০৯. বুকে জাগে ঢেউ

বুকে জাগে ঢেউ

সামনের লাল মাটির ঢিবিটা লাফিয়ে পার হলো কংকারী। তার শব্দ পেয়ে একটা সজারু শরীরের কাঁটা ফুলিয়ে কষাড়ের ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেল । এই প্রাণীটিকে একবার ঐ রকম করে ছুটতে দেখে চন্দ্রকেতু বলেছিলেন:

শল্পকী যায় তুমুল বেগে।

সে কি আছে ভীষণ রেগে?

কংকারী ইতিউতি তাকায়। না, সজারুটাকে কোথাও এখন দেখা যাচ্ছে না। এর তেলতেলে লাল মাংশ পুড়িয়ে খায় আদিবাসীরা।

কংকারীর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। কানে রক্তজবা ফুল গোঁজা। ওর বা হাতের একটা আঙুল নেই। একবার একটা হিংস্র চিতাকে আঘাত করতে গিয়ে সাহসী কিশোর কংকারী আঙুল হারিয়েছে। সে উলুঘাসের বনে ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়। মধ্য ভাদ্রের দুপুরের রোদে হলুদ বুনোফুল ঝকঝক করছে । আকাশের রঙ এখন তিশি ফুলের মতো। বুনোফুল ঘন সবুজের মাঝে হলুদ ঝিলিক যেন। বাতাসে ঝাঝালো গন্ধ । বনতুলসীর ঝোপ থেকে একটা সোনা গুঁই মুখ বের করে জুলজুল করে তাকাতে থাকে। পাশেই বিশাল দিঘি। একপাশের সুপারি গাছের সারি । দীঘল গাছের ছায়া কাঁপে। দিঘিতে কাকের চোখের মতো পানি টলমল করছে। কলমি দামের নিচে ভেসে বেড়ায় বিশাল আকারের মাছগুলো । কখনো ঘাঁই মারে। অজস্র শাদা শাপলা ফুটে রয়েছে।

কংকারী সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। মৃদুমন্দ বাতাসে শাপলা পাতা কাঁপছে। কয়েকটা জলফড়িং শরডগার উপর বসে রয়েছে। অনেকটা পথ হেঁটে আসার জন্যে কংকারী একটু ক্লান্ত। দুপুরের রোদে জঙ্গলগড়ের ভেতর দিয়ে এসেছে সে। পথটি যথেষ্ট নির্জন। তার মুখে ঘাম চিকচিক করছে। দিঘির কলাকলো বাতাস এসে তাকে খানিকটা স্নিগ্ধ করে তুলল। কাঁটার আঘাতে ওর বাঁ পায়ের একটা অংশ ছড়ে গেছে। সেখানে জ্বালা করছে। গন্ধ ভাদালের পাতা কচলে লাগিয়ে দেয়। হরিতকি গাছ থেকে কয়েকটা দুর্গা টুনটুনি ফরফর করে উড়ে যায়। কংকারী ঝোপে উঁকি মেরে পাখিদের ছোট নীল ডিম দেখার চেষ্টা করে।

কংকারী ধীরপায়ে দিঘিতে নামে। শীতল স্পর্শ পায়। স্বচ্ছ পানির নিচে সরপুঁটিদের চলাফেরা দেখা যায়। এই মাছকে অনেকে বলে শফরী। কংকারী পানিতে নামতে থাকে। লেবুফুল পানিতে টুপটুপ করে পড়ছে। তাকে শাদা শাপলা তুলতে হবে। চন্দ্রকেতু ভীষণ খুশি হবেন এই শাপলা পেলে। জলজ উদ্ভিদ আর ফুল চন্দ্রকেতুর কাছে খুব প্রিয়। কংকারী চলেছে চন্দ্রকেতুর কুটিরের দিকে। ডাহুকপুর গ্রামের শেষ মাথায় অর্জুন গাছের নিচে চন্দ্রকেতুর ছোট কুটির। চাল বেয়ে উঠেছে উঁই কুমড়োর লতা। চন্দ্রকেতু পুঁথি রচিয়তা। ছন্দ মিলিয়ে পদ্য রচনা করেন। তালপাতায়, ভূর্জপত্রে কালো আখর টেনে পদ্য লেখেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে আশপাশের দশ গাঁয়ে। রাতের পর রাত জেগে ধূসর পুঁথির পাতায় স্বদেশের ইতিহাস লেখেন চন্দ্রকেতু। সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র বাঁকালের ইতিহাস। বঙ্গের নানা পর্বের ইতিহাস।

চন্দ্রকেতু বিভিন্ন জনপদে গিয়ে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেন। এ ব্যাপারে তার কোনো ক্লান্তি নেই। হয়তো শুনলেন কোনো পণ্ডিতের সংগ্রহে বিশেষ একটি পুঁথি রয়েছে। অমনি চললেন সেখানে। হয়তো জানলেন কোনো দুরূহ শ্লোকের অর্থ আবিষ্কার করতে পেরেছে কোনো মনিষী। তখন তার আশ্রমের দিকে যাত্রা। পথ যত দুর্গম হোক। ঐ অঞ্চলের প্রায় সকল খেয়াঘাটের মাঝি চেনে পরিব্রাজক চন্দ্রকেতুকে।

চন্দ্রকেতু জানতে আগ্রহী কোন সময় থেকে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে? কোথায় রয়েছে তার প্রমাণ?

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে প্রথম এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। জনপদবাসিরা তখন পরিচিত পুণ্ডু বলে। তাদের বলা হতো পক্ষী জাতি। পাখিদের সাথে তাদের তুলনা করেছেন ঋষিরা। কেন তাদের পক্ষী জাতি বলা হয়েছে? কি এর রহস্য? তবে কি ঋষিরা ঐ জনপদের মানুষের ভাষা বুঝতে পারতেন না। যেমন বোঝা যায় না পাখিদের ডাক। বৈদিক ঋষিরা অন্য ভাষার জনগণের ভাষা বুঝতে না পারলেই তাদেরকে তুলনা করতে পশুর সাথে। মানুষের সমতুল্য বলে তাদের মনে করতেন না। বেদের একটি শ্লোকে যুদ্ধরত বিপক্ষীয় শত্রুদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে। কুকুরের ন্যায় জঘন্য শব্দকারী যারা আমাদের ধ্বংস করতে ছুটে আসছে তাদের বিনাশ কর। যারা আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায় তাদের ধ্বংস কর ।

পুঁথির পর পুঁথি উল্টে গেছে চন্দ্রকেতু। কুটিরের দাওয়ায় বসে রাতের আকাশে নক্ষত্রের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন চন্দ্রকেতু। তারা ঝিকমিক আকাশ। রাতের সেই আকাশ বুঝি মস্ত এক নীল হরিণের পিঠ। তার মাঝে সোনালি খইয়ের মতো ফুটে আছে নক্ষত্ররাজি। পরাশরের পুঁথিতে আছে, হস্তনক্ষত্রে সূর্য প্রবেশ করলে অগস্ত্যতারা দৃশ্য হন এবং রোহিনীতে প্রবেশ করলে অগস্ত্যতারা অদৃশ্য বা অস্তগত হন।

এই ধরনের বাক্য চন্দ্রকেতুকে বারবার ভীষণ ভাবে উদ্দীপ্ত করে। কতোটা তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি থাকলে এ ধরনের মন্তব্য সম্ভব। চাই প্রবল নিষ্ঠ। ধৈর্য ধরে নক্ষত্রসমূহ অবলোকন করা। তারার নাম ধ্রুব,ব্রহ্মহৃদয়, অগ্নি, অগস্ত্য, লুব্ধক। অশ্বিনী নক্ষত্রে ঘোড়ার মুখ কল্পনা করা হয়েছে। তিমিমণ্ডলে মানুষের মাথাযুক্ত একটি মাছের ছবি দেখা যায়। কৃত্তিকা নক্ষত্রের ছয়টি তারা দিয়ে আগুনের শিখা কল্পনা করা হয়েছে।

পুঁথির ধূসর পাতায় তারাদের নামগুলো দেখে চন্দ্রকেতুর মনে হতো তাতে যেন সুদূরের আভাস রয়েছে। কত নাম। হলদিবরণ, শকটমুখ, অনুসূয়া, সন্নতি, বিনতা, পূতনা, চিত্রলেখা ।

মাটির মানুষের বুকে বুঝি ঢেউ তোলে নক্ষত্রের নীল আলো। চন্দ্রকেতু সেই নীল আলোর প্রভাবকে গভীর ভাবে অনুভব করতে চান। কত রাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে তিনি বসে থেকেছেন উঠোনে। রাতের শিশির তাকে ভিজিয়ে গেছে। কোণার জবাগাছ থেকে লাল ফুল ঝরে গেছে দমকা বাতাসে। রাতের শিরশিরে বাতাস বয়ে গেছে। চন্দ্রকেতু কুশি ঘাসের চাটাইতে বসে ধ্যানমগ্ন। এই যে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড, কতটুকু মাত্র তার জানতে পেরেছেন। মানুষের জানার পরিধি কত অল্প। ব্রহ্মাণ্ডের বিশালত্বের কথা ভেবে চিন্তাশক্তি আলোড়িত হয়। পুরাণ কাহিনীতে রয়েছে এই সৃষ্টিতত্ত্বের কথা। সৃষ্টির আদিতে সর্বত্র ছিল পানি। থইথই পানি। এই পানি ক্রমে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় প্রবল ফেনার উৎপত্তি। এছাড়াও পানি থেকে বের হয়ে আর এক প্রকার শাদা জিনিস। সৃষ্টিকর্তা সেই সাদা জিনিস থেকে একটা ডিম বা অণ্ড সৃষ্টি করেন। এক সময় এই ডিমটি ফেটে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এই ডিমের ভেতর থেকে আবির্ভাব হয় ব্রহ্মার । সে জন্যে একে বলে ব্রহ্মাণ্ড। এই ফাটা ডিমের এক অংশ হলো পৃথিবী। অন্য অংশ আকাশ।।

আঃ! আকাশের কথা ভেবেই চন্দ্রকেতু আনন্দিত। পৃথিবীর মানুষজনের তুচ্ছ আচরণগুলোকে তখন ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।

চন্দ্রকেতু শুধু বলেন, আমাকে জ্ঞান অর্জনের শক্তি দাও। আমি জানতে চাই। জানাতে চাই।

চন্দ্রকেতু কখনো আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান কার্পাশ ক্ষেতের কাছে। বাতাসে কার্পাশ ফুল দোলে। তাঁতিরা সংগ্রহ করে নিয়ে যায় কার্পাশ তুলো। এ দিয়ে তৈরি হয় মিহি বস্ত্র। খুব সুনাম সেই সূক্ষ্ম বস্ত্রের । প্রাচীনকালে ছিল চার রকমের বস্ত্র। সেগুলো হলো দুকূল, পাত্রোণ, ক্ষৌম ও কাপাশিক। বঙ্গের দুকূল হলো যেমন নরম তেমনি সাদা। পুরে দুকূল হলো শ্যামবর্ণ। দেখতে মণির মতো। কামরূপের দুকূল দেখতে পালতের মতো কাপড় তৈরি করে নিপুণ পদ্ধতিতে। রেশমের উৎকৃষ্ট শ্রেণীর কাপড়ের নাম পত্রোণ। পাতার পশম। নাগবৃক্ষ, বকুল আর লিকুচ গাছের এই রেশম পোকা জন্মাত। নাগবৃক্ষের পোকা থেকে হলুদ রঙের রেশম হতো। লিকুচের পোকা থেকে গম রঙের রেশম বের হতো।

ডাহুকপুর গ্রামে অনেকগুলো লিকুচ গাছ রয়েছে। সারি বেঁধে লাগান। অনেকে বলে মাদারগাছ।

চন্দ্রকেতু প্রায়ই যেতেন তাঁতিপাড়ায়। কোথায় যেত এই অপূর্ব বস্ত্র ? বণিকেরা এ দেশ থেকে এসব নিয়ে যেত দূর দেশে। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে যেত বাণিজ্যপোত। সপ্তডিঙা মধুকর রায় ঢেউ ভেঙে যায় ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী। কোথায় যায়? কত দূর যায়?

ঢেউ টলমল নদীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন চন্দ্রকেতু। গঙ্গা নদীর মোহনায় ছিল বিখ্যাত গাঙের বন্দর। ছিল তাম্রলিপ্তি বন্দর। পাল ফুলে ওঠে মৌসুমী বাতাসে।

সমুদ্রের উপকূল ধরে নৌযান যায়। যেতে যেতে লঙ্কা দ্বীপ। সোজাসুজি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুবর্ণভূমিতে। যবদ্বীপে। সুমাত্রায়। চম্পা দেশে মালাক্কায়। যায় বিভিন্ন মশলার দ্বীপে। যেখানে রয়েছে এলাচ, দারুচিনি, পিপুলের বন। যেখানে বাতাসে ভেসে থাকে লবঙ্গ ফুলের মউ মউ গন্ধ।

চন্দ্রকেতুর কাছে বেশি প্রিয় এই স্বদেশের ইতিহাস। গৌরবগাথা।

শৈশবে তাকে একবার প্রচণ্ডভাবে অপমান করেছিল ক্ষেত্রপুরের এক উদ্ধত রাজ অমাত্য। সেই অপমানের জ্বালা ভুলতে আরো বেশি করে স্বদেশের জয়গাথা জানতে চেয়েছেন।

চন্দ্রকেতু তখন কিশোর। ক্ষেত্রপুরে গিয়েছিল একটি ভগ্ন গড় দেখতে। শুনেছেন এই গড়ের একটি রহস্যময় ইতিহাসে রয়েছে । চন্দ্রকেতু আনমনে হাঁটছিলেন গড়ের ভেতরে। বুনো লতাপাতার একটা কটু গন্ধ। কোথাও ঝুলছে সাপের ফিনফিনে খোলস। ফোকরে বসে ডাকে জলকবুতর। গড়ের এক কোণায় হঠাৎ একটি চকচকে পদার্থ দেখতে পেয়ে কৌতূহলে এগিয়ে যান চন্দ্রকেতু। পদার্থটি থেকে আলো ঠিকরে আসছিল। কি এই জিনিস। ধুলোর মাঝে পড়ে আছে। জিনিসটি যত্ন করে তুলে নেন চন্দ্রকেতু। ঘন সবুজ রঙের একটি স্ফটিক টুকরো ।

গোলাকার। কোনো দূরবীনে বসানো ছিল হয়তো। চন্দ্রকেতু স্ফটিকটিকে চোখের সামনে তুলে ধরেন। অমনি এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি হয় তার। দূরের জিনিস কাছে চলে আসে। চন্দ্রকেতু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন দূরের লিকুচ গাছের পাতাগুলো। সবুজ পাতার ফাঁকে চিলের বাসা। চিলের ছানাগুলো দেখা যায়। লাল মুখ হাঁ করে আছে। তার মনে পড়ে যায় শীলভদ্র শ্রমণের কথা। তিনি জানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরনের স্ফটিক নির্মিত দূরবিন তখন ব্যবহার করতো সমুদ্র যাত্রায় বঙ্গের নাবিকেরা। তবে কি ক্ষেত্ৰপুরের এই গড়টিতে কোনো নাবিক বাস করত? সে শুনেছে রক্তমৃত্তিকানিবাসী বুদ্ধগুপ্ত হলেন প্রথম বাঙালি নাবিক। যিনি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদূর কম্বোজ, চাম্পা দেশে গিয়েছিলেন। এই গড়ের সাথে রক্তমৃত্তিকা বিহারের সম্পর্ক ছিল । চন্দ্রকেতু কিশোরকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। শাণিত বুদ্ধির অধিকারী। যে কোনোঘটনার তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতার তার অসাধারণ। তিনি বুঝতে পারেন পুরানো কালের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ের যোগসূত্রকে হঠাৎ করে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ক্ষেত্রপুরের এই গড়টি ছিল নাবিকদের ঘাঁটি। কাছেই ডাহুকপুরের তাঁতিপাড়া। আশেপাশে রয়েছে আরো কয়েকটি বিখ্যাত উঁতিদের গ্রাম। যেখানে কুশলী কারিগরেরা তৈরি করত মসলিন। বণিকেরা এই নাবিকদের যানে করে তখন বঙ্গসাগরের বন্দরে বস্ত্র পাঠাত। ক্ষেত্রপুর ছিল ভাণ্ডারিয়ক। এর মানে এমন এক স্থান যেখানে কোনোও কিছু সম্যকভাবে ভাণ্ডার করে রাখা হয়।

ক্ষেত্রপুরের গড়ে মসলিন এনে রাখা হতো। চন্দ্রকেতু আরো কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যান সামনের ধ্বংসস্তূপের দিকে। আগাছায় ঢাকা। কাঁটাঝোপ সরিয়ে তাকান চন্দ্রকেতু। ডিবির মতো একটি স্থান । একধারে মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে পোড়ামাটির চিত্রফলক। চন্দ্রকেতু একটি গাছের শক্ত ডাল ভেঙে মাটি সরাতে থাকে। নরম মাটি। কিছুক্ষণ সরাতেই ফলকগুলো পাওয়া গেল। ফলকের মাঝে একটি ভূর্জপুত্রের পুঁথি। পুঁথিটিকে পেয়ে বিস্ময়াভূত হন চন্দ্রকেতু। পুঁথিতে লেখা নৌযাত্রা। প্রাচীন বাঙলার নৌযাত্রার অনেক কাহিনী পাওয়া যাবে এতে। হঠাৎ কিশোর চন্দ্রকেতু দেখলেন তার সামনে এক দীর্ঘ ছায়া। ক্ষেত্রপুরের এক রাজ অমাত্য শাকন। উদ্ধত স্বভাবের মানুষ। সে এসেছিল ঐ বনে ভেষজ লতার জন্যে।

চন্দ্রকেতুকে ভগ্ন গড়ের ভেতরে ঢুকতে দেখে কৌতূহলী হয়। এই ভগ্ন তূপের ভেতরে তো সহজে কোনো মানুষ প্রবেশ করে না। এতোক্ষণ গোপনে লুকিয়ে থেকে কিশোর চন্দ্রকেতুর কার্যলাপ লক্ষ্য করছিলো।

চন্দ্রকেতু দেখেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাকন। চমকে যান চন্দ্রকেতু। শাকনের নিষ্ঠুর স্বভাবের কথা তিনি জানেন। শাকন প্রায়শই পাখি ধরে মুচড়িয়ে পাখির মাথা ছিড়ে ফেলে দেয়। এই বীভৎস কাজে শাকন যথেষ্ট উল্লাস অনুভব করে।

বাজখাই গলায় শাকন জিজ্ঞেস করে,

এই বালক, এখানে তুমি কি করছ?

চন্দ্রকেতু সরল ভাবে হাসে। তার হাতে ধরা ভূর্জপত্রের পুঁথি।

পুঁথি পেলাম একটা।

তার আগে কি যেন চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলে? হীরে বুঝি?

না, দূরবিনের কাঁচের টুকরো। ওটা দিয়ে আমি দূরের জিনিস দেখছিলাম।

গর্জে উঠল শাকন। মিথ্যে কথা । তুমি এখানে এসেছ গুপ্তধনের সন্ধানে।

ঠিক বলেছেন। আমি এখানে গুপ্ত জিনিসের খোজেই এসেছি।

কি সে জিনিস?

ইতিহাস।

ইতিহাস! ওটা আবার কোন ধরনের গুপ্তধন? রসিকতা করছ আমার সাথে?

না, । আমি আসলে প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধানে ঘুরি । আজ এখানে এসে পেয়েছি প্রাচীন নৌযাত্রার পুঁথি।

আমি তোমার ইতিহাসের নিকুচি করছি। তুমি সেদিনের এক বালক। ইতিহাসের কি বোঝো?

আমি বুঝতে চাই।

প্রবঞ্চক। জোচ্চোর ।

শাকন যেন বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল চন্দ্রকেতুর ওপর। চন্দ্রকেতুর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

কোথায় সেই সবুজ হীরে? জলদি বের কর।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যান চন্দ্রকেতু। এই লোকটি তার সাথে এমন নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করছে কেন?

গড়ের দেয়ালের চন্দ্রকেতুর মাথা ঠুকে দিতে থাকে শাকন। তাকে তখন একটি হিংস্র বন্য বরাহের মতো লাগে।

শাকনের চোখ দুটো ক্রমশ জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠছে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত চন্দ্রকেতু। তার চোখের সামনে যেন সবকিছু দুলে ওঠে। তিনি ঝাপসা দেখছেন। শাকন ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করছে—

বল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস গুপ্তধন?

আমি হীরে পাইনি। সত্যি বলছি ।

হীরে না পেলে আমি তোমাকে এখানে জ্যান্ত পুঁতে রেখে যাব । কেউ কিছু জানতে পারবে না।

চন্দ্রকেতুর কপাল কেটে রক্তের ধারা নামছে। সে নোনা স্বাদ পায় । বাঘের থাবার মতো এগিয়ে আসছে শাকুনের লোমশ হাত।

আর তখনি ঘটে যায় সেই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি। ফোঁস করে একটি শব্দ শোনা যায়। একটি ফোকরের কাছে দাঁড়িয়েছিল শাকন। চন্দ্রকেতু দেখেন ফোঁকরের আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে ফণা তুলছে একটি কালকেউটে।

তোকে খুন করব আমি শয়তান বালক।

শাকন কোমর থেকে ধারালো অস্ত্র খোলে। ঠোঁট কাঁপছে চন্দ্রকেতুর। তিনি শুধু ফিসফিস করে বলেন, আমি কোনো মিথ্যে বলিনি। অন্যায় করিনি।

একটা আর্তনাদ শোনেন চন্দ্রকেতু। কালকেউটে শাকনের চোখে মুখে তীব্র ভাবে ছোবল মারছে। শাকনের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে যায়। টলতে থেকে বিশালদেহী শাকন। একটি অশ্বথের ঝুরি ধরে টানতে থাকে। গড়ের একটি অংশ নড়ে ওঠে। কয়েকটি ইট সরে যায়। চন্দ্রকেতু বিস্মিত হয়ে দেখে সামনে একটি প্রকাণ্ড গহ্বরের মতো সৃষ্টি হয়েছে। কেউটের ছোবল খাওয়া শাকন টলতে টলতে ঘুরপাক খেয়ে সেই কালো গর্তের কাছে যায়। শাকন সেই গভীর গর্তটি দেখতে পাচ্ছে না। দেয়ারে আঘাত পেয়ে শাকন সেই অন্ধকূপে ঝুপ করে পড়ে যায়। চন্দ্রকেতু সাবধানে এগিয়ে যান। শেষবিকেলের একচিলতে রোদ ক্ষীণভাবে পড়েছে সেই গর্তে। সাবধানে উঁকি দেন চন্দ্রকেতু। অন্ধকূপে উঁচিয়ে রাখা ধারালো বল্লমে গেঁথে আছে শাকন। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে। শাকনের বিস্ফারিত চোখ।

চন্দ্রকেতু অতি সাবধানে গাছের ডাল ধরে এগিয়ে যান। তার বুকে আবার সাহস ফিরে আসছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। শরীরের এখনো কাঁপুনি। কোনোমতে বটবৃক্ষের শিকড় ধরে ঐ বিপজ্জনক স্থান থেকে বেরিয়ে আসেন। তার শরীরের অনেকটা অংশ ছড়ে গেছে। ভূর্জপত্রের পুঁথিটি হারায়নি সে। সাবধানে আগলে রেখেছিল। শুধু সবুজ স্ফটিকের টুকরোটিকে খুঁজে পান না।

গড়ের ভেতরে থেকে যখন বেরিয়ে এলেন তখন গাছপালা মাথায় লেগে রয়েছে বিদায়ী রোদের আভা। সুনসান চারদিক। বালক চন্দ্রকেতু ভূর্জপত্রের পুঁথিটি নিয়ে এগুতে থাকেন। পুঁথির নাম নৌযাত্রা । কি রয়েছে। এতে? ক্ষেত্রপুরের নাবিকেরা কিভাবে কোনো দেশে কোনো দ্বীপে গিয়েছে তার বিবরণ। চন্দ্রকেতু যেনো স্পষ্ট শুনতে পান দাঁড় ছপছপ শব্দ। পুঁথির লেখাগুলোর অর্থ জানার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েন। ক্ষেতপুরের দুটো গ্রাম পরেই বেত্রী নদীর তীরে অনন্তপুর গ্রাম। সে গ্রামে বাস করেন কুন্তক পণ্ডিত। পুঁথির প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার করতে এ অঞ্চলে একমাত্র তিনিই পারদর্শী। চন্দ্রকেতু সিদ্ধান্ত নেন তাকে কুন্তক পণ্ডিতের আশ্রমে যেতে হবে। সন্ধে হয়ে এসেছে। ক্ষেত্রপুর গ্রামটি পেছনে ফেলে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন চন্দ্রকেতু। গয়না নৌকো করে অনন্তপুর যাওয়া যাবে। নদীতে ফেরা পাখিদের দেখতে পাচ্ছেন চন্দ্রকেতু বাঁশঝাড়ে ঝাঁক বেঁধে ফিরে আসছে বকেরা। বকের ছানারা শব্দ করছে। চন্দ্রকেতু বেত্রী নদীর বুক থেকে ভেসে আসা কলোকলো বাতাসের স্পর্শ পান। ক্রমশ তিনি প্রসন্ন হচ্ছেন। ক্ষেত্রপুরের গড়ের শ্বাসরুদ্ধকর ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কালকেউটের ছোবলে শাকনের অপঘাত মৃত্যু না ঘটলে ঐ হিংস্র লোকটি তাকে গড়ের মাটিতে এতোক্ষণে জ্যান্ত পুঁতে ফেলত।

অনন্তপুরের ঘাটে যখন গয়না নৌকো এসে থামল তখন বেশ রাত। তারা ঝিকমিক আকাশ। নক্ষত্রের ছায়া কাঁপছে নদীতে। খেয়াঘাটের কাছেই কুন্তক পণ্ডিতের কুটির। প্রদীপ জ্বালিয়ে পুঁথিপাঠ করছিলেন কুন্তক পণ্ডিত। মাধবীলতার ঝাড় লতিয়ে উঠেছে তার কুটিরের বেড়াতে। চন্দ্রকেতু দাঁড়ান সেখানে।

শব্দ শুনে তাকান কুন্তক। দেখলেন আবছা অন্ধকারের মাঝে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

কে, কে ওখানে?

আমার নাম চন্দ্রকেতু। ডাহুকপুর আমার বাড়ি। আমি আপনার কাছেই এসেছি কুন্তক।

এত রাতে!

কুন্তক পণ্ডিত প্রদীপ হাতে দাওয়া থেকে নেমে আসলেন। একটা রাতচরা পাখি কোথা থেকে যেন ডেকে উঠল। প্রদীপের আলোতে দেখলেন একটি মায়াবী মুখের কিশোরকে। ডাগর দুটো চোখ । কিন্তু ছেলেটির কপালের কাছে গভীর কাটা দাগ। রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে।

তুমি আহত চন্দ্রকেতু?

হ্যাঁ। ক্ষেত্ৰপুর গড়ে এক দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম।

তুমি কি এখন ক্ষেত্ৰপুর থেকে এসেছ?

এসেছি, কারণ আমি সেখান থেকে একটি মূল্যবান জিনিস সংগ্রহ করতে পেরেছি। এই পুঁথিটি পেয়েছি।

কই, দেখি, দেখি।

পরম আগ্রহভরে কুন্তক পণ্ডিত চন্দ্রকেতুর কাছ থেকে ভূর্জপত্রের পুঁথিটি তুলে নেন। পাতা উল্টিয়ে বিস্মিত হন তিনি।

এ যে খুব দুষ্প্রাপ্য পুঁথি।

জানি, একমাত্র আপনিই পারেন এর পাঠোদ্ধার করতে। সে জন্যেই এত রাতে আপনার কাছে এসেছি।

কুন্তক তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন চন্দ্রকেতুর দিকে। সেই কিশোরের চোখে তিনি জিজ্ঞাসার ঝিলিক দেখলেন। তিনি অনুভব করলেন এই কিশোর সাধারণ কেউ নয়। তার ভেতরে জন্ম নিয়েছে অজস্র কৌতূহল। এর ভেতর দিয়ে জ্ঞানের প্রবাহ সঞ্চারিত হবে। জনপদের অধিবাসীরা আলোকিত হবে এর মাধ্যমে।

কুন্তক ভাবলেন, এই পুঁথির অর্থ তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

তুমি ভেতরে এসো চন্দ্রকেতু। আমি তোমাকে এই পুঁথির কাহিনী বলব। তার আগে তুমি হাত-মুখ ধৌত কর। খাদ্য গ্রহণ কর। পথশ্রমে ক্লান্ত তুমি।

আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে যখন আপনি আমাকে এই পুঁথির কাহিনী বলবেন।

প্রদীপে রেডির তেল ঢেলে দিলেন কুন্তক। প্রদীপ তেজী হয়ে জ্বলতে লাগল।

পুঁথির ভেতর থেকে যেন কলকল করে উঠল নদীর স্রোত। বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌযানের কথা। কত যে নাম সেই সব পোতের । সলব, জলবা, কোশ, বালাম, পারোন্দ, বাতারি, পাতেলা, রথগিরি, জিলিয়া।

বেদে নৌযানের নাম অত্রিপবণ । তখন বাণিজ্য তরীতে পাল আর মাস্তুল ব্যবহৃত হতো। বড় বড় পোত যেত সমুদ্রে। চার মাস্তুল বিশিষ্ট নৌকায় ব্যবহৃত সাদা রঙ। লাল তিন মাস্তুল নৌকায়। দু মাস্তুল নৌকায় পীত রঙ। বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার পাখির মুখের আকৃতিতে গড়া হতো নৌকার সম্মুখ ভাগ।

তাম্রলিপ্তির বেশ কিছু দক্ষিণে কুমার নদীর মোহনায় ছিল গাঙ্গেয় বন্দর। প্রসিদ্ধ বন্দর। সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো মসলিন।

কুন্তক স্মিতভাবে তাকালেন চন্দ্রকেতুর দিকে।

তোমার এই পুঁথি আমাদের কাছে এক নতুন পৃথিবীর খবর দিচ্ছে। একদা এই অঞ্চলে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বস্ত্র তৈরি হতো। ভোরবেলার শিশিরের মতো ছিল সেই বস্ত্র। এত মিহিন। এই পুঁথিতে রয়েছে বিভিন্ন বন্দরে যাওয়ার বিবরণ । আমাদের দেশের গৌরবগাঁথা।

চন্দ্রকেতুর মুখ তখন আনন্দে ঝকমক করতে থাকে। দেশকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে সে।

এ দেশের লতাপাতা সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি।

চন্দ্রকেতুর একটি প্রিয় শ্লোক রয়েছে প্রকৃত পৈঙ্গল পুঁথিতে। সেখানে বলা হয়েছে, কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নালিতা শাক যে স্ত্রী নিত্য পরিবেশন করতে পারে তার স্বামী পুণ্যবান।

দিঘির পানিতে মাছের মতো ডুবে ডুবে অনেকগুলো সাদা শাপলা টেনে তুলল কংকারী । শাপলা ডগার কাছে তিরতির করে ভাসছে কাজলগৌরী মাছ। রুপোলি ছিপছিপে শরীর। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কংকারীর কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। টলটলে পানির নিচে রুপোলি কাঁপন। তরঙ্গায়িত হচ্ছে। চন্দ্রকেতু তাকে বলেছিলেন—

জলের নিচে বাস করে যে মীণ
সেও কি কখনো হয় খুব অচিন
জলের নিচে মীণের ঠাঁই
সে জগতের সন্ধান চাই।
কি করে? জিজ্ঞেস করেছিল কংকারী।
এর জন্যে প্রয়োজন অন্য চোখে দেখা।
মীণ, পখি, পতঙ্গের জীবনে যা লেখা।
আড়াল করেছে যারে বাঁধার প্রাচীর
তারে ভেঙে জেগে ওঠো, মন করো থির।

চন্দ্রকেতুর সব কথা কংকারী ঠিকমতো বুঝতে পারে না। কি প্রচণ্ড আবেগ মিশিয়ে কথা বলেন চন্দ্রকেতু। এক আশ্চর্য ধরনের মানুষ এই ডাহুকপুরের চন্দ্রকেতু। চারপাশের প্রকৃতির রহস্য দেখে বিস্মিত হতে জানেন। এই গুণটি আবার সব মানুষের মাঝে থাকে না। চন্দ্রকেতু যেন তার মাঝেই এই বোধটিকে ক্রমশ সঞ্চারিত করতে পারছেন। এখন উড়ে যাওয়া পাখিদের দেখলে কংকারী হঠাৎ কখনো আনমনা হয়ে যায়। ওর বুকেও জাগে ঢেউ।

হঠাৎ শাঁই করে একটা শব্দ শোনে কংকারী। তারপর মানুষদের উল্লা ভরা চিৎকার। চমকে তাকায় কংকারী। কয়েকজন গারুড়ী জাতের লোক এসে দাঁড়িয়েছে দিঘির পাশে। কুচকুচে কালো শরীর। তাদের হাতে এক ধরনের ছোট বর্শা ট্যাডা। তারাই হইচই করে এখানে এসেছে ভেঁদড় শিকার করতে। পাশের বিলের সাথেই দিঘিটির একটি সংযোগ রয়েছে। গারুড়ীরা চামড়া আর তেলের জন্যে ভেঁদড়, শুশুক মারে। এটাই তাদের পেশা। একজন গারুড়ী ট্যাড়া দিয়ে একটা ভোঁদড়কে গেঁথে ফেলতে পেরেছে। পানিতে ছটফট করছে আহত ভোদড়টা। গরুড়ীটা কেমন নিষ্ঠুর ভাবে ভোঁদড়টাকে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে মেরে ফেলল। দলের বাকিরা আনন্দে চিৎকার করছে। কংকারী ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, এতে চিৎকার করার কি আছে! গারুড়ীরা মৃত ভোঁদড়টির চামড়া টেনে ছিলতে শুরু করল।

কংকারী সাদা শাপলা নিয়ে এগিয়ে যায়। সামনের বাঁকটা পেরুলেই শিরিষ বন। তারপরেই শুরু হয়েছে ডাহুকপুরের সীমানা । ঐ গ্রামে অসংখ্য বেত ঝোপ। তার ভেতরে থাকে ডাহুক। লাজুক পাখিটি থাকে পাতার আড়ালে। কুব কুব করে ডাকে। গ্রামের নাম তাই ডাহুকপুর। কংকারীর মাথার উপর টুই টুই করে কয়েকটা হলুদ পাখি উড়ছে। বসন্তবৌরি পাখি। কংকারী ভাবছে ওর এই যাত্রায় এই পাখিরাও সঙ্গী হলো নাকি। নির্জন পথে কোনো সঙ্গীকে পেলে ভালোই লাগে। কংকারী জিজ্ঞেস করতে চায়,

ও হলুদ পাখির দল, তোমরাও কি আমার সাথে চন্দ্রকেতুর কুটিরে যাবে?

পাখিরা ডাকে টুই টুই।

জানো পাখি, পদ্যকার চন্দ্রকেতু তোমাদের নিয়ে এক পুঁথি রচনা করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘পক্ষীচরিত’।

হঠাৎ শোঁ শোঁ করে উত্তর দক্ষিণ থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে থাকে। আলো কেমন কমে আসে। আকাশ কালো হয়ে যায়। মাঠ থেকে শুকনো পাতা পাক খেয়ে উড়তে থাকে। মাঠে একটি ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছে। কংকারী দৌড়ে গছের নিচে যায়। ঘূর্ণিটাকে দেখে। পাক খেয়ে ঘূর্ণিটা এগিয়ে যাচ্ছে। একটা পাখি ঐ ঘূর্ণির ভেতরে পড়ে যায়। নিমিষেই পাখিটার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শিমুল তুলোর মতো পাখিটার লাল মাংশ ছিড়ে খুঁড়ে উড়তে থাকে। কংকারী ভাবল যদি ঐ পাখিটার মতো সে ঘূর্ণিপাকে পড়ত। ভাবতেই তার শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল।

শিরিষ বনের ভেতরে আলো-ছায়ার খেলা। কংকারীর শরীরের উপর শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। কোথাও শালগাছ। সবুজ টিয়ার ঝাঁক বসে আছে শালের শিকড়ে। টিয়ারা যখন ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ করে উড়ে যায় তখন তাদের ডানার ঝাপটায় শালের মঞ্জুরী খসে পড়ে বাতাসে। কংকারী কেমন মনমাতানো গন্ধ পায়। গভীর জঙ্গলের কখনো দেখা যায় লাল পালকের বনমোরগদের। শাল গাছের খোঁড়লে কখনো চকচক করে কোনো বন মুরগির ডিম।

দূর থেকেই দেখল কংকারী । চন্দ্রকেতু জলপায়রাদের খাওয়াচ্ছে। পাখিরা তার চারপাশে উড়ছে। কংকারীকে দেখে চন্দ্রকেতু খুশি হলেন।

এত শাদা শাপলা এনেছো?

আপনি ভালোবাসেন।

জলে জন্মানো ফুল আর উদ্ভিদ আমি ভালোবাসি। আসলে আমাদের দেশটাই তো হলো গিয়ে জলজ প্রকৃতির দেশ। কত নদী নালা, খাল বিল। প্রকৃতি কত স্নিগ্ধ। মৃত্তিকা উর্বর। বলল, এত সুন্দর মনোরম দেশ কি কোথাও আছে।

আমি আজ এখানে আসার পথে বেশ কয়েকটি নতুন ধরনের পাখি দেখতে পেয়েছি। কি যে অপূর্ব তাদের পালকের বাহার। কোনোটার ময়ূরকণ্ঠ রঙ। এত সুন্দর পাখিরা। তাদের ডানা ঝিলমিল করছে।

তোমরা দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ তীক্ষ্ণ কংকারী। তুমি জগত সংসারের ভিন্ন রূপ আবিষ্কার করার চেষ্টা কর। তোমাদের ভেতরে মমতা রয়েছে।

কবি চন্দ্রকেতু, আপনার সাথে বলার পর থেকে আমি যেন আমার ভেতরে একটা পরিবর্তনকে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি।

তুমি কি প্রকৃতির ভেতরে নিত্য ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য কর না। বীজ থেকে গজায় লকলকে সবুজ চারা। জলজ উদ্ভিদের ডগায় মালার মতো ঝুলে থাকে মীণের ডিম। সেগুলো যখন পোণায় রূপান্তরিত হয় তখন জলাশয়ে চঞ্চলতা বাড়ে। এভাবেই জাগে জীবন।

কংকারীর চোখের সামনে তখন যেন উদ্ভাসিত হয় জীবনের বিচিত্র রূপ।

ঠিক ঐ সময় সামনের পথ দিয়ে কয়েকজন গ্রামবাসীকে ভয়ার্ত ভাবে ছুটে যেতে দেখা যায়। মনে হয় তাদের কেউ বুঝি তাড়া করছে। চন্দ্রকেতু উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

তোমরা কোন গ্রামের অধিবাসী?

হংসিকা।

ইছামতীর তীরে গ্রাম। এভাবে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

একজন ফিরে দাঁড়ায়। তার চোখেমুখে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার ছাপ।

শুনেছি আমাদের গ্রামে আজ রাতে আক্রমণ হবে। হার্মাদরা আসছে।

হার্মাদ। ভিনদেশি জলদস্যুর দল।

তারাগঞ্জে আমরা এ খবর পেয়েছি। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলেছি।

হংসিকা গ্রামের ভীতসন্ত্রস্ত অধিবাসীরা চলে গেল। চন্দ্রকেতু বিষন্ন মুখে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।

বারবর এই জনপদের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এভাবে মানুষকে উৎখাত করা হয়েছে। এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।

কংকারী জানে, হার্মাদ হলো এদেশে আতঙ্কের আরেক নাম। এরা রাতের আঁধারে চুপিসারে আসে ছিপ নৌকা সুলুপে করে । নিঃশব্দে চলে আসে তারা। গ্রামে আগুন দেয়। মশাল ছুঁড়ে মারে ঘরের চালে । দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। হার্মাদরা খাপখোলা তলোর নিয়ে নিরীহ মানুষজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুপিয়ে কুপিয়ে মারে মানুষকে হত্যা করে শিশুদের। তাদের মনে কোনো মায়াদয়া নেই। ভিনদেশি জলদস্যুদের হাত শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হয়। তারা সেই রক্তমাখা হাত তুলে হো হো করে অট্টহাসি হাসে। তারা দূরের সাগর পারের দেশ পর্তুগালের দাগী অপরাধীর দল। চন্দ্রকেতু ফিসফিস করে বলে,

এরা আমাদের সবুজ গ্রামগুলোকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।

এ কথা শুনে আঁতকে ওঠে কংকারী। ওর চোখের সামনে ভাসে। আগুনের শিখা। ভয়ংকর লাল জিভ বের করে আগুন ছুটে আসে। মানুষের আর্ত চিৎকার । সুলুপ থেকে লাফিয়ে নামছে হার্মাদরা। কংকারী হঠাৎ করে ফুঁসে ওঠে,

আমি যদি কখনো হার্মাদদের বিরুদ্ধে লড়ি ।

লড়বে। তবে তোমাকে এ জন্যে অস্ত্র চালনা শিখতে হবে। খালি হাতে তো তুমি আর লড়াইতে যেতে পার না।

আমি অস্ত্র চালনা শিখতে চাই।

দুর্গ একডালার নাম শুনেছ?

শুনেছি। মেঘনার কাছে। নদী সেখানে প্রবল খরস্রোতা।

ঐ দুর্গে আমার এক বন্ধু আছে। তুরগিল শাহ। দক্ষ সৈনিক। তার কাছে আমার একটি পত্র নিয়ে যাবে। তিনি তোমাকে অস্ত্র চালনা শেখাবেন।

আমাকে আজই পত্রটি লিখে দেবেন?

দেব। খাগের কলম দিয়ে শুধু পদ্যই রচনা করি না, প্রয়োজন হলে লড়াইয়ের চিঠিও লিখব। একডালা দুর্গে যেতে পারবে তো? যথেষ্ট দুর্গম পথ।

যেতে আমাকে হবেই।

সন্ধে হয়ে এসেছে। কাকের ডানার মতো নামছে অন্ধকার। ঝোপে জ্বলছে জোনাকি। কংকারী আজ রাতে চন্দ্রকেতুর কুটিরে থাকবে । নতুন লেখা পুঁথি শুনবে। চন্দ্রকেতু বেতের ডালা থেকে কংকারীকে তিলের নাড়, মুগের মোয়া, নারকেলের তক্তি খেতে দেয়। সাথে বটের আঠার মতো কাজলী গরুর দুধ। ক্ষুধার্ত কংকারী আয়েশ করে খেতে থাকে। চন্দ্রকেতু তাকিয়ে রযেছেন কংকারীর দিকে। এই কিশোর ছেলেটি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। কংকারী অন্য ধরনের ছেলে। ওর ভেতরে একটা জ্বালা রয়েছে। ছেলেটা পিতৃহীন।

কংকারী, তোমার পিতার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?

সাপে ছোবল দিয়েছিল। কালকেউটে। আমার পিতা মাঠ থেকে ফিরে বাড়ির পেছনে রক্তচন্দনের ঝোপের কাছে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখি পিতা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মুখের কোণায় ফেনা। ঝোপের দিকে আঙুল তুলে বলল কালকেউটে। সারারাত বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করে পিতা ভোররাতের দিকে মারা যায়। তারপর থেকে আমাদের সংসারে দারিদ্র। ভূ-স্বামীরা আমাদের ভিটে থেকে উৎখাত করে ।

তাহলে বোঝে ভিটে হারানোর কি যন্ত্রণা। এ যেন মাটি থেকে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে টেনে ফেলার মতো। হার্মাদরা এখন আমাদের গ্রামবাসীদের উৎখাত করতে চাইছে।

সে রাতে রেড়ির তেলের প্রদীপের আলোতে এক মুগ্ধ কিশোরের সামনে পুঁথির পাতা খুললে কবি চন্দ্রকেতু। প্রদীপের শিখায় কংকারীর মুখ লালচে দেখাচ্ছে। বাইরে একটানা ঝিঝি ডাকছে।

: শোনো কংকারী, এই ভূখণ্ডের মানুষেরা কিন্তু নিজের মাটিকে খুব ভালোবাসে। নদী থেকে যেমন ঢেউকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না তেমনি স্বদেশপ্রেম থেকে মানুষকে। এই সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র, রাঢ়, চন্দ্রদ্বীপের মানুষেরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কঠিন মাটির বুক চিরে ফসল ফলায়। তবু তাদের জীবনে এতো দুর্যোগ।

কুটিরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকালো কংকারী। চন্দ্রেকেতু বললেন,

হংসিকা গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে।

পুঁথির পাতা উল্টে গেলেন চন্দ্রকেতু। হংসিকা গ্রাম পুড়ছে। চন্দ্রকেতু গভীর আবেগে ভূর্জপাতায় স্বদেশের মুখ দেখেন।

দেশের কাহিনী বলি শুন দিয়া মন
বঙ্গাল মুলুকের কথা করিব বর্ণন।
সুবে বাংলা সীমানার কথা যদি ধর।
চাট্টিগ্রাম থেকে ছিল তেলিয়াগড়।
উত্তরে পর্বতমালা দক্ষিণে মন্দারণ।
সমুদ্রে বেষ্টিত বলে বায়ু শনশন।
গঙ্গা নদী লখনৌতিকে দুই ভাগ করে।
এক ভাগে বরেন্দ্র আর অন্যের রাঢ় পড়ে।
উত্তর বঙ্গেতে ছিল পুণ্ড্রবর্ধন
যাহার খ্যাতির কথা রচে কবিগণ।
করতোয়া নদী তীরে বিশাল নগর
দেশ বিদেশের বহু জন করে সেথা ঘর।
মকরমুখীরা যায় করতোয়া দিয়ে
পাল তুলে বাণিজ্যের পশরাকে নিয়ে।
বরেন্দ্রের গৌড়তে ছিল বিপুল বসতি
গ্রীস, মিশর, চীন, রোমে ছড়ায় সে খ্যাতি।
গঙ্গার দুই স্রোত কুলুকুলু বয়
মধ্যের ভূ-ভাগের নাম বঙ্গ বলে রয়।

চন্দ্রকেতু সুর করে পড়ে চলেছেন। কংকারীর ভেতরে জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড সাহসী ছেলে সে। নিশুত রাতে একাকী মাঠ পাড়ি দেয়। হংসিকার আগুনে আকাশ নীল। সেদিকে তাকালে জ্বালা আরো বাড়ে। কালকেউটের ছোবলে মারা গেছে তার পিতা। চোখের সামনে সে দেখেছে পিতার শরীর কিভাবে বিষে জরজর হয়।

তার ভেতরে তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। এরপর দিন টাংগি হাতে একাই ঝোপে ঢুকেছিল। কালকেউটের গর্তটা খুঁজে পেল। একটা ইঁদুর ছানা ধরে গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পরেই ফোঁস ফোঁস করে কালকেউটে মুখ বাড়াল। অমনি টাংগির কোপ বসাল কংকারী। সাপটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। হার্মাদরা হচ্ছে কালকেউটের মতো। এখন ছোবল মারছে সমতটের গ্রামগুলোতে।

আপনি আমাকে এখনি আপনার বন্ধু তুরগিল শাহের কাছে পত্র লিখে দিন। আমি কালই রওয়ানা দেব একডালা দুর্গের দিকে।

চন্দ্রকেতু তখনি চিঠি লিখলেন। হার্মাদদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে কংকারীকে অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হতে হবে। অস্ত্রের কথা মনে হওয়াতে হঠাৎ চন্দ্রকেতুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এক চীনা পরিব্রাজক তাকে একবার একটি অদ্ভুত ধরনের অস্ত্র উপহার দিয়েছিল। যে অস্ত্রের নির্মাণ পদ্ধতি অত্যন্ত রহস্যময়। মাত্র অল্প ক’জন কারিগর এটি তৈরি করতে পারত। এর নির্মাণ পদ্ধতিকে কঠোর ভাবে গোপন রাখা হয়েছে। সেই অস্ত্রের আশ্চর্য ক্ষমতা। কৌশলে ব্যবহার করতে পারলে একসাথে প্রচুর শত্রুকে নিহত করা সম্ভব। তবে অস্ত্রটি যথাযথভাবে চালনা করা বেশ জটিল। যখন চীনা পরিব্রাজক এটি উপহার দেয় তখন চন্দ্রকেতু যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি একজন কবি। পুঁথি রচয়িতা। বাস করেন কুটিরে। তপোবনে বসে একাগ্রচিত্তে সাধনা করেন। ভালোবাসেন সবুজ প্রকৃতি। জলজ ফুল, লতাপাতা, পাখি। তাকে কেন এ ধরনের একটি মারাত্মক জিনিস উপহার দেওয়া হচ্ছে! তিনি চিনা পরিব্রাজককে সমতটের প্রকৃতি বন্দনা করে লেখা একটি পুঁথি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল, কিভাবে সমতটের জলাভূমি থেকে মাছরাঙ্গা পাখিদের ধরে রঙিন পালক সংগ্রহ করে তৈরি হয় পোশাক। যা পাঠানো হতো চিনের রাজদরবারে উপহার হিশেবে। তাকে অস্ত্রটি উপহার দেবার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। চীনা পরিব্রাজক মা তু সান তখন হেসে বলেছিলেন, স্বদেশভূমি বিপন্ন হলে কখনো কখনো কবিকেও অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়।

সেই অদ্ভুত আকৃতির অস্ত্রটিকে তিনি এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন । একটি পেটিকার ভেতরে। পেটিকাটি তার মাচার ওপরে রাখা।

জানো কংকারী, আমার কাছে একটি চীন দেশে প্রস্তুত অস্ত্র রয়েছে।

অস্ত্র! আপনার কাছে।

অনেক দিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখনি ওটা বের করছি। এটা তোমার কাজে আসবে।

চন্দ্রকেতু মাচায় উঠে পুঁথি তূপের নিচ থেকে সযত্নে রাখা পেটিকাটি বের করে আনলেন। কংকারী কৌতূহলী। প্রদীপের সামনে পেটিকাটি ধীরে ধীরে খুললেন। ভেতরে চকচক করছে ধাতু নির্মিত একটা বর্তুলাকার জিনিস। যার মাঝে অনেকগুলো ছিদ্র। জিনিসটির গায়ে উড়ন্ত সাপের হিংস্র ভঙ্গি খোদাই করা। সাপের মুখ থেকে আগুনের শিখা বেরুচ্ছে। উপরে একটি ছোট আংকটা। কংকারী সেই অদ্ভুত আকৃতির অস্ত্রটি ধরে ঘোরাতে থাকে।

এটা দিয়ে কি ভাবে শত্রুকে আঘাত করা সম্ভব?

মা তু সান আমাকে বলেছিল এই আংটাটি ঘোরাবার একটি গুপ্ত কৌশল রয়েছে। সেটি জেনে তের বার ঘোরালে এর ছিদ্রের মুখগুলো খুলে যাবে। আর এর ভেতর থেকে তখন তীরবেগে বেরিয়ে আসবে বিষমাখানো ক্ষুদ্র বর্শা। এক সাথে বহু শত্রুকে এতে হত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, আংটাটি ঘোরাতে হবে তের বার।

কংকারীর চোখ কেমন ধকধক করে জ্বলে উঠল। কানে এসে আছড়ে পড়ছে শিশুদের কান্না। মায়েদের বিলাপ ধ্বনি। কে যেন ভেতর থেকে বলছে,

কংকারী, তুমি এই অস্ত্রটি গ্রহণ কর। তোমার বুকে না জেগেছে। প্রতিশোর ঢেউ। তুমি নাও। তুমি প্রশিক্ষণ গ্রহণ কর। নিজেকে তৈরি করে তোল।

কংকরী সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে লড়তে হবে।

আমি এটি চাই। আমি এই অস্ত্র ব্যবহারের গোপন কৌশল অবশ্যই আবিষ্কার করতে পারব।

এটি তোমারই জন্যে কংকারী। নাও। গ্রহণ কর।

চন্দ্রকেতু অস্ত্রসহ পেটিকাটি তুলে দিলেন কংকারীর হাতে । বাইরের পাকুড় গাছের খোড়লে বসা তক্ষক নিশি রাতের নীরবতা ভেঙে ডেকে উঠল।

তখনো দক্ষিণের আকাশ লাল । হংসিকা গ্রামটি জ্বলছে। কংকারী তখনি রওয়ানা দিতে না হতে চাইল খেয়াঘাটের দিকে। একডালা দুর্গে যেতে বেশ সময় লাগবে। রাত তখন পুইয়ে আসছে। চন্দ্রকেতু কুটিরের ঝাঁপ কোলেন। কংকারীর মাথা হাত রাখেন চন্দ্রকেতু।

তোমার উদ্দেশ্য সার্থক হোক। তোমার যাত্রা শুভ হোক।

এ ঘটনার ছ’মাস পর থেকে সমতটের গ্রামে হার্মাদরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে থাকে। অসংখ্য হার্মাদ নিহত হয় ক্ষুদ্র বিষমাখানো বর্শার আঘাতে।

দুঃসাহসী কিশোর কংকারীর কথা ছড়িয়ে যায় সমতটের গ্রাম থেকে গ্রামে। এক সময় হার্মাদরা পর্যুদস্ত হয়। তারা আর গ্রামে আক্রমণ করতে সাহস পেত না।

কংকারীকে শেষ দেখা যায় এক শিশুকে বুকে চেপে বিষকাটালি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। সে রাতে বহু হার্মাদ বিষকাটালির পাশের গ্রাম কান্তনগরে নিহত হয়। ক্ষুদ্র বর্শা তাদের বুকে বিদ্ধ হয়েছিল। কংকারী যখন বিষকাটালিতে ঝাঁপ দেয় তখনো জ্বলছিল গ্রামটি।

এর অনেক দিন পর এক প্রভাতে কবি চন্দ্রকেতু বিষকাটালি নদী দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন। শেষ শরতের বাতাস বইছে। আকাশে দেখা যাচ্ছে দূরাগত পাখিদের। হঠাৎ চন্দ্রকেতু হিজল গাছের পাশে ঝোপের কাছে দুটো কঙ্কাল দেখতে পেলেন। কঙ্কাল দুটো এতদিন নদীর নিচে পানিফলের কাঁটাঝোপে আটকে ছিল। ঘূর্ণির জন্যে মুক্ত হয়ে উপরে ভেসে উঠেছে। একটি ছোট শিশুর কঙ্কালকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। আরেকটি কঙ্কাল। চন্দ্রকেতু কৌতূহলী হয়ে কাছে গেলেন। কঙ্কালের বাঁ হাতে চারটে আঙুলের সাদা হাড়।

চন্দ্রকেতু তখন শুধু ফিসফিস করে বললেন, কংকারী ফিরে এসেছে।

চন্দ্রকেতুর চোখের কোণা তখন চিকচিকি করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *