২.১৪ ব্ল্যাকল্যান্ডের অবসান

১৪. ব্ল্যাকল্যান্ডের অবসান

দরজাটা যখন ভেতর থেকে ভালো ক’রে এঁটে বন্ধ ক’রে দেয়া হ’লো, তখন প্রথম কাজটা দাঁড়ালো আহতদের সেবাশুশ্রূষা বেশ কিছু লোকই জখম হ’য়ে পড়েছিলো। আমেদে ফ্লঁরেস আর মসিয় বারজাকও অল্প চোট-জখম পেয়েছিলেন। জেন ব্লেজন নিজে, স্বয়ং, তাদের সেবাশুশ্রুষার ভার নিলে। আত্মরক্ষার জন্যে কেউ যদি কখনও এসে তার ভয়ংকর শত্রুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়, আমেদে ফ্লরেঁস শুধু তার পরিহাসের দিকটাই দেখতে পেয়েছিলেন তা নয়-ভাববার চেষ্টা করছিলেন এ-রকম দৃষ্টান্ত গল্পে বা বাস্তবে আর আছে কি না।

ফাস্ট-এইড দেবার পর জেনের কাঁধে আরেকটা দায়িত্ব বর্তালো। তাকে এই বেচারি লোকগুলোকে খাওয়াতে হবে–গত ক-দিনে এঁরা কেউ দানাটিও দাঁতে কাটেননি। কিন্তু সেটা কি সে করতে পারবে? এতগুলো লোককে খাওয়াতে পারার মতো যথেষ্ট খাবার কি আছে রাজভবনের ভাঁড়ারে?

প্রত্যেকটি তলা তন্নতন্ন ক’রে খোঁজার পর যতটুকু খাবার পাওয়া গেলো, তাতে শুধু সকলের সামান্য নাশতাই হয়। ফলে এদিক দিয়েও পরিস্থিতি এখন গুরুতর- তার যেটা অনিবার্য ফল হ’তে পারে, সেটাকেই বোধকরি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মতো ঠেকানো গেছে।

এ-সব নানা খুচরো কাজ শেষ হ’তে-হ’তে সকাল এগারোটা। এদিকে, সারাক্ষণ, বিস্ফোরণের আওয়াজ আসছে বাইরে থেকে, আর এপ্ল্যানেড থেকে ভেসে আসছে হর্ষচরিতদের কোলাহল-তারা মাঝে-মাঝেই এসে একবার ক’রে দরজাটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর সেইসঙ্গে অলিন্দ থেকে উইলিয়াম ফেরনে আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের গাঁক-গাঁক চীৎকার তো আছেই। এঁদের কানে এই সব কলরব- কোলাহল ক্রমেই স’য়ে যাচ্ছে –শেষটায় কেউ আর এ-সবে কান পাতছিলো না। তাঁদের এই আশ্রয় যে অভেদ্য—এই বিশ্বাস প্রায়-বদ্ধমূল হ’য়ে উঠেছে তাঁদের- শত্রুদের ক্ষিপ্ত গর্জনকে তেমন-একটা আর পাত্তা দিচ্ছিলেন না তাঁরা।

একটু ফুরসৎ পাবার পরেই, জেন প্রথমেই আমেদে ফ্লরেঁসকে জিগেস করলে : হঠাৎ তাঁরা কেন কারখানার সুরক্ষিত আশ্রয় ছেড়ে প্রাণ হাতে ক’রে এপ্ল্যানেডে চ’লে এসেছিলেন। জেন কারখানা ছেড়ে চ’লে-আসার পর সেখানে কী-কী ঘটেছে, সাংবাদিক তা বেশ গুছিয়েই বললেন জেনকে।

ব্যাখ্যা ক’রে বললেন, কেমন ক’রে সাড়ে-আটটার একটু পরেই, তোঙ্গানে যখন দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত সংকেতটা দিয়েছিলো, মার্সেল কামারে তার আগেই, ব্ল্যাকল্যান্ডের অন্য বাসিন্দাদের অজ্ঞাতসারে, শহরের মাঝখানে প্রচুর গোলাবারুদ আর ডায়নামাইট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাথমিক প্রস্তুতিটা শেষ হয়েছিলো রাত এগারোটা নাগাদ, আর কারখানা ততক্ষণে এই লড়াইতে নিজের কী ভূমিকা হবে, তাও স্থির ক’রে নিয়েছে।

আমেদে ফ্লরেঁস বিশদভাবে বললেন সাঁৎ-বেরার মাথাকোটা হতশার কথা : বেচারা যদি এই লড়াইতে প্রাণে বেঁচেও যায়, উদ্বেগে-আশঙ্কায় সে নিশ্চয়ই আধমরা হ’য়ে গিয়েছে।

অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দেবার আধঘণ্টা পরে শোনা গিয়েছিলো এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। তোঙ্গানে নিজের হাতে কালোদের বস্তির একটা দরজা উড়িয়ে দিয়েছে। সেই বিস্ফোরণে কালোদের বস্তিতে আগুনও ধ’রে গিয়েছিলো; আর তাঁরা বাইরে থেকে ঠিক তার পরেকার তুলকালাম হট্টগোল শুনে আন্দাজ করেছিলেন কালোরা তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেসরকারি নাগরিকদের আস্তানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বাকিটা জেন জানে। সে জানে যে নিগ্রোরা, এপ্ল্যানেডে রে-রে ক’রে তেড়ে এসেছিলো বটে, কিন্তু মেরিফেলোদের পালটা আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হ’য়ে যায়। এমন চট ক’রে পুরো ব্যাপারটা ঘ’টে যায় যে কারুপক্ষেই তাদের সাহায্যে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারখানা থেকে জেনের বন্ধুরা একবার বেরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু লড়াই তখন এমনই প্রচণ্ড হ’য়ে উঠেছিলো যে তাদের প্রায় তক্ষুনি পিছু হ’ঠে যেতে হয়—আর পরে যখন দ্বিতীয়বার চেষ্টায় তাঁরা এপ্ল্যানেডে এসে পৌঁছলেন, কালোদের ততক্ষণে গোরারা এপ্ল্যানেড থেকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছে।

কারখানার ফিরে যেতে বাধ্য হ’য়ে কারখানার সবাইকে সারাটা রাত তীব্র- উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। কালোদের এই বিদ্রোহী উত্থান এ-রকম বিপর্যস্ত হ’য়ে গেলো দেখে তাঁরা এটা ভাবতে শুরু ক’রে দিয়েছেন এভাবে হ্যারি কিলারকে ঘায়েল করা যাবে কি না। জেনের মতো তাঁরাও উৎকর্ণ শুনেছেন পর-পর সব বিস্ফোরণের শব্দ—এখন যা পুরো শহরটাকেই ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু এই বিস্ফোরণ কারা ঘটাচ্ছে, কারণ কী—তা তাঁরা কিছুই জানেন না। অবশেষে তাঁরা এটাই শুধু আন্দাজ করেছেন, এ নিশ্চয়ই খোদ মার্সেল কামারের কীর্তি— এতক্ষণে তিনি বোধহয় সব কাণ্ড-কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে সম্পূর্ণ উন্মাদ হ’য়ে গেছেন।

যত-চমকপ্রদ উদ্ভাবননিপুণ প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকই হোন না কেন, কামারে প্রায় চিরকালই প্রতিভার পরপারে পাগলামির সীমান্তে একটা পা বাড়িয়েই ছিলেন- আগেই যা দেখেছে সবাই, কোথায় যেন প্রখর বুদ্ধির সঙ্গে একটা ভারসাম্যহীনতা মিশে আছে। গত মাসে পর-পর যে-সব ঘটনা ঘটেছে, পর-পর, এত ধরনের সব ঘটনা, যে, শেষ-পর্যন্ত তা তাঁকে যেন ঠেলে দিয়েছে পাগলামির ওপারে।

প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছেন, যখন হ্যারি কিলারের বন্দীরা তাঁকে হ্যারি কিলারের কুকীর্তির কথা বর্ণনা ক’রে কারখানায় আশ্রয় চেয়েছেন। দ্বিতীয়, এবং আরো- ভয়ংকর, আঘাতটা এসেছে ড্যানিয়েল ফ্রাস্‌নের কাছ থেকে। এবার যখন দুষ্পাচ্য সত্যটার মুখোমুখি হয়েছেন, কামারে প্রতিদিনই একটু-একটু ক’রে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। শুনতে-শুনতে জেনের মনে প’ড়ে গেলো, কতদিন তিনি নিজের ঘরটায় দরজা বন্ধ ক’রে দিয়ে একাই সারাটা সময় কাটিয়ে দিতেন—আর যদি- বা কখনও ওয়ার্কশপে আসতেন তাঁকে কেমন বিষণ্ণ ও উদ্ভ্রান্ত দেখাতো।

তোঙ্গানের উদ্দেশে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করাই সম্ভবত তাঁর শেষ প্রাঞ্জল কীর্তি। প্রথম বিস্ফোরণটা যখন উঠেছিলো আর কালোদের বস্তিটা দাউ-দাউ ক’রে জ্বলে উঠেছিলো, তারপর যখন বেসরকারি নাগরিকদের আবাসও, তখন তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই আচমকা লক্ষ করেছেন কী-রকম পাণ্ডুর হ’য়ে গেছেন তিনি, আর হাতটা তুলে নিয়েছিলেন এমনভাবে যেন তাঁর দমবন্ধ হ’য়ে যাচ্ছে। আর সেইসঙ্গে জড়ানোগলায় বিড়বিড় ক’রে বকছিলেন : আমার সব কাজের ইতি হ’য়ে গেলো।… ভণ্ডুল হ’য়ে গেলো সব কাজ… সব কাজ পণ্ড হ’য়ে গেলো!’… প্রায় পনেরো মিনিট ধ’রে বিড়বিড় ক’রে শুধু এই কথা কটিই আউড়েছিলেন মার্সেল কামারে, যাঁরা তাঁকে তখন দেখেছেন তাঁরা হয়তো কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না কেমন অস্থির আর উদ্ভ্রান্ত লাগছিলো তাঁকে তখন। তারপর, আচমকা, সোজা হ’য়ে দাঁড়িয়ে, সটান, ঋজু, বুকে কিল মেরে তিনি ব’লে উঠেছিলেন : ঈশ্বর ব্ল্যাকল্যান্ডকে দণ্ডিত করেছেন! ব্ল্যাকল্যান্ড অনুদ্ধারণীয়!… আর যে-ভঙ্গিতে তিনি কথাটা বলেছিলেন, তাতে মনে হচ্চিলো ঈশ্বর বলতে তিনি শুধু নিজেকেই বুঝিয়েছেন। আর, কেউ তাঁকে বাঁধা দেবার আগেই, ছুটে গিয়েছেন তিনি, বারে বারে চীৎকার ক’রে বলেছেন : ‘ব্ল্যাকল্যান্ড অনুদ্ধারণীয়! ব্ল্যাকল্যান্ড অনুদ্ধারণীয়!

আর, গিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মিনারে, সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উঠতে-উঠতে পেছনের সব দরজা বন্ধ ক’রে দিয়েছেন পর-পর। কারখানারও প্রতিরোধব্যবস্থা হুবহু রাজভবনের মতোই; ফলে এখানে উইলিয়াম ফেরনে দরজা বন্ধ ক’রে দেবার পর যেমন নিচে নামতে পারেনি আর, তাঁর বন্ধুদের পক্ষে তেমনি কামারের কাছে গিয়েও পৌঁছুনো সম্ভব হয়নি। আর কামারে যতই ওপরে উঠে গেছেন, ততই আকাশবাণীর মতো শুনিয়েছে তাঁর স্বর : ‘ব্ল্যাকল্যান্ড অনুদ্ধার্য! ব্ল্যাকল্যান্ড অনুদ্ধাৰ্য!’

প্রথম বিস্ফোরণটা শোনা গেছে ঠিক তার পরক্ষণেই।

রিগোর নেতৃত্বে আরো-কয়েকজন কর্মী ছুটে গিয়েছে কারখানায়, চেষ্টা করেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দিয়ে মিনারকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেবে। তাঁদের গুরুর এমন দশা থেকে তারা দিশেহারা হ’য়ে পড়েছিলো। কিন্তু মিনার ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার নিজের একটা ভাঁড়ার ছিলো, যেখানে জেনারেটার তরল বাতাসকে রূপান্তিত ক’রে দেয় বিদ্যুতে—আর তাই বিস্ফোরণ বন্ধ হয়নি। কিন্তু যখন বোলতাগুলো যেভাবে পাক খেয়ে কারখানার সুরক্ষায় ঘুরছিলো, তারা একের পর এক ভির্মি খেয়ে পড়তে লাগলো নিচে, তখন রিগোরা বাধ্য হয়েছে ফের কামারের বিদ্যুৎব্যবস্থা চালু ক’রে দিতে। পাগল হ’তে পারেন কামারে, কিন্তু নিশ্চয়ই জানেন তিনি কী করতে চাচ্ছেন—কেননা বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু ক’রে দেবামাত্র আবার বোলতাগুলোকে সুরক্ষাচক্রের মতো কারখানাকে ঘিরে পাক খাইয়েছেন তিনি

বিষম উদ্বেগের মধ্যে রাতটা কেটে যাবার পর, মার্সেল কামারে এসে দেখা দিয়েছেন মিনারের প্ল্যাটফর্মটায়। সেই-উঁচু থেকে, আকাশবাণীর মতো, তিনি লম্বা- এক সন্দর্ভ ঝেড়েছেন, যার মধ্যে মাঝে-মাঝে একটা-দুটো কথাই শুধু বোঝা গেছে। যেমন, ঐশ্বরিক রোষ, স্বর্গের আগুন, সম্পূর্ণ বিনাশ এই কথাগুলো যতই বাইবেলের প্রকাশিত বাক্যের মতো শোনাক, সেগুলো এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাঁর উন্মত্ততা। সহজে কাটবার মতো নয়। এই সন্দর্ভের শেষে তিনি চেঁচিয়ে বলেছেন : পালাও!… সবাই পালিয়ে যাও!… কেউ এখানে আর থেকো না!’ আর এমনভাবে গলা ফাটিয়ে কথাগুলো বলেছেন যে কারখানার সব কোণা থেকেই তা শোনা গেছে। তারপর সেই-যে ফের তিনি মিনারে গিয়ে ঢুকেছেন, সেখান থেকে আর বেরোননি।

আর তারপরেই বামতীর থেকে উঠেছে বিস্ফোরণের আওয়াজ। এই বিস্ফোরণটার উৎপত্তি সরাসরি কারখানারই দেয়ালে-আর তা-ই দেখে সবাই ভয়ে একেবারে নীল হ’য়ে গেছে। কারখানায় থাকলেও মরণ, বাইরে বেরুলেও মরণ— এই দুই-মরণের মধ্যে কোন্‌টা ভালো বোঝা দায়। তবু তাঁরা ঠিক করেছেন, কারখানা থেকেই বেরিয়ে গিয়ে পালাবার চেষ্টা করতে হবে!

কিন্তু কপাল তো সঙ্গেই যায়, এপ্ল্যানেডে এসেই তাঁরা মুখোমুখি পড়েছেন হর্ষচরিতদের—আগে তাদের দেখা যায়নি, তাহ’লে প্রস্তুত হওয়া যেতো, কিন্তু তারা লুকিয়েছিলো দেয়ালের আড়ালে। বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির পর, পলাতকেরা দুটি ভাগে ভাগ হ’য়ে গেছেন। কেউ-কেউ, এই যেমন, সরাসরি খোদ হ্যারি কিলারের আস্তানাতে এসেই আশ্রয় পেয়েছেন, অন্যরা পালিয়ে গেছে নদীর ঘাটে, যাবার সময় ব্যারিকেডহিশেবে এপ্ল্যানেড আর নদীর ঘাটের মধ্যকার দরজাটা বন্ধ ক’রে দিয়ে গেছে।

এ-দলটাকে রাজভবন থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আবার আক্রমণ করার কোনো তোড়জোড়ই করছে না তারা—কেননা তার অর্থহীনতা তারা জানে এদিকে কারখানায় গিয়েও আশ্রয় নেবার সাহস পাচ্ছে না আর : তারা এখন পুরোপুরি নির্ভর ক’রে আছে এক উন্মাদের খামখেয়ালের ওপর-অনাহারে জীর্ণশীর্ণ, স্নায়ুগুলো সব যেন ছিন্নভিন্ন, তারা হতভম্ব হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে খোলা জায়গাতেই, অরক্ষিত। কেউ-কেউ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে, যারা দাঁড়িয়ে আছে অবসাদে তারাও যায়- যায়। নদীর অন্যতীর থেকে, রাজভবনের ওপর থেকে, গুলি ক’রে তাদের উড়িয়ে দেয়া যায়-কিংবা সার্কুলার রোড দিয়ে ঘুরে এসে তাদের ওপর চড়াও হওয়া যায়।

জেন অন্তত এটুকু স্বস্তি পেলে যে তাদের মধ্যে আছেন সাঁৎ-বেরা, আর ডাক্তার শাতোনে। অর্থাৎ, এ-যাবৎ, অন্তত, তার কোনো বন্ধুই মারা যাননি—বিশেষ ক’রে তার ঐ আধখ্যাপা আত্মীয়টি, যাকে সে এত ভালোবাসে, তিনি এখনও বেঁচে আছেন।

কিন্তু আশ্বস্ত হ’লে কী হবে, পরক্ষণেই রাজভবনের ওপর থেকে দুমদুম ক’রে ভীষণ ধাক্কাধাক্কি শুরু হ’য়ে গিয়েছে দরজায়। নিশ্চয়ই এইসব ধুপধাপ শব্দের উৎপত্তি রাজভবনের অলিন্দতেই। তারা পারলে বুঝি ছিঁড়েই ফ্যালে সবকিছু! এখনও দরজা অটুট আছে, ঠেকিয়ে রেখেছে ঐ অন্ধকারের জীবদের, কিন্তু ততক্ষণ! যদি উইলিয়াম ফেরনে আর তার সঙ্গীরাও অনাহারে খানিকটা কাহিল না-হ’য়ে পড়তো, তাহ’লে এতক্ষণে তারা হয়তো সফল হ’তে পারতো। সন্ধে ছটার একটু পরেই তেতলার দরজা শেষটায় ভেঙে ফেললো তারা, আর অমনি সকলকে তড়িঘড়ি চ’লে আসতে হ’লো দোতলায়। দোতলার দরজাটা বন্ধ ক’রে দিয়ে তারা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন এ-দরজাটাও ভেঙে পড়ে।

এইফাকে অবশ্য বারজাক আর আমেদে ফ্লরেঁসকে জেন নিজের অ্যাডভেনচারের সব কথাই খুলে বলেছে-কারখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর তাকে কী-রকম অবস্থাবিপাকে পড়তে হয়েছে। এবার সে বিশদ ক’রে খুলে বললে তার বংশবৃত্তান্ত, বললে কেমন ক’রে লুইসকে কী দুঃসহ স্পর্ধায় চুরি ক’রে এনে এখানে বন্দী ক’রে রেখেছিলো হ্যারি কিলার–আর সব-শেষে বললে কী মর্মান্তিক ও শোচনীয় আবিষ্কার সে করেছে তারপর-হ্যারি কিলার আসলে তারই সৎ-ভাই, উইলিয়াম ফেরনে। যদি ভাগ্য প্রতিবন্ধকতা করে, যদি সে আর কখনও ইংলন্ড না-পৌঁছায়, তবে আমেদে ফ্লরেঁস আর মঁসিয় বারজাকই জগৎকে সত্যিকথাটা জানিয়ে দিতে পারবেন – জর্জ বা লুইস, দুজনেই, এমন দুষ্কর্মের জন্যে অভিযুক্ত হয়েছে যে-দুষ্কর্ম তারা করেনি।

সাতটা নাগাদ দোতলার ছাদটাও নড়বোড়ে হ’য়ে গেলো। দরজা ভাঙতে না- পেরে, হ্যারি কিলার (ওরফে উইলিয়াম ফেরনে) ঠিক করেছে ছাদ ধ্বসিয়ে দিয়েই নিচে নামবে। একটুক্ষণ জিরিয়ে গায়ে তাকৎ এনে ফের ফেরনে আর তার সঙ্গীরা দোতলার ছাদ ভাঙবার কাজে লেগে গিয়েছে। শরণার্থীদের এবার আরো- নিচে চ’লে যেতে হ’লো।

তেতলার ছাদ ভাঙবার কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিলো না—আগেরটার মতোই অবিশ্রাম আঘাত চাই। ধকল মোটেই কম নয়। তবু রাত দুটো পর্যন্ত তাদের বুকের ঢিপঢিপ শব্দের সঙ্গে তাল রেখেই চললো দমাদ্দম ধুপধাপ আঘাত। তারপরেই ক্লান্ত হ’য়ে সাময়িকভাবে নিশ্চয়ই ছাদ ভাঙবার চেষ্টাটায় বিরতি দিলে তারা।

দমাদ্দম শব্দটা ফের শুরু হ’লো, এবার সরাসরি দোতলার ছাদেই, ভোর চারটের সময়। মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়া পর্যন্ত সবুর না-ক’রে, শরণার্থীরা চলে গেলো একতলায়-দরজা লাগিয়ে দিয়ে, তবে এখন তো আর তারা দরজা ভাঙবার ব্যর্থ চেষ্টাটা আর করছে না।

এই হচ্ছে তাদের শেষদুর্গ। মাথার ওপরকার বাকি ছাদগুলো ভেঙে ফেলে যখন বন্দুকের নল তাগ ক’রে ধরবে ফেনেরা, তখন তাদের হয় ঐ মাটির তলার জেলখানায় চ’লে যেতে হবে, আর নয়তো রাজভবনের দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে হবে খোলামেলায়। তারপর তাদের সামনে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

উইলিয়াম ফেরনেরা যখন বাকি-দুটো ছাদ ভাঙবার জন্যে মরীয়া চেষ্টা ক’রে চলেছে, তখন নির্মেঘ আকাশে উঠে এলো সূর্য। আর সকালবেলার ফটফটে আলোয় দেখে এই-প্রথম খানিকটা আন্দাজ পাওয়া গেলো ধ্বংসের পরিমাণ কী বিপুল, কী সর্বক্ষয়ী : যা-ই ঘটুক না কেন, ব্ল্যাকল্যান্ডের সর্বেসর্বা এর-পর তার রাজত্ব পাতবে শুধু এক ধ্বংসস্তূপেরই ওপর।

শহরটা পুরোপুরি ধ্বংস হ’য়ে গেছে। শুধু দুটো বাড়ি আস্ত আছে, হর্ষচরিতদের বসতিতে, ঠিক রাজভবনের মুখোমুখি। সূর্য ওঠবার কয়েক মিনিট পরেই তাদেরও পালা এলো : তারাও ধ’সে পড়লো পর-পর আর রাঙানদীর ডানতীরের ধ্বংসলীলা সম্পূৰ্ণ হ’য়ে গেলো।

বিস্ফোরণ কিন্তু মোটেই থামেনি, বরং এক বিস্ফোরণ থেকে আরেক বিস্ফোরণের ব্যবধান অনেকটাই ক’মে এসেছে। মার্সেল কামারে এবার বামতীর নিয়ে পড়েছেন -এবার কারখানার আস্তে-আস্তে ধ’সে-পড়ার পালা। অথচ এখনও সুদক্ষ, রণনিপুণ, সেনাধ্যক্ষের মতোই মার্সেল কামারে তাঁর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন : তাঁর উন্মত্ততার মধ্যেও কোথাও কোনো পদ্ধতিগত ব্যবস্থা আছে। তিনি এক-এক ক’রে উড়িয়ে দিচ্ছেন কর্মীদের বাড়িঘর, ওয়ার্কশপ, গুদোমঘর, একটু- একটু ক’রে, এক-এক ক’রে, আর যেন বিলম্বিত করতে চাচ্ছেন ধ্বংসের প্রক্রিয়া, যেন আস্তে-আস্তে নিংড়ে নিতে চাচ্ছেন এ-থেকে যতটা সন্তোষ পাওয়া যায়, তার সমস্তটাই, অথচ কখনও কারখানার প্রাণকেন্দ্রকে স্পর্শও করছেন না, যে-কলকব্জা থেকে তড়িৎপ্রবাহ বেরুচ্ছে অনর্গল, তারা যেন তাঁর ছক-কষা পরিকল্পনা অনুযায়ীই অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছে বারে বারে।

সারারাত ধরে রাজভবনের দরজার ওপর হামলা চালিয়ে হয়রান হ’য়ে হর্ষচরিতেরা সবাই নাজেহাল দাঁড়িয়েছিলো। বামতীরে প্রথম বিস্ফোরণটা ঘটতেই, এপ্ল্যানেডে তাদের মধ্যে এক তুমুল কোলাহল উঠলো, তারা আবার নতুন উদ্যম নিয়ে মরীয়ার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো রাজভবনের দরজায়।

তাদের এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞা সত্যিই দুর্বোধ্য-একটা প্রহেলিকার মতো। এত-জেদি কেন তারা, এমন একগুঁয়ে? এখন যখন ব্ল্যাকল্যান্ড ব’লেই কিছু আর নেই, কী তারা তবে পাবে এই রাজভবন থেকে? এই মরা শহরটা ছেড়ে চ’লে গেলেই তারা ভালো করবে না কি? এই ভুতুড়ে শহর ছেড়ে নাইজারের তীরে চ’লে-যাওয়াই তো তাদের পক্ষে শ্রেয় হ’তো।

বাইরে হর্ষচরিতদের উত্তেজিত কথাবার্তার মধ্যে তাদের এই অদ্ভুত আচরণের একটা হদিশ পাওয়া গেলো। তাদের নেতাকে উদ্ধার করবার কোনো বাসনাই আর নাই তাদের; তাদের ধারণা তাদের নেতাই এমন ক’রে তাদের পথে বসিয়েছে; এখান থেকে পালাতে পারলেই এখন তারা বাঁচে। প্রথমে, অবশ্য, সব ধনরত্ন লুঠ ক’রে নিয়ে যেতে চায় তারা –কারণ তাদের ধারণা সব ধনরত্ন নিজেদের মধ্যে তারা ভাগবাটোয়ারা ক’রে নেবে, তখন আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করবে না—তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখান থেকে সোজা পিঠটান দেবে –অন্য-কোনো আকাশের তলায় গিয়ে ফাঁদবে তাদের খুনজখমরাহাজানির ব্যাবসা।

শরণার্থীরা, পারলে, খুশি হ’য়েই রাজভবনের কোষাগার উন্মুক্ত ক’রে দিতো তাদের কাছে। কিন্তু ব্ল্যাকল্যান্ডের প্রাক্তন সর্বেসর্বা (প্রাক্তনই তো, কারণ ব্ল্যাকল্যান্ডই নেই আর) কোথায় যে তার লুঠতরাজের মাল লুকিয়ে রেখেছে কেউই তা জানে না। অথচ এই কোষাগার উন্মুক্ত ক’রে দিয়ে এই শত্রুদের হাত থেকে যদি নিষ্কৃতি পাওয়া যেতো, তবে তা-ই করতো শরণার্থীরা।

কারখানার দিক থেকে অনবরত বিস্ফোরণের আওয়াজ আসা ছাড়া পরিস্থিতি একই রকম রইলো সকাল নটা অব্দি। উইলিয়াম ফেরনে তখনও চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে ছাদ ভাঙতে, হর্ষচরিতেরা তখনও নাস্তানাবুদ হ’য়ে যাচ্ছে দরজা ভাঙতে গিয়ে।

কিন্তু শেষমুহূর্তে হয়তো হর্ষচরিতেরাও তাদের রণকৌশল পালটালে। দরজাটা ভাঙবার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রে নিজেদের খামকা অবসন্ন ক’রে ফেলার চাইতে তারা দরজাটার পাশের ইটবালিপাথর নিয়ে পড়লো। একঘণ্টা ধ’রে অবিশ্রাম শোনা গেলো পাথর ভেঙে ফেলবার শব্দ। তারপর বিকট-একটা বিস্ফোরণ দেয়ালের নিচের দিককার পাথর গুঁড়িয়ে দিলে। তারা শেষটায় বুদ্ধি ক’রে একটা গর্ত করতে পেরেছে দেয়ালে। ভাঙতে পারেনি পাথর, কিন্তু তাতে একটা ফুটো ক’রে তাতে গুলিবারুদ রেখে পলতেয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তারা।

দরজাটা আছে যদিও, তবু বড্ডই নড়বোড়ে হ’য়ে পড়েছে সেটা। দ্বিতীয় আরেকটা বিস্ফোরণেই পাশের দেয়াল উড়ে গিয়ে দরজাটা ধ’সে পড়বে। দেয়ালের সেই গর্তের মধ্য দিয়ে এর মধ্যেই দেখা দিতে শুরু ক’রেছে রাইফেলের নল।

শরণার্থীদের হলঘরটা ছেড়ে চ’লে যেতে হ’লো রাজভবনের একেবারে শেষপ্রান্তে। আর মেরিফেলোরা তখন দ্বিতীয়-একটা বিস্ফোরণের তোড়জোড় ক’রে দেয়ালের ওপর দিকে একটা ফুটো করতে লেগে গিয়েছে, যেখানে তারা রাখবে তাদের গোলাবারুদ, বাড়িতে-বানানো ডায়নামাইট।

ঠিক সেইমুহূর্তে আরেকটা উৎকট শব্দ জানান দিলে যে তৃতীয় ছাদটাও ভেঙে পড়েছে। কয়েক মিনিট বাদেই দোতলার ছাদের ওপর ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেলে শরণার্থীরা।

পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হ’য়ে উঠছে, কিছুতেই আর আয়ত্তের মধ্যে থাকছে না। বাইরে তিন-চারশো হর্ষচরিত, হয়তো আধঘণ্টা বাদেই হুড়মুড় করে বেনোজলের মতো এসে ঢুকবে রাজভবনে। ওপরে, একদল নাছোড় ও গোঁয়ার দস্যু, হয়তো প্রায় একই সময়ে বন্দুক বাগিয়ে মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে শুরু ক’রে দেবে। এই ভবিতব্যের সঙ্গে মোকাবিলা করবার মতো মোটেই কোনো অবস্থা নেই কারু। শরণাপ্রার্থীদের হালছাড়া হতাশাকে স্তোক দিয়ে কাটাবার চেষ্টা করেছিলেন আমেদে ফ্লরেঁস আর মসিয় বারজাক, জেন আর লুইস রেজন—কিন্তু বৃথা চেষ্টা। শরণার্থীরা হাল ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে আছে মেঝেয়, অপেক্ষা ক’রে আছে কখন শেষ-মর্মান্তিক আঘাতটা আসবে!

কিন্তু পুরো অবস্থাটাই আচমকা, অপ্রত্যাশিত, বদলে গেলো। উইলিয়াম ফেনেরা আর হর্ষচরিতেরা—দু-দলই একই সঙ্গে তাদের হাতের কাজ থামিয়ে দিলে। একটা বিস্ফোরণ—আশপাশে পর-পর যে ধরনের বিস্ফোরণ হচ্ছে, মোটেই তার মতো নয় –হঠাৎ সব শব্দকে ছাপিয়ে গ’র্জে উঠেছে-আর রাজভবনের চারপাশ থেকে তার প্রতিধ্বনি গুমগুম ক’রে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিলম্বিত। বিস্ফোরণ, না কি কামানের আওয়াজ? আবার পর-পর অনেকগুলো সেই একই রকমের আওয়াজ, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই, এপ্ল্যানেড আর ওপাশের খোলাজমির মাঝখানকার দক্ষিণপুবের দেয়ালের বেশির ভাগই ধ’সে পড়লো।

অকথ্য-সব খিস্তি বেরিয়ে এলো হর্ষচরিতদের মুখ থেকে, অকহতব্য-সব গালাগাল! মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে তারা ঐ উড়ে-যাওয়া দেয়ালটার দিকে, আর অমনি যা চোখে পড়েছে দেখে তা বুঝি আদপেই তাদের পছন্দ হয়নি, কেননা তারা সব পাগলের মতো হাত-পা নেড়ে কী যেন চেঁচিয়ে বলছে-তর্ক জুড়ে দিয়েছে একে-আরের সঙ্গে। উইলিয়াম ফেরনে ছাদ ভাঙবার কাজ স্থগিত রেখে ফের ছুটে উঠে যাচ্ছে মিনারে, আর হর্ষচরিতেরা বিশৃঙ্খলভাবে দৌড় লাগিয়েছে নদীর অন্যতীরটার দিকে। কী এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে তারা যেন হুটোপাটি লাগিয়ে দিয়েছে, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি-পালাবার চেষ্টায় মরীয়া, আর এমন সময় আরেকটা কামানের গোলা—হ্যাঁ, গোলাই যেন—এসে পড়লো ঠিক তাদের মাঝখানে, অন্তত পঞ্চাশজন ম’রে গেলো মুহূর্তে, আর উড়ে গেলো দুটো সেতুই—কাল ব্রিজ আর গার্ডেন ব্রিজ। স্থলপথে ডানতীরে যাবার কোনো উপায়ই আর নেই—কিন্তু তাতে কী? যারা প্রাণে বেঁচেছে, তারা সবাই ঝুপঝাপ ক’রে লাফিয়ে পড়েছে নদীর জলে।

মুহূর্তের মধ্যে এসপ্ল্যানেড ফাঁকা হ’য়ে গেলো। আর বিস্ফোরণের শব্দের ফাঁকে- ফাঁকে কী-রকম একটা থমথমে স্তব্ধতা নেমে আসছে চারপাশে। হতভম্ব শরণার্থীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কী হচ্ছে, এমন সময় রাজভবনের একটা কোণাই উড়ে গেলো। মার্সেল কামারে তাহ’লে পুরো জায়গাটাকেই একটা গোরস্থান বানিয়ে দেবেন ব’লে ঠিক করেছেন। না, এবার তাদেরও পালাতে হবে।

শরণার্থীরা সবাই ছুটে বেরিয়ে এলো এসপ্ল্যানেডে : হর্ষচরিতেরা হঠাৎ কী দেখে এমন ভয় পেয়ে পালালো, তা জানবার জন্যে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তারাও যেদিকটায় দেয়ালটা উড়ে গিয়েছে সেদিকেই ছুটলো। তারা তখনও তার কাছে পৌঁছোয়নি, ঠিক এমন সময় বেজে উঠলো তুরী-ভেরী-শিঙার শব্দ।

ভেরীর আওয়াজে এ-কোন উদ্ধার এলো, তা যেন কানে শুনেও বিশ্বাস হ’তে চাচ্ছিলো না কারু। তারা সবাই থমকে দাঁড়ালে, দোনোমনা, দ্বিধাব্যাকুল, ঠিক যেমন নদীর ঘাটেও কারখানার অন্যান্য কর্মীরা হতভম্ব হ’য়ে ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে আছে। তারাও তারপর ছুটে এলো ভাঙা দেয়ালটার দিকে।

এইভাবেই—হতভম্ব, আর্ত, ব্যাকুল-সবাইকে পেয়েছিলেন কাপ্তেন মার্সেনে। কারণ শেষমুহূর্তে কামানের গর্জন আর এই তুরীভেরীর আওয়াজ কাপ্তেন মার্সেনের দলবলের আগমনই ঘোষণা করেছিলো। সবাই তারা আছে এপ্ল্যানেডে, চারপাশে ফরাশি বাহিনী –আর শরণার্থীরা সবাই বিবর্ণ, পাণ্ডুর, হা-ক্লান্ত, দুর্বল, কম্পমান- খিদেয় প্রায়-জ্ঞানহারা

ফরাশি বাহিনীকে দেখে প্রথমটায় শরণার্থীরা ছুটে যেতে চেয়েছিলো তাদের দিকে, কিন্তু হাঁটুতে কোনো জোর ছিলো না আর, তারা শুধু তাদের বাহুগুলো আকুলভাবে বাড়িয়ে দিতে পেরেছিলো তাদের উদ্ধারকর্তাদের দিকে—কয়েকজন মুর্ছিত হ’য়ে প’ড়েই গিয়েছিলো মাটিতে।

এসপ্ল্যানেডে দলবল নিয়ে এসে শুধু এই করুণ দৃশ্যটাই দেখেছিলেন কাপ্তেন মার্সেনে। নদীর ওপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে একটা ধ্বংসস্তূপ, যা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে। ডানদিকে বামদিকে—দুটো বিশাল ভবন, এখন অর্ধেক -ভাঙা— আর সামনে প’ড়ে আছে রাশি-রাশি মৃতদেহ। আর তারপরেই ধুঁকছে এক-দল লোক—গোঙাচ্ছে, কাঁদছে, থরথর ক’রে কাঁপছে। এদের দিকেই এগুলেন কাপ্তেন মার্সেনে—এদের মধ্যে কি তিনি পাবেন তাকে, যাকে খুঁজতে তিনি বেরিয়েছেন, সেই কবে?

পরক্ষণেই সব দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। কাপ্তেন মার্সেনেকে দেখেই জেন ব্লেজন, হঠাৎ কোন্ অজ্ঞাত ভাঁড়ার থেকে শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে বার ক’রে নিয়ে, অবসন্ন পা টেনে-টেনে টলতে-টলতে কাপ্তেন মার্সেনের দিকে এগিয়ে গেলো। জেনকে দেখে যেন প্রথমে চিনতেই পারছিলেন না কাপ্তেন মার্সেনে—এই পাণ্ডুবর্ণ, কোটরগত চোখ, চোখের মণিতে জ্বরাতুর-দীপ্তি মেয়েটি-একেই কি তিন মাস আগে ছেড়ে এসেছিলেন ঝলমলে, দীপ্ত, স্বাস্থ্যে উচ্ছল। এগিয়ে এসে তাকে তিনি ধ’রে না- ফেললে জেন মূর্ছিত হ’য়ে প’ড়ে যেতো এসপ্ল্যানেডে।

যখন তিনি তার জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছেন, তখন এসপ্ল্যানেডের দু-দিকে দুটো বিশাল বিস্ফোরণ একসঙ্গেই উড়িয়ে দিলে কারখানা আর রাজভবনকে। আর সেই ধ্বংসের মাঝখানে আকাশ হাড়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু দুটো মস্ত মিনার।

রাজভবনের ওপরের মিনারটায় দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম ফেরনে, আর তার নওরতনের আটজন, ন-জন কালো ক্রীতদাস, পাঁচজন ব্ল্যাকগার্ড—সবশুদ্ধ তেইশজন, তারা রেলিঙ ধ’রে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে যেন সাহায্যের জন্যে অনুনয় করছে। আর অন্য মিনারটায় দাঁড়িয়ে আছে একজন-তিনবার সে প্ল্যাটফর্মটার চারপাশ ঘুরে এলো, হাত-পা নেড়ে উত্তেজিতস্বরে কী যেন প্রলাপ বকছে সে, এতদূর থেকে তার চীৎকার থেকে দুটো কথাই শোনা গেলো : ‘অভিশপ্ত… অভিশপ্ত ব্ল্যাকল্যান্ড! ‘

নিশ্চয়ই সে-কথা কানে গিয়েছিলো উইলিয়াম ফেরনের, সে পা দাপালে তার, আর পাশে কার হাত থেকে একটা রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালালে কারখানার দিকে—প্রায় চারশো গজ দূরে! নিশ্চয়ই তাগ করেনি সে, শুধু গায়ের জ্বালা মেটাতেই গুলিটা সে করেছিলো, কিন্তু বুলেট গিয়ে পৌঁছুলো লক্ষ্যে, মার্সেল কামারে বুক চেপে ধ’রে একবার যেন বেশামাল পাক খেয়ে গেলেন প্ল্যাটফর্মের ওপর।

আর তৎক্ষণাৎ একসঙ্গে দুটো বিস্ফোরণ—আগেরগুলোর চাইতে আরো- ভয়ংকর—কাঁপিয়ে দিলো আকাশবাতাসমাটি—আর দুটো মিনারই একসঙ্গে ধ’সে পড়লো। একটা নিজের সঙ্গে কবরে নিয়ে গেলো উইলিয়াম ফেরনেকে, আর অন্যটা কবরে নিয়ে গেলো মার্সেল কামারেকে।

আর সেই ভয়ংকর শব্দের পর সারা জায়গাটার নেমে এলো যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। আর এই বিভীষিকার মধ্যে যারা বেঁচেছিলো তারা ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রইলো, উৎকর্ণ—কিছুই নেই আর চোখের সামনে, ধ্বংস ছাড়া; আর কানে আসছে না কোনো শব্দ না, কোনো শব্দই আর নেই যেন কোথাও।

সব শেষ হয়ে গেলো।

যে-লোক ব্ল্যাকল্যান্ড তৈরি করেছিলো একদিন, সে-ই তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ক’রে দিয়েছে। মার্সেল কামারের আশ্চর্য, কিন্তু দুর্ভাগা, কীর্তির আর-কিছুই টিকে নেই।

১৫. উপসংহার

এইভাবেই শেষ হ’য়ে গেলো মার্সেল কামারে, আর উইলিয়াম ফেরনে ওরফে হ্যারি কিলারের। আর সেই একই সাথে ধ্বংস হ’য়ে গেলো ব্ল্যাকল্যান্ড, সারা জগতের অজ্ঞাতসারে যে-শহর একদিন গড়ে উঠেছিলো ধূ-ধূ মরুভূমির মাঝখানে আর তারই সাথে-সাথে ধ্বংস হ’য়ে গেলো যত আশ্চর্য উদ্ভাবন, ব্ল্যাকল্যান্ডকে যা অবিশ্বাস্য পরাক্রম দিয়েছিলো। শহর আর তার ভেতরের জিনিশ বলতে এখন যা আছে তা শুধু এক বিরাট ধ্বংসস্তূপ, মরুভূমির বালির লোল জিভ যা একদিন চেটে খাবে। সঞ্জীবনী যে-বৃষ্টি বর্ষেছিলো মার্সেল কামারের কল্যাণে, আর তা বর্ষাবে না। শুকিয়ে যাবে রাঙানদীর খাত, হ’য়ে উঠবে বন্য ঊষর অনুর্বর এক মরা আবাদ যার মধ্যে আর্দ্রতা থাকবে না একফোঁটাও, শুকিয়ে যাবে খেতখামার, আর মরুভূমি আবার ফিরে পাবে যা তার ছিলো একদিন, যা তার কাছ থেকে একদিন ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো মানুষেরই অপরিসীম সৃষ্টিপ্রতিভা। স্রষ্টারই অঙ্গুলিহেলনে ব্ল্যাকল্যান্ড এখন মরা, পরিত্যক্ত-এমন-কিছুই নেই, যা ভাবীকালকে এই আশ্চর্য্য প্রতিভার বৃত্তান্ত বলতে পারে।

কাপ্তেন মার্সেনে অত্যন্ত-তৎপর চেষ্টা করেছিলেন, যাতে এই মশানে তাঁকে বেশিক্ষণ না-থাকতে হয়। কিন্তু ফিরতে-ফিরতে তাঁর একমাস লেগে গেলো। তাঁকে কবর দিতে হ’লো মৃতদের-সংখ্যায় তারা কয়েকশো হবে, সেবাশুশ্রূষার চেষ্টা করতে হ’লো আহতদের, অতটা পথ যাবার জন্যে তাদের তো সারিয়ে তুলতে হবে, খানিকটা অন্তত ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য। ব্ল্যাকল্যান্ডের পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে কতজনই যে আর তাদের স্বদেশের মাটিতে ফিরে যেতে পারবে না। কর্মীদের মধ্যে মারা গেছে অন্তত কুড়িজন, তাছাড়া তিনজন স্ত্রীলোক, আর দুজন শিশু—তাদের হত্যা করেছে হর্ষচরিতদের বন্দুক, খুব-একটা হর্ষোৎপাদক নয় তাদের কুকীর্তি।

অথচ-কী আশ্চর্য—ভাগ্য বাঁচিয়ে দিয়েছে বারজাক মিশনের সবাইকেই। আমেদে ফ্লরেঁস একটু আহত হয়েছিলেন, কিন্তু তাছাড়া আর কারু গায়েই আঁচড়টুকুও লাগেনি। তোঙ্গানে আর মলিকও কোনো চোটজখম পায়নি-পরস্পরকে সশরীরে কাছে পেয়ে তাদের সে-কী উল্লাস।

এত-সব বিপদ-আপদ সহ্য ক’রেও যারা টিকে ছিলো, তারা যখন স্বাস্থ্যেদ্ধারের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে, কাপ্তেন মার্সেনেকে তখন ব্ল্যাকল্যান্ডের বাকি দুষ্কৃতকারীদের পাকড়াতে হ’লো। গোরাদের মধ্যে যারা গ্রেফতার এড়াতে চেয়েছিলো তাদের বিচার হ’লো বন্দুকের গুলিতে। অন্যদের হাতে-পায়ে পরানো হ’লো বেড়ি-ফ্রান্সের আইনকানুন তাদের সম্বন্ধে বিধান দেবে, যখন তারা দেশে ফিরে যাবে। আর যাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছিলো ব্ল্যাকল্যান্ডের গোরারা, সেই কালোদের জড়ো ক’রে আশ্বাস দেয়া হ’লো। নাইজারের তীরে ফিরে গিয়ে পরে তারা যে যার গাঁয়ে ফিরে যাবে।

দশই জুনের আগে বাহিনীর পক্ষে রওনা হওয়াই সম্ভব হয়নি। এমনিতেই সঙ্গে রসদ ছিলো পর্যাপ্ত, তাছাড়া মেরিফেলোরা আশপাশের যে-সব গ্রাম ছারখার ক’রে দিয়েছিলো, সেইসব পরিত্যক্ত গ্রামগুলোতেও দানাপানি মিললো। কোনো-কোনো গুরুতর আহতকে স্ট্রেচারে ক’রে নিয়ে যেতে হ’লো—কবে যে তারা হাঁটতে পারবে, সেই প্রত্যাশায় আর অপেক্ষা ক’রে থাকা যায় না। বর্ষা আসছে, আর সুদানে এই বর্ষাই শীতকাল—যদিও কাগজেকলমে পুঁজিপুথিতে তার সংযোগ গ্রীষ্মের সঙ্গেই। ফলে যাত্রা শুরু হ’লো বটে, কিন্তু বাহিনীর গতি হ’লো মন্থর। ছ-সপ্তাহ পরে কাপ্তেন মার্সেনের নেতৃত্বে সবাই এসে পৌঁছুলো টিম্‌বাকটুতে। তারও দু-মাস পরে বারজাক মিশনের সঙ্গে যাঁরা বেরিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে গেলেন ফ্রাসে, কেউ-কেউ ইংলন্ডে।

মসিয় পসাঁ তাঁর দফতরে ফিরে গিয়ে মিথ্যা, অর্ধমিথ্যা ও পরিসংখ্যানের হাজারো মজায় মনোনিবেশ করলেন। ডাক্তার শাতোনে ফিরে গেলেন তাঁর পেশায়—তাঁর পুরোনো রুগিদের কাছে। মসিয় ল্য দেপুতে বারজাক সংসদে নিজের ঘরে পুনরধিষ্ঠিত হলেন, তবে কালোদের ভোট দেবার অধিকারের প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি রাখা হলো, কিন্তু মঁসিয় বারজাকের নামডাক এতটাই বেড়ে গেলো কেউ- কেউ ভাবলে তিনিই বুঝি উপনিবেশ দফতরের ভাবীমন্ত্রী হবেন।

মলিক আর তোঙ্গানে চ’লে এসেছে ইংলন্ডে-আর ইংলন্ডে এসে বিয়ে করেছে।

সাঁৎ-বেরা… কিন্তু সাঁৎ-বেরার বৃত্তান্ত তো কিছুই নেই। তিনি মাছ ধ’রে বেড়ান, শিকারে যান, যাদের গোঁফ আছে ভুল ক’রে তাদের সম্বোধন করেন মাদাম, যাদের গোঁফ নেই তাদের বলেন মঁসিয়, আর ঐ ব্লেজনদের কালের কাছেই নিজের ভিলাটায় আছেন।

টিম্‌বাকটু পৌঁছেই কাপ্তেন মার্সেনে ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন-এবার অবশ্য কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই সেটা মঞ্জুর হয়েছে। আর ছুটি নিয়ে সাঁৎ-বেরা, লুইস আর জেন ব্লেজনের সঙ্গে তিনি এসে হাজির হয়েছেন ইংলন্ডে।

ব্ল্যাকল্যান্ডের ধ্বংসস্তূপে যে-একমাস কাটিয়েছিলেন তার মধ্যে একাধিকবারই তিনি খুলে বলেছেন—তাঁর বাগদত্তা ও অন্যান্যদের-দৈব্যের আশ্চর্য কেরামতিতে কেমন ক’রে হঠাৎ ঈথারের মধ্যে দিয়ে তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছিলো মার্সেল কামারের পাঠানো সেই বেতারবার্তা। আর তারপর সে কী তাঁর মর্মযাতনা—যখন কর্নেল আলেজ এমনকী তাঁর ছুটিও মঞ্জুর করতে চাননি।

তবে পরের দিনই—ভাগ্যিশ—উত্তর এসে পৌঁছেছিলো কর্নেল সাঁৎ-ওবানের কাছ থেকে, তাতে তিনি স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়েছিলেন তথাকথিত লিউটেনান্ট ল্যকরের আনা ঐ ফরমানটিই যে শুধু জাল তা নয়- লিউটেনান্ট ল্যকুরকেই তিনি চেনেন না; তিনি চান যে মঁসিয় বারজাকদের বিপদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এক্ষুনি একটা বাহিনী পাঠিয়ে দেয়া হোক। তৎক্ষণাৎ বাহিনী বেরিয়ে পড়লো সুপ্রস্তুত, নাইজার ধ’রে গাও; আর তারপর পথের অনেক বিপদ-আপদ পেরিয়ে মার্সেনে অবশেষে এসে পৌঁছেছেন ব্ল্যাকল্যান্ডে।

ইংলন্ডে পৌঁছেই দ্রুততম যানবাহনে করে জেন ফিরে এলো গ্লেনর কালে- সঙ্গে তার দাদা, কাপ্তেন মার্সেনে আর সাঁৎ-বেরা। তাদের আসবার খবর নিয়ে আগেই এসেছিলো টেলিগ্রাম। প্রায় একবছর আগে গ্লেনর কাস্ল ছেড়ে বেরিয়েছিলো জেন। এখন সে ফিরে এসেছে বিজয়িনী, ব্লেজন বংশের গায়ে যতটুকু কালি লেগেছিলো, তারই চেষ্টায় সে-সব মুছে গেছে এখন, হৃত-সম্মানে আবার পুনরধিষ্ঠিত হয়েছেন লর্ড অভ গ্লেনর।

জেন এসে কেমন অবস্থায় দেখেছিলো তার বাবাকে? বৃদ্ধ-তাঁর বয়েস চুরানব্বই বছর-তিনি কি কন্যার অদর্শন সহ্য করতে পেরেছেন? সহ্য করতে পেরেছেন তাঁর ছোটোছেলে সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বংশের সুনামে নতুন যা কালি ঢেলে দিয়েছে? খবরকাগজগুলো অবশ্য যতটা বিষ ঢালা সম্ভব সব বিষ ঢেলে দিয়ে এখন ফের হৃতসম্মান ফেরাবার চেষ্টায় বদ্ধপরিকর হ’য়ে আছে। আমেদে ফ্লরেঁস ইওরোপে ফিরে এসেই সব জানিয়েছেন পর-পর নিবন্ধ লিখে, আর অমনি সব শেয়ালের এক রা-য়ের মতো সব কাগজই জর্জ আর লুইস ব্লেজনের গুণগানে মুখর হ’য়ে উঠেছিলো। কিন্তু লর্ড অভ গ্লেনর কি খবরকাগজ পড়েন? না কি সব সুখবর তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছেছে আশাবিহীন-দেরিতে? সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ডাকাতির পর বাবার অবস্থা কী-রকম হয়েছিলো সেটা তো লোকের মনে আছে!

অবশেষে জেন এসে পৌঁছুলো অসহায় বৃদ্ধের কাছে। অসহায়, কিন্তু চোখে তখনও বুদ্ধির দীপ্তি ঝকমক করছে, বোঝা যায় এখনও তিনি ধরতে পারেন চারপাশে কখন কী ঘটছে, কে কী বলছে। জেনের সঙ্গে ঘরে ঢুকেছিলো লুইসও, সাথে সাঁৎ-বেরা, আর কাপ্তেন মার্সেনে। জেন সব কথা সংক্ষেপে খুলে বললে, বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে কাপ্তেন মার্সেনের, দেখালে সেই কাগজ কুবোর কবরখানায় সাক্ষীদের দস্তখৎ সমেত কী বেকসুরনামা সে লিখিয়ে নিয়েছিলো। আরো-একটা কথা সে বলেছিলো বাবাকে, যেটা সম্বন্ধে খবরকাগজ নীরব ছিলো— সেটা উইলিয়াম ফেরনের কথা, তার ঘৃণা তার দ্বেষ তার বিজাতীয় ক্রোধের কথা— বললে সে কীভাবে ব্লেজন পরিবারের মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আর সবকিছু খাপে খাপে মিলে গেলো। লর্ড অভ গ্লেনরের মনে আর কোনো সন্দেহই রইলো না। যদিও তাঁর এক ছেলে মারা গেছে, সেটা শোচনীয়, তবু দুই ছেলেরই মানইজ্জৎ আবার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রকাশ্যেই।

বৃদ্ধ, নির্নিমেষে কন্যার দিকে তাকিয়ে, সব কথা অধীরভাবে উৎকৰ্ণ হ’য়ে শুনছিলেন। জেনের বৃত্তান্ত যখন শেষ হ’লো, তাঁর মুখে একঝলক রক্ত উঠে এলো, কেঁপে উঠলো তাঁর ঠোঁট দুটো, আর থরথর ক’রে কেঁপে উঠলো তাঁর সারা শরীর। তাঁর শরীরের কাঠামোটার মধ্যে তাঁর প্রাণমন যেন কীসের সঙ্গে যুঝছে।

সবাই সম্মোহিতদের মতো তাকিয়ে দেখলো বৃদ্ধ কীভাবে নিজের সঙ্গে যুঝছেন। কিন্তু রক্তমাংসের চেয়েও প্রবলতর কারু ইচ্ছাশক্তি। এই প্রথমবার, অত মাস পর, লর্ড অভ গ্লেনর ন’ড়ে-চড়ে বসলেন, কথা বলতে পারলেন, তাঁর রূপান্তরিত মুখচ্ছবি জেনের দিকে ফেরানো। হাত বাড়িয়ে তিনি খুঁজলেন তাঁর সাহসিনী মেয়েকে, যে তাঁর জন্যে এত-কিছু ক’রে এসেছে, আর বিজয়িনীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর ঠোঁট দুটি থরথর ক’রে কেঁপে উঠলো।

আর, তারপরেই, মনে হ’লো বাঁচবার সকল কারণই যেন তাঁর হারিয়ে গেছে; গভীর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ তাঁর চোখ বুজলেন। সে-ই তাঁর শেষনিশ্বাস, নিশ্চিন্ত, কিন্তু শেষ। যেন এতদিন তিনি শুধু এইমুহূর্তটারই অপেক্ষা ক’রে ছিলেন।

মিথ্যেই তারা চেষ্টা করলে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে জীবিতদের মাঝখানে। কিন্তু গ্লেনরের লর্ড ব্লেজন পৌঁছেছেন শান্তিধামে, যেন অনেকদিন পরে নিশ্চিন্ত হ’য়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি মারা গেছেন বটে, কিন্তু শান্তি পেয়ে মরেছেন।

এই বৃত্তান্তর এখানেই শেষ হওয়া উচিত।

সব কুশীলবেরই খবর আমরা জেনে গেছি। শুধু একজনের বাদে।

অর্থাৎ আমি…

হুঁ, এই দ্যাখো, আবারও আগে থেকে সব ফাঁস ক’রে দিচ্ছি আমি… তো, না-হয় এটাই বলা যাক যে আমেদে ফ্লরেঁস ফের ল্যক্সপান্‌সিয়ঁ ফ্রাঁসেঈ-র হ’য়ে কাজ শুরু করেছেন, কিস্তিতে-কিস্তিতে এই কাগজেই বেরিয়েছে তাঁর রোমাঞ্চকর অ্যাডভেনচারের বৃত্তান্ত, তাঁর সম্পাদকেরা যার দাম ধরে দিয়েছেন লাইনপ্রতি তিরিশ সঁতিম। সেই মজুরিতে তাঁর পোষায় কী ক’রে, তিনি তো আর বড়োলোক নন, ফলে তিনি একঢিলে দুই-পাখি মারতে চেয়েছেন—এই একই বিষয়ে ফেঁদে বসেছেন দুর্বার ও আশ্চর্য এক অভিযানের উপন্যাস।

উপন্যাস? জিগেস করতে চাচ্ছেন… কোন উপনাস?

কিন্তু সে তো এটাই, প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, সে-তো এই উপন্যাসটাই আপনারা এখন যার প্রথম থেকে এ-পর্যন্ত প’ড়ে এসেছেন।

মস্ত মনস্তাত্ত্বিক এই আমেদে ফ্লরেঁস, তাঁর মনে হয়েছে তিনি যদি সব সত্যিকথাই লেখেন তাহ’লেই তা উপন্যাসের চেয়েও মনোরম হবে, লোকে পড়তে-পড়তে হাই তুলবে না—তিনি তো আর ঘুমের ওষুধ বিক্রি করতে বসেননি, অনিদ্রারোগের কোনো মহৌষধ – যেমন হয় বেশির ভাগ আজগুবি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীই। কিন্তু তাতে শুধু সাজিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজের মতো ক’রে- অর্থাৎ এ-বইতে যা আছে সবই ঘটেছে, তবে তার বিন্যাসটা আমেদে ফ্লরেঁসের স্বকপোলকল্পিত।

তা ভালো হোক মন্দ হোক, উপভোগ্যই হোক বা একঘেয়েই হোক, এইই তবে শেষ। অতএব খসানো যাক ছদ্মদেশ, সর্বসমক্ষে কবুল করা যাক এই উপন্যাসের লেখক আপনাদের সেবক এই-অধমই, যাঁর নাম আমেদে ফ্লরেঁস, ল্যাক্সপাসিয়ঁ ফ্রাঁসেঈর সাংবাদিক, যিনি অবশেষে সব উপন্যাসের সেরা কথাটাই লিখে দিচ্ছেন, রাজা-কথা, সেরা-কথা :