২.০৭ ব্ল্যাকল্যান্ড কারখানা

৭. ব্ল্যাকল্যান্ড কারখানা

তাঁর অতিথিরা আমন্ত্রণ গ্রহণ করবার জন্যে পা বাড়িয়েই ছিলেন।

‘কারখানাটা ঘুরে দেখে আবার আমরা এখানে ফিরে আসবো,’ কামারে জানিয়েছেন। তবে প্রথমে সাধারণভাবে এর ছকটা একটু খেয়াল করুন। পুরো কারখানাটা নদীর ধারে আড়াইশো গজ চওড়া আর তিনশো ষাট গজ লম্বা একটা আয়তক্ষেত্রের ওপর গ’ড়ে উঠেছে। মোটামুটি কুড়ি একর আয়তন; এই পুরো আয়তক্ষেত্রের তিনপঞ্চমাংশ জুড়ে পশ্চিমভাগটায় গ’ড়ে উঠেছে বাগান।

‘বাগান কেন?’ জানতে চেয়েছেন আমেদে ফ্লরেঁস।

‘এরা আমাদের আংশকিভাবে খাদ্য জোগায়, বাকিটা আসে বাইরে থেকে। কাজেই শুধু বাকি অংশটাকে জুড়েই—প্রায় একশো গজ চওড়া, প্রবেশপথটা নদীর ঘাটে—গ’ড়ে উঠেছে আসল কারখানাটা। ঠিক তার মাঝখানে, ঐ মিনারটার তলায়, লম্বায় প্রায় আড়াইশো গজ জায়গা নিয়ে গ’ড়ে উঠেছে ওয়ার্কশপগুলো, আর আমার থাকবার আস্তানা। তার দুই প্রান্তে প্রায় ষাট গজ চওড়া একটা রাস্তা গেছে—সোজা নদীর ধারটাকে লক্ষ্য ক’রে, আর রাস্তার দু-পাশে কর্মীদের কোয়ার্টারগুলো। একেকটা সারে সাতটা ক’রে দালান, চারতলা উঁচু—অর্থাৎ সাকুল্যে একশো কুড়িটা কোয়ার্টার।’

আপনার এখানে কর্মীর সংখ্যা কত?’ বারজাকের জিজ্ঞাসা।

ঠিক একশোজন কাজ ক’রে এখানে, তবে কেউ-কেউ বিয়ে করেছে, আর তাদের কারু-কারু ছেলেমেয়েও আছে। দেখতেই তো পাচ্ছেন ওয়ার্কশপগুলো একতলা সমান উঁচু আর তাদের ছাতের ওপর মাটি বসানো আছে-তাতে ঘাস আছে ফরাশের মতো। মাটির আস্তরটা খুব-পুরু। ফলে, বুঝতেই পারছেন, গুলিগোলা তাদের প্রায় কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এবার মোটামুটি ছকটা তো জেনে গেলেন, এখন আপনারা যদি চান তো নিচে নেমে গিয়ে খুঁটিনাটিগুলো চাক্ষুষ দেখে-আসা যেতে পারে।’

আমন্ত্রণটা গ্রহণ করবার আগে কামারের শ্রোতারা আবার একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছেন আশপাশে। অবস্থার আর-কোনো বদল হয়নি। বোলতাগুলো এখনও চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে সার্কুলার রোডের ওপর, আর হানাদারেরা, ও-রকম নাজেহাল অভিজ্ঞতার পর, আবার সেই গুলিগোলার মধ্যে ঢুকে পড়তে সাহস পাচ্ছে না। আশ্বস্ত হ’য়ে, বারজাক মিশন বৈজ্ঞানিককে অনুসরণ ক’রে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এলো।

মার্সেল কামারের নেতৃত্বে তাঁরা প্রথমে ঘুরে দেখেছেন মিনারের তলদেশ, বৈজ্ঞানিক যাকে বলেছেন মৌচাক, সেখান থেকে, খোপের পর মধ্য থেকে, বেরিয়ে এসেছে বোলতোরা; খোপগুলোর মধ্যে স্তূপ ক’রে রাখা আছে অজস্র গোলাবারুদ। তারপর তাঁরা গেছেন নানাধরনের ওয়ার্কশপে—আর সে-সব দেখে ক্রমাগত বিস্মিত হ’তে-হ’তে তারা এসে পৌঁছেছেন বাগানে, রাজভবন থেকে সবচেয়ে-কাছে এ- জায়গাটা।

কারখানার চারপাশের উঁচু দেয়াল রাজভবনকে অবশ্য তাঁদের চোখ থেকে আড়াল ক’রে রেখেছে। কিন্তু দেয়ালটা থেকে পঞ্চাশ গজ স’রে আসতেই হ্যারি কিলারের মিনারটার গম্বুজ চোখে পড়েছে তাঁদের। আর তক্ষুনি ঐ মিনার থেকে ছুটে এসেছে গুলি, তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে চ’লে গেছে। আমনি তাঁরা দ্রুতবেগে পেছিয়ে এসেছেন।

‘গাড়ল! আকাট!…’ কামারে অস্ফুটস্বরে নিজেকে বলেছেন, তারপর না-থেমেই তিনি শুধু তাঁর হাতটা তুলে ধরেছেন শূন্যে

আর ইঙ্গিতটার পরক্ষণেই এলো হিংস্র একটা হিসহিস শব্দ। তাঁর অতিথিরা কেমন আঁৎকে উঠে তাকিয়েছেন, কারখানার দিকে, কামারে কিন্তু রাজভবনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। রাজভবনের মাথার মুকুটের মতো যে-সাইক্লোস্কোপটা শোভা পেতো, সেটা আর নেই।

‘এটা থেকেই মজা টের পাবে হ্যারি কিলার,’ বৈজ্ঞানিক ব’লে উঠেছেন। ‘উড়াল-টরপেডো আমার আছে! ওর কাছে যতগুলো আছে, আমার কাছে বরং তার চাইতে অনেক-বেশিই আছে-কেননা আমিই তাদের উদ্ভাবন করেছি। আর ঐ সাইক্লোস্কোপ-দরকার হ’লে আমি না-হয় ওকে আরেকটা বানিয়ে দেবো। ব্বাস!

‘কিন্তু মঁসিয়,’ আমেদে ফ্লরেঁস জিগেস করেছেন, ‘আপনি যাকে উড়াল-টরপেডো বলেন আপনার কাছে যেহেতু সেগুলো প্রচুর পরিমাণেই আছে, আপনি সেগুলো হ্যারি কিলারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন না কেন?’

মঁসিয় কামারে একটুক্ষণ শুধু বিহ্বলভাবে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন, তাঁর চোখে একটা বিমূঢ় দৃষ্টি ফুটে উঠেছে। ‘আমি!..’ শেষকালে তিনি কী-রকম যান্ত্রিকসুরে ব’লে উঠেছেন, ‘আমি কিনা শেষে নিজের সৃষ্টিকেই ধ্বংস ক’রে বসবো!’

কথাটা আর না-বাড়িয়ে আমেদে ফ্লরেঁস শুধু তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দৃষ্টি-বিনিময় করেছেন। বিজ্ঞানের সেরা প্রতিভা হ’তে পারেন, কিন্তু আশ্চর্য মানুষটার একটা মস্ত-বড়ো দুর্বলতা আছে, আর তাঁর সেই আকিলিসগোড়ালি হ’লো তাঁর অহমিকা, তাঁর আকাশছোঁয়া দম্ভ।

চুপচাপ তাঁরা হেঁটে গিয়েছেন তারপর, রাজভবন মজাটা টের পেয়েছে। বাগান দিয়ে তাঁরা যতক্ষণ হেঁটে গিয়েছেন, রাজভবন থেকে আর-কোনো আক্রমণ আসেনি। হঠাৎ একটা দরজা খুলে দিয়ে মার্সেল কামারে ব’লে উঠেছেন : ‘এবারে আমরা সবচেয়ে-দুর্দান্ত জায়গায় এসে পড়েছি। এটা ছিলো শক্তির উৎস, কারখানার সমস্ত শক্তি আসতো এখান থেকে—মোটর, আর স্টীমএনজিন আর বয়লার সব ছিলো এখানে, অন্যকোনো জ্বালানি ছিলো না ব’লে আমরা কাঠের আগুন ব্যবহার করতুম। মস্ত ঝামেলার ব্যাপার ছিলো সেটা, কেননা কাঠ আনতে হ’তো অনেকদূর থেকে, আর বেশ বেশি পরিমাণেই ঐ জ্বালানি ব্যবহার করতে হ’তো আমাদের। ভাগ্যিশ ও-অবস্থায় আর বেশিদিন কাটাতে হয়নি! যে-মুহূর্তে আমারই সৃষ্টি-করা মুষলধারে বৃষ্টিতে নদীটা তার খাতের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে উঠে বইতে শুরু করলো, তখন থেকেই হাইড্রো-ইলেকট্রিক স্টেশনটা কাজ করতে শুরু ক’রে দিলো; আমি ততদিনে অন্তত ছ-মাইল জোড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বসিয়ে দিয়েছি। এখন আর আমাদের ঐ সেকেলে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয় না, আর ঐ চোঙগুলো দিয়েই সারাক্ষণ ভলকে ভলকে ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশ কালো ক’রে রাখে না। এই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে যত বিদ্যুৎ আসে, তাতেই আমাদের দিব্বি চ’লে যায় এখন।’

তাঁরা আরো-একটা ঘরে মার্সেল কামারেকে অনুসরণ ক’রে গেছেন।

‘এখানে, আর তারপরের ঘরগুলো—ওগুলোও এ-ঘরটারই মতো ডায়নামো, অলটারনেটর, ট্র্যান্সফর্মার আর কয়েল দিয়ে ভর্তি—এটাই হ’লো বজ্রবিদ্যুতের আস্তর। জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যত বিজলি আসে এখানেই আমরা দরকারমতো তাকে বিভিন্ন ভোল্টে বদলে নিই।’

‘অ্যাঁ?’ আমেদে ফ্লরেঁস স্তম্ভিত হ’য়ে ব’লে উঠেছেন, ‘এত-সব যন্ত্রপাতি কলকব্জা –সব আপনারা মরুভূমিতে আনিয়ে নিয়েছেন!

‘মাত্র কয়েকটাই আনিয়েছি। বেশির ভাগই তো আমরা এখানে বানিয়ে নিয়েছি।’

‘তবু, কাঁচা মাল দরকার হয়েছে তো আপনাদের। এই মরুভূমির মাঝখানে সে-সব আপনারা পেলেন কোত্থেকে?’

মার্সেল কামারে হঠাৎ একটু যে ভাবনাতেই প’ড়ে গেছেন। সত্যি-তো, এই মরুভূমির মাঝখানে এত-সব পাওয়াই বা গেলো কোত্থেকে? এটা তো কোনোদিনই তাঁর মাথায় আসেনি! ‘হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন, মসিয় ফ্লরেঁস। প্রথম যন্ত্রপাতিগুলো এখানে এসেছিলো কী ক’রে, তাছাড়া অন্যগুলো বানাতে যে-কাঁচা মাল লেগেছিলো, তা-ই বা আমরা কোত্থেকে পেয়েছিলুম? আজ কবুল করি, সে- সব প্রশ্ন নিয়ে আমি কোনোদিনই মাথা ঘামাইনি : আমি শুধু জিনিশগুলো চেয়েছি, ক-দিন বাদেই সে-সব হাতে পেয়ে গেছি। কোত্থেকে, কীভাবে এলো, সে-সব তলিয়ে দেখিনি। এখন যখন আপনি এ-বিষয়টায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন…’

‘আর লোকজনকেও বা কত কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে, মরুভূমির মধ্য দিয়ে ওগুলোকে ব’য়ে আনতে-যতক্ষণ না আপনারা হেলিবিমান বানিয়ে নিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ, সেও সত্যি,’ স্বীকার করেছেন কামারে। তাঁকে কী-রকম বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ‘আর, টাকা? এ-সব কিনতে নিশ্চয়ই কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ টাকা লেগেছে!’

‘টাকা?’ কামারে কেমন ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়েছেন।

‘হ্যাঁ, টাকা। আপনি নিশ্চয়ই রাজা-বাদশার ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন!’

আমি?… রাজা-বাদশার ধনসম্পত্তি?…উঁহু, এখানে যখন এসেছি, তখন আমার পকেটে পাঁচ সেটাইমও ছিলো কি না সন্দেহ!’

‘তাহ’লে?’

‘সবই হ্যারি কিলার…’ কেমন যেন থতমত-সুরে শুরু করেছেন কামারে। ‘হ্যাঁ, না-হয় হ্যারি কিলারই দিয়েছে, কিন্তু সে ঐ টাকা পেলো কোত্থেকে? সে কি কোনো ধনকুবের ক্রোড়পতি না কি আপনার এই হ্যারি কিলার?’

কামারে কেমন অসহায়ভাবে হাত উলটে নিজের অজ্ঞতা কবুল করেছেন। এই প্রশ্নটা আচমকা যেন তাঁকে একেবারেই পেড়ে ফেলেছে, আর আবার তাঁর চোখে ফুটে উঠেছে সেই অদ্ভুত শূন্যদৃষ্টি, যেন তিনি কোনো মরলোকের জীবই নন। এ-সব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর যা হ’তে পারে, তা তাঁকে যেন দুম ক’রে হঠাৎ রূঢ় ক্রূর বাস্তবের মুখোমুখি ক’রে দিয়েছে। এমনতর কোনো হেঁয়ালির জট তাঁকে কোনোদিনও ছাড়াতে হয়নি। তাঁর সামনে এখন এমন-একটা দিগন্ত উন্মোচিত হ’য়ে গেছে, তার সামনে তিনি কেমন যেন বিহ্বল বোধ করেছেন, অসহায়। এমন ব্যাকুল, কাতর, নিঃস্ব, নিঃসহায় দেখাচ্ছিলো তাঁকে যে শেষটায় ডাক্তার শাতোনের মনে সহানুভূতির বান ডেকে গেছে। ‘এই ব্যাপারগুলো না-হয় অন্য-সব জটিল প্রশ্নের সঙ্গেই পরে মীমাংসা ক’রে নেয়া যাবে,’ ডাক্তার শাতোনে বলেছেন, ‘এ নিয়ে এখন সারাদিন মাথা ঘামাবার কোনোই দরকার নেই। বরং কারখানাটাই ভালো ক’রে দেখে নেয়া যাক।’

যেন মাথার মধ্য থেকে উৎকট-একটা চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন কামারে। চুপচাপ গিয়ে পরের ঘরটায় ঢুকেছেন। ‘এখানে,’ এখনও তাঁর গলায় কেমন-একটা দ্বিধাকাতরতা। ‘এখানে এই-যে সব কলকব্জা দেখছেন, এগুলো হ’লো কম্প্রেসার। আমরা এখানে তরল গ্যাস নিয়ে কারবার করি। আপনারা হয়তো জানেন যে, সব গ্যাসকেই তরল ক’রে নেয়া যায়—অন্তত যতক্ষণ তাকে যথাসম্ভব সংকুচিত ক’রে রাখা যায় আর তাপমাত্রা খুব-নিচু থাকে। কিন্তু যে-মুহূর্তে এই তরলকে নিজের মর্জিমাফিক চলতে দেখা যায়, সে গরম হ’য়ে ওঠে আর আগের মতোই ফের গ্যাস হ’য়ে ওঠবার চেষ্টা ক’রে। তখন তারা যদি কোনো চারপাশ- আটকানো পাত্রের মধ্যে থাকে, সেটাকে ফাটিয়ে চুরমার ক’রে দিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

‘আমার একটা উদ্ভাবন সে-সমস্তকেই বদলে দিয়েছে। বস্তুত আমি এমন-একটা পদার্থ আবিষ্কার করেছি যেটা সম্পূর্ণ অ্যান্টিডায়াথার্মিক—উত্তাপের সংস্পর্শে এলে তার কিছুই হয় না। তার ফলে, কোনো তরল গ্যাস—ধরুন হাওয়া—এই পদার্থের তৈরি কোনো কৌটোয় যদি থাকে, তাহ’লে ককখনো আর তাপমাত্রার বদল হবে না সবসময়েই তার তাপ একই থাকবে। কাজেই সে তরলই থেকে যায়, বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়বার সম্ভাবনা আর থাকে না। এই উদ্ভাবনটা আমাকে পরে অন্য-কতগুলো উদ্ভাবনের ব্যাপারে দারুণ সাহায্য করেছিলো—এটা থেকেই বাকিগুলো গজিয়েছে। বিশেষ ক’রে ঐ দূরপাল্লার হেলিবিমানগুলো, যাদের কথা আপনারা জানেন।

‘আমরা জানি!’ আমেদে ফ্লরেঁস বুঝি আর্তনদাই ক’রে উঠেছেন। ‘জানি, মানে হাড়ে হাড়ে জানি! তাহ’লে ঐ হেলিবিমানগুলো আপনিই বানিয়েছেন!’

‘কে বানিয়েছে ব’লে ভেবেছিলেন আপনি?’ উলটে প্রশ্ন করেছেন কামারে– আবারও তাঁর তীব্র অহংকারের বোধ ফিরে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই অবশ্য তাঁর কথায় কোনো মানবিক বোধেরই ছাপ থাকেনি, নিরাসক্তভাবেই বলেছেন, ‘আমার হেলিবিমানগুলোর তিন-তিনটে বিশেষ বৈশিষ্ট আছে। যখন উড়াল দেয় তখন টালমাটাল না-ক’রে যেমনভাবে ভেসে থাকতে পারে হাওয়ায়, উড়াল শুরু করবার ধরনটা, আর তাদের চালকশক্তি সংক্ষেপেই আমি বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করবো।

‘ধরুন, একটানা সমানভাবে হাওয়ায় ভেসে থাকবার ক্ষমতা। যখন কোনো পাখি দমকা হাওয়ার পাল্লায় এসে পড়ে, তখন তার ভারসাম্য বজায় রাখবার জন্যে বা ফিরে পাবার জন্যে জটিল-কোনো হিশেব করতে হয় না তাকে। তার স্নায়বিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই এমন-একটা স্বভাবদোল আছে, যার সাহায্যে অনায়াসেই তারা ভারসাম্য ফিরে পায়। আমার যান্ত্রিক পাখির এই ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতাকে স্বয়ংক্রিয় ক’রে তোলবার জন্যে আমি তাকে কতগুলো স্বভাবদোল দিতে চেয়েছি। দেখেছেন নিশ্চয়ই হেলিবিমানগুলোকে দুটো ক’রে পাখা দেয়া হয়েছে, পনেরো ফিট উঁচু দুটো খুঁটির মাথায় সেগুলো বসানো। যে-প্ল্যাটফর্মটায় মোটর বসানো আছে, পাইলটের বসবার জায়গা আছে আর যাত্রীদের বসবার জায়গা আছে, সেখান থেকেই ঐ খুঁটি উঠেছে। এই ব্যবস্থার ফলে অভিকর্ষের কেন্দ্র অনেকটাই নেমে আসে। ‘ঐ খুঁটি কিন্তু মোটেই স্থিরভাবে পুঁতে দেয়া নেই—ঐ পাখার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। যদি তাকে হালের সঙ্গে ঠিকমতো জুড়ে দেয়া না-থাকে, সে ইচ্ছেমতো লম্বমানভাবে নিজের কক্ষেই যে-দিকে খুশি আবর্তিত হ’তে পারে, পাক খেতে পারে। কাজেই, হালের গতিবিধি বাদ দিলে, পাখা যদি সামনে বা পাশে গোঁত্তা খায়, তখন খুঁটিটা নিজের ওজনেই বাধ্য হয় তাদের সঙ্গে নতুন-একটা কোনাকুনি সম্পর্ক তৈরি করতে। এভাবে ন’ড়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে ভর এসে যায় পাখার সমান্তরভাবে অথবা উল্লম্বভাবে, আর পাখাগুলোকেও তার সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের আন্দোলনকে শুধরে নিতে হয়। সেটাই তৎক্ষণাৎ, আপনা থেকেই, হেলিবিমানের আকস্মিক দোলাচলকে শুধরে দেয়।’

মাটির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে সহজ ভঙ্গিতে মার্সেল কামারে কথাগুলো বলেছেন যে মনে হয়েছে কোনো পণ্ডিত অধ্যাপক যেন ক্লাসে ছাত্র পড়াচ্ছেন। একটুও তো-তো করতে হয়নি তাঁকে, কথা হাড়াতে হয়নি থেমে গিয়ে, কথাগুলো যেন অনায়াসেই সহজ ছন্দে তাঁর জিভের ডগায় এসে যাচ্ছে। ঐ একই ভঙ্গিতে তিনি কিন্তু ব’লেই চলেছেন :

‘এবার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটার কথায় আসা যাক। মাটি থেকে উড়াল দেবার সময় হেলিবিমানের পাখাগুলো নামানো থাকে, আর খুঁটিটাকে জড়িয়ে থাকে তারা। তখন চাকার অক্ষ, পাখার তুলনায় উল্লম্বভাবে লম্ববান ভঙ্গিতেই পাক খেতে পারে, আর টেনে ওঠায় তখন বিমানকে, আকাশে উঠে যাবার পর চাকাটা উল্লম্বভাব থেকে আবার সটান শয়ান হ’য়ে যায়। এই যন্ত্র তা-ই একটা হেলিকাপ্টার হ’য়ে ওঠে, আর এই চাকার একমাত্র কাজ হয় তাকে ঝুলিয়ে রাখা। তারপর যখন যথেষ্ট উচ্চতায় উঠে যায়, হেলিবিমানের পাখাগুলো খুলে ছড়িয়ে যায় দু-পাশে আর তখন তার সঙ্গে তাল রেখেইে চাকার অক্ষদণ্ড সামনে ঝুঁকে প’ড়ে দিগন্তশায়ী হ’য়ে যায়। আস্তে-আস্তে এই চাকা চলবার শক্তি জোগায়, আর হেলিকাপ্টার হ’য়ে ওঠে আকাশযান, এয়ারোপ্লেন।

আর তাকে যা চালায়, তা হ’লো তরল গ্যাস। জ্বালানির ট্যাঙ্কটা গড়া ঐ অ্যান্টি-ডায়াথার্মিক পদার্থতে যার কথা আমি আগেই বলেছি; পর্যায়ক্রমে কতগুলো ভালভের মধ্য দিয়ে ব’য়ে যায় তরল বাতাস, একটা নিয়মিত ছন্দে, তারপর এসে পৌঁছায় একটা নলে, যেটাকে সবসময়েই গরম রাখা হয়। তরল বাতাস অমনি তার গ্যাসের আকার ফিরে পায়, প্রচণ্ড একটা চাপ দেয়, আর মোটরকে বনবন ক’রে চালায়।’

‘এই হেলিবিমানের দ্রুততম গতি কী?’ জিগেস করেছেন আমেদে ফ্লরেঁস।

‘তিনহাজার মাইল অব্দি, নতুন জ্বালানি বিনাই, ঘণ্টায় আড়াইশো মাইল।’

নিল মিরারি, বলেছেন হোরাস, কোনোকিছুতেই আশ্চর্য হোয়া না। কিন্তু কামারের শ্রোতারা তাঁদের মুগ্ধতা চেপে রাখতে পারেননি। মিনারে ফিরে আসতে-আসতে কোনো কথাই তাঁদের কাছে তাঁর প্রতিভার যথার্থ প্রশংসা ব’লে মনে হয়নি। কিন্তু এই অদ্ভুত মানুষটা মাঝে-মাঝে অসহ্য অহংকারে ফেটে পড়েন বটে, এখন কিন্তু তাঁদের এই অকুণ্ঠ প্রশংসায় মোটেই কোনো কর্ণপাত করেননি, যেন তাঁর প্রতিভাকে তারিফ করার যোগ্যতা একমাত্র তাঁর নিজেরই আছে।

‘এখন আমরা ক্রমেই এসে পড়েছি কারখানার হৃৎপিণ্ডেরই কাছে,’ মিনারটায় পৌঁছে তিনি বলেছেন। ‘এই মিনারটার ছটা তলা ভাগ করা—প্রত্যেক তলাতেই এই একইরকম যন্ত্রপাতি আছে। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে এর চুড়ো থেকে একটা মস্ত উঁচু ধাতুর খুটি আকাশে উঠে গেছে। এই খুঁটিটা হ’লো তরঙ্গপ্রক্ষেপক, এই মিনারটায় এমনি পশুর গায়ের রোঁয়ার মতো আরো অনেকগুলো তরঙ্গপ্রক্ষেপক আছে—সেগুলো ছোটো ছোটো প্ৰক্ষেপযন্ত্র—আকারটা শুঁড়ের মতো।’

‘কী বললেন? তরঙ্গপ্রেক্ষপক?’ জিগেস করেছেন ডাক্তার শাতোনে।

‘আমি, আপাতত, আপনাদের পদার্থবিদ্যা গুলে খাওয়াবার চেষ্টা করছি না,‘ মৃদু হেসে বলেছেন মার্সেল কামারে। তবে ভৌতবিজ্ঞানের কতগুলো সূত্ৰ মনে রাখা খুবই জরুরি। হাটৎস নামে জনৈক জার্মান পদার্থবিদ কিছুদিন আগে লক্ষ করেছিলেন যে কোনো কনডেনসারের দুটো প্রেরণকেন্দ্রের মধ্যেকার সামান্য ফাঁকটা দিয়ে যখন কোনো কুণ্ডলিপাকানো পরিবাহী তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের ফুলকি ছোটে— কনডেনসার না ব’লে তাকে রেসনেটার বলতে পারেন, অসিলেটরও বলতে পারেন—ঐ ফুলকিযন্ত্রটার দুই বিপরীত মেরুবিন্দুতে একটা ঘূর্ণমান বিদ্যুতের তরঙ্গ ছিটোয়।

‘এই-দুইয়ের মধ্যে যে-ফাঁকটা আছে তাকে পেরিয়ে যায় একান্তর এক তরঙ্গ প্রবাহ, কিংবা অন্যভাবে বলতে পারি, দুই মেরুবিন্দু একান্তরভাবে একবার ধন্যাত্মক আর একবার ঋণাত্মক হ’য়ে ওঠে—যতক্ষণ-না বিদ্যুৎ ছিটেবার পর আবার তা তার সমতায় ফিরে আসে। এই ঘূর্ণির গতি, যাকে ফ্রিকোয়োন্সিও বলে, দুর্বার হ’য়ে উঠতে পারে, একটা সেকেন্ডে অর্বুদ বার এই যাওয়া-আসা চলতে পারে ধনাত্মক আর ঋণাত্মকে।

‘যে-সব বিন্দু থেকে এ-সব ঘূর্ণিগতির উদ্ভব হয়, গতিটা কিন্তু শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পক্ষান্তরে এরা তাদের পরিবেশের মধ্যে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে, হাওয়ায় কিংবা আরো-যথাযথভাবে বলতে গেলে, সেই অগাধ-তরলে যা আন্তর্নাক্ষত্রিক পরিবেশটা ভ’রে রেখেছে, যাকে আমরা বলি ঈথার। প্রত্যেক কম্পনের তাই একটা প্রতিকল্প ওঠে ঈথারেও-আর এই প্রতিকম্প তাকে ছড়িয়ে দেয় আরো দূর-দূরান্তরে। এই কম্পনগুলোকে তাই সংগতভাবেই বলে হাসীয় তরঙ্গ। আমি যা বলতে চাইছিলুম, বোঝা গেছে তো?’

‘চমৎকার!’ বলেছেন বারজাক। তিনি রাজনৈতিক নেতা হিশেবে দুর্দান্ত হ’তে পারেন, কিন্তু বিজ্ঞানের রহস্য সম্বেেন্ধ তাঁর প্রস্তুতি বিশেষ-কিছুই নেই।

‘শুধু আমি ছাড়া,’ বৈজ্ঞানিকের বয়ান তখনও ফুরোয়নি, ‘এই বিদ্যুত্তরঙ্গগুলো অন্যদের কাছে ছিলো নিছকই গবেষণাগারের বিস্ময়। ওদের দিয়ে, কোনো কিছুকে না-ছুঁয়েই, বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত ধাতুর জিনিশকে বিদ্যুতাহত ক’রে দেয়া হ’তো। এই তরঙ্গগুলোর একটা দোষ-তারা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে চায়। দিঘিতে কোনো ঢিল ছুঁড়লে যেমনভাবে গোল হ’য়ে ঢেউ ছড়িয়ে যায় চারপাশে। ফল যেটা হয়, যত দূরে চ’লে যায়, ততই তা দুর্বল হ’তে-হ’তে মিলিয়ে যায়। কাজেই একেবারে কাছে যে-ঢেউগুলো থাকে, সেগুলো ছাড়া অন্য ঢেউগুলোর কাছ থেকে বিশেষ-কোনো সাড়া পাবারই উপায় থাকে না। যদিও লোকে লক্ষ করেছে এই ঢেউগুলোকে আলোয় প্রতিফলিত করা যায়, তবু আমি ছাড়া আর-কেউ তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেনি। কিন্তু আমি যে অতিপরিবাহী এক ধাতু আবিষ্কার করেছিলুম তারই সাহায্যে – ঐ যে ধাতুটা দিয়ে আমি ঐ দেয়ালের ওপরকার দিকটা আগাগোড়া মুড়ে দিয়েছি –আমি এমন-কতগুলো প্রতিফলক অর্থাৎ রিফ্লেকটার তৈরি করেছি যার সাহায্যে আমি যেদিকে খুশি ঐ ঢেউয়ের শক্তিকে সংহত ক’রে আনতে পারি।

‘তাদের আদিশক্তিটাকে তাই অন্তরিক্ষে পুরোপুরি পাঠিয়ে দেয়া যায়—যেদিকে খুশি, যেহেতু তাদের যাবতীয় ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়তে গিয়ে অপচয়িত হ’য়ে যায়নি। এ-সব ঘূর্ণিকম্পনের পরম্পরার মধ্যে বিভিন্ন তারতম্য প্রতিষ্ঠার কথা আগেই জানা ছিলো। আমি শুধু তৈরি করেছি গ্রাহকযন্ত্র, রীসিভার, যেটা শুধু এক বিশেষ দ্রুতস্পন্দনেই সাড়া দেয়। যে-দ্রুতস্পন্দনটাকে ধরবে ব’লে ঐ গ্রাহকযন্ত্র তৈরি করা হয়, সে শুধু ঐ দ্রুতস্পন্দন এলেই তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। এখন ঐ দ্রুতস্পন্দন অজস্র ধরনের ও সংখ্যার হ’তে পারে। সে-কথা মনে রেখে আমিও অনেক মোটর বানাতে পারবো, যার মধ্যে এমন-দুটো থাকবে না যারা একই সঙ্গে দ্রুতস্পন্দনকে ধরতে চাইবে-প্রত্যেকটা মোটর থাকবে আলাদা-আলাদা দ্রুতস্পন্দনে সাড়া দেবার জন্যে তৈরি।

তাদেরই সাহায্যে আমরা অগুনতি যন্ত্র বানিয়েছি কৃষিকর্মের জন্যে, যারা দূর থেকেই তাদের শক্তি শুষে নিতে পারে, এই মিনারের ওপরে রোঁয়া ফুলিয়ে আছে যে সব প্রেরকযন্ত্র, প্রক্ষেপক, অর্থাৎ প্রজেকটার, তারা যে-দ্রুত কম্পন ছড়িয়ে দেয়, দূর থেকেই তারা সে-সব টেনে নিতে পারে। ঠিক এইভাবেই আমরা বোলতাগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করি। প্রত্যেকটার চারটে ক’রে চাকা আছে, প্রত্যেকটারই আছে খুদে-খুদে চারটে মোটর, বিশেষ-বিশেষ দ্রুতস্পন্দনের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে তৈরি—যখন-ইচ্ছে এক বা একাধিক মোটরকেই আমরা যুগপৎ চালিয়ে দিতে পারি। এই ছন্দমেলানো গ্রহণপ্রেরণকে বলে সিটোনাইজেশন। এর সাহায্যে, দরকার হলে, এই আস্ত শহরটাকেই আমি উড়িয়ে দিতে পারবো।’

‘এখান থেকেই আপনি আস্ত শহরটা উড়িয়ে দিতে পারবেন?!’ সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠেছেন বারজাক।

‘খুব সহজেই। হ্যারি কিলার আমাকে বলেছিলো একে অভেদ্য বানিয়ে দিতে- এবং আমি একে অভেদ্যই বানিয়েছি। প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বাড়ির নিচে, রাজভবনের নিচে, এমনকী এই কারখানারও নিচে আছে প্রচণ্ডশক্তিশালী সব বিস্ফোরক, প্রত্যেকটির সঙ্গে জুড়ে দেয়া আছে একটি ক’রে ডেটোনেটার, এমন দ্রুতস্পন্দনের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে সিটোনাইজ করা যার কথা শুধু আমিই জানি। শহরটা উড়িয়ে দিতে হ’লে আমাকে শুধু প্রতিটি বিস্ফোরককে উদ্দেশ ক’রে তার ডেটোনেটারের সঙ্গে মেলানো দ্রুতস্পন্দন ছড়িয়ে দিতে হবে।’ আমেদে ফ্লরেঁস জ্বরাতুর হাতে তাঁর নোটবইতে সব টুকে নিচ্ছিলেন ঘস ঘস ক’রে, একবার চকিতের জন্যে তাঁর মনে হ’লো, ব’লে দেখবেন নাকি, এখুনি হ্যারি কিলারকে উড়িয়ে দিতে! কিন্তু তাঁর অমনি মনে প’ড়ে গেছে যখন উড়াল-টরপেডো ছুঁড়ে রাজভবন উড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন তখন বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে আদৌ কোনো সাড়া পাননি। ফলে চুপ ক’রে থাকাই তাঁর কাছে সমীচীন মনে হয়েছে।

‘আর মিনারের ওপরকার ঐ মস্ত খুঁটিটা?’ জিগেস করেছেন ডাক্তার শাতোনে। ‘হ্যাঁ, এটার কথা ব’লেই আমি আপাতত আলোচনাটা শেষ করবো। এটা ভারি অদ্ভুত যে ঐ তথাকথিত হাসীয় ঢেউগুলো এমনভাবে কাজ করে যেন তারা মাধ্যাকর্ষণের টানের এক্তিয়ারে পড়ে : যেখান থেকে ঐ ঢেউ বেরিয়ে আসে, তার প্রতি আকৃষ্ট হয় তারা, আস্তে-আস্তে মাটি পৃথিবীর দিকে হেলে পড়ে, তারপর সেখানেই মহাশূন্যে হারিয়ে যায়। ফলে যদি খুব-দূরে তাদের পাঠাতে হয়, তবে উপযুক্ত উচ্চতা থেকেই তাদের পাঠাতে হবে। আমার উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে সেটা আরো-বেশি জরুরি –কারণ আমার লক্ষ্য হচ্ছে তাদের খুব-দূরে পাঠানো নয়, বরং আরো-উঁচুতে পাঠানো – আর সেটা আরো অনেকবেশি কঠিন কাজ। কিন্তু আমি তা করতে পেরেছি অসিলেটার বা স্পন্দনযন্ত্রের সঙ্গে লাগানো একশোগজ উঁচু একটা খুঁটির সাহায্যে, আর তার সঙ্গে ঐ খুঁটির ওপর অবশ্য বসিয়ে দিতে হয়েছে জোরালো-একটা প্রতিফলক।’

আপনি ওপরদিকে ঢেউ পাঠাতে চান কেন?’ জিগেস করেছেন আমেদে ফ্লরেঁস।

‘যাতে বৃষ্টি বানাতে পারে। হ্যারি কিলারের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন এর মূল তত্ত্বটা আমার মাথায় খেলে গিয়েছিলো, আর এই তাত্ত্বিক চিন্তাকে কাজে তর্জমা করতে সে আমায় সাহায্য করেছিলো। ঐ খুঁটি আর প্রতিফলকের সাহায্যে আমি মেঘের পানে পাঠিয়ে দিই ঢেউগুলো, আর যে-বৃষ্টির ফোঁটা ঐ মেঘের মধ্যে আছে তাকে বিদ্যুতাহত ক’রে জলকণায় পরিণত ক’রে দিই। যখন মেঘ আর পৃথিবীর মধ্যে সম্ভাব্যতার তারতম্য ঘটে কিংবা আশপাশের মেঘ বিশাল হ’য়ে ওঠে, তখনই ঝড় ফেটে পড়ে, বৃষ্টি নামে। এই রুক্ষ মরুভূমি যেভাবে সোনাফলানো মাটিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেটাই এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা প্রমাণ ক’রে দেবার জন্যে যথেষ্ট।’

‘কিন্তু মেঘ চাই তো তার জন্যে,’ ডাক্তার শাতোনের জিজ্ঞাসা।

‘স্বভাবতই—অন্তত, মেঘ না-হয়, ভেজা স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া চাই, আর্দ্রতা চাই। কিন্তু মেঘ তো একদিন এখান থেকে উড়ে যাবেই। আমাদের সমস্যা হ’লো, অন্য-কোথাও বৃষ্টি হ’লে নেমে না-প’ড়ে সে যাতে এখানেই নামে। এখন যখন জমিটায় চাষ-আবাদ চলেছে, গাছপালাও গজাতে শুরু করেছে, এখন স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, মেঘও আসছে ঘন-ঘন। যেই মেঘ আসে, আমাকে শুধু একটা বোতাম টিপে দিতে হয়, তার তখুনি হাজার অশ্বশক্তির বিদ্যুত্তরঙ্গ অগুনতি কম্পনের বোমা ছোঁড়ে ঐ মেঘে।’

‘চমৎকার!’ শ্রোতারা সমস্বরে তারিফ ক’রে উঠেছেন।

ঠিক এইমুহূর্তে, যদিও আপনারা কোনোভাবেই সেটা দেখতে পাচ্ছেন না, ‘ নিজের আবিষ্কারের কথা বলতে-বলতে ক্রমেই উত্তেজিত হ’য়ে উঠেছেন মার্সেল কামারে, ‘এই খুঁটির ওপর থেকে অবিশ্রাম বিদ্যুত্তরঙ্গ বেরিয়ে গিয়ে অনন্ত অসীমের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তাদের জন্যে আরেকটা ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারি। আমার মনে হয়, আমি জানি, আমার বিশ্বাস যে ঐ হারানো বিদ্যুৎত্তরঙ্গ গুলোকেও কত-শত ভিন্ন-ভিন্ন কাজে লাগানো যাবে। যেমন, সারা পৃথিবীতে, এ- প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে, টেলিগ্রাফ কিংবা টেলিফোন মারফৎ, আর তার জন্যে বিভিন্ন স্টেশনের মধ্যে যোগসূত্র করার জন্যে কোনো তারই লাগবে না।’

‘কোনো তার বিনাই!’ শ্রোতারা সবিস্ময়ে ব’লে উঠেছেন।

‘কোনো তার বিনাই। তার আমাদের দরকার হয় কেন? যতটুকু কাজে লাগে, সে তো নেহাৎই সামান্য। আমাকে শুধু একটা মানানসই রীসিভার বানিয়ে নিতে হবে—আমি সেটা নিয়েই কাজ করছি, এখন, প্রায় ধ’রে ফেলেছি সমাধানের সূত্রটা, কিন্তু এখনও তাকে ঠিকমতো বাগে আনতে পারিনি।’

বারজাক বিমূঢ় গলায় বলেছেন, ‘আমরা কিন্তু এখনও অন্ধকারেই র’য়ে গেছি!’

‘কিন্তু তার চাইতে সহজ আর-কিছুই নেই,’ কামারের উত্তেজনা আরো দপদপ ক’রে উঠেছে। ‘এই দেখুন, এটা একটা মর্স-উদ্ভাবিত যন্ত্র, যে-ধরনের যন্ত্র সাধারণ টেলিগ্রাফে ব্যবহার করা হয়, এটাকে আমি পরীক্ষামূলকভাবে এক বিশেষ বিদ্যুৎপ্রবাহের আবর্তে রেখেছি। শুধু এই বোতামগুলো টিপলেই ঢেউ বানায় যে- বিদ্যুতের স্রোত, তার সঙ্গে এই আবর্তের, এই বিশেষ সার্কিটের, যোগাযোগ হ’য়ে যাবে। মর্স-এর চাবি যখন তোলা থাকে, হাসীয় তরঙ্গ ছোটে না; যখন সেটাকে চাপ দিয়ে ডেবে দেয়া হয়, তখনই খুঁটির মাথা থেকে তরঙ্গদল বেরিয়ে পড়ে।

‘কিন্তু বেরিয়ে আকাশে চ’লে যায় না, বরং ছুটে যায় কল্পিত ঐ রীসিভারটার দিকে। সেটা সম্ভব হয় প্রতিফলকটাকে রীসিভারের দিকে ঘুরিয়ে দিতে—সেটা প্রতিফলকটা প্রবাহকেন্দ্র। কোনদিকে খবর পাঠানো হবে, তা যদি জানা না থাকে, তবে শুধু প্রতিফলকটাকেই বিচ্ছিন্ন ক’রে দিলেই চলবে—সেটা আমি করতে পারি এই অন্য বোতামটা টিপে। এখন, এই পাঠিয়ে দেয়া বিদ্যুত্তরঙ্গ পৃথিবীর দিকে- দিগন্তরে-সব-দিকেই ছড়িয়ে পড়বে আর আমি মর্স-সংহিতার চাবি টিপে নিশ্চিত হ’তে পারবো এটা গিয়ে রীসিভারে পৌঁছুবে-যদি সে-রকম কোনো রীসিভার থাকে—তা সে যেখানেই থাকুক। দুর্ভাগ্যবশত, সে-রকম কোনো রীসিভার কোথাও নেই।

‘আপনি টেলিগ্রামের কথা বলেছেন,’ জেন ব্লেজন জিগেস করেছে, ‘সে-কথাটার মানে কী?’

‘সাধারণত লোকে টেলিগ্রাফ বলতে যা-বোঝায় তা-ই। এই বোতামটাকে আমাকে সাধারণভাবে ব্যবহার করতে হবে, আর মর্স-এর বর্ণলিপির সহায়তা নিতে হবে—পৃথিবীর সব টেলিগ্রাফকর্মীই সেই বর্ণলিপি জানে। আচ্ছা, একটা দৃষ্টান্ত দিলেই ব্যাপারটা আরো-সহজ হবে। যদি এই কল্পিত রীসিভারটা কোথাও থেকে থাকে, তাহ’লে অপানি কি প্রথম সুযোগেই টেলিগ্রাফ মারফৎ এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করবেন না?’

‘সে-সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না!’ বলেছে জেন।

‘আচ্ছা, ধরুন, অমন-কোনো রীসিভার আছে,’ কামারে ঐ মর্সের যন্ত্রের কাছে ব’সে প’ড়ে বলেছেন, ‘সেক্ষেত্রে কাকে আপনি টেলিগ্রাফে খবর দিতে চান?’

‘এমন-একটা দেশে আছি, যেখানে কাউকেই আমি চিনি না, কাকে আর তাহ’লে টেলিগ্রাফ করবো?’ হেসে ফেলেছেন জেন। পরক্ষণে লজ্জায় একটু আরক্ত হ’য়ে গিয়ে বলেছে, ‘আমি তো এখানে শুধু কাপ্তেন মার্সেনেকেই চিনি।

ঠিক আছে। কাপ্তেন মার্সেনেই না-হয় হোক।’ মর্স-সংহিতা তখন তার হ্রস্বদীর্ঘ টরে-টক্কা শুরু ক’রে দিয়েছে। ‘কোথায় আছেন তিনি?’

একটু ইতস্তত ক’রে জেন বলেছে : ‘এখন সম্ভবত টিম্‌বাকটুতেই আছেন।’

‘টিমবাকটু,’ চাবিতে টরেটক্কা ক’রে কামারে বলেছেন। ‘তা, এই কাপ্তেন মার্সেনেকে আপনি ঠিক কী কথা বলতে চান? নিশ্চয়ই এ-রকম কিছু, যে, ‘জেন ব্লেজন…’

‘মাপ করবেন,’ জেন তাঁকে বাধা দিয়েছে। ‘কাপ্তেন মার্সেনে আমাকে শুধু জেন মোর্‌নাস হিশেবেই চেনেন।’

‘তাতে কিচ্ছু এসে-যায় না, কারণ এ-বার্তা তো আর কোথাও গিয়ে পৌঁছুবে না; আচ্ছা, তবু না-হয় মোরনাসের নামেই আমরা খবর পাঠালুম। তাহ’লে আমি খবর পাঠাচ্ছি : ‘ব্ল্যাকল্যান্ডের বন্দিনী জেন মোনাসের উদ্ধারে আসুন’…টরে- টক্কা থামিয়ে কামারে আবার বলেছেন : ‘আর এই ব্ল্যাকল্যান্ডের কথা যেহেতু বাইরের পৃথিবীর কারুই জানা নেই, আমি তাই তার অবস্থান জানাবো : ‘অক্ষাংশ ১৫°৫০ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ’…’ টরে-টক্কা ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছেন কামারে। ‘এই যাঃ, হ্যারি কিলার বিদ্যুৎপ্রবাহ কেটে দিয়েছে!’

ধাঁধাটা বুঝতে না-পেরে, তাঁর অতিথিরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাখ্যা ক’রে বলেছেন কামারে : ‘যেমন বলেছি, এই বিদ্যুৎশক্তি আসে প্রায় ছ-মাইল উজানে তৈরি করা এক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। হ্যারি কিলার আমাদের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দিয়েছে।’

‘তাহ’লে যে কলকব্জা সব বন্ধ হ’য়ে যাবে!’ বলেছেন ডাক্তার শাতোনে।

‘তারা আগেই বন্ধ হ’য়ে গেছে,’ উত্তর দিয়েছেন কামারে।

‘আর বোলতাগুলো?’

‘তারা যে মাটিতে আছড়ে পড়েছে, তাতে তোনো সন্দেহই নেই আর!’

‘তাহ’লে হ্যারি কিলার নিজে সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে,’ আৰ্তনাদই বুঝি ক’রে উঠেছে জেন ব্লেজন।

‘সেটা অতটা নিশ্চিত ক’রে বলা যায় না,’ বৈজ্ঞানিক বলেছেন, ‘বরং আমার সঙ্গে মিনারে উঠে আসুন, দেখতে পাবেন তাতে তার খুব-একটা লাভ হয়নি।’

চট ক’রে ওপরতলাগুলো পেরিয়ে এসে তাঁরা এসে ঢুকেছেন সাইক্লোস্কোপের মধ্যে। আগের মতোই, দেয়ালের বাইরেটা চোখে পড়েছে তাঁদের, এমনকী বাঁধানো ঘটটা শুদ্ধু। তার তলায় প’ড়ে আছে নিশ্চল, কতগুলো বোলতা

এপ্ল্যানেডে দাঁড়িয়ে হর্ষচরিতেরা সোল্লাসে চ্যাচাচ্ছে। আবার তারা হামলার জন্যে প্রস্তুত হ’তে শুরু করেছে। কেউ কেউ মাটিতে নেমে মরা বোলতাগুলোকে ছুঁয়ে দেখছে একটু আগেই সেগুলো তাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া ক’রে দিয়েছিলো। কিন্তু তারা সেগুলোকে ছোঁয়া মাত্র, অস্থির ভয়ে পেয়ে পেছিয়ে এসেছে। ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে ফের তারা পেছিয়ে যেতে শুরু করেছে। কয়েকজন এতই দুর্বল হ’য়ে পড়েছিলো যে পর-পর জ্ঞান হারিয়ে প’ড়ে গেছে মাটিতে

‘ওদের জীবনের জন্যে দুটো সুও দেবো না আমি,’ মার্সেল কামারে ঠাণ্ডা গলায় বলেছেন, ‘এ-রকম যে হ’তে পারে সেটা আমি আগেই জানতুম তাই সেই অনুযায়ী সাবধানতা অবলম্বন করেছিলুম আমি। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন ও বঞ্চিত ক’রে হ্যারি কিলার না-জেনেই, স্বতঃই, ইপসোফ্যাক্টে, এমন- একটা জলকপাট খুলে দিয়েছে যা তরল কার্বন ডায়োক্সাইডের পাত্রগুলোর মুখ খুলে দিয়েছে এখানে, আর তা আবার তরল অবস্থা থেকে গ্যাসে বদলে গিয়েছে, আর ঐ গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারি ব’লে ওখানেই ঝুলে থেকেছে, আর তার আওতায় যারাই আসবে, তারাই দূষিত গ্যাসে দম আটকে মারা যাবে।’

‘বেচারারা!’ জেন ব্লেজন বলে উঠছে।

‘সত্যি ভারি-বেচারা! তাদের সাহায্য করবার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমার যন্ত্রপাতি কলকব্জাগুলোর ব্যাপারে আমি আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করেছিলুম। আজ সকাল থেকেই তরল বাতাস—আমাদের ভাঁড়ারে প্রায় অনিঃশেষ পরিমাণে আছে এই তরল বাতাস—আজ সকাল থেকেই তরল বাতাস শক্তি জোগাচ্ছে এখানে, বিদ্যুতের বদলে যন্ত্রপাতি চালাবে এই তরল বাতাসই। আর সেটা এর মধ্যেই ঘ’টে গেছে, এই বিকল্প ব্যবহারের ফলে এর মধ্যেই ঐ শুনুন যন্ত্রপাতিগুলো আবার চলতে শুরু করেছে। ঐ দেখুন, বোলতাগুলো আবার আকাশে চক্কর দিতে শুরু করেছে?’

বোলতাগুলোর চাকারা আবার তাদের হেঁয়ালিভরা ঘুরন শুরু করেছে, যন্ত্রগুলো ফের পাহারায় বেরিয়েছে, রোদে, চক্কর দিচ্ছে শূন্যে। আর কাণ্ড দেখে বিমর্ষ ও হতভম্ব হর্ষচরিতেরা মৃত সাথীদের ফেলেই রাজভবনের দিকে চম্পট দিতে শুরু করেছে।

মার্সেল কামারে তাঁর অতিথিদের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। তাঁকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে। যেন বিষম ঘাবড়ে গেছেন, যেন প্রচণ্ড উত্তেজিতই, আর তাঁর চোখে আবার দপ ক’রে জ্ব’লে উঠেছে সেই অস্থির আলো। দেমাকে ফুলে গিয়ে, সরল ভঙ্গিতে, ছেলেমানুষের মতো তিনি ব’লে উঠেছেন : ‘এবার তাহ’লে আমরা নাকে তেল দিয়ে শান্তিতে ঘুমুতে পারবো ব’লেই মনে হয়!’