতেন না, কিছু কিছু কুটুম্ব স্বজন অসন্তুষ্ট হতেন।

এই দীর্ঘকাল সময় অবশ্য কোন পক্ষই বৃথা অতিবাহিত করেন নি। যুদ্ধ যে অনিবার্য তা সকলেই জানতেন। দুই দলই দেশে দেশে বিচক্ষণ দূত প্রেরণ করেছেন, সেসব দেশের রাজশক্তির সাহায্য প্রার্থনা ক’রে। পাণ্ডব পক্ষে পাঞ্চাল মৎস্য চেদী মণিপুর ও নাগরাজ্যের বাহিনী ও যাদবদের সর্বতো-সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু দেখা গেল শৌর্যে বীর্যে শিষ্টাচারে পাণ্ডবরা যত প্রবীণই হোন, কূটকৌশলে ধার্তরাষ্ট্রদের কাছে তাঁরা শিশু। মদ্ররাজ শল্য, পাণ্ডবদের মাতুল, নকুল সহদেবের আপন মাতুল—এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে উপপ্লব্য অভিমুখে যাত্রা করছেন শুনেই দুর্যোধন তাঁর আগমনের পথে পথে তোরণ বিশ্রামাগার প্রভৃতি স্থাপন সুভোজ্য উৎকৃষ্ট সুরা ও মৌরেয় প্রভৃতি পানীয় সেবকসেবিকা পুষ্পমাল্যাদির এমন সুব্যবস্থা করলেন যে অভিভূত শল্য অবশেষে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলেন –’এসব আয়োজন, এত বিবেচনা কার?’ দুর্যোধন প্রচ্ছন্নভাবে নিকটে ছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে এসে করজোড়ে বললেন, ‘এ আমাদের যৎসামান্য সেবার প্রচেষ্টা। পাণ্ডবদের মাতুল, সে হিসাবে আপনি তো আমাদেরও গুরুজন।

‘না-না, যৎসামান্য কেন, এ তো প্রভূত। আমি বড় তুষ্ট হয়েছি। বৎস, তোমার যদি কোন প্রার্থনা থাকে তো নিঃসঙ্কোচে জানাও।’

দুর্যোধন বললেন, ‘প্রার্থনা পূরণই যদি করতে চান, তবে দয়া করে আপনি সসৈন্যে আমাদের পক্ষে যোগ দিন—এই একমাত্র প্রার্থনা।’

এই ভাবে মদ্ররাজ নিজের অনুগ্রহ-জালে নিজেই বদ্ধ হলেন। শুধু পাণ্ডবদের শিবিরে এসে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিজের নিরুপায়তা তথা নির্বুদ্ধিতার কথা প্রকাশ ক’রে এইটুকু আশ্বাস দিলেন যে, ও-পক্ষে যোগ দিলেও যতদূর সম্ভব তিনি ভাগিনেয়দের কল্যাণকর্ম করবেন।

এঁদের আশঙ্কা কর্ণকেই বেশী। তাই যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ বলে নিলেন, ‘তা যদি করেন—যদি কর্ণর ও অর্জুনের দ্বৈরথ সমর সমুপস্থিত হয়—আপনি অনুগ্রহ ক’রে কর্ণর নিকটবর্তী থেকে তার মানসিক বলহানির চেষ্টা করবেন, তাতেই যথেষ্ট সাহায্য করা হবে।’

শল্য প্রসন্ন চিত্তেই অঙ্গীকার করলেন।

দুর্যোধন কৌশলে যতই সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করুন—একটি বিষয়ে তিনি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলেন এবং এমনই মূঢ়তা যে সে পরাজয় বুঝতেও পারলেন না, ক্ষতিটাকে লাভ মনে ক’রে উল্লসিত হলেন।

অন্য সমস্ত মিত্রভাবাপন্ন নৃপতিদের কাছে দূত প্রেরণ করলেও বাসুদেবের কাছে স্বয়ং অর্জুনের যাওয়াই শ্রেয় বিবেচিত হ’ল। কুটুম্ব, আত্মীয়, বয়োজ্যেষ্ঠ, সদাহিতাকাঙ্ক্ষী—সর্বাংশেই মাননীয়—তাঁর নিকট সাধারণ দূত পাঠানো উচিত নয়। কিন্তু অর্জুন যত গোপনেই যাত্রা করুন—গুপ্তচরমুখে সে বার্তা কৌরবতথ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে বিলম্ব ঘটল না। দুর্যোধন সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী অশ্বসকল ব্যবস্থা ক’রে অনতিবিলম্বে দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করলেন। তার ফলে দুজনে প্রায় একই সময় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের প্রাসাদে পৌঁছলেন।

শ্রীকৃষ্ণ সে সংবাদ রাখতেন বৈকি! তিনি দক্ষতম ব্যক্তি ভিন্ন অপর কাউকে সংবাদ-সংগ্রাহক নিযুক্ত করতেন না। এঁদের পুরী-প্রবেশের ঠিক পূর্বেই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়লেন, যাকে বলে গভীর নিদ্রা। দুর্যোধন বা অর্জুন—উভয়ই প্রার্থী, সুতরাং কেউই ওঁর বিশ্রামের ব্যাঘাত জন্মিয়ে অপ্রীতিভাজন হতে চাইলেন না। অপেক্ষা করাই শ্রেয় বিবেচনা করলেন। বাসুদেবেরই পূর্বনির্দেশমত অন্তঃপুরপ্রতিহারিণী ওঁদের সেই শয়নকক্ষে পৌঁছে দিয়েছিল, উভয়ই আত্মীয়—সুতরাং অপর কোন কক্ষে অপেক্ষা করতে বলাটা অসৌজন্য হত। পাদ্য-অর্ঘ পানীয় প্রভৃতি আতিথেয়তা গ্রহণ ক’রে উভয়েই নিঃশব্দে সে কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং গর্বী দুর্যোধন বসলেন শিয়রে—অর্জুন বসলেন বাসুদেবের চরণোপান্তে, আনম্র ভঙ্গিতে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সশব্দ জুম্ভণ ত্যাগ ক’রে দুই চক্ষু উন্মীলিত করলেন শ্রীকৃষ্ণ। প্রথমেই চোখে পড়ল প্রিয়বন্ধু অর্জুন, উঠে বসতে অর্জুনেরই স-ইঙ্গিত দৃষ্টি অনুসরণ ক’রে দুর্যোধন।

অতঃপর সানন্দ বিস্ময় প্রকাশ, আদর আপ্যায়ন অভ্যর্থনা—কিছুরই ত্রুটি ঘটল না। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় ও পারস্পরিক কুশল প্রশ্নের পর এই আকস্মিক আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন বাসুদেব উভয়কেই। কারণ প্রার্থনা দুজনেরই এক, উপরন্তু—দুর্যোধন যোগ করলেন—তিনি প্রথম পৌঁচেছেন, তাঁর দাবিই অগ্রগণ্য।

শ্রীকৃষ্ণ একটু হেসে বললেন, ‘আপনি প্রথম এসেছেন এও যেমন সত্য, আমি প্রথম অর্জুনকে দেখেছি তাও তেমনি। সুতরাং আমি কোন পক্ষকেই একেবারে বিফল মনোরথ হতে দেব না। দেখুন আমি স্থির করেছি, এক পক্ষে আমি একা থাকব কিন্তু নিরস্ত্র, অনাহবী—অর্থাৎ যুদ্ধ করব না। অপর পক্ষে—আমার এক অক্ষৌহিণী সৈন্য আছে, যারা প্রত্যেকেই আমার বা সাত্যকির সমযোদ্ধা, সেই কারণেই তারা নারায়ণী সৈন্য নামে খ্যাত— সেই এক অক্ষৌহিণী সৈন্য থাকবে। অর্জুন বয়োকনিষ্ঠ, তাকে আমি প্রথম নির্বাচনের সুযোগ দেব। দেখ পার্থ, তুমি কাকে বা কাদের নেবে।’

অর্জুন দুটি হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ ক’রে উত্তর দিলেন, ‘আপনাকে। সশস্ত্র হোক, নিরস্ত্র হোক— যুদ্ধ করুন বা না করুন, আপনি আমার পাশে থাকুন—এই আমার প্রার্থনা।’

এবারে দুর্যোধনের দিকে ফিরে বাসুদেব বললেন, ‘তাহলে আপনি? ঐ এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে তুষ্ট থাকা ছাড়া তো উপায় দেখি না। নেবেন তো?’

‘নিশ্চয়। যুদ্ধ যদি না করেন আপনাকে নিয়ে আমার কি লাভ? আপনার কাছে পক্ষপাতশূন্য মন্ত্রণার কোন আশা নেই আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে প্রীতিবদ্ধ, মন্ত্রণা দিলে তা সর্বদা ওদের অনুকূলে যাবে। তাতে আমার প্রয়োজন নেই।

পানভোজন বিশ্রামাদি সমাপ্ত ক’রে দুর্যোধন প্রফুল্ল মুখেই বিদায় নিলেন—সাফল্যের আনন্দ-গদগদ চিত্তে। দ্বারাবতী ত্যাগ করার পূর্বে বলদেবের কাছেও গিয়েছিলেন একবার—তিনি স্পষ্টই বলে দিলেন, ‘দেখ বাপু, তোমাকে স্নেহ করি, ছাত্র শিষ্য তুমি—পরন্তু পাণ্ডবরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তদ্ব্যতীত জনার্দন যেদিকে যোগ দেবেন, তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারব না। আমি কোন পক্ষেই থাকব না, ঠিক করেছি সে সময়ে তীর্থযাত্রায় বহির্গত হব।

এখানে কোন আশা বা ভরসা নিয়ে আসেন নি, সুতরাং দুঃখিতও হলেন না। নিয়ম রক্ষা ক’রে দুর্যোধন গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন।

অর্জুন আরও দুই-একদিন বন্ধু-গৃহে অবস্থান করবেন, বর্তমানে সম্বন্ধীগৃহও বটে, পূর্বেই স্থির ক’রে রেখেছিলেন। বিশেষ বসুদেব ও সুভদ্রাজননীও জামাতাকে আপ্যায়িত করতে চাইবেন এও স্বাভাবিক। এই দুইদিনের বিশ্রাম ও বিশ্রম্ভালাপের মধ্যেই এক সময় বাসুদেব ঈষৎ কৌতুকরঞ্জিত-হাস্যমুখে প্রশ্ন করলেন, ‘আমি নিরস্ত্র ও যুদ্ধে বিরত থাকব জেনেও আমাকে নির্বাচন করলে কেন?’

অর্জুন তাঁর দৃষ্টিতে দুই চক্ষু নিবদ্ধ ক’রে ধীরকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আপনি যুদ্ধ করুন বা না করুন—আপনি যে পক্ষে থাকবেন, এ ভারতখণ্ডের সমস্ত যোদ্ধা বা সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সমরাবতীর্ণ হলেও সে পক্ষের পরাজয় ঘটবে না— এতদিনে এটুকু বুঝেছি। এও বুঝেছি এই বিগত ত্রয়োদশ বৎসরের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় যেটুকু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে, এ যুদ্ধ আপনারই সংঘটন, আমরা বা ধার্তরাষ্ট্ররা আপনারই হস্তের ক্রীড়ণক পুত্তলিকা মাত্র। আমাদের জয় আপনারই জয়লাভ। এ ক্ষত্রমেধ যজ্ঞের তথা সমস্ত যজ্ঞেরই আপনি যজ্ঞেশ্বর—নয় কি?’

বাসুদেব তাঁর স্বভাবসুলভ রহস্যময় হাস্য ক’রে নিরুত্তর রইলেন। অর্জুনের অনুমান সমর্থন করলেন কি করলেন না—তা জানা গেল না। অর্জুনও নিষ্ফল জেনে উত্তরের জন্য পীড়াপীড়ি করলেন না।

.

দ্রুপদ-পুরোহিতকে দূতরূপে প্রেরণের প্রস্তাব প্রথম কে করেছিলেন, তা এঁদের ঠিক স্মরণ নেই। তবে বিরাট প্রভৃতি অনেকেই সমর্থন করেছিলেন বাসুদেবও। বিজ্ঞ, ভদ্র এবং বহুলাংশে নিরপেক্ষ, রাজনীতির জটিলতার ঊর্ধ্বে, এই বিবেচনাতেই সম্ভবত তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল—দীর্ঘকাল যাঁরা রাজনীতির মধ্যে না থেকেছেন, তাঁদের এমন গুরুত্বপূর্ণ দৌত্যে প্রেরণ করা উচিত নয়। ব্রাহ্মণ প্রথম কিছুক্ষণ স্থৈর্য বজায় রাখলেও কৌরবপক্ষের প্রকট ও ঘৃণ্য পরধন-লুব্ধতায়—এবং তদুপরি ধৃতরাষ্ট্রের কপট হৃদ্যতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন। এঁদের সম্বন্ধে তাঁর যা মনোভাব, এঁদের যথার্থ স্বরূপ, তা দ্ব্যর্থহীন প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত তো করলেনই, শেষের দিকে কিছু কঠিন বা কটুবাক্যও বলে ফেললেন। ফলে দৌত্যের উদ্দেশ্য একেবারেই ব্যর্থ হ’ল। ভীষ্ম পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, ‘বিপ্রবর, আপনি যা বললেন তা সর্বাংশে সত্য হলেও আপনার কথনভঙ্গী অতিশয় রুক্ষ ও কটু। বোধ হয় ব্রাহ্মণ বলেই আপনি বাক্যে রাজসভার উপযোগী মাধুর্যের প্রলেপ দিতে শেখেন নি।… আপনার এ কার্যভার গ্রহণ করা অনুচিত হয়েছে। যাই হোক, পাণ্ডবরা কুশলে আছে এই জেনেই সুখী ও নিশ্চিন্ত হলাম। আপনি চিন্তা করবেন না, সশস্ত্র অর্জুন যে পক্ষে আছেন, সে পক্ষের জয় অনিবার্য। যুদ্ধ যদি হয়ই, বিজয়লক্ষ্মী পাণ্ডুপুত্রদেরই বরণ করবেন।’

অর্জুনের এই স্তুতিবাদে কর্ণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, তিনি আরও রূঢ় ও কর্কশ বাক্যে দূতকে তিরস্কার করলেন, কিছুটা কৌরবপক্ষের শক্তির আস্ফালন করলেন, নিজ শৌর্যের অহঙ্কার প্রকাশ করলেন— শেষে দূতকে জানিয়ে দিলেন পাণ্ডবরা মিথ্যাই সময়ের অপচয় করছেন, এসব দৌত্যে কোন ফললাভ হবে না।

অবশ্য তাঁর আস্ফালনের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে ভীষ্মও বিলম্ব করলেন না। তীক্ষ্ণ তিক্ত হাস্যের সঙ্গে বললেন, ‘রাধেয়,

মাত্র কিছুদিন পূর্বেও যখন একাকী অর্জুন ছ’জন মহারথীকে পরাজিত, নিরস্ত্র ও সম্মোহিত করেছিলেন, দয়া ক’রে তোমাদের প্রাণভিক্ষা দিয়েছিলেন তখন এসব আস্ফালন, এত সব শৌর্য কোথায় ছিল? সৈন্যও তো সমুদ্রসমান নিয়ে গিয়েছিলে—তখন যদি সে তোমাদের বধ ক’রে নিশ্চিন্ত হত?’

বিপুল কলহের সম্ভাবনা দেখে ধৃতরাষ্ট্র এবার এইসব বাক্যাগ্নি নির্বাপণে সক্রিয় হলেন। দূত ও ভীষ্ম উভয়কেই মিষ্টবাক্যে প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন, বললেন, ‘বিপ্রবর, আপনি কিছুই অসত্য বলেন নি, আমার পুত্ররাই অধার্মিক ও লোভী। ভীষ্মও যা বললেন তা সবই সত্য। আপনি এখন নির্বিঘ্নে ফিরে যান, আমি একটু চিন্তা করে আমার ব্যক্তিগত সচিব সঞ্জয়কে প্রেরণ করব, সে-ই আমাদের মতামত আমার পরম প্রিয়পুত্র যুধিষ্ঠিরকে জানাতে পারবে।’

মোট কথা পুরোহিতপ্রবরের দৌত নিষ্ফল ও নিরর্থক হয়ে গেল।

ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য চঞ্চল ও ব্যস্ত হয়েই উঠেছিলেন।

বহির্দৃষ্টি আবরিত বলেই অন্ধদের প্রজ্ঞাদৃষ্টি সাধারণ মানবাপেক্ষা অধিক হয়। এ জ্ঞাতি-কলহ, প্রচণ্ড আহবের ফল শুভ হবে না—তা তিনি বুঝেছিলেন। বিশেষ যুধিষ্ঠিরকে যে অন্যায়রূপে বঞ্চিত করা হচ্ছে— সে সম্বন্ধেও তাঁর মনে তিলমাত্র সংশয় ছিল না। পাণ্ডবপক্ষের শক্তিও তিনি তাঁর তথাকথিত চক্ষুষ্মান পুত্রদের অপেক্ষা অনেক নির্ভুল, যথাযথভাবে নির্ণীত করেছিলেন, বিশেষ ঘোষযাত্রা ও উত্তরগোগৃহ অভিযানের ফলাফল জ্ঞাত হওয়ার পর। কিন্তু তাঁর পুত্ররা সমধিক অন্ধ, অথবা নিয়তিতাড়িত বলেই প্রত্যক্ষ সত্যকে দেখতে পায় না। তিনি নিরুপায়—একপ্রকার পুত্রদের বন্দী।

তবু আত্মজরক্ষা অর্থেই আত্মরক্ষা সেজন্য বিচলিত হয়ে উঠে অল্পকাল মধ্যেই সঞ্জয়কে উপপ্লব্য নগরে প্রেরণ করলেন। বক্তব্য যা ধৃতরাষ্ট্রেরই অকারণ শব্দজালজটিল ও উপমাবহুল কোন স্পষ্ট-প্রতিশ্রুতিহীন সদুপদেশ মাত্র। জ্ঞাতিযুদ্ধ যে কোনক্রমেই কাম্য নয়, ভ্রাতাদের সঙ্গে সর্বাবস্থাতেই প্রীতি রক্ষা করে চলা উচিত, ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার ক’রেও—এই কথাটাই বার বার নানাভাবে বলতে লাগলেন সঞ্জয়। কেবল যখন অর্জুনকে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন, ‘আপনার মতো লোকের ভোগতৃষ্ণা ত্যাগ করাই উচিত এবং ক্ষমাই পরমধর্ম’—তখন যুধিষ্ঠিরের বিশেষ শ্রীকৃষ্ণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তবু যুধিষ্ঠির শিষ্টবাক্য ত্যাগ করেন নি, কটু সত্যকে অনাবরিত ক’রে সঞ্জয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান নি–সে কাজটি শ্রীকৃষ্ণই করলেন। দ্যুতসভায় কৌরবদের সমস্ত কুৎসিত আচরণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন—এসব উদার ও মহান আচরণ ও আদর্শের কথা সেদিন কেন মনে পড়ে নি?

তথাপি বিদায়কালে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘বেশ, আমরা প্রাপ্য রাজ্য বা সম্পদও না হয় না-ই পেলাম, দুর্যোধন আমাদের পঞ্চভ্রাতাকে পাঁচটি গণ্ডগ্রাম দিন—কুশস্থল,* বৃকস্থল, মাকন্দী, বারণাবত ও তাঁদের ইচ্ছামতো অন্য যে কোন একটি— আমরা তাতেই তুষ্ট থাকব। যুদ্ধ করার আমাদের আদৌ ইচ্ছা নেই, তবে ক্ষত্রিয় সন্তান, রাজপুত্র, রাজা—চিরদিন ভিক্ষাব্রত-ধারীর জীবনযাপন করলে অধর্মে পতিত হতে হবে, তাতে আমরা অনিচ্ছুক।’

[* পাঠান্তর ভেদে ‘অবিস্থল’।]

এর থেকে ভদ্রতা ও ঔদার্য কেউ আশা করতে পারে না, ন্যুনতম প্রার্থনা বললেও কম বলা হয়। তা ধৃতরাষ্ট্রও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, সে কথা দুর্যোধনকে বুঝিয়ে বলতেও গেলেন—কিন্তু দুর্যোধন এই মহত্ব ও শান্তিপ্রিয়তাকে দুর্বলতার লক্ষণ মনে ক’রে বললেন, ‘পাঁচখানা গ্রাম, বিশেষ অত বড় গ্রাম কেন—একটা ছুঁচের ডগায় যতটুকু মাটি ওঠে ততটুকুও আমি পাণ্ডবদের বিনাযুদ্ধে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নই।’

ভ্রষ্ট বিবেককে সান্ত্বনা দিতে একটা যুক্তিও খাড়া করেছিলেন কর্ণ। ওঁর মতে ভীষ্মের হিসাব ঠিক নয়, অজ্ঞাতবাসের বর্ষ অতিক্রান্ত হতে কয়েকদিন অবশিষ্ট ছিল। সমগ্রভাবে ত্রয়োদশ বর্ষ হিসাব ধরলে চলবে কেন, অজ্ঞাতবাসের পূর্ণ এক বৎসরের হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। দুর্যোধনও মজ্জমান ব্যক্তির তৃণাবলম্বনের মতোই সেই যুক্তি অবলম্বন করেছিলেন।

এই ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’র সংবাদ পৌঁছবার পরেই অদ্যকার এই আলোচনাসভা এবং বাসুদেবের অকস্মাৎ এ দৌত্যগমনের প্রস্তাব।

* * *

নীরবতা ভঙ্গ হতে অর্জুনই সমধিক বিচলিত বোধ ক’রে ব্যাকুলভাবে বলে উঠলেন, ‘না না। আপনি নয়—আপনি যাবেন কেন? আপনি যাবেন না। তারা জানে, এতদিনে ভাল ভাবেই জেনেছে যে, আপনি আমাদের সর্বাধিক সহায়— বল বুদ্ধি ভরসা, আমাদের সর্বৈব শক্তি। আপনার কোন ক্ষতি করতে পারলে আমাদের ক্ষমতার মেরুদণ্ড ভগ্ন হবে। ওদের অসাধ্য কিছুই নেই— ‘

আশঙ্কাটা সুস্পষ্ট প্রকাশ করতেও পারলেন না, অন্তরের আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল তাঁর।

বাসুদেব হাসলেন। বললেন, ‘অর্জুন, তুমি আমাকে তোমার রথে থাকার জন্য— সেই কারণেই সারথ্য করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছ। তাদের সে মন্দ উদ্দেশ্য থাকলে যুদ্ধের প্রথম দিনেই তো আমাকে বধ করতে পারে।

‘সারথিকে অস্ত্রাঘাত নিষেধ–’

‘দূতও অবধ্য। ন্যায় নীতি বিবেকের শাসন যে মেনে চলে তার কাছে আশঙ্কার কিছু নেই। যে তা না মানে–তার উপর কিসের ভরসা? বিপদ তার কাছ থেকে যে কোন মুহূর্তেই আসতে পারে।… আর অর্জুন, আমিও শিশু নই। আজন্ম শত্রুর সঙ্গে, বিদ্বিষ্ট মনোভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। ওদেরও আমি বিলক্ষণ চিনি।’

এতক্ষণে যুধিষ্ঠিরও বোধ করি কণ্ঠস্বর পুনঃপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনিও উদ্বিগ্ন অনুনয়ের ভাবে বললেন, ‘না না জনার্দন, লোক সকল বিপদে মিত্রকেই অবলম্বন করে। তোমা অপেক্ষা মিত্র আমাদের কেউ নেই। বিপদে সম্পদে তুমিই আমাদের একমাত্র সহায় ও আশ্রয়। তাই কৌরবদের এই কঠিন বিরূপতার সংবাদে বিমূঢ়বৎ তোমার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম। তবু, তুমি স্বয়ং সেই পাপসভায় যাবে— এ প্রস্তাবে সাতিশয় উদ্বিগ্ন বোধ করছি। সৎকুলজাত এবং জ্ঞানশিক্ষাদি লাভ করেও যে ব্যক্তি পরধনলুব্ধ হয়, তার সে লোভ তার বুদ্ধিনাশ করে। বুদ্ধিনাশ হলেও লজ্জা যায়, লজ্জা দূর হলেই ধর্মবোধ বিবেক প্রভৃতি বিনষ্ট হয়। তখন তার অকরণীয় কিছুই থাকে না। তুমি কৌরবসভায় গমন করো—সত্যই এ আমার অভিপ্রেত নয়। তুমি যতই সদুক্তি করো, দুর্যোধনের কর্ণে তা প্রবেশ করবে না, তার অন্তরে কদাপি শুভবুদ্ধির উদয় হবে না। তার অনুগামী ও অনুবর্তী শক্তিধর ক্ষত্রিয় রাজগণ ইতিমধ্যে সেখানে সমুপস্থিত হয়েছেন। মাধব, তোমার যদি কোন অনিষ্ট হয়—রাজ্যধন তো দূরের কথা কুবেরের সমস্ত ঐশ্বর্য বা সমুদয় স্বর্গসুখও কামনা করি না—যে কোন প্রকার প্রাপ্তি ঘটুক না কেন—সমস্ত অর্থহীন হয়ে যাবে।’

প্রত্যুত্তরে শ্রীকৃষ্ণ এবার কিছু গম্ভীর ভাব ধারণ করলেন, তাঁর দুই ভ্রূর ভঙ্গীতে যেন ভয়ঙ্কর কোন সঙ্কল্পের বজ্রগর্ভ মেঘ ঘনিয়ে এল। তিনি বললেন, ‘মহরাজ-চক্রবর্তী, দুর্যোধনের মতি ও প্রবৃত্তি আমার অবিদিত নেই। তবু একবার সেখানে যাওয়া আবশ্যক—অন্তত বিশ্ববাসী ও ভবিষ্যৎকালের কাছে নিন্দাশূন্য দায়শূন্য থাকার জন্যও। আর আমার পরিবর্তে আর কাকে প্রেরণ করবেন বলুন? রাজন, আমি যখন কোন কার্যে দৃঢ়-সংকল্প হই তখন তার অগ্র-পশ্চাৎ শুভ অশুভ সকল দিক চিন্তা ক’রেই মতি স্থির করি। আপনি বৃথা শঙ্কিত হবে না।—তারাও আমাকে বিলক্ষণ জানে। আমি ক্রদ্ধ হয়ে অস্ত্র ধারণ করলে কুরুপুত্রগণ তখনই বিনষ্ট হবে।’ যখন বাসুদেব কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠেছিল, সহসা মনে হ’ল তাতে সাক্ষাৎ কালানলের আভাস।

যুধিষ্ঠির কিছুটা আশ্বস্ত এবং (এ অবস্থায় ইতিপূর্বেও যা হয়েছে) কিছুটা শঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘দেখ, তুমি যা ভাল বোঝ। তোমাপেক্ষা আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ নেই, তোমার মতো বহুদূরপ্রসারী বুদ্ধিও কারও দেখি না। তুমি তাদের বোঝাতে না পারলে আর কোন লোকই পারবে না। তার জন্য আমি বহু ক্ষতি ক্লেশ সহ্য করতেও প্রস্তুত আছি।’

ভীম এতক্ষণ নীরবে নতমস্তকে বসে কী যেন চিন্তা করছিলেন। এখন অকস্মাৎ তিনি ঋজুভাব ধারণ করলেন। কেমন এক ধরনের নিস্পৃহ শুষ্কস্বরে বললেন, ‘কেশব, তুমি যে দূত রূপে যাচ্ছ—এ আমাদের সৌভাগ্য। এ বিষয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি আমি তো আর কাকেও দেখি না। ভরতবংশ রক্ষার ভার তোমার উপরই ন্যস্ত হ’ল। দেখ, একই বংশের দুই শাখা আমরা—আমাদের মধ্যে যাতে শান্তি স্থাপিত হয়, সেই চেষ্টাই করো। স্বভাবক্রোধী, কল্যাণবিদ্বেষী, মহাঅভিমানী দুর্যোধনকে উগ্রবাক্য প্রয়োগ বা ভয়প্রদর্শনে কার্যসিদ্ধি হবে না। বরং সাত্ত্ববাদ দ্বারা তাকে নমনীয় করার চেষ্টা করো। বাসুদেব, যে ব্যক্তি স্বভাবপাপী, দস্যুতায় যার আহ্লাদ, অহঙ্কারী, দাম্ভিক অদীর্ঘদর্শী সাধুজনের অবজ্ঞাকারী, নিষ্ঠুর, ক্রর, পাণ্ডবদের চিরবৈরী, মূঢ় ও অবিবেচক সে সহজে কল্যাণ বা হিতবাক্য বুঝবে না। সে ধর্মের বা সুহৃদদের বাক্যের মর্যাদা দেবে না। তবু চেষ্টা করলে হয়ত তুমিই তাকে বশীভূত করতে পারবে। দেখ, একটি পাপিষ্ঠের ক্রর মানসহুতাশনে সমস্ত ভারতখণ্ড ভস্মীভূত হতে চলেছে। এমন ঘটনা নূতন বা অভিনব নয়—এক এক কুলনাশন পাপাত্মা খলস্বভাব নৃপতির জন্য বহু প্রাণ অকালে বিনষ্ট হয়েছে, বহু বংশ লোপ পেয়েছে, এসব তোমার অবিদিত নেই। দুর্যোধনও তেমনিই এক কালপ্রেরিত কুলাঙ্গার। উগ্র বাক্য প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শনে বিরত থেকে মৃদুমন্দ ভাষায় প্রণয় প্রদর্শন ক’রে হিতবাক্য বলো। আমরা বরং নম্র ভাব ধারণ ক’রে দুর্যোধনের অনুগত হয়ে থাকব তাও শ্রেয়— সমগ্র কুরুবংশ তথা ক্ষত্রকুল ধ্বংস হয়ে যাবে—এটা কোনমতেই অভিপ্রেত নয়।’

আবারও এক অখণ্ড নীরবতা নেমে আসে সেই আলোচনা সভায়—কিছুক্ষণের জন্য। জলে অগ্নি প্রজ্বলিত হতে দেখলে অথবা কৃষ্ণ-বারিগর্ভ জলদপুঞ্জ থেকে বহ্নিবৃষ্টি হতে দেখলে মানুষ যেমন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়—কিংবা প্রজ্বলিত চিতায় হিমশীতল স্পর্শ পেলে—এদেরও সেই দশা, নির্বাক স্তম্ভিত অবস্থা।

অবশ্য বাসুদেবের সে নীরবতা ভঙ্গ করতেও বিলম্ব হ’ল না। তিনি ব্যঙ্গমিশ্রিত সবিস্ময় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘মহাবাহু ভীমসেন, এসব শান্ত হিতকারী বিনয়বাক্য কি আপনিই বলছেন? না আপনার ছদ্মবেশে অপর কোন ব্যক্তি এখানে উপস্থিত হয়েছে? আপনিই না বৈর-প্রতিশোধতৃষ্ণায় এই গত ত্রয়োদশ বর্ষ ভূমিসংলগ্নবক্ষ হয়ে বিনিদ্র কাটিয়েছেন? সধূম পাবকের মতো ক্রোধানলে সন্তপ্ত হতে হতে ক্রমাগত দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন? দিবারাত্র ভয়ঙ্কর শব্দ সহ মধ্যে মধ্যে ভূমিতে পদাঘাত অথবা অকারণ গর্জন করে উঠে নিজের বৈরবিমর্দন প্রতিজ্ঞাকে অগ্নিহোত্রের মতো নিয়ত প্রজ্বলিত রেখেছেন? আপনার সেই প্রতিশোধতৃষ্ণার ভয়াবহতা দেখে বহু লোকে আপনাকে উন্মাদ ভেবে পরিহার ক’রে চলে। সেই আপনি কি সমর প্রত্যক্ষ দেখে এখন পশ্চাদপদ হতে চাইছেন? আসলে কি এটা কুলরক্ষার চিন্তা—না, আপনারই আশঙ্কা?’

‘আশঙ্কা’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র ভীমসেনের যেন তন্দ্রাভঙ্গ হ’ল—তিনি নিজের স্বরূপে ফিরে গেলেন। সহস্রবজ্রনির্ঘোষের মতো একটা প্রচণ্ড গর্জন ক’রে উঠে বললেন, ‘আশঙ্কা? আমার? আমি এই মুহূর্তে ঐ দুর্যোধনটার একাদশ অক্ষৌহিণীর সম্মুখীন হতে প্রস্তুত আছি। বস্তুত তার অপেক্ষা হৃদ্য ও রুচিকর আমার কাছে কিছুই হতে পারে না। ঐ পাষণ্ড দুঃশাসনের বক্ষরক্ত পানের জন্য আমার সমস্ত অন্তর শুষ্ক হয়ে আছে, তার অগ্রজটার ঊরুভঙ্গে বাক্যবদ্ধ হয়ে আছি— সে প্রতিজ্ঞা পালন না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি ও শান্তি নেই। তার সঙ্গে ঐ ভীরু বক্রদৃষ্টি বৃদ্ধগুলোকে ভূশায়িত হতে দেখলে তবে পূর্ণ তৃপ্তিলাভ করব, যারা কেবলই বাক্যজাল বিস্তার ক’রে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। বলে, আমরা অন্নঋণে বদ্ধ, ধার্তরাষ্ট্রদের বেতনভুক। পাণ্ডুর রাজ্য ন্যায়ত ধর্মত তাঁর পুত্রদেরই প্রাপ্য, সে রাজ্য যদি কেউ অন্যায় ক’রে অধিকার করে থাকে—সে রাজ্যের রাজস্ব তার হয় না, সে রাজ্যের কোষাগার থেকে প্রদত্ত বেতন পাণ্ডুপুত্রদেরই সম্পত্তি বা সম্পদ থেকে পাওয়া। আমি ন্যায়নীতির জটিল তত্ব বুঝি না, এ আমার সহজ বুদ্ধির কথা। ঐ বৃদ্ধগুলো ঘোরতর পাপী। ওরা সবাই পরোক্ষভাবে দুর্যোধনকেই সমর্থন করে। ওদের মৃত্যু না প্রত্যক্ষ করা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না। হে কেশব, যেদিন এই লোকান্তকারী মহাসমরানল প্রজ্বলিত হবে, সেদিনই আমার স্বরূপ বুঝতে পারবে। আমার মজ্জাও অবসন্ন হয় নি, চিত্তও ভয়কম্পিত কি উদভ্রান্ত নয়। পরিঘযুগলের ন্যায় আমার এই বাহুমধ্যভাগ অনুভব ক’রে দেখো—তাও দুর্বল শুষ্ক কি শক্তিহীন হয় নি, আমার ভুজবন্ধনে বদ্ধ হলে স্বয়ং দেবেন্দ্রেরও নিস্তার নেই।… না, আমি কুলরক্ষার জন্যই শঙ্কিত হয়ে কথাগুলো বলেছিলাম, পূর্বপুরুষদের প্রতি ঋণ স্মরণ ক’রে ভরতবংশ না নির্মুল হয়ে যায় এই জন্যই ব্যাকুল হয়ে, নতুবা বৈরনির্যাতন ইচ্ছা বা শক্তি আমার আদৌ দূর হয় নি।’

বলতে বলতে ভীমসেন এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন যেন সভাস্থ সকলেই যে সে রুদ্ররোষাগ্নির সম্মুখে আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের আশ্বস্ত করতে ও অচিরে ভীমসেনের প্রকৃতিস্থ অবস্থা ফিরিয়ে আনতে বললেন, ‘না না ভীমসেন, আপনার পরাক্রম আমার অবিদিত নেই। জরাসন্ধ নিগ্রহের সময়ই আপনার শারীরিক শক্তি প্ৰত্যক্ষ করেছি। আপনাকে ভর্ৎসনা করতে কি ধিক্কার দিতেও চাই নি। যেমন উচ্চবংশে আপনার জন্ম, তার উপযুক্ত প্রজ্ঞা ও সংযমই আপনি প্রদর্শন করেছেন—নিজের প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি বা ক্রোধকে দমন ক’রে সর্বাগ্রে বংশের কথা চিন্তা করেছেন এজন্য আপনাকে সাধুবাদ দিচ্ছি।—অর্জুন, তোমার কোন বক্তব্য আছে?’

অর্থাৎ ভীমসেনকে আর অধিক রোষ প্রকাশের অবসরই দিলেন না।

অর্জুন ও নকুল কতকটা কর্তব্যবোধে এবং দুই অগ্রজের বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁদের বক্তব্য জানালেন। বাসুদেব যেন প্রথমটা মিষ্টবাক্যে যুক্তির পথে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করেন—তাতে ফললাভ না হলে শেষ যুক্তি তো আছেই!

কেবল সহদেব ক্রদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘দ্যুতসভায় তারা পাঞ্চালীকে যে অপমান ও লাঞ্ছনা করেছে— যে ছলনার দ্বারা আমাদের এই দীর্ঘকাল ভিক্ষুক পরান্নভোজীর জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে তার পরেও সন্ধি-প্রস্তাব, দূত-বিনিময়, ভদ্রতারক্ষা ও অনুনয়-বিনয়ের প্রশ্ন উঠছে কেন আমি তা বুঝি না। জনার্দন, আপনার এখন একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত—সমর বা তাদের শাস্তিদানের সুযোগ যাতে ত্বরান্বিত হয় সেই চেষ্টা করা।’

মহাবল সাত্যকি সহদেবের এই মত সমর্থন ক’রে তাঁর স্পষ্ট ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সমবেত রাজন্যসমাজ ও সেনানায়কবৃন্দও উচ্চরবে সাধুবাদ জানালেন।

বাসুদেব স্মিত প্রসন্ন মুখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে সে কোলাহল ঈষৎ প্রশমিত হতে মহাদেবী কৃষ্ণার সম্মুখে এলেন।

‘সখী দ্রৌপদী, তুমি কি বলো?’

দ্রৌপদী বুঝি এতক্ষণ নীরবে রোদনই করছিলেন, এখন সেই নীলকমল-পলাশাক্ষী সুন্দরীশ্রেষ্ঠা তাঁর নীলাভকৃষ্ণ সুগন্ধযুক্ত অবেণীবদ্ধ বিপুল কেশভার অঞ্জলিবদ্ধ দুই করে বাসুদেবের দৃষ্টির সম্মুখে মেলে ধরে অশ্রু-গদগদ কণ্ঠে বললেন, ‘সহদেবকে ধন্যবাদ, বুঝলাম অন্তত আমার স্বামীদের মধ্যে একজন এমন আছেন যিনি এখনও আমার লাঞ্ছনার কথা বিস্মৃত হন নি। আমি কি বলব, মহাবীর অর্জুন, বিশেষ যাঁর প্রতিশোধতৃষার উপর আমার সর্বাধিক ভরসা সেই ভীমসেনকে আজ ধর্ম, কুলরক্ষা প্রভৃতির প্রশ্নই সর্বাগ্রবিবেচ্য বোধ করতে দেখে, শান্তিরক্ষার জন্য ব্যাকুল ও বিনয় প্রকাশের পরামর্শ দিতে দেখে আমি বিহ্বল ও হতবাক হয়ে গেছি, জীবনধারণই আমার কাছে অরুচিকর মনে হচ্ছে। দেখ, অবধ্যকে বধ করা যেমন অন্যায়, বধ্যকে অব্যাহতি দান তদ্রুপ। বাসুদেব, তুমি সত্য ক’রে বলো—আমার ন্যায় হতভাগিনী সীমন্তিনী এ ভারতভূমিতে আর কে আছে? আমি দ্রুপদরাজের প্রতিহিংসা-যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগ্নী, তোমার প্রিয়সখী, মহারাজ পাণ্ডুর মুষা এবং সাক্ষাৎ পুরন্দরসদৃশ পঞ্চ স্বামীর মহিষী। তত্রাচ, এঁরা সকলেই জীবিত, সুস্থ ও যুদ্ধপারগ থাকা সত্বেও সেই স্বামীদের সম্মুখে আমাকে দুঃসহ অবমাননা সহ্য করতে হ’ল। কোন ক্রীতদাসী কি বারনারীকেও এতাদৃশ দুর্দশা ভোগ করতে কখনও শুনি নি। তুমি আমার সখা, আমার রক্ষক, আমার আশ্রয়স্থল হয়েও আজ তাদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে যাচ্ছ! আমি কি এইজন্যই ত্রয়োদশ বর্ষ অশৌচগ্রস্তার ন্যায় মুক্তবেণী হয়ে দিন যাপন করছি? আজ ভীমসেনের মুখে বিনয় ভাব প্রকাশ করার উপদেশ শুনে মনে হচ্ছে নূতন ক’রে সেদিনের সে জ্বালা অনুভব করলাম।… বাসুদেব, যদি আমাকে বিন্দুমাত্র কৃপাপাত্রী বলে মনে করো তাহলে সন্ধি নয়—অচিরে যাতে যুদ্ধ হয় সেই ব্যবস্থা করো। যদি পাণ্ডবরা ভীত ও রণবিমুখ হন আমি অভিমুন্য কে সেনাপতি ক’রে আমার পঞ্চপুত্রকে রণক্ষেত্রে পাঠাবো, আমার বৃদ্ধ পিতা ও ধৃষ্টদ্যুম্নও নিশ্চয় আমার সে মৃত্যুর অধিক অবমাননার শোধ নিতে কুণ্ঠিত হবেন না।’

ভাগ্যক্রমে পট্টমহাদেবীকে ঐ অসহায় ভাবে কাতরকণ্ঠে রোদন করতে দেখে সে আলোচনাসভায় বেশ একটু উত্তেজিত গুঞ্জন উঠেছিল—তার মধ্যেই অপরের অশ্রুতিগোচর কণ্ঠে বাসুদেব বললেন, ‘যশস্বিনী, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো— সন্ধি করতে নয়, সন্ধির প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতেই আমি সেখানে যাচ্ছি। আজ তুমি যেমন মুক্তবেণী হয়ে আকুল ভাবে ক্রন্দন করছ, অচিরকাল মধ্যে ভরতকুলকামিনীদের সেই ভাবেই রোদন ও হাহাকার করতে দেখবে। পূর্বেও বলেছি, আজও বলছি—তুমি যাদের প্রতি কুপিতা হয়েছ তাদের মৃত বলেই ধরে নিতে পারো। পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ্য নেই —মানবিক বা দৈবিক—যা তাদের রক্ষা করতে পারে।’

.

অতঃপর আলোচনার তালিকায় অবশিষ্ট থাকে যাত্রার দিন স্থির করা। বাসুদেব পুরোহিত ধৌম্যের উপরই ভার অর্পণ করলেন। বললেন, ‘এটা কার্তিক মাস, যাত্রার প্রশস্ত সময়। দেখুন কবে ঊষাকালে রেবতী নক্ষত্র পাওয়া যাবে, সেইদিনই প্রত্যুষে আমি যাত্রা করব।’

তারপর সাত্যকিকে জনান্তিকে ডেকে বললেন, ‘দূত অবধ্য, কোন বিপদাশঙ্কার কারণ থাকা উচিত নয়, তত্রাচ প্ৰস্তুত হয়ে যাওয়াই ভালো। তুমি তো যাবেই, আরও বিশেষভাবে নির্বাচিত নয়জন মহারথ তোমার সঙ্গে যাবেন। সে নির্বাচনের ভার তোমার উপর। পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলিয়ে সহস্রসংখ্যক দেহরক্ষীও যাবে, তাদের কিছু সাধারণ অনুচর কি কিঙ্করের বেশে যাবে। অর্থাৎ আমরা তাঁদের মনোভাবে সন্দিগ্ধ, আমাদের কোন আচরণে এমন না প্ৰকাশ পায়। সুনির্বাচিত সুতীক্ষ্ণ ও অব্যর্থ অস্ত্রাদিরও না অভাব ঘটে তবে সেগুলি ভোজ্য, ইন্ধন প্রভৃতির সঙ্গে স্বতন্ত্র বৃহৎ যানে যাবে। আমরা প্রথমেই তাদের যোদ্ধৃসমারোহ প্রদর্শন করাতে চাই না, তবে প্রয়োজন হলে যোদ্ধা বা উপযুক্ত আয়ুধের না অভাব ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রেখো। আর আমি যখন কুরুরাজসভায় গমন করব, তুমি আমার সঙ্গে থেকো কিন্তু সভার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করো না, উদাসীন কি কৌতূহলীবৎ নির্গমন পথে অপেক্ষা করো। এমনভাবেই সে পথ রক্ষা করবে যাতে সহসা কেউ না তা অবরুদ্ধ করতে পারে এবং প্রয়োজন হলে ইঙ্গিতমাত্র আমাদের রথী মহারথী ও দেহরক্ষীবাহিনী সভার মধ্যে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।

সাত্যকির মুখের পেশী কি রেখায় কোন ভাবান্তর পরিস্ফুট হ’ল না, শুধু তাঁর তাম্রাভ চক্ষু দুটি উত্তেজনা ও কৌতুকে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। তিনি নীরবে সম্মতিসূচক গ্রীবাভঙ্গী ক’রে তখনই আলোচনাসভাকক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন—বোধ করি যাত্রার আয়োজন সম্পন্ন করতেই।

স্বয়ং বাসুদেব পাণ্ডবদের দূতরূপে আসছেন, মধ্যস্থতার উদ্দেশ্যে–এ একটা বিশেষ সংবাদ বৈকি! সে সংবাদ প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুততর যানবাহনযোগে কুরুসভায় পৌঁছে যাবে তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই।

এঁরা বিস্মিত হলেন, বাসুদেবের মুখ্য উদ্দেশ্য কি তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনারও অবধি রইল না, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বিষম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অন্তরে অন্তরে উদ্বিগ্নও। পুত্রদের ডেকে বললেন, ‘দেখ, বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ কার্যত আজ সমগ্র ভাবে যাদবদের—ভোজ, বৃষ্ণি, অন্ধক প্রভৃতির প্রধান পুরুষ তাঁর শক্তির কথা সুবিদিত কিন্তু তদপেক্ষাও তাঁর রাজনীতিক প্রজ্ঞা ও কূটবুদ্ধির খ্যাতি অধিক। সমগ্র জম্বুদ্বীপের তাবৎ রাজন্যসমাজ এমন কি চীন ম্লেচ্ছ-দেশ প্রভৃতির শাসকরাও তাঁকে সমীহ করেন। তিনি আজ সর্বজন- মাননীয়, সর্বজন-শ্রদ্ধেয়। তাঁর সঙ্গে স্পর্ধা প্রকাশ করতে গিয়ে জরাসন্ধর স্বয়ংবৃত সেনাপতি শিশুপালের কি দুর্দশা হয়েছিল তা তোমরাই তো প্রত্যক্ষ করেছ। তাঁর মধ্যে ধৃতি, বীর্য, প্রতাপ ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটেছে। তিনি স্বেচ্ছায় বিনা আমন্ত্রণে এ রাজ্যে পদার্পণ করছেন এ আমাদের বিশেষ সৌভাগ্য বলতে হবে। তাঁর আদর আপ্যায়ন সম্বর্ধনার কোন ত্রুটি না হয়। তিনি বিলাস ও ঐশ্বর্যে অভ্যস্ত, তাঁর বাসস্থান ও পানভোজনের ব্যবস্থাও তদ্রুপ হওয়া আবশ্যক। দুর্যোধনের বাসভবন তাদৃশ সুখদায়ক নয়—দুঃশাসনের গৃহ নব-নির্মিত ও প্রশস্ততর, নূতন শয্যাদিতে সজ্জিত। দুঃশাসন সপরিবার আমাদের প্রাসাদে চলে আসুক, তার ভবনটি সুসংস্কৃত,

পরিস্কৃত ও নূতন উপকরণে সুসজ্জিত রাখো। বাসুদেব ওখানেই অবস্থান করবেন। তাঁর সঙ্গী সেবক বা অনুচর কজন আসছেন জানি না—কয়েকশত তো হবেই, তাদের জন্য যতগুলি সম্ভব গৃহ—অভাবে বস্ত্রাবাসের ব্যবস্থা করো। অশ্ব ও অশ্বতরগুলির খাদ্য—চণক-তৃণাদি এখন থেকে সঞ্চিত রাখার আদেশ দাও। বাসুদেব না কোনক্রমেই অসন্তুষ্ট বা বিরূপ হন।’

অতঃপর বৃদ্ধ রাজা মন্ত্রী বিদুরকে ডেকে বললেন, ‘বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ এখানে আসছেন সংবাদ পেয়েছ নিশ্চয়। আমি পুত্র দুর্যোধনকে বার বার সতর্ক ক’রে দিয়েছি—তাঁর অভ্যর্থনার আয়োজনে কোন ত্রুটি না ঘটে। শুনেছি তিনি পূর্বরাত্রি বৃকস্থলে অতিবাহিত ক’রে প্রত্যুষে হস্তিনানগরে প্রবেশ করবেন। বৃকস্থলের নাগরিকরা তাঁর অভ্যর্থনার বিপুল আয়োজন করেছেন। সেটা আমাদের দিক থেকে বিচার করলে অশোভন এবং আমাদের ঔদাসীন্য বোঝায়। আমাদের আপ্যায়ন ব্যবস্থা বিপুলতর ও ব্যাপকতর হওয়া আবশ্যক। কোন বিষয়েই না ত্রুটি থাকে।’

তারপর কিয়ৎকালমাত্র মৌন থেকে পুনশ্চ বললেন, ‘আর দেখ, আমি তাঁকে রাজঅতিথি হিসাবে কিছু সম্মান- উপহার নিবেদন করতে চাই। তুমি আমার রত্নভাণ্ডার থেকে উৎকৃষ্ট রত্ননিচয় নির্বাচন করবে। তদ্ব্যতীত আমি তাঁকে বাহ্লীক দেশজাত সৰ্বসুলক্ষণযুক্ত তেজস্বী দ্রুতগামী চতুরশ্ব যোজিত ষোড়শ সংখ্যক রথ সমরদক্ষ, সানুচর আটটি হস্তী কাঞ্চনবর্ণা যুবতী, অজাতগর্ভা একশত দাসী ও সমসংখ্যক অল্পবয়স্ক দাস, হিমাচলবাসী নির্মিত সুকোমল কম্বল, চীন – দেশাগত এক সহস্র রোমবহুল চর্ম প্রভৃতি দিতে চাই। আমার নিজস্ব বায়ুগতি অশ্বতর বাহিত রথ—চতুঃপ্রহরে চতুর্দশ যোজন ভ্রমণক্ষম, সেটিও দিতে চাই। দুর্যোধন যাবে না—কিন্তু সে বাদে আমার সমস্ত পুত্রপৌত্ররা যেন নগরীর প্রবেশ পথ থেকে প্রত্যুদগমন করে। প্রধানা সুসজ্জিতা বারাঙ্গনারা যেন পূর্বেই সেখানে সমবেত হয়। বৃকস্থল থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত পথ যেন জলনিষেক দ্বারা ধূলিশূন্য রাখা হয়।’

বিদুর গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, ‘আপনি তাঁর জন্য যে সব উপহার-দ্রব্য, অভ্যর্থনা বা আতিথ্যের আয়োজন প্রস্তুত রাখতে বলেছেন, তা তাঁরই যোগ্য তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মহারাজ, এ কি কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর অলোকসাধারণ চরিত্রের কথা স্মরণ ক’রেই তাঁর এবম্বিধ পূজার আয়োজন করতে বলেছেন? আর্য, আপন সত্য ও সারল্য অবলম্বন করুন। এখনও কৌশল ও কাপট্যের দ্বারা, হয়ত বা আত্মপ্রতারণার দ্বারাও পুত্রপৌত্রাদির সর্ববিনষ্টির কারণ হবেন না। শ্রীকৃষ্ণ এই প্রকার সম্বর্ধনারই উপযুক্ত তাতে তিলমাত্র সংশয় নেই, সসাগরা পৃথিবী প্রদান করলেও তাঁকে বোধ হয় যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন হয় না—কিন্তু মহারাজ, আমি জানি সুদ্ধমাত্র সে কারণে অর্থাৎ ধর্মাচরণ কি যোগ্যতা বোধে আপনার এ ইচ্ছা দেখা দেয় নি। এ কেবল ছলনা অসত্যাচারণ ও কপটতা মাত্র। আপনি পাণ্ডবদের পাঁচখানি গ্রামমাত্রও দিতে প্রস্তুত নন—শ্রীকৃষ্ণের জন্য এত ধন ও দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যাদি দান করতে চান কেন? আপনি ভাবছেন এতদ্বারা তাঁকে বশীভূত ও পাণ্ডবদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন? সে পাত্র তিনি নন, বাসুদেব শল্য নন। না ধন, না পূজা, না যত্ন কোন কিছুর দ্বারাই তাঁকে বশীভূত বা মোহগ্রস্ত বা ধর্মচ্যুত করতে পারবেন না। পাণ্ডবদের পক্ষেই ধর্ম, তা আপনিও বিলক্ষণ অবগত আছেন অর্জুন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু—শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের কখনও ত্যাগ করবেন না— এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তিনি বারিপূর্ণ কুম্ভ, পাদপ্রক্ষালনের জল ব্যতীত আপনার নিকট হতে কোন বস্তুই গ্রহণ করবেন না। যদি সত্যই তাঁর যোগ্য অভ্যর্থনা করতে চান তো যে প্রার্থনা নিয়ে তিনি আসছেন অর্থাৎ কৌরবে পাণ্ডবে সন্ধি ও শান্তি স্থাপন সেইটিই পূর্ণ করুন, তিনি যথার্থ তুষ্ট হবেন।’

ধৃতরাষ্ট্র বিরসবদনে তূষ্ণীভাব অবলম্বন করলেন। বিদুর বহুক্ষণ প্রত্যুত্তরের বৃথা প্রত্যাশায় থেকে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন ক’রে নীরবেই বিদায় নিলেন। এ অবশ্য তিনি পূর্বেই জানতেন, শুধু কর্তব্যবোধেই নিরাবরণ সত্যভাষণ করেছিলেন।

.

দুর্যোধনও এই একটা বিষয়ে বিদুরের সঙ্গে একমত। এসব উৎকোচ প্রদানে বাসুদেবকে তুষ্ট ক’রে কার্যসিদ্ধি হবে না। তাঁর সম্বন্ধে যতটা জানেন, লোকশ্রুতি যা— তাতে এই ধারণাই ক্রমশ ধ্রুব হয়ে উঠেছে। তথাপি ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ পালনে অবশ্যই বিলম্ব কি ত্রুটি হ’ল না। রাজ্যসীমার প্রবেশপথ থেকে রাজধানী পর্যন্ত পথে পথে সম্মান-তোরণ ও অভ্যর্থনা-মণ্ডপাদি নির্মিত হ’ল—তা শোলার কারুশিল্পে চারুচিত্রাঙ্কনে ও পত্রপুষ্পসজ্জায় এবং প্রয়োজনমতো আলোকমালায় সুরম্য উজ্জ্বল ও নয়নাভিরাম ক’রে তোলা হ’ল। সেই সঙ্গে অশ্বদের খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বিশাল জলাধার ও তৃণ-শস্যভাণ্ডার বাসুদেব ও তাঁর অনুচর সেবক প্রভৃতির জন্য অন্ন-পানীয়ের ব্যবস্থা। মহারথ বা রাজবংশীয়দের জন্য পক্বান্নই অধিক। দাসদাসী, বারাঙ্গনা, নয়নমনোহারিণী মনোরঞ্জনকারিণী কামিনী প্রভৃতিও প্রেরিত হয়েছিল। দুঃশাসনের গৃহও নূতন মার্জনা ও সংস্কারে নবনির্মিত প্রাসাদ-ভবনের রূপ ধারণ করেছে। এই বিপুল সম্বর্ধনার আয়োজন প্রজাসাধারণের মধ্যেও একটা আলোড়ন সৃষ্টি করল, তারা ঔৎসুক্য ও সম্ভ্রমে পূর্ণ হয়ে সেই পরম অতিথির শুভ পদার্পণের অপেক্ষা করতে লাগল।

অবশ্য এইসব রাজকীয় আয়োজনের মধ্যেও কুচক্রীর মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় বসে নেই। সৌবল বা শকুনি সেই শ্রেণীর মানুষ—যারা কারও উন্নতি বা প্রতিপত্তি সহ্য করতে পারে না। সে একদিন এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেই নিভৃতে পেয়ে ভাগিনেয়কে বলল, ‘দেখ, বৃদ্ধরাজা যাই বলুন, বাসুদেবকে মিষ্ট ব্যবহারে বা মহার্ঘ্য উপহারে তুষ্ট করা যাবে না। তুমিও রাজ্যাংশ পাণ্ডবদের ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নও। সুতরাং যুদ্ধ অনিবার্য। এক্ষেত্রে একটিই মাত্র আমাদের করণীয় আছে— তা হচ্ছে পাণ্ডবদের শক্তিক্ষয়। আর, ওদের আসল শক্তি হচ্ছে ঐ যাদবটা, বসুদেবের পুত্র। ওদের গোষ্ঠীর প্রধান ও ও নয়—নামে উগ্রসেনই এখনও রাজা—কিন্তু আসলে ওই লোকটাই সমগ্র যাদবসমাজকে শাসন করে। তোমার ভাগ্যক্রমে দ্যুতক্রীড়ার সময় ও উপস্থিত ছিল না, নচেৎ এ বিপুল সম্পদ ও বিশাল রাজ্য তোমার ভোগে আসত না। শ্রীকৃষ্ণ একা তোমাদের সভায় আসছেন, প্রীতি ও হৃদ্যতার ছলে তাঁকে অতর্কিতে বন্দী করো—তাহলেই ওদের সকল শক্তির মূল নষ্ট হবে, এখন ওদের পক্ষে যারা আছে তারা ভবিষ্যৎ ভেবে ভীত হয়ে ওদের ত্যাগ করবে।’

দুর্যোধন এ পরামর্শে খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি এখনই অঙ্গরাজ ও দুঃশাসনের সঙ্গে আলোচনা ক’রে এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ক’রে ফেলছি।’

শকুনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘দুঃশাসনকে বলো কিন্তু কর্ণকে এর মধ্যে জড়িও না। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে সে সম্মত তো হবেই না—পরন্তু বাধা দেবে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, পাণ্ডবদের সম্বন্ধে ওর যতই বিদ্বেষ থাক, শ্ৰীকৃষ্ণ সম্বন্ধে ওর একটা দুর্বলতা আছে। দুঃশাসনকে বলো, আমি তো আছিই। এসব কথা কখনও অধিক লোকের কর্ণগোচর করতে নেই, মন্ত্রগুপ্তিই এর আসল অস্ত্র।’

তবু দুর্যোধন পূর্বদিন সন্ধ্যায় কর্তব্যবোধে একবার অন্ধ রাজাকে কথাটা জানালেন। তিনি যথারীতি তাঁর সন্তানদের মন্দমতি, অসবুদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কিছু বিলাপ করলেন, এ ধরনের কার্যের দ্বারা ওরা অবশ্যই বিনষ্ট হবে তাও জানালেন—কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে নিষেধ করতে পারলেন না। শুধু যেন নিজের বিবেককেই বার বার শোনাতে লাগলেন যে নিষেধ করলেও কোন কাজ হত না, সন্তানরা কেউ তাঁর অনুবর্তী নয়।

.

শ্রীকৃষ্ণ নগর প্রবেশের পূর্বরাত্রে বৃকস্থলে পৌঁছে সকলকেই মধুর বাক্যে আপ্যায়িত ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেও—না নাগরিকবৃন্দ, না দুর্যোধন কারও আতিথ্যই গ্রহণ করলেন না। নিজের বস্ত্রাবাসেই রাত্রিযাপন করলেন—নিজেরই অন্ন ভোজন ক’রে। উভয় পক্ষকেই—অপরের অপ্রীতিভাজন হবার আশঙ্কা যুক্তি হিসাবে উপস্থাপিত ক’রে—প্রবোধদান করলেন।

প্রত্যুষে প্রাতঃবন্দনাদি সমাপন ক’রে বৃকস্থল থেকে যাত্রা করে এক প্রহর পরে হস্তিনাপুরীর প্রধান প্রবেশপথে পৌঁছে দেখলেন, এক রাজকীয় সম্বর্ধনার বিপুল আয়োজন, অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকদের বিশাল সমাবেশ, জনসমুদ্র বললেই হয়। বাসুদেব কিন্তু এতে কোন বিস্ময় প্রকাশ করলেন না, বোধ হয় এমনই আশা করেছিলেন। সস্মিত বদনে করজোড়ে সকলকে সম্মানিত ক’রে—এক দণ্ডকাল মাত্র কৌরবদের নির্মিত মণ্ডপে নূতন আসনে উপবেশন ক’রে ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ এবং উপহার স্বরূপ একটি সবৎসা ধেনু গ্রহণ ক’রে কুরুপুত্রদের আলিঙ্গন, জ্যেষ্ঠদের নমস্কার জ্ঞাপন সমাপন হতে এঁদের অনুমতি নিয়ে সরাসরি বিদুরভবনে গমন করলেন—পিতৃসা কুন্তীকে প্রণাম নিবেদন ও কুশল বিনিময়ের জন্য।

কুন্তী এতকাল পরে ওঁকে দেখে রোদন ও বহুবিধ বিলাপ করবেন এ স্বাভাবিক। এই দীর্ঘকালের সংবাদবিনিময়েও —পৃথার দিক থেকেই আগ্রহ ও প্রশ্ন বেশী—বহু সময় অতিবাহিত হ’ল। প্রত্যেক পুত্র ও পুত্রবধূ সম্বন্ধে তাঁর আশঙ্কা ও অনিষ্টকল্পনার অবধি নেই, বিশেষ সহদেব, তাকে তিনি এখনও বালক ভাবেন, তার জন্যই সমধিক উদ্বিগ্ন।

কুন্তীর প্রশ্নাদির উত্তর ও যথাযথ সান্ত্বনা দিয়ে বিদুরের গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাসুদেব অকস্মাৎ সরাসরি দুর্যোধনের বাসভবনে উপস্থিত হলেন এবং পূর্ব-সংবাদ- প্রেরণ প্রভৃতির চেষ্টা না ক’রে বহির্বাটি অতিক্রম ক’রে উপরে উঠে গেলেন। দ্বারপাল দৌবারিকরা বিস্মিত হয়ে তাঁর সেই প্রশান্ত-সুন্দর আনন ও ধর্মোজ্জ্বল কান্তির দিকে তাকিয়ে রইল, তাঁকে বাধা দেবার বা পূর্বেই দ্রুতবেগে গিয়ে গৃহাধিকারীকে সংবাদ- প্রেরণের কথা কারও মনে পড়ল না। শ্রীকৃষ্ণও এমনভাবে যেতে লাগলেন যেন এ প্রাসাদ তাঁর বহু পরিচিত, এর প্রতিটি অলিন্দ ও গৃহকোণের অবস্থান তাঁর নখদর্পণে। তাতেই আরও দ্বারপালদের বাধা দিতে সাহস হ’ল না। বাসুদেব অবলীলায় ত্রিতলে উঠে যেখানে নিভৃত আলোচনাকক্ষে অন্তরঙ্গ বন্ধু, নৃপতি, অঙ্গরাজ প্রভৃতি বশম্বদ করদ ও আশ্রিত রাজা, শকুনি, দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে গৃহস্বামী ওঁর আগমন ও গতিবিধি নিয়েই আলোচনায় রত—সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

ঐভাবে অকস্মাৎ একা ওঁকে আসতে দেখে কিছুক্ষণ বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে শুধু চেয়েই রইলেন দুর্যোধন। তারপর ব্যস্ত হয়ে উঠে অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন এবং হাত ধরে এনে নিজের সুবর্ণমণ্ডিত পর্যঙ্কে বসাবার চেষ্টা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্মিত প্রসন্নমুখে তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একে একে উপস্থিত সকল রাজা ও কুরুবংশীয়দের সম্পর্ক ও বয়ঃক্রম অনুসারে আলিঙ্গন নমস্কার প্রীতি ও কুশল বিনিময় শেষ ক’রে নিজেই গিয়ে সে পর্যঙ্কে বসলেন।

অতঃপর মাননীয় অতিথিদের যেভাবে মধুপর্ক, পানীয় জল, দুগ্ধ প্রভৃতির দ্বারা সম্বর্ধিত করা উচিত ধেনু, গৃহ এমন কি রাজ্যখণ্ড ও যাবতীয় সম্পদের মৌখিক নিবেদন—সকল ব্যবস্থাই দ্রুত সম্পন্ন হ’ল। শ্রীকৃষ্ণ এখানেও নিবেদিত মধুপর্ক শিরোধার্য ক’রে সামান্য পানীয়জল মাত্র গ্রহণ করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তখনকার মতো বিদায়প্রার্থী হলেন। দুর্যোধন বিস্মিত ও আপাতব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘না না, তা কি ক’রে হয়! অশেষ দয়া ক’রে যখন আমার গৃহে পদার্পণ করেছেন, তখন এখানেই ভোজন সমাপন করতে হবে।’

বাসুদেব দুই হাত একত্রিত ক’রে ভিক্ষাপ্রার্থনার ভঙ্গীতে বললেন, ‘ঐটি ক্ষমা করতে হবে।’

‘কেন, আমরা কি অপরাধ করলাম? অবশ্য আপনার জন্য একটি স্বতন্ত্র নবসংস্কৃত ভবনই সুসজ্জিত রাখা হয়েছে— সেখানেও আহারাদির সব আয়োজন প্রস্তুত, তবু যখন এ অধমের গৃহে এসেছেন—এখানে অন্নগ্রহণ করতে বাধা কি?’

শ্রীকৃষ্ণের ভ্রূ ঈষৎ কুঞ্চিত হ’ল, মুখের প্রসন্নতা বিলুপ্ত হয়ে একটা কঠোর গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ল, তিনি মৃদু অথচ মেঘমন্দ্র স্বরে বললেন, ‘আমি দূতরূপে এসেছি। দূতেরা কৃতকাম হলেই যেখানে এসেছে সেখানের আতিথ্য ও তাঁদের অন্ন গ্রহণ করে। আমি কাল সভায় আমার প্রার্থনা জানালে আপনি যদি তা পূর্ণ করেন—আমি সানন্দে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আপনার অন্ন ভোজন করব।’

দুর্যোধন অভিমানাহত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন এ ব্যবহার আপনার শোভা পায় না। আপনি তো সুদ্ধমাত্র অপরের প্রেরিত দূতই নন, যদুবংশের সঙ্গে আমাদের বহুবিধ সম্পর্ক, আপনি আমাদের আত্মীয়। আপনার সঙ্গে আমাদের কোন বৈরিতা নেই, কলহ বা যুদ্ধও হয় নি। আপনি এমন ব্যবহার করছেন কেন?’

শ্রীকৃষ্ণ এবার হাসলেন। বললেন, ‘আত্মীয়তার কথা যদি বলেন, যারা আপনার বৈরী—তারা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তদ্ব্যতীত, কাম অর্থ লোভ ক্রোধ দ্বেষ কোন কারণেই ধর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। প্রীতির সম্পর্ক থাকলে তবেই তার অন্ন মানুষ গ্রহণ করে। অথবা দুঃস্থ কি বিপন্ন হলে বাধ্য হয়ে করে। আপনি—আমার প্রতি সম্প্রীতি প্রকাশ পায় এমন কোন কার্য করেন নি, আমিও বিপন্ন হইনি। আপনি বিনা কারণে আপনার খুল্লতাতপুত্রদের প্রতি বিদ্বিষ্ট, তাদের ক্ষতির জন্য বদ্ধপরিকর। তারা কখনও ধর্ম ত্যাগ করে নি। যাঁরা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষী, প্রতিকূল মনোভাব পোষণ করেন— তাঁরা আমার মিত্র বা অনুকূল হতে পারেন না। লোভ কামনা বা দ্বেষের বশবর্তী হয়ে যে ব্যক্তি ধার্মিক গুণশালী ব্যক্তির অনিষ্ট করে, পণ্ডিতেরা তাকে নরাধম বলেন। এই কারণেই আমি আমার দৌত্য সফল হওয়ার আগে আপনার অন্নভোজনে অস্বীকার করছি। আপনাদের প্রাসাদেও অবস্থান করা সম্ভব নয়। আমি আজ বিদুরের গৃহে অন্নগ্রহণ ও সেখানে রাত্রি যাপন করব।’

অবজ্ঞা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, বিদ্রুপ একপ্রকার বিচিত্র মুখভঙ্গীতে ওষ্ঠাধর বিকৃত হয়ে উঠল দুর্যোধনের। তিনি বলে উঠলেন, ‘ক্ষত্তা বিদুরের গৃহে! আমার অন্নের থেকে অনার্য দাসীপুত্রের অন্ন অধিকতর গ্রহণীয় হ’ল!

‘নিশ্চয়ই!’ তীক্ষ্ণ কঠিন কণ্ঠে উত্তর দিলেন বাসুদেব, ‘জন্মে বা জাতিতে কারও পরিচয় হয় না, হয় মনুষ্যত্বে। আমি শৈশবে বৈশ্য গোপগৃহে লালিত হয়েছি, তাতে কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করি না। যিনি কখনও কোন কারণেই সত্য বা ধর্মকে ত্যাগ করেন না—যে কোন ব্রাহ্মণের অপেক্ষাও তিনি অগ্রগণ্য, শ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি মহাত্মা। আপনার দুষ্টাভিসন্ধি-সম্বলিত অশুভ অন্ন অপেক্ষা ধর্মাত্মা বিদুরের অন্ন সর্বাংশে শ্ৰেয়।’

অতঃপর আর বাদানুবাদের অবকাশ না দিয়েই শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনের ভবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। এবারও তাঁকে বাধা দিতে বা কোন ক্ষতি কি অবমাননা করতে সাহস হ’ল না।

শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের আতিথ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন এ সংবাদ শ্রবণমাত্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য স্ব স্ব রথে বিদুরের গৃহে উপস্থিত হলেন। প্রত্যেকেরই প্রার্থনা উনি তাঁদের ভবনে অবস্থা ও ভোজনাদি করুন। শ্রীকৃষ্ণ সবিনয়ে তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ক’রে বললেন, ‘আপনারা যে এভাবে ছুটে এসেছেন—এতেই নিজেকে কৃতার্থ বোধ করছি। এতেই আমার আতিথ্য গ্রহণ করা হয়েছে, আমি নিরতিশয় তৃপ্ত। কিন্তু বিদুরের গৃহে অন্নগ্রহণ করব—এ আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা। দয়া ক’রে আমার এ সাধ পূর্ণ করতে দিন। আর দেখুন, আপনাদের অপেক্ষা দরিদ্র, শূদ্রাণীগর্ভজাত বর্ণসংকর, ব্রাত্য বলে যদি মহাত্মা বিদুরের অন্ন প্রত্যাখ্যান ক’রে আপনাদের গৃহে যাই, আমাকেই ধর্মে পতিত হতে হবে। প্রীতি ও শুভবুদ্ধির দান এ আহার্য সর্বাবস্থায় প্রেয় ও শিরোধার্য।’

সঙ্গে গিয়ে বাসুদেব সসম্মানে এঁদের নিজ নিজ রথে তুলে দিয়ে ফিরে এলে বিদুর সসঙ্কোচে বললেন, ‘কাজটা কি ভালো করলেন? ওঁরা সকলেই আমার পূজনীয়, গুরুজন। তাঁদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ক’রে আমাকে এতাদৃশ প্রাধান্য দেওয়ায় ওঁরা ক্ষুণ্ন হলেন সম্ভবত। তাছাড়া আমার সঙ্গতি সামান্য। আয়োজনও তদনুরূপ, আপনার কষ্টই হবে হয়ত

বাসুদেব তাঁকে গভীর আলিঙ্গনাবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘কাজটা ভাল হ’ল কি হ’ল না, সে পর্যালোচনা পরে একসময় করা যাবে। এখন আমি বড় ক্ষুধার্ত। আহারপর্বটা শেষ ক’রে নিই আগে। আর কষ্ট হ’ল কিনা, সেটা আহার না শেষ হলে বুঝব কি ক’রে? দেখুন রাজসুখ ভোগ আমার সহ্য হয় না, সারা জীবনই তার প্রমাণ পাচ্ছি। আজ আর নতুন ক’রে তা নিয়ে চিন্তা করতে চাই না।’

সে রাত্রে বাসুদেব বা বিদুর কারও নিদ্রা হ’ল না। নানাবিধ আলোচনা ও সৎপ্রসঙ্গেই ত্রিযামা রজনী অতিবাহিত হ’ল। দুর্যোধনের সামরিক শক্তি, কোন কোন ব্যক্তির উপর তাঁর সমধিক ভরসা, বৃদ্ধ রাজার মতিগতি সম্বন্ধে তাবৎ তথ্যই বিদুরের নিকট জানা গেল। বিদুরেরও পাণ্ডবদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল। সে উৎকণ্ঠা বা ঔৎসুক্যও শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা ও আশ্বাসবাক্যে প্রশমিত হ’ল। সেই সঙ্গে উভয়েই উভয়কে নানা শুভবাক্যে আপ্যায়িত করলেন।

নিদ্ৰা হ’ল না কিন্তু সেজন্য কেউই কোন ক্লান্তি বা জাড্য অনুভব করলেন না। বাসুদেব অভ্যাসমতোই প্রত্যুষে উঠে স্নান, জপ, হোম ও সূর্য-বন্দনা শেষ ক’রে প্রতিদিনের কৃত্য হিসাবে কিছু দানকার্যও করলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে— প্রভাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই শকুনি ও দুর্যোধন এসে উপস্থিত। তাঁদের বক্তব্য— সভায় ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম

প্রমুখ কুরুবৃদ্ধগণ ও অন্যান্য নৃপতি ও আত্মীয়বর্গ বাসুদেবের দর্শন-অভিলাষে বা আগমন প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছেন। মহামনা ধৃতরাষ্ট্র তাঁর নিজস্ব রথও প্রেরণ করেছেন ওঁকে নিয়ে যাবার জন্য।

শ্রীকৃষ্ণ সবিনয় মধুর হাস্যের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা অহেতুক ব্যস্ত হবেন না, আমার আপন রথেই এখানে আগমন করেছি, সেই রথই ব্যবহার করব। সে যানও প্রস্তুত। আপনারা অগ্রবর্তী হোন, আমি এখনই যাত্রা করছি। ‘

দ্বারকাধিপতি বাসুদেব সন্ধি সংস্থাপনের জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছেন—সে বার্তা হস্তিনা কেন—রাজ্যের প্রত্যন্ত- প্রদেশেও পৌঁছে গিয়েছিল। এই অদ্ভুতকর্মা পুরুষকে দর্শন করার জন্য সেই প্রায়-ঊষাকালেই কয়েক সহস্র ব্যক্তি বিদুরভবনের চারিপার্শ্বে সমবেত হয়েছেন। তদ্ব্যতীত রাজকর্মচারী, সৈন্যবাহিনী—এবং দুর্যোধন প্রভৃতির দেহরক্ষীর দল তো আছেনই। সে জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে রথচালনা ক’রে অগ্রসর হওয়া কঠিন, বাসুদেবের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সারথি দারুকের পক্ষেও দুঃসাধ্য— সেজন্য অনিচ্ছা সত্বেও গতি শ্লথ করতে হ’ল।

শ্রীকৃষ্ণ বিদুরকে নিয়ে রথে উঠেছিলেন। তাঁর গতরাত্রের সতর্কবাণীও বিস্মৃত হন নি। রাজসভার উপযোগী মহামূল্য বেশভূষার আবরণে সূক্ষ্ম লৌহতন্তু নির্মিত যে বর্ম ছিল তা আপাতঅদৃশ্য হলেও তার অস্তিত্ব কোন তীক্ষ্ণদৃষ্টি দর্শকের উপলব্ধি হতে পারে এই অনুমানে তা সম্পূর্ণ-আবরিত করতেই যেন জগতে-দুর্লভ কৌস্তুভমণি-বিলম্বিত কণ্ঠহার ধারণ করেছিলেন—যাতে তার প্রখর দ্যুতিতে দৃষ্টি আহত ও অন্ধবৎ হয়ে ফিরে আসে, বেশভূষা সম্পর্কিত অধিক তথ্য না নয়নগোচর হয়।

রথে আরোহণ ক’রে উপবিষ্ট হওয়ার পূর্বেই বাসুদেব একবার চতুর্দিকে তাঁর শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তাঁর লক্ষ্যে কিছুই এড়ায় না, আজও অবস্থাটা সম্যক দেখে নিলেন। সেই অকূল জনসমুদ্র মধ্যেও তাঁর দেহরক্ষী ও অনুগামীদের চিনে নিতে বিলম্ব হ’ল না। দেখলেন—সাত্যকির নির্দেশ-কৌশলে ও অভ্রান্ত পরিচালনায় তারা সেই জনতা মধ্যে মিশে থেকেও যথাসম্ভব তাঁর রথের নিকটেই আছে, একপ্রকার বেষ্টনই ক’রে আছে। সাত্যকি ও কৃতবর্মার রথ প্রকাশ্যেই এবং সঙ্গত ভাবেই ওঁর রথের পশ্চাতে আসছে। অথচ এ ব্যবস্থা যে ইচ্ছাকৃত বা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী—তা মনে করার কোন উপায় রাখেন নি তাঁরা।…

সভাগৃহের দেহলিতে তাঁর রথ থেমেছে—এ-সংবাদ পেয়ে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি প্রবীণরা তো বটেই—কর্ণ, দুঃশাসন, অশ্বত্থামা এমন কি সঞ্জয়ের সাহায্যে স্বয়ং অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রও প্রবেশদ্বারের বাহিরে এসে বাসুদেবকে অভ্যর্থনা ক’রে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গী মহারথীদের গৃহমধ্যে প্রবেশের কোন বাধা ছিল না, সকলেই পরিচিত, বিশিষ্ট ব্যক্তি। কিন্তু তাঁরা সে চেষ্টা করলেন না, উপস্থিত নাগরিক ও কৌরব রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে মিশে ভবনের প্রাঙ্গণে ও সম্মুখস্থ রাজপথেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। শুধু সাত্যকিই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গৃহমধ্যে প্রবেশ ক’রে বাসুদেবের ঠিক পিছনে আসন গ্রহণ করলেন—কৃতবর্মা এলেও উপবেশন করলেন না, যেন সভাগৃহের এতগুলি ব্যক্তির নিঃশ্বাসোষ্ণ বদ্ধ আবহাওয়া কষ্টকর বোধ হওয়ায় দ্বারপ্রান্তেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। অতিশয় স্বার্থলোলুপ ও কুবুদ্ধি-আচ্ছন্ন ধার্তরাষ্ট্ররা কেউ এ ব্যবস্থায় কোন সতর্ক পরিকল্পনার লক্ষণ লক্ষ করলেন না।

ধৃতরাষ্ট্র ইতিপূর্বেই ‘সর্বতোভদ্র’ নামে মণিমুক্তাশোভিত সুবর্ণনির্মিত এক আসন তৈরী করিয়েছিলেন—এখন হাত ধরে এনে সেখানেই বসিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণকে। সম্মুখে রইলেন স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র এবং প্রবীণগণ। কর্ণ ও দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণর দক্ষিণে একাসনে উপবেশন করলেন, বিদুর কিছু দূরে এক সুবর্ণাচ্ছাদিত পীঠের উপর শুক্ল অজিনাসন রেখে তাতে বসলেন। দুঃশাসন যেন এঁদের মনোভাব বুঝেই সাত্যকিকে শ্রীকৃষ্ণের একেবারে পশ্চাতে এক মণিময় আসনে বসিয়েছিলেন। সাত্যকির প্রসন্ন হাস্যকে সৌজন্য ও ধন্যবাদসূচক অভিব্যক্তি ভেবে দুঃশাসন আপ্যায়িত হয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন, সাত্যকির সে রহস্যপূর্ণ প্রসন্নতার অর্থ সম্বন্ধে তাঁর মনে কোন প্রশ্নও দেখা দিল না।…

প্রাথমিক সৌজন্য-বিনিময় নমস্কারাদির পর বাসুদেব শান্ত, গম্ভীর অথচ উচ্চনাদী— অর্থাৎ সভাস্থ সকলের শ্রুতিগোচর কণ্ঠে—ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘হে ভারত, আমি কেবল পাণ্ডবদের বার্তা বহন ক’রে এনেছি এ কথা বললে অসম্পূর্ণ কথন হয়। ভারতবর্ষের—বিশেষ কুরুকুলের যাতে কল্যাণ হয়, শাস্ত্রজ্ঞান ও সদাচার-যুক্ত, শৌর্যে বীর্যে উদারতায় সমগ্র ভারতখণ্ডে প্রখ্যাত ও নৃপতিকুলে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত এই কুল যাতে বিনষ্ট না হয় সেই কারণে আমি স্বেচ্ছায় মধ্যস্থরূপে, তৃতীয় পক্ষরূপেই এসেছি। আপনাদের এই প্রাচীন বংশকে সকলেই শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। দয়া, অনুকম্পা, ক্ষমা, আনৃশংস্য, সত্য ও ধর্মনিষ্ঠা এইসব গুণে সমগ্র বসুধার রাজন্যসমাজে কৌরবদের স্থান সকলের ঊর্ধ্বে। এই মহান কুলে অনপনেয় কোন কলঙ্কচিহ্ন পড়ে, তা কোনক্রমেই কারও অভিপ্রেত হওয়া উচিত নয় । আজ আপনার অশিষ্ট, লোভান্ধচিত্ত, অধর্মাসক্ত পুত্রগণ আত্মনাশে ও সেই বংশকে চিরতরে অবজ্ঞেয় ধিক্কারের লক্ষ্য করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এই একপক্ষীয় বিবাদ আপনার বংশের মধ্যেই ব্যাধি বা আপদরূপে দেখা দিয়েছে বটে কিন্তু আপনি সতর্ক ও সচেতন হয়ে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট না করলে সমগ্র ভারতখণ্ডের বিনাশকারণ হবে। কলহের এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিশ্বগ্রাসী দাবানলে পরিণত হবে, এ থেকে যে মহাহবের উৎপত্তি হবে তাতে কেউই পরিত্রাণ পাবেন না।’

এই পর্যন্ত বলে, ক্ষণেক স্তব্ধ থেকে বাসুদেব পুনশ্চ বললেন, ‘অথচ দেখুন, এখনও চেষ্টা করলে এই ভয়াবহ পরিণাম থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আপনি আপনার পুত্রদের শান্ত করুন, পাণ্ডুপুত্রগণ অবশ্যই শান্ত হবেন। পাণ্ডবরা আজ পর্যন্ত আপনার পুত্রদের অনিষ্ট হয় এমন কোন কর্মও করেন নি। অমেয়াত্মা যুধিষ্ঠির আপনাকে পিতার মতোই ভক্তি করেন। তাঁদের পরাক্রমও যেমন বিশাল, অপরিমেয়—তেমনি তাঁরা কারুণ্য ও উদারতার জন্যও বিখ্যাত। ধর্ম ও সদ্বিবেচনাই তাঁদের বর্ম। এ হেন সন্তানগণ—দুর্যোধনের জ্ঞাতিভ্রাতারা সহায় থাকলে আপনি সমস্ত পৃথিবীর অধীশ্বররূপে পূজিত হয়ে সুখে ও নিরুদ্বেগে জীবনযাপন এবং ভগবৎ-চিন্তা করতে পারবেন, আপনার পুত্রদেরও কোন দিক দিয়ে কোন আশঙ্কার কারণ থাকবে না। লোকে রাজ্য চায় শক্তি, মদমত্ততা আস্বাদন, ভোগবিলাস-উপকরণের প্রাচুর্য ও প্রতিষ্ঠার জন্য। যে বিপুল বিত্ত আপনাদের হস্তগত হয়েছে, তার অর্ধেক থাকলেও আপনার পুত্রদের এগুলির অভাব ঘটবে না। সেক্ষেত্রে এই আত্মনাশা কলহ একান্ত অকারণ নয় কি?…রাজন, পাণ্ডুপুত্ররা সর্বদাই ন্যায় ও ধর্মের অনুবর্তী। আপনার তাবৎ প্রজাদের সহানুভূতি ও কল্যাণচিন্তা সর্বদাই তাদের অনুসরণ করছে। এই দীর্ঘকাল তারা অবর্ণনীয় ক্লেশ সহ্য করেছে—তবু আপনাকে অমান্য করে নি, বা ভুজবলে এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে নি। তারাও আপনার সন্তান, কষ্টনিমগ্ন অপত্যের মতোই তারা পিতার মুখ চেয়ে আছে। আপনিও পিতৃবৎ বিবেচনা ও স্নেহ প্রদর্শন করুন—তারা আমরণ আপনার বশীভূত থেকে আপনাকে ও আপনার পুত্রদের রক্ষা করবে।’

শ্রীকৃষ্ণর বক্তব্য শেষ হতে সেই সভায় বিপুল সাধুবাদ ধ্বনিত হ’ল। সমাগত ঋষি ও অগ্রগণ্য ব্রাহ্মণগণও তাঁকে অনুমোদন করলেন। অনেকে পুরাকালের বহু দৃষ্টান্ত উদ্ধার ক’রে ধার্তরাষ্ট্রদের এই আত্মঘাতী কলহ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন।

ধৃতরাষ্ট্র কতকটা করুণ কণ্ঠেই বললেন, ‘বাসুদেব, তোমার বাক্যগুলি নিদারুণ সত্য তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু কি করব, আমি অন্ধ ও বৃদ্ধ, অসহায়, আমার পুত্ররা কেউ আমার ইচ্ছার অনুবর্তী নয়, আমি একপ্রকার তাদের হাতে বন্দী। পাণ্ডবদের প্রতি আমার কিছুমাত্র দ্বেষ বা তাদের সম্বন্ধে কোন অনুযোগও নেই। তারা চিরদিনই ভদ্র, শিষ্ট, বিবেচক আমার প্রতি সাতিশয় শ্রদ্ধাপরায়ণ। আমিও তাদের কল্যাণ প্রার্থনা করি। কিন্তু এ কলহ নিবারণ করা আমার শক্তির অতীত। অমিত-তেজস্বিনী সর্বজনপূজ্যা দেবী গান্ধারী স্বয়ং ওদের বিস্তর সদুপদেশ দিয়েছেন, তাতেও কোন কাজ হয় নি। তিনি বলেন ওদের ত্যাগ করতে, ওদের বধ করতে—তা আমার সাধ্যাতীত।’

তখন শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনকে সম্বোধন ক’রেও অনেক কল্যাণকর এবং সত্যবাক্য বললেন ‘আপনি পাণ্ডবদের প্রতি প্রায় আজন্ম বিদ্বেষপোষণ বা অনিষ্টচেষ্টা করে আসছেন, কিন্তু তাঁরা অদ্যাপি কখনও তার প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তা করেন নি। এমন কি ক্রদ্ধ হয়ে কোন অশিষ্ট বাক্যও বলেন নি। তাঁরা মিত্র থাকলে আপনাদের উন্নতিই হবে, ইহকালে নিষ্কণ্টক হয়ে রাজসুখ ভোগ করতে পারবেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুর সোমদত্ত বাহ্লীক অশ্বত্থামা—এমন কি বিকর্ণ প্রভৃতি আপনার সহোদরগণও তাতে প্রীত হবেন, আপনার হিতসাধনে তৎপর থাকবেন। মানুষ বিপদে পড়লে পিতাকে স্মরণ করে, তাঁর উপদেশ প্রার্থনা করে। আপনার পিতাও পাণ্ডবদের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক রক্ষা করতে উৎসুক। বুদ্ধিমান লোক হিতবাক্য স্বীকার ক’রে আত্মমত ত্যাগ করেন। সুবুদ্ধি মানব যে কোন কর্মই করেন তা অবশ্যই ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গ যুক্ত হয়। যারা মূঢ় তারাই কেবল অর্থ এবং ইতর ব্যক্তিরা কামের অনুরোধ রক্ষা করে। যাঁরা চিন্তাশীল পরিণামদর্শী তাঁরা এই দুইটি অনুসরণ করলেও ধর্মানুগত হয়ে করেন। আপনি যাদের পরামর্শ অনুসারে চলেছেন তারা কেউই বিক্রমে বা বুদ্ধিতে পাণ্ডবদের তুল্য নয়। সম্প্রতি বিরাট গোগৃহে একা ধনঞ্জয় যে অদ্ভুত কর্ম করেছেন, তাতেই আপনার শিক্ষালাভ করা উচিত ছিল। আপনি পাণ্ডবদের বিনির্জিত রাজ্য ও সম্পদ ভোগ করা সত্বেও সামান্য ব্যক্তিদের প্রতি অধিক নির্ভর ক’রে তাদের শত্রু করেছেন— এর থেকে অধিক নির্বুদ্ধিতা আর কি হতে পারে? যে ব্যক্তি সৎকর্ম- নিরত সচ্চরিত্র লোকদের সঙ্গে কপটাচরণ ও বৈরিতা করে, সে নিজের কুঠার দ্বারা নিজের আশ্রয়বৃক্ষের মূলছেদন করে। আত্মকল্যাণকামী কোন ব্যক্তি ত্রিভুবনের মধ্যে কোন সামান্য প্রাকৃত জনকেও অবহেলা অবজ্ঞা করেন না, বা তাদের প্রাপ্যে বঞ্চিত করতে প্রয়াস পান না। হে রাজন, এখনও সময় আছে, আপনি দুর্জন-সঙ্গ ও তাদের অসৎ মন্ত্রণা পরিহার ক’রে পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গত হোন—ইহলোকে প্রকৃত সুখ, প্রভূত কীর্তি এবং পরলোকে অক্ষয় স্বর্গ লাভ করতে পারবেন। প্রীতি স্থাপিত হলে পাণ্ডবরা আপনাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন, ধৃতরাষ্ট্র উভয় রাজ্যাংশের অধিপতি বলে গণ্য হবেন। মহতী লক্ষ্মী আপনার দ্বারে সমাগমসমুদ্যতা—তাঁকে অবমাননা ক’রে প্রত্যাখ্যান করবেন না

এই দীর্ঘ সম্ভাষণের প্রারম্ভ থেকেই দুর্যোধনের ললাটে উষ্মা ও বিরক্তির মেঘ ঘনীভূত হয়েছিল, শ্রীকৃষ্ণ নীরব হতে তিনি বজ্রাগ্নির মতোই প্রজ্বলিত হয়ে উঠে সক্রোধে উত্তর দিলেন, ‘আপনার মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সম্যক বিবেচনা ক’রে কথা বলেন না—এ বড় দুঃখের বিষয়। পাণ্ডবদের স্তুতিবাদে আর্দ্র হয়ে আপনি বিনা কারণে কেবলই আমার নিন্দা করেন। অদৃষ্টই আমার প্রতিকূল পিতা, পিতামহ, ক্ষত্তা, আচার্য—সকলেই কেবল আমার নিন্দা করেন। অপরের কোন দোষ দেখতে পান না। আমি তো আত্মকৃত কোন অন্যায়ই দেখি না, অথচ আপনারা সকলেই আমাকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখেন। আমি অনেক চিন্তা ক’রেও দুরদৃষ্ট ছাড়া এ ব্যবহারের অপর কোন কারণ দেখতে পাই না। নিজের অণুমাত্র দোষও আমার চোখে পড়ে না। আপনি আমাকে ভীতি প্রদর্শন করছেন? আমরা ক্ষত্রিয়–সম্মুখসমরে শরশয্যায় চিরনিদ্রিত হই, এই আমাদের ধর্ম। আমরা ভগ্ন হতে পারি, নত হতে শিখি নি কখনও। শত্রুর কাছে প্রণত হয়ে আত্মরক্ষা আমাদের কাছে অধর্ম। কেশব, এ বিষয়ে আমার চরম বক্তব্য শুনে রাখো। যখন আমরা বালক ছিলাম —তখন পিতা সম্ভবত ভয়প্রযুক্ত অথবা যথেষ্ট বিবেচনা ক’রেই আমার প্রাপ্য রাজ্য তাদের দিয়েছিলেন। ভাগ্য সে অবিচার সংশোধন করেছেন, দুর্যোধন জীবিত থাকতে সে রাজ্য আর তারা ফিরে পাবে না।’

ওঁর এই উদ্ধত উত্তরে বাসুদেবও ক্রদ্ধ হলেন। বিদ্রুপমিশ্রিত ধিক্কারের কঠিন হাস্যের সঙ্গে কঠোর তিরস্কার করলেন। দুর্যোধন কথিত ‘অণুমাত্র’ নয়, দুর্যোধনের অসংখ্য ও কদর্য দোষাবলীর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ওঁরা যে ভয়ঙ্করী নিয়তি তাড়িত হয়ে ভয়াবহ পরিণামের দিকেই অন্ধের মতো ছুটে চলেছেন—সে বিষয়েও পুনশ্চ সতর্ক ক’রে দিলেন।

এমন স্পষ্ট অনাবরিত সত্যভাষণ দুর্যোধনের রুচিকর হওয়ার কথা নয়, তিনি রুষ্ট হয়ে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের সকল রীতি লঙ্ঘন করলেন। কাউকে কোন সম্ভাষণ না ক’রেই, এঁদের অনুমতি প্রার্থনা না ক’রে অকস্মাৎ সে সভা ত্যাগ করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পাপসঙ্গীরাও যে তাঁর অনুগমন করবেন তার আর বিচিত্র কি! কিন্তু তিনি কক্ষের বহির্ভাগে আসামাত্র দুঃশাসন উত্তেজিত অথচ নিম্ন—অপরের অশ্রুতিগোচর কণ্ঠে অগ্রজকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘পিতা ও পিতামহ প্রভৃতি চিরদিনই আমাদের প্রতি বিরূপ, ওঁরা যেভাবে ভয় পেয়েছেন,—জীবনদাত্রী মাতা গান্ধারী তো আমাদের বধ ক’রে আপদমুক্ত হবারই উপদেশ দিয়েছেন–সেক্ষেত্রে আপনি আমি কর্ণ মাতুল—এই চারজনকে বন্দী ক’রে শ্রীকৃষ্ণর হাতে সমর্পণ করা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। আমার মনে হয় সে বুদ্ধি ইতিমধ্যেই বিদুরের মস্তিষ্কে দেখা দিয়েছে। কারণ তাঁর মুখে অকারণ এক তৃপ্তির চিহ্ন প্রত্যক্ষ করেছি। এক্ষেত্রে যদি বাঁচতে চান অতর্কিতে বাসুদেবকে বন্দী ক’রে নিজেদের আয়ত্তে রাখুন—তাতে শুধু যে আমাদের আসন্ন বিপদ দূর হবে তাই নয়, পাণ্ডবদেরও ভগ্ন-বিষদন্ত নির্বীর্য ভুজঙ্গের অবস্থা হবে। ওদের শক্তি বল সহায়—সবই বাসুদেব। এ সুযোগ নষ্ট করবেন না, সত্বর ব্যবস্থা করুন।’

দুর্যোধনের তো এ পরিকল্পনা ছিলই, এখন দুঃশাসনের সমর্থনে অধিকতর উত্তেজিত ও সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তিনি তখনই কয়েকজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ও দুঃশাসনকে দ্রুতকণ্ঠে বিভিন্ন নির্দেশ আদেশ দিলেন। তাঁরা ব্যূহবদ্ধ হয়ে অতর্কিতে সভাদ্বার অবরোধ করবেন এবং নির্বাচিত বিশেষ কয়েকজন রথী সভাকক্ষে প্রবেশ ক’রে বাসুদেবকে বেষ্টন করবেন। দ্রুতকণ্ঠে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া শেষ হলে তিনি উৎফুল্লচিত্তে পুনশ্চ সভায় প্রবেশ করলেন। এক সুনিশ্চিত বিজয়াশায় তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কিন্তু এই অত্যল্পকাল অর্থাৎ অনধিক এক দণ্ড সময়ের মধ্যেই এখানে পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। দুর্যোধনের পক্ষে বিপর্যয়ই ঘটে গেছে। তিনি যখন এক অভাবনীয় নাটকের অবতারণার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন আরও দ্রুত, আরও অকল্পনীয় এক নাটকের অভিনয় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে—সে নাটকে যবনিকাপাত বা সমাপ্তির প্রতীক্ষায় স্তব্ধ ও উদগ্রীব হয়ে আছেন এই মহান প্রেক্ষাগৃহের দর্শকগণ। দুর্যোধন এই নাট্য-পরিবর্তনের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায় এমন বিপর্যয় ঘটবে—তা ছিল কল্পনার অতীত। তিনি তো এর আভাস মাত্র পান নি, কোন দূত কোন মিত্রই তো এ-প্রস্তুতির সংবাদ দেয় নি!

দুর্যোধনের এইভাবে অকস্মাৎ নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোন প্রবল অসৎ বুদ্ধি বা অশুভ আয়োজন আছে তা অনুমান করতে সাত্যকির নিমেষমাত্র বিলম্ব ঘটে নি। এই ঈর্ষাবিষজর্জরিত মানুষটির কুটিল চিন্তা ঠিক কোন পথ অবলম্বন করেছে তা অভ্রান্তভাবে জানা না থাকলেও এক গুরুতর ষড়যন্ত্র বা সাংঘাতিক কোন পরিকল্পনা আছে সেটা বুঝেছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কৃতবর্মাকে ইঙ্গিত করেছিলেন, কৃতবর্মাও বিশেষ ধরনের পলকপাত মাত্র দ্বারা অপেক্ষমাণ অন্ধক ও বৃষ্ণি বীরদের সে ইঙ্গিত জানিয়েছিলেন।

তাঁরা তো প্রস্তুতই ছিলেন—প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সভাগৃহে প্রবেশ ক’রে কিছু অংশ বাসুদেবের তিন দিক ঘিরে এক রক্ষাব্যূহ রচনা করলেন—বাকি সকলে অবরুদ্ধ করে দাঁড়ালেন সভার দুটি প্রবেশ বা নির্গমন পথ। তাঁরা দুর্যোধনকে পথ ছেড়ে দিলেও— স-বাহিনী দুঃশাসনকে বাধা দিলেন। তাঁদের মধ্যে নায়ক যাঁরা—প্রায় সকলেই দুঃশাসনের পরিচিত, বিখ্যাত বীর প্রত্যেকেই। প্রচণ্ড যুদ্ধ ছাড়া তাঁদের পর্যুদস্ত ক’রে সভায় প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাও সে যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত। তেমন বিপুল বা পূর্বচিন্তিত আয়োজনও নেই। ফলে বিস্মিত, বিহ্বল এবং কার্যত-পরাজিতবৎ দুঃশাসন ও শকুনি ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হলেন।

.

বিভ্রান্ত দুর্যোধনের দিকে চেয়ে বাসুদেব এক প্রবল অট্টহাস্য করে উঠলেন। বললেন, ‘ওহে দুর্মতি দুর্যোধন, তুমি ভেবেছিলে তোমাদের মতো দুর্বুদ্ধিচালিত ক্ররমতিদের এই পাপসভাকক্ষে আমি একা ও অরক্ষিত ভাবে আসব? তোমার কি ধারণা—আমি এতই নির্বোধ?…বেশ তো, তোমার যদি আমাকে বধ করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা হয়ে থাকে, সেই চেষ্টাই করো না। আমি সভার প্রবেশপথ মুক্ত ক’রে দিচ্ছি—তোমার বাহিনী ও রথীদের নিয়ে এস। পাণ্ডবদের কার্য লাঘব ক’রে আমি একাই ধৃতরাষ্ট্রের কুল বিনষ্ট ক’রে যাই। দেখ—ইচ্ছা আছে শক্তি পরীক্ষা করার?

এই বলে তিনি আবারও অট্টহাস্য করলেন। সে হাস্যের গম্ভীর ও ভয়ঙ্কর রব সেই মহতী সভাকক্ষের গৃহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে এক অজ্ঞাত, নামহীন বিপুল আশঙ্কার সৃষ্টি করল। সমবেত মূর্ছাহতপ্রায় নিস্তব্ধ দর্শকদের মনে যেন তা সাক্ষাৎ কালান্তর যমের অট্টহাস্য বলে প্রতীয়মান হ’ল। সে সময় রোষপ্রজ্বলিত জনার্দনের দৃষ্টি কঠোর, আনন রক্তবর্ণ ও বাহুযুগল স্ফীতপেশীবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল তাঁর প্রতিটি রোমকূপ পর্যন্ত অনল বর্ষণ করছে, তাঁর সেই বিশ্বদেহী প্রচণ্ড ক্রোধের তাপ প্রজ্বলন্ত বাস্তব বহ্নিতাপের মতোই সকলকে ভস্মীভূত করতে উদ্যত হয়েছে। অধিকাংশ ব্যক্তিই তাঁর সেই রুদ্রমূর্তি সহ্য করতে পারলেন না, আতঙ্কে ও অসহতেজ প্রতিহত করার জন্যই যেন চক্ষু নিমীলন করলেন। ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি প্রধান ও সমাগত ঋষিতপস্বীগণ—যাঁরাই সে দৃশ্য দেখলেন তাঁদের মনে হ’ল বুঝি প্রলয়কালই সমাগত হয়েছে,–এখনই শুধু এই সভা বা এই নগরী নয়, সমস্ত বিশ্বই এই মুহূর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

দুর্যোধনও ভীত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। বাসুদেবের এ মূর্তি তিনি ইতিপূর্বেও দেখেছেন—রাজসূয় যজ্ঞসভায় শিশুপাল বধের সময়। এ রোষবহ্নি যদি এখনই বাড়বানলের মতো তাঁদের গ্রাস বা ভস্মসাৎ করে তো বুঝি বিস্মিত হবার কারণ নেই। মৃত্যু অনিবার্য ও আসন্নবোধেই যেন—তিনিও দৃষ্টি নিমীলিত করলেন।

এদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এই বিবেচনাতে সেই তেজঃপুঞ্জকান্তি বিরাট পুরুষ ধীরে ধীরে তাঁর উম্মা সম্বরণ করলেন। শুধু তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে এক অপরিসীম তাচ্ছিল্য, ঘৃণা ও বিদ্রুপের হাস্যরেখা অঙ্কিত রইল। তিনি অতঃপর যেন এঁদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই ধীর গম্ভীর ভঙ্গীতে গুরুজন, সমবেত ব্রাহ্মণ ও তপস্বীদের নমস্কার জানিয়ে কৃতবর্মা ও সাত্যকির হাত ধরে সভাগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

সমবেত কুরুপ্রধান ও অন্যান্য রাজন্যবৃন্দ যেন সম্মোহিতবৎ নির্বাকভাবে তাঁর অনুসরণ করতে লাগলেন। কিন্তু সাক্ষাৎ পাবকতুল্য সেই দিব্যপুরুষ কারও দিকে দৃকপাত করলেন না। সারথি দারুক প্রয়োজন বুঝে ওঁর হেমশৃঙ্খল পরিবৃত, শ্বেতব্যাঘ্রচর্মাস্তীর্ণ, শুভ্রবর্ণ রথ ঠিক প্রধান প্রবেশতোরণের সম্মুখেই উপস্থাপিত করেছিলেন বাসুদেব নিরুদ্বিগ্ন নিরুত্তাপ মন্থর গতিতে অগ্রসর হয়ে স্বীয় রথে পৃষ্ঠস্থাপন ক’রে কৃতাঞ্জলিপুটে এঁদের কাছে বিদায় প্রার্থনা করলেন।

অন্ধ রাজা চোখে না দেখেও বাসুদেবের রুদ্রমূর্তির আভাস ও উত্তাপ পেয়েছিলেন, তাঁর ধারণায় কিছুমাত্র ভ্রান্তি হয় নি। এক্ষণে শ্রীকৃষ্ণ যে রথারোহণে উদ্যত হয়েছেন, এবার প্রস্থান করবেন তাও বুঝতে পারলেন তিনি। কী ধারণা ও মনোভাব নিয়ে যাচ্ছেন তাও অনুমান করতে কোন অসুবিধা নেই। তিনি কতকটা করুণ কণ্ঠে বিলাপের ভঙ্গীতে বললেন, ‘বাসুদেব, পুত্রদের উপর আমার কিরূপ প্রভাব তা তো প্রত্যক্ষ দেখেই গেলে। আমি কত অসহায় তাও তোমার অবিদিত রইল না। পাপমতি দুষ্ট পুত্ররা আমার অবাধ্য, ওরা আপন মঙ্গলও বোঝে না। পাণ্ডবদের আমি স্নেহ করি, তাদের সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র অশুভ অভিপ্ৰায় নেই। আমি দুর্যোধনকে কত বোঝালাম তা তো তুমি শুনলে, সে হিতবাক্যে কখনই কর্ণপাত করে না। তুমি অবস্থা বুঝে আমাকে ক্ষমা করো, পুত্র যুধিষ্ঠিরকে আমার আশীর্বাদ জানিও।’

বাসুদেব ‘যে আজ্ঞা’ বলে তাঁর অনুরোধ স্বীকার ক’রে নিয়ে প্রবীণদের সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘এই সভায় যা যা ঘটল, যেভাবে আলোচনা হ’ল তা আপনারা সকলেই দেখলেন ও শুনলেন। দুর্যোধন কোন যুক্তি অনুনয় বা অনুরোধেই কর্ণপাত করল না, উপরন্তু সেই মন্দগতি, নিয়তিতাড়িত দুর্ভাগ্যবিভ্রান্ত লোকটি ঘোরতর অশিষ্টের মতো যে আচরণ করল, যে নিতান্ত নিন্দনীয় কর্মে উদ্যত হয়েছিল তারও আপনারা প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার আর এক্ষেত্রে কিছু করণীয় নেই, আমি উপপ্লব্যে প্রত্যাবৃত্ত হয়ে এই বৃত্তান্তই জানাব। আপনারা প্রসন্নমনে আমাকে বিদায় দিন।’

বক্তব্য ও অভিবাদনাদি শেষ ক’রে রথের একটি সোপানে উঠে তিনি যেন একপ্রকার উৎসুক হয়েই সেই সর্বশ্রেণীর দর্শকপূর্ণ সমবেত জনতার চতুর্দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ ক’রে নিলেন। দেখলেন, সমাগত এই সমস্ত বীর ও প্রবীণদের থেকে ঈষৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে—একা নিঃসঙ্গ মহাবীর কর্ণ বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে কেমন এক করুণ দৃষ্টি ওঁর উপরই নিবদ্ধ ক’রে দাঁড়িয়ে আছেন।

শ্রীকৃষ্ণ বোধ করি তাঁরই অন্বেষণ করেছিলেন, এখন স্মিত প্রসন্ন মুখে রথ থেকে অবতরণ ও অঙ্গরাজের দিকে কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে তাঁকে গাঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন, এবং সেই অবস্থাতেই যেন বাহুপাশে বন্দী ক’রে তাঁকে নিয়েই রথে উঠলেন।

বাসুদেবের ইচ্ছার গতি কোন পথে যায় তা দারুকের অবিদিত নেই, এঁরা দুজনে রথারূঢ় হওয়া মাত্র সে তেজস্বী অশ্বচতুষ্টয়ের বলগা শিথিল ক’রে দিল, রথ প্রথম কিছুটা জনবেষ্টনীর জন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেও উন্মুক্ত পথে পড়ে বিদ্যুৎবেগ অবলম্বন করল। ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, অশ্বত্থামা প্রভৃতি কিছুদূর তাঁদের অনুগমনের চেষ্টা করলেন কিন্তু ঝঞ্ঝাগতি সেই বাহন ও অভিজ্ঞ সারথি চালিত সে রথ অতি অল্পকালমধ্যে চক্র ও অশ্ব-ক্ষুরোখিত ধূলিমেঘের আবরণে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এঁদের মনে হ’ল যা কিছু শুভ, যা কিছু এ বংশের ও পুরীর পক্ষে কল্যাণকর তা সবই ঐ রথের সঙ্গে ঐ পথে এ রাজ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। মহা অমঙ্গল ও সর্ববিনষ্টি ছাড়া ওঁদের সম্মুখে আর কিছু রইল না।

আদিত্যতুল্য তেজশালী মহারথ কর্ণ কতকটা মন্ত্রমুগ্ধ, যন্ত্রচালিতের মতোই শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে তাঁর রথারূঢ় হয়েছিলেন বটে —তবে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এ কথা বলা যায় না। তিনি এই সভার প্রারম্ভকাল থেকেই কী এক অজ্ঞেয় ও দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করছিলেন বাসুদেবের প্রতি। বাসুদেব তাঁর শত্রু নন, তেমনি মিত্র দুর্যোধনের প্রতি প্রসন্ন বা অনুকূল নন, সেজন্য কিছুটা বরং–বিদ্বিষ্ট না হলেও—উদাসীন থাকারই কথা। তবে সেই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা থেকে শুরু করে রাজসূয় যজ্ঞাগার পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে মিত্রবৎ আচরণ করে আসছেন—এটা সত্য। এ আকর্ষণ কি সেইজন্যই? এটা আকর্ষণই, সাধারণ প্রীতি অপেক্ষা অধিকতর কিছু—তা কোনমতেই অস্বীকার করতে পারছেন না। এ যা-ই হোক, মনে মনে যেন আজ এই একত্র যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। এ যেন তাঁর নিয়তি—জ্ঞাত, অবশ্যম্ভাবী।

কতকটা সেই কারণেই পরিচিত জ্ঞাতি-বান্ধবদের দৃষ্টিসীমার বাইরে এসে, উদ্বেল জনতার উত্তাল গগনভেদী জয়ধ্বনি মন্দীভূত হলে কর্ণ একটি মাত্র শব্দই উচ্চারণ করলেন,—প্রশ্নের ভঙ্গীতে—’তার পর?’

ততক্ষণে নগর প্রাকারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তাঁরা। যারা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত তাঁদের অনুগমন করছিল, মহাতেজস্বী অশ্বচতুষ্টয়ের গতিবেগের কাছে পরাস্ত, ক্লান্ত হয়ে সে চেষ্টা ত্যাগ করেছে। পথ জন-বিরল, পুরোভাগে ও পশ্চাতে বাসুদেবেরই সঙ্গী বা দেহরক্ষী ছাড়া কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এ-ই উত্তম অবসর বুঝে শ্রীকৃষ্ণ দারুককে ক্ষণকালের জন্য এক বিরাট শিংশপা বৃক্ষতলে রথ রেখে কিছুদূরে গিয়ে বিশ্রাম করতে নির্দেশ দিলেন। তারপর, ইঙ্গিত বুঝে দারুক দ্রুত অন্তর্হিত হতে বাসুদেব শান্ত মধুর কণ্ঠে কর্ণকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘একটি নিগূঢ় রহস্য তোমার কাছে উদঘাটিত করব বলেই তোমাকে এতদূর টেনে এনেছি। তোমার জন্ম-রহস্য।’

সঙ্গে সঙ্গেই বোধ করি সম্বোধন সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠে বললেন, ‘মনে করো না তাচ্ছিল্যবশত ‘তুমি’ বলছি, তুমি আমার নিকট আত্মীয়, সম্পর্কে ভ্রাতা, হয়ত অনুজও বটে—সেই জন্যই এই অন্তরঙ্গ সর্বনাম ব্যবহার করছি।‘

কর্ণ হয়ত অনেক কিছু বক্তব্য বা প্রস্তাবের জন্যই প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু বাসুদেবের বার্তা সে পথ অবলম্বন করে নি, তাঁর সমস্ত কল্পনাকে অতিক্রম করেছে। তিনি বিমূঢ়বৎ বললেন, ‘আত্মীয়? ভ্রাতা?…আপনি কি রহস্য করছেন! না তিক্ত কৌতুকে আমাকে আহত করতে চাইছেন?’

‘আপনি নয় বসুষেণ, তুমি। আমি কৌতুক করি নি, কোন লঘু বাক্য নয়, মিথ্যা তো নয়ই—তুমি আমার আপন পিতৃসা-পুত্র, আমার ভ্রাতা।’

‘তার অর্থ?’ নিমেষ-মধ্যে যেন কর্ণর মুখমণ্ডল অঙ্গার-বর্ণ ধারণ করেছে, বিস্ময়ে অবিশ্বাসে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে উঠেছে প্রায়—কোন শব্দ উচ্চারণ করতেও কষ্ট হচ্ছে।

‘কর্ণ, তুমি শুধু শৌর্যে ঔদার্যে মহান নও, আমি জানি, তুমি জ্ঞানেও মহান। শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মপরায়ণ বেদবাদবেত্তা। বেদপারগ ব্রাহ্মণদের সেবা ক’রে তাঁদের সাহচর্যে ও উপদেশে ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্মতম তত্বেও জ্ঞান লাভ করেছ। তোমার সহ্যশক্তি ও মনোবল সে জ্ঞান-লাভেরই ফল।…তুমি ধীর মস্তিষ্কে এ সংবাদ গ্রহণ করতে পারবে—এর পূর্ণ তাৎপর্যও তোমার মানসক্ষেত্রে প্রতিভাত হবে এই আমার আশা। অঙ্গাধিপতি তুমি রাধেয় নও, অধিরথপুত্র নও। তুমি কৌন্তেয়, তুমি পাণ্ডব। পৃথা আমার পিতৃসা, অপুত্রক কুন্তীভোজ তাঁকে পুত্রীজ্ঞানে, কন্যাস্নেহে পালন করেছিলেন, সেই জন্যই তিনি কুন্তী নামে পরিচিত, তাতে রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হয় না। সেই কারণে তুমি আমার ভ্রাতা।’

কর্ণ আরও বিহ্বল হয়ে পড়লেন। এসবই যে অবিশ্বাস্য, উন্মাদের প্রলাপের মতোই অর্থহীন। বললেন, ‘তোমার

বক্তব্য ও বাক্যগুলি আরও দুয়ে, আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে, জটিল ধন্দ বলে বোধ হচ্ছে। দয়া করে আর একটু প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দাও, এ তথ্য পরিবেশনের অর্থ।’

‘কর্ণ, তুমি কি এখনও আমার বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ বা তার ইঙ্গিত উপলব্ধি করছ না? তোমার কি অদ্যাপি তোমার জন্ম সম্বন্ধে কোন সংশয় দেখা দেয় নি? ক্ষত্রকুল- সম্ভব সকল মনোভাব যে তোমাতে উপস্থিত। সূতপুত্রের পক্ষে কি এই বীর্য, এই শাস্ত্রজ্ঞান, এই সাহস এবং উদারতা সম্ভব বলে মনে করো?…তুমিই আর্যা কুন্তীর প্রথম সন্তান—তাঁর কন্যাবস্থায় তোমার জন্ম। এ ঘটনা অভিনব বা অস্বাভাবিক কিছু নয়, সেই জন্যই শাস্ত্রকাররা সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন কানীন ও সহোড় সন্তানকে বৈধ বলে স্বীকার করার। এই সন্তান সেই কন্যার পরিণেতার সন্তান বলেই গণ্য হবে। সেই বিধি-বলেই তুমি পাণ্ডুপুত্র, পাণ্ডবদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ, যুধিষ্ঠিরাদির অগ্রজ ….কুন্তী তখন নিতান্তই বালিকা, এসব তথ্য তখন তাঁর অনভিজ্ঞাত, স্বাভাবিক লজ্জা ও জনসমাজে, পুরমধ্যে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও হেয় হওয়ার আশঙ্কা বশত কাউকে প্রশ্ন করতে পারেন নি, এ সম্বন্ধে শাস্ত্রব্যবস্থা কি তা জানারও সুযোগ হয় নি। দুর্বলচিত্তা বালিকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তোমাকে এক মৃৎপাত্রে সংস্থাপিত ক’রে নদীজলে ভাসিয়ে দেন। দৈবানুগ্রহে নিঃসন্তান সূতশ্রেষ্ঠ অধিরথ স্নানকালে সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনে এবং তখনও পর্যন্ত তাকে জীবিত ও সুস্থ দেখে–তোমাকে উদ্ধার করেন ও গৃহে নিয়ে আসেন। তাঁরা তোমাকে যথার্থ পুত্রস্নেহেই পালন করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তাঁদের বিশ্বাস, এ তাঁদের প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহ, তাঁরা সেই কারণেই নিশ্চিন্ত মনে ও নিঃসন্দেহে তাঁদের পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, সেইভাবেই আচরণ করেছেন চিরদিন।’

এই পর্যন্ত বলে কর্ণকে এ বিস্ময়কর সংবাদের আঘাত কিছুটা সহনীয় ক’রে নেবার অবকাশ দিয়ে পুনশ্চ বললেন, ‘জননী কুন্তীর এজন্য পরিতাপ ও দুঃখের অবধি ছিল না। তবু তোমাকে প্রনষ্ট বা মৃতজ্ঞানেই কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ কৌরবকিশোরদের শস্ত্রপরীক্ষা সভায় তোমাকে—বালার্কের ন্যায় তেজঃপুঞ্জকলেবর তরুণকে—দেখে, জন্ম-অভিজ্ঞান ঐ সহজাত কবচ-কুণ্ডলে তোমাকে সেই পরিত্যক্ত পুত্র বলে চিনতে পারেন এবং সেই কারণেই—নিজের গর্ভজাত দুই সন্তানের মধ্যে সংঘর্ষ আসন্ন বুঝেই মূর্ছিতা হয়ে পড়েন। তখনকার মতো, কৃপাচার্যের উপস্থিত বুদ্ধি-বলে সে নিদারুণ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেও—তাঁর জীবন—তাঁর দিবারাত্রি বিষাক্ত হয়ে যায়। তদবধি তাঁর মনোকষ্ট ও আত্মধিক্কারের সীমাপরিসীমা নেই, একদিনের জন্যও সে চিন্তাযন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারেন নি।’

এই পর্যন্ত বলে পুনশ্চ তাঁকে বাহুবেষ্টনে বদ্ধ ক’রে গাঢ় কণ্ঠে বাসুদেব বললেন, ‘ভ্রাত কর্ণ, তুমি এবার তোমার ন্যায্য স্থান, প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীয় রাজ্য অধিকার করো। তুমিই কুরুবংশ-সিংহাসনের প্রকৃত অধীশ্বর। এ পরিচয় অবগত হলে তোমার ভ্রাতারা অবশ্যই তোমার বশ্যতা স্বীকার করবেন, তোমার প্রণত হবেন। শুধু পাণ্ডবদের পঞ্চ সহোদর কেন, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, আমার ভাগিনেয় অপরাজিত অভিমুন্য, সমাগত অন্ধক বৃষ্টি দশার্হ প্রভৃতি যাবতীয় রাজা ও রাজপুত্রগণ সকলেই তোমার চরণবন্দনা করবেন। তাঁদের সঙ্গে পাঞ্চাল ও চেদীবংশীয় কুটুম্বগণ, বিরাটপুত্ররা এবং আমি উদ্যোগী হয়ে আজই তোমার অভিষেকের ব্যবস্থা করব স্বর্ণকুম্ভে তীর্থবারি, সর্বৌষধি, সর্ববীজ, সর্ব রত্নাদি দ্বারা শাস্ত্রমতে অভিষেক কার্য-সম্পন্ন হবে। দ্বিজোত্তম ধৌম্য অগ্নিহোত্র সম্পাদন করবেন, বৈদিক কর্মাভিজ্ঞ অপর পুরোহিত ও চতুর্বেদী ব্রাহ্মণগণ অভিষেক ক্রিয়ায় নিযুক্ত হবেন। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তোমাকে শ্বেতচন্দন দ্বারা স্নিগ্ধ করবেন, মহাবল ভীমসেন তোমার মস্তকোপরি শ্বেতছত্র ধারণ করবেন। স্বয়ং অর্জুন তোমার রথচালনা করবেন, অপরাপর ভ্রাতা ও আত্মীয় কুটুম্বগণ জয়ধ্বনি দিতে দিতে তোমার অনুগমন করবেন। অতঃপর তুমি নিশ্চিন্ত সুখে গৌরবের সঙ্গে রাজ্যসুখ ভোগ করো। বসুন্ধরার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ভোগ্য বস্তু আছে সবই তোমার অধিগত হবে এমন কি, তোমার গোপন চিন্তার ধন, অর্ধেক মানসকল্পনায় গঠিতা এ সংসারের শ্রেষ্ঠ নারীরত্ন—তোমার চির-ইপ্সিতা দ্রৌপদীও তোমার অঙ্কশায়িনী হবেন, স্বীয় অধিকারেই তুমি তাঁকে লাভ করবে। প্রতি ষষ্ঠবর্ষে তিনি বৎসর কাল তোমার সেবা করবেন।

এই শেষের কথাগুলি ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে, যাতে শ্রোতার বোধগম্য হতে অসুবিধা বা বিলম্ব না হয় সেইভাবে বলে তীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টিতে কর্ণের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

এই বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে বিস্ময়ে উত্তেজনায় কর্ণের মুখমণ্ডল আরক্তিম ও স্বেদসিক্ত হয়ে উঠেছিল।

লোভ বড় বেশী। প্রবল ও দুর্বার।

যেন ওঁর মনের গোপন তৃষ্ণার বিষয় অবগত হয়েই এই শেষের কথাগুলি বলছেন বাসুদেব। যে কল্পিত সৌভাগ্যের অকল্পিত দৃশ্য ওঁর মানসচক্ষুর সম্মুখে অঙ্কিত করছেন তা বোধ করি দেবতাদেরও ঈর্ষা-প্রণোদক।

কিন্তু কর্তব্যও সুস্পষ্ট। কর্ণের মতো ধর্মশাস্ত্রপারঙ্গম ব্যক্তির কাছে তা সুনির্দিষ্টও। তিনি সামান্য দৈহিক বা ঐহিক সুখভোগের লালসায় ধর্মভ্রষ্ট হয়েছেন—এ কথা শোনার আগে মৃত্যুই শ্রেয়।

অঙ্গাধিপতি একটা প্রায়োদগত দীর্ঘশ্বাস মোচন ক’রে আবেগ সম্বরণ করলেন, সেই সঙ্গে ক্ষণেকের দুর্বলতা, দোলাচলচিত্ততা। তারপর অঙ্গাবরণের প্রান্তে ললাটের স্বেদ মোচন ক’রে শ্রীকৃষ্ণর ন্যায়ই ঈষৎ গাঢ় হলেও শান্ত কণ্ঠে ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, ‘বাসুদেব, এ অভাবনীয় অচিন্তিতপূর্ব সংবাদের মধ্যে তুমি যে আমার আত্মীয়, আমার ভ্রাতা— তোমাকে ভ্রাতৃ সম্বোধনে কোন বাধা রইল না আর, তাতে ধৃষ্টতা প্রকাশ পাবে না—এইটুকুই আমাকে সর্বাপেক্ষা হর্ষোৎফুল্ল করেছে। তোমার প্রতি চিরদিনই এক দুজ্ঞেয় অথচ প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি—এতকাল তার কারণ বুঝতাম না, বিস্মিত হতাম নিজের মনোভাবে—আজ আর সে কারণ রহস্যাবরিত রইল না। তুমি চিরদিনই আমার সঙ্গে ভদ্র আচরণ করেছ, সহানুভূতি প্রকাশ করেছ, সেজন্য আমি বরাবরই কৃতজ্ঞ বোধ করেছি, কিন্তু তা-ই এ মুগ্ধ আকর্ষণের একমাত্র হেতু নয়, সেটা আজ বুঝলাম।…আজও তুমি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছ তা প্রধানত পাণ্ডবদের হিতাকাঙ্ক্ষা-উদ্ভূত হলেও আমার পক্ষেও যে শুভ ও কল্যাণকর তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু——

এই পর্যন্ত বলে অকস্মাৎ ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে রইলেন কর্ণ।

তারপর, যেন চিত্তের উদ্বেল তরঙ্গময়তা প্রশমিত হবার কিঞ্চিৎমাত্র অবসর দিয়েই পুনশ্চ বক্তব্যের সূত্র গ্রহণ করলেন। বললেন, ‘তোমার সকল বাক্যই যুক্তি-গ্রাহ্য তা স্বীকার করছি। শাস্ত্রানুসারে পাণ্ডুই আমার পিতা, সেই হেতু তাঁর সিংহাসনে আমার অগ্রাধিকার। কিন্তু জন্মদাত্রী কুন্তী জন্মদানের পর সদ্য-প্রসূত সন্তানকে নদীগর্ভে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তার অমঙ্গল-উদ্দেশ্যেই, মৃত্যু অবধারিত জেনেই—তাতেও তো কোন সন্দেহ নেই। অপর দিকে সারথি অধিরথ আমাকে দেখামাত্র নিঃশঙ্ক চিত্তে পরম স্নেহে পরম যত্নে গৃহে এনেছিলেন, জননী রাধাও সন্তানজ্ঞানেই ক্রোড়ে ধারণ করেছিলেন, কেবল তাই নয়—সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর স্তনে ক্ষীর-সঞ্চার হয়েছিল। তিনি অক্লেশে নির্ঘণ চিত্তে আমার মূত্রপুরীষাদি মোচন করেছিলেন। নিজের গর্ভজাত সন্তানের প্রতি যে আচরণ প্রত্যাশিত বা স্বাভাবিক তার ন্যূনতম অন্যথা হয় নি। এ অবস্থায় কোন ধর্মশাস্ত্রশরণপরায়ণ ব্যক্তি তাঁদের পিণ্ডলোপ করবে? এর চেয়ে অধর্ম আর কি হতে পারে?

‘ক্রমশ, যথাসময়ে অধিরথ সূতকুল-বিধি অনুযায়ী আমার জাতকর্মাদি সম্পন্ন করিয়ে বসুষেণ নাম রাখেন এবং সেইভাবেই আমার সংস্কারাদি করেন। সূতকূলেই আমার বিবাহ হয়েছে। সেই সকল স্ত্রীদের গর্ভে আমার পুত্রসকল এবং পরবর্তীকালে তাদের বিবাহদ্বারা পৌত্র পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেছে। সে সকল ভার্যা কোন অন্যায় আচরণ করেন নি, পরন্তু আমি তাঁদের সঙ্গে প্রণয়বদ্ধ। সে সম্পর্ক আজ আমি অস্বীকার করব কি ক’রে? অখণ্ড ভূমণ্ডল বা সুমেরুসদৃশ স্তূপাকার সুবর্ণের বিনিময়েও এমন অধর্মাচরণ আমি করতে পারব না। আশা করি তুমিও আমাকে তা করতে বলবে না । কারণ সে কার্যে বিশ্বসমাজে আমি ধিকৃত ও হেয় হয়ে থাকব।

‘তারপর দেখ, দুর্যোধন আমাকে— সামান্য অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তিকে— রাজপদে অধিষ্ঠিত ও অভিষিক্ত করেছেন, তাঁর আশ্রয়ে আমি নিষ্কণ্টকে রাজ্যসুখ ভোগ করছি, উত্তরোত্তর আমার সকল দিকে শ্রীবৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠালাভ ঘটেছে। এর পরও—সূতগণের সঙ্গে জাতিগত পূজা-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেছি—বিবাহাদি ক্রিয়াকলাপ নির্বাহিত হয়েছে। দুর্যোধন সেজন্য আমাকে অবজ্ঞেয় জ্ঞান করেন নি, কোনরূপ অন্যায় আচরণ করেন নি। পরন্তু চিরদিন বন্ধুবৎ ব্যবহার

করেছেন। আমার উপর নির্ভর ক’রেই তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছেন। দ্বৈতযুদ্ধে একমাত্র আমিই সব্যসাচীর সমযোদ্ধা—সকলেই এই মত প্রকাশ ক’রে আসছেন, দুর্যোধনও সেই বিশ্বাসেই এত নিশ্চিন্ত আছেন। আজ যদি ভয় বা লোভবশত আমি তাঁর পক্ষ ত্যাগ করি, তাহলে ধর্মে তো পতিত হবোই, চিরদিন মনুষ্যসমাজে মিথ্যাচারী, কাপুরুষরূপে চিহ্নিত ও অশ্রদ্ধেয় প্রতিপন্ন হবো। সকলেই বলবেন, সাম্রাজ্য-লোভে বন্ধুকে চরম বিপদ বা সর্বনাশের মুখে পরিত্যাগ করেছি। ধিক।’

তারপর, আরও কিছুকাল নীরব থেকে বললেন, ‘তোমার কাছে আমার একটি অনুনয়—তোমাকে বলা হয়ত অকারণ, তোমার অমানবিক প্রজ্ঞায় এ সত্য পূর্বেই বুঝেছ নিশ্চয়—মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের কাছে আমার এই জন্মবৃত্তান্ত আমার পতনের বা এই যুদ্ধাবসানের পূর্বে কদাচ প্রকাশ করো না। আমি কুন্তীর প্রথম পুত্র এ ইতিহাস অবগত হলে ধর্মস্বরূপ যুধিষ্ঠির কদাচ আমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন না, এই সুবিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য আমাকেই প্রদান করবেন এবং আমি তা প্রাপ্ত হলে অবশ্যই দুর্যোধনকে পুনঃপ্রদান করব। তার প্রয়োজন নেই, সে ইচ্ছাও আমার নেই। পাণ্ডবদের প্রতি আর কোনক্রমেই বিদ্বেষের ভাব আমার মনে আসছে না। যুধিষ্ঠিরই যথাধর্ম এই রাজ্যের অধিপতি, তিনিই রাজ্যেশ্বর হয়ে থাকুন। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি তাঁর পক্ষেরই জয়লাভ হবে। বাসুদেব যে-পক্ষের নেতা ও বুদ্ধিদাতা ধনুর্ধর ধনঞ্জয়, মহাবল ভীমসেন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদেয়গণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, কুন্তীভোজ, সপুত্র বিরাট, পঞ্চ কেকয়, চেদীরাজ প্রভৃতি ক্ষত্রিয় বীরগণ যে পক্ষের যোদ্ধা— সে পক্ষের জয় অনিবার্য।’

এই পর্যন্ত বলে কর্ণ কৌতুকছলে অথচ বিষাদপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘বাসুদেব, তুমি কী না জানো! রাজনীতিতে আজ তোমার অপেক্ষা পারদর্শী তো কাউকে দেখি না। সুহৃদ্বর দুর্যোধন এক বিরাট শস্ত্র-যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। তুমিই তার উপদেষ্টা বা অধ্বর্ষ কপিধ্বজ তার হোতৃ, গাণ্ডীব, দ্রুক ও পুরুষকার আজ্যর কাজ করবে সব্যসাচী প্রযুক্ত ঐন্দ্র পাশুপত ব্ৰাহ্ম প্রভৃতি অস্ত্রসকলই এ যজ্ঞের মন্ত্রস্বরূপ হবে অভিমন্যু স্তোত্র পাঠ করবেন ভীমসেন উদগাতা ও স্তোতা যুধিষ্ঠির ব্রহ্মা শঙ্খশব্দ মুরজশব্দ ভেরীশব্দ ও সিংহনাদ মঙ্গলধ্বনি বলে গণ্য হবে কল্যাণীয় নকুল সহদেব পশুবন্ধন করবেন, ধ্বজদণ্ড ও রথশ্রেণী যূপস্থানীয় হবে। *

[* হে জনার্দন কৃষ্ণ! তুমি এই যজ্ঞের বেত্তা ও অধ্বর্যু হইবে, অর্থাৎ তোমাকেই ইহার অধ্যক্ষতা ও যজুর্বেদী ঋত্বিকের কর্ম সম্পন্ন করিতে হইবে। সন্নাহযুক্ত কপিধ্বজ বীভৎসু ঋগবেদী হোতার কার্য করিবেন। গাণ্ডীব, শরাসন, দ্রুক এবং প্রতিপক্ষীয় পুরুষগণের বীর্যই আজ্য-স্বরূপ (মনুষ্য ব্যবহারে যাহাকে ঘৃত বলা হয় তাহাই দেবগণের উদ্দেশ্যে যজ্ঞাগ্নিতে প্রদান করা হইলে আজ্য নামে অভিহিত হয়, পিতৃগণের পক্ষে তাহাই আয়ূত।) হইবে। হে মাধব! শস্ত্রবিক্ষেপ সময়ে সব্যসাচী ঐন্দ্র, পাশুপত, ব্রাহ্ম ও স্থূণাকর্ণ প্রভৃতি যে-সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করিবেন, তৎসমুদায়ই যজ্ঞীয় মন্ত্রনিচয়ের স্থানীয় হইবে। পরাক্রমে পিতৃতুল্য অথবা তদপেক্ষাও বলশালী সুভদ্রানন্দন অভিমন্যু সম্যক প্রকারে গীতস্তোত্র অর্থাৎ‍ উদগাতা হইবেন। সমরাঙ্গনে ঘন ঘন গর্জনকারী, গজসৈন্যের সাক্ষাৎ অন্তক স্বরূপ, মহাবল পরাক্রান্ত, নরব্যাঘ্র ভীমসেন সামবেদী উদগাতা ও স্তোতার কার্য করিবেন। জপ-হোম-সংযুক্ত নিত্য ধর্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির আপনিই ব্রহ্মা অর্থাৎ হোমকার্যের পর্যবেক্ষক হইবেন। শঙ্খ-মূরজ ও ভেরী-সকলের নিনাদ এবং উপকৃষ্ট সিংহনাদ—সমস্তই সুব্রহ্মণ্য অর্থাৎ কালের ভোজনার্থক আবাহন মন্ত্রস্বরূপ হইবে। যশস্বী মহাবীর্য মাদ্রীনন্দন নকুল সহদেব সেই যজ্ঞে সম্যকরূপে শমিত্র, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়-পশু হিংসা করিবেন।…বিচিত্রবর্ণ-দণ্ড-সম্পদ-সংযুক্ত সুবিমল রথরাজিনিচয় এই যজ্ঞে যূপরূপ উপকল্পিত হইবে। কর্ণি, নালীক, নারাচ প্রভৃতি অস্ত্র সকল বৎসদণ্ড ও উপবৃংহণ অর্থাৎ সোমাকৃতি সাধন চমসাদির স্থানীয় হইবে। সেই যজ্ঞে তোমর-নিকর সোমকলস সমুদয়ের শরাসন সমস্ত পবিত্র অর্থবৎ সোমোৎক্ষেপণ-সাধন অভিষবণ (যজ্ঞের পূর্বে স্নান) সমূহের, খড়্গা সমুদায় কপাল সকলের, মস্তক সমস্ত পুরোডাশ-পাকপাত্র-পুঞ্জের, শক্তিরাজি অগ্নিসন্দীপনার্থ সমিধ কদম্বের, গদা নিবহ পরিধি অর্থাৎ আহুতি রক্ষণার্থ-অগ্নির উভয় পার্শ্বে স্থাপিত কাষ্ঠ নিচয়ের এবং রুধির হবির কার্য করিবে। দ্রোণ, ও শরদ্বৎপুত্র কৃপের শিষ্যগণ সদস্য কর্ম করিবেন। গাণ্ডীবধন্বা ধনঞ্জয়, এবং দ্রোণ-দ্রৌণি প্রভৃতি অন্যান্য মহারথগণ যে সমস্ত শস্ত্র বিসর্জন করিবেন, তৎসমুদায় পরিস্তোম অর্থাৎ সোমচমসাদির স্থানীয় হইবে। সাত্যকি প্রতিপ্রাস্থানিক অর্থাৎ অধ্বর্যুর সহকারে সমুচিত মন্ত্র সংধারণ কর্ম সম্পন্ন করিবেন। ঐ যজ্ঞে দুর্যোধন দীক্ষিত হইবেন এবং মহতী অনীকিনীই তাঁহার পত্নীস্বরূপ হইবে।’ ত্মবধর্মান সংস্করণ মহাভারত–১৪১ অধ্যায়, উদ্যোগ পর্ব ]

‘বাসুদেব, আমি পাণ্ডবদের অনেক কটু বাক্য বলেছি। সব সময় যে দুর্যোধনের প্রীতিবর্ধনের জন্যই বলেছি তা নয় –স্ত্রীর অশ্রুতপূর্ব লাঞ্ছনায় তাদের নির্লজ্জ ঔদাসীন্য দেখে অপরিমাণ ক্রোধ উৎপন্ন হয়েছিল, তাদের পৌরুষকে যদি জাগ্রত করা যায় সেই আশাতেই তাদের ধিক্কার দিয়েছি। তবু, সে অপকর্মের জন্য আজ অনুতাপ হচ্ছে।… এ অবস্থার সত্বর অবসানই কামনা করি। তুমি দ্রুত যুদ্ধের আয়োজন করো, গাণ্ডীবীকে আমার সম্মুখে আনয়ন করো—এ হতভাগ্য জীবনের অবসান হোক। শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও যে সে পরিচয় দিতে পারল না, জন্মের মুহূর্ত থেকে যে মাতৃস্নেহ ও মাতৃস্তনে বঞ্চিত হ’ল–সহোদরদের প্রতি সহজ স্নেহ যার অন্তরে বিকৃত রসে জারিত হয়ে বিদ্বেষে ও অসূয়ায় রূপান্তরিত হ’ল—জীবনের যে একমাত্র তৃপ্তি এতদিন লক্ষ্য ছিল, আশায় সঞ্জীবিত রেখেছিল মনকে—পাণ্ডবদের পরাজয়—সে লক্ষ্যও আর রইল না। সামান্য ও অজ্ঞাত এক জন্মকাহিনী তা বিনষ্ট ক’রে দিয়ে জীবনকে লক্ষ্যহীন আশাহীন গ্লানিযুক্ত ক’রে দিল কয়েকটি নিমেষকাল মধ্যে। এ জীবনে শত ধিক!’

বাসুদেব বললেন, ‘কিন্তু তুমি যত সহজে এ যুদ্ধের ফলাফল নির্ণয় করছ, নিশ্চিত হচ্ছ—আমি তো তত সহজে সে ফল লাভের আশা দেখি না। দুই জামদগ্ন্যশিষ্য—অপরাজেয় ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম ও মহাপরাক্রান্ত মহেন্দ্রত্রাস কর্ণ যেদিকে যুদ্ধ করবেন, দ্রোণাচার্য তো আছেনই, সে পক্ষের পরাজিত বা বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা কোথায়? তুমি যদি ঐ পক্ষেই থাকো, সত্য রক্ষার জন্য, বীরধর্ম ক্ষাত্রধর্ম পালনের জন্য যুদ্ধ তো করতেই হবে!’

কর্ণ ভ্রূ কুঞ্চিত ক’রে কিছুকাল স্থির দৃষ্টিতে বাসুদেবের আপাতভাবলেশহীন দৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলেন, বোধ করি এই উচ্চারিত শব্দগুলির পিছনে অনুচ্চারিত অপ্রকাশিত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য। ক্রমে ক্রমে এক বিচিত্র রহস্যপূর্ণ হাস্যরেখা তাঁর অধরোষ্ঠে সঞ্চারিত হ’ল, বার বার অকারণে বিনা অপরাধে অদৃষ্টের কাছে প্রহৃত হলে যে নিরুপায় বিষণ্ণ-কৌতুকের হাস্য দেখা দেয় মানুষের মুখে—তেমনই। তিনি বললেন, ‘ভীষ্মের পতন না হলে আমি কৌরবপক্ষে যোগ দেবো না, তুমি নিশ্চিত থাকো।’

‘কিন্তু—’, বাসুদেবও বোধ করি বিস্মিত বোধ না করে পারেন না, ‘দুর্যোধনকে এ অদ্ভুত ব্যবহারের কী কারণ দেখাবে? তিনি দুঃখিত, অপ্রীত হবেন না?’

‘পিতামহ ভীষ্ম—আজ অকুণ্ঠ চিত্তেই তাঁকে পিতামহ বলছি, আমাকে রথী বলেই স্বীকার করেন না, সর্বদা ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ ও কটু-কাটব্য করেন—তাঁর সৈনাপত্যে অধীনস্থ যোদ্ধারূপে সংগ্রাম না করার সে-ই তো যথেষ্ট কারণ। ‘ এই বলে আবারও একটু ক্লান্ত ক্ষীণ হাস্য করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ কর্ণর দুখানি হাত করাবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘ভ্রাত কর্ণ, আমি তোমাকে পৃথিবীর সাম্রাজ্য দিতে চাইলাম, তুমি অনায়াসে তা সামান্য প্রস্তরখণ্ডের মতো ত্যাগ করলে!’

এতক্ষণ পরে এই প্রথম কর্ণের কণ্ঠ অকস্মাৎ বিষতিক্ত হয়ে উঠল। বললেন, ‘তুমি আমাকে যে রাজ্য দিতে চাইছ, প্রধানত যার লোভ দেখাচ্ছ, সে রাজ্য ন্যায়ত ধর্মত আমারই—এই মাত্র তুমিই সে সংবাদ দিয়েছ। আজ তা তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে কেন? সে প্রাপ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন কে–না শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর সংসারে নবজাতকের যে সর্বাপেক্ষা সহায়, বন্ধু— একান্ত কল্যাণকামী সেই মা, জন্মদাত্রী। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৃপতিকুলে জন্মে সারথিপুত্র বলে পরিচিত হলাম গৃহরক্ষক প্রহরারত সারমেয়কে যেমন গৃহকর্তা মাংসখণ্ড দেয় তেমনই এক রাজ্যখণ্ড দিয়ে দুর্যোধন আমাকে তাঁর রাজ্যরক্ষক ভৃত্য হিসাবে চিরঅধীনতাবদ্ধ করলেন। আজ যে রমণীরত্নের প্রলোভন দেখাচ্ছ—পণমূল্যে বহুপূর্বেই সে নারীর আমার অঙ্কশায়িনী হওয়ার কথা। আমার ভাগ্যে হোমাগ্নিসম্ভবা রাজকন্যা ক্ষত্রিয়কুমারীও শর্তভঙ্গ করলেন। শস্ত্রগুরু পরশুরামের ক্লেশ নিবারণের জন্য অসহ্য কষ্ট সহ্য করলাম—তার বিনিময়ে তিনি অভিসম্পাত* দিলেন, কষ্টার্জিত বহুদিনের সাধনালব্ধ অস্ত্রসকল সর্বাপেক্ষা সংকটকালে বিস্মৃত হবো! এমন ভাগ্যহত চিরবঞ্চিত কাউকে দেখেছ আর? তারপরও আমাকে রাজ্য গ্রহণ করতে বলো? না ভাই, আমার সাহস হয় না। ভাগ্যের আর এক বঞ্চনার কঠোরতর আঘাত আর না-ই বা মাথা পেতে নিলাম।’

[* কর্ণ সূতপুত্র হয়েও জামদগ্ন্যগোত্রীয় বলে পরিচয় দিয়ে শস্ত্রশিক্ষা করতে গিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ছাড়া পরশুরাম কাকেও শিক্ষা দিতেন না। কিন্তু গুরুর গোত্র নিজগোত্র বলে পরিচয় দেওয়া রীতি দীর্ঘদিনের, সেই রীতি অনুযায়ীই কর্ণ নিজের ঐ পরিচয় দিয়েছিলেন। একদা কর্ণর ঊরুতে মস্তক রক্ষা ক’রে গুরু ভার্গব সুষুপ্ত ছিলেন, এমন সময় এক বজ্রকীট কর্ণকে দংশন করতে শুরু করে। অসহ্য কষ্ট সত্বেও কর্ণ তাকে বধ করার চেষ্টা করেন নি পাছে গুরুর নিদ্রার ব্যাঘাত হয়, শেষে ওঁর রক্তধারা প্রবাহিত হয়ে ভার্গবকে স্পর্শ করলে নিদ্রোত্থিত পরশুরাম এক বজ্রকীট কর্ণর চর্ম ভেদ ক’রে মাংসখণ্ড ভক্ষণ করছে দেখে বললেন, ‘কোনও ব্রাহ্মণের পক্ষে এই কষ্ট সহ্য করা সম্ভব নয়, তুমি সত্য ক’রে বলো তুমি কোন জাতীয়?’ তখন কর্ণ সত্য কথা বলাতেই পরশুরাম ঐ অভিশাপ দিয়েছিলেন।]

বাসুদেব ধীরে ধীরে, একটা বহুক্ষণের রুদ্ধ দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন ক’রে বললেন, ‘পরশুরামের এ অভিসম্পাত মহাসংকট বা অন্তিমকালের জন্য। কিন্তু সহজাত কবচকুণ্ডলধারী মহাবীরের সে সংকটকাল এত শীঘ্র আসন্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। জয়লাভ করার কথা স্বতন্ত্র কিন্তু ঐ দুটি বস্তু তোমার অঙ্গে থাকতে তোমার নিহত হওয়ার কোন প্রশ্নই তো উঠছে না। আর যতক্ষণ তুমি জীবিত থাকছ ততক্ষণ তোমাকে পরাজিত করার সম্ভাবনা কোথায়?’

এবার কর্ণ সহসাই— বোধ করি বাসুদেবকেও সচকিত করে—হা হা রবে উচ্চহাস্য ক’রে উঠলেন। তারপর সেই সকৌতুক হাস্যপ্রতিফলিত দৃষ্টিই বাসুদেবের দুই বিশাল রহস্যময় নয়নে স্থির-নিবদ্ধ ক’রে উত্তর দিলেন, ‘আমার জীবনযাত্রার সঙ্গে যাদের কিছুমাত্র পরিচয় আছে তারাই জানে—গঙ্গা বা অপর কোন নদী কি তীর্থে স্নান ক’রে উঠে যখন আমি ইষ্টবন্দনা করি তখন যে কোন প্রার্থী যে কোন দ্রব্যই যাচঞা করুক—আমি তাকে তৎক্ষণাৎ তা দান করি, নিজের ইষ্টানিষ্ট ভবিষ্যৎ চিন্তা না ক’রেই। স্বকৃত এ নিয়মে বদ্ধ আমি বহুকালাবধি। সুতরাং আমাকে সহজাত কবচকুণ্ডলহীন করা আদৌ কোন কঠিন কর্ম নয়। না, অস্ত্র যদি স্মরণে না আসে তাহলে ধনঞ্জয়ের মতো মহাবীরের কাছে পরাজিত বা নিহত হওয়া নিমেষকালের ঘটনা মাত্র।’

শ্রীকৃষ্ণ যেন ঈষৎ অপ্রতিভভাবেই চক্ষু আনত করেছিলেন, এখন আবারও অঙ্গাধিপতির দুটি হাত চেপে ধরে বললেন, ‘কর্ণ তুমি ধন্য। তুমি মহান, লোকোত্তর পুরুষ এ কথা বহুবিদিত, বহুলপ্রচারিত। আজ তার সত্যতা প্রত্যক্ষ করে সত্যই নিজেকে কৃতার্থ মনে করছি। বিধাতা তোমাকে রাজচক্রবর্তী হওয়ার মতো সমস্ত গুণ ও মানসিক গঠন দিয়েই পাঠিয়েছিলেন, কেবল সে ভাগ্যটা দেন নি। তোমার দেশবাসীরই দুর্ভাগ্য, তোমার এই বিপুল শক্তি তাদের কল্যাণকর্মে নিয়োজিত হ’ল না। সমধিক দুর্ভাগ্য অর্জুনের— তোমার মতো জ্যেষ্ঠাগ্রজের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে–হয়ত বা নিহত করতেও হবে।’

‘ও কথা থাক বাসুদেব। বিধাতা আমাকে চিরবঞ্চিত ক’রেই পাঠিয়েছেন যখন–তখন মহৎ গুণগুলো অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক নয় কি? অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। সান্ত্বনা এই–এ রহস্য হয়ত অনাবরিতই থাকবে চিরদিন, লোকের করুণার পাত্র হতে হবে না—অন্তত আমি জীবিত থাকতে। তবে আজ আমিও তোমার যথার্থ পরিচয় লাভ করে কৃতার্থ হলাম। কেউ কেউ বলে তুমি ঈশ্বরের অবতার, বিশ্বমানবের মুক্তিদাতা কেউ বলে তুমি উৎপীড়িতের বঞ্চিতের পরিত্রাতারূপেই জন্মগ্রহণ করেছ! আমি দেখলাম তুমি আমারই মুক্তিদাতা, এই জন্ম, এ জীবনের—জীবিত থাকার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে, বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতে এসেছ, সেই মুক্তির পথই দেখিয়ে গেলে। ধন্য, ধন্য!’

এরপর দুজনেই দীর্ঘক্ষণ, বোধ করি অর্ধদণ্ডের অধিককাল নিস্তব্ধ স্থির হয়ে বসে রইলেন। দুজনেই সমাহিত‍ আত্মচিন্তামগ্ন। শেষে এক সময় যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কর্ণ বললেন, ‘তাহলে এবার আমাকে বিদায় দাও।’

তিক্ত কর্তব্য পালনের পর সামান্য একটু বিষাদের সুর বাজে কি? বাসুদেব আবারও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বিদায়! হ্যাঁ ভাই, বাইরেই বিদায় দিলাম, আমার অন্তরে তুমি যে চিরদিনের মতো প্রবেশ করলে, তার প্রস্থান বা বিদায় নেই।… যাও বীর, তোমার কীর্তির পথে।’… তার পর-মুহূর্তেই বাস্তবে ফিরে আসেন, দূরে তাকিয়ে বলেন, ‘তোমার রথ এখানে প্রেরণ করার নির্দেশ দিয়ে এসেছিলাম, দেখছি ইতিমধ্যেই তা পৌঁছে গেছে।

কর্ণ পুনশ্চ বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ওঁর রথ থেকে অবতরণ করলে বললেন, ‘অঙ্গাধিপতি, তুমি কৌরব সভায় প্রত্যাবর্তন ক’রে পিতামহ ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতিকে বলবে যে যুদ্ধের পক্ষে এই মাসই সর্বোত্তম। এখন তৃণ সুলভ অথচ ইন্ধনও দুষ্প্রাপ্য নয়। ওষধি ও বনবৃক্ষ সকল সতেজ, বৃক্ষগুলি ফলবান, মক্ষিকা বিনষ্ট, নদী বা তড়াগের সলিল নির্মল

এবং সুস্বাদু হয়েছে। এই মাস নাতিশীতোষ্ণ, আহতদের পক্ষে নিদাঘকালের উষ্ণতা অধিকতর যন্ত্রণার কারণ। আজ থেকে সপ্ত দিবস পরে অমাবস্যা, স্বয়ং ইন্দ্র এই তিথির অধীশ্বর, অতএব সেই দিনেই সংগ্রাম সামগ্রী ইত্যাদি সংগ্রহ ও সুসজ্জিত করুন। যে সকল রাজা দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন তাঁদের বলো যে পাণ্ডবরাই যে এ যুদ্ধে জয়লাভ করবেন সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই বিশ্বকর্মানির্মিত মায়াময় রথে বানরকেতু নামে ধনঞ্জয়ের অত্যুগ্র জয়ধ্বজা উত্থিত হয়েছে। যখন সেই রথে কৃষ্ণকে সারথি ক’রে তিনি কৃতান্তপ্রেরিত মৃত্যু-দূতবৎ দিব্য অস্ত্র সকল ত্যাগ করবেন যখন মহাবল ভীমসেন প্রতিমাতঙ্গঘাতী মত্তমাতঙ্গের ন্যায় দুঃশাসনের রুধির পান ক’রে রণক্ষেত্রে নৃত্য করবেন যখন দেখবে আচার্য দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম কৃপ দুর্যোধন প্রভৃতি একে একে অজেয় সব্যসাচী, আদিত্যতুল্য তেজস্বী ধর্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির ভীম নকুল সহদেব প্রভৃতির দ্বারা পরাজিত ও নিহত হচ্ছেন—তখন কি সত্য কি ত্রেতা কি দ্বাপর কোন যুগই থাকবে না —সেই মহাযুগান্তরের মুহূর্তে কেশব তোমাদের অভিলাষ পূর্ণ করবেন, পাণ্ডবদের শস্ত্রদ্বারা নিহত হয়ে অক্ষয় স্বর্গলাভ করবে।’

কর্ণ বললেন, ‘আমি তাদের আরও বলতে পারব। এই যে পৃথিবীর প্রলয় দশা উপস্থিত হয়েছে—দুর্যোধন দুঃশাসন বা শকুনিই শুধু নন, তার জন্য আমিও দায়ী। পাণ্ডব-কৌরবদের এই ভয়াবহ সংগ্রামে ভারতভূমি রুধিরে কর্দমাক্ত হবে, দুর্যোধন পক্ষীয় রাজা ও রাজপুত্রগণ, একাদশ অক্ষৌহিণী যোদ্ধা সকলেই নিহত হবেন। চারিদিকেই দুঃস্বপ্ন, ঘোর দুর্নিমিত্ত, লোমহর্ষক উৎপাত সকলের বিবরণ শুনছি—তা দুর্যোধনের পরাজয় ও তৎপক্ষীয়গণের সম্পূর্ণ বিনষ্টিরই সূচনা করছে। শনি রোহিণী নক্ষত্রে এসেছেন, মঙ্গল জ্যেষ্ঠায় বক্র হয়ে অনুরাধাকে কামনা করছেন, রাহুগ্রহ চিত্রাকে বিশেষরূপে পীড়িত করছেন চতুর্দিকে উলকাপাত হচ্ছে, মাতঙ্গগণ সভয় গর্জন ও অশ্বগণ খাদ্যবিমুখ হয়ে অশ্রুপাত করছে, ময়ূর হংস সারস চাতক চকোর প্রভৃতি পবিত্র পক্ষীরা পাণ্ডবদের এবং–গৃধ্র, বক, শ্যেন, বৃক ও মক্ষিকুল কৌরবদের শিবিরে অবলম্বন করেছে। এ সকল লক্ষণই অসংখ্য প্রাণীবিনাশ ও মহাভয়ের পূর্বাভাস। আমি স্বপ্নে দেখেছি পৃথিবী রুধিরে কর্দমাক্ত, কৃষ্ণগ্রীব রক্তপদ শকুনরা মেঘের মতো আকাশ আচ্ছন্ন করেছে তারই মধ্যে যুধিষ্ঠির অস্থিপর্বতে আরোহণ ক’রে প্রফুল্লচিত্তে উত্তমপাত্রে ঘৃত পায়স ভোজন করছেন। বাসুদেব তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে— একথা আমি তাদের বলব।’

বাসুদেব উপপ্লব্য যাত্রাকালে অঙ্গাধিপতি মহাবীর কর্ণকে তাঁর রথে তুলে হস্তিনাপুরীর নগর সীমা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন, কোন তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে উভয়ের নিভৃত আলোচনাও হয়েছে কিছু—ধর্মাত্মা বিদুরের মুখে এ সংবাদ পাওয়ার পর থেকে জননী কুন্তী কয়েকদিন আশা ও আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে রইলেন।

শ্রীকৃষ্ণ যে পিতৃসার কানীন-পুত্র-রহস্য অবগত আছেন, সেটা তাঁর আচার-ব্যবহার ও বাক্যের ইঙ্গিত থেকে কুন্তী পূর্বেই অনুমান করেছিলেন। বস্তুত ওঁর এই ভ্রাতুষ্পুত্রটির সঙ্গে আলোচনা ক’রে মনে হয়েছে বিশ্বের কোন সংবাদই তাঁর অজ্ঞাত নয়। তিনি সর্বজ্ঞ মানুষের—বিশেষ পরিচিত ব্যক্তিদের মনের কুটিলতম তথা জটিলতম পথে তাঁর অভিজ্ঞতার ও বুদ্ধির অনায়াস গতিবিধি। সুতরাং এ আলোচনা যে কর্ণকে তাঁর জন্মাধিকারের সংবাদ জ্ঞাত করিয়ে কৌরবপক্ষ ত্যাগ ও পাণ্ডবগণ বরণ করানোরই উদ্দেশ্যে তাও অনুমান করতে বিলম্ব হয় নি। আশা সেই জন্যই— আশঙ্কা কর্ণ যদি সম্মত না হন।

কিন্তু তারপরও তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। তেমন চমকপ্রদ কোন সংবাদই দিতে পারেন নি বিদুর। বরং সমরায়োজনই দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে— সে আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণতার পথে—এই সংবাদই অহরহ পাচ্ছেন কুন্তী বিদুরের নিকট হতে তো বটেই, দাসদাসী পরিজন প্রতিবেশী সকলের মুখ থেকেই শুনছেন।

ফলে আশা অন্তর্হিত হতে থাকে, আশঙ্কাই প্ৰবল হয়।

উদ্বেগের সীমা থাকে না। আর বিন্দুমাত্র কালহরণ করা উচিত নয়। এ তাঁরই সর্বনাশের প্রশ্ন। এই বিশ্বনাশা আহবে কখনও না কখনও কর্ণ ও অর্জুন দ্বৈরথ সমরে প্রবৃত্ত হবেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই বিশ্ববিজয়ী বীর রণক্ষেত্রে পরস্পরের সম্মুখীন হলে একজনের মৃত্যু অনিবার্য। যিনিই নিহত হোন, কুন্তীরই এক পুত্র বিনষ্ট হবে।

যতই সে-সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেন ততই বুকের মধ্যে অব্যক্ত অনভিজ্ঞাত একটা যন্ত্রণা হতে থাকে। মর্মন্তুদ শব্দটার সম্যক অর্থ এতদিন পরে বুঝতে পারেন চিরদুঃখিনী কুন্তী। অথচ এ অবস্থায় প্রতিকার কী তাও ভেবে পান না। শ্রীকৃষ্ণের কাছে দূত পাঠিয়ে সংবাদ আনতে গেলে বৃথা আরও দুটো দিন অতিবাহিত হবে। সে অবসর আর নেই। যা করতে হবে—এখনই, অনতিবিলম্বে।… শেষে কোন মতেই স্থির বা নিষ্ক্রিয় থাকতে না পেরে সংকল্প করলেন তিনিই একবার শেষ চেষ্টা ক’রে দেখবেন।

কি ভাবে করবেন তাও স্থির করলেন।

সকলেই বলে দিবসের দ্বিতীয় প্রহরে স্নানান্তে কর্ণ যখন আপন ইষ্ট সূর্যের বন্দনা করেন, তখন পরিচিত অপরিচিত যে-কোন প্রার্থী যে-কোন যাচঞা জানাক—কর্ণ তৎক্ষণাৎ তা পূরণ করেন, কখনও বিমুখ করেন না। কিম্বদন্তী, এইভাবে একদা নিজের পুত্রকেও নিশ্চিন্ত মৃত্যুমুখে সমর্পণ করতে গিয়েছিলেন।

এই সুযোগই নেবেন তিনি—এই পুণ্য অবসরের।

.

কুন্তী প্রত্যুষেই যমুনাভিমুখে যাত্রা করলেন। সে-কথা কাউকেই জানালেন না, এমন কি বিদুরকেও না। অবশ্য বিদুর হয়ত অনুমান করতে পারবেন এই গোপন যাত্রার কারণ—তবে তাতে কোন ক্ষতি হবে না।

একাকী অবগুণ্ঠনবতী হয়ে পদব্রজেই যাত্রা করেছিলেন কুন্তী। এই অসহায়, লজ্জাজনক দীনতার কথা কেউ না জানতে পারে—কোন বিদ্রুপোদ্দীপক ও কলঙ্কমূলক সংবাদ প্রচারের জন্য একটি লোকের কর্ণগোচর হওয়াই যথেষ্ট— এই কারণেই রথ কি শিবিকা গ্রহণ করেন নি, সঙ্গে কোন দাসী, সেবিকা বা ছত্রধারিণীও নয়। ক্লেশের সীমা পরিসীমা রইল না, কিন্তু কুন্তীও যে অনন্যোপায়। অনভ্যস্ত পদ, দীর্ঘ পথ—প্রশ্ন ক’রে ক’রে লক্ষ্যস্থান নির্ণয় করা—এ সমস্তই এমন কি স্বল্পবয়স্কের পক্ষেও কষ্টকর অভিজ্ঞতা। কর্ণ একটু নির্জনেই যেতেন স্নান করতে, যাতে অবাঞ্ছনীয় ব্যক্তির উপস্থিতি কি কোলাহলে জপ বা উপাসনায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে। সুতরাং সে-স্থানটির অবস্থান সম্বন্ধে সঠিক সংবাদ খুব অল্প লোকই জানে। ফলে অভুক্ত পরিশ্রান্ত অবসন্নপ্রায় কুন্তী যখন সে-স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন তখন দ্বিপ্রহরের সূর্য সরল রেখায় মাথার উপরে পৌঁছেছেন।

কর্ণ তখনও সূর্য-বন্দনায় নিবিষ্ট। ঊর্ধ্বমুখে একমনে ইষ্টমন্ত্র জপ করছেন, মধ্যে মধ্যে ধ্যানমগ্নও থাকছেন কিছুকাল ক’রে। নিশ্চল স্থির ভাবে দণ্ডায়মান কর্ণের ওষ্ঠ কম্পিত হচ্ছে কিনা তা নির্ণয় করাও কঠিন। চারিদিকে ধূ ধূ করছে বালুময় নদীতট-ভূমি, কোথাও কোন জনপ্রাণী নেই। শুধু মৃদুমন্দ বাতাসে কর্ণের অঙ্গ-সংলগ্ন উত্তরীয় কাঁপছে—বস্তুত জীবনের লক্ষণ বলতে যেন ওইটুকুই।

বহুদিন কোনপ্রকার দৈহিক ক্লেশে অনভ্যস্তা জননী কুন্তী পদব্রজে এই দীর্ঘপথ অতিক্রম ক’রে এসে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছেন প্রায় তদুপরি মাথার উপরে শরতের প্রখর রৌদ্র। নিকটে কোথাও পাদপাদিও নেই। মেঘাচ্ছন্ন দিন ছাড়া কৰ্ণ সূর্যতাপেই তপস্যা করেন চিরদিন— সেই কারণেই তপস্যার সময় বৃক্ষতল বা ছায়াস্নিগ্ধ স্থান পরিহার ক’রে চলেন। অথচ কুন্তীরও তখন একটু ছায়া একান্ত প্রয়োজন। অগত্যা তিনি আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ঠিক পিছনে এসে কর্ণের উত্তরীয়- অন্তরালই অবলম্বন করলেন।

.

দীর্ঘ সময় লাগল সেদিন কর্ণের ইষ্ট-আরাধনা সমাপ্ত হতে। প্রভাতেই এক অনাশঙ্কিত বিঘ্ন ঘটেছে, মন অপ্রসন্ন হয়ে আছে তখন থেকেই। সে বিরক্ত প্রশান্তিহীন মন সংযত ক’রে ইষ্টের ধ্যান সন্নিবিষ্ট করতে অনেক সময় লেগেছে

নদীতীরে পৌঁছে স্নান করতে নামবেন এমন সময় বীভৎস-দর্শন সর্বাঙ্গমললিপ্ত মদিরামত্ত এক নিষাদ এসে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। দেখলেই মন ঘৃণায় বিমুখ হয়ে ওঠে এমন তার আকৃতি। বোধ হয় কত কাল স্নান করে নি, এমন কি মুখও প্রক্ষালন করেনি লোকটি। কেশ ধূলিধূসর জটাবদ্ধ, সর্বাঙ্গের ক্লেদাবরণ বহুদিনের সঞ্চয়ে এমন আকার ধারণ করেছে যে লৌহ-অস্ত্র ছাড়া অপসারিত করা সম্ভব নয়।

দেখা মাত্র মন অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। একটু রূঢ় কণ্ঠেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কী চাই এখানে?’

লোকটা সুরারক্ত দুই চক্ষু ওঁর মুখে নিবদ্ধ রেখে মুখের বিচিত্র ভঙ্গী করে উত্তর দিয়েছিল, ‘না, কিছু চাইতে আসি নি বরং নিষেধ করতেই এসেছি—চাওয়া মাত্র দান করার অভ্যাসটা ত্যাগ করার কথা বলতে। শুনেছি খুব দাতা তুমি, যে যা চায় নিজের কোন সুবিধা-অসুবিধা না বুঝেই তাই দাও। কথাটা শুনে তোমার উপর মায়া হ’ল, তাই গরজ ক’রে সাবধান করতে এলাম…খুব ষড় হচ্ছে, এক ব্রাহ্মণ এসে তোমার কাছে ভিক্ষে চাইবে,—কী তোমার গায়ে আছে, চামড়ার সঙ্গে জড়ানো—যা থাকলে কেউ তোমাকে মারতে পারবে না— সেই বস্তু। অমন সবাইকে আগে থাকতে কথা দিও না, হ্যাঁ–যে, যা চাইবে তাই দেব।’

‘তুমি কেমন ক’রে জানলে ষড় হচ্ছে?’

অপ্রসন্নতা কিছু বিদূরিত হয়ে সে-স্থলে প্রবল কৌতূহলের উদয় হয়েছে।

‘আমিই যে সে লোক স্থির ক’রে দিয়েছি—যে ব্রাহ্মণ ভিক্ষার নাম ক’রে তোমার ওই পদার্থ দুটো অপহরণ করবে। তাকে অনেক অর্থ দেবেন একজন—সুবর্ণ দেবেন।

এবার একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল কর্ণের মুখে, ভাগ্যহতর হাসি, তিক্ত-করুণ। একটু বুঝি গর্বও বোধ হয়েছিল মুহূর্তকালের জন্য। ওধারের শিবিরে যা কিছু দুশ্চিন্তা তা হলে ওঁকে নিয়েই! যে-প্রাণটা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র মমতা নেই ওঁর— সেই প্রাণ হরণের জন্য কী গভীর ষড়যন্ত্রই না চলেছে!

ক্ষণেকের এ মনোভাব হৃদয়োত্থান মাত্রই বোধ করি বিলীন হয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলেছেন নিষাদকে, ‘তুমি কে জানি না, তথাপি বলছি, জেনে রাখো, সহজাত কবচকুণ্ডল কেন, ইহজগতে যা কিছু মানুষের প্রিয়বস্তু বা ব্যক্তি আছে— স্ত্রী পুত্র কন্যা পৌত্র দৌহিত্র, রাজ্য, ঐশ্বর্য,–এই প্রাণ–কিছুর জন্যই কর্ণ প্রতিজ্ঞা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। ইষ্ট- বন্দনার সময় কোন প্রার্থীকে বিমুখ করতে পারব না। তুমি আমার কল্যাণকামনায় এসেছ, তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, তুমি এখন যেতে পারো।’

অতঃপর নিষাদ কী সব বিদ্রুপাত্মক কটূক্তি করতে করতে চলে গিয়েছিল—তিনি নির্বোধ, বৃথাগবী ইত্যাদি ইত্যাদি সেদিকে কান না দিয়েই কর্ণ দ্রুত নদীতে অবতরণ করেছিলেন, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ধরে অবগাহন-স্নান ক’রেও মনের গ্লানি ও তিক্ততা দূর হয় নি। মন ও মস্তিষ্কে শান্ত পরিবেশ অর্থাৎ তদগতচিত্ততার সৃষ্টি না হলে সেখানে ইষ্টদেবতাকে আনয়ন করা সম্ভব হয় না।

.

সূর্যদেব শিখরবিন্দু অতিক্রম ক’রে পশ্চিমাভিমুখী হওয়ারও বহুক্ষণ পরে কর্ণ অতৃপ্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চক্ষু উন্মীলিত করলেন। দৃষ্টি বাষ্পাচ্ছন্ন, ললাটে অসীম বেদনার ছায়া। বোধ করি নিজের অন্তরের বেদনা ও বিক্ষোভই এতক্ষণ ধরে নিবেদন করছিলেন ইষ্টের কাছে—ক্ষমাপ্রার্থনাও সেই সঙ্গে, অস্থিরচিত্ততার জন্য বাহ্যজ্ঞান ছিল না তাই।

কিন্তু, এবার, পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া মাত্র, অবহিত হলেন—এখন এই মুহূর্তে তিনি একা নন, তাঁর অতি নিকটে অপর কেউ এসেছে বা প্রতীক্ষা করছে।

সচকিত হয়ে ফিরে দাঁড়াতেই অবগুণ্ঠনবতী কুন্তীকে দেখতে পেলেন।

বিস্ময়ের পরিসীমা রইল না। মুখাবয়ব দৃষ্টিগোচর না হলেও—ইনি যে কোন সম্ভ্রান্তবংশীয় মহিলা সে সম্বন্ধে তিলার্ধ সন্দেহ রইল না। এই নদীতীরে—যেখান থেকে চারিদিকে অর্ধক্রোশচক্রের মধ্যে কোন জনপদ নেই— সেখানে ইনি একা এলেন কি ক’রে? কি ভাবেই বা এলেন? কোন শিবিকা কি রথের তো চিহ্ন নেই কোথাও।

প্রথমটা বিস্ময়ে হতবাকই হয়ে গিয়েছিলেন, এখন—রাজোচিত মনোবলে, দীর্ঘদিন মানসিক আবেগ আবরিত রাখার অভ্যাসেও, অচিরে আত্মসম্বরণ ক’রে নিলেন, মহিলার সম্মুখে প্রায় আভূমি নত নমস্কার ক’রে করজোড়ে বললেন, ‘দেবী, আপনি কে, কী উদ্দেশ্যে আপনার আগমন—প্রশ্ন করতে পারি কি? এই জনহীন প্রান্তরে একা কী জন্য অপেক্ষা করছেন? এখানে তো দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই। আমার কাছেই কি কোন প্রার্থনা আছে? থাকলে নিঃসঙ্কোচে আদেশ করুন আপনার কোন প্রিয়কার্য সম্পাদন করতে পারি। আমি জননী রাধা ও সূতশ্রেষ্ঠ অধিরথের আত্মজ, কৰ্ণ।’

কুন্তী এবার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করলেন।

পূর্বের বিস্ময়ই যথেষ্ট বোধ হয়েছিল, এখন মনে হ’ল সেটা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কর্ণ তড়িতাহতের মতোই চমকিত হয়ে যেন কতকটা নিজের অজ্ঞাতসারে দুই পাদ পিছিয়ে গেলেন, অস্ফুটকণ্ঠে শুধু উচ্চারণ করলেন, ‘পাণ্ডবজননী!’

কুন্তী পথশ্রমে তখন অবসন্ন স্বেদাম্বুশোভিত তাঁর কপোলে ললাটে উদ্বেগ, শারীরিক ক্লেশ ও পুত্রদর্শনজনিত আবেগে মূহুর্মুহু বর্ণান্তর ঘটছে—তৎসত্বেও অনভ্যস্ত ক্লান্তির কালিমাই তাতে প্রধান। বেশ কয়েক নিমেষকাল সময় লাগল তাঁর কণ্ঠ ভেদ ক’রে স্বর নির্গত হতে। ওষ্ঠ দুটি বার বার কম্পিত হলেও তারা তখনও কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। কিন্তু—অবশেষে অতিকষ্টে যখন উত্তর দিলেন, তখন সমস্ত সঙ্কোচ ও দ্বিধা পরিহার করতে পেরেছেন, বললেন, ‘বৎস, আমি তোমারও জননী। তুমি রাধেয় নও, কৌন্তেয়। তুমিই আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান। অল্প বয়সের অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা, অপরিণামদর্শিতা ও কৌতূহলের ফলে, ক্ষণিকের চাপল্যে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলাম। অল্প বয়স বলেই বিবেচনা-বুদ্ধি বা মনের দৃঢ়তা ছিল না, তোমার জন্মের পর তাই লোকলজ্জায় ও সমাজে অপাংক্তেয় পতিত হবার আশঙ্কায় তোমাকে এক মৃৎপাত্রে স্থাপিত করে নদী-জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। মহাপ্রাণ অধিরথ সেই অবস্থায় তোমাকে উদ্ধার ক’রে গৃহে নিয়ে যান ও লালন করেন। তিনি ধন্য, কিন্তু তথাপি তিনি তোমার পিতৃত্ব দাবি করতে পারেন না। বৎস, তুমি এবার তোমার জন্মগত অধিকার—পাণ্ডবপক্ষের সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ ক’রে এই সসাগরা ধরা শাসন করো—এই আমার প্রার্থনা। শুনেছি তুমি ধার্মিক ও ধর্মতত্বজ্ঞ আমি তোমার গর্ভধারিণী, আমার বাক্য রক্ষা করাই তোমার ধর্ম। তুমি সিংহাসনে উপবেশন করো, মহাত্মা যুধিষ্ঠির ও আমার অবশিষ্ট চারপুত্র সানন্দে সশ্রদ্ধচিত্তে তোমার সেবা করে ধন্য হোন।’

কুন্তীর বাক্যাবলী শ্রবণ করতে করতেই কর্ণর মুখভাব কঠিন হয়ে উঠেছিল। তিনি এবার বিরস ও নিস্পৃহ কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘ক্ষত্রিয়ে, আপনি ধর্মের কথা উচ্চারণ না করলেই ভালো করতেন। আপনি গর্ভধারিণী হতে পারেন কিন্তু কোনক্রমেই জননীর প্রাপ্য মর্যাদা দাবি করতে পারেন না। আপনি ক্ষত্রিয়-কন্যা, রাজবংশসম্ভূতা—কিন্তু আপনি আমার যে অনিষ্ট করেছেন এমন কোন নীচকুলোদ্ভবা অনার্য নারীও কখনও করে না। আপনি নিজের অসুবিধা দূরীকরণের জন্য আমার মৃত্যুর প্রত্যাশাতেই আপনার সদ্যোজাত অসহায় অজ্ঞান প্রথম সন্তানকে নদীগর্ভে ত্যাগ করেছিলেন— সে বিচারে আপনার সে পুত্র মৃত। যিনি সেই অনিবার্য মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছেন সেই প্রাণদাতা অধিরথই ধর্মত আমার পিতা। এ আমার নবজন্ম, এর উপর আপনার কোন দাবি নেই।’

ক্রোধে, ক্ষোভে, দীর্ঘকালের পুঞ্জীভূত বেদনা, অপমান ও লাঞ্ছনার কারণ এই নারীকে সম্মুখে দেখে কর্ণের কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে এসেছিল, কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে নিজেকে সম্বরণ ক’রে নিয়ে পুনশ্চ বললেন, ‘আপনি আজ আমাকে বলছেন পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ হিসাবে পাণ্ডবদের সিংহাসনে অধিরোহণ করতে, কিন্তু সে পথও আপনিই নষ্ট করেন নি কি? ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ ক’রেও ক্ষত্রিয়ের কোন সংস্কার শিক্ষাদীক্ষা লাভ করি নি, সে জাতির রীতি-নীতি কিছুই জানি না—সে অবস্থায় ভারতের অগ্রগণ্য ক্ষত্রিয় রাজবংশের সিংহাসন গ্রহণ করতে গেলে জনসমাজে, প্রজাদের কাছে হাস্যাস্পদ হবো না কি? পরন্তু যে দুর্যোধন আমাকে নগণ্য সূত সমাজ থেকে তুলে রাজমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যিনি এতকাল স্নেহে সৌজন্যে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধায় লালন করেছেন, যিনি বিশ্বস্ত বন্ধুর প্রাপ্য সম্মান প্রদানে কখনও কুণ্ঠিত হন নি, যিনি প্রধানত আমার উপর নির্ভর ক’রেই এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছেন—এই আপৎকালে তাঁকে ত্যাগ করলে কোন ধর্ম আমার বজায় থাকবে বলতে পারেন?

‘তদ্ব্যতীত, এই অন্তিম সময়ে কুরুপক্ষ ত্যাগ ক’রে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলে সমস্ত ক্ষত্রিয় সমাজে ধিকৃত হবো না কি? অর্জুনের বীরখ্যাতি আজ সর্বজন প্রসিদ্ধ, অনেকেরই বিশ্বাস তিনি অপরাজেয়—সুতরাং সকলেই মনে করবেন তাঁর হস্তে পরাভূত, লাঞ্ছিত ও নিহত হওয়ার আশঙ্কাতেই আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছি, হয়ত বা অনুনয় ক’রেই। এতে বীরের ধর্ম থেকে পতিত হতে হবে। অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে শক্তি পরীক্ষা আমার আকৈশোর স্বপ্ন, এ ক্ষেত্রে মাথা নত ক’রে তাঁর আশ্রয়ের নিরাপদ ছত্রছায়ায় কালযাপন করা— সে দ্বৈরথ যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হওয়া—তার চেয়ে যে কোন নগণ্য সৈনিকের হস্তে নিহত হয়ে মৃত্যুবরণ করা সর্বাংশে শ্রেয়, তাতে অন্তত স্বর্গলাভের পথ প্রশস্ত হবে। না, সে সম্ভব নয়, ঐশ্বর্য রাজ্য বা প্রাণের জন্য নিজের ধর্ম, বিবেক, বিবেচনা, কীর্তি, সম্মান বিসর্জন দেওয়া শুধু বীর বা ক্ষত্রিয় নয়, মনুষ্য মাত্রেরই অযোগ্য বলে আমি মনে করি।’

‘কিন্তু আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলাম বৎস, তুমি তো কখনও প্রার্থীকে বিমুখ করো না।’ হতাশা ও লজ্জা- জড়িত করুণ কণ্ঠে বলেন কুন্তী।

‘গর্ভধারিণী এবং জন্মদাতা কখনও পুত্রের কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করতে পারেন না, তাঁরা আদেশ করবেন। দেখুন, আপনি এত কাল পরে আজ কেবলমাত্র আমার জন্যই ব্যাকুল হয়ে, আমার কল্যাণার্থ আমাকে আমার প্রাপ্য ভাগ দিতে বা আমার প্রাণের ভয়ে এভাবে এত ক্লেশ স্বীকার ক’রে এখানে আসেন নি। আপনার স্বীকৃত ও সর্বজনজ্ঞাত পঞ্চপুত্রের জীবননাশের আশঙ্কাতেই এসেছেন—তাই না? নিজেকে প্রতারিত করবেন না—মাতৃস্নেহ-প্রবঞ্চিত সন্তানকেও না।… তৎসত্বেও—আমার প্রতিজ্ঞা বিশ্বচরাচরবিদিত— আমি কোন প্রার্থীকে বিমুখ করি না, মাতৃসম্বন্ধীয়া নারীকে তো নয়ই। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমার বাক্য কদাচ অন্যথা হবে না, এ যুদ্ধে যাই কেন না ঘটুক আপনি পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন। যুদ্ধে আমি অর্জুন ছাড়া অপর কোন পাণ্ডবকে বধ করব না। অর্জুন ও আমার দ্বৈরথ যুদ্ধ হলে— সম্ভবত অর্জুনই জয়ী হবেন—না হলেও আপনি পঞ্চপুত্রের মাতাই থাকবেন, তখন আপনাকে জননী বলে স্বীকার করতে কোন দ্বিধা থাকবে না। যদিচ সে ক্ষেত্রেও সিংহাসন আমি গ্রহণ করব না। যুধিষ্ঠির আমার অপেক্ষা সর্বাংশেই সে সিংহাসনের উপযুক্ত, তিনি রাজ্য শাসন করবেন। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান।’

শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠে কি একটা সকরুণ ব্যঙ্গের সুরই ফুটে উঠল? ।

উঠলেও কুন্তী তা লক্ষ্য করলেন না। অঞ্চলপ্রান্তে অশ্রুমোচন ক’রে নত মস্তকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘পুত্র, তোমার বাক্যগুলি নির্ঘাৎ, জ্বলন্ত শল্যসমই তা আমার শ্রবণেন্দ্রিয় দহন ক’রে অন্তরে প্রবিষ্ট হয়েছে। তোমার বক্তব্য যে সত্য তাও অনস্বীকার্য কিন্তু অভিযোগ মিথ্যা হলে বোধ করি সহজে সহ্য হয়—সত্য বলেই তা আরও মর্মঘাতী। আমি অপরাধিনী, আমার অধিক কিছু প্রত্যাশা করার যোগ্যতাও নেই, দুঃসাহসও নেই। যে আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দিলে তাই আমার প্রাপ্যের অতীত, আশার অতীত।… কে জানে আর কখনও ইহলোকে দেখা হবে কিনা—যদি নাও হয়, হতভাগিনীর একটি মিনতি রইল, নিজের বাল্যজীবনের অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত দুর্বলতায় কোন অকরণীয় যদি কিছু ক’রে থাকো—কখনও অবসরকালে সে কথা স্মরণ হলে এই পিশাচীর সেদিনের সে অবস্থার সঙ্গে তুলনা ক’রে দেখো— তাহলে হয়ত ক্ষমা করতে পারবে।’

অন্তর্গঢ়-বাষ্পলীন কণ্ঠে কথা কটি বলে মাতা কুন্তী নতমস্তকেই বিদায় নিলেন। বহু আশায় জননীত্বর দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সন্তানের কাছে এসেছিলেন, তখন পথকষ্ট দুঃসহ হলেও অসহ বোধ হয় নি—এখন কর্ণও চেয়ে দেখলেন—ক্লান্ত পদ প্রতি পদেই যেন তাঁর গতিকে বাধা দিচ্ছে। আর বোধ করি এতটুকুও শক্তি অবশিষ্ট নেই তাঁর। তদুপরি অবিরল অশ্রুবর্ষণে দৃষ্টিও অন্ধপ্রায়। প্রায় প্রতি পদক্ষেপেই ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত উপলখণ্ডে আঘাত পাচ্ছেন।

তবু, ক্রমশ এক সময় আর্যা কুন্তী তাঁর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটি শ্বেতবিন্দুর মতো প্রতিভাত হতে হতে এক সময় যেন দিগন্তেই বিলীন হয়ে গেলেন। কিন্তু কর্ণ তখনই গৃহাভিমুখে যাত্রা করতে পারলেন না। জন্মদাত্রীর এই শেষ আবেদন যেন তাঁর সমস্ত শক্তি ও ইচ্ছা নষ্ট ক’রে তাঁকে অনড় জড় ক’রে দিয়ে গেছে।

বহুক্ষণ সেই ভাবে স্থির হয়ে রইলেন অঙ্গাধিপতি কর্ণ। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছেন, অপরাহ্নে আর বড় বিলম্ব নেই। রৌদ্রের সে-প্রজ্বলন্ত রূঢ়তা প্রশমিত হয়েছে, রবিকরের প্রখরতা স্তিমিত হয়ে প্রসন্নতা প্রকাশ পাচ্ছে। এত বিলম্ব ওঁর কখনও হয় না, গৃহে মহিষীরা ও সেবকবর্গ এতক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন নিশ্চয়ই, হয়ত বা অনুসন্ধানে নির্গত হবার কথা চিন্তা করছেন।

কিন্তু কর্ণ তখন না পরিবেশ, না পরিজন— কোনটা সম্বন্ধেই সচেতন ছিলেন না। গর্ভধারিণীর শেষ কথাগুলি—আর্ত রোদনেরই বুঝি নামান্তর—তাঁর মনভূমিতে বহুদিন পূর্বের এক অনুরূপ ঘটনার স্মৃতি অঙ্কুরিত করেছে। অপরাধী বিবেকের মৃদু অস্বস্তি বোধ করছেন একটা।

বহুদিনের কথা। সম্পূর্ণ বিস্মৃত ছিলেন এতদিন। আজ অকস্মাৎ যেন বহুদিনের রুদ্ধ দ্বারের অর্গল উন্মোচিত হয়ে নিজের সেই কদর্য চেহারাটা মাথা নত ক’রে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর মতো নির্গত হয়েছে।

সে ঘটনাও এমনি এক জনহীন নদীতীরেই সংঘটিত হয়েছিল, এমনিই স্নান ও ইষ্ট-আরাধনা সমাপনের পর। অভ্যাস-মতো নিরুদ্বেগ অবসর পেয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ইষ্টমনন করেছিলেন সেদিনও। সেদিনও এমনি পার্থিব পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া মাত্র চমকিত হয়ে উঠেছিলেন।

দেখেছিলেন একটি উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী শবরকন্যা সেই শেষ-চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে অদূরস্থ কণ্টক-বৃক্ষের ছায়া আশ্রয় না ক’রে তাঁরই সন্নিকটে করজোড়ে দণ্ডায়মান। তার ললাট-কপোলের শ্যাম বর্ণ অবিরল স্বেদত্যাগে পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে মানসিক উত্তেজনায়, সহজ সঙ্কোচে, কোন প্রবল আশঙ্কায় অথবা দৈহিক শান্তিতে থরথর ক’রে কাঁপছে

সে মেয়েটিও সেদিন ভিক্ষাই প্রার্থনা করেছিল। আদিম অনার্য জাতির সরল দুহিতা, কোন অনাবশ্যক ভূমিকা কি বাগজাল বিস্তারের চেষ্টা করে নি সুললিত কাব্যময় ভাষা তাদের অজ্ঞাত, সে ভাষার সাহায্যে মনোগত বাসনা বা মূল বক্তব্য আচ্ছাদিত করায় তারা অনভ্যস্ত। সে সোজাসুজিই ভিক্ষা চেয়েছিল সন্তান। তার মুকুলিত কৈশোরের স্বপ্ন— সে সৌভাগ্য। মহাবীর মহাতেজস্বী, বিশাল-হৃদয় কর্ণের সন্তান সে গর্ভে ধারণ করবে এ তার সর্বাধিক অত্যুগ্র কামনা। তার ঈপ্সিত ভিক্ষা লাভ করলেই সে তার নগণ্য পল্লীতে তাদের সমাজে ফিরে যাবে—তাদের দারিদ্র ও বন্যতার মধ্যে। এ সন্তানের কোন দায়-দায়িত্ব কর্ণের থাকবে না, সে কঠিনতম শপথ করেই প্রতিজ্ঞা করছে!

কর্ণ প্রথমে বিস্মিত, পরে বিপন্ন বোধ করেছিলেন। তাকে নিবৃত্ত করারও কিছু চেষ্টা করেছিলেন। এ ভিক্ষার পরিবর্তে ধনসম্পদ, ভূমি, গাভী, এমন কি অন্য যোগ্য ক্ষত্রিয় পাত্রও দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে কন্যা সম্মত হয় নি। ওই একটিই তার প্রার্থনা আর–এ বিশ্বচরাচরে কে না জানে, এ সময় কর্ণ কখনও প্রার্থীকে হতাশ করেন না!

শেষ অবধি তার ঈপ্সা পূরণ করেছিলেন কর্ণ। সে মেয়েটিও তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল। তৎক্ষণাৎ ওঁকে প্ৰণাম ও প্রদক্ষিণ ক’রে চলে গিয়েছিল সে, আর কোনদিন ওঁর সান্নিধ্যে আসে নি, কোন প্রার্থনা জানায় নি, সংবাদ পর্যন্ত দেয় নি।

সেই এক দণ্ড কালের মাত্র পরিচয়—তার পর এই দীর্ঘদিনে সে ওঁর জীবন থেকে ও স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণই বিস্মৃত হয়েছিলেন ঘটনাটা। আজ কুন্তীর এই সবেদন অনুরোধের পূর্ব পর্যন্ত মনে ছিল না।

এখন, প্রায় বিদ্যুৎবেগেই সে দিনের সে ঘটনা মনে পড়েছে। সমস্ত চিত্রটা মানসপটে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে নিমেষমধ্যে।

ন্যায়ত তাঁর কোন দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু ধৰ্মতও কি তাই?

তাঁর কি উচিত ছিল না, সে ক্ষণিকের সম্ভোগসঙ্গিনী, বিবেকের চোখে গন্ধবমতে বিবাহিতা স্ত্রী—তার সংবাদ সংগ্ৰহ করা, ভদ্রভাবে জীবনযাপনের উপায় ক’রে দেওয়া—সন্তান পুত্র হলে তার উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা? জনশ্রুতি ভীমও নাকি একাধিকবার এ কার্য করেছেন—কিন্তু তিনি উদরসর্বস্ব, বিবেচনা-বুদ্ধিহীন—সকলেই জানে। তাঁর আচরণ ও কর্ণের আচরণের পার্থক্য থাকা উচিত ছিল। তদ্ব্যতীত—তিনি শুনেছেন—সে বিবাহের সন্তানের সঙ্গে পাণ্ডবরা যোগাযোগ রেখেছেন, প্রয়োজন মতো তারা ওঁদের কাছে আসেও।

না, তাঁর আচরণ গর্হিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। নীচকুলোদ্ভব ভদ্রসংস্কারবিহীন ব্যক্তির মতোই।

আর, শুধুই কি নিরুপায় হয়ে সেদিন সে বালিকার ইচ্ছাপূরণ করেছিলেন? ধর্মের কাছে কি অকুণ্ঠিত চিত্তে সে কথা বলতে পারবেন? তাঁর নিজের কি একান্ত অনভিপ্রায় ছিল? সেই কিশোরবয়সী উদ্ধতযৌবনা তরুণীর লাবণ্য কি তাঁকে আকৃষ্ট করে নি? সে কি ওঁর অন্তরের গোপনতম প্রান্তে একবিন্দু লালসা উদ্রিক্ত করে নি? তাঁর ধমনীর রক্তস্রোত কি ঈষৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে নি?

সে ক্ষেত্রে সব দায়িত্ব সে সংসারজ্ঞানহীনা, জীবনানভিজ্ঞা বালিকার উপর ছেড়ে দিলে চলবে কেন?…

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কর্ণ একবার পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকালেন, প্রণাম করলেন সৃষ্টির আদি দেবতা, দিবসের অধিদেবতাকে। দর্পণ না থাকলেও অনুভব করলেন অস্তগামী ভগবান প্রখর-দীধিতির রক্তাভা তাঁর আননের লজ্জা ও অপরাধবোধের রক্তিমার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

তিনি অস্ফুট মর্মযন্ত্রণাবিদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘জননী, আমাকে মার্জনা করো।’

পাণ্ডব শিবিরে সেদিন যে গোপন মন্ত্রণাসভার অধিবেশন বসেছিল তাতে প্রধান আলোচ্য ছিলেন কুরুপিতামহ ভীষ্ম।

যুদ্ধের আয়োজন প্রস্তুত-প্রায়। পাণ্ডবরা সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলক ও অন্যান্য দূরগামী অস্ত্র বা অগ্নি-নিক্ষেপক যন্ত্র, প্রয়োজনীয় তৈজস, যোদ্ধৃবৃন্দ ও তাদের বাহনের জন্য খাদ্যসম্ভার, যান অচল ও ভঙ্গ হলে তার সংস্কার বা পুনর্গঠনের যন্ত্রপাতি, ঔষধ, যোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য চিকিৎসক সেবক নট গায়ক বারাঙ্গনা প্রভৃতিসহ যুদ্ধস্থলে নিজেদের জন্য সুবিধামতো স্থান অধিকার ক’রে শিবির স্থাপন করেছেন।

হিরন্বতী নদী শীর্ণকলেবরা হলেও নির্মলসলিলা, এক্ষণে এই শরৎকালে তাতে সুপেয় জলের অভাব ঘটবে না। একদিকে নদী অপর তিনদিকে গভীর পরিখা খনন করিয়ে তার ভিতর দিকে প্রস্তর এবং বৃহৎ বৃক্ষকাণ্ড সন্নিবেশে দুর্গ- প্রাচীরের মতোই দুর্ভেদ্য আশ্রয়-অন্তরাল নির্মাণ করিয়েছেন। অকর্মণ্য বা অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সৈনিকদেরও নিয়ে এসেছেন যুধিষ্ঠির শিবিরের কেন্দ্রস্থলে ঔষধ আয়ুধ খাদ্য প্রভৃতির ভাণ্ডার স্থাপন ক’রে তা রক্ষা ও সরবরাহের দায়িত্ব নিজের হাতে রেখেছেন—সেখানেই তাদের বিভিন্ন উপযুক্ত কর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে।

চতুর্দিকেই সাজো-সাজো রব উঠেছে, সকলেই আসন্ন মহাসমরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সেই সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য, তাদের সেবক পাচক ও বাহন–হয়-কুঞ্জরের ধ্বনিতে নিরন্তর অমাবস্যা পূর্ণিমার সমুদ্র গর্জনের মতো কোলাহল উঠছে। শরাসন, জ্যা, শর, গোলক, ধূনী প্রভৃতির পর্বতপ্রমাণ সঞ্চয় হয়েছে।* বহু লোকের প্রয়োজন। শুধু সুদীর্ঘ পরিখা রক্ষার জন্যই বলবান সতর্ক ও সদাজাগ্রত অসংখ্য প্রহরী নিযুক্ত করা হয়েছে—শত্রু না কোন অসতর্ক মুহূর্তে অনুপ্রবিষ্ট হতে পারে। দুই দল ক্রমান্তরে সতর্ক তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়োগ ক’রে পাহারা দিচ্ছে। তাদের সময়মতো খাদ্য-পানীয়াদি পৌঁছে দেওয়ার জন্য পূর্বোক্ত অনাহবী পুরুষদের মধ্য থেকে বিশেষ যোগাযোগকারী নিযুক্ত রাখা হয়েছে। বিরাট দ্রুপদ প্রমুখ প্রবীণ যোদ্ধারাও এই আয়োজন দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ও ব্যবস্থা ত্রুটিহীন বলে স্বীকার করেছেন।

[* অনুকর্ষ (রথের নিম্নদেশে নিবদ্ধ ভগ্ন সংস্কারার্থ কাষ্ঠ), তূণীর (রথবাহ্য বিশাল বাণকোষ), ররূথ (রথাচ্ছাদন ব্যাঘ্রচর্মাদি), তোমর (হস্তদ্বারা ক্ষেপণীয় শল্যযুক্ত দণ্ড বর্ণা?]), উপাসঙ্গ (অশ্বগজ-বাহ্য বাণকোষ), ঋষ্টি (গুরুভার কাষ্ঠদণ্ড), ধ্বজ, পতাকা, শরাসন-তোমর (ধনুদ্বারা ক্ষেপণীয় স্থুলবাণ), রজ্জু, পাশ (সমীপাগত প্রতিপক্ষের গলদেশে নিক্ষেপণার্থ রজ্জু), আস্তরণাদি পরিচ্ছদ, কচগ্রহবিক্ষেপ (কেশে গ্রহণ পূর্বক শত্রুর প্রতি নিক্ষেপার্থ তীক্ষ্ণাগ্র দণ্ড বিশেষ), তৈল, গুড়, বালুকা, সসর্প-কুম্ভ, ধূনকচূর্ণ, ঘণ্টফলক (ঘণ্টাযুক্ত ফলান্বিত শস্ত্র), অয়োগুড় (লৌহগুলি), জলোপল (জলক্ষরণশীল প্রস্তর), সশূল ভিন্দিপাল (শূলযুক্ত লগুড়), মধুচ্ছিষ্ট (মোম), মুদগর, কণ্টকময় দণ্ড, লাঙ্গল, বিষদিগ্ধ তোমর, শূর্প, পিটক (বেত্রনির্মিত বৃহৎ করণ্ড), পরশু প্রভৃতি দাত্র, অঙ্কুশাকার তোমর, দন্তযুক্ত করপত্র, বাসী, বৃক্ষাদন, (লৌহকণ্টক), ব্যাঘ্র ও দ্বীপিচর্ম পরিবৃত রথ, হস্ত দ্বারা ক্ষেপণীয় চক্রাকার কাষ্ঠফলক, শৃঙ্গ, ভল্প, কুঠার, কুদ্দাল, তৈলক্ষৌম, তৈলক্ষৌম (তৈলাক্ত বস্ত্ৰ—–আঘাতস্থলে ভস্ম চিকিৎসার জন্য), পুরাতন ঘৃত প্রভৃতি।
অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে এগুলিও গিয়েছিল আনুষঙ্গিক হিসাবে। (মহাভারত, বর্ধমান সংস্করণ, উদ্যোগ পর্ব) ]

সপ্ত অক্ষৌহিণী সৈন্যের সপ্তজন অভিজ্ঞ সেনাপতি পূর্বেই নির্বাচন করেছেন মহারাজ-চক্রবর্তী যুধিষ্ঠির—দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সাত্যকি, চেকিতান ও ভীমসেন কিন্তু এঁদের মধ্যে কে প্রধান অধিনায়ক হবেন সেটা স্থির করার জন্য তিনি সকলেরই মত জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সহদেব বলেছিলেন, ‘যাঁর আশ্রয়ে আমাদের জীবন ও পরমায়ুর ত্রয়োদশ বৎসর রক্ষা হয়েছে সেই মৎস্যরাজ রণদুর্মর বিরাটকেই প্রধান সেনাপতি পদে বৃত করা উচিত।’

নকুল বললেন, ‘যিনি আমাদের গুরু দ্রোণাচার্যের সতীর্থ, ভরদ্বাজের অস্ত্র-শিষ্য, যিনি পার্থিব হিসাবে শ্বশুর হয়েও সর্বদা আমাদের পিতার ন্যায় প্রতিপালন করেন, আমার মতে সেই প্রবীণ যোদ্ধা দ্রুপদকেই প্রধান সেনানায়ক রূপে বরণ করা কর্তব্য।

অর্জুন কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে বললেন, ‘আমার মনে হয় ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যতিরেকে কেউই ভীষ্মের বজ্রাশনিসম অস্ত্রসমূহের সম্মুখে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন না। যিনি প্রমত্তবারণতুল্য অসীমবীর্যসম্পন্ন, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় পুরুষ–আচার্য দ্রোণের বিনাশার্থই দৈবানুগ্রহে জন্মগ্রহণ করেছেন—তিনিই সর্বাংশে এ দায়িত্ব বহনের উপযুক্ত।’

ভীম প্রতিবাদ করলেন, ‘ইতঃপূর্বে সিদ্ধ ও ঋষিগণ যাঁকে ভীষ্মবধার্থে সমুৎপন্ন বলে চিহ্নিত করেছেন সেই শিখণ্ডী ব্যতিরেকে আর কাকে ভীষ্মের বিরুদ্ধে প্রধান সেনাপতি করবেন?’

বহু তর্কবিতর্ক ও আলোচনাতেও যখন এঁরা একমত হতে পারলেন না তখন যুধিষ্ঠির বিপন্ন মুখে বাসুদেবের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘রজনী গভীর হয়ে আসছে, এ আলোচনা আর দীর্ঘতর করা কর্তব্য নয়। তুমিই চিরদিন আমাদের জয়পরাজয়ের মূল, শুভাশুভ সুখদুঃখ সকলই নিয়ন্ত্রণ করছ, তুমিই বলো কাকে এ দায়িত্ব দেব। তুমি যাঁর নাম করবে তিনি অকৃতাস্ত্র হলেও তাঁকেই প্রধান সেনাপতি পদে বরণ করব।’

শ্রীকৃষ্ণ এতক্ষণ স্মিতমুখে কেবল শ্রোতারূপেই বসে ছিলেন। এখন যুধিষ্ঠির কর্তৃক এই ভাবে অনুরুদ্ধ হয়ে অর্জুনের মুখের দিকে চেয়ে মৃদুহাস্য সহকারে বললেন, ‘মহাবীর ধনঞ্জয়,—যিনি সমরে যথার্থ অর্থেই অপরাজেয় বলে আমার বিশ্বাস—এ বিষয়ে তাঁর অভিমতই সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। আমিও তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলছি—ধৃষ্টদ্যুম্নই এ গৌরবপ্রাপ্তি ও পাণ্ডবপক্ষের গৌরবরক্ষার সর্বাংশে যোগ্য ব্যক্তি।

অতঃপর এ সম্বন্ধে কেউ আর ভিন্নমত প্রকাশ কি প্রতিবাদ করতে সাহস করেন নি। যুধিষ্ঠিরের দৃঢ় মনোভাব প্রকাশের পর অন্য কোন প্রস্তাব উত্থাপন করাও অনর্থক হত। সুতরাং একপ্রকার সর্বসম্মতিক্রমেই ধৃষ্টদ্যুম্নকে আবাহন ক’রে সামগ্রিক ভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু অদ্যকার এ মন্ত্রণাসভার উদ্দেশ্য অন্য। প্রধান সেনানায়ক ও সহকারী সেনানায়কদেরও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। যুদ্ধারম্ভের দিন যত নিকটবর্তী হচ্ছে ততই তার গুরুত্ব ও বাস্তব দিকগুলি সম্বন্ধে ধারণাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে—কৃষ্ণপক্ষের অন্ধ রাত্রে গভীর সমুদ্রে অর্ণবযানের একেবারে সম্মুখে কৃষ্ণতর সুবৃহৎ পর্বতের আকস্মিক আবির্ভাবের মতোই অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তাও।

ও পক্ষের আর কারও জন্যই এঁরা তত চিন্তিত নন, আর কারও সম্বন্ধেই এঁদের মনোভাবে ভয় শব্দটি প্রযোজ্য নয় —কুরুপিতামহ ভীষ্ম ছাড়া। ভীষ্মের প্রশ্ন অপর সকলের থেকেই স্বতন্ত্র। পরশুরামের প্রিয় শিষ্য এই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা শুধু অপরাজেয় বীরই নন, অথবা কেবলমাত্র বিচক্ষণতম রণ কুশলী যুদ্ধশাস্ত্রবিশারদ নন—ইনি মহাযোগী ও মহাত্যাগী। এঁর চরিত্র ও মনোবল দেবদুর্লভ, ঋষিদেরও ঈর্ষার পাত্র ইনি।

প্রবীণ পিতার ভোগলালসা চরিতার্থ করতে উনি প্রশান্তমুখে প্রসন্নচিত্তে অনায়াসে নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন। বৃদ্ধ পিতা শান্তনু এক ধীবর কন্যার রূপলুব্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করবার প্রস্তাব করলে ধীবর বলেন, ‘বৃদ্ধের সঙ্গে এমন রূপসী ও কিশোরী কন্যার বিবাহ দেব কোন লোভে? তুমি যদি বাক্যবদ্ধ হও যে এর গর্ভে পুত্রসন্তান জন্মলাভ করলে সে-ই কুরুবংশের সিংহাসন লাভ করবে তবেই তোমাকে কন্যা দান করতে পারি।’ শান্তনু যতই মুগ্ধ বা মোহগ্রস্ত হোন, প্রবল ইন্দ্রিয়-তাড়না সত্বেও এটুকু কাণ্ডজ্ঞান তাঁর তখনও ছিল। তিনি সে-সত্য করতে পারলেন না । পুত্র দেবব্রত রূপেগুণে, বিদ্যায়, সৌজন্যে, বীর্যে, শৌর্যে, বুদ্ধি-বিবেচনায় অনন্য। সাধারণ মানুষ তো নয়ই— দেবতাদের মধ্যেও তার তুলনা বিরল। আর শক্তি! স্বয়ং পরশুরামও ইদানীং এই এককালীন শস্ত্র-শিষ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে সাহস করেন না।… এই গৌরব-করার মতো পুত্রকে বঞ্চিত ক’রে ঐ মৎস্যজীবীর দৌহিত্রকে কুরুবংশের প্রাচীন সিংহাসনে বসাবেন কোন মুখে! না, তা হয় না। ন্যায় নীতি বিবেক—কোথাও এর কোন সমৰ্থন নেই।

পিতার মনোকষ্ট তীক্ষ্ণধী ও তীক্ষ্ণতরদৃষ্টি দেবব্রত লক্ষ্য করবেন বৈকি। এর কারণও তাঁর কর্ণে প্রবেশ করতে বিলম্ব হ’ল না। তিনি নিজেই গেলেন ধীবররাজ সন্নিধানে। বললেন, ‘আমি তোমার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকছি, আমিও সিংহাসন গ্রহণ করব না। পিতার মৃত্যুর পর তোমার দৌহিত্রই এ রাজ্যের একচ্ছত্র অধীশ্বর হবেন। এও বলছি আমি যতদিন জীবিত বা সক্ষম থাকব, কায়মনোবাক্যে তার সিংহাসন রক্ষা করব, কদাচ তার বিরোধিতা করব না। তুমি অনায়াসে রাজাধিরাজকে এই কন্যা সম্প্রদান করতে পারো।’ ।

‘কিন্তু তার পর?’ ধীবররাজ তবু যেন নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, ‘তোমার ছেলেরা এই অন্যায় যদি সহ্য না করে?’ দেবব্রত অম্লানবদনে বললেন, ‘আমি সে সত্যও করছি—আমি কোনদিন বিবাহ বা নারীসঙ্গ করব না। সন্তান হবার সম্ভাবনাই থাকবে না। ‘

সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্যই তিনি অতঃপর জনসমাজে ভীষ্ম নামে পরিচিত হয়েছেন এবং সেই প্রতিজ্ঞা তিনি আক্ষরিক ভাবেই পালন করে আসছেন। এই ঊর্ধ্বরেতা মহামানব কঠোর তপস্যা ও ইন্দ্রিয়-সংযমের দ্বারা একপ্রকার মৃত্যুঞ্জয়ীই হয়েছেন। তিনি নিজে মৃত্যু বা পরাজয় ইচ্ছা না করলে তাঁকে কেউ নিহত বা পরাজিত করতে পারবেন বলে বোধ হয় না।

এ প্রাচীন ও পবিত্র অত্যাশ্চর্য ইতিহাস, ভীষ্মের শক্তি এ সভার কারও অবিদিত নেই। তবু একবার মহারথ ভীষ্মের লোকোত্তর চরিত্র ও অমানুষিক শক্তি-শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর উদ্বেগ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করলেন।

বললেন, ‘এমন কি যিনি এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন স্বয়ং অর্জুনও এই অসাধ্যসাধন করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। এখন আপনারা দয়া ক’রে বলুন, কোন পথ অবলম্বন করলে আমরা এ বিপদসাগর উত্তীর্ণ হতে পারি।’

সকলেই সময়োপযোগী সান্ত্বনা দানের চেষ্টা করলেন। যুদ্ধে প্রায় অবতীর্ণ হয়ে—যখন আর মাত্র দুটি দিন মধ্যে অবশিষ্ট আছে তখন এসব প্রশ্নের বা বিবেচনার সার্থকতা কি সে বিষয়েও অনেকে কটাক্ষ করলেন। কেউ কেউ ঈষৎ বক্রোক্তিও করলেন। অর্জুন ও ভীম তাঁদের ভুজবল সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত। অর্জুন এমন শ্লাঘাও প্রকাশ করলেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে সমস্ত কুরুবাহিনী এক দিনেই বিনষ্ট করতে পারি, সে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রও আমার আয়ত্তাধীন।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘কিন্তু সমস্ত কুরুবাহিনী আর পিতামহ ভীষ্ম এক নন, তিনি এ সমস্তর থেকে স্বতন্ত্র, বিরাট— অমানুষিক শক্তিধর।’

সকলের মত প্রকাশ শেষ হলে যেন চিরাচরিত রীতি হিসাবেই যুধিষ্ঠির বিপন্ন ও কাতর নেত্রে বাসুদেবের মুখের দিকে চাইলেন। সে চাহনির অর্থ, ‘এবার তুমিই বলো কী করা উচিত, কী করব!’

বাসুদেব এতক্ষণ সভার শেষ প্রান্তে উপবিষ্ট থেকে নীরবে এঁদের আলোচনা শুনছিলেন, এবার কথা কইলেন, ‘আপনি নিজে কিন্তু কোন পন্থা বা উপায় এখনও ব্যক্ত করেন নি। আপনার মত কি? আপনি কি করতে চান?’

যুধিষ্ঠির যেন আরও বিপন্ন ও কুণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে বললেন, ‘ওঁর কাছে যাওয়া ছাড়া তো আর কোন উপায় দেখছি না। উনিই বলে দিন কী ভাবে ওঁকে পরাজিত করা যায়!’

এবার শ্রীকৃষ্ণর চিরপ্রশান্তিও যেন ঈষৎ বিচলিত হ’ল। তিনি ভ্রূকুটিবদ্ধ নেত্রে যেন সামান্য-শাণিত-কণ্ঠেই উত্তর দিলেন, ‘ছিঃ! আপনি ক্ষত্রিয়, রাজা। নিজ বীর্যবলে মহারাজ-চক্রবর্তী পৃথ্বীশ্বররূপে স্বীকৃত— আপনি জয়ভিক্ষা করবেন? ধিক!’

যুধিষ্ঠির প্রথমটা লজ্জায় অধোবদন হলেন। এ ধিক্কার অত্যন্ত মর্মান্তিক ও একান্ত সত্য। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন, ‘তা তুমি কি পরামর্শ দাও? তুমি হলে কি করতে, কি ভাবে অগ্রসর হতে?’

‘কিছুই করতাম না। কোন গোপন প্রচেষ্টা করতাম না শত্রুর বীর্যহানি করার। যুদ্ধই করতাম। …যুদ্ধ করবেন বলেই তো এত আয়োজন, ভারতখণ্ডের প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকে রথী, সৈন্য এবং দ্রব্যসম্ভার আনা হয়েছে। যাঁরা এসেছেন প্রসন্নচিত্তে কর্তব্যবোধেই এসেছেন, মৃত্যুভয়ের কথা চিন্তা করেন নি। সে যুদ্ধ এখনও একদিনও হয় নি, এখনও শরাসন ধারণ করেন নি কেউ—এখনই এত হতাশ এত উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? ও-পক্ষের সেনাপতির পতন বা মৃত্যুর জন্যই বা এত অধীর হচ্ছেন কেন?’

‘ও-পক্ষের সেনাপতি যে অজেয়।’ অভিভাবকদের নিকট সকারণে তিরস্কৃত বালকের মতোই শঙ্কিত অপ্রতিভতার সঙ্গে বলার চেষ্টা করেন যুধিষ্ঠির।

‘অজেয় কি অমর কেউ নন এ পৃথিবীতে। জনশ্রুতি মহাত্মা ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু শক্তি আছে, অর্থাৎ ইচ্ছা না করলে মৃত্যু হবে না। কিন্তু তা সত্য হলেই বা কি, সে ইচ্ছা তো কত কারণেই হতে পারে। দেহধারী নরনারী মাত্রেরই কখনও না কখনও জীবন সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা আসে, এ জীবন সম্বন্ধে ক্লান্তি বোধ হয়, বীতস্পৃহ হয়ে ওঠে। কে বলতে পারে বহু লোকক্ষয় ক’রে, তাঁর থেকে বীর্যে শস্ত্রজ্ঞানে অভিজ্ঞতায় অনেক হীন, নিকৃষ্ট, অবোধ ও নিরপরাধ অগণিত সৈন্যবধে ওঁরও তেমন বীতস্পৃহা বা বিরক্তি দেখা দেবে না? তখন হয়ত তিনিই মৃত্যু ইচ্ছা করবেন।’

যুধিষ্ঠির যেন এতক্ষণে ধিক্কারের গাঢ় মসীময় অন্ধকারে আত্মরক্ষার ঈষৎ আলোকরেখা দেখতে পান। ব্যগ্র উৎসাহ প্রকাশ ক’রে বলেন, ‘আমারও তো সেই বক্তব্য ছিল। এই যে উভয়পক্ষের সমবেত অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা, এ যুদ্ধে এদের কোন স্বার্থ নেই, এরা কেউ আমাদের কোন অনিষ্টও করে নি—তবু এই নিরপরাধ লোকগুলিই নিহত হবে— প্রত্যহ সহস্র সহস্র, হয়ত বা লক্ষাধিক ক’রে। শুনেছি পিতামহ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছেন আমাদের পক্ষের অন্যূন দশ সহস্র পদাতিক ও এক সহস্র রথী প্রত্যহ বধ করবেন, আচার্য দ্রোণ সেই প্রকার আশ্বাস দিয়েছেন দুর্যোধনকে। অকারণে—এই বৃথা লোকক্ষয়ের কথা চিন্তা ক’রেই আরও—’

তীক্ষ্ণ কশার মতোই বাসুদেবের নির্মম কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছয়—’কিছুই অকারণ নয় মহারাজ-ধিরাজ। এ সংসারে ঘটনাপরম্পরা বিধাতার প্রয়োজন হিসাবে সাজানো আছে, সেই ভাবেই ঘটে। সব প্রয়োজন সব সময় আমরা বুঝি না, তাই আমরা অকারণে বিলাপ করি।… লোকক্ষয়ের কথা বলছেন? মধ্যে মধ্যে লোকক্ষয়ও প্রয়োজন। কত সময় মহামারীতে কত নিরপরাধ ভীত অবোধ লোকের মৃত্যু হয়, কে তার সংবাদ রাখে। এই সব ভয়াবহ সর্বনাশা যুদ্ধ, এও বিধিনির্দিষ্ট।

‘আর কিছু না হোক—জনস্ফীতি রোধ করতেই এর প্রয়োজন। বিশেষ মন্দপ্রকৃতি লোকের সংখ্যা কত বৃদ্ধি পেয়েছে তা কি আপনি অনুভব করছেন না? ক্ষাত্রশক্তি অকারণেই আজ উদ্ধত, অকারণেই নিষ্ঠুর। স্বার্থান্ধ নয় শুধু—স্বার্থোন্মত্ত । এদের ধ্বংস অনিবাৰ্য, এ-ই মহাকালের বিধান। কোন পর্বতশৃঙ্গের একাংশ যখন ভূপাতিত হয়, তখন বহু প্রাণী নরনারী বহু জনপদ তাতে পিষ্ট বিনষ্ট হয়। তাদের কথা কে হিসাব করছে! প্রতিদিন আপনার রথচক্র বা অশ্বপদে কত প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে তাদের কথা কখনও চিন্তা করেছেন? তাদের কি অপরাধ? আপনার প্রয়োজনে তারা প্রাণ দিচ্ছে মূঢ় অবোধ প্রাণী পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জানতে পারে না যে তাদের মৃত্যু আসন্ন। এই সৈন্যরা ক্ষত্রিয় নৃপতিদের অবলম্বন, এরাই ওদের ঔদ্ধত্যের উৎস শক্তি যোগাচ্ছে। সেজন্যই এদের মরতে হবে।’

এই পর্যন্ত বলে নিদাঘ-দ্বিপ্রহরের ভাস্করের মতো উগ্রমূর্তি ক্রদ্ধ বাসুদেব অকস্মাৎ নীরব হলেন। কিন্তু তাঁর মৌন অবলম্বন করার পর বহুক্ষণ পর্যন্ত সে সভাগৃহ নিঃশব্দ রইল, মনে হ’ল সেখানে অপর কোন প্রাণী উপস্থিত নেই। সমবেত রাজন্যবর্গ বা পরামর্শদাতা অভিমত-প্রকাশকর্তাদের কারও মুখেই সহসা কোন বাক্যস্ফূৰ্তি হ’ল না।

আর, সত্য বলতে কি, যুদ্ধ করতে এসে সে ঘটনার অব্যবহিত পূর্বেই এত আশঙ্কা ও হিসাব, ভবিষ্যৎ চিন্তা—তাঁদের অধিকাংশরই মনঃপূত বোধ হচ্ছিল না, তাঁদের এতে অনুমোদনও ছিল না। তাঁরা ক্ষত্রিয়, যুদ্ধই তাঁদের ধর্ম। সে ধর্মপালন করতে গিয়ে যদি মৃত্যু ঘটে তদপেক্ষা শ্রেয় লাভ আর কি হতে পারে?

অগত্যা যুধিষ্ঠিরও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ ক’রে তৃষ্ণীভাব অবলম্বন করলেন। বাসুদেবের ইচ্ছা, নির্দেশ—অনুজ্ঞা বলাই উচিত—তো স্পষ্ট, তার প্রতিবাদ করা কি তা অগ্রাহ্য করা ওঁদের শক্তির অতীত। সে সাহস বা স্পর্ধা ওঁদের নেই।

.

কুরুক্ষেত্র রণস্থলে যথাযোগ্য বাসস্থান বা বস্ত্রাবাস নির্মিত হলেও উপপ্লব্য নগরী সন্নিকটে বলেই তখনও এঁরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন নি। কিছু-কাল সেখানে অতিবাহিত ক’রে প্রয়োজনমতো উপপ্লব্যে প্রত্যাগমন করেছিলেন। তবে উপপ্লব্যের প্রাসাদ উপনগরীরই উপযুক্ত, কদাচ কোন কারণে রাজপুরুষ বা রাজার অবস্থিতির প্রয়োজন হলে এখানে বাস করবেন—এই উদ্দেশ্যেই নির্মিত, বহু জনসমাগমের কথা চিন্তা ক’রে এ প্রাসাদ পরিকল্পিত হয় নি। এখানেও অভিমন্যুর বিবাহকালেই তাই কাষ্ঠ বংশ মৃত্তিকা প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত অস্থায়ী গৃহ অথবা বিস্তৃত স্কন্ধাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। এগুলি নষ্ট করার কথাও কেউ চিন্তা করেন নি, কারণ পাণ্ডবদের অন্তঃপুরিকারা যেমন যুদ্ধের কয় দিবস এই প্রাসাদেই থাকবেন স্থির ছিল, তেমনি এ পক্ষের সেনাপতি বা প্রধানগণের স্ত্রী-কন্যা-বধূ ইত্যাদিও এই সব অস্থায়ী আবাসেই থাকবেন, যাতে রণক্ষেত্রের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে।

বাসুদেবের মূল প্রাসাদেই স্থান হতে পারত কিন্তু অপর সমাগত নিমন্ত্রিত আত্মীয় ও বান্ধবগণ, বিশেষ যাঁরা ওঁদের জন্য—সম্ভবত প্রাণ দিতেই—এসেছেন, তাঁরা এ ব্যবস্থায় অশোভন পক্ষপাতদোষ দেখতে পারেন এই আশঙ্কায় বাসুদেবই থাকতে সম্মত হন নি, নিজস্ব স্বন্ধাবারেই বাস করছেন। এদিনের মন্ত্রণাসভা অন্তে তিনি বিশ্রামার্থ সেখানেই যাচ্ছেন, প্রাসাদ থেকে একটি বালকভৃত্য অতি দ্রুতপদে তাঁর সম্মুখে এসে নতমুখে করজোড়ে বার্তা নিবেদনের ভঙ্গীতে দাঁড়াল। কেবল জিজ্ঞাসিত না হলে সেবকদের কথা বলা নিষেধ বলেই ওই ভাবে—প্রায় পথরোধ ক’রে দণ্ডায়মান রইল।

তার ভঙ্গী দেখেই বাসুদেব বুঝলেন বিশেষ কোন বার্তা বা সন্দেশ বহন ক’রে এসেছে সে, তিনি গতি সম্বরণ ক’রে হাত তুলে অভয় ভঙ্গী করতে সে এবার ভূমিষ্ঠ প্রণাম ক’রে তার বক্তব্য নিবেদন করল : ‘সর্বজন পূজিতা পট্টমহাদেবী আপনার দর্শনপ্রার্থিনী, অবশ্য যদি আপনার অন্যত্র অন্য কোন গুরুতর কার্য না থাকে বা সাতিশয় ক্লান্তি বোধ না করেন—আপনি অনুগ্রহ ক’রে তাঁর প্রকোষ্ঠে পদার্পণ করলে তিনি অনুগৃহীত বোধ করবেন।’

নিমেষকালের জন্য বাসুদেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়েছিল, যেন এই আকস্মিক আহ্বানের কারণ নির্ণয় করতে না পেরেই —কিন্তু সে ওই পলকপাত কালই, পরক্ষণেই এক অতি সূক্ষ্ম প্রায়-অদৃশ্য কৌতুক-হাস্যরেখা ওষ্ঠপ্রান্তে ফুটে উঠল। তিনি রীতি-অনুযায়ী একটি সুবর্ণ মুদ্রা আশীর্বাদী স্বরূপ প্রদান ক’রে তৎক্ষণাৎ পশ্চাদাস্য হয়ে প্রাসাদান্তঃপুরের পথ ধরলেন।

দ্রৌপদীর প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত অবশ্য তাঁকে পৌঁছতে হ’ল না। দেখা গেল তিনি যৎপরোনাস্তি উদ্বেগব্যাকুল মুখে গৃহসম্মুখস্থ অলিন্দপথেই অপেক্ষা করছেন। বোধ করি কোন দুশ্চিন্তার জন্যই তাঁর শিল্পীকল্পনাতীত সুন্দর ললাটে এই শারদ অপরাহ্নে মুক্তাবিন্দুর মতো স্বেদবিন্দু প্রকাশিত হয়েছে, কপোলে মুহুর্মুহু বর্ণোচ্ছ্বাস ঘটছে।

এই নারী আজও, এতকাল পরেও তেমনি সহস্রবর্ষ-সাধনা-দুষ্প্রাপ্য রূপ-যৌবন ও লাবণ্যের অধিকারিণী আছেন। অদ্যাপি তেমনি একান্ত ঈপ্সার পাত্রী, তেমনি চিত্ততরঙ্গোদ্বেলকারিণী। আজও পুরুষের ধমনীতে রক্ত চঞ্চল ক’রে তুলতে পারেন ইনি—তুলছেনও।

বাসুদেব হৃদয়োখিত আবেগের আভাস মাত্রে অপর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন, কক্ষবহির্গাত্রে অঙ্কিত তরুণী ও ময়ূরের চিত্রে কি কি ত্রুটি আছে তারই হিসাব যেন তাঁর একান্ত প্রয়োজন। সেও অবশ্য ওই মুহূর্তকালই। কঠোর অভ্যাসে যে কোন আবেগ দমন করতে তাঁর ঐটুকু সময়ও লাগে না। ওষ্ঠাধরে অভ্যস্ত সস্নেহ কৌতুকহাস্য ফুটিয়ে বললেন, ‘আদেশ কর সম্রাজ্ঞী— তোমার এ অপদার্থ অধম সেবক তোমার কোন প্রিয় কার্য সাধন করতে পারে!’

এ প্রকার কৌতুক বা সৌজন্য-আলাপন উপভোগের মতো মানসিক অবস্থা তখন নয় দ্রৌপদীর—তিনি বিনা ভূমিকায় কুশল প্রশ্ন মাত্রও না করে মূল বক্তব্যে চলে গেলেন।

‘কেশব, তুমি কেন মহারাজকে প্রতিনিবৃত্ত করলে? অযথা লাঞ্ছনা ক’রে তাঁরই অধীনস্থ নৃপতিসমাজে তাঁকে অপদস্থ করলে! তোমার বিশ্বের চিন্তা, মহাকালের পদক্ষেপ–কল্পনা, চিন্তাবিলাস। কিন্তু আমি যে পুত্রের জননী, আমার এ প্রশ্ন অনেক বেশী বাস্তব। স্বীয় পুত্রাধিক বালক অভিমন্যু, আমার পঞ্চপুত্র, এত আত্মীয়স্বজন, জামাতাকুটুম্বাদি—এদের আসন্ন মৃত্যু আশঙ্কা ক’রে কিছুতেই যে স্থির থাকতে পারছি না, আমার বুক কাঁপছে!…ভীষ্মের দুর্জয় শৌর্যের কথা কে না জানে। তিনি প্রতিজ্ঞাও কখনও ভঙ্গ করেন না। তিনি দুর্যোধনকে আশ্বাস দিয়েছেন যথাসাধ্য তার দিক হয়ে যুদ্ধ করবেন। প্রতিদিন অন্তত দশ সহস্র সৈন্য ও এক সহস্র রথী বিনাশ করবেন। যদি সত্যই তিনি সংহারমূর্তি ধারণ করেন! স্বীকার করছি সম্ভবত তিনি আমার স্বামীদের বধ করার চেষ্টা করবেন না। কিন্তু আমার পিতা ভ্রাতা পুত্রেরা— কেউ কি বাঁচবে! মহারাজ-চক্রবর্তী যাচ্ছিলেন তাঁর শরণ নিয়ে তাঁর মৃত্যুর উপায় জিজ্ঞাসা করতে—তুমি কেন বাধা দিলে! স্নেহবশত অবশ্যই ভীষ্ম তা বলতেন। তাতেও একেবারে যুদ্ধ ঘটত না, বা যুদ্ধের আদৌ প্রয়োজন হত না–এ কথাই বা তোমাকে কে বলবে! তবু তাতে এমন ভাবে সামগ্রিক বিনষ্টি ঘটত না। তোমার ধর্মরাজ্যের কল্পনা তোমারই থাক। বিশ্বচরাচরের কল্যাণচিন্তার থেকে আমার কাছে আমার পুত্রদের প্রাণের মূল্য বেশী!’

বলতে বলতেই দ্রৌপদীর নিম্ন কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে না পৌঁছেও তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে উঠল।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণও ততক্ষণে বুঝি এই নারী সম্বন্ধে তাঁর সামান্যমাত্র দুর্বলতাও ত্যাগ করেছেন। তাঁর দৃষ্টি ও ভ্রূকুটি পুনশ্চ কঠোর হয়ে উঠেছে—কিছু পূর্বের মন্ত্রণাসভার মতোই—ওষ্ঠাধরের দৃঢ়বদ্ধতা তেমনি নিমর্ম। তিনি তীক্ষ্ণতর কণ্ঠে বললেন, ‘ভাবিনী, এই যে এতগুলি সৈন্য-সমাগম ঘটেছে পুণ্য কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে—এরাও কোন না কোন জননীর পুত্র, অধিকাংশরই জননী হয়ত আজও জীবিতা এই সব তরুণ কিশোর রথী শৌর্য প্রদর্শনের সুযোগলাভে আনন্দিত, এই মহাবিপদের সম্মুখে, সম্ভাব্য মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার জন্য ব্যগ্র, অধীর জীবনের মূল্যে গৌরব ক্রয়ের আশায় এদের দৃষ্টি দীপ্ত, আনন উজ্জ্বল—এদেরও গৃহে জননী আছে, জায়া আছে, ভগ্নী আছে—তারাও উদ্বিগ্নব্যাকুল নেত্রে এদের প্রত্যাবর্তনের পথ চেয়ে আছে, যদিও তারা জানে যে সে আশার মূলে কোন সম্ভাবনাই নেই। এরা কেন এসেছে জান? তোমার স্বামীরা তাঁদের সিংহাসন ফিরে পেতে চান, কৌরবরা দিতে চায় না। ধার্তরাষ্ট্ররা তোমার রূপলুব্ধ, না পেয়ে কদর্য অপমান করেছে—জঘন্য শব্দ ব্যবহারই সে আচরণের যথার্থ বর্ণনা হয়—সেই অবমাননার প্রতিশোধ গ্রহণই পাণ্ডুপুত্রদের উদ্দেশ্য এই যুদ্ধ করার। কিন্তু সেসবই তোমাদের ব্যক্তিগত, কুরুকুলের নিজস্ব স্বার্থসংঘাত লোভ ও লালসার কারণে—ভারতখণ্ডের অগণিত নৃপতিকুলের হিসাবে সেটা সামান্য তথ্যমাত্র, অতি তুচ্ছ—এদের বিন্দুমাত্র স্বার্থসিদ্ধি ঘটবে না, যে পক্ষেরই জয় হোক না কেন। তবু এরা এসেছে, আহ্বান পাওয়া মাত্র—কারণ যুদ্ধ করা, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ নেওয়া ও দেওয়াই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, বীরের ধর্ম, সেই ধর্মাচরণের জন্যই এসেছে। এসব কথা তোমার মতো বুদ্ধিমতী রাজনীতি-অভিজ্ঞার কাছে বলাই অর্থহীন,—তবু বলতে হচ্ছে সেই তো বিস্ময়ের কথা, পরিতাপের কথা। এই নিঃস্বার্থ প্রাণবলিদানোদ্যত অষ্টাদশ অক্ষৌহিণীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোমার ছটি পুত্রের প্রাণের চিন্তা অগ্রগণ্য হয়ে উঠল! ধিক তোমাকে!

‘যখন কৌরব দ্যূতসভায় ক্রদ্ধ কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলে কৌরবদের সর্বনাশ দেখবে—তখন এ চিন্তা কোথায় ছিল? দাবানল প্রজ্বলিত হলে বনমধ্যস্থ ঋষির তপোবনও ভস্মীভূত হওয়ার পরিণাম থেকে অব্যাহতি পায় না। পিতামহ ভীষ্ম তোমাদের কাছে কী এমন অপরাধ করেছেন যে তোমার পুত্রদের প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দেবার অনুরোধ করবে?’

লজ্জায় পূর্বেই মাথা নত হয়েছিল। সেই তরঙ্গায়িত মেঘবর্ণ কেশপুঞ্জের মধ্যে শীর্ণ সীমন্তরেখাটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে— সঙ্কীর্ণ অথচ সুন্দর অন্তরঙ্গ বীথিপথের মতো—এখন নীল সরোবরতুল্য নেত্রের কূল প্লাবিত ক’রে পদ্মপলাশস্থ শিশিরকণার মতোই ঝরে পড়ল কয়েক বিন্দু অশ্রু। বাষ্পগাঢ় কণ্ঠে কৃষ্ণা বললেন, ‘শুধু কি আমার পুত্রদের কথাই চিন্তা করছি! জনক ভ্রাতা বা—সর্বোপরি আমার দেবাধিক মহান স্বামীরা—’

কপোলের স্বেদ-মুক্তাবলীর সঙ্গে অশ্রুবিন্দু যোগ হয়েছে, ললাটের এক এক বিন্দু স্বেদ এসে মিলিত হচ্ছে তার সঙ্গে। দ্রৌপদীর কণ্ঠে অনুতাপ ও মিনতি।

শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠাগ্নি শীতল হয়ে এসেছিল প্রথম কয়েক বিন্দু-অশ্রু-বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গেই—এখন অনেক কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘আয়ুষ্মতী, তোমার প্রথমেই হিসাবে ভুল হয়েছে, ভীষ্মের হস্তে তোমার স্বামী-পুত্রদের বিনাশ-আশঙ্কা নেই। তিনি সম্পর্কে কৌরব ও পাণ্ডব উভয়েরই পিতামহ, উভয় পক্ষই তাঁর সমান স্নেহভাজন হওয়ার কথা—কিন্তু তোমার স্বামীরা তাঁদের চারিত্রিক মহত্ব ও শুদ্ধতায়— সৌজন্যে, ভদ্রতায়, ন্যায়নীতি-অনুগ ব্যবহারে, সহস্র দুঃখ ও বঞ্চনার মধ্যে ধর্মবুদ্ধি-ভ্রষ্ট না হওয়ায়—তাঁর সমধিক প্রিয়। তাঁদের কি তাঁদের পুত্রদের বধ ক’রে পাণ্ডুর পিণ্ডলোপ করবেন না তিনি কখনওই—করতে পারবেন না। আরও, কুরুবংশের পিওর প্রশ্নও আছে সেখানে—কারণ পাণ্ডুপুত্রদের হাতে কোন ধৃতরাষ্ট্রতনয়ই অব্যাহতি পাবে না। না, ভীষ্ম নন, যার দ্বারা প্রবল অনিষ্টাশঙ্কা ছিল তাকে বলহীন করে দিয়ে এসেছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, তোমার স্বামী-পুত্রদের অন্তত এ যুদ্ধে মৃত্যু ঘটবে না।’

‘ভীষ্মের অপেক্ষাও ভীষণ, ভয়ঙ্কর যোদ্ধা—কুরুপক্ষে এমন কে আছে? দ্রোণাচার্য—?’

দ্রৌপদীর কণ্ঠে একই সঙ্গে অবিশ্বাস ও কৌতূহল প্রকাশ পায়।

‘দ্রোণাচার্য সম্বন্ধেও ঐ একই বক্তব্য—এঁরা তাঁর অধিক প্রিয়। পরন্তু কুরুপুত্রদের কখনওই তাঁরা সম্যক স্নেহ লাভ করতে পারেন নি। ‘

‘তবে?’

‘তুমি মহারথী কর্ণের কথা বিস্মৃত হচ্ছ কেন?’

‘কর্ণ এঁদের থেকে বীর! তুমি কি সত্যই তা বিশ্বাস করো, বিস্ময়ের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অভিমান যোগ হয়।

‘করি। কারণ তোমাদের সম্বন্ধে তীব্র বিদ্বেষ ছিল তাঁর মনে। বিদ্বেষ আর ঈর্ষা। তোমাদের প্রতি তাঁর স্নেহমমতা থাকার কোন কারণ আছে কি?…তদ্ব্যতীত তাঁর শৌর্য অর্জুন ব্যতীত এ পক্ষের সকলের অপেক্ষাই অধিক। তাও উত্তর গোগৃহযুদ্ধে তিনি অত সহজে অর্জুনের নিকটও পরাজিত হতেন কিনা সন্দেহ—যদি না দুর্যোধনের এই সাধারণ দ্যসুজনোচিত আচরণে তাঁর পূর্ব থেকে আপত্তি থাকত—বিরক্তি বোধ না হত। তিনি এসেছিলেন ঘোর অনিচ্ছাতেই। করদরাজা, দুর্যোধনের আশ্রিত—সেদিন বোধ করি এ অবস্থার গ্লানি তিনি তীব্রভাবেই অনুভব করেছিলেন।’

‘তা এখনই বা তাঁর পরিবর্তন হবে কেন, তাঁর শৌর্য হ্রাস পাবার কোন তো কারণ ঘটে নি…এখনও তো তিনি তেমনিই মহাশূর আছেন। ‘

‘না, তা তিনি নেই। কেশরীর নখদন্তের তীক্ষ্ণতা হ্রাস পেয়েছে, বাসুকির বিষের তীব্রতা অপগত হয়েছে—আমিই সে ব্যবস্থা ক’রে দিয়ে এসেছি।’

‘কী ভাবে!’ বিস্মিতা দ্রৌপদী প্রশ্ন করেন।

‘সেটা প্রকাশ করার কাল এখনও আসে নি মনস্বিনী, একদিন আপনিই প্রকাশ পাবে, তখনই জানবে, আমার বলার প্রয়োজন থাকবে না।’

দ্রৌপদী চোখ তুলেছেন পূর্বেই, চীনাংশুকে যতটা সম্ভব অশ্রুচিহ্নও মুছেছেন, তাঁর দৃষ্টিতে আশ্বাসের আভাস জাগলেও সন্দেহের ও উদ্বেগের চিহ্ন এখনও লোপ পায় নি।

‘কিন্তু যিনি মহাবীর হবেন, তিনি দুর্বলের সহায় হবেন, উৎপীড়িতের ত্রাণকর্তা হবেন, শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার প্রথম শর্তই এটা —নয় কি? দ্যূতসভায় তাঁর আচরণ কি একান্ত কাপুরুষবৎ নয়? নীচ বংশীয় নীচ কর্মরত ব্যক্তিরই উপযুক্ত ব্যবহার!’

‘তুমি কি তার অর্থ আজও বুঝতে পারো নি?’ এবার যেন বাসুদেবেরই বিস্মিত হবার পালা, ‘আশ্চর্য! এইখানেই স্ত্রীজাতির সহজ দীনতা। অতি বুদ্ধিমতী নারীও অন্তর দেখে না, শুধু বাইরের আচরণ দেখে পুরুষকে বিচার করে।’

এই বলে, আর দ্বিরুক্তি কি উত্তর-প্রত্যুত্তরের অবকাশ না দিয়েই বাসুদেব সে স্থান এবং প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। তিনি শ্রান্ত, সম্ভবত ক্ষুধার্তও—অবিলম্বেই নিজের বস্ত্রাবাসে পৌঁছানো আবশ্যক— তাঁর মুখভাব দেখে অন্তত সকলের তাই মনে হ’ল।

দ্রৌপদী আর বাধা দিলেন না। কিন্তু তার পরও বহুক্ষণ সেইখানে পাষাণ-প্রতিমাবৎ স্থির অনড় হয়ে হইলেন।

এ আবার কোন ধরনের বক্তব্য বাসুদেবের! কর্ণের সেদিনের সে আচরণের স্মৃতি আজ, এই সুদীর্ঘ ত্রয়োদশ বর্ষ পরেও—বিস্মৃত হন নি তিনি, সমস্ত অপমান সমস্ত বাক্যবাণের ক্ষত আজও তেমনি জ্বালার কারণ হয়ে আছে। সব তথ্যই মনে আছে তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ।

হ্যাঁ, কিছুটা দুর্বোধ্য বোধ হয়েছিল ঠিকই। তাঁর উদারতা, তাঁর দানশীলতা, তাঁর শৌর্য সম্বন্ধে যেসব জনশ্রুতি— তার সঙ্গে এ আচরণের অর্থ মিলিয়ে পান নি। তবু—তাকে সমর্থন করা, তার সপক্ষে যুক্তি অনুমান বা আরোপ করা কি সম্ভব!

অনেকক্ষণ চিন্তা এবং স্মৃতি বিশ্লেষণ করেও বাসুদেবের এ ধন্ধ-সদৃশ উক্তির কোন অর্থ খুঁজে পান না কৃষ্ণা, সে আচরণের সমর্থন বা কর্ণ সম্বন্ধে সহানুভূতির সূত্র ধরতে পারেন না। তবু কে জানে কেন—ইতিপূর্বেও নিজের এ মনোভাবে তিনি যৎপরোনাস্তি বিস্ময় বোধ করেছেন, সহজ আপাত-বিচারবুদ্ধির কাছে কেমন এক ধরনের লজ্জাও— আজও আর একবার যেন ওই অকারণে রূঢ়, অভদ্র সুরামত্তকিরাতবৎ আচরণকারী লোকটির জন্য একটি গোপন ব্যথাও অনুভব করলেন। বনবাসে থাকাকালে, অজ্ঞাতবাসের নিভৃত, কর্মহীন অবকাশে ওঁর চিন্তা মানসপটে উদিত হয়ে তীব্র ঘৃণার মধ্যে মধ্যে একাধিকবার এমনি একটা অজ্ঞাত বেদনাও অনুভব করেছেন তিনি। পরক্ষণেই নিজের এই অস্বাভাবিক মনোভাবে বিস্ময়ের অন্ত থাকে নি। লজ্জাতে একথা কাউকে বলতেও পারেন নি। শেষ পর্যন্ত নিজেকেই বুঝিয়েছেন—সেই বহুবিগত দিনের এক স্বয়ম্বর সভায় নিজের অভদ্র ও অন্যায় আচরণের জন্য অনুতাপ থেকেই বোধ করি এ বেদনার জন্ম।

কে জানে সেদিনের সে আঘাত হয়ত লোকটি আজও ভুলতে পারেন নি–হয়ত আজও বহুপূর্ণতার মধ্যেও সেই কিশোরী মেয়েটির অভাব বোধ করেন— সেই সঙ্গে একটা ব্যর্থতা ও শূন্যতা বোধও।

কে জানে–হয়ত সেই জ্বালাই সেদিনের সে তিক্ততার মূলে কাজ করেছে।

যুধিষ্ঠির বা দ্রৌপদীকে যেমনই তিরস্কার করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত বাসুদেব স্বয়ং স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে সেই দিনই মধ্যরাত্রে পদব্রজে বহুপথ অতিক্রম ক’রে কুরুসেনাপতি মহাত্মা ভীষ্মের শিবিরে উপস্থিত হলেন।

বাসুদেব এ শিবিরে সুপরিচিত, বিশেষ কৌরবসভায় দৌত্যকর্মে গমন করার পর সাধারণ সৈন্য ও প্রহরীরাও অনেকে তাঁকে চাক্ষুষ করেছে—তত্রাচ শিবিররক্ষকরা তাদের কর্তব্য পালন করতে পথরোধ করবে এ স্বাভাবিক। বিশেষ প্ৰধান সেনাপতির শিবির সম্বন্ধে সমধিক সতর্কতা অবলম্বন করাই উচিত। বোধ করি কুরুরাজ নিজে এলেও তারা প্রবেশাধিকার-ইঙ্গিত জানতে চাইত।

বাসুদেবও তা জানেন, সকল রণাঙ্গনেই এ রীতি প্রচলিত আছে, আবহমান কাল থেকে। সর্বাধিনায়ক বা রাজ্যাধিপতি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি নূতন শব্দ বা স্বল্পশব্দের একটি বাক্য প্রহরারত কর্মীদের জানিয়ে দেন—ইঙ্গিত স্বরূপ। যে রাজকার্যে শিবিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করবে বা শিবির ত্যাগ করবে কিংবা যাঁরা এ পক্ষের নেতৃস্থানীয়—তাকে বা তাঁদের সেটি জানিয়ে দেওয়া হয়। নৈশ ইঙ্গিত প্রত্যুষকাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে, দিবারম্ভে আবার নূতন ব্যবস্থা। কখনও বা প্রয়োজনবোধে মধ্যরাত্রেও—শত্রুপক্ষ কোন কৌশলে এ ইঙ্গিত অধিগত করেছেন এমন সংবাদ পেলে—এই শব্দ বা শব্দসমষ্টির পরিবর্তন করা হয়। সর্বাধিনায়কের অঙ্গুরীয়বাহী বিশ্বস্ত দূত এসে দ্বারে দ্বারে প্রহরীদের জানিয়ে দিয়ে যায়।

এ সব নিয়মই বাসুদেবের সুপরিজ্ঞাত, তাঁর নিজের রাজ্যে বরং অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তিনিও এ বাধার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। তাঁর নিষাদ অনুচর কীলক কৌরবশিবিরে—শিবিরে কেন হস্তিনার রাজপ্রাসাদেও—সুদীর্ঘকাল যাবৎ মাংস সরবরাহ করছে। সে প্রায় মধ্যরাত্র থেকে ঊষাকাল পর্যন্ত পরদিনের ভক্ষ্য মৃগ- শূকর-শশ-শল্লকী মাংস পৌঁছে দিতে থাকে অগণিত উষ্ট্র বা বৃষবাহিত শকট পূর্ণ ক’রে। সুরাপান-আধিক্য প্রভৃতি কারণে নিজে অপারগ হলেও এ সরবরাহ বন্ধ হয় না, তজ্জন্য কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মী আছে তার। সে কারণে তাকে ও তার অনুচরদের এ ইঙ্গিত জানানো আবশ্যক। কীলক বাসুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী সে ইঙ্গিত অবগত হওয়া মাত্র তাঁকে জানিয়ে দিয়ে যায়। অবশ্য কেবলমাত্র তাঁকেই ব্যক্তিগতভাবে জানায়, অপর কোন ব্যক্তির মধ্যস্থতায় আস্থা নেই তার। তদ্ব্যতীত, তার ধারণা বাসুদেবকে এ গোপন সঙ্কেত জানানো বিশ্বাসঘাতকতার পর্যায়ে পড়ে না।

বাসুদেব প্রহরীদের প্রসন্নহাস্যে ও অভয়মুদ্রায় আশ্বস্ত ক’রে মৃদুকণ্ঠে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন—’দাবানল’। প্রহরীরা সসম্ভ্রমে, তাঁকে নমস্কার করে, পথ ছেড়ে দিল।

কুরু-সেনাপতি ভীষ্ম সেদিন মধ্যরাত্রি অতিবাহিত হওয়া সত্বেও শয়ন করেন নি। ইদানীং তাঁর নিদ্রার কাল অতিশয় সংক্ষেপিত ক’রে এনেছেন। রজনীর দ্বিতীয় যামের শেষভাগে তাঁর সুখলেশহীন কঠিন শয্যা—কাষ্ঠের উপর মাত্র একটি মৃগচর্ম আস্তৃত—গ্রহণ করেন ও তৃতীয় যাম অতিবাহিত হওয়া মাত্র শয্যা ত্যাগ ক’রে স্নান-পূজা বন্দনা প্রভৃতিতে নিরত হন। আজ তিনি তাও করেন নি—তাঁর বস্ত্রাবাসের সঙ্কীর্ণ শূন্য স্থানটুকুতে কতকটা অস্থিরভাবেই পদচারণা করছিলেন, যেন কার প্রতীক্ষা করছেন।

বাসুদেব সে কার্পাসকক্ষের প্রবেশপথের কাষায়দ্বার অপসারিত ক’রে প্রায় নিঃশব্দেই প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু বিপরীত দিকে দৃষ্টি থাকা সত্বেও যেন কোন মায়ামন্ত্রবলে তা ভীষ্মের অনুভূতিগোচর হ’ল। তিনি স্নেহকোমল কণ্ঠে বললেন, ‘সুস্বাগত বসুদেবতনয়, আমি তোমারই প্রতীক্ষা করছি। আমি জানতাম তুমি আসবে।’

শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে পাদস্পর্শ প্রণামান্তে তেমনি মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘এ বিশ্বসংসারে কোন ঘটনাই যে আপনার প্রজ্ঞা বা দূরদৃষ্টির অতীত নয় কুরুপিতামহ—তা আমি বিলক্ষণ জানি। এও জানি—আমি যে ভিক্ষার্থী হয়ে আজ এসেছি সে তথ্যও আপনাকে নিবেদন করা অনর্থক।

‘বিলক্ষণ, তুমি আসবে যখন অনুমান করেছি তখন কেন আসবে তাও অনুমান করতে পারব এ আর আশ্চর্য কি! তবে ভিক্ষা শব্দটি এখানে প্রযোজ্য নয়—তুমি এমনই এক ভিক্ষুক—তোমার প্রার্থনার অর্থই হ’ল আদেশ।…আমার প্রাণদণ্ড দিতে এসেছ—এই তো?’

‘আপনাকে দণ্ড দেবার স্পর্ধা বা সাধ্য স্বর্গে মর্ত্যে কারও নেই। আপনি নিষ্পাপ শুদ্ধসত্ব যোগেশ্বর—আজীবন ব্ৰহ্মচর্য- ব্রতধারী এবং সে ব্রহ্মচর্য অটুট রেখেছেন, পরার্থেই আপনার জীবনধারণ, জীবন উৎসৃষ্ট। আমি সুদ্ধমাত্র আপনাকে স্মরণ করাতে এসেছি যে, আপনি বহুকাল এ পৃথিবীতে এসেছেন, আপনি জন্মগ্রহণ করার বা জ্ঞান হওয়ার পর যে

সমাজ ও সংস্কার দেখেছেন, যে উচ্চমানের পবিত্র জীবনযাত্রা স্বাভাবিক বলে আপনার ধারণা—তার বোধ করি আজ কোন চিহ্ন-ও কোথাও নেই। পূর্বে বিবেক ব্যতিরেকে কারও দ্বারা শাসিত হত না মানুষ, আজ সে বিবেক, আত্মসম্মানজ্ঞান, সৌজন্যবোধ, ভদ্রজীবনের অলিখিত রীতি ও নীতি সকলই বিলুপ্তপ্রায়—সে সমস্ত বহুদূরস্মৃতিতে মাত্র পর্যবসিত হয়েছে। পূর্বকালে সাধারণ প্রজারা সুবিচারের জন্য যে ধর্মাধিকরণে যেত, শাসকদের দ্বারস্থ হত—আজ সে ধর্মাধিকরণ পর্যন্ত কলুষিত, বিচারকরা অর্থলোলুপ, বিচার-বিক্রয়-উৎসুক। নৃপতিরা পর-ঐশ্বর্যলুব্ধ, ঈর্ষা, ভোগোন্মত্ত অকারণেই উদ্ধত, অকারণেই অত্যাচারী। অপরের দুর্দশায় তাদের চিত্ত তৃপ্তিলাভ করে, দরিদ্র বলহীনদের অসহায় অবস্থার পৃষ্ঠপটে নিজেদের শক্তি বহুগুণবর্ধিত স্বরূপ কল্পনা ক’রে এক বিকৃত আত্মপ্রসাদ ভোগ করে। মানবজাতির এই শোকাবহ অধঃপতন দেখেও কি আপনার মনে মৃত্যু-ইচ্ছা দেখা দেয় না? আরও কোন আশায়, কোন বাসনা চরিতার্থ করতে আপনি জীবিত থাকতে চান? আমি জানি পিতার ও গুরুর আশীর্বাদে, নিজের সাধনার ফলে আপনার ইচ্ছামৃত্যু—আপনি নিজে না শরাসন ত্যাগ করলে বা যুদ্ধে নিবৃত্ত না হলে কারও সাধ্য নেই আপনাকে নিপাতিত করে। সেই কারণেই আপনাকে স্মরণ করাতে এসেছি যে—এক্ষণে আপনার এ পাপনিমগ্ন পৃথিবী, এই জরাজীর্ণ দেহ থেকে বিদায় নেবার কাল সমুপস্থিত হয়েছে।’

ভীষ্ম ইতিমধ্যেই সাদরে সসম্মানে বাসুদেবের দুই হাত ধরে তাকে গৃহের অদ্বিতীয় কাষ্ঠাসনে বসিয়ে নিজেও সমুখস্থ শয্যায় উপবেশন করেছেন। বাসুদেবের সক্ষোভ বক্তব্য শুনতে শুনতেই তাঁর মুখ এক সকৌতুক মধুর হাস্যে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল, এখন তিনি ঈষৎ শব্দ সহকারেই হাস্য করলেন। বললেন, ‘আমার বিদায় নেবার কাল উপস্থিত হয়েছে বললে সত্যের অপলাপই ঘটে—সে ক্ষণ বহু পূর্বেই বিগত হয়েছে। সে বিষয়ে আমি অনবহিত নই। কিন্তু সত্যই একটি বাসনা অপূর্ণ আছে এখনও। ঋষিরা বলেন ব্রহ্মের তিন রূপ—ব্রহ্মারূপে তিনি সৃজন করেন, নারায়ণ বা বিষ্ণুরূপে পালন করেন ও প্রলয়কাল উপস্থিত হলে শিবরূপে সংহার করেন। যতই অস্বীকার কর—আমি জানি তুমিই সাক্ষাৎ নারায়ণ, এক অকল্পনীয় অপরূপ লীলা প্রদর্শন ও নিজেও আস্বাদনের নিমিত্ত তুমি নরদেহ ধারণ করেছ। তোমার স্ব নির্দিষ্ট কর্মকে অতিক্রম ক’রেই সেই লীলা—অর্থাৎ তুমি এবার সংহারমূর্তি ধারণ করেছ। সেই রূপ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করব বলেই আমি অদ্যাপি জীবিত আছি বাসুদেব—নইলে মানবজাতি কেন, নিজের বংশধরদের যে কুৎসিত আচরণ চোখে দেখতে হ’ল তাতে জীবনে বীতস্পৃহা জাগারই কথা।’

শ্রীকৃষ্ণ শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু আমি তো এ মহাহবে অস্ত্রধারণ করব না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

ভীষ্মের দুটি চোখে মুগ্ধতার সঙ্গে কৌতুকের এক আশ্চর্য মিলন ঘটল। তিনি বললেন, ‘আমি যদি কিছুমাত্র সৎকার্য করে থাকি—অর্থাৎ তোমার কথাই সত্য হয়—আমার কোন যোগবল থাকে তবে তোমার প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করাবই। শ্রীকৃষ্ণ, যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তুমি আমাকে বধ করো—তাহলে সেই মুহূর্তেই মৃত্যুইচ্ছা করব, তোমার এই বিস্ময়কর লীলা প্রত্যক্ষ করার পর আর কোন কারণ থাকবে না জীবিত থাকার, তোমার চক্রাস্ত্রে নিহত হওয়া অপেক্ষা আর কোন ঈপ্সিত মৃত্যুও আমার নেই!’

সে প্রসঙ্গের কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ শুধু বললেন, ‘কিন্তু আপনি কি মনে করেন না যে ক্ষাত্রশক্তির এই পচনশীল রূপ পরিবর্তনের সময় এসেছে—প্রজাশাসনের নামে অনাচার ও যথেচ্ছাচার বন্ধ করার?’

‘করি বৈকি। ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অপসারণের জন্য যে তোমার এই দীর্ঘকালব্যাপী বিপুল আয়োজন,—মনুষ্যত্বকে সংস্কৃত কলুষমুক্ত করার ইচ্ছা—তাও জানি। যদিচ এও জানি দেহধারীর শক্তিও সীমাবদ্ধ, তোমার সৃষ্টির কঠিন নিয়মে তুমি বদ্ধ—তোমারও সাধ্য নেই কালের এই বন্যাকে, মনুষ্যত্বের এই অধোগতিকে প্রতিরুদ্ধ করো।… তবু দুই চোখ মেলে তোমার লীলা তো দেখব—সেইটুকুই আমার লাভ। আমাকে বধ করার জন্য অর্জুনকে সর্বশক্তি সর্ববুদ্ধি প্রয়োগে গঠিত করেছ—সে শক্তিরও আস্বাদন করে যেতে চাই—সেই সঙ্গে তোমাকেও দেখাতে চাই—আমিও গুরুর কাছে বৃথাই শস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করি নি।’

‘তাহলে কি আমি বিমুখ হয়েই ফিরে যাব?’

শ্রীকৃষ্ণ যেন অসহায় অনুনয়ের ভঙ্গীতে বলে উঠেন।

‘বাসুদেব, আমি ক্ষত্রিয়সন্তান, প্রাচীন রাজবংশজাত। তুমিই এইমাত্র বললে, আমরা মনুষ্যত্বের ও কর্তব্যবুদ্ধির প্রাচীন নিয়মে বদ্ধ, সেই ধারণায় অভ্যস্ত। দুর্যোধনের অন্নগ্রহণ করেছি, তার বেতনভুক সেবক আমি, তদুপরি সে বিপন্ন হয়ে আমার শরণ নিয়েছে, আমাকে সেনাপতি পদে বরণ করেছে। আমি ধর্মত তার পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য।’

বাসুদেব বললেন, ‘আপনি তার অন্ন গ্রহণ করেন নি, কুরুরাজ্যের অন্ন গ্রহণ করেছেন। এ সিংহাসন পাণ্ডুর, ন্যায়ত ধর্মত তা যুধিষ্ঠিরেরই প্রাপ্য। সেই এ বংশের জ্যেষ্ঠও। দুর্যোধন অসৎ উপায়ে বলপূর্বক সে রাজ্য গ্রহণ করেছেন—নয় কি?

ভীষ্মর ললাটে সামান্য একটু ভ্রূকুটির ভঙ্গী প্রকাশ পেল। বললেন, ‘তোমার মতো প্রজ্ঞা বা সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি আমার নেই সত্য কথা। তবে আমি যা বুঝেছি—বারণাবত যাত্রার পর দীর্ঘকাল পাণ্ডবরা আমাদের জ্ঞাত জগতে ছিল না, তারা মৃত জেনেই—এমন কি ধর্মাত্মা বিদুরও তাদের জীবনরক্ষার সম্ভাবনায় শেষ পর্যন্ত জোর দিতে সাহস করেন নি–ধৃতরাষ্ট্র আপন অধিকারবলে, বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিভাবক হিসাবে, সে সিংহাসন শূন্য দেখে দুর্যোধনকে দিয়েছেন, দুর্যোধনও রাজপুরুষগণ, আশ্রিত ও করদ নৃপতিগণ তথা আপামরসাধারণ কর্তৃক ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিনিধি শাসকরূপে স্বীকৃত হয়েছেন।* পরে যখন রাজ্য দুই ভাগ হয় তখন পাণ্ডবরা আমাকে বা দ্রোণাচার্যকে কি কৃপাচার্যকে সে রাজ্যের কার্যভার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান নি, অথবা অংশভাগ হিসাবেও কাউকে দাবি করেন নি। সুতরাং আমি সর্বদিক বিবেচনান্তে নিজেকে কৌরবদের বেতনভুক কর্মচারী হিসাবেই গণ্য করি।’

[* Prince-Regent—যদিও অন্ধ এই কারণে ধৃতরাষ্ট্র অগ্রজের অধিকারে বঞ্চিত হয়েছিলেন, সিংহাসন পান নি, তবু পরবর্তীকালে, মহাভারতে যা দেখা যায়—তাঁকেই পুনঃপুনঃ মহারাজ নরপতি প্রভৃতি বলে উল্লেখ বা সম্বোধন করা হচ্ছে। সে কি শুধুই সৌজন্যমূলক, না তিনিই রাজাম দুর্যোধন তাঁর প্রতিনিধি ছিলেন?]

‘কিন্তু এরা উভয়পক্ষই আপনার বংশধর, আপনার অপত্যস্থানীয়। পাণ্ডবরাও সে হিসাবেও আপনার রক্ষ্য।’

‘ধর্মই সর্বাধিক রক্ষণীয় বাসুদেব। এক্ষেত্রে সাধারণ সেবকের ধর্ম ছাড়াও বীরের ধর্ম পালনের প্রশ্ন আছে। শোন যাদবশ্রেষ্ঠ, এ পাপপক্ষের পরাজয় অনিবার্য তুমি, যুধিষ্ঠির ও অর্জুন যে পক্ষে আছ তার জয়লাভও সুনিশ্চিত! তুমি বৃথা চিন্তিত হয়ো না, আমাকে অন্তত কিছুদিন যুদ্ধ ক’রে অন্নঋণ ধর্মঋণ শোধ করতে দাও। দুর্যোধনকে আমি আশ্বাস দিয়েছি আমার সৈনাপত্যে পাণ্ডবপক্ষে প্রতিদিন অন্যূন দশ সহস্ৰ সৈনিক ও কিছু রথী নিহত হবে, সে সত্য আমি পালন করবই, স্বয়ং গুরু ভার্গব এসে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলেও তার অন্যথা হবে না। নয় দিন যুদ্ধ চলার পর—তখনও যদি উভয়পক্ষে যুদ্ধ বন্ধ করার মতো সুমতি না হয়—যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে নিয়ে আর একবার এস, আমার পতনের অথবা আমাকে পাতনের উপায় সেইদিন বলে দেব। দশদিনের বেশী এই পাপিষ্ঠদের পক্ষে যুদ্ধ করার প্রবৃত্তি আমার নেই। আর—’, ঈষৎ পরিহাসরঞ্জিত কণ্ঠে বললেন, ‘ইতিমধ্যে তুমি যদি পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধে অবতরণ ক’রে আমাকে বধ করতে অভিলাষী হও, আমি সেই মুহূর্তে প্রাণ দেব–কিছুমাত্র বাধা দেব না।’

শ্রীকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্যরঞ্জিত মুখে তাঁকে পুনশ্চ প্রণাম ক’রে বললেন, ‘পিতামহ, আপনি ধন্য—জীবনে-মরণে আপনি অসামান্য, মানবোত্তর আপনার প্রকৃতি, আপনার চরিত্র আপনার কার্য সকলই মহান আপনার মহাত্মা বিশেষণ সার্থক।

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত তখন তৃতীয় প্রহরও বুঝি বিগতপ্রায়। প্রহরীগণ ব্যতিরেকে উভয় শিবিরে কোনজনই বোধ হয় অতন্দ্র নেই। তবুও তখনই বাসুদেব নিজের অস্থায়ী আবাসে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করলেন না। তখনও আর এক স্থলে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল তাঁর।

ধীরপদে কুরু-শিবির-সীমা-অতিক্রম ক’রে এসে এক অশ্বত্থবৃক্ষতলে উপনীত হলেন। পূর্বাহ্নেই নিশ্চয় নির্দেশ দেওয়া ছিল, ওঁর নিজস্ব রথ সেখানে অপেক্ষা করছে। রজনীও অন্ধকার, তদুপরি বৃক্ষছায়ার অন্ধকারে আরও ঘনীভূত, আরও গাঢ়—এমন স্থির ও নিঃশব্দ যে সারথি রথ ও অশ্বযুগলকেও সেই অন্ধকারের অংশ বলে ভ্রম হয়।

শ্রীকৃষ্ণ বিনা বাক্যে, বিনা সম্ভাষণে সে রথে আরোহণ করলেন। তিনি যখন নির্দেশ দেন তখন তাতে কোন ভ্রান্তির অবকাশ থাকে না। পুনঃ প্রশ্ন তিনি সহ্য করেন না—গন্তব্যস্থলের কথাও সারথি অনবগত নয়—সুতরাং সে বিনা প্রশ্নেই বলগা শিথিল করল, শিক্ষিত অশ্বও ইঙ্গিত মাত্র প্রভুর অভিপ্রায় বুঝে প্রয়োজন-নির্মিত নূতন পথ ত্যাগ ক’রে প্রান্তরের দিকে যাত্রা করল।

ভীষ্মের সৈনাপত্যকালে কর্ণ তাঁর অধীনে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবেন না—একথা তিনি দুর্যোধনকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ভীষ্ম তাঁকে অবজ্ঞেয় বোধ করেন রথীদের ক্রমবিচারে তাঁকে অর্ধরথ বলে উল্লেখ করেছেন কোন আলোচনা সভায় উভয়ে উপস্থিত থাকলেই ভীষ্ম তাঁকে বিদ্রুপে কটুবাক্যে অপমানসূচক বিশেষণে জর্জরিত করেন। কর্ণ যখন স্পর্ধা প্রকাশপূর্বক বলেছিলেন তিনি একাই পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে তাদের পরাজিত করতে পারেন—তখন উত্তরগোগৃহে অর্জুন-হস্তে কর্ণের লাঞ্ছনার ইতিবৃত্ত স্মরণ করিয়ে ভীষ্ম সভামধ্যে তাঁকে মর্মান্তিক আঘাত করেছেন। এ অবস্থায় একই যুদ্ধক্ষেত্রে উভয়ে উপস্থিত থাকলে অন্তযুদ্ধ বাধাও আশ্চর্য নয়।

দুর্যোধন প্রতিযুক্তি প্রয়োগ, অনুনয়-বিনয়—কিছুতেই কর্ণকে বিচলিত করতে পারেন নি নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে সম্মত হন নি কর্ণ। অথচ মুখে যাই বলুন, কর্ণের ভরসায় ভীষ্মকে প্রধান সেনাপতিপদ থেকে অপসারিত করতে সাহস হয় নি দুর্যোধনের এই অবস্থায়। কর্ণ কুরুক্ষেত্রের যোজন দুই উত্তর-পশ্চিমে শিবির স্থাপন ক’রে সসৈন্যে সপরিবার বাস করছেন।*

[* বর্তমান কর্ণাল?]

শ্রীকৃষ্ণের মেঘবর্ণ অশ্ব গাঢ়নীল বর্ণের রথ বহন ক’রে অন্ধকারে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল এবং অত্যল্প সময়ে সেই দীর্ঘ ব্যবধান অতিক্রম ক’রে কর্ণ-শিবির-সীমায় উপনীত হ’ল। বাসুদেব রথকে একেবারে শিবিরের প্রবেশদ্বারসম্মুখে যেতে দিলেন না, কিছু দূরেই অবতরণ ক’রে একাই পদব্রজে সেদিকে অগ্রসর হলেন।

এখানের প্রবেশসঙ্কেতও বাসুদেবের অজ্ঞাত নয়—তবে সে নিদর্শন প্রকাশের প্রয়োজন হ’ল না। কিছু দূর গিয়েই দেখলেন শিবিরের বহির্দেশেই সুবিশাল জলাশয়ের তীরে প্রস্তরমূর্তির মতো শুভ্র-বস্ত্রাবৃত এক দীর্ঘদেহ ব্যক্তি দণ্ডায়মান তাঁর দৈহিক গঠনে সেই অন্ধকারেই বোঝা গেল তিনি স্বয়ং কর্ণ। কারণ, লোকটি যেন কিছুটা ব্যগ্র উৎসুক ভাবেই ঊর্ধ্বমুখ পূর্বগগনে নিবদ্ধ ক’রে স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। স্বীয় ইষ্টদেবের আবির্ভাবের জন্যই যে তাঁর এই ব্যগ্রতা তাও বুঝতে বিলম্ব হয় না।

শ্রীকৃষ্ণ বেশ একটু শব্দ ক’রেই তাঁর নিকটবর্তী হলেন কিন্তু কর্ণের ধ্যানমগ্নতা নষ্ট হ’ল না। তখন বাসুদেব একেবারে পশ্চাতে গিয়ে মৃদু-কোমল কণ্ঠে ডাকলেন, ‘অঙ্গাধিপতি!’

এবার কর্ণ সচকিত হয়ে উঠলেন কিন্তু তখনই ইষ্টতন্ময়তা থেকে মন বা মস্তিষ্ককে বাস্তবে আনতে পারলেন না। কিছুক্ষণ বিহ্বল ভাবে চারিদিকে তাকিয়ে স্থান কাল পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হবার চেষ্টা করলেন। তবে অতি অল্পকালই—পরক্ষণেই যেন, এটা যে প্ৰাক-যুদ্ধকাল, সেই অবারিত উন্মুক্ত প্রান্তরে শত্রুচরদের গমনাগমন অনায়াসসাধ্য সেটা স্মরণ হতেই—চমকিত ও কিছুটা তৎপর ভাবে পিছন দিকে ফিরে দাঁড়ালেন, শ্রীকৃষ্ণর স্থির মূর্তি দৃষ্টিগোচর হ’ল। তিনিও সেই প্রায়-অন্ধকারে চিনতে পারলেন। সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বাসুদেব আপনি! এই শেষ রাত্রে, একা! কোথাও কোন অঘটন ঘটে নি তো?’ ।

‘আর আপনি নয় কর্ণ, এবার তুমি! আমি যে তোমার নিকট-আত্মীয় তা বিস্মৃত হবার মতো দীর্ঘকাল তো অতিবাহিত হয় নি এখনও। আর এই জনহীন, শ্রোতৃহীন প্রান্তরে সেজন্য সাবধানতা অবলম্বনেরও কোন প্রয়োজন নেই। কর্ণ তুমি আমার কাছে পাণ্ডবদের মতোই প্রিয়, তোমার শৌর্যবীর্য শুধু নয়— তোমার চরিত্রের মহত্ব, উদারতা ও অকুতোভয়তা চিরদিন আমাকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।’

কর্ণ নিজের প্রশংসার প্রসঙ্গ আর অধিককাল স্থায়ী হতে না দিয়ে বললেন, ‘কিন্তু তোমার এই আকস্মিক আবির্ভাবের কারণটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না যে।’

‘আমি একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমাকে কেউ পাঠায় নি, অর্থাৎ কারও দূতরূপে আসি নি। এ নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত একান্ত চিন্তার ফল।’

‘বেশ তো, বলো না। তোমার সঙ্কোচ দেখেই বরং আশঙ্কিত হচ্ছি।’

‘তুমি তো ভীষ্মের সেনাপতিত্বে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবে না—সেই জন্যেই এখানে থেকে তাঁর পাতনের বা নিপাতনের অপেক্ষা করছ। তা এই সময়টা তুমি পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করো না কেন!’

প্রস্তাবটা এতটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত যে ‘বার্তার শব্দার্থ থেকে মর্মার্থে’ পৌঁছে তার সম্যক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কর্ণের বেশ কয়েক লহমা বিলম্ব হ’ল। তারপর এক বিচিত্র হাস্যে রঞ্জিত হয়ে উঠল তাঁর মুখ। শেষ কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও তা বাসুদেবের লক্ষ্য হতে অসুবিধা হ’ল না। সে হাসি কৌতুকের নয়—প্রসন্নতার তো নয়ই—তা যেন কতকটা আত্মধিক্কারেরই। আবাল্য সূতপুত্র বলে পরিচিত হওয়ার জন্যই সম্মুখস্থ প্রস্তাবকারী এ ধৃষ্টতা প্রকাশ করতে সাহস করছেন—সম্ভবত ধিক্কার সেজন্যই।

কিছুকাল নীরব থেকে সক্ষোভে মৃদু তিরস্কারমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘জনার্দন, তুমি যে অদ্ভুত প্রস্তাব এইমাত্র করলে তা কোন বীর বা ক্ষত্রিয়-সন্তানের যোগ্য তো নয়ই—সাধারণ কোন ভদ্রসন্তানেরও যোগ্য নয়। এমন কি নিকৃষ্টশ্রেণীর দেহপণ্যা বারযোষিৎত্রাও এতে অপমানিত বোধ করবে। তারা নির্ধারিত বেতনদাতা উপপতির সাময়িক অনুপস্থিতিতে কখনও কখনও হয়ত পুরুষান্তর গ্রহণ করে—কিন্তু অন্নদাতা উপপতির শত্রুকে গৃহে আহ্বান ক’রে তার সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করতে তাদেরও বিবেকে বাধে। ছিঃ বাসুদেব, এ প্রচেষ্টা নিতান্তই শিশুর যোগ্য। এখন ওপক্ষে যুদ্ধ করছি না বলে তোমাদের পক্ষে যুদ্ধ করব—আবার ভীষ্মের পতন হলেই ওপক্ষে গিয়ে তোমাদের বধ করতে থাকব—এ তো উন্মাদের কাজ। এ চিন্তা তোমার মনে উদিত হ’লই বা কেমন ক’রে!… কোন কারণেই আমি আশ্রয়দাতা, অবমাননা-থেকে রক্ষাকারী, বীরের সকল সুযোগ-সুবিধাদাতা বন্ধুর এই বিপদে তিলার্ধ অনিষ্ট বা তার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারব না—এ তো তোমাকে পূর্বেই বলেছি। রাজসুখভোগ তো তুচ্ছ—তার জন্য যথাসর্বস্ব দান করলেও তার ঋণ যথেষ্ট শোধ হয় কিনা সন্দেহ!’

তিরস্কৃত শিশুর মতোই শ্রীকৃষ্ণ মাথা অবনত ক’রে আছেন দেখে কর্ণ অপেক্ষাকৃত কোমল হয়ে এলেন। গাঢ় মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘তোমার কোন ভয় নেই বাসুদেব, পূর্বগগনের নক্ষত্ররাজির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এই মাত্র এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল। কি দেখলাম জান, আমার রথের অর্ধপ্রোথিত চক্রের পার্শ্বে আমার মৃতদেহ ভুলুণ্ঠিত— তার চারিদিকে আমার পুত্র জামাতা পৌত্রের শবদেহ, মহিষী কন্যা পুত্রবধূরা আলুলায়িত কেশে হাহাকার ক’রে রোদন করছেন। এ ভবিষ্যৎ ঘটনারই পূর্বাভাস, ইষ্টদেব দয়া ক’রে দেখিয়ে দিলেন। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যাও, পাণ্ডবদের জয় নিশ্চিত। আর আমিও, তাতে সুখী ব্যতীত দুঃখিত হব না।’

ইতিমধ্যে পূর্বগগনে ঊষার আবির্ভাব লক্ষিত হয়েছে তারই একটা অস্পষ্ট দীপ্তি যেন ইষ্টপ্রদত্ত গৌরবটীকার মতোই কর্ণর মহত্বোজ্জ্বল ললাটে এসে পড়ে তাঁর উদার আননকে এক অনন্য ও অভূতপূর্ব মহীয়ানতা দান করেছে। বাসুদেবের মনে হ’ল আজ তাঁর এ গোপন নৈশ অভিযান সার্থক হয়েছে—এভাবে এ সময় একা না এলে সেই আশ্চর্য দৃশ্য তাঁর অ-দৃষ্টই থেকে যেত।

তিনি নীরবেই কর্ণকে একবার গাঢ় আলিঙ্গন ক’রে নিজের রথে আরোহণ করলেন।

ভীষ্মের অভিলাষ যে এত শীঘ্র পূর্ণ হবে, যুদ্ধের মাত্র তৃতীয় দিবসেই কৃষ্ণকে স্বীয় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ক’রে অস্ত্রধারণ করতে হবে, তা সম্ভবত ভীষ্মও কল্পনা করতে পারেন নি।

বস্তুত নাটকীয়তা ও অভাবনীয়তা দিয়েই এ মহাযুদ্ধের প্রারম্ভ।

প্রত্যুষে উভয়পক্ষের সৈন্যসমাবেশ, ব্যূহরচনা সমাপ্ত হয়েছে, রথী ও মহারথীগণ ইষ্ট স্মরণ করে স্ব স্ব কেন্দ্রে স্থান গ্রহণ করেছেন, পদাতিকদের ও তাদের নায়কদের ইচ্ছানুসারে এবং ব্যূহরচনার নিয়মানুসারে সজ্জিত করা হয়েছে বীরগণের বাহু কর্ম-অধীর—যুদ্ধে নিজ নিজ পরাক্রম ও শিক্ষা প্রদর্শনের জন্য উৎসুক, ব্যগ্র এমন কি

হয়-হস্তীগণ পর্যন্ত যেন ধৈর্যহীন হয়ে অবিরাম অস্থির পদদাপে ভূতলকে ক্ষতবিক্ষত ক’রে তুলেছে—ঠিক এমন সময় অর্জুন অকস্মাৎ বিষণ্ন হয়ে পড়লেন তাঁর গাণ্ডীবের মুষ্ঠিবন্ধন শিথিল, প্রায়-অবশ হয়ে এল, সেই বিশাল যোদ্ধৃসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে করুণ ও কাতর কণ্ঠে বন্ধু বাসুদেবকে বললেন, ‘দেখ, সমগ্র ভারতখণ্ডের শ্রেষ্ঠ শূরগণ এখানে সমবেত হয়েছেন, উভয়পক্ষেই যে পরিমাণ মহারথী মহাবীরগণের সমাবেশ দেখেছি—এ যুদ্ধ শেষ হতে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণীর একজনও থাকবে না। তাহলে ভারতে কি থাকবে, কে থাকবে? কতকগুলি বৃদ্ধ, শিশু এবং বিধবা নারী—? এদের নিয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির রাজত্ব করবেন? সে রাজত্বের মূল্য কি? ধিক! শ্রেষ্ঠ দেশবাসীগণই যদি গতাসু হন, তাহলে দেশ কাকে নিয়ে? এ ভারতভূমিকে কানন বলে কল্পনা করলে এই মানুষগুলি সে কাননের শ্রেষ্ঠ পুষ্প, এরাই যদি বিনষ্ট হয় –এ মহাদেশ কণ্টকগুল্ভম সমাকীর্ণ অরণ্যভূমিতে পরিণত হবে। বাসুদেব, এদের অকালবৈধব্যপ্রাপ্ত নারীরা অনেকেই স্বল্পাস্বাদপ্রাপ্ত স্বামীসহবাসের স্মৃতিমাত্র নিয়ে দীর্ঘ বৈধব্য বহন করতে পারবে না, উচ্চবর্ণের উচ্চ শিক্ষাদীক্ষাপ্রাপ্ত পুরুষের অভাবে নীচজাতীয় নীচকর্মা পুরুষদের আহ্বান ক’রে নিজেদের সম্ভোগতৃষ্ণা ও সন্তানাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করবে। তার ফলে নিকৃষ্ট শ্রেণীর বর্ণসঙ্করে দেশ ভরে যাবে—ভারতভূমির শোচনীয় অধঃপতন ঘটবে।’

এই পর্যন্ত বলে, ললাটের ঘর্ম ও উত্তেজনা-ক্ষোভজনিত প্রায়োদগত অশ্রুবিন্দু মোচন ক’রে পুনশ্চ বলতে লাগলেন, ‘আরও দেখ, এই রথীরা অধিকাংশই আমাদের জ্ঞাতি, কুটুম্ব, আত্মীয় ও বান্ধব। এদের মধ্যে কত তরুণ কত কিশোর এমন কি কত বালকও রয়েছে—কোন প্রাণে সেই সুকুমার জীবনকলিকা বিনষ্ট করব? এরা বিগতায়ু হলে এই সব সুপ্রাচীন রাজবংশের পিণ্ড লোপ পাবে, প্রেত বা পিশাচসম ব্যক্তিরা এসে এদের সিংহাসন অধিকার করবে, প্রাচীন কীর্তিসমূহ বিলুপ্ত হয়ে চণ্ডাল-শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।… ওই পিতামহ ভীষ্ম আমাদের পিতার মতো লালনপালন করেছেন, আমরা ওঁকেই পিতা বলে জানতাম, কতদিন সে সম্বোধনও করেছি উনি সস্নেহে ক্রোড়ে তুলে নিয়ে আমাদের ললাটে চুম্বন ক’রে সুমিষ্টভাবে ভ্রমসংশোধন করেছেন। আমরা ধূলিধূসর কলেবরে ওঁর অঙ্কে আরোহণ করেছি—শুভ্রবেশ ধূলিলিপ্ত মলিন হয়ে গেছে—উনি সেজন্য কদাচ কোন বিরক্তি প্রকাশ করেন নি। ওই আচার্য দ্রোণ পুত্রজ্ঞানে আমাদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন, পুত্রের অধিক যত্ন নিয়েছেন আমাকে অজেয় করে তুলতে। আজ কোন প্ৰাণে ওঁদের ক্ষতবিক্ষত, আহত বা নিহত করব? না সখা, প্রয়োজন নেই তুচ্ছ এ সিংহাসনে, এ রাজ্যখণ্ডে। ভ্রাতা দুর্যোধনই তা ভোগ করুক—আমরা চিরদিন বনে বাস করব সেও শ্রেয়।

শ্রীকৃষ্ণ এতক্ষণ নীরবে এই উচ্ছ্বাসোক্তি শ্রবণ করছিলেন, অর্জুনের বক্তব্য শেষ হতে গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘গাণ্ডীবী, এ যুদ্ধ তুমি করছ এমন স্পর্ধা তোমার জন্মাল কেমন ক’রে? তুমি কি? বিশ্বসৃষ্টির অনন্তায়তনের কথা চিন্তা কর দেখি— সে তুলনায় ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র কীট মাত্র, কীটাণু-কীট—নয় কী? শোন, এই যে অগণিত সৈন্য দেখছ—এরা সাধারণ মানুষ, এদের আত্মীয়স্বজন পুত্রকন্যা ফেলে এসেছে, সকলেই কি শুধু বেতনের প্রত্যাশায় অথবা লুণ্ঠনের লোভে? না, তা নয়। এরা জানে রাজবংশীয়দের কদর্য লোভে, অকারণ অবাস্তব উচ্চাশায়, মাৎসর্যে, অহঙ্কারে সাধারণ নরনারী কি অবর্ণনীয় দুর্দশা ভোগ করে। এরা এসেছে সেই অবস্থার অবসান হবে এই আশায়। বর্তমান শাসনব্যবস্থায় সর্বতোভাবে উচ্চপদাধিকারীদেরই সকলপ্রকার সুখ-সুবিধা। সে শাসনশক্তির শক্তিমত্তার রথচক্রতলে এরা নিয়ত পিষ্ট হচ্ছে সে যন্ত্রণা কোনদিন ওই নৃপতিবৃন্দ—তুমি যাদের ভারতকাননের পুষ্প ভাবছ, তারা—সুদূর কল্পনাতেও অনুভব করতে পারবে না। এক রাজা অপর রাজার বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধযাত্রায় যায়—তখন দুই দেশের অথবা যেসব ভূখণ্ড দিয়ে যেতে হয় সে দেশের অধিবাসীদের উপর কী নির্যাতন হয় তা কখনও ভেবে দেখেছ? এ যুদ্ধের আয়োজন তোমাদের ও নয় কৌরবদেরও নয়—এ আয়োজন বৃহত্তর কোন শক্তি, যাকে ঐশীশক্তি বলা হয় তাঁর। এতদিনে তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে। সাধারণ, ভাগ্যতাড়িত, শক্তিশালী-ব্যক্তি কর্তৃক প্রবঞ্চিত, সর্বরিক্ত সহায়সম্বলহীন মানুষও যে একদা মহাদাম্ভিক শক্তিমদমত্ত রাজক্ষমতাকে বিনষ্ট ক’রে ধর্মরাজ্য স্থাপন করতে পারে—সেই সম্ভাবনা সম্বন্ধে সকলকে সচেতন করতে, সকলের দৃষ্টি উন্মুক্ত করার জন্যই এত আয়োজন।

‘মূঢ় অজ্ঞান পার্থ, বিশেষ ভাবে তোমাদেরই নির্বাচিত করা হয়েছে—পঞ্চজন অর্থাৎ জনসাধারণের প্রতীক হিসাবে। তোমরা কৈশোরেই রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে বনে বনে ভিক্ষুকরূপে ঘুরে বেড়িয়েছ, কারও সাহায্য ব্যতিরেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী করতে পেরেছ—তোমরাই এই প্রতিনিধিত্বের যোগ্য! এমন কি পরবর্তীকালেও সর্বস্বান্ত হয়ে অজিনবাস-ভিক্ষুকরূপে বনে প্রেরণ ক’রে বিধাতা প্রমাণ ক’রে দিলেন যে একেবারে নিঃসহায় সর্বস্বান্ত ব্যক্তিও ধর্মপথে থেকে চেষ্টা, একাগ্রতা, লক্ষ্যনিবদ্ধতা ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা এ পৃথিবীতে প্রবলতম শক্তির বিরুদ্ধেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। তুমি বা যুধিষ্ঠির এই ঐশীকর্মচক্রের, দৈববিচারের যন্ত্রাংশমাত্র, যন্ত্রী নও। প্রকৃতপক্ষে যারা নিহত হবে ভেবে তুমি শোক বিহ্বল হয়েছে, তারা নিহত হয়েই আছে, বিনাশের জন্য পূর্ব-চিহ্নিত। তোমরা তার নিমিত্তমাত্র। এ যুদ্ধে এরা কেউই বাঁচবে না, তোমরাও লাভবান হবে না। সর্বস্বজনরিক্ত হয়ে মহাশ্মশানে রাজত্ব ক’রে তৃপ্তি বা সার্থকতা এমন কি জয়ের আনন্দও লাভ হবে না—তা আমিও জানি। এরা সকলেই মৃত, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি দেখছি। কিন্তু তাতেই বা কি? এর জন্য আমি কোন দুঃখ কি উদ্বেগ বোধ করছি না। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে, দেশের ও উৎপীড়িত নিঃস্ব বঞ্চিত দেশবাসীর কল্যাণে তোমাদের কটা প্রাণের বা সুখের কি মূল্য? ওঠ, অস্ত্র ধারণ কর, ভবিষ্যৎ কালের যুগযুগান্তের মানুষের সামনে আদর্শ স্থাপন কর।

‘আর, তোমার এত কর্তৃত্বাভিমান কেন? তোমার শক্তিসামর্থ্য কতটুকু? মানুষ তার কর্মফলে সুখদুঃখ ভোগ করে, নিধন করে বা নিহত হয়। এতই যদি তুমি শক্তিমান তো তোমাদের বারম্বার দুর্দশা, রিক্ততা, বঞ্চনা সহ্য করতে হবে কেন? তুমি যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করেছ, তোমার কর্তব্য যুদ্ধ করা, তুমি সেই কর্তব্য পালন ক’রে শিক্ষা-ঋণ শোধ কর। কর্মই হ’ল যথার্থ পুরুষের ধর্ম, সেই ধর্ম আচরণ কর। ভবিষ্যতে কি হবে তা কেউই জান না, তা নিয়ে চিন্তা করা নিরর্থক। আমাকে তুমি নাকি ভক্তি কর? বেশ তো, সর্ব কর্ম এবং তার ফল আমাকেই সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হও।…যুগে যুগে এমন হয়, যখনই অধর্মের চরম অভ্যুত্থান এবং ধর্মের কুৎসিত গ্লানি উপস্থিত হয়—সাধারণ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অত্যাচারী অধার্মিকদের হাতে লাঞ্ছিত হয় তখনই দৈবরোষ জাগ্রত হয়, তার প্রতিকারের জন্য মানুষের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ ও বাধা দেখা দেয়। অন্ধকার ভবিষ্যৎ কল্পনা ক’রে কর্মে নিবৃত্ত হওয়া অমানুষের, নপুংসকের শোভা পায়, তোমাতে তা পায় না।’

এমনি আরও বহু তিরস্কার করলেন বাসুদেব। জগৎসৃষ্টি ও মনুষ্য-জীবন—তার কর্ম ও কর্মফল সম্বন্ধে কিছু বিশুদ্ধজ্ঞানও দিলেন। মনুষ্যের প্রজ্ঞা, দৃষ্টি ও শক্তি কত সীমিত, সে সম্বন্ধে অর্জুনের মানসিক তমিস্রা দূরীভূত করলেন। এ বিশ্বসংসারে নিত্য যা ঘটছে তার কর্তৃত্ব মানুষের কতটুকু নিয়ন্ত্রণসাধ্য, কত অকিঞ্চিৎকর সে বিষয়ে সচেতন ক’রে দিলেন। এই অনন্তবিশ্ব—যাকে ব্রহ্মাণ্ড বলা হয়—তার নিয়ন্তা যে ব্রহ্ম, যিনি সগুণ ও নির্গুণ দুই-ই—অর্থাৎ তিনিই সব করছেন অথচ তিনি নিস্পৃহ, নিরাসক্ত, নিষ্ক্রিয়, এই দিব্যজ্ঞানে অর্জুনকে প্রবুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। ওঁর সেই কুরুবিন্দকঠিন* একান্ত নৈর্ব্যক্তিক অসম্পৃক্ত অথচ রোমাঞ্চকর-বিস্ময় জাগ্রতকারী বাণী শুনতে শুনতে অর্জুনের উপলব্ধি হ’ল—এ সন্দেহ তিনি পূর্বেও বহুবার করেছেন—এবার নিশ্চিত বিশ্বাস হ’ল, বাসুদেব বার বার যে অমানবিক বা ঐশীশক্তির উল্লেখ করেছেন, উনিই তার প্রতিনিধি অথবা স্বয়ং সেই শক্তির নিয়ন্তা। অর্জুনের বহুভাগ্যে বন্ধুরূপে, তাঁর সামান্য দারুনির্মিত যুদ্ধরথের শুধু নয়—জীবনরথেরও চালকরূপে ধরা দিয়েছেন। এ সৌভাগ্য দুর্লভ নয়—অলভ।

[* কুরুবিন্দ—অতি কঠিন রত্নপ্রস্তরবিশেষ, পূর্বে যার সাহায্যে হীরা-মানিক প্রভৃতি মণিরত্ন কাটা হত।]

এই বিপুল বিশ্ব যাঁর ইঙ্গিতে ইপ্সায় সৃষ্ট হয়েছে, চালিত হচ্ছে, আবার যাঁর ইচ্ছা হলে এক নিমেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যিনি এই বিশ্বেই ওতপ্রোতভাবে মিলিত আছেন অথচ এর কোন কর্ম বা কলুষ যাঁকে বিচলিত করতে বা স্পর্শ করতে পারে না—এ জীবনের বাক্য মন বা চিন্তায় যাঁকে বর্ণনা করা, প্রকাশ করা কি উপলব্ধি করা যায় না, যিনি অব্যক্ত, অক্ষর, নিরুপাধি পরমব্রহ্ম সেই পরমেশ্বরই কি আজ তাঁর সম্মুখে!

অর্জুন, সম্মোহিতের ন্যায়, ভীতবিহ্বল চিত্তে পুনরায় শরাসন তুলে নিলেন।

.

অতঃপর সংখ্যাগণনাহীন শঙ্খনাদে ও শূরগণের আস্ফালনসিংহনাদে ধরা কম্পিত ক’রে উভয়পক্ষই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন—এমন সময় আর এক বিস্ময়কর ঘটনার অবতারণা হ’ল।

আবারও এক অভাবনীয় নাটকীয়তা। ফলে এ পক্ষে দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা ও লজ্জা, ওপক্ষে ক্ষণস্থায়ী বিজয়োল্লাস দেখা দিল। এপক্ষে বার বার প্রশ্নের উত্তাল তরঙ্গ আহত হতে লাগল আকাশবেলাভূমে—ওপক্ষে ধিক্কার ও বিদ্রুপ।

এ-অবস্থার কারণও যথেষ্ট। দেখা গেল অকস্মাৎ—ঠিক প্রথম অস্ত্র নিক্ষেপের মুহূর্তটিতে যুধিষ্ঠির তাঁর বর্ম চর্ম আয়ুধ প্রভৃতি পরিত্যাগ ক’রে নিজ যুদ্ধরথ হতে অবরোহণপূর্বক কৃতাঞ্জলিপুটে পদব্রজে কৌরবব্যূহের দিকে গমন করছেন। কৌরবপক্ষ এ কর্মকে শেষ মুহূর্তের আতঙ্কের ফল বলে মনে করবেন এ নিতান্ত স্বাভাবিক। কৌরবদের এই মহারথী- সমাবেশ ও বিপুলতর সৈন্যসংখ্যা—যা দৃষ্টিসীমার সীমান্ত অতিক্রম ক’রে গেছে—এতদিন ঠিক হয়ত এটা কল্পনা করতে পারেন নি, আজ বাস্তবে দেখে ভীতিবিহ্বল হয়ে করুণাভিক্ষা ও সন্ধিপ্রার্থনা করতে যাচ্ছেন নিশ্চয়। ধিক্কার ও বিদ্রুপ সেই কারণেই।

পাণ্ডবরাও এটাকে ভীতিজনিত দুর্বলতা বলেই কল্পনা করেছেন। একেবারে এই চরমক্ষণে এই ঘোরতর যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিপুলতা ও ব্যাপকতা দেখে এবং তার পরিণতি কল্পনা ক’রে নিশ্চয় মতিভ্রম ঘটেছে মহারাজ-চক্রবর্তীর। তাঁর পক্ষের যুদ্ধাধিপতিগণ উচ্চঃস্বরে প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘হে মহারাজ, যুদ্ধকাল সমুপস্থিত, বৈরীগণ অস্ত্রত্যাগে উদ্যত, এ সময় আপনি আমাদের ব্যূহ পরিহার ক’রে কোথায় চলেছেন? প্রতিনিবৃত্ত হোন, প্রতিনিবৃত্ত হোন!

কিন্তু সে প্রশ্ন উভয়পক্ষের ভেরী, তূরী, দামামা, শঙ্খ ও সিংহনাদ এবং সমবেত উদ্বিগ্ন উত্তেজিত কণ্ঠস্বরেই নিমজ্জিত হ’ল, তা যুধিষ্ঠিরের কর্ণগোচর হওয়া সম্ভবও ছিল না। তখন ভীম, নকুল, অর্জুন, সাত্যকি প্রভৃতি রথ থেকে নেমে তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টায় তাঁর অনুগমন করতে লাগলেন। রথ থেকে নামলেন শ্রীকৃষ্ণও—কিন্তু সে অর্জুনকে নিবৃত্ত করতেই, হস্তস্পর্শে তাঁকে বিরত ক’রে অভয় ইঙ্গিত করলেন—অর্থাৎ ‘তোমরা যা কল্পনা করছ তা নয়।’ তাঁর স্মিতপ্রসন্ন মুখ দেখে বোঝা গেল এ অদ্ভুত আচরণের মর্ম তিনি বুঝেছেন, এবং এতে এত ব্যস্ত হবার কোন প্রয়োজন নেই।

অবশ্য সে অর্থ অপর সকলে বুঝল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। দেখা গেল বিশেষ ভাবে ভীষ্মের রথসান্নিধ্যই যুধিষ্ঠিরের গন্তব্য লক্ষ্য। যতবাক সেই ধর্মাত্মা পিতামহের রথের পার্শ্বে গিয়ে ভূমি থেকে তাঁকে পাদস্পর্শ প্রণাম ক’রে বললেন, ‘আমরা এখনই আপনার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হব, আপনি দয়া ক’রে অনুমতি দিন ও আশীর্বাদ করুন।

ভীষ্ম দক্ষিণহস্তে অভয়ভঙ্গী ক’রে বললেন, ‘বৎস, তুমি আমাকে প্রণাম না ক’রে যুদ্ধ আরম্ভ করলে আমি অবশ্যই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হতাম। এখন প্রসন্নমনেই আশীর্বাদ করছি, তুমি ধর্ম ও ন্যায়ানুসারে যুদ্ধ কর, অবশ্যই তোমার জয়লাভ হবে। দেখ, পুরুষ কেবলমাত্র অর্থেরই দাস—আর কারও বা আর কিছুর দাস নয়। কৌরবরা আমাকে অর্থ দ্বারা বদ্ধ করেছে সেই কারণেই আমি অন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছি। আশা করছি, তুমি আমার অবস্থা বুঝে দেখে আমার সম্বন্ধে মনে কোন ক্ষোভ বা অসন্তোষ পোষণ করবে না।’ ।

সেখান থেকে পুনঃপ্রণাম ক’রে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের কাছে গেলেন, তারপর কৃপাচার্য এবং মাতুল শল্যের কাছেও। তাঁরা সকলেই যুধিষ্ঠিরের এই বিনয় এবং বিদ্বেষহীনতায় তুষ্ট হলেন এবং মুক্তকণ্ঠে তাঁকে আশীর্বাদ ও তাঁর জয়কামনা করলেন।

এইভাবে কর্তব্য সম্পন্ন ক’রে নিজের রথে প্রত্যাগত হবার পথে পুনরায় কি মনে হল, তিনি কৌরবদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘এখনও সময় আছে, আপনাদের মধ্যে থেকে যদি কেউ এ-পক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে চান, অকুণ্ঠিতচিত্তে চলে আসুন, আমি তাঁকে সাদর সসম্মান আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’

তখন দুর্যোধনেরই এক ভ্রাতা, যুযুৎসু— কৌরবব্যূহমধ্যস্থ তাঁর স্থান থেকে বেরিয়ে মধ্যের অচিহ্নিত শূন্যস্থানে এসে বেশ স্পষ্ট কণ্ঠেই বললেন, ‘আমি আপনাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি, কারণ আপনাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। আপনি কি আমাকে গ্রহণ করবেন?’

যুধিষ্ঠির আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দুই বাহু প্রসারিত ক’রে বললেন, ‘ভাই, আমি তোমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি তোমার এই সত্য ও ন্যায়সঙ্গত কর্মে যে কী প্রকার অহ্লাদিত এবং নিজেকে ভাগ্যবান বোধ করছি—তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কে জানে, হয়ত তোমার দ্বারাই মহামনা ধৃতরাষ্ট্রের পিণ্ডরক্ষা হবে।’

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে যতই আশ্বস্ত ও আশীর্বাদ করুন—প্রথম দিনেই তিনি যুদ্ধে যে সংহারমূর্তি ধারণ করলেন তা ধারণাতীত। এমন কি কৌরবরাও এতটা আশা করতে সাহস করেন নি। তাঁর এই পরিণত বয়সে—যখন মনুষ্যমাত্রেই স্থবিরত্ব প্রাপ্ত হয়—তিনি যে এতখানি তৎপর ও ক্লান্তিহীন আছেন তা কে জানত! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাটের পুত্র —অর্জুনের স্নেহভাজন উত্তর নিহত হলেন। অতঃপর উত্তরের অগ্রজ ক্রদ্ধ শ্বেত ভীষ্মের সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে অবতীর্ণ হয়ে ভয়ঙ্কর সংগ্রাম আরম্ভ করলেন বটে কিন্তু দুর্যোধনাদি রথীবৃন্দ এসে ভীষ্মের পৃষ্ঠরক্ষা করায় শেষ পর্যন্ত তিনিও উত্তরের দশাই প্রাপ্ত হলেন।

অর্জুন-তনয় অভিমন্যু—ষোড়শবর্ষীয় তরুণ মাত্র—তিনি পূর্বেই স্পর্ধা প্রকাশ করেছিলেন যে পিতা ও পিতৃব্যগণ সুখে বিশ্রাম করুন, তিনি একাই এ যুদ্ধ পরিচালনা ক’রে বিপক্ষকে পরাজিত করতে পারবেন ভীষ্মের এই রুদ্রমূর্তি দেখে প্রথম তিনিই ক্রদ্ধ হয়ে ভীষ্মের দিকে ধাবমান হলেন। তাঁর পিঙ্গলবর্ণ তেজস্বী অশ্বচতুষ্টয়বাহিত ও কর্ণিকার-কেতু- শোভিত সুবর্ণবর্ণের রথ বহুদূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, এখন সেই রথ তাঁর দিকেই আসছে দেখে, অভিমন্যুর প্রপিতামহ সকৌতুক সস্নেহ হাস্য করলেন মাত্র, এই কিশোরের অস্ত্রধারণের সহজাত ভঙ্গী দেখে যথেষ্ট প্রীতও হলেন —প্রথম কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন বালককে পরিহার করার—সারথি ও সঙ্গীদের উপরই অস্ত্র নিক্ষেপ করার—কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই বুঝলেন এই যোদ্ধা বয়সে বালক হলেও রণকৌশলে প্রাজ্ঞ—কারণ অতি অল্পসময় মধ্যে সে সৃষ্টির অন্তিম শিবতাণ্ডবের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু ও ধ্বংসলীলার এক প্রলয়ঙ্কর রূপ প্রকট ক’রে সত্যই যেন নৃত্য ক’রে বেড়াতে লাগল। তখন আর ভীষ্ম প্রতিযোদ্ধা কিশোরবয়স্ক বলে তাকে অবহেলা বা অগ্রাহ্য করতে কি প্রশ্রয় দিতে সাহস করলেন না, অতঃপর বৃদ্ধ ও বালকে— প্রপিতামহ ও প্রপৌত্রে এক বিস্ময়কর যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। অভিমন্যুর হস্তকৌশল ও বাহুবল দেখে শুধু ভীষ্ম নন—কৃপাচার্য, কৃতবর্মা, শল্য প্রভৃতি অভিজ্ঞ ও বয়স্ক যোদ্ধারাও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে এ বালক অর্জুনেরই পুত্র বটে—সর্বাংশে তাঁর শক্তি লাভ করেছে। কালক্রমে হয়ত অর্জুন অপেক্ষাও দুর্জয় যোদ্ধা হবে।

কিন্তু তবু সে বালকই—ভীষ্মের রথধ্বজ নিপাতিত করে তাঁকে শরজালে আচ্ছন্ন ও বিব্রত করতে ভীষ্মও উত্তেজিত হয়ে এমন অস্ত্রনিক্ষেপ আরম্ভ করলেন যে পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথীগণ অভিমন্যুকে রক্ষার জন্য ছুটে এলেন–এলেন এ পক্ষের প্রবীণ প্রধান যোদ্ধারাও, ফলে যুদ্ধ যেন সেইখানেই কেন্দ্রীভূত হ’ল, অভিমন্যুর একক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ রইল না। পরন্তু বিরাট পুত্র উত্তর ও শ্বেত ভগিনীপতিকে বিপন্ন দেখে তাকে আচ্ছাদিত ও নিরাপদ করতে এসে সংহারমূর্তি ধারণ ক’রে শল্যকে বিপর্যস্ত ও স্বয়ং ভীষ্মকে রথসারথিহীন করলেন। ভীষ্মও এবার সত্য সত্যই ক্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। ফলে এই দুজন আশ্চর্যকর্মা যোদ্ধাই যে নিহত হলেন তাই নয়, সূর্যাস্তকালে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে প্রভঞ্জনমুখে পক্ক শস্যশীর্ষের মতো পাণ্ডবপক্ষীয় রথী ও পদাতিকগণ ভূপাতিত হতে লাগলেন—কত যে ক্ষয়ক্ষতি হ’ল তার ইয়ত্তা রইল না। পাণ্ডবসৈন্যরা ভীত ও ভগ্নমনোরথ হয়ে উদভ্রান্তের মতো আর্তনাদ করতে করতে ইতস্তত পলায়ন করতে লাগল। আর ভীষ্মও সেই উত্তম অবসরে তাদের যথেচ্ছ বধ করতে লাগলেন। তাঁর বায়ুবেগ- পরাজয়কারী দ্রুত-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রজালে আকাশে যেন কৃত্রিম মেঘের সৃষ্টি হ’ল। আর কিছুক্ষণ এমন অসম যুদ্ধ চলতে থাকলে অকারণে অধিক সংখ্যক লোকক্ষয় হবে বুঝে ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ অবহারধ্বনি করলেন—সাধারণ যোদ্ধারাও তৎক্ষণাৎ যে যেখানে পারল শুয়ে পড়ল। প্রকৃষ্ট বিশ্রামস্থানে গমন বা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের কথা চিন্তা মাত্র করতে পারল না।

প্রথম দিনেই যুদ্ধের এই গতিপ্রকৃতি দেখে যুধিষ্ঠির একেবারেই ভেঙে পড়লেন। তিনি এতাবৎ কোন বৃহৎ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন নি, রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে তাঁর ভ্রাতারাই দিগ্বিজয়ে গিয়েছিলেন—সুতরাং এমন ব্যাপক নরবধ ইতিপূর্বে কখনও প্রত্যক্ষ করেন নি। আহতদের আর্তনাদে, মুমূর্ষুদের অস্ফুট মৃত্যুযন্ত্রণাপূর্ণ কাতরোক্তিতে এবং জীবিত আত্মীয়-

বান্ধবদের ক্রন্দনে আকাশবাতাস যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সদ্যপাত রুধিরের গন্ধে বিবমিষা উপস্থিত হ’ল। তিনি শিবিরে ফিরে আকুলভাবে বিলাপ করতে লাগলেন এবং বার বার ঘোষণা করতে লাগলেন যে এতদপেক্ষা চীরবল্কল ধারণ ক’রে অচিরে বনগমনই তাঁর ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয়। ‘গ্রীষ্মকালের অগ্নি যেমন নিমেষপাতকালে বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে শুষ্ক তৃণরাশি দগ্ধ করে, ভীষ্ম তেমনই আমাদের সৈন্য বিনষ্ট করছেন। ওঁর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াই আমাদের পক্ষে বাতুলতা হয়েছে। এখনও সময় আছে—এ যুদ্ধে বিরত হলে বহু প্রাণনাশ মিত্রনাশ আত্মীয়নাশ বন্ধ হতে পারে। বাসুদেব, সব্যসাচী অর্জুন এই মৃত্যুবন্যা রোধ করতে পারতেন কিন্তু মমতাবশে তিনি যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছেন না। এক্ষেত্রে আমার কি করণীয় বল।’

শ্রীকৃষ্ণ মৃদু অনুযোগের সঙ্গে সান্ত্বনা যোগ ক’রে বললেন, ‘মহারাজ, উভয়পক্ষই যেখানে প্রবল সেখানে একদিনেই কিছু যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয় না, অন্তিম ফলাফলও অনুমান করা যায় না। আপনি অকারণ কাতর হচ্ছেন। আপনার পক্ষেও যোদ্ধা কম নেই, তাঁরা প্রাণপনেই যুদ্ধ করবেন। আপনি তো ইতিপূর্বেই শ্রবণ করেছেন—বিশিষ্ট ভবিষ্যদ্বক্তামুখে যে—শিখণ্ডী ভীষ্মের ও ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণ-বধের কারণ হবেন। এঁরা উভয়েই আপনাদের পক্ষে, তবে আপনি এত ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? এই রথী মহারথী নৃপতিদের মধ্যে বহু পাপিষ্ঠও এখানে সমাবিষ্ট হয়েছেন—সাধারণ প্রজাদের শান্তির ও ভারতভূমির মঙ্গলের জন্য তাঁদের মৃত্যুই প্রয়োজন। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী না হলে সে সুফল আশা করা যায় না। আর অর্জুন? তিনি আজ হয়ত জ্ঞাতি-আত্মীয় মমতাবশে কিছু দৌর্বল্য প্রকাশ ক’রে থাকবেন, হয়ত এ পর্যন্ত সে মমতা অপনোদিত হয় নি—এখনও প্রতিপক্ষ যে আত্মীয় সে তথ্য ভুলতে পারেন নি—কিন্তু এ ভ্রান্তি তাঁর থাকবে না—আপনি শান্ত ও নিশ্চিন্ত হোন।’

যুধিষ্ঠিরের অনুযোগেই প্রধানত–অর্জুন পরদিন প্রভাতে—যেন পূর্ব দিনের শৈথিল্যের ক্ষতিপূরণ করতেই—রণক্ষেত্রে কালান্তর মূর্তি ধারণ করলেন। ফলে কুরুপক্ষের অপরিমাণ লোকক্ষয় হতে লাগল। এমনকি দুর্যোধনের জ্যেষ্ঠপুত্র লক্ষ্মণ অল্পের জন্য ভীমের কবল থেকে পরিত্রাণ পেলেন। অপরাহ্নের দিকে দুর্যোধন মুখ অন্ধকার ক’রে গিয়ে ভীষ্মকে বললেন, ‘এ কী প্রকার ঘটনা ঘটছে—কিছুই বুঝছি না—আপনি ও যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ দ্রোণ উপস্থিত থাকতেও অর্জুন আমাদের তাবৎ সৈন্য বধ করছে। আপনার জন্যেই আমার যথার্থ হিতকামী বন্ধু কর্ণ অস্ত্রত্যাগ ক’রে দূরে অবস্থান করছেন, অথচ আপনার দ্বারাও কোন অভীষ্ট সিদ্ধ হচ্ছে না। অর্জুন যাতে নিহত বা যুদ্ধে অসমর্থ হয় আপনি সেই ভাবে যুদ্ধ করুন।’

ক্রোধে অপমানবোধে ভীষ্ম আরক্ত মুখে তখনই পুনশ্চ অর্জুনের সম্মুখীন হলেন। মনে হ’ল যেন সে প্রচণ্ড যুদ্ধ আকাশচারী অশরীরী প্রাণীরাও স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছেন। কিন্তু দুজনেই সমান যোদ্ধা। কোন পক্ষই অপর পক্ষকে দমিত বা বিপর্যস্ত করতে পারলেন না। তার ফলস্বরূপ সেদিনও সাধারণ সৈন্যমধ্যে হাহাকার উঠল, তবে কৌরবপক্ষেই বেশী।

মহাধনুর্ধর দ্রোণাচার্য যাতে ভীষ্মের সাহায্যার্থ তাঁর সমীপবর্তী হতে না পারেন সে ভার নিয়েছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন, তিনি প্রাণপণ প্রয়াসে বিপুল বিক্রমের সঙ্গে আক্রমণ ক’রে দ্রোণকে ব্যস্ত-বিব্রত রাখলেন। দ্রোণ বহু চেষ্টাতেও তাঁকে অতিক্রম ক’রে অর্জুনের সম্মুখীন হতে পারলেন না। এদিকে ভীমও সেদিন যেন সহস্ররথীর শক্তি প্রদর্শনে বদ্ধপরিকর। তিনি একাই প্রায় সমস্ত কলিঙ্গসৈন্য নিঃশেষ করলেন, শেষ পর্যন্ত কলিঙ্গরাজ নিজেও সপুত্র ভীমের হাতে নিহত হলেন। অধিকতর বিপর্যয় রোধ করতে ভীষ্ম দূর থেকে অস্ত্র নিক্ষেপ করে ভীমের রথাশ্বগুলিকে বধ করলেন, তার উত্তর দিলেন ভীম পিতামহের সারথিকে বধ ক’রে। ভীষ্মের রথের অশ্বচতুষ্টয় নিজেদের পরিচালকহীন বুঝে ভীত হয়ে রথসহ দ্রুত সমরের সেই কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে চলে গেল।

সেটাকে ভীষ্মের পশ্চাদপসরণ বা মৃত্যু কল্পনা ক’রে—সেই প্রায়ান্ধকার প্রদোষবেলায় দূর থেকে বিশেষ কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না—কুরুসৈন্য-মধ্যে মহা হাহাকার উঠল। অবস্থা বুঝে, এখন নিবৃত্ত না হলে যুদ্ধের গতি অধিকতর অবনতির দিকেই যাবে অনুভব ক’রে, দুর্যোধন অনিচ্ছাসত্বেও সেদিনের মতো যুদ্ধ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন।

.

কুরুপক্ষের দুই প্রধান ভীষ্ম ও দ্রোণ—সাধারণ সৈনিক ও নিম্নস্তরের রথী বা সেনানায়কদের হতাশা দূর ও মনোবল বৃদ্ধি করতেই যেন বদ্ধপরিকর হয়ে পরের দিন যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। সেদিনের যুদ্ধের সে উগ্রতা ও ব্যাপকতা দেখে সকলেই বিস্মিত ও ভীত হলেও দ্বিপ্রহর কাল পর্যন্ত কোন পক্ষেই কোন দুর্বলতা প্রকাশ পেল না। দেখতে দেখতে মনুষ্য ও হয়-হস্তীর মৃতদেহে স্তূপ রচিত হ’ল, রুধিরে ভূমি পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে উঠল।* ইতিমধ্যে একসময় ভীমের অব্যর্থ শরাঘাতে দুর্যোধন হতচেতন হয়ে রথের মধ্যেই পড়ে গেলে সারথি আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে নিয়ে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করল। তার ফল এক্ষেত্রে যা হয়, পরাজয় বা মৃত্যু কল্পনা ক’রে তাঁর সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রাণভয়ে ইতস্তত পলায়ন করতে লাগল।

[* ‘কাঞ্চন অনুত্রাণ, কিরীট ও ধ্বজা সকলের পতনধ্বনি, শৈলে শিলাপতনের শব্দসদৃশ প্রতীয়মান হইল। শত শত সহস্র সহস্র মস্তক ও ভূষণশোভিত বাহুসকল ভূতলে পড়িয়া বিচেষ্টমান হইতে থাকিল। কোন কোন পুরুষ গৃহীতাস্ত্র, কেহ বা উদ্যতাস্ত্র ভাবেই ছিন্নমস্তক হইয়া তদবস্থই রহিলেন। রণক্ষেত্রে মনুষ্য, অশ্ব ও হস্তীশরীর হইতে সমুৎপন্না, গৃধ ও গোমায়ুর হর্ষবর্ধিনী রুধিরবাহিনী মহা স্রোতস্বতী ঘোরা নদী উৎপন্ন হইল। মাতঙ্গের অঙ্গ সকল যেন ঐ সকল নদীর শিলা, শোণিত উহার সরিৎ এবং উহা পরলোকরূপ সাগরাভিমুখে বহমানা হইল। পরিকীর্ণ কবচ ও শিরস্ত্রাণসমূহ দ্বারা রণস্থল শরৎকালের নভস্থল-সদৃশ শোভমান হইল।’

মহাভারত, ভীষ্মপর্ব। বর্ধমান রাজসংস্করন ]

কিছু পরে সংজ্ঞা লাভ করে দুর্যোধন আবার রণক্ষেত্রে ফিরে এসে কিছু রূঢ়ভাবেই ভীষ্মের কাছে অনুযোগ করলেন, ‘পিতামহ, আপনি দ্রোণ ও কৃপাচার্য আমাদের পক্ষে সশস্ত্র উপস্থিত থাকতেও কুরুসৈন্য পলায়ন করে—এর চেয়ে আশ্চর্য ও পরিতাপের বিষয় কি হতে পারে? ও পক্ষে আপনাদের সমকক্ষ কেউ নেই, তথাপি তারা অবাধে আমাদের সৈন্যক্ষয় করছে দেখলে মনে হয় আপনি তাদের মঙ্গল-চিন্তাতেই অধিকতর মগ্ন। এমতাবস্থায় আপনার পূর্বেই বলা উচিত ছিল যে ‘আমি পাণ্ডব, শিনি* ও পাঞ্চালদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না।’ আপনি ও আচার্যদেব আপনাদের মনোভাব স্পষ্ট ব্যক্ত করলে আমি কর্ণর সঙ্গে পরামর্শ ক’রে ইতিকর্তব্য স্থির করতাম, এভাবে বিনষ্ট হতাম না।’

[* শ্রীকৃষ্ণ-বংশের শাখা, সাত্যকি যাঁদের অধিনায়ক।]

দুর্যোধনের এই অর্বাচীনবৎ স্পর্ধা ও কটূক্তিতে ক্রদ্ধ ভীষ্মের দুই চক্ষু আরক্ত হয়ে উঠল—অতিরিক্ত ক্রোধজনিত একপ্রকার নিরানন্দ হাস্য-সহকারে তিনি বললেন, ‘রাজন, তোমাকে আমি ইতিপূর্বে বহুবার বলেছি—শ্রীকৃষ্ণ যাদের সহায় ও সখা, উপদেষ্টা— সেই পাণ্ডবরা যুদ্ধে সুরাসুর সকলেরই অপরাজেয়। তাদের শত্রু না ক’রে সামান্য কিছু ভূখণ্ড দিয়ে মিত্র করলে তোমরাও ভারতভূমিতে সকলের নেতা এবং অপরাজেয় হয়ে থাকতে পারতে। সে কথা শোন নি, এখন মহাবিনষ্টিকালে আমাকে দোষারোপ করলে কি হবে? যাক, তবু আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আজকের যুদ্ধে পাণ্ডবসৈন্য পরাভূত ও ছত্রভঙ্গ হবে, এ যুদ্ধ চিরকাল যোদ্ধা মানবগণ স্মরণ রাখবেন।’

অতঃপর তিনি বিপুল সৈন্যদল নিয়ে অর্জুনকেই যেন বিশেষ করে প্রচণ্ড আক্রমণ করলেন। সত্যই এমন যুদ্ধ এই সকল মহাধানুকী নৃপতিরাও তাঁদের জীবিতকালের মধ্যে কখনও প্রত্যক্ষ করেন নি, পিতৃপুরুষের মুখে এমন কাহিনী শুনেছেন বলেও কারও মনে পড়ল না। ক্রদ্ধ ভীষ্মের হুঙ্কারে গর্জনে ধনুকের টনৎকারে, শঙ্খরবে বোধ হল প্রলয়কাল সমুপস্থিত। তিনি নিমেষে নিমেষে শত শত শরবর্ষণে অর্জুনকে ক্ষতবিক্ষত শোণিতাক্ত এবং আকাশমণ্ডল অন্ধকার ক’রে ফেললেন। এতই তাঁর শর গ্রহণ ও প্রয়োগের ক্ষিপ্রতা যে খুব নিকটস্থ স্বপক্ষীয় ব্যক্তিও তাঁর শরত্যাগ দেখতে পাচ্ছিল না। অক্ষিগোলক থেকে একবারের ছায়া অপসারিত হওয়ার পূর্বেই আরও অন্তত সপ্তসংখ্যক শর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অমোঘ শরাঘাত থেকে রথ ও রথীকে রক্ষা করতে ইন্দ্রজাল প্রদর্শনীর মতোই অশ্বচালনা-কৌশল অবলম্বন করলেন—দক্ষিণে বামে অগ্রে বা পশ্চাতে কখন কোথায় যাচ্ছেন বা যাবেন, কখন অশ্বগণকে যুগপৎ‍ জানু অবলম্বী করবেন তা কেউ অনুমানও করতে পারছিল না। তবু ভীষ্মের অমানুষিক অস্ত্র নিক্ষেপ-পারঙ্গমতা থেকে অর্জুন অব্যাহতি পাচ্ছিলেন না।…

পাণ্ডবপক্ষীয় অপর যোদ্ধারাও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে ছিলেন না,—কিন্তু ভীষ্মের যা ভয়ঙ্কর করাল রূপ—কারও সাধ্য হ’ল না তাঁর নিকটবর্তী হয় বা তাঁকে প্রতিরোধ করে। তিনি প্রায় সংহার মূর্তি ধারণ ক’রে রথোপরি তাথিয়া তাথিয়া নৃত্য করতে লাগলেন। সে সময় তাঁকে দেখে মনে হ’ল যেন সাক্ষাৎ মহাকাল রুদ্ররূপে ধ্বংসমহোৎসবে মত্ত হয়েছেন। সত্যিই বুঝি প্রলয় আসন্ন—কতকটা এই কল্পনায় নিদারুণ আতঙ্কবিহ্বল হয়ে যোদ্ধা ও সৈনিকরা আর্তরব করতে করতে সে স্থান থেকে পলায়ন করতে লাগল, পাণ্ডবদের ব্যূ একেবারেই ভগ্ন ও বিশৃঙ্খল হয়ে গেল।

শ্রীকৃষ্ণ আত্মরক্ষার প্রাণপণ প্রয়াসের মধ্যেই লক্ষ্য করছিলেন অর্জুন পিতামহ-নিক্ষিপ্ত অস্ত্র প্রতিরোধ করতে যতটা ক্ষিপ্রতা ও শিক্ষানৈপুণ্য দেখাচ্ছেন—ততটা ওঁকে প্রহার করতে নয়। অর্জুনের সর্বাঙ্গ শরাঘাতকণ্টকিত হওয়া সত্বেও তিনি শ্রদ্ধা ও মমতাবশত—এবং ভীষ্মের গৌরব স্মরণ ক’রে ওঁকে বিদ্ধ করতে দ্বিধা করছেন, সাধ্যমতো সে কর্তব্য পরিহার করে চলেছেন।

এদিকে পাণ্ডবপক্ষের এই ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখে সাত্যকি উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘এ কি! তোমরা এ কি করছ! হে সৈনিকগণ, ক্ষত্রিয় ও বীরের পরিচয়ে কলঙ্ক লেপন ক’রে তোমরা পলায়ন করছ! ভীষ্মের হাতে নিহত না হলে কি তোমরা অমর থাকবে? মৃত্যু তো অবধারিত, জীবমাত্রের পক্ষেই ধ্রুব। আর যখন রণক্ষেত্রে এসেছ—তখন তো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছ। বীরধর্ম ও পৌরুষধর্ম পালন না ক’রে এমন কাপুরুষতা প্রদর্শন করছ কেন?’ কিন্তু আর্তনাদ, অস্ত্রঝঙ্কার এবং হাহাকারের মধ্যে সাত্যকির কণ্ঠস্বর কারও শ্রুতিগোচর হ’ল না।

ক্রমশ যেন অর্জুনের চারিদিকেই সমগ্র কৌরবশক্তি সংহত ও কেন্দ্রীভূত হ’ল। দ্রোণ, বিকর্ণ, জয়দ্রথ, ভূরিশ্রবা, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য, পূর্বদেশীয় নৃপতিগণ, সৌবীরগণ, মালবগণ—সকলেই চারিদিক থেকে ওই একটি মাত্র রথ লক্ষ্য করে অস্ত্র বর্ষণ করতে লাগলেন। সেই মহদাশ্চর্য শস্ত্রলীলায় বায়ু উষ্ণ ও সধূম হয়ে তুমুল শব্দে বহমান হ’ল। সাধারণ রথী বা পদাতিকদের সে তেজ অসহনীয় বোধ হবে—এ স্বাভাবিক। বিশেষ অসংখ্য শরসমূহ আকাশেই অবস্থান করায় (একটি পাতিত হবার পূর্বেই অন্যূন সপ্ত সংখ্যক সেখানে উত্থিত হচ্ছে, অবতরণের বা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবার অবসর ও অবকাশ পাচ্ছে না) গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হয়ে দিবাভাগেই যেন রাত্রির অন্ধকার নেমে এল। পলায়নের পথও দেখা যায় না—ফলে নিজেদের রথচক্র ও অশ্বপদতলে নিজেরাই পিষ্ট হতে লাগল। শুধু অর্জুন নয়— এবার শ্রীকৃষ্ণের সর্বাঙ্গও শরবিদ্ধ হওয়ায় সেই অনিন্দ্য অবর্ণনীয় সুন্দর নীলাভ শ্যামদেহ ও অঙ্গের পীতাম্বর রুধিরাক্ত হয়ে রক্তপুষ্পশোভিত বোধ হতে লাগল।

তিনি আর দ্বিধা করলেন না। হুঙ্কার দিয়ে উঠে শিনিকুলপতি সাত্যকিকে বললেন, ‘যাক, যারা রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে চায় তারা করুক, যারা এখনও আছে তারাও চলে যাক—কোন কোটরে কি গহ্বরে গিয়ে ক্ষুদ্র প্রাণ রক্ষা করুক। পাণ্ডবপক্ষে আর কাউকেই যুদ্ধ করতে হবে না, আমি একাই ভীষ্ম দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে তাদের নিপাতিত করব।’

এই বলে তিনি তাঁর বিখ্যাত সুদর্শন নামক চক্রান্ত্রসহ এক-লম্ভে রথ থেকে ভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে সাক্ষাৎ কৃতান্তের মতো, ভীষ্মের রথাভিমুখে ধাবিত হলেন। তিনি একক— তবু সে সময় তাঁর সে ক্রদ্ধ প্রজ্বলিত প্রলয়াগ্নিবৎ মূর্তি দেখে আপাতবিজয়ী কৌরবপক্ষের ওই বিপুল বাহিনীও ত্রস্ত এবং বিমূঢ় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে যুদ্ধের ক্রমোখিত তীব্রগতিও যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে এক অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব ভয়ঙ্কর ঘটনার অপেক্ষা করতে লাগল।

মহাত্মা ভীষ্মের উপর এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হ’ল অন্যরূপ।

তিনি জড় কি নিষ্ক্রিয় রইলেন না, পরন্তু বোধ হ’ল তিনি এই ঘটনাটিরই প্রতীক্ষা করছিলেন। এক পলকপাত-মাত্ৰ কালে ধনুঃশর দূরে নিক্ষেপ ক’রে তিনি করজোড়ে সহাস্যে বাসুদেবকে আহ্বান করতে লাগলেন, ‘হে দেবেশ, হে চক্রপাণি মাধব, আগচ্ছতু। তুমি সকল প্রাণীর শরণ্য, সকলের পালন-ও রক্ষা-কর্তা, তুমি আমার জন্য স্বকর্ম ত্যাগ ক’রে আমাকে বধ করলে আমি গৌরবান্বিত বোধ করব। আমি এই ক্ষণেরই অপেক্ষা করেছিলাম। তুমি আমাকে নিহত করতে চাইলে আমি আর বিন্দুমাত্র জীবনেচ্ছা প্রকাশ করব না। এসো, আমাকে বধ করো—আমি ধন্য ও কৃতার্থ হই।’

ততক্ষণে অর্জুনও সাতিশয় লজ্জিত হয়ে লম্ভ প্রদান ক’রে এসে শ্রীকৃষ্ণের বাহু ধারণ করেছেন। কিন্তু শ্ৰীকৃষ্ণ তখন এতই ক্রদ্ধ হয়েছেন এবং এমন বেগেই অগ্রসর হচ্ছেন যে অর্জুন-সুদ্ধই সেই ভাবে বহু দূর যাওয়ার পর তাঁর গতি ঈষৎ মন্দীভূত হ’ল।

অর্জুন বলছেন, ‘বাসুদেব, তোমার কাছে করজোড়ে মিনতি করছি—’ তিনি সেইখানেই রুধিরাক্ত পতিতশরাকীর্ণ মৃত্তিকায় নতজানু হয়ে বসে পড়ে ওঁর চরণ স্পর্শ করেছেন—’তোমার চরণধারণ করছি, তুমি নিবৃত্ত হও। আমার অমনোযোগের ফলে যদি তোমাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে হয়, আমার লজ্জার ও কলঙ্কের পরিসীমা থাকবে না। আমি গাণ্ডীবের নামে শপথ করছি, আর বিন্দুমাত্র আমার শৈথিল্য দেখবে না। যুদ্ধে কাউকেই অব্যাহতি দেবো না—তা তিনি পিতামহই হোন বা আচার্যদেবই হোন। তুমি অস্ত্র সংবরণ করো। নতুবা স্বেচ্ছামৃত্যু ভিন্ন আমার গত্যন্তর থাকবে না।’

শ্রীকৃষ্ণ এবার মনে হ’ল সন্তুষ্ট হলেন। উদ্যত আয়ুধ সম্বরণ ক’রে অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে ফিরে এসে পুনশ্চ রথারূঢ় হয়ে অশ্ববলগা ধারণ করলেন।

তবে, তেমন কোন তীক্ষ্ণদৃষ্টি ব্যক্তি লক্ষ্য করলে দেখতে পেত— শুধু সন্তুষ্টি বা সাফল্যের তৃপ্তি নয়—তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে কেমন যেন একটু কৌতুকরেখাও ফুটে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *