১.০৮ মোরিলিরে

৮. মোরিলিরে

[ আমেদে ফ্লরেঁসের নোটবই থেকে]

২২শে জানুয়ারি। দু-দিন হ’লো আমরা সিকাসো ছেড়ে এসেছি, আর এরই মধ্যে আমার মন হ’তে শুরু করেছে কোথাও যেন একটা-কিছু গণ্ডগোল পাকিয়েছে শুধু-একটা ভাবনার বীজই এটা, অস্বস্তিটা এখনও ঠিক দানা পাকিয়ে ওঠেনি, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গেকার সহিস ও কুলিদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে, তারা যেন একটু মনমরাই হ’য়ে আছে, সহিসদের মধ্যে এগুবার যেন কোনো তাড়াই নেই, কুলিরাও চট ক’রেই ক্লান্ত হ’য়ে পড়ছে, কেমন একটা ঝিমিয়ে-পড়া ম্রিয়মাণ ভাব। হ’তে পারে সবটাই আমার কল্পনা, আর আমি হয়তো অচেতনভাবে কাকানের সেই কেনিয়ালালার ভবিষ্যদ্বাণীতে নিজের অজান্তেই প্রভাবিত হ’য়ে পড়েছি। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম এই ভয়ানক ভবিষ্যদ্বাণীটা, কিন্তু এখন আমাদের সঙ্গে সেপাইশাস্ত্রীর সংখ্যা একেবারে আদ্ধেক হয়ে গেছে ব’লেই বোধহয় সে-কথা আমার বাবে-বারে মনে প’ড়ে যাচ্ছে।

খুব কি একটা শঙ্কা হচ্ছে? উদ্বেগ? না, তাও নয়! যদি অস্বস্তি একটু খিঁচ ধরিয়ে থাকে ভেতরে-ভেতরে, সে শুধু ঐ নচ্ছার কেনিয়ালালার দিব্যদৃষ্টির বালাইটাই। আচ্ছা, সত্যি-সত্যি কী চাই আমি? অ্যাডভেনচার, অ্যাডভেনচার, এবং আরো-দুর্ধর্ষ, দুর্দান্ত, রদ্ধশ্বাস অ্যাডভেনচার, যা থেকে ভালো লেখা তৈরি করা যাবে, কারণ সেটাই আমার কাজ, জীবিকা। তবে অ্যাডভেনচার—সত্যিকার অ্যাডভেনচার-তার জন্যে সেই কবে থেকেই যে আমি হা ক’রে ব’সে আছি।

২৩ শে জানুয়ারি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা যেন একদল কচ্ছপের কনভয় হ’য়ে পড়েছি। এটা ঠিক যে এখানকার জমির ধাতটা যে-রকম তাতে হুড়মুড় ক’রে এগুনো যায় না; একবার ওঠো ওপরে, তারপরেই আবার নিচে নেমে আসো। কিন্তু তবু আমাদের কুলি-সহিসদের অনিচ্ছাটা বড্ডই প্রকট হ’য়ে পড়েছে।

৩১ শে জানুয়ারি। বেড়ে হয়েছে! বাহবা কি বাহবা! আমরা নিজেদের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছি! আমরা ছ-টা দিন লাগিয়ে দিয়েছি কুললে তিরিশমাইল পথ পেরুতে—সবশুদ্ধু ষাটমাইল এগিয়েছি দশদিনে!’-আর তার এখানে একটা খুদে গাঁয়ে এসে পৌঁছেছি, নাম কোকোরা! প্রায় যেন একটা শামুকের গর্ত!

তিনদিন আগে আমরা এন্‌গাগা গ্রামটা ছাড়িয়ে রওনা হয়েছি—এ-রকম নাম কোত্থেকে যে পায় এরা?-আবার উঠতে হয়েছে একটা খাড়া পাহাড়ে, তারপর আবার খাড়াঢাল বেয়ে নেমে আসতে হয়েছে উপত্যকায়—এই উপত্যকা ধ’রেই আমাদের চলতে হবে। উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে-সবদিকেই খাড়া পাহাড়, যেন কোনো গোপন রহস্যের অটল পাহারায় অতন্দ্র জেগে আছে। কিন্তু পুবদিকে গেছে সমতলভূমি।

পোড়াকপাল আর কাকে বলে। কোকোরোতেও আমাদের বেশ খানিকটা দেরি হ’য়ে গেলো। না, আমাদের কেউ কয়েদ ক’রে রাখেনি। বরং গাঁয়ের মোড়ল, জনৈক পিন্তিয়ে-বা, আমাদের খুব খাতিরযত্নই করেছে, প্রায় যেন কতকালের সুহৃদ।

কোকোরো থেকেই শুরু হয়েছে, বোবাদের দেশ।

দৃশ্য : কোকোরো। কাল : গতকাল, ৩০শে জানুয়ারি। রাত্রি। যেই গ্রামটার কাছে গিয়ে পৌঁছেছি, আমাদের ঘিরে ধিরেছে নিগ্রোদের একটা হট্টগোল-তোলা দল-মশালের আলোয় অন্তত আটশোজনকে গুনতে পেরেছি আমরা-আর তাদের দেখে এমনটা মনে হয়নি যে হারানো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে তারা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। এই-প্রথম কেউ এভাবে আপ্যায়ন করেছে আমাদের। কাজেই আঁৎকে, আমরা থেমেই পড়েছি-থেমে নয়, একটু পেছিয়েই এসেছি।

পেছিয়ে এসেছি, তবে কোনো বিভীষিকার ভয়ে নয়। এ-সব লস্কর যত পারে তাদের অস্ত্রশস্ত্র আস্ফালন করুক, আমরা জানি বন্দুকের একদফা গুলিতেই এদের সব ট্যা-ফোঁ ঘুচে যাবে। কাপ্তেন মার্সেনে দৃঢ়গলায় কী যেন নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর সেপাইশাস্ত্রী তাদের রাইফেলগুলো চেপে ধরে, তবে খাপগুলো থেকে খুলে আনে না। সত্যি বলতে, কাপ্তেন একটু গড়িমসিই করেছেন, একটু যেন ইতস্তত, প্রতিবেশীদের ওপর গুলিচালানো ভারি-সাংঘাতিক ব্যাপার, এমনকী সে-প্রতিবেশী যদি বোবোরাও হয়, তবু। অ্যাদ্দিন আমাদের গোলাবারুদ স্তব্ধই থেকেছে, টু শব্দটি করেনি কোথাও—আমরা চাইনি যে রাইফেলগুলোই আমাদের হ’য়ে সব কথা ব’লে দিক।

এই যখন ন যজৌ ন তথৌ দশা, তখন সাঁৎ-বেরার ঘোড়া, এত-আওয়াজ শুনে ঘাবড়ে গিয়ে, চার ঠ্যাং তুলে কেমন-একটা লাফ দেয়। জিন থেকে ছিটকে বেরিয়ে, সাঁৎ-বেরা চমৎকার-একটা ডিগবাজি খেয়ে সোজা গিয়ে সামনের নিগ্রোদের মধ্যে চিৎপাত প’ড়ে যান, তারা তো খ্যাপার মতো গ’র্জে আমাদের গোবেচারা বন্ধুটির ওপর এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে…

এমনসময় মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস তাঁর ঘোড়ার পিঠে খোঁচা দিয়ে উসকে দিয়েছেন তাঁর ঘোড়াকে, সোজা চ’লে গেছেন নিগ্রোদের মধ্যে। তাতে তক্ষুনি নিগ্রোরা সাঁৎ-বেরার ওপর থেকে নজর সরায়। তারা এই সাহসিনীর দিকে এগিয়ে যায়, অন্তত কুড়িটা আসাগে তাঁকে তাগ ক’রে উঁচানো।

‘মাতো!’ হামলাবাজদের দিকে তাকিয়ে মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস চেঁচিয়ে ওঠেন। ‘এতে আ বে সুবা!’ (চুপ করো! আমি এক ডাইনি, কুহকিনী! )

এই ব’লে জিনের পাশের থলে থেকে একটা ইলেকট্রিক টর্চ বার করে নিয়ে তিনি জালান আর নেভান, নেভান আর জ্বালান—শুধু এটাই চাক্ষুষ দেখিয়ে দিতে যে তিনি সত্যিই কোনো কুহকিনী, এবং আগুন আর বিজলি তাঁরই পেটোয়া অনুচর যেন!

দেখেই, হুলুস্থুলু-শোরগোল যেন মন্ত্রবলে থেমে যায় তাঁকে ঘিরে চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শ্রদ্ধায়-অভিভূত জনতা। আর তারই মাঝখানে এগিয়ে আসে পিত্তিয়ে-বা, যার কথা আমি আগেই বলেছি। বলা তো বাহুল্যই যে এমন অবস্থায় সে একটা ছোটোখাটো বক্তৃতাই দেবে। জগতের সব সরকারেরই এই- একটা দুর্বলতা। কিন্তু মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস তাঁকে তৎক্ষণাৎ চুপ করিয়ে দেন : ‘মাতো!’ প্রথমে এগিয়ে যান সাঁৎ-বেরাকে তাদের কবল থেকে ছিনিয়ে আনতে সে বেচারি অমনভাবে প’ড়ে গিয়ে সেই-যে চিৎপাত শুয়ে আছেন, তারপর থেকে নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু-হয়তো-বা চোটই লেগেছে কোথাও।

সেটা অবশ্য তক্ষুনি পরীক্ষা ক’রে দেখেছেন ডাক্তার শাতোনে, সকলের ভ্যাবাচাকা দশার মাঝখানে নির্বিকার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে গেছেন সেখানে, যেন ফ্রাসেরই কোনো পাড়ায় রোজকার মতো রুগি দেখতে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, চোটই লেগেছে সাঁৎ-বেরার। সারা গায়ে রক্ত। এমন বেকায়দায় একটা চোখা পাথরের ওপর পড়েছেন যে সেটা তাঁর তলপেটের তলায় অনেকটা ফুঁড়ে গিয়েছে।

তক্ষুনি আমি সচমকে আবিষ্কার করেছি যে এটা কেনিয়ালালার অন্তত একটা ভবিষ্যদ্বাণীকে ফলিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, সাঁৎ-বেরার কপালে যা ছিলো, তা ফ’লে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমার সারা গায়ে শিহরণ খেলে গিয়েছে। তাহ’লে আমার লেখাগুলোর যে কী দশা হয়েছে, তা খোদ কেনিয়ালালাই জানে!

ডাক্তার শাতোনে অবশ্য ক্ষতটা পরিষ্কার ক’রে সেখানটায় শেলাই ক’রে দিয়েছেন –আর চারপাশের কৌতূহলী ভিড় ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে দেখেছে এই আশ্চর্য শল্যচিকিৎসা।

এই শেলাইফোঁড়ের কাজ যখন চলেছে, তখন মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস কৃপা ক’রে পিত্তিয়ে-বাকে তার কথা বলবার অনুমতি দিয়েছেন। সে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছে, –বাম্বারায়, না কি অন্যকোনো ভাষায়?—কেন তুবাব (অর্থাৎ সাঁৎ-বেরা) বন্দুক বাগিয়ে ধ’রে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস তক্ষুনি তা অস্বীকার করেছেন। পিত্তিয়ে-বা নাছোড়ভাবে আঙুল তুলে দেখিয়েছেন, সাঁৎ-বেরার কাঁধে ঐ যে খাপটা, বান্দোলিয়েরদের ধরনে ঝুলছে, ওটা তবে কী? মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস তাকে ফের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। বৃথা চেষ্টা। শেষে তাকে ভালো ক’রে মাথায় গজাল ঠুকে বোঝাবার জন্যেই টর্চের আলোয় খাপটা খোলা হয়েছে, আর অমনি বেরিয়ে পড়েছে সাঁৎ-বেরার সেই বিখ্যাত ছিপগুলো।

দেখেই, পিত্তিয়ে-বার চোখ কপালে উঠে গেছে। তারপরেই ঈর্ষায় তার চোখদুটো জুলজুল ক’রে উঠেছে। আদুরের দুলারের মতো তার বায়না-ঐ ঝকমকে জিনিশটা তার চাই—হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই চাই তার। সাঁৎ-বেরা, স্বভাবতই, অত-ব্যথার মধ্যেও, সঙ্গে-সঙ্গেই নাকচ ক’রে দিয়েছেন আব্দারটা। মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস নবপ্রতিষ্ঠিত শান্তিটাকে দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজে গিয়ে বারে বারে অনুরোধ করেছেন সাঁৎ-বেরাকে, কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করলে তো?

শেষকালে একেবারে খেপেই গিয়েছেন মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস। ‘বোন-পো!’ তাঁর হাতের টর্চটা থেকে আলো প’ড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে তাঁর বোন-পোর (সত্যি কি বোনপো? )

স্যাঁৎ-বেরা অমনি বাধ্য ছেলেটির মতো পিত্তিয়ে-বাকে তাঁর সাধের বাক্সটা দিয়ে দিয়েছেন। আর পিত্তিয়ে-বার মনে হয়েছে এটা এই কুহকিনীর হাতের জাদুর বিজলি দণ্ডটারই প্রভাব একেবারে হাতে-নাতেই প্রমাণ পাওয়া গেছে এর ক্ষমতা কী অসীম! হাতে এই দুর্লভ ধনটা পেয়ে সে তো খুশিতে ডগমগ—প্ৰায় খেপেই গিয়েছে যেন। নাচ জুড়ে দিয়েছে প্রচণ্ড, আর তার ইঙ্গিতে তার দলবলের হাতের অস্ত্রশস্ত্র নিমেষে উধাও হ’য়ে গেছে। তারপর সে নিজেই এগিয়ে এসেছে আমাদের দিকে।

বিগলিতবচনে সে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে যথা-ইচ্ছা আমরা ঘুরে বেড়াতে পারি তার গাঁয়ে, আর ঘোষণা করেছে পরদিন আমাদের সম্মানে গাঁয়ে একটা মস্ত নাচের আসর বসবে। বোবোদের এইরকম সৌহাদ্য দেখে কাপ্তেন মার্সেনের মনে হয়নি এদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার মধ্যে কোনো অসুবিধে আছে। পরদিন, তাহ’লে, দুপুর গড়িয়ে যাবার পরই আমাদের নতুন সুহৃদদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমরা গাঁয়ে যাবো, আর আমাদের সেপাইশাস্ত্রী এবং কুলিসহিসরা তাতার বাইরেই এখানেই ছাউনি খাটিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।

কী বলবো, পাঠক পাঠিকাগণ!, কী দুর্ধর্ষই না নাচ হ’লো! ভিন্ন রুচিেিলাকাঃ- অন্তত আমাকে কেউ জিগেস করলে তাকে বলবো যে আমি বাপু সাঁজেলিসই পছন্দ করি।

প্রথমেই আমরা চ’লে গিয়েছি সোজা রাজকুটিরে : গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে কতগুলো কুঁড়েঘর নিয়েই এই রাজার বাড়ি। এ-সব কুঁড়েঘরের বাইরেটা লেপাপোঁছা মাটির দেয়ালে তৈরি, কিন্তু ভেতরটাই দেখবার মতো! ভেতরের অঙ্গনটা কাদামাটির একটা জমি ছাড়া আর-কিছু নয়, সেখানে থাকে গোরু ভেড়া! তাকে ঘিরেই সব থাকার ঘর, নুয়ে-পড়া, সংকীর্ণ, ঘিঞ্জি, আর মণিকোটার মতোই, কেননা তাদের মধ্যে যেতে গেলে সিঁড়ির পইঠা দিয়ে নিচে নেমে যেতে হয়। আর রাজপ্রাসাদের দশাই যদি এমন নিদারুণ হয় তবে তা থেকে খানিকটা আন্দাজ ক’রে নেয়া যায় বৈ-কি সাধারণ লোকে কেমন ক’রে থাকে। একরত্তি-সব কুঁড়েবাড়ি, ঘিঞ্জি, ভেতরে কখনও আলো-হাওয়া ঢোকে কি না সন্দেহ।

এই রাজবাড়িতেই আমাদের পোশাকি আপ্যায়নের আয়োজন হয়েছে। আপ্যায়নের এক-অর্থ এটাই যে আমাদের তরফ থেকে পিত্তিয়ে-বা কে দেয়া হয়েছে উপঢৌকন –অর্থাৎ তুচ্ছ-সব জিনিশ, থানকাপড় থেকে তালাচাবি, পুরোনো গাদাপিস্তল থেকে চুঁচসুতো। এই উপহার পেয়ে তার নিশ্চয়ই চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো, কেননা তক্ষুনি সে নাচ শুরু ক’রে দেবার ইঙ্গিত করেছে।

প্রথমে এসেছে গানের দল, কেউ-কেউ এসে বোলোতো বাজাতে-বাজাতে অর্থাৎ বুনোহরিণের শিঙের তৈরি শিঙা, অন্যরা বাজিয়েছে বুরোন, হাতির দাঁতে তৈরি অন্যরকম শিঙা, অন্যরা বাজিয়েছে তাবালা অর্থাৎ ঢাক। দুজন লোক দু- দিক থেকে ধ’রে থাকে তাবালাকে, তৃতীয়-একজন গায়ের জোরে একটা লাঠি দিয়ে তাকে পেটায়-লাঠিটাকে বলে তাবালা-কালামা। সম্ভবত কালামা কথাটার মানে হচ্ছে কলম, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় যে-কলম দিয়ে কেউ ঢাকের ওপর কিছু লেখে।

এই নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনেই বোবো-রা এসে জড়ো হয় হাটের মাঝখানে, আর মজলিশ শুরু হ’য়ে যায়।

পাঞ্চ আর জুড়িরই কোনো সুদানি সংস্করণ হবে, বা তারই কাছাকাছি-কিছু, এমনি এক পাঞ্চ এসে হাজির হয়, যার নাম মোকো মিসাই ফু, আর উদ্ভট মুখভঙ্গি ক’রে সারা শরীরের নানান কসরৎ দেখিয়ে বিদঘুটে-সব অঙ্গভঙ্গি ক’রে নাচ জুড়ে দেয়। তার পরনে লাল-একটা আলখাল্লা, মাথায় টুপি—তাতে গোরুর ল্যাজের ঝুঁটি, আর ঐ টুপি থেকে ঝোলে কাপড়-পর্দার মতো মুখটা ঢেকে রাখে। বন্দো লিয়েরদের কায়দায় তার পিঠে থাকে একটা ঝোলা, সেখানে লোহার টুকরো ঝমঝম করে পরস্পরের গায়ে ঠোকাঠুকি খেয়ে, আর কব্জিতে আর গোড়ালিতে ঘুঙুরের মতো ঘুণ্টি বাঁধা হাত-পা নেড়ে নাচলেই সেগুলো ঝুমঝুম ক’রে বাজে। তার ঐ টুপি লাগানো গোরুর ল্যাজের চুলি বুলিয়ে সে দর্শকদের মুখে শুড়শুড়িও দেয় মাঝে-মাঝে। পিত্তিয়ে-বা এবং তার সভাসদদের বিস্তর আমোদ জুগিয়ে সে যখন তার কসরৎ-নাচ বলবো? না, কসরৎই ভালো—শেষ করলে, তখন পিন্তিয়ে- বার ইঙ্গিতে তার পারিষদরা এমন অট্টরোল ক’রে উঠলো যে মনে হ’লো জঙ্গলে কোথাও হিংস্ৰজন্তুর গর্জন উঠেছে-কিন্তু সেটাই সম্ভবত সমবেত সকলের হর্ষধ্বনি ও শাবাশি!

সব আওয়াজ একটু থেমে যেতেই, পিন্তিয়ে-বা একটা ছাতা আনতে পাঠায়- এই আতপত্রের গায়ে নানান কড়ি আর কবচতাবিজ বসানো—তার যে হঠাৎ খুব- দরকার পড়েছে তা নয়, তবে রাজার মাথায় রাজছত্র না-থাকলে তার ক্ষমতা প্রকাশ পাবে কী ক’রে?

এবং অতঃপর শুরু হয় আসল নাচ। নারীপুরুষ ছেলেমেয়ে একটা বৃত্ত রচনা ক’রে দাঁড়ায়, ডাইনি-পুরুরা দমাদ্দম ঢাকঢোল পেটায়, দুই নর্তকী ছুটে আসে মাঝখানে-দু-দিক থেকে। তিনবার চক্রাকারে পাক খেয়েই তারা ছুটে যায় এ ওর দিকে, মুখোমুখি নয়, পিঠোপিঠি, আর দুজনের পিঠ দুজনকে ছুঁলেই নিতম্ব দিয়ে পরস্পরকে ঘা মারে। এই দুজনকে অনুসরণ ক’রেই আসে আরো-দুজন, আর অবশেষে দর্শকরা, সবাই চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একাকার এখন, যোগদান করে কোনো চতুরঙ্গি নাচের কায়দায়। এমন-ক্ষিপ্র, দুরন্ত ঘুর্ণি সে-নাচের যে তার কোনো তুলনাই ইওরোপের কোনো নাচে পাওয়া যাবে না।

নাচ অবশেষে শেষ হয় এক শোভাযাত্রায়। বোবো-রা এক-এক করে সার বেঁধে পিত্তিয়ে-বা-র সামনে দিয়ে চ’লে যায়, তাবালার কানে-তালা-ধরানো আওয়াজের তালে-তালে তারা সবাই মিলে সমস্বরে একটা গান গাইছে, সেই সঙ্গে মাঝে-মাঝেই পোঁ ধরছে তুরীভেরী, বাঁশের বাঁশি আর ঐ দু-ধরনের শিঙাগুলো—বোদাতো আর বুরোন।

তারপরেই আসে সান্ধ্যাভোজের পালা, এবং রক্তারক্তি কাণ্ড।

গোটা-বারো ভেড়া নিয়ে আসে তারা, কুঁড়েঘরের মধ্যেই তাদের কোতল করা হয়েছে। দড়ি দিয়ে এ-গাছ থেকে ও-গাছে বেঁধে, তাতে সেগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হয়। একটা চৌকো বর্গক্ষেত্রই তৈরি হ’য়ে যায় দড়ি থেকে ঝোলানো ভেড়াগুলোয়। আর সেই চৌকো জায়গায় মেয়েরা জড়ো করে শুকনো কাঠকুটো। ছুরি দিয়ে পুরুষরা মাংসের খণ্ড কাটে, ফালা ফালা ক’রে, আর সেই ফালিগুলো মেয়েরা সুতো থেকে ঝুলিয়ে দেয়, আর এদিকে আগুন ধরিয়ে দেয়া কাঠকুটোয়। যখন তাদের মনে হয় ঠিকমতো ঝলসানো হ’য়ে গেছে, পিন্তিয়ে-বা একটা সংকেত করে, আর সবাই ছুটে এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঝলসানো মাংসের ওপর, আর ভোজ শুরু হ’য়ে যায়।

আমরা একটু পরেই ফিরে যাই আমাদের শিবিরে। গাঁয়ের মধ্যে ভোজ চলে অনেক রাত অব্দি।

২রা ফেব্রুয়ারি। আমরা এখনও কোকোরাতেই আছি, সাঁৎ-বেরার জখমটা আমাদের দেরি করিয়ে দিচ্ছে—কেননা মামাভাগ্নে (তা-ই বলবো তাঁকে এবার থেকে) কিছুতেই আর ঘোড়ায় বসতে পারছেন না।

৩রা ফেব্রুয়ারি। এখনও কোকোরাতেই। অর্থাৎ, কী আনন্দ!

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, সকাল ছুটা। অবশেষে আমরা রওনা হ’য়ে পড়েছি। ঐ দিনই, সন্ধেবেলা। রওনা হয়েছিলুম নামেই। আমরা এখনও কোকোরাতেই আছি।

আজ সকালে, দিন যখন ফুটি-ফুটি, আমরা আমাদের বন্ধু বোবোদের বিদায় জানিয়েছি। (বন্ধু মেলে সবখানেই, শুধু তাদের খুঁজে বার করতে হয়।) সারা গাঁ এসে দাঁড়িয়েছে শিবিরের কাছে। পিত্তিয়ে-বা ছিলো তাদের প্রথমে, আর শুভেচ্ছা বর্ষেছে অজস্র। ‘নি’যাল্লা (ঈশ্বর) যেন আপনাদের শরীরস্বাস্থ্য ভালো রাখেন।’ ‘নি’যাল্লা যেন আপনাদের রাস্তা নির্বিঘ্ন করেন।’ ‘নি’যাল্লা যেন আপনাদের ভালো ঘোড়া দেন!’ আর এই শেষ-শুভেচ্ছাবাণী শুনে সাঁৎ-বেরা বিকটভাবে মুখবিকৃতি করেছেন-তাঁর জখমটা এখনও তাঁকে বেশ জ্বালাচ্ছে।

আমরা শুভেচ্ছার মধ্য থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছি নিজেদের, এবং সারিটা রওনা হ’য়ে পড়েছে।

রওনা হ’য়ে পড়েছে, কিন্তু চলেনি। কোকোরোর আগে যা হয়েছে এ তার চেয়েও শোচনীয় দশা। অনিচ্ছাটা জাজ্বল্যমানভাবে প্রকট। প্রতিমুহূর্তেই কেউ- না-কেউ থেমে পড়ছে, হয় কোনো কুলি, নয়তো কোনো সহিস, আর আমাদের তার জন্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। একটা গাধার পিঠ থেকে বোঁচকাগুলো খুলে প’ড়ে গিয়েছে, আবার সেটা তুলে ভালো ক’রে বেঁধেছেঁদে দিতে হয়েছে। বেলা দশটার সময়, আমরা যখন থেমেছি, আমরা বোধকরি চারমাইলও যেতে পারিনি।

কাপ্তেন মার্সেনের ধৈর্য দেখে মোহিত হ’য়ে যেতে হয়। ঠাণ্ডামাথা একবারও, একতিলের জন্যেও, তিনি গরম করেননি। কিছুই তাঁকে টলাতে পারে না, কিছুই তাঁকে ক্লান্ত ক’রে দিতে পারে না। এত-সব বেশ-প্রকাশ্য বাধার মধ্যেই তিনি একধরনের শান্তশীতল শক্তির বলেই যেন যুঝে চলেছেন।

কিন্তু যখন আমরা সন্ধেবেলায় আবার বেরিয়ে পড়তে গেছি, তখন সব কেমন উলটে পালটে গেছে। মোরিলিরে ব’লে বসেছে সে নাকি পথভুল ক’রে বসেছে। মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস যে-দুজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, আমরা তাদের কাছে জিগেস করেছি, সত্যি আমরা পথ হারিয়েছি কি না। ৎশুমুকি মোরিলিরের মতেই সায় দিয়েছে, কিন্তু তোঙ্গানে বলেছে আমরা ঠিকপথেই চলেছি। বেড়ে অবস্থা। এখন কাকে ছেড়ে আমরা কাকে বিশ্বাস করি?

অনেকক্ষণ ইতস্তত ক’রে আমরা দলে-ভারিদেরই মতটা মেনে নিই, এবং ফের যে-পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথেই ফিরে যাই। তখন কিন্তু তাক লেগে গেছে—কত-দ্রুত আমরা যেতে পারি, তার নমুনা দেখে। কালোরা কেউ একফোঁটা শ্রান্তি বোধ করছে না, গাধাদের পিঠেও বোঝাগুলো আঁটো ক’রে বাঁধা রয়েছে। সকালবেলায় যে-পথটা আমরা চারঘণ্টায় পেরিয়েছি, সেটাই এবার আমরা অতিক্রম ক’রে এসেছি মাত্র এক-ঘণ্টায়-আর রাত নামবার আগেই আমরা আবার ফিরে গিয়েছি, যেখান থেকে আমরা শিবির তুলেছিলুম, সেখানেই। আবারও কোকোরোরই কাছে আমরা।

৬ই ফেব্রুয়ারি। কাল, ৫ই ফেব্রুয়ারি, আবার আমরা বিশেষ-মুশকিলে না- প’ড়েই রওনা হ’য়ে পড়েছিলুম। যেটা ছিলো আশ্চর্য, সেটা এই : কাল যেটাকে আমরা ভুল- পথ ব’লে ফিরে এসেছিলুম, সেই পথেই আবার আমরা রওনা হয়েছি। মোরিলিরে এখন কিরে কেটে বলেছে, ঈশ্বরের দোহাই, সত্যি, ভালো ক’রে ভেবেচিন্তে দেখে তার নাকি মনে হয়েছে আসলে আগের দিন সন্ধেবেলাতেই সে ভুল করেছিলো। এবারও ৎশুমুকি তারই কথা দোয়ারকি ধ’রে মাথা হেলায়। আমার ক্রমশই বদ্ধমূল হচ্ছে সন্দেহটা: এই দুই নচ্ছার আসলে পদে-পদে আমাদের পথে বাধার সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।

কাল বিশেষ-কিছুই ঘটেনি, শুধু এদের মন্দবুদ্ধির সঙ্গে আমাদের কেবলই পরিচয়টা ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে; কিন্তু আজ, দুটো ভারি-গোলমেলে ব্যাপার ঘ’টে গিয়েছে।

.

সকালবেলায় যাত্রার সময় একটা গাধা হঠাৎ টাল সামলাতে না-পেরে দুম ক’রে প’ড়ে যায়। তুলতে গিয়ে দেখা গেছে সে ম’রে গিয়েছে। হ্যাঁ, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিকও হ’তে পারে, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার ঘোরতর সন্দেহ হয় যে এর পেছনে, দুং-কোনো অথবা ঐ জাতীয় কোনো ভয়াবহ গরলের কারসাজি আছে। কেউ একটাও কথা বলেনি। আমরা শুধু মরা জন্তুটার পিঠের বোঝা অন্য গাধাগুলোর পিঠে ভাগাভাগি ক’রে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছি।

যখন বিকেলবেলায় আবার চলতে শুরু করেছি, তখনই দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছে। হঠাৎ খেয়াল ক’রে দেখি কুলিদের একজনকে কোখাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার আবার কী হ’লো? এ-যে দেখি এক দুর্বোধ প্রহেলিকা! মার্সেনে তাঁর গোঁফের ডগা চিবিয়েছেন শুধু, দেখে বুঝতে পারছি বিষম ভাবনায় পড়েছেন কাপ্তেন। নিগ্রোরা সবাই যদি আমাদের ছেড়ে মাঝরাস্তায় পালিয়ে যায়, তাহ’লেই আমরা গেছি! একজন পালালেই অন্যদের মধ্যে পালাবার হিড়িক প’ড়ে যায় : এর মতো ছোঁয়াচে রোগ আরকিছু নেই। আরো লক্ষ ক’রে দেখি সেপাইশাস্ত্রীরা যেন আরো একটু বেশি সজাগ, একটু-বেশি সতর্ক হ’য়ে উঠেছে। আমাদের এখন এমনভাবে এগুতে হবে যেন প্যারেড ক’রে যাচ্ছি। দু-পাশের ঘোড়সোয়াররা একটুও এদিক-ওদিক হ’তে দেবে না-সারি ভাঙতে দেবে না কিছুতেই। এই কড়া পলটনি শৃঙ্খলা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি, তবু এক্ষেত্রে আমি তাতেই সায় দিয়ে গেছি।

যখন আমরা রাত্তিরের মতো থেমেছি, তখন দেখি আমাদের জন্যে আরেকটা চমক অপেক্ষা করে আছে। বেশ ক-জন কুলি বেহেড মাতাল হ’য়ে আছে। কিন্তু মদ এরা পেলে কোত্থেকে? কে তাদের এই চোলাই এনে দিয়েছে?

কাপ্তেন শিবিরটার ওপর হুঁশিয়ার একটা কড়াপাহারা বসাবার বন্দোবস্ত ক’রে মঁসিয় বারজাকের খোঁজে এসে দ্যাখেন আমিও মঁসিয় বারজাকের সঙ্গে আছি। কাপ্তেন যা বলেছেন তার সারমর্ম এই : সিকাসো ছাড়ার পর থেকেই অবস্থা ক্রমশ সঙিন হ’য়ে উঠছে। ডাক্তার শাতোনে, মঁসিয় পঁসা, মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস এবং সবশেষে সাঁৎ-বেরা, একে-একে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, যাতে সবাই মিলে রণকৌশল স্থির করতে পারি—কারণ হাল যা দাঁড়িয়েছে তাতে এটাকে এখন একটা যুদ্ধ ব’লেই মনে হচ্ছে।

কয়েকটি কথাতেই কাপ্তেন আমাদের তথ্যগুলো সাজিয়ে দিয়েছেন, আর সমস্ত গণ্ডগোলের দায়ই চাপিয়েছেন মোরিলিরের ঘাড়ে, সে-ই যত নষ্টের গোড়া, পাজির পাঝাড়া। তাঁর ইচ্ছে : এই ধড়িবাজ গাইডটিকে ডেকে নিয়ে এসে কড়াধমক দিয়ে সবকিছু জিগেস করা, দরকার হ’লে এমনকী বলপ্রয়োগও করা যেতে পারে—তাতে যদি আচ্ছা ক’রে তাকে কড়কে দেয়া যায়! প্রত্যেক নিগ্রোর পাশে-পাশে একজন ক’রে সশস্ত্র সেপাই থাকবে, যে তাকে ঠিকমতো চলতে বাধ্য করবে, দরকার হ’লে কঠোরসাজা দেবে।

মঁসিয় বারজাক মতটায় ঠিক সায় দিতে পারছিলেন না, সাঁৎ-বেরাও তথৈবচ। মোরিলিরেকে ডেকে জেরা করতে গেলে, জোরজবরদস্তি করতে গেলে, তাকেই সাবধান ক’রে দেয়া হবে, বুঝিয়ে দেয়া হবে যে তার সব চাল আর চালাকি আমরা ধ’রে ফেলেছি। তার বিরুদ্ধে নিছক সন্দেহ ছাড়া কোনো প্রমাণই আমাদের হাতে নেই—তাছাড়া কেনই-বা সে অমন ক’রে হঠাৎ আমাদের সঙ্গে বেইমানি করতে যাবে? মোরিলিরে ঘাড় নেড়ে সমস্ত অস্বীকার করবে, আর অমনি আমাদেরও তার কথা মেনে নিতে হবে।

আর ঐ কুলিদের? সহিসদের? তাদের আমরা বাধ্য করবো কী ক’রে? তারা যদি সবাই মাটিতে শুয়ে প’ড়ে, বলে আর-এক পাও যাবে না, তবে আমরা তাদের কী করতে পারি? তাদের গুলি ক’রে মেরে ফেললে কি আমাদের মাল বওয়ার দরকারটার কোনো সুরাহা হবে?

আমরা সবদিক দেখেশুনে স্থির ক’রে নিই আপাতত চুপ ক’রে থাকাই বরং ভালো। আরো কড়াপাহারা না-হয় করা গেলো, ধৈর্য ধ’রে না-হয় দেখাই গেলো কোথাকার জল কোথায় গড়ায়; তবে মোরিলিরেকে ককখনো চোখের আড়াল হ’তে দেয়া চলবে না-তাকে সবসময়েই চোখে-চোখে রাখতে হবে।

এ-তো খুবই বাহারে ব্যবস্থা, কিন্তু তবু আমার মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেলো। একগুঁয়ের মতো এই অভিযানটা চালিয়ে যাবারই বা সার্থকতা কী? মিশনের উদ্দেশ্য ছিলো নাইজার নদীর বাঁকে নিগ্রোদের মনোভাব কী, তা সরেজমিন তদন্ত ক’রে দেখা। তা, আমরা তো অ্যাদ্দিনে তাদের হাড়ে-হাড়েই চিনে গিয়েছি, মনের ভাব কী, তা বুঝতে তো আর-কোনো অসুবিধেই নেই। উপকূল থেকে কান্কান অব্দি, এমনকী তিওল বা সিকাসো অব্দিও, যত জাতি- উপজাতি আছে, তাদের নিজস্ব অনেক রীতিনীতি এমন আছে যেটা আমাদের চাইতে সম্পূর্ণ পৃথক, তবু তাদের হাতে যদি কোনো রাজনৈতিক অধিকার দেবার প্রস্তাব আসে, তবে আমি সেটা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করবো কিন্তু সিকাসো পেরিয়ে? তার পরের অঞ্চলে? এদের হাতে ভোটের অধিকার তুলে দেবার কোনো মানেই আমি খুঁজে পাই না। আর তা যদি হয়, তবে অভিযান চালিয়ে যাবার জন্যে এই জেদ কেন? নিছকই একটা গোঁয়ার্তুমি বৈ আর-কিছু নয়। যতই আমরা উপকূল থেকে দূরে স’রে যাবো, জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে ঢুকবো, ততই কি আবিষ্কার করবো না যে ইওরোপীয় গণতন্ত্রের কোনো ধারণাই এদের মধ্যে নেই? এই কথাগুলো আমার কাছে অতীব স্পষ্ট : এটাই অবাক কাণ্ড যে অভিযানের আর-কারু কাছে এর সত্যতা এখনও স্বীকৃত হয়নি! হয়তো তাঁদেরও এ-সব কথাই মনে হয়েছে, তবে অন্য-কতগুলো কারণ নিশ্চয় আছে, সেজন্যে তাঁরা এভাবে চোখ মুদে আছেন।

প্রিমো : কাপ্তেন মার্সেনে। তাঁর কাছে তো এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর কাজ তো তর্ক করা নয়, আদেশ পালন করা। আর হুমকি যদি না-ও থাকতো, তবু তিনি কাজটায় ইস্তফা দিতেন কি না সন্দেহ। মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস যতক্ষণ তাঁর প্রমোদভ্রমণ চালিয়ে যাবেন, তিনিও ততক্ষণই সঙ্গে-সঙ্গে থাকবেন। যতই দিন গেছে এ-ব্যাপারটা আর বুঝতে কারুরই বাকি থাকেনি যে এঁরা দুজন পরস্পরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। ভাবগতিক দেখে মঁসিয় বার্জাক এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন। অতএব সেদিক থেকে কাপ্তেন মার্সেনের আর-কোনো ভাবনাই নেই। তো, মার্সেনে না-হয় থাকুন-গে মাদমোয়াজেল সঙ্গে-সঙ্গেই। কিন্তু অন্যরা?

মোরনাসের

সেকুন্দো : মঁসিয় পঁসাঁ। তিনিও অধীনস্থ কর্মচারী, অতএব তাঁরও কাজ যা- ফরমাশ আসবে তা-ই পালন করা। নিজে মনে-মনে কী ভাবছেন, সেটা অবশ্য কখনও জানা যায়নি। সকাল থেকে রাত অব্দি সবসময়েই তিনি সবকিছু টুকে- টুকে রাখছেন, কিন্তু মানুষটা তিনি এতই চুপচাপ দারুণভাবে না-খোঁচালে কিছু বলবেন ব’লে মনে হয় না। বাজি ধ’রে বলতে পারি এ-যাবৎ পুরো অভিযানে তিনি গুনে-গুনে দশটা কথাও বলেননি। কথা বলা তাঁর কাছে যেন আদিপাপেরই মতন। অতএব তাঁর কথাও না-হয় শিকেয় তোলা থাক।

তেতিয়ো : সাঁৎ-বেরা। এঁর ব্যাপারটাই আলাদা। সাঁৎ-বেরা শুধু তাঁর মাসি- ভাগ্নির চোখ দিয়েই সবকিছু দ্যাখেন। গোটা জীবনটাই তিনি তাঁকে উৎসর্গ ক’রে দিয়ে ব’সে আছেন। আর মানুষটা এমনই ভুলোমন যে তিনি হয়তো ভুলেই ব’সে আছেন যে তিনি এখন আফ্রিকায় আছেন। তো তৃতীয়জনের পাশ কাটিয়েও না- হয় এগিয়ে যাওয়া যাক।

কুয়ার্তো : মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস। আমরা তো জানি তিনি কেন এই প্রমোদভ্রমণে বেরিয়েছেন। তিনি নিজের মুখেই আমাদের ব’লে দিয়েছেন : তাঁর ইচ্ছে হয়েছে, তা-ই। সেই সাধ হওয়াটাই শেষ কথা। তবে ভেতরে আরো-কোনো নিগূঢ় কারণ আছে কি না কে জানে!

কিন্‌তো : আমি। এই পাঁচনম্বরই শুধু এমন-একজন যার ব্যাপারটায় পুরোপুরি কাণ্ডজ্ঞানের ছাপ আছে। আমার অস্তিত্বের মূল কথাটা কী? খবরকাগজে লেখা। কাজেই যত-মুশকিল, তত-লেখা। যত-ঝক্কি যত-ঝামেলা, লেখারও বাহার তত। কাজেই আমি যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখছি না- সেটা বলাই বাহুল্য। না, কোনো খোয়াবই আমি দেখছি না।

অতএব, হাতে রইলেন মঁসিয় বারজাক। তাঁর তো মাথাটা কারু কাছে বিকিয়ে নেই, তিনি কারু খানও না পরেন না, কারু অধীনে চাকরি করেন না, কারু প্রেমে প’ড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন না। তিনি ভালো ক’রেই জানেন যে এখন আমরা ছায়াচ্ছন্ন আফ্রিকাতেই আছি। মানুষটা এমনিতে গুরুগম্ভীর-কোনো ঝোঁকের মাথায় বা খামখেয়ালের বশে কিছু করবেন ব’লে মনে হয় না—আর তাঁকে কোনো খবরকাগজেও নিয়মিত লেখা পাঠাতে হয় না। তাহ’লে?…

এই হিংটিংছট প্রশ্নটা আমার মাথার মধ্যে এমনভাবে কামড়াচ্ছে যে আমি তাঁর কাছে সরাসরি জিগেস ক’রে ফেলবো ব’লেই ভেবেছি।

মঁসিয় বারজাক একবার আমার আপাদমস্তক ভালো ক’রে খুঁটিয়ে দ্যাখেন, তারপর মাথাটা নাড়েন, হ্যাঁ-এর ভঙ্গিতে, তারপর এমন-একটা ভঙ্গি করেন, যার কোনোই অর্থ হয় না। অথচ তাঁকে অনেক কচলে শুধু ঐ ভঙ্গিমাটাই আদায় করতে পেরেছি আমি—ঐ কাঁধঝাঁকানিটা। দেখেই বোঝা যায় সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে তিনি অভ্যস্ত।

৭ই ফেব্রুয়ারি। ঘটনা অনবরত ঘ’টেই চলেছে। রাতও, অনেক ঝামেলা পাকিয়েছে। ফলাফল : আমরা সময়মতো বেরুতে পারিনি এবং আজকে আমরা শুধু একবেলাই যাবো-সন্ধের সময়।

কালপঞ্জি অনুযায়ীই বরং ঘটনাগুলোই সাজিয়ে নেয়া যাক। তা থেকে এই উপসংহারে পৌঁছুনো যেতে পারে যে বিশৃঙ্খলাও কখনও-কখনও কাজে লেগে যেতে পারে।

কাল আমরা ঠিক করেছিলুম যে মোরিলিরেকে কিচ্ছুই বলা হবে না, শুধু তার ওপর নজর রেখে যাওয়া হবে। সেইজন্যেই, তাকে চোখে-চোখে রাখবার জন্যে আমরা পালা ক’রেই নজর রাখবার ব্যবস্থা করেছি—অন্যদের কাউকে জানতেও দিইনি যে ভেতরে-ভেতরে আমরা এই-ব্যবস্থাই করেছি। মাদমোয়াজেল মোর্‌নাসকে নিয়ে আমরা সবশুদ্ধু ছ-জন আছি, আর তিনি যেহেতু সবসময়েই নিজেকে পুরুষের সমান ব’লেই ভাবেন, এই-নজর রাখার কাজটা খুব-একটা কঠিন হবে না।

জুল ভের্ন (৫) : ৯

ক্রম একটা ঠিক ক’রে নিয়েছি আমরা, রাতটাকে—নটা থেকে ভোর পাঁচটা অব্দি—ভাগ ক’রে নিয়েছি মোটামুটি সমান-সমান ছটা ভাগে, তারপর লটারি ক’রে ঠিক করা হয়েছে কখন কার নজর রাখার পালা। টুপি থেকে আমাদের নামগুলো বেরিয়েছে এই ক্রম ধ’রে : মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস, মঁসিয় বারজাক, কাপ্তেন মার্সেনে, আমি-ফ্লরেঁস, সাঁৎ-বেরা ও মসিয় পঁসাঁ। এইভাবেই ভাগ্য পুরোক্রমটা স্থির ক’রে দিয়েছে।

রাত একটায় আমার পালা এসেছে, আমি গিয়ে কাপ্তেন মার্সেনকে ছুটি দিয়েছি। আমার কানে-কানে তিনি জানিয়েছেন, এখনও অব্দি সবকিছু ঠিকঠাক আছে, আঙুল তুলে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন মোরিলিরেকে, একটা শাদা চাদর মুড়ি দিয়ে সে ঘুমিয়ে আছে—আমাদের কাছেই। পূর্ণিমাচাদ আমাকে দেখতে দিয়েছে তার মুখটা, শাদা চাদরটা কালো রং-এর পাশে একটা প্রতিতুলনার ভাব সৃষ্টি করেছে।

আমার পাহারার সময় অস্বাভাবিক কোনোকিছুই ঘটেনি, শুধু দেড়টা নাগাদ আমার মনে হয়েছে আমি যেন সেই হাজারটা বোলতার গুনগুন শুনতে পেয়েছি হঠাৎ, যে-আওয়াজটা কান্কানে আমাদের অমন হকচকিয়ে দিয়েছিলো। এই আওয়াজটা সম্ভবত পুবদিক থেকে আসছে, তবে এত-সুদূর, এত-ক্ষীণ, এত-মৃদু, যে শেষপর্যন্ত আমিই মনস্থির করতে পারিনি আওয়াজটা সত্যি-সত্যিই শুনতে পেয়েছি কি না।

পৌনে-দুটোর সময় সাঁৎ-বেরার হাতে দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়ে আমি তাঁবুতে গিয়ে ঢুকেছি কিন্তু ঘুম আর আসে না। সবকিছু কেমন অস্বস্তিকর-এ-অবস্থায় একবার ঘুম চ’টে গেলে সহজে আর আসেই না। আধঘণ্টা ধ’রে ধস্তাধস্তি ক’রে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। বিছানা থেকে নেমে প’ড়ে ঠিক করেছি বাকিরাতটা বাইরের খোলা হাওয়ায় কাটিয়ে দেবো।

সেই মুহূর্তেই আবার আমি শুনতে পেয়েছি—এত-ক্ষীণ, এত-মৃদু যে মনে হচ্ছিলো আবার বুঝি এক শ্রবণবিভ্রম–সেই গুমগুমে গুঞ্জন। কিন্তু এবার আমি ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে চাই। আমি ছুটে বেরিয়ে এসে উৎকৰ্ণ হ’য়ে শোনবার চেষ্টা করেছি।

কিছুই-না, কিংবা যা ছিলো, তা খুবই ক্ষীণ। যেন নিশ্বাস পড়েছে কারু, তারপর মিলিয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে পুবদিকেই। না, এই অনিশ্চয়ের মধ্যেই সারাটা সময় আমাকে কাটাতে হবে দেখছি।

তখন ঠিক করেছি, যাই, গিয়ে দেখি সাঁৎ-বেরা কী করছেন!

বিস্ময়! (কিন্তু সত্যিই কি বিস্ময়ের চমক ছিলো আদৌ?) সাঁৎ-বেরা তাঁর নজরদারির জায়গাটায় নেই। বাজি ধরে বলতে পারি এই দুর্মরভাবে-আশাহীন বাউণ্ডুলে মানুষটা নিজের দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আর-কিছু নিয়ে ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছেন। যদি-না এই-ফাঁকে মোরিলিরে কোথাও সটকে প’ড়ে থাকে! আমি নিশ্চিত হ’য়ে যাবার জন্যে কাছে এগিয়ে যাই। উঁহু, মোরিলিরে তো সকে পড়েনি, অমনিভাবেই সে শুয়ে শুয়ে দিব্বি ঘুম লাগাচ্ছে, মাটিতে শুয়ে আছে সটান। শাদা চাদরের ফাঁকে তার কালো মুখটা-ঐ-তো, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

আশ্বস্ত হ’য়ে, আমি সাঁৎ-বেরার, খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি—এঁকে এবার দায়িত্ব সম্বন্ধে একটু সমঝে দিতে হবে। খানিকটা আঁচ করতে পারছিলুম, কোথায় গেলে তাঁর দেখা মিলবে। কারণ আগেই আমি দেখেছি আমাদের শিবিরের কাছেই তরতর ক’রে একটা নদী ব’য়ে চলেছে। সোজা চ’লে গিয়েছি তখন নদীর পাড়ে…আর- হুঁ-হুঁ—যা ভেবেছি, তা-ই, ঐ-তো ছায়ার মতো কে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। তীর থেকে এই খ্যাপা মৎস্যশিকারি জলের মধ্যে অতদূরে চ’লে গিয়েছে কী ক’রে? ইনি কি আবার জলের ওপর দিয়েও হেঁটে যেতে পারেন নাকি?

সকালবেলায় সাঁৎ-বেরা অবশ্য খুলেই বলেছেন রহস্যটা : একটা নামকাওয়াস্তে ভেলা তৈরি ক’রে নিয়েছিলেন তিনি, শুধু কোনোমতে যাতে তাঁকে ব’য়ে নিয়ে যেতে পারে—তিনটুকরো তক্তা পর-পর বেঁধে দিয়ে। তারপর বৈঠার বদলে ব্যবহার করেছেন একটা মস্ত ডাল, সেটা তাঁর লগিই হয়েছে আসলে, তারপর’ চ’লে গিয়েছেন মাঝনদী বরাবর। সেখানে মস্ত একটা পাথরকে ব্যবহার করেছেন নোঙর হিশেবে, গাছের লতা দিয়ে শক্ত ক’রে সেটা বেঁধে নিয়েছেন। গোটা ব্যাপারটায় তাঁর সময় লেগেছে মোটে আধঘণ্টা। প্রতিভা আছে বটে সাঁৎ-বেরার, মাছ ধরার ব্যাপার এলেই তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি দিব্বি খেল দেখায়। তবে সেইমুহূর্তে সেটা আমার বিবেচ্য ছিলো না। আমি পাড়ে গিয়ে নিচুগলায় তাঁকে ডাক দিয়েছি ‘সাঁৎ-বেরা…?’

জলের ওপর থেকে ছায়া উত্তর দিয়েছে : ‘এই-যে!’

‘ওখানে আপনি করছেনটা কী, সাঁৎ-বেরা?’

অস্ফুট-একটা হাসি শুনতে পেয়েছি আমি। ‘মাছ ধরছি, সাংবাদিকসাহেব।’

‘মাছ ধরছেন?’

‘হ্যাঁ। রাতের বেলা খ্যাপলা জাল ফেলে মাছ ধরছি।’ ব’লে আবার তিনি হেসেছেন।

‘আর, মোরিলিরে?’ আমার দশা তখন অকহতব্য।

অন্ধকার থেকে এমন বিচ্ছিরি একটা শপথবাক্য বেরিয়ে এসেছে আমার কলম সেটা লিখতে পারবে না, তারপরেই ছায়া দ্রুত নড়তে শুরু করেছে, আর সাঁৎ-বের‍্যাঁ হাঁটুজলের মধ্যে দিয়ে চোরের মতো মুখ ক’রে তীরে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি ভয়ে একেবারে আমশি হয়ে গেছেন। ‘মোরিলিরে?’ তাঁর গলা দিয়ে যেন কোনো স্বরই বেরুতে চায়নি।

‘হ্যাঁ, মোরিলিরে! নচ্ছারটাকে নিয়ে কী করেছেন বলুন-তো আহাম্মুকের মতো?’

আবার-একটা বিচ্ছিরি গালাগাল দিয়ে সাঁৎ-বেরা ছুটেছেন তাঁর পাহারার জায়গায়। সেখান থেকে এমনিতেই তাঁর নড়বার কথা ছিলো না।

ভাগ্যিশ, তখনও ঘুমিয়ে ছিলো মোরিলিরে। হলফ ক’রে বলতে পারি, কাপ্তেন মার্সেনকে ছুটি দেবার পর একবারও তাকে আমি পাশ ফিরতে পর্যন্ত দেখিনি। সাঁৎ-বেরা সে-কথায় সায় দিয়েছেন। আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছেন : ‘আপনি আমাকে যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন!’

সেইমুহূর্তেই আমরা শুনতে পেয়েছি বেশ-জোরালো একটা আওয়াজ, যে- নদীর পাড় ছেড়ে আমরা এসেছি, শব্দটা সেদিক থেকেই আসছে। শুনে মনে হচ্ছে, কেউ যেন জলে ডুবে যাচ্ছে।

অমনি আমরা ছুট লাগিয়েছি, সাঁৎ-বেরা আর আমি, আর দূর থেকে দেখতেও পেয়েছি, ও-পাশে, স্যাৎ-বেরার উদ্ভাবনীশক্তির নমুনা ঐ ভেলাটার পাশে, কী- একটা কালোমতো যেন জলের ওপর আছড়াচ্ছে।

‘এ-যে এক কালাআদমি,’ ব’লে উঠেছেন সাঁৎ-বেরা।

লাফিয়ে গিয়ে উঠেছেন তিনি নিজের ভেলায়, খ্যাপলা জালটার মধ্য থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন লোকটাকে, তারপর হিড়হিড় ক’রে তাঁকে ধরে টানতে-টানতে নিয়ে এসেছেন তীরে, আর আসতে-আসতেই আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছেন : ‘হতচ্ছাড়াটা আমার জালটায় আটকা প’ড়ে গিয়েছিলো—আমি ভুলে জলেই ফেলে এসেছিলুম।’ (এ আর এমন অস্বাভাবিক কী, স্যাৎ-বেরা?) ‘কিন্তু এই হতচ্ছাড়া ওখানটায় কী করছিলো?’

হতচ্ছাড়াটার ওপর আমরা ঝুঁকে প’ড়েই চমকে উঠেছি। ‘মোরিলিরে!’

হ্যাঁ, মোরিলিরেই! মোরিলিরে, উদোম ন্যাংটো, জলে-ভিজে-একশা, আর জলে আটকে নাকানিচুবানি খেয়ে প্রায়-আধমরা! সন্দেহ নেই যে, আমাদের গাইড শিবির ছেড়ে কেটে পড়েছিলো, সাঁৎরে পেরিয়েছে নদীটা এবং গাঁয়ের রাস্তায় একটু হাওয়া খেয়ে এসেছে, তারপর ফেরবার সময় স্যাৎ-বেরার ভুলোমনের কল্যাণে ঐ জালের মধ্যে আটকে প’ড়ে আছাড়িপিছাড়ি খেয়েছে! আমাদের এই ভুলোমনটি না-থাকলে এই বেইমানটার বদমায়েশি কারু নজরেই আসতো না!

তারপরেই আমার মাথায় উটকো ভাবনাটা খেলে গেছে। অ্যাঁ, ঐ অন্য মোরিলিরেটাই বা কে? জ্যোৎস্নার মধ্যে প’ড়ে-প’ড়ে অমন ঘুম লাগাচ্ছে!

ঘুমকাতুরেকে লক্ষ্য ক’রে আমি ছুটে গিয়েছি তখন। তাকে ধ’রে ক’ষে ঝাঁকুনি লাগিয়েছি।…হুম! এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো! চাদরটার তলায় শুধু মোরিলিয়ের জামাকাপড়ই প’ড়ে আছে। মুখটার জায়গায় কাঠের তৈরি একটা মুখের ভাস্কর্য! তার ওপরেই পাগড়ি পরিয়ে রেখেছে মোরিলিরে।

এবার বাছাধন একেবারে হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন—ইংরেজরা যাকে বলে – একেবারে রক্তলোহিত হস্তে।

স্যাঁৎ-বের্যার কাছে গিয়ে তারপর মনে হয়েছে, তাঁর কয়েদি বুঝি আস্তে- আস্তে একটু-একটু ক’রে ধাতস্থ হ’য়ে উঠছে।

আমি বলেছি, ‘বুঝি,’ কেননা আচমকা সে লাফিয়ে উঠেছে তড়াক ক’রে, ছুটে চ’লে গিয়েছে নদীর পাড়ে, আবারও-একটা সাঁতার কাটার মতলব।

মোরিলিরে অবশ্য তাড়াহুড়োয় তার বন্দীকর্তা স্যাৎ-বেরার কথা ভাবেইনি, স্যাঁৎ-বেরার বজ্রমুষ্টি পড়েছে তার কব্জিতে আর মোরিলিরে মিথ্যেই ছটফট করেছে পালাবার জন্যে। স্যাৎ-বেরার গায়ে যেন হাজারটা হারকিউলিস ভর করেছে, কেননা এমনভাবে তার কব্জিটা তিনি চেপে ধ’রেছিলেন যে, যন্ত্রণায় মোরিলিরে একটা আর্তনাদ ক’রে উঠেছে। মোরিলিরে পালাবার রাস্তা না-পেয়ে তখন ধপ ক’রে পায়ে প’ড়ে গেছে—ক্ষমা চাইতে শুরু করেছে ইনিয়ে-বিনিয়ে। আর তার মুঠি আলগা হ’য়ে তার হাত থেকে কী যেন প’ড়ে গিয়েছে মাটিতে

আমি ঝুঁকে প’ড়ে জিনিশটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি। বোধহয় তেমন আর সতর্কও থাকিনি, কারণ মোরিলিরে এক মরীয়া হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েই আমার হাত থেকে জিনিশটা ছিনিয়ে নিয়েই খপ ক’রে মুখে পুরে দিয়েছে।

দম আটকে গিয়ে, আধখানা ছেড়ে দিয়েছে সে, কিন্তু হতভাগা মাত্র-আধখানাই গিলতে পারেনি, তার শক্ত দাঁতে দু-আধখানা ক’রে দিয়েছে জিনিশটা, আর আদ্ধেকটা গিলে ফেলেছে।

আমি জিনিশটার দিকে তাকিয়ে দেখেছি সেটা একটা কাগজের টুকরো, আর তাতে কী-সব যেন লেখা।

‘হতভাগাটাকে শক্ত ক’রে পাকড়ে ধ’রে থাকুন,’ স্যাৎ-বেরাকে আমি হুঁশিয়ার ক’রে দিয়েছি।

স্যাৎ-বেরা ঘাড় নেড়ে আমায় আশ্বস্ত করেছেন, আর অমনি আমি ছুটে এসেছি কাপ্তেন মার্সেনের খোঁজে। তাঁর প্রথম কাজটাই হয়েছে মোরিলিরেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শাস্ত্রীদের পাহারায় একটা তাঁবুতে আটকে রাখা-তাঁবুটার চারপাশে চারজন বিশ্বস্ত সেপাই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তারপর আমরা গিয়ে তাঁকে জিগেস করেছি, কাগজটায় কী লেখা আছে।

লণ্ঠনের আলোয়, আমরা আবিষ্কার করেছি যে কাগজটায় কতগুলো আরবি হরফে কী যেন লেখা। কাপ্তেন নিজে ভালো আরবি জানেন, কাগজটা যদি ময়লা না-হ’তো আর মোরিলিরে সেটা যদি ছিঁড়ে না-ফেলতো, তাহ’লে সহজেই কাপ্তেন মার্সেনে সেটা পড়তে পারতেন। তাছাড়া হাতের লেখাটাও একটু জড়ানো, আর বায়ানটাও পুরোপুরি নেই। এ-অবস্থায় এটা নেহাৎই-একটা হেঁয়ালি মাত্র; দিনের আলোয় ভালো ক’রে এটাকে দেখতে হবে।

কিন্তু ভোর হ’তেই আমরা অনেক ভেবে দেখে বুঝতে পেরেছি, এত ঝামেলায় যাবার আমাদের দরকার নেই—তাছাড়া ধাঁধাটার সমাধান আমরা হয়তো করতেই পারবো না। বরং মোরিলিরে এখন যখন বুঝতে পেরেছে যে আমাদের ধাপ্পা দিয়ে তার আর-কোনো লাভ হবে না, সে হয়তো আমাদের দয়াটিক্ষা ক’রে সবকিছু কবুল করবে, তার সব ধড়িবাজির উদ্দেশ্যটাও বলবে-এবং নিশ্চয়ই এই-কাগজটার পুরোবয়ান কী ছিলো, তাও ব’লে দেবে।

যে-তাঁবুটাকে কয়েদখানা বানানো হয়েছিলো, আমরা সবাই সেটার দিকে এগিয়ে গিয়েছি—একসাথে।

তাঁবুর পর্দা সরিয়ে স্তম্ভিতভাবে আমরা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়েছি : যে-দড়িটা দিয়ে আমাদের কয়েদিকে পিছমোড়া ক’রে, আচ্ছা ক’রে, বাঁধা হয়েছিলো, সেই দড়িটা মাটিতে প’ড়ে আছে। তাঁবুটা ফাঁকা। পরিত্যক্ত। তার ভেতর কেউ নেই!