১.০১ পাঞ্চজন্য – প্রথম খণ্ড

গ্রন্থারম্ভ

সাধারণত রাত্রি প্রভাত হওয়ার পরও বহুক্ষণ, প্রায় চার-পাঁচ দণ্ডকাল কোন কিছু লক্ষ্য করার মতো অবস্থা থাকে না বলদেবের। থাকার কথাও নয়। রাত্রে যে পরিমাণ সুরা তিনি উদরস্থ করেন, তাতে অপর কোন সামান্য ব্যক্তি হলে কয়েকদিনই হয়ত অচৈতন্য হয়ে থাকত। অমিতবীর্য হলধরের তেমন কোন বৈলক্ষণ্যই দেখা যায় না, শুধু একটু আত্মস্থ হয়ে থাকেন মাত্র অনেক সময়—জেগে আছেন অথবা বসে বসেই আবার নিদ্রিত হয়ে পড়েছেন—বোঝা যায় না।

কিছুকাল এইভাবে থাকার পর তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠে পুনরায় সুরা প্রার্থনা করেন। এ নিত্য-নৈমিত্তিক। এটুকু প্রয়োজনও। রেবতীও তা জানেন, সে ব্যবস্থা হাতের কাছে গুছিয়েই রাখেন। তবে বলদেব না চাইলে দেন না। কারণ এমন এক-আধবার হয়েছে, হাতের কাছে এগিয়ে ধরতে—’প্রাপ্তিমাত্রেণ’ তা পান করেছেন, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র অবহিত না হয়েই—এবং যথাসময়ে অর্থাৎ কিছু পরেই আবার প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন।

তবে সে ঐ একবারই। এটুকুর প্রয়োজন হয় তাঁর প্রকৃতিস্থ হওয়ার জন্য, সুরাপায়ী মাত্রেই তা জানেন। তার একটু পরে সহজ দৃষ্টি মেলে চারিদিক চান। কোন কিছু অনাচার বা অনিয়ম দেখলে ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন, সহজ জীবনযাত্রার লক্ষণে প্রসন্ন হন। অতঃপর প্রাতঃকৃত্য, তৈলমর্দন, স্নানাদি চলে সাধারণ ভাবেই—অভ্যাসের পথ ধরে।

কিন্তু আজ তার কিছু ব্যতিক্রম ঘটল। বোধ করি অগণিত রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি, কয়েক শত অশ্বের হ্রেষা, ভারবাহী অশ্বতরদের অসহিষ্ণু ক্ষুরনিক্ষেপ ইত্যাদির অনভ্যস্ত ও কর্কশধ্বনিতেই তাঁর প্রভাতী আধতন্দ্রার ব্যাঘাত ঘটে থাকবে। তিনি বিনা প্রাথমিক সুরাপানেই দুই আয়ত রক্তচক্ষু বিস্ফারিত ক’রে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের দিকে তাকালেন। তারপর কতকটা অসহায় ভাবেই চিরসঙ্গিনী রেবতীর সন্ধানে পিছন দিকে মুখ ফেরালেন।

রেবতী কাছেই ছিলেন। চোখও পড়ল তবু চিনতে কিছু বিলম্ব হল। প্রাভাতিক সুরাটুকু দেহাভ্যন্তরস্থ না হলে কিছু ভাল ক’রে দেখতে পান না তিনি। নিতান্ত অনুমানেই রেবতী যথাস্থানে থাকবেন ধরে নিয়েই প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপার কি প্রিয়ে, এত কোলাহল কিসের? কোথাও কি কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে? কোন মূঢ় মরণেচ্ছু শত্রু কি এ রাজ্য আক্রমণ করেছে? এ তো মনে হচ্ছে রণসজ্জারই আভাস।’

রেবতী হাসলেন। বললেন, ‘গ্রাম্য মেয়েরা বলে শুনেছি—’যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়াপড়শীর ঘুম নেই’, তা আপনারও দেখছি সেই ভাব। আপনারা কোথায় যাবেন—রাজ্যজয়ে কি রমণীজয়ে—সে খবর কি আমরা রাখব নাকি?’

‘আমরা যাব? আমরা কোথায় যাব? সে কি? কে বললে এ কথা? কই, আমি শুনি নি তো।’

‘সে আবার কি! সেই আয়োজনই তো হচ্ছে শুনেছি। যুদ্ধযাত্রা হলে অবশ্যই এই মাত্র দুই তিন শত লোক যেত না।…এ যা দেখছি, আপনাদের দেহরক্ষী, সূপকার, গাত্রসংবাহক, তৈলমর্দক, শয্যাকর ও সজ্জাকরদেরই সমারোহ। খাদ্যও তো সেই মতো সঙ্গে যাচ্ছে দেখছি। মথুরার কঠিন পিঠঠিভরী ও শর্করাবহুল লাড্ডু প্রস্তুত হয়েছে, ঘৃত, ক্ষীরপিণ্ডক*, যবচূর্ণ, গোধূমচূর্ণ—যা যাচ্ছে, এই দুই তিন শত লোকের মতোই।…আপনি তো আমাকে কোন সংবাদই জানান না, মনেও থাকে না আপনার—এসব সংবাদ আমাকে অপরের কাছ থেকেই সংগ্রহ করতে হয় চিরকাল—’ রেবতীর কণ্ঠস্বর ঈষৎ অভিমানে গাঢ় হয়ে আসে বলতে বলতে, আগে হলে রোদনরুদ্ধই হয়ে উঠত, এখন এসব ঔদাসীন্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাই অতটা আর হয় না, তবু অভিমান একটু হয় বৈকি!—’তাই ভগ্নী রুক্মিণীর কাছে সংবাদ নিতে গিয়ে শুনলাম, আপনারা নাকি পাঞ্চাল দেশে যাত্রা করছেন, আজ দ্বিতীয় প্রহরের প্রথম ভাগেই। নাকি কোন স্বয়ম্বর সভার নিমন্ত্রণ এসেছে, তাই–‘

[*পেঁড়া]

‘স্বয়ম্বর সভা! সে কি! আমরা স্বয়ম্বর সভায় যাব আর কি করতে! এ কি তোমারই মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল—না আমার?…না কই, আমার পানপাত্র দাও দেখি, তন্দ্রার জড়তাটা কাটুক ভাল ক’রে, নইলে তো কিছুই বুঝতে পারছি না।‘

‘তন্দ্রার জড়তা’ কাটার পর ভাল ক’রে তাকিয়েও যে বিশেষ কিছু বুঝলেন তা নয়। তবে আয়োজনটা যে যুদ্ধযাত্রার নয়, সেটুকু বোঝা গেল একবার মাত্র দৃষ্টিপাত ক’রেই। সেনাপতি সেনানায়কদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, অস্ত্রসম্ভারের বৃহদাকার যানগুলি অনুপস্থিত—চারিদিকে শুধুই ব্যক্তিগত সেবকদের ভিড়। আর কিছু সৈন্য যা ঘোরাফেরা করছে তাও নিতান্তই দেহরক্ষী শ্রেণীর। যতদূর মনে হয় পাঁচ শতর বেশি হবে না। হয়ত আরও কিছু দৃষ্টি-সীমার বাইরে আছে—এদিকে ওদিকে—তবে সে-ই বা কত আর হবে? আর পাঁচ শত বড় জোর।

বিমূঢ় ভাবে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বাসুদেব? বাসুদেব কোথায়? তাকে ডাক দেখি, রহস্যটা পরিষ্কার হোক!’

রেবতীর ইঙ্গিতে জনৈক দাসী বাইরে গিয়ে কাকে কি বলে এল—সম্ভবত সেখানে কোন দৌবারিক অপেক্ষা করছিল, তাকেই পাঠাল বলদেবের বার্তা দিয়ে।

তবে তাকে যে বেশীদূর যেতে হয় নি তা বোঝা গেল বাসুদেবও নিশ্চয়ই এই পথেই আসছিলেন—কারণ অর্ধদণ্ডেরও অল্পকালমধ্যে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ এসে দেখা দিলেন।

‘আর্যের জয় হোক। দাদা আমাকে স্মরণ করেছেন? আপনার শরীর ভাল আছে তো? রাত্রে বেশ সুনিদ্রা হয়েছিল?’

খুব নিরীহ ভালমানুষের মতো প্রশ্ন করেন বাসুদেব।

কিন্তু বলদেবের এ ধরনের ভদ্রতা-শিষ্টাচারের ধৈর্য নেই। তিনি ওসব গতানুগতিক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেই সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, ‘এসব কি শুনছি, তুমি নাকি কোথায় স্বয়ম্বর সভায় যোগ দিতে যাচ্ছ?’

খুব শান্ত ভাবে, ভ্রমসংশোধনের ভঙ্গীতে বাসুদেব বলেন, ‘আমি না, আমরা যাচ্ছি বলুন।’

‘আমরা—? কই, তা আমাকে বল নি তো! আমি তো কিছুই জানি না!’

জ্যেষ্ঠের প্রাপ্য মর্যাদা স্মরণ ক’রে একটু ভ্রূকুটিও করেন বলদেব।

‘বলার তো সময় যায় নি। এখনও প্রস্তুত হবার মতো যথেষ্ট সময় আছে।… দ্বিপ্রহরের পূর্বে যাত্রা করা যাবে না …আপনার নিদ্রার ভাবটা কাটলেই সংবাদটা আপনার গোচরে আনব বলে অপেক্ষা করছিলাম, বস্তুত সেই উদ্দেশ্যে আসছিলামই এদিকে—’

তার পর ঈষৎ একটু হেসে বললেন, ‘কাল জানিয়ে তো লাভও হত না। সে-কথা আজ প্রভাত পর্যন্ত আপনার স্মরণ থাকত না।’

বলদেব একটা ঢোঁক গিলে বললেন, ‘হুঁ। তা সে স্বয়ম্বর সভাটা কোথায়? কন্যাটি কার?’

‘স্বয়ম্বর পাঞ্চাল দেশে, পাত্রী পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা—কৃষ্ণা।’

‘দ্রুপদের কন্যা?—ও, সেই হোমাগ্নিসম্ভবা মেয়েটি?’

‘হ্যাঁ আর্য, সে-ই। এ স্বয়ম্বর সভা সব দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশিষ্ট। মেয়েও সাধারণ নয়, স্বয়ম্বরের শর্তও সামান্য নয়। আপনার স্মরণ আছে কিনা জানি না— দ্রুপদ কৌরব তথা দ্রোণের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে সন্তানকামনায় যে যজ্ঞ করেন—তার পূর্ণাহুতি দেওয়ার সময় তাঁর মহিষী প্রস্তুত ছিলেন না বলে পুত্র ও কন্যা দুজনে শরীর পরিগ্রহ ক’রেই যজ্ঞাগ্নি থেকে বেরিয়ে আসে। সেই সময়ই দৈববাণী হয়, এই পুত্র দ্রোণাচার্যকে বধ করবে এবং এই কন্যা কুরুবংশের মহাভয়ের কারণ হবে।…মেয়েটি সব দিক দিয়েই অসাধারণ, শ্যামবর্ণা অথচ এমন অসামান্য সুন্দরী মেয়ে নাকি ভূভারতে কোথাও নেই।…’

অসহিষ্ণু বলদেব বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ স্মরণ আছে। আমার এমন কি বিস্মরণের পরিচয় পেলে এর মধ্যে?’ বোধ হয় স্মরণশক্তি বিষয়ক ইঙ্গিতটার মধ্যে তাঁর প্রবল সুরাসক্তি সম্বন্ধে একটা প্রচ্ছন্ন তিরস্কার ছিল বলেই বিরক্ত হয়ে উঠেছেন একটু, বললেন, ‘তা সে স্বয়ম্বরের শর্তটা কি?’

বাসুদেব হাসলেন, মধুর কৌতুকের হাসি, বললেন, ‘দ্রুপদ স্বয়ম্বর সভামণ্ডপের সর্বোচ্চ বিন্দুতে একটি লক্ষ্যবস্তু রেখেছেন, তার নিচে ঘোরবেগে একটি চক্র ঘুরবে নিচে জলের মধ্যে ছায়া দেখে ঐ লক্ষ্যভেদ করতে হবে। অর্থাৎ এমন হিসাব ক’রে শরনিক্ষেপ করতে হবে যাতে সেই ঘূর্ণমান চক্রের সামান্য দণ্ড-ব্যবধান ভেদ ক’রে তা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছায়। আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয়, এক পলকের শতাংশেরও কম সময়ে এই কাজ করতে হবে। দ্রুপদ ইচ্ছা ক’রেই এই পণ রেখেছেন—বোধ হয় কোন সাধারণ নৃপতি না তাঁর ঐ অসাধারণ কন্যারত্ন লাভ করতে পারে এই তাঁর অভিপ্রায়। যে-ধনুতে শরসন্ধান করতে হবে—শুনেছি তাও বিশেষ ভাবে নির্মিত—সে-ধনু ধরে তাতে জ্যা আরোপণ করাই দুঃসাধ্য।’

‘হুঁ।’ অনেকক্ষণ ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে বসে থেকে যেন বলদেব কথাগুলোর মর্মার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করেন। তার পর বলেন, ‘তা তুমি সেখানে যাচ্ছ কেন? তুমি কি রাজন্যসমাজে নিজের অস্ত্রশিক্ষার পরীক্ষা দিতে চাও, না আর একটি বধূ-গ্রহণের ইচ্ছা? তোমার কি বিবাহের সাধ মেটে নি এখনও?’

বিদ্রুপ-শল্যটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠল বলদেবের কণ্ঠে।

কিন্তু বাসুদেব সে-আঘাত গায়ে মাখলেন বলে বোধ হল না। বরং প্রশান্তগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘না আর্য। একই স্থানে কত লোক কত কী কাজে যায়! দেবমন্দিরে কি শুধুই দর্শনাথী আসে? কেউ আসে দর্শন করতে, কেউ করাতে। কেউ পূজারী, কেউ বা ফুল কি পূজার সামগ্রী বিক্রি করতে আসে। দেবতা কি পুণ্য সম্বন্ধে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এই স্বয়ম্বরের বার্তা পেয়ে ঐ যে দেশ-দেশান্তর থেকে বিবিধ পণ্যসামগ্রী নিয়ে কত লোক আসছে—সুদূর চীন থেকে, তারও ওদিকে অসুর ম্লেচ্ছদের দেশ থেকে সার্থবাহের দল—তারাও যেমন কিঞ্চিৎ লাভের আশায় যাচ্ছে, হয়ত ঐ অযোনিসম্ভবা হোমাগ্নিউদ্ভূতা আশ্চর্য কন্যাটিকে দেখারও কোন আগ্রহ বা কৌতূহল নেই তাদের আমিও তেমনি— সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি বধূ নয়—বন্ধু খুঁজতে। যিনি এই দুঃসাধ্য-শর্ত পালন করতে পারবেন—সেই নবীন বীরের আশাতেই যে আমি পথ চেয়ে আছি দীর্ঘকাল।’

কথা শেষ ক’রে একটি অতি ক্ষুদ্র দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন বাসুদেব।

কিন্তু এত কথা যে সম্যক অনুধাবন করতে পারলেন হলধর—বলে মনে হল না। তিনি একটু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতেই উত্তর দিলেন, ‘কে আবার—দুর্যোধনই জিতবে। আর তো কাউকেই দেখছি না।’

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অভিমানান্ধ পুত্র দুর্যোধন চিরকালই বলদেবের অনুগত—অন্তত সেই ভাবই বজায় দিয়ে চলে সে। দিনকতক গদাযুদ্ধ শিক্ষাও করেছিল ওঁর কাছে। সেই সময় থেকেই–কে জানে কেন, সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণের মনোভাব সম্বন্ধে একটা অস্বস্তি বা সন্দেহ থাকাতেই—বেশী ক’রে উদার ও উদাসীন হলধরকে ধরে আছে। তাঁকেই সর্বদা চাটুবাক্যে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে।

শ্রীকৃষ্ণ তা জানেন। দুর্যোধন সম্বন্ধে ধারণা পরিবর্তন করবারও চেষ্টা করেছেন অনেকবার—কিন্তু কোন ফল হয় নি। এই ধরনের মানুষ পৃথিবীতে অনেক আছে, চিরকালই থাকবে—যারা অকস্মাৎ ক্রদ্ধ হয়ে দাবাগ্নির মতো জ্বলে ওঠে, আবার পরক্ষণেই শান্ত জলবৎ হয়ে যায় সংসারানভিজ্ঞ মানুষের মনের কুটিল গতিবিধির কোন অভিজ্ঞতাই নেই কেউ আশ্রিত বা অনুগত হলে কোন কারণেই তার সম্বন্ধে ধারণা আনতে পারে না। পক্ষপাত একটা নিজের অজ্ঞাতসারেই থেকে যায়।

শ্রীকৃষ্ণ যেমন এ দুর্বলতার সংবাদ রাখেন—তেমনি অগ্রজকে জানেন বলেই তাতে বিচলিত হন না। অনুজ সম্বন্ধে বলদেবের অগাধ বিশ্বাস, অসীম আস্থা ওঁর ওপর। ভালও বাসেন, বোধ করি একটু সমীহও করেন। ওঁর বুদ্ধির তল পান না যে, তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন। শ্রীকৃষ্ণের মতের বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে তিনি কিছু করবেন না কোন দিন – এ বিষয়ে ওঁর সন্দেহমাত্র নেই।

আজও কণ্ঠে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলার পর একটু উৎসুক ভাবেই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকান। সেখানে সমর্থন খোঁজেন।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ঘাড় নাড়েন, ‘না, তার কর্ম নয়। সে বলদর্পী, ঈষী, অহঙ্কারী, সেই জন্যই হঠকারীও, তাছাড়া ধনুর্বেদে সে খুব পারদর্শী দুরদর্শী নয় কোনকালেই। এ-পণ যে জিতবে তার দৈহিক বল, অভ্যাস ও শস্ত্র-কৌশলের সঙ্গে স্থির বুদ্ধি, অসীম ধৈর্য, একাগ্র লক্ষ্য ও অস্ত্রক্ষেপণ এবং তার গতি সম্বন্ধে নির্ভুল জ্ঞান একান্ত আবশ্যক। এই গুণগুলি যার আছে তাকেই আমার প্রয়োজন, তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি দীর্ঘকাল ধরে।’

‘তার মানে তোমার ব্যক্তিগত ক্ষতি ও অপমানের শোধ তোলবার মতো একটা লোক খুঁজছ? নিজের যোগ্যতার অভাব স্বীকার ক’রেও?’

বলদেব আবারও একটু ব্যঙ্গতীরাগ্র বেঁধাবার চেষ্টা করেন।

কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তীক্ষ্ণতর তীরের মতো শ্রীকৃষ্ণের উত্তর এসে যেন বিদ্ধ করে তাঁকে, ‘দোষ কি? মানুষ মাত্রেই তো এ স্বধর্ম। যেমন আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিও তার সহজাত—তেমনি আঘাতকারীকে প্রত্যাঘাত করার ইচ্ছাও। যার নিজের সে-শক্তি নেই, সে কৌশল অবলম্বন করবে বৈকি। ‘ব্যাঘ্রসনে নখেদন্তে নহেকো সমান, তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ, কোন নর লজ্জা পায়?’…তবে শুধু তাও নয়, আমার অন্য লক্ষ্য, অন্য উদ্দেশ্যও আছে কিছু। বৃহত্তর এক লক্ষ্য। ‘

‘কী লক্ষ্য?’ সকৌতূহলে বলদেব প্রশ্ন করেন।

‘যথাসময়ে তা আপনিই উপলব্ধি করবেন, সে গুপ্তমন্ত্রণা প্রকাশ করার সময় এখনও আসে নি। আর ইচ্ছা করলে আপনি এখনও জানতে পারেন, আপনার অসামান্য মনীষা, প্রজ্ঞা-দৃষ্টি ইচ্ছা ক’রে সুপ্ত রেখেছেন বৈ তো নয়, আপনি সচেতন হলে ত্রিকালের কোন কিছুই অজ্ঞাত থাকতে পারবে না।’

তারপরই যেন অকস্মাৎ বর্তমান কর্তব্য ও কার্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন তিনিও। অগ্রজকে অতিক্রম ক’রে রেবতীকে সম্বোধন করেন, ‘আর্যা, অন্তত দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হবার পূর্বেই যাতে যাত্রা করতে পারি সে-বিষয়ে আপনি এবার একটু সচেষ্ট হোন। আপনার আনুকূল্য ছাড়া তা হবার সম্ভাবনা নেই।’

‘অর্থাৎ—?’ মুখ টিপে হেসে রেবতী প্রশ্ন করেন।

‘অর্থাৎ দাদার প্রাত্যহিক কর্মগুলো—তৈলমর্দন, অঙ্গসংবাহন, স্নান, পূজা প্রভৃতি একটু ত্বরান্বিত না করলে—আহারাদি সেরে ঐ সময়ে যাত্রা করা যাবে না।’

এই বলে আর বাদানুবাদ বা বলদেবের কোন বক্তব্যের অবসর না রেখেই উভয়কে অবনত মস্তকে করজোড়ে প্রণিপাত জানিয়ে বাসুদেব তখনকার মতো বিদায় নেন।

‘কী গো প্রিয়তমে, আমি স্বয়ম্বর সভায় যাচ্ছি জেনেও যে মুখভার করছ না, কিংবা রোগশয্যা গ্রহণ করছ না, বরং সতীসাধ্বী স্ত্রীর মতো সব গুছিয়ে দিচ্ছ—ব্যাপারটা কী? আমি বড় শঙ্কিত বোধ করছি যে, মনে হচ্ছে আমার কপাল এবার পুড়ল, আমার প্রেমে তোমার অরুচি ধরে গেছে!’

সত্যই বাসুদেবের প্রিয়তমা মহিষী সত্যভামা (একেই যা ভয় করেন তিনি, সমীহ করেন রুক্মিণীকে) তখন একটি বেত্রপেটিকায় স্বামীর নিত্যপ্রয়োজনীয় বিশেষ দ্রব্যগুলি সাজিয়ে রাখছিলেন। রাত্রে শয়নের পূর্বে হরিতকীচূর্ণ বটিকা গ্রহণের অভ্যাস আছে, সেগুলি স্ফটিকাধারে রাখতে হবে মুখশুদ্ধির জন্য লবণাক্ত শুষ্ক আমলকীখণ্ড প্রচুর দেওয়া আবশ্যক যেখানে সেখানে জল গ্রহণ করেন না, অথচ রথচক্র-উৎক্ষিপ্ত ধূলিতে পিপাসা পাওয়া স্বাভাবিক, সাময়িক পিপাসা শান্তির জন্য তাই কতকগুলি অম্লরসাস্বাদিত শর্করাখণ্ড তৈরী করানো থাকে—সেগুলি লাক্ষারঞ্জিত ক্ষুদ্রতর মৃৎপাত্রে গুছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আছে বকুলের দন্তধাবনদণ্ড, স্বর্ণনির্মিত রসনামার্জনী আরও কত কী। এ কাজ দাসদাসীদের দ্বারা হয় না, প্রধানা দুই মহিষীই ক’রে আসছেন চিরদিন। আগে রুক্মিণীই করতেন, ইদানীং–উগ্ৰ প্রাথমিক প্রণয়াবেগ শান্ত হওয়ায়—সত্যভামা ধীরে ধীরে নবীনা প্রেয়সী থেকে সেবাপরায়ণা গৃহিণীতে পরিণত হচ্ছেন দেখে—এবং স্বামী অধিকাংশ অবসরকালই সত্রাজিৎ-নন্দিনীর পুরে অবস্থান করেন দেখে—ভারটি ছেড়ে দিয়েছেন। দিনকতক জাম্ববতী নিজেই আগ্রহ ক’রে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু সে ছেলেমানুষ, পিতার আদরিনী কন্যা—সব হিসাব ক’রে, প্রয়োজন বুঝে গুছিয়ে দিতে পারে না দেখে বাসুদেবই নিষেধ করেছেন।

সত্যভামা পেটিকা থেকে মুখ তুলে এদিকে চেয়ে অভয়কৌতুক হাস্যে উত্তর দিলেন, ‘আর্যপুত্র, সমুদ্রে যার শয্যা তার শিশিরে কি ভয়? যে দিবারাত্র অগ্নিআবর্তে দগ্ধ হচ্ছে, সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গ নিয়ে দুশ্চিন্তা তার পক্ষে হাস্যকর নয় কি?…শুনেছি পূর্বে অসংখ্য গোপকন্যা আপনার প্রসাদলাভে ধন্য হয়েছে, এখনও অগণিতপ্রায় সপত্নী নিয়ে ঘর করছি, জাম্ববতীর পরেও তো কতকগুলি এসে এই প্রাসাদে প্রবেশ করল দেখলাম—তার ওপর আর একটি যোগ হলে আর বেশী কি ক্ষতি?’

শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন, তবে ঠিক অপ্রতিভের হাসি নয় সেটা, কৌতুকেরও নয়। কেমন এক ধরনের রহস্যময় গভীরতা সে হাসিতে। সেই সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিও হয়ে এল স্বপ্নাচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে যেন স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘তুমি তো জান সখী, আর কেউ না জানুক—তোমার আর রুক্মিণীর ভাল করেই জানা আছে—এদের অনেকের সঙ্গে আমার ভাল করে পরিচয়ই হয় নি। প্রাসাদে চলাফেরার সময় সাক্ষাৎ হলেও অনেককে আমি চিনতে পারি না।…দীর্ঘকালের আজন্ম- আকাঙ্ক্ষা নাকি তাদের—কেউ বলে জন্মজন্মান্তরের—আমাকে স্বামীরূপে পাওয়া—তাদের সেই ঐকান্তিক কামনাই পূর্ণ করেছি মাত্র! কেন তারা চায় আমাকে, কেন চেয়েছে—? না শক্তিতে না বিত্তে আমি এমন কিছু অসাধারণ নই, মহারাজ-চক্রবর্তী বা ত্রিভুবনবিজয়ী বীর—কিছুই না। তবুও তারা কেন আমাকে কামনা করেছে—তা তারাই জানে!’

‘জানি, জানি ঠাকুর, তোমাকে আর ঐ পুরাতন পুঁথি খুলে বসতে হবে না। কিন্তু রহস্য থাক,—আসল কথাটা খুলে বল দিকি, তুমি কাকে খুঁজতে যাচ্ছ! সেইটে জানার জন্যেই ছটফট করছি। তোমাকে আমি চিনি, কে এ পণ জিতবে, কে জিততে পারে তা তুমি বিলক্ষণ জান, সেই বিশেষ ব্যক্তিটিকেই দেখতে যাচ্ছ!’

‘আমার মানসজগতের কোন সুড়ঙ্গ পথটাই তোমার অজ্ঞাত নেই—সেই তো হয়েছে মহাবিপদ! কিছুই গোপন করা যায় না!’ কৃত্রিম হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেন বাসুদেব, তারপর বলেন, ‘কে নয়, কাদের। পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা হবে বলেই যাচ্ছি।’

‘সে কি!’ সত্যভামা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ান, ‘তারা তো বারণাবতে দগ্ধ হয়েছে! তাদের কোথায় পাবে আবার?’ ‘ঐ ভাবে, মূঢ় দুর্যোধনের চক্রান্তে অকালে অপঘাতে মৃত্যুতে প্রাণ দেবার জন্য পাণ্ডবরা সৃষ্ট হয় নি। বিশেষ উদ্দেশ্যেই তাদের জন্ম।…বারণাবতে জতুগৃহদাহের সংবাদ পাবার পর কি আমি নিশ্চিন্ত স্থির হয়ে ছিলাম তুমি মনে কর? আমি সেখানে গিয়েছিলাম, ভস্মরাশি সরিয়ে অস্থিগুলি দেখে এসেছি। ভাল করেই দেখেছি। ভীমের অস্থি হতে পারে এমন একটাও চোখে পড়ে নি। না, তারা বেঁচে আছে। আর তা যখন আছে তখন এ স্বয়ম্বর সভায় নিশ্চিত আসবে—এইটেই আশা করছি।’

‘কত রকমই জান তুমি! কত খবর রাখ, কত ভেবে কাজ কর। আশ্চর্য, এতকাল তোমার সেবা করছি, আজও তোমার চিন্তাভাবনার অন্ত পেলুম না! তুমি বলছিলে তোমার মানসরহস্য সব জানা হয়ে গেছে—এর চেয়ে বিদ্রুপ আর কিছুই হতে পারে না।…তোমার কোন রহস্যটাই জানতে পারি নি। হয়ত জ্যেষ্ঠা রুক্মিণী কিছু জানেন— তাও সন্দেহ হয়। সমুদ্রেরও তল আছে, হয়ত বা আকাশেরও সীমা থাকা সম্ভব— তোমার তলও নেই, সীমাও নেই!’

তারপর খুব কাছে এসে বলেন, ‘আচ্ছা সবাই বলে তুমি ভগবান। কেউ বলে তুমি তাঁর অষ্টাংশগ্ধ, কেউ বলে তুমিই পূর্ণ, পরমেশ্বর।…ঠিক ক’রে বল না তুমি কী! অনেকবারই প্রশ্ন করেছি, এড়িয়ে এড়িয়ে গেছ। আমার কাছে বল— আমি কাউকে বলব না।’

শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি আবারও তেমনি রহস্যস্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে এল। এই রকম হয়ে যায় ওঁর দৃষ্টি মধ্যে মধ্যেই। এই সময়গুলোতে কেমন যেন ভয় করে সত্যভামার, মনে হয় এ যেন তাঁর পরিচিত প্রিয়তম স্বামী নয়, এ যেন আর কেউ, বিরাট কেউ—রহস্যময় কোন সত্তা। এই সব সময়ে ওঁর কণ্ঠস্বরও মৃদু গম্ভীর হয়ে ওঠে, তাতে কৌতুকের মাধুর্য বা বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা থাকে না, অতিমানবিক কোন শক্তির স্পর্শে যেন তা এক লোকোত্তর পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেই অতি মৃদু কণ্ঠস্বরেও বাতাস যেন কাঁপতে থাকে, মনের মধ্যে গুরু গুরু শব্দ ধ্বনিত হয়।

আজও তেমনি ধীর মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘এড়িয়ে যাই নি, ঠিকই বলেছি। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো নি সত্যভামা। ঈশ্বর সর্বজীবেই আছেন, সর্বত্রই আছেন। তাঁকে ছাড়া কি কেউ বা কিছু আছে? শুধু সেটা উপলব্ধি করতে পারে না লোকে। সেই বোধ যে যত জাগাতে পারে নিজের মধ্যে, সে-ই তত শক্তিমান। যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, সে বিশ্বাস, উপলব্ধি— সেই শক্তিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে—সে-ই তাঁর অবতার, সে-ই ভগবান।’

‘তা তুমি তো এসব জান’, আজও যে সত্যভামা স্বামীর কথার তল পেলেন তা নয়, তাই ভাসা-ভাসা ভাবে কথাটার সূত্র ধরে বললেন, ‘তোমার তো শক্তির জ্ঞানের শেষ নেই। তোমার যা উদ্দেশ্য তা তো তুমিই সফল করতে পার, তবে তুমি পাণ্ডবদের খুঁজে বেড়াচ্ছ কেন?’

‘দ্যাখো, তা নয়।’ বাসুদেব সস্নেহে সত্যভামার কটি বেষ্টন করলেন, ‘বহু দিনে মানুষের এই ধারণা মজ্জাগত হয়ে গেছে যে রাজারা, ধনী ব্যক্তিরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে এ বিধিনির্দিষ্ট বিধান, এর কোন প্রতিবিধান সম্ভব নয়। আমি দরিদ্র গো-পালকদের ঘরে মানুষ হয়েছি, নিরীহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে—বলদর্পী, স্বেচ্ছাচারী, অসংযমী কংসের ভয়ে জনসাধারণ—ওর প্রজারা সর্বদা কী শঙ্কাকণ্টকিত হয়ে থাকত—জীবস্মৃত হয়ে দিন কাটাত—তা আমি নিজে দেখেছি, অনুভব করেছি। এর যে কোন প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন, ওদের দ্বারা এই যে অকারণ নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার অবিচারের প্রতিবাদ করা সম্ভব—তা ওরা কখনও ভাবতেও পারে নি। এই ভাবে, নির্বাধায় মার খাওয়াই তাদের ভাগ্যলিপি, এই ভেবেই মার খেত তারা।…আমি যে কংসবধ করেছি, সেটাকেও তারা অলৌকিক দৈবলীলা ভেবেছে, আমাতে ঈশ্বরত্ব আরোপ ক’রে নিশ্চিন্ত হয়েছে। তাদের যে কিছু করণীয় থাকতে পারে, তাদের দ্বারাও এমন কাজ হতে পারে—তা কখনও ভাবে নি, এখনও ভাবে না। না-দেখা ভগবানের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে চুপ ক’রে বসে আছে।’

এই বলে একটু থেমে আবারও বললেন বাসুদেব, ‘আমি সেইটেই দেখাতে চাই সকলকে। পাণ্ডবরা আজ যদি বেঁচে থাকে, বেঁচে আছে তা জানি—তারা এখন পথের ভিখারী—সহায়সম্বলহীন, গৃহহীন, ভিক্ষান্নজীবী। যদি তাদের দিয়েই এই মদগর্বিত, ঐশ্বর্যলোভী, ক্ষমতালোলুপ, চরিত্রহীন, পরশ্রীকাতর পাশব ক্ষাত্রশক্তিকে—যা অনাচারে অত্যাচারে দেশকে জর্জরিত ক’রে তুলেছে, অগণিত দেশবাসীর রক্ত শোষণ ক’রে স্ফীতোদর হয়েছে, দেশের মাথার ওপর বসে আছে—তা ধ্বংস করাতে পারি—তাহলে এই লক্ষ লক্ষ মূঢ় মূক জনসাধারণ বুকে বল পাবে। প্রেরণা পাবে এগিয়ে যাওয়ার, মাথা তোলার।’

‘তারা তখন পাণ্ডবদের ওপরও ঈশ্বরত্ব আরোপ করবে, দৈবশক্তি দেখতে পাবে তাদের সাফল্যে।’ ‘এতগুলো ঈশ্বর? না তা ভাববে না! সবাই অন্তত ভাববে না।’

‘ঈশ্বরত্ব না হোক, দেবত্ব?’

‘সে-দেবত্বের প্রকাশ পাঁচটা মানুষে সম্ভব হলে পঞ্চাশটাতেই বা হবে না কেন—এ-কথাও কি ভাববে না কেউ?…পঞ্চপাণ্ডবকে আমি বেছে নিয়েছি এ-দেশের সাধারণ মানুষের প্রতীক হিসেবেই। ওদের আমি যতদূর জানি,— বেশী দেখি নি কিন্তু খবর রাখি ঠিকই—বোধ হয় আমার হিসেবে ভুল হয় নি। যুধিষ্ঠির ধর্মভীরু, স্থিরবুদ্ধি, বিনয়ী, ভদ্র কিন্তু বড়ই ভালমানুষ, উচ্চাশা সাহস কিছু নেই দুর্বলচিত্ত, ভীরু সব দিকেই। নিজে কোন কাজে এগিয়ে যেতে পারে না, মন স্থির করতে পারে না—পরমুখাপেক্ষী, পরবুদ্ধিনির্ভর। ভীমের অসুরের মতো দৈহিক বল—মাথায় কিছু নেই। অর্জুনের শৌর্য আছে, শিক্ষাও আছে—সেজন্য বেশ একটু গর্বিতও—কিন্তু উচ্চাশা উদ্যম কম। নকুল সহদেব যে-কোন তরুণ বয়সী ছেলেদের মতোই—লেখাপড়া জানে কিছু—তা কাজে লাগাতে শেখে নি। কোন কিছু নিয়ে নিজেরা চিন্তা করে না, শুধু বড়দের আদেশ পালন করে, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার সামর্থ্য নেই রূপচর্চায় যত মনোযোগ, বুদ্ধিচর্চায় তত নয়। * নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা গড়ে নেবে—এ তারা ভাবতেও পারে না বোধ হয়। তবু, এরা পাঁচজনে মিলে অনেক কিছু করতে পারে—বি পশেষত যদি এদের পিছনে স্থিরবুদ্ধি এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোন লোক থাকে।’

‘অর্থাৎ তুমি—এই তো? ও দুটো তোমার মতো আর কার আছে বল!’

মুগ্ধদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে হাসেন সত্যভামা। শ্রদ্ধায় কৌতুকে মেশানো হাসি। মুগ্ধতার সঙ্গে একটা সম্ভ্রম— ভয়ের ভাবও যেন জাগে সে-হাসিতে।

‘কী জানি।’ কাঁধের একটা বিচিত্র ভঙ্গী ক’রে হাসেন বাসুদেবও, ঈষৎ বিষণ্ণ হাসি। তার পর বলেন, ‘সত্যিই জানি না, সত্যভামা। এক-একসময় হতাশা আসে মনে, সেই সঙ্গে বীতস্পৃহাও। একা কি পারব এই গন্ধমাদন—এতগুলো নিষ্ক্রিয় জড় মূক ভাগ্যতাড়িত লোকের বোঝা বইতে! এরা কি সত্যই কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে?…আমার বুদ্ধির ওপর তোমার অগাধ বিশ্বাস, কিন্তু আমার এতটা আস্থা নেই নিজের বুদ্ধির ওপর। এক-একসময় সত্যিই মনে হয়—আমি যা ভাবছি, যে-পথে যাচ্ছি—তাই কি ঠিক? না, একটা বিরাট ভুলই করছি। ক্ষাত্রশক্তিকে বিনষ্ট করতে গিয়ে দেশটাকে ক্লীবের দেশ ক’রে দিতে চলেছি! বুদ্ধি না বুদ্ধির অহঙ্কার–কে জানে, বুঝতে পারি না ঠিক।

তারপর সত্যভামাকে টেনে বক্ষবদ্ধ ক’রে বলেন, ‘এক-একসময় বড় ক্লান্তি বোধ করি। যা দেখছি, যে-জীবনধারা আমার চারিদিকে বইছে—মাৎসর্য, লোভ, ব্যভিচার—অকারণ হিংসা, অকারণ অত্যাচার, দর্পের সঙ্গে তেজের সঙ্গে প্রকাশ্যে পাপাচরণ—আমার আত্মীয় বান্ধব কুটুম্ব বলে যারা পরিচিত তারা সকলেই ঐ শ্রেণীভুক্ত—এসব দেখে আর কোন আশা রাখতে পারি না। অরুচি ধরে যায় এই দেহটার ওপর, এই জন্মগ্রহণের ওপর। মনে হয় পিতামহ ব্রহ্মার এই মনুষ্যসৃষ্টিই ভুল হয়েছে, তিনি কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে জীবসৃষ্টির পরিকল্পনা করেছেন। যখন এ কথাগুলো ভাবি আর এ-জীবন রাখার ইচ্ছা থাকে না।’

সত্যভামা শিউরে উঠে ওঁর মুখে হাত চাপা দেন।

‘ছিঃ ছিঃ! ও কথা বলো না। তোমার অন্তত এ-হতাশা শোভা পায় না। তুমি মানো আর না মানো, সমগ্ৰ মানবসমাজে—সমস্ত সৃষ্টি তোমার মুখ চেয়ে আছে। তুমি মোহগ্রস্ত হলে সাধারণ উৎপীড়িত বিপন্ন মানুষ কার মুখ চেয়ে বুক বাঁধবে? তাদের আর বাঁচারই উপায় থাকবে না যে। ক্লান্তি অবসাদ মোহ এগুলো দেহের ধর্ম—কিন্তু তুমি কি এসবের ঊর্ধ্বে নও?…নাও, ওঠ, প্রস্তুত হয়ে নাও। দ্বিপ্রহরের আর দেরি নেই। দেবী রুক্মিণী তোমার আহার্য সাজিয়ে বসে আছেন নিশ্চয় এতক্ষণে!’

‘তা বটে। যেতে হবে, না? চল।…আমি সর্বদাই প্রস্তুত হয়ে থাকি, যে-কোন মুহূর্তে যত দূর দেশে হোক যাত্রা করতে পারি—চিন্তা আর্য বলদেবকে নিয়েই।’

বাসুদেব আবার কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সাধারণ পরিচিত সত্তায় ফিরে আসেন।

স্বয়ম্বর অনুষ্ঠান এমন কোন অভূতপূর্ব ঘটনা নয়,তবু যে পাঞ্চাল-নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে তার কারণ—এ- স্বয়ম্বরের পণ ও পাত্রী, দুই-ই অসাধারণ। এমন যোগাযোগ ঘটে ক্বচিৎ।

যাঁর স্বয়ম্বর—ইতিমধ্যেই তাঁর খ্যাতি কিম্বদন্তীতে পরিণত হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে বিস্তার লাভ করেছে। অনন্যশ্রুত তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, অলোকসামান্য তাঁর রূপ ও গুণ। শস্ত্রশাস্ত্রপারঙ্গম দ্রোণাচার্য পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের বাল্যবন্ধু। চরম দারিদ্র্যে নিপতিত দ্রোণ একদা সেই বন্ধুত্বের দাবীতে দ্রুপদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু সেখানে সমাদরের পরিবর্তে পান চরম অনাদর–রূঢ় ব্যবহার। ক্রোধাভিভূত আচার্য হস্তিনাপুরে এসে শ্যালক কৃপাচার্যের গৃহে প্রায় অজ্ঞাতবাস করতে থাকেন। কুরু-পিতামহ স্বয়ং মহাবীর ভীষ্ম সে-সংবাদ পেয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ করে এনে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর নাবালক পুত্রদের শস্ত্র শিক্ষার ভার অর্পণ করলেন।

সে-শিক্ষা সমাপ্ত হলে কুমাররা, বিশেষ অর্জুন ও ভীম যখন অজেয় বীরে পরিণত হলেন তখন দ্রোণ গুরুদক্ষিণা দাবী করলেন—দ্রুপদের নিপাতন ও লাঞ্ছনা এবং তা লাভও করলেন। সে-অপমান ভুলতে না পেরে প্রতিহিংসা কামনায় দ্রুপদ এক কঠোর যজ্ঞানুষ্ঠান করলেন। জনশ্রুতি সেই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি সমাপ্ত হতে যজ্ঞাগ্নি থেকেই এক কুমার ও কুমারীর আবির্ভাব হয়—ধৃষ্টদ্যুম্ন ও কৃষ্ণা। গণকরা বলেন, এই কন্যা থেকেই কৌরবদের মহাসর্বনাশ ঘটবে, এই পুত্র হবে দ্রোণের নিহন্তা।

হোমাগ্নি-নিষ্ক্রান্তা অযোনিসম্ভবা এ কন্যা পাবকশিখার মতোই দীপ্তিমতী, তেজস্বিনী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রাপ্তবয়স্কা, সর্বগুণে সকলের অগ্রগণ্যা। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা, আচরণ, কথাবার্তা–বিনয়সম্পন্ন, ত্রুটিহীন। কী চারুকলায়, কী সঙ্গীতশাস্ত্রে, কী রাজনীতিবোধে বা কী সাংসারিক কর্মব্যবস্থায়—অতুলনীয়া এই কন্যার অধিকার ও নিপুণতা যেন সহজাত। আর রূপ? সেও তো রূপকথার রাজকন্যার মতোই—সুরনারীদুর্লভ, কল্পনাসীমাতীত। তিনি শ্যামবর্ণা হয়েও অপরূপা, তাঁর দেহবর্ণের স্নিগ্ধশ্রী দর্শককে আনন্দদান করে অতিশয় সুদর্শনা সজল মেঘপুঞ্জের মতো তাঁর নিবিড় কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশ তিনি সুস্তনী, পীনপয়োধরা নীলোৎপল-পলাশের মতো আয়ত তাঁর দুই চক্ষু রহস্য ও মোহ-ময় তাঁর দৃষ্টি। তাঁর করতল পদতল ও ওষ্ঠ রক্তবর্ণ, তিনি হংসগদগদভাষিণী কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর মতোই গতি তাঁর—সুগঠিতা- দেহা, সুদর্শনা।

কন্যা বিচিত্র, বিচিত্রতর তাঁকে লাভ করার শর্তও। সীতাস্বয়ম্বরের পর এমন পণ আর কোথাও রাখা হয় নি। মানুষের আগ্রহের এও এক কারণ। কে এমন পণ জিতবে, আদৌ কেউ জিততে পারবে কিনা—এ-কৌতূহল নৃপতি থেকে স্থপতি, সেনা থেকে সেনানায়ক, গুরু থেকে ছাত্র, পুরোহিত থেকে ক্রীতদাস সকলকারই। ফলে—দ্ৰুপদ তো দেশে দেশে বার্তা পাঠিয়েছেনই, আমন্ত্রণপত্র নিয়ে দূত গেছে প্রায় সমস্ত রাজসভাতেই— লোকমুখে সংবাদ ছড়িয়েছে অনেক বেশী, অনেক দ্রুত। নিমন্ত্রণ পৌঁছবার পূর্বেই প্রস্তুত হয়েছেন রাজন্যবর্গ, এমন কি যাঁরা কোন আশা পোষণ করেন না—যথা ভূস্বামীর দল, অবস্থাপন্ন গৃহস্থ—যাঁদের সঙ্গতি আছে—তাঁরাও রবাহূত হিসাবে রওনা দিয়েছেন পাঞ্চালাভিমুখে। শুধু মজা দেখতে, কৌতূহল চরিতার্থ করতেই বেরিয়ে পড়েছেন তাঁরা। নিকটবর্তী দেশ থেকে সাধারণ গৃহস্থও বেরিয়েছেন কেউ কেউ, এমন কি স্নাতক বা শিক্ষার্থীও বাদ যায় নি।

আর এঁরা এসেছেন বলেই—আরও বহু জনসমাগম হয়েছে। বাণিজ্য ক’রে যৎকিঞ্চিৎ উপার্জন করতে এসেছে ব্যাপারীর দল চারিদিকে রাজন্যবর্গের স্কন্ধাবারগুলি কেন্দ্র ক’রে বাজার বসে গেছে, বিরাট এক ব্যস্ত নগরীর রূপ ধারণ করেছে। সুদূর চীনদেশ থেকে, তিব্বত থেকে, গান্ধারপারের অসুর ম্লেচ্ছ যবনদের দেশ থেকেও সার্থবাহর দল এসেছে বিবিধ বিচিত্র পণ্য নিয়ে। তাদের পণ্য বহন করতে, পশুপাল সংরক্ষণ করতে বেশ কিছু শ্রমিকও এসে পৌঁচেছে। খাদ্যবস্তুর অসংখ্য বিপণি খোলা হয়েছে, ইন্ধনের ব্যবসায়ে শত শত কাঠুরিয়া পৌঁছে গেছে পূর্বেই। এমন কি কুম্ভকার ও ভোজনপাত্র সরবরাহকারকদেরও ব্যবসা জোর চলছে। এতগুলি লোকের মনোরঞ্জন করতে বিভিন্ন স্তরের নটনটী নর্তক-নর্তকী বাজীকরের দলও পিছিয়ে নেই। সেই সঙ্গে কত যে ভিক্ষুক এসেছে, এসেছে সাময়িক ভিক্ষার্থীর দল—তার লেখাজোখা নেই।

রাজা দ্রুপদের দিক থেকেও আদর-আপ্যায়ন-সমাদরের ত্রুটি নেই। অভ্যর্থনা করার ভার নিয়েছেন স্বয়ং যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন। তিনি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নৃপতিদের প্রাসাদশিবিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অতিথিদের স্বাচ্ছন্দ্যবিধান ও তাঁদের অসুবিধা দূর করতে। পানীয় জলের সরবরাহ না ব্যাহত হয় আবর্জনা ইত্যাদিতে অতিথি-অভ্যাগত এবং রবাহূত দর্শকদেরও না স্বাস্থ্যহানি ঘটে—সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য পাঞ্চালরাজ কয়েকজন মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। নৃপতিদের সঙ্গে সেবক-পাচক-দাস-দাসী, শিবিকাবাহক, অশ্বরক্ষক, অঙ্গসংবাহক, দেহরক্ষী প্রভৃতি যে অসংখ্য অনুচর এসেছে, তাদের খাদ্যাদি তারা সঙ্গেই এনেছে, পাঞ্চালরাজসভা থেকেও প্রচুর সিধা পাঠানো হচ্ছে। ফলে মহোৎসব পড়ে গেছে স্কন্ধাবারে।

সে সিধায় ধান্য গোধূম তৈল ঘৃত মাংস প্রভৃতি ভোজনের প্রধান উপকরণ তো থাকছেই—দুগ্ধ দধি মিষ্টান্নেও তার একটি বৃহদংশ রচিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে সুরা প্রভৃতি রুচিকর আকাঙ্ক্ষিত পেয়ও।

কিন্তু সুদ্ধমাত্র পানভোজনের ব্যবস্থা ক’রেই পাঞ্চালরাজসভা নিশ্চিন্ত ছিলেন না। অতিথিদের মনোরঞ্জন ও নৈষ্কর্ম্যজনিত ক্লান্তি অপনোদনেরও যথেষ্ট ব্যবস্থা করেছিলেন। নগরের পূর্বোত্তর দিকে বিশাল স্বয়ম্বর সভা নির্মিত হয়েছিল, তাকে কেন্দ্র ক’রে চতুর্দিকে অতিথিদের জন্য সুরম্য বাসভবন, স্কন্ধাবার, বিপণিশ্রেণী প্রভৃতি তারও পরে প্রাচীর, প্রাচীরের পরে পরিখা। সে-প্রাচীর কয়েকটি দ্বার ও তোরণে সুশোভিত। সব মিলিয়ে সুবৃহৎ নগরীর রূপ ধারণ করেছে কিছুপূর্বের রুক্ষ পার্বত্য প্রান্তর।

সভাস্থল এই নগরীর কেন্দ্রবিন্দু বলে সেখানেই নৃত্যগীত, নাট্যাভিনয়, মল্লযুদ্ধ, ভোজবাজি প্রদর্শন প্রভৃতি আমোদ- প্রমোদের আয়োজন হয়েছিল। নানা দেশ থেকে নট, মঙ্গল-পাঠক বৈতালিক, পুরাণবক্তা, মহাবল মল্ল ও সুশিক্ষিত নর্তক এসেছিলেন। সভাস্থান চন্দনজল ছিটিয়ে ধূলিশূন্য ও সুবাসিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধূপ ও অগুরুধূম তো আছেই। রাজন্যবর্গের বসার আসনগুলিও যথাসাধ্য আরামপ্রদ করা হয়েছে। এমন কি রবাহূত দর্শকদের জন্যও আছে শুষ্কশষ্পের উপর মেষলোমের আস্তরণের ব্যবস্থা, যাতে মৃত্তিকার কাঠিন্য না বোধ করে তারা। অভ্যাগতদের আসন স্তরে স্তরে উঠে গিয়ে সভামণ্ডপের আচ্ছাদন-বস্ত্র স্পর্শ করেছে প্রায়, স্বয়ম্বর বা নৃত্যগীত অভিনয় কোনটাই দেখার অসুবিধা নেই কোন প্রান্ত থেকেই। এই বিশাল সভার বিস্তীর্ণ মধ্যক্ষেত্রে চন্দনদারুদ্বারা মঞ্চ নির্মিত হয়েছে—অভিনয় ও নৃত্যগীতের জন্য মল্ল-যুদ্ধের আয়োজন ভূমিতে। বস্তুত সারাদিনই সেখানে কিছু না-কিছু আমোদ- আহ্লাদের আয়োজন থাকছে—যার যখন ইচ্ছা এসে বসে কিছুকালের জন্য আনন্দ উপভোগ ক’রে যেতে পারে। এবং সে আয়োজন এক- আধদিনের জন্যও নয়। পূর্ণ এক পক্ষকাল ধরে চলল এই অভূতপূর্ব আনন্দ-বিতরণ মহোৎসব।

এ-বিপুল গভীর জনারণ্যে কাউকে খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব। বাসুদেব সে চেষ্টাও করলেন না। বিশিষ্ট যেসব অতিথি এসেছেন, বিভিন্ন দেশের নৃপতির দল—বিশ্বস্ত চর পাঠিয়ে তাঁদের একটা তালিকা সংগ্রহ করলেন শুধু। এর চেয়ে বেশী যোগাযোগ করার সাহস নেই, তাঁর শত্রু চারিদিকেই। কতক তাঁকে আমলই দেন না, সমান বলে স্বীকার করেন না, ‘কংসের ক্রীতদাস’ বলে বিদ্রুপও করেন কতক—যেমন মগধাধিপতি জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপাল ও প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্ত প্রভৃতি তাঁর সম্বন্ধে বিদ্বিষ্ট। এঁরাই প্রধান, শক্তিশালী। একা জরাসন্ধর ত্রিশ অক্ষৌহিণী সৈন্য। সুতরাং সমধর্মী সমব্যথী দু-চারজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করলেন মাত্র।

আর যা করলেন, স্বয়ম্বর সভায় সভার কার্যারম্ভের অনেক পূর্বে গিয়ে পৌঁছবার ব্যবস্থা। স্বয়ম্বরের কাল নির্দিষ্ট হয়েছিল দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যভাগ, কিন্তু প্রত্যুষকালেরও পূর্বে বলদেবের ঘুম ভাঙিয়ে, তার পরও অবিরাম তাগিদ দিয়ে তাঁর প্রাতঃকৃত্য স্নান পূজা প্রভৃতি সমাপন করিয়ে দধি ও দুগ্ধপিণ্ডকে সামান্য জলযোগ ক’রে প্রথম প্রহরের অন্তত চার দণ্ড অবশিষ্ট থাকতেই সভাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

সাধারণ জনতা অবশ্য তার বহু পূর্বেই পৌঁছে গেছে—বোধ করি রাত্রি প্রভাত হবার আগেই এসে বসে আছে কেউ কেউ—মঞ্চের নিকটে দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসন পাবার আশায়। বাসুদেব বা তাঁর অগ্রজ ও জ্ঞাতিদের সে-চিন্তা ছিল না পূর্বাহ্নেই নৃপতিদের মর্যাদা অনুসারে স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল যাদব ও বৃষ্ণিরাও সে-তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের এত পূর্বে আসার কারণ অন্য। এতবড় চক্রাকার সভায় কে কোথায় বসেছেন, কে কে এসেছেন, কার কতটা সাফল্যের সম্ভাবনা—মাত্র একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেওয়া সম্ভব নয়। এক প্রান্ত থেকে বিপরীত অপর প্রান্তের মানুষগুলোকে চিনতে পারাই তো দুরূহ ব্যাপার, পরিচয়ের বিশেষ লক্ষণগুলি লক্ষ্যই হয় না। আর, সেভাবে একে একে দেখা—সময়সাপেক্ষও বটে।

সভা না দেখেও আয়তনটা অনুমান করতে পেরেছিলেন বাসুদেব। সেই কারণেই এত আগে আসা তাঁর—যথেষ্ট সময় থাকতে। নৃপতিদের জন্য দুটি প্রবেশপথ নির্দিষ্ট ছিল—পূর্ব ও উত্তর দ্বার। শ্রীকৃষ্ণ সেই তোরণদ্বার দুটির দিকে দৃষ্টি রেখেই কে বা কারা আসছেন লক্ষ্য করতে লাগলেন।

এসেছেন ভারতের সর্বপ্রান্তের নৃপতিরাই। ক্ষুদ্র বৃহৎ কোন দেশ বা রাজ্যই বাদ যায় নি। মদ্র, মৎস্য, প্রাগজ্যোতিষপুর, অন্ধ্র থেকে সুদূর কেরল পর্যন্ত। তবে সকলেই কিছু গণ্য নন। যাঁরা সম্ভাব্য বিজেতা, তাঁদের সম্বন্ধেই কৌতূহল। হিসাবনিকাশ, ভবিষ্যদ্বাণী, এমন কি বাজি ধরাও—তাঁদের নিয়েই।

বলরামের অত আগ্রহ ছিল না, থাকার কারণও নেই। সূর্যোদয়ের বহু পূর্বে শয্যাত্যাগ করার ফলে বিগত রাত্রির সুরাপানের জড়তা কাটে নি তখনও। তিনি নিরাসক্ত উদাসীনবৎ চেয়ে বসে ছিলেন আর ঘন ঘন স্তন ত্যাগ করছিলেন। কেবল, অকস্মাৎ, অঙ্গাধিপতি কর্ণ সপারিষদ সভাগৃহে প্রবেশ করতেই সোজা হয়ে বসলেন তিনি, অনুজকে বললেন, ‘ওহো, এই তো কর্ণও এসেছেন দেখছি। কর্ণকে হিসেবে ধরা হয় নি তো। এ-ই আসল লোক। কর্ণই লক্ষ্যভেদ করবেন—দেখে নিও।’

বাসুদেব তখনই কোন উত্তর দিতে পারলেন না। কারণ ঠিক সেই সময়েই আর একটি ঘটনা ঘটেছে—অন্তঃপুরের দিকের বস্ত্রাবরণ সরিয়ে কন্যাকে সভায় আনা হয়েছে।

এই দ্রৌপদী!!

বাসুদেব বিস্মিত হন কদাচিৎ। যে-কারণে সাধারণ মানুষ বিস্ময় বোধ করে—সে-কারণ তাঁর জীবনে বিশেষ ঘটে না বহু জিনিসই তিনি বহু পূর্বেই অনুমান ক’রে নিতে পারেন, বহু সম্ভাবনা তাঁর আশ্চর্য সহজ বুদ্ধিতে কল্পনা ক’রে নেন। বহু দূর-ভবিষ্যতে দৃষ্টি পৌঁছয় তাঁর—মানুষের মনের গহন অন্তঃপুরে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অনায়াস গতিবিধি। কিন্তু আজ তিনিও বিস্মিত হলেন। ঠিক এ রকম কখনও ভাবেন নি, এমন যে দেখবেন তা ধারণা করেন নি। কল্পনা এত দূর পৌঁছয় নি।

অযোনিসম্ভবা, হোমাগ্নি-উদ্ভূতা এই কন্যা একেবারে কিশোরী রূপেই এই মর্ত্যে এসেছে—সেটা জানেন বৈকি। শ্যামাঙ্গী হলেও অসামান্য অতুলনীয়া সুন্দরী—এও শুনেছেন। কিন্তু সব জানা ও শোনার বাইরের বস্তু এ। আজকের এ অভিজ্ঞতা সকল পূর্ব-অভিজ্ঞতার অতীত। সাধারণত কোন তথ্য প্রচারিত হওয়ার সময় অনেক বেশী অলঙ্কার-যুক্ত হয়, অনেক বর্ণ-যুক্ত হয়—কিন্তু এখানে তা হয় নি, কারণ জনশ্রুতির শব্দবাহুল্য বাস্তব সত্যকে ধরতে পারে নি। কল্পনাকে কিছুটা জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করতে হয়—সাধারণ মানুষের কল্পনাশক্তি এতদূর পৌঁছতে পারবে না, আর পারবে না বলেই তা বাস্তবের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারে নি।…

ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত মূক হয়ে গেলেন বাসুদেব।

বোধ করি তাঁর জীবনে এই প্রথম।

তাঁর মুখে ভাষা ছিল না সে-সময়, চোখে ছিল না পলক।

‘এই দ্রৌপদী! সেই পরমাশ্চর্য যজ্ঞলব্ধ কন্যা!’

আবারও মনে মনে উচ্চারণ করলেন একবার।

রূপ?

হ্যাঁ, রূপসীও বটে। অসাধারণ, অসামান্য, অপার্থিব রূপসী—সুরকন্যা-দুর্লভ রূপ—তাতে কোন দ্বিমত নেই। এমন রূপ তিনিও বেশী দেখেন নি। তবে সেজন্য তাঁর এ-বিস্ময় নয়। শুধু রূপই একমাত্র গণনীয় হলে এতখানি বিচলিত হতেন না তিনি।

তিনি বিস্মিত বিচলিত হয়েছেন অন্য কারণে।

তিনি দেখছেন ঐ কন্যার ব্যক্তিত্ব। এত কাল এত মেয়ে দেখেছেন, বহুনারী-বল্লভ বলে একটা খ্যাতিই আছে তাঁর, —এমন ব্যক্তিত্ব, মনীষা ও বুদ্ধির এমন দীপ্তি আর কখনও তাঁর চোখে পড়ে নি।

শুধু আয়ত নীল পদ্মপলাশের মতো চোখ দুটিতেই নয়,—সুকুমার চারু ললাটের ভঙ্গীতেও স্থির তীক্ষ্ণ বুদ্ধি—সেই সঙ্গে কর্তৃত্ব করার, মানুষকে পরিচালন করার সহজাত শক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। এ-নারী শুধুমাত্র মানবী নয়, দেবীও নয়—এ আরও অনেক কিছু, অন্য কিছু। কোন পরিচিত বিশেষণে একে বিশেষিত করা যায় না, কোন বিশেষ বর্ণনায় একে ব্যঞ্জিত করা যায় না।

আশ্চর্য! এ-ই দ্রৌপদী!

আরও একবার বললেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে।

সঙ্গে সঙ্গে মনের কোন প্রত্যন্ত প্রদেশে এক লহমার জন্য একটা হতাশা-ঈর্ষা মিশ্রিত ঈপ্সা জাগে যেন—এই মেয়ে যদি তিনি পেতেন! তাঁর উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী হতে পারত—সিংহের সিংহিনী। এ তাঁর কেবলমাত্র বিলাসসহচরী নর্মসঙ্গিনী হত না। একে পাশে পেলে এমন একক, এতটা অসহায় বোধ হত না। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অন্য লোক খুঁজতেও হত না।…

কিন্তু ঐ এক লহমাই। পলককাল মধ্যেই চিন্তাটা মনে উদয় হয়ে মনেই লয় পেল। মনকে কঠোর ভাবে শাসন করলেন বাসুদেব। যা হবার নয়, যা হবে না তা নিয়ে অকারণ মনের মধ্যে একটা অভাববোধ সৃষ্টি ক’রে লাভ নেই। এ মেয়ে স্রষ্টার বরে সংহাররূপিণী হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। যেখানেই যাক, যার ঘরেই যাক—তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। আর, যদি তাঁর অনুমান গণনা ভুল না হয়, পাণ্ডবরা জীবিত এবং এই সভায় উপস্থিত থাকে তো তাদের ঘরেই যাবে। তাতেই কাজ বেশী হবে তাঁর।

চিত্তকে সংযত ক’রে প্রকৃতিস্থ হতে কয়েক লহমা সময় লাগল তাঁর। তার পর–তখনও অন্যমনস্কতার ঘোরটা কাটে নি—সেইভাবেই অগ্রজকে উত্তর দিলেন, ‘আপনিও মেয়েটাকে হিসেবে ধরেন নি। মেয়েদের আমি যতদূর জানি, এ মেয়ে কখনও সূতপুত্রকে বরণ করবে না। কর্ণ যদি সে-চেষ্টা করেন—অকারণেই হাস্যাস্পদ হবেন।’

‘তুমি যখন বলছ তখন আর সন্দেহ কি! তোমার থেকে মেয়েদের আর বেশী কে জানবে?’

সুযোগ পেয়ে বলদেব আর একবার বিদ্রূপ-শল্য বিদ্ধ করেন কনিষ্ঠকে।

ভাগ্যক্রমে অঙ্গাধিপতির আসন বৃষ্ণিদের আসন থেকে খুব দূরে পড়ে নি। কর্ণ চেয়েছিলেন বন্ধু ও পরম উপকারী লজ্জাত্রাতা দুর্যোধনের কাছে থাকবেন—কিন্তু রাজাদের মর্যাদা হিসাবে আসন নির্দিষ্ট হওয়ায় ওঁকে দূরে পড়তে হয়েছে। অঙ্গ কৌরবদের অনুগত করদরাজ্য মাত্র। সে-দেশের অধিপতি-শাসক স্বাধীন সার্বভৌম রাজাদের পংক্তিতে স্থান পেতে পারেন না।

কন্যা সভাস্থ হলেও অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে কিছু বিলম্ব হ’ল। অনেক কিছু করণীয় তখনও করা হয়ে ওঠে নি, আয়োজনের অনেক ছোটোখাটো কাজ বাকী। তাছাড়া তখনও ক্রমাগত লোক আসছে সভায়। ইতরজন বা দর্শকদের জন্য তত চিন্তা নেই, আর তারা তো পুর্বাহ্নে এসে বসে আছে, নিমন্ত্রিত অতিথিরাই তখনও সকলে উপস্থিত হতে পারেন নি, বিপুল ঘণ্টানিনাদে ও ঘোষকদের উচ্চকণ্ঠ ঘোষণায় স্বয়ম্বরের অনুষ্ঠান এবার আরম্ভ হবে শুনে দ্রুত আসতে শুরু করেছেন। দ্বাররক্ষক ও আসননির্দেশকারকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও অনেকে নির্দিষ্ট আসন খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁরা কেউ কেউ অসন্তুষ্টও নিজেদের ত্রুটি ভুলে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে হোতা তথা ব্যবস্থাপকদের ধিক্কার দিচ্ছেন। ফলে কিছুটা বিশৃঙ্খলা ও বিপুল কোলাহল দেখা দিয়েছে। দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রস্তুত হয়ে নিজের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন বটে, কিন্তু এ অবস্থা শান্ত না হলে স্বয়ম্বর সম্পর্কিত শর্তাদি ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না।

অবস্থা বুঝে—এখনও অন্তত দণ্ড-দুই কাল সময় হাতে আছে হিসাব ক’রে নিয়ে—বাসুদেব নিজের আসন থেকে উঠে সপার্ষদ অঙ্গাধিপতি যেখানে বসে আছেন সেইদিকে অগ্রসর হলেন। বিস্মিত বলদেবের ‘কোথায় যাচ্ছ’ ‘কোথায় যাচ্ছ’ প্রশ্ন শ্রুতিগোচর হলেও—না হওয়ার ভাব দেখিয়ে একেবারে কর্ণের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সৌজন্যসূচক অভিবাদন জানিয়ে কুশল প্রশ্ন করলেন, ‘মহাবীর অঙ্গাধিপতির শারীরিক ও অন্যান্য কুশল তো? পারিবারিক সংবাদ সব শুভ?…এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না?’

কর্ণ বিস্মিত হলেন। সামান্য পরিচয় মাত্র ওঁদের, বরং দুর্যোধনের শস্ত্রগুরু হিসাবে বলদেবের সঙ্গে কয়েকবার আলাপের সুযোগ ঘটেছে—শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বার-দুয়েকের বেশী সাক্ষাৎ হয়েছে বলে তো কৈ মনে পড়ে না। তার এমন আত্মীয়তার কারণ কি?…একটু শঙ্কিতও হলেন মনে মনে, কপটী ও নিদারুণ ধূর্ত বলে বাসুদেবের একটা দুর্নাম আছে —তাঁর এমন অকারণ গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় স্বতঃই শঙ্কা জাগে মনে।

আরও বিস্ময় আনত অভিবাদনে। যতই হোক—গোপালকদের ঘরে মানুষ হলেও শ্রীকৃষ্ণ যদুবংশের সন্তান। যদু ও বৃষ্ণি বংশ ক্ষত্রিয় বলেই দাবি করেন নিজেদের। সেই শ্রীকৃষ্ণ জেনেশুনে সূতপুত্রকে নমস্কার করলেন কেন? রাজা হয়েছেন ঠিকই, তাই বলে তো আর ক্ষত্রিয় হয়ে যান নি!

কিন্তু বিস্ময় বা শঙ্কা যতই থাক—ভব্যতায় বা শিষ্টতায় পিছিয়ে থাকা যায় না। কর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিনমস্কার ও প্রতিকুশল প্রশ্ন ক’রে সমারোহ সহকারে বাসুদেবের দুই হাত ধরে পাশে বসালেন।

‘আসুন, আসুন। কী ভাগ্য, আপনি অনুগ্রহ ক’রে আমাকে স্মরণ ক’রে এসেছেন। ইঙ্গিত করলে আমিই যেতাম।’ ‘না, না, তাতে কি হয়েছে! আপনি বোধ হয় বয়স ছাড়া সব বিষয়েই আমার থেকে অগ্রগণ্য। মহাবীরই শুধু নন— মহান মানুষ। আপনার অকুণ্ঠ দানের কাহিনী, পরোপকার ও জনসেবার বিবরণ আজ সমগ্র ভারতে বিদিত।’

‘ছিঃ ছিঃ! ওসব কথা বলে লজ্জা দেবেন না। আমার সাধ্য নিতান্তই সীমিত, নগণ্য। আপনি বয়সেও জ্যেষ্ঠ বিদ্যায় বুদ্ধিতে রাজনীতিতে সর্বত্রই আপনার প্রজ্ঞা স্বীকৃত, আপনার প্রতিভা সর্বজনবিদিত।… আপনি আমাকে স্মরণ রেখেছেন এতেই আমি বাধিত, ধন্য হয়েছি … এখন আপনার—আপনাদের কথা বলুন। আচার্য বলদেব সুস্থ ও প্রসন্ন আছেন তো? তাঁর কি আমাকে স্মরণ আছে?’

‘বিলক্ষণ! সেই কথাই তো আপনাকে বলতে এলাম। তিনি আপনাকে মনে রেখেছেন শুধু নয়—আপনার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা। আপনি সভাগৃহে প্রবেশ করা মাত্র আর্য বলদেব বলেছেন, এই একমাত্র ব্যক্তি যে আজকের এই দুরূহ পণ জিততে পারে। আর তো কাকেও দেখছি না। এই সুরবন্দিতা দেবাংশজাতা কন্যা অঙ্গাধিপতির কণ্ঠেই বরমাল্য অর্পণ করবে।’

‘আমি!! বলদেব আমার কথা বলেছেন? সে কি!’ আনন্দে ও অকপট বিস্ময়ে কর্ণ প্রায় আসন ছেড়ে ওঠার উপক্রম করেন। ‘কী বলছেন আপনি? পরিহাস করছেন বোধ হয়—?’

শ্রীকৃষ্ণও ভ্রূ কুঞ্চিত ক’রে মুখে ও দৃষ্টিতে অকপট বিস্ময়ের ভাব এনে বললেন, ‘কেন? একথা আপনার মনে এল কেন? নিজেদের মধ্যে অযথা বিনয় ক’রে কোন লাভ নেই— আপনিই বলুন আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ এ-সভাতে আর কে আছেন? বলশালী ঐশ্বর্যবান সুযোদ্ধা হয়ত আরও অনেকে আছেন—কিন্তু এখানে অন্য দৈহিক শক্তি বা যুদ্ধকৌশল প্রকাশের সুযোগ কোথায়? ধনুর্বাণে যে একান্ত নিপুণ সে-ই শুধু এ-পণ জিততে পারে। অর্জুন জীবিত থাকলেও কথা ছিল, এ সভামধ্যে জামদগ্ন্য-শিষ্য কর্ণ ব্যতীত আর তো কোন সম্ভাব্য বিজেতাকে দেখছি না।’

অর্জুন শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একবার কর্ণর মুখমণ্ডল ভ্রূকুটিবদ্ধ ও আরক্তিম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে কয়েক পলকের জন্যই। মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে অকারণ উষ্মা পোষণ ক’রে লাভ নেই। বিশেষ অর্জুনকে শ্রেষ্ঠতর এমন কথা বলেন নি বাসুদেব, প্রতিদ্বন্দ্বী রূপেই উল্লেখ করেছেন মাত্র। মোটের ওপর আনন্দিতই হলেন কর্ণ, প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘তাই তো! কিন্তু সত্যই বলছি, এ-স্বয়ম্বর সভায় ঠিক প্রতিযোগিতা করতে আসি নি। ভেবেছিলাম মহারথ দুর্যোধনই হয়ত এ-পণে বিজয়লাভ করবেন, আমরা মহোৎসাহে বন্ধুপত্নীকে নিয়ে হস্তিনায় ফিরব।’

‘এটা মনে করা আপনার ঠিক হয় নি কিন্তু, পুত্রস্নেহে মানুষ অন্ধ হয় শুনেছি, দেখলাম আপনি বন্ধুপ্রীতিতে অন্ধ।’ শ্রীকৃষ্ণ অমায়িক কণ্ঠে ছদ্মঅনুযোগ করেন, ‘কুরুবংশতিলক দুর্যোধন গদাযুদ্ধে যতটা পটু—ততটা কেন, তার দশমাংশও যে ধনুযুদ্ধে নন, তা আপনার চেয়ে আর কে জানে? তাছাড়া অঙ্গাধিপতি, আপনি মহাবীর, বীরের ধর্ম যেমন আশ্রিতকে বিপন্নকে রক্ষা করা, সমধর্মীর সঙ্গে যুদ্ধ করা—তেমনি বীর্যশুল্কে কন্যারত্ন গ্রহণ করাও তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এখানে শস্ত্রনিপুণতা প্রদর্শনকেই বীর্য প্রকাশ বলে ধরে নিতে হবে। এ-প্রতিযোগিতায় যোগদান আপনার অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য, সে কর্তব্য পালন না করলে আপনি প্রত্যবায়ভাগী হবেন। বড় জোর যদি মহোপকারী বন্ধুকে সম্মান দিতে চান—আপনি অগ্রবর্তী না হয়ে দুর্যোধনের পরাজয় বরণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন। তারপর আর নিরস্ত হয়ে বসে থাকার কী কারণ থাকতে পারে বলুন!’

কথাটা মনে লাগল কর্ণর। শ্রীকৃষ্ণর এই অযাচিত উপদেশকে উপকার বলেই ধরে নিয়ে কৃতজ্ঞতাও বোধ করলেন। তবে সে-মনোভাব প্রকাশের সময় মিলল না। তখন সভাগৃহ কতকটা শান্ত হয়েছে, ধৃষ্টদ্যুম্ন ইঙ্গিত ক’রে জানাচ্ছেন যে এবার তিনি তাঁর ঘোষণা শুরু করবেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হস্তোত্তোলন-ভঙ্গী দেখেই দ্রুত নিজের আসনে ফিরে এলেন। বলদেব এদিকে কৌতূহলে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ আসন গ্রহণ করা মাত্র প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার! কর্ণর সঙ্গে এত কিসের আত্মীয়তা—হঠাৎ?’

‘না আত্মীয়তা আর কি!’ প্রশান্ত সহজ কণ্ঠে উত্তর দেন বাসুদেব, ‘আপনার আশীর্বাদ আর আশ্বাস-বার্তাই জানিয়ে এলাম মাত্র।’

ভাল বুঝতে পারেন না হলধর। তিনি আবার কখন আশীর্বাদ জানালেন কর্ণকে! তাঁর কি এতই স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছে আজকাল? ‘আমার কি বললে?’ বিহ্বল দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন।

‘ঐ যে আপনি বললেন কর্ণই একমাত্র যোগ্য পাত্র এ পণে এই নারীরত্ন লাভ করার—সেই কথাটাই জানিয়ে উৎসাহিত ক’রে এলাম। ভালই হ’ল, কৰ্ণ এ-প্রতিযোগিতায় আদৌ যোগ দেবেন না বলে স্থির করেছিলেন।’

‘তবে যে তুমি বললে, মেয়েটা ওকে বরণ করবে না?’ আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বলদেব।

‘সে তো আমার অনুমান মাত্র। আমি কি মনে করি তার থেকে আপনি কি বললেন তার মূল্য কি অনেক বেশী নয়? দুর্যোধনের শস্ত্রগুরু হিসেবে অঙ্গাধিপতিও আপনাকে গুরুর মতোই শ্রদ্ধা করেন। আপনার আশ্বাস পেয়ে ওঁর উপকারই হ’ল। প্রবল উৎসাহ ও নবীন শক্তি লাভ করলেন।’

বলদেব খুশী হয়ে উঠলেন। তাঁর এই অনুজটি তাঁকে সামান্যমাত্র স্বীকৃতি দিলে তিনি ব্রহ্মাণ্ড জয়ের আনন্দ উপভোগ করেন।

কোলাহল কিছুটা প্রশমিত হলেও সম্পূর্ণ নীরব হয় নি। তাই ধৃষ্টদ্যুম্নর ঘোষণা প্রথম দিকটায় সম্পূর্ণ শোনা গেল না। তা বুঝে তিনি ক্রমাগত আরও তিনদিকে মুখ ক’রে তার পুনরুক্তি করলেন।

বললেন, ‘আপনারা দয়া ক’রে লক্ষ্য করুন, ঊর্ধ্বে এই সভাভবনের একেবারে সর্বোচ্চ বিন্দুতে একটি লক্ষ্যবস্তু স্থাপিত হয়েছে। তার নিচে চক্রাকার একটি যন্ত্র আছে, আর এই দেখছেন বৃহদাকার এই ধনু এবং পাঁচটি নিশিত শর । যিনি ঐ ঘূর্ণমান চক্রের ছিদ্রপথে এই পাঁচটি শর নিক্ষেপ ক’রে ঐ লক্ষ্য ভেদ করবেন, আমার ভগ্নী—দ্রুপদরাজকন্যা কৃষ্ণা তাঁকেই পতিত্বে বরণ করবেন।’

ঘোষণা শেষ হলে কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর কাছে সমবেত প্রধান প্রধান নৃপতিদের পরিচয় দিয়ে নীরব হলেন।

অতঃপর আবার সভামধ্যে এক বিপুল কোলাহল উঠল। দর্শকরা হিসাব করতে বসলেন কার কতটা সম্ভাবনা। কেউ কেউ এমনও বললেন, রাজা দ্রুপদের এই কন্যা গৃহান্তর করার ইচ্ছা নেই বলেই এমন কঠিন পণ রেখেছেন। কেউ বা সমর্থনও করলেন পাঞ্চালরাজকে, এমন কন্যা যে পেতে চায় তাকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে বৈকি!

রাজন্যদের মধ্যে কোলাহল ও বচসা দেখা দিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তাঁরা প্রমাণ দেবার পূর্বেই পরস্পরের কাছে স্পর্ধা প্রকাশ করতে লাগলেন যে এই পণ জিতবার সম্ভাবনা একমাত্র তাঁদেরই আছে। প্রত্যেকেই নিজের গুণাবলী অর্থাৎ শৌর্য-বীর্যের কিছু সত্য কিছু কাল্পনিক বিবরণ দিয়ে অহঙ্কার করতে লাগলেন।

কিন্তু বেশীক্ষণ এই শূন্যগর্ভ আত্মম্ভরিতা প্রকাশ সম্ভব হ’ল না। অবশেষে একজনকে উঠতেই হয়। তারপর আর একজন, আর একজন। এই রূপসী কন্যাকে দেখে সকলেই কামার্ত লোভাতুর হয়ে উঠেছেন, সেদিক থেকেও কিছু তাড়া আছে। প্রথম দিকে যাঁরা গেলেন তাঁদের মধ্যেই ছিলেন দুর্যোধন। এ ছাড়া শাল্ব, শল্য, ক্রাথ, বক্র, কলিঙ্গরাজ, বঙ্গাধিপতি, বিদেহরাজ, যবনরাজ, বৎসরাজ, সিন্ধুরাজ, কোশলাধিপতি প্রভৃতি। কিন্তু কেউই কোন সুবিধা করতে পারলেন না। লক্ষ্যভেদ তো দূরের কথা, ধনু তুলে ধরারই সাধ্য হ’ল না অনেকের। ধরতে যদি বা পারলেন দু’একজন, ধনুতে জ্যা-রোপণের সামর্থ্য হ’ল না। ধনু বাঁকিয়ে গুণ পরাতে যাবেন কি ধনুর আঘাতে ছিটকে পড়তে লাগলেন। তাঁদের অলঙ্কারকবচকুণ্ডল ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বস্ত্রাদিও ছিন্ন বিভক্ত হয়ে গেল কারও কারও। দেহ ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়তে লাগল।

যাবার আগে প্রায় সকলেই বাহ্বাস্ফোট ও আস্ফালন করেন। নিজেই নিজের পূর্বকীর্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আত্মমহিমা প্রচার করেন, ‘উদ্বাহুরি বামনঃ’ বলে বিদ্রুপ করেন পূর্ববর্তী বিফলকাম প্রতিযোগীদের—তারপরই ধনুর আঘাতে হতগৌরব ও হতশ্রী হয়ে আরক্ত মুখে ফিরে এসে নিঃশব্দে আসন গ্রহণ করেন আবার।

এইভাবে অনেকেই ব্যর্থ হবার পর সুযোগ সমুপস্থিত দেখে অবশেষে একসময় মহাদাতা অঙ্গাধিপতি কর্ণ উঠলেন। দুর্যোধনের আর কোন আশা নেই যখন, তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা কি? তবু যে এতক্ষণ অপেক্ষা করলেন সে শুধু অতিরিক্ত লোলুপতা কি ব্যগ্রতা না প্রকাশ পায় এই জন্যই।

কর্ণ আস্ফালন, আস্ফোট বা বাগাড়ম্বর কিছুই করলেন না, মর্যাদানুযায়ী ধীর মন্থর গতিতে নিঃশব্দে উঠে গিয়ে সেই বিপুল ধনু—যা অধিকাংশ প্রতিযোগী তুলতে গিয়েই বিপরীত দিকে নিপাতিত হয়েছিলেন তা অনায়াসে তুলে নিয়ে অবহেলায় জ্যা রোপণ করলেন।

প্রতিযোগীরা আসন ত্যাগ ক’রে ধনুর দিকে অগ্রসর হলেই সভাঘোষক তাঁর নাম ধাম পরিচয় এবং কিছু কিছু পূর্বকীর্তি ঘোষণা করছিল। এই এদের কাজ, এই জন্যেই নিযুক্ত। কদিন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রাজার পারিষদদের কাছ থেকে এই সব বিবরণ সংগ্রহ করেছে। কর্ণ উঠতেও যথারীতি তাঁর নাম, গুণাবলী প্রভৃতি ঘোষিত হ’ল।

নামটা শোনামাত্রই পাঞ্চালীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল, এখন ওঁকে অনায়াসে ধনুতে গুণ আরোপ করতে দেখে নিরুদ্ধ আবেগে ও আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি, সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল। তখন আর অপেক্ষা কি ইতস্তত করার সময় নেই, তিনি ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন বা পিতা দ্রুপদের অনুমতি না নিয়েই স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি সূতজাতীয়কে বিবাহ করব না, কর্ণ সফলকাম হলে তাঁকে বরমাল্য দেবার পূর্বে আমি বরং আত্মহত্যা করব।’

কথাগুলো কতকটা ঝোঁকের বশেই বলে উঠেছিলেন দ্রৌপদী। আঘাতটা আহত ব্যক্তিকে কতখানি বাজতে পারে— তখন বোঝেন নি। এখন—বলে ফেলার পর—কিছুটা বুঝলেন হয়ত। কিন্তু তখন আর উপায় কি? হাতের পাশা, ধনুর শর এবং মুখের কথা—একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না।

মহামতি কর্ণ হাসলেন। তিক্ত মধুর হাসি। দ্রৌপদীর মনে হ’ল বড় করুণও।

অতঃপর সাবধানে সন্তর্পণে জ্যা পুনর্মুক্ত ক’রে ধনু নামিয়ে যথাস্থানে রেখে কর্ণ শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘কল্যাণী, আপনি সুখী হোন, সুস্থ থাকুন, আমার জন্য আপনাকে মৃত্যু কেন, কোন দুঃখবরণই করতে হবে না। আমি নিবৃত্ত হলাম।’

তারপর ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে মুখ ক’রে স্বীয় আরাধ্য বিভাবসুকে প্রণাম—এবং সম্ভবত সেই সঙ্গে নিজের অন্তরের বেদনা—নিবেদন ক’রে ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে নিজের আসনে এসে বসলেন।

ইতিমধ্যে পরদয়ানির্ভর সামান্য সূতপুত্রের স্পর্ধা ও দুঃসাহস নিয়ে যে বিদ্রুপগুঞ্জন উঠেছিল চারিদিকে, তা তাঁর কানে গেছে কিনা, কর্ণর মুখভাব দেখে কিছু বোঝা গেল না।

শ্রীকৃষ্ণ এতক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে এই নাটক লক্ষ্য করছিলেন, বিশেষ ক’রে কর্ণকেই দেখছিলেন একদৃষ্টে। এবার অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন,’যাক, অর্ধেক কাজ তো হয়েই গেল। কর্ণ চিরশত্রু হয়ে রইল পাঞ্চালদের। এ-দাগ কখনোই মুছবে না ওর মন থেকে।’

ইচ্ছা ও ঈপ্সার অভাব নেই, তবু সঙ্কোচ ও শঙ্কা যেন কাটতে চায় না।

রবাহূত দর্শকদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের জন্য যে-স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল, সেখানে শ্যামবর্ণের একটি যুবা অনেকক্ষণ থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে তার দুই হাতে, বাহুতে এবং স্কন্ধের মাংসপেশীতে একটা আক্ষেপ জেগেছে। অতি সহজ কাজ চোখের সামনে অপরকে পণ্ড করতে দেখলে কর্মঠ লোকের যেমন অসহ্য লাগে—এই তরুণ ব্রাহ্মণটিরও যেন তেমনি অসহ্য বোধ হচ্ছে মনে হ’ল।

এ অস্থিরতা ওর কিসের তা এতক্ষণে অনেকেই বুঝেছে। বেশির ভাগ লোকই বিদ্রূপ করছে ও অযাচিত ভাবে শান্ত হতে উপদেশ দিচ্ছে। যা বড় বড় ক্ষত্রবীররা পারছে না—তা সামান্য ভিক্ষাজীবী ব্রাহ্মণ করতে গেলে—উদ্যোগেই লোকে ধিক্কার দেবে, বাতুল ভাববে বৈকি। ভাবছেও তাই। মুখেও বলছে অনেকে—’এ-কাজ করতে যেয়ো না, সত্যি সত্যিই উন্মাদ ভেবে যদি দৌবারিকরা সভা থেকে বার ক’রে দেয় তো সে বড় অপমান। সমগ্র ব্রাহ্মণসমাজই উপহসিত হবে সে ক্ষেত্রে।’

আবার দু-চারজন উৎসাহিতও করতে লাগলেন।

এত বড় বড় মহারথীরাই তো হেরে গেলেন, বিখ্যাত বিখ্যাত বীর নাকি সব। তাঁদের যদি এ-প্রচেষ্টা বাতুলতা না হয় —দরিদ্র ব্রাহ্মণ বলেই ওকে উন্মাদ ভাববে আর সভা থেকে বার ক’রে দেবে? কেন? ধৃষ্টদ্যুম্ন তো সকলকেই আহ্বান করছেন। ব্রাহ্মণ তো বর্ণশ্রেষ্ঠ। তিনি যাকে খুশি গ্রহণ করতে পারেন। ক্ষত্রিয়ের মেয়ে? তাতে কি? ‘স্ত্রীরত্নং দুস্কুলাদপি।’ তাছাড়া এ মেয়ে অযোনিসম্ভূতা, হোমাগ্নিসম্ভবা, দেবতার বরে এর জন্ম—একে গ্রহণ করায় ব্রাহ্মণদের কোন দোষ নেই। আর চেষ্টা ক’রে দেখতে ক্ষতি কি? ব্রহ্মতেজ বলে একটা কথা আছে তো, পেরে গেলেও যেতে পারে।…

উৎসাহিত করছিল ওর পাশে উপবিষ্ট অসুরাকৃতি অপর এক ব্রাহ্মণ যুবাও। বলছিল, ‘যাও যাও, কোন ভয় নেই। কারও কথা শুনো না, তুমি নিশ্চয়ই পারবে। পৌরুষের এ অপমান বসে বসে দেখা যায় না। এ স্পর্ধা যদি গ্রহণ না করো তাহলে এতকালের শিক্ষা-দীক্ষাতেই ধিক! যাও যাও। যা হবার তা হবে।’

তবুও যুবকটির দ্বিধা যেন যায় না।

ইতিমধ্যে অবশ্য নৃপতিবর্গও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে নেই। যাচ্ছেন অনেকেই—হতাশ হয়ে ফিরেও আসছেন। অমন যে দাম্ভিক চেদিরাজ শিশুপাল তিনিও ধনুতে গুণ পরাতে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। সম্রাট জরাসন্ধরও সেই অবস্থা। তাঁর কেয়ূর ও কণ্ঠহার ছিঁড়ে মণিমুক্তা ছিন্নমাল্যপুষ্পপলাশের মতো ছড়িয়ে পড়ল। অমিতবীর্য বলে খ্যাত মদ্ররাজ দূরে ছিটকে পড়লেন।

অবশেষে আর কোন রাজা বা ক্ষত্রবীর যখন অবশিষ্ট রইলেন না—মান থাকলেও, আর কেউ সাহস ক’রে এগিয়ে যাচ্ছেন না, সভাকেন্দ্র শূন্য, বিশাল ধনু অনাদৃত পড়ে, ব্যাকুল ধৃষ্টদ্যুম্ন বার বার প্রতিযোগীদের আহ্বান করছেন— দ্রৌপদী শুষ্কমুখে নত-নেত্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্তি অনুভব করছেন সেটা সকলেরই আলোচ্য হয়ে উঠেছে—তখন প্রায় মরীয়া হয়েই সেই শ্যামকান্তি ব্রাহ্মণ তরুণটি উঠে দাঁড়াল।

বলা বাহুল্য—সেক্ষেত্রে যা হওয়া স্বাভাবিক তাই হ’ল।

চারিদিকে ধিক্কার ও বিদ্রুপের ঝড় উঠল যেন, গুঞ্জন ক্রমে কোলাহলের আকার ধারণ করল।

বামন হয়ে চাঁদ নয়—সূর্যে হাত বাড়াতে চায়—কে এই অর্বাচীন, এর ধৃষ্টতা আর দুঃসাহস তো কম নয়।

ধিক্কার ও উপহাসের তরঙ্গ উঠল ওর নিজের সমাজ ব্রাহ্মণদের মধ্যেই আরও বেশী যেন। অনেকেই বেশ সরব হয়ে উঠল, বলতে লাগল, ‘বসে পড়ো, বসে পড়ো, আর লোক হাসিও না। পাগল নাকি এ-ছোকরা! বার ক’রে দিক না কেউ এখান থেকে! দ্বার-রক্ষকরা কী করছে সব?’

আবার কেউ কেউ বললে, ‘না হে, বড়ই বিয়োগান্ত হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা, এবার একজন বিদূষকের মঞ্চাবতরণ করাই প্রয়োজন। সে-কাজটা এর দ্বারা হয়ে যাক না, ভালই তো!’

এতক্ষণ কোন স্পষ্ট প্রতিকূলতা না থাকা সত্বেও যে রাজ্যের দ্বিধা, লজ্জা ও জড়তা ওকে বাধা দিচ্ছিল—এই প্রবল সোচ্চার ধিক্কারে তা যেন নিঃশেষে কেটে গেল। কঠিন হয়ে উঠল যুবার মুখ, কঠিন হয়ে উঠল বাহু ও স্কন্ধের পেশী। একবার ভ্রূকুটিবদ্ধ প্রজ্বলন্ত দৃষ্টিতে সমালোচনাকারীদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ধনুর্বেদীর দিকে।

এতক্ষণ মাটিতে খর্জুর-পত্রাসনে বসে ছিল বলে অতটা দেখা যায় নি, এখন বেদীর কাছে গিয়ে উত্তরীয়টি কোমরে বেঁধে অনাবৃত-ঊর্ধ্বদেহে ঋজু হয়ে দাঁড়াতে বিদ্রুপ নিন্দাবাদের কোলাহল সহসা যেন স্তব্ধ হয়ে এল। শ্যামবর্ণ হোক, সুগঠিত দেহ এবং দৃপ্ত পৌরুষে এখন যেন বেশ সুপুরুষ বলে মনে হচ্ছে যুবকটিকে, আর–খুব একটা অনধিকারী বলেও বোধ হচ্ছে না। যে-কাজ করতে এসেছে—তার কিছুটা গুরুত্ব বোঝে বলেও মনে হচ্ছে ওর ভাবভঙ্গী দেখে।

পাঞ্চালরাজনন্দিনী কৃষ্ণাও ক্লান্ত কৌতূহল এবং কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যভরে মুখ তুলে চেয়েছিলেন, কিন্তু অকস্মাৎ তাঁরও ভাবান্তর ঘটল একটা। নিমেষ পুনর্বার পড়ার আগেই নীলপদ্মপলাশের মতো চোখ দুটির দৃষ্টি দীনবেশী শ্যামবর্ণ তরুণ ব্রাহ্মণকে দেখে মুগ্ধ হয়ে এল। পলক পড়লও না কিছুক্ষণ, নির্নিমেষ নেত্র যেন স্থির হয়ে গেল এই প্রতিযোগীর কান্তিতে। তাঁর বুকের মধ্যে আবারও এক আবেগের ও আশঙ্কার তুফান উঠল—তবে সে ভিন্ন কারণে। কর্ণকে দেখে আশঙ্কা হয়েছিল যদি পণে জয়লাভ ক’রে ফেলে, এখন ভয় হতে লাগল যদি এ পণ জিততে না পারে! ব্যাকুল চিত্ত বার বার মস্তিষ্কের দুয়ারে মাথা কুটতে লাগল—কোন রকমে কোন অছিলায় এখন শর্তটাকে সহজসাধ্য ক’রে দেওয়ার উপায় উদ্ভাবনে।…

আরও একজনের দৃষ্টি উজ্জ্বল ও মুগ্ধ হয়ে উঠেছিল এই দুঃসাহসী চন্দ্ৰলোভী-বামনবৎ ব্রাহ্মণকে দেখে।

সে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণর।

তিনিও উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ওকে দেখা মাত্র—পিছন দিক থেকে অসহিষ্ণু অনুযোগ উঠতে বসে পড়তে বাধ্য হলেন। কিন্তু তাঁর আনন্দ-অস্থিরতা চাপা রইল না। ভাগ্যে সকলের দৃষ্টি তখন ঐ ব্রাহ্মণ যুবকটির ওপরই নিবদ্ধ ছিল, নইলে তাঁকে বাতুল ভাবত পার্শ্ববর্তীরা।

যুবকটি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে ধনুর্বেদী পর্যন্ত এগিয়ে গেলেও অকারণ ব্যস্ততা বা অশোভন আগ্রহ দেখালেন না। মনে হ’ল কৃতিত্ব দেখিয়ে বাহবা পাওয়ার জন্য তেমন ব্যগ্র নন। বরং ধনুর সামনে এসে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন স্বেচ্ছা-আরোপিত এই দূরূহ কাজের গুরুত্বটা বুঝে নিলেন মনে মনে। তার পর সেই বেদী প্রদক্ষিণ ক’রে দেবাদিদেব মহাদেবকে স্মরণ করলেন, যুক্তকরে ললাট স্পর্শ ক’রে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে অবলীলাক্রমে ধনুটি তুলে নিলেন। তার পর তাতে জ্যা রোপণ ও শরনিক্ষেপ কাজটা এত দ্রুত ঘটল যে লোকে ভাল ক’রে দেখতেও পেল না। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সকলে দেখল প্রায় একসঙ্গেই পাঁচটি শর বিদ্ধ হবার ফলে লক্ষ্যবস্তুটি খণ্ড-বিখণ্ডিত হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ যেন কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল।

তার পর যে তুমুল কাণ্ডটা হ’ল এর জন্য বোধ হয় যুবকটিও প্রস্তুত ছিল না। সভামধ্যে বিপুল কোলাহল উঠল, তার মধ্যে হর্ষধ্বনিই বেশী। ব্রাহ্মণদের তো কথাই নেই, উঠে দাঁড়িয়ে কমণ্ডলু উত্তরীয় অজিনাসন—যার যা সম্বল সেইগুলিই আন্দোলিত ক’রে হর্ষোচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলেন। উপর থেকে বিজয়ী বীরের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল, বাদ্যকররা তূর্য দামামা প্রভৃতি বাজাতে শুরু করলেন। সুতমাগধগণ স্তুতিপাঠ করতে লাগল। কেবল রাজন্যবর্গ ও তাঁদের পারিষদ অনুচররা প্রথমটায় হতচকিত বিহ্বল হয়ে গেলেন—পরে ঘটনাটা সম্পূর্ণ উপলব্ধি ক’রে লজ্জায় অপমানে মাথা নত করলেন।

এর মধ্যে কেউ হয়ত তেমন লক্ষ্য করলেন না, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ তাকিয়ে দেখলেন—প্রবল আবেগে পাঞ্চালতনয়া কৃষ্ণার যেন সুরাপায়ীর মতো ঈষৎ একটু মত্ততা এসেছে, তাঁর পা টলছে, সমস্ত শরীরই আন্দোলিত হচ্ছে প্রথম- উত্তরের- বাতাস-লাগা ধান্যশীর্ষের মতো। কৃষ্ণা একদৃষ্টে বিজয়ী বীরের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁর সেই আয়ত নীল দুটি চোখে দৃষ্টির সমুদ্র যেন উত্তাল হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই তাতে সপ্রেম আকর্ষণের তরঙ্গ মুখে কিছু বলতে পারছেন না কিন্তু বাসুদেবের মনে হ’ল, যা বলবার তা ঐ নীলোৎপল-পলাশ চক্ষু দুটি বলে নিচ্ছে, অনেক কথাই বলা হয়ে যাচ্ছে সেই সলজ্জ নীরবতায়। সে বলার প্রণয়গদগদ কণ্ঠ, বিজয়ী বীরের প্রতি নারীর স্বতোৎসারিত সেই স্তুতিগান যেন এখান থেকেই শুনতে পেলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ।…

ভগ্নীর সেই আবেশবিহ্বল অবস্থার মধ্যেই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর হাত দুটি ধরে বিজয়ী বীরের কণ্ঠের দিকে এগিয়ে দিলেন, সে-যুবাও সমবেত প্রবলতর হর্ষধ্বনির মধ্যে মাথা ঈষৎ নত ক’রে বরাঙ্গনার বরমাল্য গ্রহণ করলেন।

নৃপতিদের প্রাথমিক বিহ্বলতা ও লজ্জা কেটে যেতে বিলম্ব হ’ল না। অতঃপর যা অনুভব করলেন তাঁরা—তা হ’ল ক্রোধ। সীমাহীন প্ৰচণ্ড উম্মা।

দ্রুপদ তাঁদের ডেকে এনে যে বাহ্যিক পরিচর্যা ও আপ্যায়নের চূড়ান্ত করেছেন—তার পিছনে নিশ্চয় এই অভিসন্ধিই ছিল, তাঁদের অপমান করা। যুদ্ধ ক’রে পেরে উঠবেন না তাঁদের সঙ্গে, সেটা বিলক্ষণ জানেন—তাই এই কৌশল করেছেন।

ক্রোধ রিপুটাই এমন, যত তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় ক্রমশ ইন্ধন-পাওয়া অগ্নির মতোই বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে ইন্ধনও পর্যাপ্ত—আহত আত্মাভিমান।

প্রথম যা বিক্ষোভপ্রধান ছিল দেখতে দেখতে তা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। ‘মার ঐ কুচক্রী রাজাটাকে, সবংশে ধ্বংস কর।’ সকলে সরবে বলতে লাগলেন। ব্রাহ্মণকে বধ করা সম্ভব নয় নইলে ঐ ধৃষ্টটাকেও সমুচিত প্ৰতিফল দিতেন তাঁরা—এখন আসল নাট্যের যে গুরু, সেই দ্রুপদকে বধ ক’রেই ওঁরা নিজেদের অপমানের শোধ তুলবেন।

মানুষ যা করতে ইচ্ছা করে—তার স্বপক্ষে যুক্তিরও অভাব হয় না। দুর্যোধন প্রভৃতি রাজারা বলতে লাগলেন, ‘ক্ষত্রিয় রাজকন্যার স্বয়ম্বরে ক্ষত্রিয় এবং নৃপতিদেরই অধিকার। ব্রাহ্মণ তো এর মধ্যে গণ্য হ’তেই পারে না। এ যদি আমরা নীরবে সহ্য করি তো আমাদের ক্ষাত্রশক্তিতেই ধিক। ঐ কন্যা যদি এখনও আমাদের কাউকে বরণ করে তো আমরা ছেড়ে দিতে রাজী আছি দ্রুপদকে, নইলে আগে ঐ মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারব তারপর পাঞ্চাল রাজবংশের সকলকে শেষ করব।’

এই বলে—তাঁরা একপ্রকার বিনয়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলেন। উপস্থিত নৃপতিদের মধ্যে অপর কেউ কেউ যে বক্তার থেকে বেশী যোগ্যপাত্র–উচ্চকণ্ঠে সে কথা ঘোষণা করতে লাগলেন। দুর্যোধন শাল্বকে বা ভগদত্তকে উঁচু করেন –বলেন, ‘উনি এ- কন্যা লাভ করলে আমার কিছুই বলার ছিল না’, আবার শাল্ব বা শিশুপাল বা ভগদত্ত বলেন, ‘না না, কুরুরাজ দুর্যোধন সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ পাত্র, তাঁকেই বরমাল্য দেওয়া উচিত ছিল পাত্রীর। বেশী কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে দ্রুপদ নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলেন।’

দ্রুপদের একপ্রকার বিহ্বল অবস্থা তখন। কী করা উচিত—কী করলে সকল দিক রক্ষা পায় সে কথা চিন্তা করার মতো চিত্তস্থৈর্য নেই তাঁর। থাকা স্বাভাবিকও নয়। তিনি এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না আদৌ। স্বয়ম্বর সভার উৎসব- লক্ষণযুক্ত কার্যক্রম যে এমন ভৈরবমূর্তি ধারণ করবে তা কে জানত! আর পণে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হলে লজ্জিত হয় মানুষ। অকর্মণ্যতার সে লজ্জা ঢাকতে এমন প্রচণ্ড হয়ে ওঠে, উঠতে পারে, তা তাঁর জানা ছিল না। সকল অভিজ্ঞতার অতীত। আর ব্রাহ্মণ যে লক্ষ্যভেদ করবে—এত ক্ষত্রবীর উপস্থিত থাকতে, তাই বা তিনি কেমন ক’রে জানবেন। এখন সকল রাজারা একত্র হয়ে (কলহের সময় এঁরা বেশ মিলিত হ’তে পারেন) তাঁর প্রতিই আক্রমণোদ্যত দেখে অনন্যোপায়ের মতো বিপন্নমুখে ব্রাহ্মণদের দিকেই চাইলেন।

যুদ্ধ-অনভিজ্ঞ ও সাধারণত জ্ঞানব্রতী ব্রাহ্মণরাও কিছু না বুঝেই আশ্বাস দিলেন, ‘ভয় নেই, আমরা এই দণ্ডকমণ্ডলু নিয়েই যুদ্ধ করব মদগর্বিত ঐ অসভ্য বর্বরগুলোর সঙ্গে।’

তাঁরা নিজেদের সদভিপ্রায় প্রমাণের জন্য আগেকার হর্ষোৎসবের মতোই—যার যা ছিল—মৃগচর্ম ও কমণ্ডলু নাড়তে লাগলেন।

শস্ত্রজীবী ক্ষত্রিয়রা শাস্ত্রজীবী নিরীহ ব্রাহ্মণদের এ-স্পর্ধা—তাঁদের মতে ধৃষ্টতা—নীরবে সহ্য করবেন তা সম্ভব নয়। তাঁরা ‘মার মার’ শব্দ ক’রে তেড়ে এলেন—একদল দ্রুপদের দিকে আর একদল ব্রাহ্মণদের দিকে। অসুবিধার মধ্যে যিনি এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিমান সেই সম্রাট জরাসন্ধ সর্বসমক্ষে পরাজিত হওয়ার লজ্জায় সঙ্গে সঙ্গেই সভা ত্যাগ ক’রে তৎক্ষণাৎ মগধাভিমুখে রওনা দিয়েছেন … তা হোক, যাঁরা আছেন—এই ক্ষুদ্র পাঞ্চাল দেশের পক্ষে তাঁরাই যথেষ্ট। দুর্যোধন, কর্ণ, শল্য, শাল্ব, রুক্মাঙ্গদ, শিশুপাল—এঁরা সকলেই প্রখ্যাত যোদ্ধা, এঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরাও যাকে বলে রণদুর্মদ।

ব্রাহ্মণরা কিছুই পারতেন না—এইসব যোদ্ধা ধনুর্ধরদের সামনে মুহূর্তমাত্র দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে—কিন্তু সেই যে বলিষ্ঠ যুবকটি এই বিজয়ী তরুণের পাশে বসে ছিল এবং ইতিপূর্বে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছে তাকে প্রতিযোগিতায় যোগদানের জন্যে, সে এবার উত্তরীয়খানা কোমরবন্ধ হিসাবে বেঁধে উঠে দাঁড়াল। তারও হাতে অস্ত্র নেই, কিন্তু তাতে বিশেষ বাধা হ’ল না। এদিকে ওদিক চেয়ে দেখে—সামনেই একটি শালগাছ ছিল—সবলে সেটি উৎপাটিত ক’রে—শুধু হাতে ক’রেই—যেন পলককাল মধ্যে তাদের শাখাপ্রশাখা মুক্ত ক’রে দণ্ডের মতো বাগিয়ে ধরল।

ক্ষত্রিয় রাজারা ততক্ষণে নিজেদের আসন ছেড়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু দেখা গেল তাঁদের পক্ষে সকলেই যে এই অসূয়া ও আশাভঙ্গজনিত আক্রমণ সমর্থন করেন তা নয়।

বলদেব বললেন, ‘কী আশ্চর্য! ছেলেটি নিজের শক্তিতে পণ জিতেছে। দ্রুপদের শর্তই ছিল যে, যে জিতবে তাকেই মালা দেবেন তাঁর কন্যা—এ তো জেনেশুনেই এসেছে সকলে। একজন জিতবে বাকী সকলে বিফল হবে এও তো জানাই—কর্ণকে যে প্রত্যাখ্যান করেছে সেটা বরং কন্যারই অন্যায়, প্রতিবাদ করতে হলে তখনই করা উচিত ছিল— এখন এ-বেচারার ওপর এমন খড়্গহস্ত হয়ে ওঠার কারণ কি? চলো, আমরা ঐ ব্রাহ্মণ বালক-দুটিকে রক্ষা করি গে—’

তিনি বলতে বলতে এগিয়েই যাচ্ছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হাত ধরে নিরস্ত করলেন। বলদেব এবার ক্রদ্ধ হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘তবে এ অত্যাচার অবিচার নীরবে দাঁড়িয়ে দেখবে, কিছুই করবে না?’

‘আমাদের কিছুই করতে হবে না আর্য—’, বাসুদেব সবিনয়ে অথচ প্রচ্ছন্ন কৌতুকভরা কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘যা করবার তা ঐ যুবক দুটিই করবে।’

‘ওরা তো বালক মাত্র, যতই গায়ে জোর থাক—এতগুলি বীর যোদ্ধার সঙ্গে পেরে উঠবে কেন?’ বলদেব ভ্রূকুটি ক’রে প্রশ্ন করেন, ভাইয়ের কথার যথার্থ অর্থটা বোঝবার চেষ্টা করেন।

‘ওরা বালক, কিন্তু সাধারণ বালক তো নয়। আপনি কি ওদের চিনতে পারেন নি?’

‘চিনতে—? কৈ না তো! কে ওরা? তুমি চেনো নাকি?’ বলদেব বিহ্বলভাবে প্রশ্ন করেন।

‘সত্যিই চিনতে পারেন নি? আশ্চর্য!’ বাসুদেব যেন এতটা অজ্ঞতা জ্যেষ্ঠের কাছে আশা করেন নি এমনি ভাবেই উত্তর দিলেন, ‘যে লক্ষ্য ভেদ করল সে তৃতীয় পাণ্ডব, অর্জুন। আর ঐ মল্লযোদ্ধার মতো একটি গাছ হাতে প্রস্তুত হয়ে —সে-ই ভীম। আপনার—আমাদের পিতৃসা-পুত্ৰ।’

‘সে কি! তারা তো মৃত! বারণাবতে পুড়ে মরেছে।’ বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করেন বলদেব।

‘বারণাবতের জতুগৃহে ওদের মৃত্যু ঘটেছে, এ কি আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন নাকি? অত সহজে ওদের বধ করা যাবে না। ঐ রকম সামান্য ইতর জীবের মতো অপঘাতে মৃত্যুর জন্য ওরা জন্মগ্রহণ করেনি।’…

‘এ তুমি জানতে?’ বলদেব প্রশ্ন করেন।

‘জানতুম বৈকি—ঐ চেয়ে দেখুন মহাধনুর্ধর কর্ণের দুরবস্থাটা।’

চুম্বক যেমন ক’রে লোহাকে আকর্ষণ করে, তেমনিই বোধ হয় অর্জুনও কর্ণকে আকর্ষণ করেছিলেন। অথবা ভেবেছিলেন সমরানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই ধনুবীর ছাড়া তাঁর আক্রমণের যোগ্য আর কেউ নেই।… অবশ্য তাকেও যথেষ্ট বলে মনে করেন নি প্রথমটায়, একটু যেন অবহেলার সঙ্গেই ধনুতে শর-যোজনা করতে গিছলেন সুতরাং বিস্ময়টাই তাঁকে অধিকতর বিমূঢ় ক’রে দিল।

অর্জুনের সঙ্গে ধনুক ছিল না—ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের বেশে এসেছেন—কিন্তু লক্ষ্যভেদের ধনুক তো পড়েই আছে, তিনি চোখের নিমেষে ধৃষ্টদ্যুম্নর তূণ থেকে কিছু শর সংগ্রহ ক’রে—কর্ণ ভাল ক’রে ধনুকটা বাগিয়ে ধরার আগেই তাঁর সেটাকে কেটে দু’খানা ক’রে দিলেন। কর্ণ আবারও তাঁর অনুচরের কাছ থেকে একটি ধনু দিয়ে শরযোজনা করতে যাবেন, আবার সেই অবস্থা। কর্ণর এবার কিছু চৈতন্যোদয় হ’ল। তিনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্রাহ্মণ, তুমি কে, সত্য ক’রে বল দেখি? আমার গুরু পরশুরাম এবং অর্জুন ছাড়া এমন আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা তো আর কারও দেখি নি! এমন আশ্চর্য লক্ষ্যজ্ঞানও না।’

অর্জুন হেসে বললেন, ‘আমি সামান্য লোক, এক ব্রাহ্মণের কাছেই আমার অস্ত্র-শিক্ষা। কিন্তু আপনি এতে বিস্মিত হবেন কেন, আপনার শস্ত্রপ্রয়োগের খ্যাতি তো ভারতবিখ্যাত। আপনি অন্য ধনু নিন, আমি কথা দিচ্ছি এবার আপনার ধনু অক্ষত থাকবে।’

‘না, থাক।’ কর্ণ ঘাড় নাড়লেন, ‘তোমার এ-ঔদার্য তোমার শিক্ষারই উপযুক্ত। কিন্তু বোধ হয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে স্পর্ধা প্রকাশ করতে যাওয়াই ভুল হয়েছে।’

এই বলে নিরাসক্ত দর্শকের মতো তিনি একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন।

এদিকে ভীমও প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে তুলেছেন। দুর্যোধন তো আগেই কাবু হয়েছেন। তাঁর দুর্দশা দেখে শল্য এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি প্রসিদ্ধ মল্লযোদ্ধা, অসুরের বল তাঁর দেহে—কিন্তু তাতেও সুবিধা হ’ল না—পর পর কয়েকবারই ভীম তাঁকে তুলে আছাড় মারলেন।

এবার—যেসব নৃপতির দল মহোৎসাহে ‘মার মার’ শব্দে তেড়ে এসেছিলেন, তাঁরা একটু থমকে দাঁড়ালেন।

তাঁদের যেন একটু একটু ক’রে সুবুদ্ধির উদয় হচ্ছে এবার। এই দুই ব্রাহ্মণ তরুণ যে সাধারণ ভিক্ষুক নন—তা বেশ বুঝেছেন ততক্ষণে। এখন কি ক’রে মানে মানে মিটিয়ে ফেলা যায় সেই চিন্তা, বিশেষ, অন্য সব ব্রাহ্মণরা তাঁদের দুর্দশা দেখে যে বিদ্রুপ শুরু করেছেন তার কোন উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না, সেইটাই আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে।

শ্রীকৃষ্ণ যেন এই মুহূর্তটিরই প্রতীক্ষা করছিলেন। শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন কিন্তু তাঁর আয়ত চোখ দুটি এই সাময়িক রণক্ষেত্রের সব ঘটনাই স্থিরভাবে লক্ষ্য করছিল। যেন বলদর্পী নৃপতিদের স্পর্ধা প্রকাশের এ-পরিণাম তাঁর জানা ছিল, তাঁদের অধিকতর লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করবারই উপযুক্ত সময়টিরই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সে সময় সমুপস্থিত দেখে এবার তিনি ঐ ক্ষুদ্র রণাঙ্গনটির দিকেই এগিয়ে গেলেন।

এত অকস্মাৎ প্রস্তরবৎ স্থির মানুষটি সচল হয়ে উঠলেন যে সেটা লক্ষ্য করতেই কিছু সময় লাগল বলদেবের। সুতরাং কী উদ্দেশ্যে তিনি ঐ গোলমালের মধ্যে যাচ্ছেন তাও জানা গেল না। তবু, যদি ঐ যুদ্ধে যোগদানের জন্যেই গিয়ে থাকেন তবে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ওঁরও যাওয়া উচিত বিবেচনা ক’রে দৃঢ় বজ্রমুষ্টিতে তাঁর গদাটি বাগিয়ে ধরলেন কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলেন তার কোন প্রয়োজন নেই।

মদমত্ত করী বা উন্নতগ্রীব সিংহকে আগমনোদ্যত দেখলে মানুষ যেমন সভয়ে তাকে পথ ছেড়ে দু’পাশে সরে যায়—বলদেব দেখলেন প্রসন্নগম্ভীর মুখে বাসুদেবকে নিরস্ত্র নির্ভয়ে অগ্রসর হতে দেখে আহবী ও দর্শক উভয় দলই সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিচ্ছে।

শ্রীকৃষ্ণ সেই বিবদমান জনতার ঠিক মধ্যস্থলে এসে দুই হাত তুলে সকলকে নীরব নিরস্ত হ’তে ইঙ্গিত করলেন, তারপর প্রধানত রাজন্যবর্গকেই সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘হে ক্ষত্রিয় নৃপতিগণ, আপনারা দয়া ক’রে অস্ত্র সম্বরণ করুন। ব্রাহ্মণ অবধ্য, নিরস্ত্র ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আপনাদের মতো শস্ত্রকৌশলী মহাবীরদের শোভা পায় না। ক্ষত্রিয়দের ধর্ম যেমন সমযোদ্ধার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করা, তেমনি আর একটি ধর্ম তথা প্রধান কর্তব্য হ’ল ব্রাহ্মণদের সর্বদা রক্ষা করা, তাদের তপস্যা ও জ্ঞানচর্চার বিঘ্ন-উৎপাদনকারীদের উৎপাত থেকে নিরাপদ রাখা। এঁরা আপনাদের উষ্মার যোগ্য নন। আর দেখুন—দ্রুপদের স্বয়ম্বর-শর্ত জেনেই আপনারা এই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এই যুবা সম্যকভাবে সেই শর্ত পালন করেই পণে জয়লাভ করেছেন। কন্যাও যথাবিহিত এর গলায় মাল্য অর্পণ করেছেন। সে অন্যপূর্বা কন্যা নিয়েই বা আপনারা কি করবেন! আপনারা এখন যে ক্রোধ ও বিরক্তি প্রকাশ করছেন তা একেবারেই বালকোচিত হয়ে পড়ছে। আপনারা শান্ত হোন। এ-যুবার পরিচয়ও তো আপনারা জানেন না। অজ্ঞাতকুলশীল কারও সঙ্গে যুদ্ধ করা কোন অভিষিক্ত নৃপতির যোগ্য নয়। ঐ দেখুন মহাধনুর্ধর কর্ণ—উনি শুধু মহাযোদ্ধাই নন, মহাবুদ্ধিমানও বটে—উনিও তো প্রথমটা আপনাদের নির্বন্ধে ও সাময়িক উত্তেজনায় আপনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ-আচরণের মূঢ়তা বুঝে প্রতিনিবৃত্ত হয়েছেন। আপনারাও মহামতি কর্ণর পন্থা অনুসরণ করুন—তাতে শ্রেয় লাভই হবে।’

নৃপতিরাও পশ্চাদপসরণের এই রকম একটা যথাসম্ভব সসম্ভ্রম পথই খুঁজছিলেন। এই দুই ব্রাহ্মণ যুবার যে-বাহুবল ও শস্ত্রবলের নমুনা পেয়েছেন তার চেয়ে বেশী পাবার আকাঙ্ক্ষা আর নেই। বোধ করি গ্রহ বিরূপ–আজ তাঁদের অপমানিত হবারই দিন–কে জানে এখনও মানে মানে প্রতিনিবৃত্ত না হলে আরও কি অধিকতর দুর্ভোগ অদৃষ্টে আছে।

তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের এই আবেদনে বেঁচে গেলেন, মহাবিজ্ঞের মতো পরস্পরকে সম্বোধন ক’রে বলতে লাগলেন, ‘ওহে, যদুকুলশ্রেষ্ঠ বাসুদেব সঙ্গত কথাই বলেছেন। অকারণে উত্তেজিত না হয়ে ওঁর পরামর্শে কর্ণপাত করাই উচিত। সত্যিই তো, এ দুটি অর্বাচীনের তো পরিচয়ও আমরা জানি না—এদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমাদের একেবারেই অনুচিত কাজ হবে। পরিচয় পাই, তার পর উপযুক্ত সময়মতো এ- ধৃষ্টতার প্রতিফল দিলেই হবে।’

ক্রোধের ও ক্ষোভের সমুদ্রে যে আক্ষেপ ও আবর্তের সৃষ্টি হয়েছিল, যে তরঙ্গ দেখা দিয়েছিল—একটু একটু ক’রে তা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এল ঈর্ষা ও লালসার বহ্নি বাস্তব যুক্তির বালুকানিক্ষেপে নির্বাপিত না হোক, আপাতত নির্ঘুম বোধ হতে লাগল। রাজারা একে একে সক্ষোভ নিঃশ্বাস ফেলে নিজেদের বলদর্পের প্রতিফল পরিপাক করার চেষ্টা করতে করতে যে যার স্কন্ধাবার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন রাজা দ্রুপদও। একে তো কন্যা কোন ভিখারী ব্রাহ্মণের গলায় মালা দিল, তার কি ভবিষ্যৎ —সেই দুশ্চিন্তায় অস্থিরতার শেষ ছিল না—তার ওপর এই মহাহবের সূচনা দেখে তিনি আশঙ্কায় কাষ্ঠবৎ হয়ে নিঃশ্বাস রোধ ক’রে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ। একবার কৌরবদের হাতে যে লাঞ্ছনা ঘটেছিল সে স্মৃতি মন থেকে আজও বিদূরিত হয় নি। বাসুদেব ধন্য, তিনি আজ মহাবিপদ থেকে পাঞ্চালরাজ্যকে রক্ষা করলেন।

এদিকে নিশ্চিন্ত হতে দ্রুপদ আবার তাঁর পূর্ব উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তায় ফিরে গেলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, ‘তুমি যথাসম্ভব অলক্ষ্যে ঐ ব্রাহ্মণদের অনুসরণ করো। অন্যান্য চরদেরও সেই নির্দেশ দাও। কৃষ্ণাকে ওরা কোথায় নিয়ে গিয়ে তোলে—ওদের অবস্থা কি রকম—না জানা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।’

এই প্রচণ্ড কোলাহল—বহুলোকের উত্তেজিত কথোপকথন, বহুমুখী জনস্রোতের সংঘাত—এর মধ্যেই বাসুদেব এগিয়ে এসে অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে মৃদুকণ্ঠে সম্বোধন করলেন, ‘পার্থ!’

তারপর অর্জুন যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকাতে তেমনি নিম্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার মাতুলপুত্র যদুবংশোদ্ভব বাসুদেব। আমি তোমাকে অনেকক্ষণই চিনেছি। তোমাকে দেখব বলে তোমার জন্যই স্বয়ম্বরে আসা আমার। তুমি বধূকে নিয়ে এগিয়ে যাও। আর্যা কুন্তীকে প্রণাম করতে আমি পরে যাচ্ছি।’

যুধিষ্ঠির ঠিক এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

ক্ষুধা-তৃষ্ণা, এতক্ষণের উত্তেজনা-জনিত শ্রান্তি আর তাঁকে অবসন্ন ক’রে রাখতে পারল না এই নূতন সমস্যাটা তাঁর মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও বিষম বিচলিত ক’রে তুলল।

ধর্মরক্ষার চিন্তা চিরদিনই তাঁর কাছে অগ্রগণ্য, ধর্ম তাঁর ঐহিক সকল ভোগ সকল অনুভূতির চেয়ে প্রিয়। আজও জীবনের প্রত্যক্ষ ও বাস্তব প্রয়োজনগুলির থেকে সেই চিন্তাই তাঁর কাছে প্রবল ও প্রধান হয়ে উঠল I

যিনি ধর্মকেই একান্তভাবে ধারণ ক’রে থাকেন—তাঁকে সদাসতর্ক থাকতে হয়, বহু বিবেচনা ক’রে জীবনের পথে চলতে হয়। হঠকারিতার পরিণাম প্রায়ই শুভ হয় না, অন্যায়ের দিকেই তার সহজগতি। যুধিষ্ঠির চিরদিনই—বাক্যে কার্যে চিন্তায় বিবেচনায়—সংযত, ধীর। সহসা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। এজন্য বলশালী ক্রোধী মধ্যম পাণ্ডব মধ্যে-মধ্যেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।—অগ্রজ সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশের আশঙ্কা সত্বেও সব সময়ে রসনা সম্বরণ করতে পারেন না।

আজও যুধিষ্ঠির মায়ের কথা শুনে কুটিরের দ্বারপ্রান্তেই স্তব্ধ প্রস্তরবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। মাতা কুন্তী যা বললেন –বার বার সেই কথাগুলিই মনে মনে আবৃত্তি ক’রে যেন এই সমস্যার কুটিল গহনবর্থ থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার ছিদ্রপথ খুঁজতে লাগলেন।

কুন্তীও বিভ্রান্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা তাঁর কাছেও অভূতপূর্ব, তাই এ থেকে মুক্তির উপায়ও চিন্তা করতে পারছেন না।

পুত্রেরা স্বয়ম্বর সভায় গেছে তিনি জানতেন। তাই বলে সহায়সম্বলহীন অজিনাসনসম্বল চীরবল্কলধারী ভিক্ষুক- ব্রাহ্মণবেশী রাজপুত্ররা যে সেই স্বয়ম্বরের পণরক্ষা ক’রে দেবাংশজাতা জন্ম-কিশোরী অপরূপা কন্যাকে জয় ক’রে নিয়ে আসবে তা একবারও আশা করেন নি। আর তা করেন নি বলেই ভীমের সানন্দ-গম্ভীর বাক্যগুলির কোন বিশেষার্থ তাঁর কানে ধরা পড়ে নি। ‘মা আমরা আজ কী ভিক্ষা এনেছি দেখুন’—এ কথাগুলিকে সহজ সরল ভাবেই গ্রহণ করেছেন।

ভিক্ষায় কিছু অভিনবত্ব আছে—তা ঐ একাক্ষর ‘কী’ শব্দে ও কণ্ঠের আনন্দ উচ্ছলতায় উপলব্ধি করলেও সে সম্বন্ধে অনুমান সুখাদ্য, সুমিষ্ট ফল বা মূল্যবান বস্ত্রাদির পথ ধরেই চিন্তাকোষে প্রবেশ করেছিল। তাই বিনাদ্বিধায় কিছুমাত্র অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না ক’রেই বলেছেন—’যা এনেছ তা সবাই মিলে ভোগ করো।’

বলতে বলতেই কুটিরের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসেছেন পাণ্ডুমহিষী, দৃষ্টি পড়েছে শ্যামাঙ্গী অথচ অবর্ণনীয়া সুন্দরী কন্যার দিকে তার সর্বাঙ্গে মণিমাণিক্যের আভরণ, কণ্ঠের গুঞ্জমালা ও রক্তবর্ণ চেলাংশুকে রাজকন্যা বলে চিনতেও ভুল হয় নি। সঙ্গে সঙ্গেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন, ললাটে করাঘাত করেছেন তিনি। নিজের নির্বুদ্ধিতা বা অবিমৃষ্যকারিতার পরিণাম থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন অস্থির ব্যাকুল হয়ে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে দেখেছেন, চোখ পড়েছে ধীর স্থির প্রশান্তললাট জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের দিকে, দ্রৌপদীর হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে এসে সকাতরে বলেছেন, ‘বৎস, আমি না জেনে- বুঝে অন্যায় ক’রে ফেলেছি—এখন তুমি এর একটা প্রতিকার করো, আমার বা বধূর কোন পাপ না হয়। যাতে আমি অনুচিত বা মিথ্যা কথনের দায় থেকে এবং ইনি বহুচারিণীত্বের দোষ থেকে অব্যাহতি পান, সেইরকম একটা উপায় নির্দেশ করো।’

জননী কুন্তী যুধিষ্ঠিরের ওপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কার ওপর সেটা চাপাবেন? আশৈশব ধর্মাশ্রয়ী, ধর্মভীরু তিনি—সেজন্য অনেকে তাঁকে ধর্মরাজ, ধর্মপুত্র বলে। কেমন ক’রে ধর্মনির্দিষ্ট পথে এই উভয় সংকট উত্তীর্ণ হবেন, জটিল সমস্যার সমাধান করবেন—এই চিন্তায় তাঁর মতো স্থিতধী লোকও কিছুকালের জন্য যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন।

অথচ বেশী বিলম্ব করারও অবসর নেই। তাই সম্পূর্ণ মনোমত সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পারলেও—আপাতত যেটাকে উচিত বলে মনে হ’ল তাই করলেন—অর্জুনের দিকে ফিরে বললেন, ‘ফাল্গুনী, তুমি স্বয়ম্বরের পণ জিতে এই কন্যাকে লাভ করেছ, ধর্মত এ বধূ তোমারই। তুমি শাস্ত্রানুসারে একে বিবাহ করো।

অর্জুন লজ্জায় ঈষৎ মাথা নত ক’রে বললেন, ‘তা কেমন ক’রে হয়! আপনি ও মহাবাহু বৃকোদর আমার জ্যেষ্ঠ, আপনাদের বিবাহ না হলে আমি কেমন ক’রে বিবাহ করব! আমি যদি আপনাদের আগে বিবাহ করি বা নকুল সহদেব আমাদের তিনজনের পূর্বে বিবাহ করে—তাহলে ধর্মে পতিত হতে হবে না কি? আপনি দয়া ক’রে এ-নির্দেশ প্রত্যাহার করুন।’

ভীম—অনুজের কথা ভাল ক’রে শেষ হবার আগেই প্রায়—বলে উঠলেন, ‘আর তাহলে মা’র আদেশ? তাঁর বাক্য রক্ষার কি হবে?’

যুধিষ্ঠির একটু বিস্মিত হলেন।

কথাগুলো তাঁর কানে কেমন যেন অস্বাভাবিক বোধ হ’ল। সুষম জীবনবোধে কোথায় একটা ছন্দপতন ঘটছে। শব্দগুলো যেন একটা প্রবল আঘাত করল তাঁর শ্রুতিতে। আঘাত করল তাঁর মনকেও। অনভ্যস্ত, বেসুর বলে মনে হ’ল। মনে হ’ল এই ব্যগ্রতার মধ্যে প্রাকৃতজনের মতো কোথায় একটা স্থ±ল লোভ প্রকাশ পাচ্ছে।

তিনি বিস্মিত হয়ে মুখ তুলে তাকালেন। তিনি যে মুখ তুলে তাকিয়েছেন ভীম সে- সম্বন্ধে অবহিত নন। ইতরজনের মতো সকলপ্রকার ভব্যতা ভুলে মুগ্ধ অপলক নেত্রে দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে আছেন।

শুধু তাই নয়—এবার আরও একটি আঘাত লাগল তাঁর চোখে—অথবা বলা যায় একটি নবীন জ্ঞান লাভ হ’ল।

কারণ এবার অন্য ভ্রাতাদের দিকেও চেয়ে দেখলেন, এঁদের শিক্ষা ও মার্জিত আচরণ সম্বন্ধে অগাধ আস্থা তাঁর—কিন্তু দেখলেন, ওঁদেরও সেই অবস্থা। শুধু অর্জুন বাদে। অর্জুন সেই থেকে লজ্জাবনত অধোবদনে মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আরও দেখলেন যুধিষ্ঠির।

দেখলেন, দ্রৌপদীও ইতিমধ্যে আপাতনত মুখের বক্রকটাক্ষে ক্রমান্বয়ে তাঁদের পাঁচ ভাইয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন। তাঁর আলোল দৃষ্টিতে স্পষ্ট মুগ্ধতা। মুখে এক ধরনের ঈপ্সাতুর হাসি।

আর, এইবার আরও যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা বাকী ছিল, সেটাও লাভ করলেন যুধিষ্ঠির।

অনুভব করলেন, তিনি নিজেও এই পদ্মপলাশাক্ষী ঘনকৃষ্ণবিপুলকেশা, দিব্যজ্যোতিঃসমন্বিতা কান্তিমতী কন্যাকে দেখে দেহে ও মনে একটা অননুভূতপূর্ব চাঞ্চল্য অনুভব করছেন সম্ভবত একেই আসক্তিজনিত উত্তেজনা বলে।

এক মুহূর্তের বেশি নয় অবশ্য।

সঙ্গে সঙ্গেই—প্রথমে কতকটা বলপূর্বক দৃষ্টি সম্বরণ ক’রে নিয়ে—যুধিষ্ঠির আবারও বিপন্ন মুখে মায়ের দিকে চাইলেন। যেন কি বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না।

কথাটা মা’র মুখ থেকেই বেরিয়ে আসবে এই অবিশ্বাস্য আশায় প্রতীক্ষা ক’রে রইলেন।

যুধিষ্ঠির ও তাঁর বাকী চার ভ্রাতার এ-বিড়ম্বনা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কতক্ষণ স্থায়ী হত তা বলা কঠিন কিন্তু অকস্মাৎ সেই সামান্য কুম্ভকারগৃহের সামনে রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দ উঠতে—উচ্চাবচ কঠিন মৃত্তিকায় যেমন শব্দ ওঠে, সাত জনই সচকিত, পাণ্ডবরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন।

এ-পথে রথ আসে না কখনই। পথই নেই এখানে। চারিদিকে শস্যক্ষেত্র, তার উপর দিয়েই বলিবর্দবাহিত দ্বিচক্রযান যাতায়াত করে মাত্র। এতদিন পাণ্ডবরা এখানে আছেন, কাউকে এখানে রথ চালনার চেষ্টাও করতে দেখেন নি।

সম্ভবত দ্রুপদই লোক পাঠিয়েছেন কন্যার তত্ব নিতে। হয়ত বা ভিক্ষুকগৃহে কন্যা কষ্ট না পায় সেই কারণে শয্যা ও অপরাপর বিলাসদ্রব্য পাঠিয়েছেন। কিংবা আশাহত নৃপতিদের দুষ্টবুদ্ধি পুনর্জাগ্রত হওয়াও একেবারে অসম্ভব নয়। ওখানে বহুলোকের মধ্যে যে অসুবিধা হয়েছিল, এখানে এই বিজনস্থানে সে অসুবিধার কারণ নেই, সেই সুযোগ নিতেই কেউ কেউ এসেছেন হয়ত।

ভীম চকিত তাঁর গদার কথা স্মরণ করলেন, অর্জুন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কুটিরমধ্যে প্রবেশ ক’রে ধনুর্বাণ ও তূণীর সংগ্রহ ক’রে আনলেন।

কিন্তু দেখা গেল যা ভেবেছিলেন বা যাঁদের কথা ভেবেছিলেন তাঁরা কেউ নন। রথ থেকে যাঁরা নামলেন, পাণ্ডবদের অপরিচিত হলেও কুন্তী তাঁদের চেনেন। কিছু পূর্বে অর্জুনও তাঁদের পরিচয় পেয়েছেন।

শ্রীকৃষ্ণ ও বলদেব।

চিনতে পারলেও তখনই চেনাতে পারলেন না পাণ্ডুমহিষী। তিনি এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে কিছুকাল তাঁর মুখ দিয়ে কোন বাক্যস্ফূৰ্তি হ’ল না।

অবশ্য বাসুদেব তাঁর পরিচয় করানোর জন্য অপেক্ষাও করলেন না, এগিয়ে এসে কুন্তীর পাদবন্দনা ক’রে যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনি আমাদের হয়ত এখনও ঠিক চিনতে পারেন নি, আমি আপনাদেরই আত্মীয়, আপনার মাতুলপুত্র। জননী পৃথা আমাদের পিতৃসা। আমি যাদব বংশের বসুদেব-পুত্র শ্রীকৃষ্ণ, আর ইনি আমার অগ্রজ বলদেব

চিনতে পেরেছেন অবশ্য এঁরা সকলেই—তবে এ-পরিচয়ে নয়।

এই দীপ্তিমান পুরুষটিই কিছু পূর্বে নিজের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিচাতুর্যে এক বিপুল সংঘর্ষ নিবারণ করেছেন, অকারণ রক্তক্ষয় বন্ধ ক’রে এক বিষম বিপদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। বিপদ—সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতের প্রায় সর্বপ্রান্তের বীর নৃপতিরা একদিকে, অপরদিকে তাঁরা নিরস্ত্র পাঁচটি ভাই। তাঁরা যত বড় বীর ও রণকুশলীই হোন—এ অসম যুদ্ধের পরিণাম কি হত তা বলা কঠিন। সময় বুঝে এই ব্যক্তিটি যথাযথ বাক্যগুলি প্রয়োগ না করলে এই অশুভ সংঘটন বন্ধ হত না। অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও রাজারা সহসা নিবৃত্ত হতে পারতেন না। অবস্থা বুঝেই সেই লজ্জার দায় থেকে তাঁদের উদ্ধার ক’রে যুদ্ধ বন্ধ করেছেন ইনি।

তা হলেও—এই অসামান্য বুদ্ধিমান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কূটকৌশলী ব্যক্তিটি যে তাঁদের আত্মীয়—তা একবারও মনে করেন নি। কল্পনা এতদূর পৌঁছানো সম্ভব নয়।

তবু, এই মাত্র অল্পদিনের জীবনেই ভাগ্য তাঁদের নিয়ে এত বিচিত্র খেলা খেলেছেন, এত রকমের অবস্থা-বিপর্যয় ঘটেছে যে, তাঁরা সহজে আর বিস্ময়ে বিচলিত কি বিহ্বল হন না। বিস্মিত হলেও সে মনোভাব সত্বর দমন করতে পারেন। তাই যুধিষ্ঠির—বয়সের-হিসাব-সঠিক-না-জানায় ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্ত প্রণামেচ্ছায় আনত–বাসুদেবকে সবল আকর্ষণে আলিঙ্গনাবদ্ধ ক’রে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আপনারা আমাদের চিনলেন কেমন ক’রে? এ-বাসস্থানের কথাই বা আপনাদের জানাল কে?’

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে যথাবিহিত সম্ভাষণাদি সেরে হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘প্রজ্বলন্ত বহ্নি কখনও গুপ্ত থাকে না, ভস্ম তাকে আবরিত করতে পারে না— অগ্নিতেও সে দগ্ধ হয় না। বারণাবতের সেই কৃত্রিম অগ্নির সাধ্য কি আপনাদের মতো সাক্ষাৎ পাবককে বিনষ্ট করে! আমি নিশ্চিত জানতাম যে আপনারা বেঁচে আছেন। আর, আজ স্বয়ম্বর সভাতেও আপনাদের চিনতে বিলম্ব হয়নি। পরদয়ানির্ভর জ্ঞানব্রতী ব্রাহ্মণদের মধ্যে আপনারা যে কত বেমানান তা আপনারা বোঝেন নি কিন্তু চক্ষুষ্মান অপর ব্যক্তিদের বুঝতে অসুবিধা হবে কেন?’

তারপর একটু থেমে, ঈষৎ কৌতুক-হাস্যের সঙ্গে বললেন, ‘এখানের পথের নির্দেশ? আপনারা লক্ষ্য করেন নি, দ্রৌপদ ধৃষ্টদ্যুম্ন কয়েকটি চতুর সংবাদ সংগ্রাহক নিয়ে দূর থেকে আপনাদের অনুসরণ করেছে—সম্ভবত এই কাছেই কোথাও আত্মগোপন ক’রে থেকে আপনাদের গতিবিধি কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। তারা যে আপনাদের বাসস্থান দেখে যেতে—আপনারা কি অবস্থায় বাস করেন তা জানতে আসবে এ আমি পূর্বেই অনুমান করেছিলাম, তাই আমি তখনই আপনাদের অনুসরণ করার চেষ্টা না ক’রে—অকারণে প্রাকৃতজনের কৌতূহল বৃদ্ধি ক’রে লাভ কি—আমি ধৃষ্টদ্যুম্নর গতিবিধির দিকেই লক্ষ্য রেখেছিলাম, দূর থেকে তাকেই অনুসরণ করেছি—ফলে আপনাদের বাসস্থান খুঁজে বার করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয় নি। দূর থেকে আপনাদেরও দেখা গেছে—আপনারা পদব্রজে আসছিলেন তো—তাছাড়া আসতে আসতে অন্যান্য পথচারীদেরও আলাপ করতে শুনেছি—এই ভাগ্যবান ভিক্ষুকরা গ্রামের কুম্ভকার পল্লীতে থাকেন!

প্রাপ্য যথাবিহিত প্রণামাশীর্বাদাদি, কুশল ও সৌজন্য বিনিময়ের পর যুধিষ্ঠির গৃহসংলগ্ন অলিন্দে অজিনাসন বিছিয়ে বাসুদেবের সমাদর ক’রে বসালেন। গৃহে কোন পক্কান্ন নেই, প্রভাতে স্বয়ম্বর সভায় যাত্রার পূর্বে যে ভিক্ষা মিলেছে তা এখনও তণ্ডুলাকারেই আছে—এতকাল পরে ভ্রাতুষ্পুত্ররা এসেছে, কি দিয়ে তাদের আতিথ্য করবেন—এই চিন্তায় আর্যা কুন্তী আকুল হয়ে উঠলেন।

কিন্তু বাসুদেব কাউকেই সে চিন্তার অবসর বিশেষ দিলেন না। একেবারেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা যখন এসে পৌঁছলাম তখন আপনাদের সকলকেই খুব চিন্তাকুল বিব্রত দেখলাম,–কেন, প্রশ্ন করতে পারি কি? আপনারা কি নূতন কোন বৈরিতার আশঙ্কা করছেন?’

সহসা যুধিষ্ঠিরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি যেন অন্ধকারে কূল দেখতে পেলেন। এই প্রশ্নকে দৈবপ্রভাবিত বলে বোধ হ’ল তাঁর।

তিনি বললেন, ‘বাসুদেব, কিছু পূর্বে আপনার যে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধি-কৌশলের পরিচয় পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে আপনি আজ ঈশ্বরপ্রেরিত হয়েই এখানে এসেছেন। সমস্যাটা আপনার কাছে বিবৃত ক’রে আপনার উপরই তার সমাধানের ভার ছেড়ে দিচ্ছি।’

বললেনও তিনি। আনুপূর্বিক—ভীমের উচ্ছ্বাস ও কুন্তীর উত্তর—দুই-ই।

তুচ্ছ সামান্য কথা—সাধারণ নির্দেশ—কিন্তু যাঁর মুখ থেকে বেরিয়েছে তিনি সামান্য নন। এঁদের জননী, রাজমহিষী, দেবানুগৃহীতা, দেবপ্রিয়া। অথচ এক্ষেত্রে সে নির্দেশ এঁরা পালনই বা করেন কি ক’রে? কন্যার বহুচারিণীত্ব এবং এঁদের ব্যভিচারের দোষ হবে না কি?

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অভ্যস্ত রহস্যময় হাসিতে মুখ রঞ্জিত ক’রে বললেন, ‘আমি সেই কথা বলতেই আজ এখানে এসেছি। মহারাজ, আপনি ধর্মজ্ঞ, ধর্মপরায়ণ, ন্যায়নীতি সম্বন্ধে জ্ঞান আপনার সহজাত বর্মের মতো। শাস্ত্রমতে এ-সমস্যার মীমাংসা অতি সরল। এই ধরনের কোন বাক্য অজ্ঞাত বা অজ্ঞানতাপ্রসূত নিঃসৃত হলে—যিনি বলেছেন তিনি কি ভেবে কি উদ্দেশ্যে বা কি পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন—সেটাই আগে বিবেচনা করা উচিত। বাক্যের শব্দার্থের থেকে বক্তার বক্তব্য বা উদ্দেশ্যই সমধিক সত্য—বিচারক সেটাই বিবেচনা করবেন সর্বাগ্রে—এ-ই হ’ল ন্যায়শাস্ত্রের, বিশেষ রাজধর্মশাস্ত্রের বিধান। আর্যা পৃথা খাদ্য ভেবেই ভাগ ক’রে নিতে বলেছেন—মানুষ জেনে কি ভেবে বলেন নি। সুতরাং সে রকম কোন বাধ্যবাধকতা এখানে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আমি বলি কি, আমার অনুরোধ—আপনারা তাঁর আদেশ আক্ষরিক অর্থেই পালন করুন, আপনারা পাঁচজনই দ্রুপদ-তনয়াকে বিবাহ করুন।’

‘সে কি! তাও কি সম্ভব! এক নারীর পঞ্চস্বামী!….সে নারী ভ্রষ্টা, বারাঙ্গনা বলে গণ্য হবেন না? আর আমরাও কি অধর্মাচারী বলে প্রমাণিত হবো না!’

যুধিষ্ঠির যেন বিমূঢ় হয়ে পড়েন।

‘দেখুন মহারাজ, আপনাদের আচরণে যদি সংযম ও নিয়মের বন্ধন থাকে, তাহলে কিছুতেই কেউ আপনাদের ভ্রষ্টাচারী বা ব্যভিচারী বলতে পারবে না। আপনারা যদি পর পর পাঁচ দিনে পাঁচ জন এই কন্যার পাণিগ্রহণ করেন— পাঁচ দিন পাঁচ জনে বাসর যাপন করেন এবং নিয়ম করেন যে অতঃপর এই বধূ এক বৎসর ক’রে এক স্বামীর সঙ্গে বসবাস করবেন এবং সেই সময়টুকুতে কেবলমাত্র তাঁকেই মনে-প্রাণে স্বামী বলে জানবেন—অপরকে সেই সম্পর্ক ধরে ভাশুর বা দেবর রূপে চিন্তা করবেন—তাহলে এটাকে বিচিত্র এবং এই সমাজের অঘটিতপূর্ব ঘটনা বলে জানলেও —কারণ অন্য কোন কোন সমাজে এক নারীর বহুপতির অস্তিত্ব বিরল নয়—আপনাদের দোষ দিতে বা পঞ্চপতির কারণে কুরুকুলরাজ্ঞীকে বারাঙ্গনা বলতে পারবে না।…আমি যতদূর জানি—পরম তত্বজ্ঞ ব্যাসদেবও আপনাদের এই পরামর্শ দিতেই এখানে আসছেন।’

তারপর কিছুকাল মৌন থেকে ঈষৎ গাঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘মহারাজ, আমি জানি এই অধর্মকলুষিত ও যথেচ্ছাচারনিপীড়িত দেশে ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্যই আপনাদের জন্ম হয়েছে। অনেক দিনের অনেক পাপ অনেক আবর্জনা জমেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। রাজারা যে প্রজাদের ন্যাসরক্ষক মাত্র, ধর্মানুসারে দুষ্টকে দমন ও শিষ্টকে রক্ষা করার জন্যই তাঁরা ঈশ্বরাদিষ্ট কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে থাকেন—এ কথা আজ আর কারও মনে নেই …আপনারা জাতি তথা দেশকে আবার নতুন ক’রে সেই সত্যটা শিক্ষা দেবেন—এইটেই আপনাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য ও দায়িত্ব। যা কিছু রাজার বা রাজশক্তির তা সবই পাঁচজনের—রাজার নিজস্ব কিছু থাকতে নেই—এই মহান সত্যের প্রতীক হিসাবে আদর্শ ও দৃষ্টান্তস্বরূপই আপনারা এক মহিষীকে পাঁচ ভাই ভোগ করুন, আর এই আদর্শ থেকেই জনসাধারণ শিক্ষালাভ করুক যে, এ সংসারে নিজস্ব বলে কিছু আশা করা উচিত নয়। জনতাই নারায়ণ, জনতাই ঈশ্বর, তাদের বাণীই ভগবানের বাণী। যা কিছু শক্তি তাও যেমন পাঁচজনের—তেমনি যা কিছু ভোগ্য তাও সকলে মিলেই ভোগ করবেন—এই আদর্শ বিস্তারই যেন আপনাদের কাজ হয়।’

বাসুদেবের বলা শেষ হলে কিছুক্ষণের জন্য এক অখণ্ড নীরবতা নামে সেখানে। সেই দিবা তৃতীয় প্রহরেও যেন থমথম করতে থাকে চারিদিক। অনেকক্ষণ পরে বিহ্বলকণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলেন, ‘কিন্তু এসব কথা আপনি কাকে বলছেন, মহারাজ বলেই বা সম্বোধন করছেন কাকে? আমরা তো শুধু রাজ্যহীনই নই—গৃহহীন, পথের ভিক্ষুক। এ উপদেশ আমাদের কি কাজে লাগবে?’

‘আপনি ন্যায়ত ধর্মত কুরুকুলপতি, রাজা। ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্যই চিহ্নিত আপনারা। এ দুর্দশা আপনাদের থাকবে না। সাধারণ দরিদ্র মানুষ কী ক’রে দিন যাপন করে, কী এবং কত নিপীড়ন তাদের সহ্য করতে হয়—তাদের সুখ-দুঃখ বিপদ-দুশ্চিন্তা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই বিধাতা বোধ হয় আপনাদের এই অবস্থায় ফেলেছেন। এ ভালই হ’ল, রাজ্য পরিচালনা করতে গেলে এ অভিজ্ঞতা বিশেষ প্রয়োজন। বক-রাক্ষস-কাহিনীও আমার কানে পৌঁচেছে—স্বেচ্ছায় এক-একজনকে যেতে হত খাদ্য হিসাবে—এখন বুঝছি তাকে বধ করাও ভীমসেনেরই কাজ, শুধু রাজশক্তি বা ক্ষাত্রশক্তিই নয়—বর্বর পশুশক্তি, দানবীয় বল যেটা—সেটাও কি নিষ্ঠুর অত্যাচার করে—আর অসহায় জনসাধারণ কেমন ক’রে সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়—এই একটা দৃষ্টান্তেই কি তা স্পষ্ট হয় নি?’

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে—ধনঞ্জয় অর্জুনের কাছে এসে তাঁকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘কিন্তু তুমি শুধু আমার ভাই কি আত্মীয় মাত্র নও, তার চেয়ে অনেক বেশী–আজ থেকে আমরা পরস্পরের বন্ধু, অভিন্নাত্মা। পরস্পরের সুখদুঃখ চিন্তাকল্পনার অংশভাগী। ব্যাসদেব বলেন পুরাকালে নর ও নারায়ণ নামে দুই একাত্মা বন্ধু, হিমালয়ের বদরিকাশ্রমে তপস্যা ক’রে দেহত্যাগ করেছিলেন—আমরা দুজন সেই তাঁদেরই নবকলেবরধারী আত্মা। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা ঠিক যে তপস্যায় নর বা মানুষ ভগবানের কাছে পৌঁছতে পারে, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। মানুষ উপরে ওঠার চেষ্টা করলে ঈশ্বর তার কাছে নেমে আসেন—আর সেই নর ও নারায়ণ, মানুষ ও ঈশ্বরের শক্তি একত্র হলে তবেই অসুরশক্তির বিনাশ সম্ভব হয়। আমরা হয়ত সেই দুই ঋষির আত্মা, হয়ত সে-আত্মা পরমাত্মায় লয় পেয়েছে—আমরা সেই ঐতিহ্য ও তপোবল বহন ক’রে এসেছি পরমাত্মার ইচ্ছাতেই। এসব গূঢ় তত্ব, এর সব কথা বুঝি না—এইটুকু শুধু বুঝি, বহুদিন—যেন বহু যুগ বহু জন্মান্তর ধরে আমি তোমারই পথ চেয়ে আছি। তোমার সান্নিধ্য, তোমার সাহচর্যের জন্য লুব্ধ, তোমার শক্তির ভিক্ষুক। হে পার্থ, হে জিষ্ণু, তুমি আমার সেই ঐকান্তিক কামনা পূর্ণ করো। তুমি আমার বন্ধু হও!’

ধনঞ্জয় তাঁর নবলব্ধ অভিন্নাত্মা এই বন্ধুটিকে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, তাঁর মনের চিন্তারও তল পান না।

অনেক করেছেন বাসুদেব—তাঁদের এই রাজ্যপ্রাপ্তিতে, এটা অনস্বীকার্য। শ্রীকৃষ্ণর স্থিরবুদ্ধি ও অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়া বোধ হয় সম্ভবই হত না। পাঞ্চালরাজ জামাতাদের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে চতুরতম চর প্রেরণ করেছিলেন হস্তিনায়। তারা পৃথক পৃথক বার্তা বহন ক’রে আনলেও মোট কথাটা মিলে গেছে। তাতেই মনে হয় সত্য সংবাদই এনেছে তারা—কল্পিত কাহিনী ফেঁদে বসে নি।

কুরুবংশের সিংহাসন জ্যেষ্ঠ হিসাবে ধৃতরাষ্ট্রেরই প্রাপ্য কিন্তু তিনি জন্মান্ধ বলেই তা পান নি। পাণ্ডু রাজা হলেও ভগ্নস্বাস্থ্য নিবন্ধন দীর্ঘদিন রাজধানী থেকে দূরে পার্বত্য অঞ্চলে বাস করেছেন এঁদের চিরকুমার জ্যেষ্ঠতাত মহাত্মা ভীষ্মকে রাজ্যচালনার ভার দিয়ে। ফলে পাণ্ডুর অকাল মৃত্যুতে নাবালক ছেলেরা রাজধানী হস্তিনায় এলেন রাজার মর্যাদায় নয়—পাণ্ডু-তনয় যুধিষ্ঠির এই পুরুষের জ্যেষ্ঠ এবং পাণ্ডুর প্রথম পুত্র, সঠিক বিচারে তাঁরই সিংহাসন আরোহণ করার কথা—নিতান্ত পরান্নজীবী আশ্রিত অনাথের মতোই।

তবু তাতেও ধার্তরাষ্ট্রদের ঈর্ষাগ্নি থেকে এঁদের অব্যাহতি মিলল না। কারণ এঁরা যে ন্যায়ত এ-রাজ্যের অধিকারী শুধু তাই নন, বিদ্যায় বুদ্ধিতে শারীরিক বলে শাসক হিসাবে যোগ্যতর। বাল্যে ভীমের উপরই জ্ঞাতি ভ্রাতাদের আক্রোশ বেশি ছিল, কারণ ভীমের অপরিমাণ দৈহিক বল—তাঁরা ওঁকে সেই বয়সেই বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা করেন, দৈব সহায় বলে কোনমতে তিনি রক্ষা পান। তারপর অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে যখন পরীক্ষার ফলে প্রমাণিত হ’ল অৰ্জুনই ওঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও শ্রেষ্ঠ ধানুকী—তখন কৌরবরা এক চরম ষড়যন্ত্রে প্রবৃত্ত হলেন। বারণাবত নামে এক গণ্ডগ্রামে দাহ্য পদার্থে প্রস্তুত প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে পাণ্ডবদের সেখানে পাঠিয়ে দিলেন—একত্রে থাকলে কলহ দ্বেষ বৃদ্ধি পাবে এই যুক্তি দেখিয়ে। সঙ্গে পুরোচন বলে এক কর্মচারী দিলেন, তাকে প্রচুর পুরস্কারের অঙ্গীকারে প্রলুব্ধ করা হ’ল-সে সুযোগমতো ঐ প্রাসাদে অগ্নিসংযোগ ক’রে এঁদের পুড়িয়ে মারবে।

কিন্তু পাণ্ডব কৌরবদের এক দাসী-গর্ভজাত খুল্লতাত ছিলেন, বিদুর—তিনি ধর্মপরায়ণ ও প্রাজ্ঞ। তিনি এ ষড়যন্ত্রের পূর্ণ সংবাদ রাখতেন। তিনিই যাত্রার প্রাককালে এঁদের সে-সম্বন্ধে সচেতন ক’রে দিলেন, মাটিতে সুড়ঙ্গ কাটবার জন্য গোপনে একটি বিশ্বস্ত লোকও পাঠালেন। উদ্দেশ্যটা পাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই আশঙ্কায় পুরোচন কিছু কালহরণ করছিলেন, এঁরা তার পূর্বে নিজেরাই জতুগৃহে অগ্নিসংযোগ ক’রে সুড়ঙ্গপথে বহুদূর অরণ্যে পলায়ন করলেন। তার আগে আরও একটি বুদ্ধির কাজ করেন এঁরা। এক নিষাদী ও তার পঞ্চপুত্রকে যাত্রার পূর্বদিন আমন্ত্রণ ক’রে প্রচুর ভোজন করান। সেই সঙ্গে আকণ্ঠ সুরাপানেরও আয়োজন ছিল, ফলে সন্ধ্যার দিকে তারা অচেতন হয়ে পড়ল। জতুগৃহের ভস্মাবশেষ থেকে এদের অস্থি দেখেই কৌরবরা নিশ্চিন্ত হলেন যে পঞ্চপাণ্ডবের অপঘাত মৃত্যু ঘটেছে। সেই সঙ্গে পুরোচনও দগ্ধ হওয়ায় অন্যরূপ সাক্ষ্য দেবার কেউ ছিল না। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে সন্দেহের অবকাশ রইল না।

সেইদিন থেকে কৌরবদের ভয়ে এঁরা ভিক্ষান্নজীবী ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন—পরিচয় দিয়ে সিংহাসন দাবি করার চেষ্টা করেন নি। কারণ রাজক্ষমতা কোষাগার সবই কৌরবদের হাতে, এঁরা একান্ত সহায়সম্বলহীন—সে দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই বোধ হয় নিহত হতেন।

বস্তুত এখনও ধৃতরাষ্ট্রর ইচ্ছা ছিল না এঁদের কোন কিছু দেবার—দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতির তো ছিলই না। রাজ্যের অধিকার তো দূরের কথা—ওঁদের অস্তিত্বকে স্বীকার করারই ইচ্ছা ছিল না তাঁদের। পঞ্চপাণ্ডব পুড়ে মরেছে—এই প্রচলিত ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। নিহাৎ পাঞ্চাল ও যাদবরা নির্দ্বিধ অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিতেই অসুবিধায় পড়ে গেলেন। ঈর্ষা ও হতাশা–দ্রৌপদী এদের অধিকারে আসাতে ঈর্ষা এবং বার বার চেষ্টা সত্বেও পাণ্ডবদের বিনষ্ট করতে না পারার হতাশা—এই দুই অনুভূতি মিলিয়ে উন্মত্তবৎ দুর্যোধন নানারকম ছেলেমানুষী প্ৰস্তাব করেছিলেন, বলেছিলেন, পাঞ্চালরাজকে প্রচুর অর্থ দিয়ে বশীভূত করব—যাতে তারা পাণ্ডবদের লোকবল বা অর্থবলে সাহায্য না করে, তাদের যেন ত্যাগ করে বা পাঞ্চালেই বন্দী ক’রে রাখে—তারপর সেই সুযোগে সসৈন্যে ওদের আক্রমণ ক’রে ওদের পরাভূত ও নিহত করব।

যারা সর্বাধিক বিদ্বেষের পাত্র, যারা বার বার নিজেদের শৌর্য বীর্য ও অন্যান্য গুণাবলীর আধিক্য দ্বারা ওঁদের ক্ষত্রিয় সমাজে, রাজন্য সমাজে ছোট ক’রে দিয়েছে— তারাই আবার এসে এই পাঞ্চাল স্বয়ম্বর সভায় আরও একবার ওঁদের মুখে—ওঁর মুখে কালি লেপে দিল—এ জ্বালা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না দুর্যোধন, একরকম প্রলাপ বকতে শুরু ক’রে দিয়েছিলেন।

একবার বলেন বন্ধুবেশী কপট হিতাকাঙ্ক্ষী চতুর চর প্রেরণ ক’রে পাণ্ডবদের মধ্যে ভেদ জন্মাবেন—যাতে তারা পরস্পরের সঙ্গে মারামারি ক’রে নিজেরাই নিহত হয় আবার কখনও বলেন, গোপনে গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে ভীমকে হত্যা করবেন তাহলেই পাণ্ডবদের মন ভেঙে যাবে, তারা আত্মহত্যা করবে কিংবা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবে।… কিছুই স্থির করতে পারেন না—শুধু শলাকা-উত্তেজিত পিঞ্জরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো গর্জন করেন আর অস্থির হয়ে পাদচারণা করেন।

কর্ণ অবশ্য—যথেষ্ট কারণ থাকা সত্বেও—অতটা অস্থির কি বিচলিত হন নি, অগ্রপশ্চাৎ জ্ঞান হারিয়ে বসেন নি। দ্বিবিধ অপমানের জ্বালায় তাঁরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কথা—কিন্তু তিনি কোন অযৌক্তিক প্রস্তাব করেন নি বরং মৃদু ভর্ৎসনাই করেছিলেন বন্ধু দুর্যোধনকে এই সব বালকোচিত অবাস্তব প্রস্তাবের জন্য।

তিনি বলেছিলেন যে, ‘সেই কৌরবহস্তে লাঞ্ছিত হবার পর থেকে আজ পর্যন্তও পাঞ্চালরা যথেষ্ট বলশালী হয়ে উঠতে পারে নি বাসুদেব যে যাদববাহিনী এনে ফেলবেন তাতেও বহু বিলম্ব বিপুল কোন বাহিনী কয়েক দিনের মধ্যে এনে ফেলা যায় না—বিশেষ মৎস্য প্রভৃতি রাজ্যের মধ্য দিয়ে আসতে হবে, তাঁদের অনুমতি চাই, আনুকূল্য চাই—নইলে রসদ বা অশ্ববলদ প্রভৃতির খাদ্য সংগ্রহ হবে না অর্থাৎ পাণ্ডবদের প্রস্তুত হয়ে নিতে এখনও ছ’সাত মাস দেরি লাগবে। আমরা পাঞ্চালদের কাছাকাছি আছি, আমাদের বাহিনীও প্রস্তুত—আমরা যদি ঝটিকার মতো গিয়ে পড়তে পারি অবশ্যই ওদের পরাভূত ও বন্দী করতে পারব। আমার মনে হয় সেই চেষ্টাই করা উচিত।’

এ পরামর্শ ধৃতরাষ্ট্রের মন্দ লাগে নি। তিনিও হয়ত সেই মতই সমর্থন করতেন, যদি না দেখা যেত বাসুদেবের দূরদৃষ্টি অনেক বেশী। তিনি প্রচার ক’রে দিলেন যে পাণ্ডবদের পক্ষে বরযাত্রী হিসাবে উৎসবসঙ্গীর না অভাব হয়—সেই জন্য তিনি বহুপূর্বেই সাত্যকি, কৃতবর্মা, বজ্র প্রভৃতি যাদব বীরদের সসৈন্য ও সপার্ষদ আসতে বলেছেন, সেই সঙ্গে পাণ্ডবদের জন্য প্রচুর ধনরত্নাদি এবং তাঁদের আসন্ন সৈন্য-বাহিনীর উপযুক্ত অশ্বাদিও।

এই সংবাদটার জন্য ধৃতরাষ্ট্র বা কর্ণ ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। এদিকেও দেখা গেল কৌরবদের পক্ষে যাঁরা অজেয় এবং দুর্ধর্ষ, সেই কুরুপিতামহ ভীষ্ম ও দ্রোণ—এঁরা কেউ পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে সম্মত নন। ক্ষত্তা বিদুর তো ননই। চিরদিনই পাণ্ডবরা তাদের বিনত সশ্রদ্ধ আচরণের জন্য বিদুরের প্রিয়, সেই জন্যই আরও দুর্যোধন কৰ্ণ প্রভৃতি বিদুরকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না, ধৃতরাষ্ট্রও যে সর্বদা তাঁর পরামর্শ মেনে চলেন তাও না–তবু কে জানে কেন, ধৃতরাষ্ট্রের ওপর তাঁর অনেকখানি প্রভাব আছে—ঘোর পাতকীর ওপর বিবেকের একটা অদৃশ্য প্রচ্ছন্ন প্রভাবের মতো।

এঁদের সকলেরই মত—পাণ্ডুতনয়দের উপর যথেষ্ট অবিচার করা হয়েছে, বিশেষ এই জতুগৃহ নির্মাণ ক’রে তাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ার পর এঁরা কেউ জনসমাজে মুখ দেখাতে পারছিলেন না, এখন আবার যদি তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয় তো সমগ্র বিশ্বে ধিক্কারের ঝড় উঠবে। তার চেয়ে মনে যা-ই থাক ওঁদের সসম্মানে সসমাদরে তাঁদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপনই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। আর পাণ্ডবদের শৌর্য ও বীর্যের কিছু নমুনা তো এঁরা পেয়েছেন—যদিই এঁদের হিসাব সব ওলটপালট হয়ে যায়, পাণ্ডবদের পরাস্ত করতে না পারেন, তাহলে যথাসর্বস্বই যাবে এঁদের। তার চেয়ে বুদ্ধিমানের মতো অর্ধেক বা অর্ধেকের কাছাকাছি দিয়ে তাদের সঙ্গে একটা মিম্মাট ক’রে নিন

সেটাই সমীচীন বুঝেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রও। বিদুরকে দূত স্বরূপ পাঞ্চালে পাঠিয়ে ডাকিয়েও এনেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রদের। তাদের আদর আপ্যায়ন পানভোজনেরও কোন ত্রুটি হয় নি। উৎকৃষ্ট বস্ত্রাদি এবং নবোঢ়া সুষার জন্য অলঙ্কারের ব্যবস্থাও হয়েছিল। এমন কি শেষ মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণর প্রাণপণ চেষ্টায় পাণ্ডবদের জন্য যে একটি রক্ষীবাহিনী সংগৃহীত হয়েছিল—প্রস্তুত না থাকলেও তাদের অভ্যর্থনা বাসস্থান আহার্য—এবং অশ্ব ও বৃষাদির পরিচর্যার কোন অভাব ঘটে নি।

অবশ্যই অন্ধরাজা অর্ধেক দিতে চান নি। যেটুকু ভূখণ্ড এদের জন্য চিহ্নিত ক’রে দিয়েছিলেন, তাকে অন্ধ ছাড়া অপর কেউ কুরু-রাজ্যের অর্ধেক বলবে না। একটা নগর পর্যন্ত দিতে সম্মত হন নি—অম্লান বদনে বলেছিলেন, ‘ঐ খাণ্ডবপ্রস্থ পড়ে আছে, ঐখানেই তোমরা জনপদ বসিয়ে রাজধানী ক’রে নাও।’

এই অবিচারে ভীম অত্যন্ত উষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন, অর্জুন পর্যন্ত আত্মদমন করতে পারেন নি, তাঁর উম্মা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল মুখের রেখায়—সে-সময়ও শ্রীকৃষ্ণই এসে শান্ত করেন ওঁদের। বুঝিয়ে দেন যে, এ ভালই হ’ল–প্ৰতিষ্ঠিত জনপদ বা নগরীতে রাজধানী স্থাপন করতে গেলে পদে পদে অসুবিধা তার চেয়ে পতিত জমিই ভাল— ইচ্ছামতো, নিজেদের পরিকল্পনামতো—সব চেয়ে বড় কথা প্রয়োজন ও সুবিধা-মতো নগরীর পত্তন গঠন করা যায়। কোথায় কোন গৃহ বা মণ্ডপ, কোথায় রত্নাগার, কোথায় শস্ত্রাগার, কোথায় শস্যভাণ্ডার নির্মিত হবে—সেটা নিজেদের সুবিধামতো নির্বাচন করার স্বাধীনতা—অনেক বেশী সুবিধাজনক।

আরও বলেছিলেন বাসুদেব, ‘রাজ্যের আয়তনের ওপর শক্তি-সামর্থ্য বা বিত্ত নির্ভর করে না। যে দেশ আত্মোন্নতির সুযোগ পায় সেই দেশেই অধিক সংখ্যক প্রজা এসে বসতি স্থাপন করে। শিল্পবাণিজ্যের ওপরই রাজ্যের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। রাজা যদি তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে আয়তনে বৃহত্তর রাজ্যগুলির থেকে প্রভাবে ও প্রতিপত্তিতে এই ক্ষুদ্র রাজ্যই অগ্রগণ্য হয়ে উঠতে পারবে। দুর্যোধনরা ভুল করল, এ রাজ্য এমনিতেই এত জনবহুল— এখানে প্রজাদের উন্নতির আশা কম। বরং তোমরা রাজ্য পত্তন করলে দেখবে উদ্যমশীল পরিশ্রমী প্রজারা এদেশ ত্যাগ ক’রে তোমাদের রাজ্যেই যাবে।’

আরও অনেক উপকার করেছেন শ্রীকৃষ্ণ।

খাণ্ডবপ্রস্থ নামে যে জায়গাটি ওঁদের জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন ওঁদের জ্যেষ্ঠতাত—তাকে পার্বত্যদেশ বলাই উচিত। খুব উঁচু কোন পাহাড় না থাকলেও সেখানে মাটির থেকে পর্বতশিলাই বেশী। বৃক্ষবিরল—সজীবতা বলতে কণ্টকগুভম শুধু। ক্বচিৎ কোথাও সামান্য একটু মাটি পেয়ে দু’একটি গাছ মাথা তুলেছে। পার্বত্যদেশ বলাও হয়ত ভুল—প্রস্তরময় দেশ বললেই কতকটা ঠিক বর্ণনা হয়।

নক্সা প্রভৃতি দেখে যে স্থানটিতে ওঁরা রাজধানী পত্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানে যাওয়ার পথও তেমনি দুর্গম। বস্তুত কোন পথই ছিল না। নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ কেটে যাওয়া। অসংখ্য শ্বাপদসঙ্কুল সেই ঘোর অরণ্যে কোন পরিচিত ফলের গাছ পর্যন্ত নেই, নেই সুপেয় জলের প্রাচুর্য। বাসুদেব পূর্বেই এর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। আগে গাছ কেটে পথ তৈরী করবে, স্থানে স্থানে নৈশ বিশ্রামের জন্য সাময়িক স্কন্ধাবার ফেলবে—গো মহিষ অশ্ব ও অশ্বতরাদির সেবা ও তাদের আহার্যের ব্যবস্থা করবে—সেসব লোক বেছে বেছে আগেই নিযুক্ত করা হয়েছিল। সুবৃহৎ গোশকটে পানীয় জল সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থপতি, গৃহনির্মাণকর্মী ও শ্রমিকদের একটি বিরাট দলও সঙ্গে নিয়েছিলেন। উনি নিজে এদের সঙ্গে সঙ্গে সেই কষ্টকর পথে এসেছেন বরাবর। রথে যাওয়া কঠিন, অশ্বারূঢ় হয়েই আসতে হয়েছে।

তার পরও—এখানে নগরীর নক্সা প্রস্তুত, উপকরণাদি সংগ্রহ—কাকে কি ভার দেওয়া হবে—সমস্ত ব্যবস্থা তিনিই করেছেন। সেই সঙ্গেই সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, মন্ত্রণালয়ের কর্মী নিয়োগও তাঁর পরামর্শ মতোই করা হয়েছে। ব্যাসদেবকে দিয়ে নগরীর ভিত্তিপত্তন যজ্ঞ করানো হয়েছিল, সেও তাঁরই নির্দেশে। আর তার ফলেই মাত্র এই ক’বছরে এত বড় একটা মহান ও রমণীয় নগরী গড়ে উঠতে পেরেছে।

ব্যাসদেবের নিজেরই ভাষায়—

“সে নগর সাগরতুল্য বৃহৎ পরিখাদ্বারা অলঙ্কৃত হইল এবং শ্বেতনাগ সমাবৃত পাতালগঙ্গা ভোগবতীর ন্যায় চন্দ্র ও পাণ্ডুবর্ণ মেঘসদৃশ গগনতলব্যাপিনী প্রাকারশ্রেণীতে শোভা পাইতে লাগিল। তাহার সৌধসকল কপাট-বিশিষ্ট বিস্তৃত দ্বার দ্বারা বিস্তৃতপক্ষ গরুড়ের শোভা ধারণ করিল। ঐ পুরশ্রেষ্ঠ মেঘবৃন্দ ও মন্দরপর্বত-সদৃশ সুসংবৃত অস্ত্রযুক্ত দুর্ভেদ্য গোপুরসমূহে সুরক্ষিত হইল। এবং স্থানে স্থানে দ্বিজিহ্ব পন্নগ সদৃশ শক্তি নামক অস্ত্রসমূহে সমাবৃত, অস্ত্রশিক্ষার নিমিত্ত অট্টালক-পুঞ্জে সুশোভিত যোধগণ কর্তৃক রক্ষিত, তীক্ষ্ণ অঙ্কুশ সকল, এককালে শত শত মনুষ্যের প্রাণঘাতক শতঘ্নী নামক অস্ত্রযুক্ত যন্ত্রজাল ও লৌহময় মহাচক্রে শোভিত হইল। পথ সকল প্রশস্ত ও সুবিভক্তরূপে নির্মিত হইল। ঐ নগর পাণ্ডুবর্ণ নানাবিধ পরমোৎকৃষ্ট অট্টালিকামণ্ডলীতে পরিদীপ্যমান হইয়া অমর ভুবনের ন্যায় শোভমান হওয়াতে ‘ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ’ বলিয়া প্রকাশিত হইল। এতাদৃশ নগরমধ্যে রমণীয় কল্যাণকর স্থানে পাণ্ডবদের ধনপরিপূর্ণ ধনপতিসদৃশ প্রাসাদমণ্ডলী নভোমণ্ডলস্থ তড়িন্মালা সমাবৃত মেঘবৃন্দের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।

“অনন্তর সংস্কৃত প্রাকৃত প্রভৃতি নানাদেশীয় ভাষাজ্ঞ ব্যক্তি-সকল ও সর্ববেদ-বিশেষজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ আসিয়া বাস করিবার নিমিত্ত সেই স্থান মনোনীত করিলেন। বণিকসমূহ ধনার্জনে অভিলাষী হইয়া নানা দি¢দগন্ত হইতে তথায় আগমন করিতে লাগিল। অশেষ শিল্পবিজ্ঞান-পারদর্শী ব্যক্তিরা তথায় আসিয়া বাস করিল। নগরীর চতুর্দিকে পরম- রমণীয় উদ্যান-সকল…পুষ্প-ফল যুক্ত বিবিধ বৃক্ষসমূহ সুশোভিত হইল।“

কিন্তু এত যিনি করলেন—প্রধানত যাঁর আনুকূল্যে অতি অল্পসময়ে, মাত্র ছ’সাত বছরে এই অসম্ভব সম্ভব হল—যিনি বলতে গেলে এই ক’বছর অর্ধেকের অধিককাল এই খাণ্ডবপ্রস্থেই অতিবাহিত করলেন—এখন তাঁর এ মনোভাব কেন? অর্জুনকে তিনি ক্রমাগত এই নবীনা নবনির্মিত রাজধানী ও সদ্যপ্রাপ্ত রাজ্য ত্যাগ করে ভারত পরিক্রমায় প্ররোচিত করছেন কেন?

তাঁর কথায় একেবারে যে যুক্তি নেই, তা নয়। তিনি বলেছেন, পাণ্ডবরা এই দেবানুগৃহীত ভূমির সার্বভৌম শাসক হবেন—এই তিনি দেখতে চান। সে উচ্চাশা ওঁদেরও, অর্থাৎ পাণ্ডবদেরও থাকা উচিত। আর তা যদি থাকে তাহলে এ দেশ— দেশ বলতে দেশের মানুষকে ভাল ক’রে জানা ও বোঝা প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়া দরকার। সুদ্ধমাত্র বাহুবলে নির্ভর করলে—রাজাকে পরাজিত করা যায়—যথার্থ রাজ্যজয় হয় না। বিজিত রাজ্য পদানত থাকা বাঞ্ছনীয় নয়—বিজয়ীর স্বভূমির সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াই অভিপ্রেত। আর তা সম্ভব করতে হলে, বিজিতের সঙ্গে বিজয়ীর আত্মীয়তা স্থাপন করতে গেলে, তাদের সুখদুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা, রীতিনীতি, আচার-সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রভৃতির সঙ্গে, জীবন সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে, দর্শনের সঙ্গে পরিচয় স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘রাজ্য তার নিজ রূপ নিজেই পরিগ্রহণ করবে শিশু বালক, বালক কিশোর হ’তে বিলম্ব ঘটবে না। রক্ষণাবেক্ষণ ও শাসনের প্রাত্যহিক কাজের জন্য রাজা যুধিষ্ঠির রইলেন, ভীমসেন রইলেন। তুমি এখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো, এগিয়ে যাও। এ রাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান হতে থাক, তুমি ইত্যবসরে সমস্ত ভারতভূমি প্রদক্ষিণ করো। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে এদেশের মানুষের বিভিন্ন জাতি, তাদের চেহারা বিভিন্ন, ভাষা ও সংস্কৃতি বিভিন্ন—রীতিনীতি আচার সবই—একেরটা অপরের সঙ্গে মেলে না—পৃথক, স্বতন্ত্র। সেগুলি জানার বোঝার— তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ঈপ্সা আয়ত্ত করার চেষ্টা করো। নইলে এ দেশকে সংহত ও শক্তিশালী করে তুলতে পারবে না। একটি ধর্মের সূত্রে আবদ্ধ এই বহুজাতির যথার্থ সমন্বয় ঘটানো খুব কঠিন নয়—যদি তাদের অন্তরগুলোর সঙ্গে তোমার পরিচয় থাকে। হে ভারতর্ষভ, তুমি তোমার পিতৃপুরুষের নামাঙ্কিত এই ভারতভূমি পরিক্রমা করো। তাতে তোমার তীর্থ পরিক্রমা—নররূপী নারায়ণকে পরিক্রমা করার কাজ হবে।’

এর মূল বক্তব্যে অর্জুনের অন্যমত নেই। এ সবই তিনি স্বীকার করেন—এর অন্তর্নিহিত সত্য। কিন্তু তবু, রাজবংশের সন্তান, রাজপুত্র—নূতন রাজ্যপ্রতিষ্ঠা ও রাজ্য শাসনের স্বাদ পেয়েছেন, ক্ষমতা ও উচ্চাশার এই স্বাদ—তা উগ্র, তেজস্কর মাধ্বীর মতো আচ্ছন্ন করেছে তাঁকে। ব্যাঘ্রসন্তান প্রথম মাংস ও রক্তের আস্বাদন পেলে যেমন আনন্দে, বিস্ময়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে—কতকটা তেমনিই অবস্থা ওঁর।

অনেক কাজ করতে হবে, অনেক কাজ বাকী। পরিকল্পনা এখনও অসম্পূর্ণ—নিত্য নূতন সংযোজন চলছে তাতে— মনে হচ্ছে তিনি না থাকলে ঠিক সুচারুরূপে তা সম্পন্ন হবে না। তাঁর মতো চারিদিকে দৃষ্টি রেখে কেউ করতে পারবে না। বলেনও তাই বাসুদেবকে, সবিনয়েই বলেন, ‘সখা, এই আমরা প্রথম রাজ্য পেলাম। সবই নূতন। আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। নিকটেই ঈর্ষী আত্মীয়—তারা অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত—দক্ষতা ও ক্ষমতা দুই-ই আয়ত্ত তাদের। আমরা এতাবৎ এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম, না জানি রাজনীতি, না জানি দণ্ডনীতি, না জানি ন্যায়নীতি। সবেতেই নূতন করে পাঠ নিতে হচ্ছে। এসব আয়ত্ত করতে এখনও প্রচুর সময় লাগবে।

বলতে বলতেই যেন মনেও জোর পান খানিকটা ফাল্গুনী বলেন, ‘কোন অভিজ্ঞতাই নেই, প্রতিক্ষেত্রে ঠেকে শিখতে হচ্ছে। এই নিয়ম প্রত্যেকের বেলায় খাটে না—অবস্থা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে হয়—সেও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। তাছাড়া সীমান্ত রক্ষার ব্যবস্থা, অপরাধী দমনের আয়োজন, সৈন্যবাহিনীকে শিক্ষা দেওয়া—অনেক কাজই তো বাকী। এখনই দেশত্যাগ কি সম্ভব, না উচিত?’

অনেকক্ষণ ধরেই বাসুদেবের ওষ্ঠপ্রান্ত মৃদু কৌতুকে বক্র হচ্ছিল, এখন তা অভ্যস্ত রহস্যময় হাসিতে রঞ্জিত হয়ে উঠল।

বললেন, ‘বন্ধু, এতই যদি আত্মবিশ্বাস আর আত্মনির্ভরতা—আমাকে এনেছ কেন? বার বার আমিই বা আমাদের সব কাজ ফেলে ছুটে আসছি কেন? শাসন ব্যবস্থা তো একটা সুশৃঙ্খল রূপ নিয়েছে—তবে তোমার এত চিন্তা কিসের? বেশ তো, আমি তোমার সমস্ত দায়িত্বভার নিজে গ্রহণ করছি—তোমার সমস্ত কল্পনা ভাবনা রূপায়ণের দায়িত্ব—তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাও।….সময় বড়ই অল্প বন্ধু। তোমার শক্তি ও মনীষা সামান্য মানবজনোচিত আবেগে প্রবৃত্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে—নইলে এসব কথা তোমাকে বোঝাতে হত না। শীঘ্রই এই ভারত ভূখণ্ডে আগুন জ্বলবে—বিপুল সর্বগ্রাসী হিংসার বহ্নি—সারা ভারতে রক্তবন্যা প্রবাহিত হবে। আলস্যে-বিলাসে লোভে-লালসায় ব্যসনে-সম্ভোগে সুরায়-অহিফেনে –এদেশের শাসকসমাজ ঘোর বেগে সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। লোভ থেকে অসূয়া ও পরশ্রীকাতরতা—তা থেকে সংঘর্ষ অনিবার্য। এই অলস ঐশ্বর্যভোগীদের থেকে দেশের কোন কল্যাণ কোন দিন আসবে না, এরা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভুলে গেছে—সেবা করার অধিকারকে সেবা পাওয়ার অধিকার বলে ভুল করছে ধর্ম ন্যায় নীতি এদের হাতে বন্দী, তার আর্তনাদ তুমি শুনতে পাচ্ছ না, আমি পাচ্ছি। এই শ্রেণীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না করলে এদেশের মুক্তি নেই, শান্তি নেই।

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যাদবশ্রেষ্ঠ, এবার ধনঞ্জয়ের হাত দুটি ধরে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার হাতে সেই মুক্তি আসার কথা—তোমার দ্বারাই। কিন্তু তার আগে সব দিক দিয়ে প্রস্তুত হও, প্রস্তুত থাকো—এই আমি চাই!’

অর্জুন মাথা নত ক’রে থাকেন, সম্মতিও প্রকাশ করেন কিন্তু নানা ছুতায় বিলম্বও করেন। নিত্য নূতন অছিলা উপস্থাপিত করেন।

শেষে একদিন করজোড়ে—আর দুটি বৎসর সময় প্রার্থনা করেন। এই দু বৎসর পরে তিনি নিশ্চয়ই যাবেন— প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

আরও দু বৎসর? সে কি? দু বৎসরই বা কেন?

চমকে ওঠেন বাসুদেব—কিন্তু সে এক লহমার জন্য। সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে থেকে একটা ধূমাবরণ অপসৃত হয়।

কারণটা স্পষ্ট হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

এতদিন এটা—এই স্পষ্ট ছবিটা চোখে না পড়ার জন্যই বিস্মিত, নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের উপর বিরক্ত হন।

কৃষ্ণা!!!

মাত্র একটি বছর পার্থ তাঁর সাহচর্য লাভ করেছেন। তার পর দু বছর ব্যর্থ কেটেছে। নকুল ও সহদেবের পালা শেষ হয়েছে। কৃষ্ণা এখন যুধিষ্ঠিরের ঘরণী। অবশ্য সে কাল শেষ হতে খুব বেশী বিলম্ব নেই আর—তবে তার পরও তো ভীমসেনের এক বছর বাকী থাকে!

কৃষ্ণাকে ঐ সামান্য সময় পেয়ে তৃপ্তি হয় নি, আশ মেটে নি এখনও।

সহস্র কাজের সহস্র দায়িত্বের মধ্যেও এই বীর ধনুর্ধর ও মহাসাধকের মন পড়ে আছে সেইখানে।

আশ্চর্য নারীর মায়া।

এত বড় শক্তিও মোহাচ্ছন্ন সুপ্ত হয়ে পড়েছে।

রমণীরূপের প্রবল মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারছেন না কিছুতেই, জাগ্রত হতে পারছেন না মানসসুপ্তি থেকে। এই সত্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ব্যঙ্গ ও ঈষৎ অবজ্ঞা মিশ্রিত কৌতুকে বাসুদেবের ওষ্ঠাধর আবারও কৌতুকবক্র হবার উপক্রম করে—কিন্তু প্রায় নিমেষকাল মধ্যেই আরও একবার চমকে ওঠেন তিনি।

সেই ক্ষণপূর্বের ব্যঙ্গবক্রতা লজ্জায় ও আত্মধিক্কারে করুণ হয়ে ওঠে। কারণ সেই আশ্চর্য বুদ্ধিধর তীক্ষ্ণদর্শী মানুষের কাছে নিজের মনের চেহারাটাও অস্পষ্ট থাকে না।

দেহধারণ করলে বুঝি দেহজ ইন্দ্রিয়ের কাছে বশ্যতা না স্বীকার ক’রে উপায় নেই। সে রিপুর দাসত্ব থেকে অতিমানবিক শক্তিরও অব্যাহতি পাওয়া কঠিন। সাধকই হোন আর ভগবদ্বংশেই জন্ম হোক—পূর্ব জন্মের যত সুকৃতি নিয়েই আসুন—দেহের ঋণ কড়ায় গণ্ডায় শোধ দিতে হবে দেহীকে।

বাসুদেবের সন্দেহ হল, এই যে অর্জুনকে দূরে সরানোর জন্য তাঁর এই ব্যগ্রতা ও ব্যাকুলতা—সম্ভবত এরও কারণ ঐ হোমাগ্নিসম্ভূতা পাবকশিখারূপিণী মেয়েটি—কৃষ্ণা

অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণার পক্ষপাত এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটা পাণ্ডবদের তত লক্ষ্যগোচর না হলেও বাসুদেবের দৃষ্টি এড়ায় নি।

আর তাতেই যেন অকারণ একটা অসূয়া অনুভব করেছেন।

না, না, ছি!

শিউরে ওঠেন বাসুদেব।

এসব কি ভাবছেন তিনি! সখী, আত্মীয়া, ভ্রাতৃবধূ।

দৈবকার্যে, দৈবপ্রেরিতা, দেবাংশজাতা কন্যা।

বহ্নি-উদ্ভূতা, বহ্নিস্বরূপা। কুরুবংশ ধ্বংসের জন্য আবির্ভাব।

মনে মনে নিজেকেই স্মরণ করেন তিনি।

অন্তরস্থ চৈতন্যস্বরূপ নিজসত্তাকে।

সামান্য মানবসুলভ এই মোহ থেকে মুক্তি পাবার জন্য সুপ্ত আত্মশক্তিকে সচেতন করার চেষ্টা করেন।

‘এই যে দেহটা বিচিত্র কারণে এখনও একটা ক্ষোভ অনুভব করছে, কিছুতেই সেই সামান্য অস্বস্তিটাকে দূর করা যাচ্ছে না, কেবলই বার বার একটা কথা মনে হচ্ছে, একটা অতৃপ্তি যে, অন্তঃপুর মহিষী ও সেবিকায় পূর্ণ হলেও এমন একজনও নেই—স্বকার্যসাধন, উদ্দেশ্যসাধনের এই বৈরীটার হাত থেকে আমাকে তুমি রক্ষা করো—হে বাসুদেব, হে নারায়ণ।’

অর্জুন তাঁর চিত্ত ও বুদ্ধির এক চরম সংঘর্ষের মধ্যেই বলে ফেলেছিলেন কথাটা। না বলে উপায় ছিল না বলেই। এ- দ্বন্দ্ব তাঁর লোকবিশ্রুত স্থৈর্যকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল যেন। একদিকে বিবেচনা ও বিচারবুদ্ধি তাড়িত করছিল বাসুদেব-নির্দিষ্ট পন্থার দিকে—অপরদিকে, আসক্তিই হোক আর মোহই হোক—কিছুতেই কৃষ্ণার চিন্তা থেকে, কৃষ্ণাকে ঘিরে অসংখ্য অতৃপ্ত স্বপ্ন-কল্পনা থেকে মুক্ত হতে পারছিলেন না প্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, প্রিয়তমাকে দীর্ঘদিন চোখের দেখা থেকেও বঞ্চিত হবার চিন্তায়— সেই জন্যই লজ্জা ও পরিহাসের ভয় বিসর্জন দিয়ে ঐ সময়টুকু প্রার্থনা করেছিলেন— দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পূর্বে অন্তত আর কিছুদিন তাঁর সান্নিধ্য ও সাহচর্য উপভোগ ক’রে যাবেন, প্রধানত সেই কথাটা মনে রেখেই–বোধ করি একটু মিথ্যাচারণ হচ্ছে জেনেও। প্রতারণাই করেছিলেন এক রকম। শুধু বাসুদেবকে নয়—নিজেকেও কিছুটা। কিন্তু সে-প্রতারণাটা মনের অগোচর ছিল না বলেই, প্ৰাৰ্থনাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধিকতর লজ্জিত বোধ করেছিলেন, কুণ্ঠা সঙ্কোচের অন্ত ছিল না।

সে-কুণ্ঠা ও সঙ্কোচ বহুগুণে বর্ধিত হ’ল, সেই সঙ্গে একটু আশঙ্কাও—পরদিন প্রভাতে উঠেই যখন শুনলেন বাসুদেব তাঁর ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাসাদ ত্যাগ ক’রে একাই খাণ্ডবারণ্যে চলে গেছেন। কেবল তাই নয়, কোন রক্ষী কি সঙ্গীসাথী এমন কি রথ বা সারথিও নিয়ে যান নি। নবনির্মিত নগরীর প্রাকারসীমায় রথ রেখে পদব্রজেই অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করেছেন।

তবে কি তিনি অর্জুনের প্রতি বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ হয়েই, এই গত কয়েক বছরের প্রায় নিত্যসহচরকে ত্যাগ ক’রে এই ভাবে একা চলে গেছেন? তবে কি—তবে কি চিরদিনের মতোই ত্যাগ করলেন পাণ্ডবদের? একের অপরাধে সকলকে দণ্ড দিলেন?

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সীমা-পরিসীমা রইল না।

সেই সঙ্গে কিছু কিছু আত্মনিপীড়ন, আত্মধিক্কারও।

বড়ই অপরাধী বোধ হতে লাগল নিজেকে।

আরও—বিপদ—আশঙ্কার কারণ, অনুমিত কারণটা, যাঁকে জানিয়ে পরামর্শ উপদেশ নেওয়া চলত, সেই যুধিষ্ঠিরকে জানানোও কঠিন। তাহলেই, কেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ শোনেন নি, কেন সময় ভিক্ষা করেছেন—তাও বলতে হবে। আর সেক্ষেত্রে কি তাঁর অন্তরের এই লালসা-লালাসিক্ত কলুষঘৃণ্য চেহারাটা—স্থিতধী পরমপ্রাজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের মানসদৃষ্টির অগোচর থাকবে? বিশেষ, অর্জুন তাঁর কাছে মিথ্যা বলতে পারবেন না। যেসব যুক্তি তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে উপস্থাপিত করেছিলেন, তা যে শ্রীকৃষ্ণকে প্রতারিত করতে পারে নি—সে বিষয়ে অর্জুন যেমন আজ নিশ্চিত— তেমনি যুধিষ্ঠিরও যে নিমেষকাল মধ্যে সেই যুক্তিজাল ছিন্ন ক’রে আপাত সত্য তথ্যরাজির মধ্য থেকে আসল কারণটিকে অনাবরিত করতে পারবেন সে-বিষয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

শুধু যুধিষ্ঠিরই বা কেন, আরও যে যে শুনবে, সে-ই বুঝবে। সূক্ষ্ম বুদ্ধিকৌশল প্রয়োগের এই পদ্ধতিটা এতই স্থ±ল— প্রথম প্রণয়-উন্মত্ততা মানুষকে নির্বোধাদপি নির্বোধ ক’রে দেয়, এতকাল পুঁথিপত্রে পড়েই এসেছেন, এখন নিজেকে উপলক্ষ ক’রে এই বাস্তব অভিজ্ঞতায় সে বচনের সত্যকার উপলব্ধি ও মর্মোদ্ধার ঘটল–যে, কারুরই বুঝতে বাকী থাকবে না আসল কারণটা।

বুঝবেন স্বয়ং দ্রৌপদীও।

ছি ছি, সে বড় লজ্জার!

অবশ্য মনকে একটা অতি ক্ষীণ আশ্বাস দেবারও চেষ্টা করেন, অর্থাৎ বোধ করি আরও একটা নির্বুদ্ধিতা প্ৰকাশ ক’রে ফেলেন। তিনি মনকে বোঝাতে চান যে, এই অরণ্যটি বড় প্রিয় বাসুদেবের। ঐ কণ্টকগুল্ভমে দুষ্প্রবেশ্য, প্রস্তরখণ্ডে বন্ধুর পার্বত্য অরণ্যের মধ্যে কী আকর্ষণ আছে তা যদুনন্দনই জানেন—কী রস তিনি আস্বাদন করেন মধ্যে-মধ্যেই, ইন্দ্রপ্রস্থে থাকলে তিনি ঐ অরণ্যে চলে যান এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে বেশীর ভাগ সময়ই অর্জুনও সঙ্গে থাকেন, তবে রুক্ষ, আতিথ্য-স্নিগ্ধতাহীন প্রকৃতির এই কণ্টকিত রূপের মধ্যে কী মাধুর্য আছে, পার্থ তা ভেবে পান না।

ওঁর মনে আছে, এখানে আসবার সময়ই অর্জুন এক স্থানে—যেটা অপেক্ষাকৃত বনস্পতিবহুল—এই আরণ্যভূমির দুর্ভেদ্যতা ও দুর্গমতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, শ্রীকৃষ্ণ ঈষৎ ভাব-গাঢ় কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মানুষের বাসভূমি থেকে এ বনভূমি অনেক শ্রেয় অর্জুন! এখানে অকারণ ঈর্ষা নেই, হিংসা নেই–লোভ লালসা মাৎসর্য কিছুই নেই। কাম আর ক্রোধ হয়ত আছে—কিন্তু এখানে সেটা কেউ গোপন করার চেষ্টা করে না, সে প্রবৃত্তি বা রিপুর আদিম সরল মূর্তিটাই চোখে পড়ে। প্রবৃত্তির বর্বর চেহারা দুঃসহ—কিন্তু কাপট্যে আবরিত হলে তা অসহ হয়ে ওঠে।…ঐ বনস্পতিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি বন্ধু, ছায়া ও আশ্রয় দিয়ে ওরা প্রাণপণে উপকারই ক’রে যাচ্ছে জীবজগতের। ওদের কথাই বা বলছি কেন, এই বনভূমিতে যে মাংসভুক পশুরা ঘুরে বেড়ায়, যাদের আমরা হিংস্র শ্বাপদ বলি— মানুষের অপেক্ষা তারাও ভাল। প্রাণধারণে আহার্যের প্রয়োজন না হলে তারা হিংসা করে না, ক্ষুধা না থাকলে তারা শুধু রসনা চরিতার্থ করার জন্য ভোজন করে না। আরও কিছু অভিজ্ঞতা হোক—বুঝবে ওদের থেকে মানুষ অনেক বেশী হিংস্র, প্রাণী হিসেবে অনেক বেশী ইতর।

এই সব সময়গুলোতে শ্রীকৃষ্ণকে বুঝে উঠতে পারেন না অর্জুন…কেমন যেন ভয়-ভয় করে। মনে হয় যে মানুষটি ওঁকে সখা বলে বন্ধু বলে অভিহিত করেন, সে মানুষটির এক বিরাট সত্তা, তাঁর মনোজগতের অনেকখানিই আজও অজ্ঞাত থেকে গেছে ওঁর কাছে।

নইলে, ঐ যে কৃষ্ণকায় অনার্য লোকটা—অকারণে ওঁদের গালিগালাজ অভিসম্পাত করল—ভীমসেন ক্রদ্ধ হয়ে তাকে বধ করতে উদ্যত হলে উনি অমনভাবে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে তাকে রক্ষা করবেন কেন? পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল লোকটার অত আক্রোশ বা বিদ্বেষের হেতু কি—তবে তখন তো কেউই জানত না। শ্রীকৃষ্ণরও জানবার কথা নয়—কিন্তু না জানলেই বা তাকে ক্ষমা করবেন কেন? তবে কি উনি সত্যই অন্তর্যামী?

আজ আবারও সেদিনের সেই অপ্রীতিকর—অস্বস্তিকরও বটে—ঘটনাটা সদ্য-সংঘটিতবৎ অর্জুনের স্মৃতিপটে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

মাংস ও চর্মব্যবসায়ী, কদন্নভোজী, নীচকর্মা নিষাদ একজন। তার পরিধানে দুর্গন্ধময় মললিপ্ত ছিন্ন বস্ত্র, আমচর্মের অঙ্গরক্ষক, হাতে ধনুর্বাণ—তার চক্ষুকোণে বহুদিনের ক্লেদ তৈলহীন, প্রায়-জটাবদ্ধ পিঙ্গল কেশ—গাত্রচর্মও স্নানাভাবে ভস্ম-ধূসরবর্ণ ধারণ করেছে—সূক্কণীতে পূর্বদিনের সুরাপান ও অর্ধদগ্ধ রুধিরাক্ত মাংস ভোজনের চিহ্ন—এক কথায় মূর্তিমান পিশাচ।

ওঁরা সে-সময় রথ-অশ্বাদি ত্যাগ ক’রে পদব্রজেই সঙ্কীর্ণ, অপরিসর পথে গভীর বনভূমি অতিক্রম করছিলেন—উনি আর বাসুদেব। সেই সঙ্কীর্ণ পথেরই ঠিক মধ্যস্থলে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। তার মস্তিষ্কের অবিরাম-সুরাপানজনিত জড়তা তখনও অপনোদিত হয় নি, পদক্ষেপ তো কষ্টকর বটেই, স্থিরভাবে দাঁড়াতেও পারছে না। ওঁরা কাছে যেতেও—সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে না দিয়ে ভ্রূকুটিবদ্ধ দৃষ্টিতে, অবজ্ঞাভরে একবার ওঁদের দিকে চেয়ে একটা কুৎসিত কটূক্তি ক’রে উঠল। সেই সঙ্গে ধনুতে শরযোজনারও চেষ্টা করল কিন্তু হাত বা পা কোনটাই ঠিক স্ববশে না থাকায় কিছুতেই সে ধনুঃশর লক্ষ্যলগ্ন করতে পারল না।

অর্জুন বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কীট–বিষদংস্ট্রা না হলেও অস্বস্তিকর গাত্র-কণ্ডুয়নহেতু—তাকে পদতলে পিষ্ট করাই রীতি অর্জুনও সেইভাবে তাঁর দিবারাত্রের সঙ্গী ধনুর দিকেও তাকিয়েছিলেন একবার ইতিমধ্যেই মধ্যম পাণ্ডবও বাসুদেবের দেখাদেখি সেই পাদপরিসর পথেই আসছিলেন, দূরত্ব সংক্ষিপ্ত হওয়ার আশায়—তিনি এই বাধায় ক্রদ্ধ ভ্রূকুটি ক’রে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের এসব কোন বৈলক্ষণ্যই দেখা গেল না। তিনি বরং প্রশান্ত প্রসন্নস্মিত মুখেই সেই অপরিসর পথ ছেড়ে কণ্টকগুল্ভমের মধ্য দিয়েই লোকটিকে পরিহার ক’রে যাবার চেষ্টা করলেন।

এইবার কিন্তু অকস্মাৎ যেন লোকটির মত্ততা কেটে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টলছিল একটু একটু—এখন যেন পা- দুটো প্রকৃতিস্থ ও আজ্ঞাবহ বোধ হ’ল। সেও ক্ষিপ্রপদে সেই প্রস্তরকণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর ভূমিতে নেমে এসে পুনশ্চ ওঁদের পথ রোধ ক’রে দাঁড়াল। তারপর সুরা-রোষ-রক্তিম ক্রর দৃষ্টিতে ওঁদের দিকে চেয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও! অত ব্যস্ততার কোন হেতু নেই। তোমরা—তোমরা পাণ্ডব না? ঐ যে বিরাট দলটি অবিরত বৃক্ষচ্ছেদন ও মৃগনাশ করতে করতে নূতন নগরী পত্তন করতে চলেছে—তোমরাও তো সেই দলের? বেশ হর্ষোৎফুল্ল চিত্তেই সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ, না? বাঃ বেশ।’

আবারও ভীমের হস্ত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল, অর্জুনের ভ্রূকুটি ভয়ঙ্করতর হ’ল কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অভ্যস্ত মিষ্ট গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ। ইনিই তৃতীয় পাণ্ডব, ফাল্গুনী। পিছনে ইনি ত্রিলোকখ্যাত মহাবল ভীমসেন, দ্বিতীয় পাণ্ডব। কিন্তু তুমি কে? এভাবে আমাদের পথে বাধাসৃষ্টি করছ কেন? তোমার আকৃতি ও পরিচ্ছদে বোধ হচ্ছে তুমি নিষাদ, পশুবধ ক’রে মাংস-আহরণে এসেছ। তা আমরা তো তোমার কাজে বাধা দিচ্ছি না, তোমার প্রতিযোগীও নই, তবে তুমি এই উষ্মাই বা প্রকাশ করছ কেন, আর সর্বনাশ শব্দই বা উচ্চারণ করলে কী কারণে?’

লোকটি এতক্ষণ—শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্য তার কানে যাচ্ছে কি না বোঝাই গেল না—একদৃষ্টে অপলকনেত্রে ভীমসেনের দিকে চেয়েছিল। সে দৃষ্টি অপসারিত না ক’রেই উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমি নিষাদ। আমার নাম কীলক।’

বলতে বলতে তার কণ্ঠস্বর যেন আরও উগ্র, দৃষ্টি আরও রোষকষায়িত হয়ে উঠল, একটু এগিয়ে একেবারে অর্জুনের সামনে এসে বলল ‘নামটা শুনে মনে পড়ল কিছু? আমাকে চিনতে পারলে?’

অর্জুন বিরক্ত হয়েছিলেন, এবার বিস্মিত হয়ে তার দিকে ভাল করে তাকালেন, কিন্তু আপাদমস্তক নিরীক্ষণ ক’রে ও পরিচয়ের কোন সূত্র ধরতে পারলেন না। বললেন, ‘না বাপু, কই তোমাকে তো চিনি বলে মনে পড়ছে না! তুমিই পূর্ব- পরিচয়ের সূত্রটা ধরিয়ে দাও বরং। আমরা কি ইতিপূর্বে তোমার কোন অপ্রীতির কারণ হয়েছিলাম?… জ্ঞানত কোন অনিষ্ট করেছি বলে তো স্মরণ হচ্ছে না। যদি করেও থাকি—সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে।’

এত সৌজন্য ভীমসেন বোঝেন না। তিনি তাঁর হস্তস্থ গদাসম স্থ±ল দণ্ডটি দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে অর্জুনকে ঠেলে এগিয়ে এলেন এবার। এই মূঢ় ধৃষ্টটা নিয়তিতাড়িত হয়েছে, অধীর হয়ে উঠেছে মৃত্যুকে বরণ করার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা মিটিয়েই দেবেন আজ।

কিন্তু কীলক ভয় পেল না। মনে হ’ল তার মৃত্যুতে কোন ভয় নেই। বরং যেন সম্ভাব্য মৃত্যুকে স্পর্ধা প্রকাশ করতেই তাই বাচনভঙ্গী ও কণ্ঠ, শুধু প্রকৃতিস্থই নয়, ব্যঙ্গবক্র হয়ে উঠল আরও। সে বলল, ‘এই যে মহাবাহু মহাবল ভীমসেন, যাত্রাপথের বাধাসৃষ্টিকারী নীচ-জাতি পাপিষ্ঠটাকে বধ করতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন। তা বটে, আমিই বা অবশিষ্ট থাকি কেন!…ভীমসেন, তুমিই বেশী অপরাধী। বুদ্ধি যারই হোক, সেটাকে কার্যে পরিণত করেছ তুমিই।…অপ্রীতি! অপ্রীতির কারণ তোমরা জান না, না? অনিষ্ট করেছ বলেও মনে পড়ছে না! তা পড়বে কেন? যে অনিষ্ট করে তার তো তা জানবার কি মনে রাখার কথা নয়। যার হয় সে-ই রাখে। যে কীট পদদলিত হয়, কীট হলেও মৃত্যুযন্ত্রণা তার সমানই লাগে। মহা আনন্দে নূতন রাজধানীর পত্তন করতে চলেছ, নূতন রাজ্যসুখ ভোগ করবে বলে ….শুনে রাখো—এই সুরাপায়ী কদাচারী নিষাদের কথাগুলো মনে রাখবার চেষ্টা ক’রো—এ রাজধানী এ রাজ্য তোমাদের ভোগে হবে না, সুখেশান্তিতে কোন দিনই সম্ভোগ করতে পারবে না। এই রাজ্য আর ঐশ্বর্য মহা অশান্তির কারণ হবে, স্বর্ণপালঙ্কের সুখশয্যা কণ্টকশয্যা হয়ে উঠবে। মহাশ্মশানে পরিণত হবে এ রাজ্য, তোমরা সেই শ্মশানপ্রহরী চণ্ডালের মতো বেঁচে থাকবে শুধু। অকারণে আমার সমস্ত স্বজন, প্রিয়জন নাশ করেছ, নির্বংশ করেছ—হাহাকার সম্বল করেছ জীবনে—তোমাদেরও স্বজন বলে কেউ থাকবে না, সমস্ত ভোগৈশ্বর্যের উপকরণ বিষ হয়ে উঠবে। তোমাদের শোক আর হাহাকার সম্বল হবে।…যাও, এই পথ ছেড়ে দিচ্ছি, চলে যাও নির্বিঘ্নে—আবারও বলছি, শ্মশানরাজ্যের দিকে, মহা সর্বনাশের দিকে।’

সে সত্যিই এঁদের পথ ছেড়ে দূরে সরে গিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। কিন্তু এবার অর্জুনই ঘুরে গিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘দাঁড়াও। তুমি কেন এমন ভাবে আমাদের সম্বন্ধে এই কটূক্তি আর অভিসম্পাত করছ— তার সঙ্গত কারণ না দেখালে তোমার অব্যাহতি নেই। আমরা কোন অবিচার করতে চাই না—আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমার কি বলার আছে তা নিশ্চয়ই শুনব, কিন্তু তা যদি না বলতে পার তাহলে অবশ্যই শাস্তি নিতে হবে। তোমাকে বধ করলে আমাদের হস্ত ও অস্ত্র কলুষিত হবে, অন্য কঠোর শাস্তি দেব। মদ্যপের প্রলাপ বলে ক্ষমা করারও একটা সীমা আছে, স্মরণ রেখো।’

‘ও, তাই নাকি! অবিচার করতে চাও না, না? ক্ষমা তোমরা করতে চাও? কে চাইছে সে ক্ষমা? বিচারই তো আমি চাই, বিচার আর অপরাধীর শাস্তি। সুবিচারবোধের বড় অহঙ্কার তোমাদের, না? উচিত তো। রাজত্ব করতে যাচ্ছ, রাজবংশের সন্তান, নিজেরা রাজা—তোমাদের কাছে সুবিচারই তো আশা করি।…আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের আগে আমিই সুবিচার প্রার্থনা করছি। আমার অভিযোগ পাণ্ডুপুত্রদের নামে। অকারণে প্রাণনাশ, আশ্রিত নাশ, আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা—এই তিনটি অভিযোগ। সুবিচারই চাই আমি, ন্যায় ও ধর্মমতে সুবিচার!…করো এবার বিচার।’

শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু সর্বক্ষণ প্রশান্তমুখে স্থির দৃষ্টিতে এই নিষাদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুনের মনে হ’ল তাঁরও ওষ্ঠপ্রান্তে ঈষৎ একটু বিরূপ-হাস্যভঙ্গী। এইটেই প্রবল বিস্ময়কারণ অর্জুনের কাছে।

এবার কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কাছে এগিয়ে এলেন। তাঁর কণ্ঠে উম্মা কি বিরক্তির লেশমাত্র নেই, সহজ ভাবেই বললেন, ‘বাগাড়ম্বর বা রহস্যঘন ভাষা ত্যাগ ক’রে তোমার অভিযোগটা যদি স্পষ্ট ও সরল ভাষায় প্রকাশ করো তো এঁদের বোঝবার বা উত্তর দেওয়ার সুবিধা হতে পারে।’

পূর্বের সে সুরামত্ততা ও ঔদ্ধত্যের চিহ্নমাত্র নেই তখন আর কীলকের, তার ক্রোধ বোধ করি চরমে ওঠাতেই তার গলার স্বর শান্ত হয়ে উঠেছে, শুধু লক্ষ্য করলে দেখা যেত যে সেটা শাণিত বলেই শান্ত শোনাচ্ছে। সে বলল, ‘স্পষ্ট প্রাঞ্জল ভাষাতেও বলতে পারি বৈকি। তুমি তো দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণ, এদের পরামর্শদাতা। তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, তুমি সবই বুঝেছ, তবে আর আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছ কেন?… রাজা, রাজা কেন, ক্ষত্রিয়মাত্রেরই শুনেছি, আশ্রিত ও আশ্রয়প্রার্থী কে রক্ষা করা, বিশেষ যে সরল বিশ্বাসে নির্ভরতার সঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছে—তাকে রক্ষা করার জন্য অনায়াসে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়াই ধর্ম। তাই না?… কিন্তু এই পাপিষ্ঠ নরকীটগুলো নিজেদের অকিঞ্চিৎকর প্রাণগুলোর জন্য—তাও তখনই সে প্রাণ এত বিপন্ন হয় নি— কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে সদ্য নিজেদের প্রাণরক্ষার মতো অবস্থাও হয় নি—তা হলেও এ কুকার্যের যুক্তি থাকত—সে রকম কোন কারণই ছিল না–সুদূর ভবিষ্যতে কোন একদিন হয়ত সে প্রাণ পুনঃবিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কা দূর করতে–বেঁচে থেকে রাজৈশ্বর্য নারীসম্ভোগ করার লোভে –অনায়াসে, অকারণে ছটি প্রাণ নষ্ট করেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে!… আরও প্রাঞ্জল ভাষায় শুনতে চাও?… আমার স্ত্রী ও পাঁচটি শিশুপুত্রদের—আমি পশুশিকারে দূর অরণ্যে গিয়েছিলাম, সেই অবসরে—সুখাদ্য ও সুপেয় সুরার প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, এই এরা। হ্যাঁ, মৃত্যু সামনে দেখলে কারও অকারণে পানভোজন উৎসব করার ইচ্ছা হয় না—ব্রাহ্মণ-ভোজনের নাম ক’রে ইতর ভদ্র অনার্য নীচ জাতি সবাইকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল—জাল পেতে যেমন নিষাদরা পাখি ধরে, বন্য পাখির সঙ্গে কোন কোন চিহ্নিত মূল্যবান পাখিও এসে পড়বে এই আশায়—এও, আমার স্ত্রী-পুত্ররাও এই জালে ধরা পড়বে এই আশাতেই এত আয়োজন। আমি একাধিক প্রত্যক্ষ দর্শীর কাছ থেকে যে বিবরণ শুনেছি—তাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তাদের আহার করানো হয়েছে—সেও স্বাভাবিক, ভদ্র উচ্চবর্ণের লোকদের ভোজন শেষ হলে তবেই এই ইতরদের খেতে দেওয়া হবে, এইতেই অভ্যস্ত সবাই—এদের যত না খাদ্য দেওয়া হয়েছে তত মদ্য, বিনামূল্যে বিনা পরিশ্রমে উৎকৃষ্ট সুরা—নীচজাতীয় স্ত্রীলোকটা আকণ্ঠ পান করবে তাও এরা জানত। তাই হয়েও ছিল, মদ্য পান করতে করতে আমার স্ত্রী অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল। তা না পড়া পর্যন্ত এরা পরিবেশন থামায় নি—ঈশ্বর জানেন, শুধুই সুরা না অন্য মাদক ছিল তাতে—সে বেচারী উঠে দাঁড়াতে কি চলে যেতে পারে নি, সূর্যাস্তের পর অন্ধকারে ঐ অবস্থায় কোথায় যাবে সে! সঙ্গে পাঁচটি ছেলে ছিল, যদিও তারাও প্রচুর সুরা পান করেছে, সেই সঙ্গে বহুদিন পরে বহু সুখাদ্য—তাও আশ পুরিয়ে খেয়েছে—আর কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করে নি আমার স্ত্রী—এদের আশ্রয়ে কোন অনিষ্টের হেতু নেই এই আশ্বাসও ছিল—তারা সেখানেই মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিশ্চিন্ত মনে। সেই সুযোগে এরা—হ্যাঁ, ঐ সুযোগেরই অপেক্ষায় এত আয়োজন এদের—সমস্ত বাড়িটির চতুর্দিকে আগুন লাগিয়েছে সমস্ত বাড়িটি বেষ্টন ক’রে, চক্রাগ্নি বা বেড়া আগুন যাকে বলে, তার পর নিজেরা নিরাপদে সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে এসেছে, ঐ নিরপরাধ অচৈতন্য স্ত্রীলোক ও বালকগুলোকে নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে ফেলে। কেন জান যদুনাথ? যাতে এদের অস্থি দেখে সকলে স্থির করে যে পঞ্চপাণ্ডব আর তাদের বহুজনবল্লভা মা-টাই পুড়েছে, ওদের খুঁজে বার করার আর চেষ্টা না করে।’ তার পর একটু থেমে সব্যঙ্গে আবারও বলে, ‘কেমন, অভিযোগ বেশ স্পষ্ট ভাষাতেই ব্যক্ত হয়েছে তো? এবার সুবিচার করো। তোমাদের রাজ্যশাসনের প্রারম্ভে এই বিচারই প্রথম বিচার হোক তোমাদের!

ভীমসেন জননী সম্বন্ধে ব্যঙ্গোক্তি শুনে পুনশ্চ উগ্র বেগে তাঁর দণ্ড উদ্যত ক’রে এগিয়ে যাচ্ছিলেন—শ্রীকৃষ্ণ মাত্র বাম হস্তেই তাঁকে নিবৃত্ত ও সংযত করলেন।

সেদিন প্রভাতকাল থেকেই বিস্মিত হবার পালা চলেছে ফাল্গুনীর— কিন্তু এ বিস্ময় অপরিমাণ। ক্রদ্ধ ভীমসেন কারও প্রতি অস্ত্রবদ্ধ-করে ধাবিত হলে তাঁকে এত অনায়াসে সম্বরণ করতে পারে এমন শক্তিধর অদ্যাপি দেখেন নি অর্জুন। বাসুদেবের নবনীত-কোমল দেহে এমন দৈহিক বীর্য আছে তা তিনি কখনও কল্পনা পর্যন্ত করেন নি। এখন বুঝলেন যে তাঁর সম্বন্ধে অগণিত অসুরবধের যে কিম্বদন্তী প্রচলিত আছে, কেবলমাত্র হস্ত দ্বারা কংসবধের কাহিনী— তা অলীক কল্পনা নয়, তার মূলে সত্যও আছে।

বিস্মিত হলেন ভীমসেনও। শুধু তাই নয়, এই অবিশ্বাস্য দৈহিক বলের পরিচয় পেয়ে তিনি যেন কেমন কুণ্ডলীবৎ সঙ্কুচিত হয়ে গেলেন, কোন প্রতিবাদবাক্য উচ্চারণেরও ক্ষমতা রইল না।

ভীমসেনকে প্রতিনিবৃত্ত ক’রে শ্রীকৃষ্ণ কীলককেই সম্ভাষণ করলেন, বললেন, ‘আত্মরক্ষার্থে কোন কাজই অনুচিত বা দণ্ডাহ নয়—ন্যায়শাস্ত্রে এ বিধান আছে।’

‘কিন্তু এখানে কি আত্মরক্ষার জন্যই এ হত্যা করা হয়েছিল? তখন তো এরা কৌরব-শত্রুতার বাইরেই চলে যাচ্ছিল, ভবিষ্যতে আর কোন বিপদ না আসে— সেজন্য এতখানি শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতাও কি তোমার ন্যায়শাস্ত্র সঙ্গত?’

‘ভবিষ্যৎ প্রাণভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থাও আত্মরক্ষার মধ্যে পড়ে বৈকি নিষাদ।

‘অ। এটা আমার জানা ছিল না। আমি মূর্খ, শাস্ত্র পড়ি নি। তোমার কথাই বিশ্বাস করছি। তবে যদি সত্যই এ আচরণ পাপ না হয়, শাস্ত্রে এ ক্ষমার নির্দেশ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সে ন্যায়নীতি তোমাদের মতো সুবিধাবাদী অন্যায়-অধর্মচারীরই রচনা। তোমাদের কাছে আমি আর বিচার প্রার্থনা করব না। কোন মনুষ্যত্বই আশা করব না আর। তোমাদের অত্যাচার প্রতিনিবৃত্ত করার শক্তিও নেই, সে চেষ্টাও করব না—তোমাদের ইচ্ছা হয় আমাকে বধ করতে পারো, বা তৃতীয় পাণ্ডব যে তার অধিক শাস্তির ভয় দেখিয়েছিল, তাও দিতে পারো— তবে আমার অভিসম্পাত আমি ফিরিয়ে নেব না। আমার বিবেক আমার কাছে সব শাস্ত্রের বড়, সেই বিবেক অনুসারে তোমরা অপরাধী। অপরাধীর অপরকে বিচার করারও অধিকার নেই।

কীলক আর ওঁদের দিকে চাইল না, ওঁরা ওকে বধ করতে উদ্যত কিনা তাও জানতে চাইল না, ধীর পদক্ষেপে আরও নিবিড় অরণ্যে প্রবেশ করল।

অর্জুন তাকিয়ে দেখলেন বাসুদেবের মুখে তখনও সেই দুর্বোধ্য প্রসন্নতা, স্মিত মুখ।

কে জানে কেন, অর্জুন বা ভীমসেন কেউই আর ঐ ক্ররকর্মা নিষাদটার পশ্চাদ্ধাবন কি তাকে শাস্তি দেবার কোন উৎসাহ বোধ করলেন না।

এই ঘন অরণ্যের সুউচ্চ বৃক্ষশীর্ষের শাখাপ্রশাখা পত্রপল্লবে এখনও প্রভাত-আলোর নর্তন অব্যাহত, চারিদিকের বৃক্ষচূড়ে বিভিন্ন পক্ষীর বিচিত্র মধুর কূজনও বন্ধ হয় নি— মিশ্রিত বন্যপুষ্প ও শিশিরস্নিগ্ধ-মৃত্তিকার সৌরভ নিঃশ্বাসে প্রবেশ ক’রে ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে তেমনিই প্রফুল্ল ক’রে তুলছে— চতুর্দিকে প্রকৃতির আনন্দ-সমারোহ এতটুকু ম্লান কি ক্ষুণ্ণ হয় নি কোথাও— শুধু এই নবজীবনযাত্রী দুটি তরুণের কাছে এ সমস্তই যেন ব্যর্থ বোধ হতে লাগল, তাদের বিপুল আশা ও সীমাহীন উৎসাহের যেন আর অবশেষ কিছু রইল না। অকারণ একটা অপরাধবোধের ক্লিন্নতায় তাঁদের অন্তর ক্লিষ্ট ও চিন্তাভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে— একটা অজ্ঞাত অশুভ আশঙ্কার ছায়া তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার আকাশকে কিছুতেই নির্মল ও উজ্জ্বল হতে দিচ্ছে না।

তাঁরা গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে বাসুদেবের অনুসরণ করলেন।

ভীমার্জুন যে সেদিন ঐ স্পর্ধিত নীচকর্মা কদর্য লোকটার ধৃষ্টতার সমুচিত প্রত্যুত্তর দিতে পারেন নি— যদিচ বার বার নিজেদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, ঐ পশুরও অধম সুরাপায়ী কদন্নভোজী লোকটার এই অসহ স্পর্ধার উপযুক্ত শাস্তিদান করাই কর্তব্য ছিল অন্তত ওর অভিসম্পাতকে কিছুমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই তবু যে কিছুতেই সহজ, প্রকৃতিস্থ ও বিষাদমুক্ত হতে পারেন নি, নীরবে এক অপমানের জ্বালা ও অজ্ঞাত আশঙ্কার অস্বস্তি ভোগ করে গেছেন— সেজন্য মনে মনে বাসুদেবকে দায়ী ক’রে একটি নিগূঢ় অভিমান বোধ করেছিলেন।

বাসুদেব ওকে মিষ্ট ব্যবহারের দ্বারা প্রশ্রয় দেবার এবং ভীমকে অযথা নিবৃত্ত করার ফলেই, এতখানি স্পর্ধা প্রকাশ ক’রেও নিরাপদে চলে যেতে পারল— সে অভিমানের যেন এইটিই অনুক্ত কারণ।

অথচ সত্যাশ্রয়ী অর্জুন এ তথ্যটাও একেবারে অস্বীকার করতে পারছিলেন না যে, লোকটার অভিযোগের মূলে কিছুটা সত্যের ভিত্তি আছে। একেবারে মিথ্যা কি অযৌক্তিক নয় বলেই সেদিন তাঁদের নিরুত্তর থাকতে হয়েছিল এবং অবস্থা বুঝে তাঁদের সম্মানরক্ষার্থেই শ্রীকৃষ্ণ একটা অতি দুর্বল যুক্তি উপস্থাপিত করার চেষ্টা করে বর্ধমান অপ্রীতিটা চাপা দিতে চেয়েছিলেন। তবু, অভিমান তো যুক্তিতর্কের ছাড়পত্র বা অনুমতির অপেক্ষা করে না, বিশেষ সেদিন ঐ নিষাদের ব্যঙ্গোক্তি ধিক্কার বা অভিযোগের উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বলেই— লজ্জা আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে অভিমানের আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিনকার উপায়হীন প্রতিকারহীন অপমানবোধ অপর কাউকে, অপর কিছুকে দায়ী করতে না পারলে তাঁদের অব্যাহতি দিত না, তাঁরা মুখ দেখাতে পারতেন না তাঁদের অধস্তনদের কাছে। মানুষমাত্রেই এই মনোভাব পোষণ করে— ভীমার্জুনও মানুষ। …

আজও সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিটা স্মরণে আসা মাত্র, অর্জুন আবারও এক দুর্বার অভিমান বোধ করলেন বাসুদেব সম্বন্ধে। যেন ওঁদের লজ্জা ও অপমান থেকে বাঁচাতে বাসুদেবেরই উচিত ছিল ধৃষ্ট অভদ্র লোকটাকে বধ করা। তাহলে এঁরা বিবেকের কাছে মুক্ত থাকতে পারতেন অথচ অপমানের গ্লানিটা এমন ভাবে সহ্য করতে হত না।

সেদিনের সে ঘটনা স্মরণ হতে অভিমান উদ্বেল হয়ে উঠল অর্জুনের। কিন্তু হায়, তিনি যদি জানতেন, যদি জানা সম্ভব হত— আজ এই মুহূর্তে, কোন উদ্দেশ্যে, কোন স্বকার্য সাধনে বাসুদেব একা খাণ্ডব অরণ্যে প্রবেশ করেছেন, তাহলে এ অভিমান, অভিমান কেন সমস্ত অনুভূতিই তাঁর শিলীভূত হয়ে যেত, স্বীয় মৃত্যু ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা থাকত না। আর, বাসুদেব সম্বন্ধে তাঁর যে সীমাহীন বিস্ময়— তা আরও দুর্বোধ্য, আরও কল্পনাতীত হয়ে উঠত।

হয়ত ক্ষোভ, দুঃখ বোধ করতেন। বিরক্তি? উষ্মা?— না, এসব বোধ করার শক্তিই অর্জুনের নেই ঐ মানুষটি সম্বন্ধে ওঁর কার্যকারণের অবিশ্বাস্য সূক্ষ্মতা অর্জুনের মনে যে সম্ভ্রম ও ভীতির উদ্রেক করেছে— তাতেই বিরক্ত হওয়ার আর কোন উপায় রাখে নি।

এবং ঐ ক্ষোভ দুঃখ প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অনুভূতিগুলিও পরে— অনেক পরে বোধ করতেন। দীর্ঘকাল পরে— প্রস্তরীভূতবৎ জড়তা কাটলে।…

বাসুদেব সেদিন গহন অটবীতে একা প্রবেশ করেছিলেন সেই পিশাচমূর্তি নিষাদটারই সাক্ষাৎলাভের আশায়।

কীলকের সন্ধানে ইতিপূর্বে আরও কদিন এসেছেন। সেসব দিনে অর্জুনকে পরিহার ক’রে একাই আসেন। অর্জুন ভাবেন নির্জনে আত্মস্থ বা ধ্যানস্থ থাকার প্রয়োজনেই কণ্টকগুল্ভমসমাকীর্ণ, হিংস্র পশু-অধ্যুষিত গহনে প্রবেশ করেন। বাসুদেবের মনের বিচিত্র গতির সন্ধান পাওয়া— সন্দেহ করাও অর্জুনের সাধ্যাতীত—তা ভাসা-ভাসা ভাবে বোধ করলেও এমন ভাবে বোঝেন নি কখনও।

কীলক যে মধ্যে মধ্যে এই বনে আসে, বাসুদেব তা নির্ভুল ভাবেই অনুমান করেছিলেন। সে একা, নিঃসঙ্গ। কোথাও নতুন ক’রে বাসগৃহ বা সংসার স্থাপনের চেষ্টা করে নি, সম্ভবত ভবিষ্যতেও করবে না। এটা সেদিনের কথোপকথন থেকেই বুঝেছেন। তারও পূর্ব হতে ওর সংবাদ রাখেন তিনি। যেদিন নিঃসংশয় হয়েছিলেন যে বারণাবতের জতুগৃহে দগ্ধাবশিষ্ট নরকঙ্কালগুলি পাণ্ডবদের নয়— হতে পারে না, সেদিনই বিশেষ শিক্ষিত ও বিশ্বস্ত চর প্রেরণ ক’রে বারণাবতের চতুষ্পার্শ্বে সন্ধান করেছিলেন যে সে ভাগ্যচিহ্নিত দিনটিতে তাঁর পিতৃসা পৃথার আমন্ত্রণে যারা ঐ জতুগৃহে এসেছিল তাদের মধ্যে কে কে আর ফিরে যায় নি।

সেই চরই নিষাদীর সন্ধান দিয়েছে। পরিচয়ও। আর সে তথ্য জানার পর থেকেই কীলককে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি। ভাগ্যের ও মানুষের এই মিলিত অবিচারের জন্য তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহার বহ্নি বহন করে নিশ্চিত সে একাই কোথাও আছে। এতখানি জ্বালা তাকে কখনই স্থির থাকতে দেবে না— এও ধ্রুব।

কিন্তু প্রতিহিংসাস্পৃহা ও ক্ষুব্ধ অভিমান—যা-ই মানুষকে দগ্ধ করুক না কেন, ক্ষুধার জ্বালা আরও বেশী। নিষাদের খাদ্য বা খাদ্য উপার্জনের উপায় নিবিড় অরণ্য ছাড়া কোথাও নেই। সুতরাং অবিচ্ছিন্নভাবে বাস না করলেও ঘুরে-ফিরে তাকে কোন-না-কোন বনস্থলীতেই আসতে হবে। তবে চতুর্দিকে অরণ্যানীর অভাব নেই বলেই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটি কোন বিশেষ কেন্দ্রবিন্দুতে সীমাবদ্ধ করতে পারেননি।

এই রকম অনুমান করেছিলেন বলেই— সেদিন ওকে দেখা মাত্র চিনেছেন। জীবনে যার লক্ষ্য নেই, আশা নেই যার গৃহ নেই গৃহ-সুখ নেই—সে-ই এমন ভাবে দেহকে উপেক্ষা ক’রে ঘুরে বেড়াতে পারে, জীবনকে তাচ্ছিল্য করতে পারে

সেদিন চিনেছেন কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাতে পারেন নি। তাঁর বক্তব্য কারও সাক্ষাতে বলা যাবে না। তার পর থেকেই মধ্যে মধ্যে এখানে আসছেন কীলকের খোঁজে। সে কোথায় থাকে প্রশ্ন করে কোন লাভ হত না, কবে আবার দেখা হতে পারে সে প্রশ্নেরও অবসর ছিল না, হয়ত তাও নিরর্থক করা হত। দৈবক্রমে দেখা হয়েছে, আবার দৈবানুগ্রহেরই অপেক্ষা করতে হবে।

এমনি বৃথা অন্বেষণের কয়েক দিন অপব্যয়িত হয়েছে। তবে সেদিন দেখা গেল দৈব অনুকূল। গহনের একটু গভীর প্রদেশে প্রবেশ করতেই দেখলেন একটা সুবৃহৎ শালকাণ্ডে মাথা রেখে প্রায় অচৈতন্যের মতোই নিদ্রাভিভূত লোকটা এক হাতে চিরসঙ্গী ধনু, কিছু দূরে তূণীর এবং ঠিক পাশেই এক বিপুলাকার সুরাভাণ্ড … গত রাত্রির সুরাগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে সেই প্রত্যুষেই মক্ষিকার দল এসে জুটেছে, তাদের একদল মৃভাণ্ডটি অন্ধকার করে বসে আছে তার গায়ে, আর একদল লোকটার ঈষন্মুক্ত অধরের চারিপাশে পীতাবশিষ্ট সুরার প্রসাদ পাচ্ছে।

বাসুদেব আর বিলম্ব করলেন না। অনুতপ্ত শঙ্কিত অর্জুন যে কোন মুহূর্তে তাঁর সন্ধানে এসে পড়তে পারে। তিনি প্রথমেই সন্তর্পণে নিষাদের নিদ্রাবিবশ শিথিল মুষ্টি থেকে ধনুকটি অপসারণ করলেন, তারপর তূণীরটিও সংগ্রহ করে এক বৃক্ষশাখায় তুলে রাখলেন। অতঃপর, জলের অভাবে সেই সুরাভাণ্ডটারই এক প্রান্ত ধরে, অবশিষ্ট সামান্য মদ্যটুকু

তীব্রবীর্য কটুগন্ধ সেই পানীয়ই— ছড়িয়ে দিলেন ওর মুখে।

চমকিত, সদ্যনিদ্রাভঙ্গে বিহ্বল কীলক অস্থির ভাবে বসেই নিজের মুষ্টির দিকে তাকাল, ধনুঃশরের খোঁজে— সেগুলো না পেয়ে আরও ব্যস্ত আরও অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়াতে, শ্রীকৃষ্ণ শান্ত মধুর কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘স্থির হও কীলক। অস্ত্রের প্রয়োজন হবে না, সেজন্য চিন্তিত হয়ো না। আমি তোমার বন্ধু।‘

যে শ্বাপদ-সঙ্কুল অরণ্যে বাস করে, তার ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় সদাত্রস্ত ও সদাসতর্ক থাকে। কীলকের সুরাপান বা নিদ্রাজনিত জড়তা কাটতে বিলম্ব হয় না। সে আরও ভীত ও চকিত হয়ে চারিদিকে তাকাল, শ্রীকৃষ্ণকে দেখতেও পেল এবার। মনে হ’ল চিনতেও অসুবিধা হ’ল না। সেই সূত্র ধরে সেদিনের ঘটনাও মনে পড়ল।

আশ্বস্ত হ’ল কিনা বোঝা গেল না। তবে শান্ত হ’ল কিছুটা। ধীরেসুস্থে হাতের পিছন দিয়ে ললাটের স্বেদ এবং মুখের গ্লানি মুছে নিয়ে বলল, ‘ও তুমি!…তা তুমি এখানে কি মনে ক’রে? সেদিনের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে এসেছ বুঝি? তাই তস্করের মতো আগেই আমার ধনুঃশর চুরি করেছ? তবে এত সতর্কতার প্রয়োজন ছিল না। আমাকে বধ করতে এলে আমি এমনিও তোমাকে বাধা দিতাম না। বাধা দিলেও পেরে উঠতাম না তো। আমরা অন্তরাল থেকে পশু বধ করি— তাও করি জীবিকার জন্য—মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অকারণে মানুষ বধ করার অভ্যাস নেই।

বাসুদেব হাসলেন। সেই রহস্যময় অভয়ভরা হাসি— যে হাসি দেখলে বালক-বৃদ্ধ-স্ত্রীলোক নির্বিশেষে মুগ্ধ ও বশীভূত হয়। বললেন, ‘না কীলক, আমি তোমাকে বধ করতে আসি নি। সে ইচ্ছা থাকলে সেদিন মধ্যম পাণ্ডবকে বাধা দেব কেন? আমি সত্যই তোমার বন্ধুরূপে–বন্ধু হতে এসেছি।’

‘বন্ধু হতে এসেছ! বন্ধু! হাঃ!’ একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ ক’রে জুম্ভণ ত্যাগ করল কীলক। গতরাত্রের মত্ততা তার অনিবার্য অবসাদ এনেছে, সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের পাষাণভার। সে দু-হাতে নিজের মাথাটা ধরে একটা প্রবল নাড়া দিয়ে নিল, তারপর সুরাকলসটা নেড়ে দেখল কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা। বোধ হয় সামান্য কিছু ছিল, সেইটুকুই গলায় ঢেলে দিয়ে যেন একটু প্রকৃতিস্থ হ’ল। একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বন্ধু আমার আর কী কাজে আসবে? বন্ধুতে আমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমার কোন উপকার করতে আসোও নি। কী চাও, কী উদ্দেশ্যে এসেছ সেইটেই খুলে বল দিকি।’

‘তোমার কি কোন প্রয়োজন নেই? ভাল ক’রে ভেবে দ্যাখো তো।’

‘না, কিছুই না। আমার কোন ইচ্ছা বা কামনা নেই, সেজন্য কোন প্রয়োজনও নেই।’

‘প্রতিহিংসা নেবার ইচ্ছাও নেই? সত্য কথা বলছ?’

নিদ্রা ও মত্ততার জড়তা আগেই কেটে এসেছিল, এবার আরক্ত চক্ষুর দৃষ্টিও প্রখর হয়ে উঠল। কঠিন ও সন্দিগ্ধ। কোথাও কোন বিপদ আশঙ্কা করলে মানুষের দৃষ্টি যেমন সতর্ক ও সচেতন হয়, তেমনিই।

‘আচ্ছা! এই পথ ধরেছ!… তুমি তো ওদের বন্ধু, তোমাকে ওরা মানে-গনে দেখলাম। তোমার মুখে এসব কথা বড় অশোভন আর হাস্যকর নয়?…কোন ফাঁদে ফেলতে চাও বল তো? কোন জালে জড়াতে চাও? আর আমার মতো নগণ্য প্রাণীকে নষ্ট করার জন্য এত আয়োজন করার আছেই বা কি?… একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো পায়ের তলায় পিষ্ট করলেই তো হয়। আমারই তো অস্ত্র আছে, এনে স্বচ্ছন্দে বধ করো— তোমার ঐ কোষবদ্ধ খড়্গ বার করতে যদি ইচ্ছা না হয়। …সত্যিই বলছি, বাঁচবার এতটুকু সাধ নেই আমার।’

‘তুমি মিথ্যা বলছ কীলক। অসত্যভাষণ করছ। এখনও তোমার জীবনে একটা উদ্দেশ্য আছে, পাণ্ডবদের সর্বনাশ দেখা। তাদের অনুতাপের পরিতাপের অশান্তির আগুনে দগ্ধ হতে দেখলে তোমার অশান্তির, দুঃখের অবসান হবে, চিত্তদাহ প্রশমিত হবে… তাই না?… শোন কীলক, আমার কথা তুমি বুঝবে না। আমাদের দুজনেরই উদ্দেশ্য অনেকটা এক, কারণ ভিন্ন। ওরা আমার বন্ধু ঠিকই, আত্মীয়ও। তবু ওদের অনিষ্ট চিন্তা করতে হচ্ছে। তোমার অভিসম্পাত, ঐ নবগঠিত মহানগরীর মহাশ্মশানে ওরা রাজত্ব করবে, আমারও ইচ্ছা তাই। …কী করব, আমি নিরুপায়। আরও বহু লোকের দুঃখ দূর করতে এ দুঃখ ওদের পেতে হবে।’

তবু কীলকের সন্দেহ দূর হয় না। তীব্র ভ্রূকুটি ক’রে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে বাসুদেবের দিকে, রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করে।

বাসুদেব ওর মনোভাব বোঝেন, আরও কাছে আসেন ওর।

একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর বাহুমূলে একটা হাত রেখে বলেন, ‘কীলক, আমার চোখের দিকে দেখ দেখি। এখনও কি তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে প্রতারিত করতে এসেছি, মিথ্যা বলে বিপদে ফেলতে চাইছি?’

কীলক সে কোমল মধুর স্পর্শে কেমন যেন বিহ্বল অভিভূত হয়ে পড়ল। চোখ তুলে ওঁর চোখে দৃষ্টি রাখতে চাইল, পারল না। তার সমস্ত দেহ কাঁপছে মনে হচ্ছে সমস্ত দেহে, রক্তধারায় কিসের একটা বিপুল আনন্দানুভূতির তরঙ্গ জেগেছে, তাতেই শরীর টলছে।

‘না, না।’ অতি কষ্টে উচ্চারণ করল সে, কাতর অনুনয়ের ভঙ্গীতে বলল, ‘তা মনে হচ্ছে না। তোমাকে বিশ্বাস করছি, করছি। কিন্তু এ আমার কী হল? মনে হচ্ছে জন্মের মতো তোমার দাস হয়ে গেলাম, তোমার আদেশ পালন না করে আর কোন উপায় থাকবে না।’

‘কীলক, তোমাকে আমি সত্যিই আমার সেবক ক’রে নিলাম। দৈবকার্য সাধনে, মানুষের কল্যাণের কাজে নিয়োগ করলাম তোমাকে আজ থেকে ‘

তখনও হাতটা কীলকের বাহুতে। সেই অলৌকিক স্পর্শের অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা ও অনির্বচনীয় মাধুর্যে প্রায় হতচেতন কীলক অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘বলো কি করব! কি করতে হবে!’

‘মন দিয়ে শোন। মথুরার উপকণ্ঠে আর্য ও অনার্যদের সংমিশ্রণে যে বর্ণসংকর জাতি গড়ে উঠেছে—আদিবাসী এই সম্পর্কে যাদের জ্যেষ্ঠ বা জ্যেঠ বলে—দস্যুতাই তাদের প্রধান বৃত্তি। কিন্তু প্রবল প্রতাপ কুরুরাজদের ত্রাসে তারা এদিকে আসতে সাহস করে না। তুমি মাংস বিক্রয়ের উপলক্ষে তাদের পল্লীতে যাও, কথার ছলে তাদের জানিয়ে এস, কুরুরাজধানীর দক্ষিণে নতুন যে নগরী গড়ে উঠেছে এখানে, পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ, সেখানের ব্রাহ্মণপল্লী পাণ্ডবদের মুক্তহস্তের দানে ও দক্ষিণায় রীতিমত ঐশ্বর্যস্ফীত হয়ে উঠেছে, ব্রাহ্মণদের বিত্তের সীমা নেই। কেউ যদি তাদের গৃহ লুণ্ঠন করে তাহলে রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠনের থেকে বেশী লাভবান হবে। তাদের ভয় নেই, ব্রাহ্মণপল্লীতে কোন প্রহরার ব্যবস্থা নেই, ওঁরা শাস্ত্রজীবী নিরীহ ব্রাহ্মণ বলে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে থাকেন। ওঁদের নিজেদেরও কোন অস্ত্রাদি নেই।… দ্যাখ, পারবে তাদের প্ররোচিত করতে?’

কীলক বলল, ‘পারব। তোমার এ বিচিত্র আদেশের রহস্য কিছুই বুঝলাম না। তবে যা বলেছ তা করব।’

সে এই প্রথম তাঁকে প্রণাম করে তখনই দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে যাত্রা করল।

আবারও একটু হাসলেন বাসুদেব।

তবে তিনিও আর সেখানে দাঁড়ালেন না, বরং স্বভাববিরুদ্ধ দ্রুতগতিতেই প্রত্যাবর্তনের পথ ধরলেন।

তিনি জানতেন প্রভাতে ওঁর পুরীতে এসে ওঁকে দেখতে না পেয়ে অর্জুন বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়বেন— বিশেষ যদি শোনেন, উনি নিরস্ত্র একাকী এই গহন অরণ্যে প্রবেশ করেছেন। আর সেক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ছুটে আসবেন ওঁর সন্ধানে।

তা আসুন, তবে কীলকের সঙ্গে ওঁর সাক্ষাৎ হওয়ার সংবাদটা তাঁর জানার আবশ্যক নেই। সেই জন্যই এত ত্বরা ওঁর।…

অর্জুন সম্বন্ধে ওঁর অনুমান যে অভ্রান্ত— অল্পদূর অগ্রসর হতেই তা প্রমাণিত হল। দেখা গেল, সত্যই বিভ্রান্ত ভাবে শুষ্ক মলিন মুখে ব্যস্ত হয়ে এই দিকেই আসছেন ধনঞ্জয়।

কেশবকে দেখে তিনি উদ্বিগ্ন ও ঈষৎ অভিমানক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি হয়ত অজ্ঞানে বা অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত কোন অপরাধ করে ফেলেছি, সেজন্য এই গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা করলেন? আমার উপর বিরক্ত হয়ে থাকলে আমাকে শাস্তি দেবেন, এমন ক’রে নিজের জীবন বিপন্ন করবেন না।’

শ্রীকৃষ্ণ একেবারে ওঁকে আলিঙ্গনাবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘বন্ধু, নানা কারণে—প্রধানটা অবশ্য জানি, নবীন প্রণয়— তোমার মানসিক স্থৈর্য নষ্ট হয়েছে, তা নইলে যা করো নি সেই কল্পিত অপরাধের কথাও ভাবতে না, আমার বিরক্তিও কল্পনা করতে না। আর নিতান্তই মোহগ্রস্ত না হলে তোমার ওপর অভিমান ক’রে আমি জীবন বিপন্ন করতে এসেছি— এ কথা চিন্তা করতে পারতে না। অভিমানবশে এমন কর্ম করে স্ত্রীলোকে ও বালকে।… আর করে উন্মাদে। চল চল, এখনও প্রাভাতিক জলযোগ হয় নি, ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি। সদ্যোত্থিত নবনীত ও প্রচুর দুগ্ধপিণ্ডক ছাড়া এ ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে না।

অর্জুন একত্র চলতে চলতে গাঢ় কণ্ঠে বালকের মতোই বলে উঠলেন, ‘আমার–আমার খুব ভয় হয়েছিল, মনে হচ্ছিল আপনি বোধ হয় আমাদের ত্যাগ করলেন। কত কী যে আশঙ্কা হচ্ছিল কী বলব।’

‘তোমার ভাবে ভঙ্গীতে বাক্যে আমার কি মনে হচ্ছে জানো?’

বিস্মিত অর্জুন প্রশ্ন করলেন, ‘কি?’

‘তোমার আরও অনেকগুলি নববধূর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই চেষ্টাই করব এখন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *