২.০২ দু-পাখা ছড়ানো

২. দু-পাখা ছড়ানো

[আমেদে ফ্লরেঁসের নোটবই থেকে : আবার]

২৫শে মার্চ। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হ’তে চলেছে, আমরা এসে পড়েছি… কিন্তু এ-কোন্‌ জাহান্নামে এসে পড়েছি আমরা? কেউ যদি আমায় বলতো যে আমরা এখন চাঁদে এসে পৌঁছেছি, তাহ’লে সেটাও আমাকে খুব-একটা অবাক করতো না, যদি একবার আমরা মনে রাখি কী-রকম যানে ক’রে আমরা সফর করেছি। আসল কথা হ’লো কোথায় যে আছি, তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার।

তথ্য যা-হয় হোক, আমি শুধু মোটামুটি যথাযথভাবে এইভাবেই নিজেকে প্ৰকাশ করতে পারি : চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি আমাদের কারা যেন বন্দী করেছে, আর অবশেষে আজ সকালেই, এমনিতে শান্তিপূর্ণভাবে রাতটা কাটাবার পরই, আমার মনে হয়েছে নোটবইতে এ-কথাগুলো টুকে রাখার মতো তাকৎ হয়েছে আমার।

আকাশপথে চলবার প্রথম পাঠটা যথেষ্ট অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিতে হয়েছে আমাদের, তবু বলতে পারি সাধারণভাবে আমাদের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালোই আছে, আর সাঁৎ-বেরা যে বিছানায় সেঁটে আছেন তার কারণ ইস্পাতের বেড়ি নয়, বরং তাঁর কটিবাতের কামড়। বেচারা একটা কাঠের খুঁটির মতো আড় ধ’রে আছেন, একটুও নড়াচড়া করতে পারছেন না, আর তাঁকে একটা বাচ্চা ছেলের মতোই ধ’রে-ধীরে চামচে দিয়ে খাইয়ে দিতে হচ্ছে আমাদের। তাতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছুই নেই। বরং এটাই সবচেয়ে বিস্ময়কর, যে কালকের ঐ সফরের পরেও এখন আমরা বাকিরা দিব্বি চলাফেরা করতে পারছি। কাল সারাদিনও একে আর একে দুই করার মতো ক্ষমতাও আমার ছিলো না। আজ দিনটা তুলনায় অন্তত বেশ-ভালো, কিন্তু বাড়িতে লিখে জানাবার মতো আহামরি কিছু নয়। তাহ’লেও ভাবনাগুলোকে এক জায়গায় জড়ো ক’রে এক দুই তিন চার ক’রে যোগ ক’রে দেখা যাক।

হ্যাঁ, তা, পরশু আমরা কালঘুমই ঘুমিয়েছিলুম। ক্লান্তিতে সারাশরীর ভেঙে পড়েছিলো আমাদের, আর অবসাদে এলিয়ে সবাই আমরা ভোঁশ-ভোঁশ ক’রে ঘুমুচ্ছিলুম, তারপর আচমকা ঊষার আগেই এক উৎকট আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। সেই একই গুমগুম গর্জন, হাজারটা ভোমরার আওয়াজ, যা আমাকে এর আগে তিন-তিনবার কী-রকম ভড়কে দিয়েছিলো, কিন্তু এবার আওয়াজটা ছিলো আরো-তীব্র-এবং একেবারে যেন কানের পাশেই। চোখ খুলে পরক্ষণেই চোখের পাতা ফের বুজিয়ে ফেলতে হয়েছিলো আমাদের, কারণ আমাদের মাথার ওপর থেকে তীব্র আলোর ছটা প’ড়ে আমাদের চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো। সেই প্রচণ্ড আওয়াজটা থেকে তখনও আমরা ঠিক ধাতস্থ হ’তে পারিনি, তার ওপর ঐ চোখধাঁধানো আলো তো ছিলোই। এমন সময় কথাটি না-ক’য়ে একদল লোক আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের পাকড়ে, নিচে পেড়ে ফেলে, হাত- পা পেছমোড়া ক’রে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে, মাথার ওপর দিয়ে কী রকম থলের মতো কিছু ফেলে আমাদের অন্ধ ক’রে দিয়ে এমন কাবু ক’রে ফেলেছিলো যে এখনও প্রায় ভির্মি খাবার দশাই হয় ভাবলে। লিখতে যতটা সময় লেগেছে, তার চেয়েও ঢের অল্প সময়ে পুরো কাজটাই হাঁশিল হ’য়ে গেছে। এ নিয়ে দ্বিতীয়-কোনো কথা বলবারই উপায় নেই : এ হচ্ছে কোনো ওস্তাদ লোকের তুলকালাম কীর্তি।

প্রায় একটা মাংসের ডেলার মতোই লাগছিলো নিজেকে। গোড়ালিতে, হাঁটুতে, কব্জিতে, পিঠে কেটে কেটে বসেছিলো বাঁধন। চমৎকার লাগছিলো!

যখন হতভম্ব ভাবটা কেটে যাবার পর এই চমৎকার অনুভূতিটা প্রথম হ’তে শুরু করেছে, তখনই আমি কার যেন গলা শুনতে পেয়েছি, আর তাকে চিনতে পেরেছি লিউটেনান্ট ল্যকুরের মনোমোহন কণ্ঠস্বর ব’লে : ‘কী, সব ক-টাকেই পাকড়েছো তো?’

তারপরেই, কাউকে কিছু সাড়া দেবার সুযোগ না দিয়েই, একটু থেমে সেই একই গলা আবার রূঢ়সুরে বলেছে : ‘প্রথমে যে নড়বে, তারই মাথার খুলি গুলি মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে! এসো সব্বাই, চলো, ফেরা যাক!’

দ্বিতীয় কথাটার প্রথম লক্ষ্য যে আমরাই ছিলুম, সেটা বোঝাবার জন্যে সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক হ’তে হয় না। চমৎকার মানুষ ইনি, আমাদের বদলি রক্ষিদলের এই প্রাক্তন সর্দারটি! চলো? বলা ভারি সহজ। নড়বো যে, চলবো যে, তার উপায় কী। কিন্তু আমি তারপর কান পেতে শুনেছি আমাদের লিউটেনান্টকে কে যেন বলছে : ‘ হেরুটেরস্টাইগেন ক্যেনেন ভির হিয়ের নি! এস গিবট ৎস ফিয়েলে বাউমে!

এই কিচিরমিচির বোঝবার সাধ্য অন্তত আমার ছিলো না; বাজি ধরে বলতে পারি এ নিশ্চয়ই আলেমান বুলি; মঁসিয় বারজাক এই কটকটে ভাষাটায় যৎকিঞ্চিৎ সড়গড়, পরে তিনি আমায় জানিয়েছেন পুরো বয়ানটার মানে ছিলো : ‘আমরা এখানে নামতে পারবো না যে! বড্ড বেশি গাছপালা আছে!’ হ’তেও পারে-বা। বন্দুকের গুলির মতো বয়ানটার মানে হয়তো তা-ই।

তবে কবুল করি যে তার কোনো মর্মার্থই তখন আমার মরমে পশেনি। কিন্তু যেটা চট ক’রেই ধরতে পেরেছি তা এই : এই টিউটনি কথাটা বলা হয়েছে দূর থেকে—সম্ভবত মাথার ওপর থেকেই।

কথাটা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই, সেই অবিশ্রাম জগঝম্পের মধ্যে, তৃতীয়-একটা গলা প্রায় গরগর ক’রেই উঠেছে : ‘তোমার বন্দীদের এই গাছপালার চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে যেতে হবে—’

হুম! কথাটা এবার ইংরেজিতে বলা। শেক্সপীয়ারের শ্লোক জানি ব’লে আমি তক্ষুনি বুঝতে পেরেছি আসলে আমাদের এই গাছতলা থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। তারপরেই লিউটেনান্ট ল্যকুর-সম্ভবত ল্যকুরই—জিগেস করেছে : ‘কোন্ দিকে?’

আলবিয়নের কুলাঙ্গার বলেছে : ‘কুসুর দিকে। ‘

‘কদ্দুরে?’

‘সিকা ভেতি চিলোমেত্রি,’ চেঁচিয়ে বলেছে চতুর্থ-কেউ।

আমার যৎসামান্য লাতিন জ্ঞান থেকে ধরতে পেরেছি, এই কথাগুলো ইতালীয় –এবং এর মানে—আন্দাজ কুড়ি কিলোমিটার। আমরা কি তবে ভাষাতাত্ত্বিকদের দেশেই এসে পড়েছি নাকি? না কি এটা বাবিলেরই কোনো কানাগলি?

সে যা-হয় হোক, কেননা ততক্ষণে লিউটেনান্ট ল্যকুরের মধুর বচন শোনা গেছে: ‘ঠিক আছে। তাহ’লে ভোর হ’লেই রওনা হবো।’

আমার দিকে কেউই আর আলাদা ক’রে তখন নেকনজর দেয়নি। যেখানে ছিলুম, সেখানেই প’ড়ে থেকেছি, চিৎপাত, পিঠমোড়া ক’রে বাঁধা। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, নিশ্বাস নিতেই থলেটার মধ্যে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে, মুখের মধ্যে কাপড়ের গোলা!

লিউটেনান্টের কথার পরেই ঐ গুমগুম উৎকট আওয়াজটা আরো-দুনো হ’য়ে পুরো জায়গাটাই রীতিমতো সরগরম হ’য়ে উঠেছে। কিন্তু পরক্ষণেই আওয়াজটা কমতে শুরু করেছে, তারপর আস্তে-আস্তে ম’রে গেছে। ক-মিনিট বাদেই আওয়াজটা মিলিয়ে গিয়েছে।

কী মানে হয় এই বিকট এবং কিম্ভূত আওয়াজটার? মুখে কাপড়ের গোলা ঢোকানো ব’লে কারু সঙ্গে যে কোনো কথা বলবো তারও জো ছিলো না, অতএব প্রশ্নটা আমাকে করতে হয়েছে নিজেকেই—এবং, সেইজন্যেই বোধহয়, কোনো উত্তরই আসেনি।

সময় এ-রকম দশাতেও কেটে যায়। সময়ের এ-রকম একটা ভেলকি আছে। ঘণ্টাখানেক পরে দুটো তাগড়াই লোক আমাকে পাঁজাকোলো ক’রে ধ’রে দু-একবার হেঁইয়া-মারি গোছের দোল দিয়েই একটা শস্যের বস্তার মতো আমাকে একটা জিনের ওপর চাপিয়ে দেয়, ঘোড়ার গায়ের হাড় কেমন যেন বিঁধতে থাকে আমার গায়ে, তারপরেই ঘোড়াটা জোরকদমে ছুট লাগিয়ে দেয়।

সবচেয়ে তাজ্জব স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি যে আমি একেবারে আফ্রিকার বুকের মাঝখানে মাজেপ্পার ভূমিকায় অভিনয় করবো। ঐ কশাক কাব্যকাহিনীতে অবশ্য তেমন-অনুরাগ আমার কখনোই ছিলো না। ঘোড়সোয়ার মাজেপ্লার ছুট কবিতায় উক্রেনের এই মানুষটি, অর্থাৎ ইভান স্তেপানোভিচ মাজেপ্পা, এক নীলরক্তের অভিজাতকে চটিয়ে দেবার জন্যে ভয়াবহ সাজা পেয়েছিলো, হাত-পা বেঁধে তাকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো এক বুনো-ঘোড়ার ওপর, তারপর চাবকে সেটাকে খেপিয়ে দিয়ে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিলো স্তেপির মাঝখানে। মাজেপ্পাকে তখন অবশ্যি কশাকরা বাঁচিয়ে দেয়, আর শেষটায় সে কশাকদের সেনানায়ক হ’য়ে ওঠে। আমি শুধু এটাই ভাবছিলুম, আমি কি একদিন মাজেপ্পার মতোই মুক্তি পাবো? আর শেষটায় বাম্বারাদের সেনানায়ক হ’য়ে উঠবো? এমন সময় এক আধমাতাল গলা, যেন একেবারে আগুন ধরবার আগেকার পেট্রলে চোবানো, এমনভাবে খেঁকিয়ে উঠেছে যে অন্তরাত্মা অব্দি শিউরে উঠেছে : ‘এই ব্যাঙচির বাচ্চা! হুঁশিয়ার! ফের যদি নড়েছিস তোর এই রিভলবার তো ধ্যাষ্টামো বার ক’রে দেবে!’

বাঃ, চমৎকার! এমন বিনীত ভদ্রভাবে এমন পরামর্শ একদিনেই দু-দুবার পেয়ে গেছি আমি, একবার চোস্ত ফরাশিতে, একবার আঁস্তাকুড়ের ইংরেজিতে!

আমার চারপাশে খটাখট খটাখট ঘোড়ার খুরের শব্দ, দ্রুত, তেজিয়ান, খ্যাপা। আর মাঝে-মাঝে কানে আসছে গোঁ-গোঁ আওয়াজ, ক্ষীণ, কাপড়চাপা : নিশ্চয়ই আমার সাথীরা, তাদেরও নিশ্চয়ই আমার মতোই দশা। আর আমার দশা তো কহতব্যই নয়! প্রায় যেন দম আটকে আসছে আমার, সব রক্ত যেন মাথায় গিয়ে চ’ড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আস্ত মাথাটাই বুঝি ফেটে পড়বে!

এই খ্যাপা জোরকদম-ছুট চলেছে অন্তত তো আধঘণ্টা হবেই, আর তারপরেই এই ঘোড়সোয়ারবাহিনী আচমকা থেমে গিয়েছে। আমাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে তোলা হ’লো, কিংবা বলতে হয়, তুলে পুরোনো কাপড়ের একটা বস্তার মতো আমাকে ছুঁড়ে ফেলা হ’লো মাটিতে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো, আর তারপর ক্ষীণভাবে কানে এসে পৌঁছুলো—ক্ষীণভাবেই, কেননা আমি তখন তিনচতুর্থাংশ ম’রেই গিয়েছি,–কানে এসে পৌঁছলো এই কথাগুলো :

‘মেয়েটা তো টেশেই গিয়েছে!’ ইংরেজিতে।

‘নো এল’ এ সোলামেন্তা ভিনিতা।’ (না, কেবল জ্ঞান হারিয়েছে।)

‘খোলো, খোলো, বাঁধন খুলে দাও,’ হুকুম করেছে কেউ ফরাশিতে, গলা শুনে আমার ধারণা হয়েছে, লিউটেনান্ট ল্যকুর, ‘আর ডাক্তারেরও বাঁধন খুলে দাও।’

ইনি…. এই মহিলা… মিস্ ব্লেজনের কি প্রাণের আশঙ্কা আছে?’

আমাকে তক্ষুনি মুখেগোঁজা কাপড়ের গোল্লা আর মাথাঢাকা থলেটা থেকে অব্যাহতি দেয়া হ’লো। এই জল্লাদগুলো কি ভেবেছে এই ধরনের বিচ্ছিরি সাজপোশাকের মধ্য থেকে ডাক্তার শাতোনেকে একবারেই বার ক’রে ফেলতে পারবে? এই অধমকে যে এভাবে রেহাই দিয়েছে সে-তো এইজন্যেই যে এরা ভেবেছে আমিই বুঝি ডাক্তার শাতোনে! কেননা পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পেরেছে তারা : ‘আরে! এ-তো ডাক্তার নয়। অন্যটাকে খোলো!’ সর্দার ব’লে উঠেছে, আর হম্বিতম্বি দেখে আমার আগেই তো সন্দেহ হয়েছিলো লিউটেনান্ট ল্যকুরই এদের সর্দার।

তার দিকে তাকিয়ে দেখেছি আমি আর নিজেকে বিকট অভিসম্পাত দিয়েছি। এই লোকটাকেই আমি কিনা ফিটফাট এক ফরাশি লিউটেনান্ট ব’লে ধ’রে নিয়েছিলুম!… অবশ্য সত্যি-বলতে, গোড়া থেকেই এর ওপর আমার সন্দেহ হয়েছিলো—কেমন যেন সাজানো মনে হয়েছিলো একে। কিন্তু সে-তো নিছকই সন্দেহ, আমি তো আর তার মুখোশ খুলে দিতে পারিনি। আর তার মাশুলও দিতে হয়েছে আমাকে-আমার মাথাটা এখন তাঝিম-মাঝিম করছে। ওহ্, জাহান্নামের পোকা!…একবার যদি একে আমি বাগে পাই!

ঠিক তখনই কে-একজন তার কাছে এসে কথা বলেছে, আর তাইতেই আমি তার আসল নামটা জানতে পেরেছি : কাপ্তেন এডওয়ার্ড রুফাস। কাপ্তেনই বটে! এ যদি খোদ জেনারেলও হয়, তবু এর সম্বন্ধে আমার ধারণা পালটাবে না।

তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কাপ্তেন রুফাস আমার ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছিলো। সেই ফাঁকে আমি একটু শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার চেষ্টা করেছি, স্বাভাবিকভাবে। আরেকটু যদি অমন হাঁসফাস করতে হ’তো, আমি তবে দম আটকেই ম’রে যেতুম। সেটা নিশ্চয়ই বোঝাই যাচ্ছিলো, গায়ের রং একেবারে নীললোহিত হয়ে গেছে, বেগনি, কারণ কাপ্তেন হঠাৎ আমার দিকে একঝলক তাকিয়ে কী-যেন একটা হুকুম করেছে তার একজন সাগরেদকে। তক্ষুনি আমার সারা দেহ খানাতল্লাশ করেছে তার স্যাঙাৎ। তুলে নিয়েছে আমার অস্ত্রশস্ত্র, মেরে দিয়েছে আমার টাকাকড়ি, কিন্তু আমার নোটবইটাকে রেহাই দিয়েছে। এই জানোয়ারগুলো জানে না ‘আমেদে ফ্লরেঁস’-এর নাম সই করা লেখার দাম কী! যাচ্চ’লে! এ-সব কোন ডাহা-গাড়লদের পাল্লায় এসে পড়েছি আমি!

তবে এই ডাহা-গাড়লগুলো আমার হাত-পায়েরও বাঁধন খুলে দিয়েছে। আর আমি হাত-পা একটু নাড়াতে পেরেছি, রক্তচলাচলের ধরনটা অনেকটা সাবলীল হ’য়ে এসেছে। আর তারপরেই তাকিয়েছি আশপাশে।

প্রথমেই আমার নজরে পড়েছে দশটা… কী ও-সব?… দশটা… যন্তর, দশ, হুম! দশটা জিনিশ… বস্তু… ব্যবস্থা… দশটা – ধুত্তোর! শয়তানই জানে এ-জিনিশগুলো কী—কারণ আমার জীবদ্দশায় আমি এমনতর-কিছু আগে কখনও দেখিনি!

ধরে নিন, বেশ বড়োশড়ো এক প্ল্যাটফর্মই যেন, একপ্রান্তে দু-দুটো রণপার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে গিয়েছে খুঁটি, জাফরি-কাটা, পাঁচমিটার উঁচু; ওপরে, তার মাঝামাঝি, একটা চাকায় বসানো দুটো বৈঠার মতো কী যেন, আর, তারও ওপরে, দুটো (হুম, ফের আবার শুরু হয়েছে গণ্ডগোলটা, আমি ঠিক মানানসই-কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছি না যে!)…দুটো…হাত? দুটো… ডানা, না, না, কথাটা খুঁজে পেয়েছি এতক্ষণে, পুরো জিনিশটাকেই দেখাচ্ছে যেন অতিকায় একটা সারস একঠ্যাঙে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার দুই পাখা…হ্যাঁ, ঠিক তা-ই…

…ঝকঝকে ধাতুতে তৈরি দু-দুটো পাখা, পুরো আয়তন হবে ছ-গজের মতো। যতদূর দেখতে পাচ্ছি, দশ-দশটা এমনতর দেখতে অচেনা বস্তু, সেনাবাহিনীর যুযুৎসু সারের মতো পাশাপাশি সাজানো। অ্যাঁ, কিন্তু কী হ’তে পারে এগুলো?

যখন এই দৃশ্যটা আমার দু-চোখ গ্রোগ্রাসে গিলে শেষ করেছে, তখনই আমি তাকিয়ে খেয়াল করেছি আমাদের চারপাশে রীতিমতো একটা ভিড়ই জ’মে গিয়েছে।

প্রথমেই তো আছেন আমাদের প্রাক্তন-লিউটেনান্ট ল্যকুর, এইমাত্তর যিনি কাপ্তেন রুফাসের পদে উন্নীত হয়েছেন; তাঁর সহচর, সেই গোরা সার্জেন্ট-দুটোও আছে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো-না, না, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, তারা আসলে সার্জেন্ট কি না তা অবশ্য আমি জানি না; আছে তাদের কুড়িজন আফ্রিকি পদাতিক –যাদের বেশির ভাগকেই আমার আগে থেকে চেনা নেই; এছাড়া আছে আরো-দশজন গোরা, যাদের আমি কস্মিনকালেও চোখে দেখিনি- যাদের দেখতে লাগছে অনেকটাই শ্মশানের চিল-শকুনের মতো। ভিড় বটে, অনেক লোক, তবে একে ঠিক প্রিয়জন সান্নিধ্য’ বলা যাবে না।

এইসব মহদাশয়দের মাঝখানে রয়েছেন আমার সাথীরা। তাঁরা প্রত্যেকেই আছেন এখানে, মিস ব্লেজন মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎপাত প’ড়ে আছেন। খড়ির মতো শাদা হ’য়ে গেছে তার মুখ। মলিক হাপুশ কাঁদছে, চেষ্টা করছে কীভাবে তাঁর সেবা করা যায় তার উপায় ভাবতে। ডাক্তার শাতোনে রুগিনিকে দেখছেন। আর মিস ব্লেজনের পাশেই মাটিতে ব’সে ব’সে সাঁৎ-বেরা জোরে-জোরে শ্বাস নিয়ে কোনোরকমে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করছেন। তাঁর দশাই সবচেয়ে করুণ। তার নিস্কেশ মাথার খুলি ইটের মতো রাঙা, আর তাঁর বিশাল চোখদুটো যেন এক্ষুনি কোটর থেকে লাফিয়ে বেরুবে। বেচারা সাঁৎ-বেরা!

মঁসিয় বারজাক আর মঁসিয় পঁসার দশা অপেক্ষাকৃত-ভালো। তাঁরা দাঁড়িয়ে- দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে আড় ভাঙবার চেষ্টা করছেন। তাহ’লে আমিও কেন দাঁড়িয়ে উঠে একটু ব্যায়াম ক’রে নিয়ে শরীরের আড় ভাঙি না?

কিন্তু তোঙ্গানেকে আমি আশপাশে কোত্থাও দেখতে পাইনি। কোথায় গেছে তবে সে? কোথায়? হামলাটার সময় সে-বেচারা খুন হ’য়ে গেছে নাকি? হ’তে পারে, মলিকের ঐ ফুঁপিয়ে কান্নার সেটাও আরেকটা কারণ হ’তে পারে। আমারও মেজাজটা বিচ্ছিরিরকম তেতো হ’য়ে গেলো। তোঙ্গানের মতো ভালোলোক আমি এখানে কি কালো, কি গোরা কারু দলেই দেখিনি।

আমি উঠে প’ড়ে মিস ব্লেজনের দিকে এগিয়ে গেলুম, কেউ আমায় কোনো বাধা দিলো না। পা-দুটো বিচ্ছিরি আড় ধ’রে আছে। ঠিকভাবে হাঁটতে অব্দি পারছি না। কাপ্তেন রুফাসই আমার আগে-আগে এগিয়ে গেছে।

‘মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস কেমন আছে,’ সে জিগেস করেছে ডাক্তার শাতোনেকে।

ও-হ্যাঁ, তা-ই তো, প্রাক্তন-লিউটেনান্ট ল্যকুর তো আমাদের সঙ্গিনীকে তাঁর ধার-করা নামেই শুধু চেনে!

‘ভালো,’ ডাক্তার বলেছেন। ‘ঐ-যে, চোখ খুলছেন-’

‘আমরা যেতে পারবো এবার?’ জিগেস করেছে তথাকথিত কাপ্তেন।

‘একঘণ্টার আগে নয়,’ দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করেছেন ডাক্তার শাতোনে। ‘আর, আমাদের সবাইকেই যদি মেরে ফেলতে না-চান, তো, আমি অনুরোধ করবো ভবিষ্যতে যৎকিঞ্চিৎ কম-বর্বরভাবে আমাদের টানাহেঁচড়া করবেন।’

কাপ্তেন রুফাস কোনো জবাব না-দিয়েই কেটে পড়েছে। আমি গিয়ে দেখি, মিস ব্লেজন সত্যি-সত্যিই মূর্ছা থেকে জেগে উঠছেন। ডাক্তার শাতোনে হাঁটু মুড়ে তাঁর পাশেই বসেছিলেন; তিনি মিস ব্লেজনকে হাত ধ’রে সন্তর্পণে ওঠালেন। তারপরে মঁসিয় বারজাক আর মঁসিয় পঁসাঁ এগিয়ে এলেন আমাদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে। বাঃ, বেশ, এবার পুরো দলটাই একজায়গায়।

‘আমায় মাফ করবেন আপনারা!’ হঠাৎ মিস ব্লেজন ব’লে উঠলেন, তাঁর দু- চোখ থেকে অঝোরধারে অশ্রু ঝরছে। ‘আমিই আপনাদের এ-রকম ভীষণ সংকটের মধ্যে টেনে এনেছি। আমার জন্যে যদি না-হ’তো, আপনারা তবে এতক্ষণে… ‘

আমরা হা-হা ক’রে উঠে আপত্তি জানিয়েছি, কিন্তু মিস ব্লেজন কেবলই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত ক’রে বারে বারে আমাদের ‘মার্জনা ভিক্ষা’ চেয়েছেন। আমার ঠিক কোনো কালেই আত্বধিক্কার বা আত্মকরুনা পছন্দ হয় না, আমি প্রসঙ্গটা পালটাবার চেষ্টা করলুম। বললুম, মিস ব্লেজন যেহেতু মিস মোর্‌নাস নামেই পরিচিত এখানে, তাই তাঁর ঐ ছদ্মনামটা বজায় রাখাই বরং ভালো হবে, এই রাস্কেলগুলোর মধ্যে তাঁর দাদার এককালীন সহচরদের কারু-কারু থাকা হয়তো মোটেই অসম্ভব নয়। আর তা যদি হয়, তবে সাধ ক’রে আবার নতুন ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনা কেন? আমার কথাটা তক্ষুনি সকলের মনে ধ’রে গেলো। ঠিক হ’লো, মিস রেজন আবারও আগের মতো মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস হ’য়ে উঠবেন।

বস্তুত, ঠিক সময়েই আমরা এই সিদ্ধান্তটায় পৌঁছেছিলুম, কারণ আমাদের কথাবার্তায় বাধা দিয়ে রুক্ষ রুঢ়স্বরে কাপ্তেন রুফাস কী-একটা হুকুম দিতেই আবারও আমাদের ধরকাপড় ক’রে ফের সেই বিচ্ছিরি থলেটা পরিয়ে দিলে মুখে-মাথায়। তারপর আগের মতো আমায় চ্যাংদোলা ক’রে নিয়ে-যাওয়া হ’লো।… তবে কি আবারও মাজেপ্পার মতোই আবার আমার কপালে ঐ ঘোড়দৌড় আছে?

না, আমাকে বরং ছুঁড়ে ফেলা হ’লো—উপুড় ক’রে-কোনো শক্ত-কিছুর ওপর, যেটাকে মোটেই ঘোড়ার পিঠ ব’লে মনে হ’লো না। কয়েক মিনিট বাদেই মনে হ’লো পাখনার মতো কিছু-একটা যেন দুরন্ত বেগে হাওয়ায় ঝাপটাচ্ছে, আর যার ওপর আমি অমন উপুড় হ’য়ে প’ড়ে আছি, সেটা চারদিকে কেমন আস্তে-আস্তে দোল খাচ্ছে। সে শুধু মুহূর্তেরই জন্যে বুঝি, তার পরেই কানে তালা ধ’রে গেলো- সেই বিখ্যাত হাজার ভোমরার আওয়াজ, কিন্তু এবার পাঁচগুণ, দশগুণ, একশোগুণ জোরে, আর তার পরেই প্রচণ্ড-বেগে হাওয়া এসে ঝাপটালে আমায়-আর সেই ঝাপটের দাপট মুহূর্তে-মুহূর্তে যেন বেড়ে গেলো। আমার মনে হ’লো… কেমনভাবে বোঝাবো ঐ অনুভূতিটাকে?… মনে হ’লো আমি যেন ওপরে উঠে যাচ্ছি…

উঁহু, যেন কোনো পাহাড়ের ওপরে ট্রলিকারে ক’রে ছুটেছি…দম প্রায় বন্ধ হ’য়ে আসছে, হৃৎপিণ্ডটা কি-রকম একটা প্রবল চাপ… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঐরকমই কিছু-একটা যেন সারা বিপন্ন অস্তিত্বটা দিয়েই আমি অনুভব করতে পারছিলুম।

এই অনুভূতিটা ছিলো বোধকরি পাঁচ মিনিটের জন্যে। তারপরেই, একটু-একটু ক’রে, আমার শরীর তাতে অভ্যস্ত হ’য়ে গিয়ে তার স্বাভাবিক ছন্দটা খুঁজে পেলে- অবশ্য এই অভ্যস্ত হ’য়ে-যাওয়াটাকে যদি স্বাভাবিক বলা যায়। অবশেষে, কবুলই করি, থলের মধ্যে মাথা-মুখ, হাওয়াও নেই আলোও নেই, একটানা ঐ হাজারো ভোমরার ভোঁ-ভোঁ –যেটা এখন নিজস্ব-একটা ছন্দ খুঁজে পেয়েছে, আমি বোধহয় ঢুলেই পড়েছিলুম।

এক আচম্বিত চমক আমাকে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেই চটকা থেকে ফিরিয়ে আনলে। আমার একটা হাত নড়তে পারছে! হ্যাঁ, আমার বাঁধন বোধহয় আলগাই ছিলো, এখন একেবারে-ঢিলে হ’য়ে গেছে, আর অচেতনভাবেই আমি একসঙ্গে -বাঁধা হাতদুটোকে আলাদা ক’রে নিতে পেরেছি।

প্রথমটায় আমি ঠাণ্ডাভাবে নিশ্চল প’ড়ে থাকবার চেষ্টা করেছি, কেননা আমি সেখানে একা ছিলুম না—ঐ গর্জনের মধ্যেও কানে আসছিলো পাশেই যেন দুজন লোক কথা বলছে। একজন বলছে ইংরেজি, কিন্তু গলার স্বরটা এমনই কর্কশ যেন কণ্ঠনালীটা কোহলে টেটম্বুর। অন্যজন ইংরেজিতেই উত্তর দিচ্ছে বটে, কিন্তু কেমন-যেন জগাখিচুড়ি পাকানো তার ব্যাকরণ-সব বৈয়াকরণেরই দুঃস্বপ্ন, সঙ্গে এমন-সমস্ত শব্দ মেশানো, যার মানে আমার জানা নেই। সম্ভবত অজানা শব্দগুলো বাম্বারার, কারণ আফ্রিকায় এই চার মাসে এমনতর শব্দ আমার অনেকবারই কানে এসেছে। তার মানে এই বক্তাদের একজন ইংরেজ, অন্যজন আফ্রিকি। ক্রমশই আমার যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, কিছুই যেন মাথায় ঢুকতে চাচ্ছে না। অবশ্য তাতে যে খুব-একটা-কিছু এসে যায়, তা নয়। আমার পাহারাদের গায়ের রং যা-ই হোক না কেন—গোরা, বা কালো-থলেটা যেন একটুও না-নড়ে, তারা যেন টের না পায় যে আমি অন্তত আংশকিভাবে খানিকটা স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি।

আস্তে, সাবধানে, আমি বাঁধন ধরে টানি, গেরোটা খুলে আসে, আমি কব্জিগুলো বার ক’রে আনি, সাবধানে সদ্য-ছাড়ান-পাওয়া হাত দুটোকে টান ক’রে রাখি শরীরের দু-পাশে।

হাত তো ছাড়ানো গেছে, এবার চোখে দেখতে হবে।

আমার সঙ্গে যা আছে, তাতেই আমার চলবে। আমার পকেটে একটা ছুরি আছে… না, না, ছুরি নয় ঠিক, পেনসিল-কাটা ছুরি। সেটা এতই খুদে-মতো যে আমার খানাতল্লাশ করবার সময় তারা সেটা খুঁজে পায়নি। এই কোনো অস্ত্র না-হ’তে পারে, কিন্তু এটা অন্তত এতটা বড়ো যে দমআটকানো থলেটার মধ্যে আমি একটা ঘুলঘুলি তৈরি ক’রে নিতে পারবো। শুধু, কারু কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ না-ক’রে ঐ পেনসিল-কাটা ছুরিটা আমায় হস্তগত করতে হবে।

প্রায় পনেরো মিনিট ধ’রে লেগে থেকে শেষটায় ছুরিটা হাতে মিললো। এইভাবে সশস্ত্র হ’য়ে, ডানহাতটা তুলে আনলুম মুখের কাছে। তারপর থলেটায় ছ্যাঁদা ক’রে দিলুম!

হে অন্তরিক্ষবাসী, বাঁচাও!…এ-কী আমার চোখে পড়ছে!… কোনোমতে শুধু বিস্ময়ের চীৎকারটা খপ ক’রে গিলে ফেললুম। আমার চোখ—উপুড় হ’য়ে ছিলুম ব’লেই –মাটির দিকে ফেরানো, আর দেখি নিচের মাটির সঙ্গে বিশাল-এক দূরত্ব, পাঁচশো গজেরও বেশি, নিচের মাটির সঙ্গে আমার এই ব্যবধান। আর অমনি ঝিলিকের মতো সত্যটা মগজের মধ্যে খেলে যায়। একটা আকাশযানে আছি আমি! এই বিমান আমাকে এক্সপ্রেস ট্রেনের চাইতেও দ্রুতবেগে আকাশপথে নিয়ে যাচ্ছে!

চোখটা আমি পরক্ষণেই বুজিয়ে ফেলেছি। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত একটা শিহরণ খেলে গেলো। ঐ চমকটার আবেশ এমন ছিলো-এখন কবুল করতে কোনো বাধা নেই-যে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম।

যখন আমার বুকের ঢিপঢিপ আবার স্বাভাবিক হ’য়ে এলো, আমি অপেক্ষাকৃত শান্তভাবেই চারপাশে তাকাতে পারলুম। মাথা ঘুরিয়ে দেয়া বেগে মাটি ছুটে যাচ্ছে নিচে, পেছন-দিকে। কত-জোরে যাচ্ছি আমরা? ঘণ্টায় একশো মাইল? দুশো মাইল বেগে? আরো বেশি? উত্তর যা-ই হোক না কেন, নিচে মরুভূমির বালি, বালির সঙ্গে মেশানো ছোটো ছোটো নুড়ি, আর মাঝে-মাঝেই বেঁধে-বেঁধে তালগাছ। দৃশ্যটা আরো-খারাপও হ’তে পারতো। যত বেঁটেই হোক, এই তালীবনরাজি অন্তত জ্বলজ্বলে-সবুজ, আর ঐ নুড়ির ফাঁকে-ফাঁকে ঘাসও গজিয়েছে। তাহ’লে ব্যাপারটা কী? লোকের বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, মাঝে-মাঝে কি মরুভূমিতেও বৃষ্টি পড়ে?

মাঝে-মাঝেই দেখতে পাচ্ছি, যখন আমাদের যানের নিচে এসে পড়ে, এই বিমানের মতোই আরো আকাশযান। অন্য-কতগুলো বোধহয় আমাদের যানটারও ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। যান্ত্রিক পাখির ঝাঁকের উড়াল! আমার দশা যতই সঙিন হোক না কেন, আমি কিন্তু উত্তেজিত না-হ’য়ে পারিনি। চমৎকার দৃশ্য! আমাদের এই দৃশ্যমানরা আসলে যারাই হোক না কেন, এটা মানতেই হবে তার কেউই সাধারণ মানুষ নয়—তারা ইকারুসের প্রাচীন কিংবদন্তিটাকেও এমন চমৎকারভাবে বাস্তবে তর্জমা ক’রে দিতে পেরেছে।

অবশ্য ঐ বস্তার ফোকরটার মধ্য দিয়ে চোখ বার ক’রে বেশি কিছু দেখবার উপায় আমার ছিলো না। ধাতুর তৈরি প্ল্যাটফর্মের দুটো পাতের মধ্যে দিয়ে দেখছি ব’লে দু-পাশে আমার দৃষ্টি যাচ্ছে না—তবু এত-উঁচুতে আছি ব’লেই অনেকটাই দেখতে পাচ্ছি।

আর, এইখানে নিচের মরুভূমির চেহারায় আশ্চর্য-একটা বদল শুরু হ’য়ে গেছে। একঘণ্টার একটানা উড়ালের পর হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি তালবীথি, চষা প্রান্তর, বাগান। একটা মরূদ্যান নিশ্চয়ই, মরীচিকা নয় মোটেই, কিন্তু খুবই ছোটো-এক মরূদ্যান। যেই তারা চোখে দেখা দেয়, পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু একটাকে পেছনে ফেলে রেখে আসার সঙ্গে-সঙ্গে দিগন্তে উঠে আসে আরেকটা মরূদ্যান, তারপর ঐ-যে তৃতীয়-একটা—আর এই মরূদ্যানের ওপর দিয়ে হা-হা তুফানের বেগে আমরা উড়ে যাচ্ছি।

এই প্রত্যেকটা মরূদ্যানেই একটা ক’রে বাড়ি আছে। আমাদের উড়ালযানের আওয়াজ শুনে বেরিয়ে আসে একজন লোক ভেতর থেকে, একাই, তার সঙ্গে আর-কেউ নেই। এ-সব মরূদ্যানে কি একজন ক’রেই লোক থাকে?

তারপরেই এক নতুন ধাঁধার জট, এই ধাঁধার উত্তর আমি জানি না। প্ৰথম মরূদ্যানটা পেরিয়ে যাবার পরই দেখতে পেয়েছি আমাদের আকাশযান যে-পথ লক্ষ্য ক’রে চলেছে, তার তলায় সার বেঁধে নিয়মিত দূরত্বে একটা ক’রে খুঁটি পোঁতা—আর এমনি অনেক—আর এমন মাপজোক করা ব্যবধান একটার সঙ্গে আরেকটার যে আমার মনে হ’লো তাদের মধ্যে বুঝি তার দিয়ে সংযোগ করা আছে। নাঃ, আমি নিশ্চয়ই জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছি। ধূ-ধূ মরুভূমির মধ্যে টেলিগ্রাফের যদি না এগুলো টেলিফোনের হয়-খুঁটি?

তৃতীয় মরূদ্যানটা পেরিয়ে যাবার পরই, আরো-একটা মরূদ্যান উঠে আসে চোখের সামনে, আরো-গুরুত্বপূর্ণ এক মরূদ্যান। আমি গাছপালা দেখতে পেয়েছি, শুধু তালবীথিই নয়, খেজুরগাছই নয়, আরো নানাধরনের গাছ। যেন কারিতে, বেওবাব, একাসিয়া। দেখতে পাচ্ছি চষা জমি, চমৎকারভাবে কর্ষিত, যেখানে বেশ কিছু আফ্রিকি কাজ করছে। তারপরেই দেয়াল উঠে এসেছে দিগন্ত থেকে, আর তার দিকেই আমরা ঝড়ের বেগে এগিয়ে গিয়েছি। অজ্ঞাত-এক শহর এটা, নাম- না-জানা কোনো জনপদ, যেখানে আমাদের এই রূপকথার পাখি নামতে শুরু করেছে। ঠিক শহরটার মাথার ওপর এসে পৌঁছেছি আমরা এখন। বেশি-বড়ো হবে না শহরটা, কিন্তু ভারি আজব, আষাড়ে! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি উপবৃত্তাকার এককেন্দ্রিক সব রাস্তা, একেবারে অক্ষরে-অক্ষরে ছক মিলিয়ে তৈরি করা। মাঝের অংশটা প্রায়-পরিত্যক্ত, দিনের এই সময়ে সেখানে শুধু কয়েকজন আফ্রিকিই বাইরে রাস্তায় ছিলো, আমাদের আকাশযানের তর্জনগর্জন শুনে ছুটে তারা গিয়ে ঢুকে পড়েছে তাদের কুঁড়েগুলোয়। বাইরের অংশে কিন্তু লোকজনের কোনো কমতি নেই। তারা সবাই গোরা, আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তারা আমাদের লক্ষ্য ক’রে হাত নাড়ছে।

কিন্তু যে-যানটা আমাকে নিয়ে এসেছিলো, সেটা আরো-দ্রুত নামতে শুরু ক’রে দিলে। সরু-একটা নদী পেরিয়ে এলুম আমরা, তারপরেই আচমকা মনে হ’লো একটা ঢেলার মতোই নিচে নেমে যাচ্ছি কেন। প্রায় ঘুরে-ঘুরে নামছি, শঙ্কুল, বিসর্পিল বৃত্তের মতো, আর আমার মাথাটা ঘুরে গেলো। হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে চ’লে এলো মুখের মধ্যে! এ কোথায় দুম ক’রে পড়তে চলেছি?…

না, চাকার গর্জন থেমে গিয়েছে এখন, আমাদের আকাশযান এসে ছুঁয়ে থেমেছে। কয়েক গজ যেন পিছলেই এগিয়ে গেলো সে তারপর, বেগ ক’মে এলো ক্রমে, থেমে গেলো।

একটা হাত সজোরে পাকড়ে ধ’রে আমার মাথার ওপরকার থলেটা টেনে তুলে ফ্যালে। আমি শুধু চট ক’রে হাতের বাঁধনটা লাগাবারই সুযোগ পেয়েছি।

সরিয়ে ফেলা হ’লো থলে, খুলে দেয়া হ’লো বাঁধন। কিন্তু যে-ই খুলে থাক, সে খেলাটা টের পেয়ে গেছে। মাতাল, জড়ানো, গলায় হুমকি দিয়ে উঠেছে : ‘কোন উজবুক গেরোটা বেঁধেছিলো?’

আমি, অবশ্য, উত্তর দেবার কোনো চেষ্টাই করিনি। বরং পায়ের বাঁধন খুলে দেবার পর বেশ খুশি হ’য়েই পা নেড়ে আড় ভাঙবার চেষ্টা করেছি।

‘উঠে পড়ো!’ কার গলা থেকে যে কর্তৃত্বের এই দাপট বেরিয়েছে, তাকে আমি দেখতে পাইনি।

উঠতেই শুধু বলা হয়েছে, আর-কোনো কঠিন কাজ করতে তো বলা হয়নি, অথচ তবু উঠে-পড়াটা ততটা সহজ ছিলো না। এতক্ষণ রক্তচলাচল বন্ধ ছিলো ব’লে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার হুকুমে যেন কোনো সাড়াই দিতে চাচ্ছিলো না। যা-ই হোক, অনেক কষ্টে অবশ পায়ে সাড়া এনে আমি উঠে দাঁড়ালুম।

না, মোটেই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে না চারপাশের দৃশ্যকে। আমার সামনেই উঁচু- একটা দেয়াল উঠে গিয়েছে, তাতে একটা ছোটো ঘুলঘুলি অব্দি নেই, আর ঠিক তার উলটো ভাগে, সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। আমার বাঁপাশেও তাই। দৃশ্যবৈচিত্র্য একেবারেই নেই দেখছি! কিন্তু, তবু, তৃতীয় দেয়ালটার ওপরে আমি দেখতে পেয়েছি একটা মিনার, আর-একটা খুব-উঁচু চোঙ। কোনো কারখানা নাকি এটা? কিন্তু আর কীই বা ভাববো, যখন দেখতে পেলুম সেই মস্ত খুঁটিটা, যেটা মিনারটা থেকে উঠে গিয়েছে, সটান যেন আকাশ ফুঁড়েই!

ডান দিকে দৃশ্যটা একটু অন্যরকম, তবে খুব-একটা মনোহরণ নয়। দুটো মস্ত অট্টালিকা, তাদের সামনে প্রকাণ্ড-একটা দুর্গ, আর দুর্গ যেমন হয়, কামান-বন্দুকের জন্যে ছিদ্রময় দেয়াল, আর বাইরে-বেরিয়ে-আসা ছোটো অলিন্দ, পাহারার জন্যে।

আমার সব বন্দীসাথীরাও পাশে দাঁড়িয়ে আছেন—শুধু বেচারি তোঙ্গানে বাদে। এ কী, মলিকও দেখছি নেই, কিন্তু সকালে যখন থেমেছিলুম, তখন তাকে দেখতে পেয়েছিলুম, সকলের সাথেই। কী হ’লো তাদের, তবে?

আমার মতো থলের গায়ে ঘুলঘুলি তৈরি ক’রে নিতে পারেনি বলে আমার সাথীদের নিশ্চয়ই এই খটখটে-আলো চোখে সইয়ে নিতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। চোখ পিটপিট ক’রে তাকাবার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা, কেবলই চোখ রগড়ে নিচ্ছিলেন। তাঁদের চোখ রগড়ানো শেষ হবার আগে তাগড়াই একেকটা হাত এসে পড়েছে আমাদের কাঁধে। টেনে নিয়ে-যাওয়া হয়েছে আমাদের তারপর, প্রায় হিঁচড়েই ধাক্কাধাক্কি, আর আমরা হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নিরুৎসাহিত….

কী করতে চায় এরা আমাদের নিয়ে? আর, এ-কোন জাহান্নামে এসে পড়েছি আমরা?

হায়! একমিনিট বাদেই আমরা সবাই বন্দীশালায়!