২.০১ শাহারায় শহর

দ্বিতীয় খণ্ড – শাহারায় শহর

১. ব্ল্যাকল্যান্ড

এই বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও, সবচেয়ে-যথাযথ এবং সাম্প্রতিক মানচিত্রগুলোয়, প্রায় ৩০০,০০০ বর্গমাইলের সেই বিশাল-ফাঁকা শাহারাকে দেখানো হয়েছে নিছকই একটি শূন্যজায়গা হিশেবে-খালি, ফাঁকা, ধূ-ধূ কিছুই নেই। ফরাশি সংসদের সদস্য মঁসিয় বারজাকের নেতৃত্বে যখন নাইজারের তীরে যাবে ব’লে এক অভিযাত্রীদল বেরিয়েছিলো, তখনও কেউ শাহারাকে পেরুতে পারেনি—কেউ এমনকী তার মধ্যে ঢুকেও পড়েনি কোনোদিন। শাহারা ছিলো সম্পূর্ণ অচেনা।

সে-সময় এই অজ্ঞাত অঞ্চলটিকে নিয়ে কত-যে কিংবদন্তী, কত-যে উপকথা ছড়িয়েছিলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখানকার স্থানীয় লোকে বলেছে, তারা নাকি মাঝে-মাঝেই দেখেছে অতিকায় সব কালোপাখি হাওয়ায় পাখাদুটো ছড়িয়ে চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে উড়ে চ’লে যাচ্ছে এই রুক্ষ, শুষ্ক, বন্ধ্যা ভূমির দিকে। মাঝে-মাঝেই নাকি বিশাল-সব লোহিত শয়তান চেপে বসেছে এমন-সব ঘোড়ার ওপর যাদের নাক থেকে আগুনের হলকা-বেরোয়, আর টগবগ টগবগ বেরিয়ে এসেছেন এই রহস্যময় বিস্তার থেকে। এই ভুতুড়ে, বিদঘুটে, উদ্ভট ঘোড়সোয়ারেরা টগবগ ক’রে ঢুকেছে জনপদে, কচুকাটা ক’রে মেরেছে সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই, তারপর আবার ফিরে গেছে ধূ-ধূ মরভূমির দিকে, ঘোড়ার পেছনে উঠিয়ে নিয়ে গেছে নারীপুরুষশিশু—আর সেই আবালবৃদ্ধবনিতা আর-কোনোদিনও ফিরে আসেনি লোকালয়ে।

কারা এই নৃশংস নরাধম, যারা ধ্বংস ক’রে দেয় লোকালয়, লুঠপাট করে এমনকী কুঁড়েঘরেও, গরিব-বেচারাদের যৎসামান্য যা সম্বল থাকে, সামান্য যা পুঁজি তাও ছিনিয়ে নিয়ে যায়, আর পেছনে রেখে যায় ছারখার জমি, মরীয়া হতাশা, আর হাহাকার-হারানো মৃত্যু? কারা তারা? কেউ জানে না। কেউ জেনে নেবার কোনো চেষ্টাও করেনি কোনোদিন। কার বুকে অতখানি বেপরোয়া পাটা আছে যে দুশমনদের পেছন-পেছন তাড়া ক’রে গিয়ে ঢুকবে তপ্তবালির সেই বিস্তারে- যাদের সম্বন্ধে রটনা এটাই যে তারা সবাই অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী, নেহাৎ‍ই হেজিপেঁজি সাধারণ মানুষ নয়। এইসব জনরব ছড়িয়েছিলো নাইজারের জল ধ’রে, এমনকী তার তীর থেকে একশো মাইল দূরেও

যদি, ভয়ে-আধমরা এই অফ্রিকিদের চেয়ে ঢের-দুঃসাহসী কোনো ডাকাবুকো মানুষ মরুভূমির মধ্যে ঢুকে যাবার স্পর্ধা দেখাতো, যদি এই বীরনায়ক, ১৫০ মাইল পথ পেরিয়ে চলে যেতো ১° ডিগ্রি ৪০ মিনিট পুবে আর ১৫° ডিগ্রি ৫০, মিনিট উত্তরে, তাহ’লে হয়তো সে তার স্পর্ধার পুরস্কার পেতো। সে এমন-একটা জিনিশ দেখতে পেতো তার আগে কেউই যা কোনোদিন দ্যাখেনি, না-কোনো দুঃসাহসী অভিযাত্রী না-কোনো সদাগরের উটের বহর : সে দেখতে পেতো : একটা শহর।

হ্যাঁ, একটা শহর, সত্যিকার-এক শহর, গল্পকথার কোনো শহর নয়, কোনো মানচিত্রেই যে-শহরের কোনো উল্লেখ নেই, কেউই যার অস্তিত্বের কথা ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন কল্পনা করেনি, যার মোট লোকসংখ্যা-একেবারে বালবাচ্চাদের হিশেবে না-ধ’রে, ৬,৮০৮-এর কম হবে না।

যদি এই বেপরোয়া পথিক গিয়ে কাউকে এই শহরের নাম জিগেস করতো, আর শহরবাসীদের কেউ যদি তাকে নামটা ব’লে দিতো, সে হয়তো ফরাশিতে ব’লে দিতো: ‘ল্য নম দ্য সেৎ ভিইয়ে এস্ তের্-নোয়া’ : তবে সে হয়তো ইতালিয় ভাষাতেও উত্তর দিতে পারতো, ‘কোয়েস্তা সিত্তা এ তো-নেরা’; বাম্বারায়, নি দুগুবা এতোকো আ বে বাকু ফিঙ’; পোর্তুগিজে, ইস্তা সিউদাদ ই তোনেগ্রা,; এস্পানিওলে, ‘এস্তা সিউদাদ এস্ তিয়েররানেগ্রা’; ইংরেজিতে, ‘দ্য নেম অভ দ্য সিটি ইজ্ ব্ল্যাকল্যান্ড’। অর্থাৎ ভাষা যা-ই হোক না কেন, উত্তরটা সবসময়েই বোঝাতো : ‘এই শহরের নাম কালো দেশ’-ব্ল্যাকল্যান্ড। এমনকী তথ্যটা হয়তো লাতিনেও পৌঁছে যেতো জিজ্ঞাসুর কানে : ইস্তা উস্‌ তেরা নিগ্ৰা এস্ত্’ কৌতূহলী পথিকের সঙ্গে হয়তো দৈবাৎই, তাহ’লে, দেখা হ’য়ে গেছে জোসিয়াস এবারলির, প্রাক্তন অধ্যাপক, যিনি ব্ল্যাকল্যান্ডে তাঁর ভাষাতত্ত্বে অগাধ পাণ্ডিত্যের কোনো চাহিদাই নেই দেখে এক দোকান খুলে বসেছেন, আর হ’য়ে উঠেছেন- তেমন বৈয়াকরণ মানে-টানে কিছু না-থাকলেও, ‘জোসিয়াস এবালি, দাওয়াই নির্মাতা, রঞ্জকসামগ্রী’ বিক্রেতা।

এই নয়া বাবিল মিনারে সব ভাষাই বলা হ’য়ে থাকে, যার জনবল-বারজাক মিশন যখন কুবোর কাছে ভির্মি খেয়ে প’ড়ে কুপোকাৎ হ’য়ে গেছে—ছিলো ৫,৭৭৮ আফ্রিকি নারীপুরুষ বাদ দিলে, ১,০৩০ জন গোরা। যদিও এরা সবাই বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে এসেছে, প্রায় সকলেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা ছিলো কিন্তু এক : এরা হয় দ্বীপান্তর থেকে পালিয়েছে আর নয়তো জেলখানাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং পশ্চাদ্দেশ দেখিয়েছে—এরা হচ্ছে দিগ্বিদিকহারা ডানপিটের দল যারা ন্যায় ছাড়া আর-সব কাজেই একপায়ে খাড়া, সমাজখেদানো দেশবিদেশতাড়ানো ছন্নছাড়ার দল যারা যে-কোনো অধম কাজ করতেই রাজি। তবে এই জগাখিচুড়ি জনসমাবেশ গোরাদের মধ্যে ইংরেজদের সংখ্যাই ছিলো সবচাইতে বেশি, কাজেই ইংরেজি ভাষারই খুব-রমরমা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এই ইংরেজিতেই পালের গোদা ছাপেন তাঁর যাবতীয় বিজ্ঞপ্তি ও ঘোষণা, আর আঞ্চলিক সরকার—যদি নামকাওয়াস্তে একটা আঞ্চলিক সরকার থেকে থাকে—ছাপায় তার সংহিতা বা অনুশাসন—অর্থাৎ ডিক্রি; আর এই শহরের খাশ, সরকারি, সংবাদপত্র হচ্ছে দ্য ব্ল্যাকল্যান্ড থান্ডারবোল্ট।

এই সংবাদপত্র যে চমকপ্রদ, এটা বললে বেশ কমিয়েই বলা হয়। তার বিভিন্ন সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত নিচের এই ক-টি টুকরো দেখলেই তা যে-কারু হাড়ে হাড়ে মালুম হবে :

‘আজ জন অ্যানড্রু নিগ্রো কোরোমোকোকে ফাঁসিতে লটকেছেন : হতচ্ছাড়া তাঁর মধ্যাহ্নভোজের পর তাঁর জন্যে গড়গড়া আনতে ভুলে গিয়েছিলো।’

‘কাল সন্ধেয়, ছটার সময়, দশটা হেলিবিমান কুরকুসু আর বিদির উদ্দেশে উড়ান দেবে, সঙ্গে যাবে কাপ্তেন হিরাম হারবার্টের নেতৃত্বে দশজন হর্ষচরিত। তিন বছরের মধ্যে এই দুটো গ্রামের কোনোটাতেই যাওয়া হয়নি, ফলে এদের ওপর চরম হামলা চালানো হবে; একই রাত্তিরে ফিরেও আসবে তারা।’

‘আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে জনৈক সাংসদ বারজাকের পরিচালনায় একটি ফরাশি মিশন শিগগিরই কোনোক্রি থেকে বেরিয়ে পড়বে। বলা হয়েছে এই মিশন সিকাসো আর উয়াগাদুগ্ হ’য়ে নাইজারের তীরে পৌঁছুবার পরিকল্পনা করেছে। আমরা যথারীতি সতর্কতামূলকব্যবস্থা নিয়েছি। কালো প্রহরীদের কুড়িজন আর হর্ষচরিতদের দুজন সারাক্ষণ এদের ওপর নজর রেখে চলবে। কোনো উপযুক্ত মুহূর্তে কর্নেল এডওয়ার্ড রুফাস এদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দেবেন। রুফাস, আমরা সবাই জানি, ঔপনিবেশিক পদাতিক বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন, তিনি ল্যকুর নাম নিয়ে একজন ফরাশি লিউটেনান্টের ছদ্মবেশে গিয়ে হাজির হবেন এবং যথাকালে ফরাশি সেনাবাহিনীর রীতিনীতি জানেন ব’লে—তার সুবিধে নেবেন; উদ্দেশ্য, যেমন ক’রেই হোক উক্ত বারজাকের মিশনটি বানচাল ক’রে দেয়া, যাতে কিছুতেই তিনি তাঁর দলবল নিয়ে নাইজারের তীরে পৌঁছতে না পারেন।’

আজ, গার্ডেন ব্রিজের ওপর, এক আলোচনার ফলে কৌশুলি এল্‌হে উইলিস বাধ্য হয়েছেন হর্ষচরিত কনস্টানটিন বারনার্ডের মাথার খুলিতে কতগুলো গুলি ঢুকিয়ে দিতে। হর্ষচরিত বারনার্ড তার ফলে রাঙানদীতে প’ড়ে যায়, আর তার মাথার খুলির অতিরিক্ত-ভারে-তাতে আবার সম্প্রতি কতগুলো শিসের গুলির ওজনও যোগ হয়েছে—-নদীর জলে ডুবে যায়। মৃত ব্যক্তির স্থানে এখন কাকে বাহাল করা হবে, এই নিয়ে তক্ষুনি এক সভা বসেছিলো। ঠিক হয়েছে গিলম্যান এলির ওপরই এই দুর্লভ সম্মান বর্তাবে : ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড আর জার্মানির আদালতে সবশুদ্ধু সতেরোবার বিচারে তার দণ্ড হয়েছিলো, সবশুদ্ধু তার ২৯ বছর জেলখানায় আর ৩৫ বছর দ্বীপান্তরে কাটাবার কথা ছিলো। গিলম্যান এলি এখন থেকে হোমগার্ডের বদলে হর্ষচরিতদের দায়িত্ব পালন করবে। তার প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা রইলো।’

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এ-সব খবরে যাদেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কারু পদবি উল্লেখ করা হয়নি। ব্ল্যাকল্যান্ডে এটাই দস্তুর, যেখানে নতুন-কেউ এলে সে তক্ষুনি জীর্ণ বসনের মতো তার পারিবারিক পদবি ত্যাগ ক’রে বসে—সেগুলো জানেন শুধু সর্বেসর্বা, বড়োকর্তা, চীফ। শ্বেতাঙ্গ, অর্থাৎ গোরা অধিবাসীদের মধ্যে এই সর্বেসর্বা একটু আলাদা, নিঃসঙ্গই, লোকে তাকে সাধারণ লোকের মতোই চেনে জানে। কিন্তু তার নামটাও নিশ্চয়ই বানানো, পোশাকি ছদ্মনাম—যেটা যুগপৎ ভয়ংকর ও আতঙ্ক জাগানো : হ্যারি কিলার

বারজাক মিশনের সব সদস্যকে পাকড়ে ফেলবার দশ বছর আগে কোত্থেকে একদিন যেন মাটি ফুঁড়েই এসে উদয় হয়েছিলো হ্যারি কিলার। সঙ্গে তারই মতো যকৃৎ আর বৃক্কওলা আরো কয়েকজন সাগরেদ-মরুভূমির সেইখানটাতে এসেই তাদের আবির্ভাব হয়েছিলো, যেখানে পরে একদিন গ’ড়ে উঠেছিলো ব্ল্যাকল্যান্ড কিন্তু সে যখন এসেছিলো, তখন সেখানে ছিলো ধূ-ধূ বালি, আর সেইখানেই তাঁবু ফেলে সে বলেছিলো, ‘শহরটা গ’ড়ে উঠবে এখানেই।’ আর বালির মধ্যেই গজিয়ে উঠেছিলো ব্ল্যাকল্যান্ড, যেন মায়াবলে।

আশ্চর্য জায়গা এই ব্ল্যাকল্যান্ড। তাফাসায়েৎ উয়েদ্-এর ডান তীরে, জমির সমতলে ছিলো একটা খাত–রুক্ষ, শুষ্ক, হা-হা বালির খাত, আর যেন হ্যারি কিলারের মরুমায়াতেই সেখানে উপচে উঠলো জল, তাকে তৈরি করা হ’লো পরিখার মতো, উপবৃত্তাকার, উত্তর-পুব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম অব্দি জলের সমান্তরাল মেপে মেপে গেছে ১২০০ গজ, আর উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পুবে তেমনি নিখুঁত মাপজোক ক’রে গেছে ৬০০ গজ। তার উপরিতল তাই একশো একর, তিনটি অসমান ভাগে ভাগ-করা, তাকে ঘিরে আছে উপবৃত্তাকারেই অনধিগম্য জমাটমাটির দেয়াল, তিরিশ ফিটেরও বেশি-উঁচু, আর প্রায় ততটাই-পুরু নিচে-মাটির কাছে।

স্রোতের নাম এখন দেয়া হয়েছে রাঙানদী, নামকরণ হ্যারি কিলারেরই, তার প্রথম অংশটার পরিধি আড়াইশো গজ। নদীর পাড়ে দ্বিতীয় অংশটার সঙ্গে তাকে জুড়ে দিয়েছে একশোফিট চওড়া এক বুলভার-একেবারে সোজা তৃতীয় অংশটার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর তাতে ক’রে তার উপরিভাগের আয়তন আরো- পঁয়ত্রিশ একর বেড়ে গিয়েছে।

প্রথম অংশটায় থাকে ব্ল্যাকল্যান্ডের মাতব্বরেরা, তারা যাকে তাদের অভিজাত সম্প্রদায় ব’লে গণ্য করে, অর্থাৎ শাঁসালো মাল, কিন্তু যেন বিরোধাভাস হিশেবেই তাদের নাম দিয়েছে হর্ষচরিত—মেরি ফেলোস। কয়েকজনকে অবশ্য নিয়তি উচ্চতর ধামেই নিয়ে গেছে, কিন্তু এই হর্ষচরিতদের ভ্রুণ ছিলো হ্যারি কিলারের আদি- সাগরেদদেরই মধ্যে। এই শাঁসালোদের ঘিরেই দেখতে-না-দেখতে এসে জড়ো হয়েছে দলে-দলে দস্যুডাকাত, কেউ পালিয়েছে হাজত থেকে কেউ-বা দ্বীপান্তর থেকে, যাদের কাছে হ্যারি কিলারের প্রতিশ্রুতি ছিলো, তাদের জঘন্য কাজকারবারের বাধাবন্ধহীন উদ্দাম স্বাধীনতা। অচিরেই হর্ষচরিতদের সংখ্যা হ’য়ে উঠেছে ৬৬৬, কিছুতেই কোনো ছুতোতেই যে-সংখ্যা আর নাকি বাড়ানো যাবে না।

তাদের ওপর অগুনতি কাজের ভার। প্রায় সেনাবাহিনীর মতোই কঠোর রীতি- শৃঙ্খলায় সুগঠিত, তাদের আছে একজন কর্নেল, পাঁচজন কাপ্তেন, দশজন লিউটেনান্ট আর পঞ্চাশজন সার্জেন্ট, যথাক্রমে পাঁচশো, একশো, পঞ্চাশ এবং দশজন লোককে চালাবার ভার তাদের ওপর। তারাই ব্ল্যাকল্যান্ডের সেনাবাহিনী, যুদ্ধই তাদের জীবিকা –না, জীবিকা নয়, ব্যবসা ও নেশা। কেননা এ-যুদ্ধে মানইজ্জতের কোনো বালাই নেই, এ-যুদ্ধ লুঠতরাজের যুদ্ধ, শুধু গ্রামের পর গ্রাম ছারখার ক’রে দেয়া উৎখাত ক’রে দেয়াই এদের কাজ-আর যদি গ্রামের লোকদের বন্দী ক’রে গোলাম বানাতে না-পারে তো তাদের মেরে ফেলাই যে-যুদ্ধের প্রায় একমাত্র অভিপ্রায়। এই হর্ষচরিতেরা শহরের কোতোয়ালিও চালায়; চালায় চড়চাপড় লাথিঘুষিতে-যদি- না রিভলবারই ব্যবহার ক’রে বসে : তারাই সামলায় গোলামদের, গোলামরা গায়ে গতরে খাটে, চাষবাস দ্যাখে, যা-কিছু কায়িকশ্রমের কাজ সব এদেরই করবার কথা। কিন্তু হর্ষচরিতদের আসল কাজ মহামান্য মাতব্বরপ্রধানের দেহরক্ষীর কাজ করা এবং অন্ধের মতো তাঁর হুকুম তামিল করা।

শহরের তৃতীয় অংশটাই কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরে উপবৃত্তকার একটি চাপ, লম্বায় প্রায় ছশো গজ আর চওড়ায় পঞ্চাশ। এর দুটো প্রান্তই গিয়ে মিশেছে প্রথম অংশে আর রাঙানদীতে-রেডরিভারে, তারপর অনুসরণ ক’রে এসেছে শহরের পরিসীমা তার বাইরের সীমান্তরেখা তার দ্বিতীয় অংশের সীমারেখার মাঝখানে, যেখানে রাখা হয় গোলামদের, এরা ক্রীতদাসও নয়, কেননা এদের কিনে-আনা হয়নি, এদের জোর ক’রে ধ’রে আনা হয়েছে, অর্থাৎ কেনাগোলামের চেয়েও অধম। এই তৃতীয় অংশেই থাকে, সাধারণভাবে বেসরকারি সংস্থা হিশেবে, সেইসব গোরা –যারা প্রথম অংশে থাকবার অনুমতি পায়নি। পুরসভা, নাগরিক সংঘ- যা-ই নাম দেয়া যাক, এই গোরারা অপেক্ষা ক’রে থাকে কখন আসন ফাঁকা হবে হর্ষচরিতদের—আর তার জন্যে খুব-একটা অপেক্ষাও করতে হয় না, কারণ ব্ল্যাকল্যান্ডের নৃশংস রীতিনীতি প্রায়ই মৃত্যু ঘটায় এর-ওর-এরা এই অপেক্ষার সময় কাটায় নাগরিক সংগে, যাকে বলা যেতে পারে শোধন-স্টেশন—মূল্য লক্ষ থাকে, হর্ষচরিতদের বেহেস্ত।

ততদিন টিকে থাকতে হবে তো—কেননা শহরের যাবতীয় নাগরিক ক্রিয়াকলাপ এবং হর্ষচরিতদের মাসোহারা জুগিয়ে থাকেন খোদ সর্বেসর্বা—ফলে এরা নানারকম ব্যবসায় মন দেয়। এই অংশ এই শহরের গঞ্জ, সদাগরি কেন্দ্র, আর এখান থেকেই হর্ষচরিতরা এসে তাদের যাবতীয় পণ্য খরিদ ক’রে আর ভোগ্যপণ্যের জন্যে তাদের খাঁই যেন কিছুতেই আর মেটে না, এমনকী বিলাসের সেরা উপকরণটি অব্দি তাদের হাতের কাছে থাকা চাই। কিন্তু এ-সব পণ্য ব্যবসাদারদের কিনে আনতে হয় খোদ সর্বেসর্বার কাছ থেকে—আর এই মহারথী তো এ-সব জুটিয়েছেন লুঠতরাজ ক’রে, আর ইওরোপের সর্বাধুনিক ভোগ্যপণ্য যে তিনি কেমন ক’রে কোন-চুলো থেকে জোগাড় করেন, তা শুধু তিনিই জানেন-আর হয়তো জানে তাঁর একেবারে জিগরি দোস্তেরা।

এই তৃতীয় অংশে আছে ২৪৬ জন গোরা—তাদের মধ্যে ৪৫ জন শ্বেতাঙ্গিনী –আর তারা এই গোরাপুরুষদের যথার্থ সহচরী, কেননা কুকর্মের জন্যে তাদের নামেও হুলিয়া আছে, তারাও কয়েদখানা বা দ্বীপান্তর থেকে পালিয়ে এসেছে।

প্রথম আর তৃতীয় অংশের মধ্যে আছে—যোজক হিশেবেই যেন—দ্বিতীয় অংশ। দ্বিতীয় অংশের জমি সাকুল্যে ৬৩ একর। এটা হ’লো গোলামখানা : এর ৫,৭৭৮ জন গোলামের মধ্যে ৪,১৯৬ পুরুষ আর ১,৫৮২ মেয়ে। সেখানেই, প্রায় ব্যতিক্রমবিহীনভাবে, গোলামগিরিতেই তাদের জীবন কাটে। সেখানেই আছে তাদের কুঁড়েবাড়ি-গরিবখানা –যার মধ্যে দুঃস্থ, নিঃস্ব, নিঃসহায় জীবন কাটিয়ে দেয় তারা।

রোজ ভোরে তার দেয়ালে খুলে যায় চারটে দরজা, আর হাতে মুগুর কিংবা বন্দুক নিয়ে গোরুভেড়া খেদাবার মতো ক’রে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে আসে হর্ষচরিতেরা। এই কালো আফ্রিকিদের মধ্যে যারা শহরটাকে বাসযোগ্য ক’রে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। না, তারা পালে-পালে গিয়ে হাজির হয় খেতে-খামারে, চাষের মধ্যে। সন্ধেবেলায় এই হতভাগারা আবার তেমনি-তাড়িত-ফিরে আসে তাদের দুঃস্থ আস্তানায়, আর ফটকের ভারি ভারি দরজাগুলো বিকট আওয়াজ ক’রে বন্ধ হ’য়ে যায়—পরদিন সকালের আগে সেগুলো আর খুলবে না। বাইরের জগতে যাবার আর-কোনো দরজাই নেই সেখানে। তাদের একদিকে আছে হর্ষচরিতেরা— অন্যদিকে হবু-হর্ষচরিতেরা—অর্থাৎ নাগরিক সংঘ। এবং বর্বরতায়, রক্তপিপাসায় কেউ কারু চাইতে কম যায় না।

এই হতভাগাদের অনেকেই টেশে যায়, হয় জর্জর দারিদ্র্যে, অভাবে-অনটনে, অথবা তাদের পাহারার হাতে মার খেয়ে—পাহারারা সবাই খুনে, রক্তপিপাসু। নিতান্তই তুচ্ছ অরুচিকর তথ্য এটা। কেননা গোলামের সংখ্যা ক’মে গেলে উদয়াস্ত তাদের স্বাচ্ছন্দের জন্যে খাটবে কে। তবে তুচ্ছ এইজন্যে যে আরেকবার হামলা চালালেই শূন্যস্থান পূর্ণ হ’য়ে যায়। আর যাদের ঘাড় ধ’রে নিয়ে গিয়ে মরণকে খাওয়ানো হয়েছে তাদের জায়গা দখল ক’রে বসে নতুন শহিদেরা।

‘তানতীরের এই জেলা-উপজেলাগুলোই কিন্তু সমস্তটা ব্ল্যাকল্যান্ড গ’ড়ে দেয়নি। রাঙানদীর বামতীরে মাটি উঠে গেছে আচম্বিতে, সটান, খাড়া, প্রায় পঞ্চাশ গজ উঁচু একটা টিলা। বাহির-দেয়াল আরো প্রসারিত হয়েছে এখানে। আলাদা ক’রে চিহ্নিত ক’রে গেছে এক বারোশো গজ আয়তনের সমায়তক্ষেত্র—নদীর পাড় ধ’রে, আর তীর থেকে তিনশো গজ দূরে স’রে গিয়ে। এই দ্বিতীয় শহর, প্রথমটার চেয়ে ছোটোই হবে, কারণ সেখানে আছে প্রায়-সত্তর একর জমি, নিজেকে দু-ভাগ করেছে আড়াআড়ি তির্যকভাবে বসানো একটা উঁচু দেয়াল দিয়ে।

এর একটা ভাগ পড়েছে টিলাটার উত্তর-পুবদিকের ঢালে, তাকে তৈরি করা হয়েছে দুর্গবীথিকার আদলে, সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত-এক চক, উত্তর প্রান্তের সঙ্গে সে সংযোগ টিকিয়ে রেখেছে একটা সেতু দিয়ে, তার নাম গার্ডেন ব্রিজ-তার মারফৎই হর্ষচরিত এবং হবু-হর্ষচরিতগণ এখানে যাতায়াত করতে পারে। অন্য- অর্ধেকটা চুড়োয় বসানো, আর তাতেই আছে শহরের প্রাণকোষ

উত্তরপ্রান্তে, চকটার পাশেই, উঠে গিয়েছে বিশাল এক চতুর্ভুজাকার নির্মাণ, দু-পাশে তার দেয়াল। এর উত্তর-পশ্চিম মুখটা রাঙানদীর দিকে তাকিয়ে আছে নব্বুই ফিট উঁচু থেকে। তাকে লোকে বলে রাজভবন, এটাই হ্যারি কিলার আর তার নবরত্নের বাসস্থান—এই নবরত্নেরা তার কৌশুলি। অদ্ভুত এই কৌশুলিরা, তাদের এই সর্বেসর্বার, এই মহামাতব্বরের, সকল কাজেরই কাজি—সব কাজেই তাদের সমান অংশ। সর্বেসর্বা প্রভুর দেখা সামান্য-মরমনুষ্য পায় না—তিনি শুধু, অনধিগম্য নন, অদৃশ্যও থাকেন সবসময়— তার শ্রীমুখ থেকে কোনো বাক্য খসলে তার আর কোনো নড়চড় হয় না, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না—তবে এই হাকিম নিজেই নড়েন না—আর তাঁর মুখ থেকে খসা ইচ্ছাগুলো মুহূর্তে পালন করার দায়িত্ব এই অদ্ভুত কৌশুলিদের ওপর। কৌশুলিসভার, নবরত্নের, যাবতীয় পরামর্শ তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল করাতেই শেষ।

অন্য-একটা সেতু, রাত্তিরে নিরেট লোহার গরাদ নেমে আসে তাকে সুরক্ষিত ক’রে; এই সেতুর নাম কাল ব্রিজ, ডানতীরের সঙ্গে শাসনযন্ত্রের পীঠস্থানের যোগাযোগ ঘটায় সে।

রাজভবনের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে দুটো ব্যারাক। একটা ব্যারাক নির্দিষ্ট হয়েছে বাছা-বাছা একডজন গোলামের জন্যে, তারা খাশ চাকর, এছাড়া আছে আরো- পঞ্চাশজন আফ্রিকি, তারাও বাছাই করা, সবচেয়ে-হিংস্র ও বর্বর প্রবৃত্তি যাদের তাদের মধ্য থেকেই এদের বাছাই করা হয়েছে—তারাই হচ্ছে ব্ল্যাকগার্ড-কালোপাহারা। অন্য ব্যারাকটায় থাকে চল্লিশজন গোরা ঠিক এই একই বর্বরতার বাহার দেখে তাদের বাছা হয়েছে; তাদেরই ওপর উড়নকলগুলোর উড়ালের গোপন দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে –ব্ল্যাকল্যান্ডে এই উড়নকলগুলোকে বলে হেলিবিমান।

কোনো-এক আশ্চর্য প্রতিভার অত্যাশ্চর্য উদ্ভাবন এই হেলিবিমানগুলো—এ-রকম শক্তিশালী কোনো উড়োজাহাজের কথা এর আগে কারু মাথাতেই আসেনি গড়ে। আড়াইশো মাইল গতিতে একটানা উড়ে যেতে পারে এরা তিনহাজার মাইল- পথে জ্বালানির জন্যে একবারও না-থেমেই। এই হেলিবিমানগুলোর কাছেই ব্ল্যাকল্যান্ডের হার্মাদেরা তাদের সর্বব্যাপিতার জন্যে ঋণী! কিন্তু শুধু সর্বত্রগামিতাই এর বৈশিষ্ট্য নয়, লুঠতরাজরাহাজানির পর চক্ষের পলকে অকুস্থল থেকে উধাও হ’য়ে যাবার আশ্চর্য সুবিধেটা দিয়েছে এই হেলিবিমান। এই হেলিবিমানগুলোর ওপরই, প্রধানত, হ্যারি কিলারের যাবতীয় স্বৈরাচারী ক্ষমতা নির্ভর ক’রে আছে।

সর্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছে হ্যারি তার অজ্ঞাত সাম্রাজ্যটির শাসন চালায়—এই ব্ল্যাকল্যান্ড যার রাজধানী। বিভীষিকার মারফৎই সে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে— আর তাকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাই ব’লে এই স্বৈরাচারী ককখনো ভুলেও ভাবেনি যে বিদ্রোহের কোনো সম্ভবনা নেই—শুধু ভয়ের ওপর নির্ভর ক’রে সবাইকে কাবু ক’রে রাখলে একদিন-না-একদিন লোকে যে খেপে যাবেই, কি কালো, কি গোরা, তা সে জানে। সেইজন্যেই এমন-উঁচুতে গ’ড়ে তুলেছে তার রাজভবন, যেখান থেকে কামান দেগে সে উড়িয়ে দিতে পারে শহরটাকে—দুর্গবীথিকা আর এই ব্যারাক শুদ্ধু। বিদ্রোহের ক্ষীণ ইঙ্গিতই সংকেত হবে নির্বিচার-হত্যার-যার হাত থেকে কেউ পার পাবে না। মরুভূমি তৈরি ক’রে রেখেছে অনতিক্রম্য বাধা, আর যেই একবার এই দস্যুর ডেরায় ঢুকবে, তাকেই এই হার্মাদদের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে বেরিয়ে আসার আশা ছেড়ে দিতে হবে।

অথচ এমনিতে নিখুঁত চলে ব্ল্যাকল্যান্ডের জীবন : চমৎকার-পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সারাক্ষণ যত্ন নেয়া হচ্ছে সবকিছুর, যে-পণ্য চাই তা-ই সেখানে মেলে—যদি অবশ্য তোমার কড়ি বা ক্ষমতা থাকে। হর্ষচরিত বা হবু-হর্ষচরিতদের এমন-কোনো বাড়ি নেই, যেখানে টেলিফোন নেই। প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বাড়ি, এমনকী গুলামখানার দুঃস্থতম কুঁড়েতেও, শহরের প্রধান প্রণালী থেকে চব্বিশ ঘণ্টা জল আসে, আর বিদ্যুৎ পাওয়া যায় সারাক্ষণ।

মাত্র দশবছর আগে খাঁ-খাঁ মরুভূমিতে গ’ড়ে উঠেছিলো এই শহর—তার মধ্যেই তার এই উন্নতি। কিন্তু শহরের চারপাশে বিস্ময়টা আরো-মাত্রাছাড়ানো। যদিও তার চারপাশে মরুভূমির হলুদ সায়র এখন ধূ-ধূ করে, কিন্তু সে তার দেয়াল থেকে আরো-কয়েক মাইল চ’লে গেলে তবেই। শহরের কাছাকাছি যে-জমি এতই বিশাল যে তার শেষসীমা দিগন্তের ওপারে গিয়েই যেন পথ হারিয়েছে, সেই জমি মরুভূমির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে ব্ল্যাকল্যান্ড। কেননা সেখানে চাষ হয় সর্বাধুনিক দক্ষ-সব প্রকৌশল মারফৎ : এখানেই গজায়, ক্রমবর্ধমান সাফল্যের সঙ্গে, আফ্রিকা আর ইওরোপের সমস্ত শাকসব্জি ফলমূল।

হ্যারি কিলারের সৃষ্টি এটাই : যদি এই বাহাদুর ব্যবস্থাপনা শুধু দুষ্কর্মের পেছনেই ব্যয় করা না-হ’তো তো সারাজগৎ সমবেতকণ্ঠে তার সাধুবাদ দিতো, জয়ধ্বনি দিতো। কিন্তু কেমন ক’রে সে ঘটিয়েছে, মরুভূমির মধ্যে, এই আশ্চর্য রূপান্তর? কেমন ক’রে সে উর্বর ক’রে তুলেছে এই রুখু-শুখু বন্ধ্যা মরুভূমিকে? সারা উদ্ভিদজগৎ, সারা জীবজগৎ – নিম্নতম জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত—জল বাদ দিয়ে কারু একমুহূর্তও চলে না- জলই জীবন, জলই চালায় পৃথিবীকে। হ্যারি কিলার এখানে জল পেলো কোত্থেকে, যেখানে বছরের পর বছর একবার বৃষ্টি পড়ে না–কিংবা বৃষ্টি নামলেই যাকে শুষে নেয় তৃষাতুল তপ্ত বালি-হ্যারি কিলার সেখানে এত জল পেলো কোথায় যে এমনভাবে চমৎকার সেচের ব্যবস্থা করতে পেরেছে? সে কি ভেলকি জানে না কি, ভোজবাজি? না-হ’লে কেউ যা তার আগে পারেনি, সে হঠাৎ এই অলৌকিক রূপান্তর ঘটাতে পেরেছে কীভাবে?

না। কোনো ভেলকি বা ভোজবাজি নয়। হ্যারি কিলারের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক শক্তিও নেই; যদি শুধু নিজের উদ্ভাবনী বুদ্ধির ওপর তাকে নির্ভর করতে হ’তো তাহ’লে কোনোদিনই সে এ-সব ভোজবাজি দেখাতে পারতো না। কিন্তু হ্যারি কিলার তো একা নয়। রাজভবন, যেখানে সে থাকে তারই বাছাই- বাছাই সব দুষ্কর্মের সাথীদের নিয়ে, ইয়ার্কি ক’রেই যাদের সে নাম দিয়েছে কৌশুলিসভা, উপদেষ্টা পরিষদ, যেখানে ব্যারাকে থাকে ব্ল্যাকগার্ড, আর হেলিবিমান রাখার ছাউনি আর চাতাল—এই সবকিছু মিলেই ব্ল্যাকল্যান্ডের শেষঅংশটার মাত্র একটা ছোট্ট টুকরোই যায়। মস্ত খোলা-জমির মাঝখানে আরো-সব বাড়ি উঠেছে— কিংবা বলা যায় প্রথম শহরটার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরো-একটা শহর; এদের বাড়িঘরগুলোর ধরন আলাদা, সামনে আছে উঠোন, পেছনে সাজানো বাগান- আর সবমিলিয়ে এরা প্রায় কুড়ি একর জমি নিয়ে নিয়েছে। রাজভবনের সামনে উঠে গেছে কারখানা

কারখানা যেন এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র, স্বশাসিত শহর, যার ওপর সর্বেসর্বা ছড়িয়েছে অঢেল সম্পদ, অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্য, যাকে সে রেয়াৎ করে, সমীহ করে, যাকে নিজেকেও সে বলেনি কোনোদিন-যাকে সে একটু ভয়ও করে। পুরো ব্ল্যাকল্যান্ডের নীল ছকটা যদি সে-ই ক’ষে থাকে, তবে সেই ছটার সার্থক রূপায়ণ করেছে এই কারখানা-কারখানা শুধু তাকে হাতেকলমে বানিয়েই দেয়নি সব, তাকে সর্বাধুনিক সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ জুগিয়েছে, টেলিফোন বিজলি চব্বিশঘণ্টার জল ইত্যাদি—এমনকী এমন-সমস্ত আশ্চর্য উদ্ভাবন দিয়ে তাকে প্রায় মায়ানগরী বানিয়ে তুলেছে, ইওরোপ যে-সব উদ্ভাবনের কথা জানবে-আরো অনেক পরে।

কারখানার দেহ-মন দুইই আছে। তার পরিচালকই তার আত্মা। আর তার শরীরটা তৈরি হয়েছে একশোজন প্রকৌশলবিদের সমবেত চেষ্টায়—যে-প্রকৌশলীরা এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে, তবে যাদের মধ্যে ফরাশি আর ইংরেজদের সংখ্যাই সর্বাধিক। তাদেরও বেছে-বেছে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে—নিজের-নিজের বিষয়ে এরা উৎকর্ষের শেষ সীমায় এসেই পৌঁছেছে, আর তাদের এখানে আনা হয়েছে এক স্বর্ণসেতুর ওপর দিয়ে। প্রত্যেকেই পায় আকাশছোঁয়া মাসোহারা, তার বদলে তাদের মেনে নিতে হয় ব্ল্যাকল্যান্ডের অনড় নিয়মকানুন।

এই প্রকৌশলীদের সবাই হাতে-কলমে কাজ ক’রেই ওস্তাদ, তাদের মধ্যে কৃতবিদ্য যন্ত্রবিদের সংখ্যাই সবচেয়ে-বেশি। কয়েকজন আবার বিবাহিতও, তাই কারখানার আওতায় আছে সাতাশজন মেয়ে, কারু-কারু আবার বাচ্চাও আছে।

এরা কিন্তু সবাই খাঁটি আর সৎ আর পরিশ্রমী : শহরের অন্যান্য লোকদের পাশে কেমন যেন বেমানান, সবাই এরা কারখানাতেই থাকে, আর এই কারখানার চৌহদ্দি থেকে বেরুনো তাদের পক্ষে প্রায়-অসম্ভব, কড়া নিষেধ আছে তাদের ওপর। যদি তারা কখনও বেরুতেও চাইতো, তাদের পক্ষে পাহারার চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে-পড়া সম্ভব ছিলো না, কারণ দিনে-রাতে অষ্টপ্রহরই তাদের ওপর কড়ানজর রাখতো ব্ল্যাকগার্ড আর মেরিফেলোরা, কিন্তু তাদের চাকরি দেবার সময়েই বিশদ ক’রে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যাপারটা, আর এই নিয়মটা ভাঙবার কোনো তাগিদই কোনোদিন অনুভব করেনি কেউ। যে-ইনাম মিলছে তাদের, যে-রকম অচিন্ত্যনীয় বেতন, তার বিনিময়ে যতদিন তারা ব্ল্যাকল্যান্ডে কাটাবে ততদিন সারা জগতের কাছ থেকেই গুটিয়ে থাকতে রাজি হয়েছে তারা। তারা যে শুধু কারখানা ছেড়ে বেরুতে পারবে না তা-ই নয়, তারা বাইরের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ ও রাখতে পারবে না—বাইরের কাউকে চিঠি লেখা যেমন বারণ, তেমনি মানা আছে বাইরের কারু চিঠি পাবারও।

যদিও অনেকেই এত-কড়াকড়ি দেখে একটু থমকে গিয়েছিলো, অনেকেই আবার বেতন বেড়ে যাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে যা আপত্তি ছিলো সব খপ ক’রে গিলে ফেলেছে। এককালে এতই গরিব ছিলো যে দু-বেলার রুটি জোগাতে গিয়েই প্ৰাণান্ত হ’তো—এখন এইসব কড়া বাধানিষেধের মধ্যে থাকলে যদি সচ্ছলভাবে নিশ্চিন্তে জীবন কাটানো যায়, তবে সত্যি বলতে-কী-ই বা হারালো তারা? অজানার মধ্যে ঝাঁপ খাবার সব ভয়কে জয় ক’রে নিয়েছে ঐশ্বর্যের প্রতিশ্রুতি; আর, সত্যি- তো, তারা নিজেদের চোখ ঠেরেছে, না-হয় বাইরের একটু ফুর্তিফার্তা থেকে নিজেদের কয়েকদিন বঞ্চিত ক’রেই রাখা গেলো –তাতে আর কোন-বাইবেল উলটে যাবে।

চুক্তিতে সই করবামাত্র, যেমন কথা, তেমনি কাজ। যে-জাহাজে টিকিট কাটা হয়েছে, সেই জাহাজেই উঠে পড়েছে নতুন কর্মচারীরা, আর সেই জাহাজ তাদের নিয়ে গেছে বিসাগো দ্বীপগুলোর একটাতে, পর্তুগিজ গিনির উপকূলে যে-দ্বীপপুঞ্জ আছে তারই একটায়, যেখানে তাদের জাহাজ থেকে নেমে পড়তে হয়েছে। তারপর তাকে রাজি হ’তে হয়েছে তার চোখ বেঁধে দেয়ায়; আর তীরের একটা পরিত্যক্ত- ফাঁকা জায়গায় একটা বড়ো আশ্রয় বানানো হয়েছিলো হেলিবিমানগুলোর জন্যে, সেখান থেকে হেলিবিমান তাদের উড়িয়ে নিয়ে এসেছে ব্ল্যাকল্যাণ্ডে—ছ-ঘণ্টার মধ্যেই, চোদ্দেশো মাইল আকাশপথ পেরিয়ে। হেলিবিমান থেমেছে রাজভবন আর কারখানার মধ্যকার এস্প্ল্যানেডে, আর চোখ খুলে দেবার পর কর্মীরা নেমেছে মাটিতে, ঢুকে পড়েছে কারখানার চৌহদ্দিতে, যদ্দিন-না চুক্তি শেষ হচ্ছে তদ্দিন আর সেখান থেকে তাদের বেরুবার জো নেই। তবে একটা ফাঁক থেকে গেছে অবশ্য শর্তগুলোর মধ্যে। যদি তার ব্ল্যাকল্যান্ডে এভাবে কয়েদ হ’য়ে থাকতে কোনো সময় রুচিতে বাধে, তবে সে চিরকালের মতো এ শহর ছেড়ে চ’লে যেতে পারে। তখন আরেকটা হেলিবিমান, চোখবাঁধা, তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে এপ্ল্যানেড থেকে বিসাগো দ্বীপপুঞ্জে, যেখান থেকে সে ইওরোপ যাবার জন্যে স্টীমবোট পেয়ে যাবে।

অন্তত, এই আশ্বাসই দেয়া হয়েছে কর্মীদের যারা এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছে। কারখানায় তাদের সাথীরা যে-খবরটা পায়নি, তা অবশ্য এই : এরা কেউই কোনোদিনই তাদের গন্তব্যে আর পৌঁছুতে পারেনি, তাদের হাড়গোড় মরুভূমির কোথাও শ্বেতসারে পরিণত হচ্ছে, আর যে-বেতন তাদের দেয়া হয়েছিলো রাজভবন থেকে, সেই টাকাটা ফের জমা প’ড়ে গেছে রাজভবনের তহবিলেই। ফলে, শহরের খাজাঞ্চিখানা ককখনো শূন্য প’ড়ে থাকেনি—আর এইভাবেই ব্ল্যাকল্যান্ডের অস্তিত্বের কথাটা গোপন থেকেছে সকলের কাছে, আর হ্যারি কিলারের এই সাম্রাজ্যের কথা বাইরের পৃথিবীর কাছে সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গেছে।

তবে প্রস্থানের ঘটনা ঘটেছে কদাচিৎ। শহরের লোকজনের জীবন কেমনভাবে কাটে তা তারা জানতে পারেনি—জানা সম্ভবই ছিলো না, কোনো সন্দেহই তারা পোষণ করেনি সে-সম্বন্ধে, তাই দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই কখনও কারখানা ছেড়ে চ’লে যেতে চায়নি। তাদের মধ্যেই থাকে ন-জন কালোগোলাম, নারী পুরুষ দুইই আছে ন-জনের মধ্যে, তাদেরই মতো এরাও বন্দী, যারা ঘরের কাজে কর্মীদের স্ত্রীদের সাহায্য করে। কর্মীরা, তাই এই যক্ষপুরীতে তাদের স্বদেশের চাইতে ভালোই আছে—আর মনের মতো কাজ পেয়েছে ব’লে অনেক সময় বাড়তিই খাটে— রাত্তিরেও অনেকক্ষণ। কর্মীদের ভার একজনেরই ওপর, তাদের পরিচালক, ফরাশি বৈজ্ঞানিক একজন—মার্সেল কামারে, যাঁকে তারা প্রায় ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ব’লেই মনে করে।

কারখানায় বাসিন্দাদের মধ্যে একমাত্র মার্সেল কামারেরই যখন-তখন যেখানে- খুশি যাবার অধিকার ছিলো-রাস্তায় তো বেরুতেই পারেন, ব্ল্যাকল্যান্ডের আশপাশের দেশেও যেতে পারেন, যথেচ্ছ। এই স্বাধীনতা কাজে খাটাতে তিনি বেশি সবুর করেননি, কসুরও করেননি, বরং চিন্তাচ্ছন্ন দার্শনিকের মতোই বিমনা ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে-ঘাটে; তাই ব’লে এই অনুমান করা সংগত হবে না যে তাঁর অধীনে যারা কাজ করে, তাদের চাইতে ব্ল্যাকল্যান্ডের কাজকারবার সম্বন্ধে তিনি বেশি ওয়াকিবহাল-সত্যি বলতে শহরের অদ্ভুত ব্যবস্থাপনার তিনি কিছুই জানতেন না, এমনকী শহরের নামটা শুদ্ধু না।

একদিন একজন কর্মী তাঁকে জিগেস করেছিলো, এ-জায়গাটার নাম কী। কামারে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন কিছুক্ষণ, তারপর কর্মীটিকে একেবারে তাজ্জব ক’রে দিয়ে বলেছেন, ‘আরে, সত্যি-তো, আমি তো জায়গাটার নামই জানি না।’

এর আগে কোনোদিনও তাঁর মাথাতেই আসেনি এমন-একটা অনুপুঙ্খ, এমন- একটা নাম জানবার আদপেই কোনো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আরো যেটা আশ্চর্য, এই প্রশ্নটা এবং তার কী উত্তর তিনি দিয়েছেন, তা কিন্তু তিনি পরমুহূর্তেই বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। তাঁর খেয়ালই যে এমন-একটা বিষয় নিয়েও মাথাঘামানো যেতে পারে।

সত্যি, ভারি-অদ্ভুত মানুষ আমাদের এই মার্সেল কামারে!

সম্ভবত বছর-চল্লিশ বয়েস। মাঝারি গড়ন, ঋজুরেখ কাঁধ, বক্ষোদেশ সমতল, সামান্য কয়েকগাছি সোনালি চুল তাঁর চেহারাকে কেমন-একধরনের পলকা পেলবতা দিয়েছিলো। হাত-পা সহজে নাড়েন না, চিরপ্রশান্ত তাঁর স্থৈর্য, আর কথাও বলেন শিশুর মতো সরল লাজুক ভঙ্গিতে, কেমন-একটু ক্ষীণ মৃদুস্বরে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন ককখনো মেজাজ খারাপ করেন না, কথায় কখনও রাগের লেশ থাকে না, এমনকী কোনো অস্থিরতারও না। সবসময়েই মাথাটা একটু ঝুঁকে-পড়া, বাঁমকাঁধের দিকে, যে মাথার ওজনটা তাঁর কাছে বড্ড-বেশি লাগছে, আর মুখমণ্ডলও কেমন বিবর্ণ, নীরস, হালকা একটু অসুখের ছোঁয়াই লেগে আছে যেন। কিন্তু একটাই সৌন্দর্যই ছিলো তাঁর : তাঁর আয়তনীল চোখদুটতে যেন আকাশছোঁয়া ভাবনার আভাস।

কেউ যদি খুব খুঁটিয়ে দেখতো, তবে ঐ চমৎকার চোখদুটিতে আরো কিছু আবিষ্কার ক’রে নিতে পারতো। মাঝে-মাঝেই সে-চোখের তারায় ভেসে যেতো আবছা-একটা ঝিলিক, মুহূর্তের জন্যে মনে হ’তো দৃষ্টিটায় বুঝি একটা সবহারা ভাব লুকিয়ে আছে। কেউ যদি হঠাৎ এই ফাঁকা, শূন্য, হারা দৃষ্টিটা দেখে ফেলতো, তাহলে এই সন্দেহ করতে দ্বিধা করতো না যে মার্সেল কামারে এক আস্ত-উন্মাদ— আর সে-যে মিথ্যা-কিছু অনুমান করতো, তাও নয়। দুর্দান্ত প্রতিভার সঙ্গে উন্মত্ততার দূরত্ব

কি নূন্যতম নয়? প্রতিভা কি পাগলামির সীমান্তে বসবাস করে না? তার দুর্বল, রোগাপটকা চেহারা এবং অলস, পেলব ভঙ্গি সত্ত্বেও মার্সেল কামারের মধ্যে যেন অফুরন প্রাণশক্তি টগবগ ক’রে ফুটেছে। দুর্দশা-দুরবস্থা, ভয়ংকর বিপদের সম্ভাবনা, নিষ্ঠুরতম অনটন—কিছুই তাঁকে নড়াতে পারে না। তার কারণ : এদের সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তাঁর ছিলো না। তাঁর স্বচ্ছ-নীল চোখ-দুটো সবসময়ে ফেরানো ভেতরমুখো, চারপাশে কী ঘটছে না-ঘটছে তার কোনো ছায়াই তাতে পড়ে না। তাঁর বসবাস যেন সময়ের পরপারে, এমন-এক আশ্চর্য জগতে যেখানে শুধু খ্যাপা কল্পনাদেরই আনাগোনা, সবসময়েই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মাথায় গভীরভাবেই ভাবেন তিনি সবসময়-শুধুই ভাবেন, সারাক্ষণ। মার্সেল কামারে একটা ভাবুকযন্ত্র বৈ আর-কিছুই নন-এমন-এক ভাবুকযন্ত্র, যেটা প্রচণ্ড-শক্তিমান, প্রবল- পরাক্রান্ত এবং ভয়ংকর-তাঁর আপাতসরল ভঙ্গি সত্ত্বেও।

এতটাই ভুলোমন যে সাঁৎ-বেরাকেও তিনি যেন অন্যমনস্কতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হারিয়ে দিতে পারতেন। পার্থিব জীবন যাকে বলে তার কাছে তিনি যেন এক অনাহুত ‘বিদেশী; কতবার যে টাল সামলাতে না-পেরে হোঁচট খেয়ে পড়লেন রাঙানদীতে-হয়তো ভাবছিলেন যে সেতু পেরুচ্ছেন বুঝি! তাঁর খাশ খিদমতগার আস্ত একটা বাঁদরের মতোই দেখতে, সেইজন্যেই সবাই এর নাম দিয়েছিলো জ্যাকো, জ্যাকোর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হ’তো না তাঁকে নিয়ন ক’রে দু-বেলা খেতে বসাতে। যখনই খিদে পেতো তখনই কিছু-না-কিছু মুখে দিতেন মার্সেল কামারে, ঘুমুতে যেতেন যদি-কখনও ঘুম পেতো – সে ঠা-ঠা দিনদুপুরেও হ’তে পারে, খাঁ-খাঁ নিশুত রাতেও হ’তে পারে।

দশবছর আগে, পরিস্থিতি তাঁকে আচমকা হ্যারি কিলারের সংস্পর্শে এনে দিয়েছিলো। একটা আশ্চর্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন—যখন খুশি যেখানে খুশি বৃষ্টি এনে দেবার পদ্ধতি। কেউ যদি শুনতে চাইতো, অমনি তাকে তাঁর সব স্বপ্ন তিনি খুলে বলতেন, তা সে দৈবাৎ-দেখা-হওয়া কোনো অচেনা লোক হ’লেও আপত্তি নেই; আর অন্য কয়েকজনের সঙ্গে-সঙ্গে হ্যারি কিলারও শুনেছিলো এই উদ্ভাবিত পদ্ধতির কথা, যেটা তখনও নিছক তাত্ত্বিক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু অন্যরা এই পাগলামির কথা শুনে হো-হো করে হেসে উড়িয়ে দিলেও, হ্যারি কিলার এই তত্ত্বটাকে সীরিয়াসভাবেই নিয়েছিলো, এতটাই সীরিয়াসভাবে যে তক্ষুনি সে তার ভাবী পরিকল্পনার একটা ছক কষে ফেলেছিলো!

হ্যারি কিলার যদি হার্মাদ হয়, তবে এমন-হার্মাদ যার দূরপ্রসারী দৃষ্টি আছে— অন্তত সে-ই বুঝতে পেরেছিলো জগৎ যে-প্রতিভাকে চিনতে পারেনি তাকে কী ক’রে কাজে লাগানো যায়। দৈব অকস্কাৎ কামারেকে তার হাতে এনে তুলে দিয়েছে, আর সে তাঁর স্বপ্ন সফল ক’রে তোলবার পথ দেখিয়ে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। তাকে সে নিয়ে গিয়েছে মরুভূমির ধূ-ধূ বিস্তারে, পরে যেখানে ব্ল্যাকল্যান্ড গড়ে উঠবে, বলেছে : ‘দেখি, আপনার সেই প্রতিশ্রুত বৃষ্টিকে এখানে ফেলুন, দেখি! আর বৃষ্টি যেন বাধ্য বশম্বদের মতো তক্ষুনি ঝমঝম ক’রে পড়তে শুরু করেছে সেখানে।

কামারে এক চিরন্তন জ্বরের ঘোরের মধ্যেই আছেন তারপর থেকে। যা-যা তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, সব তারপর একের পর এক ফ’লে গিয়েছে। বাদলযন্ত্রের পর তাঁর জ্বরাতুর মগজ উদ্ভাবন করেছে আরো হাজারো অদ্ভুত জিনিশ, যা থেকে হ্যারি কিলার মুনাফা লুঠেছে অন্তহীন, বৈজ্ঞানিক ভূলেও একবারও জানতেও চাননি তাঁর আবিষ্কারগুলো নিয়ে হ্যারি কিলার করেছে কী।

এটা হয়তো কেউ-কেউ বলবে যে তার আবিষ্কারের দুষ্প্রয়োগের জন্যে খামকা এমনকী পরোক্ষভাবেও কোনো বৈজ্ঞানিককে দোষী ক’রে লাভ নেই। একদিন যে রিভলবার বানিয়েছিলো সে কিন্তু জানতোই যে এ-রকম একটা অস্ত্র খুনোখুনি শুরু ক’রে দিতে পারে—নিশ্চয়ই এই কথা মনে রেখেই সে তার প্রথম রিভলবারটা বানিয়েছিলো।

হয়তো মার্সেল কামারে সম্বন্ধে, শেষপর্যন্ত, এ-কথা বলা যাবে না। যদি তাঁর মাথায় কখনও এই ভাবনা খেলে যেতো যে, আচ্ছা, এমন-একটা কামান বানানো যাক যার পাল্লাটা আগেকার সব কামানের চাইতে বেশি হবে, আর গোলাটাও বেশি- ভারি হবে, তবে তিনি তক্ষুনি হৃষ্টচিত্তে সেই কামানটার মাপজোক ঠিক করতে লেগে যেতেন, বার ক’রে ফেলতেন গোলাটা কেমন হবে দেখতে, খোলটার ভেতর কতটা বিস্ফোরক থাকবে…ইত্যাদি, আর তার মধ্যে তিনি বুদ্ধির ব্যায়াম ছাড়া আর- কিছুই দেখতে পেতেন ব’লে মনে হয় না। তিনি হয়তো বোমকেই যেতেন যদি শুনতেন তাঁর এই কামান কেউ বিনাশের কাজে, ধ্বংসের কাজে, লাগিয়েছে।

হ্যারি কিলার বৃষ্টি চেয়েছিলো, মার্সেল কামারে তাকে বৃষ্টি এনে দিয়েছেন। হ্যারি কিলার চাষের সরঞ্জাম চেয়েছিলো, আর মার্সেল কামারে পর-পর উদ্ভাবন করেছেন নতুন লাঙল, রোপণযন্ত্র, আগাছা তাড়ানো যন্ত্র, ফসল কাটা যন্ত্র, মাড়াই যন্ত্র, সব একসঙ্গে, একটা মোটর থেকেই সর্ববিদ্যাবিশারদ এই চাষের যন্ত্র তার শক্তি পাবে। হ্যারি কিলার তার কাছে চেয়েছিলো উড়াল কল—বিমান, আর মার্সেল কামারে তাকে দিয়েছেন হেলিবিমান—যেটা উল্কার বেগে পেরিয়ে যেতে পারে, এক বারেই তিন-তিন হাজার মাইল।

তাঁর পৃষ্ঠপোষক এ-সব যন্ত্র নিয়ে যে কী করে, মার্সেল কামারের মাথায় এ- কথাটা জিগেস করবারও কোনো তাগিদ কখনও হয়নি। তাত্ত্বিক চিন্তায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে শুধু মনে হয়েছে সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, কেমন ক’রে সব জট ছাড়িয়ে বানিয়ে তোলা যায় জিনিশটাকে—তাদের ব্যবহারিক প্রয়োগ কী হবে, সে নিয়ে তিনি ককখনো মাথা ঘামাননি। তিনি যে ব্ল্যাকল্যান্ডের সৃষ্টি চাক্ষুষ দেখেছেন, দেখেছেন কী ক’রে শাহারা মরুভূমির মধ্যে গ’ড়ে উঠেছে উর্বর ফলনজমি, এ-তথ্যটা তাঁর মনে কোনো রেখাপাতই করেনি। তিনি আবিষ্কার করেছেন পদ্ধতি, তা-ই এমনটা তো হবেই, এ-তো স্বতঃসিদ্ধ।

বরং মার্সেল কামারে হ্যারি কিলারের কাছে প্রথমেই চেয়েছেন একটা বড়ো কারখানা—যেন তিনি যা চেয়েছেন, তেমনতর কোনো সর্ববিদ্যাবিশারদ কারখানা বানানো ভারি-সহজ কাজ।

আর অমনি হ্যারি কিলার শয়ে শয়ে আফ্রিকিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় আশ্চর্য- ক্ষিপ্রতায় তাঁকে সেই কারখানা গ’ড়ে দিয়েছে। তারপর মার্সেল কামারে চেয়েছেন এটা-সেটা কলকব্জা, চেয়েছেন ডায়নামো, চেয়েছেন স্টীমএনজিন, চেয়েছেন তমুক ধাতু –আর দু-দিন আগে বা পরে, সব তাঁকে ফর্দ মিলিয়ে এনে হাজির করে দিয়েছে হ্যারি কিলার -যেন মায়াবলেই মরুভূমির মাঝখানে এসে হাজির হয়েছে বাষ্পচালিত এনজিন

মার্সেল কামারে চেয়েছেন দক্ষ কর্মী, কুশলী ও অভিজ্ঞ—আর একের পর এক কর্মীরা এসে হাজির হয়েছে, যতজন চেয়েছেন ততজন। কেমন ক’রে এই আশ্চর্য কাণ্ড সমাধা করেছে হ্যারি কিলার? মার্সেল কামারে সে নিয়ে আদপেই মাথা ঘামাননি। তিনি চেয়েছেন, তিনি পেয়েছেন : ব্বাস, ল্যাঠা চুকে গেছে। তাঁর কাছে এর চেয়ে সহজ কাজ কিছু আছে ব’লেই মনে হয়নি।

এমনকী, তাঁর সমস্ত স্বপ্নকে কাজে খাটিয়ে তুলতে গেলে কতটা পুঁজি লাগবে, তা নিয়েও তিনি মাথা ঘামাননি, ভুলেও কখনও জিগেস করেননি : ‘এত টাকা কোত্থেকে আসছে?’

ব্ল্যাকল্যান্ডে সেদিন সবকিছুই রীতিমাফিক চলেছে। কারখানায় কর্মীরা দম ফেলবার ফুরসৎ পাচ্ছে না। হুল্লোড়বাজ হর্ষচরিতেরা খেতে-খামারে খবরদারি করছে আফ্রিকি গোলামদের ওপর। নাগরিক সমিতি তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।

বেলা তখন এগারোটা। হ্যারি কিলার তার নিজের আপিশঘরে একাই ব’সে ছিলো। কী যেন ভাবছে যে গভীরভাবে, আর তার ভ্রুকুটিকুটিল মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তার ভাবনাগুলো নিশ্চয়ই খুব-সুমধুর নয়।

হঠাৎ ঝনঝন ক’রে টেলিফোন বেজে উঠলো।

‘শুনছি!’ রীসিভার কানে তুলে নিয়ে বললে হ্যারি কিলার।

‘পশ্চিমে, সতেরো ডিগ্রি দক্ষিণে, দশটা হেলিবিমান দেখা গেছে এক্ষুনি, ‘ টেলিফোন জানালে।

‘আসছি,’ ব’লে রীসিভারটা নামিয়ে রাখলে হ্যারি কিলার।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে পৌঁছে গেলো রাজভবনের বিশাল ছাতে। তার ওপরে একটা মিনার উঠে গিয়েছে, প্রায় তিরিশ ফিট উঁচু; পইঠা পেরিয়ে সে গিয়ে উঠলো তারই ওপর। প্ল্যাটফর্মের ওপর যে হর্ষচরিত দাঁড়িয়েছিলো, সে-ই এইমাত্তর টেলিফোন ক’রে তাকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে।

‘ঐ-যে,’ সে আঙুল তুলে আকাশের একটা দিক দেখালে।

হ্যারি কিলার তার দুরবিনটাকে সেইদিকেই ঘুরিয়ে নিলে।

‘ওরাই তাহ’লে,’ একটুক্ষণ দেখে নিয়ে সে বললে। তারপর জুড়ে দিলে ‘কৌশুলিদের ডেকে পাঠাও। আমি নিচে যাচ্ছি।’

হর্ষচরিত বা মেরিফেলো যখন উপদেষ্টা পরিষদের কৌশুলিদের একের পর এক টেলিফোন ক’রে খবর দিচ্ছে, হ্যারি কিলার ততক্ষণে হুড়মুড় ক’রে নেমে এসেছে কারখানা আর রাজভবনের মধ্যকার এসপ্ল্যানেডে। সেখানে তার নবরত্নসভার ন-জন কৌশুলি এসে দেখা দিয়েছে একে-একে। সবাই আকাশপানে চোখ তুলে তাকিয়ে সবুর করতে লাগলো।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’লো না। যত কাছে এগিয়ে আসছে, হেলিবিমানগুলোকে ততই বড়ো দেখাচ্ছে। ক-মিনিট বাদেই তারা এক-এক ক’রে আস্তে নেমে পড়লো এপ্ল্যানেডে।

হ্যারি কিলারের চোখদুটো ফুর্তিতে ঝকঝক ক’রে উঠলো। চারটে হেলিবিমান যদি শুধু তাদের চালকদেরই ব’য়ে এনে থাকে, তাহ’লে বাকি ছটার প্রত্যেকটাই দুজন ক’রে যাত্রী ব’য়ে এনেছে : ব্ল্যাকগার্ডদের একজন, আর একজন কয়েদি- আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, চোখমুখ ঢেকে মাথাঢাকা নামানো

কয়েদি-ছজনের বাঁধন খুলে দেয়া হ’লো। যখন তাঁদের ধাঁধিয়ে-যাওয়া চোখগুলোয় খটখটে দিনের আলো স’য়ে গেলো, তাঁরা বিস্ময়বিস্ফারিত নয়নে ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন চারপাশে। নিজেদের তাঁরা দেখতে পেলেন মস্ত একটা খোলা চকের ওপর, চারপাশেই অনতিক্রম্য দেয়াল। কয়েক পা ওধারেই আছে অদ্ভুত-সব বাহন, যেগুলো তাঁদর এতটা রাস্তা আকাশপথে উড়িয়ে এনেছে। তাঁদের সামনে বিশাল এক রাজভবন-তার ছাতের ওপর উঁচু একটা মিনার, ব্ল্যাকগার্ডের তিরিশজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রাজভবনটাকে পাহারা দিচ্ছে।

তাঁদের পেছনে, শ-খানেক গজ দূরে, আড়াইশো গজ লম্বা এক নিরেট দেয়াল, তাতে না-দেখা যাচ্ছে দরজা, না-বা কোনো জানলা বা ঘুলঘুলি। তার ওপরে উঠে গেছে উঁচু-একটা কারখানার চোঙ, আর তাকেও ছাপিয়ে উঠে গেছে মস্ত-একটা থাম, পলকাই দেখতে, ধাতুর তৈরি—কিন্তু এই খুঁটিটার কোনো মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এ কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে তাঁদের? এই দুর্গটার কথা আফ্রিকার কোনো মানচিত্রে দেখানো হয়নি কেন?

এই ব্যাসকূটগুলো যখন হিংটিংছট কতগুলো প্রশ্নের মতো তাঁদের মাথার মধ্যে কামড়াচ্ছে, হ্যারি কিলার হাত তুলে একটা ইঙ্গিত করতেই প্রত্যেক বন্দীর কাঁধের ওপর শক্ত হাত এসে চেপে ধরলো। ইচ্ছা-অনিচ্ছা কৌতূহল-বিতৃষ্ণার মাখামাখি বন্দীরা ঢুকলো রাজভবনে, সামনে যেতেই যেন আপনা থেকেই খুলে গিয়েছে তার দরজা, আর তাঁরা ভেতরে ঢুকতেই আবার যেন নিজে থেকেই বন্ধ হ’য়ে গেছে। মসৃণ, নিখুঁত।

জেন ব্লেজন, সাঁৎ-বেঁরা, বারজাক, আমেদে ফ্লরেঁস, ডাক্তার শাতোনে আর মঁসিয় পঁসা—সকলেই এখন হ্যারি কিলারের কবলে; ব্ল্যাকল্যান্ডের এই স্বৈরাচারের তাঁরা কুক্ষিগত, যে-ব্ল্যাকল্যান্ড কোনো অজানা সাম্রাজ্যেরই অজানা রাজধানী!