১১. এক জোড়া রাজহাঁস

এক জোড়া রাজহাঁস

আল্পস পাহাড়ের দক্ষিণ দিকের একটি ছোট, নিরিবিলি গ্রামে আমরা থাকি। আমার বাবা একজন চাষি। আমাদের বেশি জমিজমা নেই । বাবা ঢালু জমিতে যব, গম আর ভুট্টার চাষ করে। গায়ের মধ্যে আমরাই হলাম গরিব।

বড়দিনের উৎসবের সময় আমাদের প্রতিবেশীরা বিশাল ধরনের ভোজের আয়োজন করে থাকে। সেখানে প্রচুর সুখাদ্যের আয়োজন। সবচাইতে বেশি থাকে টার্কিশ মোরগ আর হাঁসের ঝলসানো মাংস। আমাদের দরিদ্র বাবা আর এসব খাবার জোটাতে পারেন না। তাই আমাদের বাড়িতে তখন শুধুমাত্র শাকপাতা আর সবজির আয়োজন করা হয়ে থাকে। পালংশাক, মটর, গাজর, শালগম আর বাঁধাকপি সেদ্ধ । উৎসবের সময় প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে পাখি আর হাঁসের মাংসের মনমাতানো গন্ধ পেলে আমাদের খিদে বেশ চনমনে হয়ে ওঠে । কিন্তু আমার মা নিরুপায় । আমাদের জন্য কোনোমতেই আর মাংস জোটাতে পারেন না। বাজার থেকে এক জোড়া রাজহাঁসের ছানা কিনে এনে পুষবেন । সারা বছর ছানা দুটো এটোঁকাঁটা খেয়ে পুরুষ্ট হবে। তাগড়াই হবে । আর বড়দিনের উৎসবের সময় এলে ওদের মাংস ঝলসিয়ে খাওয়া যাবে। ইউক্যালিপটাস গাছের কাঠ দিয়ে ঐ মাংস সেঁকলে তাতে সুগন্ধি হবে। স্বাদের হবে। মা তার সাথে দেবেন কচকচে লেটুস পাতার সালাদ। মা যখন আমাদের কাছে এ ধরনের রান্নার কথা বলতেন তখন তার চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করত। তিনি যেন চোখের সামনে সে ধরনের রান্নাকে দেখতে পাচ্ছেন।

একদিন রাজহাঁসের ছানা কিনতে নিজেই গেলেন বাজারে। মা অনেক ঘুরলেন। কিন্তু কোথাও রাজহাঁসের ছানা পাওয়া যাচ্ছে না। এক বৃদ্ধ পাখি বিক্রেতা বলল, আমার কাছে অবশ্য দুটো ছানা রয়েছে। তবে ওগুলো আমি বেচবো না।

কেন? মা জানতে চাইলেন।

কারণ ও দুটো একেবারেই কাহিল অবস্থায়। মরণদশা পেয়েছে। ওগুলোকে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত জ্যান্ত অবস্থায় আর নিয়ে যেতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তার আগেই ও দুটো মারা যাবে।

মা বৃদ্ধ বিক্রেতার এ ধরনের কথা শুনেও হাল ছাড়লেন না। অনুনয় করে বলতে লাগলেন, অনুগ্রহ করে আমাকে একবার দেখান না ঐ ছানা দুটো। দেখি কী রকম মরোমরো অবস্থা।

মার এতটা আগ্রহ দেখে পাখি বিক্রেতা মাকে নিয়ে গেল দোকানের পেছনের দিকের অংশে। সেখানে থিকথিকে নোংরা কাদামাটিতে দুটো রোঁয়া ওঠা ছানা নেতানো অবস্থায় পড়ে ধুকপুক করছে। মনে হয় কোনো মতে যেন জীবিত রয়েছে। ছানা দুটো ঐ রকম করুণ অবস্থা দেখে মার মন কেমন নরম হয়ে গেল । ছানা দুটোর থরথর করে কাপা অবস্থায় দেখে মার মনে মমতা জন্মায়। মা বললেন, আমি এই দুটো ছানাই কিনে নিতে চাই। বলুন, এদের জন্য আমাকে কত দাম দিতে হবে?

মার কথা শুনে বৃদ্ধ বিক্রেতা খানিকটা যেন অবাকই হলো। কেউ যে এরকম প্রায় মৃতপ্রায় প্রাণী কিনতে পারে এটা তার ঠিক বিশ্বাস হচিছল না।

ঠিক আছে, আপনি এ দুটো ছানা নিয়ে যান। আপনাকে আমি এমনিতেই দিয়ে দিলাম। এদের ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে এগুলো মারা যাবে। আপনার হাতে পড়ে এ দুটো যদি কোনোভাবে বেঁচে ওঠে তবে তোে ওদের ভাগ্য। নিয়ে যান।

পাখি বিক্রেতা কাদামাটি থেকে নেতানো ছানা দুটোকে তুলে মায়ের টুকরিতে ঢুকিয়ে দিল। ছানা দুটো তখন তিরতির করে কাঁপছিল।

বাড়িতে আনার পর ছানা দুটো ওরকম অবস্থা দেখে বাবা রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন। মা বাজার থেকে এ কী রকম প্রাণী সংগ্রহ করে এনেছেন। ছানা দুটো চিক চিকিম করে শব্দ করছিল। মা চেয়েছিলেন এক জোড়া রাজহাঁসের বাচ্চাকে সারা বছর ধরে পুষে নদর গোছের করবেন। যাতে করে বড় দিনের উৎসবের সময় আমাদের ভাগ্যে স্বাদু মাংশ জোটে। কিন্তু এ দুটো ছানার যা ছিরিছাঁদ। কোনোমতেই এগুলো টিকবে না। বাবা বললেন, বুঝেছি, আগামী বড় দিনের উৎসবেও আমাদের শুধু শাকসবজি সেদ্ধই খেয়ে থাকতে হবে বোধহয়।

মা একটা গামলায় গরম পানি ঢেলে তাতে তুলতুলে হাঁসছানা দুটোকে ছেড়ে দিলেন। তারপর ছানা দুটোর শরীরের লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করলেন। তুলো দিয়ে ছানা দুটোর পালক ঘষলেন। তোয়ালে দিয়ে ওদের শরীর মুছে দিলেন। দুধ আর শিমবিচি সেদ্ধ খেতে দিলেন। আমাদের মা এ কাজগুলো করলেন খুবই যত্ন করে। মাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল ছানা দুটোর প্রতি তার স্নেহ যেন উছলে পড়ছে।

রাতের বেলায় মা খুব খুশি। জুবুথুবু হয়ে থাকা ছানা দুটো যেন শরীরে কিছুটা বল ফিরে পেয়েছে। ডানা ঝাড়ছে। ইতিউতি তাকাচ্ছে। ছানা দুটো সবল হয়েছে। মা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আর কোনো ডর নেই। এবারের মতো এরা বেঁচে উঠেছে। দেখছো না, এরা এখন পালক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। দেখো, এরা পুষ্ট হবেই। তাহলে আমাদের আগামী বড়দিনের উৎসবটা অবশ্যই জমবে।

এভাবে মার সেবা যত্নে রাজহাঁসের ছানা দুটো ক্রমশ পুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ইতোমধ্যে ছানা দুটো বেশ পোষ মেনে ফেলেছে। প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকে। ছুটোছুটি করে। ইসকুলে যাওয়ার সময় আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে দেয়। আমাদের সাথে ছানা দুটোর বেশ ভাব হয়ে গেছে।

একদিন তো দারুণ এক কাণ্ড হলো। আমাদের গাঁয়ের মাঝখানে দিয়ে একটা পাহাড়ি ঝরনা কলকলিয়ে বয়ে গেছে। গায়ে রয়েছে বেশ কটি কামারশালা। গায়ের উজানে একটা বাঁধ দিয়ে ঐ ঝরনার পানিকে আটকে রাখা হয়। সন্ধেবেলা বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়। কামারশালার যন্ত্র ঘোরাবার জন্য তখন প্রচণ্ড স্রোতের শক্তি প্রয়োজন।

ঝরনার পানি যতক্ষণ বাঁধে আটকানো থাকে ততক্ষণ স্রোতের একটা ক্ষীণধারা বয়ে যায়। সেই তিরতিরে ধারার নিচে দেখা যায় আশ্চর্য, সুন্দর সব নুড়ি পাথর। চকচক করছে। বুঝি রূপকথার রাজ্যের রত্ন পাথরের ভাণ্ডার থেকে কেউ ওখানে সেগুলোকে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে। গাঁয়ের ছোটদের কাছে ভীষণ প্রিয় ছিল ঐ রঙিন পাথরের টুকরোগুলো।

গাঁয়ের ছোটরা যাতে নদীর খাতে না নামে সে ব্যাপারে সাবধান বাণী জানানো ছিল। বাঁধটি খুলে দেয়া মাত্র নেমে আসবে তীব্র জলস্রোত। সেই স্রোতের গেড়ে সহজেই ভেসে যাবে ছোটরা। তাই সতর্কবাণীর নোটিশ টাঙানো ছিল। কিন্তু গাঁয়ের ছোটরা প্রায়ই নদীর ঐ খাতে চলে যায়। সেখানে থেকে রঙিন নুড়িপাথর আর চকমকি পাথর কুড়িয়ে আনতে।

আমরাও কখনও কখনও সেখানে দল বেঁধে যাই । আমাদের সাথে থাকে বড় হওয়া রাজহাঁসের সেই দুটো বাচ্চা। আমরা টলটলে পানির নিচে খুঁজি চকমকি পাথর। হাঁস দুটো পাথরের খাজে খোঁজে শামকু, গুগলি। ব্যাঙ পেলে কপ করে ধরে খায়।

একদিন আমরা নদীগর্ভ থেকে রঙিন পাথরের টুকরো সংগ্রহ করছি। এদিকে কখন যে দিনের আলো ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধে হয়ে গেছে তা খেয়াল করিনি। সন্ধে হলেই বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়।

হঠাৎ দেখি হাঁস দুটো তীক্ষ্ণ স্বরে কক কক করে ডাকাডাকি করছে। আমাদের যেন সাবধান করে দিতে চাইছে। আমরা তাড়াতাড়ি নদীগর্ভ থেকে তীরে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই কলকল করে ধেয়ে এলো ঝরনার পানির তীব্র স্রোত। হাঁস দুটো আমাদের তখন অমন করে সাবধান না করে দিলে আমরা এই স্রোতের টানে ভেসে যেতাম।

এর মানে হচ্ছে হাঁস দুটো আমাদেরকে আজ সাংঘাতিক একটা বিপদের হাতে থেকে রক্ষা করল। ঐ তীব্র স্রোতে ভেসে গেলে আমাদের ভয়ানক এক ক্ষতি হতো।

আমার দিদামণি বলতেন, আমাদের চারপাশে এমন অনেক পশুপাখি রয়েছে যারা কিনা অদ্ভুতভাবে দুর্যোগের সংবাদ আগাম টের পেয়ে যায় । তাহলে কী এই হাঁস দুটো জানতে পেরেছিল আধ মাইল উজানে কামারশালার কর্মীরা বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে আর ছুটে আসছে স্রোতের ধারা?

সারা গায়ে মুহূর্তের মাঝে এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ল। হাঁস দুটো সতর্কতার জন্য এ যাত্রা গাঁয়ের শিশুরা এক মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। সব কথা জেনে আমাদের মা কী যে খুশি হলেন। দেখলে তো, এই রাজহাঁসের বাচ্চা দুটোর কত বুদ্ধি! আমি কতটা যত্ন করে এদের বড় করেছি।

মাকে তখন দেখে মনে হচ্ছিল এ ব্যাপারে সমস্ত কৃতিত্ব বুঝি তার।

বড়দিনের উৎসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। হাঁসজোড়া কেনা হয়েছিল আসন্ন বড়দিনের ভোজের অংশ হিসেবে। আমরা কিন্তু সে বিষয়টা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। বড়দিনের বাজারে হাঁসের বেশ চাহিদা থাকে। তাই হাঁসের চড়া দাম। সে কারণে গাঁয়ের সিঁদেল চোর এক রাতে ঐ হাঁসজোড়া চুরি করার জন্য আমাদের খোঁয়াড়ে হানা দিল।

গভীর রাতে খোঁয়াড়ে শোনা গেল ছুটোছুটির শব্দ। বাবা সেখানে ছুটে গেলেন। সাথে আমরাও গেলাম। দেখি গাঁয়ের সিঁদেল চোরটা খোঁয়াড়ের এক কোণায় কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটি রাজহাঁসকে সে কোনোমতে তার ঝোলার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। অন্য হাঁসটা তখন তার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে এমন জোরে জোরে ঠুকরিয়েছে যে বেচারা শেষপর্যন্ত ধরা পড়ে গেছে।

মা দৌড়ে গিয়ে রাজহাঁস দুটোকে বুকে তুলে নিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম রাজহাঁস দুটো কীভাবে আমাদের সংসারের একটা অংশ হয়ে গেছে।

এবারের বড়দিনটাও আমরা অন্যান্য বারের মতো শাকসবজি খেয়েই পালন করলাম। আমাদের কাছে বেশ ভালোই লাগছিল খেতে। আমাদের কারোর পাতে হাঁসের ঝলসানো মাংস ছিল না বলে কোনো দুঃখই ছিল না। আমরা দেখছিলাম চাঁদের মায়াবী আলোতে খোয়াড়ের মেঝেতে রাজহাঁস দুটো কী প্রশান্তিতে পালকে মুখ গুঁজে রয়েছে।

মা হাঁস দুটোর জন্য বিন আর গাজর সেদ্ধ নিয়ে গেলেন। হাঁস দুটো মাকে দেখে প্যাঁকপ্যাঁক করে ডেকে উঠে ডানা ঝাড়তে লাগল।

রাজহাঁসদের দিকে তাকিয়ে মার চোখ দুটো কেন টলটল করছে, আমরা তা বুঝতে পারিনি।

-ফ্রান্সের গল্প

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *