২.০৬ মার্সেল কামারে

৬. মার্সেল কামারে

এই শিষ্টাচার ও সৌজন্যে মুগ্ধ, তাজ্জব ও অভিভূত, ছজন গোরা ও তাদের সঙ্গে কার দুজন কালো, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন—সিঁড়ির পইঠাগুলো বিজলিবাতির আলোয় ঝলমল করছে। প্রায় কুড়িধাপ পেরিয়ে এসে তাঁরা ঢুকলেন দ্বিতীয় একটা হলওয়েতে। মার্সেল কামারে তাঁদের পেছন-পেছন আসছিলেন, এবার তিনি তাঁদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে দ্বিতীয়-আরেকটা দরজা খুলে দিয়ে একপাশে একটু স’রে দাঁড়ালেন, যাতে তাঁর অপ্রত্যাশিত অভ্যাগ্যতরা তাঁর আগে যেতে পারেন।

মস্ত-একটি ঘরে এসে ঢুকলেন অভ্যাগতরা ঘরটা যেন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা কেমন দেখাতে পারে, তারই জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। একটা দেয়ালের একপাশে আছে মস্ত- একটা টেবিল, যেমনতর টেবিলে এনজিনিয়াররা তাঁদের নীল নকশা আঁকেন, বাকি তিনটে দেয়ালভর্তি বইয়ের তাক। এলোমেলো ছড়িয়ে আছে গোটা-বারো চেয়ার, সবগুলোর ওপর বইপত্র আর কাগজ চাপানো। মার্সেল কামারে এমনি-একটা বইকাগজের স্তূপ তুলে নিয়ে মেঝেয় রেখে দিয়ে চেয়ারটায় ব’সে পড়লেন। এই দৃষ্টান্ত দেখে উৎসাহিত হ’য়ে তাঁর অভ্যাগতরাও তাঁর দেখাদেখি চেয়ারগুলো ফাঁকা ক’রে নিয়ে তাতে ব’সে পড়লেন—শুধু মলিক আর তোঙ্গানে সসম্ভ্রমে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘আপনাদের কোন্ কাজে লাগতে পারি, বলুন, মার্সেল কামারের কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হ’লো এমন অপ্রত্যাশিত আগমনের মধ্যে অস্বাভাবিক-কিছুই তিনি দেখতে পাননি।

চেয়ার ফাঁকা ক’রে বসতে যতটা সময় লেগেছে, পলাতকেরা তার মধ্যেই এই আশ্চর্য মানুষটিকে ভালো ক’রে লক্ষ ক’রে নিয়েছেন। যাঁর ঘরে এ-রকম বলা- নেই-কওয়া-নেই এসে চড়াও হয়েছেন, সে কেমনতর মানুষ? দেখে বরং একটু আশ্বস্তই হওয়া গেছে। মানুষটি যে ভারি অদ্ভুত, তাতে কোনো সন্দেহই নেই— এই যাঁকে তোঙ্গানে ‘কামারে’নামে সম্বোধন করেছে; যিনি এমনই নিজের ভাবনায় মশগুল হ’য়ে ছিলেন যে কখন যে ঘাটের পাশে এদের গায়ে গা ঘেঁসে এসেছেন তা অব্দি খেয়াল করেননি, যাঁর ভাবগতিক দেখে মনে হয় এইসব তুচ্ছ পার্থিব ব্যাপারে তাঁর কোনো মাথাব্যথাই নেই; এমন অতর্কিতে-চড়াও-হওয়া অনিমন্ত্রিত অতিথিদের যেমন সহজসরল ভঙ্গিতে স্বাগত জানিয়েছেন সেটাও কম আশ্চর্য নয়।

তবে এ-সব অনুপুঙ্খ যতই অসাধারণ হোক, এর মধ্যে কোনো সাজানো ব্যাপার বা ঘোরপ্যাচ আছে ব’লে মনে হয় না। একধরনের সততা মাখানো আছে তাঁর মধ্যে, একধরনের আশ্চর্য সারল্য, যাঁর ছোটোখাটো মিরকুট্টে শরীরটা দেখে মনে হয় এখন পুরোপুরি বেড়ে ওঠেনি, যেন বয়ঃসন্ধির মুখে এসে দাঁড়ানো কোনো কিশোরের শরীর। না, এই চওড়া প্রশস্ত কপাল যাঁর, যাঁর আয়ত চোখদুটির সরলদৃষ্টি এ-রকম, সে কিছুতেই হ্যারি কিলারের নৈতিক সংসারের মানুষ হ’তে পারে না। অথচ সবকিছু দেখেশুনে বোঝা যাচ্ছে এঁরা দুজনেই একই জীবনযাত্রার শরিক।

‘মঁসিয় কামারে,’ মঁসিয় বারজাক এতক্ষণে আবার তাঁর আত্মবিশ্বাস খানিকটা ফিরে পেয়েছেন, ‘আমরা আপনার কাছে নিরাপত্তা চাইতে এসেছি।’

‘নিরাপত্তা?’কামারে খুব-বিস্মিত ভঙ্গিতেই শব্দটার পুনরাবৃত্তি করেছেন। ‘কার কাছ থেকে, বলুন তো?’

‘এই শহরের প্রভু–কিংবা সর্বেসর্বার হাত থেকে : হ্যারি কিলারের হাত থেকে।’

‘হ্যারি কিলার? প্রভ? সর্বেসর্বা?’ কামারে কেমন হতভম্বভাবে কথাগুলো আউড়েছেন আবার।

‘আপনি জানতেন না যে সে স্বৈরাচারী একনায়ক?’ মঁসিয় কামারের ভাবগতিক দেখে মঁসিয় বারজাকও কম অবাক হননি।

‘না-তো,–’

‘এটা নিশ্চয়ই জানেন যে এখানে একটা শহর আছে?’

‘বাঃ, নিশ্চয়ই!’

শহরটার নাম ব্ল্যাকল্যান্ড–নয় কি?’

‘ওঃ, তাহ’লে ব্ল্যাকল্যান্ড নাম দেয়া হয়েছে?’ শব্দটা যেন জিভের ডগায় চেখে নিলেন কামারে। ‘নাঃ, খুব-একটা মন্দ নাম দেয়নি তো… না, এ-নামটা আমি জানতুম না, তবে ‘আপনি যখন বললেন, এখন তাহ’লে জানি। তবে ও-সব নাম-টামে আমার কিছুই এসে যায় না।’

শহরের নামটা যদি নাও জানেন, এটা নিশ্চয়ই জানতেন, এ শহরে লোক থাকে —জনসংখ্যা খুব-একটা কমও নয়।’

‘বাঃ রে, তা জানবো না কেন,’ শান্তসুরেই বললেন কামারে।

‘তা, কোনো শহর থাকলে সেটা চালাবার জন্যে সংগঠন লাগে—সরকার, বা শাসকসভা।’

‘তা তো নিশ্চয়ই।’

‘ব্ল্যাকল্যান্ডে এই শাসনের দায়িত্ব পুরোপুরি, সবদিক থেকেই, হ্যারি কিলারের হাতে। আর সে এক নিষ্ঠুর, বদমায়েশ, রক্তলোলুপ স্বৈরাচর বৈ আর-কিছু নয়- মাতাল জানোয়ার একটা সে, সম্ভবত বদ্ধউন্মাদ!’

এতক্ষণ মার্সেল কামারে বারজাকের দিকে মুখ তুলেও তাকাননি। এবার তাঁর দিকে যখন মুখ তুলে তাকিয়েছেন, তখন তাঁর চোখে অসহায় একটা বিমূঢ়ভাব ফুটে উঠেছে। কিছুই যেন তিনি বুঝতে পারছেন না। যেন সদ্য তিনি চাঁদ থেকে এসে নেমেছেন পৃথিবীতে অন্যগ্রহের জীব।

‘ওঃ,’ কি-রকম বিমূঢ় ভাবে অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘আপনি এমন ভাষা ব্যবহার করছেন—’

‘হ্যাঁ, যে-বাস্তবটা ফোটাতে চাচ্ছি, তার পক্ষে এ-ভাষার সামর্থ্যে মোটেই কুলোয় না, তা জানি, কিন্তু আগে আমাকে আমাদের পরিচয়টা জানাতে দিন-তাহ’লে হয়তো খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন।’

কামারে যদিও ঘাড় হেলিয়ে সৌজন্যের সঙ্গেই তাঁকে অনুমতি দিয়েছেন, তবু তাঁর ভঙ্গিতে এমন-একটা ঔদাসীন্য ছিলো, যেটা আদৌ তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। জেন ব্লেজনের ছদ্মনামটাই বলেছেন বারজাক, বাকি সকলের পরিচয় দেবার সময় নামের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা কী কাজ করেন তাও বলেছেন। আর সব-শেষে,’ বারজাক বললেন, ‘এ হ’লো তোঙ্গানে, তবে একে-তো আপনি আগে থেকেই চেনেন ব’লে মনে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ,’ অস্ফুট নরমসুরে বললেন কামারে, আবারও তিনি তাঁর চোখ নামিয়ে নিয়েছেন।

‘ফরাশি সরকারের নির্দেশে… আপনি নিজেই নিশ্চয়ই একজন ফরাশি, মঁসিয় কামারে?’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ,’ আবারও সেই নিরাসক্ত অস্ফুটস্বরে বলেছেন বৈজ্ঞানিক।

‘নিদের্শে, বলেছি…ফরাশি সরকারের নির্দেশে আমি আর আমার সহকর্মীরা একটা মিশনে এসেছিলুম, পথে অবিরাম একের পর এক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের…নাইজার অব্দি যাবার কথা ছিলো, কিন্তু যেতে পারিনি—কারণ আমাদের সামনে এ-বাধাগুলো উপস্থাপিত করেছিলো, আবারও বলছি, একের পর এক, সে ঐ হ্যারি কিলার।’

‘কিন্তু সে তা করতে যাবে কেন?’ অবশেষে কামারে একটা আপত্তি তুলেছেন।

‘যাতে আমরা নাইজারে যেতে না-পারি। কারণ হ্যারি কিলার চায় তার এই ডেরাটার কথা কেউ না জানে। সেইজন্যেই সে আফ্রিকার এদিকটায় আমাদের ঢুকতে দিতে চায়নি। তার ভয় হচ্ছিলো, আমার হয়তো ব্ল্যাকল্যান্ডের কথা জেনে ফেলবো। ইওরোপে কেউই জানে না যে এ-রকম কোনো দেশ আছে!’

‘এ আপনি কী বলছেন?’ হঠাৎ যেন কামারের ঔৎসুক্য চুলবুল ক’রে উঠলো। ‘কিন্তু জানবে বা কেন? ইওরোপে নিশ্চয়ই জানবে—এখান থেকে কত কর্মীই তো কাজ শেষ ক’রে ইওরোপে ফিরে গেছেন।

‘অথচ, কেউ ব্ল্যাকল্যান্ডের কথা জানে না।’

‘আপনি কি তাহ’লে বলতে চাইছেন,’ ক্রমেই একটা অদ্ভুত অস্থিরতা ফুটে উঠেছিলো কামারের গলায়, ‘যে কেউ—আমি বলতে চাইছি, কেউ—আমাদের কথা জানে না?’

‘না, কেউ না।’

আর তারা এখনও ভাবছে যে এই মরুভূমি বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য?’

‘হ্যাঁ, মঁসিয়, আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি।’

কামারে ততক্ষণে দুম ক’রে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। কি-রকম অস্থিরভাবে ঘরটার মধ্যে পায়চারি করতে-করতে তিনি বললেন : ‘অচিন্ত্যনীয়!…এ যে একেবারেই ভাবা যায় না!’ তাঁর উত্তেজনা অবশ্য একটু পরেই প্রশমিত হয়েছে, অতি-কষ্টে নিজেকে দমন ক’রে আবার তিনি চেয়ারে গিয়ে ব’সে পড়েছেন। ‘বলুন, মঁসিয়, আপনি কী বলতে চাইছিলেন।’

‘সে-সব যে কত বাধা হ্যারি কিলার আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছিলো, তার বর্ণনা দিয়ে আপনাকে আমি বিরক্ত করতে চাই না। শুধু এটুকু জানুন যে, হ্যারি কিলার আমাদের রক্ষিদলকে মিথ্যে অছিলায় পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, যখন দেখেছে ঐ রক্ষিদল বিনাই আমরা তবু নাইজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সে রাতের অন্ধকারে তার লোকজন পাঠিয়ে অতর্কিতে আমাদের আক্রমণ ক’রে বন্দী ক’রে নেয়-তারপর এখানে এনে চোদ্দ দিন ধ’রে আমাদের তার জেলখানায় আটকে রেখেছে আর বারে বারে ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছে!’

মার্সেল কামারের মুখটা ততক্ষণে টকটকেলাল হ’য়ে উঠেছে। ‘আপনি যা বলছেন তা অচিন্ত্যনীয়-অবিশ্বাস্য! অ্যা…হ্যারি কিলার এইরকম করেছে!’

‘শুধু তা-ই নয়,’ বলে মঁসিয় বারজাক বিশদভাবে খুলে বলেছেন কী ভয়ংকর অত্যাচার চালাচ্ছে যে মাদ্‌মোয়াজেল মোরনাসের ওপর, আর কী-রকম ঘৃণ্য ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, শুধু একটা খেয়ালখুশি মেটাবার জন্যে, দু-দুজন আফ্রিকি চাষীকে। আর শুনতে-শুনতে মার্সেল কামারে যেন যন্ত্রণায় দুমড়ে গেছেন। আপাতত, অন্তত, শুদ্ধ নির্বস্তুক চিন্তার জগৎ থেকে আছাড় খেয়ে পড়েছেন তিনি বাস্তবের রূঢ় জগতে। তাঁর ভেতরকার সত্তা যেন এই কথা শুনে প্রচণ্ড মার খাচ্ছে। যে-তিনি একটা পিঁপড়েকে পর্যন্ত মারবার জন্যে হাত ওঠাতে পারেন না, সেই- তিনিই কি না এত-বছর ধ’রে এমন-একজনের সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ ক’রে চলেছেন, এসব নৃশংস কাজ যার কাছে রুটিমাখনের মতোই দৈনন্দিন! প্রায় ছটফট ক’রে উঠে অস্ফুটস্বরে কামারে বললেন: ‘বীভৎস!… ভয়ানক!’

যে-বিভীষিকার বোধ তাঁকে আচ্ছন্ন ক’রে আছে, তার সঙ্গে মেশানো যে- বিবমিষা, দুটোই নির্ভেজাল ও অকৃত্রিম, তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই যেন উৎসারিত হয়েছে। নিজের বিবেককে তিনি এখন শামাল দেবেন কী ক’রে? কী ক’রে, এত-সব গর্হিত কাজের বিবরণ শোনবার পর, এই শহরে থাকবেন তিনি এখন?

‘এবং মঁসিয়,’ বারজাক বলেছেন, ‘যে-লোকঠাণ্ডামাথায় এমন-সব নৃশংস কাজ করতে পারে, আর যা-ই হোক, সে কোনো অপেশাদার শখের অপরাধী নয়। হ্যারি কিলারের বিবেকে নিশ্চয়ই আরো-সব অপকর্মের স্মৃতি গাঁথা হ’য়ে আছে। আর আপনি তার কিছুই জানেন না?’

‘আপনি… আপনার সাহস হয় আমাকে এমনতর প্রশ্ন করতে?’ কামারে তীব্রসুরে প্রতিবাদ ক’রে উঠেছেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি, এ-সবের বিন্দুবিসর্গও ঘুণাক্ষরেও আমি টের পাইনি কোনোদিন। আপনি ঠিকই বলেছেন, এমন জঘন্য কাজ কেউ একদিন হঠাৎ দুম ক’রে ক’রে বসে না-এ কোনো অপেশাদারের কাজ নয়। এখন আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে আরো কত জঘন্যতর কাজই না সে করেছে। এই কারখানা থেকে আমি প্রায়-কখনোই বেরুই না, এর সব দায়িত্ব আমার-এ নিয়েই আমি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। নতুন-নতুন পরিকল্পনার ছক তৈরি করতে হয় আমায়। এটা আমি জোর দিয়েই বলছি সম্ভবত সেইজন্যেই এ-সবের কোনোকিছু আমার চোখে পড়েনি, কানেও আসেনি, কোনোদিনই না।’

‘আপনি যদি আমাদের কথা বুঝতে পেরে থাকেন,’ বারজাক বললেন, ‘তাহ’লে, অন্তত আংশিক হ’লেও, আপনি আমাদের একটা কৌতূহল মেটাতে পারবেন। এখানে এসেই, এই শহরটা দেখবামাত্র, আমরা সবাই তাজ্জব হ’য়ে গেছি। এই শহর আর তার আশপাশের ঐ সোনাফলানো জমি নিশ্চয়ই হ্যারি কিলারের কীর্তি হ’তে পারে না—বিশেষত যখন আমরা সবাই জানি যে মাত্র দশ বছর আগেও এখানে খাঁ-খাঁ করতো মরুভূমির রুক্ষ বালি! এর উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, রূপান্তরটা চমকপ্রদ। আর হ্যারি কিলারের মাথায় যদি কোনোকালে কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি থেকেও থাকতো, এতদিনে তা অন্তত অত মদের তলায় চাপা প’ড়ে গেছে। এটা আমাদের মাথায় ঢুকছে না ও-রকম একজন নরাধম পশু কী ক’রে এই আশ্চর্য রূপান্তরটা সম্ভব ক’রে তুলেছে।’

‘ও!’ হঠাৎ যেন প্রচণ্ড ক্রোধে মার্সেল কামারের সর্বাঙ্গ চিড়বিড় ক’রে জ্ব’লে উঠলো। ‘ও!… ও করবে এই কাজ, যে একটা কেউ-না, যে একটা কিছুই-না….. এ আপনারা কী ভাবছেন।… এ-কাজ দুর্দান্ত, আর এমনতর কাজ যে ঘটাতে পারে, সে নিশ্চয়ই হ্যারি কিলারের চাইতে একেবারেই অন্যরকম হবে!’

‘তাহ’লে এর জন্যে দায়ী কে?’

‘আমি!’ কামারের মুখ অহংকারে জ্বলজ্বল ক’রে উঠলো। ‘এখানে যা-কিছু আপনারা দেখছেন, সব আমার নিজের হাতের কাজ। আমিই এই তুষাতুর মাটিতে জীবনদায়ী বৃষ্টি ঝরিয়েছি, আমিই মরুভূমিকে রূপান্তরিত করেছি সোনাফলানো মাটিতে। আমিই প্রায় শূন্য থেকেই তুড়ি মেরে বার ক’রে এনেছি এই শহরটাকে— ঈশ্বর যেমন ক’রে কিছুই-না থেকে সৃষ্টি করেছেন এই বিশ্বকে!’

বারজাক আর তাঁর সঙ্গীরা একটু অস্বস্তিভরে পরস্পরের দিকে চোখ চাওয়াচাউি করলেন। এ-যে দেখছি নিজেরই মহিমার স্তুতি গাইতে শুরু করেছে! তাহ’লে কি একজন পাগলের পাল্লা থেকে বেরিয়ে তাঁরা আরেকজন পাগলের খপ্পরে এসে পড়লেন?

একমুহূর্তের স্তব্ধতা ভেঙে এবার ডাক্তার শাতোনে জিগেস করলেন, ‘আপনিই যদি এইসব আশ্চর্য কাজ ক’রে থাকেন, তাহ’লে হ্যারি কিলারের হাতে এইসমস্ত তুলে দিলেন কেন? একবারও জানবার চেষ্টা করলেন না এইসব আবিষ্কার আর উদ্ভাবন নিয়ে সে কী করছে?’

ঈশ্বর যখন অসীম আকাশে তারা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তখন কি তিনি এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন পরে এদের কী হবে?’

ঈশ্বর শুনেছি পাপের সাজা দেন,’ ডাক্তার শাতোনে বললেন, ‘বাইবেলে তিনি বলেছেন : ‘প্রতিহিংসা আমার।’‘

‘যদি দরকার হয়, তাহ’লে আমিও তাঁরই মতো কঠোর সাজা দেবো,’ অস্থির- একটা আলোয় আবার ঝকঝক ক’রে উঠলো মার্সেল কামারের চোখের তারা।

পলাতকেরা মহাফাঁপরে পড়লেন। এঁর ওপরে নির্ভর করা যায় কী ক’রে? ইনি মস্ত প্রতিভা হ’তে পারেন, কিন্তু এঁর তো মানসিক ভারসাম্য ব’লে কিছুই নেই।

‘মঁসিয় কামারে,’ আমাদে ফ্লরেঁস আবার আলোচনাটাকে নিকট-বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন, ‘আমি যদি জিগেস করি আপনার সঙ্গে এই হ্যারি কিলারের পরিচয় হ’লো কী ক’রে, তা কি নিতান্তই অনধিকার চর্চা হবে? আর এই ব্ল্যাকল্যান্ডকে গড়বার পরিকল্পনাটাই বা হঠাৎ আপনার মাথায় এসেছিলো কেমন ক’রে?’

‘না-না, অনধিকার চর্চা হবে কেন?’ মার্সেল কামারের গলার স্বর আবার মৃদু হ’য়ে এলো, ‘ভাবনাটা এসেছিলো হ্যারি কিলারের মাথাতেই, তবে সেটাকে বাস্তবে রূপায়ণ করার দায়িত্ব ছিলো আমারই ওপর। আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিলো, যখন এক ইংরেজ সমরবাহিনীর কাপ্তেন, জনৈক জর্জ ব্লেজন, সেই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’

নামটা বলবামাত্র সবাই জেন ব্লেজনের দিকে ফিরে তাকালেন, কিন্তু তার মুখের একটা পেশীও কাঁপলো না।

‘সার্জেন্ট হিশেবে তোঙ্গানেও সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলো। আর সেইজন্যেই এত-বছর বাদেও ওকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। আমার কাজ ছিলো, এনজিনিয়ারের, আমার কাজ ছিলো পর্বতবিদ্যাচর্চাসংক্রান্ত-সেইসঙ্গে জলবিদ্যা ও বিশেষত খনিবিদ্যাতেও অভিনিবেশ দিতে বলা হয়েছিলো। আশান্তিভূমির আসেরা থেকে উত্তরদিকে আমরা এগিয়েছি ক্রমাগত, দু-মাস কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন হ্যারি কিলার এসে সেখানে আবির্ভূত হয়। আমাদের নেতা কাপ্তেন জর্জ ব্লেজন তাকে দেখেই উচ্ছ্বসিতভাবে অভ্যর্থনা জানান, সেও তখন আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়—কখনও আর অভিযানের সঙ্গ ছাড়েনি।’

‘এটা বলা কি ঠিক হবে না,’ জেন জিগেস করলে, ‘অবশেষে ধীরে-ধীরে সকলের অলক্ষিতে সে-ই শেষটায় নেতা হ’য়ে উঠেছিলো? এমনই ধীরে-ধীরে, কেউ সেটা খেয়ালও করেনি?’

তরুণীর দিকে ফিরে তাকালেন মার্সেল কামারে। ‘সেটা আমি ঠিক বলতে পারবো না,’ একটু ইতস্তত করলেন বটে, কিন্তু এ-প্রশ্ন শুনে যে খুব-একটা অবাক হয়েছেন, তা মনে হ’লো না। ‘আমি আমার নিজের কাজেই এমন ডুবেছিলুম যে বাইরের খুঁটিনাটির দিকে নজর দেবার কোনো অবসর ছিলো না। জর্জ ব্লেজনের চাইতে বরং অনেক-বেশিবারই হ্যারি কিলারের সঙ্গে আমার দেখা হ’তো। তা, একদিন যখন আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে আমার নিজের গবেষণা সেরে আমি ফিরে এসেছি, দেখি যেখানে শিবিরটা থাকবার কথা ছিলো, সেটা সেখানে নেই। লোকজন কেউ নেই, যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম কিছু নেই… কিছু না! একটু যখন বিরক্তই বোধ করছি, ভাবছি কোথায় যাবো, এমন সময় হঠাৎ আমার সঙ্গে হ্যারি কিলারের দেখা হ’য়ে গেছে।

‘সে আমায় জানালে কাপ্তেন ব্লেজন নাকি প্রায় গোটা দলবলটা নিয়েই উপকূলের দিকে ফিরে গেছেন, কুড়িজন অনুচর দিয়ে তারই ওপর নাকি ভার দেয়া হয়েছে আমাদের অনুসন্ধানের বাকি কাজটা শেষ করার। আমার কী এসে যায় বলুন- নেতা এ-ই হোক, বা ও-ই হোক। তাছাড়া কাপ্তেন ব্লেজনের নাগালই বা তখন আমি ধরবো কোথায়? তো, আমি কোনো দ্বিধা না-ক’রেই হ্যারি কিলারের সঙ্গে গেছি তখন। সে নাকি গুজব শুনেছিলো যে আমি কতগুলো আশ্চর্য জিনিশ উদ্ভাবন করতে চাইছি। সে তখন আমাকে এখানে নিয়ে এসে বলে সেগুলো তাহ’লে এবার কাজে রূপায়িত করা যাক। আমি রাজি হ’য়ে যাই। হ্যারি কিলারের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সেটাই শুরু।’

মঁসিয় কামারে, হ্যারি কিলার সম্বন্ধে আপনি যতটুকু জেনেছেন, তার সঙ্গে আরো-কতগুলো তথ্য যোগ করতে দিন আমায়।’ জেন ব্লেজনের গলার স্বর গম্ভীর। ‘যেদিন থেকে সে গিয়ে কাপ্তেন ব্লেজনের দলে যোগ দিয়েছিলো, সেদিন থেকেই বাহিনীটা একটা দস্যুর দল হ’য়ে ওঠে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, নির্বিচারে হত্যা করেছে নিরীহ মানুষদের, মেয়েদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে, আর শিশুদের পর্যন্ত কুপিয়ে মেরেছে!’

‘অসম্ভব!…’ কামারে তীব্র আপত্তি জানালেন। ‘গোল্লায় যাক গুজব-আমি নিজে সেখানে ছিলুম। এবং আমি সে-সব কিছুই দেখিনি!’

‘যেমন এখনও আপনি আপনার চোখের সামনে যা-সব কাণ্ড ঘ’টে যাচ্ছে তার কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না! গত দশবছরে হ্যারি কিলারের অপকর্মের কিছুই আপনি খেয়াল করেননি! অথচ, হায়-রে, আমি যে-সব ঘটনার কথা বললুম, তা তো কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। এ-সবই ঐতিহাসিক তথ্য, এবং সারাজগৎ এ- সবের কথা জানে!’

‘আর আমি তার কিছুই জানতে পারিনি!…’ মার্সেল কামারে বুঝি বজ্রাহত।

‘না-জানতে পারেন,’ জেন তখনও তার কথা শেষ করেনি, ‘এ-সব নৃশংস অত্যাচারের খবর ইওরোপে গিয়ে পৌঁছেছে। কাপ্তেন ব্লেজনের বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে ফৌজ পাঠানো হয়েছে। যেদিন আপনি গিয়ে শিবিরটাকেই দেখতে পাননি, জর্জ ব্লেজন সেখান থেকে দলবল নিয়ে চ’লে যাননি। তিনি তখন মৃত।’

‘মৃত?!’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আগে যে লোকে বলেছিলো ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তিনি মারা গেছেন, সেটা ঠিক খবর নয়। জর্জ ব্লেজন খুন হয়েছেন আততায়ীর হাতে!’

আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন!…’

‘এবং পেছন থেকে এই এই খঞ্জর চালিয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে,’ ব’লে, জেন তার জামার ভেতর থেকে খঞ্জরটা বার ক’রে দেখালে। ‘এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে আমি আমার দাদার কবর খুঁজে বার করতে গিয়েছিলুম; সেখানে, এঁদের সামনে, আমি তার দেহাবশিষ্ট পরীক্ষা ক’রে দেখেছি। তাঁর কাঁধের হাড়ের মধ্য দিয়ে এই খঞ্জর তার দেহে বেঁধানো ছিলো, ফলাটা গিয়ে বিধেছিলো হৃৎপিণ্ডে। খুনীর নামটাও খোদাই করা ছিলো হাতলে, কিন্তু সময় নামের হরফগুলোকে ঝাপসা ক’রে দিয়ে গেছে। কিন্তু দুটি হরফ এখনও পড়া যায়, আর আপনি আমাদের এইমাত্র যা বললেন, তা থেকে আমার অন্তত কোনো সন্দেহই নেই যে এই নামটা ছিলো ‘হ্যারি কিলার’

এই শোচনীয় কাহিনীটা শুনতে-শুনতে মার্সেল কামারে ক্রমেই অস্থির হ’য়ে উঠছিলেন, উত্তেজিতভাবে নিজের আঙুলগুলো মোচড়াচ্ছিলেন, আর মাঝে-মাঝেই কপাল থেকে ঘাম মুছে নিচ্ছিলেন।

‘এ-যে ভয়ংকর! বীভৎস কাণ্ড!…শেষ পর্যন্ত আমিই কিনা এ-রকম করলুম! আমি! ..আমি!’ তাঁর বিস্ফারিত চোখে কেমন-একটা অদ্ভুত আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

আপনি আমাদের লুকিয়ে থাকতে দেবেন এখানে?’ এতক্ষণ বারজাক আসল প্রশ্নটা জিগেস করলেন।

‘আমি আপনাদের লুকিয়ে থাকতে দেবো কি না?…’ একটু তিক্ততপ্ত স্বরেই মার্সেল কামারে জিগেস করলেন : ‘সেটা আবার আমাকে জিগেস করছেন আপনারা? আপনারা কি ভুলেও ভাবতে পারেন যে এমন-একটা জঘন্য অপরাধের সঙ্গে আমি লিপ্ত আছি, যখন কি না আমি ভাবছি তাকে কী-রকম কঠোর সাজা দেবো!’

সাজা দেবার কথা ভাববার আগে বরং আমরা কী ক’রে আত্মরক্ষা করতে পারি, সেটাই প্রথমে ভাবা উচিত,’ আমেদে ফ্লরেঁস কাণ্ডজ্ঞানের কথাটা শোনালেন, ‘হ্যারি কিলার আবার ধরপাকড় চালাবে নিশ্চয়ই—আমাদের নিশ্চয়ই আবার পাকড়াবার চেষ্টা করবে!

মার্সেল কামারে মৃদু হাসলেন। ‘আপনারা যে এখানে আছেন, এ-কথা সে জানে না। আর যদি জানেও,’ তাচ্ছিল্যভরে হাত নেড়ে এমন-একটা ভঙ্গি করলেন যাতে বোঝা গেলো তিনি তার থোড়াই পরোয়া করেন, ‘আপাতত আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনারা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ, এটা জেনে রাখবেন।’ ব’লে তিনি একটা বোতাম টিপেছেন, আর একটা ঘণ্টা বেজেছে। অমনি দরজা খুলে কালো-একটি পরিচারক এসে হাজির। আর এঁদের সবাইকে দেখেই বিস্ময়ে সে আঁৎকে উঠেছে। কামারে অবশ্য সেদিকে দৃপাত না-ক’রে এমন সহজ-সুরে তাকে নির্দেশ দিলেন যেন জগৎসংসারে এর চেয়ে নিরীহ্ সরলসোজা কাজ আর কিছুই নেই। ‘জ্যাকো, এই মহিলা আর এই ভদ্রলোকদের তাঁদের শোবার ঘর দেখিয়ে দাও।’

মার্সেল কামারে উঠে ঘর পেরিয়ে গিয়ে একটা দরজা খুললেন। ‘শুভরাত্রি,’ শিষ্টাচার ও সৌজন্যের এই নিদর্শনের পরেই তিনি অদৃশ্য হ’য়ে গেলেন, আর সবাই বিস্মিত হ’য়ে তাঁর প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সবচেয়ে বোমকে গিয়েছে এই কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারকটিই, এদের বিছানা জোগাড় ক’রে দেবার সবচেয়ে- কঠিন দায়িত্বটা তো পড়েছে তারই ওপর। বাস্তবিকই, বেচারা জ্যাকো এখন মাঝরাত গড়িয়ে যাবার পর তাঁদের জন্যে বিছানা জোগাড় করতে যাবে কোথায়? কারখানার সব বিছানাই যার-যার ঘরে, এবং সেগুলো ব্যবহার হয়; অপ্রত্যাশিত অতিথিদের শোবার জন্যে কোনো ব্যবস্থাই নেই এখানে। তাকে কি তবে দোরে-দোরে ঘুরে এখন এই বর্ষাবাদলের রাতে গিয়ে কর্মীদের কাঁচাঘুম ভাঙিয়ে তুলতে হবে?

তার বিষম মুশকিলের কথাটা অনুমান ক’রেই মঁসিয় বারজাক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন যে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীদের কোনো বিছানা ছাড়াই চলবে। তাঁরা সবাই বরং এ-ঘরটাতেই থাকবেন, ঘরটা এমনিতে বেশ-বড়ো, প্রশস্ত, শুধু জ্যাকো যদি কতগুলো আরামকেদারা আর চাদর জোগাড় ক’রে দিতে পারে! এতেই তাঁরা মানিয়ে নেবেন; তাছাড়া রাত তো এমনিতেই বোধহয় কাবার হ’তে চলেছে।

অবশেষে একসময় সকাল হ’লো। যে-দরজাটা দিয়ে গতরাতে ঘর ছেড়ে মার্সেল কামারে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ছটায় সেই দরজা খুলেই তিনি আবার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর ঘরটাকে যে এঁরা একটা ঢালাও শোবার জায়গায় পরিণত ক’রে নিয়েছেন, সেই ডরমিটরি-মার্কা হাল দেখে তিনি খুব-একটা যে অবাক হয়েছেন তা কারুই মনে হ’লো না।

‘সুপ্রভাত,’ যেমন শান্তসুরে গতরাতে তিনি তাঁদের ‘শুভরাত্রি’ জানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি শান্ত গলায় তিনি প্রাতঃকালীন সম্ভাষণ জানালেন।

‘সুপ্রভাত, মঁসিয় কামারে,’ তাঁরাও সমস্বরে প্রত্যভিবাদন জানালেন।

কামারে সোজা কাজের কথায় এলেন। ‘কাল রাতে আপনারা আমায় যা-যা বলেছেন, তা নিয়ে আমি অনেকক্ষণ ভেবেছি। এই অবস্থা কিছুতেই আর চলতে দেয়া যেতে পারে না। আমাদের এক্ষুনি এর মোকাবিলা করতে হবে।’ ব’লে তিনি একটা বোতাম টিপলেন, অমনি চারপাশ থেকে শোরগোলের ঝমঝম শুরু হ’য়ে গেলো।

‘অনুগ্রহ ক’রে আমার সঙ্গে আসুন,’ কামারে তাঁদের বললেন।

কয়েকটা করিডর পেরিয়ে যাবার পর, তাঁরা এসে পৌঁছুলেন বিশাল-এক ওয়ার্কশপে, অনেক যন্ত্রপাতির ঘটাংঘটাং চলে সেখানে, তবে এখন সেগুলো নিঃশব্দ প’ড়ে আছে। আর সে-সব যন্ত্রের চারপাশে নারী-পুরুষের এক জটলা।

‘সবাই এসেছে তো?’ জিগেস করলেন কামারে, ‘রিগো, একটু নাম ডেকে দ্যাখো তো!’

যখন জানা গেলো যে কারখানার সব কর্মীই এই ওয়ার্কশপে উপস্থিত, তিনি তাঁদের উদ্দেশ ক’রে বলতে শুরু করলেন। প্রথমেই রাতের অতিথিদের সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন, এঁরা প্রাণ বাঁচাবার জন্যে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তারপর তিনি স্পষ্ট-প্রাঞ্জল ভাষায় খুলে ব’লে দিলেন রাত্তিরে তিনি কী-কী তথ্য জেনেছেন।

যে-কোনো কারণেই হোক, হঠাৎ জর্জ ব্লেজনের লোকেরা হ্যারি কিলারের নিয়ন্ত্রণে আসার পর চারপাশে কীভাবে নিপীড়ন লাঞ্ছনার ঝড় তুলেছিলো; এইসব খুনজখম রাহাজানি লুঠতরাজের জন্যে হ্যারি কিলারকেই কীভাবে দায়ী করা যায়; বারজাক মিশনের অভিযাত্রীদের ধ’রে এনে কীভাবে বন্দী ক’রে রেখে হুমকী দেয়া হচ্ছে সারাক্ষণ; জেন ব্লেজনের প্রতি কী নিদারুণ নিপীড়ন চালানো হচ্ছে : আর শেষ পর্যন্ত—ঐ হত্যা, নিষ্ঠুর এবং অন্যায়, দুজন নিগ্রোকে কীভাবে ঠাণ্ডামাথায় হ্যারি কিলার-সব, সব তিনি শ্রোতাদের জানালেন। কাল রাতে যা-যা তথ্য তিনি জেনেছেন, তার একটা খুঁটিনাটিও বাদ দেননি।

তা থেকে এটাই স্পষ্ট হ’য়ে যাচ্ছে যে তাঁরা সবাই না-জেনে এক নির্মম দস্যুর হ’য়ে কাজ ক’রে যাচ্ছেন—এবং কারখানার সব কাজই ঐ দস্যু তার স্বৈরাচার কায়েম রাখার জন্যে আরো-সব ভয়ংকর দুষ্ক্রিয়ার কাজে লাগাবার জন্যে করাচ্ছে। এ-রকম অবস্থা কিছুতেই চলতে-দেয়া যেতে পারে না, আর যদি কারু মধ্যে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানের বোধ থাকে, তাহ’লে হ্যারি কিলার যাঁদের জোর ক’রে ধ’রে রেখেছিলো, তাঁদের কাউকেই তার হাতে ফিরিয়ে দেয়া চলে না। তাহ’লে এটাই মোদ্দা ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে যে এই মুহূর্তেই কারখানাকে রাজভবনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে দিতে হবে-আর একজন একজন ক’রে সবাইকেই সমস্ত ক্ষতিপূরণ সমেত নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে দেবার দাবি জানাতে হবে।

পিন-পড়া স্তব্ধতার মধ্যেই কর্মীরা সবাই কামারের বৃত্তান্ত শুনে প্রথমে স্তম্ভিত হ’য়ে গেছেন—এঁরা সবাই সৎকর্মী, এ-রকম একটা বিষম কাণ্ড যে চলেছে এ- সম্বন্ধে কোনো ধারণাই কারু ছিলো না। উত্তেজনা একটু কমলে পরে সকলেই একবাক্যে কামারের সমস্ত সিদ্ধান্তে সায় দিলেন। যে-পরিচালককে কর্মীরা সবাই এমন শ্রদ্ধাসম্মান করে, তাঁর কথায় কোনো আপত্তি তোলবার কথা কেউই স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না।

তিনি যে-সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন, তার কারণ মার্সেল কামারে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে তাঁর শ্রোতাদের কল্পনাকে স্পর্শ ক’রে গেছে : ‘কাল রাতে আমি যত অবিশ্বাস্য তথ্য জেনেছি, তার মধ্যে যেটা আমাকে সবচেয়ে তাজ্জব করেছে সেটা এই: ইওরোপে নাকি কেউই এই শহরটার অস্তিত্বের কথাই জানে না হ্যারি কিলার যার নাম দিয়েছে ব্ল্যাকল্যান্ড। এটা আমি জানি যে এই শহরটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ক্যারাভানের বহর যেখান দিয়ে তার চাইতে অনেক দূরে- একেবারে মরুভূমির বুকের মাঝখানে, যেখানে কেউই কোনোদিন ভুলেও পা দেয়- না—আর তার একটা মস্ত কারণও ছিলো।

‘কিন্তু এটাও আমরা জানি যে আমাদের কর্মী ও সাথীদের কেউ-কেউ এখানে কিছুকাল কাটাবার পর দেশের টানে এতটাই ব্যাকুল হ’য়ে পড়েছিলেন যে তাঁরা সবাই যে-যাঁর দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। আমি কাল রাতে হিশেব ক’রে দেখেছি এ-রকম প্রাক্তন কর্মী কতজন। কাজ শুরু করার পর থেকে সবশুদ্ধ একশোসাঁইত্রিশজন কর্মী আমাদের এখান থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁদের দু- চারজনও যদি দেশে গিয়ে পৌঁছুতেন, তাহ’লেই ইওরোপের কারু কাছে এই শহরটার কথা অগোচর থাকতো না। কিন্তু ইওরোপে কেউ যেহেতু ব্ল্যাকল্যান্ডের নামই শোনেনি, তাতে বোঝা যায় ঐ একশো-সাঁইত্রিশজনের কেউই আজ অব্দি তাঁদের গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছোননি।’

সমবেত কর্মীদের সবাই যেন দম আটকে আছে : এই অকাট্য যুক্তির সামনে তারা সবাই স্তম্ভিত হ’য়ে গেছে।

আর তার ফলে এটাও বোঝা যায় তোমাদেরও কেউই আর-কোনোদিন এই দুরাশা করতে পারবে না যে একদিন কাজ শেষ ক’রে স্বদেশে ফিরে যাবে, অন্তত যতদিন সব ক্ষমতা হ্যারি কিলারের হাতে আছে, ততদিন নয়। আমরা যদি একবার তার কবলে গিয়ে পড়ি, তবে তার সেই খপ্পর থেকে বেরুবার কোনো আশাই আর থাকবে না আমাদের। আমাদের নিজেদের স্বার্থে, আর সুবিচারের স্বার্থেও, হ্যারি কিলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে আমাদের গ’র্জে-ওঠা উচিত।’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ…… আপনি আমাদের ওপর নির্ভর করতে পারেন,’ চার পাশ থেকেই এই একই সাড়া উঠলো।

মার্সেল কামারের ওপর তাদের অগাধ আস্থা। প্রথমে, সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়েছে শুনে তারা কেমন মোহ্যমান হ’য়ে পড়েছিলো, কিন্তু এই প্রকৌশলী ও বৈজ্ঞানিকের কথা শুনতে-শুনতে তারা আবার তাদের সাহস ফিরে পেয়েছে; মার্সেল কামারে যখন সঙ্গে আছেন, তখন আর ভয় কী। এই অগাধ অবস্থার নিদর্শন হিশেবেই তাদের সকলের বজ্রমুঠি ওপরে উঠলো।

‘কাজ চলুক, প্রতিদিনকার মতোই, যেমন চলছিলো। আমার ওপর তোমরা নির্ভর রেখো,’ ব’লে সকলের আশা ও উল্লাসের কোলাহলের মধ্য দিয়ে মার্সেল কামারে ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কয়েক মিনিট তিনি তাঁর ফোরম্যানের সঙ্গে কাটালেন—তাকেই তিনি রিগো ব’লে ডেকেছিলেন। পরে, রিগো যখন তার নির্দেশগুলো নিয়ে চ’লে গেলো, কামারে ফিরে এলেন তাঁর নিজের পড়ার ঘরে এবং তাঁর আশ্রিতরাও তাঁর পেছন-পেছন সে-ঘরে এসে ঢুকলেন।

আর ঢোকবামাত্র, ঝনঝন ক’রে টেলিফোন বেজে উঠলো। রীসিভারটা তুলে নিলেন মার্সেল কামারে, আর অন্যরা শুনতে পেলেন তিনি মৃদুস্বরে কেবল ‘হুঁ- হুঁ, ‘হ্যাঁ,’ ‘না’, ‘বেশ,’

‘যা আপনার ইচ্ছে’ এইসব কথাই ব’লে চলেছেন, উত্তরে! শেষে তিনি হো-হো ক’রে হেসে উঠে রীসিভার নামিয়ে রাখলেন।

‘হ্যারি কিলার ফোন করেছিলো,’ বেশ-নিরাসক্ত গলাতেই বললেন মার্সেল কামারে, সে জানে আপনারা এখানে আছেন।’

‘এর মধ্যেই?!’ অস্ফুটস্বরে বিস্ময় ব্যক্ত করেছেন বারজাক

‘হ্যাঁ, ৎশুমুকি নামে কাকে যেন সে পেয়েছে। একটা নৌকো নদীর মাথায় প’ড়ে থাকতে দেখেছে, আর দেখেছে ৎশুমুকির মতোই আরো একজন শাস্ত্রীকে কারা যেন বেঁধে রেখে গেছে। যেহেতু তার অজ্ঞাতসারে কারু পক্ষেই রাত্তিরে এ-শহর ছেড়ে কোথাও চ’লে যাবার জো নেই, সে তাই ধ’রেই নিয়েছে আপনারা এখানে আছেন। আমি তা অস্বীকার করিনি। তারপর সে বলেছে আপনাদেরকে তার হাতে তুলে দিতে। আমি তাতে রাজি হইনি। সে বড্ড চাপ দেবার চেষ্টা করেছিলো, আমি আবারও তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। তাতে সে প্রচণ্ড খেপে যায়। শাসিয়ে বলে, সে নিজেই এসে জোর ক’রে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে আপনাদের। তাতে আমার হাসি পেয়ে গেছে, আমি টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিয়েছি।’

অন্যরা, একসঙ্গে, উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে।

‘এটা বলবার দরকার নেই, যে আপনি আমাদের ওপর নির্ভর করতে পারেন,’ সকলের হ’য়েই বারজাক তাঁদের মনে কথা জানালেন। ‘কিন্তু আমাদের যে কিছু অস্ত্রশস্ত্র চাই…. ‘

‘অস্ত্রশস্ত্র?…’ কামারে মৃদুভাবে হেসে উঠলেন। ‘অস্ত্রশস্ত্র কিসের জন্যে? … এখানে কোনো অস্ত্রশস্ত্র আছে ব’লেও আমার মনে হয় না। তবে আপনারা তা ব’লে ঘাবড়ে যাবেন না। আমাদের হাতে অন্য উপায় আছে।’

রাজভবনের গোলাবন্দুক ঠেকাবার মতো উপায়?’

‘তাও আছে, তাছাড়াও অনেক-কিছু আছে। আমার যদি কখনও ইচ্ছে হয় শহরটা ধ্বংস ক’রে দিই, তাহ’লে আমি তা একনিমেষে ক’রে ফেলতে পারি। তবে আমার মনে হয় না আমাদের ও-রকম চূড়ান্ত-কিছু করতে হবে। রাজভবনের কামান- বন্দুক চুপ ক’রেই থাকবে-এ-ব্যাপারটা সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্তই থাকতে পারেন।

‘কিলার যে শুধু আমার ক্ষমতা সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল তা নয়, সে এও জানে যে তার গোলাবারুদ এই কারখানার গায়ে আঁচড়টুকুও কাটতে পারবে না, ঐ- কারখানা শেল-প্রুফ। তাছাড়া এটাকে সে খামকা ধ্বংসও করতে চাইবে না, কেননা সে জানে তার সব শক্তির উৎসই হচ্ছে এই কারখানা। সে বরং তার গোয়েন্দা বা সেপাইশাস্ত্রী পাঠিয়ে আপনাদের ধ’রে নিয়ে যেতে চাইবে। তবে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, তা সে পারবে না।’

যেন তাঁর এই ঘোষণার জবাবেই নিচে দরজার কাছ থেকে দুমদুম ধাক্কার শব্দ এলো।

‘কী বললুম আপনাদের?’ মৃদু হেসে বললেন বৈজ্ঞানিক। ওরা এসে দরজাটার ওপর হামলা চালাচ্ছে। তবে এই আশ্বাস দিতে পারি যে এই নিরেট দরজাটা এতই পুরু যে ওদের শত ধাক্কাধাক্কিতেও কিছু হবে না।’

‘কিন্তু যদি একটা কামান এনে ওরা ঠেলা লাগায় দরজায়?’ বৈজ্ঞানিকের প্রশান্ত মুখচ্ছবি দেখেও বারজাক ততটা আশ্বস্ত হ’তে পারেননি।

‘তাহ’লেও দরজাটা ভেঙে ফেলা ততটা সহজসাধ্য হবে না। কিন্তু রাজভবনের একটা কামানকে জাহাজঘাটায় এনে হাজির করতেও বেশ সময় লাগবে—আপাতত আমাদের ঐ কটা মানুষের ঠেলাঠেলি নিয়েই কারবার করতে হবে। ঘুষি কষিয়ে, লাথি মেরে ওরা একটা আস্ত শতাব্দী কাটিয়ে দিতে পারে ইচ্ছে করলে, কিন্তু তাতে ওদের কোনোই লাভ হবে না। তবু আপনারা যদি আমার সঙ্গে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত ক’রে আসতে চান, তবে, চলুন, যাই, গিয়ে দেখি আসি হামলাটার হাল কেমন, আমার মনে হয় সে-দৃশ্য দেখে আপনাদের ভারি আমোদ হবে।’

আবার তাঁরা ফিরে গেলেন ওয়ার্কশপে, কিন্তু না-থেমে, অন্য-একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন পাশে। যন্ত্রগুলো তখন পুরোদমেই চলছে, কিন্তু কর্মীদের মধ্যে তেমন একটা উৎসাহের ভাব দেখা যাচ্ছে না। একটা জায়গায় জড়ো হ’য়ে তারা সকালে যা শুনেছে তা-ই নিয়েই ব্যস্তভাবে আলোচনা করে চলেছে, এবং ওয়ার্কশপে সামান্য-একটু বিশৃঙ্খলারই সৃষ্টি হয়েছে, তবে কামারে সেটাকে তেমন পাত্তা দেননি।

ওয়ার্কশপ পেরিয়ে, তাঁরা একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে সরাসরি একটা মিনারের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন; রাজভবনের মিনারের প্ল্যাটফর্মটার সঙ্গে এটার তফাৎ শুধু এইখানটাতেই যে এখানে প্ল্যাটফর্ম ও মিনারটা রাশি-রাশি খুঁটি দিয়ে ঘেরা- দুর্বোধ্য এই খুঁটিগুলো, কেন এখানে আছে কে জানে—এদের ডগা প্রায় একশো গজ ওপরে উঠে গিয়েছে, শূন্যে। রাজভবনের মতোই, এখানেও খুঁটিগুলোর মাঝখানে একটা সাইক্লোস্কোপ বসানো। কামারে সবাইকে তার ভেতরে ঢুকে পড়তে আমন্ত্রণ জানালেন।

‘হ্যারি কিলারের জন্যে আমি যে-সাইক্রোস্কোপটা বানিয়ে দিয়েছি এটার অবশ্য তার মতো মাইল-মাইল পাল্লা নয়। তবে কারখানার দেয়ালের ওপর বাঁকাভাবে বসানো সারি-সারি আয়নার সৌজন্যে আমরা আমাদের আশপাশে কী ঘটছে, সে- সব খুব ভালোভাবেই দেখতে পারি। এখান থেকে আশপাশের দেয়ালের বাইরের দিকটায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে তা স্পষ্ট দেখতে পাবেন।’

সাইক্লোস্কোপে, বাস্তবিকই, এসপ্ল্যানেড, নদীর ঘাট, উপবৃত্তাকার রাস্তা- সবকিছু ছবির মতো ফুটে উঠেছিলো, প্রতিচ্ছবিগুলো রাজভবনের সাইক্লোস্কোপের প্রতিচ্ছবিগুলোর মত অত-বড়ো না-হ’তে পারে কিন্তু তার চেয়ে অনেক স্পষ্ট। পরকলার মধ্য দিয়ে দেখা গেলো একদল লোক, তাদের কেউ-কেউ আবার ম‍ই নিয়ে এসেছে, কারখানার দেয়ালের চারপাশে ছুটোছুটি ক’রে বেড়াচ্ছে, আর প্রায় জনা-তিরিশ লোক কারখানার দরজাটা ভাঙবার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রেই ক্রমেই হাঁফিয়ে উঠেছে।

‘হুঁ, যা ভেবেছিলুম,’ কামারে বললেন, ‘এরা দেখছি একটা পুরোদস্তুর হামলারই তোড়জোড় করছে! এবার তাহ’লে পুরো ব্যাপারটা দারুণ-চিত্তাকর্ষক হ’য়ে উঠবে।’

হামলাটার তোড়জোড় চলছে জোর। এরই মধ্যে কয়েকখানা মই এনে দেয়ালের গায়ে ঠেকানো হয়েছে, আর তার ওপর চড়তে শুরু করেছে বেশ ক-জন হর্ষচরিত। মইয়ের ডগায় পৌঁছে কয়েকজন কোনো সন্দেহ বিনাই দেয়ালের কিনারটা আঁকড়ে ধরেছে।

আর পরমুহূর্তেই পুরো দৃশ্যটাই বদলে গেলো। দেয়ালের ওপরটা ছুঁতে না- ছুঁতেই যন্ত্রণায় ভীষণভাবে কুঁকড়ে গেলো লোকগুলো। দেয়ালের ওপর থেকে ল্যাগব্যাগ ক’রে ঝুলছে একেকজন, যেন তাদের হাতগুলো আঠার মতো আটকে গিয়েছে দেয়ালে, আর তারা উৎকট-একটা নাচ জুড়ে দিয়েছে, যেমন ক’রে পুতুলনাচের আসরে সুতো ধ’রে কেউ ধেই-ধেই ক’রে নাচায় পুতুলদের।

‘লোকগুলো ভারি হাবার মতো কাজ করেছে,’ কামারে তাঁদের ব্যাখ্যা ক’রে বোঝালেন। ‘দেয়ালের ওপরটা পুরোপুরি এমন-একটা ধাতুর পাত দিয়ে মোড়া, যেটা আমারই এক আবিষ্কার-তামার চাইতেও আরো শতগুণ-জোরালো পরিবাহী। আমি তার মধ্যেই একান্তর এক বিদ্যুতের ঢেউ চালিয়ে দিয়েছি, আর তার ফল কী হয়েছে, সে তো আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।’

তিনি যখন এই ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, মইয়ের নিচের ধাপে যারা ছিলো, তারা ওপরের লোকেদের ঠ্যাং ধ’রে টান দিলে, আর অমনি শুরু হ’লো তাদেরও খিঁচুনি, অঙ্গবিক্ষেপ, হুলুস্থূল নৃত্য-আর নিচে যারা দাঁড়িয়েছিলো তারা একেবারেই হতভম্ব হ’য়ে পড়লো, বেশ ভয়ও পেয়ে গেলো।

‘এই খ্যাপাগুলো ছেড়ে দিচ্ছে না কেন দেয়াল, নিচে লাফিয়ে পড়ছে না কেন? সাঁৎ-বেরাকে বেশ কৌতূহলীই দেখালো।

‘কারণ, তারা ছাড়তে পারলে তো! আমি যতক্ষণ চাইবো, ততক্ষণ এই হতচ্ছাড়াগুলোকে দেয়ালের সঙ্গে লেপটে গিয়ে এমন বেদম নাচ নাচতে হবে… তবে আরো মজা করতে পারি আমি!’ ব’লে, মার্সেল কামারে একটা বোতাম টিপে দিয়েছেন। অমনি মইগুলো নিচে প’ড়ে গেলো টালমাটাল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত বিষম জোরে তাদের ঠেলে ফেলে দিয়েছে-আর যে-সব লোক মইটা ধ’রে ছিলো তারা উলটে পালটে ডিগবাজি খেয়ে চিৎপটাং আছড়ে পড়লো নিচে দেয়ালের গায়ে তখনও আটকে রইলো তারা, যারা গোড়াতেই দেয়াল টপকাবে ব’লে দেয়ালের ওপরদিকে হাত দিয়েছিলো। তারা তখনও প্রাণপণে দেয়াল থেকে হাত ছাড়াবার জন্যে আকুলব্যাকুল চেষ্টা ক’রে চলেছে।

কামারে খুব-নরমসুরে বললেন, ‘কারু ক্ষয়ক্ষতির জন্যে আমি কিন্তু দায়ী নই। নিজের চোখেই তো দেখতে পেলেন আপনারা-আমি কি কাউকে একবারও ছোঁবার চেষ্টা করেছি? জানতে চান, কেমন ক’রে ব্যাপারটা হ’লো?

আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমার মতে, শক্তি—তার প্রকৃতি বা ধাত যা- ই হোক না কেন—শক্তি শুধু কতগুলো দোল বা কম্পনেরই সমষ্টি—ইথারের মধ্যে তারা অন্যরকম শিহরণ তৈরি ক’রে দেয়। মোটামুটিভাবে সবাই এখন মেনে নিয়েছে যে আলোকরশ্মি শুধু-একটা বিশেষ মাত্রায় প্রবাহিত হওয়া তরঙ্গদৈর্ঘ্য—আর বিদ্যুতের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা-শিহরনের বা কম্পনের স্তরেরও একটা মস্ত তারতম্য আছে এই দুয়ের মধ্যে। নিশ্চয়ই এদের দুয়েরই সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে উত্তাপেরও সম্পর্ক আছে। আমি এই বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং বিভিন্ন কম্পনস্রোত তৈরি করতে পারি, আর তাতে যা আশ্চর্য কাণ্ড হয় তার একটু নমুনা তো এইমাত্তর আপনাদের দেখিয়ে দিলুম।’

এই ব্যাখ্যানার সময় সেই কিম্ভূতকিমাকার নাচ কিন্তু সমানে চলেছে-মাটি থেকে অনেকটাই ওপরে।

‘নাঃ, এই তুচ্ছ খেলাটা বড্ড-বেশি সময় ধ’রে চলেছে,’ ব’লে, মার্সেল কামারে আরেকটা বোতাম টিপে দিলেন।

তক্ষুনি ব্যাঙ-তড়কা-খাওয়া মনুষ্যশরীরগুলো ধুপধাপ ক’রে তিরিশ ফিট নিচে মাটিতে এসে আছড়ে পড়েছে-আর প’ড়েই থেকেছে চিৎপটাং, নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। একটু ইতস্তত ক’রে তাদের সাথীরা এসে তাদের চ্যাংদোলা ক’রে নিয়ে গেছে।

‘প্রথম অঙ্কের সমাপ্তি,’ কামারে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মৃদু স্বরে বললেন, ‘প্ৰথম অঙ্কটা অবশ্য খলনায়ক হ্যারি কিলারের ভালো কাটেনি। এরইমধ্যে ওর তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন চেলা অকর্মণ্য হ’য়ে পড়েছে। এবার তাহ’লে ঐ-যে হাবাগুলো দরজাটার ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের একটু মজা দেখাবো?’ ব’লেই, একটা টেলিফোন তুলে নিয়ে জিগেস করলেন, ‘তুমি তৈরি আছো তো, রিগো?’

‘হ্যাঁ,’ আর সাইক্লোস্কোপের সবখানেই তার উত্তরটা শোনা গেলো।

‘তাহ’লে পাঠিয়ে দাও!’ কামারে হুকুম দিলেন।

অমনি, অদ্ভুত দেখতে একটা যন্ত্র, তখুনি মিনারের তলাটা থেকে বেরিয়ে এসে স’রে গেলো। অদ্ভুত-একটা খাড়া গোলক, লম্বমান, বেলনের মতো দেখতে, যেদিকটা মাটির দিকে আছে, সেটা বিশাল একটা শঙ্কুর মতো দেখতে হ’য়ে গেলো।

অন্যদিকটায় আছে চারটে খুদে চাকা, একটা শোয়ানো অন্যগুলো খাড়া, তারা বনবন ক’রে, চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে, পাক খাচ্ছে। এই অদ্ভুত যন্ত্ৰ মুহূর্তে ভুউশ ক’রে গিয়ে উঠেছে আকাশে, বাইরের দেয়াল থেকে অনেকটাই স’রে গেছে। বেশ কয়েক গজ উঁচুতে উঠে গিয়ে সেটা চিৎ হ’য়ে শুয়ে পড়লো যেন, আর কারখানার সীমা অনুসরণ ক’রে ছুটলো।

এই প্রথম যন্ত্রটার পর-পরই বেরিয়ে এসেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং আরো অনেকগুলো। কামারের অতিথিরা সবশুদ্ধ কুড়িটা গুনেছেন। তারা পর-পর বেরিয়ে এসেছে মিনারের তলা থেকে, যেন পাখির বাসা থেকে একটার পর একটা পাখি বেরুচ্ছে, আর সকলেই একইভাবে শূন্যে উঠে গিয়েই চিৎ হ’য়ে শুয়েছে হাওয়ায়। আর প্রথম যন্ত্রটাকে অনুসরণ ক’রে গেছে, পেছন-পেছন।

‘এরা হ’লো আমার বোলতা,’ মার্সেল কামারে বোলতা এবং আমার এই দুটো কথারই ওপর বড্ড-বেশি ঝোঁক দিলেন। ‘পরে আপনাদের বলবো, এগুলোকে কেমনভাবে চালায়। আপাতত শুধু দেখে যান এরা কেমনভাবে কাজ করে।

আবারও টেলিফোন তুলে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘রিগো, একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে দাও!’

তারপর নতুন বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছেন, ‘খামকা এই বেচারাগুলোকে আমি মারতে যাবো কেন, বলুন? এরা তো আর আমার সঙ্গে কিছু করেনি। একটা শুধু ধমক দিয়ে দেখছি, এই হুঁশিয়ারিতে যদি এদের টনক নড়ে।’

হানাদারদের অবস্থা ততক্ষণে বেশ-সঙিন। অত ওপর থেকে আছাড় খেয়ে প’ড়ে কেউ-কেউ নির্ঘাৎ টেশেই গেছে, অন্যদেরও জখম এতটা যে তাদের চ্যাংদোলা ক’রে ধ’রে নিয়ে যেতে হয়েছে। তারপর সবাই উপবৃত্তাকার রাস্তাটা ছেড়ে গিয়ে জড়ো হয়েছে এপ্ল্যানেডে, কারখানা থেকে একটা সসমম্ভ্রম-দূরত্ব বজায় রেখেই, আর বিমূঢ়ভাবে তাকিয়ে আছে তার দেয়ালের দিকে।

তবে দরজায় যারা ধাক্কাধাক্কি করছিলো, তারা তাদের কাজ থামায়নি, বরং কতগুলো মোটা-মোটা থাম এনে কুড়িজনে মিলে ধ’রে দুমদাম ক’রে ঠেলছে দরজাটা—তাতে দরজা অবশ্য একচুলও নড়েনি বা টলেনি। কারখানার চৌহদ্দিটায় পাক খেয়ে বোলতারা এই দলটার ওপর দিয়ে ভোঁ-ভোঁ ক’রে পর-পর উড়ে যাচ্ছে। এই দলটা তাদের দিকে দৃকপাতও করেনি।

হঠাৎ একটা বোলতার মধ্য থেকে বিষম-একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ফেটে পড়েছে, আর প্রায় একশোগজ জমি ঘিরে পর-পর ছুটে গিয়েছে মেশিনগারের গুলি।

বিস্ফোরণের আওয়াজটা শুনে যারা দরজা ঠেলছিলো তারা মুখ তুলে তাকিয়েছে ওপরে। কোত্থেকে যে-আওয়াজটা এসেছে, তা তারা কখনও ধরতে পারেনি। এমন সময় আরেকটা বোলতা ভোঁ ক’রে উড়ে এসেছে তাদের কাছে, আর অমনি আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ এবং, প্রথমটারই মতো আবারও মেশিনগারের গুলির বর্ষণ।

এবার গুলিগোলা কাছেই পড়েছে, কয়েকজনের গায়েও লেগেছে। অন্যরা আর অপেক্ষা করেনি। ঐ মোটা গাছের গুঁড়িটা ফেলে রেখেই আহতদের তুলে নিয়ে ভোঁ-দৌড় দিয়ে প্রাণপণে ছুটে পালিয়েছে সেখান থেকে।

বারজাকরা যেন নিজের চোখকেই আর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। প্রত্যেকটি বোলতা, গুলিগোলা ছুঁড়ে, দিব্বি শান্তশিষ্ট বাধ্য, পোষা বোলতার মতোই ফিরে এসেছে তাদের পাখির বাসায়, মিনারের ঠিক তলাটায়। তারপর আবার ভেতরে গুলিগোলা পুরে সেই চক্রটার মধ্যে ফিরে গিয়েছে যে যার নিজের জায়গায়। ‘আমার মনে হয় না এদের নিয়ে আর আমাদের মাথা ঘামাতে হবে,’ বলেছেন মার্সেল কামারে, ‘এখন বরং চলুন, কারখানাটা একবার ঘুরে দেখবেন…’