১.১০ ক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণের মিলিত বাক্য

১০

এতগুলি ক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণের মিলিত বাক্যের কোলাহল থেকে তাঁদের বক্তব্য বোধগম্য হতে কিছু সময় লাগল। নিদারুণ উত্তেজিত তাঁরা, বিপন্ন যে তাতেও সন্দেহ নেই। কেউ যজ্ঞ করতে করতে উঠে এসেছেন, কেউ বা পূজাবন্দনাদি সেরে আহারে বসেছিলেন, কেউ বা গৃহদেবতা কি ইষ্টকে ভোগ নিবেদন করছিলেন, তার চিহ্ন এখনও বহন করছেন সবাই। যাঁরা ভোজনে বসেছিলেন, অনেকে আচমন করবারও সময় পান নি, সেই অশুচি অবস্থাতেই এসেছেন—ব্রাহ্মণদের পক্ষে যা মহাপাপ।

অর্জুন বহু চেষ্টা করলেন তাঁদের বোঝাতে যাতে একজন মাত্র স্থিরভাবে তাঁদের বক্তব্য বলতে পারেন, বাকী সকলে নীরব থাকেন—এভাবে সকলে একসঙ্গে বলতে গেলে ত্বরার থেকে বিলম্বই ঘটবে বেশী–কিন্তু সে যুক্তি তাঁদের উত্তপ্ত মস্তিষ্কে, এবং দূরে যাঁরা ছিলেন কোলাহল ভেদ ক’রে তাঁদের কর্ণে পৌঁছল না।

অতি কষ্টে, তাঁরা নিজেদের উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ায় ও উচ্চরবের পরিশ্রমে শ্রান্ত হবার ফলে কিছুটা স্থির হতে অর্জুন যে বার্তাটি উদ্ধার করলেন তা হ’ল এই আজ এই দিবাভাগের প্রথমাংশেই একদল জ্যেঠ দস্যু এসে তাঁদের শস্য ও গোধন হরণ ক’রে নিয়ে গেছে। তাঁরা নিরীহ শাস্ত্রজীবী ব্রাহ্মণ, শস্ত্রজীবী দস্যুদের বাধা দেবার মতো সামর্থ্য বা অস্ত্র তাঁদের নেই, বাধা দিতে পারেনও নি, ফলে সেই শর্শরীক দস্যুরা অবাধে লুণ্ঠন-কার্য চালিয়ে যাচ্ছে, হয়ত এখনও চালাচ্ছে হয়ত অতঃপর স্ত্রীলোকদের ওপরও অত্যাচার শুরু হবে, কারণ যদিচ নগরের অন্যান্য পল্লী সুদূর নয়, দস্যুদের পৈশাচিক উল্লাসধ্বনি এবং তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের আর্তনাদ সেসব স্থানে না পৌঁছানোর কথা নয়— তথাপি এখনও কোন প্রহরী বা সৈন্যদল ছুটে আসেনি, কোন ক্ষত্রিয় অধিবাসী, অস্ত্রাদি নিয়ে আত্মরক্ষায় ছুটে আসার প্রয়োজন বোধ করেন নি।

অতঃপর তাঁরা সংবাদ শেষ হতে— পুনশ্চ রাজা বা রাজশক্তিকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। উৎপন্ন দ্রব্যের ষষ্ঠাংশ তাঁরা কর হিসাবে রাজাকে দিচ্ছেন—ব্রাহ্মণ বলে অব্যাহতি পান নি— সে তো রাজা তাঁদের সর্বদা সর্বতোভাবে রক্ষা করবেন এই অঙ্গীকারে। কেবলমাত্র হর্ম্যাদি নির্মাণ, পয়ঃনিঃসারণ ব্যবস্থা করলেই নাগরিকগণের স্বাচ্ছন্দ্যের চূড়ান্ত হয় না। নিরাপত্তার জন্যই লোকে রাজধানীতে এসে বাস করে। এ রাজধানীর মূল্য কি? এখানে বাস করা অপেক্ষা অরণ্যে বাস করাও তো শ্রেয়, সাবধানে থাকলেই নিরাপদে থাকা যায়। সেখানে শ্বাপদভয় আছে, দস্যুভয় নেই।

অর্জুন নিজের বক্তব্য শোনাতে না পেরে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এখন গত্যন্তর না দেখে কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে চড়াতে বাধ্য হলেন। একটু রূঢ় ও পরুষ শোনালেও— অথবা শোনাল বলেই— ব্রাহ্মণরা পরস্পরকে অপেক্ষাকৃত অনুত্তেজিত কণ্ঠে— ‘শোন, শোন, ধর্মাত্মা বীর্যবান তৃতীয় পাণ্ডব কি বলতে চান মন দিয়ে শোন’ বলে পরস্পরকে প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

অর্জুন বললেন, ‘ব্রাহ্মণগণ, আপনারা অকারণে এত উত্তেজিত হবেন না। আমাদের ধারণা ছিল যে এ নগরে দস্যুরা প্রবেশ করতেই সাহস করবে না, সেই জন্যই পর্যাপ্ত প্রহরার ব্যবস্থা ছিল না। এখন দেখছি সে ধারণা ভ্রান্ত। সেজন্য কৃতাপরাধের মতোই মার্জনা ভিক্ষা করছি। আপনারা শান্ত হোন, যে পরিমাণ শস্যসম্পদ ধনাদি ও গোধন অপহৃত হয়েছে বলছেন আপনারা, তাতে তাদের লুণ্ঠনকার্য শেষ হলেও অধিক দূরে যেতে পারবে না নিশ্চয়। আপনারা মাত্র দুই দণ্ড সময় দিন, তারা যত দূরেই যাক, তাদের বিমর্দিত বিনষ্ট করে আপনাদের সম্পদ আপনাদের প্রত্যার্পণ করব। এছাড়াও রাজভাণ্ডার থেকে অবশ্যই আপনাদের ক্ষতিপূরণ করা হবে। আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে গৃহে ফিরে যান, লুণ্ঠন ছাড়া যদি অপর কোন গর্হিত অত্যাচার করে থাকে দুর্বৃত্তরা— তো জেনে রাখুন, অপরাধের তুলনায় চতুগুণ শাস্তি পেতে হবে তাদের, পাতালে প্রবেশ করলেও তারা অব্যাহতি পাবে না।’

তৃতীয় পাণ্ডবের শৌর্য ও আশ্চর্য শস্ত্রশিক্ষার কথা ইতিমধ্যেই প্রবাদে পরিণত হয়েছে প্রায় ব্রাহ্মণরা আশ্বস্ত হয়ে এবারে আনন্দ-কোলাহল করতে করতে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।

কিন্তু আশ্বাসদানকারী পড়লেন মহা বিপদে।

তিনি যখন এঁদের কাছে এই কুঘটন প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, তখন ব্রাহ্মণদের বিপদ ও নিজেদের অমর্যাদা ছাড়া অন্য চিন্তা ছিল না। সময়ের হিসাব করতে শুধু রথে অশ্বযোজনা ও এই ক্রোশের পথ অতিক্রমের কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু অস্ত্র? সেখানে যে এক বিপুল জটিলতা বেধে বসে আছে!

বাসুদেবই পরামর্শ দিয়েছিলেন, কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের উচিত নিজ নিজ নবনির্মিত পুরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও রাজাকে মধ্যে মধ্যে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা। তাতে সৌহার্দ্য ও সৌভ্রাত্র বৃদ্ধি পায়। অবশ্য রাজাও কনিষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করবেন বৈকি। সুদ্ধমাত্র রাজসভা বা মন্ত্রণাসভাতেই ভাইদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়— এ ব্যবস্থা আদৌ অভিপ্রেত নয়— ওতে মানসিক দূরত্ব বা ব্যবধান বৃদ্ধি পায়।

ধনঞ্জয় সে কথার উত্তরে একটা বিশেষ নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। স্বেচ্ছাপ্রণীত স্বেচ্ছারোপিত নিয়ম। যখন পাঁচ ভাই একই দার পরিগ্রহণ করবেন স্থির হ’ল—তখন মহর্ষি নারদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসে ওঁদের সতর্ক ক’রে দিয়ে যান যে, কেবলমাত্র স্ত্রীলোককে উপলক্ষ ক’রেই বহু সখ্য ও সৌভ্রাত্র নষ্ট হয়েছে ভ্রাতার হাতে ভ্রাতা নিহত হয়েছে, প্রাণাধিক সখা পরস্যাপি পর হয়ে গেছে। তোমরা যদি পূর্বেই এ বিষয়ে কতকগুলি কঠোর নিয়ম না ক’রে নাও, এবং ধর্মপালনের মতো ক’রে তা পালন না করো, তাহলে এ বিপদ তোমরাও এড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ, বিপদ শব্দ ব্যবহার করছি ইচ্ছে ক’রেই। সুন্দরী নারীরত্ন লাভ পরম সৌভাগ্যের কথা সন্দেহ নেই— কিন্তু অনেক সময়ই তা চরম সর্বনাশেরও কারণ হয়ে ওঠে ।

সেই উপদেশ অনুসারেই ওঁরা কটি নিয়ম করেছিলেন। সুচিন্তিত, সুবিবেচিত। তার মধ্যে একটি হ’ল পট্টমহাদেবী কল্যাণী দ্রৌপদী যখন কোন এক স্বামীর সঙ্গে কোন গৃহে বাস করবেন— তখন অপর স্বামীরা কদাচ সে গৃহে প্রবেশ করবেন না বা অন্তরঙ্গ অবসরে উভয়কে একত্র দেখবেন না। কেউ যদি এ নিয়ম লঙ্ঘন করেন তবে তাঁকে ব্ৰহ্মচর্য গ্রহণ ক’রে দ্বাদশ বর্ষের জন্য নির্বাসন বরণ করতে হবে।

এ নিয়মে এতকাল কোন অসুবিধা হয়নি। এখন এক বিচিত্র কারণ দেখা দিয়েছে অসুবিধার।

মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে ধনঞ্জয় ফাল্গুনীর সনির্বন্ধ অনুরোধ ও অনুনয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর আবাসে আগমন করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ ও বৃহত্তম হিসাবে— যে গৃহে অর্জুনের আয়ুধাদি থাকে সেই গৃহই তাঁদের বাসস্থানের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে। পূর্বে সংবাদ দিয়ে অনুমতি সংগ্রহ করে সে গৃহে যেতে কোন বাধা নেই আয়ুষ্মতী দ্রৌপদী সে সময় অন্তরালে যেতে পারেন বা অবগুণ্ঠনবতী হতে পারেন— আর যুধিষ্ঠিরও কিছু সব সময় ঘরেই আবদ্ধ থাকেন না— সুতরাং এ ব্যবস্থায় যে কোন অসুবিধা হতে পারে তা মনে হয় নি।

তবু কে জানে কেন একটা অজ্ঞাত ও দুর্বোধ্য অমঙ্গলাশঙ্কা নিয়েই অর্জুন তাঁর আবাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। দেখলেন, তাঁর গৃহ-সেবক-সেবিকারা কেউ নেই, সম্ভবত তারা নিকটবর্তী সরোবরে স্নান বা বস্ত্রাদি প্রক্ষালনে গেছে। তাদের দোষও দেওয়া যায় না। ওঁদের মধ্যাহ্ন-ভোজন শেষ হয়েছে, এখন তারা নিশ্চিত। তাদের এটা অবসর কালও। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এমন কি মহিষীপ্রধানা দ্রৌপদীরও আহার শেষ হয়েছে নিশ্চয়— নইলে পাচক ও ভৃত্যরা অন্যত্র যেত না— এখন তাঁরা বিশ্রম্ভালাপ করছেন।

এ সময় সে গৃহে প্রবেশ করার একটি পরিণাম। নির্বাসন।

অথচ অবসরও আর নেই। ব্রাহ্মণদের কাছে তিনি বাক্যদত্ত, দুই দণ্ডকাল মধ্যে এই পাপাচরণের প্রতিকার করবেন, দুঃসাহসিক দস্যুদলের স্পর্ধার সমুচিত প্রত্যুত্তর দেবেন—অমার্জনীয় ধৃষ্টতার শাস্তিবিধান করবেন।

ব্রাহ্মণদের অবহেলা করলে অভিসম্পাতের ভয় আছে। তিনি আশ্বাসদানে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করলে সে সর্বনাশ ঘটত। ব্রহ্মশাপে সবংশে নিহত হওয়া, সেই সঙ্গে রাজলক্ষ্মীভ্রষ্ট হওয়ার থেকে তাঁর একার দুঃসহ ক্লেশ স্বীকারও অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়। বংশকে রক্ষা করতে, ভ্রাতাদের নিরাপদ সুখে রাখতে বনবাসে যেতেও কোন দুঃখ নেই।

তিনি আর দ্বিধা করলেন না। বারেক দ্বারে করঘাত ক’রেই গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। দ্রৌপদী এখন তাঁর পূজনীয়া। হয়ত বা সেই ঈষৎ অসমৃতবাসা অগ্রজপত্নীকে অবলোকন অনুচিত—এ বোধ এবং সর্ববিধ সতর্কতা সত্বেও দৃষ্টি সেদিকেই আগে গিয়ে পড়ল। দেখলেন তাঁর অনুমানই ঠিক। দ্রৌপদী তখন বসে স্বামীর পদসেবা করলেও তাঁর বেশবাস শয়নোপযোগী শিথিলিত।

দ্রৌপদী বিস্মিত হলেও বিহ্বল হলেন না, দ্রুত অবগুণ্ঠন টেনে দিলেন মাথায়। কিন্তু সেই অত্যল্প–প্রায়-নিমেষকাল মধ্যেই অর্জুন লক্ষ্য করলেন শুধু লজ্জা নয়, আকস্মিক প্রিয়দর্শনসুখের অনির্বচনীয় বার্তাও তাঁর নবারুণরক্ত মুখে ফুটে উঠল।

নিয়ম রীতি ন্যায়— এসব পালন করে দেহ, বিচারবুদ্ধি, সংস্কার— হৃদয় ও অনুভূতি এসব বন্ধনের অতীত, স্বাধীন। তখন আর বিলম্বের অবসর নেই, মাত্র কয়েকটি বাক্যে এই নির্লজ্জ আগমনের প্রয়োজন জানিয়ে ধনঞ্জয় তাঁর অস্ত্রাদি নিয়ে চলে গেলেন। দ্রৌপদীর দিকে অবশ্যই আর তাকালেন না, কিন্তু কেমন যেন মনে হতে লাগল— এক নীলোৎপল-পলাশ-যুগলাক্ষির দৃষ্টি পট্টবস্ত্রের অবগুণ্ঠন ভেদ ক’রেও তাঁর অনুসরণ করছে।

অর্জুনের পক্ষে দস্যুদের পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের বিমর্দিত ও ব্রহ্মস্ব উদ্ধার করা কয়েক দণ্ডের কাজ। তার জন্য কোন চিন্তাও ছিল না। অভিযানের পরিণাম তো তাঁর জানাই। অবশ্যম্ভাবী। তিনি কামুক ধারণ করলে কয়েকজন কেন সহস্র দস্যুরও পরিত্রাণ নেই।

চিন্তা অন্যত্র, অন্য কারণে।

চিন্তিত ও বিমর্ষ মুখেই আবাসে প্রত্যাবর্তন করলেন ফাল্গুনী।

যে প্রিয়া-সান্নিধ্যচ্যুত হবার আশঙ্কায় তিনি শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছিলেন, সেই সান্নিধ্যই হারাতে হবে। আরও দীর্ঘকালের জন্য। মানবজীবনে দ্বাদশ বৎসর সময় হয়ত অকিঞ্চিৎকর কিন্তু যৌবনকালে, বিশেষ নববিবাহিতের বিরহদশায়—তা সুদীর্ঘকাল।

চিন্তাক্লিষ্ট ধর্মরাজও।

যুধিষ্ঠির কোন সময়েই বিচলিত হন না। সম্প্রতি তাঁর প্রজারা যে তাঁকে ধর্মরাজ বলে অভিহিত করছে— তা একেবারে অকারণ নয়। ধর্মের মতোই অবিচল, স্থির। ধর্মের গতির মতোই ধীর। তবু, আজ তাঁর মুখের প্রশান্তি ও যেন নষ্ট হয়েছে, ঈষৎ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাঁকে। বার বার নিজের করতল নিরীক্ষণ করছেন, যেন আসন্ন কোন অমঙ্গলের বার্তা অন্বেষণ করছেন সেখানে।

পট্টমহাদেবী দ্রৌপদীও স্থির হতে পারছেন না বিনা প্রয়োজনেই প্রাসাদের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গৃহসজ্জার বিন্যাস নষ্ট ক’রে পুনশ্চ তা নূতন ভাবে সজ্জিত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু নানা অসম্বন্ধ চিন্তা ও অন্যমনস্কতাহেতু বিশৃঙ্খলাই বাড়ছে—মনোমতো ভাবে সুসজ্জিত করা যাচ্ছে না।

বিজয়ী বীরের প্রত্যাবর্তন-সংবাদ রথচক্র ও অশ্বক্ষুরের শব্দেই পাওয়া গিয়েছিল, সেই সঙ্গে গৃহভৃত্য, সেবক ও প্রজাগণের হর্ষোৎফুল্ল জয়ধ্বনিতে। তবু, যুধিষ্ঠির অন্য দিনের মতো স্নেহবশত উঠে প্রত্যুদগমনের চেষ্টা করলেন না, বরং অধোবদন অর্জুন এসে পাদবন্দনা করার সময়— প্রাণপণ চেষ্টা সত্বেও যেন বিবর্ণ হয়ে উঠলেন। মুখশ্রী পাণ্ডুরবর্ণ ধারণ করল। অস্ফুট স্বরে আশীর্বাদ বাক্য উচ্চারণ করলেন মাত্র, কার্যোদ্ধার হল কিনা, ভ্রাতা অক্ষত দেহে নিরাপদেই ফিরে আসতে পেরেছেন কিনা এ-প্রশ্নও করতে পারলেন না।

কিন্তু অর্জুন বৃথা কালহরণ ক’রে— যে দুঃখ নিশ্চিত তাকে দীর্ঘায়ত করতে চাইলেন না। দ্বিধা বা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকার অর্থ হয়, যদি সামান্য মাত্র আশার সম্ভাবনা থাকে।

তিনি নিজেই দস্যুবিনাশ ও ব্রাহ্মণদের সম্পদাদি পুনরুদ্ধারের সংবাদ দিয়ে কয়েক নিমেষকাল অপেক্ষা ক’রে করজোড়ে নিবেদন করলেন, ‘এবার মহারাজের আদেশ পেলেই নির্বাসন-যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে পারি।’

সকল বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখেও যিনি অনুদ্বিগ্ন থাকেন— সেই বিজ্ঞতম যুধিষ্ঠিরও ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

এই সংকট কালেরই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ, অনিবার্য জেনেও এই আশঙ্কাতেই কণ্টকিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘না না, এ কি বলছ! তোমার কিছুমাত্র অপরাধ হয় নি। আমি কিছু মনে করি নি। আপৎকালে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম ঘটে। প্রজার সমূহ বিপদ, ব্রহ্মশাপে সর্ববিনষ্টির সম্ভাবনা—এর চেয়ে আপৎকাল আর কি আসতে পারে? না না, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। বিশেষ রাজ্যের চারিদিকে শত্রু, বিদ্বেষের মেঘ এ রাজ্যের সর্বদিগন্ত আচ্ছন্ন করে আছে—এখন তুমি অনুপস্থিত থাকলে প্রভূত বিপদ।’

অর্জুন সেইভাবে করজোড়েই–বিনত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, আমার যা কিছু শিক্ষা, ধর্মাচরণ সম্বন্ধে যা কিছু জ্ঞান ও ধারণা, তা সবই আপনার প্রসাদে লাভ করেছি, আপনার চরণপ্রান্তে বসেই জীবন গঠনের পথ দেখতে পেয়েছি। আপনার কাছেই শুনেছি— বিবেকের সঙ্গে ছলনা করা যায় না, মিথ্যার সঙ্গে আপোস করা চলে না। সত্যের একটিই মাত্র পথ—ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে কোন মধ্যপন্থা নেই। আমরা যে নিয়ম করেছি তা যদি লঙ্ঘন করি প্রজারা আমাদের অপত্যগণ, কেউ আর আমাদের উপদেশে কর্ণপাত করবে না। না মহারাজ, অন্যায় জেনেও স্নেহবশত তাকে প্রশ্রয় দেওয়া—এ দৌর্বল্য আপনাকে শোভা পায় না। আপনি অনুমতি দিন, দ্বাদশবর্ষকাল দেখতে দেখতে কেটে যাবে। এখানে রণদুর্মর মহাবীর ভীমসেন রইলেন, পাণ্ডব-সিংহাসনের কোন শত্রু তাঁর সম্মুখীন হতে সাহস করবে না।’

যুধিষ্ঠিরের চিত্তস্থৈর্য তবুও প্রত্যাবৃত্ত হল না। তিনি অধিকতর অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অবিলম্বে এই প্রাসাদে আসার জন্য সংবাদ পাঠালেন। গত কয়েক বৎসরে বিপদে-সম্পদে সর্ব বিষয়ে তাঁর উপর নির্ভর করতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কোন কারণে মনস্থির করতে না পারলেই শ্রীকৃষ্ণের উপর সে বিচারের ভারটা ছেড়ে দেন। সেই জন্যই তাঁর দ্বারকা প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ উঠলেই নানা কারণ উপস্থিত ক’রে সেটা বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন।…

কিন্তু গ্রহ বিরূপ আজ, শ্রীকৃষ্ণও ধর্মরাজকে নিরাশ করলেন।

সহজ প্রশান্ত মুখেই যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য শুনলেন— সেই দুর্বোধ্য মধুর হাসিমুখে— তার পর অল্প কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে উত্তর দিলেন, ‘ধর্মরাজ, আপনাকে এ বিষয়ে উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়া আমার ধৃষ্টতা। অতিরিক্ত স্নেহে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন বলেই আপনার প্রজ্ঞাদৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়েছে, না হলে এ প্রশ্নই আপনার মনে দেখা দিত না। যদি সত্যভ্রষ্ট হওয়া অনভিপ্রেত হয় তাহলে অর্জুনের নির্বাসনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ স্বেচ্ছা-আরোপিত নিয়ম—লঙ্ঘন করলে নিজেদের কাছেই চিরদিন লজ্জিত থাকতে হবে। না মহারাজ, অর্জুনের আর এক রাত্রিও রাজধানীতে বাস করা উচিত হবে না। আজ প্রদোষ আসন্ন হওয়ার পূর্বেই তার কর্তব্য গৃহ এবং নগর ত্যাগ করা। ‘

যুধিষ্ঠির ললাটে করাঘাত করলেন শুধু।

প্রাণ ধরে ‘যাও’ এ শব্দ উচ্চারণ করতে পারবেন না তিনি—এ তো জানা কথাই। দীর্ঘদিনের সঙ্গী তাঁরা—তাঁরা সম্পদে বিপদে, দুঃখে আনন্দে, উৎসবে দৈন্যদশায় চিরদিন একত্র থেকেছেন, ভীম অর্জুন দুজনই প্রধান সহায়—কিন্তু অর্জুনের ওপরই বেশী আস্থা, বেশী নির্ভরতা তাঁর। সেই অর্জুন দীর্ঘদিনের জন্য অজ্ঞাত পথে যাত্রা করবেন—অসহায় বোধ হয় বৈকি।

অর্জুনও আর মৌখিক সম্মতির অপেক্ষা করলেন না। নিজের অন্তঃপুরে গিয়ে অপরা স্ত্রীকে সংবাদ দিয়ে অস্ত্র ও অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি গুছিয়ে দিতে বললেন। তারই বা কি মুখের অবস্থা হল—তাও লক্ষ্য করার চেষ্টা করলেন না।

দেখতে দেখতে এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

ভাইয়েরা সকলেই প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন, ভীম তো রীতিমতো উত্তেজিত ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ক্রুদ্ধ—পুরবাসী বিশেষ ব্রাহ্মণরা যখন শুনলেন তাঁদের জন্যেই এই অবস্থা ধনঞ্জয়ের—সকলে বললেন, তাঁরাও অর্জুনের এই অনির্দেশ্য যাত্রার সঙ্গী হবেন। পাণ্ডবগণ, অর্জুন এমন কি পরম বুদ্ধিমান বাককৌশলী স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরও বিবিধ প্রবোধ বাক্য ও আশ্বাস দিয়ে শান্ত করতে বিস্তর সময় লাগল। সকলে নিবৃত্ত হলেনও না। বহু দূরে এবং বহুদিন পর্যন্ত তাঁর অনুগমন করলেন।

বহুদূর পর্যন্ত এলেন শ্রীকৃষ্ণও।

দ্বিতীয় দিন সূর্যাস্তকালে এক নির্ঝরিণীতীরে স্কন্ধাবার স্থাপন করে অর্জুন যখন করজোড়ে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানালেন— তখন অন্ধকার রজনীর অজুহাতে সে রাত্রিটা সেই বস্ত্রাবাসেই অতিবাহিত করলেন তিনি। তার পরদিন প্রত্যুষে— এই সমস্ত সময় সমস্ত পথ অর্জুনের অনুষঙ্গী হওয়া সম্ভব নয়, মিছামিছি আরও কিছুদূর পর্যন্ত যাওয়া অনর্থক জেনেই— বিদায় নিলেন। যাবার সময় শুধু বললেন, ‘এ একরকম ভালই হল তোমার। তুমি স্বেচ্ছায় দীর্ঘকালের জন্য কৃষ্ণাকে এখানে রেখে কোথাও যেতে পারতে না–বাধ্য হয়ে যা করতে হয়—ইচ্ছাপূর্বক তা করা কঠিন।’ বলতে বলতে তাঁর নয়নপ্রান্তে যে ঈষৎ কৌতুক নৃত্য ক’রে উঠল তা দেখে অর্জুন আরক্তমুখে মাথা নত করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ বলেই চললেন, ‘আশা করি তুমি এটাকে বিধিনির্দেশ মনে ক’রে এই অবসরে লাভবান হবে, দেশ ও দেশবাসী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান-সঞ্চয় করবে।… আমি তোমাকে ভারতভূমি পরিক্রমা করতে বলেছিলুম, এখন তো বেশী সময় পেলে, তুমি সম্পূর্ণ ভারতখণ্ড পরিভ্রমণ করো। একটা কথা বলে দিই, এ দেশের অনার্য আদিবাসীদের অবহেলা করো না— স্মরণ রেখো, আমাদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা জীবনধারণার মিল না থাকলেও—তাদেরও এক ধরনের সভ্যতা আছে, আর সে সভ্যতা আরও প্রাচীন। এ দেশের জলহাওয়া প্রকৃতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা তাদের অনেক বেশী। তাদের সঙ্গে মিশবে অবজ্ঞাভরে নয়—সশ্রদ্ধ চিত্তে। তাদের ঘর থেকে—যদি ভাল লাগে, কন্যা গ্রহণ করতেও দ্বিধা করো না। ব্রহ্মচর্য তোমার দ্রৌপদী সম্পর্কেই, এ নির্বাসন শুধু তাঁর কারণে কখনও কারও লালসা অত্যুগ্র হয়ে উঠে ভ্রাতৃবিরোধের বীজ না বপন করে তোমাদের সাংসারিক অনভিজ্ঞতার উর্বর ভূমিতে—এই আশঙ্কায়। তুমি রাজ্যসীমার ঠিক বাইরে কোন জনপদে বসবাস করলেও নিয়ম লঙ্ঘিত হত না, কিন্তু তাতে ভ্রাতৃবিরোধের সম্ভাবনা থেকে যেত। তোমার মন অস্থির হত। লোভের আকাঙ্ক্ষার বস্তু আয়ত্ত সীমার মধ্যে থাকলে লালসা উগ্র হয়ে ওঠে। সুতরাং দূরে যাওয়াই ভাল। তুমি দক্ষিণের দেশগুলি দেখে সমুদ্রতীরের পথ ধরে পূর্বে চলে যেও। তোমার পরিক্রমা শেষ হবে পশ্চিমে, দ্বাদশবর্ষে আমি তোমাকে দ্বারকায় আশা করব।… পূর্ব দেশ সম্বন্ধে একটু সচেতন থেকো। প্রাগজ্যোতিষপুরের ভগদত্ত শক্তিশালী লোক, কৌরবের বন্ধু, সে কারণে তোমাদের শত্রু। ঐ দেশের চারিদিকে যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য আছে তাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করো, সুবিধা বুঝলে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ো, ভবিষ্যতে সে আত্মীয়তা কাজে লাগতে পারে … অর্জুন, সাধারণ মানুষের মতো ঐশ্বর্য বিলাসসামগ্রী ও ইন্দ্রিয়সম্ভোগ করার জন্য তোমাদের জন্ম হয় নি—বহু দৈব কর্তব্য পালন করতে হবে, সে কথাটা মনে রেখে সেই ভাবেই প্রস্তুত করো নিজেকে।’

অতঃপর অর্জুনকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ ও দুই গণ্ডে চুম্বন ক’রে শ্রীকৃষ্ণ বিদায় নিলেন।

১১

ক্রমে ক্রমে দ্রৌপদীর জন্য তৃষ্ণা ও তাঁর দর্শনাভাব-জনিত চিত্তক্ষোভ প্রশমিত হয়ে আসে বৈকি। সেই হোমাগ্নিসম্ভবা কন্যার সুরলোকদুর্লভ লাবণ্য—অগ্নিশিখার মতোই প্রজ্বলিত রূপবহ্নিও স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত হয়। নূতন দেশে নূতন মানুষ—অপরিচিত অপরিজ্ঞাত পরিবেশ—মনে নূতন উৎসাহ আগ্রহের সৃষ্টি করে। নব নব বিস্ময়ে মাদকতার আস্বাদ পান। আরও দেখা আরও জানার জন্য ব্যগ্র, উৎসুক হয়ে ওঠেন।

বাসুদেবের উপদেশ ও নির্দেশের কথাও মনে পড়ে। ক্রমে তার মর্মও প্রতিভাত হয়। এদেশে এত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আছে তা পূর্বে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। তাদের সঙ্গে মিশে, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মাচরণ ধর্মবিশ্বাস—তাদের সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে অপরূপ অনুভূতি বোধ করেন একটা—যেন এক সবিপুল অজ্ঞতা নূতন জগৎ তাঁর সম্মুখে অনাবরিত হচ্ছে।

এদের ধারণা কল্পনা থেকে শিক্ষা করারও অনেক কিছু আছে। দেশের কোনও লোক, সামান্যতম ইতরতম ব্যক্তিও অবজ্ঞেয় নয়—এ শিক্ষাও লাভ করেন তিনি। এ যেন ঈশ্বরের এক বিশ্বরূপ। তাঁর বিরাট শক্তি, বিপুল বিভূতি ও সীমাহীন মহিমারই বিচিত্র বিকাশ এরা।… এ দেশ প্রকৃত ভাবে শাসন করতে গেলে— বিশেষ এই বিভিন্ন বৃত্তির জীবনধারণার বহুবিচিত্র মনুসন্তানগুলির উপর সার্বভৌমত্ব, একচ্ছত্র-নৃপতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আগে এদের জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া, এদের চিন্তাধারার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা প্রয়োজন—এই মহামূল্যবান শিক্ষাও লাভ হয় তাঁর। প্রতিদিন প্রতিনিয়তই তাই বাসুদেবের উপদেশ মনে পড়ে, তাঁর দূরদৃষ্টির মূল্য উপলব্ধি করেন।

আর সে মূল্য বোঝেন বলেই তা সামগ্রিক ভাবে পালন করার চেষ্টা করেন। এদেশের আদিম অনার্য অধিবাসীদেরও অবহেলা করেন না, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো সমকক্ষ ভাবেই মেশার চেষ্টা করেন— সর্বপ্রকার ঔদ্ধত্য বা গর্ববোধ বিসর্জন দিয়ে।

তাতে উপকৃতও হন। বিস্মিত হন বোধ করি তার চেয়েও বেশী। এদের অস্ত্রশস্ত্র, তার প্রয়োগপদ্ধতি যে এত অগ্রসর— এত নিপুণ ও অব্যর্থ, এত শক্তিশালী— সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না তাঁর। কোন কোন ক্ষেত্রে পরাজয়ের মূল্যেই সে অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়েছে তাঁকে। এই রকম দুটি-একটি ঘটনাতে অন্তরঙ্গতাও ঘটেছে— অর্থাৎ নারীসাহচর্য লাভ হয়েছে। আর সে সাহচর্যে তিনি প্রীত বা তুষ্ট হয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বরং এটুকু বললে অল্পই বলা হয়। সে মিলনের স্মৃতি অন্তর-মধ্যে এক পুলকমাধুর্যে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে চিরদিন। আর সে অন্তরঙ্গ পরিচয়ের ফলে এই সব অনার্য যোষিতাদের সম্বন্ধে যে বিস্ময় শ্রদ্ধা আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন সেও বড় সামান্য নয়।

বিশেষ করে দুটি কন্যা ও তাদের দেশবাসীদের সম্বন্ধেই বিস্ময় শ্রদ্ধা সমধিক। তাদের কথা চিরদিন মনে থাকবে ওঁর। ভবিষ্যতে কোন প্রবল শত্রুর সম্মুখীন হলে এরা যে বৈরী বা উদাসীন হয়ে থাকবে না, এদের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বন্ধন স্থাপন ক’রে এদের বান্ধব ও সহায় করতে পেরেছেন— এজন্য তিনি ঈশ্বরকে ও গুরু-বন্ধু-উপদেষ্টা বাসুদেবকে শত শত ধন্যবাদ দেন।

এই কন্যা দুটির প্রথমা হলেন সুদূর পার্বত্য অঞ্চলবাসী নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলূপী।

উলূপী কোন এক ব্রত উপলক্ষে গঙ্গাস্নানে এসেছিলেন। দৈবের যোগাযোগে ধনঞ্জয় ফাল্গুনীও সেইদিন সেখানে সমাগত। প্রভাতে স্নানের সময়— তিনি যথারীতি ইষ্টপ্রণামাদির পর গঙ্গাজল মাথায় দিয়ে জলে নেমেছেন। নয়নপ্রিয় শ্যামবর্ণের সেই যশস্বী-শিল্পীখোদিত সুনিপুণ ভাস্কর্যকর্মের মতো সুগঠিত অনিন্দ্যসুন্দর অনাবৃত বলিষ্ঠ দেহের দিকে দৃষ্টি পড়ে পলকে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন উলূপী, চোখ ফেরাতে পারেন নি।

ফেরাবার প্রয়োজনও বোধ করেন নি অবশ্য। সরল পার্বতীরা এ ধরনের নাগরিক শালীনতাবোধে অভ্যস্থ নয়। মনোভাব গোপন করার কোন প্রয়োজন বোধ করে না তারা, বরং সেটাকে কৃত্রিমতা ও মিথ্যাচারণ বলেই জানে।

সুন্দরী রমণীর মুগ্ধদৃষ্টির পূজা বীর্যবান পুরুষকে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করে। সেই বিচিত্র অমোঘ নিয়মে অর্জুনের দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয়েছিল।

মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনিও।

দ্রৌপদীর মতো আলোকসাধারণ রূপসী ইনি নন ঠিকই। আর্যাবর্তের যে ধরনের গাত্রবর্ণ বা দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে তাঁরা পরিচিত— এ তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানের গৌরবর্ণ রক্তাভ, এখানে পীতাভ। তবু সুগৌর, উজ্জ্বল— তাতে সন্দেহ নেই। পর্বতরাজদুহিতা সুউচ্চ-নাসা নন। কিন্তু নাসার খর্বতা মুখের শ্রী ও সৌকুমার্যকে খর্ব করতে পারে নি। বরং অর্জুনের মনে হ’ল এই দিব্যরূপা শ্রীপ্রদীপ্তা মনোরমা সুকুমারী তন্বঙ্গীর সুকোমল দেহলতার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ভারতের খড়্গনাসা একান্তই বেমানান। কন্যার দেহগঠন পুষ্পবল্লরীর মতোই নমনীয়, বুঝি বা ভঙ্গুর। যেন নবনীতকোমল বিশেষণ এই কুমারী-কন্যাকে দেখেই রচিত হয়েছিল।

কিন্তু অর্জুন সুশিক্ষিত, মার্জিত-রুচিসম্পন্ন। ভব্যতা, শালীনতাবোধ, মনোভাব দমনের শিক্ষা তাঁদের মজ্জাগত। ক্ষত্রিয় রাজবংশের প্রাথমিক শিক্ষা এটা। তিনি সবলে নিজের দৃষ্টি ও চিত্তকে সংযত করে স্নানান্তে ইষ্ট-আরাধনায় মন দিলেন। তাতে বিপরীত ফল হ’ল। উলূপী ইতিপূর্বে মহাবলবান পুরুষদেহের গঠনসৌকুমার্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন—এবার সেই বীর পুরুষের মুখের ভক্তি-তন্ময়তা ও ইষ্ট-তদগতভাবে ধ্যানমগ্ন মুখের জ্যোতিতে বিহ্বল হয়ে উঠলেন (এসব পরবর্তীকালে উলূপীর মুখে শোনা)।

অর্জুন পূজা স্তোত্রোচ্চারণ সমাপন করে তীরে উঠে গাত্রমার্জনা করছেন, অকস্মাৎ কতকগুলি পার্বত্য সৈনিক তাঁকে ঘিরে ধরল, এবং ঘটনার তাৎপর্য উপলব্ধি বা বাধা দেবার কোন চেষ্টা করার পূর্বেই তাঁকে কঠিন রেশম রজ্জুতে বেঁধে ফেলল। অস্ত্রধারণের কোন অবকাশই ঘটল না।

তাঁর সঙ্গী অনুচররা অবশ্যই বাধা দিতে গিয়েছিল। সেই সময়ই প্রায় অলৌকিক এক অভিজ্ঞতা হল ধনঞ্জয়ের। দেখলেন তাঁর সঙ্গীদের একটি শরনিক্ষেপ কার্যের মধ্যে এই তথাকথিত বর্বর পার্বত্য অধিবাসীরা সহস্র শরে আকাশ আচ্ছন্ন ক’রে ফেলে। পাণ্ডবপক্ষের কামুক ভল্ল প্রভৃতি অস্ত্র নিমেষে খান খান হয়ে পড়ল, অস্ত্রধররাও শায়ক-বিষে হতচেতন হলেন।

প্রথমটা তো সে অবস্থা দেখে অর্জুন তাদের প্রাণ সম্বন্ধেই হতাশ হয়েছিলেন কারণ তাঁর শোনা ছিল এই বন্যদের লঘুভার শরগুলি দৈর্ঘ্যে ক্ষুদ্র হলেও যেমন শাণিত তেমনি তীব্র বিষাক্ত। সাধারণত নাকি এগুলি সর্প-বিষলিপ্ত থাকে, দেহে বিদ্ধ হওয়া মাত্র সে বিষ শোণিতধারায় মিশে গিয়ে অনুপল-কয়েক মাত্রে আহত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়। সৌভাগ্যক্রমে দেখা গেল এরা তত মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে নি, ভেষজ-বিষ-মিশ্রিত শরে আচ্ছন্ন বা মূর্ছিত ক’রে ফেলেছিল মাত্র।

অর্জুন বাধা দেবার কি প্রতিবাদ করার অবকাশ পান নি। চোখের পলক ফেলতে যেটুকু সময় লাগে তার মধ্যেই তাঁকে বেঁধেছে ওরা। বন্ধন মুক্ত হবার প্রয়াস বৃথা এবং অযথা কষ্টকর জেনে সে চেষ্টাও করেন নি। সেই বন্দী অবস্থাতেই তিনি কিছুদূরে নাগরাজ ঐরাবত বংশীয় কৌরব্যের স্থানীয় প্রাসাদে নীত হলেন। অর্জুন নির্বাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, তাঁদের চেয়ে অনেক খর্ব ও কৃশকায় মানুষগুলি রণ-অশ্বের চেয়েও দ্রুতগামী, কষ্টসহ। তাঁর মতো বলিষ্ঠকায় পুরুষকেও একজন অনায়াসে পৃষ্ঠে বহন ক’রে অতি অল্প সময়ে দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করে নাগপ্রাসাদে নিয়ে গেল।

বুদ্ধিমান অর্জুন আরও মনে করেছিলেন, তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয় দ্বারা বুঝেছিলেন যে, এ চক্রান্তের মূলে ঐ তন্বঙ্গী রূপসী কন্যাটিই আছেন। আরও সেই জন্যেই তিনি বাধা দেবার বেশীরকম কোন চেষ্টা করেননি। তরুণী নারী যখন কোন ঈপ্সাযোগ্য তরুণকে বন্দী করে, তখন সেটাকে মধুর ও বৃহত্তর বন্দীদশারই ভূমিকা বলে বুঝতে হয়— সেখানে কোন দৈহিক অনিষ্টের আশঙ্কা থাকে না। বধ করা উদ্দেশ্য হলে সেই নদীতীরেই বধ করতে পারত।

যা আশা করেছিলেন— কৌরব্য-আবাসে উপস্থিত হবার পর আতিথেয়তা বা আদর যত্নের কোন ত্রুটি হ’ল না। মূর্ছাহত অনুচরগুলিরও সুব্যবস্থা হয়েছে জানা গেল তারা অন্যত্র থাকলেও রাজঅতিথি রূপেই সমাদৃত হচ্ছে। তখনও কিছু তন্দ্রাচ্ছন্নতা ছাড়া নাকি কোন বৈকল্য নেই তাদের।

অর্জুনের অনুমান সমর্থিত হতেও বিলম্ব হ’ল না। এই সব পার্বত্য বন্য লোক

বৃথা বাগজাল বিস্তার করতে, ভূমিকা করতে কি বক্তব্যকে বক্রদীর্ঘায়ত করতে শেখেনি। স্পষ্ট কথা সংক্ষেপে বলাই তাদের রীতি। কৌরব্যপুরে পূজা বা হোমাগ্নির ব্যবস্থা ছিল। দেখা গেল প্রতি প্রকোষ্ঠেই অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত। অর্জুন তাঁর নিত্যকার অভ্যাসমতোই তাঁর দেবকৃত্য শেষ করলেন। আহার্যও গ্রহণ করলেন বিনা প্রতিবাদে। কেন এই বন্দীদশা— অনাবশ্যক বোধে সে প্রশ্নও করলেন না কাউকে। তার প্রয়োজনও ছিল না। আহার শেষ হতে স্বয়ং উলূপীই তাম্বুল কর্পূর হস্তে দেখা দিলেন। অযথা কোন সঙ্কোচ বা বৃথা কালবিলম্ব না ক’রেই তিনি জানালেন যে তিনি অর্জুনের প্রনপ্রার্থী, অর্জুন তাঁকে গ্রহণ করলে কৃতার্থ হবেন।

বাসুদেবের অভয়বাণী ও উপদেশ মনে ছিল, ইচ্ছাও প্রতিকূল নয়— তবু অর্জুন আজন্মনাগরিক শিক্ষামতোই উত্তর দিলেন, ‘ভদ্রে, আমি দ্বাদশ বর্ষের জন্য ব্রহ্মচর্য অবলম্বন ক’রে দেশভ্রমণে ব্রতী হয়েছি, এ সময় নারী সহবাস কৰ্তব্য নয়।’

উলূপী গৃহে প্রবেশ পর্যন্তই অর্জুনের মুখের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন, সে দৃষ্টিতে এখন ঈষৎ কৌতুকের হাসি খেলে গেল, সে হাসি সঞ্চারিত হল তাঁর অধরকোণেও। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীনের চাতুর্য বুঝতে পেরে বা প্রার্থনা প্রত্যাখ্যানের জন্য অপরপক্ষ কোন কৌশল অবলম্বন করবে তা পূর্বাই জেনে প্রস্তুত থাকলে সেই প্রত্যাশিত যুক্তির সামনে যেমন আত্মপ্রসাদমিশ্রিত কৌতুকের হাসি হাসেন— উলূপীর হাসির ভঙ্গী কতকটা সেই রকমেরই।

তিনি স্থিরকণ্ঠে বললেন, ‘আপনারা নিয়ম করেছিলেন— আপনাদের মধ্যে কেউ যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে বাস করবেন তখন অপর কোন ভ্রাতা সেই স্থানে গেলে দ্বাদশ বর্ষের জন্য নির্বাসনদণ্ড গ্রহণ করবেন—স্বেচ্ছা-নির্বাসন। তার মধ্যে ব্রহ্মচর্যের প্রশ্নই ছিল না। এর মধ্যে যেটুকু ব্রহ্মচর্য পালন করণীয় সে কেবল পট্টমহাদেবী দ্রৌপদী সম্বন্ধেই, অর্থাৎ যেটুকু নির্বাসনজনিত দূরত্বের ফলে অবশ্যম্ভাবী, স্বতঃসিদ্ধ। অপর নারীগ্রহণ আপনার ইচ্ছাধীন, তাতে কোন বাধা নেই।

বিস্ময়ের অন্ত রইল না অর্জুনের। ।

ইন্দ্রপ্রস্থ হতে বহু দূরে এই দেশ, এখানের সঙ্গে তাঁদের দূতবিনিময়ও হয় না। তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসনও এমন কোন গুরুতর ঘটনা নয় যে দেশে দেশে সে বার্তা আপনিই ছড়িয়ে যাবে। তবে? এক্ষেত্রে এই অনুমানই স্বাভাবিক যে, এই সংবাদটা কেউ ভেবে দেখে, হিসাব ক’রে প্রয়োজন বুঝে পূর্বাই প্রেরণ করেছে।

কিন্তু তেমন কার গরজ পড়ল? কার এত স্বার্থ এই ব্যাপারে?

তবে কি বাসুদেবই—? এ মিলন কি তাঁরই কাম্য, পূর্বকল্পিত?

কে জানে! বাসুদেবের পক্ষে সবই সম্ভব, তা সত্বেও যেন বিশ্বাস হয় না।

এ গভীর রহস্যেরও যেন তল পান না।

বেশী চিন্তারও অবসর নেই। এই তরুণী বরনারীর দুই চক্ষুতে একাগ্র কামনার বহ্নি, যেন সর্বস্ব নিবেদনের ডালা সাজিয়ে আরতি করছে, সমগ্র সত্তা ওঁর জন্য উৎসুক, উন্মুখ, উৎকণ্ঠ। সে আরতি সে পূজা ওঁরও অরুচিকর নয়।

তবু একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কন্যার সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করে নিয়ে বললেন, ‘কিন্তু সুহাসিনী, তুমি তো পরপূর্বা। ইতিপূর্বে নিশ্চয়ই তোমার বিবাহ হয়েছিল—?’

উলূপী এ অভিযোগে কিছুমাত্র লজ্জিত হলেন না, অকম্পিত কণ্ঠেই উত্তর দিলেন, ‘আমি বিধবা কিন্তু অনপত্যা। বিবাহের অল্পকাল পরেই আমার স্বামী নিহত হয়েছেন। আমার অতৃপ্ত কামনা পূর্ণ করলে, আমাকে সন্তান দান করলে, আপনার ধর্মপালনের পুণ্য হবে।… আর, ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্মদান তো আপনাদের বংশে নতুন কোন ঘটনা নয়।

আবারও চমকে উঠলেন অর্জুন। এই মেয়েটি যেন সব জানে, তাঁদের সব সংবাদ রাখে। অন্তরঙ্গ গোপন তথ্যও কোনটা জানতে বাকি নেই। হয় এ মায়াবিনী বা কোন অলৌকিক শক্তিসম্পন্না, নয় তো কেউ পূর্বাই ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখার জন্য একে সব কিছু জানিয়ে দিয়ে গেছে, ওঁর সম্ভাব্য আপত্তির প্রতি-যুক্তিগুলি যুগিয়ে দিয়ে গেছে।

এই শেষের সম্ভাবনার কথাটাই ভাবতে ভাল লাগল তাঁর।

আর কোন প্রতিবাদ করলেন না অর্জুন। তৃষ্ণার সময় সুপেয় পানীয় মুখের কাছে এগিয়ে এলে তা প্রত্যাখ্যান করা মূর্খতা।

উলূপীর ঈপ্সা পূর্ণ করে– তাঁর কায়মনোবাক্য-নিবেদিত পূজা গ্রহণ করে অর্জুন তৃপ্ত হলেন। এই পর্বতদুহিতারা সর্বতোসেবায় পুরুষের মনোরঞ্জন করতে পারে— সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না তাঁর। সে সুমধুর বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি পরবর্তী সারাজীবনই বহন করেছেন তিনি। তার পর বহু সুসভ্যা সুশিক্ষিতা নাগরিকাদের সংস্পর্শে এসেছেন, সাহচর্য লাভ করেছেন— তবু বারে বারেই মনে হয়েছে তাঁর— এ অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। মনে রয়েছে এসব রাজৈশ্বর্য, এই ঠাট— এই সমস্যা-দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের বোঝা ফেলে সেই প্রণয়সর্বস্ব চিত্তসর্বস্বা পার্বতী নারীর কাছে চলে যান।

অত্যাশ্চর্য দুটি নারীরত্নের দ্বিতীয়া হলেন মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা।

এঁর অবশ্য বেঁধে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় নি। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন নিজেই এসে ধরা দিয়েছেন, বন্ধনকে আকাঙ্ক্ষিত, শ্রেয় বোধ করেছেন।

পথেই দেখা।

কৌতূহলী ধনঞ্জয় অনির্দেশ্য ভাবেই নগরের পথে ভ্রমণ করছেন এদেশের অনুন্নত-নাসা গৌরকান্তি বিনত মানুষগুলিকে যেমন ভাল লাগছে, তেমনি এখানের ঘরবাড়ির অনাড়ম্বর লঘু অথচ নয়নানন্দ নির্মাণ-কৌশল, বিপণি- সজ্জা পরিচ্ছদ-পারিপাট্য—সর্ব ক্ষেত্রেই মার্জিত রুচি ও সূক্ষ্ম শিল্প-বোধের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হচ্ছেন।

দ্রুততারও কোন হেতু ছিল না, অন্যমনস্ক হয়েই পথ অতিক্রম করছেন—অকস্মাৎ অপ্রশস্ত যানবাহনবিরল পথে অশ্বপদশব্দ শুনে সচকিত হয়ে ফিরে তাকিয়ে পলকের মধ্যে চমৎকৃত— যেন স্থাণু হয়ে গেলেন।

এ শব্দ তাঁর পরিচিত। বিস্ময় সেইখানেই, চমকিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সেই কারণেই। অভিজ্ঞ বীরযোদ্ধা যে ভাবে অশ্ব পরিচালনা করেন সেই ভাবেই কেউ অশ্বচালনা ক’রে আসছেন। কোন অলস ধনী ব্যক্তির বিলাসভ্রমণ নয় এ– যে ব্যক্তি আসছে সে অশ্বারোহীরূপেই যুদ্ধবিদ্যাশিক্ষা করেছে, হয়ত যুদ্ধও করেছে এ বিষয়ে তার পটুতা সন্দেহাতীত।

কিন্তু সে কোন অনুমানের সঙ্গেই এ বর্তমান দৃশ্য মিলল না।

এ কী দেখলেন।

কোন বীরযোদ্ধা নয়, এমন কি পুরুষও নয়। এক অতি সুন্দরী নারী— সুমধ্যমা, সুশ্রোণী, সুস্তনী, সুগৌরী, সুগঠিতদেহা নবযুবতী কন্যা সেই সংকীর্ণপথে অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে পথিক ও অন্যান্য যানবাহনের বাধা এড়িয়ে সবেগে স্বচ্ছন্দে অশ্ব পরিচালনা করে চলে গেলেন।*

[* মহাভারতে আছে, ‘বরারোহা চিত্রাঙ্গদাকে যদৃচ্ছা নগরপথে ভ্রমণ’ করতে দেখেছিলেন অর্জুন। অভিধানে বরারোহা শব্দের দুটি অর্থ আছে : সুনিতম্বিনী, উত্তম যানবাহন-আরূঢ়া। আমি শেষের অর্থটিই গ্রহণ করেছি। রাজার পুত্রিকা কন্যা পায়ে হেঁটে পথে ঘুরছিলেন তা মনে করার কোন হেতু নেই।–লেখক।]

তাঁর প্রায় পুরুষের বেশ, ঘোড়ার পিঠে পুরুষের মতোই বসেছেন ঋজু ও অনায়াস-নির্ভয় ভঙ্গীতে বাম হস্তে বলগা, দক্ষিণ হস্ত কোমরবন্ধের খড়ো কিন্তু বর্মচর্ম কিছু নেই, অর্থাৎ মনে হল এদেশে তিনি কোন শত্রুর আশঙ্কা করেন না, অথবা কোন শত্রুকেই আশঙ্কার যোগ্য মনে করেন না— সম্ভবত আদৌ কোন আশঙ্কাই নেই তাঁর মনে।

কিন্তু বীরচিত্তে মোহ আনয়নের সে-ই একমাত্র কারণ নয়। বীর্যবান রণকুশলী যোদ্ধার ভঙ্গী ও ভাব, অথচ কী সুকুমার তাঁর মুখশ্রী কী লতার মতো কোমল তাঁর দুটি বাহু কজ্জলাঙ্কিত দুটি আয়ত নেত্রে কী মোহমদির দৃষ্টি শিশিরধৌত পুষ্পের মতো নির্মল কলুষলেশবিহীন অপরূপ মুখ নিবিড় কৃষ্ণকেশরাশি গ্রন্থিবদ্ধ কিন্তু কিছু কিছু স্খলিত হয়ে বাতাসে উড়ছে, দুটি-একটি চূর্ণকুন্তল স্বেদজড়িত হয়ে সেই সপ্তমীচন্দ্রের মতো চারুললাটে পত্রলেখার কাজ করছে ঈশ্বরের আশ্চর্য সৃষ্টি সে নারীর দিকে চাইলে পলকে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়, পলক পড়েও না চোখে।….

প্রায় এক দণ্ডকাল সেই ভাবেই স্তম্ভবৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃষ্টি স্থির অথচ শূন্য। কোন প্রদীপ্ত তেজস্মান বস্তুতে চোখ পড়লে দৃষ্টি যেমন বহুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, সেই দীপ্ত পদার্থের আকারে একটা কৃষ্ণছায়া চোখের সামনে ভাসে— তাঁরও তেমনি ভাসছে। সে ছবি আর নেই, বিদ্যুল্লেখার মতো ক্ষণিক জ্বলে উঠেছিল— কিন্তু ছায়াটা আছে।… কী দেখলেন তা ধারণা করতে পারছেন না ঠিক, শুধু যা দেখলেন তা বড় সুন্দর, এমন অভিরাম ছবি ইতিপূর্বে আর কখনও চোখে পড়ে নি— এই কথাই মনে হচ্ছে বার বার। সুন্দর, অতি সুন্দর।

বহুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে এলে দেখলেন চারিপাশে অগণিত পথিকের কৌতূহলী দৃষ্টি তাঁর উপর নিবদ্ধ। তাঁর বিহ্বলতা— কারণ অনুমান ক’রে— অনেকের চোখেই কৌতুক হাস্যের সৃষ্টি করেছে। এ-বিসদৃশ প্রাকৃতজনোচিত অবস্থার জন্য লজ্জিত বোধ করলেন অর্জুন, নিজেকে সংযত করে নিতেও বিলম্ব হ’ল না। অকারণেই নিজ আচরণের স্বপক্ষ-যুক্তি প্রয়োগ করতে গেলেন, একজনকে বললেন, ‘এ ভাবে কোন নারীকে পুরুষের মতো অশ্বারোহণ ও অশ্বচালনা করতে দেখি নি তো— একটু হতবাকই হয়ে গেছি—’

সে বৃদ্ধ পথিক স্মিতহাস্যে উত্তর দিলেন, ‘সৌম্য, আপনাকে বিদেশী বলে বোধ হচ্ছে, নইলে এত বিস্মিত হতেন না। যাঁকে দেখলেন তিনি কোন সামান্যা নারী নন, উনি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। উনি পুরুষের মতো, যুবরাজের মতোই রাজ্যশাসনে পিতাকে সাহায্য করেন, তাঁর কাছে রাজনীতি ও শস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন।

রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা! মণিপুর রাজকন্যা!

অর্থাৎ একেবারে অলভ্য নয় অসম্ভব নয় মিলনাকাঙ্ক্ষা।

তবু দু দিন অপেক্ষা করলেন অর্জুন, নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। নগরীর উপকণ্ঠে স্কন্ধাবার স্থাপন ক’রে ছিলেন— সহজে বা বিনা কারণে নিজের পরিচয় দেবার ইচ্ছা ছিল না। সেইখানেই একান্তবাস করলেন দু দিন তিন রাত্রি। কিন্তু তাতেও, প্রাণপণে নিজের অন্তরাবেগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও, যখন চিত্তদমন বা প্রবৃত্তিসংযম করতে পারলেন না, ঈপ্সার হ’ল না উপশম— তখন সাড়ম্বরে দেহরক্ষী দূত ঘোষক অনুচর প্রভৃতি নিয়ে রাজোচিত মর্যাদায় রাজপুরী অভিমুখে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে তাঁর জনৈক দেহরক্ষী প্রাসাদ-দেহলীর সম্মুখে রাখা দুন্দুভিতে আঘাত দিয়ে ঘোষণা করল, ‘কুরুবংশ-গৌরব ধর্মাত্মা মহারাজা যুধিষ্ঠিরের অনুজ মহাবীর অর্জুন ভারত প্রদক্ষিণে বেরিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। শত্রুরূপে বা এ রাজ্যের অনিষ্ট কামনায় নয়, যুদ্ধ কি রাজ্যজয়ের অভিপ্রায়েও নয়— প্রীতি ও সৌজন্য-বিনিময়ের উদ্দেশ্যে, বন্ধু ও সমানধর্মী ক্ষত্রিয় রাজা হিসাবেই তিনি মণিপুরাধিপতির দর্শনপ্রার্থী।’

অর্জুনের শৌর্য, শস্ত্রবিদ্যায় তাঁর অত্যদ্ভুদ পারদর্শিতার কাহিনী বহু দেশ অতিক্রম ক’রে এই সুদূর পূর্বপ্রান্তেও পৌঁছেছিল। তাঁর আগমন সংবাদ অপ্রত্যাশিত, বিশেষ বন্ধুরূপে, সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য। রাজা চিত্রবাহন শশব্যস্তে প্রত্যুদগমন করে সম্বর্ধনা জানালেন। পাদ্য অর্ঘ্য পানীয় ইত্যাদি যথাযথ নিবেদন করা হ’ল অতিথিদের শ্রেণী ও পদবী হিসাবে বাসস্থান ও সিধা, পাচক সেবক প্রভৃতিরও ব্যবস্থা হ’ল। অর্জুনের জন্য নির্দিষ্ট হল প্রাসাদের শ্রেষ্ঠ কক্ষ।

চিত্রবাহন ওঁর দুই হাত ধরে নিজের আসনে বসিয়ে বললেন, ‘এই শুভ আগমনে আমি যে কী পরিমাণ সম্মানিত বোধ করছি ও আনন্দিত হয়েছি— তা বলতে পারব না। আশা করছি মহারাজ যুধিষ্ঠির ও আপনার অন্যান্য ভ্রাতারা কুশলেই আছেন। হস্তিনাপুরের রাজপরিবারেরও অবশ্যই মঙ্গল। সুতরাং আমার প্রার্থনা আপনার মণিপুর অবস্থিতি দীর্ঘায়ত হোক, অন্তত বৎসরকাল এদেশে অবস্থান করুন। এখানে ভোজ্য পানীয়ের অভাব হবে না, শিকারের সুযোগ প্রচুর, মণিপুর নৃত্যগীতাদি ও অভিনয়ের জন্য প্রসিদ্ধ—এ রাজ্যের অধিবাসীরা অনেকেই নৃত্যকলা ও সঙ্গীতশাস্ত্রে পারঙ্গম—আপনার চিত্তবিনোদনে অপারগ হবে বলে মনে হয় না।’

‘রাজশ্রেষ্ঠ, আমার দীর্ঘতর অবস্থিতি আপনার আনুকূল্যের ওপরই নির্ভর করছে।’ বলে উঠলেন অর্জুন।

সৌজন্য প্রকাশ, অভ্যর্থনাপর্ব, প্রতি-আমন্ত্রণ, কুশল-বিনিময়—রাজ-আতিথ্যের সর্বজনস্বীকৃত প্রারম্ভিক ভূমিকা। কোন গূঢ় উদ্দেশ্য বা প্রার্থনা থাকলে এইসব প্রাথমিক সবিনয় কথোপকথনের পর তা জানাতে হয়। এই-ই নিয়ম। কিন্তু অর্জুন এই গত দু দিনে ধৈর্য ও স্থৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় এসে পড়েছেন। তাঁর ধমনীতে তখন রক্তস্রোত উত্তাল, আশা ও আশঙ্কায় তিনি কণ্টকিত, ক্ষতবিক্ষত কামনায় বাসনায় চিত্তাবেগ অসম্বরণীয় হয়ে উঠেছে। তাঁর আর বিলম্ব সইছে না। তিনি বললেন, ‘রাজন, রাজকীয় আতিথ্যের প্রধান অঙ্গ হ’ল উপহার বা উপঢৌকন বিনিময়। আমি পথিক, খুব বেশী কিছু আনতে পারি নি, কতকগুলি নবনির্মিত নূতন পদ্ধতির অস্ত্র এনেছি মাত্র। আশা করি তা সামান্য হলেও আপনার কাছে অরুচিকর বা অকিঞ্চিৎকর বোধ হবে না। কিন্তু মহারাজ, আমি যদি প্রগলভের মতো কোন উপহার পূর্বেই যাচঞা করে নিই, তাহলে সে নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতা আশা করি বয়ঃকনিষ্ঠ হিসাবে মার্জনা করবেন এইটুকু আশ্বাস বা প্রশ্রয় প্রার্থনা করছি।’

‘অবশ্য, অবশ্য। যাচঞা কি, আদেশ বলুন। আপনি নিঃসঙ্কোচে আপনার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে পারেন। নিজের সম্মান ও ধর্ম ছাড়া যা চাইবেন, সাধ্যে থাকলে অবশ্যই পূরণ করব।’

‘মহারাজ, আমি আপনার চারুদর্শনা কন্যা চিত্রাঙ্গদার পাণিপ্রার্থী।

রাজা চিত্রবাহন উপহার প্রার্থনার কথা শুনে ঈষৎ শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। এখন সে সংশয়ের ভ্রূকুটি রেখা মিলিয়ে গেল বটে, কিন্তু রাজা চিত্রবাহন যেন গম্ভীর ও অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন, ‘তৃতীয় পাণ্ডব, পাত্র হিসাবে আপনি পৃথিবীর কোন কন্যারই অকাম্য নন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি অন্য জটিলতা আছে। পিনাকধৃত ভগবান উমাপতির ইচ্ছায় আমাদের বংশে সকলেরই একটি ক’রে সন্তান হয়। এর আগে অবশ্য আমার পূর্বপুরুষদের পুত্রই হয়েছিল, দৈবক্রমে আমারই ঐ কন্যাটি লাভ হয়েছে। অন্য অপত্য আর সম্ভব নয় বলে আমি ঐ কন্যাকে পুত্রিকারূপে পালন করেছি অর্থাৎ ওর গর্ভজাত পুত্র আমাদের বংশধর বলেই গণ্য হবে, এবং এই সিংহাসনও সে লাভ করবে। সে সন্তানের ওপর তার জন্মদাতা বা তার বংশের কোন অধিকার থাকবে না। আমার কন্যা এই রাজ্যের ভাবী শাসক, তারও পতিগৃহবাস সম্ভব নয়। আপনি যদি এই শর্তে আমার কন্যা গ্রহণ করতে সম্মত থাকেন— আমি সানন্দে সাহ্লাদে তাকে আপনার হাতে সমর্পণ করব।’

ক্ষুধার্তের সম্মুখে লোভনীয় সুধাঘ্রাণরুচি সুখাদ্য— তার তখন খাদ্যের গুণাগুণ, দাতার শর্ত, নিজের কতটা প্রাপ্য বা অধিকার—এসব কোন কথাই মনে থাকা সম্ভব নয়। অর্জুনও এসব কোন কথা বিচার করে বৃথা সময় নষ্ট করলেন না । তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিলেন।

তিনি এই বধূ ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্তও নন তত।

দুদিনের সম্ভোগেচ্ছা মিটে গেলেই ভারত-পরিক্রমায় আবার বেরিয়ে পড়বেন, সঙ্গে স্ত্রীলোক না থাকাই বাঞ্ছনীয়। অর্জুনের হিসাবে একটু ভুল হয়েছিল। চিত্রাঙ্গদার পূর্ণ মূল্য সেদিন নির্ধারণ করতে পারেন নি।

এর পরে এক দুই করে মাসগুলো কোথা দিয়ে কেটে গেল তা বুঝতেও পারলেন না ফাল্গুনী। মাসকয়েক এখানে থেকে বর্ষার প্রারম্ভে চলে যাবেন—এই রকমই মনে ছিল তাঁর। আসলে এতদিন যে কেটেছে, তাঁর এই অবস্থানকাল যে এত প্রলম্বিত হয়েছে, তা অনুভবই করতে পারেন নি। যে আনন্দ উন্মত্ততায় স্থান-কাল-পাত্রের হিসাব থাকে না— সেই আনন্দের ঘূর্ণাবর্তেই দণ্ড পল দিন রাত্রি পক্ষ মাস বৎসর একাকার হয়ে গেছে তাঁর। আনন্দ আর বিস্ময়। উলূপীকেও ভাল লেগেছিল, কিন্তু তার মধ্যে এত নব নব বিস্ময় আবিষ্কার করেন নি। তাই সে গর্ভবতী হতেই তিনি নাগরাজ্য ত্যাগ করেছেন— কী সন্তান হ’ল তা জানার জন্য অপেক্ষা করার কথাও মনে হয় নি তাঁর। এখানে তার বিপরীত। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গ-সাহচর্য ত্যাগ করার কথাই ভাবতে পারেন নি। এমন কি সে অন্তঃসত্বা, সন্তানসম্ভবা হবার পরও না।

আসলে চিত্রাঙ্গদার অপরূপত্ব শুধু দেহে নয়—যা অতি ক্ষণস্থায়ী যৌবনেই সীমাবদ্ধ— চিত্রাঙ্গদার অপরূপত্ব চিরনবত্বের কোন সীমা নেই, শেষ নেই।… কোমলে কঠোরে, সংযমে আবেগে, প্রেমে কর্তব্যপরায়ণতায়, রাজকার্যে সেবাব্রতে— অভিনব সে। দিনে রাতে অবিরাম নব নব রূপে উদ্ভাসিত, উজ্জ্বলিত। একদিকে প্রেমিকা নারী, সরলা প্রণয়বিধুরা— মনে হয় কামসর্বস্বা—অন্যদিকে রাজকার্যে রাজনীতিতে ধীরস্থির, অতীব বুদ্ধিমতী, কূটকৌশলী আবার শিকারে অস্ত্রচালনায় তার দ্বিতীয়া নেই। অর্জুন আলোচনা ক’রে দেখলেন যুদ্ধবিদ্যাতেও সে শিক্ষার্থী নয়, রণ-কৌশলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্বও তার আয়ত্ত।

এইভাবে অর্জুনের মানসপটে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় চিত্রাঙ্গদার। যখনই মনে হয় দেখা শেষ হয়ে গেছে ওঁকে, তখনই আর এক নতুন রূপ প্রকাশ পায়। বিস্ময়ের অবধি থাকে না। এ নারীর সাহচর্যে ক্লান্তি বোধ হয় না, কোন অভিজ্ঞতার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। দ্রৌপদীও অসাধারণ, অতুলনীয়া, কিন্তু তিনি মহিষী, প্রেয়সী। চিত্রাঙ্গদা তার থেকেও বেশী–বন্ধু বয়স্যা। জীবনের সর্বকার্যে সর্বদা সঙ্গিনী হবার যোগ্যা। অর্জুনের মনে হয় তাঁর আদর্শ অর্ধাঙ্গিনী।

শেষে একদিন— সুদীর্ঘ তিন বৎসর অতিবাহিত হয়ে যাবার পর— সুপ্তোত্থিতের মতো সচেতন হয়ে উঠলেন অর্জুন। মনে পড়ল ভারত-পরিক্রমার পথে এখনও বহু রাজ্য বাকি আছে। যে কাজের জন্য বাসুদেব পাঠিয়েছিলেন, যে ব্রত দিয়ে— তা আজও অসমাপ্ত, অথবা অর্ধসমাপ্ত মাত্ৰ।

এই অবসরে চিত্রাঙ্গদার একটি পুত্রসন্তানও হয়েছে। অতিপ্রিয়দর্শন, অর্জুনের সমস্ত লক্ষণ নিয়ে জন্মেছে। এ ছেলেকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়। …এই কি মায়ার বন্ধন? নিজেকেই প্রশ্ন করেন মধ্যে মধ্যে, নইলে এমন বোধ হচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে এই তো বেশ, কী হবে দুরাশার পিছনে ছুটে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি খুঁজে?…

ক্ষণিকের এই আত্মবিস্মৃতি ও চিত্তদৌর্বল্যকে জয় করতেও অবশ্য অর্জুনের খুব একটা বিলম্ব ঘটে না। এক সময় মনকে দৃঢ় করে তুলে বিদায় প্রার্থনা করেন চিত্রাঙ্গদার কাছে।

চিত্রাঙ্গদা তখন যৌবরাজ্যে অভিষিক্তা, প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের শাসক। সাধারণ নারীর মতো দুর্বলতা তাঁর নেই। তবু এই গত দীর্ঘ তিন বৎসরকাল যে সুখস্বপ্নের মতো কেটে গেছে— তা থেকে রূঢ় বাস্তবে জেগে উঠে বিচলিত বোধ করেন বৈকি, বিহ্বলা হয়ে পড়েন।

অর্জুনের মতো স্বামীকে, সম্ভবত চিরদিনের মতো ছেড়ে দেওয়া? তিনি বাষ্পাকুল নেত্রে স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে বলেন, ‘আর সামান্য কিছু কালও কি থেকে যাওয়া যায় না?’

‘না সুচরিতে,’ অর্জুনও গাঢ় কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘এমনিই বহুদিন অলস সুখ-সম্ভোগে কেটে গেছে। আমরা ক্ষত্রিয়, রাজপুত্র, কর্তব্য আমাদের ব্যক্তিগত সকল বিবেচনার ঊর্ধ্বে। তোমার এই নিরুপায় স্বামীকে তুমি অবশ্যই কর্ম- কর্তব্যহীন হতভাগ্য ক্লীব বা নপুংসকরূপে দেখতে চাও না। …আর, যখনই যেদিনই যাব তখনই তোমার দুঃখ বোধ হবে। তুমি তো সামান্যা সাধারণ স্ত্রীলোক নও, তোমার এ দুর্বলতা শোভা পায় না। তুমি হাসিমুখে বিদায় দেবে— এইটেই আশা করি।

চিত্রাঙ্গদা তাঁর প্রিয়তমকে আরও নিবিড় বাহুবন্ধনে আবদ্ধ ক’রে তাঁর সুপ্রশস্ত বক্ষ অশ্রুতে সিক্ত করে ব্যথাবিকৃত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি রাজা চিত্রবাহনের পুত্রিকা—রাজধর্মের দায়িত্বসূত্রে বাঁধা— কিন্তু সে বন্ধন আমার দেহের, কর্তব্যবুদ্ধির—আমার মুখের হাসি কারও ক্রীতদাস নয়। হাসি বা চোখের জল কর্তব্যের ধার ধারে না!’ ।

বীর অর্জুনের চক্ষু দুটিও কি সিক্ত হয়ে উঠেছিল? কে জানে? তবে তিনি কিছুক্ষণ উত্তর দিতে পারলেন না। অনেক পরে বললেন, ‘আমি তোমার দ্বারে ক্ষণিকের অতিথি— তা জেনেই তো আমাকে মাল্যদান করেছিলে!’

ম্লান হাসি হাসলেন বোধ হয় চিত্রাঙ্গদা, বললেন, ‘আমি আপনাকে মাল্যদান করি নি, আপনি কেড়ে নিয়েছেন। তবে সে কথা থাক। মন কি এত বিচার ক’রে চলে? না হ’লে সব জেনেও—আপনি আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিবাহ করবেন কেন? আপনি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন না, আমি আপনার একমাত্রও নই— এসব কথা তো তখন বিচার করেন নি!… আমি কোন অনুযোগ করছি না, শুধু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—মানুষের মন, তাদের প্রেম–কর্তব্য ধর্ম প্রয়োজন এসব বিচার করে চলে না।’

এবার অর্জুন সম্পূর্ণ নিরুত্তর রইলেন।

অবশেষে একসময় চিত্রাঙ্গদাই বাহুপাশ শিথিল করেন। চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘যান আপনি, আর বাধা দেব না। ভাগ্যের বিধান অলঙ্ঘ্য জেনেও তার দুয়ারে মাথা কোটার প্রবৃত্তি আমার নেই, তাতে আমার ললাটই ক্ষতবিক্ষত হবে… ভবিষ্যৎ পরিবর্তিত হবে না। আমি ভিক্ষাতেও অভ্যস্ত নই। আমরা অনার্য পার্বত্য নারী— আমরা ভালবাসি নিঃশেষে নিঃশর্তে, নিজের বলতে কিছুই রাখি না। প্রেম আমাদের নিঃসপত্ন, সেখানে একটিই মাত্র পুরুষ, একেশ্বর। আপনারা সুসভ্য আর্যাবর্তবাসী, একই হৃদয় বহু নারীকে দিতে অসুবিধা হয় না। আপনারা আমার কথা বা ব্যথা বুঝবেন না, আমি আপনার বহু প্রেয়সীর একজন, অথবা প্রেয়সী বলাও ভুল— ভোগ্যবস্তুর মতোই। প্রহরান্তরেই বিরহ ব্যথা ভোলার জন্য অন্য নারী গ্রহণ করতে পারবেন, তা ভুলতেও বিলম্ব হবে না, কিন্তু আমার জীবনে কোন সান্ত্বনা কোন আশ্রয় আর রইল না। ‘

বলতে বলতে কিছু পূর্ব-উচ্চারিত দার্ঢ্য সত্বেও—আবেগে ভেঙে পড়েন রাজকন্যা, বলেন, ‘কিন্তু সত্যিই আর কি কোনদিন দেখতে পাব না? আর দেখা হবে না? শুধু যদি আর একটি বার কাছে পেতাম। মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলা বাকি রয়ে গেল, জীবনের এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে আপনার পায়ে সঁপে দিতে— এই অহঙ্কার, চরিত্রের দৃঢ়তা সব বিসর্জন দিয়ে আপনার কাছে ভিখারিণী হয়ে দাঁড়াতে।… সে কি কিছুতেই সম্ভব নয়?

অর্জুন প্রণয়াবেগে গদগদ কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘প্রিয়তমে, শান্ত হও। ক্ষোভ করো না। যদি জীবিত থাকি, এ অঞ্চল পরিভ্রমণ শেষ হলে অবশ্য একবার আসব, অর্ধবর্ষকাল থেকেও যাব— তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তারপরও— অবসর আর সুযোগ মতো, কিংবা আমন্ত্রণ পেলে তুমিও ইন্দ্রপ্রস্থে যেতে পারবে, যাবে, এই আমার আশা। চিরদিনের জন্য না হোক, কিছুদিনের জন্য যেতে তো বাধা নেই। আমি আশ্বাস দিচ্ছি, সেখানে মহাদেবী দ্রৌপদীর পরেই মর্যাদার স্থান তোমার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে।’

তারপর ক্ষণকাল মৌন থেকে বললেন, ‘আর যদি কখনও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কারও কোন সংঘর্ষ উপস্থিত হয় – মণিপুর রাজশক্তির সাহায্য পাব তো?’

‘বলাই বাহুল্য, ন্যায়ত ধর্মত এ সিংহাসনের আপনিই অধিকারী। আমিও আপনাকে কথা দিচ্ছি, যদি বেঁচে থাকি— আপনার পুত্রকে আপনার উপযুক্ত সমযোদ্ধারূপেই দেখতে পাবেন, তাকে আত্মজ বলে পরিচয় দিতে কোনদিন লজ্জা পাবেন না। প্রয়োজন হলে রণক্ষেত্রে সে আপনার দক্ষিণ পার্শ্বে থাকবে।’

‘প্রিয়ে, আমি ধন্য, কৃতাৰ্থ।’

১২

অর্জুন তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। পূর্বাঞ্চল ত্যাগ করার পূর্বে আর একবার মণিপুর গিয়েছিলেন।

কিন্তু সে শুধুই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য।

প্রাণের আকৃতি অবশ্যই ছিল। বড় বেশী ছিল।

বেশী ছিল বলেই মনে হয়েছে বার বার যে, আর নতুন ক’রে সেই আকর্ষণগণ্ডীর মধ্যে— সে ঐকান্তিক, সর্বস্বসমর্পণ-করা প্রেমভাবের মধ্যে গিয়ে দরকার নেই।

মণিপুর ত্যাগ করার পর দীর্ঘকাল এক বিরাট শূন্যতা অনুভব করেছেন। এ অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম, আর সেই কারণেই বড় দুঃসহ। যখন দ্রৌপদীকে ছেড়ে আসেন তখনও ক্লেশ বোধ হয়েছিল, মনে হয়েছিল সেই বিচ্ছেদই মর্মান্তিক, আজ বুঝলেন কোন দুঃখ, ভাগ্যের কোন আঘাতই চূড়ান্ত মনে করার কোন কারণ নেই। দ্রৌপদী প্রিয়া, মহিষী, চিত্রাঙ্গদা তার থেকেও বেশী–দাসী, সখী, বান্ধবী, মর্মসঙ্গিনী। কেবলই মনে হয়েছে কদিন— যদি চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন! রণে বনে দুর্গমে সর্বত্র সে ওঁর আদর্শ জীবনসঙ্গিনী, সহমর্মিণী, সহধর্মিণী হতে পারত। রক্ষিকাও বটে। চিত্রাঙ্গদা মহা-বীর্যবতী, রণনিপুণা— সে পরিচয়ও পেয়েছেন ইতিমধ্যে।

সে দুর্বিষহ চিত্তবেদনার পুনরাবৃত্তি বাঞ্ছনীয় নয়, কিন্তু তিনি বাক্য-বদ্ধ— যেতেই হ’ল আর একবার। এবার আগে থাকতেই সতর্ক হয়ে ছিলেন, বেশীদিন থাকতে সম্মত হন নি। ছেলে বড় হয়েছে সে বৃহত্তর বন্ধন, বিপজ্জনক আকর্ষণ। ছেলে ওঁর ঋজুতা ও মায়ের সৌকুমার্য নিয়ে জন্মেছে। ফলে লক্ষের মধ্যেও লক্ষ্য হয় তাকে। এ ছেলেকে ও কাছে রাখতে ইচ্ছা করে বৈকি। নিজের মতো ক’রে মানুষ করতে সাধ হয়। যদিও চিত্রাঙ্গদার ওপর পূর্ণ আস্থা আছে ওঁর, তিনি মানুষই করবেন। সে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি দ্বিতীয় অর্জুন করেই একদা তাকে পিতার কাছে পাঠাবেন। প্রয়োজনের দিনে, বিপদের দিনে সে-শিক্ষার পরিচয় দেবে সে। চিত্রাঙ্গদা নিজে হয়ত যাবেন না কোনদিনই, কোনদিনই হয়ত দেখা পাবেন না আর–এক যদি অর্জুন নিজেই আবার এখানে আসেন কোন প্রয়োজনে তো দেখা হতে পারে—তবে বভ্রুবাহন যাবেন এ- আশ্বাস দিয়েছেন চিত্রাঙ্গদা।

তবু সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভরসায় এমন ছেলেকে ছেড়ে যেতে কার না কষ্ট হয়! এক একবার মনে হয় জোর ক’রেই নিয়ে যাবেন ছেলেকে ও ছেলের মাকে— অর্জুনকে বাধা দেবে কে?—পরক্ষণেই মনে পড়ে উনি চিত্রবাহনের শর্ত স্বীকার করে নিয়ে তাঁর পুত্রিকা-কন্যাকে বিবাহ করেছেন। ধর্মে বদ্ধ।

তাই আবার একদা প্রিয়বিরহবেদনাভারাক্রান্ত চিত্তে নিঃসঙ্গ হয়েই বিদায় নিতে হয়। প্রায়শ্চিত্তের কাল তাঁর, ভারতখণ্ড পরিক্রমার ব্রত নিয়ে বার হয়েছেন, একক ভ্রমণই তো করার কথা। দুদিনের এই সুখলাভটুকু স্মৃতিতেই সঙ্গী হোক। যা হবে না, যা হবার নয়—তার জন্য বৃথা বিলাপ বা মনস্তাপে প্রয়োজন নেই।

পরিক্রমা বামাবর্তে করাই বিধি। অর্জুনও সেই ভাবেই যেতে লাগলেন। দক্ষিণে পৌঁছে সমুদ্রতীরবর্তী স্থান দিয়ে ভারতের পূর্ব উপকূল ভ্রমণ শেষ ক’রে রামেশ্বরমে পূজা দিয়ে পশ্চিম উপকূলে পড়লেন। বহু তীর্থে স্নান করলেন এই পথে, বহু দেবতা দর্শন হল। বহু জাতি, বহু আচার-আচরণ বিধিবিধানের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। বিপুল ও প্রাচীন অনার্য সভ্যতার কথা বলেছিলেন বাসুদেব, তবু সে যে এত প্রাচীন ও এত বিশাল তা অনুমান করতে পারেন নি অর্জুন। এখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় অভিভূত হলেন। এইসব নূতন অপরিচিত দেশে কোন কোন নারীর সঙ্গেও অন্তরঙ্গতার সুযোগ যে না ঘটল তাও না। ফলে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে বিচ্ছেদের নিদারুণ দুঃসহ দুঃখও ক্রমশ মন্দীভূত হয়ে এল।

পশ্চিম উপকূল ধরেই উত্তরের দিকে এগিয়ে গেলেন পার্থ। লক্ষ্য পূর্বেই স্থির ছিল— দ্বারাবতী।

বহুকাল বাসুদেবকে দেখেননি, ব্যাকুল ও বিষণ্ণ বোধ করছেন। একটু যেন অসহায়ও। তাছাড়া, যা দেখেছেন ও শুনেছেন, যে-বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে তা তাঁকে নিবেদন করে আলোচনা না করতে পারা অবধি স্বস্তি পাচ্ছেন না।

সৌরাষ্ট্রে পৌঁছে শুনলেন শ্রীকৃষ্ণ প্রভাসে অবস্থান করছেন। এই স্থানটি তাঁর বড়ই প্রিয়, মধ্যে-মধ্যেই এখানে এসে একা থাকেন। এটিকে বাসুদেবের চিত্ত-বিশ্রাম বলা চলে। কে জানে—এখানের সঙ্গে কোন প্রিয়স্মৃতি বিজড়িত আছে কিনা।

অর্জুনের অবশ্য ভাল হল। প্রথমত, ওঁরও প্রভাসে আসার ইচ্ছা বহুকালের— দেখবার ইচ্ছা স্থানটিতে কী এমন আছে যা ওঁর গুরু ও আত্মীয় পুরুষোত্তমকে এত আকৃষ্ট করে! দ্বিতীয়ত, তবু কিছুক্ষণ আগে দেখা পাবেন বাসুদেবের। পার্থ পূর্ব-সংবাদ পাঠানোর অপেক্ষা করলেন না, শেষে একদিন প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে রথ চালনা করিয়ে প্রভাসে পৌঁছলেন।

কিন্তু দেখা গেল উনি সংবাদ না পাঠালেও বাসুদেবের এ শুভাগমন বার্তা পেতে কোন অসুবিধা হয় নি। প্রভাসের প্রবেশপথেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। আবারও সেই আতঙ্ক-বিস্ময়মিশ্রিত সম্ভ্রমের ভাব বোধ করলেন অর্জুন। সত্যই কি অন্তর্যামী এই মানুষটি—যাঁকে সখারূপে আত্মীয়রূপে ভাবতেই ভাল লাগে?

শ্রীকৃষ্ণ ওঁকে দেখেই নিবিড় আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। অর্জুন কি বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখনই ব্যস্ত হবার কোন কারণ নেই। দ্বাদশ বৎসর ধরে দেশভ্রমণের বিবরণ একদিনে বলা বা শোনা যাবে না। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত, তোমার ব্রতও শেষ, এখন তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বিশ্রাম করো। কথা যা কিছু কাল হবে।’

তবু রাত্রে পাশাপাশি শয্যায় শুয়ে কিছু কিছু বলতে গেলেন অর্জুন। দেখলেন, হয় বাসুদেব পূর্বেই সংবাদ পেয়েছেন, নয়তো প্রসঙ্গ শুরু করা মাত্র বুঝে নিয়েছেন— অথবা ঐ যা-সন্দেহ, তিনি অন্তর্যামী কিম্বা এ সবের তিনিই চক্ৰী। অর্জুন যা করেছেন যেখানে গেছেন, বাসুদেবই তার নিয়ন্তা, বাসুদেবের ইচ্ছার বাইরে যেতে পারেন নি।

বাসুদেব হেসে বললেন, ‘নাও, এখন নিদ্রা যাও। একা চিত্রাঙ্গদা হলে বলতাম তাঁকে স্বপ্ন দেখ— কিন্তু উলূপী, চিত্রাঙ্গদা, অপ্সরা ভগিনীরা— আরও কত সারা জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে আছে কে জানে! এ ক্ষেত্রে একজন কাউকে স্বপ্ন দেখে অনিদ্রায় কাটবে সে আশঙ্কা নেই।’

অর্জুন অপ্রতিভ হয়ে কি বলতে যাচ্ছিলেন, বোধ করি এ ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব কত কম সেইটেই প্রমাণ করতে চাইছিলেন, বাসুদেব বাধা দিয়ে বললেন, ‘না, না, এতে লজ্জার কোন কারণ নেই। আমি একটু পরিহাস করছিলাম মাত্র।… এ ভালই হল বন্ধু।দেশে দেশে আত্মীয়, দেশে দেশে বান্ধব, এইটেই আমি চেয়েছিলাম। পূর্বদিক অনেকটা নিরাপদ রইল, প্রাগজ্যোতিষপুরের ভগদত্ত খুব বেশী শত্রুতা করতে পারবেন না।’

পরদিনই দ্বারকা রওনা দিলেন কৃষ্ণার্জুন।

পূর্বদিন অর্জুনকে প্রত্যুদগমন করতে আসার মধ্যে, যাতে প্রভাসে এক দিন কালক্ষেপ হয়— তার একটা গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল বাসুদেবের। সেটি পরের দিন দ্বারকায় পৌঁছে বুঝতে পারলেন অর্জুন।

না, প্রথমে তাও বুঝতে পারেন নি।

নগরীর প্রবেশপথে, সমুদ্রতীরের পোতাশ্রয়েই বিরাট এক তোরণ নির্মিত হয়েছে, বিজয়তোরণ বিভিন্ন বিচিত্র পত্রপুষ্প-সম্ভার ও পতাকায় সুসজ্জিত, চারুচিত্রিত। নগরীতে প্রবেশ ক’রেও দেখলেন সর্বত্র উৎসব সজ্জা। প্রধান প্রধান রাজপথে অসংখ্য তোরণ, তোরণগুলির মধ্যে পুষ্পমাল্যের চন্দ্রাতপ। প্রতি গৃহেই উৎসব সমারোহ, প্রতি গৃহস্থই হর্ষ প্রকাশের জন্য প্রস্তুত, উন্মুখ।

সাধারণত রাজা কোন যুদ্ধে জয়লাভ ক’রে এলেই এ ধরনের উৎসব সমারোহ ঘটে। বিস্মিত অর্জুন প্রশ্ন করলেন, ‘এ যে বিজয়-মহোৎসবের আয়োজন। তবে কি বৃষ্ণিবংশীয়রা কোন যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন? না চিরশত্রু জরাসন্ধ নিহত হয়েছে?’

মৃদু হাসিতে বাসুদেবের মুখ রঞ্জিত হয়ে উঠল। কোন কৌতুকের ষড়যন্ত্র সফল হলে যেমন হাসে মানুষ— তেমনি। বললেন, ‘না, তেমন কিছু নয়। তবে ঠিকই অনুমান করেছ, এক বিজয়ী বীরের সংবর্ধনারই আয়োজন বটে।’

‘বিজয়ী বীর? কে সে?’ কণ্ঠে আহত বিস্ময়ের সুর।

তখনও বুঝতে পারছেন না অর্জুন কথাটা।

অবশ্য আর বেশী বিলম্বও হ’ল না।

বাসুদেব উত্তর দেবার পূর্বেই যে সমস্ত অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা উৎসব সাজে সজ্জিত হয়ে মাল্য চন্দন মধু ধূপ ইত্যাদি নিয়ে অভ্যর্থনার জন্য প্রধান রাজপথ ধরে আসছিলেন— তাঁরা অর্জুনকে দেখে ওঁর নাম যুক্ত ক’রেই জয়ধ্বনি ক’রে উঠলেন। সে জয়ধ্বনি প্রতিধ্বনির মতো পুনরুচ্চারিত হতে হতে বহুদূর অবধি তরঙ্গায়িত হ’ল।

পুনরুচ্চারিত হতে লাগল গৃহে গৃহে। অলিন্দগুলি থেকে পুষ্পবৃষ্টি ও মঙ্গলধ্বনি হতে লাগল।

‘এবার বুঝলে বন্ধু, কার অভ্যর্থনার আয়োজন!’ বাসুদেব সস্নেহ পরিহাস-তরল কণ্ঠে বললেন।

আনন্দ-লজ্জা-রঞ্জিত মুখে অর্জুন বললেন, ‘কিন্তু আমি তো কোন বিজয়লাভ করি নি, এ অকারণ সম্মানে বিব্রতই বোধ করছি যে।’

‘যুদ্ধে জয়লাভ তোমার মতো রণ-সুপণ্ডিত শস্ত্রশাস্ত্রজ্ঞর পক্ষে এমন কোন কঠিন কাজ নয় বন্ধু। তার চেয়ে অনেক কঠিন—দীর্ঘকাল ধরে যে সুদুশ্চর ব্রত তুমি পালন করেছ! এ কাজ ইতিপূর্বে কেউ করেন নি, অচিরভবিষ্যতেও কেউ করবেন বলে মনে করি না। বিজয়ী রূপে, রক্তবন্যা প্রবাহিত ক’রে নয়— বন্ধু রূপে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন জাতি- উপজাতি-সংস্কৃতি-ভাষার সঙ্গে এই যে যোগসূত্র স্থাপন করলে– যে কোন বৃহৎ যুদ্ধজয়ের থেকেও ঢের বেশী কঠিন কাজ এ, ঢের বেশী কৃতিত্ব!

অর্জুন মাথা নত ক’রে এই শুভেচ্ছা ও প্রশংসা গ্রহণ করলেন। ভাবাবেগে-বিচলিত তাঁর কণ্ঠ থেকে কোন উত্তর প্রকাশিত হ’ল না।

দ্বারকায় একদিন মাত্র অবস্থান করেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিয়ে রৈবতকে চলে গেলেন। সেখানে কি একটা ব্ৰত উপলক্ষে উৎসব আছে, সে উৎসবে সহজেই অর্জুনের ক্লান্তি অপনোদন হতে পারবে, এই কথাই বললেন সকলকে। শুধু এই বিজয়সংবর্ধনা জানাতেই রাজধানীতে আসা, নইলে সেখানেই চলে যেতেন আগে।

রৈবতক সম্বন্ধে অর্জুনের কৌতূহল সমধিক।

এই স্থানটি নির্বাচন ও এখানে জনপদের পত্তন শ্রীকৃষ্ণের অসাধারণ রাজনীতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিরই আর এক নিদর্শন। জরাসন্ধের আক্রমণ আশঙ্কাতেই তিনি এতদূরে সহস্র যোজন ব্যবধানে সমুদ্রবেষ্টিত দ্বারকাপুরী বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে। স্থলপথে যার যত বিক্রম জলপথে সে তত অসহায়। এর প্রমাণ আগে বা পরে বিস্তর পাওয়া গেছে।

কিন্তু এ তো গেল বাসস্থান, রাজধানী। রাজ্য না থাকলে রাজধানীর মূল্য কি?

সে রাজ্য স্থাপন মূল ভূখণ্ড ছাড়া সম্ভব নয়। প্রজাপত্তন গোপালন বা কৃষিকর্ম— উপার্জনের যে কোন উপায়ই হোক— বিস্তৃত ভূমিসম্পদ প্রয়োজন। জলবেষ্টিত ক্ষুদ্র দ্বীপে সেটা সম্ভব নয়।

মূল ভূখণ্ডে রাজ্যশাসন করতে গেলে সেখানেও একটা প্রজাসংযোগকেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। প্রতি পদে সমুদ্র পেরিয়ে প্রজারা অভাব অভিযোগ জানাতে আসবে কেন? আসা সহজও নয়। তাছাড়া বেশির ভাগ লোকেই সমুদ্রে পাড়ি দিতে ভয় পায়।

সেই কারণেই প্রমোদাবাসের নামে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করা। কিন্তু এখানে থাকলেই শত্রুভয়ও থাকবে। সেজন্যই এই পর্বতশিখরটি বেছে নিয়েছিলেন বাসুদেব। এখানে আবহাওয়া অতীব মনোরম, চিরবসন্ত বিরাজিত এখানে। নয়ন-আরাম এখানের দৃশ্য। উপরে অনেকখানি সমতলভূমি, বাসগৃহাদি নির্মাণের উপযোগী। একাধিক নির্ঝরিণী থাকায় পানীয়জলের অপ্রাচুর্য নেই— অথচ এখানে আসার একটিই মাত্র পথ, সেটিও যথেষ্ট সংকীর্ণ অর্থাৎ একটু বিবেচনা মতো ঠিক স্থানটি নির্বাচন করে প্রহরারত থাকলে একশত লোক এক অনীকিনীর মহড়া নিতে পারে।

রৈবতকে পৌঁছে যেমন পরিতৃপ্ত তেমনি চমৎকৃত হলেন অর্জুন।

অভিরাম দৃশ্য, স্নিগ্ধ বাতাস—নিমেষমধ্যে মন এবং দৃষ্টি আরাম বোধ করল। নগরীর—নগরী না বলে গণ্ডগ্রাম বলাই হয়ত উচিত— নির্মাণকৌশলও বড় সুন্দর। কোথাও এই দৃশ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ চক্ষুর পীড়াদায়ক বৃহৎ হর্ম্যাদি নির্মাণের চেষ্টা করা হয় নি অট্টালিকার পাশে পর্ণকুটির—ধনী দরিদ্র উচ্চনীচের বাসস্থান চিহ্নিত ক’রে— কোন ভেদ ঘোষণা করে নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির, তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ পুষ্পোদ্যান, প্রতি চতুষ্পথে একটি ক’রে মন্দির।

তবে বিস্ময় সে কারণেই শুধু নয়।

বাসুদেব পূৰ্বাই জানিয়েছিলেন—কী একটা পূজা উপলক্ষ ক’রে তিনদিন ব্যাপী উৎসব হবে, সেই কারণেই যাদব- প্রধানরা দ্বারকা ত্যাগ ক’রে রৈবতক যাচ্ছেন। আরও বলেছেন পূজাটা উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ্য উৎসব। অন্ধক ও বৃষ্ণি বংশীয়েরা উৎসবের জন্য পঞ্জিকা খুঁজে তিথি বার করেন।

কিন্তু সে উৎসব যে এই বস্তু— অর্জুন তা কল্পনাও করতে পারেন নি। তাঁর বাল্য-কৈশোরও অবিরাম ভ্রমণে কেটেছে —জীবনরক্ষার জন্য স্থান থেকে স্থানান্তরে যেতে হয়েছে—তার পরও এই তো দ্বাদশ বৎসর ধরে সমগ্র ভারত প্রদক্ষিণ ক’রে এলেন, কোথাও এমন উৎসব-উন্মত্ততা দেখেন নি। এখানে সকলেই তরুণ প্রবীণ নির্বিশেষে, যুগলবদ্ধ হয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে নারী— হয়ত অনেক স্ত্রীর একজন, কেউ হয়ত পরস্ত্রী বা বারনারীও নিয়েছেন সঙ্গে। সকলেরই দৃষ্টি সুরা অথবা সিদ্ধিতে আরক্ত, ঢুলুঢুলু করছে। প্রত্যেকেই যথেষ্ট পুষ্পাভরণ ধারণ করেছেন, সমস্ত ঊর্ধ্বাঙ্গ চন্দনপরিলিপ্ত। বেশভূষার পারিপাট্যও—প্রভাতে যথেষ্ট ছিল, এখন এই দ্বিপ্রহরের মধ্যভাগে কিঞ্চিৎ শিথিল কারও উত্তরীয় লিত, কারও বা অঞ্চল ভূলুণ্ঠিত। কোথাও নৃত্যগীত-নাটকাদি অভিনীত হচ্ছে, অনেকে সেখানে ভিড় ক’রে দাঁড়িয়ে নানারূপ মন্তব্য করছেন অথবা সাধুবাদ দিচ্ছেন কেউ বা নিজেরাই নৃত্যগীতসহকারে ভ্রমণ করছেন কোথাও বা পাশা ইত্যাদি জুয়া খেলার আসর বসেছে, সেগুলো কেন্দ্র ক’রে বহু জনসমাগম। তবে পথে পথে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানোর দলই বেশী। স্বয়ং আর্য বলদেব রেবতীকে নিয়ে মদিরামত্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া, শাম্ব, প্রদ্যুম্ন, অক্রর, সারণ, সাত্যকি, হার্দিক্য প্রভৃতি গোষ্ঠী-প্রধান বা রাজকুমাররাও একাধিক বনিতা নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছেন, সকলেই আমোদ-প্রমোদের নব নব পন্থা আবিষ্কারে, উপায়-উদ্ভাবনে ব্যস্ত।*

অর্জুন বাসুদেবের সঙ্গে দর্শক হিসেবেই অনেকক্ষণ পথে পথে ঘুরে বেড়ালেন। বাসুদেব এই ধরনের মত্ততা পছন্দ করেন না, সে কথা এঁরাও জানেন, তাই ওঁকে দেখে ক্ষণিকের জন্য সঙ্কোচ বোধ করছে সবাই, এমন কি বলদেব ও চোখাচোখি হলে লজ্জিত হয়ে পড়ছেন।

বাসুদেব ইচ্ছা ক’রেই একটা বিশেষ দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন কিনা কে জানে, সহসা একসময় ওঁরা নগরের মধ্যভাগে বড় মন্দিরটির সামনে এসে পড়লেন। এই মন্দিরটিই এ উৎসব-সমারোহের কেন্দ্রবিন্দু, তিনদিন ধরে এখানেই পূজা দেবার কথা।

অবশ্য ওঁরা যখন পৌঁছলেন তখন আর বিশেষ ভিড় নেই, অল্প দু-চারজন পূজা দিতে এসেছেন বা পূজা শেষ ক’রে চলে যাচ্ছেন। স্ত্রীলোকই বেশির ভাগ।

দৈব, অথবা বাসুদেবের যোগাযোগ।

এই পূজার্থিনীদের মধ্যে একটি কিশোরী কন্যাকে দেখে কখন অর্জুনের গতি বন্ধ হয়ে গেছে, স্থির নিশ্চল বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন, তা তিনি বুঝতেও পারেন নি। এমন কি এভাবে অনাত্মীয় কোন নারীর দিকে পলক-শূন্য নেত্রে চেয়ে থাকা যে শিষ্টাচারবিরুদ্ধ— সে জ্ঞানও ছিল না।

নিজের আচরণ, পরিবেশ, সঙ্গী—কিছু সম্বন্ধেই যে অবহিত নয়— তার ভব্যতাবোধ থাকবেই বা কি ক’রে? অর্জুনের কোন বিষয়েই আর কোন সচেতনতা ছিল না।

অল্পবয়সী কুমারী কন্যা। সম্ভ্রান্ত-বংশীয়া নিশ্চয়ই, কারণ সঙ্গে অনেকগুলি দাসী বা সহচরী রয়েছে—পূজার উপকরণাদি বহন ক’রে এনেছে তারা।

সুন্দরী অনেক দেখেছেন বৈকি। দ্রৌপদীর তো কথাই নেই। সাম্প্রতিককালেও কয়েকটি সুন্দরী তরুণীকে দেখলেন। চিত্রাঙ্গদা অনিন্দ্যসুন্দরী না হলেও তাঁর অন্য আকর্ষণ আছে, সে আকর্ষণ বীর হৃদয়ের চিত্তে কম তরঙ্গের সৃষ্টি করে না। কিন্তু এই লোকললামভূতা বিশাল-তাম্রনয়না মেয়েটির শান্ত শ্রীতে যে মাধুর্য, শ্রদ্ধাতদগত ভঙ্গীতে, লজ্জাস্পর্শবিনত দৃষ্টিতে, গতির কোমল ছন্দে, দেহের যৌবনোচ্ছ্বাসে যে অত্যাশ্চর্য ঐন্দ্রজালিক মায়া, তা অভিভূত করে, মোহগ্রস্ত করে।–এ রূপ আর কোন মেয়ের মধ্যে দেখেন নি এতাবৎ।

তাছাড়াও, বলিষ্ঠ পুরুষের চিত্ত চায় আশ্বাস ও প্রশ্রয়ের সূর্যতাপে একটি কোমল লতা-প্রাণকে সংসারের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করতে। দ্রৌপদী ও চিত্রাঙ্গদার মতো কন্যাতে সে সাধ মেটে না। সুভদ্রাতে মেটে।

ফাল্গুনীর এই প্রস্তরীভূতপ্রায় অবস্থা, নিমেষহীন দৃষ্টি, উন্মুক্ত ওষ্ঠে আবদ্ধ নিঃশ্বাস— বাসুদেবের চোখ এড়ায় নি। হয়ত এ তিনি জানতেন, আশাই করেছিলেন। হয়ত অর্জুনের অজ্ঞাতে এদিকে ইচ্ছাপূর্বকই নিয়ে এসেছেন, এ নাটকের অবতারণা করবেন বলে।

কিছুক্ষণ প্রিয় বন্ধুর দুর্দশাটা উপভোগ করে মৃদু কৌতুকের হাসি হেসে বললেন, ‘এ কি! অরণ্যচারী ব্রহ্মচারীর মন এত সামান্য কারণে উতলা কেন?… মনে হচ্ছে চিত্রাঙ্গদার চিত্রও স্মৃতির দিগন্তে অস্ত গেল!… আমার তো দুর্নাম চিরকালের কিন্তু দৃঢ়চেতা ফাল্গুনীও যে দেখি ক্ষণে ক্ষণে চিত্ত হারিয়ে ফেলেন!

অর্জুন এবার লজ্জিত হলেন, আত্মসচেতনও হলেন কতকটা, কিন্তু প্রকৃতিস্থ হতে পারলেন না তখনই। বিহ্বল লজ্জাজড়িত কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন, ‘এ–এ মেয়েটি কে?’

‘এ সুভদ্রা। আমার পিতা বাসুদেবের কন্যা, সারণের সহোদরা।’

ততক্ষণে সুভদ্রা মন্দিরে প্রবেশ করেছেন, ইন্দ্রজালের প্রভাব দৃষ্টির অন্তরাল হওয়াতে অনেকটা কমে গেছে। অর্জুনও পরিবেশসচেতন হয়ে উঠেছেন। সেই মণিপুরের মতোই তিনি যে অনেকের কৌতূহল ও কৌতুকের পাত্র হয়ে উঠেছেন তা বুঝে বিষম লজ্জিত হয়ে পড়েছেন। ‘ছিঃ ছিঃ, বাসুদেব কী মনে করলেন, কত দুর্বল ভাবলেন আমাকে, কি অভব্যই ভাবলেন বা’– সে কথা মনে ক’রে আর মাথা তুলতে পারছেন না।

ততক্ষণে অবশ্য দুজনেই চলতে শুরু করেছেন। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়া, তবু লজ্জাতেই— ইচ্ছা থাকা সত্বেও— সেদিকে আরও তাকাতে পারলেন না।

কিন্তু যতই লজ্জা পান না কেন, মনের মধ্যে উদ্বেলিত উচ্ছ্বাস গোপন করাও সম্ভব হ’ল না বেশীক্ষণ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অপূর্ব! সত্যই বলছি, এমন আর কখনও দেখি নি। এ স্বতন্ত্র, একক। ।

শ্রীকৃষ্ণ খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার এই ভগ্নীটির রূপের বিশিষ্টতা আছে তা অবশ্যস্বীকার্য। রূপ ছাড়াও—গুণেরও তুলনা নেই বোধ করি। এত মধুভাষিণী, মিষ্ট চরিত্রের মেয়ে কমই দেখা যায়— এত সেবাপরায়ণা, এত স্নেহশীলা কোমলপ্রাণা।… এ তোমার কৃষ্ণার বিপরীত। কৃষ্ণা কেন তোমার কোন চিত্তপ্রিয়ার সঙ্গেই এঁর মিল নেই। কৃষ্ণা মহিষী, গৃহিণী নব নব কীর্তিতে কর্মে উদ্বুদ্ধ করবেন সুভদ্রা শ্রান্তি অপনোদন করবেন, শান্তি আনবেন প্রাণে। আমার পিতারও সর্বাধিক প্রিয় এই সন্তান, তাঁর নয়নের মণি।… তা দ্যাখো, বল তো তাঁকে জানাই!’

অর্জুন মস্তক আরও নত করে প্রায় অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘ওঁর স্বয়ম্বরের কি কোন আয়োজন হচ্ছে? তেমন কোন অভিপ্ৰায়—?’

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘সুভদ্রা যদি সত্যই তোমার মন আকৃষ্ট করে থাকেন তো—’

কথা শেষ হবার পূর্বেই অর্জুন বলে ফেললেন, ‘হ্যাঁ, মনে হচ্ছে এ কন্যাকে না পেলে জীবনধারণের কোন অর্থই নেই । মনে হচ্ছে এঁর জন্যই এতকাল অপেক্ষা করেছি, ইনি আমার তৃষ্ণার শান্তি, জীবনের পূর্ণতা—’

‘ধীরে বন্ধু ধীরে। এমন আরও কতবার মনে হবে। তুমিই যথার্থ বীর, আবেগসর্বস্ব।… সে কথা যাক, বলছি যদি সত্যই এমন দুর্বল হয়ে থাকো—স্বয়ম্বরের ঝুঁকি নিতে যেয়ো না।’

‘কেন? ঝুঁকি বলছেন কেন?’

হাসলেন বাসুদেব, তাঁর নিজস্ব সেই হাসি। বললেন, ‘তোমার নিজের ওপর এত বিশ্বাস! বন্ধু, মেয়েদের মন এক আশ্চর্য বস্তু— দেবতারাও তার তল পান না— তুমি তো কোন ছার। স্বয়ম্বর মানেই তো কন্যাটির অভিরুচির উপর নির্ভর করা। একবার স্বয়ম্বর ঘোষণা করলে মেয়ে যাকে নির্বাচন করবে তার হাতেই সম্প্রদান করতে হবে। কথা দিলে কথা ফেরানো যায় না। সুভদ্রা যে তোমার গলাতে মালা দেবেন তার কোন নিশ্চয়তা আছে? দ্রৌপদী যে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান ক’রে তোমায় বরণ করলেন! তখন তোমার পরিচয়ও তো জানতেন না! তোমার নিজের সম্বন্ধে যতটা উচ্চ ধারণা, আমার ভগ্নীর যদি ততটা না থাকে? মেয়েরা হৃদয়ের আজ্ঞায় চলে, বিচার-বিবেচনার ধার ধারে না। পুরুষকে পছন্দ করার সময় সবাই যে তার শৌর্য কি কুলশীল কি পাণ্ডিত্যের কথা চিন্তা করবে এমন কোন নিয়ম নেই। এক- একজনের এক এক রকমের মতি-বুদ্ধি। একেবারে অপাত্রে প্রণয় দিয়েছে এমন ইতিহাসও তো বিরল নয়। যদি এঁকে না পেলে তোমার কষ্ট হবে ভাবো—তাহলে স্বয়ম্বরের জালে পা বাড়িও না।’

‘তবে?’ অর্জুন বুঝতে পারেন না কথাটা, ‘তাহলে কি এমনি—মানে আপনার পিতাকে বললে—’

‘না, তিনিও যে স্বেচ্ছায় সানন্দে প্রবলা সপত্নীর ঘরে প্রিয় কন্যাটিকে দান করবেন তারও কোন স্থিরতা নেই। বিশেষ এ পাত্র, যতই হোক, রাজা নয়, রাজভ্রাতা।’

‘তবে?’ আবারও সেই বিমূঢ় প্ৰশ্ন।

‘তোমার প্রয়োজন—তুমি গ্রহণ করবে! অত চিন্তার কী আছে! তুমি ক্ষত্রিয় বীর—মাটির মতো স্ত্রীলোকও বীরভোগ্যা ইচ্ছা প্রবল হয়ে থাকে, নিয়ে চলে যাও। হরণ করো।’

‘আপনার ভগ্নীকে হরণ করে নিয়ে যাব?’

‘দোষ কি? বিবাহার্থে বলপূর্বক কন্যা হরণ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অবিধি কি অন্যায় নয়।’

‘কিন্তু—’, লোভ ও বিবেকের মধ্যে দোলাচল-চিত্ত অর্জুন বলেন, ‘তার পরও যদি আমাকে পছন্দ না করেন সুভদ্রা?’ বাসুদেব বললেন, ‘মূর্খ! স্ত্রীলোকেরা যে গায়ের জোরের ওপরই বেশী জোর দেয়, পছন্দ করে— সেটা এতকালেও বোঝ নি! যাও কালই উত্তম অবসর, এ পূজা ও উৎসবের শেষ দিন কাল। এই সময়ে সুভদ্রা আসেন, তার কারণ এ সময় ভিড় থাকে না, এদিকে বড় কেউ আসে না। বাধা দেবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। আর যাদব-প্রধানদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে তাঁরা প্রস্তুত হতে হতে তোমরা বহুদূরে চলে যেতে পারবে।’

অর্জুন অবনত হয়ে বন্ধুকে নমস্কার জানালেন— কৃতজ্ঞতা ও কৃতার্থতার পরিচয় স্বরূপ।

১৩

এটাও যে দৈবের যোগাযোগ নয়, বাসুদেবের ইচ্ছাতেই এই সংঘটন–অর্জুন সেটা জানতে পারলেন অনেক পরে।

শ্রীকৃষ্ণ ঠিকই বলেছিলেন এই অপহরণের সংবাদ, ভীত ও সন্ত্রস্ত সহচরীর দল এবং মন্দিরের পূজারী যখন গোষ্ঠীপ্রধানদের খুঁজে বার ক’রে জানালেন— জানানোও সহজ হয় নি, তিনদিন ব্যাপী সুরাপানের প্রভাব থেকে মুক্ত ক’রে অবস্থাটা হৃদয়ঙ্গম করাতে যথেষ্ট সময় লাগল— তখন অর্জুনের রথ বহুদূর পৌঁছে গেছে, রৈবতক থেকে নেমে সমতলে পৌঁছেও বেশ খানিকটা চলে গেছেন তিনি।

পূর্বদিন রাত্রে বাসুদেবই সব নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোথায় রথ নিয়ে দাঁড়াতে হবে, কোনখানে কোন পথ দিয়ে ঘুরে গেলে বিশেষ কারও চোখে পড়বে না—ইত্যাদি। সুভদ্রা পূজা শেষ ক’রে অন্যমনস্ক ভাবে মন্দির থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন, দেবারাধনার তন্ময়তায় তখনও কিছুটা আচ্ছন্ন থাকবেন তিনি—সে-ই অবসর। ।

অর্জুনকে বেশী বলতে হয় নি। সামান্য আভাস দিতেই সমস্ত চিত্রটা কল্পনা ক’রে নিতে পেরেছিলেন। খুব একটা বলপ্রয়োগেরও প্রয়োজন হয় নি। অর্জুনের শৌর্যখ্যাতি শোনাই ছিল, এখানে আসার পর দেখাও হয়েছে, মনে হয়ত সুভদ্রারও কিছু অভিলাষ জেগে থাকবে— তিনি সামান্য একটু প্রাথমিক বাধার পর বেশ শান্তভাবেই মেনে নিয়েছিলেন এই হরণোদ্যোগটা উচ্চকণ্ঠে পথচারীদের সচেতন করে সাহায্য ভিক্ষা করা কিংবা রথ যখন অপেক্ষাকৃত মন্দগতিতে যেতে বাধ্য হচ্ছে তখন নেমে পড়ার চেষ্টা— কোনটাই করেন নি।

কিন্তু মনোভাবের এত সূক্ষ্ম সম্ভাব্য বিশ্লেষণ এঁরা করবেন তা সম্ভব নয়। যাদব-প্রধানদের কর্ণে ও মস্তিষ্কে সংবাদটা পৌঁছতে—মধুচক্রে নয়—একেবারে ভূঙ্গরোলচক্রে-লোষ্ট্রবৎ প্রতিক্রিয়া জাগল—একটা প্রচণ্ড ক্রদ্ধ হুঙ্কার উঠল চারিদিকে। মত্ততা ছুটে গেল অধিকাংশরই। সকলেই অর্জুন ও তাঁর বংশ সম্বন্ধে কটুবাক্যে মুখর হয়ে উঠলেন। যাদবদের অপমান করেছেন, আতিথ্যের অমর্যাদা করেছেন ফাল্গুনী, সকল প্রকার শিষ্টাচারের নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। কেউ বললেন, এটা দুঃসহ স্পর্ধা, কঠিন শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন—যাতে সুদূর ভবিষ্যতেও এমন দুষ্কার্য, দুর্বৃত্তজনোচিত আচরণ করতে কেউ সাহস না করে। বলদেব বললেন, ‘চলো এখনই রওনা হওয়া যাক, পাণ্ডবদের সকলকে বধ ক’রে ওদের ঐ নূতন রাজধানীটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসি।’

সাত্যকি, শাম্ব, সারণ প্রভৃতি মহাবীরগণও যথেষ্ট আস্ফালন ও স্পর্ধা প্রকাশ করতে লাগলেন। বললেন, ‘মৃত্যু ঘনিয়ে এলেই মূর্খদের এই রকম দুঃসাহস দেখা দেয়। মূঢ় জানে না যে, কাদের কাছে এই ধৃষ্টতা প্রকাশ করতে এসেছে!’

সকলেই উত্তপ্ত, ক্রোধোন্মত্ত! সুশৃঙ্খল ভাবে রণসজ্জা করা দুষ্কর। তবু দেখতে দেখতে সহস্রাধিক যোদ্ধা, অশ্ব, রথ, অস্ত্রবাহী অশ্বতর প্রভৃতি প্রস্তুত হল—প্রায় প্রহর কালের মধ্যেই।

বাসুদেবের কাছে এসব সংবাদই পৌঁছচ্ছিল—যাতে দণ্ডে দণ্ডে নিয়মিতভাবে পৌঁছয় সে ব্যবস্থা তিনিই ক’রে রেখেছিলেন—কিন্তু তিনি বিচলিত হন নি, অথবা ক্রদ্ধ আত্মীয়দের শান্ত করার চেষ্টা করেন নি।

বরং তাঁর অভ্যাসমতো আত্মবিশ্লেষণে নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। এ কাজ কেন করলেন, এই প্রশ্নটাই তাঁর অন্তরসত্তাকে পীড়া দিচ্ছে। উত্তর একটা তো প্রস্তুতই আছে আপাত-কারণ স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ। পাঞ্চাল, নাগরাজ্য, মণিপুর, মদ্র প্রভৃতি দেশ বিবাহ ও অন্যান্য আত্মীয়তাসূত্রে পাণ্ডবদের সঙ্গে বদ্ধ, এঁরা বিপক্ষে যেতে পারবে না। এদের সঙ্গে যদি বৃষ্ণি ও অন্ধক বীরগণও যুক্ত থাকেন তাহলে পাণ্ডবরা ভবিষ্যৎ অনিবার্য সংঘর্ষকালে খুব বেশী নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে না। এঁরা পক্ষে যদি নাও থাকেন, বিপক্ষে যেতে পারবেন না।

কিন্তু এই স্থূল কারণটা ছাড়া কি আর কিছু নেই?

কোথাও গোপনে কি অন্য কোন অভিপ্রায় কাজ করে নি?—একটা বিশেষ তথ্য এই বিবাহ হলে দ্রৌপদীর মনে অর্জুনের প্রতি অতটা শ্রদ্ধাতদগত প্রেম, অত ঐকান্তিক আসক্তি থাকবে না, কিছুটা বরং বিদ্বেষ বা বিতৃষ্ণা কাজ করবে!

পাঞ্চালী, পাঞ্চালী! এ তুমি কি করলে! কেন বাসুদেবকে এমনভাবে সংশয়াচ্ছন্ন করছ বার বার!

এই কুটিল অভিপ্রায় যদি তাঁর মনে দেখা দিয়ে থাকে, তার প্রভাবেই ঐ আপাত-সৎ কারণটা খুঁজে নিয়ে থাকেন তো—সেটা তাঁর যথেষ্ট অন্যায় হয়েছে। সেক্ষেত্রে অর্জুনকে সুভদ্রা-হরণে প্ররোচিত করার কোন অধিকার নেই তাঁর।

সকলে প্রায় যখন যুদ্ধযাত্রায় প্রস্তুত, আরও যাঁরা পিছনে থাকলেন তাঁরা কীভাবে দলবদ্ধ হয়ে সৈন্যসামন্ত-সহ এই অগ্রগামী দলের সঙ্গে কোথায় যোগ দেবেন সে- নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে—তখন বলদেবেরই স্মরণ হ’ল কথাটা।

একটু যেন উদ্বিগ্নভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ? শ্রীকৃষ্ণ কই? কই, তাঁকে তো দেখছি না! এ বিষয়ে তাঁর কি বক্তব্য সেটা তো আগে শোনা দরকার। তিনি কি এ সংবাদ পান নি!’

আসলে এই ভ্রাতাটি সম্বন্ধে চিরদিনই একটা অস্বস্তি আছে বলদেবের মনে। সাধারণত সকলে যেমন ভাবে, তাঁর অনুজের চিন্তা সে পথ ধরে যায় না,–এ উনি বারবারই দেখেছেন। অন্য একটা যুক্তি প্রয়োগ ক’রে এদের সঙ্কল্প কার্যধারা সব গোলমাল ক’রে দেন। শেষ মুহূর্তে নিজেদেরই অপ্রতিভ হতে হয়। তাই বাসুদেবের সম্মতি ও সমর্থন না পেলে কোন কাজেই পুরোপুরি অগ্রসর হতে ভরসা পান না উনি।

বলদেবের উৎকণ্ঠা অপরের মনে সংক্রামিত হতেও বিলম্ব হ’ল না। সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন ছুটল বাসুদেবের গৃহে, তাঁকে সংবাদ দিতে।

যাদববীরগণ রণসজ্জায় সজ্জিত, রথ অস্ত্রাদিও প্রস্তুত, এবার উনি তাঁদের নেতৃত্ব দেবেন, সেই অপেক্ষাই করছে সকলে।—তারা জানাল।

শ্রীকৃষ্ণ যেন বহু—বহু দূর থেকে তাঁর মন ও সচেতনতাকে আহরণ ক’রে নিয়ে এলেন।

জোর ক’রেই মনের ক্লিন্নতা, সূক্ষ্ম অন্যায়-বোধ দূর করে সক্রিয় হয়ে উঠলেন ।

বাইরে বেরিয়ে বলদেবের সামনে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে খুব নিরীহভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘আর্য, আমাকে স্মরণ করেছেন?’

ক্রোধে ও উত্তেজনায় বলদেবের কণ্ঠ দিয়ে স্বরই বেরোতে চায় না কিছুক্ষণ। অবশেষে অতিকষ্টে উষ্মারুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘স্মরণ করেছেন মানে! তুমি কি কিছু শোন নি নাকি! আর্যা পৃথার ঐ কুলাঙ্গার ছেলেটা কি করেছে শোন নি? তোমার তো একান্ত প্রিয় বন্ধু, তোমার নির্বন্ধাতিশয্যেই তাকে আমরা এত সম্মান করেছি, কিন্তু সে তার যোগ্য নয়। যার সদ্বংশে জন্ম সে অন্নগ্রহণ ক’রে ভোজনপাত্র চূর্ণ করে না—অন্নদাতার অনিষ্ট করে না। সুভদ্রাকে হরণ ক’রে সে আমাদের মাথায় পা দিয়েছে। অতি হীন সে, অতি নীচমনা। আমাদের এত সখ্য ও আতিথ্যের এই প্রতিদান! এ অপমান আমরা কখনও সহ্য করব না। আমি একাই প্রয়োজন হলে পৃথিবী কৌরবশূন্য করব।’

‘অজুর্নের সুভদ্রা গ্রহণ করার কথা শুনেছি বৈকি। কিন্তু এর দ্বারা সে কী এমন দুষ্কর্ম বা অন্যায় করল সেইটেই তো বুঝতে পারছি না।’

‘তার মানে!’ একজন অন্ধক-বংশীয় প্রধান বলে উঠলেন, ‘ও, তোমার যে প্রিয় বন্ধু, তুমি তার দোষ দেখবে কেন?’

‘হ্যাঁ, সে আমার বন্ধু, কিন্তু সে-ই তার একমাত্র পরিচয় নয়। আর সে আমার বন্ধু এ পরিচয় দিতে এখনও আমি লজ্জাবোধ করছি না।’ তারপর সেই ব্যক্তির দিকে পিছনে ফিরে বলদেবকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘অর্জুন যে পাত্র হিসেবে খুবই যোগ্য তাতে আশা করি আপনিও দ্বিমত হবেন না। সে আমাদের পিতৃসার পুত্র, কুরুবংশের সন্তান। একা মহাদেব ছাড়া তার সমান রণদক্ষ বীর পৃথিবীতে নেই। আপনার প্রিয় ছাত্র দুর্যোধন পাণ্ডবদের প্রতি খুবই অবিচার ও অত্যাচার করেছে—তৎসত্বেও আজ পাণ্ডবরা পূর্ণগৌরবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের নগর-নির্মাণ, রাজ্যশাসনপদ্ধতি, ন্যায়নীতি-নির্ণয় প্রভৃতি ইতিমধ্যেই অপর রাজারা অনুকরণ করতে আরম্ভ করেছেন। সম্প্রতি সে দ্বাদশ বর্ষ ধরে অতি স্বল্পসংখ্যক অনুচর নিয়ে সারা ভারত ভ্রমণ করেছে চারিদিকে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন, সৌহার্দ্য বিনিময় করে তাদের রাজ্যের ভিত্তি আরও দৃঢ় করেছে। তার শৌর্য, অস্ত্র-শিক্ষা, চরিত্রের দৃঢ়তা ও বিনয় সারা ভারত-খণ্ডের আদর্শ।’

বলদেব ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা নরম হয়েছেন। তিনি আমতা আমতা ক’রে বললেন, ‘তা বেশ তো, তাই না হয় হ’ল—তাই বলে এমন ভাবে—বলপূর্বক হরণ করা—’

‘ক্ষত্রিয়ের বিবাহার্থ কন্যা-হরণ করা কিছু অনিয়ম নয়, অন্যায়ও নয়। এমন অনেকেই করেছেন। কুরুপিতামহ মহাভাগ ভীষ্ম অপরের জন্যও করেছেন। তা ছাড়া আর কী ভাবেই বা সে এ কন্যাকে বিবাহ করতে পারত! আমরা স্বয়ম্বর ঘোষণা করিনি। কোন কোন কুলে পণপ্রথা প্রচলিত আছে, পাত্র সর্বোচ্চ পণ দিয়ে কন্যা গ্রহণ করে। আমরা তাতে প্রস্তুত নই, কন্যা বিক্রয় করব না। তিনিই বা ভিক্ষুকের মতো দান গ্রহণ করবেন কেন? এক্ষেত্রে যা প্রকৃষ্ট পন্থা —বীর্যশুল্কে কন্যা গ্রহণ করা—অর্জুন তাই করেছেন। আমি তো এর মধ্যে কোন অন্যায় কি অপরাধ দেখছি না!’

বলদেব হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে ওঁর মনের তল পাবার বৃথা চেষ্টা ক’রে বললেন, ‘তা তুমি কি করতে বলো এখন?’

‘আমাদের উচিত দ্রুত দূত প্রেরণ ক’রে সাদরে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনা—এবং যথারীতি উভয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করা। আমি ইতিমধ্যেই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি প্রার্থনা ক’রে ইন্দ্রপ্রস্থে দূত পাঠিয়েছি, মনে হয় তাঁর কোন আপত্তি হবে না। তবে যতদিন না সে দূত ফিরে আসে—সেই কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে তার পূর্বে অনুষ্ঠান শেষ করা শোভন হবে না।’

‘বেশ!…তাহ’লে সব কাজ তো তুমি করেই রেখেছ! বৃথাই আমরা এতক্ষণ ধরে উত্তেজনা প্রকাশ করলাম।…অমন মাধ্বীর আমেজটা নষ্ট হয়ে গেল মিছিমিছি।’

বলদেব যেন নিশ্চিন্ত হয়ে পুনশ্চ মাধ্বী ও রেবতীর খোঁজে গেলেন। যাদবপ্রধানদের ক্ষোভ ও ক্রোধ সকলের হয়ত অত সহজে প্রশমিত হ’ল না—কিন্তু বাসুদেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে কে?

তবে অর্জুন ফিরে এসে বিনয়বচনে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে অনেকেই আবার সহজ হয়ে এলেন। দ্বারাবতী বসুদেবকন্যা সুভদ্রার আসন্ন বিবাহোৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর পরে প্রিয়সন্দর্শন, প্রিয়মিলন।

দ্রৌপদী স্বাভাবিকভাবেই—অভিমানাহত অন্তরের যুক্তির বিরুদ্ধেই বোধ করি—উৎসুক, উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণের সুগৌরী সুন্দরী ভগিনীকে বিবাহ করে আনছেন—এ সংবাদ শোনার পর একটা অভিমান তো বোধ করবেনই। সুগভীর অভিমান। আর সে অভিমান যে অকারণ এমন অপবাদ তাঁকে কোন বিবাহিত নারীই দিতে পারবেন না।

অর্জুন যে আর একটি বিবাহ করেছেন, ক্ষত্রিয় রাজবংশের কন্যা—অনার্য-কন্যাদের মতো সুদূর শ্রুতিমাত্র-পরিচয় নয় —তারা এখানে আসবে না কোনদিনই, এলেও ক্ষণিকের জন্য, এখানের জীবনযাত্রা রীতিনীতি ঐশ্বর্য-আড়ম্বরের সঙ্গে পরিচিত হবার কৌতূহলে, সে প্রবৃত্তির অবসানে ফিরে যাবে আবার—এ পরিচিত ঘরের কন্যা, আত্মীয়া, এ আসবে ঘর করতে এবং তাঁর মতো চার বৎসর অন্তর স্বামীসঙ্গলাভের ভাগ্য তার নয়, সে-ই প্রকৃত গৃহিণী হয়ে থাকবে, ঘরণী–সে আশঙ্কা যতই থাক–অভিমান এ কারণেও ততটা নয়। রাজবংশের বধূ কে আর কবে নিঃসপত্ন অধিকার পেয়েছে স্বামীর! বিশেষ যে স্ত্রী নিজেই সব সময় কাছে থাকতে পারবে না, তার তো এতটা আশা করাও অন্যায়। আর সপত্নী তো ইতিপূর্বেই এ পুরে অনেক এসে গেছে।

না, সেজন্য নয়।

অভিমানের অন্য গূঢ় কারণ আছে। রমণীমনবেত্তার কাছে তা প্রত্যক্ষও। অর্জুন বিবাহের পরই যদি নববধূকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসতেন—তাহ’লে অত দুঃখ বা আশঙ্কার (আশঙ্কাও, সে মনোভাব অস্বীকার করলে মিথ্যাচরণ হবে) কারণ থাকত না।

দ্বাদশ বর্ষ অতিক্রান্ত হবার পরেও অর্জুন তাঁর কৃষ্ণাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন না—দীর্ঘ ব্ৰহ্মচর্যব্ৰত পালনান্তে আসছেন কৃষ্ণার সঙ্গে সাহচর্যে, তাঁরই যে অগ্রাধিকার—সে বিষয়ে পাণ্ডব ভ্রাতারা সকলেই একমত, সেই মতোই নির্দেশ বা অনুমতি দেওয়া আছে দ্রৌপদীকে—এ তথ্য না জানার কথা নয় ফাল্গুনীর। তৎসত্বেও পূর্ণ এক বৎসর কাল রৈবতক-প্রভাসের নির্জন প্রমোদাবাসে নবোঢ়া বধূকে নিয়েই মত্ত রইলেন–এ আচরণের অর্থ তাঁর কাছে তো বটেই—অন্য সকলের কাছেও স্পষ্ট। এখানে এলেই দ্রৌপদীর অগ্রাধিকার, অর্থাৎ অন্তত এক বৎসর কাল সুভদ্রাকে দূরে রাখতে হবে হৃদয় থেকে না হলেও শয়নমন্দির থেকে—অন্তত নিত্য মিলনের সম্ভাবনা থাকবে না—সে বুঝেই কি অর্জুন এই কালহরণ করেন নি? দ্বাদশ বৎসর যে এর মধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে—সে হিসাব কৃষ্ণা স্ত্রীলোক হয়েও রেখেছেন, আর অর্জুন রাখতে পারেন নি? না এতটা ভ্রান্তি বা অনবধানতা বিশ্বাসযোগ্য নয়।…

অভিমানের আর একটি কারণ বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের এক অকারণ অপ্রত্যাশিত পত্রাঘাত।

পত্রটি এসেছে গোপনে। ব্যক্তিগত দূত এসে দ্রৌপদীর নিজের হাতে দিয়ে গেছে।

শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর বন্ধুরূপেই জানতেন দ্রৌপদী।

বন্ধুরও বেশী, স্নেহশীল অগ্রজরূপে। উপকারী শুভার্থীরূপে।

বিপদে সম্পদে যে সর্বদা কল্যাণ কামনা করে—এমন অগ্রজবন্ধু।

সেই বাসুদেব অর্জুনের এই বিবাহ সংঘটন করিয়েছেন—জেনে শুনে, সুপরিকল্পিত ভাবে দুজনের যোগাযোগ ঘটিয়েছেন—এই সংবাদটাই তো যথেষ্ট। একে বিশ্বাসঘাতকতা বলেই মনে হয়েছে দ্রৌপদীর। নিজের ভগ্নীকে গছিয়ে দিয়েছেন বাসুদেব–বন্ধুর উপর অধিকতর প্রভাব বিস্তারের জন্য।

দ্রৌপদী বীর্যশুল্কে ক্রীতা স্ত্রী মাত্র—সুভদ্রা বন্ধুর ভগিনী, সুন্দরী, তার প্রতি অর্জুনের অধিকতর আসক্তি স্বাভাবিক— এসব জেনেও অর্জুনকে এই বিবাহে প্ররোচিত করার একটিই মাত্র অর্থ দ্রৌপদীর কাছে—দ্রৌপদীর অনিষ্ট করা।

কিন্তু তাতেও যেন আশ মেটে না বাসুদেবের।

তীব্র আঘাতের উপরও অপমান যোগ করেছেন। এই পত্রটি পাঠিয়েছেন

শুষ্ক পত্র। স্নেহসম্পর্কহীন।

সাধারণ কুশল প্রশ্নের পর সুভদ্রার্জুনের বিবাহবার্তা জানিয়েছেন বাসুদেব। তবে সে বিষয়ে তাঁর যে কিছুমাত্র সঙ্কোচ নেই সেটা স্পষ্ট। এই সংবাদ দ্রৌপদীর মনে ঈর্ষা ও সপত্নী সম্বন্ধে বিদ্বেষ উৎপাদন করেছে কিনা—সেই উদ্বেগই বেশী

অর্জুনের মতো সর্বনারীকাম্য স্বামীর হৃদয়ে একাধিপত্য করবে—শ্রীকৃষ্ণ আশা করেন—এ অন্যায় মনোভাব দ্রৌপদীর নেই। কোন একমাত্র নারীর হৃদয়বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে যে পুরুষ—বিধাতা অর্জুনকে সে সাধারণ পরিমাপে তৈরী করেন নি। এর ধাতু অন্য, সঞ্চও অন্য। দ্রৌপদী নিশ্চয় এতদিনে স্বামীর এই বিরাটত্ব অনন্যত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং স্বামী সম্বন্ধে প্রকৃত নারীর মনোভাব পোষণ করেন না। শ্রীকৃষ্ণের ধারণা তিনি প্রসন্ন মনেই সুভদ্রাকে অনুজারূপে গ্রহণ করবেন। ইত্যাদি—

ক্ষোভে দুঃখে কৃষ্ণার চোখে জল এসে গেল।

কী মনে করেন বাসুদেব ওঁকে? কৃষ্ণাকে? বাসুদেব আর তাঁর প্রাণের বন্ধু অর্জুন!

ইতর, কলহপরায়ণা, মনোভাব-দমনে-অসমর্থা, অশিক্ষিতা গ্রাম্য নারী?

দেব-অংশে, দৈবকার্যে জন্ম দ্রৌপদীর, হোমাগ্নিতে তাঁর আবির্ভাব। জন্মশিক্ষিতা তিনি। মহিষী হবার জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। সামান্য সাত্বত-কন্যাকে তিনি ঈর্ষা করবেন!—যার পিতা সেদিন পর্যন্ত শ্যালকের কারাগারে বন্দী ছিল, বন্দীশালাতেই যে নির্লজ্জের মতো সন্তান উৎপাদন করেছে!…এ-ঈর্ষা মনে জন্মাবার আগে যেন মৃত্যু হয় তাঁর!

কিন্তু, তিনি ভাবছেন, বাসুদেবের কথা।

বাসুদেব কেমন ক’রে তাঁকে এত হীন কল্পনা করে নিজেই হীন ছোট হয়ে গেলেন!

এ পত্র প্রেরণ করা যে উচিত হয় নি তাঁর—সে বিষয়ে বাসুদেব কি কম সচেতন!

এ জন্য নিজের কাছেই লজ্জার সীমাপরিসীমা ছিল না যে তাঁর!

কিন্তু এ পত্র না পাঠালেও শান্তি পেতেন না তিনি। এ যে তাঁর এক ধরনের প্রায়শ্চিত্ত—সে কথা কাকে তিনি বোঝাবেন। দ্রৌপদীকে তো নয়ই—অপর কাউকেও এ রহস্যের কথা বলা যাবে না কোনদিন। সকল রহস্যের নিয়ন্তা অন্তর্যামীর যিনি অন্তরপুরুষ—তিনিই শুধু সাক্ষী রইলেন—নিজের মানবমানসের সামান্য সুগোপন একটা কুটিল চিন্তার আভাস পাওয়া মাত্র কী অব্যক্ত যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তাঁর, কী গ্লানি!

অথচ সে কথাটাও হয়ত সম্পূর্ণ সত্য নয়, তাঁর এই বিবাহ-সংঘটনের একমাত্র কারণ নয়। তবু নিত্যশুদ্ধ, ন্যায়- ধর্মের পূর্ণ মূর্তি তাঁর যে সত্তা—চিন্তাটা অনুমানের আকার ধারণ করার কলুষটুকুও সহ্য করতে পারেন নি।…দ্রৌপদীর অপ্রীতিভাজন, তাঁর চোখে অর্জুনকে বিদ্বেষের পাত্র করে তোলার জন্যই যদি এ আয়োজন হয়ে থাকে তাঁর—নিজেকে ও দ্রৌপদীর কাছে হীন অবজ্ঞেয় করার জন্যই এ পত্র তাঁকে পাঠাতে হয়েছে, অনুতাপের মূল্য শোধ করতে—ঈষৎ আংশিক দণ্ড ভোগ করতে।

‘কৃষ্ণা, তোমার চোখে আমি না কোনদিন তোমাদের স্বামীদের চেয়ে বড় হয়ে উঠি—এই আশীর্বাদই তোমাকে করছি!’

মনে মনে যতই নিজেকে নিরাসক্ত ও সাধারণ মানবোচিত মানঅভিমান বা প্রাকৃত ঈর্ষার ঊর্ধ্বে মনে ক’রে থাকুন দ্রৌপদী—অর্জুন সম্মুখে উপস্থিত হওয়া মাত্র তাঁর রাজ্যের সামান্যতম প্রজার স্ত্রীর মতোই অভিমানে ফেটে পড়লেন।

‘আপনি—আপনি আবার এখানে কেন?…কী আশ্চর্য, পুরাতন ছিন্ন পাদুকা আর পুরাতন প্রেমিকা—উভয়েই যে নূতনের আগমন মাত্রে অসহ্য হয়ে ওঠে এ কে না জানে! পুরাতন বন্ধনে নূতন দৃঢ়তর গ্রন্থি পড়লে পূর্বের গ্রন্থি শিথিল হয়ই। অন্যরকম যে আশা করে, সে মূর্খ। বৃথা চক্ষুলজ্জাতে প্রয়োজন নেই, আপনি আপনার সেই যাদবনন্দিনীর কাছেই যান, তাকে নিয়েই সুখে থাকুন—আমার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই!

স্ফুরিত ওষ্ঠাধর, বিদ্যুৎবর্ষী দৃষ্টি, মর্মভেদী কণ্ঠ ও তীব্র কঠিন বাক্য—সর্বোপরি ‘আপনি’ সম্বোধন!

অর্জুন দেবদানবগন্ধর্ব যে-কোন শত্রুর সামনেই অকুতোভয়ে দাঁড়াতে পারেন—কিন্তু অভিমানাহত প্রেয়সীর সামনে দাঁড়াবার মতো সাহস তাঁর নেই। এক্ষেত্রে কী করণীয়, কী করলে এ উষ্মা প্রশমিত হবে তাও জানেন না। এমন অভিজ্ঞতা পূর্বে কখনও হয় নি।…তিনি যৎপরোনাস্তি বিব্রত ও অপ্রতিভ ভাবে বার বার ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগলেন। স্বকার্যসমর্থনে কিছু কিছু যুক্তিপ্রয়োগের চেষ্টাও যে না করলেন তা নয়। কিন্তু আচরণে ও উচ্চারণে এমন অপটুত্ব ও অসংলগ্নতা প্রকাশ পেল যে অত দুঃখ ও ক্ষোভের মধ্যেও কৃষ্ণা তার কৌতুকরসটুকু উপভোগ না করে পারলেন না। হয়ত কিছু আশ্বাসও লাভ করলেন।

অর্জুনও আর বেশীক্ষণ দাঁড়াতে সাহস করলেন না প্রিয়তমা স্ত্রীর সামনে। গলদঘর্ম হয়ে আরক্ত মুখে চিন্তিত চিত্তে নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। সেখানে নববধূবেশে সজ্জিতা সুভদ্রা অপেক্ষা করছেন—স্বামীর সঙ্গে শ্বশ্র+মাতা ও জ্যেষ্ঠা যাতা এবং সপত্নীকে প্রণাম জানাতে যাবেন বলে প্রস্তুত হয়ে। তাঁকে কী বলবেন? দ্রৌপদীর কাছে নিয়ে গেলে হয়ত বিস্তর কটুবাক্য ও বক্রোক্তির সম্মুখীন হতে হবে বাসুদেবের ভগ্নীর অবমাননার অর্থ সমগ্র যদুবংশের অপমান— তাঁদের মতের বিরুদ্ধে বিনা অনুমোদনে বিবাহ ক’রে এনেছেন, এক্ষেত্রে সুভদ্রাকে যদি এখানে বিদ্বেষের সম্মুখীন হতে হয় তো বন্ধুর বদলে বৃষ্ণি ও অন্ধকগণ শত্রুতেই পরিণত হবেন। এই সব নানা দুশ্চিন্তায় অর্জুনের অশান্তির অবধি রইল না।…

সে অশান্তি ও দুর্ভাবনা নিমেষে শতগুণ বেড়ে গেল যখন এসে দেখলেন সুভদ্রা তাঁর রাজকুলকন্যা ও রাজবধূর মহার্ঘ্য বস্ত্র-অলঙ্কার খুলে ফেলে অতি দীনা গোপবধূর বেশ পরিধান করেছেন।

আশঙ্কায় কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে গেল মহাধনুর্ধর ফাল্গুনীর। এ বেশ পরিবর্তনের একটিই অর্থ বুঝলেন তিনি—সুগভীর অভিমান। কিন্তু—দ্রৌপদীর বিরূপতার কথা ইতিমধ্যেই এঁকে কে জানিয়ে গেল? তবে কি কৃষ্ণা নিজেই এর মধ্যে কোন সহচরী বা দাসীকে দিয়ে অপমানকর কোন বাক্য বলে পাঠিয়েছেন?

প্রশ্ন করতেও সাহস হয় না। কোনমতে আড়ষ্ট কণ্ঠে শুধু উচ্চারণ করেন, ‘এ–এসব কি ভদ্রা?’

কিন্তু সুভদ্রার অভয়ভরা মধুর হাসি যেন নিমেষে, শরতাবসানের উত্তর-সমীরের মতোই সমস্ত চিন্তার মেঘ উড়িয়ে দিল। তিনি বরং ঈষৎ অপ্রতিভভাবেই হেসে বললেন, ‘অগ্রজ শ্রীকৃষ্ণের এই রকমই নির্দেশ আছে। আমি যেন দীনহীন বেশে, সামান্য গোয়ালিনীর মতো পট্টমহাদেবীকে প্রণাম করতে যাই—কোনরকম মহার্ঘ্য বেশভূষা বা আড়ম্বর না থাকে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্জুন আরও একবার মনে মনে বাসুদেবের প্রজ্ঞাকে অভিনন্দন জানালেন।

তবু আশঙ্কা যে একেবারে দূরীভূত হ’ল তা নয়। নারীজাতির মনোভাবের অন্ত পাওয়া সম্ভব নয়, বাসুদেবের এই উক্তিই তাঁকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে।

অবশ্য কুন্তী সম্বন্ধে সংশয়ের কারণ ছিল না কখনই।

সেখানে সসমাদর অভ্যর্থনাই হবে, সে জানা কথা। কে জানে কুন্তী হয়ত কৃষ্ণার একাধিপত্যে খুব তুষ্টও ছিলেন না তিনি সাগ্রহে সস্নেহে একেবারে বুকে টেনে নিয়ে মস্তক আঘ্রাণ ও চুম্বন ক’রে সুভদ্রাকে বার বার আশীর্বাদ করলেন। বরং এই নিরাড়ম্বর বেশের জন্যই অনুযোগ করতে লাগলেন।

কিন্তু —

এইবার দ্রৌপদী।

অরাতি-ত্রাস অর্জুন দুরু-দুরু বক্ষে শুষ্ককণ্ঠে যজ্ঞের অশ্বের মতো গিয়ে দাঁড়ালেন সুভদ্রাকে একটু এগিয়ে দিয়েই। কিন্তু দেখা গেল অতটা আশঙ্কার কারণ ছিল না। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ-নির্দেশ সুভদ্রা ভাল ভাবেই স্মরণ রেখেছেন। তিনি জ্যেষ্ঠা যাতাকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমি আপনার এক নূতন দাসী, আমাকে সেবার অধিকার দিয়ে কৃতার্থ করুন।’

দ্রৌপদীও ততক্ষণে আত্মস্থ হয়েছেন। হয়ত কিছু পূর্বের আচরণের জন্য লজ্জিতও অর্জুনের ম্লান-মুখ, অপরাধীসুলভ শঙ্কিত দৃষ্টিও তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। তিনি প্রণতা সুভদ্রাকে যথেষ্ট অবনত হবার আগেই জড়িয়ে তুলে নিয়ে গাঢ়

আলিঙ্গনাবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘কল্যাণী, তোমার স্বামী নিঃসপত্ন হোন, তুমি সৌভাগ্যবতী হও।’

অর্জুন এতক্ষণে কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। কৃষ্ণার দিকে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টি তুলে ভাল ক’রে চেয়ে দেখলেন, সেখানেও, দুটি পদ্মপলাশতুল্য আয়ত চোখের চাহনিতে—শুধু আশ্বাস বা ক্ষমাই ফুটে ওঠে নি, সে যেন দুটি পরিপূর্ণ সরোবরের মতোই প্রেমে ও কামনায় টলমল করছে।

১৪

ভগ্নীকে দরিদ্র গোপবধূর মতোই শ্বশুরালয়ে পাঠালেও—তার মর্যাদা বিস্মৃত হন নি শ্রীকৃষ্ণ। প্রাপ্যও না। ওদের সাড়ম্বরে পুর-প্রবেশ কৃষ্ণার প্রীতিপদ হবে না জেনেই অমন একা নিরাড়ম্বর ভাবে তাঁর কাছে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাধারণ গৃহস্থঘরের বধূর সঙ্গে যা লোকজন থাকে—তাও নিতে দেন নি।

উপহার-যৌতুকাদি এল—এঁরা এসে পৌঁছবার অল্প কদিন পরেই।

প্রজাসাধারণ বা রাজকর্মচারীরা যেমন প্রথমটার জন্যও প্রস্তুত ছিল না, তেমনি এই দ্বিতীয়টার জন্যও না।

বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। অনেকের কাছে এটা বাড়াবাড়িই বোধ হল। কেউ কেউ উপযাচক হয়ে কৃষ্ণাকে এসে বলে গেলেন যে, পাঞ্চালদের থেকে নিজেদের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যই যাদবদের এই মাত্রাধিক্য। যতটা বাড়াবাড়ি করছে, এতটা সাধ্য ওদের নেই। এমন ভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে ঐশ্বর্যের পরিচয় দেয় মূর্খরাই। প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এ ব্যাকুলতা দেখে তাঁদের মনে করুণারই উদ্রেক হয়। ইত্যাদি—

যে অপরিমাণ যৌতুক-দ্রব্যাদি নিয়ে এলেন ওঁরা, তার বর্ণনা দেওয়া আমাদের দুঃসাধ্য। ব্যাসদেব বলেছেন

‘মহাযশস্বী শ্রীমান কমললোচন কৃষ্ণ বৈবাহিক রীতিক্রমে বর ও বরপক্ষীয়গণকে উত্তম উত্তম ধন প্রদান করিলেন এবং সুভদ্রাকে জ্ঞাতিদের যৌতুকস্বরূপ বহু ধন দিলেন। তিনি পাণ্ডবদিগকে সুশিক্ষিত নিপুণ-সারথিসহ অশ্বচতুষ্টয়যুক্ত কিঙ্গিণীজাল-মালাবিভূষিত সহস্র রথ মথুরা-প্রদেশীয় তেজস্বী বহুদুগ্ধপ্রদ অযুত গো চন্দ্রবর্ণ বিশুদ্ধ হেম-ভূষিত সহস্র ঘোটকী কৃষ্ণকেশরযুক্ত শ্বেতবর্ণ, বায়ুসম-দ্রুতগামী সুশিক্ষিত সহস্র সংখ্যক অশ্বতরী স্নানপানোৎসবে প্রয়োগ-নিপুণা পরিচর্যাদক্ষা, বয়ঃপ্রাপ্তা, গৌরবর্ণা, সুবেশা, সুকান্তিমতী, সুঅলঙ্কৃতা, কণ্ঠদেশে-শতসুবর্ণ-হার-সুশোভিতা সহস্র পরিচারিণী বাহ্লিক দেশীয় পৃষ্ঠবাহ শতসহস্ৰ অশ্ব নানাবিধ মহার্ঘ্য বস্ত্র ও কম্বল প্রভৃতি বিবিধ সামগ্রী প্রীতমনে প্রদান করিলেন এবং সুভদ্রাকে মনুষ্যের বহনীয় দশভার বিশুদ্ধ ও বিমিশ্র দুই প্রকার উৎকৃষ্ট সুবর্ণ যৌতুক দিলেন।

‘হলধর রাম প্রীতিযুক্ত হইয়া বিবাহোপলক্ষে সম্বন্ধের গৌরববৃদ্ধি নিমিত্ত ত্রিবিধমদস্রাবীকারী-গিরিশৃঙ্গসদৃশ, সাহসী, সমরে অনিবর্তী, হেমমালা-বিভূষিত নিনাদপটু-ঘণ্টাবিলম্বিত, উপবেশন-পর্যঙ্কযুক্ত মনোহর সহস্র মাতঙ্গী হস্তিপকের সহিত ধনঞ্জয়কে উপহার দিলেন। বস্ত্রকম্বলাদি-রূপ-ফেনযুক্ত মহাগজরূপ মহাগ্রাহাকুলিত ও পতাকা-রূপ-শৈবাল সমাকুল সেই মহাধনরত্ন-সমূহরূপ জলপ্রবাহ বিস্তীর্ণ হইয়া পাণ্ডুসাগরে প্রবেশ করিয়া পরিপূর্ণ করাতে তাহা শত্রুগণের শোকাবহ হইয়া উঠিল

এছাড়াও বৃষ্ণি, ভোজ ও অন্ধক জ্ঞাতি ও আত্মীয়রা এনেছিলেন অপরিমিত যৌতুক।

‘ধীমান মহাকীর্তিমান দানশীল অক্রর, বৃষ্ণি-সেনাপতি মহাতেজস্বী অরিন্দম অনাধৃষ্টি, অতিতেজস্বী উদ্ধব, সাক্ষাৎ বৃহস্পতিশিষ্য মহানুভব সত্যক, সাত্যকি, সাত্বত, কৃতবর্মা, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, নিশঠ, শঙ্কু, চারুদেষ্ণ, ঝিল্লী, বিপৃথ, সারণ, গদ—ইঁহারা এবং আর আর অনেকেই বহুবিধ বহু পরিমিত যৌতুক লইয়া আগমন করিলেন।’

এরকম সমারোহ, এত ধনরত্ন ইন্দ্রপ্রস্থের প্রজাসাধারণ কখনও দেখেন নি, তাঁরা বিহ্বল হয়ে পড়বেন—এতে আর আশ্চর্য কি?

বলা বাহুল্য, পাণ্ডবপক্ষেও এর যোগ্য সমাদর, আদর-আপ্যায়ন, আতিথ্য বা প্রতিসৌজন্যের ত্রুটি ঘটল না।

উৎকৃষ্ট পানভোজন ও বিশ্রাম-ব্যবস্থা আতিথেয়তার প্রধান অঙ্গ, সে ব্যবস্থার ভার নিলেন স্বয়ং ভীমসেন। এত অল্পকাল মধ্যে এতগুলি লোকের উপযুক্ত রসনাতৃপ্তিকর, সুস্বাদু, নানা রসের খাদ্য, সুমিষ্ট ফল ও পানীয়, উৎকৃষ্ট সুরা, সুকোমল শয্যা, উত্তম গৃহ—অভাবে সুপ্রশস্ত, সুসজ্জিত বস্ত্রাবাস প্রভৃতির সুব্যবস্থা ভীমসেন ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব হত না। এ ছাড়াও অন্য আয়োজন আছে। সে ভার পড়ল নকুল ও সহদেবের উপর। অর্জুন ওপক্ষের জামাতা –এই কারণেই ঈষৎ লজ্জিত ভাবে তিনি কতকটা উদাসীন রইলেন। তবে তাতে কোন ক্ষতি হ’ল না। নকুল- সহদেবও যে যথেষ্ট করিৎকর্মা অচিরেই তা প্রমাণিত হ’ল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সুপটু নটনটী নর্তক-নর্তকী গায়ক-গায়িকা দ্বারা নৃত্যগীত, অভিনয়—রুচিভেদে মৃগয়া প্রভৃতি মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা হয়ে গেল। ব্যক্তিগত সেবার জন্য অসংখ্য প্রিয়দর্শন দক্ষ ভৃত্য ও সুন্দরী পরিচারিকাও নিযুক্ত হ’ল।

বয়স-ভেদে চিত্ত-বিনোদনের ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন দরকার।

কেউ কেউ অন্তরঙ্গ-ক্রীড়ামোদী, তাঁদের জন্য অক্ষবিদ ও মল্লবীর আনানো হল মদ্র দেশ থেকে। কেউ বা–অক্রর প্রভৃতি—সৎপ্রসঙ্গ আলোচনায় উৎসুক। স্বয়ং যুধিষ্ঠির তাঁদের সঙ্গদান করতে লাগলেন। দু’চারজন দর্শন-শাস্ত্রপারঙ্গম পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ ক’রে আনা হ’ল। অর্থাৎ কোন দিকেই কারও কোন অসন্তোষ বা অভাববোধ না থাকে—পাণ্ডব- ভ্রাতারা সেজন্য সদাসর্বদা সজাগ ও সতর্ক হয়ে রইলেন।

কুটুম্বরা অতিথি হয়ে এলে সদাই হোতার ত্রুটি-সন্ধানের চেষ্টা করেন। সকলের পক্ষে না হলেও অনেকের পক্ষেই এ-সত্য প্ৰযোজ্য। যাদব-দলেও সে রকম লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আদর-আপ্যায়ন-ব্যবস্থার কোন ছিদ্র খুঁজে না পেয়ে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। শেষে ‘আতিথ্যের আয়োজন বড় বেশী, এত উত্তম ভোজনে ও উৎকৃষ্ট সুরাপানে আমাদের শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে’ এই অজুহাতে গৃহপ্রত্যাগমনের জন্য ব্যস্ত হলেন। যাঁরা ছিদ্রান্বেষী নন, তাঁরা দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাঁরাও ‘বহু দিন দেশ ছেড়ে থাকা উচিত নয়’ এই বোধে দ্বারকা প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্ৰাৰ্থনা করলেন।

পাণ্ডবরাও—বলা অধিক—অন্তরে অন্তরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কিছু শুষ্ক সৌজন্যের পর সে অনুমতি দিলেন—কিন্তু বাসুদেবকে ছাড়তে রাজী হলেন না। সকলে সম্মিলিতভাবে ওঁকে অনুরোধ জানালেন আর কিছু দিন ইন্দ্রপ্রস্থে অতিবাহিত করার জন্য।

কে জানে, হয়ত বাসুদেবেরও সেই উদ্দেশ্য ছিল, তিনি সহজেই সম্মত হয়ে গেলেন। সামান্য সংখ্যক কিছু দেহরক্ষী ও অনুচর নিজের জন্য রেখে বাকী সকলকেই দ্বারকার দিকে রওনা ক’রে দিলেন। সাবধানে—মগধাধিপতি জরাসন্ধর আশ্রিত ও অনুরক্ত দেশগুলি বাঁচিয়ে—বিনয়ে সৌজন্যে মিত্র-রাজ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দৃঢ়তর করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।

অতঃপর পানভোজন, মৃগয়া ও রাত্রে নৃত্যগীতাদি উপভোগ, এ ছাড়া কোন কাজ রইল না। কদিন অতিথি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজকার্যে অনেক ক্ষতি হয়েছে, পাণ্ডবরা এখন সেই সব অবহেলিত অবশ্য-করণীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যুধিষ্ঠির শুধু অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি সর্বদা বাসুদেবের সঙ্গে থাকো, তাঁকে সাহচর্য ও সেবায় তুষ্ট করো। আপাতত কোন শত্রুর আক্রমণাশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না, সুতরাং তোমার যা দায়িত্ব—প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, তার জন্য বিশেষ ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। বাসুদেবের মনোরঞ্জনেই তুমি পূর্ণ মনোনিয়োগ করো।’

বাসুদেব যেন এই ঢালা অনুমতিরই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি অর্জুনকে নিয়ে নগরসীমার বাইরে যমুনাতীরে চলে গেলেন। তখন গ্রীষ্মকাল সমাসন্ন, জলবিহারে সকলেই উৎসুক। কিছু পুরনারীও সঙ্গে ছিলেন, আহারাদি ও অন্যান্য সেবার কোন অসুবিধা হল না। কিন্তু দেখা গেল বাসুদেবের গৃহ অপেক্ষা অরণ্যেই প্রীতি বেশী— তিনি অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানত নদীতীরের বনময় অঞ্চলে মৃগ ও বরাহ শিকার করেই বেড়াতে লাগলেন।

বিলাসে ও ব্যসনে স্বচ্ছন্দ গতিতে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি, নদী-স্রোতের মতোই। উচ্ছল হয়ে উঠেছেন পুরনারীরাও । তাঁদের প্রমত্ত আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল আনন্দই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য, ব্যসনই ইষ্ট।

কিন্তু সুখ বা ব্যসন বাসুদেবের যে একমাত্র লক্ষ্য নয় এখানে আসার–তা অর্জুনও বুঝেছিলেন, শুধু প্রধান উদ্দেশ্যটা কি—সেটাই ধরতে পারছিলেন না।

কয়েক দিন পরেই জানা গেল অবশ্য।

সহসাই একদিন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বভাবানুযায়ী প্রত্যুষে উঠে একা খাণ্ডব-অরণ্যে চলে গেলেন।

অর্জুন এতদিন বাসুদেবের এ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই তিনি এবার আর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না, কি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন না। শান্ত মনে শ্রীকৃষ্ণের প্রত্যাগমনের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

হয়তো দ্রৌপদী প্রভৃতির প্রমোদোৎসবের ঈষৎ যতিভঙ্গ হ’ল। কিন্তু বাসুদেব যে কোন গুরুতর কারণে এই ভাবে আত্মগোপন করেছেন—এমন সন্দেহ কারও হ’ল না।

আসলে বাসুদেব এভাবে একা গভীর অরণ্যে গিয়ে কি করেন সে বিষয়ে কারও কোন ধারণাও নেই। অর্জুনেরও না তিনি কখনও ভাবেন শ্রীকৃষ্ণ নির্জনে ধ্যানস্থ থাকেন কোথাও, কখনও মনে হয় শুধুই ঐ বনানীর শান্ত গম্ভীর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। আবার মনে হয় উনি একা জনহীন স্থানে বসে তাঁর কার্য ও কর্তব্য সম্বন্ধেই চিন্তা করেন। দু’একবার প্রশ্ন করতে গেছেন—কিন্তু বিশেষ সদুত্তর পান নি, তাতেই মনে হয়েছে—এ বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ বাসুদেব পছন্দ করেন না। তাই আর অধিক প্রশ্ন করতে সাহস হয় নি।

তবে যতই কল্পনা বা ধারণা করুন, বাসুদেবের প্রয়োজন ও কার্য-কারণ সম্বন্ধে অভ্রান্ত অনুমান অর্জুনের সাধ্যাতীত। এমনিতে ওঁর চিন্তার বুদ্ধির তল পাওয়া যায় না—এই খাণ্ডব-অরণ্যে গিয়ে উনি যা করেন তা যে-কোন মানুষেরই কল্পনার অতীত। এমন কি অর্জুনেরও।

সেদিন প্রত্যাবর্তনে বেশ একটু বিলম্ব হ’ল।

তার কারণ—সেদিনও উনি খাণ্ডবপ্রস্থে নিষাদ কীলকেরই অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন। যেসব স্থানে তার থাকার কথা— যেসব স্থানে সে থাকে—তার সবগুলিই দেখেছেন বাসুদেব কিন্তু তাকে পান নি। এ অনুপস্থিতি একটু দুজ্ঞেয়ই বোধ হয়েছে বাসুদেবের। এখন তিনি নিয়মিতভাবে কীলককে বৃত্তি দেন, তার সুরাপানের মূল্য যোগান। শর্ত—প্ৰতিমাসে পূর্ণিমা ও কৃষ্ণা দ্বাদশীতে সে এই অরণ্যে উপস্থিত থাকবে, যদি বাসুদেবের কোন প্রয়োজন পড়ে—তিনি নিজে এসে অথবা কোন বিশ্বস্ত অনুচরের দ্বারা যোগাযোগ করবেন। অনুচরের ক্ষেত্রে কী অভিজ্ঞান থাকবে, সে সম্বন্ধেও পূর্ব নির্দেশ দেওয়া আছে—যাতে সে অভিজ্ঞান দেখা মাত্র বাসুদেবের প্রেরিত লোক বলে বুঝতে পারে কীলক।

ইতিমধ্যে এমন প্রয়োজন পড়েছেও। বাসুদেব ঠিক ঠিক তাকে খুঁজে পেয়েছেন। কতকগুলো বিশেষ স্থান ঠিক করা আছে—তারই কোনটাতে কীলক থাকবে। থাকেও সে। আজই তার ব্যতিক্রম দেখছেন।

প্রায় সারা দিনই ঘুরলেন শ্রীকৃষ্ণ—সেই জনহীন বিষধর-সরীসৃপ অধ্যুষিত হিংস্র-পশু সমাকীর্ণ অরণ্য দেশে। এদের কাউকেই ভয় নেই তাঁর। আজ পর্যন্ত কোন ঋক্ষ কি শার্দুল তাঁকে আক্রমণ করে নি, শঙ্খচূড়ের উদ্যত ফণা নেমে গেছে তাঁর দৃষ্টি পড়া মাত্র। না, তিনি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন অন্য কারণে। বিশেষ প্রয়োজন আজ কীলককে—তাকে যথাস্থানে না দেখতে পেয়ে বিরক্তও।

অবশেষে প্রায় যখন ওকে খুঁজে পাবার আশা বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসছেন, বনস্থলীর শুষ্ক পত্ররাশিতে দ্রুত পদক্ষেপের শব্দ উঠল। অভ্রান্ত অনুমানে ফিরে দাঁড়ালেন বাসুদেব।

হ্যাঁ, কীলকই। কীলক সত্যিই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। তার সর্বাঙ্গ ধূলিধূসর, দেহ ঘর্মাক্ত—ঘর্মের সঙ্গে ধূলি মিশে কর্দমাক্ত বলাই উচিত, দৃষ্টি ক্লান্ত, মদ্যপানে আরক্তও।

বাসুদেব ভ্রূ-কুঞ্চিত করলেন। তবে কি লোকটা মদ্যপান ও আনুষঙ্গিক কদর্য ব্যসনেই মত্ত ছিল, স্থান কাল তিথির হিসাব এবং তার অবশ্য পালনীয় শর্ত মনে রাখে নি, স্মরণে পড়ে নি যে আজ কৃষ্ণা দ্বাদশী?

বোধ হয় তাঁর ভ্রূকুটির অর্থ কীলকও বুঝল। সেও রূঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘না হে, তা নয়। তোমারই কাজ করছিলাম। বাড়তি কাজ। তুমি বলো নি—বলার সময় হয় নি–তবু তোমার কাজ মনে করেই করেছিলাম। নইলে, যতই নেশা করি, এসব হিসেবে আমার ভুল হয় না।’

‘আমার কাজ? কী কাজ?’ বাসুদেবের প্রশান্তি ফিরে এসেছে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।

‘হস্তিনাপুরে গেছলাম মাংস বেচতে। সেখানে দেখলাম বেশ একটু গরম ভাব। বাড়তি লোকজনের আমদানি। বাইরের লোক এসেছে বলেই জিনিসপত্রের দরও চড়া, মাংস দ্বিগুণ দামে কিনতে চাইছে। কী ব্যাপার—শুনলাম দুর্যোধনের আমন্ত্রণে চেদী ও মগধ থেকে বিশেষ রাজদূত এসেছে। তাঁদেরই দেহরক্ষী, পরিচারক ইত্যাদিতে এত ভিড়। সহসা এদের কেন ডাকতে হল—ভাবলাম। মনে পড়ল জরাসন্ধ শিশুপাল দুজনেই তোমাদের শত্রু—হ্যাঁ, অনেকদিন পথে পথে ঘুরছি, এসব খবর জানতে বাকী নেই। আজ কেউ তোমার কাছ থেকে আসতে পারে, তুমিও এখানে আছ জানি— তোমাকে দেবার মতো কোন খবর আনতে পারি কিনা ভেবে ওদের দলে মিশে গেলাম। দেহরক্ষী সৈন্যরা নিজেদের খুব বড়-কেউ ভাবে—আমার এই দেশী মদের গন্ধে নাক তুলবে হয়ত—পাচক পরিচারক গাত্রসংবাহকরা তা করবে না। আর যত গোপনকথা মন্ত্রণাই হোক না কেন—দাসদাসীর অগোচর থাকে না। সেই ভেবেই দুদিন ধরে যেচে তাদের মদ খাওয়ালুম, মাংসর চড়া দাম পেয়েছি, তাতে ক্ষতিও হয় নি—তাতেই এত দেরি, দ্বিতীয় প্রহরের আগে যাত্রা শুরু করতেই পারলুম না, তবু তো সারা পথ দৌড়েই আসছি—’

‘তা বার্তাটা কি?’

‘দুর্যোধন চায় জরাসন্ধ তার দলবল বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে এদের এই নতুন রাজধানী ছারখার করুক পাণ্ডবদের বধ করুক। এ রাজ্য সে জয় ক’রে দুর্যোধনকে দিলে সে তখন জরাসন্ধকে সাহায্য করবে–তোমাকে বধ করতে, তোমার বংশ লোপ করতে।’

বাসুদেব হাসলেন।

ঈর্ষায় উন্মাদ হয়ে গিয়ে শিশুত্ব প্রাপ্ত হয়েছে দুর্যোধন। তা নইলে এমন অবাস্তব কথা ভাবত না, ওদের কাছেও প্রস্তাব করত না। সে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হতে পারে—জরাসন্ধ শিশুপাল জ্ঞান হারান নি নিশ্চয়। পাণ্ডবদের আক্রমণ করলে বৃষ্ণি পাঞ্চালরা দর্শক মাত্র হয়ে থাকবে না। সে এক ঘোরতর সংগ্রাম বাধবে। এত শক্তিই যদি থাকবে—জরাসন্ধের লক্ষ্য যে বৈরী, সেই যাদবদেরই তো ধ্বংস করতে পারত। সদ্য কংস-শাসন-মুক্ত দীর্ঘদিনের পরাধীনতায় ক্লৈব্যাভ্যস্ত যাদবদের আক্রমণ ক’রেই সে পরাজিত পদানত করতে পারে নি, শ্রীকৃষ্ণ বলদেবকে বধ করা সম্ভব হয় নি–বার বার মথুরা অবরোধ করেছেন, সহস্র সহস্র সৈনিক নিহত হয়েছে সে চেষ্টায়। এখন সমুদ্র পার হয়ে সেই সুদূর পশ্চিম- দেশে গিয়ে যাদবদলন কতটা সম্ভব হবে—সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি জরাসন্ধের আছে নিশ্চয়। নইলে তিনি আজ উত্তর ভারতের রাজচক্রবর্তী বলে স্বীকৃত হতেন না। কন্যাদের বৈধব্যের জ্বালা তাদের হাহাকার সহ্য করতে না পেরেই মথুরায় হানা দিয়েছিলেন, তাছাড়া–বোধ হয় যাদবদের কষ্ট সহ্য করার শক্তি কতটা তাও অনুমান করতে পারেন নি। যাই হোক, তাতেই শিক্ষালাভ হয়েছে আরও—এখন দুর্যোধনের কণ্টক দূর করতে তিনি ওদের সঙ্গে—পাণ্ডবদের আক্রমণ করলে যাদবরা দর্শক মাত্র হয়ে থাকবে না এ তো জানাই—প্রচণ্ড যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন। এত নির্বোধ তিনি নন।

তবু, আর বিলম্ব করাও উচিত নয়।

যে উদ্দেশ্যে এসেছেন সে-কাজ ত্বরান্বিত করাই বরং প্রয়োজন এখন।

কীলক ঈষৎ কুণ্ঠিত অপ্রতিভ ভাবেই বলছে শুনলেন উনি, ‘ওদের—মানে জরাসন্ধদের কী যুক্তি হবে তা অবশ্য জানা গেল না। এরা এই বার্তা নিয়ে দেশে ফিরে গেলে তারা বিবেচনা ক’রে দেখবে।’

‘তারা কি স্থির করবে তা আমি জানি, সেজন্য চিন্তা নেই। শোন, তোমাকে যে কাজের জন্য ডেকেছি। দানব-স্থপতি ময়ের কোন সন্ধান পেলে?’

‘না। নাগরাজ তক্ষকের ভয়ে সে এমনই আত্মগোপন করেছে যে, কিছুতেই তাকে খুঁজে বার করতে পারছি না। তবে সে এই অরণ্যেই যে আছে—এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’

‘আশ্চর্য! এই অরণ্যেই সে আছে—তবু তার সন্ধান পেলে না?’

‘না। ওরা অনেক রকম মায়া জানে, ছদ্মবেশ ধারণ করা এমন কোন কঠিন কাজ নয় ওদের কাছে। দীর্ঘকাল অনাহারে থাকতে পারে। সে যেখানে আছে—সেখান থেকে যদি বার না হয়, ধরব কী ক’রে?’

‘তা হলে কী কর্তব্য মনে করো?’

‘কে জানে, কোন উপায় তো মনে পড়ছে না।’

‘এই বনে আছে—সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই?’

‘না। সেটা আমি নিশ্চিত জানি। সব দিক থেকে সব রকম ভাবে সে সংবাদ নিয়েছি। এই বনে তাকে ঢুকতে দেখেছে অনেকেই, বেরোতে দেখে নি একজনও। তার বাড়িতে খবর নিয়েছি, সমস্ত আত্মীয়-বান্ধবের কাছে—কোথাও সে যায় নি।’

‘তা হলে এক কাজ করো। প্রয়োজন-মতো কিছু বিশ্বস্ত সহকারী সংগ্রহ করতে পারবে? অবশ্যই তাদের পারিশ্রমিক দেব, অকৃপণ হাতেই দেব।’

‘কাজটা কি?’

‘এই খাণ্ডবদাবে অগ্নিসংযোগ করতে হবে। চারিদিক ঘিরে সে-বৃত্তাগ্নি জ্বলবে, কোথাও না ছেদ থাকে। শুধু একষ্মিািত্র পথ থাকবে মুক্ত, সে পথ আমি ও অর্জুন পাহারা দেব। দানব-স্থপতি যত বড় মায়াধর ঐন্দ্রজালিকই হোক, পাবক তাকে দগ্ধ করবে না—তা সম্ভব নয়।’

‘কিন্তু ঠাকুর ওরা নানা ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে, তুমি চিনবে কি ক’রে।’

‘কোন প্রাণীই যদি পরিত্রাণ না পায় তো সে পালাবে কী ক’রে? এটুকু সে বুঝবে যে স্ব-রূপেই বরং নিরাপদ, তাকে বধ করার কোন হেতু নেই।’

‘কিন্তু এত বড় বনস্থলীতে আগুন লাগাবো, লোকে রাগ করবে না? নানা কথা জিজ্ঞাসা করবে না?’

‘কী আর জিজ্ঞাসা করবে! দাবানল কিছু অপ্রাকৃত ঘটনা নয়। রটনা করো যে যজ্ঞে নিরন্তর হবি পান করে অগ্নির অগ্নিমান্দ্য হয়েছে, তাই তিনি মাংস ভোজন করে রসনাকে প্রকৃতিস্থ করার জন্য এই অরণ্য আহারে প্রবৃত্ত হয়েছেন!’

‘বেশ, তাই না হয় বলব। কিন্তু চারিদিক থেকে এত বড় বনে আগুন লাগানো— অনেক লোক চাই সে-লোক সংগ্ৰহ করতে কয়েক দিন লাগবে!’

‘তা হোক, কত দিন আর লাগবে? এর মধ্যে একটু নজর রেখো, দানব না পালায়। আগামী শুক্লা একাদশী দিন স্থির রইল। যদি সমগ্র বনস্থলী দাহ শেষ হতে সারা দিনেও না কুলোয়—প্রথম রাত্রে জ্যোৎস্না পাওয়াই বাঞ্ছনীয়।…কাল তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি এক সহস্ৰ নিষ্ক পাঠাবো, আশা করি তাতেই কাজ চলে যাবে।’

কীলকের দৃষ্টি নিমেষে লুব্ধ হয়ে উঠল অর্থের পরিমাণ শুনে। সে সবেগে বার কতক ঘাড় নাড়ল।

তারপর, বাসুদেব ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছেন—এমন সময় কি ভেবে বললে, ‘শোন—

আরক্ত চক্ষু দুটির দৃষ্টি কঠিন ও কুটিল হয়ে উঠল কীলকের। সে বলল, ‘তুমি কি বলো আমি বুঝি না। বিশ্বাসও হয় না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারি না তোমাকে …তুমি যে বলো এখন পাণ্ডবদের সাহায্য ক’রে গেলেই আমার প্রতিহিংসার পথ সুগম হবে—এ কি ঠিক?’

‘আমি মিথ্যা বলি না নিষাদ।’ শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেন শ্রীকৃষ্ণ। সহজ স্বাভাবিক স্বর—কিন্তু মনে হয় যেন অরণ্যের বহু দূর পর্যন্ত এক গম্ভীর লয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

‘কে জানে! তবু বিশ্বাস না করে যখন কোন উপায় নেই, তখন করলুম। দ্যাখো, ওই বনে দেব-দত্ত এক বিরাট ধনু আছে, গণ্ডকের মেরুদণ্ডে তৈরী—আজ পর্যন্ত এমন অস্ত্র নাকি তৈরীই হয় নি পৃথিবীতে—যা ঐ ধনুকে কাটতে পারে। ঐ ধনু, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, বিশাল এক গদা আর দুটি রথও লুকানো আছে। কেউ জানে না এমন ভাবে গোপন করা আছে। সেগুলি যদি সরিয়ে না নাও, আগুনে নষ্ট হবে, তোমরা পেলে তোমাদের শক্তির সীমা থাকবে না, অজেয় হবে। নেবে তোমরা?’

বাসুদেবের মুখভাবে লোভ বা অশোভন ব্যগ্রতা প্রকাশ পেল না বটে—তবে দৃষ্টি তাঁরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। গাণ্ডীব ধনু,—কপিধ্বজ রথ, কৌমুদকী গদা—এদের কথা শুনেছি। কোথায় আছে সন্ধান পাই নি। চলো, এখনই দেখে আসি। তেমন বুঝলে আগামী কালই সেগুলি সরিয়ে নেব।…আর, তোমার এই আনুকূল্যও আমি স্মরণ রাখব নিষাদ, তোমার যা আকৃতি তা পূর্ণ হবে, প্রতিশোধলালসা চরিতার্থ হবে। পাণ্ডবদের পুত্রনাশ বংশনাশ তুমি দেখতে পাবে, তোমাকে সত্যই বলছি।

১৫

পঞ্চদশ দিবারাত্রিব্যাপী সেই প্রায়-প্রলয়াগ্নিলীলায় বিরাট খাণ্ডব বন তার অসংখ্য পশু পক্ষী সরীসৃপ ও কিছু কিছু অরণ্যচারী মানবসহ ভস্মীভূত হয়ে গেল। তবে পশু-পক্ষী ও সর্পাদিই বেশী। পিশাচধর্মী যেসব বর্বর মানুষ আরণ্যক জীবনে অভ্যস্ত, হিংস্র জন্তুর মতোই জীবনযাপন করে—কীলক ও তার সহচররা পূর্বাহ্নেই তাদের সতর্ক করেছে। কেউ কেউ শুনেছে, কেউ শোনে নি। যারা শুনেছে তারাও অনেকে বিশ্বাস করে নি। ভাবতে পারে নি এত বড় বনটা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হবে। যখন প্রত্যক্ষ দেখল তখন আর কেউ সে বহ্নিবলয় থেকে বার হতে পারল না। অগ্নিশিখার একটা সর্বনাশা মোহ আছে, তাতে সব জ্ঞান অভিজ্ঞতা বুদ্ধি যুক্তি আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সেই প্রলয়ঙ্কর লেলিহান শিখাকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করতে দেখে অর্ধনর বনচারীদের উদভ্রান্তি জন্মাবে, এ আর আশ্চর্য কী

কিন্তু তা হোক বাসুদেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। মহৎ উদ্দেশ্যে দু-চারটে প্রাণী কি মানুষ নিহত হলে দোষ নেই। যারা অবিরতই মরছে—নানা কারণে—তাদের মৃত্যুটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ময়দানবকে বাসুদেবের প্রয়োজন। এই খাণ্ডব দগ্ধ না হলে তাকে পেতেন না, সেইটেই বড় কথা।

দানবস্থপতি ময় দানবশত্রু মহেন্দ্রের ভয়ে তাঁরই বন্ধু নাগরাজ তক্ষকের আরণ্য আবাসে আত্মগোপন ক’রে ছিলেন। এই সময় তক্ষকরা থাকেন না, সেই সুযোগ। ইন্দ্র আর যেখানেই সন্ধান করুন না কেন—পরম মিত্রর ঘরে তাঁর শত্রুকে অন্বেষণ করবেন না। তক্ষক বন্ধুর বিদ্বেষভাজন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেবেন ইন্দ্রের কাছে তা বিশ্বাস্য নয়। কল্পনারও অগোচর। ।

কিন্তু—বাসুদেবের অনুমান অভ্রান্ত। আগ্রাসী অগ্নির সামনে অন্য কোন ভয়েই আত্মগোপন ক’রে থাকা সম্ভব নয়। শুধু তাও না, আত্মপরিচয় নিজেকেই দিতে হ’ল। এই বহ্নিবেষ্টনী থেকে অব্যাহতির একমাত্র যে সংকীর্ণ পথ–সে পথে কালান্তক কৃতান্তসহচরের মতোই প্রহরায় ছিলেন বাসুদেব ও অর্জুন। পাছে ছদ্মবেশে বা অজ্ঞাতপরিচয় সামান্য বনচর হিসাবে তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে যান—তাঁরা নির্বিচারে সেই নিষ্ক্রমণ পথের পলায়নপর সমস্ত প্রাণীকেই বধ করছিলেন।

ময় বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন তাও, দাবানল হয়ত একসময় আপনিই নিভে যাবে—এই আশায়। কিন্তু যখন আর সম্ভব হ’ল না, তখন সেই পথের সামনে এসে তারস্বরে অর্জুনের দয়া ভিক্ষা করলেন, ‘হে ফাল্গুনী, আমাকে রক্ষা করো, আমি তোমার কাছে চিরঋণী থাকব। আমি তোমার শরণ নিলাম। তোমাদের বংশে শরণার্থীর জন্য প্রাণ দেওয়ার দৃষ্টান্ত ভুরি-ভুরি—আশা করি আজ তুমি সে-ঐতিহ্য বিস্মৃত হবে না।’

তার পরই পরিচয় দিয়েছিল, ‘আমি দানবস্থপতি—দানবদের বিশ্বকর্মা ময়, আমাকে রক্ষা করলে অবশ্যই আমি তোমার কোন প্রিয় কর্ম করে তোমার ঋণ শোধ করব।’

অর্জুন অবশ্য এ পরিচয় জানবার পূর্বেই, শরণার্থী প্রাণভিক্ষা চাইছে এ-ই যথেষ্ট কারণ বোধে, অস্ত্র সম্বরণ করেছিলেন হাত তুলে শ্রীকৃষ্ণকেও ইঙ্গিত করেছিলেন নিরস্ত হতে। এখন—পরিচয় পাবার পর, আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি আয়ত্তাধীন জেনে—আর কোন প্রয়োজন রইল না। একেবারেই অস্ত্রত্যাগ করলেন তাঁরা। অবশ্য তখন–না বন না বনচর—কিছুই বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না। কে রক্ষা পেল আর কে পেল না তা নিয়ে মাথাও ঘামালেন না বাসুদেব আর। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, প্রয়োজন সিদ্ধ—তিনি শ্রান্তদেহে নিশ্চিন্ত চিত্তে যমুনার তীরবর্তী প্রমোদাবাসে প্রত্যাবর্তন করলেন। অগ্নিতাপে দেহটাও প্রায় অর্ধদগ্ধ, তৈল ও ঔষধ প্রয়োগ আশু প্রয়োজন, তখন আর ময়দানবের সঙ্গে বাক্যালাপেও কালক্ষেপ করলেন না। দানবস্থপতির সম্মানের উপর এটুকু নির্ভর করা যায়, কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করতে তিনি আসবেনই।

অর্জুনকে খাণ্ডব-দাহনের এ প্রয়োজনের কথাটা বলেন নি বাসুদেব—ময়দানবের কথাটা।

সে প্রয়োজনও হ’ল না। কয়েকদিন পরে যখন ময়দানব নিজেই এসে দেখা করে অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আমার প্রাণ দান করেছ, আমার কাছে সেটা বিপুলতম ঋণ। সম্পূর্ণ শোধ করার সাধ্য নেই হয়ত—কিন্তু আংশিক হিসাবেও সে ঋণ কীভাবে শোধ করতে পারি—তোমার কোন প্রিয়কার্য সাধন ক’রে—যদি জানাও তো অনুগৃহীত হই।’ তখন অর্জুন বাসুদেবকেই দেখিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমার কোন প্রয়োজন বা তেমন কোন বাসনা নেই—তুমি আমার এই সখা ও আত্মীয় শ্রীকৃষ্ণের কোন আজ্ঞা পালন বা প্রিয়কার্য সাধন করলেই আমার ঋণ শোধ হবে। তুমি এঁকেই জিজ্ঞাসা করো।’

শ্রীকৃষ্ণ বোধ করি এও জানতেন। উত্তরও প্রস্তুত ছিল তাঁর। দ্বিধামাত্র না ক’রে তাই বললেন, ‘দেখ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নূতন রাজ্য পত্তন ক’রেও অল্পদিনেই যশস্বী ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছেন। পাণ্ডবদের যা শক্তি, কর্মকুশলতা এবং বুদ্ধিমত্তা—যুধিষ্ঠির অচিরে রাজচক্রবর্তী বলে গণ্য হবেন তাতেও সন্দেহ নেই। রাজচক্রবর্তী বলে স্বীকৃত হলেই দেশবিদেশ থেকে নৃপতিরা আসবেন, শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি জানাতে। সে অবস্থার বড় বিলম্বও নেই। অথচ সেদিনের উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা, এ রাজধানীতে করা যায়নি অদ্যাপি। আমার ইচ্ছা—অবশ্য তুমি যদি তোমার প্রাণের মূল্য শোধ করা আবশ্যক মনে করো—তুমি এখানে, এই নূতন নগরীর উপান্তে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন ক’রে এমন একটি সভাগৃহ নির্মাণ ক’রে দাও, যা সর্বতোভাবে ভারতখণ্ডের ভাবী মহারাজচক্রবর্তীর উপযুক্ত হয়। হে দানবস্থপতি, আমি জানি, শিল্পসৃষ্টির সকল দিকেই তোমার নৈপুণ্য শিল্পীশ্রেষ্ঠ বলে খ্যাত বিশ্বকর্মার অপেক্ষা অনেক বেশী। স্থপতি হিসেবেও তুমি অদ্বিতীয় তাতেও সন্দেহ নেই। তুমি তার সর্বজন-প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসাবেই এমন একটি সভাগৃহ নির্মাণ করো—যা বিপুলতায় সৌন্দর্যে ও অভিনবত্বে এই ভূমণ্ডলে অভিনব ও অনির্মিতপূর্ব বলে স্বীকৃত হয়। সে সভাভবন এমন হবে যা শুধু এই জম্বুদ্বীপেই নয়, সারা বিশ্বে কোথাও কেউ নির্মাণ করে নি, কল্পনাও করতে পারে নি–পরেও পারবে না—ন ভূতো ন ভবিষ্যতি। মানবজাতির ইতিহাসেই যেন চিরবিস্ময়ের তুলনারূপে লিখিত থাকে তার বিবরণ। হে মহাস্থপতি, এ কার্য সমাপ্ত হলে শুধু আমার প্রিয়সাধন কি তোমার জীবনঋণই শোধ হবে না—এ গৃহ যুগে-যুগান্তরে তোমার অক্ষয় কীর্তি ঘোষণা করবে।’

ময় স্থির হয়ে অর্ধনিমীলিত নেত্রে নতমস্তকে কৃতাঞ্জলিপুটে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন—তারপর বাসুদেবকে নমস্কার ক’রে বললেন, ‘তাই হবে। তবে এই ধরনের সুবিপুল গৃহ নির্মাণ বহু ব্যয়সাধ্য, আশা করি আপনিও তা জানেন। অসংখ্য শিল্পী ও কারিগর লাগবে, সহস্রাধিক সাধারণ শ্রমিক। তা ব্যতীত উপকরণের প্রশ্ন আছে। শ্বেত প্রস্তর, স্ফটিক, স্বর্ণ রৌপ্য, মণিমাণিক্যাদির তো কথাই নেই। লক্ষ লক্ষ সুবর্ণনিষ্কর প্রয়োজন হবে। সেসব কে যোগাবেন – মহারাজাধিরাজ যুধিষ্ঠিরের সে সঙ্গতি আছে কিনা জানি না, সন্দেহ প্রকাশের ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন—তবে এসব স্থ±ল কথাগুলো পূর্বাহ্নেই সেরে নেওয়া আবশ্যক, তাতে বিস্তর সুবিধা হয়, অকারণে কালক্ষেপ করতে হয় না। কাজ আরম্ভ ক’রে উপকরণ বা ধনাদি সরবরাহে বিঘ্ন উপস্থিত হওয়া, বা পরের প্রসন্নতার জন্য অপেক্ষা করা—শিল্পকর্ম কেন, যে কোন বৃহৎ কর্মের পক্ষেই ক্ষতিকর অযথা বিলম্ব তো ঘটেই, অনেক সময় সে কর্মও সমাধা হয় না। ‘

বাসুদেব যেন কতকটা উদাসীনভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘উপকরণ ও অর্থ সরবরাহের দায়িত্ব আমার, কর্মী সংগ্রহের ভার তোমার উপর রইল।’

শঙ্কিত বিস্ময়াহত অর্জুনের যখন বাঙনিষ্পত্তি সম্ভব হ’ল তখন ময়দানব আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি লাভে নিশ্চিন্ত এবং প্রসন্ন হয়ে বিদায় নিয়েছেন।

ব্যাকুল অর্জুন বললেন, ‘এ কী করলেন আপনি! না না, এত সম্পদ বা অর্থ আমাদের কোথায়? এ যে কুবেরেরও অসাধ্য কাজ! আপনি নিবৃত্ত করুন ওকে—’

‘তুমি তো আমার ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলে, এখন আবার সে কথা ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে অপমানিত করতে চাও নাকি?’

এই একটি মাত্র প্রশ্নে অর্জুনকে নির্বাক করে দিলেন বাসুদেব।

দেখা গেল শ্রীকৃষ্ণ উপকরণ সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি—তার পূর্ণ দায়িত্ব সম্বন্ধে চিন্তা বিবেচনা ক’রেই দিয়েছিলেন।

এই দানবস্থপতি ময়ই ইতিপূর্বে কৈলাসের উত্তরে বিন্দুসরোবরের তীরে দানবরাজ বৃষপর্বার জন্য একটি সভাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। বিশেষ যজ্ঞের জন্যই তা প্রস্তুত হয়েছিল, এখনও তার বহু তৈজস উপকরণাদি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। বাসুদেব সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ময় সেই প্রাসাদ ভেঙে সেখানকার মূল্যবান স্ফটিক, শ্বেত প্রস্তর ও মণি- রত্নাদি আনানোর ব্যবস্থা করলেন। এছাড়া সেই জনহীন তুষারাবৃত পার্বত্য দেশে যুগযুগান্তর ধরে বিস্তর স্বর্ণ ও মণিমুক্তা জমে ছিল—কিম্বদন্তী বৃষপর্বারও পূর্বে দেবরাজ ইন্দ্র বহু বৎসর যজ্ঞ করেছিলেন—সে সময় অসংখ্য হিরণ্ময় চৈত্য বা মন্দির নির্মাণ করেন, সেগুলিও এখন কাজে লাগল।

এসব উপাদান বিনা বাধাতেই আনা গেল। সেই সঙ্গে ময় আরও দুটি জিনিস নিয়ে এলেন, বৃষপর্বার দেবদত্ত নামে মহানাদী এক শঙ্খ এবং বিশ্বে অতুলনীয় একটি গদা। ময় শঙ্খটি অর্জুনকে ও গদাটি ভীমকে উপহার দিলেন। সে শঙ্খের গম্ভীর ভীমনাদ বহু দূর পর্যন্ত পৌঁছয়, সহস্র সহস্র শ্রোতার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। গদাটি স্বর্ণখচিত কিন্তু সাধারণ মানুষের যোগ্য বা সহজায়ত্ত নয়। বৃষপর্বা বিশেষ কারিগর দ্বারা এটি নির্মাণ করান, আকৃতিতে তেমন বিশাল বা ভয়াবহ না হলেও অতিশয় গুরুভার—বিশেষ বলশালী ব্যক্তি ছাড়া কেউ তা আস্ফালন করতে বা যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন না। এ গদা নিক্ষিপ্ত হলে ভূপাতিত বা নিহত হবেন না—ভীমসেন ও দুর্যোধন ছাড়া সে সময়ও এমন মল্লবীর কেউ ছিলেন না। শক্রনিধনে অদ্বিতীয় সেই গদাটি পেয়ে ভীমসেন আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। অর্জুনও এবার গাণ্ডীব ধনু, কপিধ্বজ রথ, অক্ষয় তূণীর এবং দেবদত্ত শঙ্খ পেয়ে বিশ্বত্রাস অপরাজেয় যোদ্ধা রূপে পরিগণিত হলেন।

অতঃপর ময় সেই আশ্চর্য সভা নির্মাণে প্রবৃত্ত হলেন। স্থান নির্বাচনই সর্বাধিক সমস্যা। ময় এমন একটি স্থান বেছে নিলেন—গ্রীষ্মে অসহ তাপ, শীতে হিমতীক্ষ্ণ উত্তর বাতাস সেখানে অধিবাসীদের ক্লিষ্ট করতে না পারে, অতি বর্ষণে জল জমে না বৃক্ষরাজি নষ্ট নয়। ঈষৎ-উচ্চ অথচ সমতল কঠিন মৃত্তিকা দেখে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দুদিকেই দশ সহস্ৰ হস্ত হিসাবে সভাগৃহ নির্মাণ ভূমি নির্বাচন করলেন। অধিকাংশই পতিত জমি, তার মধ্যে জনপদ বা গ্রাম বিশেষ ছিল না, যা দু-চার ঘর অরণ্য অধিবাসী ছিল তাদের রাজ আদেশে অন্যত্র উৎকৃষ্টতর জমি দিয়ে পুনর্বসতির ব্যবস্থা হোলো

দানবস্থপতি হিমালয় থেকে বহু উপকরণ ও সম্পদ আহরণ করেছিলেন। শুধু বৃষপর্বা বা ইন্দ্ৰই নন, তারও পূর্বে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি সে-স্থানে দীর্ঘকাল ধরে যজ্ঞাদি করেছেন। শিবাবাসভূমি কৈলাসের কাছেই এই স্থান দেবদানব- গন্ধর্বদের প্রিয় সাধনক্ষেত্র। সেই সব যজ্ঞকারদের পরিত্যক্ত অপরিমিত ঐশ্বর্যে সে-স্থান কুবেরের ভাণ্ডার হয়ে আছে। পরিত্যক্ত বলেই অধিকার নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। যে গ্রহণ করবে তারই সে সম্পদ। ময় আট হাজার বলিষ্ঠ অনার্য আদিবাসী সংগ্রহ ক’রে তাদের সাহায্যে সেই প্রস্তর, স্ফটিক ও মণিমাণিক্য স্বর্ণ বহন করিয়ে আনলেন এবং তাদের আর বিদায় দিলেন না, তারাই শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে লাগল। সভাগৃহ নির্মাণ সমাপ্ত হলে মহারাজ যুধিষ্ঠির তাদের মধ্যে বহু লোককে সেখানে প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন।

এই আট হাজার প্রভূতবলশালী শ্রমিক, সহস্রাধিক স্থাপত্য-শিল্পী এবং ময় স্বয়ং—এক বৎসর দুই মাস কাল অহোরাত্র পরিশ্রম ক’রে সেই সভাগৃহ নির্মাণ সমাপ্ত করলেন। শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন তা-ই ক’রে দিলেন ময়–ন ভূতো ন ভবিষ্যতি’। তেমন সভাগৃহ পূর্বেও পৃথিবীর কুত্রাপি নির্মিত হয় নি, সম্ভবত পরেও হবে না।

‘ময় ত্রিলোক-বিখ্যাত মণিময় সভা নির্মাণ করলেন যার দীপ্তিতে যেন সূর্যের প্রভাও বিনষ্ট হ’ল। এই বিশাল সভা নবোদিত মেঘের ন্যায় আকাশ ব্যাপ্ত ক’রে রইল। তার প্রাচীর ও তোরণ রত্নময়, অভ্যন্তর বহুবিধ উত্তম দ্রব্যে ও চিত্রে সজ্জিত।… ময় দানব সেখানে একটি অতুলনীয় সরোবর রচনা করলেন, তার সোপান স্ফটিক-নির্মিত, জল অতি নির্মল, বিবিধ মণিরত্নে সমাকীর্ণ এবং স্বর্ণময় পদ্ম মৎস্য ও কূর্মে শোভিত। যে সমস্ত রাজারা দেখতে এলেন তাঁদের কেউ কেউ সরোবর বলে বুঝতে না পেরে জলে পড়ে গেলেন। সভাস্থলের সকল দিকেই পুষ্পিত বৃক্ষশোভিত উদ্যান হংসকারণ্ডবাদি সমন্বিত পুষ্করিণী সভা শেষ হলে যুধিষ্ঠির গুরুজনদের অনুমতি ও ব্রাহ্মণদের অনুমোদন নিয়ে ঘৃত-মধুযুক্ত পায়স, মৃগ-শূকর মাংস ও অন্যান্য সুস্বাদু বিবিধ ভোজ্য দিয়ে কয়েক হাজার ব্রাহ্মণভোজন করালেন এবং দেবপূজা ও দেববিগ্রহ স্থাপন করে পরিশেষে সভায় প্রবেশ করলেন এবং দুর্লভ মণিমাণিক্যখচিত নবনির্মিত সিংহাসনে আসীন হলেন। এই উপলক্ষে বেশ কয়েক দিন ধরে মল্লযুদ্ধ, লাঠিখেলা, নৃত্যগীত অভিনয় অনুষ্ঠান প্রভৃতি উৎসব সমারোহ চলল।

এই আশ্চর্য ও অতুলনীয় সভাগৃহের খ্যাতি দেশবিদেশে পরিব্যাপ্ত হওয়ায় অনেক মিত্ররাজ্য থেকে নরাধিপরা রবাহূত হয়েই দেখতে এলেন। তাঁদেরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাঁরা কেউ কেউ এই উপলক্ষে হাস্যাস্পদ ও অপ্রতিভও হলেন। স্ফটিকের গৃহপ্রাচীরকে মুক্ত নিষ্ক্রমণ পথ ভেবে মস্তকে আঘাত পেলেন, আবার সরোবরের অতিস্বচ্ছ জলের মধ্যে দ্যুতিমান স্বর্ণনির্মিত ও মণিরত্নশোভিত পুষ্পবৃক্ষ দেখে উদ্যান বোধে সে পুষ্প আহরণ করতে গিয়ে জলমগ্ন হলেন

প্রাচুর্যের ও ঐশ্বর্যেরও শেষ নেই, সসম্ভ্রম বিস্ময়বোধেরও না। সবটাই যেন অলৌকিক অবিশ্বাস্য বোধ হয় তাঁদের। পাণ্ডবদের ধৈর্য সৌজন্য এবং লোকোত্তর শৌর্যের খ্যাতি ইতিমধ্যেই ভারত-খণ্ডের নৃপতিমহলে সম্ভ্রমের সৃষ্টি করেছিল, সেই সঙ্গে—বিশেষ কৃষ্ণার স্বয়ম্বরের পর—একটু মাৎসর্যেরও। এখন এই ঐশ্বর্য দেখে সে দুই মনোভাবই আরও বৃদ্ধি পেল। এই কুবেরেরও-ঈর্ষা-উৎপাদনকারী অপরিমাণ সম্পদ–পাণ্ডবরা স্বীয় ভুজবলে আহরণ করেছেন এই রকমই প্রতীতি হল সকলের। সুদুর্গম হিমালয় পর্বতের গহন বিজন প্রদেশ থেকে এই বিপুল সংখ্যাগণনার অতীত ঐশ্বর্য সংগৃহীত হয়েছে তা কেউই জানত না, ময়ও কাউকে বলেন নি, কারণ তাহলে সুবর্ণলোলুপ এই সব নৃপতিরা গলিত- মাংসের-স্তূপে-গৃধ্রদের মতো সেখানে গিয়ে পড়তেন ও ময়ের কাজে ব্যাঘাত জন্মাতেন।

সুতরাং পরশ্রীকাতর দর্শকের দল সক্ষোভ দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতেই নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সে-বক্ষবেদনা প্রকাশ করতে বা একদা এই সম্পদ কোন দিন এখান থেকে বলপূর্বক হরণ করতে পারবেন—এমন স্বপ্ন দেখতেও সাহস করেন নি।

কিন্তু এই দেশের সর্বপ্রান্ত থেকে আগত অগণিত নৃপতি ও সম্ভ্রান্ত দর্শকেরই ঈর্ষা-বিস্ময়-মিশ্রিত প্রশংসা ও চাটুবাদ, প্রজাদের সহর্ষ জয়ধ্বনি, কৌরব ভ্রাতাদের গাত্রদাহের কৌতুককর কাহিনী—কিছুই পাণ্ডবদের পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করতে পারল না।

এই সমস্ত কিছুর মূল যিনি, আসলে সংঘটনকারী—যাঁর পরিকল্পনা নির্দেশেই এই স্বপ্ন-কল্পনার বস্তু আকার ধারণ করে পাণ্ডবদের স্বপ্নেরও অতীত সৌভাগ্য দ্যোতনা করছে—যাঁর দুঃসাহসিক ব্যবস্থাপনাতেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে— পাণ্ডবদের একান্ত শুভানুধ্যায়ী সেই মানুষটি কোথায়!

সেই বাসুদেব?

তিনি আসছেন না কেন?

যাঁর সর্বাগ্রে আসবার কথা, সর্বাপেক্ষা আনন্দ লাভের কথা?

সভাগৃহ মোটামুটি একটা আকার পরিগ্রহ করার সময় থেকেই ধর্মরাজ সাদর আহ্বান জানিয়ে দূত পাঠাতে আরম্ভ করেছেন, সমাপ্তির পথে এসেছে বুঝে জানিয়েছেন সাদর আমন্ত্রণ, এ গৃহপ্রবেশে তাঁরই অগ্রাধিকার, সবিনয়ে সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—কিন্তু সে সভাগৃহের প্রতিষ্ঠাযজ্ঞ ও প্রবেশ, অধিরোহণ প্রভৃতি অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল— তবু তিনি এলেন না কেন? যাঁর আগ্রহ উৎসাহ সর্বাধিক হবার কথা—সেই বাসুদেব এমন উদাসীন ও বীতস্পৃহ রইলেন কেন?

তবে কি পাণ্ডবদের কোন অপরাধ হয়ে গেল কোথাও?

ওঁদের কি এত দ্রুত গৃহপ্রবেশ অকর্তব্য হয়েছে? উচিত ছিল তাঁর আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করা?

এর কোন উত্তর মেলে না কারও কাছ থেকে। কেউ এ রহস্যের সমাধান করতে পারেন না। এমন কি বৃষ্ণি ও অন্ধক প্রধানদের কাছ থেকেও কোন সদুত্তর লাভ করতে পারলেন না যুধিষ্ঠিরের প্রেরিত দূতগণ।

তাতেই পাণ্ডবদের অস্বস্তি বৃদ্ধি পায়। এমন একটি করায়ত্ত সুভোগ্য বস্তুও শান্তিতে ভোগ করতে পারেন না।

কেন যে বাসুদেব অযথা এই বিলম্ব করেছেন—সত্যই তা দ্বারাবতীতে কেউ জানত না।

যাদবরা ভাবছেন সুভদ্রার শ্বশুরালয়ে প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ইন্দ্রপ্রস্থে অযথা দীর্ঘকাল কাটিয়ে এসেছেন—আলস্যে বিলাসে ব্যসনে মৃগয়ায়—তাতে রাজকার্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই কারণেই বিব্রত অনুতপ্ত শ্রীকৃষ্ণ এখন আর পুরী ত্যাগ করতে পারছেন না।

বাসুদেবের এই দুর্বোধ্য আচরণ—তাঁর গোপন অন্তর্দ্বন্দ্বের ইতিহাস—তাঁর প্রিয়তমা মহিষীরাও জানতেন না।

তাঁদের জানানোর মতো নয়ও কথাটা।

দানবস্থপতি স্থান নির্বাচন ক’রে গৃহ নির্মাণের সূচনা করেছেন এইটুকু দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ ত্যাগ করেছেন বাসুদেব।

ইতিপূর্বে বহুবারই ইন্দ্রপ্রস্থে এসেছেন ও দ্বারকায় ফিরেছেন—কিন্তু এবারের এই আসা-যাওয়ার মধ্যে একটু বিশেষত্ব ছিল। এখন তিনি এ পুরীর কুটুম্ব, আত্মীয়। সেক্ষেত্রে বিদায়-পর্বের কতকগুলি নিয়মরীতি আছে, তা তিনি–নিজে সর্বসংস্কারের অতীত হলেও –মানতে বাধ্য। সেবকদের পারিতোষিক দান, আত্মীয়-গুরুজনদের বস্ত্রাদি প্রণামী গৃহদেবতা-পুরদেবতা পূজার্চ্চনা, ব্রাহ্মণদের সাদর সম্ভাষণ প্রণামাদি জ্ঞাপন ও সম্মান-দক্ষিণা প্রদান—সর্বোপরি আত্মীয়দের বয়স পদবী সম্পর্ক ইত্যাদি বিচার ক’রে বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপন ও কর্তব্যানুগ আচরণ—এই শ্রেণীর বিদায় গ্রহণের আবশ্যিক অঙ্গ।

এমনিই একটি অবশ্য (এবং অকারণ) কর্তব্য—সুভদ্রাকে তাঁর জ্যেষ্ঠা সপত্নী ও যাতার হাতে সমর্পণ ক’রে লৌকিক সৌজন্যাচার হিসাবে তাঁকে এই অনুজার রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশ্রয়দানের অনুরোধ জ্ঞাপন।

সেই সময় কৃষ্ণার হাতে সুভদ্রার হাতখানি রাখতে গিয়ে কৃষ্ণার হাত স্পর্শ করতে হয়েছিল। না, স্পর্শ মাত্র নয়, এক হাতে তাঁর হাত ধরে অপর হাতে সুভদ্রার হাত এনে ধরিয়ে দিতে হয়েছিল। সেই সুরনারী-দুর্লভ মদনেরও কাম- আনয়নকারী করপদ্মের স্পর্শ সেদিন অকস্মাৎ তেজস্কর মাধ্বীর মতো উগ্র মাদকতার সঞ্চার করেছিল বাসুদেবের দেহে।

যৌবনোষ্ণ অথচ স্বেদার্দ্র, পুষ্পদলের মতো কোমল সেই অপরূপ করকমল স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে কী একটা পুলকবেদনাতুর শিহরণ অনুভব করেছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ—— দুঃখেম্বনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ’ যিনি, যিনি সকল বাসনা-কামনাকে কালীয় নাগের মতো মথিতবিমর্দিত করে ইন্দ্রিয়জিৎ হয়েছেন—ক্ষণকালের জন্য—বোধ করি নিমেষকালের বেশি নয়—একটা বিহ্বলতা, অননুভূতপূর্ব চিত্ত-চাঞ্চল্য অনুভব করেছিলেন—সামান্য তরুণ যুবার মতোই ।

না, এ-দেহটাকে দোষ দিতে পারবেন না শ্রীকৃষ্ণ। সে করযুগল সামান্য সাধারণ নয়, সে স্পর্শের লোকোত্তর অভিনবত্ব তো নয়ই।

দেহের সঙ্গে অনুভূতির সহজ সম্পর্ক, সেই অনুভব-শক্তি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের কাছে বিদ্যুৎরেখাবৎ গতিতে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে আকৈশোর নানা ভাবে অসংখ্য সুন্দরীর সংস্পর্শে এলেও এমন করাঙ্গুলি স্পর্শ করার ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি কখনও।

নিমেষকালেই বোধ করি—একটি নিমেষপাতের সময়টুকু—তার বেশী নয়।

কিন্তু সেই অত্যল্প সময়েই তাঁর চিত্ত-অবশতা, তাঁর একটা পুলকবিস্ময় কৃষ্ণা বুঝেছেন। বুঝেছেন ঐ পরিমাপহীন অল্প সময় মধ্যেই। পরিবেশ ও তার ফলে মুখের বর্তমান পরিস্থিতি—পরিবেশ ও কর্তব্য-অনুযায়ী কৌতুকমধুর অভয়হাস্য ওষ্ঠভঙ্গিতে লেগে থাকা সত্বেও কেমন এক রকমের স্থির নিশ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন বাসুদেবের চোখের দিকে।

তাতে কি বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছিল? কৌতূহল?

অনুযোগ, তিরস্কার?

অথবা সীমাহীন অথচ সুগোপন বেদনাবোধ?

তা বোঝা যায় নি, এতই পাথরের মতো ভাবপ্রকাশহীন সে চাহনি।

ওষ্ঠপ্রান্তের প্রসন্ন হাসির রেখাটুকু তেমনিই আছে, মুখের ভঙ্গিতে অভয় আশ্বাসেরও অভাব নেই—তার মধ্যে সেই দৃষ্টির বিশেষত্বটুকু অবশ্যই আর কারও চোখে পড়ে নি—বাসুদেব ছাড়া। বাসুদেবের সে অভিভূত অবস্থাও কেউ লক্ষ্য করে নি।

ক্ষণিককালের সে বিহ্বলতা অপসারিত হতেও বিলম্ব হয় নি।

দ্রৌপদীর সেই দুর্বোধ্য দৃষ্টি মিলেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। সে চাহনির ভাষাও তাঁর অন্তরে পৌঁছেছিল—অথবা বলা যায় তীব্র আঘাতে বেজেছিল। সঙ্গে সঙ্গে—তাঁর পক্ষে একান্ত অস্বাভাবিক ভাবেই—লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলেন।

তারপর অবশ্য সবই স্বাভাবিক নিয়মে চলেছে। উভয় পক্ষেই যথোচিত বাক্যবিন্যাসে অসুবিধা হয় নি, কণ্ঠস্বরেও কোন জড়তা ছিল না আর। দ্রৌপদীও তাঁর নীলোৎপল-পলাশতুল্য নেত্রের আশ্চর্য রহস্যময় দৃষ্টিতে মুখের কৌতুক- হাস্যটুকু টেনে এনে স্থানকালপাত্র-ঘটনার যথোপযুক্ত সৌজন্য প্রকাশ করেছিলেন, কিছু হাস্যপরিহাসও সুভদ্রাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে যথেষ্ট স্নেহপ্রকাশ ও অভয়দান করেছিলেন—সত্যকারের স্নেহপাত্রী অনুজার মতোই। ওঁর মনের সেই কিছুকালের মানসিক বিপর্যয়ের ইতিহাস উপস্থিত পুরনারী সহচরী দাসীর দল কেউই জানতে কি বুঝতে পারে নি।

অতি সামান্য ঘটনা।

অনুক্ত, অস্বীকৃত, অপ্রকাশিত।

তবু, সেইটেই প্রচণ্ডভাবে বিচলিত করেছে বাসুদেবকে।

দেহ দেহের ধর্ম পালন করবেই। এ জানা কথা। কিন্তু উনি ভেবেছিলেন সেই অবশ্যম্ভাবী সত্যটুকুকে তিনি জয় করতে পেরেছেন। দ্রৌপদী সম্বন্ধে তাঁর যে দুর্বলতা সে শুধুই গুণগত। কৃষ্ণার অসাধারণ মনীষা, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, কর্মৈষণা ও কর্তৃত্বশক্তি দেখেই তিনি মনের কোন প্রত্যন্ত প্রদেশে একটু ইচ্ছাতুর ক্ষোভ অনুভব করেন, এই নারীরত্নকে সঙ্গিনী পেলে তাঁর আরদ্ধ ও ইপ্সিত কর্মযজ্ঞ কত সহজ হত এই ভেবে।

তবে কি তিনি আত্মপ্রতারিত হয়েছেন?

এই সংশয়, চিত্ত-অস্থিরতা থেকেই ইন্দ্রপ্রস্থগমনে অনীহা দেখা দিয়েছে তাঁর।

অবশ্য এভাবে পাণ্ডবদের পরিহার ক’রে বেশীদিন যে চলতে পারবেন না এও নিশ্চিত। দূতের পর দূত আসছে, হয়ত এবার ধনঞ্জয় কিংবা ধর্মরাজ স্বয়ং এসে উপস্থিত হবেন।

এ আশঙ্কা সত্বেও তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক এই সঙ্কোচটুকু কাটিয়ে মনস্থির করা কঠিন হত—যদি না তাঁর মহিষী রুক্মিণী ওঁকে সাহায্য করতেন। রুক্মিণীকে তিনি কিছু বলেন নি, কিন্তু রুক্মিণীর এই এক আশ্চর্য শক্তি—স্বামীর মনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভিপ্রায় ও দ্বিধাদ্বন্দ্বও তিনি যেন ওঁর পক্ষপাতনে অনুভব করতে পারেন। তাঁর সুগভীর প্রেমেই এটা সম্ভব হয়েছে, এটা সিদ্ধি প্রিয়তমা সত্যভামাও লাভ করতে পারেন নি।

তিনিও একদিন এ প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, ‘যদুনাথ, এই অশোভন জাড্য, এই ইতরমানবোচিত সঙ্কোচ আপনাকে শোভা পায় না।’

‘সঙ্কোচ!’ যেন চমকে উঠলেন বাসুদেব।

‘হ্যাঁ। আপনার মুখেই বহুবার শুনেছি, দেবতাই হোন আর দেবাদিদেবই হোন বা স্বয়ং ভগবানই হোন, মর্ত্যভূমে বিচরণকারী নরদেহধারী মাত্রেরই দেহের সহজ গতিপ্রকৃতি, তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অধীনতা স্বীকার করতে হবে। যদি কোন চিত্তবৈকল্য ঘটেই থাকে তো সে নিতান্তই সেই স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে, এবং সেজন্য এই সঙ্কোচও সেই নিয়মেই দেহের ধর্ম প্রতিপালন করছে মাত্র। আপনি যে সে দুইয়েরই ঊর্ধ্বে, দয়া ক’রে সেইটুকু স্মরণে আনুন। যাঁর সামনে বিরাট কর্তব্যভার—যাকে কর্তব্যযজ্ঞ বলাই উচিত, যার অভাবনীয় আয়োজন তিনিই করেছেন—সামান্য কী এক অতিতুচ্ছ ঘটনায় তাঁর এইভাবে শিশির-দিনের ভেকের মতো জড়ত্বের গহ্বরে আবদ্ধ থাকা শোভা পায় না। সাধারণ মানুষ রক্ষার ব্রত আপনার। সেই মানুষের থেকে আপনি স্বতন্ত্র, স্বরাট। আপনি শুধু এই দেহ-মাত্র নন, এর যা কিছু শিক্ষা তা আপনার সেবা ক’রে, আপনার চরণপ্রান্তে বসেই লাভ করছি—সেই সাহসেই বলছি, মানুষের পক্ষে যা লজ্জা কি সঙ্কোচের কারণ—আপনার পক্ষে তা নয়। আপনার লীলাময় রূপের এই ক্ষণিক অনুভূতি যেন আপনার কর্মময় রূপের বাধা না হয়ে দাঁড়ায়—এই প্রার্থনা।’

শ্রীকৃষ্ণ যেন বহুদিনের সুপ্তি থেকে জেগে উঠলেন।

বললেন, ‘প্রিয়ে, আমি ধন্য। তোমার এই মননশক্তি যদি আমার শিক্ষার ফল হয়— সে শিক্ষাও ধন্য। কিন্তু সে কি আমারই শিক্ষা? জীবনে বার বার তো তোমার কাছ থেকেই আমাকে পাঠগ্রহণ করতে হচ্ছে। বোধ করি এক অসাধারণ শুভগ্রহ প্রভাবেই তোমাকে লাভ করেছিলাম। এক-একসময় মনে হয় আমিই তোমার যোগ্য নই।’

রুক্মিণী হাসেন। প্রেমবিহ্বল প্রশ্রয়মধুর হাসি। বলেন, ‘এই চাটুবাদেই মনে হচ্ছে আপনি আবার স্ব-স্বরূপে ফিরে এসেছেন।… তাহলে ইন্দ্রপ্রস্থ যাত্রার আয়োজন করি?’

‘অবশ্যই। যত দ্রুত হয়। আমি বরং এখনই পিতা বসুদেব ও আর্য বলদেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসি।’

১৬

ইন্দ্রপ্রস্থে এসে প্রাথমিক অভ্যর্থনা অনুযোগাদির উচ্ছ্বাস মন্দীভূত হলে—মাত্র কয়েক দণ্ড স্নান-বিশ্রামাদিতে অতিবাহিত করার পর—বাসুদেব পাণ্ডবদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে প্রায় অলৌকিক স্বপ্নসৌধের মতো অবিশ্বাস্য সুন্দর সভাগৃহটি দেখলেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই দেখলেন। কারণ স্থাপত্যকৌশল, ভাস্কর্য কি গঠন-নৈপুণ্যের দিক থেকেই নয়—চারুকলার চরমোৎকর্ষ হিসেবেও এই প্রাসাদ অনুপম, অভূতদৃষ্ট। এর উদ্যান, সরোবর, কৃত্রিম সজ্জা—এমন কি প্রাচীরগুলিও বিশেষ লক্ষ্যণীয়। একাধারে নয়নাভিরাম এবং ঘাতসহ—এই ঐশ্বর্যময় সভা-ভবনের নিরাপত্তা রক্ষার উপযুক্ত করেই নির্মিত। প্রয়োজন ও সৌকুমার্যের এমন অপূর্ব সমন্বয় কদাচিৎ চোখে পড়ে।

অভ্যর্থনার মধ্যে আন্তরিক আনন্দোচ্ছ্বাসেরও যেমন অভাব ছিল না, তেমনি অনুযোগও ছিল প্রচুর।

অনুযোগ এতকাল—বিশেষ এই সভাগৃহ নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার সংবাদ পেয়েও—না আসার জন্য। অর্জুনের চোখে জল, কৃষ্ণার কণ্ঠস্বর আবেগরুদ্ধ। যদিচ তিনি মৃদু অনুযোগ নয়—তিরস্কারই করলেন বলতে গেলে। যুধিষ্ঠিরের উৎকণ্ঠাই বেশী— কোথায় কী অপরাধ হয়ে গেল যে শ্রীকৃষ্ণ এমনভাবে তাঁদের ত্যাগ করলেন। ভীম বললেন, ‘নাগরিক রীতিপদ্ধতিতে আমরা অভ্যস্ত নই তা তো জানতেই, তাতেও যদি আমাদের আচরণে ত্রুটি গ্রহণ কর তাহলে আমাদের এ ঠাটে প্রয়োজন নেই। এ রাজ্য রাজধানী তুমিই নিয়ে নাও, আমরা আবার অরণ্যে চলে যাই।’

বাসুদেব এসব অভিমান অভিযোগ অভ্যস্ত মৃদুমধুর হাস্যের বর্মে প্রতিহত ক’রে যেন অধিকতর মনোযোগী হয়ে পড়লেন সভাগৃহের দিকেই। প্রশংসার উচ্ছ্বাস ও বিস্ময় প্রকাশে এঁদের এতদিনের দুশ্চিন্তা দুঃখ ভুলিয়ে দিতে বেশীক্ষণ সময় লাগল না।

এ সভাভবন না দেখলেও ময় কী করবেন তা বাসুদেব জানতেন। অনেকটাই অনুমান করতে পেরেছিলেন। আর সেই কারণেই এখানে আসার পূর্বে যখন সত্রাজিৎ-নন্দিনী বলেছিলেন, ‘শুনেছি এমন সভাভবন তৈরী হয়েছে ত্রিভুবনে যার তুলনা নেই। ইন্দ্রসভা আয়তনে বিশাল হলেও নাকি এত সুন্দর নয়। আপনি এর একটা ভাল দেখে নামকরণ ক’রে দেবেন। মর্তের স্বর্গ—এই রকম অর্থ দাঁড়ায়, সেইভাবে নাম দেবেন।’

বাসুদেব হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নামকরণ আমি সে সভা না দেখেই করতে পারি। তবে তা প্রকাশ্য নয়।’

‘কী সে নাম—যা কাউকে বলা চলবে না?’ সকৌতুক কৌতূহলে প্রশ্ন করেন সত্যভামা।

‘ওদের কাছে বড় জোর বলা চলে ঈর্ষার প্রাসাদ, কিংবা অসূয়াভবন–কিন্তু আসলে ওটা সর্বনাশের প্রাসাদ, সর্ববিনষ্টিভবন! নিয়তি-গৃহ বা পরিণাম-গৃহও বলা চলে।’

‘হে ভগবান! এসব কি অশুভ কথা বলছেন? না না, ছি।’ শিউরে উঠেছিলেন সত্যভামা অজ্ঞাত অমঙ্গলাশঙ্কায়।

‘যা সত্য তাই বলছি। ক্রমশ বুঝবে এর অর্থ ‘

তাঁর চিরাভ্যস্ত রহস্যময় হাসিতে যবনিকা টেনে দিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে।

এখানে এসে সভাগৃহ দেখেও সে মত পরিবর্তনের কোন কারণ দেখলেন না। বরং এই অমরাবতী-দুর্লভ প্রাসাদভবন মাৎসর্যের পথে একদা ভারতের সমস্ত ক্ষাত্রশক্তিকে মহাবিনষ্টির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে— এই বিশ্বাসই দৃঢ় হ’ল তাঁর।

মনে হ’ল, কল্পনায় সে মহাপরিণাম প্রত্যক্ষ ক’রে তিনি প্রীতই হলেন।

আহারাদির পর বিশ্রম্ভালাপ প্রসঙ্গে বাসুদেব প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর? ইতিমধ্যে আর কী কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল বলুন, দেবার মতো কী সংবাদ আছে?’

ধর্মরাজ বোধ করি সে সংবাদ দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন, বললেন, ‘কয়েকদিন আগে মহাতপস্বী সর্বজ্ঞ নারদ অনুগ্রহ ক’রে এখানে পদার্পণ করেছিলেন।’

বাসুদেবের এ সংবাদ অজ্ঞাত ছিল না, হয়ত নারদের এই শুভাগমনের মূলে তাঁরই প্রেরণা—তবু তিনি ঋজু হয়ে বসে বললেন, ‘তাই নাকি! এ তো সুসংবাদ। আপনার পুরী পবিত্র, রাজসভা ধন্য হল।… তা কী বললেন তিনি? মুনিবরের কলহপ্রিয়তার একটা কুখ্যাতি প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে— সেরকম কোন অশান্তির বীজ বপন ক’রে যান নি তো?’

‘না না, বরং রাজ্য পরিচালনা সম্বন্ধে কয়েকটি মহামূল্যবান নির্দেশ উপদেশ দিয়ে গেছেন।’ ।

‘সে তো অতি উত্তম সংবাদ। বাঞ্ছনীয়ও বটে। তিনি ত্রিকালজ্ঞ, ত্রিভুবনের তাবৎ রাজসভাতেই তাঁর অবাধ গতি। এ বিষয়ে তাঁর তুল্য জ্ঞানী আর কে আছেন। তবে আমি জানি, তিনি এমন কোন আচরণ বা কর্তব্যের নির্দেশ আপনাকে দিতে পারবেন না যা আপনি ইতিমধ্যেই পালন করছেন না।’ স্মিত হাস্যের সঙ্গে শেষের কথাগুলি বলেন বাসুদেব।

ধর্মরাজ পরিহাসছলেও মিথ্যা বলেন না, বিনয় প্রকাশের জন্যও বলতে পারলেন না যে, ‘না না, তা কেন, আমি আর কতটুকুই বা করতে পেরেছি’ ইত্যাদি। তিনি প্রশংসারক্ত নতমুখে শুধু উত্তর দিলেন, ‘কী জানি, সব তো মিলিয়ে দেখি নি। হয়তো কোন কোন বিষয়ে অদ্যাপি আমার দৃষ্টি পড়ে নি—এমন হতে পারে।’

বাসুদেব তাঁর মনোভাব বুÄঝে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন, ‘তারপর? আর কি বললেন তিনি? অন্য কোন সংবাদ?’ যুধিষ্ঠির ঈষৎ ইতস্তত ক’রে বললেন, ‘সেই কথাই বলব বলে এত অধীর আগ্রহে তোমার প্রতীক্ষা করছিলাম। তিনি বললেন, আমাদের বংশের যেসব নৃপতি রাজসূয় যজ্ঞ ক’রে গেছেন তাঁরা নাকি পরলোকেও অতুল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। আমি যদি ঐ যজ্ঞ করতে পারি—আমাদের পিতৃপুরুষ প্রসন্ন হয়ে আশীর্বাদ করবেন। রাজা হয়ে রাজসূয় যজ্ঞ সমাপন করার মতো সুকীর্তি নাকি আর নেই। ইহলোকে ও পরলোকে চিরদিন যজ্ঞকর্তার এই মহৎকর্ম প্রশংসিত হয়। দেবতা ও ঋষিগণ ধন্য ধন্য করেন। ঋষিশ্রেষ্ঠ নারদ আমাকে রাজসূয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে বললেন। বললেন, ‘নচেৎ এই সুরপুরীদুর্লভ সভাগৃহের মর্যাদা থাকবে না। ময়ের এটা স্থাপত্য-তপস্যা—এও ব্যর্থ হবে।’

এই পর্যন্ত বলে—বড় বেশী স্পর্ধা বা ধৃষ্টতা কি উচ্চাশা প্রকাশ পেল কিনা—এই আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত চিত্তে শ্রীকৃষ্ণের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। সেখানে ভীম ও অর্জুনও উপস্থিত ছিলেন—তাঁরা এ প্রস্তাবে এমন বিস্ময়ের বা ধৃষ্টতার কিছু দেখলেন না, আশঙ্কা কি উৎকণ্ঠারও না। বড় বেশী দুরাশা কি দুঃসাহস প্রকাশ পেল বলেও মনে করলেন না। বরং কার্যকারণপরম্পরা ধরলে এ গৃহনির্মাণের এই-ই স্বাভাবিক পরিণতি বলে বোধ হ’ল তাঁদের।

বাসুদেব হয়ত এই প্রস্তাবই আশা করছিলেন–হয়ত সবই জানতেন তিনি। তবু একবার অস্ফুট কণ্ঠে ‘নিয়তি’ এই শব্দটি উচ্চরণ ক’রে মৌন এবং চিন্তাবিষ্ট হলেন।

সে সামান্য তিনটি উচ্চারিত অক্ষর উপস্থিত আর কারও কর্ণগোচর হ’ল না। তাঁরা সকলেই শান্ত ধীর ভাবে বাসুদেবের সুচিন্তিত মতামতের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

বহুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মতো স্থির হয়ে রইলেন শ্রীকৃষ্ণ। যেন চিন্তার কোন গভীরে অবগাহন করেছেন বলে বোধ হ’ল। এক সময় পাণ্ডব ভ্রাতাদের এমনও আশঙ্কা হতে লাগল যে তিনি বুঝি বা তন্দ্রাচ্ছন্নই হয়ে পড়েছেন। শেষে আর দ্বিধা বা অনিশ্চয়তা সহ্য করতে না পেরে যুধিষ্ঠির মৃদুকণ্ঠে তাঁকে কিছুটা সচেতন করার জন্যই সম্বোধন করলেন, ‘বাসুদেব!’

শ্রীকৃষ্ণ এবার মুখ তুলে স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইলেন। ধীরে ধীরে বললেন, ‘এ প্রস্তাব অসঙ্গত কি অন্যায় নয়— অসম্ভব কিনা সেটাই বিচার্য। সত্য কথা বলতে কি, আমারই লোভ হয়েছিল—আপনাদের কাছে এ প্রস্তাব উত্থাপিত করার। শুধু একটি লোকের কথা চিন্তা করেই দ্বিধা বোধ করেছি।’

‘একটি লোক! কে সে?’ অসহিষ্ণু ভীম প্রশ্ন করেন। তাঁর কণ্ঠে যুগপৎ অবিশ্বাস ও অবজ্ঞা।

তাঁর সে মনোভাবের প্রতি দৃকপাত মাত্র করলেন বলে মনে হ’ল না। তেমনিই ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, ‘মগধ- সম্রাট জরাসন্ধ। ভারতখণ্ডে এমন কোন রাজা বা রাজশক্তির কথা স্মরণ হচ্ছে না যা নাকি পাণ্ডবভ্রাতারা পরাজিত বা বশীভূত করতে পারবেন না। কেবল এই জরাসন্ধ সম্বন্ধেই আমার আশঙ্কা ও সংশয় আছে। এই লোকটির ব্যক্তিগত শৌর্য অপরিসীম, বাহিনী বিশাল ও অপরাজেয়! ওঁর সেনাপতিরা রণদুর্মর ও অভিজ্ঞ, বিশ্বস্তও বটে। তার কারণ কর্মচারীদের প্রতি জরাসন্ধের অবিশ্বাস্য রকমের সদয় ও সস্নেহ ব্যবহার। ইনি কন্যাদের ক্রন্দনে ব্যথিত ও ক্রদ্ধ হয়ে* বহুবার মথুরা অবরোধ করেছেন— কেবলমাত্র যাদবদের একতা ও দৃঢ় সঙ্কল্পেই কোনমতে রক্ষা পেয়েছি। অমানুষিক কষ্ট সহ্য করেছেন তাঁরা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। আমি নিজে সে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দিবারাত্র পরিশ্রম করেছি, সেই জন্যই আমি এঁর শিক্ষা শক্তি বা পরাক্রম অবগত আছি। ইনি নিষ্ঠুর ও ক্ররকর্মা—ভয়ঙ্করকর্মা। অকারণে ছিয়াশিজন রাজা ও রাজপুত্রকে পরাজিত ক’রে নিদারুণ দুর্দশার মধ্যে অন্ধকার গৃহে বন্দী করে রেখেছেন। জরাসন্ধ পরাজিত ও নিহত হলে এইসব নৃপতিরা সানন্দে আপনাদের বশীভূত ও কৃতজ্ঞ থাকবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু এতগুলি রাজা বা রাজন্য যা পারেন নি পাণ্ডবদের পক্ষে তা সহজসাধ্য হবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। সর্বশক্তি প্রয়োগেও বার বার ওঁকে প্রতিরোধ করতে পারব না বুঝেই সুদূর সিন্ধুপারে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছি।’

[* জরাসন্ধের দুই কন্যা কংসের স্ত্রী ছিলেন। কংস বাসুদেবের হাতে নিহত হলে এই দুই বিধবার প্রতিহিংসা-স্পৃহা স্বাভাবিক।]

‘তবে কি আশা পরিত্যাগই করব? বলদর্পী নিষ্ঠুর জরাসন্ধ এই ভাবেই ক্ষত্রিয় রাজাদের মাথায় পা দিয়ে চলবেন?’

কেমন এক রকম ক্ষোভ ও হতাশামিশ্রিত সুর যুধিষ্ঠিরের কণ্ঠে।

‘কখনওই না।’ অসহিষ্ণু ভীমসেন আস্ফালন ক’রে ওঠেন। অর্জুনের দৃষ্টি ভ্রূকুটিবদ্ধ হয়।

ঈষৎ একটু হাসেন বাসুদেব, তাঁর নিজস্ব হাসি। বলেন, ‘মহাবল বৃকোদর ও মহারথী অর্জুনের এ অধীরতা প্রশংসার্হ, ক্ষত্রিয়েরই যোগ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকগুলি প্রশ্ন আছে। স্বাধীন, মিত্র ও করদরাজ্য—সর্বত্র থেকেই বশ্যতার নিদর্শনস্বরূপ কর সংগ্রহ করে সেই অর্থে রাজসূয় যজ্ঞ করা বিধি। অশ্বমেধ যজ্ঞে ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। সে যদৃচ্ছ ভ্রমণ করে। কেউ বাধা না দিলেই হ’ল। সেখানে পরাজয় বা বশ্যতা স্বীকারের প্রশ্নটা এত স্পষ্ট নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কোন ছদ্ম আবরণ নেই, কর প্রদানেই অধীনতা প্রমাণিত হয়। অর্থের পরিমাণ কম কি বেশী তাতে কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি নেই—হীনতা স্বীকারের অগৌরবটাই দুঃসহ। যাঁরা দেবেন তাঁদের অনেকেই আহত ও অপমানিত বোধ করবেন। মনে মনে সে আঘাতের জ্বালা লালন করবেন। সুতরাং আপৎকালে তাঁরা পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করবেন এ আশা ত্যাগ করাই ভালো। আর—ভীম ও অর্জুন যত বড় যোদ্ধাই হোন, সম্মুখসমরে জরাসন্ধের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার পরামর্শ আমি তাঁদের দেব না।

‘তা হলে এ প্রস্তাব আলোচনায় এত সময় ও বাক্য ব্যয় ক’রে লাভ কি?’ ক্ষুব্ধ ভীমসেন সনিঃশ্বাসে বলে উঠলেন। ‘দাঁড়ান, আমার কথা শেষ হয় নি।’ বাসুদেব বললেন, ‘যুদ্ধ দু’রকমে করা যায়। এক অস্ত্রের দ্বারা। আমি সম্মুখযুদ্ধে সরাসরি জরাসন্ধকে আক্রমণ করতে নিরুৎসাহ করছি। তাই বলে সে অপরাজেয় বা অমর এমন কথা বলি নি। বাহুবলে যা সাধিত না হয় তা কৌশলে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আমার মনে হয়—কৌশল ও বাহুবল দুই-ই প্রয়োজন হবে।’

‘যথা—!’ বিস্মিত অর্জুন প্রশ্ন করেন।

‘সে যথাসময়েই আলোচনা করব। কৌশলের প্রশ্ন যেখানে সেখানে মন্ত্রগুপ্তির একান্ত প্রয়োজন। তোমাদের তো বলতেই হবে—কারণ এ কর্মের তোমরাই কর্তা। তবে সে সময় এখনও আসে নি। প্রস্তাব তো এখনও পরিকল্পনাহীন কল্পনায় সীমাবদ্ধ। এই বিরাট যজ্ঞের আয়োজনও বিপুল ও বিবিধ। সঙ্কল্প স্থির হলে কর্মপ্রণালীও একটা স্থির করতে হবে। তারপর প্রাথমিক আয়োজন। দিগ্বিজয় যাত্রা তার পরের কথা। এখন সে প্রসঙ্গ নিয়ে উত্তেজিত হওয়া অর্থহীন নয় কি?’

শেষের কথাগুলি বোধ করি যুধিষ্ঠিরের ভালো মতো হৃদয়ঙ্গম হয় নি—তিনি সেই পূর্বের একটি শব্দ নিয়েই চিন্তা ও অস্বস্তি ভোগ করছিলেন। এখন বেশ একটু জোর দিয়েই বললেন,–’কৌশল—মানে মিথ্যাচরণ নয় তো? শুভকার্যের সূচনাতে কোন মিথ্যা বা অসদাচরণ থাকে তা আমার ইচ্ছা নয়।’

এ প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর ঈষৎ যেন কঠিন হয়ে উঠল, ‘মহারাজ, মিথ্যাচরণ বা মিথ্যাভাষণ ব্যতিরেকেও কৌশল অবলম্বন করা যায়। কিন্তু আপনি শাস্ত্রজ্ঞ, শাস্ত্রকার সর্বজ্ঞ ঋষিগণের উপদেশ আপনার অজানা নেই। দেহ ধারণ করলে, সংসারধর্ম পালন করতে হলে মিথ্যাভাষণ যে প্রায় অনিবার্য, এ তাঁরা জীবন-অভিজ্ঞতার দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির—এই নাম আর সত্যনিষ্ঠা আপনার এই অল্প বয়সেই অনেকের কাছে—বিশেষ পরিচিতদের মধ্যে প্রায় একার্থ হয়ে গেছে। তবু আমি বলছি, এ দেহ পরিত্যাগ করার পূর্বে আপনাকেও হয়ত মিথ্যা বলতে হবে। শাস্ত্রে আছে, সত্য বলাই ধর্মসঙ্গত, সত্যই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সর্বথা সত্যানুসারে কর্মের অনুষ্ঠান উচিত কিনা তা স্থির করা একান্ত দুরূহ। যেখানে মিথ্যা বললে হিত হয় এবং সত্য মিথ্যার মতো অনিষ্টকর হয়ে ওঠে সেখানে সত্য বলা অনুচিত, মিথ্যা বলাই কর্তব্য। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যা বলায় অধর্ম হয় না, সে-সম্বন্ধে শাস্ত্রকারদের বিধান অতিশয় সুস্পষ্ট। বিবাহকালে, পরিহাসছলে, রতিসম্প্রয়োগে, প্রাণ-সংশয়ে, সর্বস্ব যেখানে বিনষ্ট হতে বসেছে, স্ত্রীলোকের কাছে এবং পরের উপকারের জন্য মিথ্যা বলায় দোষ নেই।* হে ভারত অগ্রগণ্য, আপনি সেই ষড়শীতিসংখ্যক ক্ষত্রিয় নৃপতিদের কথা চিন্তা করুন দেখি—যারা কেবলমাত্র মগধাধিপতি অপেক্ষা দুর্বল এই অপরাধে কারাগৃহে অসীম দুঃখভোগ করছে, যাদের শেষ পর্যন্ত সঙ্কল্পিত শতসংখ্যা পূর্ণ হলেই বলিদান দেওয়া হবে বলে জরাসন্ধ ঘোষণা করেছেন। বহু সজ্জন ও ব্রাহ্মণ এ মদগবীর কাছে অকারণে লাঞ্ছিত হচ্ছে। অবিরত অকারণ যুদ্ধযাত্রায় বহু ব্যক্তি নিহত হচ্ছে—এ শুধু তাঁর যুদ্ধ-বিলাস চরিতার্থ করতেই নয় কি? জরাসন্ধ বার বার মথুরা আক্রমণ করেছেন, কেবলমাত্র কন্যাদের অনুরোধে—কিন্তু তার ফলে উভয় পক্ষে কত লোক হতাহত হয়েছে তা অনুমান করতে পারেন? এমন লোককে কৌশলে বা মিথ্যাচরণের দ্বারা ধরাপৃষ্ঠ হতে অপসারিত করাও শ্রেয়—তাতে যদি কোন পাপ হয় তাহলে পাপ ও পুণ্য এই দুই শব্দের সংজ্ঞাই মিথ্যা!’

১৭

জরাসন্ধ নিহত হবার পর বহুদিন পর্যন্ত ফাল্গুনী বিমর্ষ হয়ে রইলেন, কোন কাজ বা আলোচনাতেই যেন তাঁর রুচি বা উৎসাহ রইল না। এতগুলি সদ্যমুক্ত নৃপতির সাধুবাদ, উল্লাস ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, চতুর্দিকে উত্থিত ধন্য ধন্য রবও তাঁকে তৃপ্ত করতে বা তাঁর মানসিক গ্লানি দূর করতে পারল না।

স্নাতকের ছদ্মবেশে, এক প্রকার মিথ্যা পরিচয়ে, ভৃত্যদি বা অন্তরঙ্গ পরিজনদের যাতায়াতের পথে অদ্বার দিয়ে পুরপ্রবেশ ক’রে একেবারে বাসকক্ষে উপনীত হয়ে অতর্কিতে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করা—এ যদি চৌরকার্যের মতো গর্হিত বা কাপুরুষের আচরণ না হয় তো, সে কোন আচরণ, কাকে বলে তা তিনি জানেন না। যে কোন প্রকারে, ছলে বা কৌশলে কার্যসিদ্ধিই বীরের কর্ম বা ধর্ম নয়। সদ্বংশজাত ক্ষত্রিয়ের শস্ত্রশিক্ষার উদ্দেশ্যও তা নয়। অথচ বাসুদেবের পরামর্শে সেই কাজই তো করতে হ’ল তাঁদের। জরাসন্ধকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান ক’রে তিনি এমন ভাবেই বৃকোদরকে এগিয়ে দিলেন যাতে বীর দীর্ঘাঙ্গ জরাসন্ধ তাকেই প্রতিযোদ্ধা নির্বাচন করেন।

এও অর্জুনের ক্ষোভের কারণ। তিনি এতদিনের সযত্ন-শিক্ষা প্রয়োগের কোন সুযোগই পেলেন না। জরাসন্ধ তাঁকে বালক জ্ঞানেই পরিহার ক’রে ভীমসেনের সঙ্গে বল পরীক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অর্জুন তাঁর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে পরাজিত হলে লজ্জিত হতেন—নিজের কাছে এমন অপমানিত হতেন না। নিজেকে এমন ক্ষুদ্র মনে হত না।

আশ্চর্য, বাসুদেবের মতো এমন স্থির বুদ্ধি, বিরাট প্রজ্ঞা ও সূক্ষ্ম বিবেচনা এতকালের মধ্যে আর কারও যে দেখেছেন বলে তো মনে পড়ে না। এমন অত্যুত্তম মানুষ কী করে অনায়াসে এই নীচজনোচিত কার্যে প্রবৃত্ত ও প্রবুদ্ধ করলেন তাঁদের—বিশেষ ভীমসেনকে! সে কথা মনে হলে অন্ধকার গৃহেও আরক্ত হয়ে ওঠেন ফাল্গুনী। দর্পণে বা নবনির্মিত প্রাসাদের জলাশয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতে লজ্জা বোধ হয়। ক্রমাগত ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ করে চতুর্দশ দিবসে শ্রান্ত জরাসন্ধ ক্ষণকালের জন্য নিবৃত্ত হয়ে যখন কেবলমাত্র ঈষৎ নিঃশ্বাস-গ্রহণ-অবসরের জন্য আকুলতা প্রকাশ করেছেন, তখন তাঁর সেই দুর্বল ভগ্নোন্মুখ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করার জন্যই বাসুদেব বললেন, ‘ভীম, ক্লান্ত শত্রুকে অধিক পীড়ন করলে তাঁর প্রাণহানি হতে পারে—অতএব এখন তুমি মৃদু মৃদু বাহ্বাঘাত দ্বারা কোনমতে যুদ্ধের অবস্থাটা রক্ষা ক’রে যাও।’ ভীম সে ইঙ্গিত বুঝেই সেই ক্লান্ত মহাবলধর জরাসন্ধকে সবলে ঘূর্ণিত, উৎক্ষিপ্ত ও পিষ্ট করে নিহত করলেন। সে সময় অর্জুনের মনে হয়েছিল—এর চেয়ে তাঁর নিজের হত হওয়াও শ্রেয় ছিল! ছি! মধ্যমাগ্রজ এ কী করলেন!

কিন্তু বিরাট-পুরুষ বাসুদেব নির্বিকার। তিনি প্রশংসাই করলেন ভীমসেনকে, অজস্র স্তুতি করলেন। তিনি যে যৎপরোনাস্তি তৃপ্ত ও সিদ্ধকাম হয়েছেন— সে বিষয়েও কোন সংশয় রইল না।

এবং অনুযোগের উত্তরে অর্জুনকে বরং মৃদু তিরস্কারই করলেন। বললেন, ‘পূর্ব পূর্ব কালে কোন কোন দানব তপস্যার দ্বারা, শস্ত্রাভ্যাসের দ্বারা, শিক্ষা, মনন ও একাগ্রতার দ্বারা অপরাজেয় হয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তী কালে উদ্ধত ও ক্ষমতাগর্বিত সেই দানবরাই তপস্যা সদবুদ্ধি ত্যাগ করে মানবের মহাশত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন, স্বয়ং ভগবান বা মহাশক্তিকে বার বার অবতীর্ণ হতে হয়েছে সেই অশুভ নাশের জন্য—সেই মদোদ্ধত অত্যাচারী দানবদের ধ্বংসের জন্য। নৈকষেয় রাবণও মহাতপস্বী ও মহাবীর ছিলেন। সেই রাবণের শক্তিকে চূর্ণ ও ধ্বংস করার জন্য ভগবান রামচন্দ্র রাবণের অনুজকে কবলিত ক’রে যুদ্ধের আগে গৃহসন্ধান নিয়েছিলেন। বিভীষণের সাহায্যে চোরের মতো গোপন পথে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে গিয়ে উপবাসী যজ্ঞসঙ্কল্পিত মেঘনাদকে বধ করেছিলেন রামানুজ লক্ষ্মণ। তারও পূর্বে বলিকে দমন করতে বামন-রূপ ধরে ভগবান রীতিমতো মিথ্যাচরণ, ছলনাই করেছিলেন। সিংহ প্রভৃতি অরণ্যের হিংস্র পশু বধ করতে মানুষ নখদন্ত ব্যবহার করে না, ছলনা ও লৌহাস্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা কি পাপাচারণ করে? তোমরা শিকারে গিয়ে যখন মৃগ শশক প্রভৃতি নিরীহ পশুদের বধ করো, নিজেদের রসনা-তৃপ্তির জন্য, তখন তোমার এসব নীতিজ্ঞান কোথায় থাকে? জরাসন্ধ তাঁর থেকে দুর্বল নৃপতিদের বিনা কারণে পর্যুদস্ত লাঞ্ছিত ক’রে অশেষ কষ্টের মধ্যে কারাগারে বন্দী ক’রে রেখেছিলেন—সেটা দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ নয়? ফাল্গুনী, সংসার—বিশেষ রাজকার্যের হিসাব বড় জটিল। বিনা বিচারে বা বিবেচনায় কতকগুলো পুরাতন নীতিবোধ ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে থেকো না, বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে বলেই কোন ধারণা বা বিশ্বাস সত্য হয়ে ওঠে না। তাদের অভ্রান্ত বলে মনে করারও প্রয়োজন নেই। আর মায়া মমতা অত অস্থানে বিতরণ করো না। যদি কোন দিন যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখ আত্মীয়রা আত্মীয়দের অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করছে, প্রবীণ বিখ্যাত যোদ্ধারা কৌশলে সকলে মিলে একটা সামান্য বালককে বধ ক’রে জয়গৌরবে উৎফুল্ল হচ্ছে—বিস্মিত কি দুঃখিত হয়ো না। পৃথিবীর নিয়ম মনে ক’রে সান্ত্বনা লাভ করো।’

কথাগুলো যে সত্য অর্জুনও স্বীকার করতে বাধ্য হন। তবু কোথায় যেন অন্যায়বোধের কাঁটাটা মন থেকে যেতে চায় না। মনে হয় শ্রীকৃষ্ণ অকারণেই ভয় পেয়েছিলেন, গাণ্ডীব হাতে থাকতে তাঁকে জরাসন্ধ পরাজিত করতে পারতেন না।

অবশ্য বেশী দিন বিমর্ষ কি অভিমানাহত থাকার অবসরও দিলেন না বাসুদেব।

তাঁরই উপদেশে ও যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অবিলম্বে এঁদের দিগ্বিজয় যাত্রা করতে হ’ল।

চার ভাই সসৈন্যে চার দিকে যাত্রা করলেন। অর্জুন গেলেন উত্তর দিকে, ভীমসেন পূর্ব দিকে, সহদেব দক্ষিণে ও নকুল পশ্চিমে।

এই দিগ্বিজয় যাত্রাতেই অর্জুনের ক্ষোভ লজ্জায় পরিণত হল, তাঁর বীরত্বের অহমিকাও খর্ব হল কিছু।

কয়েকটি দেশের নৃপতিদের কাছ থেকে সম্রাটের প্রাপ্য সম্মানকর গ্রহণ ক’রে—তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করিয়ে প্রাগজ্যোতিষপুরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রবীণ অধিপতি ভগদত্ত দুর্ধর্ষ বীর এবং কৌরবদের প্রতি সমধিক প্রীতিসম্পন্ন। তিনি সহজে বশ্যতা স্বীকার করবেন কেন? অর্জুনও তা আশা করেন নি, তেমনি ভগদত্তকে পরাজিত করা কঠিন হবে এমনও কল্পনা করেন নি। কিন্তু অষ্টাহ ব্যাপী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলার পরও কোন পক্ষই অপরকে পরাজিত করতে পারলেন না।

তখন ভগদত্তই অবশ্য সহাস্য ও সস্নেহ-বচনে বললেন, ‘বৎস, আমি তোমার পিতৃবন্ধু, তুমি আমার পুত্রতুল্য। তোমার শৌর্যে আমি প্রীত হয়েছি, আমার সমযোদ্ধা হবারই উপযুক্ত তা স্বীকার করছি। তোমার প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ বা অসূয়া নেই, তোমাকে বধ করার ইচ্ছা তো নেই-ই। তোমার বল পরীক্ষা করার জন্যেই এইটুকু যুদ্ধ করা। তুমি কি চাও বল, আমি সন্তুষ্টচিত্তেই তা দিচ্ছি।’

দিলেনও তা। রাজচক্রবর্তীর প্রাপ্য হিসেবে নানাবিধ ধনরত্ন বস্ত্র-হস্তী-আদি প্রসন্ন মনেই দিলেন ধনঞ্জয়কে।

পরাজয় হ’ল না ঠিকই, তবু অর্জুনের মনে হ’ল—অন্তরীক্ষে এবং দূরে থেকেও বাসুদেব ঈষৎ সানুকম্প বিদ্রুপের হাসি হাসছেন।

ভগদত্ত তাঁকে পরাজিত করতে পারেন নি সত্য কথা, তেমনি নিজেও পরাজিত হন নি। ক্লান্তও হন নি। হয়ত এমন আরও সপ্তাহকাল যুদ্ধ চললে হতে পারতেন—সে সম্ভাবনা ধনঞ্জয় সম্বন্ধেও ছিল। ভগদত্তর সঙ্গে যুদ্ধেই এই অবস্থা, জরাসন্ধর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে কী হত তা কে জানে। হয়ত বা পরাজিতই হতেন। জরাসন্ধর বধ্য নৃপতিদের শত সংখ্যা পূরণে আরেকটি সংখ্যা যোগ হত।

আরও একটি আঘাত পেলেন অর্জুন, মানস সরোবর পার হয়ে চির-তুষারাবৃত হরিবর্ষে পৌঁছে। সেখানকার প্রধান প্রবেশপথে প্রহরারত রাজ্যরক্ষীরা ওঁদের আগমনে ভীতও হলেন না, রুষ্টও হলেন না, উগ্রতা কিংবা যুদ্ধেচ্ছাও প্রকাশ করলেন না। বরং যেন, বালকোচিত অবোধ আচরণ দেখলে অভিভাবকরা যেমন সস্নেহে প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন, তেমনি ভাবেই মৃদু হাস্য করলেন, বললেন, ‘ভদ্র, এখানে প্রবেশের বৃথা চেষ্টা করো না। এটা তুষার-মরুর দেশ, এ দেশ সর্বদা নিবিড় দুর্ভেদ্য নিশ্ছিদ্র সর্বাবলোপকারী কুহেলিকায় আচ্ছন্ন থাকে। এখানে প্রবেশ করলে তুমি কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষকে দেখতে পাবে না, কিন্তু যারা এদেশবাসী, এই চিরকুহেলিকায় অভ্যস্ত, তারা ইচ্ছে করলে অনায়াসে অতর্কিতে তোমাকে ও তোমার সঙ্গীদের বধ করতে পারবে। এখানে প্রকৃতিও ভয়ঙ্করী, বস্তুত তিনিই তোমাদের প্রতিপক্ষ। কোন সাধারণ মানুষই এখানে প্রবেশ ক’রে আজ পর্যন্ত জীবিত প্রত্যাবৃত্ত হতে পারে নি। কোথাও অতলস্পর্শী তুষারকদম–পদক্ষেপ মাত্রে সে অতলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কোথাও বা প্রায় শূন্যাবলম্বী শিথিল বিরাট হিমবাহ, সামান্য পদশব্দেও মহাভয়ঙ্কর শব্দে নেমে এসে শব্দকারীকে সদলে সমাহিত করবে। যে এখানে জন্মগ্রহণ করে নি, সে এখানে মুহূর্তকালও জীবিত থাকতে পারবে না। আর বলপ্রয়োগ বা শক্তি-পরীক্ষার প্রয়োজনই বা কি? তোমাদের যদি কোন প্রার্থনা বা অভিপ্সা থাকে তো বল, সাধ্য থাকলে আমরা হৃষ্টচিত্তেই তা পূরণ করব।’

চেয়ে দেখলেন ধনঞ্জয়। কিন্তু তাতে নেত্র উন্মীলনই সার হল। কিছুই দেখা গেল না। কোথাও কোন পাদপ, শস্য এমন কি শম্পের শ্যামলিমাও নয়ন-গোচর হয় না। দৃষ্টি চলেও না বেশীদূর। বোধ হয় এখানে চন্দ্র-সূর্যের আলোক প্রবেশ করে না, তুষারেরই একটা প্রতিফলিত অনৈসর্গিক অপ্রাকৃত আলোক মাত্র ভরসা, তাও কুহেলিকায় আবৃত, ছায়ান্ধকার করে রেখেছে সে নিবিড় সূচীভেদ্য বাষ্পাভ কুহেলিকা। যেন একটা ভয়াবহ, অজ্ঞেয়, অজ্ঞাত রহস্যে ঢাকা এ সমগ্র ভূখণ্ড। যে দেশে কেউ ইন্দ্রিয়গোচর নয় কেউ ঈর্ষা প্রকাশ করে না, অপরের ঈর্ষা প্রতিহত করার চেষ্টাও করে না— সে দেশে কার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তিনি?

অগত্যা অর্জুনকে তাঁর বক্তব্য সেখানেই বলতে হ’ল। রক্ষীবাহিনী প্রসন্ন ঔদার্যের সঙ্গেই তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলেন। ওদেশের নিজস্ব কিছু কিছু অস্ত্র এবং দীর্ঘলোমাবৃত পশুচর্ম দিলেন সম্রাটের কর স্বরূপ। সেই সঙ্গে কিছু মূল্যবান মণিরত্ন, সম্রাট আভরণ হিসাবে ব্যবহার করবেন—এই ইচ্ছা প্রকাশ ক’রে।

প্রাপ্য পেলেন, অভীষ্ট পূৰ্ণ হ’ল, কার্য সিদ্ধ–বিনা যুদ্ধে বিনা রক্তপাতে এমন কি কোন প্রকারের তিক্ততা ব্যতিরেকেই —তবু অর্জুন নিজেকে পরাজিত ও অসম্মানিত বোধ করতে লাগলেন। এখানে প্রতিপক্ষকে দেখা মাত্র গেল না, দেখা করলই না কেউ, যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নীরব ও অদৃশ্য রইল তারা। শুধু প্রাকৃতিক অবস্থান ও পরিবেশের কাছেই পরাভূত হয়ে সে উপেক্ষা নিরুত্তরে সহ্য করতে হ’ল। এই মানুষের শৌর্য ও বীর্যের পরিমাণ ও পরিণাম! এরই অহঙ্কারে তিনি বাসুদেবের ভীরুতা প্রকাশ ও কৌশল অবলম্বনের প্রস্তাবে ও শত্রুর শারীরিক দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার নির্দেশে—হীনজনোচিত আচরণ ভেবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন? ধিক!

অবশ্য আর কোথাও কোন অসুবিধা হয় নি।

সামান্য সামান্য যুদ্ধ না করতে হয়েছে তা নয়, কিন্তু সর্বত্রই পাণ্ডব-ভ্রাতারা অনায়াসে জয়লাভ করেছেন। একমাত্র মাহিষ্মতীতে গিয়ে সহদেব একটু বিপন্ন হয়েছিলেন। মাহিষ্মতী ঠিক নারীশাসিত না হলেও নারীরাই প্রধান সে-রাজ্যে। সেখানে পুরনারীরা প্রকাশ্যে স্বৈরিণীর জীবন যাপন করে কিন্তু সে আচরণকে কেউ দোষাহ মনে করেন না। বোধ হয় তাদের শাসন করা সাধ্যাতীত বলেই সে চেষ্টা কেউ করে নি। কিন্তু রণক্ষেত্রে দেখা গেল তারা দুর্ধর্ষ, দুর্মর। ফলে, সহদেবকে হয়ত পরাজয় স্বীকার ক’রে রাজধানীতে সাহায্য প্রার্থনা ক’রে পাঠাতে হত। শেষ পর্যন্ত হয়ত বা ফাল্গুনীরই আগমন আবশ্যক হয়ে পড়ত কিন্তু সে অপমান থেকে কনিষ্ঠ পাণ্ডবকে রক্ষা করলেন রাজজামাতা অগ্নি। তাঁরই পরামর্শে ও মধ্যস্থতায় একটি সন্ধি স্থাপিত হ’ল, রাজা নীল নিয়মরক্ষা মতো একটু সামান্য করও দিলেন, যজ্ঞে উপস্থিত থাকবেন সে প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেল। সহদেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। ।

এটা আকস্মিক, মাহিষ্মতীকে কেউ সংকটকেন্দ্র বলে গণ্য করেন নি। বরং কিছু দুশ্চিন্তার কারণ ছিল পূর্বদিকেই। চেদীরাজ শিশুপাল জরাসন্ধের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন ছিলেন। যিনি তাঁকে সদ্য নিহত ক’রে এসেছেন সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে শিশুপালের মনোভাব কেমন হবে তা নিয়ে একটু আশঙ্কা সকলেরই ছিল। কিন্তু শিশুপাল সে আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণিত ক’রে বেশ সাদরে ও সসম্মানেই অভ্যর্থনা করলেন ভীমসেনকে। প্রাথমিক আপ্যায়ন ও কুশল প্রশ্ন শেষ হতে সহাস্যেই এই শুভাগমনের অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করলেন এবং জ্ঞাত হবার পর তাঁর অমায়িকতা বা আত্মীয়বৎ ব্যবহার খর্ব হল না। যুধিষ্ঠির সর্বথা রাজচক্রবর্তী হওয়ার উপযুক্ত—এ সত্য তিনি সহজেই মেনে নিলেন। প্রচুর কর ও উপঢৌকন দিলেন—তারপরও ভীমসেনকে ছাড়তে চাইলেন না। তিনি ভোজনপ্রিয় এই খ্যাতি সুদূর চেদীতেও এসে পৌঁছেছিল। শিশুপাল সেজন্য এত প্রচুর ও বহুবিচিত্র ভোজ্যের ব্যবস্থা করলেন যে ভীম প্রায় পক্ষকাল সেখানে থেকে গেলেন—এর পূর্বে সে স্থান ত্যাগ করতে পারলেন না।

চেদীরাজ থেকেও পাণ্ডবদের আশঙ্কা ছিল অঙ্গরাজ কর্ণ সম্বন্ধে। অঙ্গ কৌরবদের আশ্রিতরাজ্য, মিত্ররাজ্যও। তাছাড়াও কারণ ছিল বিরাগ বা বিদ্বেষের। কর্ণ মহেন্দ্রদুর্লভ শৌর্যের অধিকারী ও অলোকসাধারণ উদার চরিত্র হওয়া সত্বেও সামান্য কুলে জন্মগ্রহণ করার জন্য কোন ক্ষেত্রেই তাঁর যোগ্য মর্যাদা পান নি। কৈশোর বয়সে বহু ক্লেশে শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা ভার্গবের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সম্যক ক্ষেত্র পান নি তার পরিচয় দেবার। শেষে ভাগ্যান্বেষণে হস্তিনায় এসে পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষার রঙ্গক্ষেত্রে গিয়ে সেদিনের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাস্করের মতো তেজস্বী এই তরুণের আকস্মিক আবির্ভাব ও স্পর্ধাপ্রকাশে পরীক্ষার প্রধান উদ্যোক্তা আচার্য কৃপ একটু ভীতই হয়ে পড়েছিলেন, পাছে তাঁর আশ্রয়দাতাদের সন্তান ও এক সময়ের ছাত্র অর্জুন শেষ পর্যন্ত হতমান হন—এই আশঙ্কায়, কর্ণ সূত বা সারথিপুত্র, রাজপুত্রদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য—এই অছিলায় তাঁকে সে-ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।

এ-ই ক্ষোভের আরম্ভ, শেষ নয়।

ওঁর তেজঃপুঞ্জ আকৃতি ও উদার প্রশস্ত ললাট দেখে অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন, পাণ্ডবযশঈর্ষী দুর্যোধনও তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সেই মুহূর্তেই ওঁকে করদরাজ্য অঙ্গের অধিপতি রূপে ঘোষণা করলেন ও তদ্দণ্ডেই যথারীতি শাস্ত্রানুযায়ী অভিষেকের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সে পর্ব শেষ হলে কর্ণ আবার যখন ধনুকে হাত দিয়েছেন— ‘রাজমাতা কুন্তী মূর্ছিতা হয়ে পড়েছেন’ এই রব তুলে আচার্য কৃপ পরীক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা ক’রে দিলেন।

ভাগ্য! জন্মলগ্নে প্রতিকূল নক্ষত্রাবস্থানের জন্য দেব-অংশে জন্মগ্রহণ ক’রেও তিনি পিতৃপরিচয়ে বঞ্চিত। কুন্তীরই পুত্র তিনি, কলঙ্কিত-পরিচয় কানীন পুত্র, কিন্তু সে-পরিচয় তখনও পর্যন্ত কেউ জানত না, কর্ণ নিজেও না। এক মৃৎপাত্রে সদ্যোজাত শিশু ভেসে যাচ্ছে, ঐ বয়সেই সে তেজঃপুঞ্জ কান্তি, সহজাত কবচ ও কুণ্ডলধারী— দেখে সারথি অধিরথ দয়ার্দ্র হয়ে তুলে গৃহে এনেছিলেন, এবং পুত্রবৎ পালন করেছিলেন। সেই সূত্রেই তাঁকে সকলে সূতপুত্র বলে জানে।

অবশ্য এ পরিচয় জানলেও যিনি জন্মক্ষণে মাতৃত্যক্ত শিশুর জীবন ও প্রাণ রক্ষা করেছেন, তাঁর পরিচয় কর্ণ ত্যাগ করতেন কিনা সন্দেহ। সে প্রকৃতির অকৃতজ্ঞ সুযোগসন্ধানী ছিলেন না কৰ্ণ।

অথচ এই পরিচয়ের জন্যই পাঞ্চাল স্বয়ম্বর সভায় দ্রৌপদী তাঁকে মর্মান্তিক অপমান করেছেন। সর্বপ্রকার যোগ্যতা সত্বেও স্বয়ম্বরের পণ পরীক্ষা করার ন্যায্য সুযোগ দেওয়া হয় নি তাঁকে। ধৃষ্টদ্যুম্ন পণ ঘোষণা করার সময় কোন বৃত্তিগত বা জাতিগত বাধা উল্লেখ করেন নি। তৎসত্বেও দ্রৌপদী বলেছিলেন, ‘সূতপুত্রের কণ্ঠে বরমাল্য দানের পূর্বে আমি আত্মহত্যা করব, সেই শ্রেয়।’ কর্ণ তখন অনায়াসে পূর্বের ঘোষণা স্মরণ করিয়ে নিজের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন কিন্তু সে প্রবৃত্তি তাঁর হয় নি। তিনি করুণমধুর হেসে অভয় ও আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘কল্যাণী তুমি সুখী হও, সুখে থাকো। আমার জন্য তোমার অকালে জীবন নষ্ট করতে হবে না।’

কে জানে অত্যন্ত রূঢ় অন্যায় আচরণের, অকারণ অপমানের এই মার্জিত ভদ্র প্রতিশোধ দ্রৌপদী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কি না!

সে যাই হোক, পাণ্ডবদের সম্বন্ধে তাঁর ঈর্ষা ও বিদ্বেষ স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তিনি বিনাযুদ্ধে কর দেবেন তা কেউ আশা করেন নি। ভীমও যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু কর্ণ সে দিক দিয়েই গেলেন না, বরং সপার্ষদ প্রত্যুদগমন ক’রে এসে আন্তরিক প্রীতিনিষেকের সঙ্গে ভীমকে অভ্যর্থনা করলেন, সবিনয়েই আপ্যায়ন ও আতিথ্যগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন।

তবু ভীম একটু সন্দিহান ছিলেন। ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ‘কিন্তু আমি সুদ্ধমাত্র বন্ধুত্ব স্থাপন বা প্রীতিবিনিয়মের জন্যই আসি নি। মহারাজচক্রবর্তী পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের অভিলাষ করেছেন, ভারতখণ্ডের তাবৎ রাজন্য কর দিয়ে বশ্যতা স্বীকার না করলে সে যজ্ঞ সম্ভব নয়। আমি সেই কর সংগ্রহের জন্যই এসেছি। এ তথ্য জেনেও আমাকে অভ্যর্থনা করবেন কিনা ভেবে দেখুন। কর পাওয়া যাবে—এ প্রতিশ্রুতি না পেলে আপনার আতিথ্যগ্রহণ করতে পারব না—কারণ কারও আতিথ্যগ্রহণ করার পর তার সঙ্গে যে যুদ্ধ করে সে কাপুরুষ ও কুলাঙ্গার।

কর্ণ প্রায় বলপ্রয়োগে তাঁকে বক্ষলগ্ন ও আলিঙ্গনাবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘প্রিয়বর, কর্ণের কাছে প্রার্থী হয়ে এসে কেউ ফিরে যায় না—এ রকম একটা জনশ্রুতি আছে। তুমি কি তা শোন নি?’

‘কী বিপদ! সে তো ভিক্ষা যাচঞা। আমি এসেছি সম্রাটের প্রাপ্য কর চাইতে।’ ভীম যেন একটু বিমূঢ়ই হয়ে পড়েন

‘সেও তো প্রার্থনা। কর প্রার্থনাই করতে এসেছ, বশ্যতাও তুমি চাইছ। ভিক্ষা শব্দে আমার আপত্তি আছে। প্রার্থীর প্রার্থনা, অভিলাষীর অভিলাষ পূর্ণ করা মানুষের পক্ষে একটা মহান সুযোগ, যে তা পারে সেই কৃতজ্ঞ, কৃতার্থ হয়। আমি তোমার কাছে সেই পুণ্য সুযোগই প্রার্থনা করছি ভাই ভীম!’

ভীম লজ্জায় অধোবদন হয়ে স্বীয় রূঢ়তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন।

এই অভ্যর্থনাতেই ভীমসেনের বিস্ময়ের অবধি ছিল না, পরবর্তী কয়দিনে সে বিস্ময় ক্রমশ তাঁকে বিহ্বল ক’রে দিল।

আদর আপ্যায়ন আতিথ্য এই কয়মাসে প্রচুর পেলেন বৈকি, চেদীরাজ তো আতিথ্যের চূড়ান্ত করেছেন—কিন্তু কর্ণের আচরণ, সস্নেহ সম্প্রীতি ব্যবহার যেন ভিন্ন রকম, এর কি বর্ণনা দেবেন ভেবে পান না ভীমসেন। এ আন্তরিকতা অনুভব করা যায়—এর কোন অভিধা দেওয়া যায় না। আত্মীয়বৎ? না আত্মীয়ের থেকে অনেক বেশী। জ্যেষ্ঠ সহোদর

বহুকাল পরে প্রত্যাগত অতিপ্রিয় অনুজকে যেমন আদর করেন—কর্ণের আচরণও কতকটা সেই রকম।

বোঝেন না কর্ণ নিজেও। নিজের আচরণ, এই মানসজটিলতা নিজের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। এ কী অদ্ভুত অকারণ প্রীতিরস তাঁর চিত্ত হতে স্বতঃই উৎসারিত হয় এই ভীমকান্তি রূঢ়ভাষী অতিখাদ্যলোলুপ ভীমসেনকে দেখে!

বাৎসল্য? অনেকটা সেই রকমই। মনে হয় কোন এক অদৃশ্য বন্ধন তাঁকে অমোঘ আকর্ষণে টানছে এই তরুণটির দিকে, কোন এক রহস্য উদ্বেল উত্তাল হয়ে উঠেছে রক্তে। একে সমাদর ক’রে সাধ মেটে না। একে তৃপ্ত ক’রে তৃপ্তি হয় না।

তবু একসময় বিদায় দিতে হয়।

ভীমও যেন অনিচ্ছাতেই একদা সচেতন হয়ে ওঠেন। যত আলস্য বিলাসের আয়োজন থাক—কাজেই এসেছেন, ফিরতে হবে, অযথা কালবিলম্ব করা উচিত নয়—এ তথ্যটাও কিছুতে ভুলতে পারেন না। কর্ণ করস্বরূপ যথেষ্ট অর্থ ও অন্যান্য বস্তু দিয়েছেন। উপহার উপঢৌকনও তার সঙ্গে। প্রার্থীর আকাঙ্ক্ষার অতীত দেওয়াই তাঁর স্বভাব, এক্ষেত্রে অন্তরের তাগিদ যেন আরও বেশী। সুতরাং কালহরণের আর কোন প্রয়োজন নেই নিজের বিবেককে বোঝানো যায়— এমন কোন যুক্তি নেই।

বিদায়কালে সৌজন্য বিনিময় আলিঙ্গন ইত্যাদির সময় কর্ণ আরও এক পাদ অগ্রসর হলেন। আত্মজ বা সহোদর অনুজকে বিদায় দেওয়ার সময় যেমন মস্তক আঘ্রাণ করার রীতি আছে তেমনই করলেন।

ভীম বোধ করি ঠিক এতটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি একটু বিহ্বলই হয়ে পড়লেন এই আন্তরিকতায়। এক্ষেত্রে পাদস্পর্শ করাই স্বাভাবিক রীতিও। সমস্ত সত্তা সেই দিকেই অগ্রসর হতে চাইছে। নিতান্ত এ ব্যক্তি নীচজাতীয়, তাঁর প্রণামের যোগ্য নয়—এই কথা স্মরণ করেই সম্বরণ করলেন নিজেকে।

প্রণাম করতে না পারলেও ভীমসেন কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর কৃতজ্ঞতা নিবেদন ক’রে বললেন, ‘মহারাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে সসম্মান ও সাদর আমন্ত্রণ পূর্বেই জানিয়েছি, এবার আমার পক্ষ থেকে জানাচ্ছি। আমরা আপনার শুভাগমন প্রত্যাশায় প্রহর গণনা করব। আপনি যে আদর আপ্যায়ন করেছেন তার শতাংশও করতে পারব না হয়ত—আর তা করতে চাইও না। কারও কারও কাছে ঋণী থাকাই সুখের, আপনি সেই লোক। তবে আশা করছি আদর আপ্যায়ন আতিথেয়তার ত্রুটিবিচ্যুতি আন্তরিকতায় পুরিয়ে যাবে। আপনার বন্ধুত্ব ও প্রীতি লাভ করলে আমার সব ভ্রাতারাই সুখী ও কৃতার্থ বোধ করবেন। আপনি আমাদের পঞ্চভ্রাতার অগ্রজস্থানীয় বন্ধু হয়ে থাকবেন, এ- ই আমার আশা ও প্ৰাৰ্থনা।’

কর্ণ হাসলেন। করুণমধুর হাসি—ঔদার্যে মেশা। বললেন, ‘তোমাদের সব কজন ভ্রাতার সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপন সম্ভব – কিন্তু অর্জুন? না, সে ইহজন্মে আর হয়ে উঠবে না!’

‘কেন?’ বিস্মিত হন ভীমসেন, ‘তার সঙ্গে তো কোন শত্রুতার কারণ ঘটে নি আপনার। কখনও কোন প্রকাশ্য আহবে আপনারা পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছেন বলেও তো শুনি নি—?’

‘না, তেমন ঘটনা ঘটে নি এবং সেইটেই বিদ্বেষের কারণ হয়ে উঠেছে।’

‘তার অর্থ?’ ভীমসেন আরও বিমূঢ় বোধ করেন নিজেকে।

‘শত্ৰুতা নয়—প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নয়—প্রতিযোগিতাই করতে চেয়েছিলাম। প্রতিযোগিতায় পরাজিত হতাম অথবা জয়লাভ করতাম। তাতে বৈরিতা বা বিদ্বেষের কোন প্রশ্ন থাকত না। কিন্তু সে সুযোগ বা অবসর আমাকে দেওয়া হয় নি। দু- দুবার সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। তুচ্ছ কারণে আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে—ভিক্ষার্থী ভিক্ষা পায়, আমি তাও পাই নি। একবার তোমাদের পরীক্ষা-রঙ্গশালায় আর একবার দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে।’

‘কিন্তু তার মধ্যে তো অর্জুনের কোন হাত ছিল না!’

‘সেও যেমন সত্য তেমনি আমার এই ব্যর্থতার জ্বালা, অবিচারের এই চিত্ত-ক্ষোভও সত্য। একবার প্রতিযোগিতার ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি ক্ররমনা এক ব্রাহ্মণের কৌশলে আর একবার বঞ্চিত হয়েছি এক স্ত্রীলোকের অর্থহীন জাতি-অভিমানে। রাজকীয় ঘোষণাও মিথ্যা ক’রে দিয়েছেন তিনি। যেটা সাময়িক প্রতিযোগিতায় শেষ হয়ে স্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্কে পরিণত হতে পারত, সেটাই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আকার ধারণ করেছে আমার মনে, ক্ৰমশ বৈরিতায় পরিণত হয়েছে।… না, এখন আর সখ্য সম্ভব নয়। এখন অর্জুনের সঙ্গে কোন সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ না হতে পারা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই, শস্ত্রচালনায় কে অধিকতর পারদর্শী সেটা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত।… আর সে যুদ্ধের ফলাফলও জানি— হয় অর্জুন নয় কর্ণ বিদায় নেবে এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে। সুতরাং এ জন্মে তার সঙ্গে মিত্রতা সম্ভব হবে না ভাই বৃকোদর। মৃত্যুতে আমার দুঃখ নেই, তার জন্য বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নই, শুধু তার আগে আমি এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই যে যোদ্ধা হিসেবে শস্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে অর্জুনের থেকে কোন অংশেই আমি হীন বা নিকৃষ্ট নই। এই-ই এখন আমার ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন।’

১৮

পাণ্ডবরা সসম্মানে ও সবিনয়েই চতুর্দিকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। শত সহস্র ব্রাহ্মণ সে কার্যে নিযুক্ত হয়েছিল স্বয়ং সহদেবকে এই সুকঠিন কার্যের ভার দেওয়া হয়েছিল, নিমন্ত্রিতের তালিকা প্রস্তুত করার। কারণ তিনি ধীর স্থির হিসাবী। আর কোন কার্যে তিনি লিপ্ত হয়ে না পড়েন বা তাঁর উপর কেউ অন্য কোন কার্যের ভার না দেন—সে বিষয়ে মহারাজচক্রবর্তীর পরিষ্কার নির্দেশ ছিল।

বস্তুত তিনি নিজেও এ বিষয়ে বিশেষ চিন্তান্বিত ছিলেন।

যাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে কর সংগ্রহ করতে হয়েছে— তাঁদেরও মনে পরাজয়ের আত্মগ্লানি বা অসহায় অবস্থার জন্য বেদনাবোধের তীব্রতা ও তিক্ততা না থাকে বিজয়ীপক্ষের বাক্যে-কার্যে-ব্যবহারে কোন ঔদ্ধত্য, অবহেলা বা অহংকার প্রকাশ না পায়—পাণ্ডবভ্রাতাদের সেজন্য যত্নের কোন ত্রুটি ছিল না, অবধি ছিল না উদ্বেগের। যুধিষ্ঠির দিগ্বিজয়-যাত্রার প্রাক্কালে বার বার এ বিষয়ে অনুজদের সতর্ক ক’রে দিয়েও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি–কিছুদিন পরেই দূতের হাতে পত্র দিয়ে সে বিষয়ে পুনঃসচেতন করে দিয়েছেন।

ভ্রাতাদের জন্য তত দুশ্চিন্তা ছিল না, যতটা ছিল তাঁদের অনুগামী সেনা ও সেনানায়কদের সম্বন্ধে। বিজিতদের সম্পদ লুণ্ঠন করা বিজয়ী সেনাদের পক্ষে অপরাধ নয়— এ বিশ্বাস তাদের মজ্জাগত। এই পরস্বলোলুপদের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখা—তাদের সংযত রাখার কথাই বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কি ভাবে তাদের উন্মত্ত লোভকে বলগাবদ্ধ রাখতে হবে, কী পরিমাণ কঠোর হস্তে তাদের সহজ দর্প ও অপরের প্রতি তাচ্ছিল্য ঔদাসীন্যকে চূর্ণ করতে হবে—এ যুদ্ধ যে কিছুই নয়, এ জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন কোন চূড়ান্ত পর্যায়ের নয়, বরং এটা এক শ্রেণীর শক্তি-পরীক্ষার ক্রীড়া মাত্র সেই জন্যই বিজিতের প্রতি সৌজন্য ও বিনয়ের ভাবকে প্রেমপ্রীতির পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে— সে সম্বন্ধে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নির্দেশ থাকত ঐ সব পত্রে।

যদিচ তিনি বার বারই স্বীকার করতেন যে এসব উপদেশ ও তার গূঢ়ার্থ—বহুদূর-ভবিষ্যৎ-প্রসারী ফলাফল সম্বন্ধে সচেতনতা—বাসুদেবেরই দূরদৃষ্টি ও প্রশাসনিক প্রজ্ঞার ফল, শ্রীকৃষ্ণই এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন—তবু এর মধ্যে যে তাঁর স্বভাবসুলভ ভদ্রতাবোধও কম কাজ করে নি, সে বিষয়ে কারও দ্বিমত ছিল না। বাসুদেব অন্তত এই পরিমাণ আতিশয্য প্রকাশ করবেন না। শেষের দিকে তো নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা এই সতর্কতার বাহুল্যকে কিছুটা অনুকম্পামিশ্রিত প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছিল— সম্ভবত নাতিপ্রচ্ছন্ন উপহাসের দৃষ্টিতেও। ধর্মরাজ যেন অকালবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন—এই অকারণ অতি-ব্যস্ততা বার্ধক্যেরই অঙ্গ।

সেই অমায়িকতার কারণেই হোক বা অত্যধিক কৌতূহলবশতই হোক—পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য ও শক্তির খ্যাতি বোধ করি তাঁদের রণবাহিনীরও পূর্বে পৌঁছে গেছে, নবনির্মিত ঐন্দ্রজালিক সভাগৃহ সম্বন্ধে কৌতূহল তো অদম্য–বিজিত নৃপতিরাও অপমান বা লজ্জায় বিমুখ থাকেন নি বা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি। ভারতের সর্ব প্রান্ত এমন কি প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকেও স্বাধীন নৃপতি, আশ্রিত ও করদরাজগণ, শাসকবর্গ—দলে দলে এই রাজসূয় যজ্ঞ দর্শন করতে বা যজ্ঞের অঙ্গীভূত হতে এলেন। ‘অঙ্গীভূত হতে’ বলছি এই জন্য যে নিয়মমতে নিদর্শনস্বরূপ প্রদেয় কর যা দেবার তা তো ইতিপূর্বেই দিয়েছেন, এখানে এসেও সকলে রাশি রাশি অর্থ যজ্ঞ-ভাণ্ডারে গচ্ছিত করতে লাগলেন। এ যেন একটা প্রতিযোগিতা পড়ে গেল। যিনি সর্বাপেক্ষা নিম্নবিত্ত তিনিও সহস্র মুদ্রার কম দিলেন না। ধনী ও প্রতাপশালী রাজন্যবর্গ যজ্ঞের উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তাদের কাছে বার বার স্পর্ধা প্রকাশ করতে লাগলেন, এই বৃহৎ কর্মের যাবতীয় ব্যয়ভার তাঁরাই বহন করবেন, মহারাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির যেন সে বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তা না করেন বা ব্যস্ত না হন।

এ আশ্বাসের বুঝি প্রয়োজনও ছিল।

শস্য, অর্থ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কী পরিমাণ সঞ্চয় আছে দেশে, শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়, মন্ত্রী ও অমাত্যগণের সঙ্গে পরামর্শ ক’রেই যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির—তবু আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের সংখ্যা যে এত বিপুল অঙ্ক ধারণ করবে তা তিনি কল্পনাও করেন নি। প্রায়-সদ্যদগ্ধ খাণ্ডব বনের বিস্তৃত ভূ-খণ্ড এবং ইন্দ্রপ্রস্থের চতুষ্পার্শ্বস্থ উপকণ্ঠে সীমাহীন প্রান্তর ও অরণ্যানীব্যাপী যেন কয়েকটি মহানগরীর পত্তন হয়ে গেল। স্কন্ধাবার ও কাষ্ঠপত্রাদি নির্মিত গৃহই অধিকাংশ, কিছু কিছু অবশ্য ভবিষ্যতের প্রয়োজন চিন্তা ক’রে প্রস্তরনির্মিত হর্ম্য প্রস্তুত হয়েছিল, তবে সে সামান্যই—এই সাময়িক আবাস-গৃহগুলিই আয়তনে ও গণনায় সুদূরতম অনুমানকে অতিক্রম ক’রে গেল।

প্রতিটি নৃপতিই তাঁদের প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি ও সাধ্যানুযায়ী— দেহরক্ষী, সারথি, অশ্বরক্ষক, ভৃত্য ও তৈজসপত্র-বাহকের বিপুল দল সঙ্গে এনেছেন। পথের নিরাপত্তার জন্য— কোন রাজ্য কখন অপর কোন রাজ্যের প্রতি বিমুখ বা বৈরীভাবাপন্ন হয়ে পড়ে তার তো কোন স্থিরতা নেই— কিছু কিছু সৈন্যও সঙ্গে আনতে হয়েছে। যাঁদের পথ তেমন বিপজ্জনক নয়—তাঁরা মর্যাদার অঙ্গ হিসাবে অকারণেই এনেছেন।

সমাগত রাজন্যবৃন্দ অবশ্য প্রায় সকলেই প্রস্তাব করেছিলেন—অনুনয় অনুরোধই করেছিলেন বলা উচিত, যে অনুগামী অনুচর বা সেবকদের ব্যবস্থা তাঁরা নিজেরাই করবেন— কিন্তু পাণ্ডবদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তাতে সম্রাটের সম্মান থাকে না—তাই তাঁরা সে কথায় কর্ণপাতও করেন নি, করজোড়ে প্রস্তাবকারীদের নিরস্ত করেছেন। বলেছেন, এরা সকলেই তাঁদের অতিথি, সে দায়িত্ব বুঝেই তো নিমন্ত্রণ করেছেন। তাছাড়া শুধু রাজা বা শাসকদেরই তো আর আমন্ত্রণ করেন নি, ভারত-খণ্ডের সর্বত্র ব্রাহ্মণ দূত প্রেরণ ক’রে ব্রাহ্মণ শূদ্র নির্বিশেষে সমস্ত বিশিষ্ট ও গণ্য ব্যক্তিদেরই নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আয়োজনও সেই অনুপাতেই করা হয়েছিল। কিছু বেশী ধরা হবে তাও স্বাভাবিক। সুতরাং বাস্তব কল্পনাপেক্ষা বিশালতর রূপ পরিগ্রহণ করলেও লজ্জিত বা অপমানিত হবার কোন কারণ ঘটল না। পূর্বাই উপযুক্ত গৃহশিল্পী নিয়োগ ক’রে অতিথিদের মর্যাদা ও প্রয়োজনানুসারে আবাস সকল নির্মাণ করা হয়েছিল। উদ্বেলিত সমুদ্র-তরঙ্গের মতো জনসমাগম দেখে এখন সে-কর্মের পরিধি বিস্তৃততর ও দ্রুততর ক’রে দিলেন মাত্ৰ।

গৃহনির্মাণ-কার্য যেমন যেমন অগ্রসর হতে লাগল, আবাসযোগ্য বোধ হতেই কর্মচারীরা বস্ত্র, শয্যা, পানাহারের পাত্র, অন্যান্য তৈজস-পত্রাদি হিসাব ক’রে রেখে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই সহস্ৰ সহস্ৰ দুগ্ধবতী গাভী,

সূপকার-পাচক- সেবক, সুদর্শন দাসদাসী সংগৃহীত হয়েছিল, প্রয়োজনমতো সংখ্যা হিসাব ক’রে সরবরাহ করা হ’ল। এছাড়া অতিথিদের চিত্তবিনোদনের জন্য গায়ক, নর্তক, রমণী, নটনটী, সরস ও কৌতূহলোদ্দীপক আখ্যায়িকা বলে মনোরঞ্জন করতে পারেন এমন সুবক্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোন দিক দিয়েই আতিথেয়তার কোন ত্রুটি আবিষ্কার করতে না পেরেই বরং কেউ কেউ যেন ক্লান্তি ও বিরক্তি বোধ করতে লাগলেন।

পাণ্ডবভ্রাতারা এই কার্যেও মানবসাধ্যাতীত শক্তির পরিচয় দিলেন। আগমনের সময় নিজেদের সাধ্য ও অভ্যাগতদের মর্যাদানুযায়ী সকলকে ব্যক্তিগতভাবে মাল্য চন্দন উত্তরীয় মধু ও কাঞ্চনসহ অভ্যর্থনা জানাতে লাগলেন। অতিথিদের মনোভাব যাই হোক—সকলেই বলতে বাধ্য হলেন যে পাণ্ডবভ্রাতারা যে-আয়োজন, যে-সুব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগতভাবে যে- পরিশ্রম করলেন—প্রতিটি ব্যক্তির স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য যে দূরদৃষ্টি ও বিবেচনার পরিচয় দিলেন, যার ফলে বিপুল এক সুনিয়ন্ত্রিত কর্মচক্র যেন আপন নিয়মে আবর্তিত হল মাসাধিক কাল—তা অপর কারও পক্ষে সম্ভব হত না, এ যাবৎ হয়ও নি।

ব্যাসদেব লিখছেন—

‘ধর্মরাজের আদেশে তাঁহাদিগকে বহুল-ভক্ষ্য-ভোজ্য সমন্বিত, দীর্ঘিকা ও বৃক্ষসমূহে সুশোভিত বাসগৃহ সমস্ত প্ৰদত্ত হইল। ধর্মনন্দন স্বয়ং সেই মহাত্মা নরপতিগণের পূজা করিলেন। পরে তাঁহারা সংস্কৃত হইয়া যথানির্দিষ্ট বাসস্থানে গমন করিলেন। ঐ সকল বাসগৃহের কোন কোনটি কৈলাসশিখর-সদৃশ মনোহর, নানা দ্রব্য বিভূষিত, সুনির্মিত, শুভ্রবর্ণ, অত্যুন্নত প্রাকারনিকরে সর্বদিকে সমাদৃত, সুবর্ণজাল পরিকীর্ণ, মণিকুট্টিম শোভিত, সুখারোহণীয় সোপানপঙক্তি সমন্বিত, মহামূল্য আসন ও পরিচ্ছদ-বিশিষ্ট, মাল্যদান সমাকীর্ণ, উত্তম অগুরুগন্ধ সুবাসিত, হংস ও সুধাংশু সদৃশ শুভ্রবর্ণ হওয়ায় এক যোজন দূর হইতেও উত্তম দর্শনীয় অসংকীর্ণ সমানদ্বারযুক্ত, নানাপ্রকার উপকরণসমন্বিত এবং অবয়বনিবহে বহুতর ধাতুবন্ধ হওয়ায় হিমাচল শিখররাজির ন্যায় সুদৃশ্য ছিল। সমাগত ভূপাল-গণ তথায় বিশ্রাম করিয়া পরিশেষে প্রচুর দক্ষিণাপ্রদ, বহুল সদস্য সমুদয় পরিবৃত ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সন্দর্শন করিলেন। সমুদয় পার্থিববর্গ ও মহর্ষি ব্রাহ্মণগণে সমাকীর্ণ সেই সভামণ্ডপ তৎকালে অমরনিকরে পরিবৃত স্বর্গপৃষ্ঠের ন্যায় অতিমাত্র দীপ্তি পাইতে লাগিল।’

প্রধানত সহদেবের ব্যবস্থাপনায় ব্রাহ্মণদূতগণ নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও কোথাও ওঁদের নিজেদেরও যেতে হয়েছিল। কৌরবদের কি যাদবদের দূত পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করা শোভন নয় তেমনি পাঞ্চাল বা মদ্রদেশেও।

এই কারণেই স্বয়ং নকুল হস্তিনায় গিয়েছিলেন—পুরোহিত ধৌম্য সমভিব্যাহারে কৌরবদের সসম্মান নিমন্ত্রণ জানাতে

জনশ্রুতি সত্যকে শতগুণে বর্ধিত করে, বিকৃতও করে। কিন্তু এখানে সে-সম্ভাবনা কম, কারণ হস্তিনা থেকে ইন্দ্রপ্রস্থ এমন বেশীদূরের পথ নয়, দূত পাঠিয়ে সঠিক তথ্য আহরণ করা যায়, আর দুর্যোধন তাতে অবহেলা কি বিলম্বও করেন নি। যেটুকু বর্ণানুলেপ–তা ঘটেছে দূতের কল্পনাশক্তি অনুসারেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যেখানে লাভ হয় নি—সময় সুযোগাভাবে—সেখানে সে শূন্যতাটুকু তাদের কল্পনা দিয়ে ভরানো ছাড়া উপায় কি? তবু যথেষ্ট সত্য সংবাদই পেয়েছিলেন। ফলে কৌতূহলে অধীর চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন বহুকাল ধরেই—সভাগৃহ নির্মাণের পর থেকেই। এখন নকুল যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানাতে—ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, ধৃতরাষ্ট্র তো বটেই, জ্যেষ্ঠ বোধে দুর্যোধনের চরণবন্দনা ক’রে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নকুল, ভিক্ষা প্রার্থনার মতো করে— কোন কুণ্ঠা কি অভিমানের বাধা রইল না।

কৌরবরা সদলবলে ও সপরিবারে—অর্থাৎ ভার্যাগণ পরিবৃত হয়েই ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। অপর নৃপতিদের সঙ্গে অতিথির সম্পর্ক—কৌরব-যাদব-পাঞ্চালরা আত্মীয়কুটুম্ব, তাঁদের অন্তঃপুরিকারাও নিমন্ত্রত হয়েছিলেন। এঁদের সনির্বন্ধ অনুরোধে কৌরবরা তাঁদের আত্মীয়কুটুম্ব-কুটুম্বিনীদেরও আনতে দ্বিধা করেন নি।

এঁরা এসে পড়লেন বিরাট কর্মাবর্তের মধ্যেই বলতে গেলে। সভাভবন ভাল ক’রে দেখা কি পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য ও প্রতাপের সম্যক পরিমাপ করা তখনই কিছু সম্ভব নয়। তবুও, যেটুকু দেখলেন ও বুঝলেন, তাতেই ওঁদের মুখকান্তি অসিতবর্ণ ধারণ করল, আহারে নিদ্রায়, এমন কি বেশভূষাতেও রুচি চলে গেল। কৌরবপুরললনারা প্রকাশ্যেই স্বামীদের অকর্মণ্যতা ও অক্ষমতায়, সর্বপ্রকার ন্যূনতায় বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ ও ক্রব্ধ হয়ে সেই যে প্রথম দিন নির্দিষ্ট আবাস-গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন—আর কিছুতেই তা ত্যাগ ক’রে উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্মত হলেন না।

যাদব-প্রধানদের আসতে কিছু বিলম্ব হলেও জনার্দন শ্রীকৃষ্ণ বহু পূর্বেই ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যজ্ঞের কর্মকাণ্ডর শুরু থেকেই তাঁর আচরণ ও মুখভাব হয়ে গিয়েছিল নিরাসক্ত, নিস্পৃহ। কোন অনাত্মীয় দর্শকের মতোই যেন দূর থেকে দেখে যাচ্ছেন সব, এই সুবৃহৎ যজ্ঞ বা তার কর্মব্যবস্থা—উদ্যোগ-আয়োজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মাত্রও নেই। অথচ এতদিনে পাণ্ডব অন্তরঙ্গগণ সকলেই জেনে গেছেন যে এই অভূতপূর্ব, কল্পনাতীত বিরাট যজ্ঞায়োজনের পরিকল্পনা থেকেই পাণ্ডবরা ওঁর উপদেশ নির্দেশ পরামর্শ নিয়ে সেই মতো কাজ করছেন।

ওঁর এই অদ্ভুত আচরণে—যাকে অনায়াসে বীতস্পৃহা, এঁদের সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধাও বলে ধরা যায়—সকলেই বিস্ময় বোধ করতে লাগলেন। এমন কি পাণ্ডবরাও অস্বস্তি অনুভব না ক’রে পারলেন না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে এঁদের সকলেরই একটা ঈষৎ সভয় সম্ভ্রমবোধ ছিল, সাহস ক’রে এঁরা সব সময় তাঁর আচরণ কি মনোভাব সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে পারতেন না।

তবু একদিন সহদেব থাকতে না পেরে কনিষ্ঠের প্রাপ্য প্রশ্রয়ের দাবিতে প্রশ্নটা ক’রেই বসলেন, ‘আর্য, আপনি এমন দূরে দূরে থাকছেন কেন, আর এত কীই বা দিবারাত্র লক্ষ্য করেন? কোন বিশেষ ঘটনায় এত মনোযোগ আপনার?

শ্রীকৃষ্ণ সামান্য হেসে উত্তর দিলেন, ‘ঘটনা নয়, চিত্তবৃত্তি। এক বিশেষ চিত্তবৃত্তিও বলতে পারো।

‘সেটা কি? যা এই সমবেত রাজন্যবর্গের মধ্যে সমগ্রভাবে লক্ষণীয়—জানতে ইচ্ছা করে।’

একটা প্রশ্ন ক’রেই সহদেবের সাহস যেন ফুরিয়ে গেছে, তাই তিনি ইচ্ছাটা মাত্র প্রকাশ ক’রেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন, অপেক্ষা করতে লাগলেন শ্রীকৃষ্ণ যদি অনুগ্রহ ক’রে উত্তর দেন।

শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু তৎক্ষণাৎই উত্তর দিলেন, ‘মাৎসর্য। অসূয়ায় মানুষের মুখের কত রকম বর্ণান্তর ঘটে— সেইটেই দেখছি।… শিক্ষালাভ করছিও বলতে পারো।’

‘আপনি শিক্ষালাভ করছেন!’ অবিশ্বাসের সুরে বিস্ময়োক্তি করেন সহদেব।

‘নিশ্চয়। শিক্ষার কি শেষ আছে! যতক্ষণ জীবন ততক্ষণই শিক্ষার সুযোগ থাকে, এমন কি শেষ নিঃশ্বাসেও। তাছাড়া এর মধ্যে কৌতুকের কারণও তো কম নেই। সুতরাং অরুচিকর কি বিরক্তিকর নয় আদৌ। ঈর্ষা যে এত প্রকারের হয়—এখন মনে হচ্ছে হওয়াই স্বাভাবিক—কিন্তু আগে জানতাম না, এত ভেবে দেখি নি। আত্মীয় বন্ধুরাও ঈর্ষিত, তবে তাঁরা তা প্রাণপণে গোপন করার চেষ্টা করছেন মুখে আনন্দের ভাব ফুটিয়ে তুলতে হচ্ছে—ফলে তাদের কষ্টের সীমা নেই। সাধারণ রাজন্যবর্গও ঈর্ষিত, সেই সঙ্গে কিছুটা লুব্ধও। নিজেদের অক্ষমতাকে মন্দভাগ্য বলে ক্ষোভ অনুভব করছেন। এ সুযোগ তোমাদের হাতে তাঁরাই তুলে দিয়েছেন মনে ক’রে নীরবে নিজেদের ধিক্কার দিচ্ছেন। কেউ কেউ কেমন অকারণে ক্রদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে উঠছে দেখছ না!… আবার দেখছি তোমাদের জ্ঞাতি, নিকটাত্মীয় ধার্তরাষ্ট্রদের। তাদের সুগৌর মুখকান্তি ক্ষণে অসিতবর্ণ ক্ষণে অঙ্গারবর্ণ ধারণ করছে—কখনও বা রক্তহীন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শুধু এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহাবীর অঙ্গাধিপতি। তিনিও ঈর্ষিত তবে সে অন্য কারণে।… তোমাদের ঐশ্বর্য বা প্রতিপত্তির কারণে— সৌভাগ্যের এই প্রজ্জ্বলন্ত দীপ্তিতে নয়।’

‘অন্য কারণ? আর কি কারণ থাকতে পারে?’

‘সেটা—? না-ই বা শুনলে। হয়ত নিজেই বুঝবে একদিন।’

সহদেব আর অধিক কৌতূহল প্রকাশ করতে ভরসা পেলেন না।

১৯

ঈর্ষার লক্ষণটা—মুখশ্রীর এই বিবর্ণতা বা দীপ্তিহীনতা—যে কেউ লক্ষ্য করেছে বা করছে, অঙ্গাধিপতির এমন আশঙ্কা বিন্দুমাত্রও ছিল না। ওঁর মনে হয়েছে এ গোপন ক্ষত, ব্যথাতুর এই ঈর্ষা ও ক্ষোভ একান্তভাবে ওঁরই নিজস্ব।

এ জ্বালা যন্ত্রণাদায়ক—তবু উনি তা সযত্নে লালন করছিলেন। আসলে এই অন্তরবেদনাটুকুই যে যন্ত্রণাদাত্রীর সঙ্গে ওঁর একমাত্র যোগসূত্র, এই যন্ত্রণাই অনুক্ষণ তাঁকে ঘিরে আছে, তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে—দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে। এই একটি মাত্র উপায়ে ওঁর হৃদয়ের আরতি পৌঁছচ্ছে সেইখানে—যেখানে ওঁর পৌঁছনোর কোন উপায় নেই।

দ্রৌপদী। কৃষ্ণা। পাণ্ডব-মহিষী—ইন্দ্রপ্রস্থের পট্টমহাদেবী।

এ জীবনে বহু নারী কামনা করেছে ওঁকে—মহাবীর, ভাস্করদ্যুতি, অনলকান্তি কর্ণকে। যারা স্বেচ্ছায় এসে আত্মদান করেছে, তার মধ্যে অলোকসামান্যা সুন্দরীরও অভাব ছিল না। ওঁর প্রধানা মহিষীর প্রেমেও উনি তৃপ্ত, উনি পূর্ণ— তাতেও সন্দেহ নেই। তবু সেদিনের সেই পাঞ্চাল-স্বয়ম্বর-সভায় কৃষ্ণার রূঢ় প্রত্যাখ্যানের ক্ষতটা আজও নিরাময় হয় নি, সে অপমান অনির্বাণ অগ্নিদাহরূপে তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করছে।

সেই একবার মাত্র। তারপর আর দেখেন নি তিনি দ্রৌপদীকে।

পাণ্ডবদের নব রাজ্যাভিষেকের সময় তুচ্ছ বাধাকে নিমন্ত্রণ-রক্ষার প্রবল অন্তরায় ক’রে তুলে এড়িয়ে গেছেন। ।

তবু সেই একদিন মাত্র দেখার স্মৃতিই যথেষ্ট। মনে হয়েছে জীবনে আর যাকেই পান—ঐ নারীটিকে না পেয়ে তাঁর এই শৌর্য খ্যাতি সব মিথ্যা হয়ে গেছে, এ জীবনেরই আর কোন অর্থ নেই।

সে দীপ্তিময়ীর মুখ অবয়বের সমস্ত তথ্য বিস্মৃত হয়েছেন—শুধু একটা ঈপ্সাতুর কল্পনায় গড়া অস্পষ্ট চিত্রমূর্তিকেই মনে মনে পূজা করেছেন, কামনা করেছেন। …

তারপর, দীর্ঘকাল পরে আবার দেখছেন।

কিন্তু এ কী দেখলেন!

অগ্নিসম্ভবা—সাক্ষাৎ অগ্নিরূপিণী শিখাময়ী এ কন্যা, বিদ্যুতাগ্নি-শিখার মতোই যেন নিমেষকাল মধ্যে দৃষ্টি দগ্ধ ক’রে দিয়ে চলে গেল। সে জ্যোতিতে যেমন ত্রিভুবন দীপিত হয়েছিল তার অভাবে যেন তেমনিই গাঢ় তমিস্রায় ঢেকে গেল সব। না, এ বহ্নির দাহিকা শক্তি আছে, পাবকতা নেই। দগ্ধ ক’রে শুধু জ্বালার সৃষ্টি করে, ক্ষত-বিক্ষত করে। এ মৃত্যু রূপিণী, মুক্তিরূপিণী নয়।

কিন্তু শুধুই কি রূপ!

না, এ নারীকে যত দেখছেন ততই বিস্মিত অভিভূত হচ্ছেন কর্ণ।

ঈর্ষিত হচ্ছেন পাণ্ডবদের অকারণ অপ্রত্যাশিত অযাচিত এই সৌভাগ্যে। হ্যাঁ অকারণই। ওরা এর যোগ্য নয় কেউ। ওরা সম্ভবত এর মূল্যও বুঝছে না।

এই বিপুল, সংখ্যাগণনার আয়ত্তাতীত বিশাল যজ্ঞকাণ্ডের কৃষ্ণাই যেন নিয়ন্ত্রী, কেন্দ্রবিন্দু। সর্বত্রই তাঁর কর্তৃত্ব, সর্ব কার্যের উপরই তাঁর প্রখর দৃষ্টি—তাঁর আদেশের পতাকা শোভমান। এ কর্মোদ্যোগের সঙ্গে যদি অশ্বের তুলনা দেওয়া যায় তো বলতে হবে—এই লক্ষ কোটি বা তারও অধিক রথাশ্বের রশ্মি এই একটি মাত্র নারীর হাতে। বলা উচিত পাণ্ডবেরা কার্য দ্রৌপদীই কারণ। তাঁরা বাহু, দ্রৌপদী মস্তিষ্ক। একটি মাত্র সুকুমার তনু যেন সহস্র অবয়বে বিভক্ত হয়ে লক্ষ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করছে।

এমন কখনও দেখেন নি কর্ণ, কখনও ভাবতে পারেন নি। এমন যে হয় তাও কখনও শোনেন নি। সমস্ত অনুমান, এতদিনের অগণিত বর্ণরঞ্জিত সুদূর কল্পনাকে অতিক্রম ক’রে গেছে এ বাস্তব। সমস্ত বিস্ময় ক্ষুদ্র তুচ্ছ হয়ে গেছে যেন

তবু, এই চিন্তাভাবনা একমাত্র তাঁরই গোপন অন্তর-সম্পদ, এই যন্ত্রণা এই দহন তাঁরই নিভৃত নিজস্ব—ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন কর্ণ।

তার কারণ, তিনি জানতেন সমব্যথী না হলে কারও পক্ষে এ সত্য অনুমান করা সম্ভব নয়।

আর তাঁর সমব্যথী তাঁর চিন্তার অংশীদার এখানে কে থাকবে? কে অনুমান করতে পারবে তাঁর মনের এই ঝঞ্ঝা?

শ্রীকৃষ্ণের হিসাব তো ধরেনই নি। যতই বুদ্ধিমান হোন, তিনিই বা ওঁর মনের তল পাবেন কেন? তাঁর তো এ মনোভাবের কোন কারণ নেই। তিনি সর্বভাবে পূর্ণ, তৃপ্ত।

তাই, যখন এক অপরাবেলায় সভাগৃহ-সংলগ্ন উদ্যানে, ময়দানব–বুঝি মায়াদানব বলাই উচিত—রচিত স্বপ্নকাননে উদাস-ভাবে-বিচরণকারী দিগন্তে-স্থাপিত-দৃষ্টি কর্ণকে বাহুপাশে আবদ্ধ ক’রে শ্রীকৃষ্ণ এই প্রশ্ন করলেন—তখন তিনি যে চকিত চমকিত হয়ে উঠেছিলেন, নিমেষে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ললাট-কপোল, দেবনিন্দিত কণ্ঠেও নিমেষকাল মধ্যে স্বেদ-বিন্দু দেখা দিয়েছিল—তার মধ্যে শুধু বিস্ময় নয় এক অজ্ঞাত আশঙ্কার ভাবও ছিল। এ লোকটিকে অনেকেই মায়াধর ঐন্দ্রজালিক বলে—তাই কি সত্য? এ তাঁর মনের গোপনতম কক্ষের কুঞ্চিকা আবিষ্কার করল কী ক’রে?

শ্রীকৃষ্ণ প্রশ্ন করলেন, ‘অঙ্গাধিপতি, এখানে এসে পর্যন্ত মাৎসর্যের বহুবিধ রূপ ও বর্ণ দেখলাম, তার মধ্যে একমাত্র আপনার মুখভাবই স্বতন্ত্র ও অনন্য। আপনি তো কই এদের এই প্রায়-অলৌকিক সম্পদ ও প্রতিপত্তিতে বিন্দুমাত্র ঈর্ষা বোধ করছেন না? ভারতের সমস্ত রাজন্য যুধিষ্ঠিরকে রাজচক্রবর্তী বলে নতি জানাচ্ছেন, তাতেও আপনার অন্তর্দাহ নেই —আশ্চর্য!’

আত্মসম্বরণ ক’রে নিতে একটু বিলম্ব হ’ল বৈকি ।

বেশ একটুক্ষণ নিঃশব্দে থেকে ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন কর্ণ, ‘না। শক্তি থাকলে, সে শক্তি অর্জনের জন্য সাধনা থাকলে—এবং তার সদ্ব্যবহার করার সুযোগ থাকলে এ কিছু অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নয়। সুতরাং আমি দুঃখ বা ঈর্ষা বোধ করব কেন? ঈর্ষা করে দুর্বল ও অকর্মণরা, বিধাতা আমাকে পৌরুষ দিয়েছেন, শৌর্য আমার আয়ত্ত, অস্ত্রশিক্ষার জন্য জীবন পণ শুধু নয়, ভবিষ্যৎ পর্যন্ত পণ রেখে সাধনা করেছি, তপস্যা করেছি বলতে গেলে। আমার ক্ষোভ সেইখানে—সে-শৌর্য সে-শিক্ষা প্রয়োগ করার সুযোগ বা ক্ষেত্র পেলাম না। জন্মটাই আমার প্রবল শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল। মিথ্যা পাণ্ডবদের ঈর্ষা ক’রে কী করব? যারা করছে তারা কেউই পাণ্ডবদের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়—এ সত্য আমি স্বীকার করতে বাধ্য।’

শ্রীকৃষ্ণ ভাবোচ্ছ্বাসগাঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ধন্য ধন্য, কর্ণ, আপনি ধন্য। লোকে যে আপনাকে মহান, দেবচরিত্র মানুষ বলে তা সত্য নয়—আপনি দেবদুর্লভ চরিত্র।’

কিন্তু তারপর, যেন কিঞ্চিৎ আত্মসম্বরণ ক’রে নিয়ে অতি শান্ত কণ্ঠে পুনশ্চ প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু অঙ্গাধিপতি, এই কি একমাত্র কারণ? এতটা ক্ষোভ কি শুধু এই জন্য? ঈর্ষা করার কি আর কোন হেতু নেই? আপনি নিজের মানসলোকের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন তো?’

আবারও যেন একটা প্রবল আঘাত পেলেন কর্ণ

তেমনিই শঙ্কা-সম্ভ্রমে মেশা বিস্ময়ের আঘাত।

মুহূর্তের জন্য আবারও অরুণাভ হয়ে উঠল তাঁর মুখ।

কিন্তু এবার তিনি অকস্মাৎ পাদচারণা বন্ধ করলেন, বাসুদেবের মুখোমুখি ফিরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওঁর মুখের দিকে কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি এ প্রশ্ন করলেন কেন? অন্য কোন হেতু থাকতে পারে এমন আপনি ভাবলেনই বা কি ক’রে? অনুমান? কিন্তু সমব্যথী না হলে অন্তরের নিভৃততম কক্ষের এই অন্তলীন রহস্য অনুমান করার তো কথা নয়। অথচ—অথচ আপনারই বা এমন, এ ধরনের ক্ষোভ থাকবে কেন? আশ্চর্য! আমার ধারণা ইহলোকে যা কিছু কাম্য থাকতে পারে পুরুষের—তা আপনি সবই পেয়ে গেছেন। এক সম্রাট রূপে প্রতিষ্ঠা পান নি, তবে আপনার লোকোত্তর প্রতিভা ও অবিশ্বাস্য তীক্ষ্ণধার বুদ্ধির যে পরিচয় পেয়েছি বা পাচ্ছি—লোকমুখে শুনেই অবশ্য বেশির ভাগ, তবু তা যতই অতিরঞ্জিত হোক, তার মধ্যে কিছু সত্য নিশ্চয়ই আছে— আপনি ইচ্ছা করলে সে প্রতিষ্ঠাও আপনার পক্ষে খুব আয়াসসাধ্য হ’ত না। এই প্রাসাদ এই ঐশ্বর্য তো আপনারই দান।…তাই ভেবেছিলাম আপনি পরিপূর্ণ, তৃপ্তকাম। ‘

শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন। তাঁর সেই বিশেষ রহস্যঘন হাসি। তা যেমন গভীর তেমনি দুর্বোধ্য!

বললেন, ‘অঙ্গাধিপতি, পুরুষ কেন সমগ্র ভাবে মানুষের কথাই চিন্তা করুন। এ পৃথিবীতে যেই দেহ ধারণ করুক— তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা কখনওই চরিতার্থ হয় না, হওয়া সম্ভব নয়। কিছু না কিছু কাম্য অপ্রাপ্য থেকেই যায়—কিছু না কিছু অতৃপ্তি। এই পার্থিব নিয়ম। একটা কামনা পূর্ণ হতে না হতে আর একটার কথা ভাবে মানুষ। তার সম্ভোগের সমাপ্তি নেই, কামনা-বাসনারও না। এমন কি মৃত্যুকালেও অক্ষয় স্বর্গবাসের বা আরও সুখদ পুনর্জন্মলাভের কামনা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ আবশ্যক। সম্পূর্ণ নিবৃত্তি মানেই নির্বাণ—মহানির্বাণ। তার জন্যেই ঋষিরা তপস্যা করেন কিন্তু তাও কি পান কেউ? সহস্র বৎসর শত জন্ম কঠোর তপস্যার পরও দেখি মুহূর্তমধ্যে সে কৃচ্ছ্রসাধন ব্যর্থ হয়ে যায়, সামান্য সম্ভোগের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠেন—অথবা প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি-সম্মানের জন্য। হয়ত—কোটিতে গোটিক মানুষের সেই দিব্য পূর্ণতা, সেই দুর্লভ বস্তু–মহা পরিনির্বাণ লাভ হয়—অকামনার সিদ্ধিলাভ হয়।’

বাসুদেবের মুখের উপর স্থির-নিবদ্ধ-দৃষ্টি কর্ণ ওঁর কথাগুলি মনোযোগ দিয়েই শুনছিলেন—কিন্তু পূর্ণ মন সেখানে যুক্ত করা সম্ভব হয় নি। অর্ধেক মন তাঁর সম্মুখস্থ ঐ অবর্ণনীয় সুন্দর—নীলকান্ত মণির মতোই নীলাভ আয়ত নয়নের মধ্যে থেকে বক্তার মনোরাজ্যের অন্তগূঢ় রহস্য যবনিকা উন্মোচনের চেষ্টা করছিল। এখন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘তাহলে কি আপনিও—? আপনার এ ক্ষোভ কি আমার হতাশারই সমধর্মী?’

শ্রীকৃষ্ণ পুনশ্চ তাঁকে গভীর আলিঙ্গনে বদ্ধ ক’রে প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘সব প্রশ্নের উত্তর সর্বদা দেওয়া সম্ভব নয় বন্ধু, আর…সব কৌতূহল প্রকাশ করতেও নেই।’

সেই দিনই সায়াহ্নবেলায় যুধিষ্ঠির বিশিষ্ট আত্মীয়, জ্ঞাতিবর্গ ও অন্তরঙ্গ বান্ধবজনকে এক উদ্যোগ-মন্ত্রণা-সভায় আহ্বান করেছিলেন।

যজ্ঞের পুরোহিত ঋত্বিক প্রভৃতি পূর্বেই স্থিরীকৃত হয়েছিল। স্বয়ং মহর্ষি ব্যাসদেবই সে ভার গ্রহণ করেছিলেন। সুদামা, যাজ্ঞবল্ক্য—এঁদের পুরোহিত ধৌম্য, পৈল প্রভৃতি সুপণ্ডিত ও তপস্বীগণকে অন্যান্য কার্যের ভার দিয়ে ব্যাসদেব স্বয়ং ব্রহ্মা বা প্রধান ঋত্বিক রূপে যজ্ঞের যেটা দেবকার্য সেটা সমাধা করবেন। কিন্তু যজ্ঞ বলতে শুধু সেটুকুই নয়, অন্তত এ রাজসূয় যজ্ঞ নয়। সুতরাং কাজ এবং দায়িত্ব দুইই বহুবিধ ও বহুবিচিত্র। তা পালন বা সুসম্পন্ন করাও দুঃসাধ্য। সেইজন্যই এই মন্ত্রণা বা পরামর্শ সভার আয়োজন।

সমাগত সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যাসদেব, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, ধৃতরাষ্ট্রর পাদবন্দনা ক’রে, বিদুরকে নমস্কার জানিয়ে—জ্ঞাতি-ভ্রাতাদের সস্নেহ আলিঙ্গন ও কনিষ্ঠদের সাদর শিরচুম্বন ক’রে যুধিষ্ঠির সকলকেই হাত ধরে এনে যথাযোগ্য আসনে বসালেন তারপর নিজে গুরুজনদের থেকে কিছু নিম্নে আসন গ্রহণ ক’রে—এতাবৎ যা যা আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে—তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ‘এখন এই বিরাট কর্মকাণ্ডে অনুগ্রহ ক’রে কে কী ভার নেবেন তা যদি জানান, আমার বিপুল দুশ্চিন্তা কিঞ্চিৎ লাঘব হয়।’

বক্তব্য নিবেদন শেষ ক’রে কিছুটা উৎসুক এবং কিছু উৎকণ্ঠিত মুখে তিনি পিতামহ ভীষ্মের দিকে তাকালেন। ভীষ্ম জন্মাধিকারসূত্রে এঁদের পিতামহ। তাঁরই সিংহাসন পাবার কথা। তাঁর পিতা কুরুরাজ শান্তনু এক রূপবতী মৎস্যজীবী-কন্যাকে দেখে প্রায় জ্ঞান হারিয়েছিলেন, উন্মত্তবৎ, তাঁর পিতার কাছে গিয়ে বিবাহের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সে ধীবর এই শ্রেণীর নৃপতিদের চরিত্র জানত, দুদিনের সম্ভোগেচ্ছা মিটে গেলে দাসীর মতো একদিকে ঠেলে দেবে, এর গর্ভজাত সন্তানকে জারজ সন্তানের মতো দেখবে। সে শর্ত করল, ‘ওর গর্ভে পুত্র হলে সে-ই সিংহাসনে বসবে, এই প্রতিজ্ঞা করলে তবেই আমি কন্যা দান করব।’ ।

শান্তনু বিপন্ন বোধ করলেন, পুত্র দেবব্রত রূপে গুণে বিদ্যায় বুদ্ধিতে বিবেচনায় শৌর্যে—গর্ব করার মতোই সন্তান, পৃথিবীতে তার সমান বীর কেউ নেই, একবিংশতিবার যিনি স্বীয় ভুজবলে পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন, সেই স্বয়ং মহর্ষি ভার্গবও তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছেন–সে পুত্রকে সিংহাসনে বঞ্চিত করেন কী ক’রে? তাতে শুধু যে বিরাট একটা অবিচারের কারণ হবে তাই নয়, কুরুসিংহাসনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি সে-শর্তে রাজী হতে পারলেন না। ম্লান মুখে বাড়ি ফিরলেন কিন্তু অতিরিক্ত কামনা অতৃপ্ত থাকায় আহার-নিদ্রা নষ্ট হয়ে গেল, দিন দিন শীর্ণ হয়ে যেতে লাগলেন। দেবব্রত পিতার এই ভাবান্তর লক্ষ্য করে সেবকের কাছে কারণ অনুসন্ধান করলেন, এবং পিতাকে না জানিয়েই ধীবররাজের কাছে গেলেন, বললেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমার এই জননীর পুত্রই—যদি পুত্রই হয়— সিংহাসন লাভ করবে।’

ধীবররাজ বললে, ‘কিন্তু বাপু, এর পর তোমার ছেলেরা যদি সে সিংহাসন দাবি করে? আমার দৌহিত্ররা কি তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে? এই বিপদ অবশ্যম্ভাবী জেনে আমি কন্যাকে প্রৌঢ় পাত্রে দিতে প্ৰস্তুত নই।’

দেবব্রত বললেন, ‘বেশ, আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি কখনও দার-পরিগ্রহ করব না, তাহলে তো আর কোন কলহ-বিবাদের সম্ভাবনা থাকবে না?’

ধীবররাজ নিশ্চিন্ত হয়ে কন্যাকে কুরুরাজ-অন্তঃপুরে পাঠালেন।

এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করার জন্যই জন-সমাজে দেবব্রত ভীষ্ম বলে পরিজ্ঞাত হয়েছেন। সেই থেকে তিনি তপস্বীর জীবনযাপন করেছেন এবং অভিভাবক উপদেষ্টা রূপে এদের লালনপালন ও রক্ষা করেছেন। ভাই বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু হলে তিনিই অন্ধ ভ্রাতুষ্পুত্র ধৃতরাষ্ট্র, রুগণ পাণ্ডু, দাসী-গর্ভজাত তাদের ভাই বিদুরকে লালন করেছেন সেই জন্যই তিনি সর্বজন-শ্রদ্ধেয় এ বংশের তিনিই অগ্রগণ্য।

ভীষ্ম কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন, ‘এখানে আমার ভ্রাতৃতুল্য মহাজ্ঞানী মহাতপস্বী কৃষ্ণদ্বৈপায়ন* আছেন, তিনি আমাপেক্ষা অনেক প্রাজ্ঞ, সুতরাং সর্বাগ্রে তাঁর মতামত জ্ঞাত হওয়াই বাঞ্ছনীয়, কর্তব্যও। তবে বৎস, তোমাকে ও সত্যনিষ্ঠ স্থিতধী ও বুদ্ধিমান বলে জানি—তুমি কোন অর্বাচীনতা প্রকাশ করবে না এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুমি কি কিছু স্থির করেছ এ বিষয়ে? তোমার ধারণা কি যদি বলো তো আমরা তা অনুমোদন, পরিবর্তন, বা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করব কিনা—সেটা বিবেচনা করতে পারি।’

ব্যাসদেব সম্মতিসূচক শিরসঞ্চালন ক’রে বললেন, ‘শ্রীমান যুধিষ্ঠির বয়সে নবীন হলেও এ পর্যন্ত অর্বাচীনবৎ কোন কর্ম করেন নি, কোন হঠকারিতা বোধ করি তাঁর সাধ্যাতীত। বরং তাঁর বিবেচনাদি ও কর্ম-নির্দেশনা দেখে আমি বিস্মিতই হয়েছি। আমার মনে হয় তিনি যা ধারণা ও স্থির করেছেন তা পরিবর্তনের অপেক্ষা রাখে না।’

ওঁদের এই উৎসাহদানে যুধিষ্ঠির যেন কিছু মানসিক বল লাভ করলেন। তবু আগের মতোই কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ‘অনুমোদন করার অপেক্ষা আপনাদের স্থিরীকৃত তালিকাই সর্বাংশে শ্রেয় হ’ত। কোন পরিচিত নাম পেলে আর নূতন নামের কথা চিন্তা করেন না কেউ। তত্রাচ আপনারা যখন আদেশ করেছেন তখন আমার প্রস্তাব আমি আপনাদের কাছে নিবেদন করছি। আমার মনে হয় কোন কর্ম সঙ্গত বা অসমীচীন, করা অবশ্যক বা নিষ্প্রয়োজন—স্থির করার ভার কুরুপিতামহ, আমাদের একান্ত শুভার্থী মহাত্মা ভীষ্ম ও আমাদের শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য যদি অনুগ্রহ ক’রে গ্রহণ করেন তো সকল দিক দিয়েই তা উপযুক্ত হয়। তেমনি আমার মনে হয়েছে ভোজনরসিক ধীমান দুঃশাসন যদি খাদ্যভাণ্ডার নিত্য পরিপূরণ ও সুষ্ঠু বণ্টনের ভার নেন গুরুপুত্র অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণদের আতিথেয়তা ও সম্মান-রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহামতি সঞ্জয় রাজন্যবর্গের সেবায় নিযুক্ত থাকেন সকলপ্রকার ঐশ্বর্যে বীতস্পৃহ গুরু কৃপাচার্য যদি কোষাগার ও রত্নভাণ্ডার রক্ষার গুরুভার বহনে সম্মত হন এবং সেই সঙ্গে দক্ষিণাদি দানের ব্যবস্থাও, তো, এই সব সুকঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কার্য সুসম্পন্ন হতে পারে। …ধর্মজ্ঞ বিদুর ব্যতীত আয়ব্যয়ের হিসাব রক্ষা করতে পারেন ও প্রয়োজন বুঝে সুসঙ্গত ভাবে ব্যয় করতে পারেন—এমন কোন লোক আমার স্মরণে আসে নি। বাহ্লীক, সোমদত্ত, পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্র ও আমাদের স্নেহাস্পদ ভগ্নীপতি জয়দ্রথ* সমস্ত কার্য পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন ও সামগ্রিক ভাবে কর্তৃত্ব করলেই শোভন ও যথোপযুক্ত হয়। আর একটি যা গুরুতর কার্য অবশিষ্ট থাকে তা হ’ল উপহার উপঢৌকনাদি গ্রহণ ও আমন্ত্রিত অতিথি- বর্গের অভ্যর্থনা। মহামানী আত্মসম্মানসচেতন স্নেহাস্পদ ভ্রাতা সুযোধনকেই** আমি এ-কার্যের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত কর্তা বলে বোধ করি।’

যুধিষ্ঠির তাঁর বক্তব্য শেষ ক’রে নীরব হলে চতুর্দিকে ‘সাধু’ ‘সাধু’ রব উঠল। ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, ব্যাসদেব প্রভৃতি জ্ঞানীপ্রধানগণ শুধু যে এ তালিকা সর্বাংশে অনুমোদন করলেন তাই নয়—এর ভূয়সী প্রশংসা ক’রে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করলেন যে, এর অপেক্ষা সদ্বিবেচনা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হত না।

প্রশংসা ও হর্ষধ্বনি কিঞ্চিৎ স্তিমিত হতে অপেক্ষাকৃত নীরবতা নেমে এল সেই মন্ত্রণাগৃহে। হৃষ্ট সকলেই। এমন কি এই কার্যভার প্রদানেই যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে মনে ক’রে চিরঈর্ষী দুর্যোধনকেও বেশ সন্তুষ্ট মনে হ’ল।

আরও কিছু সাধারণ দায়িত্বভার বণ্টন অবশিষ্ট ছিল, যুধিষ্ঠির দ্রুত তার তালিকা নিবেদন করলেন। পরবর্তীকালে কোন বিভ্রান্তি বা অসঙ্গতি না দেখা দেয় সেই কারণে নকুল সেগুলি স্বতন্ত্র ভূর্জপত্রে লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন।

সে কাজও একসময় সমাপ্ত হ’ল। এবার সভাভঙ্গেরই চিন্তা সকলের মনে—ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র, বাহ্লীক এবং দুর্যোধন ও তাঁর মাতুল সৌবল শকুনি যেন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে মৃদুগুঞ্জনে আলোচনা আরম্ভ করলেন।

বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু এ পর্যন্ত কোন বাঙনিষ্পত্তি করেন নি।

সভাগৃহের একেবারে সর্বশেষ প্রান্তের এক কোণে স্থির হয়ে বসে ছিলেন। দৃষ্টি তাঁর এপাশের মুক্ত বাতায়নপথে দূর বলভিতে নিবদ্ধ সেখানে দুটি কপোতকপোতী পরস্পরের সঙ্গে কৃত্রিম কলহে লিপ্ত—এক-দৃষ্টে মনোযোগের সঙ্গে যেন তা-ই লক্ষ্য করছেন। মনে হচ্ছে এখানে থেকেও তিনি এই আলোচনা বা মানুষগুলির সঙ্গে যুক্ত নন, কোনো বহুদূরে কোথাও চলে গিয়েছেন, এতক্ষণের এ আলোচনার এক বর্ণও তাঁর শ্রুতিগোচর হয় নি, যেন এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মাত্র নেই।

কিন্তু ঠিক যখন মন্ত্রণা বা আয়োজন-পূর্ব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন হওয়ায় তৃপ্ত যুধিষ্ঠির সভাসমাপ্তি ঘোষণার মৌন অনুমতি প্রার্থনা ক’রে চতুর্দিকে তাকিয়েছেন—তখন অকস্মাৎ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এতক্ষণের নীরবতা ভঙ্গ করলেন, স্বভাবসিদ্ধ সকৌতুক হাস্যের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘মহারাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির যে আমাকে একবারেই অকর্মণ্য মনে করেন তা জানতাম না। আমার ধারণা ছিল—অহঙ্কারও বলতে পারেন যে—অন্তত কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মভার, নিতান্ত অগুরুতর কিছু—একটা পাব।’

এ গৃহের সকলেই সে কণ্ঠস্বরে ও বক্তব্যে চমকিত হয়ে উঠলেন। বাসুদেব যে এতক্ষণ কোন কথা বলেন নি–সে তথ্য সম্বন্ধেও এই প্রথম সকলে সচেতন হলেন। পাণ্ডবরা উদ্বিগ্ন ও অপ্রতিভ, ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি বিস্মিত—কুরুভ্রাতাগণ এঁদের-মধ্যে-আসন্ন-মনোমালিন্যের-মতো-বাঞ্ছিত-সৌভাগ্য আশা না করলেও একটা কৌতুককর পরিস্থিতির প্রত্যাশায় উৎফুল্ল ও উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।

শুধু বিশেষ বিচলিত হলেন না বরং যুধিষ্ঠিরই, তাঁর প্রশান্ত মুখেই বিশেষ কোন বৈলক্ষণ্য দেখা দিল না। বরং তিনি স্নিগ্ধ কণ্ঠে শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘বাসুদেব, আমার ধারণা ছিল, এবং এখনও আছে বস্তুত আমি যা কিছু করেছি, করছি বা করব—তা তোমারই প্রতিনিধিরূপে। আমি তোমার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি মাত্র। এ বৃহৎ কর্মচক্রের তো তুমিই চক্রী, তুমি এর স্রষ্টা ও দ্রষ্টা। এর ধ্যানমূর্তি। এ কর্মের কল্পনা থেকে সূচনা ও বর্তমান বাস্তব আকার গ্রহণ–এ কি সবই তোমার ইচ্ছায় সংঘটিত হয় নি? আমি জানি আমাদের সকলকে সুপরিচালনা করবার কঠিন দায়িত্ব তুমি একা বহন করছ, তাই এ বিপুল যন্ত্রের কোন খণ্ডাংশরূপে তোমাকে দেখতে চাই নি। কোন সামান্য কার্যে তোমাকে জড়িত করার কথা চিন্তাই করি নি। এখন যদি তুমি ইচ্ছা করো— বল কোন কার্যভারে তোমার অভিলাষ, কোন কর্তব্যকে তুমি সুষ্ঠুতর রূপে সার্থক করতে চাও—তুমি অনায়াসে তা গ্রহণ করো। তুমি পূর্ণ, এখন যদি আবার নিজেকে খণ্ডাংশরূপে প্রকাশিত করার অভিপ্রায় হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের আর কি বলার আছে? আমরা তাতে সুখী ও নিশ্চিন্তই হব।’

জনার্দন শ্রীকৃষ্ণর কবি-কল্পনাতীত অবর্ণনীয় মোহন মুখমণ্ডল মধুরতর হাস্যে রঞ্জিত হয়ে উঠল। বললেন, ‘মহারাজ যুধিষ্ঠির—যিনি ধর্মরাজ নামেই বেশী পরিচিত—তিনি সত্যবাদী, প্রয়োজন হলেও অনৃতবাক্য বলেন না, এ-ই জানতাম। তিনি যে বিনয়বচনেও এমন সুপটু তা জানা ছিল না।’ ।

অকস্মাৎ কুরুরাজজামাতা জয়দ্রথ এক ধরনের রূঢ় ব্যঙ্গ-হাস্যের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘হাঁ ঠিক। মহারাজচক্রবর্তী বড় বিপজ্জনক পথে অগ্রসর হচ্ছেন। বিনয়বাক্যের পরের পংক্তিই হ’ল চাটুবাদ—আর কে না জানে চাটুবাদের অর্ধাংশ স্বার্থ বাকি অর্ধাংশ মিথ্যায় গঠিত!’

অনেকেরই ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল এই ধৃষ্টতায়। ভীষ্মর মুখ বিরক্তিতে কঠিন হয়ে উঠল, তবু তিনি সে মনোভাব গোপন ক’রেই বললেন, ‘আমার বিশ্বাস কল্যাণীয় যুধিষ্ঠির তাঁর আন্তরিক বিশ্বাসই প্রকাশ করেছেন, অকারণ বিনয় করেন নি। আমিও—যতটুকু যা এখানে এসে শুনেছি, প্রত্যক্ষ করেছি ও শ্রীমান পাণ্ডবদের সঙ্গে আলোচনায় আহরণ করেছি, তাতে— তাঁর সঙ্গে আমি একমত। তাঁর প্রস্তাবও সমর্থন করি। এখন বাসুদেব তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করলেই আমরা দায়িত্ববণ্টনের তালিকা সমাপ্ত করতে পারি।’

শ্রীকৃষ্ণ এবার উঠে দাঁড়ালেন। দুই কর অর্ধযুক্ত ক’রে অনুগ্রহ প্রার্থনার ভঙ্গীতে বললেন, ‘যা শুনলাম প্রধান প্রধান প্রায় সব কর্মসম্পাদনের ভারই বণ্টিত এবং তা নিশ্চিত যোগ্য স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে। শুধু একটি কর্তব্যের কথা সম্রাট যুধিষ্ঠির এমন কি পিতামহ ভীষ্মেরও দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আমি সেই আপাত-প্রধান কর্ম সম্পাদনেরই অনুমতি প্রার্থনা করছি। অভ্যাগতদের পাদপ্রক্ষালনের ভারটি অনুগ্রহ ক’রে আমাকে দেওয়া হোক।’

সে সভায় আকস্মিক বজ্রপাত হলেও বোধ করি সকলে এত হতচেতন বিমূঢ় বোধ করতেন না নিজেদের। কিছুক্ষণের জন্য যেন জনহীন প্রাণহীন চির-তুষারাবৃত সুমেরু শিখরের মতো একটা অপার্থিব নিস্তব্ধতা নেমে এল সে সভাগৃহে। সূচীপতনশব্দহীন নীরবতা।

অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য।

সকলেরই এই কথাটাই প্রথম মনে হ’ল— তাঁরা কি ঠিক শুনছেন? বাসুদেবের কথার কি সম্যক অর্থ গ্রহণ করতে পেরেছেন?

তার পর কারও বা মনে হ’ল, এটা ব্যঙ্গ ক’রে বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর নাম বাদ দেওয়ার অভিমানে এঁদের সমুচিত শিক্ষা দিতেই এই অদ্ভুত প্রস্তাব করেছেন।

অনেক— অনেকক্ষণ পরে ব্যাকুল যুধিষ্ঠির বলে উঠলেন, ‘না না–এ কী বলছ! তুমি রহস্য করছ নিশ্চয়? অথবা আমাদের ওপর বিরক্ত কি রুষ্ট হয়েছ! এ কাজটার কথা মনে পড়ে নি ঠিকই—তুমি হয়ত সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই—’

শ্রীকৃষ্ণর কণ্ঠ একই সঙ্গে গম্ভীর শান্ত অথচ শাণিত হয়ে উঠল। তিনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যে বাধা দিয়ে বললেন, ‘না মহারাজ। আপনাদের মনে পড়লেও আমি এই কাজটিই চেয়ে নিতাম আপনাদের কাছ থেকে। আপনারা অপরকে এ ভার দিলে আমি তাঁর কাছ থেকে ভিক্ষা চাইতাম। আমার কাছে এ-ই দেবকার্য, ভগবৎসেবা। যেখানে বহু মানুষের অধিষ্ঠান, যেখানে জনতা, যেখানে পঞ্চজন— সেখানেই যথার্থ ঈশ্বরের অস্তিত্ব, তাঁর উপস্থিতি এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। অধিকাংশের মতামতই সত্য, গ্রাহ্য। বহু লোকের মিলিত ইচ্ছাই নিঃসন্দেহে দৈব ইচ্ছা। হে মহারাজচক্রবর্তী, আপনার এই সুবৃহৎ যজ্ঞ, এই কর্ম-সমারোহ—যা পূর্বেও আর সংঘটিত হয় নি পরেও হবে না সম্ভবত, ইতিহাস যুগ যুগ ধরে যার সাক্ষ্য ও কাহিনী বহন করবে, যা সহস্র বর্ষ পরে প্রবাদে পরিণত হয়ে থাকবে—সেই যজ্ঞের এই সুফলটি আমি ভিক্ষা করছি। এই সুদুর্লভ সুযোগে জনদেবতা—জনতারূপ ঈশ্বরের সেবা ও পূজা করার অকল্পনীয় সৌভাগ্যই আমার কাম্য ও প্রার্থনা। যজ্ঞের যাবতীয় ফল আপনারই থাক—এইটুকু পুণ্যসঞ্চয়ের অধিকার মাত্র আমাকে দিন।

আবারও সভাগৃহ তেমনি নীরব হয়ে রইল কিছুকাল। মনে হতে লাগল শ্রীকৃষ্ণের সেই গম্ভীর বজ্রনির্ঘোষবৎ কণ্ঠধ্বনির স্মৃতি সেই কক্ষের স্তম্ভে স্তম্ভে প্রতিহত হয়ে সে সভাগৃহের বায়ুমণ্ডলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, সকলেই কেমন উদাস ও চিন্তাকুল হয়ে উঠলেন। অনেকেরই বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে পলক পড়ল না বহুক্ষণ।

শুধু তার মধ্যে বাষ্পার্দ্রনেত্র বিদুর উঠে দাঁড়িয়ে আবেগগাঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ধন্য ধন্য। শ্ৰীকৃষ্ণ তুমিই পুরুষোত্তম। তোমার কথিত জনদেবতার বাণীমূর্তি তুমি, তার শক্তি তোমাতেই সংহত রূপ ধারণ করেছে। আমি তোমাকে প্রণাম করি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *