১৩. যদি যায় জানা

যদি যায় জানা

ঘরের দেয়াল কচি কলাপাতার মতো রং দিয়ে ডিসটেম্পার করা। বিছানায় শুয়ে তাকালে চোখে একটা নরম ছায়া ভাসে। আর যদি জানালার ভারী পর্দা টেনে দেখা যায় অন্তুর তখন মনে হয় ঘরের ভেতরে ঝুপ করে কালো বেড়ালের মতো অন্ধকার লাফিয়ে পড়ল। জানালার পর্দা সরাতেই চোখে পড়বে সেই দিঘল গাছটা। এই সময়ে যে গাছের ডালগুলো ভরে যায় আশ্চর্যরকম সুন্দর সব ফুলে । জারুল গাছটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্তু। কোনো পাখি কী উড়ে এসে ডালে বসছে? বাসা বানাতে চাইছে? এই বিশাল দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছ’তলায় থাকে অন্তুরা । এত লোকজন রয়েছে ফ্ল্যাটবাড়িতে তবুও অন্তুর মনে হয় কেউ যেন কারো সঙ্গে কথা বলে না। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয় ছোটাছুটি করছে। ছোটবেলা থেকে অন্তুর শরীরটা খারাপ । প্রায়ই জ্বর হয়। বাঁ পাটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে দিন। দিন । বিনু আপা তাকে একদিন বলেছিল, তুই আর কোনোদিন ভালো হবি নারে অন্তু। তোর অসুখটা খুব খারাপ। অন্তুর মাঝে মাঝে মনে। হয় শেলফের কোণায় পড়ে থাকা কমিক বইগুলো ভেতর তুলতুলে হাঁসের ছানা ডোনাল্ড ডাক্ প্যাঁকপ্যাঁক করে তাকে বলছে, হ্যালো, মাই ফ্রেন্ড, আমার সাথে যাবে নাকি? সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চমৎকার একটা দ্বীপে যাচ্ছি। সেখানে পান্নার মতো সোনা রোদ ঝলমল করছে।

অন্তু তখন উঠে বসতে চায়। বাঁ পা চিনচিন করে ওঠে। অজস্র ব্যথার স্রোত ছড়িয়ে যায় সবখানে। ও যেন দেখে ঘরের কোণায় রহস্যময় হাসি হাসছে স্পাইডার ম্যান। ফিসফিস করে স্পাইডার ম্যান বলছে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। এই মেট্রোপলিটন শহরের সবগুলো উঁচু বাড়ি ডিঙিয়ে আমি তোমাকে মেঘের দেশে নিয়ে যাব। আমি স্পাইডার ম্যান যে কোনো জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পারি জাল। আর সেই জাল বেয়ে এগিয়ে যেতে পারি তরতর করে।

বইয়ের খসখসে পাতার ভেতর থেকে উঁকি মারছে মিকি মাউস। অম্ভকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবার হাতছানি দিচ্ছে মিকি মাউস।

নিঝুম দুপুরে যখন লোকজন থাকে না তখন কেমন ঘোর লাগে অদ্ভুর। ওর টেবিলে রয়েছে সেই রহস্যময় টেবলেটগুলো । কোয়েল পাখির ডিমের মতো টেবলেটগুলোর রং। যেগুলো খেলে ওর চোখের সামনে রহস্যময় কুয়াশা ঘনিয়ে আসে। অন্তু আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দেখে তুষার ঝড়ের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ছে বুনো হাঁসের ঝাঁক।

বাড়ির সবাই ওর সাথে বেশি কথা বলে না। তাই অন্তুর খুব অভিমান। ও কী সবার কাছে একটা বোঝা? টোকাই? ও কী পথের ধারের নুলো ভিখিরি? দেয়ালে মৃত মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায় অন্তু। ছোটবেলায় গরম ভাতের সাথে কাগজি লেবুর রস মাখিয়ে ভাত খাওয়াত মা। সেই মা এখন দূর আকাশের তারা। অন্তুর কত ইচ্ছে করে জ্বরের পর থানকুনি শাকের ভর্তা খাবে। তাতে জিভে তেতো ভাবটা কেটে যায়। অন্তু ভয়ে সে কথা কাউকে বলতে পারে না ভয়ে।

একদিন।

শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা অন্তুর। কোয়েল পাখির ডিমের মতো অনেকগুলো টেবলেট খেয়ে ফেলল অন্তু। তার পরপরই অম্ভর শরীরের ভেতর ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা চিনচিনে ব্যথার স্রোত । বিছানা থেকে উঠতে চাইল সে। তার আগেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল অন্তু। ঘরের কোণায় সারা দুপুর আর বিকেল আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল সে। জ্ঞান ফিরল সন্ধ্যার পর। তখন বাড়ির লোকজন বাইরে থেকে ফিরতে শুরু করেছে। ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে অন্তুর সৎ মা। সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেল অন্তু। তার মনে হচ্ছে একটা হিংস্র বাঘের মুখ যেন ঘরে ঢুকছে। সে কী তবে কিছুদিন আগে দেখা সেই সায়েন্স ফিকশন ছবির কিশোর নায়কের মতো হয়ে গেছে? সে কিশোর মানুষের মুখের আদলে দেখতে পেত নানা ধরনের জন্তুর চেহারা। কখনও হিংস্র, ভয়ংকর, কখনও কোমল ও মায়াবী? কে ঢুকছে ঘরে? ওর মা নাকি একটা হিংস্র বাঘ? মায়ের হাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে, কিরে অন্তু, এখানে পড়ে আছিস যে!

তার মনে হয় একটা থাবা এগিয়ে আসছে তার দিকে। অন্তু কেমন ভয়ে কুঁকড়ে যায়। পেছনে সরে আসতে চায় ও। এমন সময়ে ঘরে ঢোকে কাজের বুয়া। অন্তুর মনে হয়, বুয়া যেন একটা পুরনো কালের দিঘির বড় মৃগেল মাছ। শরীর থেকে বেরুচ্ছে একটা শ্যাওলা ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস। যেন অন্তুর জ্বরতপ্ত শরীরটাকে কোমল পরশে জড়িয়ে রাখবে। এগিয়ে আসছে অন্তুর মা। চিৎকার করে উঠল। বাঘ যেন তাকে থাবা দিয়ে ছিড়ে ফেলবে । জানালার দিকে দৌড়ে গেল অন্তু। তাকিয়ে দেখল ফ্ল্যাটবাড়ির সদর দরজা দিয়ে মস্ত অজগর সাপ ঢুকছে। আর্তচিৎকার করে উঠল, সাপ-সাপ-সাপ।

অন্তু সৎ মা জানালার কাছে এগিয়ে এসে বলল, কোথায় সাপ? কী দেখছিস? অন্তু নিচের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে সাপ। অজগর সাপ। গেট দিয়ে ঢুকছে।

তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেল অম্ভ? ও যে তোর বিন্টু মামা।

অন্তু নামের রোগে ভোগা অসহায় সরল কিশোর ছেলেটি কী আর জানে তার বিন্দু মামা তাকে এ বাড়ি থেকে একটি অনাথ আশ্রমে ভর্তি করার কাগজপত্র নিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে উপরে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *