০৭. উড়ন্ত মানুষ

উড়ন্ত মানুষ

হাসপাতালে এক সকালে জন্ম নিল সেই অদ্ভুত শিশুটি। জন্মের এক ঘণ্টা পর ওর মা মারা গেল । শিশুর বাবা মারা গেছে কিছুদিন আগে । শিশুটির পিঠে একটি কুঁজ। দেখতে অস্বাভাবিক। হাসপাতালের প্রধান নার্স দুঃখমাখা কণ্ঠে বলল, কী দুর্ভাগ্য এই শিশুটির। অনাথ হয়ে জন্মাল। তার উপর বিকৃত শরীর।

লাল মুখের শিশুটি তখন চিৎকার করে কাঁদছিল । প্রবীণ ডাক্তার ঝুঁকে বিস্মিতভাবে দেখছিলেন শিশুটিকে। শিশুর পিঠটা অন্য ধরনের। বাঁ কাঁধের হাড় দুটো থেকে কুঁজের মতো দুটো অংশ বেরিয়ে এসেছে। অংশ দুটো আবার বেঁকে নেমে গেছে নিচের পাঁজরের দিকে। ভালো করে নেড়েচেড়ে শিশুটিকে পরীক্ষা করলেন ডাক্তার ।

জীবনে তিনি এমন ধরনের কুঁজঅলা শিশু আর দেখেননি। তার ভীষণ কৌতূহল হলো। এক্স-রে-এর সাহায্যে এই কুঁজ দুটো পরীক্ষা করে দেখতে হবে ।

শিশুটিকে নিয়ে আসা হয় এক্স-রে মেশিনের সামনে। তখনও চিৎকার করছিল শিশুটি। চালু করা হলো মেশিন। শিশুর দেহে রঞ্জনরশ্মি প্রবেশ করল। প্রবীণ ডাক্তার গভীর আগ্রহে তাকিয়েছিলেন ফ্লুরোস্কোপ-এর দিকে। ক্রমশ তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি যেন হতবাক হয়ে গেছেন। এমন ধরনের বিচিত্র দৃশ্য এর আগে আর কখনও দেখেননি তিনি।

প্রবীণ ডাক্তার যন্ত্রের ভেতরে দেখলেন, শিশুটির দেহের হাড়গুলো ফাঁপা। ওর কঙ্কালের গড়ন আলাদা। শরীরের ওজন খুব কম। নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য! একেবারে অন্য ধরনের শিশু। জিনের পরিবর্তনের ফলে এ রকম হতে পারে। শিশুর জন্মের আগে এর মায়ের উপর হয়তো কোনো মারাত্মক জটিল প্রভাব পড়ছিল। তাই এই পরিবর্তন। নার্স জানাল।

স্যার, এর মা কিছুদিন আগে একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল।

মনে পড়ল ডাক্তার হ্যারিম্যানের সে কথা। বছরখানেক আগে এক মারাত্মক বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণের ফলে শিশুর মা খুব আহত হয়েছিল। হয়ত সেই প্রচণ্ড আঘাতেই পাল্টে গিয়েছিল শিশুর মায়ের জিন। তীব্র বিকিরণের পরে জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ডাক্তারের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে নার্স জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে স্যার, আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।

যতদূর জানি আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এ রকম শিশুর আর জন্ম হয়নি। এ সবই হয়েছে সেই প্রচণ্ড? বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণের জন্যে। শুনে অবাক হয়ে এই শিশুটির এক সময় দুটো পাখা গজাবে পাখির ডানার মতো। এর পিঠের এগুলো কোনো কুঁজ নয়। এ দুটো হলো ডানার প্রাথমিক রূপ। খুব শিগগিরই এই কুঁজ দুটো থেকে পাখির মতো পাখা বের হবে। ডানা বড় হবে। এই শিশু তখন আকাশে উড়বে পাখিদের মতো।

প্রবীণ ডাক্তারের কথা শুনে নার্স রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল শিশুটির দিকে। নরম বিছানায় হাত-পা ছুড়ছে শিশুটি। জানালা দিয়ে সকালের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতরে । সেই আলোতে শিশুটির মুখ কেমন মায়াবী লাগছে। প্রবীণ ডাক্তারের মনে হচ্ছে তিনি যেন চোখের সামনে একটি পাখির শাবককে দেখছেন। ডানা মুড়ে সে শাবক শুয়ে আছে। এক্স-রেতে শিশুটির শরীরে প্রাথমিক পালক ও পাখনার হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। নার্সের কাছে তখনও ব্যাপারটা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

স্যার, আপনি কি বলতে চাইছেন এই শিশুটি সত্যি সত্যি পাখির মতো আকাশে উড়বে?

নিশ্চয়। এর পাখা দুখানা হবে বড়। দেহটা সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক হালকা। সুতরাং ওর পাখা দুখানা সহজেই ওকে শূন্যে তুলতে পারবে।

ডাক্তার হ্যারিম্যান তার ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। এই বিচিত্র শিশুটি তার চিন্তাশক্তিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি শরীরবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। এই শিশুটির পিতা-মাতার দেহের জিন-এর বড় ধরনের একটা পরিবর্তনের ফলেই এ ডানাঅলা শিশু হিসেবে জন্ম নিয়েছে। জিন হলো কোষের ভেতরের অতি সূক্ষ্ম বস্তু। এই জিনই প্রাণীদের বংশানুগতির নিয়ন্ত্রক উপাদান। জীবদেহের দৈহিক বিকাশ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবকিছুই জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যদি জিনের আদল বদলানো হয় তবে দেহের বিকাশও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এই শিশুটির পিতা-মাতার ক্ষেত্রে জিনের আদল একবারে আমূল পালটে গিয়েছিল। বছরখানেক আগে এক প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণের ফলেই এই ব্যাপারটা ঘটেছিল।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে রশ্মির বিকিরণের সাহায্যে জিনের আদলকে অনেকখানি পালটে দেয়া যেতে পারে। বিরাট দুর্ঘটনার পরে এই শিশুটির পিতা-মাতার দেহের জিন আমূল পালটে সম্পূর্ণ নতুন জিন প্যাটার্ন হয়েছিল। আর তার ফলেই জন্ম হয়েছে এই ডানাঅলা শিশুর। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই শিশুটি হলো মিউট্যান্ট। অর্থাৎ পূর্বপুরুষের চাইতে ভিন্ন আকৃতির চেহারা।

ডাক্তার হ্যারিম্যান এই বিচিত্র শিশুটির খবর গোপন রাখতে চাইলেন। পত্রিকার লোকজন জানতে পারলে প্রচণ্ড হৈচৈ সৃষ্টি করবে। সমাজে উত্তেজনা ছড়াবে। ভীতিকর, বিকৃতভাবে সংবাদ প্রকাশ করবে পত্রিকার কাটতি বাড়াতে। এসব মোটেই চান না তিনি। জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে এই শিশুটির জন্ম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখন এই শিশুটির আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ওর প্রতিদিনের এই অস্বাভাবিক শরীর নিয়ে বেড়ে ওঠা লক্ষ্য করতে হবে । ওকে বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে অবলোকন করতে হবে। জানতে হবে তার এই ধারাবাহিক বৃদ্ধির ধারাকে।

ডানাঅলা শিশুটির কথা তিন মাস গোপন রাখা হয়েছিল। তখন একে রাখা হয়েছিল এমন এক ঘরে যেখানে শুধু প্রধান নার্স যেত। সে একাই দেখাশোনা করত শিশুটিকে। আর যেতেন প্রবীণ ডাক্তার হ্যারিম্যান। হাসপাতালের সবাই জানত ওই ঘরে ডাক্তার হ্যারিম্যান কোনো একটি গবেষণার কাজ করছেন।

তিন মাসের মধ্যে শিশুটির পিঠের কুঁজের মতো জিনিস দুটো দ্রুতগতিতে বেড়ে যেতে লাগল। তারপর একদিন কুঁজ দুটোর কোমরের চামড়া ফেটে বেরিয়ে এলো দুখানা পাখা।

প্রবীণ ডাক্তার আর নার্স দেখলেন, পায়ের মতো পাখা দুখানা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা শিশুটির রয়েছে। পাখার নিচে মাংশপেশির সাহায্যেই নিয়ন্ত্রিত করা যাচ্ছে ডানা দুটো। একজন স্বাভাবিক মানব শিশুর চাইতে এর রক্ত বেশি উষ্ণ।

এই ডানাঅলা বিচিত্র শিশুটির খবর আর গোপন রইল না। হাসপাতালের কর্মীরা জেনে গেল এক সময়। তারপর জানল অনেকেই। এক সময় শহরের সমস্ত দৈনিকে প্রকাশিত হলো এই বিচিত্র খবরটি। সাংবাদিকরা ভিড় করল হাসপাতালে। সাধারণের ভেতরে দ্বিধা। সংশয়। সত্যি কি এমনটা সম্ভব! হাসপাতালের এক কর্মী লুকিয়ে শিশুটির একটি ছবি গোপনে তুলে পত্রিকায় দিল। ছবিতে স্পষ্ট দুখানা পাখার অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। মানুষের মাঝে শিশুটিকে নিয়ে কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই চলল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উপর প্রবল চাপ আসতে লাগল । সত্যি ঘটনাটি প্রকাশ করার জন্য। ততদিন প্রচুর গুজবের জন্ম হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে তাই বিচিত্র শিশুটিকে উপস্থিত করা হলো।

একজন সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আচ্ছা ডাক্তার হ্যারিম্যান, বড় হয়ে এই ছেলেটি কি উড়তে পারবে?

প্রবীণ ডাক্তার জানালেন, যেভাবে ও বাড়ছে তাতে মনে হয় উড়তে পারবে।

পাখাঅলা শিশুটির নাম রাখা হলো ডেভিড। এই বিচিত্র শিশুকে নিয়ে শুরু হলো ব্যাপক আলোচনা। জল্পনা-কল্পনা।

সার্কাসের মালিকেরা চাইল শিশু ডেভিডকে কাচের বাক্সে রেখে প্রদর্শন করতে। তাতে প্রচুর আয় করা যাবে।

শিশু ডেভিড হাসপাতালের ছোট বিছানাটিতে শুয়ে পাখা ঝাপটায়। কাঁদে।

শিশুটিকে দেখার জন্যে হাসপাতালে ভিড় ক্রমশ বেড়েই চলল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হলে ভিড় সামলাতে। কোনোমতেই আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মানুষের ভেতরে প্রচণ্ড কৌতূহল।

অস্থির হয়ে পড়লেন ডাক্তার হ্যারিম্যান। তিনি ঠিক করলেন শিশু ডেভিডকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। জনমানবহীন কোনো দ্বীপে। লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে ওর উপর গবেষণা করবেন। ওকে যত্ন করে বড় করে তুলবেন।

ডাক্তার হ্যারিম্যান একটি নির্জন দ্বীপের খোঁজ পেলেন। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের উপকূলের কাছেই রয়েছে একটি ছোট নির্জন দ্বীপ। দ্বীপ না বলে বরং বলা যেতে পারে একটি পাথুরে ডাঙা। বালু জমির জায়গা। সেখানে গাছপালা রয়েছে অল্প। ডাক্তার হ্যারিম্যান জায়গাটি ইজারা নিলেন। সেখানে তৈরি করলেন একটি কাঠের বাংলোবাড়ি। ডেভিড আর একজন বয়স্কা নার্সকে নিয়ে সে দ্বীপে চলে গেলেন ডাক্তার হ্যারিম্যান। দ্বীপটি পাহারা দেবার জন্যে একজন বলশালী রক্ষী নিয়োগ করলেন। কৌতূহলী মানুষ যাতে নৌকো করে দ্বীপে আসতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবে এ রক্ষী লোকটি।

ওই নির্জন দ্বীপে দিন দিন বড় হয়ে উঠতে লাগল ডেভিড।

এমনিভাবে কেটে গেল পাঁচ বছর। ডেভিডের স্বাস্থ্য ভালো। মাথায় সোনালি কোঁকড়ানো চুল। তার পাখা দুটো বেশ বড় হয়েছে। পাখার রঙ ঘন বাদামি। ডেভিড ছুটে বেড়ায় ঘাসবনে। সবুজ মাঠে। মাঝে মাঝে কখনও প্রবলভাবে ডানা ঝাপটায়।

ডেভিডের যখন দশ বছর তখন সে উড়তে শিখল। এর মধ্যে শরীর একটু রোগা হয়েছে। বাদামি পাখা হয়েছে উজ্জ্বল। পাখা দুটো বড় হয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত এসেছে। ডেভিড পাখা দুটো ভাজ করে পিঠের উপর রাখত।

ড. হ্যারিম্যান চাইছিলেন ডেভিড তার নিজের চেষ্টায় উড়তে শিখুক। কীভাবে ডানা মেলে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে যেতে হয় ।

হ্যারিম্যান চাইছিলেন ডেভিডের ওড়ার চেষ্টার প্রতিটি ধাপের ছবি তুলে রাখতে। এতে তার গবেষণার কাজটি বেশ সহজ হবে। | একটি পাখি যেমন স্বাভাবিকভাবে ওড়ে ডেভিডও প্রথম সেভাবে উড়ল।

ডেভিড ভালো করেই জানত সে অন্য ধরনের। আলাদা। ডাক্তার দাদুর পাখা নেই। নার্সের পাখা নেই। রক্ষীর পাখা নেই। পাখা আছে শুধু তার। ডেভিড এই তিনজন ছাড়া দ্বীপে আর কাউকে দেখেনি। শুনেছে নীল সমুদ্রের ওপারে একটি বিরাট দেশ রয়েছে। সেখানে নাকি অনেক মানুষজন থাকে। ডেভিডের ধারণা মানুষ হচ্ছে দুধরনের। এক ধরনের মানুষের পাখা আছে। বাকিদের নেই। পাখা নাড়াতে তার কাছে বেশ ভালো লাগে। ছুটে যাওয়ার সময় সে পাখা খুলে দিত।

একদিন ডেভিড পাখির বাসার খোজে একটি লম্বা ওক গাছে উঠল। দ্বীপের পাখিদের প্রতি সে বেশ কৌতূহলী। বুঝতে পারে পাখিদের সঙ্গে কোথায় যেন তার একটা মিল রয়েছে।

ডেভিড অবাক হয়ে দেখত। শরৎকালে পাখিরা কেমন ঝাঁক বেঁধে সমুদ্রের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যায়। বসন্তকালে উড়ে যায় উত্তর দিকে। নীল আকাশে ডানা মেলে দিয়ে তারা শাঁ শাঁ করে উড়ে যায়। পাখিদের জীবনধারা জানতে তার খুব ইচ্ছে করে। তাই সে খোঁজ করে পাখির বাসায়। গাছে ওঠে। দেখতে চায় পাখির ডিম। তাদের কুষি ছানা।

সেদিন এমনিভাবে পাখির বাসা খুঁজতে গিয়ে উঠল ওক গাছে। তরতর করে উঠে গেল। এ ব্যাপার সে বেশ দক্ষ। মগডালে পাখির বাসা। শুকনো ঘাসপাতা খড়কুটো দিয়ে বোনা। অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে ডেভিড। নিচে দেখা যাচ্ছে তাদের বাংলোবাড়িটা। চারদিকে নীল সমুদ্র। ঝোপঝাড়। ডেভিডের চোখের সামনে পাখির বাসা। এদিকের গাছগুলোতে সিন্ধু সারসেরা বাসা বাঁধে। ডেভিড বাসাটিকে ধরার জন্য হাত বাড়াল। আর ঠিক তখনি ঘটল সেই উত্তেজনাময় ঘটনাটি।

ডেভিডের শরীর বেশ হালকা। ওক গাছের যে ডালে সে পা রেখেছিল তা ছিল পচা। নরম। মরমর করে ডালটা ভেঙে পড়ল। ডেভিড পড়ে গেল গাছ থেকে। শোঁ শোঁ করে সে নিচের দিকে পড়তে লাগল । ডেভিডের মনে হলো এখনি সে মাটিতে পড়ে থেঁতলে যাবে। আছড়ে পড়বে শক্ত ডাঙ্গায়।

কিন্তু সে সময় ঘটল সেই বিস্ময়কর ঘটনাটি। ডেভিডের চিন্তাশক্তি সজাগ আর তীক্ষ্ণ হলো। তাকে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হবে। এভাবে মাটিতে আঁছড়ে পড়ার জন্যে তার জন্ম হয়নি। ডেভিডের পিঠের উপর গোটানো পাখা দুটো তখন খুলে গেল। প্রবল টান পড়ল পাখা দুটোতে। ডেভিডের কাঁধ যেন মুচড়ে যাচ্ছে। প্রথমে একটা চিনচিনে যন্ত্রণার স্রোত বয়ে গেল। তারপরেই দেখা গেল সেই বিস্ময়কর ঘটনাটি। ডেভিড শূন্যে উড়ছে। বাতাসে পাখা নড়ছে। সে আর মাটিতে নামছে না। পতপত করে উড়ে যাচ্ছে। আঃ, কী প্রচণ্ড এক উল্লাস হচ্ছে তখন তার মাঝে। সমস্ত শরীরে জাগছে শিহরণ । ওর ভেতরে যেন অজস্র জোনাকিরা তখন জ্বলছে নিভছে। ডেভিড তীব্র পুলকে চিষ্কার করে উঠল। এত আনন্দ সে আগে আর কখনও পায়নি।

উপরের দিকে উড়তে লাগল ডেভিড। তার ভেতরে নতুন করে যেন শক্তির জন্ম হয়েছে। বিরাট ছড়ানো পাখা দুটো বাতাসকে আঘাত করছে। বাতাস কেটে উড়ে চলেছে। হাত দুখানা সে ছড়িয়ে দিল দুপাশে। পা রাখল সোজাভাবে জোড়া করে।

অনেকটা উপরে উঠে এসেছে ডেভিড। তাদের দ্বীপটিকে এখন নীল সমুদ্রে একটা কালো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। ডেভিডের চারদিকে বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। শীতল বাতাস। ডেভিডের কাছে মনে হচ্ছে জীবনে এত ভালো লাগাও তাহলে রয়েছে।

ডাক্তার হ্যারিম্যান বাংলো থেকে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তার কানে এলো তীক্ষ্ণ এক চিৎকার। উপর থেকে আসছে। চমকে আকাশের দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন উড়ন্ত ডেভিডকে। সোনালি রোদে তার বিশাল পাখা দুটো ঝকঝক করছে। তাকে দেখাচ্ছে যেন দেবদূতের মতো। আকাশ থেকে নেমে আসছে ডেভিড ।

হ্যারিম্যান মুগ্ধ বিস্ময়ে এই সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে লাগলেন। মাটিতে নেমে এলো ডেভিড। এসে দাঁড়াল ডাক্তার দাদুর সামনে। তার দুচোখে তখন চাপা আনন্দের ঝিলিক।

আমি এখন উড়তে পারি!

তাই তো দেখছি! তুমি এখন সত্যিই উড়তে পার । তুমি কিন্তু উড়ে এ দ্বীপ ছেড়ে আবার চলে যেও না। তোমাকে থাকতে হবে সাবধানে। সতর্কভাবে।

সেই নির্জন দ্বীপটিতে তাদের দিনগুলো কাটতে লাগল। দিন পেরিয়ে মাস। মাস পেরিয়ে বছর। ডেভিডের বয়স এখন সতের। তার নীল চোখে ঝিকমিক করে দূরের স্বপ্ন। ওই স্বপ্নকে বুঝি ভয় পান ডাক্তার হ্যারিম্যান।

আকাশে চমৎকারভাবে সময় কাটায় ডেভিড। কখনও তাড়া করে পাখিদের ঝক। পাখিদের দল ভয় পেয়ে তখন তাদের গতিপথ পালটে ফেলে।

কখনও ঘন কুয়াশায় ঢেকে যেত দ্বীপটি। কুয়াশা ঢাকা আকাশের বুক থেকে ভেসে আসত উড়ন্ত মানুষের ধ্বনি।

ডাক্তার হ্যারিম্যান তখন বুঝতে পারতেন কোথায় রয়েছে ডেভিড ।

ডেভিডের আরেকটি প্রিয় খেলা ছিল আকাশ থেকে শোঁ করে নেমে সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনা স্পর্শ করা। আবার সিন্ধু সারসের মতো শাঁ করে উড়ে যাওয়া।

উড়ন্ত মানুষ সম্পর্কে মূল ভূ-খণ্ডের মানুষদের ভেতরে প্রচুর কৌতূহল সৃষ্টি হলো। অনেকেই উড়ন্ত মানুষকে দেখার জন্যে লঞ্চে নৌকোয় করে দ্বীপের চারপাশে ঘুরত। উড়ন্ত ডেভিডের ছবি চাইত। ঐসব ছবি অনেক দামে পত্রিকায় বিক্রি হতো।

ডেভিড দ্বীপের তীরে দাঁড়িয়ে দেখে ওপারের অস্পষ্ট কালো রেখা। বুঝতে পারে ওই রেখার ওপাশ থেকে তাকে দেখতে আসে পাখাহীন মানুষেরা। কখনও তারা আসে ছোট বিমানে করে।

ডাক্তার হ্যারিম্যান তাকে বারবার নিষেধ করে দিয়েছেন কালো রেখার ওপারে যেতে। অথচ ডেভিড ইচ্ছে করলে আরও দূরের দেশে চলে যেতে পারে।

একদিন ডেভিড ডাক্তার হ্যারিম্যানের মুখোমুখি হয় ।

আমি ওই দূর দেশে যেতে চাই।

এখন না। সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব।

কবে?

খুব শিগগিরই।

এখন যেতে দিচ্ছ না কেন?

কারণ তোমার পাখা আছে। পৃথিবীর আর কোনো মানুষের তা নেই। এ জন্যে দ্বীপের বাইরে গেলে তোমাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

কিন্তু কেন?

কারণ তুমি অন্যদের চাইতে আলাদা। স্বতন্ত্র। তোমাকে সবাই অন্য চোখে দেখবে। মানুষের বহু ধরনের বাজে কৌতূহল রয়েছে। কেউ হয়তো তোমার সাংঘাতিক ক্ষতিও করতে পারে। অনেক হিংস্র প্রকৃতির মানুষ রয়েছে। আমি ওদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যেই শিশু অবস্থায় তোমাকে নিয়ে এই নির্জন দ্বীপে চলে এসেছিলাম। বাইরের বিচিত্র পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে তোমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তখন আকাশ দিয়ে একঝাঁক পাখি দক্ষিণ দিকে উড়ে যাচ্ছিল। ডেভিড সেদিকে তাকিয়ে বলল, কই, এরা তো অপেক্ষা করে না। কেবল আমাকেই শুধু এই দ্বীপে পড়ে থাকতে হবে? ডেভিডের চোখে অভিমান।

আমিও ওদের মতো দূরে উড়ে যাব । দূরের দেশ দেখব। আপনি কোনো বাঁধা দেবেন না।

তুমি তো বাইরের পৃথিবীর কিছুই জান না। তোমাকে কী করে আমি একলা ছাড়ব?

ডেভিড একবুক যন্ত্রণা নিয়ে চলে যায়। তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। এক ধরনের কষ্ট তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার হ্যারিম্যান দেখলেন একটা সাদা ফুলেভরা গাছের নিচে চুপচাপ বসে আছে ডেভিড। শরতের মৃদু বাতাস বইছে। ডেভিড তাকিয়ে রয়েছে দক্ষিণে উড়ে যাওয়া পাখিদের দিকে। তার পাখা পিঠে উপর গুটিয়ে রাখা।

প্রবীণ ডাক্তার অনুভব করলেন ডেভিড এখন বেশ বড় হয়েছে। হঠাৎ তার মনে একটা ভয় হলো। পাখির ছানা যেমন বড় হলে নীড় ছেড়ে চলে যায় তেমনি কী ডেভিডও চাইছে? ওর ভেতরে যে রয়ে গেছে পাখির বুনো স্বভাব ।

ডাক্তারের কেন জানি মনে হলো তিনি আর ডেভিডকে এ দ্বীপে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবেন না। দ্বীপ ছেড়ে একদিন সে উড়ে চলে যাবে।

এক শেষরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ডাক্তার হ্যারিম্যানের। তার বুকের ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই মারা গেলেন তিনি।

ডেভিড তার ডাক্তার দাদুকে বারবার জাগাবার চেষ্টা করছে। দাদু কোনোমতেই জাগছে না। গভীর এক ঘুমে আচ্ছন্ন। ডেভিড দেখল নার্স কাঁদছে। রক্ষী নৌকো করে চলে গেল ওপারে। ডাক্তার হ্যারিম্যানের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে। ডেভিড বিষন্নভাবে পাখা গুটিয়ে বসে রইল। তার দৃষ্টি তখন দূর দিগন্তরেখার দিকে।

সে রাতে বাংলোবাড়িতে কেউ বাতি জ্বালাল না। ঘন অন্ধকারে ঢেকে রইল বাড়িটি। রক্ষী তখনও ফেরেনি। ডেভিড একবার গেল দাদুর ঘরে। বিছানায় পড়ে আছে দাদুর হিমশীতল শরীর। একটি শীর্ণ হাত ঝুলে রয়েছে। ডেভিড সেই শীতল হাতটাকে স্পর্শ করল। এই হাত কতদিন তাকে আদর করেছে। তার চুল টেনে দিয়েছে । ডেভিডের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এক সময় সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এখানে তার আর কোনো বন্ধন নেই। ডেভিড ধীরপায়ে হেঁটে গেল সমুদ্রের তীরে। শরতের চাদ চারপাশে স্নিগ্ধ মায়াবী আলো ছড়াচ্ছে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।

ডেভিড উপরের দিকে লাফ দিল। তার বিশাল পাখা দুটো খুলে গেল। শূন্যে উঠল ডেভিড। শীতল বাতাসের স্রোত বইছে তার চারদিকে। ডেভিড দ্বীপ ছেড়ে উড়ে গেল। মেঘের রাজ্যে মিলিয়ে গেল ডানাঅলা মানুষ।

উড়তে উড়তে পাখিদের একটি ঝাঁকের মাঝে মিশে গেল ডেভিড। পাখিরা ভয় পেল। তারা পরে দেখল এই বিচিত্র প্রাণীটা তাদের কোনো রকম ক্ষতি করছে না। তারা তখন ডেভিডকে তাদের সাথী হিসেবে নিল। ডেভিড উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে।

চাঁদের আলোতে সারারাত উড়ল ডেভিড। পরদিনও একটানা উড়ল। নিচে কলকল করছে নীল সমুদ্র। এক সময় ডেভিডের চোখে পড়ল ডাঙা। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একটি দ্বীপভূমি। পাখা গুটিয়ে ডেভিড তখন নেমে এলো দ্বীপে। তার খুব খিদে পেয়েছে। ক্লান্তিতে সারা শরীর অবসন্ন। দ্বীপের গাছে গাছে ঝুলছে টসটসে পাকা ফল । সেগুলো পেড়ে খেয়ে নিল ডেভিড। চমৎকার স্বাদ।

সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। সে তরতর করে একটি ওক গাছে উঠে গেল। শক্ত একটা বড় ডালে শুয়ে থাকল। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। মেঘের ফাকে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ। আজ সে একা। আশেপাশে কেউ নেই। ডাক্তার দাদু নেই। নার্স নেই। রক্ষী নেই। শুধু বাতাসের একটানা গর্জন। এক সময় ঘুমিয়ে গেল ডেভিড।

পরদিন ভোরে গাছের ডালে ঘুম ভাঙল ডেভিডের। চারদিকে নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। গাঙচিলেরা উড়ছে। ডেভিড আবার উড়ল আকাশে। তাকে যেতে হবে অনেক দূর।

মূল ভূ-খণ্ডের মানুষ তখন জানল পাখাঅলা মানুষ দ্বীপ ছেড়ে বাইরে এসেছে। খামারের চাষিরা দেখল উড়ন্ত ডেভিডকে। গ্রাম ও শহরের মানুষেরা দেখল উড়ন্ত ডেভিডকে। অনেক গ্রামের লোক ভয় পেয়ে গেল তাকে দেখে। ভাবল দেবদূত বুঝি নেমে এসেছে আকাশের সিঁড়ি বেয়ে।

ডানাঅলা মানুষকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র সব খবর ছড়িয়ে গেল। সমস্ত শীত কালটা জুড়েই দক্ষিণ দিক থেকে আসতে লাগল এসব বিচিত্র খবর। কেউ জানল পাখাঅলা মানুষ এখন পুরোপুরি বুনো হয়ে গেছে। জঙ্গলে থাকে। আকাশ থেকে বাজপাখির মতো ঝাপ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ থেকে তুলে নেয় রুপোলি মাছ। রাতে ঘুমায় কোনো গাছের ডালে। কাঁচা মাছ চিবিয়ে খায় ।

কোনো কোনো রাতে ডেভিডকে দেখা যেত শহরের উপর ভেসে যেত । শহরে কখনও নামত না সে।

বসন্তকাল এলে পাখিদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। তারা এবার ফিরে যাবে উত্তরের দেশে। ডেভিডও এই ফিরে যাবার তাগিদ অনুভব করল। তাদের সেই ছোট্ট দ্বীপের কথা তার মনে হল।

পাখিদের ঝাঁকের সঙ্গে মিশে আবার নিজেদের পুরনো দ্বীপে ফিরে এলো ডেভিড। কেউ কোথাও নেই। বাংলোবাড়িটা ভেঙে গেছে। কাঠ গেছে পচে। চারদিকে আগাছা। সব জিনিসে ধুলো।

দ্বীপে ডেভিডের মন বসল না। আবার সে উড়ে গেল। তিন বছর ধরে এভাবে বিভিন্ন স্থানে উড়ল ডেভিড। থাকল বনে-জঙ্গলে। মানুষের পৃথিবী থেকে দূরে সরে রইল।

এক সময় মানুষও ডানাঅলা ডেভিডের কথা ভুলে যেতে থাকল। তিন বছর পরের কথা। বসন্তকাল। বনে বনে ফুল ফুটেছে। সোয়ালো পাখিদের একটি ঝাকের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল ডেভিড । তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। চারপাশে ঘনিয়ে উঠেছে অন্ধকার। একটি বাগানবাড়ির উপরে এলো ডেভিড । তার বেশ খিদে পেয়েছে। নিচে অনেক ফলের গাছ। ডেভিড ফল নেবার জন্যে নেমে এলো। ঠিক সে সময় একটি বন্দুক গর্জে উঠল । ডেভিডের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। সে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

জ্ঞান ফিরে পাবার পর ডেভিড দেখল সে শুয়ে রয়েছে দামি বিছানায়। ঘরে একজন বয়স্ক লোক আর তরুণী দাঁড়ানো। ডেভিডের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। বয়স্ক লোক চিনতে পেরেছেন ডেভিডকে।

তুমিই তাহলে সেই বিখ্যাত পাখাঅলা মানুষ। তোমার কথা জানে অনেকেই।

ডেভিড একটু উঠে বসে। ভদ্রলোকের কণ্ঠে মমতা।

আমাদের বাগানের মালী তোমাকে বাজপাখি মনে করে গুলি করেছে। আমার খামার থেকে প্রায়ই মুরগির বাচ্চা তুলে নিত বাজপাখি। ভাগ্যিস, তুমি মারা যাওনি। সামান্য আহত হয়েছে।

আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আমার নাম রুথ।

ডেভিডের কাছে মনে হলো এত অপূর্ব কোনো মেয়েকে সে আগে কখনও দেখেনি। শোনেনি এমন মধুর কণ্ঠ।

তার এতদিনের জীবন ছিল বুনো।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল ডেভিড। রুথ দিনরাত তার সেবা করছে। ডেভিড তার জীবনের এক নতুন অর্থ খুঁজে পেল।

একদিন ডেভিড বলল, আমি তোমাকে সবসময় সাথী হিসেবে পেতে চাই।

তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও?

হ্যা।

কিন্তু তোমার পাখা… হেসে ফেলল ডেভিড,

আমার পাখার কোনো ক্ষতি হয়নি। ইচ্ছে করলে আমি এখনি আকাশে উড়ে যেতে পারি।

ডেভিড তখন খুলে ফেলল তার গুটিয়ে রাখা পাখা ।

রুথ বিষন্ন কণ্ঠে বলল, এই পাখার জন্যেই যে তুমি আলাদা । তোমার এই পাখা যে অস্বাভাবিক। বিস্ময়কর।

আমার পাখা সুন্দর। আমাকে কত সহজেই নিয়ে যায় আলোভরা আকাশে। এই দেখ।

ডেভিড ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। রুথ তাকিয়ে রইল উপরের দিকে। ডেভিডকে তখন ছোট একটি কালো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে।

খানিক পর নেমে এলো ডেভিড।

রুথ বলল, যখন তুমি আকাশে থাক তখন তোমাকে আর মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় বিরাট অদ্ভুত একটি পাখি । তোমার পাখাই তোমাকে যে আলাদা করেছে। এমন পাখি মানুষ নিয়ে আমি কী করে সমাজে থাকব? এই সমাজ তোমাকে গুরুত্ব দেবে না। অদ্ভুত একটি প্রাণী হিসেবে দেখবে। উপহাস করবে। তোমার দেহ থেকে পাখা দুটো বাদ দিলে আমি তোমার চিরদিনের সাথী হতে পারি।

একথা শুনে ডেভিড স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রুথ তার পাখা দুটো কেটে ফেলার জন্যে পরামর্শ দিচ্ছে। রুথ কাছে এগিয়ে আসে।

আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তোমার পাখা দুটো খুব সহজেই কেটে বাদ দেয়া যেতে পারে। এতে তোমার শরীরের কোনোরকম ক্ষতি হয় না। কেবল তোমার পিঠের দুপাশ থাকবে উঁচু।

অনেক দিন ভাবল ডেভিড। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল তার পাখা দুটো কেটে বাদ দেবে।

একদিন অপারেশন করে ডেভিডের পাখা দুটো কেটে বাদ দেয়া হলো।

ডেভিডের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রুথের।

বিয়ের পর ওরা দুজন. ঘাস পাহাড়ের উপর তৈরি একটি সুন্দর সাদা কটেজে উঠে এলো। নতুন জীবন শুরু করতে।

তাদের দিনগুলো কাটতে লাগল আনন্দে।

শরতকালের এক রাত। হঠাৎ ডেভিডের ঘুম ভেঙে গেল। সে যেন শুনতে পেল পাখিদের উড়ে আসার শব্দ। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আকাশপথে ছুটে আসছে পাখিরা।

ডেভিড তখন অস্থির হয়ে উঠল। তারা ঝিকমিক আকাশ। যাযাবর পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে দক্ষিণে।

ডেভিডের ভেতরে ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। মনে হচ্ছে শূন্যে ঝাঁপ দিতে। শাঁ শাঁ করে উড়ে আকাশে চলে যেতে। যাযাবর পাখিদের মাঝে মিশে যেতে। যেখানে তার দুটো পাখা ছিল শরীরের সেখানটায় যেন প্রবল রকমের টান পড়ল। মাংশপেশি কাঁপছে। কান্না পেল ডেভিডের। তার এখন পাখা নেই। উড়তে পাড়ার কোনো ক্ষমতা নেই।

জানালা বন্ধ করে দিল ডেভিড । আকাশ দেখতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার চেয়ে এই ভালো। চার দেয়ালের ভেতরে আটকে থাকা। বন্দি জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। | পরদিন নীল আকাশ দেখে আবার ডেভিডের মনে উড়ে যাবার ইচ্ছে জেগে উঠল। এই রকম এক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছে ডেভিডের দিনকাল।

একদিন ডেভিড অনুভব করল তার পাখার স্থানে বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রথমে চিনচিন করত। দিন দিন যন্ত্রণা বাড়তে লাগল। ডানা কাটার স্থানে যে মূল ছিল সেগুলো ক্রমশ বড় হতে লাগল । চিন্তিত হলো ডেভিড। বুঝতে পারল তার শরীরের ভেতরে একটি পরিবর্তন আসছে।

তবে কি আবার তার দুটো ডানা গজাচ্ছে?

একদিন প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। এই ডাক্তারই তার অপারেশন করেছিল।

ডাক্তার, আবার কি আমার পাখা হতে পারে?

পারে। টিকটিকির লেজ খসে গেলেও আবার তা তৈরি হয়। গোসাপও তার হারানো অঙ্গকে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারে। আরও বেশ কিছু প্রাণীর এ রকম ক্ষমতা রয়েছে। তোমার পাখা জোড়ার স্থানে এমন শক্তি হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারে যার সাহায্যে তোমার পাখা দুখানা আবার মূল থেকে আংশিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারে। ভয় নেই। যদি বের হয় আমি আবার অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেব।

ডেভিড চিন্তিতভাবে বাড়িতে ফিরে এলো। এরপর থেকে রোজ আয়নায় পিঠ দেখত। একদিন দেখল ওর মূলের ভেতর থেকে দুটো পাখা উকি দিচ্ছে। দিন দিন বাড়ল পাখা। ডেভিড অনেক কষ্টে সে দুটো লুকিয়ে রাখল।

ডেভিড ভাবছে, তার কি এখন ডাক্তারের কাছে গিয়ে অপারেশন করে পাখা কেটে বাদ দেয়া উচিত। এবারের পাখা জোড়া অবশ্য আগের চাইতে ছোট। ডেভিড মনে করল পাখা আরও একটু বড় হলে সে অপারেশনের জন্য যাবে।

কদিন পর ডেভিড বাবা হলো। তার ছেলের শরীরে কোনো অস্বাভাবিকতার চিহ্ন নেই। পিঠে নেই কুঁজ । ডেভিড সেদিকে তাকিয়ে ভাবল, এ ছেলের কোনোদিন পাখা হবে না। সে আকাশের উড়তেও পারবে না।

আজকাল ডেভিড রাতে ঘুমুতে পারে না। অস্থির ভাবে পায়চারি করে। ওর ভেতরের একটি সত্তা বলে, তোমার পাখা জোড়াকে নিয়ে আবার আকাশে উড়তে চাও। বাস্তব সত্তা বলে, সত্যি এখন আমি উড়তে চাই না। আমার একটি ছেলে হয়েছে। আমার সুখী সংসার।

ডেভিড মনস্থির করল। সে ডাক্তারের কাছে যাবে অপারেশনের জন্যে।

পাহাড়ি কটেজ থেকে বেরিয়ে এলো সে।

সেটা ছিল শরতের এক রাত। হঠাৎ করে বাতাস ঝড়ো হয়ে উঠল। পাহাড়ি পথের গাছপালার ভেতরে তীব্র গর্জন করে বইছে বাতাস।

ডেভিড তখন শুনতে পেল পাখিদের কলধ্বনি। যাযাবর পাখিরা দক্ষিণ দিকে উড়ে চলেছে। ডেভিড ছটফট করে উঠল। তাকাল আকাশের দিকে । উড়ে আসছে যাযাবর পাখিদের আঁক। ডেভিডের শরীর তখন কেন জানি উত্তেজনায় থরথর করে উঠল। তার চোখ দুটো চাঁদের আলোতে ঝিকিয়ে উঠেছে।

ডেভিডের মনে কাঁপন জাগায় তখন সুদূর আকাশের ডাক। নীলাকাশের হাতছানি। তাকে ডাকছে মেঘমালা। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসছে পাখিরা। তাদের তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

ডেভিড এবার উড়তে চায়। তার ভেতরে ক্রমশ ফুলে উঠছে আবেগের প্রবল স্রোত। মাটির বন্ধন কাটিয়ে সে শূন্যে চলে যাবে। দূরে কোথাও।

ডেভিড পাখা ছড়িয়ে লাফ দেয়ার ভঙ্গি করল। থরথর করে কেঁপে উঠল ডানা।

সে যেন আগের মতো আর উড়তে পারছে না। ভয়ে মুখ তার ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে কি সে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে? বাতাস ফিসফিস করে যেন তাকে বলছে, তুমি আবার উড়তে পারবে। কত বিশাল আকাশের এ পথ। তুমি এখানে উদ্দামভাবে ছুটছে। কোনো বাধা নেই।

যাযাবর পাখিরা যেন তাকে বলছে, তুমি তো আমাদের একজন। মাটির পৃথিবীতে এখনও রয়ে গেছ কেন? ডানা মেলে দিয়ে চলে এস আমাদের মাঝে।

ডেভিড শিহরিত হলো এসব ডাকে।

শূন্যে লাফ দিল ডেভিড। তার পাখা দুটো বাতাস কেটে তাকে নিয়ে গেল উপরে। অনেক উপরে। মেঘের দেশে।

যাযাবর পাখিদের ঝাঁকের সঙ্গে মিশে গেল সে। পাখিরা তাকে ঘিরে নিয়ে চলল। ডেভিডের মনে হলো এই তো তার আসল জীবন। বেঁচে থাকার অপূর্ব স্বাদ সে এখন পাচ্ছে। ফিরে পেয়েছে নিজের আসল রূপ। এতদিন পৃথিবীতে ভুলভাবে সে বন্দি হয়েছিল। তীব্র গতিতে উড়তে লাগল ডেভিড। এক সময় তার ছোট পাখা দুটোর শক্তি কমে এলো। ডেভিড আর উড়তে পারছে না। সে নিচের দিকে শোঁ শোঁ করে নেমে আসতে লাগল। সমুদ্রের ঢেউগুলো এগিয়ে আসছে তার দিকে। ডেভিড যেন সেখানে দেখল টলটল করে ভাসছে রুথের মায়াবী মুখ। তার ছেলের কোমল, নিস্পাপ মুখ।

ডেভিডের শরীর আছড়ে পড়ল সমুদ্রের ঢেউতে।

এডমন্ড হ্যামিলটনের কাহিনির ছায়া অবলম্বনে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *