০৫. চাঁদের মেয়ে

চাঁদের মেয়ে

২০৫০ সালের রাতে লোকটার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা তখন বিমানে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। সে রাতে লোকটি আমাকে এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনিয়েছিল।

আমি যে কাহিনিটি বলব সেটা হলো ২২ শতকের। কাহিনি শুরুর আগে আমার পিতামহের কথাটি বলি । ১৯৯৬ সালে তাঁর জন্ম। আমার বিয়ে ১৯১৬ সালে । আমার ছেলে জুলিয়াস ১৯১৭ তে জন্ম নেয়। ১৯১৮ সালে আমি মারা যাই । বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দিনে।

আমি আবার জন্ম নিলাম ১৯৩৭ সালে । আমি পুনর্জন্মগ্রহণ করি । আগের জন্মের সব কথাই আমার স্মৃতিতে রয়েছে। সময়ের বিচিত্র স্তর পেরিয়ে আমি আসা-যাওয়া করেছি। আমি বলব পঞ্চম জুলিয়ানের কথা । ঘটনা ঘটে ২০০০ সালের পর । জুলিয়ান যে বছর জন্ম নেয়। আমারই নাম পঞ্চম জুলিয়ান। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন প্রথম জুলিয়ান । একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল।

আমরা জেনেছিলাম মঙ্গল গ্রহের বুকে এক বিশাল সভ্যতা রয়েছে । তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। আমরাও সেই চেষ্টা করছিলাম। খবর পেলাম তারা একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছে পৃথিবীর দিকে। মহাকাশযানের নাম বারশুম। দুর্ভাগ্য শেষপর্যন্ত বারশুম পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে পারেনি। এরপর পৃথিবী থেকে সেখানে একটা মহাকাশযান পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমি ওই যানের চালক নির্বাচিত হলাম।

মহাকাশযানের প্রধান প্রকৌশলী ছিল আমার সহপাঠী অর্থিস। বুদ্ধিমান কিন্তু খুব বাজে স্বভাবের লোক। মনের মধ্যে শুধু হিংসে। মহাকাশযানটি অর্থিসেরই আবিষ্কার। আমরা ভাবছিলাম বারশুমের কথা। কোন অনন্তে হারিয়ে গেল মহাকাশযানটি। আমাদেরও না আবার ও রকম হয়।

২০২৪ সালে আমাদের মহাকাশযান যাত্রা শুরু করল মঙ্গলের দিকে। কয়েক বছরের খাবার নেয়া হয়েছিল। ত্রিশ জন কর্মী মহাকাশযানে। আমার সহকারী অর্থিস আর নর্টন। আট মাস ধরে মহাশূন্যে ভেসে চললাম আমরা। আমাদের দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে গেছে পৃথিবী। শুনেছি বারশুম কিছুদিন খবর পাঠিয়েছিল বেতার তরঙ্গে। এক সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।

অর্থিসকে আমার কাছে ভালো লাগত না। তার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মাঝে মাঝে কেমন হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকাতো । একদিন আমার ঘরে ঢুকে ক্ষেপে গেল, তোমার জন্যে আমি এ যানের চালক হতে পারিনি। সবসময় তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়েছ। মঙ্গলে পৌছালে সব সম্মান তুমি পাবে অথচ এ যানটি আমি তৈরি করেছি।

আমি দেখলাম অর্থিস কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ। ওকে তখন বেরিয়ে যেতে বললাম।

পরদিন একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটল। রাতের বেলা আমি শুয়ে রয়েছি। নর্টন ছুটে এলো।

ক্যাপ্টেন, শিগগিরই একবার আসুন। অর্থিস ইঞ্জিন নষ্ট করে ফেলেছে।

আমি ছুটে গেলাম ইঞ্জিন ঘরে। চারদিকে নানা যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মাঝখানে অর্থিস দাঁড়িয়ে। আমি ওকে একটা ঝাকুনি দিয়ে তীব্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী করছ ইঞ্জিনের?

কী করেছি সেটা ভালো করেই বুঝবে। মঙ্গল গ্রহে আর যাওয়া হবে না ।

শয়তানের মতো হাসতে লাগল অর্থিস। তার চোখ দুটো লাল । সেখানে যেন ধ্বংসের ছায়া। অর্থিসের কাণ্ড দেখে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ক‘দিন পরই বোঝা গেল আমাদের মহাকাশযানের কতটা মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মহাকাশযান তখন মঙ্গলের কক্ষপথ আর অভিকর্ষে না ঢুকে চাঁদের অভিকর্ষে আকর্ষিত হতে চাইল। এবার তাহলে চাঁদে নামতে যাচ্ছে।

অর্থিস ঈর্ষায় উন্মাদের মতো আচরণ করছে। ওকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হলো।

আমরা ধীরে ধীরে চাঁদের আকর্ষণ টের পাচ্ছি। মহাকাশযানটি দ্রুত চাঁদের দিকে নেমে চলেছে। চাঁদের বিরাট আকৃতি জেগে উঠছে সামনে। শেষপর্যন্ত আমরা চাঁদের বুকে পৌছালাম। তারিখটি ছিল ২০২৬ সালের ৪ জানুয়ারি। সময় বেলা এগারোটা। মহাকাশযানের দরজা খুলে বাইরে এসে বুক ভরে চাঁদের বাতাস টেনে নিলাম।

বিস্তীর্ণ ভূমি। অসংখ্য পাহাড়। সবকিছু যেন কুয়াশায় ঢাকা। কখনও সূর্যের আলোতে চারপাশ ঝলমল করে ওঠে। নিজেদের ওজন বেশ হালকা লাগছে।

চাঁদের বুকে নেমে আমরা প্রথমে কিছু পাথর আর সবুজ লতা পরীক্ষা করলাম। লতাগুলো বিচিত্র। মহাকাশযানে একটি গবেষণাগার ছিল। চাঁদের মাটি ঘাসে ঢাকা। কোথাও কীটপতঙ্গ। সরসর করে পালিয়ে যায় সরীসৃপ। একদিন দেখলাম পাঁচ পাঅলা সাপ। সেটার মাথার মাঝখানে একটি মাত্র চোখ জ্বলজ্বল করছে।

নর্টন বলল, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে এখানে পৃথিবীর মতো প্রাণীও থাকতে পারে।

তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

হঠাৎ নর্টন কী যেন দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল। তাকিয়ে দেখি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। অদ্ভুত ঘোড়ার মতো একটি প্রাণী। সামনের দিকটা মানুষের মতো। চারটে পা। প্রাণীটার হাতে একটা বিরাট বর্শা জাতীয় চকচকে অস্ত্র।

চারদিক থেকে অসংখ্য ঘোড়া মানুষ এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। আমার আর নর্টনের হাতের বন্দুক একসঙ্গে গর্জে উঠল। দুটো বিচিত্র প্রাণী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বাকি প্রাণীগুলো হিংস্র আক্রোশে ঝাপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। বন্দি করল আমাদের। বিচিত্র এক ধরনের ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে।

আমাদের একদিন হাজির করা হলো ওদের দলপতির সামনে। ওই জাতির নাম নোভানস। দলপতি তীক্ষ্ণ স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি আমাদের ভাষা শিখেছ?

কিছুটা। কোনোমতে কথা চালিয়ে যেতে পারব।

কোথা থেকে এসেছ তোমরা ।

পৃথিবী থেকে।

আমাকে সেখানে নিয়ে চল। সেখানে খাবার আছে? মাংস আছে?

সেখানে যাওয়া যাবে না। মাংস আর খাবার প্রচুর আছে।

তোমরা কি নিজেরা নিজেদের ভক্ষণ কর?

আমাদের মাংশে বিষ আছে। ওই মুহূর্তে হইচই শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি বিচিত্র এক ঘটনা। পৃথিবীর অধিবাসীদের মতো একটি মেয়েকে ঘোড়া মানুষেরা ধরে এনেছে। মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

এক কুটিরে আমাদের বন্দি করে রাখা হলো। ঘোড়া মানুষেরা নরখাদক। ওরা আমাদের সময়মতো খাবে।

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। খাবার হিসেবে আমাদের দেয়া হচ্ছে ফলমূল আর পাখির পোড়া মাংস। অর্থিস আমাদের মধ্যে ছিল না। ও ওদের দলপতির সঙ্গে ভাব করে ফেলেছে।

সারা দিন রাত ঘোড়া মানুষেরা আমাদের পাহারা দিত । পালিয়ে যাবার কোনো পথ নেই।

চাঁদের এ মেয়েটির ভাষা আমি শিখে ফেলেছি। ও চাঁদের অন্য এক জাতের মেয়ে। ওদের জাতির নাম সঈদ। ওরা নোভানসদের প্রধান শত্রু

মেয়েটির নাম নাহিলা। জানাল, তাকে উদ্ধার করতে চার দলের লোকেরা আসবে। একদিন রাতে প্রচণ্ড হইচই। দেখি দলে দলে ঘোড়া মানুষেরা বর্শা হাতে ছুটে আসছে। আমাদের কুটিরে তখন কোনো পাহারা নেই। সেই সুযোগে পালালাম।

রাতের অন্ধকারে দু‘দলের যুদ্ধের মারাত্মক শব্দে হচ্ছে। আর্তচিৎকার। অস্ত্রের ঝনঝনানি। ভয়ঙ্কর এক পরিবেশ চারদিকে।

আমরা উন্মাদের মতো ছুটে চলেছি। পালাতে হবে এখান থেকে। এক সময় দেখি আমি একা। সঙ্গীরা কেউ কোথাও নেই। কোথায় যে ছিটকে পড়েছে। হতাশা ঘিরে ফেলল আমাকে। এক সময় রাত শেষ হলো। ভোরের নরম আলো ফুটে উঠেছে। চাদের বিস্তীর্ণ পাথুরে জমি। কোথাও প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে একদিন এলাম সঈদদের রাজ্যে। সেখানে নাহিলাও ছিল। আমাকে দেখে হাসল।

একদিন নোভানসরা আবার আক্রমণ করল। আমি পালালাম। সঙ্গে নাহিলা ছিল। বনে-জঙ্গলে ছুটতে লাগতাম আমরা। পথ যেন আর শেষ হয় না। হঠাৎ এক পাহাড়ের কোণায় খুঁজে পেলাম আমাদের মহাকাশযানটিকে। দেখে কী যে খুশি লাগল। যানটিকে আবার ঠিক করা হয়েছে। ওর ভেতর থেকে হাসি মুখে নর্টন বেরিয়ে এলো, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম ক্যাপ্টেন। আমি ইঞ্জিন সারাতে পেরেছি। এবার আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব।

প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে বিমান। কাহিনি শেষ করে উঠে দাঁড়াল জুলিয়ান। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, চমক্কার কাটল কিন্তু সময়টা।

কিন্তু একটা কথা যে বলেননি। কবে ফিরেছিলেন পৃথিবীতে?

পঞ্চম জুলিয়ান পৃথিবীতে ফেরে ২০৩৬ সালে। তাঁর স্ত্রীর নাম হলো নাহিলা। চাঁদের মেয়ে। কিন্তু সময়ের কোনো হিসেবে যে আমার জানা নেই।

এডগার রাইস বারোজ-এর কাহিনির ছায়া অবলম্বনে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *