১.০৩ গ্লেনর-এর লর্ড রেজন

৩. গ্লেনর-এর লর্ড রেজন

কত বছর যে কেটে গিয়েছে, লর্ড রেজন একবারের জন্যেও বাড়ির বাইরে পা দেননি। ইংলণ্ডের একেবারে বুকের মাঝখানে উটোক্সেটার নামে ছোট্ট শহরের কাছে তাঁর গ্লেনর কাল, সেখানেই তিনি থাকেন; আজ কত বছর হ’লো তার দরজা একবারও কোনো অভ্যাগতের জন্যে খোলেনি; অনেক বছর হ’য়ে গেছে তাঁর নিজের ঘরের জানলাগুলো শেষবার শক্ত ক’রে আটকানো হয়েছে। তাঁর নির্জনবাস চূড়ান্তই বলা যায়, একেবারে চরমে পৌঁছেছে তাঁর একাকিত্ব—সেই- সেদিন তাঁর বংশের মুখে চুনকালি পড়েছে, তাঁর নামে টি-টি প’ড়ে গিয়েছে, তাঁর জীবনটাই প্রায় ধ্বংস ক’রে দিয়েছে কেলেঙ্কারিটা, ঠিক সেদিন-থেকেই-এরকম।

ষাট বছরেরও আগে, লর্ড ব্লেজন, রয়্যাল নেভাল অ্যাকাডেমি থেকে সদ্য পাশ ক’রে বেরিয়ে সদর দরজা দিয়েই সগর্বে ঢুকেছিলেন বয়োপ্রাপ্তদের জীবনে; পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তিনি উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন অগাধ ধনসম্পদ, নিষ্কলঙ্ক বংশগৌরব আর সারা ইংলন্ড-জোড়া খ্যাতি। সত্যি বলতে, ইংলন্ডের ইতিহাসের সঙ্গেই ব্লেজন বংশের কালপঞ্জি জড়ানো ছিলো—ইংলন্ডের জন্যে অঝোরধারে রক্ত ঝরিয়েছেন তাঁর পূর্বপুরুষ। স্বদেশ কথাটা জাতীয়বাদের গৌরবের সঙ্গে তখনও জড়িয়ে যায়নি, কিন্তু এই পরিবারের প্রতিটি পুরুষের হৃদয়পটে এই স্বাদেশিকতা গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছে; নর্মান বিজয়ের সঙ্গে -সঙ্গেই এসেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ, শুধু তরবারি নিয়েই বেঁচেছিলেন, এই অসিকে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন দেশের সেবায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী গেছে, একবারের জন্যেও এই বংশের গৌরবগাথায় কোনো আঁচড়ই পড়েনি, কোনো দাগই লাগেনি কলঙ্কের।

এডওয়ার্ড অ্যালান ব্লেজন সেই বিখ্যাত পরিবারেরই সুযোগ্য উত্তরপুরুষ। পূর্বপুরুষদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিলেন তিনি, দেশসেবা ছাড়া আর-কিছু যে করণীয় আছে তা কখনও ভাবেননি, বংশের মর্যাদায় কোনোরকম দাগ লাগুক এমন-কোনো কাজও কখনও করেননি।

পূর্বগানুকৃতি, বংশধারা অথবা অন্য যে-কোনো নামই দেয়া হোক না কেন তার, যে-প্রক্রিয়া বলে পুত্র তার পিতারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তা কিন্তু এই স্বদেশবোধ তাঁর মধ্যে সংক্রমিত করেনি, বরং যে-বিদ্যাভ্যাস তিনি করেছিলেন সেটাই তাঁর মধ্যে এই বোধ দীপিত ক’রে দিয়েছে। ইংলন্ডের ইতিহাস তাঁর পূর্বপুরুষের গৌরবগাথায় ভরা, আর তা-ই তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিলো : তাঁদের মতো তো বটেই, পারলে তাঁদের চাইতেও ভালোভাবে দেশসেবা ক’রে তিনি কৃতার্থ হ’তে চেয়েছিলেন।

বাইশ বছর বয়েসে বিয়ে করেছিলেন ইংলন্ডের প্রথম-পরিবারগুলোর অন্তর্ভূত একটি তরুণীকে, আর বিয়ের একবছর পরেই একটি কন্যা জন্মেছিলো তাঁদের। একটু নিরাশই হয়েছিলেন লর্ড ব্লেজন, অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন কবে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান জন্মায়।

সেই অপেক্ষা বিস্তৃত হয়েছে কুড়ি বছরব্যাপী। শুধু এত-বছর বাদেই লেডি ব্রেজন –কন্যার জন্মের সময় তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিলো—তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন সেই পুত্রসন্তান, যার জন্যে এতদিন ধ’রে সাগ্রহে তিনি কামনা ক’রে এসেছেন। ছেলের নাম দেয়া হয় জর্জ; ঠিক প্রায় সেই সময়েই তাঁর কন্যা— তাঁর বিয়ে হয় মসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা, নামে একজন ফরাশির সঙ্গে—পৃথিবীতে নিয়ে আসেন তাঁর পুত্রসন্তান, যার নাম অজেনর। এই সেই অজেনর, যে চল্লিশ বছর বাদে, হঠাৎ এমন বিস্ময়করভাবে আবির্ভূত হয়েছিলো ফ্রাসের সাংসদ মঁসি বারজাকের কাছে।

পাঁচ বছর বাদে, আরো-একটি ছেলে হ’লো লর্ড ব্লেজনের : লুইস রবার্ট, যে-পঁয়ত্রিশ বছর বাদে দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে? -অমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলো সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ডাকাতিতে।

বংশের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে এই দ্বিতীয় পুত্রসন্তানের জন্ম অপরিসীম সৌভাগ্যের সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড মারাত্মক একটি আঘাত হেনেছিলো। শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে জননীর মৃত্যু হ’লো; লর্ড রেজনের এতদিনের সুখদুঃখের সাথী প্রিয়তমা পত্নীর আকস্মিক বিয়োগ, অমন-নিষ্ঠুর দুর্বিপাকে, লর্ড রেজন যেন, বেটাল, মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। বুক ভেঙে গিয়েছিলো তাঁর, দুঃখে জর্জর বোধ করেছিলেন, কাজে আর মন লাগেনি, নৌবাহিনীর পদটায় তিনি ইস্তফা দেন— অথচ আর-কিছুদিন নৌবাহিনীতে থাকলে তিনি সম্ভবত নৌসেনাপতির পদে ভষিত হতেন।

পত্নীর মৃত্যুর পর অনেকদিন কেমন যেন গুটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নিজের মধ্যে। তারপর সময় যখন শোকের তীব্রতা একটু হ্রাস ক’রে দিয়েছে, ন-বছর নিঃসঙ্গ কাটাবার পর, তিনি আবার তাঁর ভেঙে-পড়া গৃহস্থালিতে নতুন ক’রে জোড়াতালি দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরই এক পরম বন্ধুর বিধবা পত্নী মার্গারিট ফেনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি, আর তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী সঙ্গে যৌতুক এনেছিলো শুধু ষোলো বছরের একটি ছেলে, তার নাম উইলিয়াম।

নিয়তি কিন্তু ঠিক ক’রে রেখেছিলো যে লর্ড গ্লেনর একা-একাই বৃদ্ধ ও জরাকবলিত হ’য়ে পড়বেন, জীবনের শেষদিনগুলো তাঁকে নিঃসঙ্গই কাটাতে হবে। কয়েক বছর বাদে, চতুর্থ একটি সন্তান জন্মালো তাঁর, মেয়ে এবার, তার নাম জেন, এবং জীবনে দ্বিতীয়বার তিনি বিপত্নীক হলেন।

লর্ড গ্লেনরের বয়েস তখন ষাট, এই বয়েসে আবার নতুন ক’রে জীবন গড়ার কোনো আশাই তাঁর ছিলো না। প্রেমপ্রীতিভালোবাসার ব্যাপারে দু-বার এমন প্রচণ্ড ঘা খেয়ে, তিনি পিতা হিশাবে তাঁর কর্তব্যপালনেই পুরোপুরি সমর্পণ ক’রে দিলেন নিজেকে। যদিও তাঁর প্রথম কন্যা-এখন মাদাম দ্য সাঁৎ-বেরা—অনেকদিনই পরের ঘরনি, তাঁর কিছু দেখাশুনো করার নেই; কিন্তু এখন চার-চারজন সন্তান আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়োটির বয়েস সদ্য কুড়ি ছুঁয়েছে। তিনি কোনোদিনই উইলিয়ামের সঙ্গে তাঁর নিজের ঔরসজাত সন্তানদের পৃথক ক’রে দ্যাখেননি। কিন্তু নিয়তি তো তাঁর নাগাল ছাড়েনি। এবার লর্ড গ্লেনরকে এমন-একটা শোকেতাপে জর্জরিত হ’তে হবে যার তুলনায় মনে হবে আগের দুঃখগুলো যেন কিছুই-না

ভবিষ্যৎ তাঁর জন্যে প্রথম যে-আঘাতটা তুলে রেখেছিলো তা কিন্তু সরাসরি এসেছিলো উইলিয়াম ফেরনের কাছ থেকে, তাঁর পরলোকগতা পত্নীর পুত্রসন্তান, যাকে তিনি নিজের ছেলের মতোই মানুষ করতে চাচ্ছিলেন। ধূর্ত, ধান্দাবাজ, খানিকটা ভণ্ডও বটে, উইলিয়াম কিন্তু তাঁর স্নেহে ঠিকমতো সাড়া দিতে পারেনি, আর কি-রকম সারাক্ষণ একাচোরা হ’য়েই কাটিয়েছে এই পরিবারে। উদাসীন, মনমরা, আর কেমনতর যেন রূঢ়ভাষী—যতই তাকে কাছে ডাকা যাক না কেন, ততই সে দূরে স’রে গেছে; যতই তাকে প্রীতি দেখানো যাক, ততই সে ঘৃণা পোষণ করেছে গোটা ব্লেজন পরিবারের প্রতিই।

অসূয়া, মাৎসর্য, ঈর্ষা, হিংস্র-বিদ্বেষ-সারাক্ষণ তার বুকটা কুরে কুরে খেয়েছে। যেদিন সে তার মায়ের সঙ্গে এই বিশাল গ্লেনর কালে এসে ঢুকেছে, সেদিন থেকেই সকলের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ অনুভব ক’রে এসেছে সে। তার অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গে নিজের পার্থক্যটা নিয়ে ভেবে-ভেবে তার মাথাটাই বুঝি গেছে— জর্জ আর লুইসের প্রতি দুঃসহ একটা ঘৃণাই বোধ করেছে সে অবিরাম : এরা বড়োলোক হবে, এরাই লর্ড রেজনের উত্তরাধিকারী; আর সে-মার্গারিট ফেনের ছেলে-সম্পত্তির কিছুই পাবে না। এবং তার পরেই যখন তার সৎ-বোন জেন- এর জন্ম হ’লো তাঁর ঘৃণা ও বিদ্বেষ গিয়ে পৌঁছুলো চরমে। কারণ সেও–জেনও- এই অগাধ ধনসম্পদের একটা অংশ পাবে, অথচ সে-ই রবে একমাত্র বঞ্চিত। শুধু দান হিশেবে সামান্য দু-চার পেনি হয়তো পাবে, ব্বাস, আর-কিছু না! তারপর যে-ই তার মায়ের মৃত্যু হ’লো, যতটুকু বোধবুদ্ধি তার অবশিষ্ট ছিলো, তাও গেলো : তার অসুস্থ হৃদয়টায় হয়তো তার মা-ই কোনোরকমে ঢুকতে পারতেন। কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না আর, জর্জ আর লুইসের ভাই-বেরাদরিও না, লর্ড ব্লেজনের অপত্য-স্নেহও না। দিনের পর দিন সে গুটিয়ে গেছে নিজের আরো-ভেতরে। এমন-এক জীবনযাপন করতে শুরু করেছে যার গুপ্তরহস্য কেবল একের পর এক কেলেঙ্কারিতেই একটু যা উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। শোনা গেছে, সে অসৎসংসর্গে পড়েছে, বদলোকের পাল্লায়।

তার সব বাড়াবাড়ির খবরই গুজবের আকারে পল্লবিত হ’য়ে একদিন লর্ড ব্লেজনের কানে গিয়ে পৌঁছলো : মিথ্যেই তিনি সদুপদেশ ও ভর্ৎসনা দিয়ে তাকে শোধরাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিতে অ্যাদ্দিন তিনি তার সব ধার- দেনাই শোধ ক’রে আসছিলেন, কিন্তু এবার তার পরিমাণ এতই ফেঁপে গেলো যে তিনি ঠিক করলেন একে আর একটি ফার্দিংও দেবেন না। শুধু-একটা মাসোহারা দেবেন তাকে, তাতে তার মতো যুবকদের হেসেখেলেই চ’লে যাবার কথা। কিন্তু তারপরেও উইলিয়াম ফেরনে তার জীবনযাপনের ভঙ্গিমা এতটুকুও পালটালো না। এত টাকা সে পায় কোত্থেকে এটাই ছিলো পরম রহস্য, কিন্তু একদিন-যখন লর্ড গ্লেনরের সামনে ব্যাঙ্ক থেকে মোটা-অঙ্কের একটা হুন্ডি পাঠালো, যাতে চমৎকার কৌশলে কেউ তাঁর সই হুবহু জাল করেছে, তখন সমস্ত রহস্যটাই ফাঁস হ’য়ে গেলো।

বিনাবাক্যব্যয়ে লর্ড ব্লেজন সে-টাকাটাও শোধ ক’রে দিলেন। কিন্তু কোনো জালিয়াৎকে সহ্য করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হ’লো, ফেরেব্বাজ ব’লে গালাগাল দিয়ে নিজের চোখের সামনে থেকে তাকে তিনি বার করে দিলেন; বললেন তিনি তাঁর মুখটিও দেখতে চান না—তবে তাকে তিনি এই মাসোহারাটা দিয়েই যাবেন। উইলিয়াম ফেরনে যথারীতি, ধান্দাবাজের মতো, মাথা নিচু ক’রে সব তিরস্কার-ভর্ৎসনা শুনলো, তারপর কথাটি না-ব’লে, তার নতুন মাসোহারার প্রথম কিস্তিটা স্পর্শ না-ক’রেই, সে গ্লেনর কাল ছেড়ে চ’লে গেলো-তারপর থেকে তার আর কোনো পাত্তাই পাওয়া যায়নি।

পরে যে তার কী হয়েছিলো, লর্ড রেজন তার কিছুই জানতে পারেননি কোনোদিন। তার কাছ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া যায়নি, তারপর আস্তে- আস্তে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই বেদনাদায়ক স্মৃতিও মিলিয়ে গেলো।

উইলিয়াম তাঁকে যতটা জ্বালিয়েছে, জর্জ আর লুইস কিন্তু সে-রকম কিছুই করেনি, বরং তাদের আচারব্যবহার তাঁকে সন্তোষই দিয়েছে চিরকাল। জর্জ গিয়ে বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেই নাম লিখিয়েছে রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে, সেখান থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হ’য়ে সমরবাহিনীতে কাজ নিয়ে উপনিবেশ চ’লে গিয়েছে অ্যাডভেনচারের খোঁজে। লর্ড ব্লেজনের দুঃখ এটাই যে তাঁর ছোটোছেলেটির কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহে কোনোই আসক্তি নেই, যদিও নিজের নির্বাচিত বিষয়ে সে যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে-তার অটুট কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার প্রতি যে-কেউই নির্ভর করতে পারতো।

উইলিয়াম আচমকা অন্তর্হিত হ’য়ে যাবার পর থেকে দুই ভাইয়ের জীবন স্বাভাবিকভাবেই কেটেছে। লুইসের প্রখর বুদ্ধি খেলে ব্যবসায়; সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে কর্মদক্ষতা দেখিয়ে সে অচিরেই ধাপে-ধাপে উঠে গেছে ওপরে- লোকে এটাই আশা করেছে যে একদিন সে এই ব্যাঙ্কেরই ডিরেক্টার হ’য়ে বসবে। জর্জ এই উপনিবেশ থেকে ঐ উপনিবেশে বদলি হয়েছে, আর মসীর বদলে দক্ষতার ছাপ রেখেছে অসিতে, আর ধাপে-ধাপে তারও উন্নতি হয়েছে ক্রমশ।

লর্ড ব্লেজন এ-সব দেখেশুনে ভাবতেই পারতেন বিরূপ নিয়তি বুঝি অবশেষে তাঁর ওপর থেকে তার কুদৃষ্টি সরিয়েছে, মনশ্চক্ষুতে তিনি বৃদ্ধ বয়েসের সুখসৌভাগ্যের ছবিই দেখেছিলেন। আর তারপরেই এসেছে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত, এর আগে যত ঘা খেয়েছে তাদের চেয়ে অনেক-ভয়ানক প্ৰায় যেন করাল এই ঘা, তাঁকে একেবারে পেড়ে ফেললো। শুধু যে নিদারুণ মর্মযন্ত্রণাই জুটেছে তা নয়, বংশের মুখে অনপনেয় চুনকালি পড়েছে। আজও, এতদিন পরেও, সেই ভয়ংকর অপনাট্যের দৃশ্য ভাসে চোখে, যাতে প্রধান ভূমিকা ছিলো তাঁরই জ্যেষ্ঠপুত্রের। কে জানতো যে গ্নেনর কালের গৌরব দেশদ্রোহিতার কালিমায় এমনভাবে কলঙ্কিত হ’য়ে উঠবে।

জর্জ ব্লেজন সমরবাহিনীর সুপারিশে, একটা কম্পানির দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলো : এই কম্পানির কাজ ছিলো আফ্রিকায় জরুরি সমস্ত সন্ধানী অভিযান চালানো। দু-বছর ধ’রে তার কর্মদক্ষতায় কম্পানির নানাভাবেই উন্নতি হয়েছিলো, কেননা সে-ই ছিলো মোটামুটি সংঘবদ্ধ একটি সমিতির প্রধান। সে যখন আশান্তিতে, তখন হঠাৎ খবর এলো সে নাকি একটা মস্ত ডিগবাজি খেয়ে নিজের দেশের বিরুদ্ধেই প্রকাশ্যে বিদ্রোহে নেমেছে।

খবরটা এলো যেন বজ্রাঘাতের মতো নিদারুণ-শুধু-যে তার বিদ্রোহেরই খবর তা-ই নয়, তার অনিবার্য শাস্তিরও খবর। খবরে প্রকাশ পেলো, কাপ্তেন ব্লেজন যে শুধু দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই করেছে তা নয়—তার দলবল নিয়ে সে একটা দুর্ধর্ষ দস্যুদল গ’ড়ে তুলেছে, তাদের লুঠতরাজের কাহিনী, নৃশংসতার কাহিনী, তাদের অন্যায় অবিচার ও অত্যাচারের কাহিনী ফলাও ক’রে বেরুলো সব কাগজে-আর এলো কী-রকম কঠোরভাবে ক-দিনের মধ্যেই এই বিদ্রোহকে দমন করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কোনো রোমাঞ্চকর উপন্যাসের মতো কিস্তিতে-কিস্তিতে বেরিয়েছিলো জর্জ ব্লেজনের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। দিনের পর দিন তারা ছাপিয়েছে দস্যুদল পর-পর কী-সব অপকর্ম করছে, কেমনভাবে তাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থেকেছে সামরিক বাহিনী, আর কী-ক’রেই বা পিছু হঠতে-হঠতে দস্যুর দল একেবারে কোণঠাশা হ’য়ে পড়েছে। শেষটায় নাকি কাপ্তেন ব্লেজন তার কয়েকজন কুকর্মের সাথী নিয়ে ঢুকে পড়েছে ফরাশি সাম্রাজ্যের মধ্যে, শেষটায় কুবোর কাছে, ওম্বুরি পাহাড়ের তলায় তাদের নাগাল পেয়েছে পল্টন, আর কীভাবেই-বা প্রথমঝাঁক গুলির ঘায়ে সে মারা গেছে। পল্টনের যে-অফিসার তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী, পরে সেও মারা গেছে জ্বরে; মৃত্যুর আগে যে-সাজা সে দিয়ে গেছে জর্জ ব্লেজনকে, তা ছিলো অমোঘ, ক্ষিপ্ৰ, আর মরণান্তিক। পরে অবশ্য অন্য-সব রগরগে ঘটনার মাঝখানে এই নিদারুণ কাহিনীটি চাপা প’ড়ে যায়, লোকে ভুলেও যায় তার কথা, কিন্তু শুধু-একজন ভোলেননি-তিনি লর্ড রেজন।

ছেলেকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, কিন্তু তাঁর কাছে প্রাণাধিক-প্রিয় ছিলো গ্লেনর কালের গৌরব-দু-দিক থেকেই নিদারুণ ঘা খেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু, প্রকাশ্যে, তাঁর বিবর্ণ মুখচ্ছবি দেখেও বোঝা যেতো না তার অন্তরের অন্তস্তলে কী ভয়ংকর টানাপোড়েন চলেছে। কোনো প্রশ্ন তিনি জিগেস করেননি, কথাটি পর্যন্ত বলেননি তিনি এই অসহ্য বিষয় নিয়ে, শুধু বিষম এক নির্জনতা আর অবর্ণনীয় স্তব্ধতায় নিজেকে মুড়ে নিয়েছেন। সেদিন থেকে আর-কেউ তাঁকে দ্যাখেনি তাঁর দৈনিক পদভ্রমণে; সেদিন থেকে তাঁর বাড়িতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও পুরোনো বন্ধুদেরও আনাগোনা নিষেধ ক’রে দিয়েছেন তিনি, সারাক্ষণ থেকেছেন প্রায় অনড়ই যেন, স্তব্ধ, নিশ্চল, নিঃসঙ্গ।

নিঃসঙ্গ? না, পুরোপুরি সঙ্গীসাথীহীন হয়তো নয়। শুধু-তিনজন পালা ক’রে তাঁর সঙ্গে থাকতো; জীবন্ত প্রস্তরমূর্তির মতো যে-ভয়াবহ অস্তিত্ব তিনি নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন, তারও মধ্যে এই তিনজনে তাঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করার মতো গুণ খুঁজে পেতো। নিজের মধ্যে এমনভাবে গুটিয়ে যেতেও অসীম সাহস লাগে; প্রচণ্ড মনের জোর লাগে নিজের জীবদ্দশাতেই অমনভাবে প্রেতের মতো হ’য়ে যেতে; আর এই-তিনজনে তাঁর এই মনের জোর, তাঁর দাপট, তাঁর এই সাহসকেই শ্রদ্ধাভক্তি করতো।

প্রথম জন হ’লো তাঁর দ্বিতীয় ছেলে লুইস রবার্ট ব্লেজন, এমন সপ্তাহ যেতো না যে-সপ্তাহে সে অন্তত একটা গোটা দিন বাবার কাছাকাছি গ্লেনর কালে কাটায়নি।

আর ছিলো তাঁর নাতি- অজেনর দ্য সাঁৎ-বেরা, বাড়ির এই দমবন্ধ আবহাওয়াকে যে তার দিলখোলা হাসি আর হুল্লোড় দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইতো। যখন এই অবিশ্বাস্য দেশদ্রোহিতার দায়ে জর্জ ব্লেজনের নামে চারপাশে ছি-ছি প’ড়ে গিয়েছিলো, যখন তার আর্দালি পর-পর অনেকগুলো চিঠিতে তার অপকীর্তির বিবরণ দিয়ে ধিক্কার জানাতো, তখনও অজেনরের মনে হয়েছে কোথায় যেন একটা রহস্য আছে, একটা প্রহেলিকা, একটা সমাধানহীন ধাঁধাই বুঝি, জর্জ ব্লেজন এমন করতেই পারে না : তখনও সে সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, নিজে এসে তার মাতামহের পাশে দাঁড়িয়েছে, কোনো কাজে লাগতে পারলে যেন ব’র্তে যায়, তার আনুগত্যে কোথাও কোনো চিড় ধরেনি। অন্যদের সঙ্গে অবশ্য তার তফাত্ত ছিলো-অন্তত তিনটে বিষয়ে সে সাধারণ কোনো লোকের চাইতে আলাদা : তার ছিলো এক অবিশ্বাস্য ভুলোমন; সমস্ত সীমা পেরিয়ে-যাওয়া নেশা—ছিপ ফেলে মাছ ধরবার জন্যে সে যেন সবকিছুই করতে পারে; আর সর্বোপরি, নারীসঙ্গ সম্বন্ধে তার ছিলো তীব্র অনীহা – অনীহা নয়, বিতৃষ্ণাই বুঝি। তার বাবা-মার কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিশেবে বিস্তর টাকা পেয়েছে, তা-ই সে স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করতে পারে-কারু গোলামিও করতে হয় না, অন্য-কারু কাছে হাতও পাততে হয় না। ফলে জর্জ ব্লেজনের খবরটা শোনবামাত্র ফ্লাস ছেড়ে সে চ’লে এসেছে এখানে, গ্লেনর কালের কাছে একটা ভিলাতেই দিন কাটায় সে সেই থেকে।

এই ভিলার বাগানের পাশ দিয়ে গেছে স্বচ্ছতোয়া এক ছোটোনদী—আর তাতেই সারাক্ষণ সে ছিপ ফেলে ব’সে থাকে। কী ক’রে যে কেউ অমনভাবে ফানার দিকে অনিমেষ লোচনে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব’সে থাকতে পারে, তা দেবতারাও বোধহয় জানেন না, মানুষ তো কোন্ ছার! অথচ তার এই নেশার কোনোই মাথামুণ্ডু নেই। কেননা ফাত্নার দিকে ওভাবে অপলকে তাকিয়ে ব’সে থাকবার সময় তার মন কিন্তু প’ড়ে থাকে অন্যসব বিচিত্র বিষয়ে। যদি কোনো মাছ বঁড়শিতে গেঁথেও যেতো, কোনো বারবেল, বা রোচ বা পাইক, তবে সে হয়তো তার কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে তাকে আবার নদীতে ছেড়ে দিতো—কেননা ককখনো সে এমনকী খেয়াল ক’রেও দ্যাখেনি তার এত সাধের টোপ কোনো কাজে লেগেছে কি না!

অদ্ভুত নেশা—এই মাছধরার রহস্যময় বাতিক। তবে তাও না-হয় ব্যাখ্যা করা যায় বড়োলোকের দুলালের খামখেয়াল হিশেবে, কিন্তু কী ক’রে কেউ ব্যাখ্যা করবে এমন তীব্র নারীবিদ্বেষ কেন তার। যে-ই পাঁচ মিনিট শুনতে চাইবে তাদের কাছেই সে হাত-পা নেড়ে ব্যাখ্যানা দেবে কেন সে মেয়েদের এত অপছন্দ করে। পৃথিবীর যত দোষ, যত ঝামেলা, যত গণ্ডগোল—সবকিছুর মূলে নাকি মেয়েরাই। ‘মোহিনী প্রতারক, বিশ্বাসঘাতিনী, অনৃতভাষিনী এবং উড়নচণ্ডী, টাকাকড়ি সব নয়ছয় ক’রে উড়িয়ে দেয়—’ এইভাবেই সে বর্ণনা করে মেয়েদের, সেই সঙ্গে আরো-যে কত থাকে অভিধা, লক্ষণা, ব্যাঙ্গ্যার্থ! কেউ যখন তাকে একবার বিয়ে করতে বলেছিলো, সে ব’লে উঠেছিলো: ‘কে বিয়ে করবে? আমি? আমি গিয়ে সম্পর্ক পাতাবো ও-রকম কোনো বিশ্বাসহন্ত্রী দস্যুনেত্রীর সঙ্গে!’ তারপরেও যদি কেউ নাছোড়ভাবে তাকে চাপ দেয়, তবে সে বলবে : ‘মেয়েদের ভালোবাসায় বাপু আমার কোনো বিশ্বাস নেই-আমার কবরে যদি কখনও কাউকে দুঃখেশোকে পাগলিনী হ’য়ে ম’রে যেতে দেখি, তবেই আমার এই মত পালটাবো।’ কিন্তু এ-রকমটা ঘটা যেহেতু আদৌ সম্ভবপর নয়, তাতে মনে হয় সে হয়তো চিরকুমারই থেকে যাবে।

সুন্দরীদের প্রতি তার এই অহেতুক বিতৃষ্ণার অবশ্য একটা ব্যতিক্রম ছিলো- ব্যতিক্রমটি জেন ব্লেজন, গ্লেনরের লর্ডের শেষ সন্তান, অরা সে হিশেবে অজেনরের মাসি—তবে এই মাসি তার চাইতে পনেরো বছরের ছোটো, যাকে সে শৈশব থেকে চেনে, যাকে সে হাতে ধীরে-ধ’রে হাঁটতে শিখিয়েছে, আর যে-মুহূর্তে তার বাবা জগৎসংসার পরিত্যাগ ক’রে নিজের অকথ্য দুঃখের ভেতর গুটিয়ে গেছেন, সেই মুহূর্তেই সে এই বালিকার স্বনিযুক্ত অভিভাবকের পদে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছে। প্রায় পিতৃস্নেহই সে অনুভব করে এই বালিকার প্রতি- আর সেই গভীর স্নেহের প্রতিদানও সে পায় জেনের কাছ থেকে, জেন তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, বোধহয় এই খ্যাপাটে ভাগ্নেটির জন্যে ভেতরে কোথাও একটা মমতার বোধও লুকিয়ে আছে তার। এমনিতে সবাই জানে যে অজেনর হ’লো জেনের শিক্ষক—কিন্তু এমন গুরু যিনি প্রাণপণে চেষ্টা ক’রে চলেছেন তাঁর শিষ্যটিরই চেলা হ’য়ে যেতে। প্রায় কখনোই পরস্পরের কাছছাড়া হয় না তারা। ঘুরতেও বেরোয় একসঙ্গে, ঘুরে বেড়ায় বনেবাদাড়ে, পদব্রজে অথবা অশ্বপৃষ্ঠে, নৌকোয় ক’রে অথবা কোচগাড়িতে, শিকারে যায় তাড়া ক’রে যায় বুনো হাঁস বা বনমোরগ, আর শেষটায় একদিন বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয়টি ব’লে বসে তার বয়োকনিষ্ঠা মাতৃস্বসা সম্বন্ধে যে তাকে সে কেবল ডানপিটে ক’রেই তুলবে না, একেবারে সেরা পুরুষই বানিয়ে ছাড়বে-তার পৌরুষ দেখে নাকি একদিন সকলেরই তাক লেগে যাবে!

জেন ব্লেজনই হ’লো সেই তৃতীয়জন, লর্ড গ্লেনরের জন্যে যার শ্রদ্ধা ও মমতার কোনো অস্ত নেই, প্রায় যেন মায়ের মতোই সে তার বৃদ্ধ বাপের এই শোচনীয় দশায় দেখাশুনো করে। তাঁর মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্যে সে হয়তো নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিতে পারতো; যে-ক’রেই হোক বাবার এই তিক্তদীর্ণ হৃদয়ে এতটুকু সুখ এনে দেবার জন্যে হেন কাজ নেই যা সে করতে পারবে না। সারাক্ষণ কেবল এই এক চিন্তা তার সব কাজকর্ম আচ্ছন্ন ক’রে রাখে। সে গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিলো তাঁর বাবা তাঁর নিজের ছেলের এই দুর্ভাগা পরিণামের জন্যে ভেতরে-ভেতরে কাঁদছেন না, কেননা তার কলঙ্কিত জীবনে এই শোচনীয় শাস্তিই তার প্রাপ্য ছিলো—যার মানইজ্জৎ সব গেছে তার আর বেঁচে থেকে লাভ কী। অথচ তবু তিনি কাঁদছেন–হয়তো ব্লেজন বংশের মুখে অনপনেয় কালি লেগেছে ব’লে। সে নিজে কিন্তু কখনও কাঁদেনি, আড়ালেও না, নিজের কাছেও না। তার মানে এই নয় যে যাকে সে গভীর ভালোবাসতো, সেই দাদার অভাবটা সে অনুভব করতে পারে না-বাড়ির মানসম্ভ্রম যে সব গেছে, সেটাও তাকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু শোকের চাইতেও যেটা জোরালোভাবে তার মনের মধ্যে হানা দেয় সেটা এক প্রতিবাদের সুর। কী? লুইস আর তার বাবা কি না এত সহজেই শোনবামাত্র জর্জের কলঙ্ককাহিনী বিশ্বাস করে বসে আছেন? একবারও জানতে চেষ্টা করলেন না, এই কেলেঙ্কারিটা সত্যি কি না! কোনো অনুসন্ধান, কোনো তদন্তই করলেন না! সাতসাগর পার থেকে কতগুলো নালিশ এলো, আর প্রমাণ বিনাই, কিছুই খতিয়ে না-দেখে, সব মেনে নিলেন! সরকারি প্রতিবেদনের মূল্যই বা কী? এ-সব প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে, তথাকথিত সাক্ষ্যপ্রমাণের বিরুদ্ধে, জর্জের গোটা জীবনটাই তো দাঁড়িয়ে আছে! সে হবে কি না দেশদ্রোহী,—তার এমন চমৎকার দাদা, বীর, অকুতোভয়, দুর্জয় সাহসী; এত ভালো, এত সৎ, এত নিষ্কলঙ্ক, যার সারা জীবনটাই তো দেশাভিমান আর আনুগত্যের প্রোজ্জ্বল সাক্ষী-এ-যে অচিন্ত্যনীয়! সারা জগৎ তাকে ছেড়ে যায় থাক, সে অন্তত তার স্মৃতিকে সম্মান করবে, দাদার ওপর বিশ্বাস তার কখনও হারাবে না। সেইজন্যেই শোকের চাইতেও তীব্র তার অভিমানের বোধ, তার রাগ। আর সময় বরং দিনে-দিনে তার সে-বিশ্বাস আরো জোরালো ক’রেই তুলেছে। দাদার নির্দোষিতায় তার আস্থা আরো বেড়েছে –অথচ, হায়-রে, যা তার এই নির্দোষিতা প্রতিষ্ঠিত করবে, তার প্রমাণ কই। অবশেষে সেই-মুহূর্ত এসেছে, ঘটনাটা ঘ’টে যাবার কয়েক বছর পর, যখন সে মরীয়া হ’য়ে বেপরোয়াভাবে সেই চরম স্তব্ধতাকে ভেঙেছে—মৌন ও অলিখিত কোনো সম্মতির দরুণ কবোর সেই শোচনীয় পরিণামের পর থেকে গ্লেনর কালের কেউই যে-স্তব্ধতাকে ভাঙতে সাহস পায়নি!

‘মামা?’ ভাগ্নে হ’লেও বয়েসে বড়ো ব’লে অজেনর সাঁৎ-বের্যাকে সে মামা ব’লেই ডাকে। আর অজেনরও একইভাবে সম্পর্কটাকে উলটে দিয়ে মাসিকে ডাকে ভাগ্নী ব’লে। তবে সবসময় তা হয় না অবশ্য… যদি এই তথাকথিত মাতুল কখনও এই ছদ্ম-ভাগিনেয়ীকে নালিশ করার কোনো কারণ জোগায়, অথবা অজেনর যদি কখনও তার কোনো ইচ্ছাপূরণে অসম্মতি জানায়—এমনকী তার কোনো খামখেয়ালে বাধা দেবার চেষ্টা করে, জেন তক্ষুনি তার সত্যিকার সম্পর্কটা নিয়ে হৈ-চৈ বাধিয়ে দেবে, তার বোন-পোর উচিত বড়োদের যথার্থ সন্মান করা, মাসির কথার বিরুদ্ধে না-যাওয়া? অবস্থা বুঝে, কুঁকড়ে গিয়ে, কাঁচুমাচু বোন-পো তার পরমা-শ্রদ্ধেয়া মাসিমনির কাছে গলা নামিয়ে আনে, হার মেনে নেয়, পারলে হাত-পায়ে ধরে। সম্পর্কের আকস্মিক ডিগবাজি মাঝে-মাঝেই চমকপ্রদ সমস্ত সংলাপের সূচনা ক’রে দেয়। যেমন, সেদিন জেন যখন ডেকেছে, ‘মামা?’, অজেনর বর্শেলের বিড়ম্বনা বিষয়ে একটি কেতাবে মুখ গুঁজেই অন্যমনস্কভাবে বলেছে, ‘কী?’

‘আমি জর্জ বিষয়ে কথা বলতে চাই।’

অজেনর এমনই চমকে গেছে যে অমনি কেতাবটা নামিয়ে রেখেছে। জর্জ বিষয়ে? একটু বিচলিত ও বিমূঢ়ভাবেই জিগেস করেছে, ‘কোন্ জর্জ? কে জর্জ?’

ঠাণ্ডাভাবে জেন জানিয়েছে, ‘আমার দাদা জর্জ।’

অজেনর কেনন মিইয়ে গেছে, ফ্যাকাশে। ‘কিন্তু তুই তো জানিসই,’ কাঁপাগলায় সে বলেছে, ‘এ-বাড়িতে ঐ নাম মুখে আনাও বারণ।’

জেন কেবল মাথা নেড়ে আপত্তিটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। ‘তাতে কিছুই এসে-যায় না,’ শান্ত গলায় সে বলেছে, জর্জ বিষয়ে আমাকে বলো, মামা।

‘কী জানতে চাস?’

‘তার সম্বন্ধে সবকিছু – সবকিছু!

‘সে আমি কখনও বলতে পারবো না।’

জেন ভুরু কুঁচকেছে। ‘বোন-পো?’ তার গলায় ঝড়ের পূর্বাভাস। আর-কিছুই দরকার হয়নি।

‘ঠিক আছে! ঠিক আছে!’ তড়বড় ক’রে বলেছে অজেনর, আর তারপর সেই কাহন ফেঁদেছে, সেই বিষাদসিন্ধু। সব খুঁটিনাটি সমেতই বলেছে সে সেই শোচনীয় কাহিনী। জেন শুধু গালে হাত দিয়ে ব’সে চুপচাপ শুনেই গেছে, আর-কোনো প্রশ্নই করেনি। ব্যাপারটা চুকে গেছে ভেবে অজেনর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছে।

কিন্তু অজেনর ভুল ভেবে ছিলো। কয়েকদিন পর আবার এসে হানা দিয়েছে জেন।

‘মামা?’ আবার সে জিগেস করেছে একদিন।

‘কী? ‘

আচ্ছা, ধরো, জর্জ যদি দোষী না-হয়? ‘

অজেনর বুঝতে পারেনি নিজের কানটাকে তার বিশ্বাস করা উচিত কি না। ‘দোষী না-হয়?’ সে বলেছে, ‘বলতে দুঃখ হচ্ছে, বাছা, এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। হতভাগার অপরাধ এবং শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যু—এ-সব হ’লো ঐতিহাসিক তথ্য—এ-বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতেই পারে না।

‘পারে না মানে? ‘

অজেনর আবার আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে বলেছে সব। উল্লেখ করেছে, খবরকাগজে কী-সব প্রতিবেদন বেরিয়েছে, সরকারি-সব প্রতিবেদন যার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। আর শেষটায় সে প্রমাণ হিশেবে দাখিল করেছে অভিযোক্তার অনুপস্থিতি-সে যে বেঁচে নেই এটা তারই তো অকাট্য প্রমাণ।

‘হ্যাঁ, মৃত্যুর প্রমাণ হ’তে পারে বটে,’ জেন পাকা আইনজীবীর মতো আপত্তি তুলেছে; ‘কিন্তু তা তো আর তার দেশদ্রোহিতার প্রমাণ হ’তে পারে না!’

‘একটা তো আরেকটারই ফল,’ জেনের জেদ তাকে অবাক ক’রে দিয়েছে।

এই একগুঁয়েমি যে কতটা বদ্ধমূল, তা সে আন্দাজও করতে পারেনি। সে- দিন থেকে প্রায়ই জেন এসে ঐ অবাঞ্ছিত ও অরুচিকর প্রসঙ্গটা তুলেছে—জেরায় – জেরায় একেবারে জেরবার ক’রে দিয়েছে অজেনরকে। তা থেকে বেচারা অন্তত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, আজও জেনের মতে তার দাদা সম্পূর্ণ নিরপরাধ।

এ-ব্যাপারটায়, অবশ্য, অজেনর নিজের মতটা আদপেই পালটায়নি। জেনের সেরা সব বিরুদ্ধযুক্তির সামনে শুধু কষ্ট-কষ্ট মুখ ক’রে তার মাথাটাই নেড়েছে— যেন এমনতর অপ্রয়োজনীয় তর্কে সে মোটেই আর অংশ নিতে চায় না। জেন বুঝতে পেরেছে যে তার এই বোন-পোর বিশ্বাসকে কিছুতেই আর নাড়ানো যাবে না। শেষটায় একদিন জেন তার ধৈর্য হারিয়ে প্রায় দাপিয়েছে যেন। আবার সে শুরু করেছে : ‘মামা?’

‘কী?’ উত্তরও এসেছে যথারীতি।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি, মামা, আর শেষটায় এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি যে, জর্জ সম্পূর্ণ নিরপরাধ।’

‘কিন্তু, বাছা—’ অজেনর শুধু শুরু করতে গিয়েছে, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে জেন তীব্রসুরে ব’লে উঠেছে, ‘এর মধ্যে আর-কোনো কিন্তু নেই। জর্জ নিরপরাধ।’

‘তবু–’

জেন উঠে দাঁড়িয়েছে, নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত। ‘শোনো, বোন-পো, তোমাকে স্পষ্ট ক’রে বলি : আমার দাদা জর্জ সম্পূর্ণ নিরপরাধ

অজেনর তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। বাধ্য ছেলের মতো বলেছে, তাহ’লে তাই হবে, মাসি।’

সেই থেকে জর্জের নির্দোষিতা স্বীকৃততথ্য হিশেবেই গণ্য হয়েছে, অজেনর দ্য সাঁৎ-বেরা তা নিয়ে আর-কোনোই তর্ক তোলেনি। তাছাড়া, জেনের এই অনড় দৃঢ়বিশ্বাস তার মধ্যেও খানিকটা প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিলো। অন্তত তার সম্বন্ধে অভিযোগগুলো সত্য কি না, সে-সম্বন্ধে বেশ খটকাই জাগতে শুরু করেছিলো তার।

পরের বছরগুলোয়, জেনের চিন্তা এমনদিকে বিকশিত হ’তে শুরু করেছিলো যাতে একফোঁটাও যুক্তিতর্কের বালাই ছিলো না। তর্ক ক’রে কি আর বিশ্বাস নাড়ানো যায়? যুক্তিগর্ভ না-হ’তে পারে, তার বিশ্বাস হয়তো পুরোটাই আবেগের বশবর্তী, কিন্তু তবু তো তা বিশ্বাস। আর তাতে সহমত কাউকে পাওয়া তো সত্যি যেন হাতে-চাঁদ-পাওয়া। কিন্তু তাতেই বা কী এসে যায়? ঢাকঢোল পিটিয়েই না-হয় বলা গেলো যে আমার দাদা নিরাপরাধ, কিন্তু যতক্ষণ-না তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে ততক্ষণ এ-কথাটার কোনোই মানে নেই। শেষকালে, অনেক মাথা ঘামিয়ে, জেনের মনে হ’লো সে বুঝি এটা প্রমাণ করবার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে।

‘তাহ’লে এটা আমরা ধ’রে নিয়েছি,’ একদিন সে অজেনরকে বলেছে, ‘যে জর্জ সম্পূর্ণ নিরপরাধ?

‘হ্যাঁ, বাছা,’ অজেনর মুখে যদিও কথাটা বলেছে, তবু সে ও-বিশ্বাসে পুরোপুরি নিশ্চিত হ’তে পারেনি।

‘জর্জের প্রখর বুদ্ধি ছিলো, অত্যন্ত চালাক ছিলো সে,’ দাদা সম্বন্ধে আরো ভেঙে বলেছে জেন, ‘তার পক্ষে এমন হাঁদার মতো কিছু করা সম্ভবই ছিলো না। তাছাড়া নিজের সম্বন্ধে তার এতটাই অহংকার ছিলো যে তার পক্ষে এভাবে কাদায় গড়াগড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। দেশকে সে এতটাই ভালোবাসতো যে খামকা হঠাৎ সে দেশদ্রোহিতা করতে যাবেই বা কেন?’

‘সেটাও বোঝা যায়।’

‘আমরা তো ওর সঙ্গে থেকেছি, দাদা কী ভাবতো না-ভাবতো সব আমি জানি, মানইজ্জৎ সম্বন্ধে ভারি সচেতন ছিলো সে, বাবাকে ছাড়া আর কাউকেই সে অমন শ্রদ্ধাভক্তি করতো না, আর দেশের গৌরবের অংশীদার হওয়া ছাড়া আর-কোনো উচ্চাশাই তার ছিলো না। তারপরেও কি বিশ্বাস করা যায় যে সে আচমকা একদিন মানসম্মান সব জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে- দেশ আর বংশের মুখে চুনকালি মাখাবে? বলো, মামা, বলো- তুমি কি বিশ্বাস করো যে জর্জ কখনও দেশদ্রোহী হ’তে পারে?’

‘আমি! আমি কিছুই ভাবতে চাই না, মাসি,’ অজেনর সাফাই গেয়েছে, ভেবেছে মাসি ব’লে ডেকেই বুঝি জেনকে ঠাণ্ডা করা যাবে।

‘অথচ তবু কি না তুমি জুলজুল ক’রে আমার দিকে তাকিয়ে হাত-পা এলিয়ে গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছো? তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে অমন জঘন্য- কোনো ভাবনা জর্জের দুঃস্বপ্নেও হানা দিতে পারতো না! আর তা যদি বিশ্বাস করো, তবে বলো, মুখ ফুটে একবার বলো, আমার কর্ণযুগল সার্থক করি!’

‘বলি তো, মাসি, আমি-তো ঐ কথাই বলি! ‘

হুঁ, এবার অন্তত কিছু-একটা মুখ ফুটে বলেছো! তবে, যারা এই অলীক কাব্যকাহিনী বানিয়েছে, তারা হচ্ছে সত্যিকার হতভাগা-বদমায়েশের হদ্দ!’

‘খলনায়ক সব! ফেরেব্বাজ!

তাদের সব কটাকে পাকড়ে হাজতে পোরা উচিত!’

‘একশোবার! আর নয়তো ফাঁসিতেই লটকে দেয়া উচিত। একেবারেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে।’

‘সেইসঙ্গে খবরকাগজের ঐসব নিজস্ব সাংবাদদাতাদেরও দাবড়ে দেয়া উচিত! তাদেরই মিথ্যা গালগল্প এমন বেইজ্জতি করেছে আমাদের!’

‘হ্যাঁ, সব সংবাদদাতাকেই লটকে দেয়া উচিত ফাঁসিতে! তাদের ফায়ারিংস্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি ক’রে মারা উচিত!’

‘এ-বিষয়ে তোমার আর-কোনো সংশয় নেই তো?’

‘মোটেই না! একফোঁটাও না!’

‘বেশ, আমি শুধু জেনে নিতে চাচ্ছিলুম তোমার কোনো খটকা আছে কি না!’

‘আমি তো স্বপ্নেও ককখনো…’

‘বেশ! তা যদি না-হ’তো তবে আমি তোমাকে দূর-দূর ক’রে তাড়িয়ে দিতুম, আর কখনও তোমার শ্রীমুখটা আমার সামনে দেখাতে দিতুম না!

ঈশ্বর আমায় রক্ষে করুন!’ বেচারা অজেনর এই হুমকিতে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে কাঁচুমাচু হ’য়ে ব’লে উঠেছে।

জেন একটু থেমে আড়চোখে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করেছে তার শিকারকে। পুরো প্ল্যানটাই সে আগাগোড়া ছ’কে রেখেছে, কারণ তার এই চোটপাটের মধ্যে যতটা- না সত্যিকার দাবড়ানি ছিলো, তার চাইতেও বেশি ছিলো হিশেব। সে এবার অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরেই বলেছে, ‘এই-যে আমরা দুজনা জর্জের নির্দোষিতায় বিশ্বাস ক’রে মুখ কালো ক’রে নিরুপায় ব’সে আছি, এটা মোটেই ঠিক না। কোনো- না-কোনো উপায়ে সেটা আমাদের এবার প্রমাণ করতেই হবে! দেখো, আমরা ঠিক কিছু-একটা করতে পারবো এ-বিষয়ে! ‘

অজেনরের মুখ আলো হ’য়ে উঠেছে। যাক, তুফানটা তবে কেটেই গেছে এবারকার মতো!

‘কিছু যদি করতেই না-পারি, তবু ছাতে উঠে গলা ফাটিয়ে হাজার চ্যাঁচালেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে জর্জ নির্দোষ।

‘সে-তো ঠিকই।’

‘কতগুলো গুজব,—কে জানে কোন চুলোয় পাকানো হয়েছে তাদের!-বাবা কি না সেগুলোকেই বিশ্বাস ক’রে দ’গ্ধে-দ’গ্ধে মরতে বসেছেন—জলজ্যান্ত আমাদেরই চোখের সামনে। এমনকী যারা এই গুজব রটাচ্ছে একবারও তাদের তিনি মোকাবিলা করতেও চাননি! একবারও বলেননি : ‘তোরা সব মিথ্যাবাদী! কাপুরুষ! জর্জ কখনও এমন কাজ করতেই পারে না!’ কী ক’রে তাহ’লে এখন ভাববো যে অজানা অচেনা উটকো কোনো লোক এসে আমার দাদার নির্দোষিতা স্পষ্ট ক’রে প্রমাণ ক’রে দেবে –বাবাই যখন কিছু না-ক’রে হাল ছেড়ে দিয়ে ব’সে আছেন!’

‘সে তো অবশ্যই—তা মোটেই সম্ভব নয়,’ অজেনর সায় দিয়েছে, তবে সেটাই তো হয়েছে মুশকিল…প্রমাণ…অকাট্য প্রমাণ…সেগুলো আমরা এখন পাবো কোন চুলোয়?’

‘এ-বাড়িতে ব’সে যে পাবো না, তাতে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই,’ জেন একটু থেমে, তারপরেই জুড়ে দিয়েছে, ‘অন্য-কোথাও গিয়েই পাবো, সম্ভবত!’

‘অন্য-কোথাও গিয়ে? কোথায় গিয়ে?’

‘যেখানে ব্যাপারটা ঘটেছিলো ব’লে শোনা যায়। অকুস্থলে! কুবোয়!’

‘কুবোয়!’

হ্যাঁ, কুবোয়। প্রথমে সেখানে গিয়ে খুঁজে বার করতে হবে জর্জের কবর- কেননা তাদের মতে সেখানেই নাকি মারা গিয়েছে সে, আর তা যদি হয়, কবর খুড়ে দেখলেই বোঝা যাবে কেমন ক’রে সে মারা গেছে! তারপর হন্যে হ’য়ে খুঁজে বার করতে হবে অন্যদ্রের, যারা প্রাণ নিয়ে সটকেছে-সেই-যারা তার বিদ্রোহের দলে ছিলো ব’লে বলাবলি করে লোকে। তারা তো সংখ্যায় তেমন নগণ্য ছিলো না–আর সকলেই কর্পূরের মতো উবে যেতে পারে না। তারাই হচ্ছে সাক্ষী : তাদের প্রশ্ন করতে হবে, জেরা করতে হবে, অন্ধকার থেকে আলোয় টেনে বার ক’রে আনতে হবে সত্যকে জানতে হবে সত্যি কী হয়েছিলো।’ বলতে- বলতে জেনের মুখচোখ উদ্ভাসিত হ’য়ে উঠেছে, কেঁপে উঠেছে তার গলার স্বর। তুই ঠিকই বলেছিস, জেন,’ অজেনর ঠিক বুঝতেও পারেনি কোন ফাঁদে সে পা দিতে চলেছে।

অমনি জেনের মুখে তার একরোখা জেদের ভাবটা ফুটে উঠেছে। ‘বেশ। আমি যদি ঠিক কথা ব’লে থাকি, তবে এক্ষুনি কারু সেখানে যাওয়া উচিত।’

অজেনর আঁৎকে উঠেছে। ‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার…কুবোয়!

‘কুবোয়! তা কোন হতভাগ্যকে তুই সেখানে পাঠাতে চাস, শুনি!’

জেন তখন অজেনরের গলা জড়িয়ে ধরেছে। ‘তোমাকে, মামা।’

‘আমাকে!’

অজেনর গলা থেকে হাত দুটি ছাড়িয়ে নিয়েছে। এই-একবার সে সত্যি-সত্যি চ’টে উঠেছে। ‘তোর মাথাটাই গেছে!’

‘না, যায়নি। আমার মাথা খারাপ হয়নি।’ জেন ফের তাকে দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। ‘আর, শুনি, কেন তুমি কুবোয় যেতে চাচ্ছো না? তোমার কি দেশ-বিদেশ বেড়াতে ‘ভালো লাগে না?’

‘মোটেই লাগে না। আমার বরং অসহ্য লাগে-কোথাও যেতে হ’লে! সময়মতো স্টেশনে যাও, টিকিট কাটো, ট্রেন ধরো-এ-সব আমার আসে না।’

মাছ ধরতেও তোমার নিশ্চয়ই জঘন্য লাগে?’

‘মাছ ধরতে? তুই যে কী বলতে চাচ্ছিস, তা-ই আমার মাথায় ঢুকছে না।’

‘তাহ’লে টাটকা জলজ্যান্ত লাফাতে-থাকা মাছগুলোকে তুমি কী বলবে—ঐ নাইজার নদীর জলে যাদের তুমি তোমার বঁড়শিতে গাঁথবে? সে নিশ্চয়ই একখানা কাণ্ডই হবে –নাইজারের জলে মাছ ধরা-আর কতরকম মাছ, আর কত বড়ো- বড়ো! আর তুমি কি না সে-সব মাছ ধরবার জন্যে কোনোই চেষ্টা করবে না!’

‘সে-কথা আমি বলিনি… তবে…’

আর মাছ ধরতে ধরতেই দু-চার জায়গায় শুলুকসন্ধান করা যেতে পারে- একে-ওকে-তাকে জিগেস করা যেতে পারে, স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও তুমি আলাপ করে জানতে পারো…

‘কথা যে বলবো, কোন্ ভাষায়? আমার তো জানা ছিলো না ওরা সবাই ‘ ইংরেজিতে দারুণ সড়গড়!’

জেনকে মোটেই রসিকতাটায় সহাস্য দেখায়নি। ‘সেইজন্যেই বাম্বারাতেই তাদের সঙ্গে কথা বলা অনেক-বেশি ভালো হবে।’

‘বাম্বারা? আমি কি ছাই বাম্বারা-ফাম্বারা জানি নাকি?’

‘কেন? শিখে নেবে।’

‘আমার এই বয়সে?’

‘কেন? আমি তো শিখেছি। আর আমি তো তোমার মাসি হই।’

তুই? তুই জানিস নাকি বাম্বারা?’

‘নিশ্চয়ই। শোনোই না তবে : ‘দিফি লোখো আ বে না’

‘তা এই হ-য-ব-র-ল-র মানে কী?’

তার মানে, ‘আমার তেষ্টা পেয়েছে’। আর ‘ই দু, নোনো ই মিতা’।’ আরে ব্বাস… নোনো… মিতা!’

তার মানে : ‘এসো, আমি তোমাকে দুধ দিচ্ছি’। আর ‘কুকো বে না।

কুলু উয়াবারা উতে আ মান দুমুনি’। তোমাকে মাথা চুলকোতে হবে না। তর্জমা

আমার খুব খিদে পেয়েছে। কাল সকাল থেকে আমি কিছু খাইনি’।’

‘আর আমাকে এ-সব কথা শিখতে হবে?’

‘হ্যাঁ, শুধু এই ক-টা কথাই নয়, আরো-বেশি। আর সময় নষ্ট কোরো না, আমাদের চটপট রওনা হ’য়ে পড়তে হবে।’

‘তার মানে? রওনা হ’য়ে পড়তে হবে—মানে? আমি বাপু যাচ্ছি না-একপাও নড়ছি না, বলে রাখলুম। কী একখানা আব্দার! না, আমি বাপু আফ্রিকায় গিয়ে ওখানকার লোকজনের সঙ্গে মাখামাখি করতে পারবো না!’

জেন বুঝি হাল ছেড়ে দিয়েছে, তাকে আর-কিছু বোঝাতে চেষ্টা করেনি। ‘অগত্যা আমাকে একাই যেতে হবে।’

‘তুই একাই যাবি!’ অজেনর আকাশ থেকে পড়েছে। ‘তুই একা সশরীরে সেখানে গিয়ে হাজির হবি?’

হ্যাঁ। কুবোয় তো যেতে হবেই।’

‘সমুদ্রের তীর থেকে হাজার মাইল ভেতরে?’

‘হাজার নয়, মামা, এগারোশো মাইল।’

‘বলা নেই, কওয়া নেই, অমনি ছট ক’রে গিয়ে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বি? তাও একা-একাই?’

‘বলা নেই কওয়া নেই মানে? এই-তো তোমাকে বললুম। তা তুমি যদি সঙ্গে যেতে না-চাও তো আমাকে একা-একাই যেতে হবে বৈকি!

‘তোর মাথাখারাপ হ’য়ে গেছে! এ যে একেবারে বাতুলের প্রলাপ! বিকার! ব’লে, ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অজেনর, দড়াম ক’রে বন্ধ ক’রে গেছে দরজা!

কিন্তু পরের দিন জেনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছে, জেন তার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ ক’রে দিয়েছে। আড়ি। তার মুখ থেকে চুঁ শব্দও খসানো যায়নি। এই আড়িই চলেছে দিন-কতক। অজেনর এমন মরণখেলার খেলোয়াড় হ’তে রাজি নয়, কিন্তু শেষটায় ক-দিন বাদে নিজে থেকে শান্তির ঝাণ্ডা ওড়াতে হয়েছে তাকে। ক-দিন মানে মাত্র চারদিন বাদেই!

তারপর থেকে তার তরুণী মাসি তাকে যা বলেছে তাতেই সে সায় দিয়েছে, তারই মতের শরিক হয়েছে। আফ্রিকায় এই অভিযানে–গোড়ায় যেটাকে তার কারু অতিআতপ্ত মস্তিষ্কের বিকার বলেই মনে হয়েছিলো, তাকে তারপরে মনে হয়েছে নেহাৎই-বিপজ্জনক, তারপরে ‘বাঃ, যাওয়াই বা যাবে না কেন,’ এবং শেষকালে মনে হয়েছে—’এ আর এমন কথা কী? বেড়াতে তো লোকে যায়ই।’ সেইজন্যেই চব্বিশ গুণ চার ঘণ্টা কাটিয়ে সে মাফি মেঙেছে কাঁচুমাচু হ’য়ে, নিজের ভুল স্বীকার করেছে একশোবার, আর জানিয়েছে –যাত্রার জন্যে সে একপায়েই খাড়া।

জেন অবশ্য সদাশয়াই, গোড়ার ঐ ওজর-আপত্তির কথা সে ভুলে গিয়েছে, তার দুইগালে দুই চুমু খেয়ে বলেছে : ‘প্রথমে কিন্তু ভাষাটা তোমায় শিখে নিতে হবে, মামা,।’

তারপর থেকে লোকে বোধহয় শয়নে স্বপনে সবসময়েই অজেনরকে দেখেছে একটা বাম্বারা ব্যাকরণের বইতে মুখ গুঁজে প’ড়ে থাকতে।

রওনা হবার আগে অবশ্য জেনকে এটা জেনে নিতে হবে যে তার এই অভিযানে তার বাবারও সম্মতি আছে। ভেবেছিলো, সহজে অনুমতি মিলবে না- কিন্তু চট ক’রেই পাওয়া গিয়েছে বাবার মত-জেন কথাটা পাড়বামাত্র একবার উদ্ভাসিত মুখে তাকিয়েছিলেন তিনি ছোটোমেয়ের দিকে, ইঙ্গিতে সায় দিয়েছেন, তারপরেই ডুবে গিয়েছেন আবার তাঁর অন্তহীন হতাশায়। তিনি কি সত্যি শুনেছেন তাঁর ছোটোমেয়ে কী বলেছে? তাঁর তো আজকাল আবার কোনোকিছুতেই কোনো চেভেদ নেই।

তারপরেই যাত্রার জন্যে তৈরি হ’তে উঠে-পড়ে লেগে গিয়েছে মাসি- বোনপো। তখনও যেহেতু জানতো না যে বারজাক মিশন তাদের সহায়তা দেবে, তারা ভেবেছিলো শুধু তাদের দুজনকেই বুঝি নিজেদের বলভরসাকে সম্বল ক’রে দু-হাজার মাইল পথ ছুটে বেড়াতে হবে আফ্রিকায়। গত কয়েক বছর ধ’রে সকলের অগোচরে ভূগোল নিয়ে পড়াশুনো করেছে জেন বিশেষত যে-সব দেশের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে, সে-সব দেশের ভৌগোলিক জ্ঞান অতিসযত্নে আহরণ করেছে সে। আর তাইতেই সে জেনেছে তাকে যদি সশস্ত্র হ’য়ে অভিযান চালাতে হয়, কয়েকশো স্বেচ্ছাসেবীকে যদি নিতে হয় সঙ্গে, তবে তাদের সবাইকে হাতিয়ার জোগাতে, খাওয়াতে পরাতে, মাইনে দিতে বিস্তর খরচ প’ড়ে যাবে। তাছাড়া অত সশস্ত্র লোক নিয়ে যদি তাকে যেতে হয়, তবে বেশির ভাগ গ্রামগঞ্জই তার সদুদ্দেশ্য নিয়ে মাথা ঘামাবে না—আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়, এই মত অনুযায়ী তাদের ওপর এসে চড়াও হবে। তাহ’লে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে গেলে তাকে সারাপথ লড়াই ক’রে-ক’রেই এগুতে হবে—আর তাতে কোনো ফায়দা হবে ব’লেও মনে হয় না। সেইজন্যেই জেন ঠিক করেছিলো, সে শান্তিপূর্ণভাবেই যাবে—প্রকাশ্যে কোনো অস্ত্রশস্ত্রের আস্ফালন করবে না, সঙ্গে নেবে কিছু বিশ্বাসী অনুগত অনুচর-আর যুদ্ধ-টুদ্ধের হ্যাঙামায় না-গিয়ে বিভিন্ন গ্রামের মোড়ল বা গ্রামপ্রধানের জন্যে ছোটোখাটো উপঢৌকন নিয়েই যাবে।

শুষ্ক তপ্ত দিনগুলোর জন্যে চাই হালকা সুতির পোশাক, শুধু বর্ষার জন্যে সঙ্গে রাখতে হবে পশমের তৈরি জামাকাপড়, আর বেশি মোট সঙ্গে না-নিয়ে হালকা কতগুলো বাক্সপ্যাটরাই নিতে হবে সঙ্গে—যতটুকু না-হ’লেই নয়, তার বেশি একটা-কিছুও না। কেননা এছাড়া তো গ্রামপ্রধানদের জন্যে উপঢৌকনও নিতে হবে সঙ্গে—প্রায় একটা আস্ত হাটবাজার। নিজেদের জন্যে আরো চাই ছোটোখাটো একটা ওষুধের দোকান, অস্ত্রশস্ত্র, দুরবিন, কাঁটাকম্পাস, ছাউনি ফেলার তাঁবু খাটাবার সরঞ্জাম, অভিধান, অন্য-কতগুলো ভূগোল ও রাজনীতির বই, সর্বাধুনিক সব মানচিত্র, রান্নার বাসনকোশন, প্রসাধনসামগ্রী, চা, রসদপত্তর, অর্থাৎ দীর্ঘদিন আফ্রিকার বনে-জঙ্গলে কাটাতে গেলে যা-যা চাই, সব–অবান্তর ফালতু জিনিশ একটাও না। তাছাড়া গেলো দস্তায় তৈরি ঝকঝকে একটা তোরঙ্গ তাতে আছে ছিপ আর বঁড়শি—টোনসুতো, অন্তত আধডজন বর্শেলের যাতে মাছ ধরতে গিয়ে কোনো বিড়ম্বনাই না-হয়, তার ব্যবস্থা। এটাই অজেনরের একান্ত সাধের মাল।

মাসি-বোনপো—নাকি মামা-ভাগ্নে-তারপর যাবে লিভারপুল, সেখান থেকে আফ্রিকার উপকূলে যাবার জাহাজে চাপবে। প্রথমে যাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ গামবিয়ায়, আর সেন্ট লুইসে নামবার আগে তারা জানতেই পারেনি যে বারজাক মিশনও ঠিক ও-পথ দিয়েই আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাবে। শুনেই অবশ্য তারা ঠিক করেছিলো সাঁৎ-বেরার দেশের লোকের সহযাত্রী হওয়া বোধহয় ভালো হবে তাদের পক্ষে।

সেপ্টেম্বরের শেষদিকেই তারা সব মালপত্তর পাঠিয়ে দিয়েছিলো লিভারপুলে, আর দোসরা অক্টোবর শেষবার সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছিলো গ্লেনর কালে, কেননা লর্ড রেজন তো আর তাঁর একাচোরা খোপটা ছেড়ে একপাও নড়বে না। নিজের কাঁধে যে গুরুদায়িত্ব নিজেই চাপিয়ে দিয়েছেন জেন ব্লেজন, সেটার মাহাত্ম্য যা-ই হোক না কেন, এই-শেষবার একসঙ্গে সবাই মিলে খেতে ব’সে তার মনে হয়েছে, যে-বিপদের মধ্যে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তাতে হয়তো আর-কোনোদিনই সে এই বিশাল কালটিকে চোখেই দেখতে পাবে না। কিংবা যখন সে ফিরে আসবে, তখন হয়তো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবার জন্যে তার ভগ্নদেহ নিরাশমন বাবা আর বেঁচেই থাকবেন না। অথচ সে-যে এই দুর্জয় অভিযানে বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছে, ঝাঁপ খেতে চাচ্ছে অজ্ঞাত সব বিপদের মাঝখানে, সে-তো তার এই বাবার জন্যেই—যাতে তাঁর বিমর্ষ চিত্তে একটু শান্তিসন্তোষ এনে দিতে পারে সে, যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে ব্লেজন বংশের সুনাম, যাতে এই কলঙ্কচিহ্ন সে মুছে দিতে পারে চিরকালের জন্যে।

যাত্রার সময় যেন ঘনিয়ে এলো, জেন তার বাবাকে বিদায় জানাতে গেলো, সঙ্গে নিয়ে গেলো অজেনরকে। তিনি সেই একই ভঙ্গিতে ব’সে ছিলেন বড়ো জানলাটার সামনে, উদাসভাবে তাকিয়েছিলেন কোন দূরে, দিগন্তের দিকে। যেন কারু জন্যে অধীর হ’য়ে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি, ঠায় ব’সে, চুপচাপ। কার জন্যে? সে কি জর্জ, তার ছেলে, বংশের কুলাঙ্গার, দেশদ্রোহী? তাকেই কি খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর চোখ, অনিমেষ?

মেয়ের গলা শুনে একটু ফিরিয়েছেন তিনি তাঁর ঘাড়, আর তাঁর ম্রিয়মাণ চোখ-দুটো হঠাৎ আলো হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু সামান্য-একটা ঝিলিক সে, আর-কিছু নয়, তারপরেই আধোনিমীলিত হয়েছে তাঁর নয়ন, তাঁর মুখে আবার ফিরে এসেছে সেই একই নির্বিকার উদাসভাব।

চোখের জল সামলাবার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রে জেন রুদ্ধস্বরে বলেছে, ‘বাবা, তবে আসি?’

লর্ড গ্লেনর মুখে কোনো সাড়া দেননি। তাঁর মস্ত আরামকেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছোটোমেয়ের হাত চেপে ধরেছেন শুধু, তারপরেই একবার তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন, আলতো ক’রে চুমু খেয়েছেন মেয়ের কপালে

কান্নায় ফেটে পড়বার শঙ্কায় জেন তাঁর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত ক’রে ছুটে, সজল চোখে, বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। বৃদ্ধ তখন চেপে ধরেছেন তাঁর নাতির হাত, আবেগের বশে সেটা ঝাঁকিয়েছেন শুধু, আর হাত তুলে নীরবে ইশারা ক’রে দেখিয়েছেন দরজাটা, যেটা দিয়ে এইমাত্র ছুটে বেরিয়ে গেছে জেন। আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন,’ তাঁকে আশ্বাস দিয়েছে অজেনর। তারপর লর্ড গ্লেনর আবার ফিরে গিয়েছেন জানলায়, তাঁর আরামকেদারায়, আবার তাঁর চোখ দূরে কাকে যেন খুঁজে ফিরেছে। সাঁৎ-বেরা নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

কালের অঙ্গনে একটা কোচগাড়ি অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্যে-দু-মাইল দূরে উটোক্সেটার স্টেশনে তাদের পৌঁছে দেবে সে।

‘এবার তাহ’লে অজানার উজানে?’ তারা যে গ্লেনর কাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে সেটাই বোধহয় খেয়াল করেনি অজেনর, সে তখনও মাতামহের সাক্ষাৎকারের দৃশ্যে খানিকটা মোহ্যমান।

জেন শুধু নীরবে তার কাঁধদুটো ঝাঁকিয়েছে।

কিন্তু তারা পাঁচশো গজও বোধহয় যায়নি! অজেনর আর্তনাদ ক’রে উঠেছে : ‘আমার ছিপ! আমার বঁড়শি!’ তার গলা কান্নায় ভেঙেই গিয়েছে যেন।

সেই অতিবিখ্যাত ছিপগুলোর জন্যে তারপর আবার তাদের ফিরে আসতে হয়েছে কালে, অজেনরের সুবিদিত ভুলোমনই তার জন্যে দায়ী, ছিপগুলো খুঁজে বার করতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে পনেরো মিনিটেরও বেশি। তারপর যখন তারা স্টেশনে এসে পৌঁছেছে, এক্সপ্রেস ট্রেনটা তখন ছাড়ো-ছাড়ো, চোঙ দিয়ে ভলকে- ভলকে ধোঁয়া উঠছে, তীব্র-সুরে বাঁশি বেজেছে একবার, আর পড়িমরি ক’রে তারা কোনোমতে উঠে পড়তে পেরেছে ট্রেনে, আর অজেনর জাঁক দেখিয়ে বেশ গর্বের সুরেই বলেছে : ‘জীবনে এই দ্বিতীয়বার আমাকে কোনো ট্রেন মিস করতে হ’লো না।’

দরদর-ক’রে-ঝ’রে-পড়া চোখের জলের মাঝখানেও হেসে ফেলেছে জেন। আর এইভাবেই শুরু হয়েছে অজ্ঞাতের উদ্দেশে অভিযান। সে যখন থাকবে না, তখন যে কী হবে, তা যদি জেন আগেভাগেই জানতো, তবে কি জেন এ- রকম ভাবে অনিশ্চিতের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়তো? সে কি জানতো, আবার কোন প্রচণ্ড আঘাত অপেক্ষা ক’রে আছে তার বাবার জন্যে, যাঁর মুখে একটু হাসি ফোটাতে সে এমন ক’রে বেরিয়ে পড়েছে?

না, তার পক্ষে সেই শোচনীয় দুর্ঘটনার কথা স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব ছিলো না। সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ঐ দুর্ধর্ষ ডাকাতির কথা আগে থেকে সে জানবে কী ক’রে? সে তো আর ত্রিকালজ্ঞ-কেউ নয়। সে বরং ভেবেছে তার অবর্তমানে লুইসই বাবার দেখাশুনো করবে।

অত্যুৎসাহী এক ভৃত্য ওল্ড ব্রড স্ট্রিটের সেই দুর্ধর্ষ ডাকাতির পরদিনই লুইসের নিরুদ্দেশ হবার খবর শুনিয়েছে লর্ড রেজনকে, আর এই ধাক্কাটা তাঁকে একেবারে ধূলিসাৎ ক’রে দিয়েছে। বীরের বংশে এ-সব কোন কুলাঙ্গার জন্মেছে পর-পর? একজন দেশদ্রোহী, অন্যজন দস্যু! হতভাগ্য বৃদ্ধ বুকচাপা একটা আর্তনাদ ক’রে লুটিয়ে পড়েছেন মেঝেয়। ভৃত্যেরা ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাঁকে। তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়েছে বিছানায়। তাদের অবিরাম সেবা-যত্নে একসময় বৃদ্ধের মুদিত চোখের পাতা খুলেছে। আর ঐ ফ্যালফেলে হতাশদৃষ্টিই বুঝিয়েছে এখনও তাঁর দেহে প্রাণের একটু সাড়া আছে। পক্ষাঘাতে অসাড় শরীরে তিনি যদি বেঁচেও থাকেন, চিরকাল তাঁকে কাটাতে হবে নিশ্চল, নির্বাক। নিয়তির নির্মম পরিহাসের শেষ কিন্তু তখনও আসেনি। হতচৈতন্য, মৌনবাহ; অসাড়দেহ, লর্ড রেজন তখনও চিন্তা করবার ক্ষমতা হারাননি!

আর, দ্রাঘিমার ব্যবধান সত্ত্বেও, ঠিক যখন লর্ড ব্লেজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন, ঠিক তখন, সেই মুহূর্তেই কাপ্তেন মার্সেনের হাত ধ’রে জেন রেজন উঠেছে ঘোড়ার ওপর, তারপর লাগাম টেনে ঘোড়া ছুটিয়েছে সেতুটার ওপর দিয়ে, যে-সেতুটা কোনোক্রিকে জুড়ে রেখেছে গোটা ছায়াচ্ছন্ন মহাদেশটার সঙ্গে, আর এতদিনে সত্যি-সত্যি রৌদ্রতপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের তলায় অন্ধকার (!) মহাদেশে শুরু – হয়েছে তার অভিযান!