২.০৯ দুর্বিপাক

৯. দুর্বিপাক

জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে তড়িৎপ্রবাহ সাময়িকভাবেই বন্ধ হ’য়ে গিয়েছিলো, কেননা এই বিরতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ৯ই এপ্রিল স্থগিত হয়েছিলো তড়িৎপ্রবাহ, ফিরে এসেছিলো পরের দিন সকালেই। বাস্তবিক, এই বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দেবার ফলে তার প্রথম বলি হয়েছিলো হ্যারি কিলার নিজেই। গোড়ায় নিজেকে তার দারুণ বুদ্ধিমান ব’লে মনে হয়েছিলো। ভাবখানা : কেমন জব্দ করেছি! কিন্তু কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ক’রে দেবার ফলে, কারখানার কাছ থেকে যে-সব সেবা পেতে সে অভ্যস্ত, কারখানা উল্টে সে-সবই বন্ধ ক’রে দিয়েছিলো। চাষের যন্ত্রপাতি আচমকা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আচমকাই থমকে থেমে গিয়েছিলো। যে-পাম্প দিয়ে নদী থেকে জল তুলে জলাগারগুলোয় ভরা হ’তো, তারাও অকেজো হ’য়ে গিয়েছিলো। জলাগার ছিলো দুটো: একটা কারখানায় জল জোগাতো; অন্যটা জল জোগাতো ব্ল্যাকগার্ডদের বস্তিতে—আর সেখান থেকে, সারা শহরে। দু-দিনেই এই দ্বিতীয় জলাগার খালি হ’য়ে গিয়েছিলো, সারা ব্ল্যাকল্যান্ডে জলের জন্যে হাহাকার প’ড়ে গিয়েছিলো। আর, তারপর, রাত্তিরে বিজলি বাতি নেই–আর আলো জ্বালাবার যেহেতু অন্যকোনো বিকল্পব্যবস্থাই ছিলো না, সারা শহরটাই তলিয়ে গিয়েছিলো নিকষ অন্ধকারে। আর সেটা হ্যারি কিলারকে একেবারে খেপিয়ে তুলেছিলো, বিশেষত রাজভবন থেকে সে দেখতে পাচ্ছিলো কারখানা শুধু আলোয় ঝলমল করছে না, চারপাশে সে জোরালো-সব সন্ধানী আলো জ্বেলে রেখেছে, যাতে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে কেউ এসে হামলা চালাতে না-পারে। শেষটায় সে যখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে বিপক্ষের হাতের তাশ তার চেয়ে জোরালো, রাগে ফোঁস-ফোঁস করতে-করতে সে নিজেই ফের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র চালু করতে বাধ্য হয়েছে—প্রায় নিজের থুতু গেলার মতোই, কেননা আগের দিন সে নিজেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ক’রে দেবার হুকুম দিয়েছিলো। সেইসঙ্গে সে একটা ফোনও করেছে মার্সেল কামারেকে। তিনি তখন তাঁর অতিথিদের সঙ্গে নিজের পড়ার ঘরেই বসেছিলেন।

অতিথিরা শুনতে পেলেন, বৈজ্ঞানিক আগের দিনের মতোই হুঁ-হাঁ ক’রে উত্তর দিচ্ছেন। ‘হ্যাঁ,’ ‘না,’ ‘বেশ’–এর বেশি কিছুই বলছেন না, আর এই খুচরো কথাগুলো থেকে মোটেই বোঝা যাচ্ছিলো না হ্যারি কিলার অন্যপ্রান্তে কী বলছে। আগের মতোই, এবারও, বৈজ্ঞানিক হো-হো ক’রে হেসে উঠে রূঢ়ভাবেই রীসিভার নামিয়ে রেখেছেন।

অতিথিদের তিনি যে-সংক্ষিপ্তসার দিলেন, তার মমার্থ এই : হ্যারি কিলার আর তিনি নাকি সাময়িক এক সন্ধিতে পৌঁছেছেন। ঠিক হয়েছে, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ফের বিদ্যুৎ জোগাবে, বদলে কারখানা ব্ল্যাকল্যান্ডের বাকি পরিষেবাগুলো বজায় রাখার ব্যবস্থা করবে। এই সন্ধিচুক্তিতে, অবশ্য, বাকি-অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি- ফলে গোটা ব্যাপারটাই কেমন অদ্ভুত আর জটিল হ’য়ে উঠেছে। শান্তির প্রস্তাব শুধু ঐ একটা ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ। বাকি সংঘর্যটা এখনও চলেছে। হ্যারি কিলার বিশেষভাবে হুমকি দিয়ে দাবি করেছে বন্দীদের ফেরৎ পাঠানো হোক, এবং মার্সেল কামারে শুধু ছোট্ট ক’রে ঠাণ্ডাভাবে জানিয়েছেন এ-প্রস্তাবে তিনি আদৌ রাজি নন।

কথাবার্তার শেষে হ্যারি কিলার নাকি তার হেলিবিমানগুলোর জন্যে তাঁর কাছে তরল বাতাস চেয়েছিলো। যখনই কোনো সফর-শেষে হেলিবিমানগুলো ফিরে আসে, তখন তাদের জ্বালানির ট্যাঙ্ক থাকে ফাঁকা, সেগুলো ফের জ্বালানি দিয়ে ভর্তি ক’রে ফেবলার জন্যে কারখানায় এনে রাখা হয়। হ্যারি কিলারের কাছে আর একফোঁটাও তরল আগুন নেই, আর তার ফলে তার চল্লিশটা হেলিবিমান অকেজো হ’য়ে পড়ে আছে। এ-ব্যাপারেও মার্সেল কামারে সোজাসুজি তার আরজিটা নাকচ ক’রে দিয়েছেন। প্রথমত, নিজের হাতে যাতে এই শক্তি প্রচুর পরিমাণে মজুদ থাকে সেটা তাঁকে দেখতে হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর শত্রুর হাতে এত-বড়ো একটা হাতিয়ার তুলে দিতে রাজি হননি। তাতে নাকি হ্যারি কিলার খেপে-বোম, হুমকি দিয়ে বলেছেন সে নাকি কারখানাকে অনাহারে শুকিয়ে মারবে। আলোচনার ঠিক এইখানটাতেই বৈজ্ঞানিক হুমকিটাকে হো-হো করে হেসে উড়িয়ে দিয়ে রীসিভার নামিয়ে রেখেছেন।

তাঁর শ্রোতারা অবশ্য হ্যারি কিলারের শাসানিটাকে বেশ গুরুত্বই দিয়েছেন। কামারে যে-প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গ’ড়ে তুলেছেন, তার ফলে কারখানা যদি-বা একটা অভেদ্য দুর্গের মতোই হয়, তবু এটা ঠিক যে আক্রমণ করার মতো অস্ত্রশস্ত্র তেমন- কিছু নেই এই কারখানায়, তাছাড়া যদি-বা কিছু থেকেও থাকে, বৈজ্ঞানিক তা কিছুতেই কাজে লাগাবেন না। এ-রকম অবস্থায়, দু-পক্ষের কেউই যদিও আপাতত বাজিমাৎ করতে পারবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে এমন-একটা দিন নিশ্চয়ই আসবে যখন খাবারের অভাবেই কারখানা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

বারজাক যখন এ-সম্ভাবনাটার কথা তুলেছেন, কামারে শুধু তাঁর কাঁধ ঝাঁকিয়েছেন, বলেছেন, ‘বেশ-কিছুদিনের উপযোগী রসদ আমাদের হাতে আছে।’

‘কিন্তু কতদিনের জন্যে?’

কামারে একটু বুঝি এড়িয়েই গেছেন। ‘আমি ঠিক জানি না, তবে পনেরো দিন—কিংবা তিনহপ্তার মতো খাবারদাবার নিশ্চয়ই আছে। সেটা অবশ্য আদৌ পাত্তা দেবার মতো ব্যাপার নয়, কারণ আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা নিজেরাই একটা হেলিবিমান বানিয়ে নিতে পারবো–নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আপাতত আমি শুধু আপনাদের তার মহড়াতেই অংশ নিতে বলবো, আমরা অবশ্য রাত্তিরেই প্রথমবার চালিয়ে দেখবো সব ঠিকঠাক আছে কি না, যাতে রাজভবন ব্যাপারটার কোনো আঁচ না-পায়। মহড়াটা হবে পরশুদিন, ১২ই এপ্রিল, ভোররাতে, চারটের সময়।’

এটা একটা শুভসংবাদ বটে। বন্দীরা এর কথাটা আগে ভাবেননি। হেলিবিমান থাকা মানে অবস্থাটা অনেকটা আয়ত্তে চ’লে-আসা। কিন্তু তার মারফৎ কি শেষ-অব্দি সত্যি উদ্ধার আসবে? নিষ্কৃতি পাবেন তাঁরা এখান থেকে?

‘কারখানায় একশোজনেরও বেশি লোকজন আছে,’ বারজাক মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘আপনার হেলিবিমান যত-শক্তিশালীই হোক, তাদের সবাইকে তো আর এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।’

‘পাইলটকে বাদ দিয়ে আর শুধু দশজনকে নিয়ে যেতে পারবে,’ কামারে জানিয়েছেন। ‘সেটা নেহাৎ মন্দ নয়।’

‘চমৎকার!’ বারজাক সায় দিয়েছেন। অথচ তবু আপনাদের সবাইকে এই আপদটা থেকে বাঁচাতে পারবে না!’

‘উঁহু, মোটেই তা নয়।’ কামারে উত্তর দিয়েছেন। ‘কাকের ওড়ার পথে, সায়ী থেকে এ নেহাৎ দুশো মাইল দূরে, আর টিম্‌বাকটু থেকে প্রায় সাড়ে চারশো মাইল— সেটা হয়তো আরো-ভালো। উড়াল-টরপেডোগুলোর হাত এড়াবার জন্যে আমরা যেহেতু শুধু রাত্তিরেই পাড়ি জমাতে পারবো। হেলিবিমান আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সায়ীতে তিনবার আর টিম্‌বাকটুতে দু-বার পাড়ি দিতে পারবে। কারখানায় সে- পাঁচশো জন লোক আছে, নারী ও শিশু শুদ্ধু, তাদের সায়ী নিয়ে যেতে লাগবে মোট পাঁচদিন আর টিমবাকটু যেতে আটদিন!’

এই পরিকল্পনাটার আলোচনা অন্তত এই সুফল ফলিয়েছে যে হ্যারি কিলারের হুমকির ফানুশের মধ্য থেকে সব হাওয়া বার ক’রে দিয়েছে, আর মনে হয়েছে এভাবে ব্ল্যাকল্যান্ড থেকে উদ্ধার-পাওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। অধীরভাবে এখন শুধু সবুর ক’রে থাকতে হবে কখন এই পরিকল্পনাটাকে কাজে খাটানো যায়।

এই চারপাশ-থেকে-ঘেরাও-হওয়া দুর্গটার মধ্যে এই দু-দিনের অপেক্ষাই যেন অনন্তকাল ব’লে মনে হ’লো। তারই মধ্যে যতটা সম্ভব ভালোভাবেই দিন কাটাবার চেষ্টা করেছেন তাঁরা, বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাগানে ঘুরে বেড়িয়ে, তার উঁচু দেয়ালটার জন্যে রাজভবনের হামলার হাত থেকে এই বাগান অনেকটাই সুরক্ষিত। মঁসিয় পঁসাঁ, বিশেষত, সকাল থেকে রাত সারাক্ষণই-প্রায় বাগানেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সারাক্ষণ উদ্ভিদগুলোর ওপর ঝুঁকে প’ড়ে, একটা পরকলার সাহায্যে তাদের মাপজোক নিয়েছেন তিনি, আর সবকিছু তাঁর খাতায় টুকে নিয়েছেন।

‘এ আপনি করছেন কী?’ তাঁকে ব্যস্তভাবে এ-সব টুকে রাখতে দেখে একরার আমেদে ফ্লরেঁস আর তাঁর কৌতূহল চাপতে পারেননি।

‘এ তো আমার কাজ, মঁসিয় ফ্লরেঁস,’ কিঞ্চিৎ কেউকেটার ভঙ্গি ক’রেই বলেছেন মসিয় পঁসা।

‘পরিসংখ্যান?’

‘তা ছাড়া আর কী। আমি শুধু হিশেব ক’রে দেখছি নাইজার নদীর বাঁক কতজনকে লালন করতে পারবে।’

‘আহা! সবসময়েই নদীর বাঁক! আমার কাছে অবিশ্যি মনে হচ্ছে যে আমরা ঐ বাঁকেও গিয়ে থাকবো না, এখানেও থাকবো না! তাছাড়া, বাঁক কোথায় তার ঠিক কী—আপনি মাপজোক নিচ্ছেন সেখান থেকে এত-দূরে!

প্রায় পণ্ডিতি চালে মঁসিয় পঁসা জবাব দিয়েছেন, ‘তাই ব’লে আমরা যে তুলনা ক’রে কোনো ধারণা করতে পারবো না, তা বলা যায় কি?’

এমন সময় ডাক্তার শাতোনে এসে হাজির হয়েছেন সেখানে। আপনারা এখানে কী করছেন!’

‘মঁসিয় পঁসাঁ পরিসংখ্যানবিদ্যার কারিকুরি বোঝাচ্ছেন।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই সহজ,’ বলেছেন মঁসিয় পঁসাঁ। ‘ধরুন এই পালং শাক, চার বর্গ ইঞ্চি জায়গা জুড়ে আছে। তারপরেই ওদিকটায় দেখতে পাবেন একটা ফুলকপি –সে জায়গা নিয়েছে ষোলো বর্গ ইঞ্চি। আমি এমনিভাবেই এলোমেলো ভঙ্গিতে একশো উদ্ভিদের মাপজোক নিয়েছি। গড়ে তারা কতটুকু ক’রে জায়গা জোড়ে তারও একটা হিশেব করেছি। তেমনি রোজ এরা কতখানি ক’রে বাড়ে, তারও একটা হিশেব নিয়েছি আমি। ধরুন এই লেটুস, কালকের চাইতে এই লেটুস ঠিক আটগ্রামের ৬১.৭ ভাগ বেড়েছে। অর্থাৎ আমি গণিতশাস্ত্রের সাহায্যে নির্ধারণ করেছি দৈনন্দিন বৃদ্ধির হার একদানার প্রায় .৩৩৯ ভাগ, এক বর্গ ইঞ্চির .৯৬৪ ভাগ।’

অ্যা! এ তো ভারি তাজ্জব কাণ্ড!’ চোখের পাতা না-ফেলেই বলেছেন ডাক্তার শাতোনে।

‘সত্যি, তাজ্জব হবারই কথা! ওই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানগুলো সবসময়েই ভারি কৌতূহলোদ্দীপক।’ আর তা-ই থেকে হিশেব ক’রে নাকি দাঁড়িয়েছে ‘পুরো নাইজারের বাঁকে রোজ খাদ্য ফলতে পারে ১২,০১২,০০০টন—আর বৎসরে—’

‘আমার সন্দেহ নেই এ-সব হিশেব-টিশেব ভারি-চিত্তাকর্ষক ব্যাপার,’ ডাক্তার শাতোনে ফোড়ন কেটেছেন।

‘একজন লোকের জীবনধারণের জন্যে যত খাদ্য লাগে, সেটা মাথায় রাখলে নাইজার নদীর বাঁক কত-লোকের জীবন বাঁচাতে পারে, তা সহজেই বার ক’রে নেয়া যায়। আর এই জিনিশটাই পরিসংখ্যানবিজ্ঞান জানিয়ে দিতে পারে। আমি এই চেষ্টাই করছি আমাদের এই কারাবাস যাতে একেবারেই বিফলে না-যায়,’ খুবই শান্তসুরে বলেছেন মঁসিয় পঁসাঁ।

‘সে-তো আপনারই সৌজন্যে, মঁসিয় পঁসাঁ, এই ব’লে ডাক্তার শাতোনে আর আমেদে ফ্লরেঁস যুগপৎ, একযোগে, সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন।

এইভাবেই একটি-একটি ক’রে ঘণ্টা কেটেছে ১০ই আর তারপরে ১১ই এপ্রিলের।

একটা ছোট্ট ঘটনা, অবশ্য, দ্বিতীয়দিনের একঘেয়েমিটা কিঞ্চিৎ কাটিয়ে দিয়েছিলো। বিকেল পাঁচটা নাগাদ কামারেকে এসে জানানো হলো যে যে-পাম্পটা দিয়ে নদী থেকে জল তোলা হয়, সেটা আর কাজ করছে না। কামারেও দেখেশুনে এসে সমস্যাটা স্বীকার করলেন। খ্যাপামি করছে পাম্পটা, যেন সে শূন্যের মধ্যে কাজ করছে, টেনে তোলবার মতো কিছুই পাচ্ছে না। অমনি কামারে নির্দেশ দিলেন তার পিস্টনটা বার ক’রে নিতে, কারণ চাকার চারপাশের কানার বড্ড ক্ষতি হয়েছে, ফলে ঐ সিলিন্ডারগুলোর মাপে মাপে তা আর বসতে পারছে না। সামান্যই একটা মেরামতির ব্যাপার, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই খুঁতটা সারিয়ে নেয়া যাবে।

পরদিন ভোরের মধ্যেই স্নায়ুখ্যাপানো অপেক্ষা অবশেষে শেষ হ’য়ে গেলো। অনায়াসেই নিশ্চয়ই বোঝা যায় মার্সেল কামারে রাত চারটের সময় রঁদে-ভূ-র ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও কেউই তখন আর নাসাগর্জন ক’রে ঘুমুচ্ছিলেন না। তিনি তাঁর নিজের কথা রেখেছেন, কাঁটায় কাঁটায়। বাগান থেকে মহড়ার কাজ শুরু হবে : তাঁরা সবাই বাগানে পৌঁছে দ্যাখেন, যে-প্রকৌশলবিদেরা হেলিবিমানটা বানিয়েছে, তারা এর মধ্যেই সেটাকে বাগানে এনে হাজির করেছে।

মার্সেল কামারে প্ল্যাটফর্মে উঠে মোটরটাকে চালু ক’রে দিলেন। ক-মিনিট কেটে গেলো, দর্শকদের কাছে মনে হচ্ছিলো যেন অনন্তকাল। তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, যদি কোথাও কোনো ভুলচুক হ’য়ে থাকে। একটু পরেই অবশ্য তাঁদের সব আশঙ্কা দূর হ’য়ে গেলো। হেলিবিমানটা হঠাৎ শূন্যে উঠে গেলো, মেলে দিলো তার দুই পাখা, তারপর কারখানার মধ্যে আকাশে একবার পাক খেয়ে যেখান থেকে রওনা হয়েছিলো, সেখানেই এসে নেমে পড়লো। মার্সেল কামারে এবার দশজন সঙ্গী নিয়ে আকাশে উড়লেন, তিনবার চক্কর খেলেন বাগানের ওপর, পরীক্ষা শেষ। হেলিবিমান তার মহড়ায় সসম্মানে উৎরেছে।

প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে পড়তে-পড়তে তিনি বললেন, ‘আজ রাত নটার সময় প্রথম উড়াল।’

আর তাতে সমস্ত দুরবস্থাই যেন একনিমেষে মুছে গেলো : হামলা, কারাবাস, গত পনেরো দিনের রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠা আর তার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মেশানো একঘেয়েমির বোধ। আর ক-ঘণ্টার মধ্যেই এই নিদারুণ দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। তাঁরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে শুভেচ্ছাবিনিময় করলেন বন্দীরা, আর মিস্ত্রিরা আবার হেলিবিমানটাকে নিয়ে গেলো তার হ্যাঙারে, পরদিন সন্ধেবেলায়, যথাসময়ে সে আসবে আবার-টিম্‌বাকটু যাবার জন্যে উড়ানে।

পুরো কারখানা খালি ক’রে সবাইকে নিয়ে যেতে যেহেতু কয়েকটা দিন লেগে যাবে, রোজকার নিয়মিত কাজ তাই ব’লে থামানো চলবে না। বিশেষত পাম্পটা সেদিনই সারিয়ে ফেলা হ’লো। মেরামত করতে গিয়ে দেখা হলো ক্ষতি যা হয়েছে তা অতি-নগণ্য। অন্তত সেদিক দিয়ে কোনো গণ্ডগোল কিছু নেই। পাম্পটা কেন খ্যাপার মতো কাজ করছিলো, তার কারণ খুঁজতে হবে অন্য-কোথাও। আপাতত- অবশ্য তাকে আবার জুড়ে বসিয়ে দিলেই কাজ চলবে আর সে-কাজটা অবিলম্বেই সমাধা করা হ’লো।

সন্ধে সাড়ে আটটায়, অন্ধকার যখন নিবিড় হ’য়ে গিয়েছে, মার্সেল কামারে অবশেষে প্রস্থানের সংকেত দিলেন। তার অনেক আগেই হ্যারি কিলারের আটজন প্রাক্তন কয়েদি আর দুজন মিস্ত্রির স্ত্রী-প্রথম দফায় তাঁরাই যাবেন—এসে বাগানে অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে একজন অভিজ্ঞ পাইলটের নিয়ন্ত্রণে হেলিবিমান তার উড়াল দেবে। মার্সেল কামারের নির্দেশে, জনাবারো কর্মী গেছে হ্যাঙারের দিকে, গিয়ে দরজা খুলেছে…

সেটাই ছিলো সর্বনাশের মুহূর্ত—যে-দুর্বিপাকের কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।

ঠিক যে-মুহূর্তে দরজাটা খুলেছে, সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজে সমস্ত-কিছু কেঁপে উঠেছে। পুরো হ্যাঙারটাই তাশের প্রাসাদের মতো হুড়মুড় ক’রে ধ্ব’সে পড়েছে, যেখানে আস্ত-একটা বাড়ি ছিলো সেখানে এখন শুধু রাবিশের স্তূপ।

স্তম্ভিত ভাবটা কেটে যেতেই সবাই ছুটে গিয়েছেন কর্মীদের সাহায্যে। ভাগ্যিশ, তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে সামনে ছিলো, বিস্ফোরণে সে-ই একটু জখম হয়েছে, অন্য-কারু গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি, তারা হ্যাঙারের মধ্যে ঢোকবার আগেই বিস্ফোরণটা হয়েছে ব’লেই বাঁচোয়া।

যদিও কেউ বিশেষ আহত হয়নি বা মারা যায়নি, বিলাপের তবু কারণ ছিলো : প্রচণ্ড-একটা দুর্বিপাক এটা, অপ্রত্যাশিত ব’লেই এত-নিদারুণ, অপূরণীয় একটা ক্ষতি। হেলিবিমানটা শুধু নষ্টই হয়নি, একেবারে ধূলিসাৎ হ’য়ে গেছে। শুধু কতগুলো বাতিল অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল ছাড়া আর-কিছুই নেই সেখানে।

‘রিগো,’ এমন নিদারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে কামারের ধীরস্থিরশান্ত ভঙ্গিটা কিন্তু অটুট আছে, ‘এক্ষুনি আবর্জনা সাফ করবার ব্যবস্থা করো। বিস্ফোরণের কারণটা আমাদের বার করতে হবে।’

যেখানটায় একটু আগেও হেলিবিমানটা ছিলো, সেখানেই সবাই প্রথমে জঞ্জাল সাফ করতে লেগে গেলো। সবাই মিলে হাত লাগিয়েছিলো, কাজটা চললো দ্রুতবেগে। এগারোটা নাগাদ হ্যাঙারের মেঝেটা পুরোপুরি সাফ হ’য়ে গেলো— দেখা গেলো শান-বাঁধানো মেঝের মধ্যে মস্ত-বড়ো একটা গর্ত।

‘ডায়নামাইট,’ ঠাণ্ডা গলায় বললেন কামারে, ‘সে নিশ্চয়ই নিজেই পায়ে হেঁটে এখানে আসেনি।’

আবর্জনাস্তূপের মধ্যে রক্তের দাগ দেখে বোঝা গেছে বিস্ফোরণ শেষ-অব্দি তার বলি নিয়েছে। আরো-দ্রুতহাতে জঞ্জাল সাফের কাজ চলতে লাগলো। আর শিগগিরিই নিদারুণ আবিষ্কারটা সবাইকে মোহ্যমান ক’রে দিলে। মাঝরাতের একটু- আগে, প্রথমে পাওয়া গেলো একজন কালো আফ্রিকির একটা উড়ে-যাওয়া হাত, তারপর এলো আরেকটা, তারপরে একটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন, প্রায় থেঁৎলে-যাওয়া, শরীর, আর মাথাটা।

আমেদে ফ্লরেঁস পুরো ব্যাপারটাই তাঁর সাংবাদিকের চোখে এতক্ষণ দেখে যাচ্ছিলেন, এবার তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘শুমুকি!’

কামারেকে তিনি ব্যাখ্যা ক’রে বললেন এই ৎশুমুকি কে : একজন নিমকহারাম, যাকে মিস ব্লেজন চাকরি দিয়েছিলেন, কিন্তু যাকে ভুলিয়েভালিয়ে হ্যারি কিলার নিজের দলে টেনে নিয়েছিলো। সেটা, বস্তুত, গোটা ব্যাপারটাই ব্যাখ্যা ক’রে দিলে। ৎশুমুকিই এই বিস্ফোরণের কারণ এবং বলি। এখন শুধু এটাই জানা বাকি এত লোকের চোখে ধুলো দিয়ে সে কী ক’রে কারখানার মধ্যে এসে ঢুকেছিলেন। কারণ একজন যদি এসে থাকতে পারে, তবে তার সঙ্গে অন্যরাও যে আসেনি, তারই বা ঠিক কী। এবার শুধু শত্রুপক্ষকে উলটে একটা প্রচণ্ড আঘাত হানার ওয়াস্তা : তাদের প্রাণে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলতে না-পারলে তারা যে এ-রকম কত দুর্বিপাক সৃষ্টি করবে, কে জানে!

সেইজন্যেই কামারে নির্দেশ দিলেন ৎশুমুকির ছিন্নভিন্ন দেহটা এপ্ল্যানেডে ছুঁড়ে ফেলতে—হ্যারি কিলারের স্যাঙাত্রা তাহ’লে চাক্ষুষ দেখতে পাবে তার পরিণামটা কী ভয়ংকর হয়েছে। তারা তাহ’লে এটাও নিশ্চয়ই তাদের মোটা মাথাগুলোয় ঢোকাবে যে কারখানার মধ্যে এসে ঢোকার পরিণাম খুব-একটা আহ্লাদজনক নয়।

এদিকে জঞ্জাল সাফ করার কাজ চললো একটানা। কর্মীরা হাত থেকে হাতে পাচার ক’রে দিচ্ছে আবর্জনা, জঞ্জাল স্তূপ হ’য়ে উঠছে বাগানে, আর হ্যাঙারের বাকি-অংশটাও জঞ্জালের স্তূপ থেকে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে আসছে।

‘এই-যে, এখানে দেখি আরেকজন!’ হঠাৎ কর্মীদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো। মার্সেল কামারে নিজেই এগিয়ে গেলেন। আবর্জনার মধ্যে কার-একজনের একটা পা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মিনিট বাদেই পুরো দেহটাই বেরিয়ে এলো। এবার একজন গোরার মৃতদেহ—ওপর থেকে ছাত ভেঙে প’ড়ে তার কাঁধের হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে।

ডাক্তার শাতোনে তার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ‘এখনও প্রাণ আছে!’

লোকটাকে আবর্জনাস্তূপ থেকে উদ্ধার ক’রে কামারের কাছে নিয়ে-আসা হ’লো, আর ডাক্তার তার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হ’য়ে পড়লেন। কাল যদি সে কথা বলবার মতো অবস্থায় থাকে, তাহ’লে তাকে জেরা করা হবে।

‘অবশ্য যদি সে কথা বলতে রাজি হয়,’ ফোড়ন কাটলেন আমেদে ফ্লরেঁস।

দাঁতে দাঁত চেপে মার্সেল কামারে বললেন, ‘আমি দেখবো কী ক’রে কথা না-ব’লে পারে ও!’

জঞ্জাল সাফ করার কাজটা মোটামুটিভাবে শেষই হ’য়ে গেছে এখন। অন্তত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যে আর-কারু মৃত বা আহত দেহ প’ড়ে নেই, এটা বেশ-নিশ্চিত হওয়া গেছে। মার্সেল কামারে কাজটায় ইতি টেনে দিয়ে কর্মীদের ছুটি দিয়ে দিলেন –বেচারিদের এখন বিশ্রাম দরকার।

আর তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ ক’রেই, বৈজ্ঞানিক ও তাঁর অতিথিরা বিপর্যয়ের স্থান ছেড়ে যে যার আশ্রয়ের দিকে চললেন।

কিন্তু ক-পা এগিয়েই হঠাৎ আমেদে ফ্লরেঁস থমকে থেমে গিয়ে মার্সেল কামারেকে জিগেস করলেন : ‘এখন যখন হেলিবিমান আর নেই, আপনি এখন কী করবেন ব’লে ঠিক করেছেন?’

‘আমরা আরেকটা হেলিবিমান বানিয়ে নেবো,’ কামারে উত্তর দিলেন!

বারজাক জিগেস করলেন : ‘মালমশলা সব আছে তো আপনার?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘কত-দিন লাগবে বানাতে?’

‘দু-মাস।’

‘হুম! শুধু এই আওয়াজটাই হ’লো আমেদে ফ্লরেঁসের উত্তর; প্ৰশ্নটা নিয়ে আর না-ঘাঁটিয়ে তিনি চিন্তিত মুখে স্থানটা পরিত্যাগ করলেন।

দু মাস!… এবং কারখানার মধ্যে কি না আর-মাত্র পনেরোদিনের খাবার আছে!

সাংবাদিকের মাথায় তখন একটাই ভাবনা পাক খাচ্ছে : কী ক’রে এই সংকট থেকে এখন উদ্ধার পাওয়া যায়!