১.২০ সঙ্কল্পিত যজ্ঞের পূত বেদীতে

২০

সঙ্কল্পিত যজ্ঞের পূত বেদীতে প্রারম্ভাগ্নি প্রজ্বলিত হওয়ার পূর্বেই সেই বিশাল সভার অন্তর্গ্রহে অন্য এক অগ্নি প্রধূমিত হয়ে উঠল।

প্রথম স্ফুলিঙ্গাকারে। কিন্তু কে না জানে উপযুক্ত উপাদান পেলে একটি মাত্র ক্ষুদ্র অগ্নিকণা বিপুল বহ্নিলীলায় পরিণত হতে বিলম্ব হয় না।

না, সে স্ফুলিঙ্গ যজ্ঞবিদদের অরণি-মন্থদণ্ডের সংঘর্ষে দেখা দেয় নি, সে অগ্নি যজ্ঞমূর্তিকে হবিনিষেকের কাজেও লাগে নি।

তার উপাদান হ’ল ঈর্ষা, যজ্ঞবাহন হলেন চেদীরাজ শিশুপাল। অনেকের আহত অভিমানের বাণীরূপ।

যজ্ঞের প্রাক্কালে যজ্ঞপতি যুধিষ্ঠিরের অভিষেক প্রয়োজন। তার পূর্বেও কিছু কৃত্য আছে। কোন কোন দেবতাকে স্মরণ করতে হয় তারপর ব্রহ্মা-ঋত্বিক-অধ্বর্যু-উদগাতা প্রভৃতির বরণ অর্ঘ্য নিবেদন করতে হয় পুরোহিত, সমাগত ঋষি ও প্রধান বিপ্রদের সেই সঙ্গে মাল্যচন্দনাদির অর্ঘ্য নিবেদন করতে হয় বিশিষ্ট অতিথিদের। এক্ষেত্রে রাজন্যবর্গই সেই শ্রেণীতে পড়েন।

বিশাল যজ্ঞসভা দারুণ হলহলা শব্দে পূর্ণ। তন্মধ্যে যাজক ও ব্রাহ্মণদের তর্কবিতর্ক, স্বীয় জ্ঞানপ্রদর্শনের আস্ফালনই অধিক। নৃপতিদের সাহঙ্কার স্পর্ধা প্রকাশের প্রতিযোগিতা তো আছেই—পারিষদদেরও কম নয়, বরং তাঁদের অহঙ্কার প্রকাশের কারণতালিকা যেন সমধিক।

কিন্তু ঋত্বিক পুরোহিত বরণ শেষ হলে, যখন বিধি অনুযায়ী অর্ঘ্য দেবার কাল উপস্থিত হ’ল—তখন অকস্মাৎ সেই বৃহদংশের সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল। আর সহসা এই নিস্তব্ধতায় ব্রাহ্মণগণও তাঁদের অন্তহীন তর্কবিতর্ক স্থগিত রেখে নির্নিমেষ কৌতূহলে এদিকে চেয়ে রইলেন। অর্থাৎ বিশিষ্ট অতিথি নৃপতিদের দিকে।

এ আকস্মিক নীরবতার কারণ আছে।

ভারতের সর্বপ্রান্তের ছোট বড়—স্বাধীন সামন্ত করদরাজা সকলেই সমাগত হয়েছেন। এঁদের প্রত্যেককেই কিছু অর্ঘ্যদান সম্ভব নয়। অবশ্যই নির্বাচিত কয়েকজনকে দেওয়া হবে। সে সৌভাগ্য কাদের ভাগ্যে? পাণ্ডবরা কাকে অগ্রাহ্য ক’রে কাকে সম্মান প্রদর্শন করবেন—কৌতূহল ও অধীর প্রতীক্ষা সেইজন্যই। রাজন্যবর্গের অলস কৌতূহল মাত্র নয় —তাঁদের কাছে এ সম্মান বা অবহেলার মূল্য অনেকখানি। যেটা প্রাপ্য বলে মনে করছেন সেটা না পেলে অসম্মানিত শুধু নয়—অপমানিত বোধ করবেন। সকলেরই কিছু না কিছু দাবি আছে। যাঁর ক্ষুদ্র রাজ্য, সামান্য ক্ষমতা, তিনিও মনে মনে বংশ-মর্যাদার অভিমান দিয়ে বিশালতর দাবি রচনা করছেন।

রাজবংশীয় বা ক্ষত্রিয় সমাজে বোধ করি ভীষ্মই প্রাচীনতম ব্যক্তি, তিনি রাজাদের এ মনোভাবের কথা বিলক্ষণ অবগত আছেন। যুধিষ্ঠির যে অর্ঘ্যদানের পূর্বে সে কর্তব্যবিধির কথা তাঁকেই প্রশ্ন করবেন, কিংকর্তব্য তাঁর কাছেই জানতে চাইবেন—তাও জানেন। তাই অনেক চিন্তা ক’রে সে সমস্যার সমাধানও ভেবে রেখেছেন।

যুধিষ্ঠিরও সত্যসত্যই—যথাসময়ে তাঁর সামনে এসেই—সে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন।

ভীষ্ম মনে মনে উত্তরটা ভেবে রাখলেও ক্ষণকাল মৌন থেকে উপস্থিত রাজন্যবর্গের দিকে একবার চেয়ে নিলেন, যেন ওঁদের মনোভাবের মৌখিক প্রতিচ্ছবির সঙ্গে নিজের বিচারটা মিলিয়ে নিলেন আর একবার। তারপর তাঁর অভ্যাসমতো ধীরে ধীরে বললেন, ‘গুরু, পুরোহিত, স্নাতক, সম্বন্ধী, সুহৃৎ ও রাজগণ—এঁরা সকলেই শুভ-কর্মারম্ভে অর্ঘ্যলাভের বা সম্মানিত হবার যোগ্য। এঁরা বহুদিন পরে অনুগ্রহ ক’রে আমাদের কাছে এসেছেন, এজন্য এঁদের অর্ঘ্য দিয়ে সম্মান প্রদর্শন কর্তব্য। তবে এই শ্রেণীর অভ্যাগতদের সংখ্যা যেরূপ বিপুল, সকলকে অর্ঘ্য দিতে গেলে আজকের দিন তো বটেই—পক্ষকাল লেগে যাওয়াও বিচিত্র নয়। তাই, আমার মতে, এঁদের প্রতিভূ হিসেবে কিছু কিছু প্রধান ব্যক্তিকে অর্ঘ্য দাও, কিন্তু তারও পূর্বে এ সভার যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ অভ্যাগত—তাঁকে সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য প্ৰদান করে তোমার কার্য আরম্ভ কর। আমার মনে হয় এ ব্যবস্থায় কেউ তোমার ত্রুটি ধরে ক্ষুণ্ণ হবেন না।’

এই সংখ্যাতীত অতিথিদের অর্ঘ্যদানের কথা চিন্তা করতে গিয়ে বিপুল কালব্যয়ের কথাটাই উৎকণ্ঠিত করেছিল যুধিষ্ঠিরকে। তিনি এখন যেন অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে করজোড়ে পুনঃপ্রশ্ন করলেন, ‘পিতামহ, সেক্ষেত্রে আপনিই সেই সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিকে চিহ্নিত করুন, যিনি এই সকল অতিথির মধ্যে প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাবার যোগ্য।’

ভীষ্ম বললেন, ‘যিনি অবনত মস্তকে সকলের পাদস্পর্শ করে সর্বজন-শ্রদ্ধেয় হয়েছেন, যার আগমনে এই সভা আলোকিত, এখানের বাতাস আমোদিত ও আহ্লাদিত হয়েছে— সেই শ্ৰীকৃষ্ণ ব্যতীত এ-প্রসঙ্গে তো আর কারও কথা মনে আসছে না। তুমি তাঁকেই ঐ অর্ঘ্য দান করো।’

ভীষ্মের এ প্রস্তাব যাঁদের কর্ণগোচর হ’ল–হওয়ার খুব বাধাও ছিল না, কয়েক জন উচ্চকণ্ঠ দৌবারিক নিযুক্তই ছিল, যারা সকল প্রয়োজনীয় প্রশ্নোত্তর সভার প্রান্তে প্রান্তে পুনঃউচ্চারিত ক’রে দূরতম স্থানে পর্যন্ত তার বার্তা পৌঁছে দেবে— তাঁদের অধিকাংশই হর্ষধ্বনি করে ভীষ্মকে সমর্থন করলেন। কিন্তু আর এক অংশ যে সকল নৃপতি পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষিত ও বৃষ্ণি বা যদুকুল সম্বন্ধে বিদ্বিষ্ট—তাঁদের মুখ ক্রোধে অঙ্গারবর্ণ ধারণ করল, তাঁরা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ ও করমুষ্ঠি বদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু অধিকাংশেরই অনুমোদন ও সহদেব কর্তৃক সেই শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যদানকার্য প্রত্যক্ষ করলেও—তখনই কোন প্রতিবাদ করতে সাহস করলেন না।

একমাত্র চেদীরাজ শিশুপাল ছাড়া।

সম্রাট জরাসন্ধর পাপ-সহচর শিশুপালের শৈশবে এক বিচিত্র ইতিহাস ছিল।

শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণ-বলদেবের নিকট-আত্মীয়, এঁদের পিতৃসা-সম্পর্কে ভ্রাতা। কিন্তু লোকটি যেমন পাষণ্ড তেমনি ক্রর। বিবেকবর্জিতও।

কিম্বদন্তী, এঁর জন্মের সময় চারটি হাত ও তিনটি চক্ষু ছিল। শুধু তাই নয়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্দভের ন্যায় উচ্চ শব্দ ক’রে উঠেছিলেন। অশুভ আশঙ্কা ক’রে ওঁর জননী ও জনক তখনই ওঁকে ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু দৈবজ্ঞ ভবিষ্যদ্বক্তারা এসে গণনা ক’রে বললেন, ‘আপনারা অযথা ভয় পাবেন না। এই শিশু কালে স্বাভাবিক মানুষের আকার ধারণ করবে। এবং যৌবন-প্রান্তে মহাবল পরাক্রান্ত যুদ্ধজীবী হবে। কোন ভগদবংশজাত মহাপুরুষ— এরই আত্মীয়—একে ক্রোড়ে করলেই এর অতিরিক্ত বাহু শুষ্ক হয়ে মিলিয়ে যাবে, তৃতীয় চক্ষুটিও নিশ্চিহ্ন হবে। সাধারণ মানুষের মতোই অবয়বপ্রাপ্ত হবে। তবে যার স্পর্শে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটবে, পরমায়ু পূর্ণ হলে তার আয়ুধেই এ নিহত হবে। এ-ই ভাগ্যলিপি, কোন কারণেই তার অন্যথা হবে না।

দৈবজ্ঞদের বাক্যে কিছুটা নিরুদ্বিগ্ন হয়ে চেদীরাজ-মহিষী নবজাতককে ক্রোড়ে তুলে নিয়ে স্তন্যদান করলেন এবং পালন করতে লাগলেন কিন্তু সম্পূর্ণ আশ্বাস লাভ করতে পারলেন না। ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের নিষ্ঠুর গণনা তাঁর দিন-রাত্রিকে বিভীষিকাগ্রস্ত করে রাখল।

সেই কারণেই তিনি শিশুকে সমাগত অতিথি আত্মজন ঋষি ব্রাহ্মণ সকলের ক্রোড়েই দিতে লাগলেন কিন্তু কারও স্পর্শেই কোন পরিবর্তন ঘটল না। কিছুকাল পরে একদা অন্যদেশ-যাত্রাপথে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণও কয়েক প্রহরের জন্য অতিথি হলেন এবং তাঁর পিতৃসা—কোন কিছু আশা না রেখে কতকটা অভ্যাসবশতই, কারণ বাসুদেব তখন তরুণবয়স্ক ভাগ্যান্বেষী মাত্র—শিশুকে তাঁর অঙ্কে স্থাপন করলেন। কিন্তু এইবারই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, আশ্চর্য ফল দেখা দিল। কণ্ঠস্বর তো স্বাভাবিক শিশুর মতো হয়ে গেলই,—অতিরিক্ত বাহু দুটিও সেই দণ্ড থেকে শুষ্ক ও বিবর্ণ হতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন-মূল শাখার মতো শুষ্ক সে দুটি বাহু একদা আপনিই খসে পড়ে গেল এবং তৃতীয় নেত্রবিবরও এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হল যে সেটি কোন স্থানে ছিল তা স্মরণ করা জননীর পক্ষেও কঠিন হয়ে উঠল।

তবে—এক দুশ্চিন্তা গত হলেও আর এক দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।

চেদীরাজ-মহিষী যেন অধিকতর উৎকণ্ঠিত হয়ে বাসুদেবকে আহ্বান ক’রে পাঠালেন। এবং শ্রীকৃষ্ণ এলে ওঁর দুটি কর ধরে অনুনয় জানালেন, ‘তুমি প্রতিজ্ঞা করো আমার পুত্রকে কোনদিন বধ করবে না!’

সেই বয়সেই—কংস-বধের পর যদুবংশকে তখন সুপ্রতিষ্ঠিত বা স্বতন্ত্র শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি শ্রীকৃষ্ণ, তৎসত্বেও—তাঁর রহস্যময় হাসি লোকের আলোচনার বস্তু হয়ে উঠেছিল। এদিকে তিনি তেমনি দুয়ে হাসি হেসে উত্তর দিলেন, ‘এ জগতে দেহধারণ করলেই সে দেহের নাশ অনিবার্য জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আপনার পুত্র অমর হতে পারে না।—এটা আপনিও নিশ্চয় স্বীকার করবেন। আমার দ্বারাই ওর বিনাশ যদি এই জাতকের ভাগ্যলিপি হয়—গণকরা যদি ভুল না ক’রে থাকেন তো তা হবেই। তবে আমি অকারণে কাউকে বিশেষ আত্মীয়কে—বধ করব, এমন আশঙ্কা করছেন কেন? যদি এই জাতক পরবর্তীকালে আমার কোন বিশেষ অনিষ্ট না করে বা আমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হয় তো ওকে বধ করবার তো কোন কারণ দেখি না। তবু, আপনার মনস্তুষ্টির জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমার সম্পর্কে ওর একশত অপরাধ ক্ষমা করব। তার পরও যদি কোন কারণে আমার অনিষ্টসাধন কি অবমাননা করে, তাহলে আর আমি দায়ী থাকব না।’

তখন এই আশ্বাসই যথেষ্ট বোধ হয়েছিল।

মাতারও, পুত্রেরও। কতকটা যেন সেই বলে বলীয়ান হয়েই শিশুপাল কৈশোরকাল থেকে দুর্বৃত্ততা ক’রে বেড়াচ্ছিলেন। দুর্জনের দুর্জন বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষকের অভাব ঘটে না। এমনিই কয়েকটি নাতিবৃহৎ রাষ্ট্রের স্বয়ংবৃত সেনাপতি হয়েছিলেন শিশুপাল।

স্বাভাবিক ভাবেই সব চেয়ে আক্রোশ বাসুদেবের ওপর। নানা প্রকারে তাই বিগত কয়েক বৎসর অকারণেই তাঁর যথেচ্ছ অবমাননা ও ক্ষতি ক’রে বেড়িয়েছেন শিশুপাল, নানা প্রকারে তাঁকে বিব্রত ও বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

সুযোগও পেয়েছেন বৈকি। শ্রীকৃষ্ণের ক্রমবর্ধমান বীর্য-খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ জরাসন্ধের সঙ্গে বৈরিতা তো সর্বজনজ্ঞাত হয়ে পড়েছিল। স্বর্ণলতা রসালকে অবলম্বন করে, বিষলতা কণ্টক- তরুর আলিঙ্গন খোঁজে। পাপও পাপের সাহচর্যের জন্য লালায়িত হয়। বিকৃতরুচি দুষ্ট ব্যক্তিই মন্দবুদ্ধির আশ্রয়দাতা হয়। শিশুপাল সেই কারণেই জরাসন্ধের পৃষ্ঠপোষকতা প্রার্থনা ও লাভ করেছিলেন। জরাসন্ধের নামে আরও অনেক নৃপতি —কিছুটা ভয়ে কিছুটা নিজেদের নিরাপত্তার আশায় তাঁকে সাহায্য করতেন।

জরাসন্ধের মৃত্যুতে যাদবদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধের সাহস দূরীভূত হলেও, তস্করের মতো গোপন উপায়ে ও কৌশলে শ্রীকৃষ্ণকে বিব্রত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার পন্থা ত্যাগ করেন নি শিশুপাল। এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞাকে উপায়হীনতা ভেবে যথেষ্ট আত্মশ্লাঘাও বোধ করতেন।

আজ সেই শিশুপালই জনার্দনের পূজার তীব্র প্রতিবাদ করবেন এতে আর আশ্চর্য কি? এবং সে প্রতিবাদ যে ইতর ও কদর্য গালিগালাজের রূপ ধারণ করবে সেও তো এক প্রকার সুনিশ্চিত।

কিন্তু সে গালিগালাজ শ্রীকৃষ্ণতেই কেন্দ্রীভূত রইল না।

তাকে উপলক্ষ ক’রে প্রধানত—এই নির্দেশ দিয়েছেন বলে—ভীষ্ম, ও সে নির্দেশ মান্য করেছেন বলে পাণ্ডবদের উপরেও বর্ষিত হতে লাগল। ।

ভীষ্ম বিবাহ করেন নি পিতৃভক্তিবশত কিন্তু শিশুপাল তাঁকে ক্লীব নপুংসক বলার সুযোগ ছাড়বেন কেন? শ্ৰীকৃষ্ণ এই অর্ঘ্য গ্রহণ করেছেন বলে তাঁকে আবর্জনাস্তূপে-নিক্ষিপ্ত-খাদ্যলোলুপ পথকুক্কুর বলতে দ্বিধা করলেন না। কিছু কিছু যুক্তিও দিলেন স্বপক্ষে। শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতার্থে নৃপতি নন, তাঁর মাতামহ উগ্রসেন এখন এই কুলের অভিষিক্ত নরপতি। বয়োবৃদ্ধ ধরলে কৃষ্ণের থেকে বয়স্ক লোক অসংখ্য আছেন, ভীষ্মই তো রয়েছেন। তিনি পাণ্ডব-কৌরবদের কুলপতি ও বটে। ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, শাস্ত্রগুরু কৃপ, বহুশাস্ত্রজ্ঞ অশ্বত্থামা, মহামানী রাজা দুর্যোধন, মাতুল শল্য, আত্মীয় দ্রুপদ, ভীষ্মক প্রভৃতি উপস্থিত থাকতে শ্রীকৃষ্ণ কোনক্রমেই এ অর্ঘ্য পেতে পারেন না। বিশেষ অতুলপ্রতাপ বিশ্বত্রাস জরাসন্ধ অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছেন—সে কেবল এই বিবেকহীন বীরধর্মপরাঙ্মুখ শ্রীকৃষ্ণের চক্রান্তে ও পরামর্শে। এই দুর্মতি ভদ্রসমাজে স্থান পাওয়ারই যোগ্য নয়।

সহদেব ছেলেমানুষ, অর্ঘ্য তিনিই হাতে ক’রে দিয়েছেন। তাঁর আর সহ্য হল না, বলে উঠলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের পূজা যে সহ্য করতে পারে না, আমি তার মস্তকে পদাঘাত করি।’

এতটা বলা উচিত হয় নি, বিশেষ তিনি হোতা-পক্ষের একজন। সভামধ্যে প্রতিবাদের একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল। যুধিষ্ঠিরও ‘ছি!’ বলে সহদেবকে অস্ফুট একটা ধিক্কার দিয়ে উঠে এসে বিনয়-বচনে মিষ্টবাক্যে শিশুপালকে নিরস্ত ও শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে সান্ত্বনাবাক্য যেন অগ্নিতে ঘৃত নিক্ষেপেরই কাজ করল। শিশুপাল অধিকতর ক্রদ্ধ ও প্রগলভ হয়ে উঠলেন। রাসভ-কর্কশ কণ্ঠে আরও গালিগালাজ ও স্পর্ধা প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁর দুঃসাহসে ভরসা সঞ্চয় করে বেশ কয়েকজন অন্য রাজা ও প্রধানগণও স্ব-স্ব আসন ত্যাগ ক’রে তাঁর সঙ্গে সভাগৃহের বাইরে আসার চেষ্টা করলেন।

এতক্ষণে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে ভীষ্মরও।

তিনি বললেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ কেবল আমাদেরই পূজ্য নন, সমস্ত বিশ্বেরই পূজনীয়। জন্মাবধি তিনি যেসব আশ্চর্য আশ্চর্য কর্ম করেছেন তেমন আর কবে কোথায় শোনা গেছে? পূতনাবধ তো একান্ত শৈশবের কথা। বাল্যে আরও কত দানবসদৃশ ভয়ঙ্কর দ্যসু পামর চক্রীকে নিহত করেছেন, গোবর্ধন পূজার সময় যাদবদের নেতৃত্ব ক’রে ইন্দ্রের দর্পচূর্ণ করেছেন—সে বৃত্তান্ত ওঁর যৌবনকালেই কিম্বদন্তীতে পরিণত হয়েছে। যখন কেবলমাত্র কিশোরবয়স্ক তখনই ইনি মহাবলপরাক্রান্ত দ্যসুরাজ কংসকে একক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত ক’রে মাতামহ উগ্রসেন, নিজ পিতামাতা এবং অন্যান্য বহু সজ্জন ক্ষত্রবীরকে ভয়াবহ কষ্টদায়ক কারাবাস থেকে মুক্ত করেছেন। জরাসন্ধ বধের জন্য যদি ইনি বাহুবল অপেক্ষা কৌশলের উপরেই অধিক নির্ভর করে থাকেন, তা এমন কিছু দোষাহ হয় নি। শত্রুবিশেষে বিভিন্ন যুদ্ধপদ্ধতি অবলম্বন করা নূতনও নয়, অশাস্ত্রীয়ও নয়। মানুষ শার্দূলকে নখদন্তে বিনষ্ট করবে তা সম্ভব নয়।… আর বৃদ্ধ? কেবলমাত্র বয়সে বৃদ্ধ হলেই সে প্রবীণ বা পূজ্য বলে গণ্য হয় না। জ্ঞানবৃদ্ধ, বলবৃদ্ধ, ধন বা সঙ্গতিবৃদ্ধ—এঁরাও বৃদ্ধ বলে গণ্য হন, এগুলিও বার্ধক্যের মান। শ্রীকৃষ্ণ সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, মানব-মানসাভিজ্ঞ, সাতিশয় বলশালী যোদ্ধা, এতকালে প্রভূত ঐশ্বর্যও সঞ্চয় করেছেন—সুতরাং সকল দিক দিয়েই তিনি এ সভার বৃদ্ধতম ব্যক্তি। শাস্ত্রে উল্লিখিত ষড়-প্রকার যোগ্যতার মধ্যে অধিকাংশ যোগ্যতা এঁর বিদ্যমান। গুরু, ঋত্বিক, স্নাতক, সম্বন্ধী, সুহৃৎ, নৃপতি–এর মধ্যে কমপক্ষে চারটি যোগ্যতায় এই অর্ঘ্য উনি দাবি করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের যোগ্যতায় যে সন্দিহান হয়—সে ঘোরতর অজ্ঞ ও নির্বোধ। তিনি এই সভাতেই উপস্থিত আছেন, যাদের মৃত্যু আসন্ন তারা ওঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেই দেখুক না, শ্রীকৃষ্ণের পরাক্রম কতদূর।’

আরও বহুক্ষণ এইভাবে উক্তি, প্রত্যুক্তি—কদৰ্য বাকযুদ্ধ চলল।

এই সমস্ত সময় শ্রীকৃষ্ণ নিজ আসনে স্থির ভাবে বসে ছিলেন। মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ রহস্যময় প্রসন্ন হাসি, দৃষ্টিতে ঔদাসীন্য বা নির্লিপ্ততা। ক্রমশ কদর্যতা চরমে পৌঁছে যজ্ঞের আয়োজন পণ্ড হবার আশঙ্কা দেখা দিতেই তিনি সহসা উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে তাঁকে দাঁড়াতে দেখে সব কোলাহল ও বিবদমান দুই পক্ষের বাগবিতণ্ডা সঙ্গে সঙ্গেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

শ্রীকৃষ্ণ গম্ভীর উচ্চনাদী কণ্ঠে বললেন, ‘সভাস্থ ঋষি ব্রাহ্মণবৃন্দ, আত্মীয়, সুহৃদ ও সমাগত সজ্জনবৃন্দ, আপনারা সকলে দয়া ক’রে শ্রবণ করুন। এই ব্যক্তি আমার আত্মীয়মধ্যে গণ্য। এর মাতার কাতরোক্তিতে আমি এর একশত অপরাধ ক্ষমা করব বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম—সে কাহিনী কিছু পূর্বে ভীষ্মমুখে আপনারা শুনেছেন। মাতৃঅঞ্চলাবৃত নিরাপত্তার ভরসায় শিশু যেমন স্পর্ধা প্রকাশ করে—এর অবস্থাও প্রায় তদ্রুপ। কিন্তু সে ধৃষ্টতা যদি কেবলমাত্র মৌখিক কটূক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকত, আমি অবহেলা করতাম—একশত অপরাধের সীমা অতিক্রম করা সত্বেও। কিন্তু এই মূর্খের স্পর্ধা চরমে পৌঁচেছে। এর দুর্বৃত্ততার পূর্ণ তালিকা দিতে গেলে এক প্রহরকাল অতিক্রান্ত হবে, তদপেক্ষা সময়ের অপব্যবহার আর কি হতে পারে? আমি সাম্প্রতিক দু-একটি পাশবিক আচরণের কথা উল্লেখ করব, তা থেকেই এর চরিত্র কেমন আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি ও আর্য বলদেব আমন্ত্রিত হয়ে যখন ভারতের অন্যপ্রান্তে প্রাগজ্যোতিষপুরে যাই তখন যদুবংশের দৌহিত্র হয়েও এই দুরাচার দ্বারকা উৎসাদিত ও দগ্ধ করে, লুণ্ঠন ও নারীদের অমর্যাদা তো বটেই। ভোজরাজ আমাদের অতিথি হয়ে রৈবতকে এসে কয়েক মাস ছিলেন, আমার ও বলদেবের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সসৈন্যে অতর্কিতে এসে তাঁর সহচরদেরও কাউকে হত্যা কাউকে বা বন্দী করে নিয়ে যায়। এই পাপাত্মা নিজ মাতুল—আমার পিতা বসুদেবের যজ্ঞাশ্ব হরণ করেছিল। তপস্বী অক্ররের ভার্যা দ্বারকা থেকে সৌবীর রাষ্ট্রে গমন করছিলেন—এই পাষণ্ড তাঁকে অনভিলাষিণী জেনেও হরণ ও ধর্ষণ করেছিল। এই কুলপাংশুল ছদ্মবেশে স্বীয় মাতুলকন্যা ভদ্রাকে হরণ করতেও দ্বিধাবোধ করে নি। এমন কি এই মূঢ় আমার বিবাহে বাধা দেবার উদ্দেশ্যেই রুক্মিণীকে প্রার্থনা করেছিল কিন্তু উদ্বাহু বামনের চন্দ্রাভিলাষের মতোই ব্যর্থ হয়েছিল, তাতে কিছুমাত্র অপ্রতিভ বোধ করেনি।…আমি এই সব অনাচার ও বিরুদ্ধাচরণ সহ্য করেছি পিতৃসার অনুনয় স্মরণ করেই। তবে এর—পশুর থেকে নিকৃষ্ট প্রাণী—বোধ করি ক্রিমিকীটের মতো আচরণ ও দুর্ব্যবহার তাঁর কাছে প্রতিশ্রুত শত সংখ্যা অতিক্রম করেছে, এইবার এই পাপিষ্ঠকে আমি বধ করব।’

অনেক সময় বালকরা তাদের নবলব্ধ শক্তির পরিসীমা জ্ঞাত না থাকায় যেমন অনায়াসে প্রজ্বলিত অগ্নিকে করায়ত্ত করার চেষ্টা করে—মোহগ্রস্ত ব্যক্তি যেমন নিজেই বিষধর সর্পের নিকটবর্তী হয়—শিশুপালও যেন মৃত্যু আসন্ন দেখেও অধিকতর কটূক্তি ও ব্যঙ্গোক্তি করতে গেলেন, বিশেষ রুক্মিণীকে নিয়ে।

কিন্তু ততক্ষণে—স্বীয় বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই–কেশিনিসূদন কেশব শ্রীকৃষ্ণের ভ্রূকুটি ভয়ঙ্কর ও দৃষ্টি করাল হয়ে উঠেছে, সে দৃষ্টিতে যে চরাচর দগ্ধ হবে এমন ধারণা হচ্ছে দর্শকদের মনে। যাঁরা চিরদিন তাঁর প্রসন্ন মধুর শান্ত মুখশ্রী দেখে এসেছেন, তাঁরা সেদিকে চেয়ে বিস্ময়ে ও আতঙ্কে মূর্ছাহত হয়ে পড়লেন কেউ কেউ সে দৃষ্টির প্রাখর্য সহ্য করতে না পেরে সত্যিই মূর্ছিত হলেন। সে মৃত্যু-অনলবর্ষী আয়ত চক্ষুর দিকে যেন কেউ তাকাতে পারছেন না, চোখ ফিরিয়ে নিতেও পারছেন না।

সে দৃষ্টির দুঃসহতার সম্মুখে শিশুপালও যেন কেমন জড়বৎ হয়ে গেলেন, আর কিছু করা কি বলা, আত্মরক্ষার চেষ্টামাত্র করারও সামর্থ্য রইল না। সে অবসরও অবশ্য পেলেন না বিশেষ। শ্রীকৃষ্ণ নিমেষকালমধ্যে তাঁর বিখ্যাত চক্রাস্ত্রে সেই অগণিত ক্ষত্রবীর-মধ্যে, শিশুপালের অনুচর ও অনুষঙ্গীদের সামনেই ওঁকে দ্বিখণ্ডিত ও নিহত করলেন।

তারপরও বহুক্ষণ পর্যন্ত এই বিপুল যজ্ঞসভা প্রাণহীন সুষুপ্তবৎ স্তব্ধ হয়ে রইল। কারও কিছু চিন্তা করার, প্রতিবাদ করার, এমন কি বাসুদেবের জয়ধ্বনি করারও সামর্থ্য রইল না। যেসব নৃপতিরা শিশুপালকে সমর্থন ও অনুসরণ করেছিলেন এতক্ষণ, তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য নীরবে দন্তে দন্তে ঘর্ষণ কিংবা ওষ্ঠ দংশন করতে লাগলেন কিন্তু বাঙ-নিষ্পত্তি করার সাহস হ’ল না কারও। এক কথায়—প্রায় দণ্ডকাল সময় লাগল সেই অভূতপূর্ব, অকল্পনীয়, অবর্ণনীয় ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে। এই সমস্ত সময়টা সেই বিশাল জনসমুদ্রে যেন মৃত্যুরই নীরবতা বিরাজ করতে লাগল।

২১

সেই প্রথম দিনের একান্ত অনভিপ্রেত ঘটনার পর যজ্ঞে আর কোন বাধা কি বিপত্তি দেখা দেয় নি। প্রবীণ শাস্ত্রজ্ঞদের বিধান অনুযায়ী শিশুপালের শবদেহ সৎকারের জন্য প্রেরণ ক’রে সে স্থান সুপরিস্কৃত ও তাঁর পুত্রকে চেদীরাজ বলে ঘোষণা করে যুধিষ্ঠির যথাবিহিত সংকল্পান্তে যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।

ক্ষোভ যে একেবারে দূরীভূত হ’ল তা নয়। এ সংসারে এক শ্রেণীর মানুষ চিরদিনই থাকে—অন্যায় দমনকে যারা অত্যাচার বলে মনে করে এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া সত্বেও দুষ্কৃিতিকারী সম্বন্ধে মমতা পোষণ করে। পাপের সাহায্যে শক্তি-সম্পদ আহরণ-প্রয়াসী ব্যক্তির সংখ্যাও বড় অল্প নয়। নৃপতিদের মধ্যেও এই ধরনের মনোভাব যথেষ্ট। তাঁরা ক্ষুদ্ধ, কেউ কেউ ক্রদ্ধ হয়েই রইলেন। কিন্তু শিশুপালের মতো দুর্ধর্ষ ব্যক্তির পরিণাম, শ্রীকৃষ্ণের সেই ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি, এবং পাণ্ডবসমর্থনকারীদের সংখ্যা ও শক্তি প্রত্যক্ষ ক’রে কেউই কোন প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতে সাহস করলেন না। তবে তাঁদের অনেকেই বহুক্ষণ পর্যন্ত অবনত মস্তকে অপমানিত অসহায়ের সম্বল ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন ও দন্তে দন্তে ঘর্ষণ বা ওষ্ঠ দংশন ক’রে মনোবেদনা দমনের চেষ্টা করতে লাগলেন। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এর প্রতিশোধ নেবেন এই কামনায় সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করলেন কেউ কেউ ।

কিন্তু সেদিকে আর কারও মনোযোগ ছিল না। অত ভ্রূক্ষেপও করলেন না কেউ। মধ্যের এই ছেদটুকুর পরেই আবার উৎসব সমারোহের সুর লেগেছে সবার মনে, কর্মকাণ্ডের বিশালতার বিস্ময় ও মোহ আচ্ছন্ন করেছে অধিকাংশ চিন্তাশক্তি। দু-চারজন এদিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন অবশ্য—ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতি—তাঁরা যতটা সম্ভব অতিরিক্ত সম্মান ও সমাদর প্রদর্শন ক’রে এঁদের কিঞ্চিৎ তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন—কিন্তু তাতেও তাঁদের চিত্তানল যে নির্বাপিত বা প্রশমিত হ’ল না—তাও বুঝতে পারলেন। তবে এসব তুচ্ছ তথ্যাদি—যজ্ঞকর্ম ও দীয়তাং ভুজ্যতাং-এর বিপুলতার সমারোহে চাপা পড়ে গেল। আমন্ত্রিত, রবাহূত জনসাধারণ এবং বিপ্রাদিরা তো বটেই, রাজন্যবর্গও এতাদৃশ অভূতপূর্ব আপ্যায়ন ও সুখাদ্য এবং বিলাসদ্রব্যের বাহুল্যে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁদের অধিকাংশই এ ধরনের ভোগবিলাস ও আহারাদিতে অভ্যস্ত নন, অনেকের কাছে কল্পনাতীত—রূপকথার বর্ণনায় শ্রুত। সাধারণ ব্যক্তিরা যথেষ্ট তুষ্ট হলেন, তাঁরা পাণ্ডবদের জয়জয়কার করতে লাগলেন। বিশিষ্ট অতিথিরাও প্রায় সকলেই গোপনে হৃদয়োত্থিত দীর্ঘশ্বাস মোচন ও সহজ ঈপ্সাতুর ঈর্ষা অন্তরেই দমন ক’রে মুখে এঁদের জয়ধ্বনি করতে করতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও প্রতিনিমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলেন। যাওয়ার সময় পাণ্ডবরা যেসব উপহার দ্রব্যাদি সঙ্গে দিলেন, তার পার্থক্য বা বৈষম্য ও কল্পিত পক্ষপাত বিচার রইল দীর্ঘ যাত্রাপথের আলোচনার বস্তু। ।

গেলেন না কেবল ধার্তরাষ্ট্র ভ্রাতৃবর্গ ও তাঁদের পরভৃৎ মাতুল,—গান্ধাররাজ তনয় সুবল-পুত্র শকুনি জ্যেষ্ঠ ভাগিনেয়র অহরহ চাটুগান ও কুমন্ত্রণাদানই যাঁর জীবিকা-নির্বাহের প্রধান উপায় বলা যেতে পারে।

পাণ্ডবরাই—কতকটা কর্তব্যবোধে, সৌজন্য প্রকাশের রীতি অনুযায়ী, কতকটা শ্রীকৃষ্ণের উপদেশেও জ্ঞাতি-ভ্রাতাদের অনুরোধ করেছিলেন আর কয়েকদিন থেকে যেতে। বলেছিলেন, এই লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে ও কর্মব্যস্ততায় ভ্রাতাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ ও প্রীতিবিনিময়ের অবসর পাওয়া যায় নি। ওঁরা যদি আর কটা দিন এখানে বিশ্রাম ক’রে যান তো সেই একান্ত অভিপ্রেত সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।

আমন্ত্রণটুকু জানিয়েছিলেন ঠিকই—কিন্তু কৌরবরা যে সত্য সত্যই রাজী হয়ে যাবেন তা আশঙ্কা করেন নি।—হ্যাঁ আশঙ্কাই। কৌরবরা কখনওই ওঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী নন। জন্মান্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্বেও সিংহাসনে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সে দুঃখ কিছুটা দূর হতে পারত যদি ওঁর সন্তান অন্তত বংশের জ্যেষ্ঠ হত। সেদিক দিয়েও ভাগ্য বঞ্চিত করলেন ওঁকে। কনিষ্ঠ পাণ্ডুর সন্তান যুধিষ্ঠিরই প্রথম জন্মগ্রহণ করলেন। ধৃতরাষ্ট্রর একশত পুত্ৰ হ’ল—কিন্তু সিংহাসন দাবি করার কোন দিকেই কোন অধিকার রইল না।

পাণ্ডুর অকালমৃত্যুর পর তাঁর নাবালক সন্তান পাঁচটি এবং এই রাজ্যের দায়িত্ব ভীষ্মই বহন করছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এরা উপযুক্ত হয়ে উঠলে ভাগ্যের অবিচার-এর কিছুটা ক্ষতিপূরণ করে দেবেন উনি, অর্থাৎ কুরুরাজ্য বংশের এই দুই ধারার মধ্যে বণ্টন ক’রে দেবেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রতনয়দের সে-অপেক্ষা সইল না। অদৃষ্টের প্রবঞ্চনা নিজেদের বুদ্ধিবলে পরাভূত করতে চেষ্টা করলেন। অন্যায় শুধু নয়—চরম পাপের পথে প্রতিবিধান করতে গেলেন, এবং সেটা শুরু হয়ে গেল প্রায় বাল্য থেকেই। হত্যার দ্বারা জ্ঞাতিকণ্টক দূর করার চেষ্ট করতে লাগলেন। ।

দুর্যোধন ছিলেন ভীমের প্রায় সমবয়সী। দুজনেই মহাবলী, দুজনেই মল্লক্রীড়া ও গদাযুদ্ধে সুদক্ষ। স্বভাবত এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু সেখানেও দেখা গেল বিধাতা পক্ষপাত করেছেন কিছু। দৈহিক পরাক্রম ও আকৃতিতে ভীমেরই অধিকতর যোগ্যতা প্রমাণিত হ’ল একাধিক বার। সেজন্য ভীমের প্রতি তাঁর আক্রোশ সর্বাধিক। তিনি সেই অনতিক্রান্ত-বাল্যেই কয়েকজন ভ্রাতার সঙ্গে চক্রান্ত ক’রে ভীমকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দৈবানুগ্রহে— দুর্যোধনের মতে দৈববিড়ম্বনায়—ভীম প্রায় অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেলেন। ।

তারপর কৈশোরে পদার্পণ ক’রে পাণ্ডুপুত্রগণ যখন সকল দিক থেকেই সাফল্য ও যশ অর্জন করতে লাগলেন—তখন ঈর্ষা ক্ষোভ ও নিষ্ফল আক্রোশ ক্রমশ বিদ্বেষ ও ক্রোধের আকার ধারণ করবে এও স্বাভাবিক। অথচ—ভীষ্ম কোন একদেশদর্শিতা করেন নি, একই শিক্ষক একই শস্ত্রগুরু সকলের শিক্ষার তত্বাবধান করতেন। কিন্তু না ভীম না অর্জুন কারুরই সমকক্ষ হতে পারলেন না কৌরবরা। প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে দুর্যোধন এক অজ্ঞাতকুলশীল তরুণ যোদ্ধা কর্ণকে দিয়ে প্রদর্শনী-পরীক্ষা মণ্ডপে অর্জুনকে পরাভূত করার চেষ্টা করলেন—অপর কেউ ওদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এটা প্রমাণিত হলেও বুঝি ক্ষোভ কিছুটা অপনোদিত হয়—কিন্তু অকস্মাৎ মাতা কুন্তী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ক্রীড়ামঞ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারল না। আক্রোশ ও উষ্মা—প্রকাশের পথ না পেয়ে—বর্ধিততর হতে থাকল।

শেষ পর্যন্ত ক্ররমনা দুর্যোধন—সম্ভবত ধৃতরাষ্ট্রের অনুমোদন ও অর্থানুকূল্যেই ছল ক’রে দূরান্তের এক গ্রামে পাণ্ডবদের পাঠিয়ে তাঁদের অগ্নিদগ্ধ ক’রে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলেন। দাহ্য পদার্থ প্রস্তুত জতু-গঠিত প্রাসাদ নির্মিত হ’ল। কৌরবদের বেতনভুক পুরস্কারলুব্ধ সৈনিকরা পাণ্ডুতনয়দের দেহরক্ষীর ছদ্মবেশে ঘিরে রইলেন—পুরোচন নামে অতি নিষ্ঠুর পাপকর্মা এক ব্যক্তি গেলেন এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড তত্বাবধান করতে।

বাঁচার কথা নয়, কিন্তু দাসীগর্ভজাত এঁদের পিতৃব্য ধর্মনিষ্ঠ বিদ্বান ও বুদ্ধিমান বিদুর শুধু যে পাণ্ডবদের পূর্বে সতর্ক ক’রে দিলেন তাই নয়, এই ঈর্ষাগ্নিবলয় থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় সম্বন্ধেও ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন। সেই উপায়েই এঁরা কোনমতে প্রাণ রক্ষা পেলেন সে-যাত্ৰা।

তবু পরিত্রাণ পেয়েও— নিঃসম্বল পাণ্ডবরা আর রাজধানীতে ফিরে যেতে সাহস করেন নি। ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের বেশে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কোনমতে জীবনধারণ করছিলেন মাত্র। এভাবে বাঁচাও সম্ভব হত কিনা সন্দেহ—ভীম এক অনার্য কন্যাকে বিবাহ ক’রে তার অর্থানুকূল্য ও সাহায্য পেয়ে অনেকটা সুবিধা ক’রে নিতে পেরেছিলেন। তাই রক্ষা!

তারপর—একেবারে পাঞ্চালদের জামাতা রূপে যখন এঁরা আত্মপ্রকাশ করলেন, যাদব ও বৃষ্ণিরা যখন আত্মীয় বলে স্বীকার করলেন—ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য প্রভৃতি প্রধান বীর ও যোদ্ধারা যখন প্রবল ধিক্কারধ্বনি তুললেন, তখন কতকটা দিশাহারা হয়েই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের তিরস্কার ক’রে এই সামান্য রাজ্যাংশ অর্ধেক বলে পাণ্ডবদের বুঝিয়ে দিয়ে নিজের পদবী ও বয়সের সম্মান রক্ষা করলেন। এটুকু সম্বল করেই স্বীয় শৌর্য বুদ্ধি ও সাহসবলে অল্প কিছুকাল মধ্যে পাণ্ডবরাজ ভারতখণ্ডের সম্রাট রূপে স্বীকৃতি পেলেন, এই স্বপ্ন-কল্পনাতীত সমৃদ্ধির ও অধিকারী হলেন—এ দেখে কৌরবরা স্নেহ বিগলিত হবেন ও এঁদের অধিকতর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করবেন—এমন আশা করার কোন কারণ নেই—পাণ্ডবরাও তা করেন না।

কৌরবরাও প্রীতিবশত থাকেন নি। আসলে এই ঐন্দ্রজালিক প্রাসাদ ও এঁদের অর্জিত অবিশ্বাস্য বিত্তরাশি সম্বন্ধে কৌরবদের কৌতূহলের অবধি ছিল না। এই এক মাস কাল মধ্যে তার একটা অস্বচ্ছ ধারণা মাত্র হয়েছে, সম্পূর্ণ উপলব্ধির সুযোগ বা অবসর লাভ হয় নি।

এমনিতেই এই ধরনের প্রায় দৈবপ্রাপ্ত সৌভাগ্যে জ্ঞাতিদের মনে জ্বালা ধরা স্বাভাবিক। সে জ্বালার তীব্রতা ও দাহিকাশক্তি সম্বন্ধেও কৌরবরা যে অনবহিত ছিলেন তা নয়। কিন্তু কোন কোন যন্ত্রণা–বেদনাদায়ক হওয়া সত্বেও— বিকৃত মানসিকতা ও বিপরীত মনোধর্ম অনুযায়ী মানুষ উপভোগও করে। বিষধর সর্পের দৃষ্টির দিকে চেয়ে একই সঙ্গে সে আতঙ্কিত ও মোহগ্রস্ত হয়। কৌরবরাও অপেক্ষাকৃত নির্জনতা ও কর্মহীনতার অবসর মুহূর্তে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী, পাণ্ডবদের ভোগবিলাস সমারোহ ও এই নবনির্মিত প্রাসাদসৌধ দর্শনের বিষামৃত পান করতে লাগলেন।

লাঞ্ছনারও অধিক রইল না। বিশেষ, ভাগ্যক্রমে যেন দুর্যোধনের দুর্দশাই সমধিক। গৃহপ্রান্তের স্ফটিক প্রাচীরকে মুক্ত দ্বারপথ কল্পনা করে বহিষ্ক্রান্ত হতে গিয়ে মুখে মস্তকে আঘাত পেলেন। জলভ্রমে কৃত্রিম সরোবরে অবগাহন করতে গিয়ে হাস্যাস্পদ হলেন। আবার যথার্থ দীর্ঘিকাকে স্ফটিক নির্মিত কৃত্রিম জলাশয় ভেবে তার ওপর পদচারণা করতে গিয়ে মহার্ঘ্য বস্ত্রাদিসহ জলমগ্ন হলেন। পাণ্ডবরা যে সব সময় উপস্থিত থাকছিলেন তা নয়—কিন্তু আরও বহু লোক চারিদিকে। এবং স্বতোৎসারিত কৌতুক-দমনের প্রাণপণ চেষ্টা সত্বেও তাদের অধরকোণে সে কৌতুক—উপভোগের হাস্যরেখা ফুটে ওঠে I ।

ফলে এখানের অত্যুত্তম আহার্যে কষায় স্বাদ পান দুর্যোধন। বিলাস-শয্যা কণ্টকশয্যায় পরিণত হয়। এদের ঐশ্বর্য- সম্পদেরও যেন কোন সীমা সংখ্যা পরিমাণ পান না তিনি। সেও এক মহা যন্ত্রণা। নিষ্ফল আক্রোশে চেয়ে চেয়ে দেখেন সহস্ৰ সহস্ৰ স্নাতক গৃহস্থ ও তাঁদের প্রত্যেকের অগণিত দাসদাসী পালন করছেন পাণ্ডবরা। তাঁদের প্রাসাদে প্রত্যহ দশ সহস্ৰ লোক স্বর্ণপাত্রে উত্তম খাদ্য আহার করে। সমাগত বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ যেসব উপহার এনেছিলেন—তা দুর্যোধনই গ্রহণ করেছেন। এত সম্পদ, এত বিচিত্র বস্তু যে আছে, এত রকম দেশ ও জাতি আছে—যারা যুধিষ্ঠিরের প্রাধান্য স্বীকার করছে—তা দুর্যোধনের জ্ঞান নয়, কল্পনারও বাইরে। যে সব উৎকৃষ্ট রত্নখচিত সুবর্ণ কলস ও অন্যান্য দ্রব্যাদি একমাত্র যাদবদের কাছ থেকেই উপহার পেয়েছেন যুধিষ্ঠির, তার মূল্যের সমান সম্পদ বোধ করি জরাসন্ধের ভাণ্ডারেও ছিল না। তিনি রাজন্যবর্গের বিদায়কালে যে সব প্রত্যুপহার দান করেছেন তাও অপরিমিত অগণিত। যজ্ঞকালে শেষ পর্যন্ত যেসব ধনরত্ন করস্বরূপ বা উপহারস্বরূপ এসেছিল, স্থানাভাবেই তা গ্রহণ করতে পারেন নি যুধিষ্ঠির। নগরপ্রাকারের বাইরে স্তূপাকারে পড়ে ছিল। মনে হয় বর্তমানকালে যুধিষ্ঠিরের যা সম্পদ তা বরুণ ইন্দ্র বা কুবেরের ভাণ্ডারেও নেই।

পাণ্ডবদের এই সৌভাগ্য নিয়ে যতই চিন্তা বা হিসাব করেন ততই অন্তরে মাৎসর্যাগ্নি প্রজ্বলিত হয়। তাতে ইন্ধন যোগাবারও লোকের অভাব নেই। মাতুল সৌবল-পুত্র শকুনি ও অন্যান্য পার্শ্বচররা এটাকে পাণ্ডবদের সুপরিকল্পিত অবমাননার আয়োজন বলে মনে করেন—মনে করিয়ে দেন। ফলে এই সভাগৃহ নির্মাণটার একমাত্র কারণ তাঁদেরই হেয় করা—এই বোধ জন্মাল কৌরবদের মনে। এইভাবে কোনমতে পক্ষকাল অতিবাহিত ক’রে যখন তাঁরা হস্তিনার উদ্দেশে যাত্রা করলেন তখন বোধ করি মৌখিক সৌজন্যসম্মত আনন্দ ও তৃপ্তি প্রকাশের শক্তিও আর তাঁদের অবশিষ্ট রইল না। এই সুখবাস যে তাঁদের কাছে নরকযন্ত্রণাতুল্য হয়েছে তার স্পষ্ট পরিচয়ই কথাবার্তা ও মুখভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়তে লাগল।

তবু—মুখভাব ও আচরণকে ওখানে যতটুকু সংযমের বাঁধ দিয়ে রাখা গিয়েছিল, স্বগৃহে প্রত্যাবৃত্ত হয়ে আর সেটুকুও রাখা যায় না। দুর্যোধন একেবারেই ভেঙে পড়েন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারও সঙ্গে রহস্যালাপ ও বিশ্রম্ভালাপ তো দূরের কথা—বাক্যালাপ পর্যন্ত করেন না। আহার-নিদ্রা একেবারে ত্যাগ না করলেও যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা কোন সুস্থ মানুষের জীবন ধারণের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। ফলে দিন দিন কৃশ ও বিশুষ্ক হতে থাকেন দুর্যোধন। অন্যান্য রাজকুমারদের এতটা না হলেও ওখানের অপ্রমাণিত কল্পিত অপমানের লজ্জায় তাঁরা যেন এখানের প্রজা-পরিজন, এমন কি সেবকদের কাছেও মাথা তুলতে পারেন না। নিজেদের যা শক্তিসম্পদ আছে তাও যেন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন মনে হয়। সেজন্য মৃগয়া ক্রীড়াদি সকল প্রকার ব্যসন ত্যাগ ক’রে অশৌচ পালনের মতো অধিকাংশ সময় গৃহকোণেই অতিবাহিত করেন।

ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও—অথবা অন্ধ বলেই—রাজ্য ও রাজপুরী, বিশেষ পুত্র-কন্যাদের সংবাদ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সংবাদ সংগ্রহের জন্য এবং ক্ষণে ক্ষণে তাঁকে সে সংবাদ শোনানোর জন্য বহুসংখ্যক কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। এর মধ্যে আবার পুত্রদের সম্বন্ধে স্নেহ ও সজাগ সচেতনতা—দুর্বলতা বলাই উচিত—সর্বজনবিদিত। দুর্যোধনের এই ভাবান্তর ও স্বাস্থ্যভঙ্গের সংবাদ সহজ নিয়মেই ক্রমশ ওঁর কাছে পৌঁছয়। পুত্ররা সকলেই প্রিয় কিন্তু দুর্যোধন প্রিয়তম। তাঁর এই দুর্দশার সংবাদে নিরতিশয় উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে ওঠেন।

দুর্যোধনকে ডেকে পাঠিয়েও যখন কোন সুফল লাভ হয় না—তখন তিনি নিজেই শিবিকাবাহিত হয়ে পুত্রের বাসভবনে উপস্থিত হন। এবং ব্যাকুল কণ্ঠে ওঁর এই বিষাদ ও জীবনে—বিশেষ আনন্দ উপকরণে—এতাদৃশ অনীহা ও অরুচির কারণ সম্বন্ধে বার বার প্রশ্ন করতে থাকেন। ।

‘বৎস দুর্যোধন, শুনলাম তুমি দিন দিন বিশুষ্ক শীর্ণ মলিন ও পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যাচ্ছ। আহারাদি আমোদ-আহ্লাদে স্পৃহা নেই, স্বজন বা বয়স্যদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ বা রসালাপ কর না, রমণীদের সেবা নাও না। এত কাতর হয়ে পড়লে কেন? যদি দৈহিক অস্বাস্থ্যই এর কারণ হয়, হস্তিনাপুরে তো প্রাজ্ঞ বৈদ্যের অভাব নেই। আমি তো অনেক চিন্তা ক’রেও তোমার এই অমর্ষতার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। এ রাজপুরীর বিপুল ঐশ্বর্য সবই তো তোমার যথেচ্ছ উপভোগ্য এবং তোমাতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তোমার ভ্রাতৃগণ বা সুহৃদগণ তোমার অপ্রিয়াচরণ করার কথা চিন্তামাত্র করে না। তোমার পেটিকায় উত্তম উত্তম মহার্ঘ্য বস্ত্রাদি রয়েছে। প্রত্যহ সমাংস অন্ন আহার করছ। উৎকৃষ্ট অশ্ব ও সুনির্মিত রথের অভাব নেই। ক্রীড়াদি বা মৃগয়ার সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত। মহামূল্যবান আরামদায়ক শয্যা, মনোরমা ভার্যা ও চিত্তহারিণী সুন্দরী রমণীগণ, সুসজ্জিত গৃহনিবহ—তোমার ইচ্ছাধীন ও আজ্ঞাবহের মতো প্রতীক্ষা করছে। এছাড়াও যদি তোমার কোন ভোগাভিলাষ থাকে তা ব্যক্ত করো, আমি এখনই তার ব্যবস্থা করছি।’

দুর্যোধন এবারে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন যেন। বললেন, ‘আপনি এইসব ভোগ্য বস্তুর গর্ব করেন? আরও দেবেন? কী দেবেন আপনি, কী দিতে পারেন? ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণাই নেই। ভাগ্যদোষে—অথবা দোষই বা বলছি কেন, ভাগ্য-অনুগ্রহই বলব, এই সব দেখে আমার মতো তীক্ষ্ণ বিষের জ্বালা ভোগ করতে হচ্ছে না—আপনি অন্ধ। পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত ছিলেন কিন্তু তাদের বিত্ত বা প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিমাণ সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন নি। আপনার সংবাদ-সরবরাহকারকদের পক্ষেও সম্ভব হয় নি সেই জনবহুলতার মধ্যে যথার্থ বিবরণ দেওয়ার। পাণ্ডবদের অমরাপুরীদুর্লভ শ্রী ও অসুরদুর্লভ শক্তিই আমার দুঃখের কারণ। জ্ঞাতিদের এই ধরনের বিপুল অভ্যুত্থান ও ক্রমবর্ধমান অপরিমেয় সমৃদ্ধি দেখার পরও যারা নিশ্চল নিষ্ক্রিয় উদাসীনবৎ বসে থাকে, তারা হয় মৃত নয় নপুংসক।

বলতে বলতে অতৃপ্ত রোষ ও আত্মধিক্কারে দুর্যোধনের চোখে জল এসে গিয়েছিল।

ক্ষণকাল নীরব থেকে সে ক্ষোভাশ্রু করপৃষ্ঠতলে মোচন করে বললেন, ‘আপনি জানেন যুধিষ্ঠির বহু সহস্র গৃহমেধী স্নাতককে ভরণপোষণ করেন, তাদের প্রত্যেকের সেবার জন্য ত্রিশটি ক’রে সুন্দরী দাসী নিয়োগ করেছেন? দশ সহস্ৰ ব্রাহ্মণ প্রত্যহ তাঁর গৃহে স্বর্ণপাত্রে ভোজন করেন? আপনার সমস্ত সৈনিক ও সেবকের সংখ্যা যোগ করলে যা হয় তার থেকে অনেক বেশী সংখ্যক শুধু অশ্বযোষিৎ উষ্ট্রযোষিৎই আছে পাণ্ডবদের। এই যজ্ঞে আমার উপরই উপহার গ্রহণের ভার ছিল। যেসব দ্রব্যাদি এসেছে তার অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র নেই, কোন গ্রন্থেও সে অমূল্য দ্রব্যাদির বিবরণ পাই নি। উপহারের মহার্ঘ্যতা ও বিপুলতা আপনার কল্পনার অতীত। হিসাব রক্ষা আমার পক্ষেও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। রাজভাণ্ডার কেন, রাজধানীর মধ্যেও সেগুলি রক্ষা করার মতো কোন স্থান অবশিষ্ট ছিল না। আমাদের রাজ্যখণ্ডের মতো বেশ কয়েকটি দেশের তাবৎ সম্পত্তির যা মূল্য তার থেকে অনেক বেশী মূল্যের আশ্চর্য উপহারদ্রব্য নগরপ্রাকারের বাইরে প্রান্তরে স্তূপাকার হয়ে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেল। সেখানে এমন কেউ দরিদ্র ব্যক্তি নেই যা তার কোনটি গ্রহণ করে।… মহারাজ, এই কল্পকথাসুলভ শ্রীবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করার পর আমার আর জীবনধারণের বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই। কোন সত্ববান পুরুষ শত্রুর এতাদৃশী শক্তিসম্পদ দেখেও স্থির থাকতে পারে! আমার মনে হচ্ছে আমি না স্ত্রী না অ-স্ত্রী, না ক্লীব—কিছুই না। পুরুষ হলে কেউ শত্রুর এই অপরিমাণ সৌভাগ্যসন্দর্শনে অবিচল থাকতে পারে না। স্ত্রীলোক সপত্নীর ঋদ্ধি-প্রতিপত্তি সহ্য করে না। এখন মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুই শ্রেয়, হয় অগ্নিতে বা জলে প্রবেশ ক’রে—নয়তো বিষ ভক্ষণ ক’রে আমি মৃত্যুবরণ করব—এ আপনি নিশ্চিত জানবেন।’

ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে বিহ্বল ও বর্তমানে তার মনক্লেশের বিবরণ শুনে দুঃখিত হলেও একেবারে বিবেকশূন্য ছিলেন না। তিনি অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘এ তোমার কেমন কথা। তারা নিজেদের ভুজবলে ঐশ্বর্য আহরণ করেছে, তোমার ক্ষমতা থাকে তুমিও কর। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। পৃথিবীর বিত্ত তো শেষ হয় নি, সমস্ত দেশ ধ্বংস বা সকল প্রজাও বিনষ্ট হয় নি। অপরের শ্রীতে ঈর্ষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার মতো কাপুরুষতা আর কী হতে পারে।’

দুর্যোধনও তিক্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আপনি বিলক্ষণ জানেন যে আমার একার পক্ষে এ ধরনের অভিযান সম্ভব নয়। আমার সে সহায় সম্বল কোথায়? অধিকাংশ ক্ষত্রিয় রাজাই এখন ওদের বশীভূত, আজ্ঞাবহ। ওরা পাঁচ ভাই-ই রণকুশলী, সুদক্ষ সেনানায়ক। আমাদের পক্ষে তো সেনাপতি বলতে ঐ জরদগব দুই বৃদ্ধ—ভীষ্ম ও দ্রোণ। তারাও পাণ্ডবদের কল্যাণের জন্যই বেশী ব্যস্ত। তাদের ভরসায় দিগ্বিজয় সম্ভব নয়। না, আমার কেউ কোথাও নেই তা বেশ বুঝেছি। পিতাই যার দুঃখ বোঝেন না তার চেয়ে হতভাগ্য আর কে আছে!’

প্রিয়তম পুত্রের অভিমানরুদ্ধ কণ্ঠ তীক্ষ্ণ-অস্ত্রের মতোই ধৃতরাষ্ট্রের বুকে বিঁধল, তিনি বিষম বিচলিত হয়ে উঠলেন, তবু একটা ক্ষীণ সৎ প্রচেষ্টা হিসেবে কতকটা দুর্বল ভাবেই বললেন, ‘বৎস, যুধিষ্ঠির তোমার সম্বন্ধে দ্বেষ পোষণ করেন না। তার অর্থবল, মিত্রবল রাজ্যপ্রাপ্তির সময়ে যা ছিল তা তোমার থেকে বেশী নয়—বরং অনেক কম। সে সেই সামান্য সম্বল অবলম্বনে যদি আজ এই অভূতপূর্ব রাজশ্রী অর্জন করে থাকে—তুমি পারবে না কেন? তোমার আর পাণ্ডবদের একই পিতামহ—এ কোন দূরসম্পর্ক কিছু নয়। ভ্রাতারা যদি মিত্রতাপাশে বদ্ধ থাকে তবে সমৃদ্ধি ও শক্তি তাদের আশ্রয় করে। ভ্রাতাদের নাশ করতে চাও কেন? তুমি প্রীতিভরে তাদের কাছে কোন প্রার্থনা জানালে তাঁরা অবশ্যই তা পূরণ করবেন। তুমি যদি অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাও অনায়াসে করতে পার। ভার্গবজিৎ মহাত্মা ভীষ্ম, মহাধনুর্ধর দ্রোণ, ব্রহ্মাস্ত্রভিজ্ঞ মহাবীর অশ্বত্থামা, অঙ্গরাজ মহাবলী কর্ণ, গুরু কৃপাচার্য, সুবলতনয়গণ, রাজা সোমদত্ত— এঁরা কেউই নগণ্য নন। এঁরা তোমার সহায় হলে অচিরে বসুন্ধরা তোমার পদানত হবে।’

শকুনি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকেই ভাগিনেয়কে উত্তেজিত করছিলেন, এখানে এসেও জ্ঞাতিবিদ্বেষবহ্নিতে ইন্ধন ক্ষেপণে কিছুমাত্র আলস্য করেন নি। তিনি এখন বললেন, ‘মহারাজ, আমার নাম উল্লেখ করলেন, আমাদেরও রথী বলে স্বীকার করলেন, সেই সাহসেই একটা কথা বলছি, বৃথা সন্তাপও যেমন অর্থহীন তেমনি নিজেদের শক্তি সহায় সম্বন্ধে অবাস্তব স্ফীত ধারণাও নৃপতিদের পক্ষে ক্ষতিকর। পাণ্ডবরা ও পাঞ্চালগণ একত্র হলে— বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ যদি সহায় থাকেন তো যাদব বীররাও অবশ্যই ওঁদের পক্ষে যোগ দেবেন— দেবতারাও এঁদের যুদ্ধে পরাভূত করতে পারবেন না। কল্যাণীয় দুর্যোধন, আমি যা বলছি শোন, আমি ওখানে থাকতেই একটা বিষয় লক্ষ্য করে এসেছি—অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের মাত্রাধিক আসক্তি। কিন্তু যতটা ওঁর সাধ ততটা নিপুণতা নেই। এ ক্রীড়ার কূটকৌশল, অক্ষ ক্ষেপণের হিসাব কিছুই জানেন না। ব্যসনই হচ্ছে মানুষের দুর্বলতা, সেই ছিদ্রপথে মহা মহা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরও সর্বনাশ প্রবিষ্ট হয়েছে। তুমি এক কাজ কর। অক্ষক্রীড়ার জন্য ওঁদের সাদর আমন্ত্রণ পাঠাও। ইতিমধ্যে আমি যেমন বলি তেমনি একটি সভাগৃহ নির্মাণ কর। না না, ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বলছি না, ঐশ্বর্য দেখাবার প্রয়োজন নেই। তার আয়তন ও আড়ম্বর আমাদের সাধ্যসীমার মধ্যে রাখলেই হবে। আমি এক বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই নবভবন নির্মাণের কথা বলেছি। যাতে যুধিষ্ঠিরের মুখের উপর আলো এসে পড়ে, তিনি অক্ষপট ভাল ক’রে দেখতে না পান–এই ভাবে তার দ্বার-গবাক্ষাদি বসাতে হবে। আমি অক্ষচালনা কৌশলেই ওদের যথাসর্বস্ব—ঐ কুবেরকল্পনাতীত ঐশ্বর্য জয় করে পাণ্ডবরাজলক্ষ্মীকে তোমার গৃহে বন্দিনী ক’রে দেব।’

দুর্যোধন লোভে ও প্রতিশোধস্পৃহা পরিতৃপ্তির আশায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘মহারাজ, মাতুলের কথা তো শুনলেন, এখন অনুমতি করুন, সেই ব্যবস্থা করি।’

অকস্মাৎ ধৃতরাষ্ট্রের বাম অঙ্গ স্পন্দিত হয়ে উঠল, গবাক্ষপথের সম্মুখ দিয়ে এক বায়স কর্কশ কণ্ঠে ডেকে চলে গেল। আরও অনেক দুর্লক্ষণ অনুভব করলেন তিনি। অমঙ্গলাশঙ্কায় বিবর্ণ হয়ে অসহায় কণ্ঠে বললেন, ‘তাই তো! শকুনি, তুমি কোথায় ওকে প্রতিনিবৃত্ত করবে, না উত্তেজিত করছ! এ ভ্রাতৃসংঘর্ষের ফল কদাচ শুভ হবে না। আমার মনে হচ্ছে তুমি ইচ্ছাপূর্বক এদের সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছ। পুত্র, তুমি এখনও নিজেকে সংযত ও শান্ত কর। তুমি তো জ্যেষ্ঠ হিসাবে কুরুবংশের রাজসিংহাসন লাভ করেছ। ভারতখণ্ডের অগ্রগণ্য নৃপতি-রূপেই সকলে তোমাকে সমীহ করেন। পাণ্ডবরা সহায় থাকলে পৃথিবীর কোন ব্যক্তি তোমার কোন অমঙ্গল করতে পারবে না। তুমি নিঃসংশয়ে নিশ্চিন্তে রাজ-সুখ ভোগ কর—বৃথা কেন এ লোকক্ষয় স্বজনক্ষয়ের পথে যেতে চাইছ?’

দুর্যোধন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘মাতুল, এক আপনি ব্যতীত এ পুরীতে আমার দ্বিতীয় কোন আত্মজন নেই, আপনিই দয়া করে আমাকে কোন তীব্র হলাহল এনে দিন, যাতে বিনা যন্ত্রণায় নিমেষকাল মধ্যে প্রাণত্যাগ করতে পারি।‘

ধৃতরাষ্ট্র উন্মত্তের মতো লিতপদে পুত্রের কাছে আসার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘বৎস, ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও। আর কিছুকাল ধৈর্য ধর।…তুমি জান ধর্মাত্মা প্রাজ্ঞ বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি কোন কর্মে প্রবৃত্ত হই না। তাঁকে সংবাদ দাও, তিনি আসুন। তিনি কি বলেন আগে শুনি, তারপর মন স্থির করব—’

দুর্যোধন বিরক্তি ও অবজ্ঞাভরে বললেন, ‘ক্ষত্তা বিদুর রাজা বা ক্ষত্রিয়দের মনোবেদনা কি বুঝবেন? তিনি স্বভাবভীরু ও পাণ্ডবদের সম্বন্ধে স্নেহান্ধ। তিনি আপনার অন্নে প্রতিপালিত হয়ে তাদের কল্যাণ চিন্তা করেন। তাতেও দোষ ছিল না, আমি লক্ষ্য করছি, চিরদিনই দেখছি—তিনি আপনার কাছে আমার বুদ্ধি ও প্রবৃত্তিকে হেয় প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তাঁর কাছে এ-প্রস্তাব উত্থাপন করলে তিনি ভালমন্দ না বুঝেই বাধা দেবার চেষ্টা করবেন, যেহেতু প্রস্তাব ও ইচ্ছা আমার …. আমি আপনাকে শেষ বারের মতো এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি—এই নিদারুণ মর্মদাহ, এই সন্তাপের উপশম ব্যবস্থা না হলে আমি প্রাণত্যাগ করবই। যুদ্ধ নয়, কলহ নয়—তাদের ক্রীড়ায় আহ্বান করছি, এতেও যদি বাধা দেন তাহলে আপনি নিরানব্বই পুত্র নিয়েই সুখে বাস করুন, জ্যেষ্ঠ পুত্র আর কখনও আপনার বিরক্তিভাজন হবে না।’

প্রায় অশ্রুরুদ্ধ ভগ্ন কণ্ঠে অসহায় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বলে উঠলেন, ‘তবু, তবু বিদুরকে যে বলা দরকার একবার। সে কী বলে… বিদুর বিদুর কোথায়? সে ছাড়া ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কেউ যে আমার পাশে নেই। ওরে, কে এখানে আছিস, দ্বারসেবক,— কেউ বিদুরকে গিয়ে এখনই একবার সংবাদ দে না! বল আমি তাঁকে স্মরণ করেছি। বিশেষ প্রয়োজন তাঁকে। বিশেষ প্রয়োজন। এখনই আসতে বল।’

তারপর শূন্যে অবলম্বন-সন্ধানের মতোই দুই বাহু সম্মুখে প্রসারিত ক’রে কম্পিত দুর্বল পদে সর্বতো-অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র এসে একসময় আবার শিবিকায় উঠলেন, জ্ঞানশূন্য, স্থানকাল-বিস্মৃতের মতো আর্ত উচ্চরবে ‘বিদুর! বিদুর!’ এই আহ্বান করতে করতে।

বলিষ্ঠ প্রৌঢ়ের সে-উচ্চস্বর প্রাসাদপুরীর পাষাণপ্রাচীর ও বলভিতে অলিন্দে প্রতিধ্বনিত হয়ে কোন এক বিচিত্র নিয়মে বহুক্ষণ অবধি শেষ দুটি অক্ষর ফিরিয়ে দিতে লাগল—’দূর! দূর!’

সে প্রতিধ্বনি যাঁদের কর্ণগোচর হল তাঁরা যেন অকারণেই শিউরে উঠলেন। কেবল সদ্য জয়মত্ত দুর্যোধনের কানেই তা কোন দুর্লক্ষণ রূপে প্রতিভাত হ’ল না।

২২

আনুষ্ঠানিক যজ্ঞ সম্পূর্ণ হওয়ার পরও ইন্দ্রপ্রস্থ বেশ কিছুদিন—সহজ নিয়মেই—জনসমাকীর্ণ ও কোলাহলমুখর ছিল, কর্মব্যস্ততারও অন্ত ছিল না। যেখানে কয়েক লক্ষ অতিথি আর অভ্যাগতের সমাগম হয়েছে, সহস্র যোজনব্যাপী অস্থায়ী জনপদ গড়ে উঠেছে, সেখানে কিছু একদিনেই সকল দায়িত্ব ও কর্মের অবসান ঘটে না। অতগুলি লোকের প্রত্যাবর্তন-পৰ্বই তো এক বিরাট ব্যাপার। সংখ্যাতীত যানবাহন অশ্ব-অশ্বতরাদির জন্য পথ পাওয়া, পথে পথে তাদের খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা করা—আপাত-দৃষ্টিতে দুঃসাধ্য বলেই মনে হয়। সুদ্ধমাত্র পাণ্ডবদের শৃঙ্খলাবদ্ধ মন ও পূর্ব-চিন্তিত সুনির্দেশের জন্যই তা কোন শোচনীয় পরিণামে পর্যবসিত হতে পারে নি।

সুতরাং যজ্ঞের বৈদিক কার্যাদি এক্ষেত্রে বাহ্য ও সামান্য তথ্য মাত্র। যজ্ঞে আহূত দেবতারা স্বর্গে থাকেন, তাঁদের কোন পার্থিব বস্তুতে প্রয়োজন নেই, অভিমান কিছু থাকলেও সামান্য। এই বিপুল সংখ্যক ঈর্ষা-দ্বেষ-অভিমানে পূর্ণ নর- দেবতাদের তুষ্ট ক’রে মিষ্ট বাক্যে বিদায় দেওয়াকেই আসল যজ্ঞ বলা চলে। খাদ্য, পানীয়, সেবক, যানবাহন ইত্যাদি— অতিথিদের স্ব স্ব রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের সুব্যবস্থা, কে কোন পথ দিয়ে কার পূর্বে বা পরে যাবেন, কার সত্বর যাওয়া প্রয়োজন—সমস্ত তথ্যাদি সংগ্রহ ক’রে কারও অহঙ্কারে আঘাত না লাগে— সে-বিষয়ে সতর্ক হয়ে সুষ্ঠু কর্মপরিচালনা মানব-সাধ্যাতীত কাজ। বিদায়-পর্ব অভ্যর্থনা-পর্বাপেক্ষা কঠিনতর, দুর্বহ দায়িত্ব। কারণ এই প্রায় দুই মাস কালের অতন্দ্র অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে ক্লান্তি সকল কর্মীরই প্রভূত শক্তি হরণ করেছে। শুধু দেহগুলোই অবসন্ন নয়—সে দেহকে চালিত করবে সে মন বা চিন্তাশক্তিও ক্লান্ত, উত্যক্ত।

এই কারণেই এঁদের পরামর্শ উপদেশ দিতে বাসুদেব কিছু কালহরণ করবেন এটা স্বাভাবিক। তাঁর উপস্থিতিটা আবশ্যিক ও ইন্দ্রপ্রস্থ-রাজসভা শাসনব্যবস্থার অঙ্গ বলেই ধরে নিয়েছিল সকলে। বস্তুত যজ্ঞ সমাপ্তি ঘোষণার দিন থেকে সমাধিকাল গত হওয়ার পরও, যখন বাসুদেব দ্বারকা প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন তখনও যেন মনে হয়েছিল পাণ্ডবদের শিরে আকাশ-পতন ঘটল। তাঁরা…ব্যাকুল হয়েই আর কয়েকদিন অবস্থিতির অনুরোধ, অনুনয় জানিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণও সে আকুলতা ও মিনতি উপেক্ষা করতে পারেন নি। তবুও শেষ পর্যন্ত যেদিন ওঁকে বিদায় দিতেই হ’ল, সেদিন সাশ্রুলোচনেই প্রীতি নমস্কার ও আলিঙ্গনাদি নিবেদন করেছিলেন তাঁরা—এবং সামান্য বৃদ্ধা নারীর মতো নগরীর প্রাকারসীমা পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের গরুড়ধ্বজ রথের অনুগমন করেছিলেন।

তবু এ সবই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বিস্ময়কর বা অশোভন কিছু দেখতে পান নি কেউ। শ্রীকৃষ্ণই এ যজ্ঞের প্রাণ- স্বরূপ, তিনি সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এঁদের পাশে থাকবেন, এটাই আশা করবে সবাই। ইতিমধ্যে অন্য এক বিরাট নাটক কোথাও অভিনীত হচ্ছে, কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে তা কেউ সন্দেহমাত্র করে নি। শ্রীকৃষ্ণের অত সাধের রাজধানী দ্বারাবতী শত্রু দ্বারা উৎসাদিত, পুরনারীরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত এবং আত্মীয়স্বজন বিশেষ তাঁর প্রিয় পুত্ররা পর্যন্ত নির্জিত ও আহত হচ্ছে—একথা যে কারও কল্পনামাত্র করাও সম্ভব নয়।

জানতেও পারে নি কেউ, যাদবরা পর্যন্ত নয়।

কারণ পর পর যে চারজন দূত এই বার্তা নিয়েই এসেছিল— সে-সংবাদও তো কেউ পায় নি।

পায় নি তার কারণ—তাঁর ইন্দ্রপ্রস্থ আগমনের পর থেকে প্রতি সপ্তাহেই নিয়মিত দ্বারকার দূত আসত ওখানকার বার্তা নিয়ে। এই ব্যবস্থাই ক’রে এসেছিলেন বাসুদেব। বিশেষ কোন আশঙ্কা ক’রে নয়—নিতান্তই নিয়ম মতো। রাজাদের সকলেরই এইভাবে দূত আসত—মানে প্রত্যক্ষভাবে রাজ্য শাসন করেন, নামমাত্র রাজা নন—তাঁদের সকলের পক্ষেই এটা প্রয়োজন ছিল। এক পক্ষের প্রেরিত সংবাদ বা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা বিপজ্জনক এমনিই তো— দিবারাত্র পথ চললেও—অশ্ব বা রথ যেখানে সবচেয়ে দ্রুতগামী যানবাহন, দূর দেশ থেকে বার্তাবাহকের পৌঁছুতেই বহু কাল অতিবাহিত হত—ততদিনে নানা প্রকারের বিপদ-বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। কিরাত, ম্লেচ্ছ ও অনার্য জাতিরা অনেকে পর্বত শৃঙ্গে শৃঙ্গে আলোকসংকেতের আয়োজন ক’রে অনেক দ্রুত সংবাদ পাঠায়—কিন্তু তারও গতি সীমাবদ্ধ, এমন বহু পথ আছে যেখানে পাহাড়-পর্বত নেই। তাই দুদিক থেকে নিয়মিত বার্তাবাহক প্রেরিত হতে থাকত, প্রয়োজন বুঝে দুই-তিন দিবসের ব্যবধানে, শান্তি অব্যাহত থাকলে সপ্তাহ বা পক্ষকাল পর পরও। তাও অশ্বই বিশ্রাম পেত, অশ্বারোহী বা রথীরা নয়। বিশ্রাম অনিবার্য হয়ে পড়লে সাংকেতিক ভাষায় লিখিত পত্র অন্য লোককে দেওয়া হত —সংবাদের গতি অব্যাহত থাকত।

লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে মাত্র দুই-একদিন বিশ্রাম ক’রেই পুনশ্চ অপর প্রান্তের জন্য সন্দেশ নিয়ে যাত্রা করতে হত বাহকদের। এইভাবে চক্রাকারে চলত সমস্যা ও সমাধানের আদান-প্রদান শাসনকর্তার নির্দেশ বা মন্ত্রণা, অস্থায়ী শাসকদের বক্তব্য নিবেদনের পালা।

কিন্তু গত চার-পাঁচ সপ্তাহকাল যাদব শিবিরে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। তবে তাও, কারও জানা কি লক্ষ্য করার উপায় ছিল না। যেখানে উত্তাল জনসমুদ্র নিত্য-তরঙ্গিত, যেখানে অতিথি, অভ্যাগত সেবক কিঙ্কর পশু সব মিলে ঘন-সন্নিবিষ্ট তৃণভূমির মতো নিশ্ছিদ্র অবস্থা—সেখানে সকলে সকলের গতিবিধির সংবাদ রাখবে এমন আশা করাও বাতুলতা।

দ্বারাবতীর দূত বাসুদেবের কাছেই পৌঁছাত, প্রেরক বসুদেব। বাসুদেবের আদেশ-নির্দেশ মতোই তাদের বাসস্থানাদি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা হত। পুনর্যাত্রার দিন তাঁর কাছ থেকে পত্র নিয়ে তারা যাত্রা করত। সেসব পত্রে কি থাকে বা থাকছে তা কেউই কোনদিন জানতে চান নি, এমন কি অগ্রজ বলদেব বা সাত্যকি পর্যন্ত সে-বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেন নি। বিশেষ যে কোন সংবাদ থাকতে পারে বা বিপদ-আপদ ঘটতে পারে—এমন মনে হয় নি কারও। কারণ এ তো নিতান্তই গতানুগতিক, নিত্যনৈমিত্তিক। বিশেষ জ্ঞাতব্য কিছু থাকলে তা বাসুদেবই অবশ্য জানাবেন।

গত চার-পাঁচ সপ্তাহেও দ্বারাবতীর বার্তা নিয়মিত ভাবেই পৌঁচেছে কিন্তু তার উত্তর সেখানে ফিরে যায় নি। কেন ফেরে নি তার কারণ কেউ জানে না, ফেরে নি যে তাও না। বহু পরে জানা গেছে, ইন্দ্রপ্রস্থের সীমা অতিক্রম করে আরণ্য অঞ্চলে পড়ামাত্রই দস্যুদের হাতে প্রহৃত ও বন্দী হয়েছিল তারা। তার পর তারা কোথায় গেছে, পরিণতি কী ঘটেছে, জীবিত আছে বা নিহত হয়েছে—সে-সংবাদ কেউ বলতে পারে নি। কীলক ও তার নিষাদের দল প্রত্যহ রাজধানীতে পর্বতপ্রমাণ মাংস সরবরাহ করতে এসেছে, হয়ত এক-আধদিন কোন দুর্লভ অবসরে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছে—তবে তার সঙ্গে পঞ্চনদবাসী দ্যসুদের কোন সংযোগ আছে, এমন সন্দেহ করবে কে?

যে বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেছে তার পূর্ণ বিবরণ পেলেন বাসুদেব একেবারে দ্বারকার উপান্তে পৌঁছে। যজ্ঞারম্ভের দিন শিশুপাল নিহত হলে ক্রদ্ধ ও প্রতিশোধ-কামনায় অধীর শাল্ব যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সকলের অজ্ঞাতসারে যজ্ঞ-নগরী ত্যাগ করেছেন তা কেউই অত লক্ষ্য করেন নি। দুই-একজন রাজকর্মচারী সে-সংবাদ অবগত থাকলেও প্রধান কর্তাদের জানানো আবশ্যক বোধ করেন নি। যাঁরা লক্ষ্য করেছেন তাঁরাও তা নিয়ে চিন্তা করা বা শাল্বর গতিবিধির সংবাদ সংগ্রহ করা যে প্রয়োজন হতে পারে তাও মনে করেন নি। শাল্বও তা জানতেন—তিনি সেই সুযোগই গ্রহণ করেছেন। বাসুদেব ও অদ্ভুতকর্মা যাদববীরগণ এখনও বেশ কিছুকাল যজ্ঞনগরে ব্যস্ত ও আনন্দমত্ত থাকবেন—সে-বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হয়ে তিনি সসৈন্যে দ্বারকা আক্রমণ ও উৎসাদন করেছেন। কিছু রক্ষীসৈন্য অবশ্যই ছিল। দু-চারজন উল্লেখযোগ্য যোদ্ধাও। কিন্তু সেই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শাল্বকে বাধা দিতে পারেন এমন অভিজ্ঞ যুদ্ধ পরিচালক তেমন কেউ ছিল না। এই অভাবিত অকারণ আকস্মিক আক্রমণের আশঙ্কাও করেন নি কেউ, তাই প্রস্তুতও ছিলেন না। শাল্ব নিজে সৌভ নামক যানে আসীন হয়ে যুদ্ধ করতেন, তাঁর জলে-স্থলে-গগনপথে সমান গতি ছিল* তাঁর সঙ্গে পদাতিক তো নয়ই, রথারূঢ়দেরও যুদ্ধ করা কঠিন। শ্রীকৃষ্ণপুত্র কিশোর প্রদ্যুম্ন দুর্ধর্ষ বীর। তিনি প্রাণপণেই বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু গুরুতর আহত হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হয় নি তাঁর পক্ষেও। ফলে এক সময় অসহায়, অরক্ষিত দ্বারাবতী ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চল শাল্বর ভয়ঙ্কর নারকীয় প্রতিশোধ-বাসনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর অনুচরদের বীভৎস কার্যকলাপের ফলে স্ত্রীলোক শিশু ও আতুরদের ক্রন্দনধ্বনি বহুদূর পর্যন্ত আকাশ-বাতাসকে কলঙ্কিত ও মসীলিপ্ত করেছে। সেসব অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করাও মহাপাপ।

শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় পৌঁছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে কোন বিলাপ বা পরিতাপ করলেন না। সর্বাগ্রগণ্য কর্তব্য বিবেচনায় প্রথমেই নিহতদের গৃহে গিয়ে আত্মীয়দের সান্ত্বনা দান ও তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাদি সম্বন্ধে সংবাদাদি নিলেন, আহতদের চিকিৎসা ও শুশ্রুষার কাজ কেমন চলছে প্রত্যক্ষভাবে তত্বাবধান করলেন। পুত্ৰ প্ৰদ্যুম্ন যৎপরোনাস্তি অমর্ষিত, দুঃখিত ও লজ্জিত বোধ করছিলেন—তাকে আশ্বস্ত করলেন। কর্তব্য-পালনই ক্ষত্রিয়ের জীবনধারণের উদ্দেশ্য, তাতে কোন অবহেলা না করলে সেটাই সিদ্ধি বুঝবে ধর্মবোধে যুদ্ধ করা ব্যক্তিগত বিদ্বেষকে প্রাধান্য না দিয়ে, আতত্রাণে দেশবাসীর সেবা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার থেকে বড় কর্তব্য আর কী আছে? যা অসম্ভব তা যদি সম্ভব করতে না পেরে থাকেন কুমার, তো লজ্জা বা ক্ষোভ বোধ করার কোন কারণ নেই।…

এসবই প্রহর দুই কালের কাজ। এই প্রাথমিক দায়িত্ব পালন শেষ হওয়া মাত্র বাসুদেব বৃষ্ণি, অন্ধক ও যাদব প্রধানদের নিয়ে মন্ত্রণাসভায় সমবেত হলেন—স্নানাহারের অবসরটুকুও না নিয়ে। কুলপ্রধানরাও এখানে এসে ধ্বংসকার্য প্রাণক্ষয়ের পরিমাণ দেখা পর্যন্ত অপমানে দগ্ধ হচ্ছেন, সে বহ্নির জ্বালায় অধীর ও উন্মত্তবৎ হয়ে উঠেছেন। কাজ তো একটিই, সে সম্বন্ধে আর দ্বিমত কার? এই অনাচার তস্করতা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ এবং ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তিদান না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই তাঁদের।

যুদ্ধযাত্রা তো বটেই। কিন্তু সেটা কবে, কখন কী ভাবে—প্রশ্ন এই।

স্থির হ’লে আয়োজনে একান্ত আবশ্যক যেটুকু বিলম্ব—তাও প্রাণপণ চেষ্টায় এঁরা সেটাকে ত্বরান্বিত করবেন—সেইটুকু মাত্র অপেক্ষা ক’রেই এরা শাল্বকে শাস্তিদানে যাত্রা করবেন। সৈন্যাপত্যের প্রশ্নে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ সবিনয়ে করজোড়ে প্রধান যোদ্ধাদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ওঁরা রাজধানী রক্ষা করুন, ওঁদের অনুমতি পেলে তিনিই বাহিনী পরিচালনার ভার নেবেন।

এক প্রধান—উদ্ধব সস্নেহে হাস্যে উত্তর দিলেন, ‘আমরাই বরং এতে উপকৃত হলাম বাসুদেব। তবে এত লোক দ্বারাবতী রক্ষায় আর প্রয়োজন হবে না, আমরা তোমার অধীনস্থ যোদ্ধারূপে তোমার অনুগমনই করব। তাতে আমাদের গৌরব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হবে বলে আমি মনে করি না।’

বাকী সকলেই, যেন সমস্বরে, সে প্রস্তাব অনুমোদন করলেন।

সমরায়োজন চক্র আবর্তিত ক’রে প্রায় মধ্যরাত্রে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন বাসুদেব।

রুক্মিণী সঙ্গে এসেছিলেন, এখানে পৌঁছে পুত্রের গুরুতর আঘাতের সংবাদ পাওয়া মাত্র রথের গতিমুখ পরিবর্তিত ক’রে প্রদ্যুম্নের গৃহে চলে গেছেন। সুতরাং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। সামান্য একটুক্ষণ চিন্তা ক’রে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সত্রাজিৎ-দুহিতার পুরীর পথ ধরলেন।

সত্যভামাও অন্যান্য বিশিষ্ট পুরনারীর সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়েছিলেন। যজ্ঞান্তের এক মাস কাল পরে যখন আর্য বলদেব সহ অধিকাংশ যাদব প্রধান প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হলেন তখন তাঁকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এখানের অন্তঃপুর বিপুল, এক জগৎ বিশেষ। তার পরিচালনায় এতটুকু শৈথিল্য ঘটলেই নানা বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রাট দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে সত্যভামার তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি, সামগ্রিক কর্তৃত্বশক্তি ও সাংসারিক কার্যে অভিজ্ঞতা একান্ত প্রয়োজন—এই হেতু দেখিয়েই পাঠিয়েছিলেন। ভৃত্য পরিচারিকা ও অপর কর্মচারীদের দিয়ে সম্পূর্ণ কর্তব্য পালন করিয়ে নিতে সত্যভামার তুলনা কোথায়?

এই অহেতুক কৈতবাক্যে সত্যভামার অধরোষ্ঠে মৃদুমধুর হাস্যরেখাই ফুটেছিল, প্রতিবাদের ভাষা নিগলিত হয় নি। তার প্রথম কারণ—কথাটা অনেকাংশে সত্য। দ্বিতীয়ত—শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনর্থক নয়, বিনা উদ্দেশ্যে কোন ব্যবস্থায় প্রবৃত্ত হন না তিনি, আর–এতদিনে তিনি তাঁর প্রিয়তম আর্যপুত্রকে ভালই চিনে নিয়েছিলেন ইচ্ছা বা আদেশ অত্যন্ত মিষ্ট ভাষায় অনুরোধ এমন কি অনুনয়ের ভঙ্গীতে জানালেও— তা অপরিবর্তনীয়। তাঁর আপাত-অর্থহীন দুর্বোধ্য কর্মপন্থার পরিবর্তন হয় না কখনও। সে আদেশই, এবং তা মান্য করিয়ে নিতেও তিনি জানেন, করিয়ে নিয়ে তবে ছাড়েন। তা সে কৌশলেই হোক, যুক্তিপ্রয়োগেই হোক বা কোন নির্মম কঠিন পদ্ধতিতেই হোক। তাঁর ইচ্ছায় বাধা দেবার চেষ্টা আর কঠিন শৈলগাত্রে সমুদ্রতরঙ্গের বার বার আছড়ে পড়া—সমান নিষ্ফল। তাতে পাষাণ বিচলিত হয় না, বিগলিত তো হয়ই না।

তবু—স্তম্ভগাত্রে প্রবুদ্ধ প্রায় শতাধিক তৈলবর্তিকার উজ্জ্বল আলোতে—শ্রীকৃষ্ণ ওঁর অনিন্দ্যসুন্দর প্রস্ফুট-কমলাননের দিকে চেয়ে বুঝলেন সেখানেও বিরাট একটা বাক বা অভিমানযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে তাঁকে। সোহাগিনী সত্যভামা আজ অতিমাত্রায় ক্রদ্ধ হয়েছেন।

কারণটাও অনুমান করতে অসুবিধা হল না।

তবু তিনি অজ্ঞতা ও সারল্যই শ্রেয় বিবেচনা করলেন এক্ষেত্রে।

রসিকতা ক’রেই বলতে গেলেন, ‘পূর্ণিমার প্রস্ফুট জ্যোৎস্নায় আজ নিদাঘ-সূর্যের উত্তাপ পাচ্ছি যেন! প্রিয়তমে, তোমার এ রোষাগ্নি কার উদ্দেশে মহদ্ভয় উদ্যত-বজ্ররূপে প্রস্তুত হয়ে আছে? সে হতভাগ্য তোমার এ দাসানুদাস নয় তো?

‘কংসারি আজ নিজ জটিল উদ্দেশ্যের ঊর্ণাতন্তু-নির্মাণে এমনই তন্ময় ও একান্তচিত্ত হয়েছেন যে, বহু-ব্যবহারে জীর্ণ রসিকতার রসহীন পুনরাবৃত্তির শ্রুতিকটুতাও আর তাঁর কর্ণকে আঘাত করছে না। হা ধিক, আপনার রসিকরাজ নাম আজ আপনার লজ্জাকর ভূষণে পরিণত হ’ল।’

স্ফুরিতাধর সত্যভামা এক নিমেষকাল স্তব্ধ থেকে নিজের ক্রোধ অভিমান প্রভৃতি আবেগকে কিছুটা সম্বরণ ক’রে নিয়ে পুনশ্চ বললেন, ‘আপনার তো বুদ্ধির সীমা নেই। তা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বার বার আমাদেরই লাঞ্ছনার মধ্যে নিক্ষেপ না ক’রে অন্য উপায় উদ্ভাবন করতে পারেন না? এখনই আবার কিছু দিন দ্বারকা থেকে, আপনার প্রাণের বন্ধুদের যোগাযোগ সীমা থেকে দূরে থাকতে চান—এই তো? তা বেশ তো, তার জন্য বহু কারণই তো তৈরী হতে পারত। শিকারেও তো যেতে পারতেন কোন দূর বনান্তস্থলীতে। হিমালয়ে তপস্যা করতে কিংবা বৃন্দাবনে-পুরাতন- পাদুকার-মতো পরিত্যক্তা গোপিনীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে—অথবা গোদাবরী-তীর্থে স্নান করতে যাওয়া—কত কীই তো কারণ ঘটতে পারত। আপনার তীক্ষ্ণ মানস-ক্ষেত্রের উর্বর ভূমিতে এমন অ-কারণ আবিষ্কার করা তো এক মুহূর্তের ব্যাপার।’

শ্রীকৃষ্ণ অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তখন। আর তিনি বার বারই লক্ষ্য করেছেন, রুক্মিণী আর সত্যভামা এই দুই নারী, হয়ত বা দ্রৌপদীও—তাঁর মনের গহন অরণ্যের বহু গভীরে প্রবেশ করেছে। এদের কাছে অকারণ আত্মগোপন বা অভিনয় করতে গিয়ে লাভও নেই।

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ক’রে মাথার উষ্ণীষ ও কটিবন্ধের অসি কোষমুক্ত ক’রে নীরবেই সত্যভামার প্রসারিত হাতে দিলেন। তারপর একটা উচ্চ-আসনে বসে পড়ে শাণিত শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তাতে শাল্ববধ করা যেত না। এতে একই সঙ্গে দুই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। দুটোই আমার প্রয়োজন। শাল্বর স্পর্ধা ও দুর্বৃত্ততা সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে, শিশুপালের মতোই সে ধরার ভার, মনুষ্যসমাজের আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব এখন থাক প্রিয়ে, আমি সত্যই বড় পরিশ্রান্ত। তৃষার্ত পথিক পিপাসাহরা প্রাণভরা সুধার অন্বেষণে তোমার দুয়ারে অতিথি, তাকে অমৃতের বদলে বহ্নি দিয়ে বঞ্চিত করো না।… একটু বিশ্রাম করতে দাও। বোধ করি এক প্রহরের মধ্যে আমার আগামী কালের কর্মদিবস আরম্ভ হয়ে যাবে। বিশ্রামের অবসর বড় স্বল্প।’ ।

এই পুরুষশ্রেষ্ঠর পক্ষে অস্বাভাবিক, অপরিসীম শ্রান্তি চোখেই দেখা যাচ্ছে, এর পর দুটি ইন্দীবর-কোমল সেবাহস্তে দয়িতের সে ক্লান্তি অপনোদন করতে এগিয়ে আসা ছাড়া উপায় কি? বুকে যে মমতা ঘনিয়ে এসেছে—ঐ ধূলিস্বেদ- বিজড়িত রেখাঙ্কিত ললাট ও অবসন্ন দৃষ্টি দেখে—তাতেই তো আহত অভিমান ও রোষের আগুন তিন-চতুর্থাংশ নির্বাপিত-প্রায়—বাকী যেটুকু, অন্তরের উদ্বেলিত প্রেমে এখনই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

তাছাড়া, ও কণ্ঠস্বরও চেনেন বই কি। বৃথাই কিছু এতকাল এ মানুষটাকে নিয়ে ঘর করেন নি!

এ শান্ত কণ্ঠস্বর—প্রস্তর নয়, প্রস্তরও পর্যাপ্ত তাপে দ্রবীভূত হয়—নিয়তির মতোই কঠিন, নির্মম মৃত্যুর মতোই অনিবার্য।

ওঁর পায়ে মাথা কুটেও লাভ নেই, তাতে নিজের ললাটই রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হবে, ওঁকে বিগলিত করা যাবে না।

২৩

যাকে দেখা মাত্র মন আনন্দে আশ্বাসে কৃতজ্ঞতায় তৃপ্তিবোধে ভরে যায়—কখনও কখনও সে অসেচনককে দেখেও আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে উঠতে হয়–এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা যুধিষ্ঠিরের।

বিদুর চিরদিনই তাঁদের হিতাকাঙ্ক্ষী—তাঁরাও বিদুরের প্রিয়–তবু সেদিন ওঁকে দেখেই কোন এক অজ্ঞাত অমঙ্গলাশঙ্কায় যেন তাঁর বুক কেঁপে উঠেছিল। এখন ওঁর বার্তা শুনে বিহ্বল হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বহুকাল কোন বাক্যস্ফূৰ্তি হ’ল না।

বিহ্বলতা ছাড়া আর কোন শব্দে তাঁর তখনকার মনোভাব বর্ণনা করা যায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা বললেও ঠিক বলা হয় না। এ প্রস্তাব, এ আমন্ত্রণ এতই অপ্রত্যাশিত, বিদুরের মুখভাব এমনই ভাবলেশহীন নির্বিকার, আত্মীয়তাসম্পর্কহীন—যুধিষ্ঠিরের আননের প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্রে পূর্ব পূর্ব কালে যে বিদুরের দৃষ্টি স্নিগ্ধ ও মুখভাব প্রীতিকোমল হয়ে উঠেছে–যে, তাঁর মুখনিঃসৃত বাক্যগুলির মর্মার্থ বুঝতে বেশ একটু বিলম্ব ঘটল।

দুর্যোধন এক নূতন সভাগৃহ নির্মাণ করিয়েছেন সে সভাগৃহ প্রবেশের অনুষ্ঠানে কুলাগ্রজ হিসাবে তিনি যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। নূতন সে সভার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ অগ্রজ, ভারতের অবিসম্বাদী সম্রাট যুধিষ্ঠির—এই তাঁর ইচ্ছা। দুর্যোধন সেই উৎসব উপলক্ষে কিঞ্চিৎ দ্যূতক্রীড়ার আয়োজনও রেখেছেন। কুরুবৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর এই উভয়বিধ অনুষ্ঠানে সপরিবারে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। বিদুর আত্মীয়রূপে, কুরু-রাজ্যের মন্ত্রীরূপে এসেছেন বলেই সঙ্গে পুরোহিত বা কোন রাজকুলবধূকে আনার আবশ্যকতা বোধ করেন নি। তিনি আশা করেছেন মহারাজ-চক্রবর্তীর কাছেও সেটা কোন ত্রুটি বলে গণ্য হবে না।

বাহ্যত এ বক্তব্য অতি প্রাঞ্জল, কোন বাক্য বা বাক্যাংশের শব্দগত অর্থ বুঝতেও কোন অসুবিধা নেই।

বিহ্বলতা বা অর্থগ্রহণে অসুবিধা অন্য কারণে।

এ আমন্ত্রণ এত আকস্মিক, এত অকারণ এবং বিদুরের মুখভাব ও কণ্ঠস্বর এমনই চেষ্টাকৃত আত্মীয়তালেশহীন যে, যুধিষ্ঠিরের এই যোগাযোগগুলোর গূঢ়ার্থ অনুসন্ধানের ব্যাকুলতাতেই সরল মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না।

সবচেয়ে বিস্ময়কর বিদুরের আচরণ।

এই কঠিন নিস্পৃহতা বা নৈর্ব্যক্তিকতার একটি মাত্র অর্থ হয়—এ যাত্রায় তিনি মাত্র আদেশ পালন করতেই এসেছেন, এ কার্যে তাঁর হৃদয়ের বা বিচার-বুদ্ধির অনুমোদন নেই।

বিদুর শুধুই ধর্মজ্ঞ বা ধর্মপরায়ণ নন। তিনি অতীব বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বহুদূরদর্শী বলেও তাঁর খ্যাতি আছে। তিনি সর্বদা সৎ পরামর্শ দেন। কদাচ কোন অসৎ বা অমঙ্গলকর পরামর্শ দেন না, ভবিষ্যতে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে এমন প্রস্তাব অনুমোদন করেন না। এই সত্য সম্যক অবগত আছেন বলেই তাঁর পরামর্শ সর্বদা প্রেয় বা রুচিকর বোধ না হলেও শ্রেয়জ্ঞানে, তাঁকে যথার্থ শুভার্থী জ্ঞানে মন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত রেখেছেন ধৃতরাষ্ট্র, পুত্রদের প্রবল প্রতিবাদ সত্বেও।

বিদুর তাঁর জীবনদর্শন ও জীবনাদর্শকে ধর্ম ও সত্যের সঙ্গে যুক্ত রেখেছেন বলেই সম্ভবত খলবুদ্ধি-বর্জিত পাণ্ডবরা তাঁর সমধিক প্রিয়। চিরদিন তিনি এঁদের কল্যাণ কামনা ক’রে এসেছেন। সে পরিচয়ও চূড়ান্তভাবে পেয়েছেন যুধিষ্ঠির বারণাবত যাত্রার সময়। বিদুর সতর্ক ক’রে না দিলে আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা প্রস্তুত হতে পারতেন না। এমন কি বিপদের কোন আশঙ্কাই তাঁদের মনে দেখা দিত না হয়ত। সেই বিদুরের এই দুর্বোধ্য মুখভাব আদৌ কোন শুভ সূচিত করছে না।…

যুধিষ্ঠির বহুক্ষণ এইপ্রকার হতভম্ব ভাবে বসে আছেন দেখে বিদুর তাঁর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলেন সাবধানে, যেন প্রতিটি শব্দ স্মরণ ক’রে ক’রে।

এবার বাক্যগুলির মধ্য থেকে সরল ও সাধারণ আপাত-বক্তব্যটুকু মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে আর বিলম্ব হ’ল না।

তথাপি, আরও কিছুকাল নীরব থেকে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, ‘ক্ষত্তা, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য ও পরামর্শ জানতে পারি কি?’

এবার বিদুরের ললাট উজ্জ্বল, মুখভাব কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক বোধ হ’ল।

তবে তিনিও আর একটি প্রশ্নেই এর উত্তর দিলেন, ‘তুমি আমার ব্যক্তিগত মত শুনতে চাও?’

‘হ্যাঁ। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী ও স্নেহপরায়ণ পিতৃব্যরূপে।’

‘বৎস, দ্যূতক্রীড়ায় কারও মঙ্গল হয়েছে বলে আমি শুনি নি। অপিচ এই ক্রীড়া উপলক্ষ ক’রে বহু বিবাদবিসম্বাদ, রক্তক্ষয়, স্বজনহানির ভয়াবহ ও শোকাবহ বিবরণ আমার শোনা আছে। পণ রেখে যে খেলা হয়, তাতে অনেক সময় নিজের বিচারবুদ্ধি নিষ্ক্রিয়, দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায়, হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। এসব ক্রীড়ার নেশা আসব পানের আসক্তি অপেক্ষাও প্রবল। আমি এ আয়োজনে আমার অনিচ্ছা ও আপত্তি জানিয়েছিলাম, কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহমোহান্ধ হয়ে তাতে কর্ণপাত করেন নি। আমি তাঁর বেতনভুক ভৃত্যরূপে তাঁর আদেশ পালন করতে এসেছি, এ আমন্ত্রণে বা এ দ্যূতক্রীড়ার ব্যবস্থায় আমার কিছুমাত্র অনুমোদন বা আনন্দ নেই। তোমরা সপরিবারে তোমাদের পৈতৃক বাসভবনে— আমার একান্ত সন্নিকটে যাবে, সে সম্ভাবনাতেও আমি কিছুমাত্র উৎফুল্ল বোধ করছি না। এই সভাগৃহ অতি দ্রুত নির্মিত হয়েছে, পাপবুদ্ধি সৌবল এর প্রধান উদ্যোক্তা ও এই সমস্ত আমন্ত্রণ-পর্বের পরামর্শদাতা। দুর্যোধন একান্ত ভাবে তার পরামর্শেই চালিত হচ্ছেন। বৎস যুধিষ্ঠির, এ সকলের মধ্যে আমি কিছুমাত্র মঙ্গল লক্ষণ দেখছি না, পরন্তু যৎপরোনাস্তি উদ্বেগ বোধ করছি।’

বিদুর নীরব হলে যুধিষ্ঠির ললাটে হস্ত মর্দন করে কিছুক্ষণ বিভ্রান্তের মতোই কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘এক্ষেত্রে উপায়?’

‘তুমি তোমার বুদ্ধি ও ভ্রাতৃগণের পরামর্শ অনুসারে যদি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পার তাহলেই সকল দিক রক্ষা হয়।’

যুধিষ্ঠির বিপন্ন মুখে বললেন, ‘কিন্তু ক্ষত্তা, শুনেছি ভদ্রজনসমাজে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধ ও দ্যূতক্রীড়ার আহ্বান গ্রহণ না করা কাপুরুষতা বলেই গণ্য হয়। মাত্র কিছুদিন পূর্বে সমগ্র রাজন্যসমাজ যাঁকে সম্রাট বলে স্বীকার ও পূজা করেছেন, তাঁর পক্ষে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা কি শোভন বা সঙ্গত হবে?’

বিদুর যেন ঈষৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠেই বললেন, ‘সাধারণ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও রাজার ধর্ম এক নয় বৎস। রাজার সর্বপ্রথম কর্তব্য তাঁর প্রজাদের প্রতি। তার পর তাঁদের ও বংশের মর্যাদা রক্ষা করার প্রশ্ন, নিজ সিংহাসনের নিরাপত্তার প্রশ্নও বিবেচনা করা কর্তব্য। তোমার রাজত্বে যারা সুখে আছে, নিত্যবর্ধমান সমৃদ্ধি ভোগ করছে—তাদের এক অত্যাচারী দাম্ভিক নিজসম্ভোগসর্বস্ব প্রতিবেশী রাজ-পরিবারের করুণায় নিক্ষেপ করার কোন অধিকার তোমার নেই।… তাছাড়া, শব্দ ও বাক্য প্রয়োগের গুণে ও নিপুণতাতেই বার্তা মনোহারী হয়, অন্যথায় অরুচিকর ও অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে। প্রত্যাখ্যানের শত শত সত্য কারণ নির্ণয় কি রাজনীতিবিদ বা রাজ্যশাসকদের পক্ষে এমন কিছু কঠিন কাজ?… এমন কি এমতাবস্থায়—আত্মরক্ষার জন্যই বলতে গেলে—সামান্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াতেও অন্যায় হয় না—শাস্ত্রে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে।’

যুধিষ্ঠির নত মুখে নীরবে বসে রইলেন, কোন প্রত্যুত্তর করলেন না। অর্থাৎ এ পরামর্শ তাঁর মনঃপূত হ’ল না। বিদুর এবার প্রমাদ গণলেন। সৎপরামর্শ যখন গ্রহণযোগ্য বোধ হয় না—তখনই বুঝতে হবে যথার্থ দুঃসময় এসেছে, দুর্গ্রহ-সমাবেশ হয়েছে শ্রোতার রাশি-লগ্নে।

তিনি অল্প কিছুক্ষণ যুধিষ্ঠিরের উত্তর প্রতীক্ষা ক’রে উৎকণ্ঠিত ভাবে পুনশ্চ বললেন, ‘বেশ তো, তোমাদের শুভাশুভ সকল কর্মে যিনি তোমাদের হিত পরামর্শ দেন, যিনি যথার্থ তোমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী—সেই বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করছ না কেন? তাঁর পরামর্শ চেয়ে পাঠাও না!’

এবার বোধ করি উপদেশটা ধর্মরাজের মনোমত হ’ল। তবু তিনি ঈষৎ চিন্তা ও দ্বিধা-গ্রস্ত চিত্তে বললেন, ‘কিন্তু যত দ্রুতই দূত-যাতায়াতের ব্যবস্থা করি না কেন, দণ্ডকাল মাত্র বিশ্রাম গ্রহণ না ক’রেও যদি সুদ্ধমাত্র অশ্ব পরিবর্তন করার কাল-হরণই করে সে, তাহলেও এখান থেকে দ্বারাবতী যাতায়াতে মাসাধিক কাল লাগবে, কুরুরাজদূত কি এতদিন অপেক্ষা করতে পারবেন? আপনি তো সে রাজ্যের মন্ত্রীও বটে!’

‘না-ই বা পারলাম। এত বড় বিশাল রাজ্য-শাসন ব্যবস্থার যাঁরা নিয়ন্তা, যাঁদের দায়দায়িত্বের অন্ত নেই—তাঁরা এক মুহূর্তের মধ্যেই সকল কার্য ফেলে এই প্রায়-অকারণ আমন্ত্রণে যাত্রা করবেন—এমন আশা করাই তো অসঙ্গত। তোমাদের সকল দিক বিবেচনা ক’রে অনুপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী হলে সে অবস্থায় কে কোন ভার নেবেন তার ব্যবস্থা করতে— মনস্থির করতে বিলম্ব হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’

তারপর কিছুকাল নীরব থেকে—যেন মনে মনে হিসাব ক’রে নিয়ে বিদুর বললেন, ‘আমি বরং পাঁচ ছয় দিন বিশ্রাম নিয়েই পুনর্যাত্রা করি। এই কথাই তাঁদের জানাই যে এ আমন্ত্রণের উত্তর দিতে তোমাদের কিছুদিন বিলম্ব ঘটবে। তোমাদের মন ও বক্তব্য স্থির হলে তোমাদের দূত সে উত্তরের বার্তা সেখানে পৌঁছে দেবে। ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’

‘আপনি আরও কিছুদিন বিলম্ব করতে পারেন না?’

‘মহারাজ-চক্রবর্তী আদেশ করলে অবশ্যই তা পালন করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে সেখানে অধীরতা ও ঔৎসুক্য বৃদ্ধি পাবে, দুর্যোধন অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন। ভাববেন আমি এখানে থেকে তোমাকে তাঁদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছি। তার প্রয়োজন নেই, আমি আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী একজনকে রেখে যাচ্ছি, সে ই তোমাদের প্রতিক্রিয়া ও উত্তরের বার্তা নিয়ে যথাসময়ে হস্তিনা যাত্রা করবে।’

সেই ব্যবস্থাই হ’ল।

কঠোর পরিশ্রমী, অভিজ্ঞ ও পারগ বার্তাবহদের সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী রথে প্রেরণ করা হ’ল দ্বারকায়। তাদের দুটি দলে বিভক্ত ক’রে দুই দলকে দুই বিভিন্ন পথে পাঠানো হ’ল। এক দল যদি কোন কারণে বিপন্ন হয় কি দ্যসুহস্তে নিগৃহীত কিংবা বন্দী হয়, আর এক দল পৌঁছতে পারবে। দুই দলের হস্তে একই পত্রের প্রতিলিপি দেওয়া হ’ল। স্থির রইল—এরা কেউই পথিমধ্যে বিশ্রাম করবে না, রথেই রাত্রিদিন বাস করবে। কেবলমাত্র সম্রাটের অশ্বশালাগুলি থেকে তাঁর অনুজ্ঞালিপি অনুযায়ী সারথি ও অশ্ব পরিবর্তিত হবে—তাদের শ্রান্তি বিবেচনা ক’রে।

কিন্তু মাসাধিককাল পরে দুই দলই ফিরে এসে একই সংবাদ নিবেদন করল—শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় অনুপস্থিত। কোথায় ঠিক আছেন, কেউ জানে না। বাসুদেবের ইন্দ্রপ্রস্থ অবস্থানকালে শাল্ব দ্বারকা উৎসাদন ও লুণ্ঠন করেছেন। নিগ্রহে নিপীড়নে দুর্দশার চরম হয়েছে বৃষ্ণি ও অন্ধকদের, শিশু ও নারীর হাহাকারে সেখানের আকাশ বাতাস পর্যন্ত যেন ক্রুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। শ্রীকৃষ্ণ এখান থেকে প্রত্যাবৃত্ত হবার পর এই দৃশ্য দেখে ও দুর্দশার কাহিনী শ্রবণ ক’রে প্রতিশোধ-পিপাসায় উন্মত্তবৎ হয়ে বিনা বিশ্রামে প্রায় তৎক্ষণাৎই শাল্বর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। শাল্ব সৌভ নামক ত্রিচর বিমানের অধিকারী। তিনি অন্তরীক্ষ থেকে যুদ্ধ ক’রে আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রগর্ভে আশ্রয় নেন। শ্ৰীকৃষ্ণ আহার-নিদ্রা ত্যাগ ক’রে সর্বত্র তাঁর অনুসরণ করছেন, কখন কোথায় তাঁদের যুদ্ধ হচ্ছে তা কেউ জানে না। সুতরাং বাসুদেবের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রে যুধিষ্ঠিরের পত্র তাঁকে দেওয়া সম্ভব হয় নি।

আবারও সেই দ্বিধা, সেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা।

কিন্তু বিস্ময়ের এই, দুঃসময় আসন্ন হলে যেমন বুদ্ধিনাশ হয়—এই দারুণ দায়িত্ব ও সুদূর-বিপদসম্ভাবনাপূর্ণ ইতিকর্তব্য নির্ধারণে তিনি ভ্রাতাদের পরামর্শ নেওয়াও উচিত বিবেচনা করলেন না। প্রহরকালমাত্র ইতস্তত ক’রে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার সম্মতি জানিয়ে কুরুরাজ-দূতকে রীতিমতো উপঢৌকন ও পুরস্কারাদি দিয়ে বিদায় দিলেন।

তারপর যখন ভ্রাতা ও স্ত্রীদের জানালেন তখন আর করার কিছুই নেই। ভীম ক্রদ্ধ হলেন, অর্জুন প্রচ্ছন্ন তিরস্কার করলেন—ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নকুল গম্ভীর হয়ে রইলেন। কিন্তু রাজসম্মতির অন্যথা করা তখন আর সম্ভব নয়।

আসলে শকুনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন—যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ায় দুর্বল, অপটু, সেইজন্যই তাঁর এ ক্রীড়ায় আসক্তি প্রবল। সেই প্রলুব্ধ আসক্তিই দুর্বার গতিতে তাঁকে আকর্ষণ করেছে—অথবা নিয়তি, কে জানে কি!

এই সংবাদ নিয়ে হস্তিনায় দূত পৌঁছলে সেখানে মহোৎসবের মহোল্লাসধ্বনি উঠল। প্রাসাদের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে পান-ভোজনের বন্যা বয়ে গেল প্ৰায়!

কেবল বিদুর ললাটে করাঘাত ক’রে অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘পাণ্ডব সৌভাগ্য-সূর্য প্রায় উদয়ক্ষণেই অস্ত গেল! সম্মুখে দুর্ভাগ্যের দুস্তর রাত্রি। জানি না বাসুদেব, এ তোমার কি খেলা।’

যাত্রার ঠিক পূর্বক্ষণে—ঠাটকটক প্রস্তুত, অগ্রগামী দল যখন প্রায় ইন্দ্রপ্রস্থের সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, পশ্চাদনুসরণকারী দলের অসহিষ্ণু অশ্বনিচয়ের হ্রেষারব নদীর পরপারবর্তী শৈলসানুতে প্রতিধ্বনি জাগ্রত ক’রে শান্ত অনুদ্বিগ্ন নগরবাসীদের সচকিত ও ত্রস্ত ক’রে তুলছে—তখন সামান্য একটু বাধা পড়েছিল।

পট্টমহাদেবীর শিবিকা থেকে এক করঙ্কবাহিনী এসে সংবাদ দিল—যাত্রায় বিঘ্ন দেখা দিয়েছে, সম্রাজ্ঞী অকস্মাৎ রজস্বলা হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তো যাত্রা নিষিদ্ধ। মহাদেবীও অস্বস্তি বোধ করছেন, অমঙ্গল আশঙ্কা করছেন। এক্ষণে মহারাজ-চক্রবর্তীর কি নির্দেশ জানতে চান তিনি।

যুধিষ্ঠির এই অযথা বিলম্বে বিরক্ত মুখে ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে উত্তর দিলেন, ‘আমরা পূর্বেই যথাবহিত শাস্ত্রবিধি-অনুযায়ী যাত্রা ক’রে প্রাসাদপরিখা অতিক্রম করেছি, এখন যা-ই ঘটুক, তাতে যাত্রার বাধা জন্মাবে না। পট্টমহিষীর শিবিকা আমাদের রথের পুরোভাগে আনতে বল, তিনিই অগ্রগামিনী হবেন। মহিষীরা সকলেই আগে যাবেন, আমাদের রথ তাঁদের অনুগামী হবে—এই আমার ইচ্ছা।’

এর পর আর কোন প্রশ্নই ওঠে না।

সেই মতোই শিবিকা, রথ, হস্তী, অস্ত্র ও খাদ্যবস্তুবাহী গোশকট ইত্যাদি একে একে চলে গেলে পশ্চাদংশরক্ষাকারী সৈন্যদল তাদের অনুগামী হ’ল। এই বিপুল যানবাহন-পদোৎক্ষিপ্ত ধূলিতে মনে হ’ল–প্রাক-মধ্যাহ্নসূর্যের প্রদীপ্ত রশ্মিজাল প্রাবৃটজলদাবৃত হয়েছে, প্রায় প্রভাতকালেই নেমেছে সন্ধ্যায় ছায়া।

সেই ধূলিরাশিও দীর্ঘকাল বায়ুতাড়িত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় যখন স্থির ও ভূমিস্থ হয়ে এল, সূর্যকিরণ ও তার খরতাপ পুনশ্চ পথচারীর দেহকে উত্তপ্ত ও স্বেদসিক্ত ক’রে তুলল, তখন দেখা গেল আরও কয়েকটি প্রাণী পদব্ৰজে এই দলের অনুসরণ করছে।

নিষাদ কীলক ও কয়েকটি সারমেয় পরিবৃত বিরাট একদল বৃষ ও শূকর। কীলকও বোধ করি বাণিজ্য করতেই চলেছে। কিন্তু আজ তার চোখে মুখে সেই প্রায়চিরস্থায়ী হিংস্রতা ও ঘৃণার ভাব নেই, বরঞ্চ এক অপরিসীম তৃপ্তির প্রসন্নতা ফুটে উঠেছে। ফলে তার বীভৎস মুখও অপেক্ষাকৃত দৃষ্টিসহনীয় বোধ হচ্ছে।

কীলক যেতে যেতে সঙ্গীতের কলির মতোই অস্ফুটস্বরে বার বার একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করছিল, ‘সর্বনাশের দিকে ছুটে যাবার কী আনন্দ, কী আগ্রহ! নিজেরই হোক পরেরই হোক—সর্বনাশের পথই বোধ করি অধিকতর মনোহর।‘

২৪

রাজকুলের অন্তঃপুরেও সৌজন্যরক্ষার কতকগুলি বাঁধাধরা রীতি আছে—যা অবশ্য-পালনীয়। সে কথা জানেন ও কৌরববধূরা। তত্রাচ তাঁদের প্রত্যেককেই সে সম্বন্ধে পুনশ্চ সচেতন ক’রে দেওয়া হয়েছিল। এই সতর্কীকরণের জন্য বিশেষ সংবাদবাহিকা থাকেন, তিনি রাজা বা প্রধানা মহিষী–বা অন্তঃপুরের কর্ত্রী

স্থানীয়া—তাঁর নির্দেশ প্রতি বধূ বা কন্যার কক্ষে কক্ষে গিয়ে জানিয়ে দিয়ে আসেন। ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় নি।

যে বধূরা প্রধান প্রাসাদে থাকেন না, দুর্যোধন বা দুঃশাসনের পত্নীগণ—এই সব প্রধান কুমাররা স্বতন্ত্র গৃহে দাসদাসী পরিজন নিয়ে পৃথক বাস করেন—তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা যেন ঐদিন পাণ্ডবপুরনারীদের অভ্যর্থনার জন্য স্নান প্রসাধন সমাপ্ত ক’রে প্রাসাদে এসে অপেক্ষা করেন। কারণ পৃথক বাস করেন স্থানাভাববশত, মূলে তাঁরা এই পরিবারের অন্তর্গত, প্রধানা মহিষী গান্ধারীর অধীন। অন্তত লোকদৃষ্টিতে তাই। পাণ্ডবমহিষীগণ, রাজমাতা ও অন্যান্য যেসব পুরললনা তাঁদের সঙ্গে আছেন, অন্তঃপুরের প্রবেশপথে রথ বা শিবিকা থেকে বস্ত্রবেষ্টনী সরিয়ে হাত ধরে নামিয়ে আনতে হবে। এবং প্রতি অতিথিকে এক জন হিসাবে পুরবর্তিনী হয়ে নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে পৌঁছে দিতে হবে।

মর্যাদা উভয় পক্ষেরই বিচার্য। সেই ভাবেই অভ্যর্থনা পর্ব পালিত হবে। নির্দেশও খুব স্পষ্ট। দুর্যোধনের প্রধানা পত্নী ভানুমতী পাণ্ডবদের পট্টমহাদেবী দ্রৌপদীর হাত ধরে নামাবেন, মাল্যচন্দন নববস্ত্রে ভূষিত করবেন, উপহারাদি গ্রহণ করবেন, তারপর হাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। অন্যান্য বধূরা এ পক্ষের অপরাপর মহিষীদের বা বধূদের নামাবেন, বয়স ও পদবীর ক্রম অনুযায়ী এ পক্ষের বধূরা কে কাকে স্বাগত জানাবেন, তাও পূর্বেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই রীতি অনুযায়ী গান্ধারীরও দেহলীপ্রান্তে আসবার কথা—গান্ধারীর যাতা রাজমাতা কুন্তীকে অভ্যর্থনা করার জন্য। কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাতে ওঁর এমনি যথেষ্ট আগ্রহ কিন্তু এক্ষেত্রে একটু দ্বিধা ও সঙ্কোচ ছিল। পুত্রদের এ ষড়যন্ত্রে অবশ্যই তাঁর সম্মতি নেওয়া হয় নি। তাঁকে এ সমস্ত সংবাদ জানানোই হবে না—এটা পিতা-পুত্র কোন আলোচনা না ক’রেও স্থির রেখেছিলেন। অলিখিত বা অকথিত চুক্তি বলা যায়। কিন্তু একান্ত ধর্মপরায়ণা ও অতিশয় বুদ্ধিমতী গান্ধারী যেন বাতাসেই অধর্মের গন্ধ পেতেন। অকস্মাৎ পাণ্ডবদের সাড়ম্বরে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সাজ সাজ রব পড়ে গেছে— ভৃত্য সেবক পরিজন দেহরক্ষী সারথি তৈজসবাহক—এতগুলি লোকের স্থানসংকুলান করা, তাদের খাদ্য-পানীয় ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, খুব সহজ কর্ম নয়, নিঃশব্দে করার মতোও নয়।

এ সবই কেবলমাত্র সৌজন্যবশত নয়। বিশেষ কোন উৎসব, সানন্দ অনুষ্ঠান—সৌজন্য, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাত্রর ঘটনা হলে পূর্বেই তাঁকে জানানো হত, তাঁর মত ও নির্দেশ নেওয়া হ’ত। তাতে যে এসব কর্মদায়িত্ব পালনের গুরুভার অনেক লাঘব হত—তাঁর পুত্রদের তাও অজানা নেই। তাঁকে জানানো হয় নি আশঙ্কাবশতই। তিনি দৃঢ় ও স্পষ্ট কণ্ঠে কোন কার্যে নিষেধ করলে এ পুরীতে এমন কেউ নেই যে সে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে সাহসী হত। এ অন্য কিছু এবং এতে পাণ্ডবদের শুভ কি কল্যাণ নেই। অধর্মের পথ অবলম্বন করলে কৌরবদেরও না। মূঢ়রা জানে না, অধর্মে কিছুদিন বেশ সুবিধা হতে পারে, জয় বা সাফল্যও অসম্ভব নয়, কিন্তু সে পথে গেলে একদিন সমূলে বিনষ্ট হতে হবে।

সঙ্কোচ এই কারণেই ছিল. রাজমাতা কুন্তী সে দায় থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিলেন, রাজধানীতে প্রবেশের পূর্বেই দ্রুতগামিনী দূতী প্রেরণ ক’রে জানিয়ে দিলেন—তিনি বিদুরের গৃহেই বাস করবেন এবং সরাসরি সেখানেই চলে যাবেন

সুতরাং ভানুমতীই আজ সর্বতো কর্ত্রী অভ্যর্থনাকারিণীদের প্রধানা। তবে, এই প্রথম, প্রাধান্য তাঁর কাছে অরুচিকর ঠেকছে।

ভানুমতী কুরুভাণ্ডারের সর্বাপেক্ষা মহার্ঘ্য মণিমুক্তার অলঙ্কারে সর্বাঙ্গ আবৃত ক’রে, নিপুণভাবে অতিশয় অনিচ্ছা ও অরুচির ভাবটিই মুখে ফুটিয়ে দ্বারে এসে দাঁড়ালেন। ঈর্ষার চিহ্নমাত্রও না মুখে ফোটে এই তাঁর চেষ্টা। উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য, রূঢ়তা যা হয় বুঝুক ওরা—কিন্তু মাৎসর্য অর্থাৎ তিনি ঈর্ষিতা—এ কথা না ভাবতে পারে।

কিন্তু প্রথমেই প্রচণ্ড একটা আঘাত পেলেন দুর্যোধন-মহিষী—যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। যে অবস্থার কথা সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না।

অথচ এর মধ্যে পাণ্ডবদের কোন চক্রান্ত বা পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ঘটনাটা নিতান্তই আকস্মিক। খাণ্ডবপ্রস্থ পার হওয়ার সময় কে বা কারা অন্তরাল থেকে তীক্ষ্ণ ও অব্যর্থ শরনিক্ষেপে মহারাজ্ঞী কৃষ্ণার রথের চারটি অশ্বকেই গুরুতর আহত করল। জীবন রক্ষা হোক বা না হোক সে পরের কথা, রথাকর্ষণ অন্তত এযাত্রা তাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।

ঘটনাটা যে সত্যই ঘটেছে এবং তার গুরুত্ব অনুভব করতেই বহুক্ষণ সময় লাগল এঁদের।

এত দুঃসাহস কার? এর থেকে সাক্ষাৎ কৃতান্তর মুখগহ্বরে প্রবেশ করাও যে অনেক তুচ্ছ এবং নিরাপদ কাজ!

প্রথমেই সন্দেহ হয় এ কোন কৌরব গুপ্তচরের কাজ—কিন্তু পাণ্ডব ভ্রাতারা শোভনতা ও স্বীয় বংশের সম্মানের কথা চিন্তা ক’রে কেউই সে সংশয় মুখে উচ্চারণ পর্যন্ত করলেন না। তার পরিবর্তে সেখানকার বিটপীবহুল বনস্থলীতে যাকে বলে ‘পত্রে পত্রে সন্ধান’ তাই করলেন। কিন্তু নিজেদের বিশ্বস্ত পরিচিত যাত্রীদলভুক্ত লোক ছাড়া তেমন সন্দেহভাজন কাউকেই পাওয়া গেল না। এক, কয়েকজন নিরীহ নিষাদ মাংসব্যবসায়ী তাঁদের পিছু পিছু আসছিল একপাল মৃগ ও শূকর নিয়ে—এদের প্রয়োজনমতো কিছু ব্যবসায় করবে এই আশায়—এত সাহস তাদের হবে এ কথা কারও মনে হ’ল না। তারা ছিলও অনেক পিছনে, তাছাড়া তাদের কাছে যে ধনুঃশর ছিল তা নিতান্তই গ্রাম্য বা বন্য ধরনের, গৃহনির্মিত। আমমাংসের স্থ±ল তন্ত্রী ও বেত্রদণ্ডের ধনু, শর প্রভৃতিতেও কুত্রাপি কোন নিপুণতার চিহ্ন নেই। যে সুতীক্ষ্ণ সায়কে রাজ-অশ্বগণ আহত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে কোন সুদক্ষ যান্ত্রিক দ্বারা প্রস্তুত। এবং অভ্যস্ত ও সুশিক্ষিত পটু ছাড়া এমন অব্যর্থ শরসন্ধানও সম্ভব নয়।

অগত্যা অনুসন্ধান পর্বে ছেদ টানতে হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন মহাদেবী কিসে যাবেন? অন্য কোন শিবিকারোহিণীর সঙ্গে যাওয়া তাঁর পক্ষে অশোভন, অমর্যাদাকর। রথ বা শিবিকা হয়ত একটা খালি করিয়ে নেওয়া যেতে পারে তবে তা মহামহিষীর উপযুক্ত হবে না। অনেক চিন্তা ও আলোচনার পর মনে পড়ল—এই রাজযাত্রী-দলের পুরোভাগে একটি হস্তী যাচ্ছে, সৌন্দর্য ও আড়ম্বরের লক্ষণ হিসাবে — হস্তীপৃষ্ঠে রাজজনোচিত বরগুকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিন্তু আরোহী কেউ নেই। এ হস্তী রাজসূয় যজ্ঞে প্রাগজ্যোতিষপুরের উপহার হিসাবে এসেছে, পর্বতকার বিরাট ও সুদন্তী এবং সুশিক্ষিত। সুসজ্জিত তো বটেই। ভীমসেন আদেশ করলেন, ‘মহামহিষী কৃষ্ণা ঐ গজপৃষ্ঠেই আরোহণ করুন, তাতে তাঁর মর্যাদা খর্ব হবে না। অসুবিধারও কোন কারণ নেই। বরং তাঁর অনুরূপ বাহন বলেই বিবেচিত হবে সকলের কাছে। আরোহিণীর জন্য যে বরণ্ডক আছে তা যথেষ্ট আরামদায়ক, বিস্তৃত ও মহার্ঘ্য বস্ত্রাবরণে নাতিক্ষুদ্র গৃহতুল্য বলেই বোধ হবে, স্বচ্ছন্দে যেতে পারবেন। মনে হচ্ছে যেন ওঁর জন্যই, কেউ পূর্বাহ্নে এ সম্ভাবনার কথা চিন্তা ক’রেই, এভাবে সুসজ্জিত করেছে।’

এ প্রস্তাবে আপত্তির কোন কারণ খুঁজে পান নি কেউ। এর মধ্যে যে কিছু অতিরিক্ত দম্ভ প্রকাশ পেতে পারে বা অপরকে ক্ষুদ্র করার চেষ্টা বলে মনে হবে—তাও কারও চিন্তায় আসে নি ……

প্রাসাদান্তঃপুরের প্রবেশপথের কিছু দূরেই সে বিপুলকায় হস্তীকে থামতে হ’ল। কারণ বহির্দ্বার রথ বা শিবিকার কথা চিন্তা ক’রেই হয়ত নির্মিত হয়েছিল, এমন বিশালকায় বাহনের কল্পনা ছিল না। শিক্ষিত হস্তী অবশ্য পরিচালকের ইঙ্গিতে অতি সাবধানে বসে পড়ল তবু সে প্রাবৃটকান্তি গজপৃষ্ঠকে স্ত্রীলোকের পক্ষে পর্বতকারই বোধ হবার কথা, ভয়াবহ তো বটেই।

অবশ্য এমনি কারও পক্ষেই সেখান থেকে নেমে আসা সম্ভব নয়। এক শিক্ষিত মহামাত্র ছাড়া। সে ব্যবস্থাও ছিল, রজতনির্মিত এক সোপানশ্রেণী সঙ্গেই আসছিল, মহারাজ্ঞীর অবতরণের সুবিধার্থ তা আসনের সঙ্গেই একেবারে লাগিয়ে দেওয়া হ’ল।

কিন্তু ভানুমতীর অন্য সমস্যা। এক্ষেত্রে তাঁর করণীয় কি? হস্তীপৃষ্ঠ থেকে নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা—অথবা সেখান পর্যন্ত উঠে গিয়ে নামিয়ে আনা? রাজ-আচরণবিদের নির্দেশ খুব স্পষ্ট বাম হস্তে শি বিকা বা রথের বস্ত্রবেষ্টনী অপসারণ ক’রে দক্ষিণ হস্তে আরোহিণীর দক্ষিণ হস্ত ধারণ ক’রে সসম্মানে নামিয়ে নিতে হবে। এ তো শিবিকাও না এক্ষেত্রে কি কর্তব্য?

চিন্তা করা, অপেক্ষা করার সময় নেই। প্রাসাদ-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ আনার চেষ্টা করা তো বাতুলতা। অগত্যা সেই ঈষৎ দোলায়মান স্বল্পপরিসর সোপান বেয়ে—অস্থায়ী সোপান বলেই পা রাখার স্থানও সংঙ্কীর্ণ—উঠে যেতে হয়। কিছুদূর তো যেতেই হবে যদি পাণ্ডবমহিষী অভিমানবশত বসেই থাকেন তো পুরোটাই উঠতে হবে। এ যেন মর্ত্যের জীবের স্বর্গবাসিনীকে নামিয়ে আনতে যাওয়া!

এ অপমান মৃত্যুতুল্য বোধ হ’ল ভানুমতীর। অজ্ঞাতকুলোদ্ভবা ক্রীতদাসীর মতো নগণ্য ও অবজ্ঞেয় ব্যক্তির পর্যায়ে পৌঁছলেন বলে মনে হতে লাগল। চোখে জল আসা স্বাভাবিক। কিন্তু সে তো সামান্যা প্রাকৃত স্ত্রীলোকের পক্ষে। রাজরাণীর কারও সামনে চোখের জল ফেলতে নেই, সে অধিকতর অপমান। এসব জেনেও ওঁর দৃষ্টি এত অবাধ্য হ’তে চায় কোন স্পর্ধায়?

তবু এতেই দীনতার শেষ নয়। উপরে উঠতে উঠতেই চোখে পড়ল গজপৃষ্ঠের হেমনির্মিত আসনবেষ্টনীতে পাশ্চাত্য দেশাগত যে সূক্ষ্ম পশুলোমের আবরণী দেওয়া—তাদৃশ নয়নমনোহর বস্ত্র ইতিপূর্বে কখনও দেখেন নি ভানুমতী। সে বস্ত্ৰই নিঃসন্দেহে মহার্ঘ্য—কোন উপকরণে প্রস্তুত তাও জ্ঞান বা অনুমানের অতীত—তবে সেও তুচ্ছ কথা, সে বস্ত্রের উপর যে কারুকার্য করা হয়েছে তা বোধ করি কোন কারুশিল্পীর সমগ্র জীবনসাধনার ফল।

নিমেষকালেরও কিঞ্চিৎ অধিক সময় হবে—ভানুমতী সেদিকে চেয়ে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন, স্থান কাল পাত্র কিছুর সম্বন্ধেই সচেতনতা ছিল না তাঁর—তার মধ্যেই স্বীয় বামহস্তে সে সন্মুখাবরণ উন্মোচিত ক’রে সহাস্যবদনা মহিষী কৃষ্ণা নেমে এলেন।

‘তুমি কেন উঠতে গেলে ভাই আবার এ সিঁড়িতে—এ যে ভীষণ কষ্ট। ছি ছি! এ কি স্ত্রীলোকের কর্ম, এই একটা কিম্ভূতকিমাকার জীবের পৃষ্ঠে আরোহণ করা! মধ্যম পাণ্ডব নিজের মতোই বিশ্বসংসারকে ভাবেন, দিলেন আমাকে এখানে উঠিয়ে।…তুমি সাবধানে আগে নেমে যাও, আমি ঠিক নামছি।’

কিন্তু এসব কোন কথারই অর্থ বোধগম্য হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না তখন ভানুমতীর। তাঁর মতো সর্ব-অঙ্গ- আবরিত করা সুবর্ণ ও রত্ন অলঙ্কারের বাহুল্য নেই পাণ্ডব মহিষীর—কিন্তু যে স্বল্পসংখ্যক মণিরত্ন দ্রৌপদী পরিধান করেছেন তার দুষ্প্রাপ্যতা, মহার্ঘ্যতা ও শিল্পচাতুর্য সম্বন্ধে অলঙ্কারপ্রিয় ভানুমতীর কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। এগুলির নির্বাচনেও যথেষ্ট সুরুচির পরিচয় দিয়েছেন কৃষ্ণা, সেটা মুখে স্বীকার করুন না করুন তাতেই যে এই আশ্চর্য রূপবতী নারীর সহজ সৌন্দর্য শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা মনে মনে অন্তত অস্বীকার করবেন কি ক’রে! আর এর পার্শ্বে নিজের দেহের এই সুবর্ণ ও প্রস্তরের বোঝা যে দাসী ও অন্যান্য পুরললনার কাছে পরিহাসের বস্তু হয়ে উঠেছে তা অনুভব ক’রে নিজেকে আরও হীন ও লুব্ধ বোধ হতে লাগল।

যে ঈর্ষা-চিহ্ন কিছুতে মুখে প্রকাশিত হতে দেবেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন ভানুমতী, সেই ঈর্ষাতেই মুখ মসীবর্ণ ধারণ করল—মাৎসর্যের তীব্র আশীবিষ-জ্বালায় যেন সকল প্রকার হিতাহিত জ্ঞান হারালেন, নিমেষে প্রধান মহিষীর স্তর থেকে গ্রাম্য প্রাকৃত নারীতে পরিণত হলেন! হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশও মনে রইল না। শুধু পথ দেখিয়ে যাওয়ার মতো আগে আগে গেলেন মাত্র। এবং দেহলীপ্রান্তে পৌঁছে—দাসী মাল্যচন্দন মধু নববস্ত্র প্রভৃতি অভ্যর্থনার উপচার-সজ্জিত সুবর্ণথালি নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিল—কোনমতে অবশ্যকরণীয় সে পর্বটুকু শেষ ক’রে—বিনা সম্ভাষণে যন্ত্রচালিতবৎ—আর এক ছত্রবাহিনী দাসীকে নির্দেশ দিলেন, ‘যা, পাণ্ডবমহিষীকে তাঁর কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আয়। সাবধানে নিয়ে যাস।’ শেষের বাক্যটি অনেক পরে অনেক অনিচ্ছায় উচ্চারিত হ’ল।

অবমাননাটা তীব্র কশাঘাতের মতোই অনুভূত হ’ল দ্রৌপদীর।

মাত্র কয়েক মাস পূর্বেই তিনি এই বধূকে সসম্মান সাড়ম্বর অভ্যর্থনা জানিয়ে দু হাত ধরে নির্দিষ্ট প্রাসাদে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে কথাও স্মরণে রইল না!

তবে দ্রুপদনন্দিনী পাণ্ডবজায়ার শিক্ষা অন্যরূপ। তাঁর মুখে কোন ভাবান্তর লক্ষিত হ’ল না। পূর্বের মতোই বরং আন্তরিক অমায়িকতার সুরে বললেন, ‘সামান্য কিছু উপহার এনেছিলাম ভগ্নী—’

ঈর্ষা ক্ষোভ বা তজ্জনিত উম্মা যতই প্রবল হোক, কৌতূহল প্রবলতর। তাই থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে চাইতে হ’ল। ‘সামান্য’ এক্ষেত্রে উপঢৌকনের স্তূপ। আচ্ছাদনী বস্ত্র (তাও অ-দৃষ্টপূর্ব) অপসারিত করতেই মুহূর্তে দৃষ্টি যেন বিভ্রান্তিপ্রাপ্ত হ’ল। রত্নালঙ্কার, মহামূল্য বস্ত্র, দুর্লভ এবং এদের অজ্ঞাত গৃহসজ্জার উপকরণ—যা পাণ্ডবরাও পূর্বে কখনও দেখেন নি, ব্যবহার তো দূরে থাক, এই রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষে প্রথম দেখলেন, কার কি ব্যবহার শুনলেন। দূরাগত অতিথিরাই এনেছিলেন রাজচক্রবর্তীর প্রাপ্য হিসাবে। পাণ্ডবদের জ্ঞান এমন কি শ্রুতিরও বাইরের বহু দেশ থেকে এসেছিলেন তাঁরা, তাঁদের দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পসামগ্রী নিয়ে। তা থেকেই দ্রৌপদী নারীমনোরঞ্জক দ্রব্যগুলি বেছে বেছে এনেছিলেন, ভানুমতী প্রীত ও প্রসন্ন হবেন এই দুরাশায়।

দ্রৌপদী যা ভেবেছিলেন প্রীতির সেতু রচনা করবে—তা ‘তীব্রজ্বালা অগ্নিঢালা’ হলাহলবৎ দগ্ধ করতে লাগল কৌরব বধূ-প্রধানাকে। তিনি প্রাণপণ চেষ্টায় মুখে উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে একবার মাত্র সেই চারজন বলিষ্ঠা যবনীদাসীবাহিত পর্বতপ্রমাণ উপঢৌকনরাশি দুই হাতে স্পর্শ ক’রে বললেন, ‘নিলাম। সত্যই বড় সুন্দর।’ তার পর আর এক দাসীকে আদেশ করলেন, ‘এই—এগুলো আমার প্রাসাদের কোন কক্ষে রেখে দিয়ে আয়। একটি তালিকা ক’রে রাখতে বলিস কাউকে, সেই বুঝে এঁদের বিদায়কালে উপহার দিতে হবে।’

তার পর দ্রৌপদীকে কোন সম্ভাষণ মাত্র না জানিয়ে দ্রুত অন্য দিকে প্রস্থান করলেন।

দ্রৌপদী পূর্বোক্ত দাসীর সঙ্গে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বাসকক্ষে যাত্রা করার পূর্বে একবার দুই পাশ চেয়ে দেখলেন। অন্যান্য পাণ্ডবপত্নীদের অভ্যর্থনাজ্ঞাপনের জন্য যেসব কৌরববধূরা অপেক্ষা করছেন, প্রত্যেকেরই বিরস বদন–বিরক্তি ও ঈর্ষায় মসীবর্ণ ধারণ করেছে। অভ্যর্থনা যে কেমন হবে তা তো ওঁকে দিয়েই বুঝতে পারছেন। এদের কারও মুখভাবেই প্রীতি বা শুভেচ্ছা—এমন কি সৌজন্যেরও বিন্দুবৎ চিহ্নমাত্র নেই। যেন তাঁদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার জন্যই ডেকে আনা হয়েছে।

এ কী করলেন ধর্মরাজ! এখানের আকাশ-বাতাসও বোধ করি পাণ্ডবদের সম্বন্ধে বিদ্বেষ-বিষে তিক্ত, বিষাক্ত। যুধিষ্ঠির নিজে এসে তো ভুল করলেনই—অধিকতর ভুল করলেন অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে এনে।

শুধু অভ্যর্থনাতেই নয়—আহার বিশ্রাম স্নানাদি—সর্ব ব্যবস্থার সর্ব পর্যায়েই অসূয়া বিদ্বেষ—তজ্জনিত চেষ্টাকৃত তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেতে লাগল। এক-একবার তা সর্বপ্রকার শোভনতা শালীনতা এমন কি এঁদের সহ্যেরও সীমা অতিক্রম করল। বোধ করি কৃষ্ণার কয়েকবারই মনে হ’ল তাঁর শিবিকা বা রথ আনিয়ে তিনি একাই ইন্দ্রপ্রস্থে যাত্রা করেন বা বিদুরের গৃহে জননী কুন্তীর কাছে চলে যান। কিন্তু সৌজন্যবোধ যাদের সহজাত, অস্থিতে মজ্জাতে রক্তে মিশে আছে, তারা সহস্র অবমাননা সহ্য ক’রেও অপর পক্ষকে আঘাত করতে দ্বিধা বোধ করে। দ্রৌপদীও তাই অতিকষ্টে নিজেকে সম্বরণ ক’রে রইলেন।…

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে এলেও গৃহে প্রদীপ জ্বেলে দেওয়ার কথা কারও মনে পড়ে নি। দ্রৌপদীর নিজস্ব দাসীদের কোথায় কোন এক দূর প্রান্তে স্থান দিয়েছে এরা কে জানে, তাদের কেউই আসছে না। হয়ত এরাই বাধা দিয়েছে, ‘আমাদের গৃহে আমাদের দাসীই পরিচর্যা করবে’ এই অছিলায়।

সেই প্রায়ান্ধকার কক্ষে প্রাণপণে চক্ষুপ্রান্তাগত ক্রোধোত্তপ্ত অশ্রু দমন করার চেষ্টা করছেন দ্রৌপদী, দ্বারপ্রান্তে অন্ধকারের মধ্য থেকে যেন সেখানকার ছায়াই ঘনতর হয়ে মূর্তি ধারণ ক’রে পাশে এসে দাঁড়াল।

‘কে?’ চমকে উঠলেন কৃষ্ণা।

যে এসেছিল সে এবার সামনে এসে ওঁর পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করল।

‘মহাদেবী, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি এক নগণ্যা শূদ্রা দাসী মাত্ৰ।’

‘দাসী? কার দাসী? কে পাঠিয়েছে?’

সে-কথার উত্তর দিল না মেয়েটি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, অনার্য কন্যা। কিন্তু তার কথাবার্তা বেশ মার্জিত মনে হ’ল।

সে এবার ওঁর চরণপ্রান্তে এক খণ্ড বস্ত্র রেখে বলল, ‘আপনার কোন হিতাকাঙ্ক্ষী বান্ধব পূর্বদেশাগত এই সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র পাঠিয়েছেন। দুইশত হস্ত পরিমিত বস্ত্র, কিন্তু পরে থাকলে মনে হবে একটিই মাত্র একপ্রস্থ শাড়ি। কাল প্রভাতে আপনি অতি অবশ্য এই বস্ত্র ধারণ করবেন।’

দ্রৌপদী অধিকতর বিস্মিত, কিছু-বা সন্দিগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আমি রজঃস্বলা, এ অবস্থায় নববস্ত্র পরিধান যে নিষেধ।’ দাসীটি সবিনয়ে অথচ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল, ‘আপৎকালে কোন কিছুই নিষিদ্ধ নয় মহাদেবী। কাল আপনাকে ঘোর বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। ধর্ম যাঁর আজ্ঞাধীন এমন এক ব্যক্তি এ বস্ত্র পাঠিয়েছেন। আমি যে শত্রুপক্ষের কোন লোক নই বা বাতুলও নই—তার প্রমাণ এই অঙ্গুরীয়।’

দুই হাতে একটা কি বস্তু মেলে ধরল সে।

দ্রৌপদী তা হাতে ক’রে তুলে নিয়ে পশ্চিম বাতায়নের কাছে এনে তখনও যেটুকু আলোর আভাস ছিল—তাতেই ভাল ক’রে চেয়ে এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তাঁরই অঙ্গুরীয়, কুমারী অবস্থার–পিতৃদত্ত। কিন্তু এ কেমন ক’রে পেল? কই, তিনি যে কাউকে দিয়েছেন কখনও—তা তো মনে পড়ছে না! হয়ত খুলে কোনদিন কোন পেটিকায় রেখেছেন, এ অঙ্গুরীয়ের কথা স্মরণে পড়লেও এই ভেবেই আশ্বাস লাভ করলেন।

তিনি ফিরে আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাবেন—দেখলেন সে দাসী নেই। যেমন এসেছিল ছায়ামূর্তির মতো ঘনায়মান অন্ধকারকে যেন ঘনতর ক’রে—তেমনি সেই অন্ধকারেই মিশে গেছে কখন।

শুধু এ যে সমস্তটাই স্বপ্ন নয়—তার প্রমাণ স্বরূপ সে বস্ত্রখণ্ডটি পড়ে আছে এখনও।

২৫

মানবজীবনে কখনও কখনও এমন দিন আসে, এমন ঘটনা ঘটে—যা সম্পূর্ণ সজ্ঞানে প্রত্যক্ষ ক’রে বা নিজে সে ঘটনাবর্তের অঙ্গীভূত হয়েও মানুষ সম্পূর্ণ উপলব্ধি বা বিশ্বাস করতে পারে না। নিজের জীবনের একটি বাস্তব খণ্ডাংশকে সে উত্তপ্ত ক্লান্ত মস্তিষ্কের কল্পনা ভাবে, দুঃসহ চরম দুঃখদুর্দশাকেও দুঃস্বপ্ন বলে বোধ করে।

এ সত্যটা দ্রৌপদী নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করলেন, নারীজীবনের চরম লাঞ্ছনার মূল্যে তা ক্রয় করতে হ’ল।

সে দিনের প্রতিটি দণ্ড পলের ইতিহাসই তো অবিশ্বাস্য। মানুষ যে এমন ভাবে অনায়াসে পশুরও নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসতে পারে তা তো কোনদিন সুদূরতম কল্পনাতেও ধারণা করতে পারেন নি তিনি। না, পশুর সঙ্গে তুলনা দিলে পশুর অপমান করা হয়। অতি ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, অখাদ্যভোজী, মললুব্ধ পশুদের জীবনেও কতকগুলি নিয়ম আছে, যা তারা কদাচ লঙ্ঘন করে না। কিন্তু এরা সে নিয়মও রক্ষা করে নি সে দিন। তারা যে আচরণ করেছে ঐ অন্ত্যজ পশুদের জ্ঞান বা অনুভব শক্তি থাকলে তারা ঘৃণায় লজ্জায় শিহরিত হ’ত। কারও পক্ষে কোন অবস্থাতেই তো এমন আচরণ কল্পনা করা সম্ভব নয়। এই ইতরতা, এই কদর্য প্রবৃত্তির তুলনা রাজবংশে কেন—অতিতামস-জীবন-যাপনকারী সদা-সুরামত্ত নিষাদ-জীবনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তবু সেদিনের সেই লাঞ্ছনা অবমাননার মধ্যে, আকণ্ঠ-ফেনায়িত গ্লানি ও ক্ষোভের মধ্যে, আপন-দাহী উষ্মার অসহ্য জ্বালার মধ্যেও—জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যার আচরণ দুর্বোধ্য ও সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বলে বোধ হবে কৃষ্ণার—তা হ’ল অঙ্গাধিপতি কর্ণর উন্মত্ত ইতরতা।

দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি কৌরবপ্রধানদের এমন পশুবৎ আচরণের তবু কিছু কারণ আছে। ঈর্ষাই সে কারণ। জ্ঞাতিদের মধ্যে যে ঈর্ষা এসব ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী না হলেও দুর্লভ নয়। একই বংশের দুটি শাখা—একটি ধনে মানে শৌর্যে বীর্যে প্রভাবে অপর শাখাকে বহু পশ্চাতে রেখে উন্নতির শীর্ষস্থানে উঠলে–বিশেষ যে শাখাটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার প্রচেষ্টায় কোন ত্রুটিই রাখেন নি হীনপ্রতিষ্ঠ শাখাটি—অপর শাখার অন্তরে তীব্র হলাহল জ্বালা অনুভূত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু অঙ্গাধিপতির সে ঈর্ষা থাকার তো কোন কারণ নেই। সামান্য সূতপুত্র কৌরবদের করদ বা আশ্রিত রাজ্যের অধিপতি বলে স্বীকৃত হয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে স্বাধীন শাসক হিসাবেই রাজত্ব করছেন—তাই কি যথেষ্ট নয়? যে উচ্চাশা কৌরবে স্বাভাবিক, যে আশাভঙ্গের বেদনা তাঁদের পক্ষে অসহ বোধ হতে পারে—সে আশা কি তাঁদের আশ্রিত ব্যক্তিও মনে মনে পোষণ করবেন? তিনি এত নির্বোধ, এত অবিবেচক?

তবে কি এ দ্রৌপদীর প্রতিই ক্রোধ, ব্যক্তিগত উষ্মা? সেদিনের সেই স্বয়ম্বর সভার রূঢ় অবজ্ঞাপূর্ণ প্রত্যাখ্যানের জ্বালা কি তিনি আজও ভুলতে পারেন নি? সে প্রতিহিংসাস্পৃহাই কি এমন অমানুষ ক’রে দিয়েছে তাঁকে?

তাও তো বিশ্বাস হয় না। অন্তত বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না দ্রৌপদীর। অঙ্গরাজ কর্ণের শৌর্যখ্যাতি তাঁর অগণিত মহানুভবতার ও অকৃপণ দানের কাহিনী—যা সমগ্র ভারতখণ্ডে তাঁর জীবদ্দশাতেই কিম্বদন্তীতে পরিণত—তাঁর দীপ্ত কান্তি, আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহার, বিনম্র বাক্য প্রভৃতির সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয়—কিছু বা প্রত্যক্ষ কিছু বা জনশ্রুতিতে—ঘটেছে বৈকি। তার পর এই অহেতুক অকারণ অভদ্রতা, কুৎসিত অমার্জিত বাক্যপ্রয়োগ বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে! এ কি কৃষ্ণা নিজ কানে শুনছেন? সে কদর্য অঙ্গভঙ্গী ও মুখভঙ্গী নিজে প্রত্যক্ষ করছেন?

এই দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যক্তিসত্তাই যে তিনি মেলাতে পারছেন না কোনমতে।

প্রাভাতিক স্নানবন্দনাদি সমাপন হতেই পাণ্ডবভ্রাতাদের আবাহন এসেছে দ্যূতক্রীড়া-সভা থেকে। সামান্য জলযোগ মাত্র ক’রেই ওঁদের যাত্রা করতে হয়েছে। তখন থেকেই পাণ্ডবদের পট্টমহাদেবী তাঁর কক্ষের বাতায়নপার্শ্বস্থ আসনে বসে আছেন—অদূরে নবনির্মিত সভাহর্ম্য লক্ষ ক’রে। সেদিকে চেয়ে চেয়ে তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে ওটা একটা ক্লেদাক্ত জীব, বিষাক্ত কোন সরীসৃপের মতো। ওটা পিশাচপুরী, ওর প্রতি প্রস্তরখণ্ড বিদ্বেষের উপকরণে গ্রথিত, ওর প্রতি রন্ধ্রে সর্বনাশের ষড়যন্ত্র। যেমন এই কৌরবপ্রদত্ত তাঁর বাসগৃহ—এর অন্তঃ ও বহিঃ-প্রদেশের বায়ুমণ্ডল যেন লক্ষ সর্পের নিঃশ্বাসে বিষাক্ত। ইন্দ্রপ্রস্থের সভাগৃহ দানবে প্রস্তুত করেছিল কিন্তু পাণ্ডবদের পুণ্যে ও সদিচ্ছায় সেখানে দেবতাদের আরাধনা সম্ভব হয়েছে, তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে। যজ্ঞাগ্নিতে নিবেদিত হবি স্বয়ং ব্রহ্মণ্যদেব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মনুষ্যনির্মিত সভাগৃহে আজ দানবীয় লীলার নিপুণ আয়োজন, মিথ্যা ও শাঠ্য এখানের সমিধ, স্বার্থ এখানে ঋত্বিক —ঈর্ষাই অগ্নি। অপরের সর্বনাশে এ যজ্ঞের সিদ্ধি। এ আয়োজন শেষ পর্যন্ত নারকীয় পৈশাচিক ঘটনাতে পরিসমাপ্ত হলেও বিস্মিত হবার কিছু থাকবে না।

অস্বস্তির সীমা থাকে না। বাহিরের নিশ্চলতা বা স্থৈর্যের মধ্যে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের অস্থিরতা। এমন মানসিক উদ্বেগের সঙ্গে দ্রৌপদীর পূর্বপরিচয় নেই। অশুচি অবস্থায় ইষ্টবন্দনা চলবে না, স্মরণ মাত্র বিধেয়। সুতরাং পূজাপাঠের কোন আবশ্যকতা নেই। আহার্য এসেছিল–অবজ্ঞার দান, বিদ্বেষ-বিষতিক্ত বোধেই তা গ্রহণে প্রবৃত্তি হয় নি। পূর্ব রাত্রিও প্রায় অনাহারে অতিবাহিত হয়েছে, অনিদ্রাতেও বটে।

রাত্রি জাগরণে আরক্ত উপবাসক্লান্ত-নয়না দ্রৌপদী অবদ্ধবেণী আলুলায়িতাকেশা একবস্ত্রা অবস্থায় সেই এক স্থানে বসে আছেন—অজ্ঞাত অমঙ্গল আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে।

অজ্ঞাত—অর্থাৎ বিপদ কোন পথে কী বেশে আসবে তা জানা নেই—কিন্তু অমূলক নয় একেবারেই। এই জ্ঞাতিশত্রুগণ সুদ্ধমাত্র কৌতুকক্রীড়া বা অলস ব্যসনের উদ্দেশ্যে পাণ্ডবদের এখানে আহ্বান করেন নি। এঁরা কোন ইষ্টবুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত নন। এঁদের স্নেহ-প্রীতি আত্মীয়তাবোধ নেই কিছু মাত্র। কখনওই ছিল না। পাণ্ডবরা যখন পিতৃহীন—বাস্তবিকপক্ষে ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রিত মাত্র—তখনও ছিল না। বিষপ্রয়োগে, অগ্নিতে দগ্ধ ক’রে—নানা ভাবে হত্যার চেষ্টা করেছে কৌরবরা। আজ সর্বোচ্চ শক্তিধর, সর্বাপেক্ষা সম্মানিত, সকলের ভীতি-উৎপাদক সম্রাটপদে অধিষ্ঠিত পাণ্ডবদের প্রতি সুপ্রবৃত্তি থাকবে—এমন ধারণা বাতুল ছাড়া কেউ করবে না।

এরা বিবেককে স্বীকার করে না, ধর্মকে উপেক্ষা করে। নিজেদের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্তি গ্রথিত ক’রে গুরুজনদের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের বুদ্ধির অপেক্ষা নিজেদের কূটবুদ্ধি ও পাপপ্রচেষ্টায় আস্থা বেশী। সুতরাং যথাসর্বস্ব তো যাবেই—সর্বস্বান্ত হয়েই এ কালপুরী থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হবে—তা ভারতসর্বেশ্বরী দ্রৌপদী জানেন কিন্তু তাছাড়াও আরও কী অনিষ্ট হবে, আরও কোন কোন উপায়ে এরা দীর্ঘদিনের সঞ্চিত বিদ্বেষ, হীনমন্যতা এবং অধুনা-প্রবল-প্রজ্বলিত মাৎসর্যাগ্নির শোধ তুলবে—বহু চেষ্টাতেও ঠিক সেটা কল্পনা করতে পারছেন না বলেই তাঁর এই অস্বস্তি, উদ্বেগ—রাত্রের নিদ্রা ও প্রভাতের আহার তাঁকে ত্যাগ করেছে

সংবাদ পৌঁছনোর আয়োজন আছে।

সহদেবকে অনুরোধ ক’রে দ্রৌপদীই সেই ব্যবস্থা করেছেন।

অগ্রজদের তুল্যই দ্রৌপদীর প্রণয়মুগ্ধ হওয়া সত্বেও—এই কনিষ্ঠ স্বামীটির মন থেকে গুরুজনবোধজনিত সম্ভ্রমের ভাবটা যেতে চায় না কিছুতেই। এমন কি কৃষ্ণাকে প্রণয়ালিঙ্গনে বদ্ধ ক’রেও যেন তিনি সহজ বা স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না। স্বামীর প্রাপ্য একান্ত বশ্যতা ও শ্রদ্ধা পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ কি উপভোগ করতে পারেন না। জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ জ্ঞানে মধ্যে মধ্যেই ‘আর্যা’ ও ‘দেবী’ সম্বোধন করতে যান–হয়ত সে শব্দের একাক্ষর উচ্চারিত হবার পর কৃষ্ণার উচ্ছ্বসিত কৌতুকহাস্যে সম্বিৎ ফেরে, আত্মসম্বরণ করে নেন।

এই অলোকসামান্যা, সুরলোকবাসী-ঈপ্সিতা নারীরত্ন যে সত্যই তাঁর রমণী হয়েছেন—এটা ওঁকে বক্ষলগ্ন দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না, ধারণায় আনতে বিলম্ব হয়। বিশেষ দ্রৌপদীর গাম্ভীর্য, সহজাত কৰ্তৃত্বশক্তি, সর্বদিকে প্রখর দৃষ্টি ও প্রখরতর বুদ্ধি, বিরক্তিসঞ্জাত অবস্থায় বজ্রাগ্নির মতো রোষদীপ্ত দৃষ্টি ও কঠিন ভ্রভঙ্গী দেখে সমীহ না ক’রেও পারেন না।

সহদেবের এ মনোভাব, এ দুর্বলতা দ্রৌপদী জানেন। এও জানেন যে এই কারণেই ওঁর মনস্তুষ্টি করার জন্য তিনি সদা ব্যস্ত। কৌরবদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করার পর থেকে স্বামীদের সঙ্গে ওঁর সাক্ষাৎ হয় নি। ঋতুস্নান করার পূর্বে সাক্ষাৎ করাও নিষিদ্ধ। কিন্তু পত্রালাপে অসুবিধা নেই। দ্রৌপদী সেই সুযোগ নিয়েই সহদেবকে একটি অনুরোধলিপি পাঠিয়েছেন। যাতে তিনি দুটি বুদ্ধিমতী প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্না সুদক্ষা সংবাদবাহিকা নিয়োগ করেন—যারা এক দণ্ড অন্তর ক্রমান্বয়ে তাঁকে সভাগৃহের সংবাদ পৌঁছে দিয়ে যাবে। সহদেব পত্রপ্রাপ্তি মাত্র সে ব্যবস্থা করেছিলেন। শুধু তাই নয়—এই বিশেষ দূতীরা যাতে অবাধে সভাগৃহে গমনাগমন করতে পারে সেজন্য প্রবেশাধিকারের সাংকেতিক শব্দও জানিয়ে দিয়েছিলেন।

সে সংবাদ নিয়মিতই আসছে।

তার কোনটাই শুভ নয়—আশ্বাসদায়ক তো নয়ই।

যুধিষ্ঠির কেবলই পরাজিত হচ্ছেন। দুর্যোধন ক্রীড়ার আহ্বায়ক এবং পণ-সরবরাহক হলেও তাঁর প্রতিভূ রূপে অক্ষপাতন করছেন সৌবল শকুনি। তিনি যে সহজ সত্যপথে ক্রীড়া করছেন না, কপটতার আশ্রয় নিচ্ছেন, সে বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের সংশয়মাত্রও নেই, তাঁর সে নিশ্চিত বিশ্বাস তিনি অদ্ব্যর্থ ভাষায় প্রকাশও করেছেন, তত্রাচ এ ক্রীড়া থেকে নিবৃত্ত হন নি। অক্ষের নেশা তাঁকে মোহগ্রস্ত করছে!

সেই তথ্যই বোধ করি অদ্যকার চরম দুঃসংবাদ।

অন্তত দ্রৌপদীর কাছে। এর মধ্যেই তিনি নিয়তির নির্মম ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন। পরমা নিয়তির অতল অন্ধ আহ্বান।

যুধিষ্ঠির প্রথম পণ রাখেন তাঁর কণ্ঠস্থ, বিশ্বে অদ্বিতীয়, কুবেরেরও ঈর্ষা-আনয়ন-কারী অমূল্য মণিহার। দুর্যোধন কি রাখলেন তা নির্দিষ্ট ক’রে বলেন নি, শুধু বলেছিলেন, ‘আমার বিস্তর মণিরত্ন আছে, তুমি জয়লাভ করলে, পণের অভাব হবে না।’

অবশ্য তাঁর পণ নির্ধারণের আবশ্যকও হ’ল না কারণ কাপট্য-পারঙ্গম শকুনি নিমেষপাতমাত্র সময়ে সে পণ জিতে নিলেন। অতঃপর যুধিষ্ঠির সহস্র সুবর্ণমুদ্রাপূর্ণ কয়েক শত পেটিকা পণ রাখলেন। সেও শকুনি তৎক্ষণাৎ কপট পাশা নিক্ষেপে জিতে নিলেন। অতঃপর ক্রমান্বয়ে মহারাজচক্রবর্তীর মণিরত্নশোভিত সুবর্ণ রথ ও তাঁর তুষার-শুভ্র কুমুদকান্তি অশ্বঅষ্টক*, সুন্দরী সালঙ্কারা চন্দনচর্চিতা নৃত্যগীতাদি-নিপুণা এক লক্ষ তরুণী দাসী কর্মকুশল নম্রস্বভাব মেধাবী এক লক্ষ সুদর্শন তরুণ দাস এক সহস্র রণহস্তী সুবর্ণময় ধ্বজাপতাকাশোভিত কয়েক সহস্র রথ—যার রথীরা যুদ্ধ না করতে হলেও মাসিক সহস্র সুবর্ণ বেতন পান গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ অর্জুনকে যেসব বিচিত্র বর্ণ অশ্ব দিয়েছিলেন বহু সহস্ৰ সাধারণ রথ, শকট, অশ্ব ষষ্টি সহস্র বীর সবলদেহ যোদ্ধা কয়েকশত ধনভাণ্ডার—এ সকলই শকুনি তাঁর বিশেষ- কৌশলে-নির্মিত অক্ষ দ্বারা জয় ক’রে নিলেন। স্থিতধী যুধিষ্ঠিরের একবারও মনে হ’ল না যে তিনি ঐ অক্ষ পরিবর্তন করতে বলেন, অথবা তাঁর নিজস্ব অক্ষ ব্যবহারের দাবি জানান।

[* যুধিষ্ঠির কহিলেন, জলদ ও জলধিতুল্য নিনাদযুক্ত, সহস্র রথের বেগবিশিষ্ট ব্যাঘ্রচর্মাবৃত, সুপ্রিতিষ্ঠ, সুন্দর চক্র ও উপস্কর সমন্বিত, শ্রীমান কিঙ্কিনী জালভূষিত, হৃদয়-হ্লাদন, যে রাজপথ আমাদিগকে এখানে আনয়ন করিয়াছে এবং কোন ভূচর ব্যক্তি যাহাদের পদবিক্রম হইতে নিষ্কৃতি পাইতে পারে না, কুমুদের ন্যায় কান্তিবিশিষ্ট, রাষ্ট্রপ্রসংসিত এইরূপ উৎকৃষ্ট অষ্ট অশ্ব যাহাকে বহন করে সেই জয়শীল রথবর এবার আমার পন রহিল । [বর্ধমান সংস্করণ মহাভারত]

ক্রীড়ার গতি ও ধর্মরাজের মোহমত্ততা দেখে—নিতান্ত নিয়তিসৃষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া যাকে আর কোন আখ্যা দেওয়া যায় না —সভাস্থ বয়স্ক ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা চিন্তিত হলেন। যাঁরা ধর্মভীরু সৎ প্রকৃতির লোক তাঁরা এই প্রত্যক্ষত কপট ক্রীড়ার পরিণাম বুঝে ভবিষ্যতের মহা সর্বনাশ কল্পনায় চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

শেষে বিদুর আর থাকতে না পেরে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, ‘মহারাজ, আপনার ঘোর বিপদ উপস্থিত, এ সময় আপনি উদাসীন থাকবেন না। স্মরণ করুন—এই দুর্যোধন ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র গোমায়ুর* মতো রব করেছিল। তখনই জানি এ জাতক ভারতবংশ ধ্বংস করবে। কুরুরাজ, নিজের দেহের কোন অংশ অচিকিৎস্য-ভাবে বিষাক্ত হলে তাও তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করতে হয়। আপনি জানেন, অন্ধক যাদব আর ভোজবংশীয়রা তাঁদের আত্মীয় কংসকে ত্যাগ করেছিলেন, তাঁদেরই নির্দেশে শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেন। মহারাজ, আপনি আদেশ দিন, অর্জুন দুর্যোধনকে বধ করলে কৌরবগণ ও এ রাজ্য অমঙ্গলমুক্ত হবে। একজনকে ত্যাগ করলে যদি কুলরক্ষা হয়—সে নির্মমতাই প্রাজ্ঞদের বাঞ্ছনীয় কলহমত্ত বৃষ যেমন নিজের শৃঙ্গভঙ্গ করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নষ্ট করে—দুর্যোধনও তেমনি নিজের পুরী ও রাজ্যের মঙ্গল দূর করেছে। এখনও সময় আছে, আপনি তাকে ত্যাগ করুন।’

[* শৃগাল]

সভাস্থ অনেকেই তাঁর অনুমোদন ক’রে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলেন, কিন্তু দুর্যোধনের উষ্মার সীমা রইল না। তিনি বিস্তর কটু বাক্য বলে বিদুরকে সভাগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে আদেশ দিলেন।

একটির পর একটি এমনি দুঃসংবাদ পাচ্ছেন ভারতসম্রাজ্ঞী দ্রৌপদী।

তাঁর ললাট ও হস্ততালু স্বেদাক্ত হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। অপরিসীম পিপাসায় বক্ষ পর্যন্ত যেন শুষ্ক হয়ে উঠেছে।

আরও সাংঘাতিক দুঃসংবাদ আসবে—এ তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। ধর্ম যখন মোহান্ধতা, মূঢ়তা, ভ্রান্তি ও জাড্য দ্বারা আচ্ছন্ন হন, তখন আর শ্রেয় কোথায়। শ্রী ও কল্যাণ তো অন্তর্হিত হবেনই।

সংবাদ পেলেনও।

নিয়তির নির্দয় নির্দেশের মতোই তা অব্যর্থ ও অমোঘ ভাবে এসে আঘাত করতে লাগল তাঁর সহ্যশক্তিকে। …

শকুনি সবিদ্রূপে প্রশ্ন করলেন, ‘রাজন! তোমার তো প্রায় তাবৎ ধনই আমাদের করায়ত্ত হ’ল। পণ রাখার মতো আর কিছু আছে নাকি?’

যুধিষ্ঠির অন্ধের মতোই তাঁর এই সুনিশ্চিত বিদ্রুপের ফাঁদে পা দিলেন। বললেন, ‘আমার ঐশ্বর্য অপরিমেয়, অসংখ্যেয়। তুমি অযুত প্রযুত কোটি অর্বুদ এমন কি মধ্য পরার্ধ* যা পণ চাও আমি তাই রাখছি।’

[* কোটি, অর্বুদ, খর্ব, নিখর্ব, পদ্ম, শঙ্খ, মহাপদ্ম, মধ্য, পরার্ধ।]

সেও যখন এক নিমেষে স্বামী বদল করল, তখন যুধিষ্ঠির বললেন, ‘পর্ণাশা থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে আমার যে গো-মেষ-মহিষ প্রমুখ পশুসম্পদ আছে—এবার তাই পণ রাখলাম।’

অতঃপর রাজ্যের যা অবশিষ্ট পণ-যোগ্য সম্পদ ও নরনারী—তাও যখন গেল, তখন ভ্রাতাদের অঙ্গের মহামূল্য অলঙ্কার পণ রাখলেন। কিন্তু পুষ্পদণ্ডের দ্বারা যেমন প্রবল বন্যার জলে বাধা দেওয়া যায় না—তেমনি এই অবশিষ্ট সামান্য পণে সর্ববিনষ্টির আসন্নতাকে প্রলম্বিত করা গেল না।

ধন ধেনু রথ অশ্ব দাস দাসী সব গেল। অবশিষ্ট পঞ্চ ভ্রাতা

যুধিষ্ঠির এবার উন্মত্তের মতো তাঁদেরই পণ রাখতে লাগলেন।

নকুল, সহদেব, ধনঞ্জয়—শেষে ভীমও, এই ভাবে অত্যল্প সময়ে শত্রুহস্তগত হলেন।

শেষে যুধিষ্ঠির নিজেকেই পণ রাখলেন। যেন সর্বনাশকে অগ্রবর্তী হয়ে অভ্যর্থনা করাতেই আগ্রহ তাঁর।

সে পণও—কৌরবপক্ষের সভাষদ পারিষদ তোষামোদকারীদের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে—জিতে নিলেন শকুনি। কিন্তু তাতেও বিরত হলে চলবে না তাঁর।

এরা পথের ভিখারী হয়েছে, তাঁদের দাস হচ্ছে—কিন্তু অবমাননার চূড়ান্ত হয় নি এখনও।

অন্তঃপুরের মর্যাদা বিনষ্ট করতে না পারলে তা হবেও না।

শকুনি ভ্রূ কুঞ্চিত ক’রে ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বললেন, ‘এবার? আর তো কিছুই পণ রাখার মতো রইল না তোমার। এক বাকী আছেন তোমাদের প্রেয়সী—পাঞ্চালনন্দিনী। তা–লোকে বলে স্ত্রীভাগ্যে ধন। দ্যাখো—তাঁকে পণ রেখে ভাগ্য পুনরুদ্ধার করতে পারো কি না।’

যুধিষ্ঠির আর দ্বিধামাত্র করলেন না, কর্তব্য-অকর্তব্য চিন্তার অবকাশ নিলেন না, ন্যায়-নীতির অনুশাসন চিন্তা কি বিচার করলেন না—তৎক্ষণাৎ সেই পণই রাখলেন।

এবং পরাজিত হলেন। *

[* যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘যিনি না খর্বাকৃতি, না দীর্ঘা, না কৃশা, না স্থূলা, সেই নীলকুটিলকুন্তলা, শারদপদ্মপলাশনয়না, শারদোৎপল-গন্ধা, রূপে শারদোৎপলসেবিনী লক্ষ্মীর এবং লাবণ্য-সৌভাগ্যাদিরূপিণী শ্রীর সদৃশা পাঞ্চালীর দ্বারা তোমার সহিত ক্রীড়া করিতেছি। হে সৌবল! পুরুষ লক্ষ্মীতুল্য গুণশালিনী যাদৃশী স্ত্রী কামনা করে, কি দয়া, কি রূপসম্পত্তি, কি শীল-সম্পত্তি সর্বাংশেই যিনি তাদৃশ-হইতে পারেন মনুষ্য-অনুকূলা, প্রিয়ম্বদা ও ধর্মকামার্থ-সিদ্ধি প্রযোজকা যাদৃশী স্ত্রী ইচ্ছা করে—তাদৃশ সমস্ত গুণেই যিনি উপপন্না হইয়াছেন যিনি সকলের শেষে শয়ন ও অগ্রে জাগরণ করেন এবং গোপাল ও মেষপাল পর্যন্ত সকল লোকেরই তত্বাবধান করিয়া থাকেন যাঁহার ঘর্মবিন্দুযুক্ত মুখমণ্ডল শিশিরশোভিত কমল ও মল্লিকার ন্যায় শোভা পায় বেদীসদৃশ সুমধ্যমা, দীর্ঘকেশা, তাম্রবদনা, অনতিলোমান্বিতা—এবম্বিধা সর্বাঙ্গসুন্দরী পাঞ্চালনন্দিনী দ্রৌপদীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করিতেছি।’ ]

শকুনি ‘তাও জিতে নিলাম’ এই বাক্য উচ্চারণ করা মাত্র—সমস্ত সভা অকস্মাৎ কিছুক্ষণের মতো প্রায় প্রস্তরীভূত ও নিস্তব্ধ হয়ে গেল তারপর সভাস্থ প্রবীণ ও পক্ষপাতশূন্য সমস্ত লোক একবাক্যে ‘ধিক! ধিক!’ এই দুটি শব্দ উচ্চারণ করলেন। যে সকল করদ ও মিত্ররাজ্যের অধিপতি উপস্থিত ছিলেন—তাঁরা লজ্জায় ও ক্ষোভে মাথা হেঁট করলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি প্রধানদের প্রচুর স্বেদ নির্গত হতে লাগল। দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষমাণ বিদুর বার বার মস্তকে করাঘাত ক’রে হাহাকার ক’রে উঠলেন।

কেবল ধৃতরাষ্ট্রই আর মনের ভাব বাহ্যিক সৌজন্যে আবরিত করতে না পেরে ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘আমাদেরই জয়লাভ হ’ল তো? আমরাই জিতলাম তো?’

শকুনি উত্তর দিলেন, ‘নিশ্চয়! আপনি বিজয়োৎসবের আদেশ দিন, যাজ্ঞসেনী এখন আমাদের পণে-ক্রীতা দাসী।’ দুর্যোধন পূর্বলাঞ্ছনা-দৈন্য-প্রতিশোধ উল্লাসে ও গর্বে একবার নিজের গুম্ভ মার্জনা ক’রে নিয়ে বিদুরকেই ডাকলেন আবার, ‘ক্ষত্তা, আপনি যাজ্ঞসেনীকে এখনই এ সভায় নিয়ে আসুন, তিনি আমার পদসেবা করবেন।

বিদুর ক্রদ্ধ হয়ে বললেন, ‘মূঢ়, বিক্রীত ব্যক্তির কোন সম্পত্তি থাকে না, যুধিষ্ঠিরের এ পণ রাখার কোন অধিকার নেই। এ তোমার বিজয় লাভ নয়, নিদারুণ পরাজয় মাত্র। বিষধর সর্প তোমার সম্মুখে ফণা বিস্তার করেছে—তুমি তাকে কুপিত ও উত্তেজিত ক’রে অতিশোচনীয় মৃত্যুকে আহ্বান করছ। তুমি মৃগ হয়ে ব্যাঘ্রকে লাঞ্ছিত করতে চাইছ! মেষশাবক হয়ে সিংহের গহ্বরে প্রবেশ ক’রে স্পর্ধা প্রকাশের অভিলাষী হয়েছ! এভাবে মৃত্যুর দিকে ধাবমান হয়ো না সে তো আছেই, অনিবার্য, তাকে আহ্বান ক’রে এনে লাভ কি? তুমি যে বাক্য উচ্চারণ করেছ তা শ্রবণেও মহাপাপ। মূর্খ, এখনও নিজেকে সম্বরণ ও সংযত কর, আমি তোমাকে সতর্ক করছি। ‘

দুর্যোধন অধিকতর রুষ্ট হয়ে দ্বারদূত এক প্রাতিকামীকে ডেকে আদেশ দিলেন, ‘ক্ষত্তা বিদুর কেবল নিজকুশল-চিন্তা ও আমাদের অবনতি কামনা করেন। তোমার কোন ভয় নেই, তুমি গিয়ে আমাদের দাসী দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এস। তিনি আমাদের সেবা করবেন।’

প্রাতিকামী লজ্জায় অধোবদন হয়ে আশঙ্কায় কম্পিত হতে হতে গিয়ে অত্যন্ত দীন ও অনুতপ্তভাবে অগত্যা পাঞ্চালীকে সে আদেশ নিবেদন করল।

পাণ্ডবকুললক্ষ্মী দ্রৌপদীরও সর্বাঙ্গ কম্পিত হচ্ছিল—তবে সে কোন শঙ্কায় নয়— ক্ষোভে ও রোষে। কারণ কিছু পূর্বে তিনিও এ সংবাদ পেয়েছেন।

তিনি ক্ষোভরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘প্রতিহারী, মনে হচ্ছে তুমি কৌরবদের দূতরূপে প্রেরিত হলেও আমার সম্বন্ধে করুণার্দ্র। আমার অনুরোধ, তুমি একবার সভায় ফিরে যাও, ধর্মরাজকে প্রশ্ন কর—তিনি কি পূর্বে নিজেকে পণ রেখে পরাজিত হয়েছেন?—না তার পূর্বে আমাকে পণ রেখেছিলেন? নিজে পরাজিত হওয়ার পরও কি আমাকে তাঁর পণ রাখার অধিকার ছিল?’

প্রাতিকামী ন্যায়ের এত সূক্ষ্ম ও কুটিল নীতি অবগত নয়, সে কিছুক্ষণ বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সভায় ফিরে গেল—এবং যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে না চেয়েই প্রশ্নটি উপস্থাপিত করল।

যুধিষ্ঠির পূর্বেই অধোমুখে নির্জীব জড়পদার্থের মতো বসে ছিলেন, সেই ভাবেই স্থির হয়ে বসে রইলেন, এ প্রশ্ন তাঁর কর্ণগোচর হ’ল কিনা বোঝা গেল না। উত্তর দিলেন দুর্যোধনই। অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলেন, ‘তাঁর যা কিছু প্রশ্ন তা তিনি সভায় এসে নিজেই করুন।…যাও, নিয়ে এস তাঁকে।’

প্রাতিকামী বেতনভোগী ভৃত্য, আদেশ পালন ব্যতীত তার গত্যন্তর নেই। সে আবারও পাংশুমুখে …লিত পদক্ষেপে ফিরে এসে পাঞ্চালীকে যুধিষ্ঠিরের নিরুত্তরতা ও দুর্যোধনের আদেশ জানাল। দ্রৌপদী উষ্মায় ও অপমানবোধে অগ্নিশিখার মতোই মূর্তি ধারণ করেছেন সেদিকে চেয়ে—যারা তাঁর শাসনকর্ত্রী রূপেই অভ্যস্ত—তারা অবশ্যই ভীত বোধ করবে।

পাঞ্চালনন্দিনী কিন্তু কোন কটু বা কুবাক্য বললেন না। বরং ধীরভাবে মিনতির ভঙ্গীতেই বললেন, ‘প্রাতিকামী, আমি অনুনয় করছি, তুমি আরও একবার সে সভায় যাও, যদিচ তার প্রতি অণুপরমাণু পাপবুদ্ধি শাঠ্য ও বিদ্বেষ দ্বারা গঠিত তবু আশা করছি কিছু সৎবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত আছেন যাঁরা ন্যায়নীতির মর্যাদা সম্বন্ধে অনবহিত নন, আমার প্রশ্ন তাঁদেরই কাছে তুমি তাঁদের জিজ্ঞাসা ক’রে এস— আমি কৌরবদের বিজিতা কিনা, ওঁদের এ আদেশ করার কোন অধিকার আছে কিনা!’

প্রাতিকামীর অবস্থা শোচনীয়। দুর্যোধনের করাল কোপকে কে না ভয় করে! অথচ এখানে এই মহিমময়ী নারীর অনুরোধ বা আদেশ অমান্য করার শক্তিও তো তার নেই! সে যজ্ঞে উৎসর্গকৃত পশুর মতোই কম্পিত ধীর পদক্ষেপে এসে সভার মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে পাণ্ডব-অধিরাজ্ঞীর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করল।

কিন্তু উত্তর দেবে কে?

ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি প্রবীণগণ সকলেই লজ্জাবনত-শিরে নীরব থেকে ললাটের ঘর্ম মোচন করতে লাগলেন। অর্জুন স্বীয় অধরোষ্ঠ দন্তে পিষ্ট ক’রে উচ্ছ্বসিত রোষবহ্নির বহিপথ রুদ্ধ করার প্রচেষ্টায় ওষ্ঠ দুটি রক্তাক্ত ক’রে তুললেন, ভীম নিষ্ফল ক্ষোভে শত্রুর পরিবর্তে কক্ষকুট্টিমের প্রস্তরখণ্ডেই মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন বার বার। শুধু যুধিষ্ঠির পানীয় – প্রার্থনা-ছলে স্বপক্ষীয় এক বিশ্বস্ত অনুচরকে কাছে ডেকে তাকে দিয়ে গোপনে বলে পাঠালেন, পাঞ্চালী যেন এই রজস্বলা একবস্ত্রা অবস্থাতেই সভামধ্যে এসে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে করুণা ভিক্ষা করেন। ।

দূত গিয়ে সে নির্দেশ নিবেদন করতে এতক্ষণ পরে যেন দ্রৌপদীর নয়ন-কোণের উদ্যতবজ্র বিদ্যুতাগ্নি নির্বাপিত হয়ে সেখানে বর্ষণ শুরু হ’ল। তিনি বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘ঐ পাপিষ্ঠরা কত কি লাঞ্ছনা করবে তা এখনও জানি না, কিন্তু আমার ক্ষত্রিয় ভর্তা এই প্রস্তাব পাঠিয়ে যে অপমান করলেন আমাকে—এমন আর কেউ কোন দিন করেন নি। আমার ভাগ্যকেই ধিক! শুনেছি আমি যজ্ঞসম্ভবা—হায়! সে যজ্ঞাগ্নিতেই আমার মৃত্যু হ’ল না কেন!’

এবারে দুর্যোধন—এই অবিশ্বাস্য অপ্রত্যাশিত কল্পনাতীত সিদ্ধি হস্তগত হওয়া সত্বেও তা উপভোগে অযথা বিলম্ব হওয়ায়—অধৈর্য হয়ে রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এসব বাগবিস্তারে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। অধিকারও নেই। তুমি পুনশ্চ সেখানে গিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট আদেশ জানাও। সহজে আসতে না চান—তুমি বলপূর্বক তাঁকে এখানে নিয়ে এস।’

‘বলপূর্বক’ শব্দটি যেন বেত্রাঘাতের মতোই আঘাত করল সভাস্থ নিরপেক্ষ জনদের। প্রাতিকামীও বাত্যাতাড়িত বেতসপত্রের মতো কেঁপে উঠল একবার, তারপর জোড়করে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আপনি স্বামী, আপনার অবাধ্য হলে আপনি আমাকে যে কোন কঠিন শাস্তি দিতে এমন কি বধ করতেও পারেন। আপনি সেই দণ্ডই দিন, আমি বিনা অনুযোগে মাথা পেতে নেব—কিন্তু তবু এ আদেশ পালন করতে পারব না।…ভারতসম্রাজ্ঞীকে বলপূর্বক এই পুরুষদের সভায় আনয়ন করার সাহস বা সাধ্য আমার নেই।’

কৌরব এবং তাঁদের স্তাবক, অনুগৃহীত ও আশ্রিত ব্যক্তিগণ ব্যতীত সে সভার প্রায় প্রত্যেকেই ‘সাধু’ ‘সাধু’ রবে সেই সামান্য দীনবংশোদ্ভব প্রাতিকামীকে অভিনন্দিত করল। বিদুর এসে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন।

কিন্তু সেই অপরিসীম চাঞ্চল্য ও সাধুবাদের শব্দকে অতিক্রম ক’রে কার পরুষ কর্কশ কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে উঠল, ‘এই নীচকুলোদ্ভব মূর্খ প্রাতিকামী বৃথাবলদর্পিত অতিভোজী ভীমসেনকে দেখে মৃত্যুভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছে! ওর কর্ম নয়। দুঃশাসন, তুমি যাও, বলপূর্বক কেশাকর্ষণ ক’রে আমাদের দাসী দ্রৌপদীকে এ সভায় নিয়ে এস!’

কার কণ্ঠ, সে কোলাহলের মধ্যে অনেকেই বুঝতে পারলেন না। দুর্যোধনের কি—না অঙ্গাধিপতি কর্ণর?

২৬

আর যে দুর্গতিই কল্পনা ক’রে থাকুন দ্রৌপদী—দুঃশাসনের এ ধৃষ্টতা, এত বড় দুঃসাহস হবে তা ভাবতে পারেন নি। যুধিষ্ঠিরের সম্পর্ক ধরলে তিনি ওর জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃজায়া, মাতার সমান মাননীয়া। পাদবন্দনার যোগ্য। দুঃশাসনের কলুষ – হস্তস্পর্শে তাই তিনি যে কেঁপে উঠেছিলেন তা যতটা রোষে, বোধ হয় ঠিক ততটাই বিস্ময়ে

তবু তিনি দুঃশাসনের রাজরক্তকে জাগ্রত করার জন্যই করুণ কণ্ঠে বলতে গিয়েছিলেন, ‘দুঃশাসন, আমি বর্তমানে রজঃস্বলা, একবস্ত্রা। এ অবস্থায় উত্তরীয় ব্যবহার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি নিষিদ্ধ গুরুজন বা পরপুরুষের সম্মুখীন হওয়া। তুমি এ ভাবে আমাকে নিয়ে যেও না। তোমারই বংশের বধূ আমি, সেটা স্মরণ করো।’

কিন্তু সুরা ও বিজয়গর্ব—এই দুই উগ্র মাদকে উন্মত্ত আরক্ত-লোচন দুঃশাসন পরুষ কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘থাম থাম। তুই এখন কৌরবদের দাসী। আমাদের যা ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে হবে যেখানে বাস করতে বলব সেখানেই বাস করতে হবে। রাজকুমারী বা রাজকুলবধূর যে মর্যাদা তা তুই এখনও প্রত্যাশা করছিস? তোর স্পর্ধাও তো কম নয়!’ বলতে বলতে হা-হা ক’রে প্রমত্ততারই হাসি হেসে দ্রৌপদীর সেই তরঙ্গায়িত ঈষৎ নীলাভ-কৃষ্ণবর্ণ সুবিপুল কেশরাশি মুষ্টিবদ্ধ ক’রে সেই কক্ষের নির্গমন পথের দিকে আকর্ষণ করতে লাগলেন।

দ্রৌপদী নিতান্ত বলহীনা নন। পাঞ্চাল দেশের নারীরা স্বভাববলিষ্ঠা—তিনি আকস্মিক বলপ্রয়োগে দুঃশাসনের কবলমুক্ত হয়ে ছুটে গেলেন যেখানে কুরু-কুলনারীরা নির্বাক বিস্ময়ে, হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভীতনেত্রে এই অঘটিতপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন। তাঁদের সম্মুখে গিয়ে অপমানকম্পিত রোদনরুদ্ধ কণ্ঠে আবেদন জানালেন, ‘তোমরাও রাজবংশ ক্ষত্রিয়বংশের কন্যা, বধূ,–এই মর্মান্তিক অপমানের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। আমি তোমাদের দাসীরূপে তোমাদের সেবা করতে প্রস্তুত আছি। আমাকে এই ভাবে সাধারণ পুংশ্চলীর মতো প্রকাশ্য সভাগৃহে সহস্র ইতরদৃষ্টির সম্মুখে নিয়ে যেতে দিও না।’

রাজমাতা গান্ধারী সেখানে ছিলেন না। ভানুমতীও না। অবশ্য তিনি উপস্থিত থাকলেও তাঁর হৃদয় বিগলিত হ’ত কিনা সন্দেহ। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা দুঃশাসনের সেই ভয়ঙ্কর মুখভাব দেখে ও অভব্য বাক্যাদি শুনে কিছু বলতে সাহস করলেন না। অবশ্য সে অবসরও বিশেষ পেলেন না, তার পূর্বেই পশ্চাদ্ধাবী দুঃশাসন ছুটে এসে পুনরপি কৃষ্ণার কেশরাশি দৃঢ়তর মুষ্টিতে আবদ্ধ ক’রে সবলে আকর্ষণ করতে করতে জনবহুল পরিজন-পরিবৃত পথ অতিক্রম ক’রে সভাগৃহে উপনীত হলেন।

এহেন অশালীন, রাজবংশ-বিধিবহির্ভূত আচরণে প্রায় সকলেই লজ্জা পেলেন, এমন কি দুর্যোধনও অপর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক’রে নীরব রইলেন—কর্ণই উচ্চরবে দুঃশাসনের এই দুর্মতির ভূয়সী প্রশংসা ক’রে তাঁকে অধিকতর উত্তেজিত করতে লাগলেন।

একেবারে সভার মধ্যস্থলে পৌঁছে দ্রৌপদী আবারও প্রাণপণ বলপ্রয়োগে দুঃশাসনের মুষ্টিমুক্ত হলেন। তারপর একবার মাত্র বর্ষণবিদ্যুৎভরা দৃষ্টিতে লজ্জাবনতমুখ স্বামীদের দিকে তাকিয়ে সভাস্থ প্রবীণ ও কুলপ্রধানরা যেদিকে বসেছিলেন, সেইদিকে ফিরে বললেন, ‘আপনারা আমার গুরুজন—শিক্ষা, দীক্ষা, ন্যায়বিচার, ধর্মবুদ্ধি, সকল দিকেই শ্রেষ্ঠ—আপনাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, আশা করছি উত্তমরূপে বিচার ক’রে উত্তর দেবেন—নিজে পরাজিত হবার পরও মহারাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের কি এই কপট দ্যূতক্রীড়ায় আমাকে পণ রাখার অধিকার ছিল?’

নিষ্ফল-রোষদগ্ধ প্রতিকারশক্তিহীন ভীষ্ম ললাটের ঘর্ম মোচন ক’রে বললেন, ‘ভাগ্যবতী, এ প্রশ্ন তুমি করার পূর্বে আমার মনেই উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু এর যথার্থ মীমাংসায় এখনও উপনীত হতে পারি নি। ধর্মের বিচার অতি সূক্ষ্ম, তার সত্যাসত্য নির্ণয় করা আমাদের সাধ্যাতীত। বিজিত বা বিক্রীত ব্যক্তির কোন কিছুতেই অধিকার থাকে না, অথচ স্ত্রীর উপরও স্বামীর চিরন্তন অধিকার। যদি তাঁর কিছু না থাকে—তাঁরই স্ত্রীরই বা থাকবে কি ক’রে? সেদিক দিয়ে বিচার করলে এই স্বামীদের পরাজয়ের সঙ্গেই তোমার সত্তা বিলুপ্ত হয়েছে। যুধিষ্ঠির পরম ধার্মিক, শ্রেষ্ঠ তত্বজ্ঞ, তিনি যখন তোমাকে পণ রেখেছেন তখন তাঁর সে অধিকার নেই তাই বা বলি কি ক’রে?…তুমি কপট দ্যূতক্রীড়ার অভিযোগ এনেছ—সে বিচারের কথাও যুধিষ্ঠিরের। হতে পারে শকুনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ কিতব, সুচতুর ও অক্ষক্ষেপণকুশলী। যুধিষ্ঠির তাঁর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নন। এতক্ষণ খেলার পরও তিনি যদি প্রতিবাদ ক’রে বা প্রতিনিবৃিত্ত হয়ে না থাকেন তাহলে এ অভিযোগই বা করা যায় কি ক’রে?’

আবারও কর্ণের যেন চেষ্টাকৃত রূঢ় কণ্ঠ ধ্বনিত হয়—’দুঃশাসন, এই দাসী ও এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের প্রলাপোক্তি এত মনোযোগ দিয়ে শোনার কি আছে? দ্রৌপদী যে আমাদের দাসী হয়েছে সেটা তাকে ভাল ভাবে অনুভব করতে দাও।’

আরও একবার—যেন চরম বিপদে পরম অভয় অন্বেষণের মতোই স্বামীদের দিকে আর্ত দৃষ্টিতে চাইলেন দ্রৌপদী। কিন্তু তাঁরা সকলেই মাথা নত ক’রে বসে—তাঁদের দৃষ্টিতে এ বিপন্ন আবেদন পৌঁছল না।

কর্ণ বোধ করি অনিমেষপাত-নেত্রে কৃষ্ণাকে লক্ষ্য করছিলেন, ওঁর এ নিঃশব্দ আবেদনও তাঁর দৃষ্টি এড়াল না। তিনি নিষ্ঠুর কৌতুকে হা-হা ক’রে হেসে বললেন, ‘ঐ নির্জীব কাপুরুষ দাসগুলোর দিকে তাকিয়ে কোন লাভ হবে না পাঞ্চালী। ওরা কি মানুষ? মেষপাল বললেও বুঝি তাদের অপমান করা হয়। পতি নির্বাচনের সময় তুমি সুবিবেচনার পরিচয় দাও নি। সেদিন দুর্যোধনকে বরণ করলে আজ এ দুৰ্গতি হ’ত না।’

এবার ভীমসেন আর আত্মসম্বরণ করতে পারলেন না। বিপুল দুঃখের উপর এই মর্মান্তিক, কঠিন আঘাত স্ফুলিঙ্গাঘাতে অগ্নি-প্রজ্বলনের কাজ করল। তিনি জ্যেষ্ঠাগ্রজকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘মহারাজ, সসাগরা পৃথিবী জয় ক’রে যে ধনরত্ন আহরিত হয়েছিল, ভুবনবিজয়ী নৃপতিগণ স্বেচ্ছায় প্রীতিবশে যেসব অমূল্য দ্রব্যাদি উপহার দিয়েছেন— তৎসমস্ত সহ আমাদের স্বপ্রতিষ্ঠিত রাজ্য, ঐশ্বর্য, এমন কি আপনার ভ্রাতাদেরও আপনি পণ রেখে পরাজিত হয়েছেন— তাতেও আমার তাদৃশ ক্রোধ উৎপন্ন হয় নি। কারণ আপনি এ সমুদয় এবং আমাদেরও প্রভু। কিন্তু এবার আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। দ্যূতক্রীড়াপ্রিয় ব্যক্তিদের অনেক রক্ষিতা থাকে—তাঁরাও সেই বেশ্যাদের প্রতি স্নেহবশত কখনও তাদের পণ রাখেন না। আপনি আপনার প্রিয়তম ভার্যা ও আমাদের কুললক্ষ্মীকে পণ রাখলেন। সহদেব, অগ্নির আয়োজন কর, আমি ওঁর ঐ হাত, যে হাতে স্ত্রীকে পণ রেখে তিনি অক্ষক্ষেপণ করেছেন—দগ্ধ করব।’

উত্তেজনায় ভীমসেন উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অর্জুন ওঁর বাহুমূল ধরে নিরস্ত ক’রে বললেন, ‘ছিঃ! আর্য ভীমসেন, আপনি ভাগ্যের প্রতারণায় উত্তেজিত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা সম্বন্ধে এ ধরনের বাক্য উচ্চারণ করা এমন কি কল্পনা করাও গর্হিত। আমরা এখন প্রবল শত্রুর সম্মুখীন, ভাগ্য আমাদের উপর বিরূপ, এ অবস্থায় আমাদের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার অর্থ প্রকারান্তরে তাদেরই বৃহত্তর জয়লাভ, তাদের হাতে আঘাতের নূতন অস্ত্র তুলে দেওয়া। ভেবে দেখুন, এ সময়ে কোনরূপ অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেলে শত্রুরা উৎসাহিত হবে, আমরাও মানবসমাজে উপহাসাস্পদ হব। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধে বা অক্ষক্রীড়ায় পশ্চাৎপদ হওয়ার অর্থ শুধু কাপুরুষতা প্রকাশ পাওয়া নয়, ধর্মভ্রষ্ট হওয়াও। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কুলধর্ম পালনের জন্য এই দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

অর্জুনের বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই এক সুদর্শন তরুণ যুবক সভাস্থলে উঠে দাঁড়ালেন। ইনি দুর্যোধনের সহোদর অনুজ—বিকর্ণ।

বিকর্ণ বললেন, ‘হে সভাস্থ ভদ্রমণ্ডলী, মনস্বিনী দ্রৌপদী যে প্রশ্ন করেছেন তা আপনাদের সকলেরই উদ্দেশে। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, কুলপ্রধান ধৃতরাষ্ট্র, আচার্য দ্রোণ, কৃপ–আপনারা কেউ এঁর প্রশ্নের সম্যক উত্তর দেন নি। এই সভামধ্যে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাগত রাজন্যবৃন্দও রয়েছেন, ক্ষত্রিয়ের পালনীয় ধর্ম বা আচরণ তাঁরাও অবগত আছেন। আপনারা পক্ষপাত অথবা ব্যক্তিগত দ্বেষ কি আশঙ্কা ত্যাগ ক’রে সত্য মতামত ব্যক্ত করছেন না কেন?’

যেন উত্তরের জন্যই কিছুক্ষণ নীরবে অপেক্ষা ক’রে বিকর্ণ পুনশ্চ বললেন, ‘আপনারা এই লজ্জাজনক অবস্থা এবং এক্ষেত্রে নিজেদের কি করণীয় তা স্থিরমস্তিষ্কে চিন্তা করুন। পণ্ডিতেরা রাজাদের চার প্রকার প্রবল আসক্তিকে ব্যসনরূপে অভিহিত করেছেন। মৃগয়া, সুরাপান, দ্যূতক্রীড়া এবং স্ত্রীসম্ভোগ। ব্যসনে মত্ত হলে কোন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ধর্মবুদ্ধি সে ব্যক্তিকে ত্যাগ করে। সে শ্রেণীর ব্যক্তিকে অমানুষ বলে গণ্য করা হয়। তাদের অনুষ্ঠিত কর্মকেও কেউ অভ্রান্ত বা প্রামাণিক ভাবে না। মহারাজ যুধিষ্ঠিরও ব্যসনমত্ত অবস্থাতেই দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। দ্রৌপদী অন্য পাণ্ডবদেরও পত্নী। নিজে পূর্বে পরাজিত হয়ে স্ত্রীকে পণ রাখার কী অধিকার তাঁর ছিল, অপরের পত্নীকেই বা তিনি পণ রাখেন কি ক’রে? আরও একটি বিষয় আপনারা স্মরণ রাখবেন, পাণ্ডবমহিষীকে পণ রাখার কথা যুধিষ্ঠির পূর্বে কল্পনামাত্র করেন নি–ধূর্ত শকুনিই ওঁর বিহ্বলতা ও বুদ্ধিবিভ্রম লক্ষ্য ক’রে সুযোগ বুঝে সে প্রস্তাব করেন— ব্যসনাসক্ত মহারাজ অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না ক’রে তাতেই সম্মতি দান করেন। সুতরাং সেক্ষেত্রে কোন মতেই দ্রৌপদীকে কৌরবদের বিজিতা বলে স্বীকার করা যায় না।’

বিকর্ণের বক্তব্য শেষ হতে সভামধ্যে দারুণ কোলাহল দেখা দিল। অধিকাংশ ব্যক্তিই বিকর্ণকে সমর্থন ও শকুনির ঘোর নিন্দা করতে লাগলেন। কিন্তু কুরুকুলের কেউ এমন কি দুর্যোধনও এ কথার কোন উত্তর দেওয়ার পূর্বেই ক্রোধরক্তিমানন অঙ্গাধিপতি কর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল কণ্ঠে বিকর্ণকে তিরস্কার করতে লাগলেন।

‘বিকর্ণ, তুমি তোমার বংশের, আপন ভ্রাতাদের বিরুদ্ধাচরণ করছ—এই তো সর্বাপেক্ষা অমানুষের কাজ। অরণি-কাষ্ঠ ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে সেই কাষ্ঠকেই সর্বাগ্রে বিনাশ করে—তুমিও সেইভাবে পিতৃকুলের স্বার্থবিরুদ্ধ কাজ করছ। এ সভায় এত প্রবীণ জ্ঞানী শাস্ত্রাভিজ্ঞ ব্যক্তি নীরব রয়েছেন—কিছু বলতে সাহস করছেন না— তুমি কি তাঁদের চেয়েও পণ্ডিত মনে কর নিজেকে? তুমি বালক, ধর্মের সূক্ষ্মতত্ব কিছুই জান না—আমাদের সে সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে এসেছ! এর অপেক্ষা ধৃষ্টতা এবং অর্বাচীনতা আর কি হতে পারে! তোমার বয়স অল্প সে কারণে এতাদৃশ প্রগলভতা প্রকাশ করে নিজেকে মূর্খ প্রতিপন্ন করছ …কৃষ্ণা এখন নন, বহুপূর্বেই কৌরব কর্তৃক বিজিতা হয়েছেন। যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ রেখে পরাজিত হয়েছিলেন, দ্রৌপদীও কি সে সর্বস্বের মধ্যে পড়েন না? শকুনি ওঁর নামটা মনে করিয়ে দিয়েছেন বলেই যুধিষ্ঠির পণ রেখেছেন? তিনি কি একেবারে শিশু, না কি এতই নির্বোধ? আর যদি মনে করো তাঁকে একবস্ত্রা অবস্থায় সভামধ্যে আনা অন্যায় হয়েছে—তবে তার উত্তরে একটি কথা বলেই তোমার ভ্রান্তি নিরসন করব স্ত্রীলোকের একটিই মাত্র পতি শাস্ত্রে বিহিত হয়েছে। বিশেষ পঞ্চপতি হলেই সে নারী বেশ্যারূপে পরিগণিত হয়। এ কথা সবাই জানে। দ্রৌপদী যখনই পঞ্চ ব্যক্তির স্বামীত্ব স্বীকার করেছেন তখনই তো তিনি বারাঙ্গনার পর্যায়ে পড়েছেন। বহুজনভোগ্যা বারনারীকে একবস্ত্র কেন বিবস্ত্র অবস্থায় আনাতেও কোন দোষ হয় না। ‘

এতদূর অসৌজন্য, অশালীন ভাষা ব্যবহারেও বুঝি অঙ্গাধিপতির অন্তরের জ্বালা প্রশমিত হয় না—তাঁর উদ্ধত উচ্চ কণ্ঠস্বর সে সভার পরিবেশ বিদ্বেষবিষজর্জরিত ক’রে দিয়েছে অনুভব ক’রেও বুঝি থামতে পারেন না—কঠোর বাক্যাঘাত শেষ হতেই অধিকতর অপমানের কথা মনে পড়ে তাঁর। তর্জনী সংকেতে দুঃশাসনকে লক্ষ্য ক’রে বলেন, ‘দুঃশাসন, বিজ্ঞতাভিমানী বালক বিকর্ণর আস্ফালনে তুমি কর্তব্যে বিরত কেন? তুমি পাণ্ডবদের ও যাজ্ঞসেনীর বস্ত্রসকল আহরণ করো। যাজ্ঞসেনীকে একবস্ত্রে আসতে হয়েছে বলে উনি বড়ই দুঃখিত—সে বস্ত্র-বন্ধন থেকে ওঁকে মুক্তি দাও!’

বিস্মিত হলেন সকলেই। কর্ণের পক্ষে এ ধরনের অন্ত্যজবৎ আচরণ কল্পনাতীত।

কিন্তু দুঃশাসনের এসব কোন চিন্তাসংকট বা ভাবদ্বন্দ্বের দুর্বলতা নেই। তিনি বিকর্ণ ও কর্ণের বাকযুদ্ধের অবসরে মত্ততাজনিত ঈষৎ তন্দ্রাসুখ উপভোগ করছিলেন, সহসা অকারণেই হেসে উঠে দ্রৌপদীর দিকে অগ্রসর হলেন।

কর্ণের নির্লজ্জ নির্দেশ শোনামাত্রই পাণ্ডবরা নিজ নিজ উত্তরীয় ও উষ্ণীষ খুলে দুঃশাসনের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন। তবে সেদিকে না দুঃশাসন আর না কর্ণ কারও লক্ষ্য ছিল না। তাঁদের দৃষ্টি দ্রৌপদীতেই আবদ্ধ। দ্রৌপদী তখন দুঃখে ক্ষোভে লজ্জায় ও উষ্মায় বাত্যাতাড়িত বেতসপত্রের মতোই কম্পমানা। তাঁর দুই চক্ষুতে একই সঙ্গে বজ্ৰ ও বর্ষণের সম্মেলন ঘটেছে।

কিন্তু দুঃশাসনকে অগ্রসর হতে দেখেই কৃষ্ণা যেন অকস্মাৎ শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন। স্থিরকণ্ঠে কুরুপ্রধানদের শ্রবণযোগ্য স্বরে বললেন, ‘বুঝলাম এ সভাগৃহে সকলেই দুর্যোধনের ভয়ে ত্রস্ত, আতঙ্কিত। এখানে সুবিচার বা সুবিবেচনা আশা করাই নির্বুদ্ধিতা। একমাত্র পাণ্ডবদের পরম শুভানুধ্যায়ী দ্বারকাধীশ যদি এখানে উপস্থিত থাকতেন তাহলে এ স্পর্ধার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতেন। তিনি থাকলে কারও এতখানি দুঃসাহস হ’তও না। সুতরাং আমি জন্ম জন্মান্তরে যা মানবের নিত্যসঙ্গী নিত্য-রক্ষক—সেই ধর্মকে স্মরণ ক’রে নীরব রইলাম। এঁদের প্রত্যেকের ঘরেই জননী জায়া দুহিতা আছে, তত্রাচ তাঁরা নীরবে বিনা প্রতিবাদে আমার এ লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করছেন। মনে হচ্ছে জগৎ থেকে শ্রেয় বুদ্ধি অন্তর্হিত হয়েছে, অধর্মই আজ প্রবল ও প্রধান। তথাপি আমি এ সংসারের শাশ্বত বস্তু ধর্মকেই আশ্রয় করলাম, তিনি আমাকে রক্ষা করুন।’

সভাস্থ সকল ভদ্রব্যক্তিই নীরব ও চিত্রার্পিতপ্রায় নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন। দ্রৌপদীর অভিযোগে সকলেই লজ্জিত, তবু ‘অপর কেউ প্রতিবাদে অগ্রসর হলে আমি অবশ্যই হব’ প্রত্যেকেই এই বোধে এত বড় অশালীন কাজেও বাধা দিতে উঠলেন না। দুঃশাসনের তো এসব কথার মর্ম বোঝারই অবস্থা নয়, বিশেষ কর্ণ উন্মত্ত বৃষভবৎ ক্রমাগত উত্তেজিত করছেন—তিনি সত্যই অগ্রসর হয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রপ্রান্ত ধরে আকর্ষণ করলেন!

কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি আর যে ঘটনার কথাই কল্পনা ক’রে থাকুন, বাস্তবে তার কিছুই ঘটল না। ক্রন্দন আক্ষেপ করুণাভিক্ষা–হয়ত শেষে আত্মসমর্পণ—এই কথাই চিন্তা করছিলেন তাঁরা। কিন্তু যাজ্ঞসেনী সেসব কিছুই করলেন না, এমন কি তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত বলেও মনে হ’ল না, দুই চক্ষু বন্ধ ক’রে করজোড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ধর্ম—এবং তাঁর কাছে যিনি ধর্মশক্তির প্রতীক—সেই শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করতে লাগলেন।

তবু বিস্ময় সুদ্ধমাত্র এই স্থৈর্যেই নয়।

সেই সভাগৃহে সেদিন যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল, যে অলৌকিক দৈবশক্তির আবির্ভাব হ’ল—তা সভাস্থ তাবৎ লোকেরই আমরণ স্মরণ রাখার মতো। পুত্রপৌত্রাদিক্রমেই এ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সেই সভায় আগত আহূত-অনাহূত ব্যক্তি বা আগন্তুকদের বংশে—যদিচ পরবর্তী কালের মানুষের পক্ষে, পূর্বপুরুষদের দ্বারা কথিত হওয়া সত্বেও, এই লোকোত্তর ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথমটা অনেকে বুঝতেও পারেন নি, বিশেষ দূরস্থিত দর্শকরা। দুঃশাসন পৈশাচিক উল্লাসে ভ্রাতৃজায়ার বস্ত্র আকর্ষণ করছেন, সে বস্ত্র শিথিল হয়ে খুলে আসছে—এ-ই দেখেছে সবাই। অনেকে লজ্জায়—নিজ বংশের সংস্কারে, চক্ষু মুদিত করেছেন। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়া সত্বেও তো প্রত্যাশিত কোন ধিক্কারের শব্দ উঠল না! তখন সকলেই চেয়ে দেখলেন—দুঃশাসনের সামনে বস্ত্রের স্তূপ জমে উঠেছে—উঠছে –কিন্তু দ্রৌপদী তখনও অনাবৃতা হন নি। কে যেন কোন অলৌকিকশক্তিবলে অদৃশ্য থেকে দুর্বৃত্ত দুঃশাসনের হাতে ক্রমাগত বস্ত্ৰ যুগিয়ে যাচ্ছে, অঞ্চলই বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হচ্ছে—দ্রৌপদীর পরিধেয় এতটুকু কোথাও স্থানচ্যুত হচ্ছে না।

নারীদের প্রমাণ পরিধেয়ের পরিমাপ সম্বন্ধে সকলেরই অল্পবিস্তর ধারণা আছে— সে মাপের হিসাবে শতাধিক বস্ত্ৰ খুলে এসেছে, এখনও ক্রমাগতই আসছে, স্তূপ ক্ষুদ্র পর্বতাকৃতি ধারণ করছে—তবু দ্রৌপদীর অঙ্গ অনাবরিত হওয়া তো দূরে থাক কোন অঙ্গের আবরণই স্থানচ্যুত হয় নি। এবার পিছনের লোকরা এই অভূতপূর্ব, প্রায় দৈবঘটনা চাক্ষুষ করার জন্য উঠে দাঁড়াল। এখনও বস্ত্রের পর বস্ত্র চলে আসছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দ্রৌপদীর অঙ্গ থেকেই। দুঃশাসনও বিস্ময়ে হতচেতন প্রায়। শুধু অবিরলভাবে বেরিয়ে আসছে বলেই বিস্ময় নয়—এত সূক্ষ্ম ও মহার্ঘ্য বস্ত্র তিনি কখনও দেখেন নি। এ কোন তন্তু থেকে নির্গতই-বা হয়েছে! এত দীর্ঘ বস্ত্র ধারণ করতে পারে এমন কোন তন্তু কখনও তিনি দেখেন নি, শোনেনও নি তিনি এতদিনের মধ্যে।

বহুক্ষণ ধরে চলল এই ঘটনা। হতবাক সকলেই। কারও চোখে পলক পড়ছে না। লজ্জাবনতমুখ পাণ্ডবরাও কোন আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে অনুভব ক’রে মুখ তুলে চেয়েছেন এবং চেয়েই আছেন।

বহুক্ষণ ধরে বস্ত্র আকর্ষণ-পর্ব চলার পর যখন শিথিল সেই বস্ত্রের স্তূপ সত্যই পর্বতাকার ধারণ করল তখন দুঃশাসন ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে বসে পড়লেন। সভামধ্যে দারুণ কোলাহল উত্থিত হ’ল। এবার কৌরবদের আশ্রিতরাও—বোধ করি ধর্মের এই মহান মহিমা প্রত্যক্ষ ক’রে কিছু সাহস সঞ্চারিত হওয়ায়—সরবে কৌরবদের নিন্দাবাদ ও পরমাসতী দ্রৌপদীর জয়গান করতে লাগলেন, সভায় সংপ্লবের অবধি রইল না।

কিছুক্ষণ দারুভূতবৎ নির্বাক বসে থাকার পর এ-পক্ষে কর্ণরই প্রথম সম্বিৎ ফিরল। তিনি সভার এই বিরূপতা লক্ষ্য ক’রে বললেন, ‘দুঃশাসন, অকারণ বিলম্ব করছ কেন, এই দাসীকে এবার আমাদের দাসীদের আবাসে নিয়ে যাও!’

কর্ণর বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই—চতুর্দিকের মহতী হলহলা শব্দ প্রদমিত ক’রে সভাকে নিস্তব্ধ ক’রে ভীমের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হ’ল, ‘এই সভাস্থ সকলে শুনে রাখুন, যুদ্ধক্ষেত্রে আপন নখরে এই পাপাত্মা পাপকর্মা দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে ওর রক্ত পান করব। যদি না পারি মৃত্যুর পর যেন আমার পিতৃলোকে গতি না হয়—যেন পিশাচত্ব প্রাপ্ত হই।’

এই ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞায় সমগ্র সভাকক্ষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল। সকলেই যেন এক আসন্ন অপ্রতিরোধ্য অমঙ্গলাশঙ্কায় অবশ হয়ে গেলেন।

এই সুযোগে বিদুর আবারও সভাস্থ ভদ্রজনের শুভবুদ্ধির কাছে পুনরাবেদন জানানোর প্রয়াস পেলেন। দুই বাহু ঊর্ধ্বে উৎক্ষেপণ ক’রে বললেন, ‘সভ্যগণ, সাধ্বী দ্রৌপদী যে প্রশ্ন করেছেন আপনারা এতাবৎ তার কোন উত্তর দেন নি। বালক বিকর্ণর যে সৎসাহস আছে, এ সভার প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদেরও তা নেই দেখে আমি যুগপৎ বিস্ময় ও ব্যথা অনুভব করছি এবং এই কালকে ধিক্কার দিচ্ছি। শাস্ত্রে আছে অভিজ্ঞ হয়েও যে ব্যক্তি ধর্মজিজ্ঞাসু ব্যক্তিকে সত্য উত্তর না দেয়, তার দুর্দশার সীমা থাকে না। যার ধন অপহৃত হয়, যার পুত্র নিহত হয়, যে ঋণ-শোধে অপারগ, যে স্ত্রী অকালবৈধব্য প্রাপ্ত হয়, যে রাজপুরুষদের হাতে নিগৃহীত ও সর্বস্বান্ত হয়, যাকে শার্দূলে আহত করে, যে নারীকে সপত্নীসঙ্গ সহ্য করতে হয়—মিথ্যা উত্তরদাতাদের সেই সমস্ত এবং আরও বহুবিধ দুরবস্থার ন্যায় যন্ত্রণাভোগ নির্দিষ্ট হয়েছে।’

বিদুর যেন কিছুই বলেন নি এই ভাবে কর্ণ আবারও বললেন, ‘দুঃশাসন কী দেখছ? এ উন্মাদ এবং স্থবিরদের সভা। তুমি দাসীকে শীঘ্র তার যথাযোগ্য বাসগৃহে নিয়ে যাও।’

দুঃশাসন এতক্ষণে কিছুটা শান্ত ও শ্রান্তিবিযুক্ত হয়েছেন, ভীমের ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞার প্রাথমিক আতঙ্ক-আচ্ছন্নতাও কিছুটা বিদূরিত হয়েছে। তিনি আবারও উঠে অশ্রাব্য কটূক্তি ও …লিত হাস্যসহকারে দ্রৌপদীর কেশমণ্ডলীতে হস্তার্পণ করলেন।

কিন্তু বোধ করি মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি অভিজ্ঞতার অতীত অদৃষ্টপূর্ব এই দৈবঘটনায় চিত্তবল ফিরে পেয়েছিলেন দ্রৌপদী, তিনি কুপিতা ব্যাঘ্রীর ন্যায় গর্জন ক’রে উঠলেন। সজোরে দুঃশাসনের কবলমুক্ত হয়ে সভাস্থ প্রবীণ ও প্রধান ব্যক্তিদের দিকে চেয়ে উচ্চরবে বললেন, ‘যাকে কোনদিন এমন কি চন্দ্র সূর্যও দেখতে পেত না–সে আজ এই ভাবে কলুষিত দৃষ্টির সম্মুখে লাঞ্ছিত হ’ল। পাঞ্চালরাজের কন্যা, পাণ্ডবদের পট্টমহাদেবী, কংস ও শিশুপালের নিহন্তা বাসুদেবের প্রিয় সখীর আজ এই দুর্গতি হচ্ছে দেখেও পাণ্ডবরা নীরব রয়েছেন, কৌরবরাও তাঁদের সুষা ও দুহিতা প্রকাশ্য সভায় নিগৃহীতা দেখে সহ্য করছেন, সেক্ষেত্রে আমি এখানে কারও কাছ থেকেই এর প্রতিবাদ কি প্রতিকার আশা করি না, শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর প্রার্থনা করি—আপনারা দয়া ক’রে বলুন আমি বিজিতা কি অজিতা! আপনারা সকলে যে মত দেবেন আমি তাই স্বীকার করে নেব।’

প্রবীণরা সকলেই লজ্জিত অপ্রতিভ ভাবে প্রবীণতম সভ্য ভীষ্মর মুখেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

ভীষ্ম অধোমুখেই উত্তর দিলেন, ‘কল্যাণী, তোমাকে পূর্বেই বলেছি, ধর্মের গতি বিজ্ঞ মানব এমন কি ঋষিদেরও সম্পূর্ণ জ্ঞাত নয়। এ সংসারে বলবান মানুষ যাকে ধর্ম মনে করে, তা অধর্ম হলেও লোকসমাজে তাই সত্য ও ধর্ম বলে প্রতিষ্ঠা পায়, দুর্বলের কথিত পরম ধর্মও কেউ স্বীকার করে না। উপস্থিত এই জয়পরাজয়ের প্রসঙ্গে যে ন্যায়ের প্রশ্ন তুমি তুলেছ তার সূক্ষ্মতা ও দুরবগাহতা বিচার ক’রে আমার পক্ষে এর সত্য নির্ণয় করা অসাধ্য। তবে এইটুকু বলতে পারি আজ এখানে কৌরবরা যে কুৎসিত লোভের পরিচয় দিল ও যে ইতরতা প্রকাশ করল তাতে অচিরকাল মধ্যেই এই কুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। ভাগ্যবতী, তুমি যে এই কষ্ট ও দুর্দশার মধ্যেও ধর্মকে অবলম্বন করেছ—এ তোমারই উপযুক্ত হয়েছে, এর জন্য আমি তোমাকে প্রশংসা করছি। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলুম না, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি শাস্ত্রজ্ঞ ও ধর্মজ্ঞ বৃদ্ধরা মৃতর মতো জড় হয়ে বসে আছেন, সুতরাং আমার মতে, তোমার প্রশ্ন তুমি ধীমান যুধিষ্ঠিরকেই কর। উনি অন্যায় বলবেন বলে বোধ করি না।’

ভীষ্ম নীরব হলে আর কোন আশ্রয় কি ভরসা কোথাও রইল না ভেবে দ্রৌপদী আর্তস্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন। সভাস্থ সকলেই মূক। ভীষ্মের এই স্পষ্টোক্তির পরও যুধিষ্ঠির পূর্ববৎ আনত মুখে বসে রইলেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না।

সভার এই মৌনতা লক্ষ্য ক’রে নিজের শক্তি ও জয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত দুর্যোধন ঈষৎ হাস্য ক’রে বললেন, ‘পাঞ্চালী, যুধিষ্ঠির তো দেখছি নিরুত্তর। আমাদের কথার প্রতিবাদ করার শক্তি ওঁর নেই। বেশ তো, তোমার তো আরও চারজন মহাবল ও জ্ঞানবান স্বামী এখানে উপস্থিত আছেন এ প্রশ্ন তুমি তাঁদেরই কর না। তাঁরা এই সভাস্থ আর্যদের সামনে বলুন যুধিষ্ঠিরের এই পণ রাখার কোন অধিকার ছিল না, তিনি মিথ্যাবাদী—আমি এখনই তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। যা হোক একটা পথ তুমি অবলম্বন কর, সভাস্থ সকল ভদ্রব্যক্তিই তোমার রোদনে দুঃখ বোধ করছেন, কেবল তোমার মন্দভাগ্য স্বামীদের মুখ চেয়ে চক্ষুলজ্জাতেই যথার্থ উত্তর দিতে পারছেন না।’

আবারও এক বিপুল কোলাহল উঠল। অনেকে দুর্যোধনকে সমর্থন করলেন, অর্বাচীনরা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে চক্ষুর ইঙ্গিত ক’রে কৌতুকসূচক শব্দ করতে লাগল। যাঁরা কিছুটা মধ্যপথাবলম্বী তাঁরা উৎকণ্ঠ হয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, উনি কি বলেন শোনার জন্য।

উত্তর দিলেন ভীম। তবে সে এ প্রশ্নের উত্তর নয়। সশব্দে দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন ক’রে বললেন, ‘এই মহারাজ আমাদের জ্যেষ্ঠ ও কুলাধিপতি। ইনি আমাদের প্রভু, আমাদের পুণ্য, তপস্যা এমন কি জীবনেরও অধীশ্বর। ইনি নিজেকে এবং আমাদের পরাজিত বোধ করছেন বলেই অগত্যা আমাদের নীরব থাকতে হয়েছে। নইলে পাঞ্চালীর কেশপাশ স্পর্শ করার পরও কোন দেহধারী জন্মমরণশীল ব্যক্তি দণ্ডমাত্রও জীবিত থাকত না। জ্যেষ্ঠের গৌরব রক্ষার্থই এই অপমান সহ্য করতে হয়েছে, বিশেষ স্থিতধী অর্জুন বারম্বার নিরস্ত করছেন—নইলে কেবলমাত্র হস্ত ও পদদ্বারাই আজ কৌরবদের নিশ্চিহ্ন করতাম।’

কর্ণর সব্যঙ্গ কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠল, বললেন, ‘থাক, থাক। তুমি ভোজনে আর আস্ফালনে পটু তা সকলেই জানে। সামান্য অপরাধীরা যখন বন্দী হয়ে রাজকীয় কারাগারে আবদ্ধ থাকে, তখন তারাই এ রকম বালকোচিত আস্ফালন করে। কোন ক্ষত্রবংশীয়ের এবপ্রকার বৃথা বাক্য-বিক্রম-প্রদর্শন শোভা পায় না। যাজ্ঞসেনী, তুমি আমার কাছে তোমার প্রশ্নের উত্তর শোন। শাস্ত্রে আছে অস্বাধীন দাস, তার পুত্র ও নারী এ তিনজনই অধন, এদের নিজস্ব কিছু থাকে না, তারা যদি কখনও কিছু লাভ করে তা তাদের প্রভু বা স্বামীরই প্রাপ্য বলে গণ্য হয়। তুমি সেই অধন দাসের পত্নী, তাদের সমুদয় ধনের সঙ্গে তুমিও এই প্রভুর অধীন হয়েছ। অতএব আর বৃথা বাগজাল বিস্তার না ক’রে তোমার প্রভুর অন্তঃপুরে গমন কর এবং তাঁর পরিবারবর্গের সেবা কর। সুন্দরী, এখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররাই তোমার স্বামী। তবে দাসীদের পক্ষেও পতিবরণ অবিধেয় নয়। পঞ্চপাণ্ডব পরাজিত এবং দাসে পরিণত। তাদের আর তোমার পতিত্বের অধিকার নেই। তুমি শীঘ্রই এই কৌরবদের মধ্যে মনোমত কাউকে পতিত্বে বরণ ক’রে নাও—যাঁর হাতে পড়লে ভবিষ্যতে এমন লাঞ্ছনার সম্ভাবনা থাকবে না। ক্ষত্ৰকুলজাত তো দূরে থাক, এই কৌন্তেয়রা যদি মানুষ হত এতটুকু পৌরুষ বা শৌর্য যদি থাকত—তাহলে নিজেদের পত্নীকে পণ রেখে অক্ষক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হত না।’

ভীম উচ্চৈঃস্বরে একটা হা-হা রব ক’রে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জ্যেষ্ঠের উদ্দেশে বললেন, ‘ঐ নীচ সূতপুত্রটার দোষ দিতে পারি না। কারণ সে সত্য কথাই বলেছে, আমরা যথার্থই এখন ওদের দাসে পরিণত হয়েছি…হায়, আপনি যদি কৃষ্ণাকে পণ না রাখতেন তাহলে আজ শত্রুরা এমন ভাবে আমাদের ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করতে পারত না। সে-ই একসময় আপনাকে ক্রীড়ায় ক্ষান্তি দিতে হ’ল, নিজেদের পরাজয়েই ক্ষান্ত হলেন না কেন!

এবার দুর্যোধনের পালা। তিনি কৃত্রিম সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘কই মহারাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির, আপনি নীরব কেন?…ভীম অর্জুন তো সর্বতোভাবে আপনারই ওপর নির্ভর করছে। আপনিই বলুন এবার—কৃষ্ণা অপরাজিতা না পরাজিতা!’

এই বক্রোক্তির সঙ্গেই এক হাতে গুম্ভকে বক্রতর করতে করতে অপর হাতে নিজের বাম ঊরুর বস্ত্র অপসারিত ক’রে সেই কদলীদণ্ডসদৃশ অনাবরিত ঊরুদেশ দেখিয়ে দ্রৌপদীর দৃষ্টি আকর্ষণ উদ্দেশ্যে মৃদু চপেটাঘাত করলেন এবং

সেই দেহাংশে এসে উপবেশন করার ইঙ্গিত করলেন।

তাঁর এই শিক্ষা-সংস্কৃতি-বংশমর্যাদাহীন বর্বরোচিত আচরণে ভীমসেন ক্রদ্ধ সিংহের মতো গর্জন ক’রে বললেন, ‘আপনারা সকলে শ্রবণ করুন, আমি যদি একদা সমরাঙ্গণে গদাঘাতে এই পামরের ঐ ঊরু ভঙ্গ করতে না পারি, তবে যেন মৃত্যুর পরে আমার সদগতি না হয়—পিতৃপুরুষরা যেন আমার অশুচি আত্মাকে নিত্য অভিসম্পাত করেন!’

বলতে বলতে মনে হ’ল উষ্মা নয়—ভীমের সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সত্যকার বহ্নিশিখাই নির্গত হতে লাগল।

তাঁর সেই সাক্ষাৎ কৃতান্তসদৃশ করাল মূর্তি দেখে অনেকেই আতঙ্কে মূর্ছাহত হয়ে পড়ল। বিদুর এই সুযোগটিরই যেন অপেক্ষা করছিলেন, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় বললেন, ‘হে সভ্যগণ, আপনারা দেখুন মহাবলী বৃকোদর থেকে আজ ধরিত্রীর মহাভয় উপস্থিত হ’ল। মনে হচ্ছে দৈবই প্রতীপবংশীয়দের প্রতি প্রতিকূল, সেই কারণে অক্ষবেশে অধর্মকে প্রেরণ করেছেন। ধার্তরাষ্ট্ররা বংশমহিমা এবং নিজেদের মর্যাদাকে ধুলিসাৎ ক’রে স্ত্রীলোককে বিশেষ নিজকুলের বধূকে পণীভূত ক’রে এই দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। ধর্ম বিনষ্ট হলে সর্ব কার্যই দূষিত হয়। এ সভাও পাপপুরীতে পরিণত হয়েছে। কোনও ব্যক্তি নিজে অনীশ্বর হয়ে—অর্থাৎ বিক্রীত হবার পর যদি কিছু পণ রাখে তা জয় করাও অর্থহীন স্বপ্নলব্ধ পণের সঙ্গে তার কিছুমাত্র প্রভেদ নেই। কৌরবগণ এখনও সতর্ক হোন, নতুবা মহাসর্বনাশ হবে!’

দুর্যোধন এ বক্তৃতার প্রারম্ভেই ভ্রূ কুঞ্চিত করেছিলেন, এখন বিদুরের সতর্কবাণী শেষ হতেই ব্যঙ্গ-বিষাক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বেশ তো, এই কথাটাই ভীম অর্জুন নকুল সহদেব স্বীকার করুন যে যুধিষ্ঠির অনীশ্বর হয়ে কৃষ্ণাকে পণ রেখেছেন—আমি এখনই যাজ্ঞসেনীকে মুক্তি দিচ্ছি!’

ঠিক সেই সময়, সেই দিবাভাগেই, অগ্নিহোত্ৰ গৃহে* এক শৃগাল বিকট চিৎকার ক’রে উঠল এবং সেই সঙ্গে যেন ঐকতান মিলিয়ে কোথা থেকে কয়েকটি গর্দভ ও সভাগৃহের বলভিতে উপবিষ্ট কয়েকটি কদাকার বিরাট পাখীও শ্রুতিকটু ঘোর রবে ডাকতে লাগল।

সেই বীভৎস উচ্চরবে সকলেই দুর্লক্ষণ চিন্তায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি প্রবীণগণ ‘স্বস্তি স্বস্তি’ উচ্চারণ করলেন। সভাস্থ তাবৎ ব্যক্তি কিছুকাল বিমূঢ়ের মতো হতবাক হয়ে রইলেন।

সে কুস্বর শুনেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র-মহিষী মনস্বিনী গান্ধারীও। এই মহাসতী অন্ধস্বামীর গৃহে আসার প্রস্তাবেই নিজের দুই আয়ত পদ্মপলাশসদৃশ চক্ষু চিরদিনের মতো আবরিত ক’রে স্বামীর জন্মদুর্ভাগ্য ভাগ ক’রে নিয়েছিলেন। স্বামীর অপেক্ষা কোন বিষয়েই তাঁর অতিরিক্ত সুযোগ না থাকে—সেই তাঁর তপস্যা। অতিশয় ধর্মপরায়ণা সাধ্বী তেজস্বিনী এই নারী বোধ করি সেই কারণেই কুরুকুলে সর্বশ্রেষ্ঠা রূপে স্বীকৃত হয়েছিলেন, আজও স্মরণীয়া হয়ে আছেন।

এই দ্যূতক্রীড়ার পূর্বে পিতা বা পুত্র কেউ তাঁর মত নেন নি, কারণ তিনি নিষেধ করলে এ কাজ করার সাহস হ’ত না তাঁদের। পরে অবশ্যই সংবাদ তাঁর কানে গিয়েছিল, তবু ক্রীড়াগৃহে এমন কদর্য কাণ্ড ঘটবে তা তিনি আশঙ্কা করেন নি, নিজের পূজাগৃহেই নিভৃত ইষ্টচিন্তায় রত ছিলেন। এখন এই বিকট রব কানে যেতে, পূর্বাপর সেদিনের ঘটনার বিবরণ শুনে এক ভৃত্যকে দিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে অনুনয় ক’রে পাঠালেন—অবিলম্বে নারী-নির্যাতন-রূপ মহাপাপ থেকে বিরত হতে এবং পাপ দ্যূতক্রীড়া বন্ধ করতে।

সম্ভবত এই ভয়ঙ্কর দুর্লক্ষণে ধৃতরাষ্ট্রও বিচলিত হয়ে থাকবেন। পরের সম্পদে ঐশ্বর্যশালী হওয়ার চিন্তা অপেক্ষা আত্মরক্ষার চিন্তাই তাঁর প্রবল হয়ে উঠেছিল। ভীমের বাহুবল, অর্জুনের শস্ত্রবল—কোনটাই তাঁর অজ্ঞাত নয়। ভীমের উভয় প্রতিজ্ঞাই তাঁর কর্ণগোচর হয়েছে। এই সমস্ত নানা দিক চিন্তা ক’রে তিনি এবার—এতক্ষণে—প্রতিবাদ ক’রে উঠলেন। দুর্যোধনকে কিছু তিরস্কার ক’রে মুষা দ্রৌপদীকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘কল্যাণী, তুমি আমার বধূগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। তোমাকে যারা লাঞ্ছিত করছে সেই মূঢ়দের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। তুমি পূর্ণ মহিমায় স্বপুরে ফিরে যাও। কিন্তু ভাগ্যবতী, তার পূর্বে আমার কাছে কিছু বর প্রার্থনা কর। আমি তোমার প্রসন্নতা যাচঞা করছি।’

দ্রৌপদী তাঁকে প্রণাম ক’রে করজোড়ে বললেন, ‘যদি অনুগ্রহ ক’রে বর দেওয়াই মনস্থ ক’রে থাকেন—আর্যপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে মুক্তি দিন। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র প্রতিবিন্ধ্যকে লোকে দাসপুত্র বলবে, এ চিন্তাই আমার অসহ্য।’

‘অবশ্য, অবশ্য।’ ধৃতরাষ্ট্র যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘তুমি আরও কিছু বর প্রার্থনা কর।’

‘তাহলে আমার অবশিষ্ট চারজন স্বামীকেও মুক্তি দিন। আর কিছু আমার প্রার্থনা নেই।’

‘না না। সে তো বটেই। পাণ্ডবরা শুধু মুক্ত নন, এই বিজিত ধনরত্ন—ক্রীড়ার সকল লভ্যই তাঁদের প্রত্যপর্ণ করলাম। তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে নিরাপদে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রত্যাগমন ক’রে ঐশ্বর্যাদি ভোগ করুন। তাঁদের কল্যাণ হোক, আমি তাঁদের আশীর্বাদ করছি।’

তারপর যুধিষ্ঠিরকে নিজ সামীপ্যে আহ্বান করলেন, ‘পুত্র যুধিষ্ঠির, তুমি আমার সম্মুখে এস।’

যুধিষ্ঠির কাছে এসে দাঁড়াতে—শব্দেই তা অবগত হয়ে—অন্ধরাজা পুনশ্চ বললেন, ‘অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির, তোমার মঙ্গল হোক, তুমি নির্বিঘ্নে স্বীয়পুরে ফিরে যাও। তোমার রাজ্য সম্পদ সবই আমি ফিরিয়ে দিলাম। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, হয়ত বা পুত্রস্নেহে অযথা দুর্বলও—আমার ওপর ক্রোধ কি অভিমান রেখো না। তুমি যে ধর্মপথাবলম্বী হয়ে নীরব ও নম্র ছিলে, ধৈর্য হারিয়ে কটূক্তি করো নি, কি ক্রোধ প্রকাশ করো নি–এতেই বুঝেছি তুমি নিরতিশয় বুদ্ধিমান। যেখানে বুদ্ধি সেখানেই ক্ষমা। তথাপি পুনঃপুনঃ বলছি তুমি শান্তির পথেই থেকো, কদাচ জ্ঞাতিযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ো না। দেখ, পাথরে কাঠুরিয়ার কুঠার প্রবিষ্ট হয় না, কাষ্ঠখণ্ডে অনায়াসেই হয়। যারা শত্রুর বৈরাচরণ মনে না রেখে তাঁদের যা কিছু সৎগুণের কথাই চিন্তা করেন, তাঁরাই উত্তম পুরুষ। বৎস, তুমি দুর্যোধনের নিষ্ঠুরতার কথা মনে স্থান দিও না, বৃদ্ধা গান্ধারী ও উপস্থিত এই অন্ধ পিতার কথা চিন্তা ক’রে তাকে মার্জনা ক’রো। তোমার কল্যাণ হোক, তোমরা সগৌরবে সমস্ত স্বজনসম্পদসহ ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাও।’

কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের কথা শেষ হতে না হতে–কর্ণ যেন মর্মবিদারী ব্যঙ্গের আঘাতে সদ্যআভাসিত শান্তির-পরিবেশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন ক’রে দিলেন।

বলে উঠলেন, ‘অদ্যাবধি অনেক নারীর কাহিনী শুনেছি, কিন্তু আজ দ্রৌপদী যে কীর্তি স্থাপিত করলেন জগতে বোধ করি তার তুলনা নেই। পুরুষ এবং ক্ষত্রিয়, বীর বলে পরিগণিত—তাদের পরিত্রাণ করতে অবলা নারী এগিয়ে এলেন, তিনি ধন্য বৈকি!…পাণ্ডবেরা তরণীভ্রষ্ট হয়ে অগাধ বিপদসাগরে নিমগ্ন হচ্ছিলেন, তাঁদের পত্নীই নৌকাস্বরূপা হয়ে তাঁদের বাঁচিয়ে দিলেন। আপৎকালে পাণ্ডুপুত্ররা সর্বদাই পত্নীকে এগিয়ে দিয়ে নিজেরা পিছিয়ে থাকেন—নিরাপদ ছত্রছায়ায়, এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার।’

লৌহে প্রস্তরাঘাত হলে অগ্নিশিখাই উৎপন্ন হয়। ভীম আবারও অসহ্য ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। বললেন, ‘মহারাজ, আপনি আদেশ দিন, এই সভাস্থ সমুদয় শত্রুকে এখনই নিপাতিত করি। অপমানিতা ভার্যার লাঞ্ছনার প্রতিশোধ না নিয়ে পুত্রদের কাছে মুখ দেখাব কি ক’রে? তারা আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করবে!’

অর্জুন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘নীচ লোকে কত কি কটুবাক্য বলে, যাঁরা ধীমান, উত্তম পুরুষ, তাঁরা কখনও তাতে কর্ণপাত করেন না—বিচলিত হন না। শত্রুরা বৈরাচরণ করলেও বীর প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিগণ তাদের যতদিন সম্ভব মার্জনা করেন। আমরা যথাসময়ে এই অপমানের প্রতিশোধ নেব, আপনি চিন্তা করবেন না। এই কর্ণকে আমি রণাঙ্গনে অবশ্যই বধ করব—আপনি নিশ্চিত জানবেন।’

কর্ণ নিকটে এসে দাঁড়ালেন এবার। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, ভীমের মতো তাঁরও সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন অগ্ন্যুদগীরণ করছিল। তাঁর সেই ভয়াল মূর্তি দেখে সকলেই পথ ছেড়ে দিল।

কর্ণ বিশেষভাবে অর্জুনের সম্মুখবর্তী হয়ে কঠোর শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘এসব শৌর্য এতক্ষণ কোথায় ছিল অর্জুন? প্রিয়তমা ভার্যা যখন সভামধ্যে সহস্র দর্শকের সামনে লাঞ্ছিতা হলেন, তোমরা তার শোধ নেবে কোন-এক উত্তরকালে? পিতামাতার মৃত্যু ঘটলে অচিরেই তার সৎকার এবং বিধিমতো শ্রাদ্ধাদি করতে হয় কেউ সুবিধা ও অবসর মতো কোন এক ভবিষ্যৎকালে তা করে না। কুলবধূর সম্মান পিতা-মাতৃগণের সম্মানের মতো সযত্নে রক্ষণীয়। অর্জুন, এককালে আমার একমাত্র উচ্চাশা ছিল, সম্মুখযুদ্ধে তোমাকে পরাজিত করব। এখন মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়াই আমার পক্ষে অপমানকর। তুমি যোদ্ধা? তুমি বীর? তুমি অপরাজেয় ধানুকী? এই বুঝি তার পরিচয়!…হায় কৌন্তেয়, তোমার শৌর্যে ধিক, তোমার বীর্যে ধিক, তোমার শস্ত্রজ্ঞানে ধিক! তোমাকে যিনি রণবিদ্যায় শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই দ্রোণাচার্যকেও ধিক, এক কাপুরুষকে তিনি এই দুর্লভ বিদ্যা দিয়েছেন। ধিক! ধিক!’

২৭

কর্ণের এই স্বভাববিরুদ্ধ রূঢ় আচরণের অর্থটাই সেদিন বুঝতে পারেন নি দ্রৌপদী। সেদিন কেন—আজও ওঁর কাছে এটা দুয়ে, দুর্বোধ্য, দুরবগম্য হয়ে আছে—তাঁর এই অকারণ উত্তাপ ও তিক্ততার কারণটা সকল দুঃখের সকল কর্মের মধ্যেও এই রহস্যটা অস্বস্তি সঞ্চার করে ওঁর অন্তরে এমন কি সুদীর্ঘ বনবাসের নির্জন, লোভ-ক্রোধ-অসূয়াহীন শান্ত পরিবেশ ও মনস্তাপহরণকারী প্রাকৃতিক শোভার মধ্যেও সেটা ভুলতে পারেন না। এই প্রশ্নটা ওঁর তীব্র ক্ষোভ অভিমান ও দুঃসহ বেদনার যেন স্থায়ী সঙ্গী হয়ে আছে মনে।

হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের বনবাসেই যেতে হয়েছিল।

দ্বাদশ বৎসরের জন্য মৃগচর্ম ধারণ ক’রে বনবাস ও আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস।

শর্ত—এই শেষ বৎসরটি কোন জনপদেই অতিবাহিত করতে হবে, জনসমাজের মধ্যে, অথচ কেউ তাঁদের সত্য পরিচয় জানবে না। অন্তত এঁরা—কৌরবপক্ষের কোন লোক জানতে পারবেন না। এই এক বৎসর কালের মধ্যে পরিচয় প্রকাশ পেলে আরও দ্বাদশ বৎসর বনে অতিবাহিত করতে হবে পাণ্ডবদের।

কর্ণ কিছু মিথ্যা বলেন নি–দ্যূতক্রীড়ার প্রথম পর্বে পাণ্ডবরা বস্তুত দ্রৌপদীর কল্যাণেই পরিত্রাণ পেয়ে গেলেন। অথবা বলা উচিত, দ্রৌপদীর অকথ্য অকল্পনীয় লাঞ্ছনার মূল্যে নিজেদের মুক্তি ও হৃত আর্থিকসম্পদ ক্রয় করলেন। কিন্তু সে স্বাধীনতা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ পর্যন্তও পৌঁছতে পারলেন না পাণ্ডবরা, তার পূর্বেই পুনশ্চ হস্তিনাপুরীর অশুভ আহ্বান এসে পৌঁছল। ।

আবারও অক্ষক্রীড়ার আমন্ত্রণ–পূর্ব-নির্ধারিত, নির্দিষ্ট পণে।

এর পূর্বাপর ইতিহাসও দ্রৌপদী শুনেছেন—বনে আসার পরও তা শুনিয়ে যাবার লোকের অভাব ছিল না।

পাণ্ডবরা সদলবলে স্বপুরী অভিমুখে যাত্রা করতেই দুর্যোধন উদগ্র ক্রোধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। সেই সঙ্গে দুঃশাসনও তাঁর ক্ষোভের বা বিলাপের থেকে ক্রোধই বেশী।

তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। সুদুর্লভ সৌভাগ্য, বহুদিনের ঐকান্তিক আশা ও কামনার বস্তু করায়ত্ত হবার পর যদি পরমুহূর্তেই হস্তচ্যুত হয় তাহলে এ মনোভাবগুলোও স্বাভাবিক। সে পরিতাপে এই প্রকার মনোবৈকল্য, অর্ধোন্মাদ দশা হবে—তাও।

দুঃশাসন তো প্রায় গালিগালাজই করতে লাগলেন পিতাকে, বার বার বলতে লাগলেন, ‘এত কাণ্ড এত আয়োজন এত দুর্নাম সহ্য ক’রে যে শক্তি ও সম্পদ আয়ত্তে এল–তা ঐ এক মতিচ্ছন্ন বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধের জন্যই হারালাম। এই অতুল সম্পদ এতদিন জ্ঞাতিদের সম্পত্তি ছিল, আজ তা উনি শত্রুসাৎ ক’রে দিলেন। কারণ এ ঘটনার পর—ঐ জরাগ্রস্তবুদ্ধি বৃদ্ধ যতই অনুনয় করুন—পাণ্ডবরা আমাদের প্রতি বৈরিতার মনোভাব পরিত্যাগ করবে তা সম্ভব নয়। সে আশা ওঁর মতো পরবুদ্ধি পরিচালিত ভীমরতিপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বা সদ্যোজাত শিশু ব্যতীত আর কেউ করবে না!’

সর্বনাশ আসন্ন হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞানই সর্বপ্রথম বিলুপ্ত হয়। কে তার যথার্থ হিতাকাঙ্ক্ষী কে অনিষ্টকারী তা বুঝতে পারে না। দুর্যোধনও এই কুপরামর্শের প্রধান উদগাতা সৌবলেরই শরণাপন্ন হলেন আবার। প্রায় উদভ্রান্ত ভাবে বললেন, ‘আপনি শীঘ্র কোন উপায় করুন, নচেৎ এর পর আর জীবন ধারণ করার কোন অর্থ থাকবে না। করতে পারবও না, যদি অতঃপর পাণ্ডবরা সুখে-স্বচ্ছন্দে ওখানে রাজত্ব করতে থাকে তাহলে আমাদের বিনষ্টি অনিবার্য । অথবা ওদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে, ওদের সেবা ক’রে বেঁচে থাকতে হবে। সে আমি পারব না।’

শকুনির চিত্ত ও চিন্তা কখনও সুপথ ধরে চলে না। তাঁর প্রতিভা কুবুদ্ধিতেই দীপ্যমান হয়ে ওঠে। আজও নিমেষ মাত্র বিলম্ব ঘটল না কুপরামর্শ দানে। তিনি বললেন, ‘এখন আবার পূর্বের ন্যায় অক্ষক্রীড়ার প্রস্তাবে বৃদ্ধ কিছুতেই সম্মত হবেন না। তার চেয়ে মাত্র একদান খেলার এক প্রস্তাব দাও। একবারই অক্ষপাত হবে, একমাত্র পথ। যে পক্ষ পরাজিত হবে সে সর্বস্ব ত্যাগ ক’রে দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনে যাবে এবং তার পরও এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে থাকবে। ঐ বৎসরকাল মধ্যে তাদের অবস্থান-স্থল জানা গেলে পুনশ্চ দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনে যেতে হবে—এই পণ থাক।’

‘তার পর?’ দুর্যোধন তখনও ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারেন না, ‘যদি আমরা পরাজিত হই?’

‘সে আশঙ্কা ক’রো না। পাণ্ডবরাই পরাজিত হবে। তুমি নিশ্চিত থাকো। আমার প্রাণ পণ রইল। যদি পরাজিত হই –তোমাদের সম্মুখে প্রাণত্যাগ করব।’

দুর্যোধন হৃষ্ট ও নিশ্চিন্ত মনে পিতার কাছে গেলেন।

প্রথমটায়—যা আশঙ্কা করেছিলেন ওঁরা—ধৃতরাষ্ট্র অক্ষক্রীড়া শব্দটি শোনা মাত্র প্রবল আপত্তি ক’রে উঠলেন, ‘না না, অনেক কষ্টে ওদের শান্ত করেছি, অনেক অনুনয়ে, বলবান ব্যক্তিকে বার বার উত্যক্ত ক’রে শত্রুতে পরিণত করা মূর্খের কাজ।’

দুর্যোধন বললেন, ‘মহারাজ, শত্রু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বিষধর সর্পকে কুপিত ক’রে তাকে পদাঘাতে আহত করার পর তাকে বক্ষে ধারণ করলে সে বিষ সম্বরণ করে না, মিত্র হয় না। তাদের প্রতিজ্ঞা আপনি শুনেছেন— এর পর কিছুদিন নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে পেলে আয়োজন সম্পূর্ণ হলে কোন এক সূত্র ধরে আমাদের সঙ্গে ওরা যুদ্ধ বাধাবে—এবং অনায়াসে বিনাশ করবে। সে সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চাই। আপনি আমাদের প্রস্তাবটা শুনুন, —এবার আর ঐ ভাবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেব না—আমি আপনার পাদস্পর্শ ক’রে শপথ করছি। একবারই মাত্র খেলা হবে, একটি পণ রেখে। যে পরাজিত হবে—পাণ্ডবরাই হবে সে বিষয়ে আমাদের সংশয় মাত্র নেই —সে অজিন ধারণ ক’রে নিঃসম্বল অবস্থায় বনে যাবে, এবং তারও পরে এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। যদি এই সময়ে তাদের সন্ধান পাওয়া যায় তো পুনর্বার দ্বাদশ বৎসর বনে থাকতে হবে। পিতা, এই ত্রয়োদশ বৎসরে তাদের এই কুবের-স্বপ্নাতীত ঐশ্বর্য আমাদের হস্তগত হলে আমরা যথেষ্ট শক্তিবৃদ্ধি এবং সৈন্য ও শস্ত্রবৃদ্ধি করতে পারব। ওদের তখন যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য থাকবে না, সে প্রয়াস পেলেও ব্যর্থ হবে। আপনি দয়া ক’রে সম্মতি দিন, রাজলক্ষ্মী আমাদের গলায় মাল্যদান করতে উদ্যত, সে সৌভাগ্য-মাল্য আপনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করবেন না।’

লোভ তো ছিলই, প্রচ্ছন্ন মাৎসর্যও। ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘তা–তাহলে তাই করো। সে ভাল। বোধ হয় এখনও তারা বেশীদূর যেতে পারে নি, দ্রুতগামী অশ্ব দিয়ে কোন বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান দূত প্রেরণ করো—তারা এই প্রস্তাব ও আমন্ত্রণ জানিয়ে পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনুক।’

সে রকম বিশ্বস্ত দূত পূর্বেই প্রস্তুত রেখেছিলেন দুর্যোধন, সে ওঁর দৃষ্টির ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র অশ্বচালনা করল। এবার যথা সময়েই গান্ধারীর কাছে এ-সংবাদ পৌঁছল।

তিনি এসে বেদানার্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, ‘এ কী করলেন মহারাজ, আবার এক ঘোর অনর্থকে আবাহন করলেন! শুনেছি, কোন কোন প্রাণী আছে যারা স্বীয় সন্তানকে ভক্ষণ করে—আপনি মনুষ্য, তদুপরি জ্ঞানবান ও বিচক্ষণ হয়ে সেই আচরণেই প্রবৃত্ত হলেন! মহারাজ, বিদুরই আপনার সর্বাপেক্ষা হিতকামী, অথচ আপনি তার পরামর্শই চিরদিন অবহেলা করেন। আমার আবেদন, আপনি তার উপদেশ শুনুন, দুর্যোধনকে ত্যাগ করুন। ওর জন্মের সময় যখন ভূমিষ্ঠমাত্রই গোমায়ুর মতো রব ক’রে উঠেছিল তখন বুঝেছিলাম এ কুল ধ্বংস করতে জন্মেছে। তখন আমিও আপনাকে— তার মাতা, গর্ভভারকাতরা জননী হয়েও এই অনুরোধ করেছিলাম, আজও অনুনয় করছি— জ্যেষ্ঠ পুত্রকে আপনি ত্যাগ করুন, তাকে বধ করার আদেশ দিন, না হলে কিছুতেই সর্বাত্মক কুলনাশ পরিহার করতে পারবেন না। এই পুত্রকে বাঁচতে দিলে, তার ইচ্ছায় চালিত হলে এ বংশে পিণ্ড দেবার মতো একটি শিশুও জীবিত থাকবে না। এখন সময় আছে, কুরুবংশের মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষা করুন।’

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘রাজ্ঞী, বিধাতা আমায় বহির্দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করেছেন, কিন্তু সে অভাব পূরণ করেছেন অন্তদৃষ্টি প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এ বংশের বিনাশ আসন্ন, অবশ্যম্ভাবী। এরা কোনমতেই রক্ষা পাবে না। নিদ্রিত অবস্থায় বিস্তীর্ণ স্থানব্যাপী মহাশ্মশানের স্বপ্ন দেখি, জাগ্রত অবস্থায় চিতাধূমের গন্ধ পাই, মহাদেবী, এ সর্বনাশের বন্যা রোধ করি, এমন সাধ্য আমার নেই। ওদের বাধা দেওয়া যাবে না। এখন তবু ওরা বাহ্য সম্মান রক্ষা ক’রে আমার সম্মতি নিচ্ছে আমার আদেশ ওদের ইচ্ছার প্রতিকূল হলে আমার মত গ্রহণই বন্ধ করবে। আমি তাদের পিতা বটে—কিন্তু এ রাজ্যের সম্পদ, রাজশক্তি, শাসনব্যবস্থা সবই ওদের করায়ত্ত। আমি ওদের ইচ্ছাকে প্রতিরোধ করব কি উপায়ে? তারা আমার বাক্য অবহেলা ক’রে ইচ্ছামতো কার্য করবে। সে অপমান আমি স্বেচ্ছায় বরণ করতে যাই কেন? তা ব্যতিরেকেও—মহিষী, আমি জানি আমার জ্যেষ্ঠপুত্র অতিশয় পাষণ্ড, তার বিনাশ অনিবার্য ও আসন্ন—আরও সেই জন্যই তাকে ত্যাগ করতে পারব না। এই বিপদকালে তার একমাত্র বন্ধু তার পিতা তাকে ত্যাগ করবে কোন প্রাণে? সে হতভাগ্যের এই শেষ সম্বল পিতৃপ্রশ্রয় থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারব না।’…

এ প্রান্তে দ্রৌপদীও অনুরোধ আবেদন কম করেন নি। তিনি স্বভাবজ স্থৈর্য হারিয়ে ব্যাকুলতাই প্রকাশ করেছিলেন। সাম্প্রতিক দুঃসহ পূর্বস্মৃতি স্মরণ করিয়ে এ অশুভ ঈর্ষাপ্রণোদিত নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে বলেছিলেন, অর্জুনকে অনুনয় করেছিলেন মহারাজ-চক্রবর্তীকে বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করতে। অর্জুনও–অর্জুন কেন সব ভ্ৰাতাই কুটিলতার প্রতিহিংসাজাত অনিষ্টচিন্তা, তৎপ্রসূত উদ্ধারসম্ভাবনাহীন বিপদাশঙ্কার কথা চিন্তা ক’রে তাঁর মত পুনর্বিবেচনা করতে অনুবাধ করেছিলেন—কিন্তু কোন ফল হয় নি। যুধিষ্ঠির অবিচল দৃঢ়তায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এর মধ্যে নূতন ক’রে বিচার-বিবেচনার কোন কারণ নেই। বিধাতার বিধানে জন্মলগ্নেই জাতকের ভাগ্যের শুভাশুভ নির্দিষ্ট হয়। সেই ক্ষণের গ্রহসন্নিবেশের ফলেই প্রাণীগণ সুখ দুঃখ ভোগ করে। যদ্যপি এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানও করি, আমাদের অদৃষ্টলিপি তাতে ব্যর্থ, খণ্ডিত করা যাবে না। এ অবস্থায় পিতৃসম স্থবিরের আদেশ লঙ্ঘন ক’রে অপরাধী হব কেন? সুতরাং পুনশ্চ দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হওয়া ব্যতীত আমার কোন উপায় নেই।’

তারপর কিয়ৎকাল মৌন থেকে—অপরাহ্নের সিন্দূরবর্ণ মেঘের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে দ্রৌপদীকে সম্বোধন ক’রে বলেছিলেন, ‘প্রিয়ে, পাপ ও অনাচার চরমে না পৌঁছলে বোধ করি তার প্রতিবিধান হয় না। যে ধর্মপথে থাকে কিছুদিন হয়ত তাকে দুর্গতি কি দুঃখ ভোগ করতে হয়—পরিশেষে কিন্তু সে-ই জয়ী হয়, স্থায়ী হয়। দ্যাখ, রামচন্দ্রের মতো স্থিতধী প্রাজ্ঞ ব্যক্তিও স্বর্ণমৃগের পশ্চাতে ধাবিত হয়েছিলেন। তিনি কি জানতেন না যে ধাতুনির্মিত কোন জীবের পক্ষে জীবিত প্রাণীর সচলতা সম্ভব নয়? তবু তিনি গিয়েছিলেন—কারণ এই উপলক্ষে অনাচার চরমে না উঠলে রাবণের তপস্যাফল ক্ষয়প্রাপ্ত হত না, আর তা না হলে রক্ষতেজ ধ্বংস ক’রে পৃথিবীতে শান্তি আনয়ন করা যেত না।’

এ আপাতশান্ত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে এঁদের সকলেরই পরিচয় ছিল। এ কাঠিন্যকে কিছুতেই অবদমিত করা যাবে না। সুতরাং আর বৃথা কালক্ষেপ করেন নি, হস্তিনাতেই ফিরে এসেছিলেন আবার। পরিণাম তো পূর্বেই জানা অনুমান নয়, স্থিরনিশ্চয় হয়েই সর্বনাশের দিকে ফিরেছিলেন।

শুধু ভার্যা কি অনুজরা নন, পথের দুদিকে সারিবদ্ধ নাগরিক—সভাস্থ আত্মীয়-কুটুম্বাদি সকলেই এই বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন, পাণ্ডবদের শ্রুতিগোচর ভাবেই আক্ষেপ করেছিলেন, ‘হায় হায়! এমন হিতৈষী কি কেউ নেই যে এঁদের এই মৃত্যুতুল্য দুরবস্থা সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয়! পতঙ্গরা দীপ-শিখার দিকে ছুটে যায় তারা বুদ্ধিহীন, চিন্তাশক্তিহীন বলে। এঁরা তো নির্বোধ কি অবিবেচক নন, তবে কেন এই মহাসর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন?’

যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ হাস্যে হস্তোত্তোলন ক’রে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে—পার্শ্ববর্তী এক আত্মীয়কে বললেন, ‘আমাদের নয়—কৌরবদেরই অমোঘ নিয়তি তাদের এই দুর্বুদ্ধিতে প্ররোচিত করছে। আমরা ওদেরই ভাগ্যচক্রে জড়িত হয়ে পড়ে নিমিত্তমাত্রে পরিণত হয়েছি।’…

এরপর রীতি-নিয়মমতো সর্বজনসমক্ষে পণের শর্ত জানিয়ে ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হওয়া এবং পরাজিত হওয়া তো মাত্র এক দণ্ডের ব্যাপার। একবার মাত্র খেলা, একবার মাত্র অক্ষপাত—এক পলক সময়—শকুনি এদের যথাসর্বস্ব এবং পরমায়ুর ত্রয়োদশ বৎসর জিতে নিলেন।

এও পূর্ব-অনুমিত—সুতরাং এদের পরিতাপ বিলাপ কি বিক্ষোভ প্রকাশের কোন নতুন কারণ ছিল না। তা এঁরা করলেনও না। অবনত মস্তকে ভাগ্যের এই ছলনা মেনে নিলেন, নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু কৌরবপক্ষের হর্ষোল্লাস সমস্ত শোভনতার সীমা অতিক্রম করল। ঈর্ষার কুৎসিত দংষ্ট্রা বিকশিত ক’রে নীচ মনের কদর্যতম রূপ প্রকাশিত হ’ল। সে প্রেততাণ্ডবে সভাস্থ প্রবীণগণ মস্তক নত করতে বাধ্য হলেন, অনেকে সভা ত্যাগ ক’রে এই ঘৃণ্য পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দায় থেকে অব্যাহতি পেলেন।

সর্বাপেক্ষা কলঙ্কজনক আচরণ করলেন দুঃশাসনই। এঁদের শ্রবণে কোন বাধা না থাকে এতাদৃশ উচ্চস্বরে পরিষদ ও বয়স্যদের সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘এইবার ধর্মপ্রাণ মহাত্মা দুর্যোধনের সাম্রাজ্য আরদ্ধ হল। কুরুবংশের ব্রণসদৃশ পাণ্ডুপুত্ররা তাদের যথাযোগ্য বিপত্তি লাভ ক’রে উপযুক্ত স্থানে গমন করছে। শত্রুগণ অপেক্ষা যে আমরা সর্ব বিষয়েই শ্রেষ্ঠ তা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয়েছে বিজয়লক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মী আমাদের গলেই মাল্যার্পণ করেছেন।… ওরা দৈবাৎ অপরিমিত ধন পেয়ে অহঙ্কারে স্ফীত হচ্ছিল, আমাদের হাস্যাস্পদ ক’রে পরিহাসের পাত্র করে—পরিহাস ক’রে তৃপ্তিলাভ করছিল। হায়! আজ তাদেরই অবনত বদনে অজিন-উত্তরীয় ধারণ ক’রে বনবাসে যেতে হচ্ছে। এই যথার্থ বিধাতার সুবিচার।…এই, কে আছিস, ওদের কিরীট উষ্ণীষ অলঙ্কার খুলে নে, রুরু-চর্মের-পরিধেয়র সঙ্গে ওসব শোভা পায় না। লোকে দেখলে আমাদেরই রুচির নিন্দা করবে।’

তার পর কর্ণের দিকে চেয়ে—যেন সমর্থনের আশায়—একটি চক্ষু অর্ধমুদিত ক’রে কৌতুকের ভঙ্গীতে বললেন ‘ওদের ধারণা ছিল ওদের মতো পুরুষ আর কেউ নেই। সে আত্মশ্লাঘার উপযুক্ত ফলই পেয়েছে। দ্যাখ, দ্যাখ—ভাল ক’রে চেয়ে দ্যাখ, দুই চক্ষু তৃপ্ত হোক। তপস্বীদের মতো অজিন ধারণ করলে কী হবে, ওদের যা চেহারা, অদীক্ষিত অনার্যদের মতোই দেখাচ্ছে না? কী দেখে যে রাজা দ্রুপদ এদের কন্যাদান করেছিলেন! যাজ্ঞসেনী, এই নিঃসম্বল, নিঃসহায়, গৃহহীন সামান্য অজিনাবৃত—সবদিক দিয়েই অযোগ্য পতিদের সঙ্গে তোমাকেও বনবাসে যেতে হচ্ছে দেখে আমি ক্লেশ অনুভব করছি। তুমি বরং এক কাজ করো, দীর্ঘকাল তো ঐ ক্লীবগুলোর সেবা করলে—এখন এই বীর্যবান ঐশ্বর্যসম্পন্ন কৌরবদের মধ্য থেকে মনোমত কাউকে পতি নির্বাচন করো, তুমি সুখে ও নির্বিঘ্নে থাকতে পারবে। ভেবে দ্যাখ—শস্যহীন তিল, চর্মমাত্রসার মৃগ ও তণ্ডুলহীন ধান যেমন—পাণ্ডবরাও আজ তেমনি অন্তঃসারশূন্য পুরুষে পরিণত হয়েছে, তাদের অনুগমন করা একান্ত নির্বোধের কাজ হবে।

ভীমসেন আর সহ্য করতে পারলেন না। দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ ক’রে এগিয়ে এসে দুঃশাসনকে বললেন, ‘মুর্খ—এই শকুনিটার জোরে কপটদ্যূতে জয়লাভ ক’রে তোর এত উল্লাস! ধর্মবদ্ধ বলে এখনই এর সমুচিত প্রতিফল দিতে পারলাম না। তবে তার অধিক বিলম্বও নেই। ত্রয়োদশ বর্ষ মানুষের জীবনে এমন কিছু দীর্ঘকাল নয়, তা একদিন কেটেই যাবে। তোকে যেদিন সবান্ধবে সসহায়ে নিপাতিত ক’রে মর্মস্থল ছিন্ন ক’রে তোর রক্তপান করব সেদিনই এই অপমানের যোগ্য প্রত্যুত্তর পাবি!’

দুঃশাসন বর্তমান স্বার্থসিদ্ধির উল্লাসেই মত্ত, অপ্রীতিকর ভবিষ্যৎ চিন্তায় এ আনন্দ নষ্ট করবার পাত্র নন, ‘চুপ কর গরু! গরু গরু! তুই গরু!’ বলে দুই বাহু ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত ক’রে নৃত্য করতে লাগলেন।

কর্ণ এতক্ষণ নির্নিমেষ নেত্রে বিচিত্র দৃষ্টিতে পাঞ্চালীর দিকে চেয়েছিলেন, এখন এই কর্কশ ধ্বনি কানে যেতে দুঃশাসনের দিকে তাকিয়ে তাকে ঐ ভাবে সুরামত্ত নিষাদের মতো নৃত্যরত দেখে যেন ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

কিন্তু শুধু দুঃশাসনই নন, দুর্যোধনও—বহুদিনের আশা, দুরাশাই বলা উচিত—অভাবনীয় ভাবে পূর্ণ হবার তৃপ্তিতে যেন জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন। রাজবংশের মর্যাদা, আভিজাত্যের রীতি বিস্মৃত হয়ে, ভীমের পাশে পাশে তাঁর মাতঙ্গবৎ গতিভঙ্গির বিকৃত অনুকরণ ক’রে চলতে লাগলেন এবং নিজের এই কুরুচি-পরিচায়ক কৌতুকে নিজেই হেসে সারা হলেন।

ভীম রোষে অরুণবর্ণ ধারণ ক’রে আরক্ত লোচনে কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘যদি যুদ্ধ হয় তবে দেবতারা সাক্ষী থাকুন— এই পাপাত্মা দুর্যোধনকে গদাঘাতে নিপাতিত ক’রে সর্বজনসমক্ষে এই মস্তকে দুই পদ রক্ষা করব। ‘

অর্জুন তাঁর বাহুমূল ধরে আকর্ষণ ক’রে বললেন, ‘ছিঃ! যথার্থ যাঁরা বীর, মুখে আস্ফালন করা তাঁদের শোভা পায় না। এই পণের ত্রয়োদশ বৎসর অতীত হলে যা ঘটবে তা মানবসমাজ প্রত্যক্ষই করবেন, ইতিহাসে লিখিত থাকবে। আপনার নিয়োগানুসারে আমি এই অসূয়াপরবশ অকারণ-বিদ্বেষী কটুভাষী কর্ণকে বধ করব। আপনি দুর্যোধন ও দুঃশাসনের রাক্ষসোচিত ব্যবহারের প্রতিফল দেবেন। এই পর-অনিষ্টবিলাসী ধূর্ত সৌবল, এদের অনুগামী—কেউ রক্ষা পাবে না। যদি কেউ আমাদের সহায় নাও হন, আমরা এই পাঁচ ভাই-ই যথেষ্ট—আজকের এ ঘটনার প্রতিশোধ নেবই। যদি হিমাচল ধূলিতে পরিণত হয়, সূর্য প্রভাশূন্য এবং চন্দ্র শৈত্যবিরহিত হয়—তথাপি আমার এ বাক্য নিষ্ফল হবে না।‘

এসব কোন কথাই যুধিষ্ঠিরের কর্ণগোচর হয়েছে বলে মনে হ’ল না।

তিনি ধীরে ধীরে মহিমান্বিত ভঙ্গিতে অগ্রসর হয়ে ধৃতরাষ্ট্রর আসনসম্মুখে পৌঁছলেন। করজোড়ে বললেন, ‘আমি ভরতবংশীয় সকলেরই যথাযোগ্য সম্মাননা ক’রে বিদায় প্রার্থনা করছি। পিতামহ, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, অন্যান্য নৃপতি সকল, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, তদীয় পুত্রগণ, সঞ্জয় প্রভৃতি সভাসদগণ সকলে প্রসন্ন মনে আমাদের বিদায় দিন। বিধাতার ইচ্ছা হ’লে ত্রয়োদশ বৎসর পরে আবার আপনাদের কাছে এসে নমস্কার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাব।’

কিন্তু যাঁদের কাছে এই প্রার্থনা তাঁরা একটি উত্তরও দিতে পারলেন না, লজ্জাবনত শিরে স্থির হয়ে বসে রইলেন, এমন কি যাঁর চক্ষুলজ্জার কোন কারণ নেই—সেই জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও মস্তক অবনত করলেন। শুধু বিদুরই প্রসারিত হস্তে আশীর্বাদ ও আশ্বাসের মুদ্রা ক’রে বললেন, ‘বৎস, আর্যা কুন্তী বৃদ্ধা, চিরদিন সুখসেবিতা, অরণ্যবাসের কষ্ট তাঁর সহ্য হবে না। তাঁকে আমার কাছে রেখে যাও। আমি তাঁর যথাসাধ্য পরিচর্যা করব, তিনি আমার ভবনে পর্যাপ্ত সুখে না হোক, স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন।’

‘যে আজ্ঞা’, বলে যুধিষ্ঠির তাঁর বাক্যে সম্মান জ্ঞাপন ক’রে বললেন, ‘ক্ষত্তা, চিরদিন আপৎকালে আপনি আমাদের যথাযথ উপদেশ ও সুপরামর্শ দিয়েছেন। বস্তুত আপনি আমাদের পুত্রতুল্য জ্ঞানে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছেন। এখনও আপনার আশীর্বাদ ও উপদেশই আমাদের পাথেয় হবে—এই আশাই করি।’

বিদুর বললেন, ‘বৎস, অধর্ম দ্বারা পরাজিত হলে সে পরাভবের জন্য ক্ষুব্ধ, লজ্জিত বা ব্যথিত হবার কোন কারণ থাকে না। তোমরা পাঁচ ভাই, পুরোহিত ধৌম্য ও বধূ দ্রৌপদী—তোমরা অশেষ গুণসম্পন্ন ও পরস্পরের প্রিয়কারী— তোমরা একত্র থাকলে তোমাদের বিশেষ অনিষ্ট কেউ করতে পারবে না। তুমি বুদ্ধিমান, তুমি ইন্দ্রের নিকট হতে বিজয় লাভের শক্তি, যমের ক্রোধ সম্বরণ ক্ষমতা, কুবেরের দানে আগ্রহ এবং বরুণের নিকট হতে সংযমের আদর্শ গ্রহণ করো। তোমরা জ্ঞানত কোন পাপ করো নি, সুতরাং তোমরা কৃতার্থ ও কল্যাণযুক্ত হয়ে পুনরায় শুভাগমন করবে এ- সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।’

সভাগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পাণ্ডবরা বিদুরের গৃহেই গেলেন—মাতা কুন্তীর পাদবন্দনা ক’রে বিদায় প্রার্থনা করতে। দেবী পৃথা ওঁদের দেখা মাত্র উচ্চরোলে কেঁদে উঠলেন, ‘অশেষ গুণশালিনী কর্তব্যপরায়ণা পুণ্যবতী পাঞ্চালীর এই বেশ ও দুর্দশা দেখার আগে আমার মৃত্যু হ’ল না কেন! তোমাদের পিতা আজ জীবিত থাকলে এর শোধ নিতে পারতেন। ভগ্নী মাদ্রী ভাগ্যবতী, এই সব দৃশ্য তাঁকে দেখতে হ’ল না।… পুত্র সহদেব আমার পঞ্জরাস্থি অপেক্ষা আপন, নিকট ও প্রিয়—তাকে ছেড়ে আমি কেমন করে থাকব? আমাকেও তোমরা বনে নিয়ে চলো, তোমাদের কাছে থাকলে কোন ক্লেশই আমাকে পীড়িত করতে পারবে না। ‘

পাণ্ডবরা বহু কষ্টে তাঁকে শান্ত ও নিরস্ত করলে তিনি দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন ও শিরচুম্বন ক’রে বললেন, ‘সাবধানে থেকো। আমি জানি আমার পুত্ররা তোমাকে যতদূর সম্ভব কষ্ট, অসম্মান ও বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তুমি স্বামীদের অনুবর্তিনী হচ্ছ–তোমার এ যশোগৌরব দীর্ঘকাল পর্যন্ত অপর নারীদের কাছে ঈর্ষার বস্তু হয়ে থাকবে। কন্যা, আমার সকল পুত্রকেই তোমার হস্তে অর্পণ করলাম, কিন্তু তবু অনুরোধ—সহদেব সম্বন্ধে একটু বিশেষ সচেতন থেকো। সে চিরদিন আমার স্নেহে ও প্রশ্রয়ে আবরিত, তা থেকে বঞ্চিত হয়ে মনঃপীড়া ভোগ করবে।’

অতঃপর দ্রৌপদী গেলেন কুরুকুলবধূদের কাছে বিদায় গ্রহণ করতে।

দ্যূতক্রীড়ার শোচনীয় পরিণাম প্রত্যক্ষ করা পর্যন্ত তাঁদের লজ্জা ও পরিতাপের অবধি ছিল না। এই অবস্থা দেখে তাঁরা সরবে রোদন করতে লাগলেন। সকলে সাশ্রুনেত্রে বার বার স্বামীদের হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। যাঁরা একদিন পূর্বেও ওঁর সম্বন্ধে ঘোরতর ঈর্ষিত ও বিদ্বিষ্ট ছিলেন—তাঁরাই এখন পাণ্ডবমহিষীর এই দুর্দশায় অসম্মানে লজ্জাবনত, অনুতপ্ত। এমন কি ভানুমতীও নতবদনে এসে ওঁর দুটি হাত ধরে বললেন, ‘তুমি আমাদের মুখ চেয়ে ওদের এই অমার্জনীয় বর্বর আচরণ, এই দুস্কৃতি ক্ষমা করো। তুমি নারী—নারীদের ব্যথা বুঝবে। তোমার প্রতিটি বিন্দু অশ্রু এদের মহাপতনের এক একটি সোপান রচনা করেছে। তুমি ক্ষমা না করলে আমাদের মহাসর্বনাশ হবে। আমাদের জন্য না হোক, আমাদের পুত্রকন্যার মুখ চেয়েও অন্তত এদের মার্জনা করো।’

এঁদের এই অনুনয় ও অনুতাপে দ্রৌপদীর চক্ষু দুটিও বাষ্পার্দ্র হয়ে উঠল। তিনি করুণ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘ভগ্নী, আমার সে চোখের জল আর তো চোখে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। সম্ভব হলে তোমাদের মুখ চেয়েও হয়ত তা নিতাম। তার সব কটি বিন্দুই যে ধর্মের চরণে নিবেদিত, তাঁরই বিচারশালার ভাণ্ডারে রক্ষিত। এখন তাঁর যা অভিপ্রায় তাই হবে। তবে যদি কৌরবদের এখনও চৈতন্য হয়—তাঁরা অনুতপ্ত হয়ে এখনও সুবিচার করেন—তা হলে, আমার মনে হয় ধর্মের ধর্মাধিকরণে তাঁদের মুক্তিলাভ একেবারে অসম্ভব হবে না। ‘

পাণ্ডবরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে শুধু যে ধৃতরাষ্ট্রের অন্তঃপুরেই শোক-ক্রন্দনরোল উঠল তাই নয়—হস্তিনাপুরের রাজপথের দুদিকে সমাগত প্রজাদের বিলাপ, পাণ্ডুপুত্রদের বনগমন স্থগিত রাখার জন্য অনুনয় এবং ধৃতরাষ্ট্রদের প্রতি অভিসম্পাতের ধ্বনিও সুদূর প্রাসাদাভ্যন্তরের নিভৃত কক্ষে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কানে পৌঁছে তাঁকে উদ্বিগ্ন ও আশঙ্কার্ত ক’রে তুলল।

তিনি অসহায়ভাবে নিজে নিজেই কিছুক্ষণ বিলাপ করার পর তাঁর একান্ত সচিব ও পার্শ্বচর সঞ্জয়কে দিয়ে বিদুরকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে ব্যস্ত ও ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পাণ্ডবরা কি পুরীর বাইরে চলে গেছে? তাদের কি খুব কাতর দেখলে? কী ভাবে তারা গেল—আমার কাছে একটু বর্ণনা কর। আমি জানি আমার পুরীতে অনয় আসন্ন। আমার পাষণ্ড পুত্রদের প্রাণনাশ ও ধননাশের বিলম্ব নেই।… পাণ্ডবরা—যুধিষ্ঠির এদের অভিসম্পাত করছেন না তো?

‘মহারাজ, মনে হয় আপনি এখনও যুধিষ্ঠিরের সম্যক পরিচয় লাভ করতে পারেন নি। পাছে তাঁর দৃষ্টি অতিশয় বিষণ্ণ কি ক্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং দৈবাৎ সে দৃষ্টি কৌরবদের প্রতি নিপতিত হয়ে তাদের অভিশপ্ত ক’রে তোলে তাই তিনি দুই চক্ষু আবরিত ক’রে নগরের পথ অতিক্রম করছিলেন।’

‘আর? অবশিষ্ট চারজন? আমার বধূমাতা দ্রৌপদী?’ ধৃতরাষ্ট্র কণ্ঠে উদ্বেগ গোপন করতে পারেন না।

‘ওদের মধ্যে ভীম—ত্রয়োদশ বর্ষ অতীত হ’লে স্বীয় ভুজবলে আপনার সন্তানদের দুস্কৃতির প্রতিশোধ নেবেন—যেন তারই ইঙ্গিত স্বরূপ দুই বিশাল লৌহকঠিন বলিষ্ঠ বাহু প্রসারিত ক’রে চলেছেন কল্যাণীয় অর্জুন যুদ্ধের সময় যেভাবে অনর্গল শরবর্ষণ করবেন তারই পূর্বাভাস হিসাবে দুই হাতে বালুকা বিকীরণ করতে করতে যাচ্ছেন নকুল ও সহদেব মুখে মৃত্তিকা লেপন করেছেন—তাঁরা উভয়েই অতিশয় রূপবান, রমণীমনোহর— মনে হয় এ অবস্থায় কোন জনপদবধূ না তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধৈর্যচ্যুত হন—সেই কারণেই এ সতর্কতা।’

ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে উঠলেও তখনই কিছু বলতে পারলেন না। তারপর কিছু ইতস্তত ক’রে বললেন, ‘আমি যেন কিছু পূর্বে একটা ভূকম্পন অনুভব করলাম, মনে হ’ল একটা বজ্রপাতের শব্দও পাওয়া গেল। বিদুর—এ কি সত্য? তুমি কি এরকম কিছু প্রত্যক্ষ করেছ?’

‘হাঁ আর্য। পাণ্ডবরা নগরপ্রাকার অতিক্রম করা মাত্র নগরীর প্রবেশতোরণে বজ্রপাত হ’ল, সেই সঙ্গে প্রবল ভূমিকম্প, তার ফলে স্থানে স্থানে অরণি-ঘর্ষণ ব্যতিরেকেই অকারণে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। তাছাড়া প্রজাদের বিলাপ ও ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে অকস্মাৎ বহু বায়স, গলিত-মাংস-লোভী গৃধ্র ও গোমায়ুর বিকট রব মিলিত হয়ে এক ভয়াবহ কোলাহলের সৃষ্টি করল।’

ধৃতরাষ্ট্র ললাটে করাঘাত ক’রে বললেন, ‘আমি জানি আমার পুত্রদের আর রক্ষা নেই। হায় হায়! অত্যধিক অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও ক্ষমতালোলুপতাই তাদের মহা অনর্থের কারণ হ’ল। কিন্তু আমি কি করব, তারা কেউই আমার বাধ্য নয়। আমিই বা নিজ পুত্রদের ত্যাগ ক’রে কি নিয়ে, কাদের নিয়ে থাকব?’

এই হাহাকার, এই ক্রন্দন কলরোল, এই কর্কশ অমঙ্গল রব কর্ণের প্রাসাদেও পৌঁছেছিল বৈকি! দ্রৌপদী প্রচুর- রুধিরাক্ত বস্ত্রে আলুলায়িত কুন্তলে অশ্রুমোচন করতে করতে যাচ্ছেন দেখার পর কর্ণ যেন কোন বিষাক্ত মর্মভেদী শায়কে বিদ্ধ হয়েছেন—এইভাবে দুইহাতে বক্ষ দমন করে নিজের পুরে এসে অন্ধকার এক কক্ষে প্রবেশ ক’রে অর্গলরুদ্ধ করেছিলেন। তখন থেকে সেই ভাবেই নির্জনে আত্মগোপন ক’রে ছিলেন।

দ্রৌপদীকে ঐভাবে দুঃস্থ অনার্য রমণীর মতো যেতে দেখে পথিপার্শ্বের সমবেত জনতা সরবেই আলোচনা করছিল, ‘এই ভাবেই ত্রয়োদশবর্ষ পরে কৌরবদের ভার্যারা পতিপুত্র-আত্মীয়-বান্ধবদের শোণিত-লিপ্ত ও মুক্তকেশী হয়ে হস্তিনার রাজপথে এমনি উন্মাদিনীবৎ পরিভ্রমণ করবে—এ আমরা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।’ আরও সেই কথাগুলো গলিত সীসার মতো কর্ণে প্রবেশ ক’রে তীব্র এক যন্ত্রণার কারণ ঘটিয়েছে অঙ্গাধিপতির।

কিন্তু হাহাকার, বিলাপ ও অমঙ্গলসূচক শব্দের যেন বিরাম নেই। শেষে কর্ণ যেন আর স্থির থাকতে না পেরে উদভ্রান্তের মতো নিজের প্রাসাদ থেকে নির্গত হয়ে পদব্রজেই দুঃশাসনের গৃহে পৌঁছলেন। দুঃশাসনও তখন কিছু ম্রিয়মাণ অবস্থায় একটি জনহীন সেবকহীন কক্ষে বসে ছিলেন। কিছু পূর্বের সেই উন্মত্ত আনন্দ, সে জয়গর্বের কোন উল্লাস যেন অবশিষ্ট নেই—তাঁর সুরাবিকৃত মস্তিষ্কেও এই অমঙ্গল-চিহ্ন ও প্রজাদের খেদোক্তি কিছুটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

কর্ণকে দেখে বোধ হ’ল তিনি মনে কিছু বল পেলেন। অর্ধশয়ান অবস্থা থেকে ঋজু হয়ে উঠে সম্মুখের পর্যঙ্ক দেখিয়ে বললেন, ‘এসো এসো অঙ্গরাজ। তোমার কথাই চিন্তা করছিলাম।’

কর্ণ কিন্তু এসব সামাজিকতা ও সৌজন্যের ধার দিয়েই গেলেন না। অকারণ ও আকস্মিক ক্রদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা কি চিরদিন দুর্যোধনের কিঙ্করের মতো কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর আদেশ ও অভিপ্রায়ের অপেক্ষায় থাকব? আমাদের কি স্বাধীন ভাবে কিছুই করার অধিকার নেই? এমন কি তাঁর হিত–বা প্রিয়কার্যও না?… চল, তাঁকে না জানিয়েই আমরা কয়েকজন এখনও পাণ্ডবদের পশ্চাদ্ধাবন করি। তারা অসতর্ক, অ-প্রস্তুত এবং নিরতিশয় ক্লান্ত ও অবসন্ন। এ অবস্থায় তারা কোনক্রমেই আমাদের মিলিত প্রচণ্ড আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে না, আমরা অনায়াসে তাদের নিহত করতে পারব। শত্রুকে পুষ্ট হতে দিয়ে বল সংগ্রহ করতে দেওয়া নির্বোধের কাজ। …এখনই প্রকৃষ্ট সুযোগ— দুর্যোধনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তার বিষবৃক্ষ নির্মূল করার। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’লে বন্ধু দুর্যোধন নিশ্চিন্ত হয়ে রাজ্যভোগ করার ও মনোমত শাসন করার অবসর পাবেন, আমাদের প্রতি বিরক্ত না হয়ে ধন্যবাদই দেবেন।

দুঃশাসনের মত্ততা অপনীত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্তি ও বিমর্ষতা দেখা দিয়েছে। কর্ণকে দেখে যেটুকু উৎসাহ বোধ করেছিলেন সেটুকুও অন্তর্হিত হয়ে তিনি আবার যেন অবসন্ন বোধ করলেন। পূর্ববৎ উপাধানে দেহ এলিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘না অঙ্গাধিপতি, ওদের আমি চিনি, আজন্ম দেখছি। একই বৃক্ষের দুই শাখায় আমাদের জন্ম তা ভুলে যেও না। যতই দুর্বল ক্লিন্ন ও ক্লিষ্ট হোক—যতই অতর্কিতে আক্রমণ করি না কেন—ওদের পরাজিত করা অত সহজ হবে না। আমরা যদি চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হই, সকলের উপহাসাস্পদ হব, দুর্যোধন রুষ্ট হবেন,–এবং যদি নিহত হই, অসহায় হয়ে পড়বেন। শুনলাম কিছু পূর্বে স্বয়ং পিতামহ ব্যাসদেব এসে পিতৃদেবকে ভবিষ্যৎ অমঙ্গলের এক ভয়াবহ বিবরণ শুনিয়ে গেছেন। সে চিত্র মানসপটে অঙ্কিত হওয়াতেও বিলম্ব ঘটে নি। পিতা অস্থির হয়ে উঠেছেন, আমাদের গালাগালি করেছেন। এখন আর এসব হঠকারিতার প্রয়োজন নেই। আপনি শান্ত হোন, একটু বিশ্রাম করুন।

‘শান্ত!’ বিচিত্র ভাবে হাসলেন কর্ণ, প্রদীপের স্বল্পালোকেও তা দেখে দুঃশাসন শিউরে উঠলেন সে হাসি অশ্রুর থেকেও করুণ বললেন, ‘বিশ্রাম একেবারেই করব দুঃশাসন, রণক্ষেত্রে মৃত্যুর ক্রোড়ে। আর তখনই—তার হিমশীতল স্পর্শে—শান্ত হব। তার আগে ও দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচয়ের কোন সম্ভাবনা নেই।’

২৮

দুঃখ-ক্ষোভ-ভারাক্রান্ত পাণ্ডবদের পদব্রজে হস্তিনাপুরীর সীমান্ত অতিক্রম করতে কিছু সময় লেগেছিল, শারীরিক ক্লান্তিও কম বাধা নয়। বিশেষ দ্রৌপদী, কিয়দ্দূর যাবার পরই তাঁর পদযুগল ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার পর যে অভাবনীয় কাণ্ড হ’ল তাতে সে ক্লান্তি ক্ষোভ সমস্ত মুছে গিয়ে একটিই মাত্র মনোভাব তাঁদের আচ্ছন্ন অভিভূত ক’রে রাখল—তা হ’ল বিস্ময়। শুধুই বিস্ময়! আরও বিস্ময়! এমন কি দ্রৌপদী সেই অপরিণাম দুঃখ ও সহস্র ক্ষোভের মধ্যেও কিছুটা তৃপ্তিলাভ করলেন।

মহিমাম্বিত ব্যক্তির পতনেও কিছু মহিমা ও মর্যাদা প্রকাশ পায়। ছিন্নমূল বনস্পতি যখন ভূপাতিত হয়, কিংবা প্রচণ্ড ঝঞ্ঝায় উৎপাটিত হয়ে পড়ে যায়—তখন বহুদূরবিস্তৃত ভূখণ্ড সে গুরুভার পতনের বেগ-তরঙ্গ অনুভব করে, বহুদূর পর্যন্ত জনপদ তজ্জনিত আলোড়ন ও প্রচণ্ড শব্দে সচকিত হয়। পাণ্ডবরা দীন বেশে লাঞ্ছিত বিতাড়িত ভিক্ষুকের মতো বনগমন করুক—দুর্যোধন ঈর্ষাবীজনির্গত এই অভিপ্রায়-তরুতেই নীচ-কৌশলবারি সিঞ্চন করেছেন, তাঁরা ওঁদের সেই দৈন্যদশা ও অসহায়তা দেখে ব্যঙ্গ-উপহাস ক’রে আনন্দ উপভোগ করবেন এই আশায়। এই জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, নগর-প্রাকার পর্যন্ত সংবাদ-সংগ্রাহক পাঠিয়েছিলেন সেই উপভোগ্য দুর্দশার বিবরণ প্রত্যাশায়। কিন্তু সে ব্যক্তি যে সংবাদ আনয়ন করল তাতে তৃপ্ত হতে পারলেন না—সদ্যদ্যূতযুদ্ধবিজয়ী স্বয়ংঘোষিত নূতন সম্রাট।

পাণ্ডবদের এই ভাগ্য বিপর্যয়ের সংবাদ ব্যাপ্ত হতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল। কিন্তু ওঁদেরও—গুরুজন জ্ঞাতিদের কাছে বিদায় নিয়ে, শুভার্থীদের সান্ত্বনা দিয়ে প্রাসাদ থেকে নির্গত হতেও কম সময় লাগে নি। তদুপরি ধীর বিলম্বিত গতিতে নগরতোরণ পর্যন্ত পৌঁছবার মধ্যেই শূদ্র, ক্রীতদাস পর্যন্ত—গৃহস্থ থেকে তাদের সেবকরা—ছুটে এলেন ওঁদের সন্ধানে। সকলেরই এক কথা—’পাণ্ডবরা যেখানে যাবেন আমরাও সেখানেই যাব। ওঁদের ছেড়ে কৌরবদের রাজ্যে কিছুতেই থাকব না আমরা।’

তাঁরা প্রকাশ্যেই অকুতোভয়ে, কৌরব এবং ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর প্রভৃতিকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। তাঁদের মত এই—এ পাপিষ্ঠদের শাসনকালে তাঁদের আচার-ধর্ম-কুল-গো-গৃহ-ধনরত্ন কিছুই নিরাপদ নয়, সুতরাং কোন আগ্রহ বা আসক্তিতে পড়ে থাকবেন তাঁরা?

‘এই দুর্যোধনকে আমরা জানি। সে গুরুদ্বেষী, আচারভ্রষ্ট, সুহৃত্যাগী, অর্থলোভী, গর্বিত, নীচ ও নির্দয়-প্রকৃতি! এ ব্যক্তি রাজা হলে প্রজাদের দুর্গতি অনিবার্য! অতএব এ স্থল ত্যাগ ক’রে জিতেন্দ্রিয় কীর্তিমান, দয়াধর্ম ও আচার-পরায়ণ, সহানুভূতিসম্পন্ন পাণ্ডবদের অনুগমন করাই শ্রেয়। তাঁরা অরণ্যে থাকলে সেই অরণ্যই আমাদের কাছে সুখস্বর্গ হয়ে উঠবে।’

আর যাই হোক—এই বিপুল জনসমাগম আর এদের এই আর্তি—এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পাণ্ডবরা। তাঁরা আবেগাভিভূত হয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠির জোড়-করে বার বার সকলের কাছে অনুরোধ করতে লাগলেন স্ব-স্ব গৃহে প্রত্যাগত হতে। কিন্তু তাঁরা ওঁর বাক্যে কর্ণপাত তো করলেনই না—উপরন্তু সহস্র যুক্তিপ্রয়োগ ও মিনতি করতে লাগলেন—এই অন্যায় দ্যূতক্রীড়াজনিত পণের দাবি উপেক্ষা ক’রে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে রাজশক্তি পরিচালনা করতে। শৌর্যে বা বীর্যে কৌরবরা ওঁদের পরাজিত করতে পারবেন না সেটা তো নিশ্চিত।

জনসাধারণের এই কাকুতি-মিনতিতে দ্রৌপদীর চোখে জল এসে যেতে লাগল বার বার। ওরা তাঁর পায়েও পড়ছে, উচ্চরবে তাঁদের জয়ধ্বনি ও কৌরবদের নিন্দাবাদ করছে। এবং পুনঃ পুনঃ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করছে যে পাণ্ডবরা যদি নিজেদের পুরে ফিরে না যান—ওরাও আর ফিরবে না, তাঁদের সঙ্গে বনেই চলে যাবে।

অসহায় ব্যাকুল যুধিষ্ঠির অনন্যোপায় হয়ে প্রধান সারথি ইন্দ্রসেনকে ইঙ্গিত করলেন। সে পূর্বেই কিছু কিছু পরিজন ও অন্তঃপুরিকাদের নিয়ে কয়েকটি রথে এঁদের অগ্রগমন করেছিল। সে এখন আরও তিনটি রথ উপস্থিত করল। পাণ্ডবভ্রাতারা কোন এক অবসরে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে রথে আরোহণ করলেন। তেজস্বী অশ্ব যেন নিমেষকাল মধ্যে ওঁদের বহন ক’রে বহু দূর গিয়ে পড়ল। পাণ্ডবরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

কিন্তু হায়! এখনও তাঁরা তাঁদের প্রজাসমূহের প্রীতির প্রগাঢ়তা পরিমাপ করতে পারেন নি, তাঁদের অন্তর-বেদনার সম্যক পরিচয় পান নি।

পাণ্ডবরা যাত্রা করেছিলেন অপরাহ্নে। কিছুদূর যাওয়ার পরই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সম্মুখে বিপুলা নদী! সে রাত্রে সবাইকে নিয়ে পার হওয়া দুঃসাধ্য। অগত্যা ওঁরা সেখানেই যাত্রা স্থগিত রেখে নদীতে স্নান করে সারাদিনের অনাহার ও মনোকষ্টের ক্লান্তি কিছুটা অপনোদন করলেন। ইতিমধ্যে এক বিশাল বটবৃক্ষ পাওয়া গিয়েছিল, তারই পত্রছায়ায় রাত্রি অতিবাহিত করা স্থির হ’ল। আহার্যের কোন ব্যবস্থা নেই, আহার্যে প্রবৃত্তিও নেই কারও, অঞ্জলিবদ্ধ নদীজল পান ক’রেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করলেন।

কিন্তু নদীতীরের সে স্থান জনবিরল হলেও জনশূন্য নয়। অরণ্য তো নয়ই। পাণ্ডবদের ভাগ্যবিপর্যয় ও সেখানে অবস্থানের কাহিনী প্রচারিত হতেও বিলম্ব হ’ল না। দেখতে দেখতে বহু সাধু তপস্বী এসে সমবেত হলেন। তাঁরা ওঁদের ভোজন বা শয্যার কোন ব্যবস্থা করতে পারলেন না বটে কিন্তু ওঁদের ঘিরে বেদগান, স্তোত্রপাঠ ও হোম ইত্যাদি ক’রে তাঁরাও সারারাত জেগে রইলেন।

আর ইত্যবসরে—সাধারণ গৃহস্থ বা কৃষক প্রজারা প্রতিনিবৃত্ত হ’লেও বহু ব্রাহ্মণ সারা রাত পথ চলে এসে আবারও পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হলেন।

অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের দুঃখের সঙ্গে দুশ্চিন্তা যোগ হ’ল। যদি সত্যই এতগুলি লোক ওঁদের অনুগামী হন—তাঁদের খাওয়াবেন কি?

পূর্ব রাত্রের সমাগত তপস্বীদের মধ্যে বিখ্যাত শৌনক মুনিও ছিলেন। যুধিষ্ঠিরকে নিরতিশয় উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল দেখে তিনি এসে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন, ‘মহারাজ মানুষের জীবনযাত্রায় সহস্র শোকস্থান ও শত শত ভয়স্থান আছে। এগুলি মূর্খকেই আকুল ও অবসন্ন করে। জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিকে তা কদাচ অবদমিত করতে পারে না। বুদ্ধি হচ্ছেন সর্বদুঃখবিঘাতিনী, সেই অষ্টাঙ্গ বুদ্ধি ও জ্ঞান আপনার মধ্যে অবস্থিত আছেন। আপৎকালে শারীরিক কি মানসিক দুঃখে বিষণ্ণ হওয়া আপনাতে শোভা পায় না। জ্ঞানী ব্যক্তিরা অসন্তোষ ও অভাববোধকে কখনও প্রশ্রয় দেন না। আসক্তি বা প্রিয় বস্তুতে অতিরিক্ত স্পৃহাই মানসিক দুঃখের মূল। আপনি ধর্ম ব্যতীত তাবৎ বস্তুতেই স্পৃহা ত্যাগ করুন—শান্তি লাভ করবেন।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘মুনিবর! আমার নিজের জন্য আমি অর্থ বা বস্তুতে স্পৃহা কি অভাববোধ প্রকাশ করছি না। এই অতিরিক্ত প্রীতিপরায়ণ সহগামীদের জন্যই অর্থ বা সম্পদের কথা চিন্তা করছি। এঁদের আহারের ব্যবস্থা কী হবে?’

শৌনক বললেন, ‘মহারাজ, যে ভাগ্য আপনাকে অকস্মাৎ সর্বরিক্ত নিঃস্ব করেছে, সেই ভাগ্যই এতগুলি অনুগামীকে প্রেরণ করেছে—আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য। অদৃষ্ট প্রবল, মানুষ বিত্ত বা শাস্ত্র দিয়ে তার বিধান খণ্ডন করতে পারে না। সে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারে মাত্র। আপনার এই অপ্রত্যাশিত অতিথিদের সেবার জন্য আপনাদের যথাসাধ্য করুন, সে-ই যথেষ্ট। এঁরা আপনার নিমন্ত্রিত নন, ভোগবিলাস-পরিপূর্ণ প্রাসাদেও বাস করতে আসেন নি। শারীরিক কষ্টের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। ওঁরাও খাদ্য সংগ্রহে উদাসীন থাকবেন না। শুনেছি মনস্বিনী দ্রৌপদী সুগৃহিণী, সংসার-কর্মের সকল দিকেই তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তিনি পরিশ্রমপরায়নাও। মহারাজ, সুগৃহিণীর হস্তে সংসারের দায়িত্ব ন্যস্ত করার সুযোগ পাওয়াই মহা সৌভাগ্যের কথা। আপনি সেই সুদুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। আপনি অকারণেই ব্যস্ত ও চিন্তান্বিত হচ্ছেন। আপনার ভ্রাতাদের উপরই মাংস প্রভৃতি খাদ্য সংগ্রহের ভার অর্পণ করুন, অতিথিদের আনুকূল্য গ্রহণ করতেও কুণ্ঠা বোধ করবেন না—দ্রৌপদী তাঁদের ভোজনের সুব্যবস্থা করবেন, আপনার অরণ্যবাস নিশ্চিত রূপেই নির্বিঘ্ন ও সুযাপিত হবে।’

যুধিষ্ঠির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি ধন্য যে আপনি অযাচিত ভাবে এসে আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। শৌনক পুনশ্চ বললেন, ‘আপনি বনবাস থাকাকালীন প্রত্যহ সূর্যস্তব করবেন। সূর্যই সকল শক্তির আদি কারণ, তিনি আপনাকে এই দুঃসময় উত্তরণের শক্তি দান করবেন।’…

সে রাত্রি অতিক্রান্ত হলে এঁরা প্রত্যুষেই আবার যাত্রা আরম্ভ করলেন। সেখান থেকে পদব্রজে তিন দিনের পথ কাম্যক বন। হিংস্র শ্বাপদ ও বর্বর রাক্ষস-সমান অরণ্যচারী কিছু মানুষ থাকা সত্বেও ওঁরা সেই বনেই অবস্থান শ্রেয় বলে বোধ করলেন। শিকার-যোগ্য পশু অসংখ্য, অর্থাৎ খাদ্যের অভাব হবে না। তা ব্যতীত প্রয়োজন মতো সেখান থেকে আত্মীয় বান্ধব ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। রাজধানীর বার্তা পাওয়াও কঠিন হবে না।

সেই মতো তাঁরা কাম্যক বনেই গিয়ে বসবাস যোগ্য পর্ণকুটিরাদি নির্মাণে ব্রতী হলেন। এ কাজে সমাগত অনুরক্তজনেরা প্রচুর সহায়তা করতে লাগলেন। ভীম ও অর্জুন যতদূর সম্ভব হিংস্র পশু ও হিংস্রতর মানুষ বধ ক’রে অরণ্যকে নিরাপদ ক’রে তুলতে লাগলেন।

এ পর্যন্ত বাসুদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি, তাঁর সংবাদও পান নি এঁরা। মাসাধিককাল পরে অকস্মাৎই একদিন তিনি সদলবলে এসে উপস্থিত হলেন। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ তাঁদের এই দুর্দশার সংবাদ পেয়ে ব্যস্ত ও ব্যাকুল হয়ে সংবাদ নেওয়ার জন্য যাত্রা করছেন—ঠিক তার অব্যবহিত পূর্বে বাসুদেব শাল্ব বধ ক’রে প্রত্যাবৃত্ত হলেন এবং বিশ্রামের চেষ্টা মাত্র না ক’রে তন্মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গ নিলেন। যাদবদের সঙ্গে আরও এসে মিলিত হলেন দ্রৌপদীর পিতৃগৃহের আত্মীয়গণ, শিশুপালের পুত্র চেদীরাজ ধৃষ্টকেতু এবং কেকয় রাজপুত্ররা।

পাণ্ডবদের দুরবস্থার সংবাদ শুনেই ওঁরা এসেছেন, তবু বোধ করি ঠিক এতখানি নিঃস্বতা, সর্বাঙ্গীণ দৈন্য, ও ক্লেশ- ভোগের দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সকলেই ক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন ।

কিন্তু সর্বাধিক উত্তেজিত দেখা গেল বাসুদেবকে। তিনি প্রচণ্ড রুষ্ট হয়ে যেন তৎক্ষণেই সর্বলোক দগ্ধ ও ধ্বংস করবেন—এইরূপ বোধ হতে লাগল। বললেন, ‘রণভূমি দুরাত্মা দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ ও শকুনির শোণিত-সিক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। অনাবশ্যক বিলম্বে প্রয়োজনই-বা কি? চল আমরা এখনই যুদ্ধযাত্রা ক’রে ওদের সবংশে সপরিজনে নিহত করি। পাণ্ডবদের তাদের স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করি।’

বলদেব প্রভৃতি যাদবরা তো প্রস্তুতই, তবু তাঁর সেই কালানল-সন্নিভ ক্রোধবহ্নি প্রজ্বলিত দেখে একটু ভীতও হলেন নিদারুণ ভীত বোধ করতে লাগলেন অন্যান্য ব্যক্তিরা।

অর্জুন তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা ক’রে বললেন, ‘বাসুদেব, আমরা পণে বদ্ধ—এখন যুদ্ধযাত্রা করলে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পাপ হবে, প্রজাদের চোখে আমরা লুব্ধ ও সেই কারণে হেয় প্রতিপন্ন হব। বিশেষ আর্য যুধিষ্ঠির মিথ্যাচারী বলে গণ্য হবেন। যুধিষ্ঠির তা কদাচ সহ্য করবেন না। এ কার্য সম্ভব হলে আমরা তন্মুহূর্তেই ঐ পাপিষ্ঠদের বধ করতাম।এই আয়ুক্ষয়কারী মনোক্ষোভ সহ্য করার কোন কারণ থাকত না। তুমি শান্ত হও, তুমি সর্বশক্তিমান, তুমি ক্রদ্ধ হলে জগৎ- সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে।’

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘অর্জুন, তুমি আর আমি অভিন্নাত্মা। যুগযুগান্তর ধরে, জন্মজন্মান্তরে আমরা বন্ধু ও আত্মীয়। তোমার কেউ কোন অনিষ্ট বা ক্ষতি করলে সে ক্ষতি আমারই করা হয়। ওদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হতে পারব না।’

অর্জুন বললেন, ‘কাল মনের মতোই প্রায় দ্রুতগামী, ত্রয়োদশ বর্ষ অতিবাহিত করা এমন কিছু কঠিন বা দুঃসাধ্য হবে না। তারপর তুমি ও আমি এই সমস্ত দুঃখের শোধ নেব। তুমি ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাক, আমি মিনতি করছি।’

যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ বদনে বললেন, ‘বাসুদেব, তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়া পর্যন্ত বিপদে সম্পদে তোমার উপদেশ পেয়ে আসছি। কখনও তোমার পরামর্শ উপেক্ষা করি নি। কিন্তু ভাগ্য এমনই বিরূপ যে এই ঘোর দুর্দিনে তোমার উপদেশ নির্দেশ থেকে বঞ্চিত হলাম। কোন রূপেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা গেল না। আমি বায়ুগতি অশ্ব প্রেরণ করেছিলাম, সে বহু চেষ্টা ক’রেও তোমার অবস্থিতি-স্থান অবগত হতে পারল না। এতেই বোধ করছি আমাদের এ দুঃখভোগ নিতান্তই অবধারিত অদৃষ্টলিপি।’

শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁর অভ্যস্ত অপূর্ব শব্দজাল-রচনা ও বর্ণনাকৌশলে তাঁর অনুপস্থিতির (একরূপ অজ্ঞাতবাসই বলা চলে) কারণ বিস্তার করলেন। শাল্ব যে কী পরিমাণ পাপাচারী ভ্রূর ও নিষ্ঠুর, অকারণেই শত্রুতাবদ্ধ বাসুদেবের ইন্দ্রপ্রস্থ অবস্থানকালে কীভাবে দ্বারকার উৎসাদন, পুরবাসীদের নিগ্রহ এবং অন্তঃপুরিকাদের অবমাননা করেছে, তার বর্বর সৈন্যদল বালিকা-বয়স্কা নির্বিশেষে সম্ভ্রান্ত যাদব নারীদের সতীত্বনাশ ও তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করেছে—তার বাস্তব দৃশ্যমান বিবরণ দিয়ে বললেন, ‘সে দানব বা পিশাচবৎ আচরণ ও দুরাচারের প্রতিফল না দেওয়া পর্যন্ত আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন বা বিশ্রাম করব না এই প্রতিজ্ঞা ক’রেই দ্বারাবতী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলাম। অপর কোন যোদ্ধা বা শূর হলে আমার বিলম্ব হত না–কিন্তু শাল্ব মায়াবী, কূটকৌশলী, শৌর্য বা যুদ্ধরীতিতে অবিশ্বাসী, উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য কোনো অনাচার বা ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বনেই দ্বিধাবোধ করে না। সে দক্ষ যান্ত্রিকও, সে এমন এক নভোচর যান নির্মাণ করেছিল —ভূমিতলে এমন কি জলেও যার অবাধ গতি। তার সৈন্যদের নিগৃহীত বা পরাজিত করা কঠিন হয় নি কিন্তু সে দুরাত্মাকে বধ করতে আমার বহু কালক্ষয় হয়েছে। সে নানাবিধ মায়া বিস্তার ক’রে আমাকে বহু দূরে সাগরতীরবর্তী নির্জন প্রদেশে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে সমুদ্রের উপর শূন্যে অবস্থিত সৌভবিমানে আত্মগোপন ক’রে অদৃশ্য থেকে অবিরাম অস্ত্র বর্ষণ করতে লাগল। আমার বিখ্যাত শাঙ্গধনু থেকে নিক্ষিপ্ত অস্ত্রও অত ঊর্ধ্বে তার বিমান স্পর্শ করতে পারল না। তখন আমি উগ্র ভয়ঙ্কর ও সুদূরগামী অস্ত্র সকল প্রয়োগ করলাম। তার বিমান নগরীর তুল্য বৃহৎ, দুর্গের ন্যায় সুদৃঢ় কিন্তু আমার সেই সকল অস্ত্রাঘাতে তার অনেকাংশ বিনষ্ট হ’ল এবং ওপক্ষের বহু যোদ্ধা আর্তনাদ করতে করতে মহার্ণবে নিপতিত হ’ল।’

শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা-কৌশলে সকলে মুগ্ধ, চিত্রার্পিতবৎ এই কাহিনী শুনছিলেন, তিনি এখন ঈষৎ এক মুহূর্ত দূরাবস্থিতা পাণ্ডবমহিষীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে পুনশ্চ কাহিনীর সূত্র অবলম্বন করলেন, ‘এবার ঐ দুরাত্মা দানব অন্য কৌশল অবলম্বন করল। বোধ হয় পূর্বেই সে এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল, উগ্রসেনের এক ভৃত্যকে প্রচুর উৎকোচে বশীভূত ক’রে তাকে এই কুকার্যে প্রবৃত্ত করেছিল, সে ব্যক্তি আমাকে এসে সংবাদ দিল যে বসুদেব নিহত হয়েছেন, যাদব-প্রধানগণ অধিকাংশই বন্দী এবং দানব সৈন্যরা দ্বারকা অধিকার করেছে। আমি যেন অবিলম্বে সেখানে প্রত্যাবর্তন করি। লোকটি আমার পরিচিত, পুরাতন সেবক। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম। কিন্তু কাল যখন পূর্ণ হয় তখন নিয়তি দুর্মতি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। অতি কৌশল ও অধিক ব্যগ্রতাই শাল্বর নিয়তি রূপে তার বিনাশে অগ্রসর হ’ল, সহসা দেখলাম আমার পিতা বসুদেব হস্তপদ প্রসারিত ক’রে বিমান থেকে সমুদ্রে নিপতিত হচ্ছেন। তখনই বুঝলাম এ মায়া, মিথ্যা। নিশ্চয়ই নিষ্ঠুর ক্রর শাল্ব বসুদেবের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়ে কোন অনুচরকে এই ভাবে নিক্ষেপ করল—নিশ্চিত মৃত্যুমুখে। বসুদেব দ্বারকায় নিহত হ’লে সে দেহ এ বিমানে আসবে কিরূপে? তখন আমি—এ পাপকে অধিকতর অগ্রসর হতে দেওয়া উচিত নয় এই বোধেও বটে—এবং অতিমাত্রায় ক্রদ্ধ হয়েও—সাক্ষাৎ কৃতান্ত-তুল্য আমার মন্ত্রঃপুত সুদর্শন চক্রান্ত্র ত্যাগ করলাম। সে অস্ত্র তৎক্ষণাৎ প্রলয়কালীন সহস্রগুণতেজসম্পন্ন সূর্যের ন্যায় গগনপথে উত্থিত হয়ে ক্রকচ * যেভাবে কাষ্ঠকে বিদারিত করে সেইভাবেই বিশাল সৌভবিমানকে দ্বিখণ্ডিত ও শাল্বকে বধ করল। সেই অবিশ্বাস্য নিদারুণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর ওর পাপ অনুচরদের আর মনোবল রইল না। তারা ভীত হয়ে—করাল মৃত্যু তাদের পশ্চাতে ধাবমান এই কল্পনায় হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল।’

শাল্বর সঙ্গে যুদ্ধের এই লোমহর্ষক বিবরণ সমাপ্ত ক’রে বাসুদেব বললেন, ‘এই কারণেই আপনার দূত আমার কাছে উপস্থিত হতে পারে নি। আমিও সংবাদ পেলে অবশ্যই আপনাকে নিবৃত্ত করতাম। শেষ পর্যন্ত, প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করেও এ কপট ক্রীড়া বন্ধ করতাম।… সবই দৈব। এক্ষণে যা ঘটবার তা তো ঘটেই গিয়েছে, আপনার অঙ্গীকৃত স্বীকৃত পণের ত্রয়োদশ বর্ষ অতিবাহিত হলে যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড সংঘটিত হবে—তা বহুকাল পর্যন্ত পাপীদের মনে ত্রাসের কারণ হয়ে থাকবে।’

পাণ্ডবদের আশ্বস্ত ও তাঁদের গোপন অভিমান প্রশমিত ক’রে বাসুদেব নত বদনে পাঞ্চালতনয়ার কাছে এসে ওঁরই অজিনাসনের একপার্শ্বে উপবেশন করলেন।

দ্রৌপদী এতক্ষণ স্থির ও নীরব হয়ে ছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণের অত্যাশ্চর্য শাল্বনিগ্রহ বিবরণ * উপস্থিত সকল শ্রোতাকে অভিভূত করলেও—মনে হ’ল তাঁর সেই অপূর্ব বর্ণনা-কৌশল দ্রুপদনন্দিনীকে বিশেষ বিচলিত করতে পারে নি। বরং অতিসূক্ষ্ম এক হাস্যরেখা ওঁর অধরোষ্ঠে আবদ্ধ থেকেও এক ধরনের কৌতুকানুভূতিই প্রকাশ করছিল।

এবং—অপাঙ্গদৃষ্টিনিক্ষেপকারী সে ঈশ্বরাত্মা কথকও সে সম্বন্ধে অনবহিত ছিলেন না। নত দৃষ্টি সেই কারণেই। বালকের কৌশল অবলম্বনের স্থ±ল প্রচেষ্টা অভিভাবকের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ার অপ্রতিভতার মতোই একটু সলজ্জ হাসিও ফুটে উঠেছিল বোধ করি বিশ্ববিমোহন তাঁর সে মুখে।

দ্রৌপদী এই নিভৃত ক্ষণটিরই অপেক্ষা করছিলেন।

বাসুদেব মৃদু স্বরে ‘প্রিয় সখী’ বলে সম্বোধন করতেই তিনি সক্ষোভে সরোদনে বলে উঠলেন, ‘লোকে বলে তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর, সর্বত্র বিরাজমান। তুমি আমাকে সখী সম্বোধন করেছ সেই অভিমানেই আমার মনোদুঃখ তোমাকে নিবেদন করছি। আমি বিশ্বত্রাস মহাবল পাণ্ডবদের ভার্যা, তোমার প্রিয়সখী, অনলাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগ্নী— তৎসত্বেও দুঃশাসন আমাকে অনায়াসে কুরুসভায় টেনে নিয়ে গেল। একমাত্র-বস্ত্র শোণিতাক্ত, সেই অবস্থার কথাও কেউ চিন্তা করল না। লজ্জায় ক্ষোভে রোষে কম্পমানা আমাকে দেখে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্মতি পুত্রগণ কৌতুকহাস্য করল এবং নানাবিধ কদর্য ইঙ্গিত করতে লাগল। পাঞ্চাল ও বৃষ্ণি বংশ জীবিত থাকতেও এ দুর্গতি রোধ হ’ল না! ধার্তরাষ্ট্ররা নির্ভয়ে আমাকে দাসীরূপে সম্ভোগ করতে চাইল। সে সময় তোমার সুদর্শন কোথায় ছিল? কোথায় ছিল তোমার এ আস্ফালন ও মহাবীর্য?…ধিক তোমার সে দৈব অস্ত্র, ধিক ভীমসেনের গদা, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু! তাঁদের ধর্মপত্নীকে নীচজনে পীড়ন করতে লাগল, তাঁরা স্থাণুবৎ বসে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। দীনতম প্রজার কুলনারীর মর্যাদা রক্ষা করাও রাজার কর্তব্য—তাই না? স্বামী দুর্বল হলে স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দেয়—গুরুজনদের মুখে শুনেছি এ-ই সনাতন ধর্ম! ধর্মরাজ নামে খ্যাত আমার স্বামী আমাকে রক্ষা করার কোন চেষ্টাই করলেন না। সকলের সামনেই দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করল, বিবস্ত্র করতে চাইল! সেই দিনই বুঝেছি আমার কেউ নেই।*

[* মৃদুভাষিণী কৃষ্ণা পদ্মকোষতুল্য হস্তে মুখ আবৃত ক’রে সরোদনে বললেন, ‘মধুসূদন, আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব ভ্রাতা পিতা নেই—তুমিও নেই। ক্ষুদ্রেরা আমাকে নির্যাতিত করেছে, তোমরা শোকশূন্যের ন্যায় তা উপেক্ষা করেছ। তখন কর্ণ যে আমাকে উপহাস করেছিল সেই দুঃখও আমার দূর হচ্ছে না। কেশব আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, তোমার যশোগৌরব আছে, তুমি সখ ও প্রভু (নিগ্রহ অনুগ্রহ সমর্থ)—এই চার কারণে আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।’ (মহাভারত, রাজশেখর বসু) ]

শ্রীকৃষ্ণ এবার মুখ তুলে এক প্রকারের গভীর দৃষ্টি দ্রৌপদীর দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করলেন। বললেন, ‘মনস্বিনী, তুমি যাদের উপর ক্রদ্ধ হয়েছ, তারা ইতিমধ্যেই মৃত্যুপুরীর দ্বারপথে পৌঁছে গেছে। সাক্ষাৎ যমরাজ ইচ্ছা করলেও আর তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। তোমার এক এক বিন্দু অশ্রু কৌরব রমণীদের সহস্র বিন্দু অশ্রুর কারণ হয়ে রইল। আমি এই সত্য প্রতিজ্ঞা করছি তুমি আবার পূর্ণ গৌরবে ভারত-সম্রাজ্ঞী রূপে সিংহাসনে উপবেশন করবে। যদি আকাশ ভূলুণ্ঠিত হয়, হিমালয় চূর্ণ হয়, পৃথিবী ধূলিকণায় পরিণত হয়, সমুদ্র মরুভূমি হয়ে যায় তথাপি আমার বাক্য মিথ্যা হবে না।’

দ্রৌপদীও স্থির নিশ্চল দৃষ্টিতে তাঁর চোখের দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘বাসুদেব, তুমি আর যার মনেই প্রতীতি সঞ্চার ক’রে থাকো, যত শব্দঝঙ্কারগুঞ্জিত অপূর্ব বাগজালই বিস্তার করো—আমাকে প্রতারিত করতে পারবে না, পারো নি। আমি জানি তোমার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় নি, তোমার অজ্ঞাতসারে এসব ঘটনা ঘটে নি। তুমি ইচ্ছাপূর্বক দূরে গিয়েছিলে।…আমার বিশ্বাস তুমি আমার এই দুর্গতিতে তৃপ্ত হয়েছ। সত্য ক’রে বলো।’

‘হ্যাঁ, তা হয়েছি।’ নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন শ্রীকৃষ্ণ, ‘তোমার কাছে গোপন করব না। এর প্রয়োজন ছিল। দ্রৌপদীর অনুমানই সত্য প্রতিপন্ন হ’ল, তবু বোধ হ’ল এ উত্তরের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘প্রয়োজন ছিল? প্রয়োজন! আমার এই দুঃসহ কষ্টের এই অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার প্রয়োজন ছিল? এই অকারণ অঘটিতপূর্ব অবমাননার? তার অর্থ? আমি কি অপরাধ করলাম?’

বাসুদেব হাসলেন, বহুপরিচিত সেই মধুর দুয়ে হাসি। বললেন, ‘প্রিয়সখী, রথ যখন বন্ধুর উপলাস্তৃত পথে ধাবিত হয়, তখন পথের কর্কশ প্রস্তরে ঘর্ষিত হয়ে তার চক্র-যুগলের কত ক্লেশ হয় ভাবো দেখি! তাদের লৌহ-বেষ্টনীও প্রতিমুহূর্তে ক্ষয় পেতে থাকে। সে তীব্র দ্রুত ঘর্ষণে যে বহ্নিস্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হয় দুই দিকে— তাতে কত না কীটপতঙ্গাদি দগ্ধ হয়। এদের অপরাধ কি বলতে পারো? যাত্রার প্রয়োজন সেই চিন্তাটাই রথী-সারথির মনে অগ্রগণ্য হয়ে থাকে, রথ কিংবা তার নেমি কি চক্রের কথা কে মনে রাখে? অশ্বদের শষ্যশম্প দেয়, পানীয় দেয়—মধ্যে মধ্যে বিশ্রাম করায়—সেও ঐ যাত্রারই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য, অশ্ব সুস্থ না থাকলে রথ আকর্ষণ করবে কে? চক্র একেবারে ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে সেখানে অপর চক্র সন্নিবিষ্ট করে— তার পূর্ব পর্যন্ত চক্রের অস্তিত্বই কি কারও মনে থাকে?

‘তুমি আমাকে সামান্য রথচক্রের সঙ্গে তুলনা করলে?’

দ্রৌপদী সাভিমানে ক্ষুণ্নস্বরে প্রশ্ন করলেন।

শ্রীকৃষ্ণের দুই নেত্র তখন অর্ধ নিমীলিত হয়ে গেছে, গম্ভীর গদগদ কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন, ‘সাধ্বী, মহাকালের বিজয়রথ ধাবিত হয়েছে তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি প্রত্যক্ষ করছি। তুমি তার চক্রও নও। অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। শুভ বুদ্ধি ও দৃঢ় সঙ্কল্পই তার দুই চক্র। তবে যে বিরাট উদ্দেশ্যে এই মহান যাত্রা, তাতে সে রথের ক্ষুদ্রতম অংশ হওয়াও গর্বের কথা। ভামিনী, দুঃখ-লাঞ্ছনা তো তুচ্ছ—তোমার প্রাণ নিলেও যদি সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়—তা নিতেও মুহূর্ত-মাত্র দ্বিধা করব না। ‘

বলতে বলতে তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডল এক অবর্ণনীয় দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সেদিকে চেয়ে থাকা যায় না —মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছুটা বা শঙ্কিতভাবে চেয়ে থাকার চেষ্টা ক’রে দ্রৌপদী বললেন, ‘কী সে বিরাট মহান উদ্দেশ্য তা জানবারও কি অধিকার নেই আমাদের? শুধুই পিষ্ট হব ঘর্ষিত হব–হয়ত বা বিনষ্ট হব?’

‘না। এ আমার সাধনা—সাধনার কথা গোপন রাখতে হয়। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে সমগ্র বিশ্ববাসীই তা জানবে, অনুভব করবে—সে সময় তুমিও জানবে। হয়ত আরও বিস্তর দুঃখের মূল্যেই তা জানতে হবে। কিন্তু উপায় কি?’

তারপর যেন কিছুটা সহজ হবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টাতেই ঈষৎ কৌতুক-স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দ্রৌপদীর মুখের দিকে চেয়ে বলেন, ‘এই যে রথে চড়ে অরণ্যময় বন্ধুর পথে এসেছিলে—তখন তুমি কি চক্রের, অশ্বের বা রথের অনুমতি নিয়েছিলে? শোন দ্রৌপদী, একটা কথা তোমাকে বলতে পারি, আমিও এই নির্মম মহা-যাত্রার প্রয়োজনেই এসেছি,

আমার এ তপস্যা বা সাধনাও তাই পূর্বনির্দিষ্ট। আমিও যন্ত্র, যন্ত্রী নই। নইলে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ ক’রে জীবনের সেই প্রথম দণ্ডেই জাতিভেদের সংস্কার ছিন্ন করতে হবে কেন? ক্ষত্রিয়-পিতা বসুদেব কারাগৃহের দ্বার উন্মুক্ত পেয়েও পলায়ন করতে বা কোন ক্ষত্রিয় গৃহে রাখতে সাহস করেন নি কেন? কেন বৈশ্যের অন্নে প্রতিপালিত হবার জন্য গোপগৃহে রেখে এলেন? কিশোর বয়সে একাকী, নিরস্ত্র—সেই কংসকে বধ করার সাহস পেলাম কি রূপে? অলস, আসবাসক্ত স্বভাবভীত যাদবদের সংহত ক’রে সুদ্ধমাত্র সহ্যশক্তির দ্বারা অষ্টাদশবার জরাসন্ধের প্রচণ্ড শক্তি প্রতিহত করার প্রেরণা কে দিল আমাকে? নিতান্ত বালক বয়সে ইন্দ্রের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ ও প্রতিকার করার শক্তি পেলাম কেমন ক’রে? মাত্র দুটি লোক নিয়ে জরাসন্ধের পুরপ্রবেশ করলাম কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে?….পাঁচটি তরুণ অনভিজ্ঞ ভিক্ষুক রাজনন্দিনীকে লাভ ক’রে অত্যল্পকাল মধ্যে সমগ্র ভারতের সম্রাটরূপে, একচ্ছত্র অধিপতিরূপে স্বীকৃত হলেন—এর মধ্যে কি সেই বিশ্বচিন্তা, নিয়তি বা মহাকালের অদৃশ্য হস্ত দেখতে পাও নি? আজ সেই নিয়তিই যদি অকথ্য লাঞ্ছনার আয়োজন ক’রে থাকেন, সেই মহারাজচক্রবর্তীদের অরণ্যবাসী ভিক্ষুকে পরিণত করেন আবার—তাতে বিস্মিত কি ক্ষুব্ধ হও কেন? শুধু জোড়-করে নিমীলিত নেত্রে তাঁর বিরাট ইচ্ছার কাছে মাথা নত করো, ভীষণা নিবৃত্তিকে প্রণাম ক’রে তাঁর দ্বারা পিষ্ট দলিত হবার, তাঁর প্রয়োজনে প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত হও।‘

।। প্রথম পর্ব সমাপ্ত।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *