১৮. রাক্ষুসে শাদা তিমি

রাক্ষুসে শাদা তিমি

নান্টুকেট হচ্ছে আমেরিকার পুব উপকূলের একটি দ্বীপ । তিমি শিকারের জন্যে চমৎকার একটি স্থান। বছরের এ সময়টাতে বিভিন্ন অঞ্চলের তিমি শিকারিদের নৌকাগুলো এসে ভিড় জমায় নান্টুকেট-এ।

ইসমাইল নামের এক দুঃসাহসী কিশোর বাস করত পুব উপকূলের এক ছোট বন্দরে। স্বভাবে সে ছিল কিছুটা বেপরোয়া ধরনের। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে চাইতো। ভালোবাসত ভয়ঙ্করের সাথে মিতালি করতে। নাবিকদের কাছে সে শুনত দূর সমুদ্র যাত্রার রোমাঞ্চকর সব কাহিনি । শুনে শুনে সে প্রচণ্ড উত্তেজিত হতো। ইসমাইল স্বপ্ন দেখত তিমি শিকারিদের নৌকার সাথে সেও যেন উদ্দামভাবে ভেসে চলেছে। প্রচণ্ড ঢেউতে তাদের নৌকা অবিরাম ওঠানামা করছে। সাধারণ এক খালাসী হিশেবে ইসমাইল এক জাহাজে উঠে পড়ল। সমুদ্রের বাতাসের ঝাঁঝালো নোনা গন্ধ সে খুব পছন্দ করত । তাদের জাহাজটি এক সময় এসে পৌছালো নিউ বেডফোর্ড এ। সেখান থেকে নান্টুকেট-এ যেতে হয় নৌকা করে । তিমিরা ঝাকবেঁধে চলে আসে নান্টুকেট-এ। ইসমাইল যখন বেডফোর্ড-এ নামলো ততক্ষণে নান্টুকেট-এর নৌকা ছেড়ে গেছে। আবার ক’দিন পর নৌকা সেখানে যাবে । বাধ্য হয়ে ইসমাইলকে থাকতে হবে বেডফোর্ড বন্দরে।

রাতের জন্যে তার একটা আশ্রয় চাই। ইসমাইলরে কাছে আবার বেশি পরিমাণে অর্থ নেই। সে একটি স্বল্প ভাড়ার সরাইখানার খোজে বের হল।

সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইসমাইল একটি ছোট সরাইখানার সন্ধান পেল। কলকল করে সমুদ্র থেকে ভেজা বাতাস ভেসে আসছে। শুকনো মাছ ভাজার গন্ধ ছড়াছে বাতাস। ইসমাইল সাহস করে ঢুকল সেই রাইখানাটিতে। অনেকটা পথ হেঁটে আসায় সে যথেষ্ট ক্লান্ত। মৃদু আলোতে ঘরটিকে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে।

গল্পগুজবরত নাবিকেরা বসে রয়েছে খাবার টেবিলের চারপাশে। টেবিলে ধোঁয়াওঠা খাবার সাজানো। সরাইখানার মালিকের কাছে গেল ইসমাইল।

: আজ রাতে থাকার জন্যে কোন ঘর পাওয়া যাবে?

: নাহে, কোনো ঘর যে খালি নেই। বুঝতে পারছ তো এটা হল গিয়ে তিমি শিকারের ভরা মৌসুম। মেলা লোকজন এখন ছুটে আসছে। তবে তুমি কি কারো সাথে ভাগ করে এক ঘরে থাকতে পারবে? তাহলে হয়তো আমি একটা ব্যবস্থা কোনোমতে করে দিতে পারি।

: আমাকে তাহলে কার সাথে থাকতে হবে?

: একজন হার্পুনধারির সাথে।

ইসমাইল জানত তিমি শিকারের জন্যে হার্পুন খুবই প্রয়োজন। হার্পুন হচ্ছে এক ধরনের ধারালো বল্লম। হার্পুনধারিরা শিকারের সময় তিমিকে লক্ষ্য করে নিপুণ ভঙ্গিতে হার্পুন ছুঁড়ে মারে। হার্পুন তীরবেগে ছুটে গিয়ে তিমির বিশাল শরীরে গেঁথে যায়। পেছনের দিকটি ধারালো হওয়ার জন্যে হার্পুনটিকে আর টেনে বের করা যায় না। হাপুনের সাথে একটি শক্ত দড়ি আটকানো থাকে। আহত তিমিটি দড়িশুদ্ধ নৌকাকে টানতে টানতে সাঁতার কাটে। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। হার্পুনধারিরা সাধারণত নিষ্ঠুর স্বভাবের লোক হয়ে থাকে। তারা আবার যথেষ্ট বলশালী। এ ধরনের একটি লোকের সাথে থাকতে হবে ভেবে ইসমাইলের মনে কিছুটা দ্বিধা হচ্ছিল।

সরাইঅলা পরিষ্কার ভাবে জানাল, এ ছাড়া অন্য কোনো ঘর খালি নেই। আর সেখানে থাকতেও তোমার অল্প কিছু ভাড়া লাগবে।

বাইরে তীব্র শীতের হিমেল রাত কনকন করছে। চাবুকের মতো ধারালো বাতাস বইছে। ইসমাইল বাধ্য হয়ে সেখানে থাকতে রাজি হল।

সরাইঅলা ইসমাইলকে খাবার দিল। আলু আর ময়দা থেকে তৈরি পুডিং ।

: হাঁর্পুনধারি লোকটি এখন কোথায়?

: সে অনেক রাতে আসবে। লোকটি আবার লাল মাংস খেতে বেশি পছন্দ করে থাকে।

সরাইখানাতে তখন সমুদ্র থেকে ফিরে আসা ক্ষুধার্ত নাবিকেরা ভিড় করছিল। তারা এখন গরম খাবার খেতে চায়। ইসমাইল অবশ্য তাদের কাছ থেকে রোমাঞ্চকর সমুদ্রযাত্রার গল্প শুনতে বেশি আগ্রহী। এ ধরনের গল্প তাকে সহজেই আলোড়িত করে তোলে। তাকে সহজেই পরিচয় করিয়ে দেয় এক দুরন্ত জীবনের সাথে।

সরাইঅলা ইসমাইলকে বলল, এবার তুমি শুতে যাও।

তিমির চর্বির বাতি হাতে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ঠুকঠুকিয়ে উঠে গেল সরাইঅলা । ইসমাইলকে কোণার একটা ঠাণ্ডা, ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিল।

প্রচণ্ড শীত। হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। ইসমাইল বিছানায় পশমি কম্বলের নিচে গুঁটিশুঁটি মেরে শুয়ে পড়ল।

অনেক রাতে কাঠের দরজা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ইসমাইলের। চমকে দেখল একটি বিশাল ছায়ামূর্তি ঘরে প্রবেশ করছে। অল্প আলোতে দেখল এক ভয়ঙ্কর চেহারার মূর্তি। সারা মুখে হলদে, কালো, লাল দাগ। উল্কির চিহ্ন। চকচকে টেকো মাথা। মাঝখানে একটি টিকি ঝুলছে। লোকটাকে কেমন জংলির মতো মনে হচ্ছে।

লোকটি পকেট থেকে একটি কুচকুচে কালো কাঠের মূর্তি বের করল। তারপর মূর্তিটাকে ঝুলিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। ইসমাইলের কাছে মনে হল বুনো লোকটা সুর করে প্রার্থনা সংগীত গাইছে। লোকটি তখনো বিছানায় শুয়ে থাকা ইসমাইলকে দেখতে পায়নি। বাতি নিভিয়ে সে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। ইসমাইল তখন ভয়ে চিঙ্কার করে ওঠে। বুনো লোকটি লাফ দিয়ে উঠে বাতি জ্বালাল। ইসমাইলকে দেখে সে খুব অবাক হয়ে গেছে। বুনো লোকটা লাল চোখ দিয়ে ইসমাইলের দিকে তীব্র ভাবে তাকাল।

: কে তুমি? এখানে কি করছ? আমি তোমাকে খুন করব ।

ইসমাইলের চিৎকার শুনে নিচ থেকে সরাইঅলা হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসে।

: বুঝেছ, এই হল গিয়ে সেই হার্পুনধারি। এর নাম হচ্ছে কিকেগ। কিকেগ, এ ছেলেটি আজ রাতে কিন্তু এখানে থাকবে। সে অর্ধেক ভাড়া দিয়েছে।

কিকেগ তখন হাসতে লাগল, এ কথা আমাকে আগে বলতে হয় । আমি তো এখনি এই ছেলেটাকে প্রচণ্ড আঘাত করতাম। কী বাজে একটা ব্যাপার তাহলে হতো।

: তুমি তো এলে সেই মাঝ রাতে। বলি কখন।

কিকেগের সাথে তখন ইসমাইলের বেশ ভাব হয়ে যায়।

পর দিন ইসমাইল ছোট সমুদ্র বন্দরটি ঘুরে দেখল। এ ধরনের বন্দরে হাঁটলে সমুদ্রের তাজা নোনা গন্ধ পাওয়া যায়। জেটিতে দুধশাদা গাঙচিলের ঝক অবিরাম ওড়ে। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ফেরে জেলেরা। নাবিকেরা বেশিরভাগ সময় তিমি শিকারের কথা বলে। তাদের চোখ তখন উত্তেজনায় চকচক করে।

সন্ধেবেলায় সরাইখানায় ফিরে ইসমাইল দেখল কিকেগ চুল্লির আগুনের সামনে বসে রয়েছে। লালচে আভায় কিকেগের উলকি আঁকা মুখকে বিচিত্র দেখাচ্ছে। কিকেগ ইসমাইলকে শোনাল তার বিচিত্র পরিচয়।

দক্ষিণ পশ্চিমের অনেক দূরে কোকোভুকো নামের একটি ছোট দ্বীপে কিকেগের জন্ম। তার বাবা ছিলেন ঐ দ্বীপের একজন গোত্রপতি। তার প্রবল শখ দেশ ভ্রমণের। তাই সে একদিন দ্বীপে ভেড়া এক জাহাজে উঠে নতুন বন্দরের খোঁজে পালাল। প্রথমে সে ছিল খালাসী। সমুদ্র যাত্রায় প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করল কিকেগ। ধীরে ধীরে একজন দক্ষ তিমি শিকারি হল। নিপুণ ভাবে হার্পুন ছুঁড়ে মারতে পারত সে। যখন উত্তাল সমুদ্রে বিশাল তিমিকে গাঁথা হতো ধারালো হার্পুন তখন সে খুব উত্তেজনা অনুভব করত। নীল সমুদ্রে কেমন ছটফটিয়ে ওঠে তিমি। তীক্ষ্ণ হার্পুন তিমির শরীরে গভীরভাবে গেঁথে যায়। তিমি তখন তার বিশাল শরীরটাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করতে থাকে।

এ কথাগুলো বলার সময় কিকেগের চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছিল। ইসমাইল মুগ্ধভাবে শুনছিল কিকেগের কথা। এ রকম বন্য স্বপ্ন মাঝে মাঝে হয় তারও। কিকেগ যেন তার মনের কথাগুলোই বলছে।

: জানো কিকগ, আমি তো ঘর থেকে বেরিয়েছি তিমি শিকারের জাহাজে কাজ নেবার জন্যে। আগামীকাল তাই নান্টুকেটুতে যাচ্ছি।

কিকেগ উৎসাহী হয়, আমিও তাহলে যাবো তোমার সাথে। আমরা একই জাহাজে যাবো।

ইসমাইল তার অভিযানে কিকেগের মতো অভিজ্ঞ একজনকে পেয়ে খুশি হল । কিকেগ একজন দক্ষ হার্পন শিকারি। তিমি শিকারের জাহাজে তার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।

পরদিন সন্ধেবেলার দিকে নান্টুকেট-এ এসে পৌছালো ইসমাইল আর কিকেগ। তারা এল একটি গরুর গাড়িতে করে। এ দিকের পাহাড়ি পথে শুধু গরুর গাড়ি চলে। তারা এসে একটি সরাইখানায় উঠল। এটার ঠিকানা পেয়েছিল আগের সরাইঅলার কাছ থেকে। সেখানে সামুদ্রিক মাছের চমৎকার স্যুপ পাওয়া যায়। সরাইখানার মাছের ডিমের তরকারিও আবার বেশ সুস্বাদু।

সরাইঅলার স্ত্রী কিকেগের হাতের হাৰ্পনটি দেখে বলল, শোবার ঘরে কিন্তু হাৰ্পন রাখা যাবে না।

: কেন?

: একবার হার্পুনবেঁধা অবস্থায় শোবার ঘরে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে আমরা শয়নকক্ষে কোনো ধরনের অস্ত্র রাখা নিষেধ করে দিয়েছি। অসুবিধে নেই, হার্পুনটি আমাদের কাছেই থাকবে। সমুদ্রে যাবার সময় নিয়ে যাবে।

পরদিন কিকেগ ইসমাইলকে বলল, অনেক জাহাজ এখন তিমি শিকারে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। তুমিও এমন একটি জাহাজের খোজ করো।

ইসমাইল বলল, এখানে তোমাকে তো অনেকেই চেনে। তুমি একটু খোঁজ করলে ভালো হয়। তাতে আমার উপকার হয়।

: তুমি খোজ। এতে তোমার অভিজ্ঞতা হবে।

ইসমাইল জাহাজের খোঁজে গেল তীরের দিকে। একপাশে ওয়ালো পাতার তৈরি জেলেদের ঝুপড়ি। বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ। একটি জাহাজের খোঁজ পেল ইসমাইল। জাহাজটি তিন বছরের জন্যে সমুদ্র যাত্রার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাহাজটির নাম পেকুডে। পুরানো, ছোট আকারের জাহাজ। অসমতল ডেক। তিমির চোয়ালের হাড় দিয়ে জাহাজের হাতলটি তৈরি।

ইসমাইল কথা বলল জাহাজের লোকদের সাথে। যাওয়ার ব্যবস্থাটাকে পাকা করল। জানল পেকুড়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম হচ্ছে আহাব। বড় রহস্যময় আর দুর্দান্ত স্বভাবের মানুষ বলে পরিচিত এই ক্যাপ্টেন আহাব। বাড়ি থেকে সহজে সে বের হয় না। অনেক গল্প রয়েছে তার অদ্ভুত সব আচরণ নিয়ে।

এবারের যাত্রায় তিন বছর সমুদ্রে থাকবে পেকুড়ে জাহাজটি। কাজেই প্রচুর রসদপত্র সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

পেকুডে জাহাজে উঠে এলো ইসমাইল আর কিকেগ। জাহাজের বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে বুঝল সবাই ক্যাপ্টেন আহাবকে অন্য চোখে দেখে। তাকে রীতিমতো ভয় পায়।

জাহাজের প্রধান মেট স্টারবেক। কিকেগকে দেখে খুশি হল।

: বন্দরে আমি তোমার অনেক সুনাম শুনেছি। তুমি একজন খুব দক্ষ হার্পুন শিকারি। আমি তোমাকে আমার নৌকায় অবশ্যই নেব। সমুদ্রে তিমি দেখামাত্রই নৌকা নামানো হবে। | পরদিন ভোরে জাহাজটি বন্দর থেকে ছাড়বে । তার সবরকমের প্রস্তুতি জোরেসোরে চলছে। পাল টাঙানো হচ্ছে। দড়ি বাঁধা হচ্ছে। রাতে ক্যাপ্টেন আহাব জাহাজে এলেন।

ভোরবেলাটি ছিল কুয়াশাঢাকা। সূর্যের দেখা নেই। পেকুডে যাত্রা শুরু করল। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন আহাব। ইসমাইল কৌতূহলী চোখে তাকে দেখতে থাকে। লম্বা তামাটে শরীর। ধূসর চুল। দেখতে কেমন ভয়ঙ্কর। দৃপ্ত ভঙ্গিতে ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার একটি পা নেই। মাস্তুলের দড়ি ধরে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে । জাহাজের সমস্ত লোক, খালাসীরা তার সামনে এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন পকেট থেকে একটা সোনার মুদ্রা বের করলেন। সকালের আলোতে সেটা চকচক করে উঠল।

ক্যাপ্টেন তখন ঘোষণা করলেন, যে প্রথমে শাদা তিমিটাকে দেখতে পাবে তাকে এই সোনার মুদ্রা পুরস্কার দেয়া হবে।

জাহাজের সবাই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, মবি ডিক, মবি ডিক। শাদা তিমি, শাদা তিমি ।

ক্যাপ্টেন আহাব তার হাতের স্বর্ণমুদ্রা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ধরলেন। গাঙচিলেরা শাদা ডানা মেলে উড়ছে। লোকজনেরা সমবেতভাবে বলল-আমরা অবশ্যই শাদা তিমিটাকে খুঁজে বের করব। এবং সেটাকে মেরে ফেলব। তাকে শেষ করব।

ক্যাপ্টেন আহাব ঋজু ভঙ্গিতে ঘুরে তাকালেন। সোনালি রোদের আভা পড়েছে তার মুখে । তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তিনি কি যেন সন্ধান করছেন।

: শাদা তিমিটাকে দেখামাত্রই চিৎকার করে তোমরা আমাকে জানিয়ে দেবে। ঐ তিমিটা ফোয়ারার মতো পানি ছিটিয়ে দেয়। ঐ মবি ডিক আমার একটা পা কেটে নিয়েছে। আমার জীবনটাকে একেবারে অভিশপ্ত করে দিয়েছে। বাকি জীবনের জন্যে পঙ্গু করেছে। আমি এর প্রতিশোধ নেবই। শাদা তিমিকে আমি ছাড়ব না ।

নিজের পা-টি খোয়া যাবার পর থেকে আহাবের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় কী করে এই মারাত্মক ক্ষতির প্রতিশোধ সে নেবে।

ইসমাইল দেখল ক্যাপ্টেন আহাব জাহাজের মাস্তুলের দড়ি হাতের মুঠোতে ধরে শক্তভাবে পাকিয়ে চলেছে। তাকে তখন যেন অনেকটা হিংস্র চিতাবাঘের মতো দেখাচ্ছে। ইসমাইলের পেছনে এসে দাঁড়াল কিকেগ।

ওরা দুজন ক্যাপ্টেনের মারাত্মক ক্রোধকে দেখছিল।

: ঐ তিমিটিকে ধরার জন্যে প্রয়োজনে আমি সারা পৃথিবীর সমুদ্র চষে ফিরব। তোমরা কি আমার সাথে থাকবে না? আমি তোমাদেরকে চাই।

খালাসীরা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, অবশ্যই থাকব। আমরা শাদা তিমিটার উপর নজর রাখব। আপনার প্রতিশোধে থাকব।

মৌসুমী বাতাস পেয়ে তখন জাহাজের পাল ফুলে উঠেছে। পেকুডে তরতর করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। ক্যাপ্টেন আহাব দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি শাদা তিমিটিকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ইসমাইল কৌতুহলী হল শাদা তিমি মবি ডিক সম্পর্কে। ক্যাপ্টেনের কি প্রচণ্ড রাগ ঐ তিমিটির উপর । জাহাজের প্রবীণ খালাসীদের কাছে ইসমাইল জানতে চাইল শাদা তিমিটি সম্পর্কে। তারা তাকে শোনাল এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।

এই মবি ডিক হল এক রহস্যময় তিমি। কেউ বলে সে অজেয়। তাকে কোনোভাবেই আর ধরা যায় না। অতি দুরন্ত স্বভাবের এই তিমিটি যেন সকল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কারো কাছে সে আবার একটি পিশাচ বলে পরিচিত। সমুদ্রের ‘মহাআতঙ্ক। বেশিরভাগ লোক তাকে অবশ্য দেখতে পায়নি।

জাহাজের মাস্তুলের চুড়োতে বসে থাকা লোকটি তিমির খোজে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। কোথাও তিমির চিহ্নকে দেখতে পেলেই অদ্ভুত এক সুরে ডাক দেয়। তার সেই ডাকের প্রতীক্ষায় তখন আকুল হয়ে থাকে তিমি শিকারিরা।

জাহাজের সবাই সেই ডাক শুনে ছুটে এল। ঝটপট করে নৌকা নামানো হল। তিমিটি ডুশ করে ডুব দেয়। তার বড় লেজটাকে দেখা গেল তখন।

নৌকার হার্পুনধারিরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আবার দেখা গেল তিমিটাকে। ক্যাপ্টেন আহাব হাঁক ছাড়লেন, হার্পুন ছুঁড়ে মারো।

শাঁ শাঁ করে ছুটে গেল হাপুন। তিমিটার কুঁজের গভীরে গিয়ে ঢুকল হাধুনটা। তিমিটি নৌকাকে তীব্র ভাবে টেনে নিয়ে চলল । খুব দ্রুত চলছিল তিমিটি। সেই সাথে দড়ির টানে নৌকাটাও। খালাসীরা নৌকার পাটাতনে সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় আহত তিমিটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। খালাসীরা তখন হার্পুনের দড়িটি টানতে লাগল। নৌকাটাকে নিয়ে আসা হল তিমির কাছাকাছি। কয়েকজন খালাসী লম্বা ছুরি দিয়ে তিমিটাকে আঘাত করতে থাকে। রক্তে লাল হয়ে গেল সমুদ্র। এক সময় তিমিটি মারা যায়।

তিমি শিকারিরা উল্লাস প্রকাশ করে। এ রকম বিশাল একটি প্রাণিকে মারতে পেরে তারা নিজেদের যথেষ্ট সাহসী বলে মনে করছে। পেকুডে জাহাজের পাটাতন থেকে মোটা শিকল নামানো হল মৃত তিমিটাকে বাধার জন্যে। তিমির রক্ত কলকলিয়ে মিশে যায় সমুদ্রে। মৃত তিমির রক্তের গন্ধে তখন ছুটে আসে হাঙ্গরেরা। খালাসীরা বর্শা দিয়ে হাঙ্গরদের আঘাত করা শুরু করল। হাঙ্গরেরা সুযোগ পেলেই তিমিটিকে ছিড়ে খেয়ে ফেলত।

সকালে শুরু হল তিমির শরীর থেকে তেল বের করার কাজ। তিমির পিঠে একটা বড় ফুটো করা হল। তিমির চর্বিঅলা মাংশ থেকে তেল বের করা হল। কমলার খোসার মতো এক ধরনের লম্বা আঁশ থেকে চর্বি সংগ্রহ করা হচ্ছিল। চর্বির ডোরাকাটা আঁশগুলো ফেলা হল খোলের ভেতরে। সেখানে সেগুলো জ্বাল দেয়া হবে। সেখান থেকে তখন পাওয়া যাবে প্রচুর তেল।

পেকুডে ভেসে চলেছে তরতর করে। বেশ কয়দিন আর কোনো তিমির দেখা পাওয়া গেল না। মাস্তুলে বসা লোকটি তাকিয়ে থাকে। সমুদ্রে কোনো ফোয়ারা দেখা যায় কিনা। ফোয়ারা দেখে বোঝা যাবে তিমির অবস্থানটি কোথায় ।

কিকেগ দীর্ঘদিন সমুদ্রে ছিল। সে অনেক অভিজ্ঞ। ইসমাইলকে সে তিমির ফোয়ারার ব্যাপারটিকে বোঝায় ।

তিমিরা চোয়ালের সাহায্যে নিশ্বাস নেয় না। মাথার উপরের একটি ফুটোর সাহায্যে নিশ্বাস নেয় । তিমি যখন শ্বাসক্রিয়া চালায় তখনই সমুদ্রের পানিতে ফোয়ারার সৃষ্টি হয়। তিমিরা একবার মাত্র এক ঘণ্টার জন্যে নিশ্বাস নিয়ে রাখতে পারে। ঐ সময়টুকু পেরিয়ে গেলেই আবার নিশ্বাস নেয়ার জন্যে পানির উপরে উঠে আসে। শিকারিরা ধাওয়া করলে ডুব মেরে সমুদ্রের তলে চলে যায়।

কিকেগ একটি অদ্ভুত কথা জানায়। এই ফোয়ারা নিয়ে কোথাও একটি বিশ্বাস রয়েছে। ফোয়ারার পানি যদি কোনোভাবে কারো চোখে পড়ে যায় তাহলে সে অন্ধ হয়ে যাবে। তিমি চরিত্র সম্পর্কে ইসমাইলকে আরো বেশ কিছু তথ্য জানায় কিকেগ।

এক ধরনের তিমি আছে যাদের সরু মাথা নৌকার অগ্রভাগের মতো। যাদের পেছনে শিকারিরা তাড়া করলে ভাসমান বরফখণ্ডের নিচে লুকিয়ে পড়ে। এ ধরনের তিমির লেজের পেছনে গিয়ে পড়লে প্রচণ্ড ঝাপটায় নৌকাকে উল্টে দেয়। হিংস্র স্পার্ম তিমি মাথা, লেজ কিংবা চোয়াল, যা দিয়ে সুবিধে তাই দিয়ে লড়াই করে। এদের হাঁ করা চোয়ালের কাছে কোনো নৌকা এসে পড়লে সে মুখ বন্ধ করে ডিমের খোসার মতো নৌকাটাকে চিবিয়ে খুঁড়িয়ে দেয়।

কয়েক দিন পর মাস্তুল থেকে ফোয়ারা দেখার খবর পাওয়া গেল। জাহাজের সবাই দেখল বিরাট একটা এলাকা নিয়ে ফোয়ারা ফুটছে। গোলাপি বুঁদবুঁদগুলো বাতাসে উড়ছে।

নৌকা নামানো হল সাথে সাথে। কিকেগ হাৰ্পুন ছুঁড়ে মারল। একটি তিমি আহত হল। সেখানে ছিল তিমিদের একটি ঝক। অন্য তিমিগুলো ধেয়ে এসে ঘিরে ফেলল নৌকাগুলোকে। তিমিদের জটলার মধ্যে পড়ে যায় খালাসীরা। এ রকম বিপজ্জনক অবস্থায় আগে আর কখনও পড়েনি তারা। তিমিগুলো তীব্র আক্রোশে ফুসছে। তাদের কাছে তখন মনে হচ্ছিল তিমিগুলো যেন জীবন্ত প্রাচীরের মতো তাদের ঠেসে চেপে ধরতে ছুটে আসছে। খালাসীরা ক্রমাগত দাঁড়ের আঘাত করতে থাকে তিমিগুলোর উপর। কোনো মতে একটা সরু পথ বের করে দ্রুত গতিতে সেখান দিয়ে নৌকাগুলো বের করে আনল। সেদিন পেকুড়ে জাহাজের খালাসীদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

ইসমাইল পেকুড়ে জাহাজে উঠেছিল তিমি শিকারের আকর্ষণে। ছোটবেলা থেকেই তিমি শিকারের কাহিনিতে সে প্রচণ্ড আকৃষ্ট। এতো বিশাল আকারের একটি প্রাণিকে বধ করতে মানুষ মোটেই ভয় না। দক্ষতার সাথে তিমিকে সে কাবু করে ফেলে।

তিমি শিকারের কাহিনি শোনার সময় বালক ইসমাইলের মাঝে এক ধরনের বুনো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত। দিন দিন প্রচুর অভিজ্ঞতা হতে লাগল তার। ক্রমশ সে হয়ে উঠলো সাহসী। মৃত তিমিকে জাহাজের ডেকে তুলে চাক চাক করে কাটার কাজে সে দক্ষ ছিল। চাকা মাংশগুলো জ্বাল দেয়া হতো। তিমির দাঁত আর লম্বা চোয়ালের হাড় যত্ন করে রাখা হতো। জাহাজে দিনগুলো বেশ উত্তেজনার মাঝ দিয়ে কেটে যাচ্ছিল ইসমাইলের ।

একসময় জাহাজটি এসে পৌঁছাল ভারত মহাসাগরে। পেকুডে জাহাজের খালাসীদের নাকে একটা উগ্র গন্ধ এসে লাগে। একজন বৃদ্ধ কর্মচারি দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, এ গন্ধ আমার কাছে খুব চেনা। এটা হচ্ছে কোনো মৃত তিমির গন্ধ। আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটা ফরাসি জাহাজ ভেসে যাচ্ছে। সেটার পাটাতনের সাথে বাঁধা রয়েছে একটি মৃত তিমি। বিশাল শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। | বিড়বিড় করে বলল স্টারবেক, এটা নিশ্চয়ই একটা অসুস্থ তিমি ছিল। তারপর মারা গেছে। আমি গন্ধ পেয়েই ঠিক বুঝতে পেরেছি। আর অসুস্থ তিমির পেটেই তো থাকতে পারে…

: কি থাকতে পারে?

: দারুন এক জিনিশ। দেখি না পাই কিনা। ওদের জাহাজ থেকে আগে বুদ্ধি করে তিমিটাকে উদ্ধার করতে হবে। তিমিটাকে ছাড়িয়ে আমাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

বাতাসে ভাসছে মৃত তিমির উগ্র গন্ধ। খালাসীরা নাকে কাপড় দেয়। ফরাসি জাহাজটি কাছে আসে।

ক্যাপ্টেন আহাব চিৎকার করে জানতে চায়, তোমরা কি কোনো শাদা তিমিকে দেখেছ? একটা শাদা তিমি।

ফরাসি জাহাজ থেকে উত্তর আসে, না। শাদা তিমিকে আমরা দেখিনি।

স্টারবেক চালাকি করে বলে : তোমরা যে এই মৃত তিমিকে এভাবে বেঁধে নিয়ে চলেছ এর গন্ধে তো তোমরা এক সময় ভয়ানক অসুস্থ হয়ে যাবে। এ যে বিপদজনক।

স্টারবেকের এ কথায় ফরাসি জাহাজের ক্যাপ্টেন বেশ চিন্তিত হয়।

: তাহলে আমরা কি করব?

: বাঁচতে চাইলে মৃত তিমিটার দড়ি কেটে এখনই ফেলে দাও।

তাই করল তারা। মৃত তিমির বিকট গন্ধে ঐ জাহাজের খালাসীরাও যথেষ্ট বিরক্ত ছিল। শুধু ওদের ক্যাপ্টেনের জন্যে ওরা কিছু বলতে পারছিলনা । ক্যাপ্টেন বলেছিল তিমিটাকে বেঁধে রাখতে। এখন পেকুডে জাহাজ থেকে জোর সমর্থন পেয়ে ফরাসি জাহাজের খালাসীরা তাড়াতাড়ি মৃত তিমিটাকে সমুদ্রে ফেলে দিল। তাদের চেহারা দেখে মনে হল যে আপদ বিদায় করেছে। ফরাসি জাহাজটা চলে যায়।

স্টারবেক মৃত তিমিটির কাছে গেল নৌকা নিয়ে। তারপর তিমিটির পেট লম্বা ছুরি দিয়ে চিরে ফেলল। অনেকটা গভীর গর্ত করে ফেলল। লাল মাংশ ফাঁক করে স্টারবেক ভেতরে হাত ঢোকাল। তারপর সাবানের মতো থকথকে একটা জিনিশ বের করে আনল। অমনি চমৎকার মিষ্টি একটা গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে যায়। খালাসীরা পেল সুগন্ধ। সামুদ্রিক নোনা গন্ধটা যেন কিছুক্ষণের জন্যে চলে গেল। স্টারবেকের চোখ মুখ আনন্দে চিকচিক করছে। যেন একটা মহার্ঘ বস্তুকে সে এবার পেয়েছে।

: পেয়েছি। এটা হল খুব দামি জিনিশ এ্যামবার। এক ধরনের মোম। এ দিয়ে সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা হয়।

কিকেগ ইসমাইলকে জানাল সাধারণত অসুস্থ তিমির পেটে এই এ্যামবার কখনো কখনো পাওয়া যায়। যেমন এটার পেটে পাওয়া গেছে।

বাতাসে পাল তুলে পেকুড়ে তরতর করে ভেসে চলেছে। ক্যাপ্টেন আহাব প্রতিদিন ডেকে এসে দাঁড়ায়। তিমির হাড়ের তৈরি নকল পা টি পাটাতনে ঠকঠক করে শব্দ তোলে। মাস্তুলের চুড়োতে বসে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেশ করে, শাদা তিমির কোনো চিহ্ন কোথাও কি দেখা যাচ্ছে?

: না।

উত্তর শুনে ক্যাপ্টেন আহাবের চোয়াল শক্ত হয়।

একদিন একটি জাহাজকে পেকুডের দিকে আসতে দেখা গেল। ইংরেজদের জাহাজ। পেকুডের পাশে এসে থামে। নীল পোশাক পরা বয়স্ক ক্যাপ্টেন ডেকে দাঁড়ানো। ক্যাপ্টেন আহাব যথারীতি জানতে চায়, আপনি কোনো শাদা তিমিকে দেখেছেন?

জাহাজের ইংরেজ ক্যাপ্টেন তার একটি নকল হাত তুলে ধরে। সেটা তিমির হাড় দিয়ে তৈরি।

: এটা দেখেছেন?

ক্যাপ্টেন আহাব হেসে ওঠে।

: আমার গেছে পা আর আপনার হাত। আপনি তাহলে সেই শাদা তিমিটাকে দেখেছেন।

: গত বছর আমি ঐ শাদা তিমিটিকে দেখেছি। ওটাই আমার হাতটিকে কেড়ে নিয়েছে।

: কেমন করে?

: একবার তিমি শিকারের জন্যে নৌকা নামিয়েছি। প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম সেই তিমিটাকে। হঠাৎ বিরাট একটা শাদা তিমি সমুদ্রের নিচ থেকে উঠে এলো। দুধশাদা মাথা। পিঠে শাদা দাগ। কিন্তু ঐ তিমিটির চামড়ায় প্রচুর আঘাতের চিহ্ন দেখলাম।

এ কথা শুনে ক্যাপ্টেন আহাব উত্তেজিত হয়ে যায়।

: বুঝেছি, ওটাই ছিল মবি ডিক। আর চামড়ার দাগগুলো ছিল আমার ছোড়া হার্পুনের আঘাত। আমি যে ওটাকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছিলাম।

: কি যে ধূর্ত ছিল ঐ শাদা তিমিটা। সেটা ছুটে এসে আহত তিমির দড়ি কামড়াতে শুরু করল। সে চেয়েছিল তিমিটিকে ছাড়িয়ে নিতে। ওটাকে ধরার অনেক চেষ্টা করলাম। শাদা তিমি তার বিশাল লেজ দিয়ে আমাদের নৌকাকে প্রচণ্ড আঘাত করল। নৌকা ভেঙে দু টুকরো হল। পানিতে ছিটকে পড়লাম আমরা। শাদা তিমিটা হাৰ্পুন নিয়ে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিল। আমিও সেই সাথে ডুবে গেলাম।

: আপনি কি ওটাকে আর দেখেছেন?

: আরো দু বার ওটাকে দেখেছি।

: তখন আপনি মারার জন্য চেষ্টা করেননি?

: না, কারণ ওটা ছিল ভয়ানক ধূর্ত তিমি । ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে তিমি। আমি জানতাম ওটাকে বাগে পাওয়াটা আমার জন্য দুঃসাধ্য হবে। আমাকে সমুদ্রে যথেষ্ট নাস্তানাবুদ করেছে।

ক্যাপ্টন আহাব দাত পিষলেন। তার চোখে মুখে ক্রোধের রক্তিম ছাপ।

: জেনে রাখুন, ঐ তিমিটি কিন্তু শিকারির আঘাতেই মরবে। সে আর ছাড়া পাবে না। কোনোভাবেই তার মুক্তি নেই ।

পেকুড়ে জাহাজের নিচের একটা ঘর ছিল কামারশালা। তিমি শিকারের জন্যে যে সব ছুরি আর হার্পুন ব্যবহার করা হতো সেগুলোর ফলা সেখানে শাণ দেয়া হতো। ধারালো করা হতো। গনগন করে সবসময় আগুন জ্বলত কামারশালাটিতে। একদিন সেখানে এলেন ক্যাপ্টেন আহাব। তার হাতে একটি থলি। কারিগর লোকটি তখন বলুমের ফলাকে ধারালো করছিল। ক্যাপ্টেন আহাব তার সামনে এসে দাঁড়ায়।

: কি করছ তুমি?

: পুরানো বল্লমের ফলা মেরামত করছি ক্যাপ্টেন।

: তোমাকে আমার জন্য একটি জরুরি কাজ করে দিতে হবে।

: কি?

: এই যে দেখছ থলি এর ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের নাল। ঐ ঘোড়াগুলো ছিল আবার খুব দৌড়বাজ। আমি অনেক দিন ধরে এসব জমিয়েছি। তুমি ওগুলো গলিয়ে একটা হার্পুন বানিয়ে দেবে। এমন শক্ত বল্লম হবে সেটা যা হবে তিমির হাড়ের চাইতেও অনেক বেশি শক্ত। ভাঙবে না কোনো অবস্থায়। পারবে তো?

: পারব।

: চমৎকার। তাহলে তুমি পুরস্কার হিশেবে পাবে স্বর্ণমুদ্রা। আমি চাই শক্ত, তীক্ষ চকচকে একটি বল্লম। বুঝতে পারছ?

ক্যাপ্টেন আহাবের চোখ উত্তেজনায় ঝিকিয়ে উঠল।

: বুঝলে, এমন একটা বলুম চাই কোনো পিশাচও যেন তা আর ভাঙতে না পারে।

জাহাজ ভেসে চলেছে জাপান সমুদ্রের দিকে। আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হয়ে এলো। ক্যাপ্টেন আহাব অস্থিরভাবে ডেকে চলাফেরা করত। তাকে কখনও কখনও অস্বাভাবিক প্রকৃতির বলে মনে হতো। কি যেন তাকে অবিরাম তাড়া করে ফিরছে। তাকে আর স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কখনো কোনো মাপার যন্ত্র দিয়ে সূর্যের দিকে তাকাত। বিড়বিড় করে বলত, হে সূর্য, তুমি তো আমাকে ঠিক নির্দেশ দিতে পারো। তুমি কি বলতে পারবে কোথায় রয়েছে আমার প্রধান শত্রু? কোথায় রয়েছে মবি ডিক? তুমি তো তাকে সবসময় দেখতে পাচ্ছো। এখনো দেখছো। আমাকে তার সঠিক অবস্থানটি জানিয়ে দাও। আমার যে খুব প্রয়োজন।

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যন্ত্রটিকে ডেকে ছুঁড়ে মারতেন।

: না, আমি আর এই যন্ত্র ব্যবহার করব না। করব কেন? যা আমি জানতে চাই তাতো এই যন্ত্রটি বলে দেয় না।

সন্ধেবেলায় পুব দিক থেকে হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস বইতে থাকে। বুনো ঘোড়ার মতো ছুটে আসে বাতাস। একসময় প্রবল হয়ে উঠলো। পেকুডে দুলতে লাগল। একটা প্রবল ঢেউ এসে জাহাজের পাটাতনে আঘাত করল। পেছনে রাখা ছিল ক্যাপ্টন আহাবের নৌকা। সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

ডেক থেকে চিৎকার করে উঠলো প্রধান মেট স্টারবেক।

: দেখো, উপরে তাকাও।

খালাসীরা দেখল মাস্তুলের আগায় আগুন জ্বলছে। দড়িতে আগুনের কণাগুলো দপদপ করে লাফাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে জাহাজের সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়। স্টারবেক তখন নুয়ে পড়ল ডেকে। প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলতে লাগল, আমাদের সবাইকে এবার দয়া করুন ঈশ্বর । দয়া করুন। ঘোর অমঙ্গলের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুন।

তখন শোনা গেল আহাবের চিৎকার।

: সবাই শোন । তাকাও ওদিকে। ঐ আগুন আমাদেরকে শাদা তিমির আস্তানা দেখিয়ে দিচ্ছে। চিনিয়ে দিচ্ছে আমি এই আগুনকে এখন অনুসরণ করব।

পেকুডে তখন দুলছে। ক্যাপ্টেন আহাবকে উন্মাদের মতো দেখাচ্ছে। ঘোড়ার নাল থেকে তৈরি হার্পুনটা একপাশে রয়েছে। শোঁ শোঁ বাতাস বইছে। চারপাশে ঘন ধূসর ছায়া নেমে এসেছে। খালাসীরা কেমন আতঙ্কিত।

স্টারবেক ক্যাপ্টেন আহাবের হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দেয়।

: চলুন, আমরা এখান থেকে ফিরে যাই। মনে হচ্ছে এই যাত্রা আমাদের জন্যে শুভ হবে না। ঐ শাদা তিমির খোঁজে আর সামনে যাবেন না । ওটা একটা পিশাচ। চলুন ক্যাপ্টেন।

খালাসীরা স্টারবেকের কথায় রাজি। তারা সবাই এখন বাড়িতে ফিরে যেতে চাইছে। সমুদ্রের এই পরিবেশকে তাদের কাছে যথেষ্ট ভীতিকর বলে মনে হচ্ছে। এ কোনো অনিশ্চয়তার দিকে তাদের নিয়ে যেতে চাইছে ক্যাপ্টেন আহাব। খালাসীরা জাহাজটিকে ঘোরাতে প্রস্তুত হয়।

তখন ক্যাপ্টেন আহাব তার সেই নতুন হার্পুনটিকে তুলে ধরল। হাপুনের আগায় তখন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে উঠলেন ক্যাপ্টেন, তোমরা না শপথ নিয়েছিলে শাদা তিমিকে শিকার করবে বলে। তোমাদের অঙ্গীকার ছিল সেটা। যতক্ষণ পর্যন্ত শাদা তিমিটির দেখা না পাওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত জাহাজ পুব দিকে চলতে থাকবে। কোনোরকমের ভয় নেই।

ক্যাপ্টেনের নির্দেশে জাহাজটি আবার পুব দিকে চলতে থাকে। পরদিন খুব ভোরে মাস্তুলের চুড়তে বসা লোকটি সমুদ্রে পড়ে গেল। খালাসীরা সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর কয়েকটি ছোট তিমি। লোকটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। উত্তাল সমুদ্র তাকে গ্রাস করেছে।

পেকুডে ক্যাপ্টেন আহাবের নির্দেশে মহা সমুদ্রের এলাকায় এসে পৌছাল। ক্যাপ্টেন আহাবই প্রথম শাদা তিমি মবি ডিককে দেখতে পেলেন। তখন থেকেই তিমিটিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে লাগলেন।

ক্যাপ্টেন আহাব জানেন মহা সমুদ্রের এই এলাকাটি হল মবি ডিকের থাকার একটি জায়গা। সমুদ্রের এখানেই সেবার রাক্ষুসে শাদা তিমিটা তার পা-টাকে কেটে নিয়েছিল।

ক্যাপ্টেন আহাবের জিঁদ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

: সবার আগে আমি মবি ডিককে দেখতে চাই। আমাকে একটি কাঠের আসনে বসিয়ে মাস্তুলের চুড়োতে তোল। আমি এখন থেকে সেখানেই থাকব।

তাই করা হল। দিনেরবেলায় আহাব কাঠের আসনের চুড়োতে বসে থাকতেন। সেখানেই তার জন্যে খাবার দেয়া হতো। রাতে তিনি অস্থিরভাবে ডেকে ঘুরতেন। তার পোশাক ভিজে যেত ঘন কুয়াশায়।

পেকুড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শাদা তিমিটাকে কোথাও আর দেখা যাচ্ছে । একদিন স্টারবেক দেখল ক্যাপ্টেন আহাব রেলিং ধরে ঝুঁকে রয়েছেন। তার চোখে টলটল করছে অশ্রু বিন্দু।

স্টারবেক পেছনে এসে দাঁড়ায়।

: ক্যাপ্টেন ।

: বুঝলে স্টারবেক, আমার মনে পড়ছে চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স মাত্র আঠারো। তাজা এক যুবক। ভালোভাবে হার্পুন চালাতে পারতাম। সেই সময়ে আমি তিমি শিকার করেছি। বছরের পর বছর একনাগাড়ে থেকেছি সমুদ্রে। ঝড়ের প্রচণ্ড বাতাসে ঝুঁকি নিয়েছি । আর এখন বৃদ্ধ আহাব একটি তিমিকে ধরার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। আমি পিশাচকে বেশি পছন্দ করি। একটা পা নেই আমার। বিকলাঙ্গ বৃদ্ধ আমি। তবু দেখ আমি থামছি না।

স্টারবে বুঝল ক্যাপ্টেন এখন আবেগতাড়িত । আহাব ডেকের উপর পায়চারি করতে থাকে। হঠাৎ স্বচ্ছ পানির নিচে শাদা তিমিটাকে দেখতে পেলেন তিনি। চিৎকার করে উঠলেন, ঐ যে মবি ডিক। শাদা শয়তান।

মবি ডিক ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। রাক্ষুসে শাদা তিমিটা ওখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল জাহাজের সবখানে। তাড়াতাড়ি নৌকা নামানো হল। তিমি শিকারিরা লাফ দিয়ে নামল নৌকাতে। দাঁড়ের শব্দ হচ্ছে ছপছপ। নৌকাগুলো ছুটছে। সমুদ্র শান্ত। হার্পুনধারিরা তীক্ষ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ক্যাপ্টেন আহাবের নৌকা সবার সামনে। শাদা তিমিটি ভেসে উঠল। তার প্রকাণ্ড লেজ দেখা যাচ্ছে। লেজটা তুলেই আবার গভীর সমুদ্রে ডুব দিল। নৌকাগুলো অপেক্ষা করছে তিমিটির ফিরে আসার জন্যে।

ক্যাপ্টেন আহাব দেখলেন তিমিটিকে। দ্রুত পানির ওপরে চলে আসছে দীর্ঘ চোয়াল ফাঁক করে। শাদা দাঁতের ঝিলিক দেখা যায় । ছুটে আসছে আহাবের দিকে। আহাব তার নৌকাটাকে একটু দোলা দিল। তারপর চট করে হার্পুন তুলে নিল। তিমিটি পাক খেয়ে চলে গেল পেছনের দিকে। তারপর আহাবের নৌকাটাকে তুলে নিল। তুলে একটা প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি দিল। পা পিছলে আহাব সমুদ্রে ছিটকে পড়ে যায়। নৌকাটা তিমির আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। নৌকার লোকগুলো তলিয়ে যেতে থাকে। শাদা তিমিটাও ঘুরতে লাগল তাদের চারদিকে। এই দৃশ্য দেখে অন্য নৌকার লোকেরা তিমিটিকে আর আক্রমণ করার জন্য সাহস পেল না। আহাব পেকুডের লোকদের বলতে লাগল : তোমরা সোজা তিমিটির পিঠের উপর দিয়ে এবার জাহাজ চালিয়ে যাও।

প্রবল ঢেউ এর সাথে ঝুঁঝতে হচ্ছে আহাবকে। পেকুড়ে ছুটে এল তিমির উপর। পালিয়ে যায় তিমিটি। জাহাজের খালাসীরা তখন সমুদ্রে ভেসে থাকা লোকদের উদ্ধার করল।

আহাবকে অবসন্ন অবস্থায় তোলা হলে প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করল : আমার হার্টুনটা কি আছে?

: আছে।

মবি ডিক পালিয়ে গেছে। পাল তুলে পেকুডে জাহাজও তিমিটিকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ করল। ক্যাপ্টেন আহাব অস্থিরভাবে তাকাচ্ছেন চারদিকে। একসময় সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।

পরদিন খুব ভোরে জাহাজের খালাসীরা ডেকে দাঁড়িয়ে শাদা তিমিকে দেখার চেষ্টা করছিল। তখনো সবার মাঝে উত্তেজনা টানটান অবস্থায় রয়েছে।

হঠাৎ গভীর সমুদ্রের ভেতর থেকে শাদা তিমিটি দ্রুত বেগে ছুটে আসল। তার পুরো শরীরটা তখন পানির উপরে। সমুদ্রকে উথাল পাথাল করে তুলল তিমিটি।

জাহাজ থেকে তিনটি নৌকা নামানো হল। শাদা তিমি চক্কর মেরে সোজা নৌকাগুলোর দিকে ছুটে আসল। মাঝখানে আহাবের নৌকা। মবি ডিক দ্রুত বেগে ছুটে আসছে। আহাব হার্পুন দিয়ে তিমিটিকে আক্রমণ করল। তিমিটা বিশাল মুখ হাঁ করে ছুটে আসে। তার শরীরের আঘাতে বাকি দুটো নৌকা ভেঙে যায়। নাবিকেরা ছিটকে পড়ল সমুদ্রে। ক্যাপ্টেন আহাবের নৌকাটি তখনো অক্ষত অবস্থায় ছিল। মবি ডিক তীরবেগে ছুটে এসে এক আঘাতে নৌকাটাকে শূন্যে তুলে দিল। নৌকাটি উপর থেকে সমুদ্রে পড়েই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যায়। পেকুডে এসে তিমি শিকারিদের সমুদ্রে থেকে উদ্ধার করে।

: দেখুন, তিমিটি কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। ওটাকে এবার যেতে দিন। ওর পেছনে ছুটে আর কাজ নেই।

ক্যাপ্টেন আহাব কোনো কিছু শুনলেন না। তার নৌকাটি ছুটে গেল তিমিটির দিকে। তিনি অভিশাপ দিচ্ছেন তিমিকে। হার্পুন ছুঁড়ে মারলেন। ঝটপটিয়ে উঠল আহত মবি ডিক। হার্পুন তার শরীরের গভীর গেঁথে গেছে। মবি ডিক ছুটে গেল পেকুড়ে জাহাজের দিকে। তার প্রকাণ্ড মাথা দিয়ে ধাক্কা দিল জাহাজের পাটাতনে। পাটাতন ফুটো হয়ে যায়। জাহাজে পানি ঢুকতে থাকে প্রবল বেগে। উন্মাদের মতো হাপুন ছুঁড়ে মারল আহাব। হার্পুনদের লাইনটি তখন নৌকায় আটকে যায়। আহাব লাইনটি ঠিক করার জন্যে নিচের দিকে নামল। সাথে সাথেই তার গলায় পেঁচিয়ে গেল লাইনটি। তীব্র টানে আহাব গড়িয়ে পড়ল। তারপর সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পেকুড়ে জাহাজটিও তখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।

হারমান মেলভিল-এর মবিডিক এর ছায়া অবলম্বনে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *