০২. বাদাবনের হাতছানি

বাদাবনের হাতছানি

রোদের ঝাঁঝ একটু কমে আসতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম । বাংলাবাজারের কাছে ছোট্ট একটি দোকান আছে। চমৎকার সবজির চপ বানায়। সেখানে গেলে কজন বন্ধু পাওয়া যাবেই। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার জন্যে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ছোট্ট দোকানটিতে অসম্ভব ভিড় । এক কোণায় দেখি টুনু ভাইকে। আমাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন।

ভালোই হলো তোকে পেয়ে । তোর তো আবার পুরনো বইগুলোর ঘাটার অভ্যেস আছে । আজ এক বাড়িতে নিয়ে যাব। ওরা কিছু পুরনো বই বিক্রি করবে। নে, চপ খা।

চপগুলোর উপর থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে। বেশ কয়েকটা সবজির চপ তেঁতুলের চাটনির সাথে মিশিয়ে খেলাম। সঙ্গে কুঁচি কুঁচি করে কাটা পুদিনার পাতা ছিল। টুনু ভাইয়ের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে উৎসাহিত হয়ে উঠি। পুরনো বই খোঁজার আমার এক দারুণ রকমের নেশা।

একসময় ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। পাশের টেবিলে একটি কিশোর সিলেটের হাওরে যে সত্যি সত্যি স্কাইল্যাবের টুকরো পড়েছে সেটাই এক বন্ধুকে আপ্রাণভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে। বর্ষাকালটা শেষ হয়ে এলেই ওরা সেখানে একটি অভিযান চালাবে বলেও ভাবছে।

টুনুভাই ডিমের কারি খেতে খেতে বললেন, কপাল বটে ওই অস্ট্রেলিয়ার থর্নটন ছোঁড়াটার। নিজেদের বাগানে প্রথম কুড়িয়ে পেল স্কাইল্যাবের টুকরো। আমেরিকার কোনো এক পত্রিকায় সেই টুকরোটা প্রথমে গছিয়ে দিতেই কড়কড়ে দুলাখ টাকা পেয়ে গেল।

সেই পত্রিকাটির নাম সানফ্রান্সিসকো একজামিনার। আমি জানিয়ে দেই।

দোকানগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণ ধরে লোডশেডিং চলছিল। গাড়িঘোড়ার অবিরাম শব্দ। একটি মেয়েকে তার মা বোধ হয় করুণ সুরে ডাকছে। কে জানে, মানুষের এই ভিড়ের মাঝে মেয়েটি হারিয়ে গেছে কিনা। টুনুই পকেট থেকে কাগজ বের করে ঠিকানাটি দেখে নেন। ফরাশগঞ্জে বাসা। আমরা দুজন দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি।

রাস্তার দু’পাশে শুধু দোকান আর গুদামঘর। শুকনো মশলা ভাই করে রাখা। লাল মরিচের পাহাড়। পেঁয়াজের স্তুপ। এদিককার দোকানগুলোতে মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। পেছনেই নদী। দূরের গ্রামগুলো থেকে নৌকা বোঝাই করে কাঁচা তরিতরকারি আসছে।

বাড়িটিকে খুঁজে বের করি। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে টুনুভাই ঠিকানাটি মিলিয়ে দেখলেন। পুরনো তিনতলা বাড়ি। নিচতলায় একটি কবিরাজি ওষুধের দোকান। রঙচটা সাইনবোর্ডে নানা রকমের ওষুধের নাম। একটি লোক একজনের কাছ থেকে হরিতকি কিনছে।

তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,

যিনি বই বেচবেন তিনি তিনতলায় থাকেন। সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে হবে।

একটি পাগল বসে ছিল সিঁড়ির দোরগোড়ায়। সে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। সিঁড়ির মাথায় অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। একটি শাদা কালো মেশানো রঙের বেড়াল ধুপ করে নেমে দৌড়ে পালাল।

আমি আর টুনুভাই কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে তিনতলায় উঠে এলাম। দরজা খোলা। ঘরের মাঝখানে একটি পুরনো আমলের পালঙ্ক। নানা ধরনের কারুকাজ করা। একটি বিরাট বাজপাখি যেন ডানা মেলে উড়ে আসছে। কাঠের উপর এই নকশাটি চমৎকার ফুটেছে। পালঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে ফ্যাকাশে চেহারার এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে একজন যুবক দাঁড়ানো। যুবক তালপাখা দিয়ে বৃদ্ধকে বাতাস করছিল। আমাদের চোখে পড়তেই এগিয়ে এলো । টুনুভাই বললেন, পুরনো বই বিক্রির কথা।

কথাটা কানে যেতেই বৃদ্ধ লোকটি আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, আসুন, বসুন। খুব টানাটানি যাচ্ছে বলে বইগুলো বিক্রি করছি। এসব আমার দাদামশায়ের সংগ্রহ। তার বই জমাবার বাতিক ছিল। খুব দুপ্রাপ্য কিছু বই আছে। জেমস টেলরের টপোগ্রাফী অব ঢাকার প্রথম সংস্করণটি আছে। ঢাউস আকারের বই। কি, জেমস টেলরের নাম কোনোদিন শোনেননি বলে মনে হচ্ছে! তা শুনবেন কোথেকে। তিনি তো আর ছায়াছবির অভিনেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ১৮০৮ সালের ঢাকা শহরের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্জন। ঢাকার আশপাশের অঞ্চল নিয়ে চমৎকার রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। সেটাই তো ওই বই।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বৃদ্ধ হাঁপাতে লাগলেন। আমি আর টুনুভাই হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি কুশনে বসে শুনছি।

ঢাকার আদি ইতিহাসের উপর বিদেশি কিছু লেখা আছে। আমি একবার ঢাকার পুরনো কিছু রাস্তার নামের ইতিহাস লিখে ইংরেজি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম, ছাপেনি।

বৃদ্ধ লোকটি পালঙ্কে ঠেস দিয়ে উঠে বসেছেন। যুবকটি তাকে শাদা পাথরের গ্লাসে পানি খেতে দিল।

আগের দিনে ধুপখোলার মাঠে বুলবুলির লড়াই হতো। ঢাকার রইস আদমিরা মাঠে তাবু ফেলত। খাঁচাভর্তি বুলবুলি। লাল বুলবুলি। সেপাই বুলবুলি। সাংঘাতিক লড়াই হতো। একপাখি অন্যপাখির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতো। ঠোট দিয়ে কামড়ে পেট ফুটো করে দিত। তাই দেখে উত্তেজিত লোক বাহবা দিত। বাজি ধরত।

ফরাশগঞ্জের এই বৃদ্ধ লোকটির চোখে তখন হারিয়ে যাওয়া দিনের স্বপ্ন । সেসব দিনগুলোকে এরা বড় যত্ন করে আগলে রাখে। যেন মলিন না হয়ে যায়।

খুব কষ্ট করে এসব পুঁথিপত্তর জমিয়ে রেখেছি। আমি চোখ মুঁদলেই তো সব লুটেপুটে নিয়ে যাবে। মুদি দোকানের ঠোঙা হবে।

আমি ঘরটির চারদিকে তাকাতে লাগলাম। বিভিন্ন লতাপাতার ছবি ঝোলানো।

বুঝলেন, একসময় অর্কিডের চাষ করতাম। বলধার জমিদারকে বহু চারা দিয়েছি। তার শখটা ভালো লাগতো খুব উৎসাহ ছিল। আমাজান থেকে পদ্মফুলের বীজ আনিয়ে শঙ্খনিধির দিঘিতে ফুটিয়েছিলেন। ইয়া বড় বড় পাতা। একটা মানুষের বাচ্চাকে সে পাতার উপর দিব্যি বসিয়ে রাখা যেত। এসব কথা আজকালকার লোকেরা জানে? সব তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার শহরের দুপ্রাপ্য সব গাছপালা কেটেকুটে সাফ করে দিচ্ছে। বলধা বাগানের সেই দারুচিনি গাছটা এখনও আছে, না নেই?

বৃদ্ধ লোকটি কথা বলতে ভালবাসেন। কথা বলার সময় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। দেখলেই বোঝা যায় বহু বছরের কথা জমে আছে। শোনাবার লোক পান না। সবাই হয়তো অবহেলা করে যায়। তাই এক ধরনের চাপা অভিমানে গুমড়ে মরেন ।

আমি কিন্তু দায়ে পড়ে বইগুলো বিক্রি করছি। দরদাম না করলেই খুশি হব। আলো, পাশের ঘর থেকে বইগুলো নিয়ে এসো তো।

একটা অদ্ভুত সুরে সামনের দেয়ালঘড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট পেতলের পাখি ডেকে সময় জানিয়ে দিল। যুবকটি অনেকগুলো বাঁধানো বই নিয়ে এলো। বেশ কিছু বই মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো। বৃদ্ধ লোকটি যা দাম চাইলেন, টুনুভাই তা দিয়েই কিনে নিলেন।

সেই পুরনো বাড়ি থেকে নেমে আমাকে কয়েকটা বই দিয়ে বললেন, রাতে ভালো করে এগুলো উল্টোপাল্টে দেখ। কাল দুপুরে আমার বাসায় আসবি। বইগুলো নিয়ে তখন আলাপ করা যাবে।

আমি খুব খুশি হলাম বইগুলো পেয়ে। কেমন পুরনো গন্ধ। নানি বাড়ির ট্রাঙ্ক খুললে এ রকম গন্ধ পাওয়া যায়। ন্যাপথোলিন মেশানো গন্ধ। অনেকগুলো বইয়ের পাতা হলদেটে, ঝুরঝুরে ।

সিঁড়ির গোড়ায় সেই পাগলটা তেমনি বিড়বিড় করে আপন মনে হাসছে। কবিরাজি দোকানটা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। হলুদ চাঁদ উঠেছে আকাশে। ইলেকট্রিকের তারে একটা মরা কাক ঝুলে আছে।

সে রাতেই মাথার কাছে টেবিলল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বইগুলো পড়তে বসলাম। একটি বই নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলের সাধুদের উপর লেখা। এসব সাধুরা এক ধরনের রহস্যময় গাছের শেকড় খেয়ে দীর্ঘজীবী হয়। সেই গাছের শেকড়ের নাম রুণ। আরেকটি বই মঙ্গোলিয়ার যাযাবরদের জীবনযাত্রা নিয়ে খেলা। তারা কীভাবে ঘাসজমিতে বুনোঘোড়া নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। বুনো তিতির দিয়ে অন্য পাখিদের শিকার করে।

বইগুলোতে বেশকিছু কাঠের ব্লকের ছবি ছাপা হয়েছে। তাতে ছবিগুলোকে একটু রহস্যময় লাগে।

বইগুলোর ভেতরে একটি খয়েরি চামড়ায় বাঁধানো খাতা চোখে পড়ল। সবুজ কালিতে গোটা গোটা করে লেখা। কিছুটা পড়েই বুঝলাম একজনের ডাইরি সেটা। দেড়শো বছরের পুরনো। বৃদ্ধ লোকটির দাদামশায়ের ডাইরি নাকি! বেশ গুছিয়ে লেখা। জয়দেবপুরের জঙ্গলে একবার ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে বাঘ শিকার করতে গিয়েছিলেন। আরেকবার শীতের সময় কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এভাবে, ‘এ স্থানের বাজারগুলি সাময়িক, ইহাতে অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যই ক্রয়-বিক্রয় হইয়া থাকে। সমস্ত বাজার ছিল মৎস, লুনামাছ, হাঙর, কস্তুরি প্রভৃতি সামুদ্রিক দ্রব্যসম্ভারে পরিপূর্ণ। এই স্থানের প্রধান বাজারে নাম মেলিবাজার। সাব ডিভিশনাল অফিসার মেকাশি সাহেবের দুহিতার নামে এই মেলিবাজার হইয়াছে। একটি উচ্চ পর্বতের অধিত্যকা প্রদেশে একখানা সুন্দর গৃহ দেখিয়া দর্শনের অভিলাষ জন্মিল। গৃহটি চীনঘর নামে পরিচিত। কেন এই নাম হইল, জিজ্ঞাস করিয়া জানিতে পারিলাম, চীন দেশের বৌদ্ধ মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত বলিয়া ইহার এই নাম হইয়াছে ।‘

ভদ্রলোক খুব ঘুরতে পছন্দ করতেন। তার দিনলিপির বিবর্ণ পাতায় কয়েক মাসের বিবরণ রয়েছে। জাফলঙয়ের প্রকৃতি তাকে খুব আলোড়িত করেছিল। কীভাবে আরও পরিকল্পিতভাবে কমলার চাষ বাড়ানো যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। স্পেন থেকে জলপাই চারা এনে সেখানে চাষ করা যায় কিনা সেটা নিয়েও ভেবেছেন।

এই রকমের ভ্রমণ করতে গিয়ে তাকে কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। গারো পাহাড়ে এক কাপালিক তাকে আক্রমণ করে। কাপালিক তার পিঠে বাঘনখের থাবা বসিয়ে দিয়েছিল। এক মিশনারির সেবায় তিনি সেবার বেঁচে ওঠেন।

সেই রাতে ডাইরিটি পড়তে পড়তে আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত হই। যেন অন্য এক পৃথিবীতে বারবার হারিয়ে যাই। এক শক্ত কব্জীওয়ালা লোককে আবিষ্কার করি। যিনি জীবনকে সারাজীবন মনে করে এসেছেন একটা বুনো মোষ। তার দুটো শিঙ তীব্রভাবে ধরে লড়াই করে গেছেন। লোকটির নানা বিষয়ে কৌতূহল ছিল। ডাইরি পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন দেড়শো বছর আগের কোনো এক দিনে চলে গেছি। শহর ঢাকার রাস্তায় তখন পালকি। নবাববাড়ি থেকে হাতির মিছিল যায়। ফিটন গাড়ি, ছ্যাকড়া গাড়ি যায়। ফরাশগঞ্জের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ফরাসিদের বেশ কিছু কুঠিবাড়ি গড়ে উঠেছে। চন্দননগর থেকে পালতোলা বজরা আসছে। পাদরিরা ছাপাখানা বসাচ্ছে। একজন লোক হাসিমুখে যেন আমাকে সেসব দিনের কথা বলছেন।

টেপ রেকর্ডারে একটি জাপানি সঙ্গীত মৃদু সুরে বাজছিল । সঙ্গীতের নাম চেরি ফোটার দিন। এত সূক্ষ্ম কারুকাজ আছে সঙ্গীতটিতে যে মন হয় পাতা ঝরার শব্দও ওতে বুঝি মিশে আছে। ডাইরির এক জায়গায় এসে মনে হলো কয়েকটি পাতা যেন একটু পুরু। ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুঝলাম সেখানে পাতাগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে সেলাই করে জোড়া লাগানো হয়েছে। কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেলাম। ড্রয়ার থেকে ব্লেড বের করে খুব সাবধানে খুললাম। খুলে দেখি অল্প কিছু কথা লেখা :

‘এ কথা কাহাকেও বলি নাই । সুন্দরবন ভ্রমণের সময় চুনকুড়ি নদীর নিকট কৈখালি গ্রামে আমি এক বৃদ্ধ বাওয়ালির সাক্ষাৎ পাই। তাহার নাম সিদ্দাই বাওয়ালি। লোকটি খালি হাতেই কয়েকটি বাঘকে মারিয়াছিল। আমি যখন তাহার সাক্ষাৎ পাই তখন সে মৃত্যুপথযাত্রী। সে জানায় গড় মুকুন্দপুরে গুপ্তধন রহিয়াছে। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধন। ঘড়া ঘড়া মোহর। তাহার নিশানা কৈখালি গ্রামের শ্মশানঘাটের কাছের পাকুড় গাছের নিচে একটি হাতির দাঁত নির্মিত বাক্সে রহিয়াছে। সেখানে খুব সাপের ভয় থাকায় আমি যাইতে পারি নাই। শহরে আসিয়াই আমি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী হইয়া পড়ি। এই কথা কাহাকেও বলা হইল না।’

পড়তে পড়তে আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। পুরনো আমলের এই ডাইরির পাতায় সুন্দরবনের গুপ্তধনের সংবাদ! এখনও হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল রহস্যে ঘেরা বাদাবন। ভাটির দেশ। গাছ-গাছালির ভেতরে গড় মুকুন্দপুরের ক্ষয়ে যাওয়া বাড়ি। নোনাধরা ইট। শ্যাওলাছছাপা দেয়াল। সাপের খোলস বাতাসে ফিনফিন করে ঝুলছে। প্যাচার ডাক। ডাইরির হলদেটে, মুচমুচে পাতাগুলো যেনো নিকষ কালো অন্ধকারের ভেতরে আমাকে নিয়ে গেল। ছলাৎ ছলাৎ করছে চুনকুড়ি। ছোট্ট গ্রাম কৈখালি। শ্মশানঘাটের পাকুড় গাছের পাতা কাঁপছে বাতাসে। যে গাছের ডালে হয়তো শকুনের বাচ্চারা মাঝরাতে কাঁদে। সেই গাছের নিচে আছে গড় মুকুন্দপুরের নিশানা। মাটির নিচে এখনও কি হাতির দাঁতের বাক্সটি আছে? সেখানে কী অজস্র সাপ কিলবিল করছে? জ্যোস্নার আলোতে সাপকে নাকি রুপোলি ঝালর বলে মনে হয়।

সারারাত আমার ঘুম এলো না। টেপ রেকর্ডারে কখনও মেক্সিকোর পাহাড়ি গানের ক্যাসেট দিলাম। কখনও স্পেনের ফ্লেমিঙ্গো নাচের সুর। তবু সবকিছুকে ছাপিয়ে জেগে রইল গড় মুকুন্দপুরের ভাঙা চুড়ো। রাতটা ছটফট করে কাটালাম। কখন সকাল হবে । কখন টুনুভাইয়ের কাছে যাব।

শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। দেখলাম, গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ডালপালা সরিয়ে আমি আর টুনুভাই হেঁটে যাচ্ছি। আমাদের সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন বাওয়ালি। ঝকড়া ঝাঁকড়া তার চুল। লোকটা অরণ্যের মাঝে একটি পরিষ্কার জায়গায় আমাদের নিয়ে গেল। সেখানে ছোট একটি বেদি। তার উপর টকটকে লাল রঙের নিশানা টাঙানো। বড় বড় মশাল জ্বলছে। কয়েকজন লোক হঠাৎ রাম দা হাতে ছুটে এলো। তারপর চিৎকার করতে করতে পশুপাখি বলি দেয়া শুরু করল। আমাদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল ঘুঘু, বটের আর হরিয়ালের রক্তমাখা মাথা। মশালের আলোতে লোকগুলোর চেহারা কী রকম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কখনও মুখগুলো কাছে আসছে আবার কখনও দূরে সরে যাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে।

তখনও রাস্তাঘাটে লোক চলাচল ভালো করে শুরু হয়নি। টুনুভাইয়ের দরজার শিকল জোরে জোরে নাড়তে থাকি। সদ্য ঘুমভাঙা টুনুভাই দরজা খুলে আমাকে ও রকম উসকো-খুসকোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যান।

কি হয়েছে? সারারাত ঘুমাসনি?

এটাই আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। বলে আমি সেই ডাইরিটি তুলে ধরি।

কি এটা?

দেড়শো বছরের পুরনো এক ডাইরি।

পেলি কোথায়?

কাল তুমি যে বইগুলো দিয়েছিলে তার মধ্যে ছিল এটা।

কী আছে এতে?

গড় মুকুন্দপুরের রাজা প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধনের নিশানা!

টুনুভাই এবার চমকে যান। ঢোক গিলে বলেন, কি সব বলছিস এই সাতসকালে। তোর কি মাথা বিগড়ে গেল নাকি?

আমি ফিসফিস করে বলি, ঘড়া ঘড়া মোহরের খবর আছে টুনুভাই। সব বলছি। আগে এক কাপ চা খাওয়াও। দরজাটা বন্ধ করো। তারপর সব বলছি।

এক কাপ আদা চা খেয়ে শরীরটা বেশ ভালো লাগে। ডাইরির সব কথা খুলে বলি টুনুভাইকে। তিনি মন দিয়ে শোনেন। ডাইরিটি খুলে দেখেন। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে টুনুভাইয়ের জুড়ি নেই। শান্ত গলায় তিনি শুধু বললেন, আজ রাতের ট্রেনেই আমরা খুলনা যাচ্ছি। ঠিকমতো গোছগাছ করে নে।

রাতের ট্রেন চলেছে সাঁই সাঁই করে। ফর্সা চেহারার এক ভদ্রলোক হিচককের একটি বই পড়ছিলেন। আমি টুনুভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,

তুমি জানো, ভয়াল ছবির রাজা বলা হয় কাকে?

টুনুভাই ঝিমুতে ঝিমুতে বললেন, জানি না। এখন একটু ঘুমুতে দে তো।

আলফ্রেড হিচকক, বলে আমি লোকটির হাতে ধরা বইটির দিকে তাকাই। কেন জানি মনে হয় ফর্সা লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

তুমি হিচককের কোনো ছবি দেখছো? লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

দেখেছি। পাখিদের নিয়ে একটি ছবি। কী যেন নাম। দূর ছাই মনে পড়ছে না।

দি বার্ডস। একঝাঁক পাখি কী করে পুরো একটা শহরকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। কি রকম নিষ্ঠুর হয়ে মানুষের উপর আক্রমণ করছিল খুদে পাখিগুলো। মনে আছে একটি লোকের চোখ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলেছিল।

ফর্সা লোকটি কেমন ফিসফিস করে বলতে থাকে।

এটা কিন্তু খুবই খারাপ কথা যে তুমি ছবির নামটা চট করে মনে করতে পারোনি। তার মানে তোমার স্মরণশক্তি দুর্বল। এ বয়স থেকেই কীভাবে স্মরণশক্তিকে বাড়ানো যায় তার চেষ্টা করা উচিত। জানো, যে কোনো মানুষ তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার মাত্র সামান্য অংশ ব্যবহার করে থাকে। আইনস্টাইনের মতো লোক তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার মাত্র শতকরা তেরো ভাগ ব্যবহার করেছিলেন। আর তাতেই আমাদের আধুনিক সভ্যতাকে কতটা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিতে পেরেছিলেন।

রাতের ট্রেনের এই যাত্রীকে তখন চমৎকার লাগে আমার কাছে।

জানো, হিপনোটাইজ করে মানুষের স্মৃতিশক্তিকে অনেক বাড়ানো যায়। মানুষের মনের ভেতরের অনেক কথাকে টেনে বার করে আনা যায়। এই ধরো তুমি এখন কী ভাবছো আমি যদি হিপনোটাইজ করার বিদ্যেটা জানতাম, তাহলে ঠিক বলে দিতে পারতাম।

বলে ফর্সা লোকটি আমার দিকে তীব্রভাবে তাকায়। আমার মাথাটা যেন একটু দুলে ওঠে। মনে হয় কামরার সব বাতিগুলো নিভে গেছে। শুধু সবুজ রঙের একটা বাতি জ্বলছে। তার মাঝে লোকটার মুখ কুয়াশার মতো মিশে আছে। সেই সবুজ আলোটা ক্রমশ তীরের মতো হয়ে উঠছে। যেন আমার শরীরের ভেতরে বিধে যাবে। আমি জোর করে মনটাকে সরিয়ে আনি। ঝট করে তাকাই জানালার বাইরের দিকে। একটা স্টেশনের আলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

ট্রেন আস্তে আস্তে এসে থামে ছোট্ট একটি স্টেশনে। মিটমিট করে কয়েকটা আলো জ্বলছে। কয়েকজন লোক লটবহর নিয়ে নামে। ফেরিঅলারা ছোটাছুটি করতে থাকে। আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। এক ফল বিক্রেতার কাছ থেকে একটি কচি ডাব কিনে ঢকঢক করে খাই। আমার মুখ সেই পানিতে ভিজে যায়। হঠাৎ চোখ পড়ে সামনের বেঞ্চির সেই ফর্সা লোকটির দিকে। আমার দিকে কী রকম অস্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে আছে। লোকটির ওই রকম চাউনি আমার কাছে মোটেই ভালো লাগে না।

তুমি বুঝি ফিল্ম দেখতে ভালবাসো?

হুম।

আমি ফিল্ম বানাই।

তাই নাকি! লোকটির প্রতি আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি।

আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রার উপর ছবি তুলছি। এবার যাচ্ছি সুন্দরবন। বাঘ আর হরিণের উপর ছবি তুলতে। আগামী বছর অটোয়াতে এ ধরনের ডকুমেন্টারি ছবির এক বিরাট প্রতিযোগিতা হবে। আমি সেখানে এ ছবি নিয়ে যেতে চাই।

লোকটি তার ব্রিফকেস খুলে আমাকে বিভিন্ন প্রাণীর রঙিন স্থিরচিত্র দেখায়। এই দেখ, এটা বনরুই। অনেকেই মনে করে এটা বুঝি দক্ষিণ আমেরিকার আর্মিডিলোর ছবি। যারা লম্বা জিভ দিয়ে সুড়ুৎ করে শুধু পিপড়ে খায় । জঙ্গল এলাকায় বনরুই পাওয়া যায়। দেখছো, এর পিঠ রুই মাছের মতো বড় বড় আঁশে ঢাকা । দিনের বেলায় এর কোনো পাত্তা নেই। রাত হলেই উইপোকার ঢিবি নয়তো পিঁপড়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এদের উপর সুটিং করতে আমাকে খুব বেগ পেতে হয়েছিল ।

লোকটি বেশ উৎসাহের সঙ্গে আমাকে ছবিগুলো দেখাতে থাকে। নোট বইতে বিভিন্ন প্রাণীর উপর নানা তথ্য লেখা। কখনও কখনও সেগুলো পড়ে শোনায়।

এটা হলো মাছবিড়াল। হাওড়, বিল, আর নদী পাড়ের ঝোপ-জঙ্গলে থাকে। এর শরীরে বাদামি ছাপ। কপাল ঘাড় পর্যন্ত ৬ থেকে ৮টি কালো ডোরা দাগ আছে। মাছ, শামুক, ঝিনুক খায়। অনেক সময় ছোট ছোট পাখিদেরও ধরে খায়। আমি একসময় খুব ভয়ের ছবি দেখতাম। ভাবতাম ওই ধরনের ছবি বানাব। ড্রাকুলার ছবি দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম।

ড্রাকুলা কে?

এই দেখ, হিচককের নাম জানো আর ড্রাকুলার কথা জানো না। প্রিন্স ড্রাকুলা। মধ্য যুগের জার্মানির এক রাজপুত্র। জঙ্গলের ভেতরে দুর্গবাড়িতে থাকত। অদ্ভুত এক নেশা ছিল তার। মানুষের রক্ত পান করা। প্রিন্স ড্রাকুলার গা ছমছম করা কাণ্ডকারখানা নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে। কিন্তু একটি পোলিশ ছবি দেখে আমার সব ধারণা পাল্টে গেল।

কেন? কী ছিল সেই ছবিতে?

ছবিটির নাম ছিল ম্যাথুসের দিন। ম্যাথুস নামের এক বুড়ো থাকত পাহাড়ি ছোট্ট গ্রামে। লেকের পাশে বাড়ি। খুব শান্ত প্রকৃতি চারদিকে। ম্যাথুস গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পাখি আর লেকের মাছ খুব ভালবাসতো। ওর মনে হতো, সে নিজেও বুঝি প্রকৃতির এক অংশ। কেউ গাছ কাটলে সে দারুণ কষ্ট পেতো। বঁড়শি দিয়ে মাছ গেঁথে তুলতে তার খারাপ লাগতো। একবার এক শিকারি একটি বককে গুলি করেছিল। ম্যাথুস সেই গুলিবিদ্ধ বিশাল বকটিকে বুকে আগলে ছলছল করে তাকিয়েছিল। আস্তে আস্তে নেতিয়ে আসছে বকটি। ঘোলাটে চোখ মেলে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ক্যামেরা এখানে বিগ ক্লোজ-আপে বকের চোখের ছবি নিয়েছে। বকটি একসময় মারা যায়। যেনো সভ্যতার মৃত্যু হয়। সেই ছবি আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। তারপর থেকে আমি আমাদের দেশের বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে থাকি।

ট্রেন আরেকটি স্টেশনে এসে থাকে। টুনুভাই দিব্যি ঘুমাচ্ছেন। ফর্সা লোকটি হঠাৎ আমার দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছো?

সুন্দরবন।

সুন্দরবনে কেন?

আমি তখন আমতা আমতা করতে থাকি। লোকটি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সুন্দরবন কেন যাচ্ছো?

আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুম জড়িত স্বরে বলি।

তুমি ঘুমোও। নীল ঘুমের রাজ্যে তুমি চলে যাও। ঘুমটা যেন শান্ত একটি হ্রদ। তার ভেতরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাও তুমি। তারপর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। কথা হবে।

আমার চোখের সামনে থেকে তখন সবকিছু ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু মনে হয় একটি সবুজ বাতি থেকে আলো এসে পড়েছে আমার মুখে। ট্রেন তখনও চলছে সাঁই সাঁই করে। আমার আর কিছু মনে থাকে না ।

টুনুভাইয়ের ধাক্কায় ঘুম ভাঙে।

ইস্, কী ঘুমকাতুরে ছেলেরে বাবা। এত ধাক্কাধাক্কি করছি।

কামরাটি রোদে ঝলমল করছে। আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। সেই ফর্সা লোকটিকে কোথাও দেখলাম না। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হঠাৎ মনে হলো আমরা যে গড় মুকুন্দপুরে গুপ্তধনের খোঁজে যাচ্ছি, কৈখালি গ্রামে যাচ্ছি, সব কথা সেই লোকটা জানে।

টুনুভাই, রাতের বেলায় একটি লোক আমাকে হিপনোটাইজ করেছিল।

নে নে হয়েছে। এখন জলদি করে নাম । রাজ্যির সব ভুতুড়ে বই পড়ে এসব কথা বকছিস। জলদি নাম ।

স্টেশনের কাছের একটি দোকান থেকে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। গরম ভাত। পাঙ্গাস মাছের ঝোল। তারপর ক্ষীরের মিষ্টি।

দুপুরবেলায় রওনা দিলাম সুন্দরবনের দিকে। লঞ্চ চলছে ভটভট করে। প্রথম আমরা যাব বুড়ি গোয়ালিনি রেঞ্জে। সেখান থেকে নৌকা করে যেতে হবে।

দু পাশে সুন্দরী গাছের সারি। কোথাও কোথাও কাঠশালার জঙ্গল। গাঙচিল আর স্নাইপ উড়ে যাচ্ছে। গাঙচিলগুলো লঞ্চের পেছনের ছিটকে যাওয়া পানির ভেতর থেকে ছোঁ মেরে মাছ তুলে নিচ্ছে।

গোলপাতা বোঝাই করে নৌকা যাচ্ছে। মাছ ধরার নৌকা যাচ্ছে।

নৌকাতে মটকা ভর্তি মিঠা পানি। তেঁতুলগোলা পানি। হঠাৎ করে দেখা যায় কেওড়া গাছের জঙ্গল। সেখানে কুড়াবক থাকে। কত রকমের গাছ আছে এই জঙ্গলে। আমি সারেঙের ঘরে যাই। বৃদ্ধ সারেঙ। পেটা শরীর। বলে, বহু জাতের গাছ। সুন্দরী, গরান, কাঁকড়া, আমড়া, বান, হেতাল, গেওয়া, গোল। এদিককার গরিব লোকদের বাড়ি গোলপাতায় ছাওয়া। হেতাল গাছের ঝোপে বাঘ লুকিয়ে থাকে। আর আছে চেঁচো ঘাসের বন।

আচ্ছা সারেঙ, এখানে বনমুরগি কেমন?

আগে স্যার অনেক ছিল। এখন কমে গেছে। বনবিবির পুজোর জন্য বাওয়ালিরা জঙ্গলে এসে তার নামে মানত করা মোরগ মুরগি ছেড়ে দিত। সেগুলো জঙ্গলের ভেতরে লকলক করে বড় হতো। খেতে রাজ্যের পোকামাকড় আর কাঁকড়ার বাচ্চা। কাঁকড়ার বাচ্চা খেয়ে খেয়ে বনমুরগিগুলোর শরীরে তেলও হতো। এরা গাছের খোড়লে ডিম পাড়ে। তা দেয়। বাচ্চা ফোটায়। কট কট কটাস শব্দ করে ডাকে।

লঞ্চ একসময় বুড়ি গোয়ালিনির ফরেস্ট অফিসের কাছে এসে থামে। আমি আর টুনুভাই নির্বিকার। আমরা যে ঢাকা থেকে সাঙ্ঘাতিক একটা উত্তেজনাকর কাজে এসেছি সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। গুপ্তধনের ব্যাপার। খুব সাবধানে থাকতে হবে। কোনোমতেই যেন কিছু ফাঁস না হয়ে যায়।

বুড়ি গোয়ালিনিতে টুনুভাইয়ের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আছেন। ভদ্রলোক বন বিভাগে কাজ করেন। তার ওখানেই উঠলাম। ভদ্রলোক খুব আমুদে। আমাদের পায়রাতলি মাছের ভাজি খাওয়ালেন।

এসব গাছের হিসেব নিকেশ রেখে লাভ নেই। বড্ড ড্রাই কাজ। বুঝলে টুনু, ভাবছি কুমিরের চাষ করব।

কিসের চাষ!

কুমিরের। ইন্ডিয়াতে অনেকেই করছে। রীতিমতো কুমিরের খামার করে। ব্যাপারটা এই রকম। লোক লাগিয়ে জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুমিরের ডিম সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেগুলো ইনক্যুবেটরে যান্ত্রিকভাবে ফোটাতে হবে। কুমিরের বাচ্চাদের লালন করতে হবে। তারপর একটু বড় হলেই বিদেশে চিড়িয়াখানাগুলোতে পাঠাও। দারুণ ডিমান্ড রয়েছে।

পরদিন ভোরে নৌকা করে মুকুন্দপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেদ্ধ ডিমের মতো মসৃণ আকাশ। আঁকাবাঁকা খাল। অনেক জায়গাতে গাছপালা ঝুঁকে থাকার জন্যে থমথমে অন্ধকার। কোথাও কোথাও গাছের শাখায় দক্ষিণ রায়ের বাসা দেখা যায়। দক্ষিণ রায় বাঘের দেবতা। বাদাবনে তার খুব দাপট।

দক্ষিণ রায়ের মূর্তি দেখতে চমৎকার। হলুদ বরণ শরীর। মাথায় বাবরি চুল। তার উপর মুকুট। কানে কুণ্ডল। কপালে রক্ততিলক। হাতে তীর ধনুক। পিঠে ঢাল। জানু পেতে বসে আছে। সোনালি খড়ে ছাওয়া মাটির থানে দক্ষিণ রায় বসা। দেড়শো বছরের পুরনো সেই ডাইরির পাতায় দক্ষিণ রায়ের পুজোর কথা উল্লেখ করা আছে। আমাদের নৌকার মাঝিকে দেখলাম একবার নৌকা থামিয়ে ওখানে গিয়ে কিছু পয়সা দিয়ে আসতে। এ এলাকার লোক নাকি হাঁস মানত করে। মাঝির সঙ্গে আমাদের ভাব হয়ে যায়। মাঝি সুন্দরবনের পুঁথি জানে। আমরা মাঝির সেই ভরাট গলার পুঁথিপাঠ টেপ করে রাখি।

এ বলিয়া বাঘ সব সাজিতে লাগিল।
খান্দেওয়ালা বাঘ সেই প্রথমে সাজিল।
সেই বাঘ হয় সেই প্রথমে সাজিল।
সেই বাঘ হয় সব বাঘের প্রধান।
রাক্ষস ধরিয়া খায় ভাঙ্গিয়া গর্দান।
সাজে বাঘ বেড়াভাঙা বৃহৎ ভীষণ।
মারিয়া অসুর সিংহ করেন ভক্ষণ ।
সাজে বাঘ দানে ওরা চলে লম্ফ দিয়া ।
আকাশের সূর্য চায় খাইতে ধরিয়া।
সাজে বাঘ কালকূট ধবধব চলে।
হাতি নিয়া দৌড় দেয় দন্তে ধরি গলে।

দুপুরের ছলাৎ ছলাৎ নদীর ভেতরে আমরা মাঝির পুঁথিপাঠ রেকর্ড করি।

শেষবিকেলের দিকে গাছপালার ফাঁকে ভাঙা ইটের দেউল চোখে পড়ে। কয়েকটি শামুকখোল ওদিকে উড়ে যায়। এখানকার লোক শামুকখোলকে বলে ঠুঁটিভাঙা সারস। মাঝি সেদিকে তাকিয়ে বলে, হুই যে মুকুন্দপুরের গড়।

আমার আর টুনুভাইয়ের বুক ছলকে ওঠে। শেষবিকেলের মরে যাওয়া আলোতে সেই গড়কে খুব রহস্যময় দেখায়। আমার মনে হয় এর কোথায় জানি মাটির তলায় লুকিয়ে আছে ঘড়াভর্তি মোহর! কোথায় তার নিশানা।

আমরা মুকুন্দপুরের বাজারে যাই। ছোট্ট কয়েকটি চালাঘর। আনাজপাতি বিক্রি হয়। গুড় বিক্রি হয়। নোনা পানির দেশ বলে এখানকার লোক বেশ গুড় খায়। কৈখালি গ্রাম এখান থেকে বেশ দূরে। পরদিন সকালে সেখানে রওনা দেব বলে ভাবি। রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব। মুকুন্দপুরের এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি তার বাড়িতেই রাতে থাকার নিমন্ত্রণ জানান।

সন্ধেবেলায় আমরা গড়টা ভালো করে দেখতে যাই। গুপ্তধনের নিশানা আছে পাকুড় গাছের নিচে হাতির দাঁতের বাক্সের ভেতরে। সেটা উদ্ধার না করা পর্যন্ত গড় মুকুন্দপুর আমাদের কাছে শুধুমাত্র নোনাধরা ইটের দেয়াল। শ্যাওলা ছোপ ছোপ দেয়াল। এলোমেলো বাতাসে সাপের খোলসের ফিনফিনে দুলুনি।

আমি আর টুনুভাই সাবধানে গড়ের ভেতরে হাঁটতে থাকি। কোথাও পড়ে আছে প্যাচার ডিম। হঠাৎ আমার মনে হয় কে যেন হেঁটে আসছে। এই নির্জন গড়ে আবার কে আসবে? টর্চটা নিবিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সরু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। একজন লোক এদিকে আসছে। টর্চের আলোতে লোকটিকে আমি চিনতে পারি। ট্রেনের সেই ফর্সা চিত্রপরিচালক। আমার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের একটা শব্দ বের হতেই সে লোকটি চমকে যায়। ঠিক সেই সময়ে একটা রাতচরা পাখি বিচ্ছিরিভাবে ডেকে ওঠে। লোকটি গড় থেকে দৌড়ে পালিয়ে মিশে যায় অন্ধকারের ভেতরে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যময় লাগে।

পরদিন খুব ভোর থাকতেই কৈখালি গ্রামের দিকে নৌকা ছেড়ে দেই। দু’পাশে কষাড়ের ঘন জঙ্গল। একটা লোককে দেখলাম হরিণের বাচ্চা কোলে নিয়ে যেতে। মাঝে মাঝে পাখির ঝাক মাথার উপর চক্কর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। একটি ডিঙি নৌকা কামট শিকার করে ফিরছিল। তাদের জিজ্ঞেস করতেই বলল, সামনের বাঁকটা পেরুলেই কৈখালি গ্রাম দেখা যাবে।

আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টানটান হয়ে যাই। শ্মশানঘাটের কাছে পাকুড় গাছ। ট্রেজার আইল্যান্ড উপন্যাসের কথা মনে হয়। নীল রঙের কোটপরা কাপ্তান গানের সুর শিস দিতে দিতে আসছে। গানটা সমুদ্রের। লোকটার পিঠে ঝুলছে শুয়োরের লেজের মতো বেনি। গালের এক পাশে তলোয়ারের আঘাতের কাটা দাগ। সামুদ্রিক বাতাসে ভরে থাকা ছোট্ট শহরে কাপ্তান গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে,

মরা মানুষের সিন্দুক
নজর রেখেছে পনের জন।

হা হা হা।

আমার মনে হতে লাগল সেই উপন্যাসের লাল কালিতে আঁকা ম্যাপটার কথা।

বেশির ভাগ ধনরত্ন এইখানে
লম্বা গাছ, স্পাই গ্লাস কাঁধ,
কঙ্কাল দ্বীপ দশ ফিট
রূপার বাঁট উত্তর কোণে পুবের দিক
ঘেঁষে দশ হাত দূরে
বালিয়াড়িতে সঙ্কেত চিহ্ন আছে।

শুধু এসব মনে হচ্ছে। কৈখালির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চুনকুড়ি। আমরা একটা হিজল গাছের কাছে নৌকা বাঁধলাম। একজন বৃদ্ধ লোক জাল নিয়ে যাচ্ছে। তাকে ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, এখানকার শ্মশানঘাটটা কোথায়?

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দূরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, বহু বছর আগেই সেটা নদীতে তলিয়ে গেছে।

তাকিয়ে দেখলাম দুপুরের রোদে চিকচিক করছে নদী। কয়েকটি গাঙচিল সেখানে পাঁক খেয়ে খেয়ে উড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *