১.০১ নাইজার নদীর বাঁকে

প্ৰথম খণ্ড – নাইজার নদীর বাঁকে

১. সেনট্রাল ব্যাঙ্কে ডাকাতি

খবরকাগজে যাকে বলেছিলো সেনট্রাল ব্যাঙ্কে ডাকাতি সেই দুঃসাহসী কাণ্ডটা পনেরো দিন ধ’রে সমস্ত খবরকাগজেরই প্রথম পাতা জুড়ে বসেছিলো—এখনও নিশ্চয়ই কেউ তার কথা ভুলে যায়নি। বেপরোয়া অপকীর্তি অনেক ঘটে, কিন্তু এই ডাকাতি যতটা হুলুস্থুল তুলেছিলো, স্মরণকালের মধ্যে এমন-কোনো ঘটনা আর ঘটেনি : স্পর্ধার সঙ্গে জড়ানো ছিলো রহস্য-এই-তো গেলো এক, কিন্তু এত টাকাও এর আগে কেউ লুঠ করেনি, আর সমস্তটাই ঘটেছিলো যেন ভয়ংকর- দক্ষতার সঙ্গে—এমন অনায়াসদক্ষতায় যে এর পেছনে যার বা যাদের মাথাটা কাজ করেছে তাদের সাধারণ-কোনো ডাকাতের সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর সূচনাতেই ঘটেছিলো ডাকাতিটা—কিন্তু কী ঘটেছিলো, কেমনভাবে ঘটেছিলো, তার সংক্ষিপ্তসারটা-শুদ্ধু আজও আমাদের কৌতূহলকে দারুণ উসকে দিতে পারে।

ডাকাতিটা ঘটেছিলো সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ডি কে শাখায়, স্টক এক্সচেঞ্জ বা দালাল স্ট্রিটের কাছে, থ্রেডনীডল স্ট্রিটের মোড়ে; তার ম্যানেজার ছিলো লুইস রবার্ট ব্লেজন, লর্ড রেজনর ছেলে।

একটা মস্ত ঘরের মাঝে লম্বা-একটা ওককাঠের কাউন্টার গেছে—তার ওপাশে বসে ব্যাঙ্কের কেরানিরা, এপাশে দাঁড়ায় মক্কেলরা। ফুটপাথ থেকে ঢুকেই একটা ভেস্টিবিউল, রাস্তার ঠিক মোড়েই; সেখান থেকে কাচের পাল্লাবসানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতরে বামদিকে আছে কঠিন লোহার শিক দিয়ে ঘেরা স্ট্রংরুম, সেখান থেকে মূল আপিশটায় ঢোকবার জন্যে একটা দরজা আছে বটে তবে সেটাতেও অমনি লোহার শিক বসানো প্রায় একটা দুর্ভেদ্য খাঁচারই মতো। ডানদিকের ওকের কাউন্টারটা ওপর-ঢাকনা তুলে ভেতরে আসা যায়, যদি কোনো মক্কেলের কখনও কোনো কাজে ভেতরে এসে কোনো কেরানির সঙ্গে আলাপ করার দরকার হয়। তারই পেছনে ম্যানেজারের ঘরে যাবার দরজা, সেখান থেকে যাওয়া-আসার আর-কোনো দরজাই নেই; তারপরেই গেছে একটা করিডর, একেবারে থ্রেডনীডল স্ট্রিট অব্দি; এই মস্ত বাড়িটার সবাই এই করিডর আর তার সঙ্গে লাগোয়া হলঘরটা ব্যবহার করে। এই হলওয়ে একদিকে গেছে আর্দালিদের বাক্সটা ছাড়িয়ে, সোজা থ্রেডনীডল স্ট্রিটের রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, প্রধান সিঁড়ির পইঠা পেরিয়ে গেলে, কাচের দুনো-পাল্লাবসানো দরজা, যেটা আসলে আড়ালই ক’রে রেখেছে মাটির নিচের ঘরে যাবার দরজা, আর তারই মুখোমুখি বসানো ঝাড়ুদারদের আসা-যাওয়ার দরজা।

ঘটনাটা যখন শুরু হল, পাঁচটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি তখন, কাঁটায়- কাঁটায়; ব্যাঙ্কের পাঁচজন কর্মচারী তখন যে-যার কাজে ব্যস্ত; দুজনে মন দিয়ে খাতা লিখছে, অন্য তিনজনে কাউন্টারে ঝুঁকেদাঁড়ানো মক্কেলদের কাজ দেখছে; খাজাঞ্চি সব রশিদপত্তর মিলিয়ে টাকার হিশেব করছে : দিনটা যেহেতু মাইনের দিন তাই সবমিলিয়ে যোগফল দাঁড়িয়েছে একুনে ৭২, ০৭৯ পাউণ্ড ২ শিলিং ৪ পেন্স।

কুড়ি মিনিট বাদে বন্ধ হ’য়ে যাবে ব্যাঙ্ক, ঝমঝম ক’রে টেনে নামানো হবে তার ইস্পাতের দরজা; তার একটু বাদেই কর্মচারীরা দিনের কাজ সেরে নিয়ে বিদায় নেবে। বাইরে থেকে গাড়িঘোড়া চলার ভারি গুমগুমে আওয়াজ আর রাস্তার লোকজনের কোলাহল ক্ষীণভাবে কানে আসছে ভেতরে, আর আসন্ন নভেম্বর- সন্ধের আবছায়ায় দরজার কাচের পাল্লাগুলো ঝাপসা হ’য়ে আসছে।

ঠিক তখনই দরজাটা খুলে গিয়েছে, আর ভেতরে এসে ঢুকেছে একটা লোক। দ্রুত চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে ফিরে দাঁড়িয়ে তার ডানহাত তুলে কী-একটা ইশারা করলে, বুড়ো আঙুল সমেত আরো দুটো আঙুল তুলে দেখালে সে, অর্থাৎ বোঝালে—তিন। কেরানিদের দৃষ্টি যদি তার ওপর পড়তোও তবু তারা এই ইশারাটা দেখতে পেতো না, যেহেতু লোকটা তখনও আধখোলা দরজার আড়ালে ঢাকা ছিলো। আর যদি-বা দেখতেও পেতো, স্বপ্নেও তারা ভাবতে পারতো না যে ঐ তিন আঙুলের অর্থ হচ্ছে কাউন্টারে আছে মাত্র তিনজন লোক।

এই সংকেত-যদি তা সংকেতই হ’য়ে থাকে—দেবার পর, লোকটা দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো, দোলদরজার পাল্লার দুলুনি থামবার আগেই সে গিয়ে একজন মক্কেলের পেছনে দাঁড়ালে, হাতের কাজ শেষ করে আগের মক্কেলকে বিদায় দিয়ে কেরানিটি যাতে তার কাজে হাত দেয়।

কেরানিদের একজন উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে এসে জিগেস করলে : ‘আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি কি, সার? ‘

‘ধন্যবাদ, আমি বরং লাইনেই দাঁড়াই,’ আগন্তুক হাত নেড়ে এমনভাবে বললে যাতে মনে হ’লো সামনে যে-কেরানিটি কাজ করছে তার সঙ্গেই সে কথা বলবে। নিজের বিবেকের তাড়নাকে সামলে নিয়ে অন্য কেরানিটি নিজে যে-কাজ করছিলো তাতেই ফিরে গেলো, লোকটাও তেমনি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো, কেউই আর তার দিকে অহেতুক কোনো মনোযোগ দিলে না।

অথচ তার অদ্ভুত বেশভূষা হয়তো বিশেষভাবে তাকিয়ে দেখার মতোই ছিলো। ঢ্যাঙা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ সে, শরীরের কাঠামো দেখে বোঝা যায় সে অসাধারণ শক্তির অধিকারী। তার রোদে পোড়া মুখটাকে অনেকটাই ঢেকে রেখেছে চমৎকার হালকা সোনালি দাড়ি। তার বেশভূষা দেখে তার সামাজিক শ্রেণী বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিলো, কারণ লম্বা-একটা রেশমি ওভারকোট তার পরনে, সেটা একেবারে পা পর্যন্ত নেমে এসেছে।

কেরানি আগের মক্কেলটির কাজ শেষ ক’রে দেবার পর, ওভারকোট-পরা লোকটা তার জায়গায় এসে দাঁড়ালে, আর খুলে বললে সে কী চায়।

আগের মক্কেলটি সবে ঘর ছেড়ে চ’লে গিয়েছে এমন সময় দরজা খুলে গেলো, ভেতরে এসে ঢুকলো দ্বিতীয়-একজন লোক, ওভারকোট-পরা লোকটার মতোই দেখতে –অদ্ভুত সাদৃশ্য দুজনের, যেন একজন আরেকজনের অবিকল-নকল; লম্বায় চওড়ায় আগের জনের মতোই দেখতে, গড়নটা হুবহু এক, তেমনি হালকা- সোনালি দাড়ি ঘিরে আছে তার ব্রজ মুখ, তারও পরনে লম্বা ওভারকোট, ভেতরে কী প’রে আছে বোঝবার জো নেই।

নবাগত লোকটিও তার পূর্ববর্তী আগুন্তুকের মতোই দুজন মক্কেলের একজনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালে, কাউন্টারের সামনে, অন্য-একজন কেরানির জন্যে; তারপর তার সামনে দাঁড়ানো মক্কেল চ’লে যেতেই সে গিয়ে কেরানিকে খুলে বললে তার চাহিদা কী

অমনি, আগের মতোই, দরজা আবার খুলে গেলো। তৃতীয়-একজন লোক এসে ভেতরে ঢুকলো, গিয়ে দাঁড়ালো তিনজন মক্কেলের শেষজনের পেছনে। তার গড়নটা মাঝারি, মাথায় একটু খাটো কিন্তু আরো-চওড়া, তার কালো মুখখানা কুচকুচে কালো দাড়িতে ঢাকা, আর তার পরনের পোশাকও ধূসর-একটা লম্বা ওভারকোটে ঢাকা—একই সঙ্গে আগের দুজনের সঙ্গে তার কোনো-কোনো ব্যাপারে মিলও ছিলো, আবার তফাৎ-ও ছিলো।

শেষকালে, তিনজন মক্কেলের শেষজন তার কাজ সেরে কাউন্টার ছেড়ে দিতেই এবার দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢুকলো দুজন লোক। ওদের একজনের গায়ে যেন হারকিউলিসের শক্তি, তাদের গায়ে অলেস্টার-অর্থাৎ লম্বা পশমি ওভারকোট, এখনও এমন ঠাণ্ডা পড়েনি যে লোকে অলেস্টার গায়ে ঘুরে বেড়াবে। অন্য তিনজনের মতো তাদের মুখও রোদে-পোড়া, ব্রনজ, তার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ।

যেভাবে পর-পর তারা ঢুকেছে, সেটা একটু অদ্ভুতই : প্রথমে এসেছে দুজনের মধ্যে যে লম্বা, আর ভেতরে ঢোকবামাত্র এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন দ্বিতীয়জনকে আড়াল ক’রে দাঁড়াতে চাচ্ছে-আর দ্বিতীয়জন এমন ভঙ্গি করছে যেন দরজার হাতলে তার অলেস্টার আটকে গেছে, আসলে কী-একটা রহস্যময় ব্যস্ততা দরজায়, এই থমকে-থাকাটা শুধু মুহূর্তের জন্যেই, তারপরেই পাল্লা দোল খেয়ে এসে পড়েছে সশব্দে, বন্ধ হ’য়ে গেছে। ততক্ষণে অবশ্য, যদিও তার ভেতরের হাতলটা দরজার পাল্লায় লাগানোই ছিলো, যাতে ভেতর থেকে লোক বাইরে যেতে পারে, কিন্তু বাইরের হাতলটা অদৃশ্য হ’য়ে গেছে – যাতে বাইরে থেকে আর-কোনো লোক ভেতরে আসতে না-পারে। আর, কেউ-যে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বা কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকবে তারও সম্ভাবনা ছিলো না, কারণ ততক্ষণে বাইরে এই নোটিসটা ঝোলানো হ’য়ে গেছে যে এই শাখার কাজ আজকের মতো শেষ হ’য়ে গেছে।

কেরানিরা কখনও এই সন্দেহ করেনি যে তারা এখন বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হ’য়ে গেছে। আর তা যদি তারা জানতোও, সে শুধু তাদের মুখে মৃদুহাসির একটা রেখাই ফুটিয়ে তুলতো। অস্বস্তি হবে কেন তাদের খামকা, শহরের একেবারে বুকের ওপর এই শাখা, এখন হচ্ছে দিনের ব্যস্ততম সময়, বাইরের কোলাহাল একটু-একটু তো কানেই আসছে তাদের-মাত্র-তো কাচের একটা পাল্লা তাদের রাস্তা থেকে আলাদা ক’রে রেখেছে!

অন্য দুজন কেরানি বিনীত ভঙ্গিতে এই নবাগতদের কাছে এগিয়ে এলো, কারণ তারা জানতো যে ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে চলেছে, ক-মিনিটের মধ্যেই এই বিরক্তিকর লেটলতিফদের কাজ শেষ ক’রে ফেললেই আজকের মতো ছুটি তাদের। লেটলতিফদের একজন তার কাজ খুলে বললে একজন কেরানিকে, অন্যজন কিন্তু সরাসরি প্রস্তাবটা উপেক্ষা ক’রে বললে সে একটা বিশেষ কাজে এক্ষুনি খোদ ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

‘দেখি, উনি ওঁর ঘরে আছেন কি না।’

কেরানিটি ভেতরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই, প্রায়-পরক্ষণেই, বেরিয়ে এলো।

কাউন্টারের ঢাকনা খুলে দিয়ে সে বললে, ‘আপনি যদি অনুগ্রহ ক’রে এদিক দিয়ে আসেন—’

অলেস্টার-পরা ঐ দীর্ঘাকৃতি লোকটা আপিশের ভেতরে গিয়ে ঢুকলো, আর কেরানিটি চ’লে গেলো তার নিজের হাতের কাজ সারতে।

ব্রাঞ্চম্যানেজার আর এই আগন্তুকের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিলো?

দফতরের অন্যান্য কর্মচারীরা পরে বলেছিলো তারা এ-সম্বন্ধে কিছুই জানতো না। যে-তদন্ত হয়েছিলো পরে, তাতে শুধু কতগুলো অনুমানই করা গিয়েছিলো— কেননা আজও কেউ জানে না সেদিন ম্যানেজারের ঘরে বন্ধ দরজার আড়ালে সত্যি-সত্যি কী হয়েছিলো।

তবে একটা বিষয় অন্তত নিশ্চিত জানা গিয়েছিলো : দু-মিনিটও কাটেনি, দরজা আবার খুলে গিয়েছে আর অলেস্টার-পরা লোকটা আবার এসে দেখা দিয়েছে ঘরের চৌকাঠে।

খুবই নৈর্ব্যক্তিক নির্বিকার ভঙ্গিতে, ঠিক কাউকেই উদ্দেশ না-করে, সে শান্ত গলায় বলেছে : ‘ম্যানেজার খাজাঞ্চির সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।’

‘নিশ্চয়ই, সার,’ কেরানিটি ঘুরে তারপর ডাক দিয়েছে : ‘স্টোর! ‘বলুন, মিস্টার বার্কলে?’

‘কত্তা আপনাকে একটু ডাকছেন।

‘যাচ্ছি,’ বলেছে খাজাঞ্চি।

নগদ টাকা নিয়ে যারা কাজকারবার করে, চিরকালই তারা খুব-হুঁশিয়ার হয়- যেন রক্তে দানা বেঁধে যায় সতর্কতা। কিছু না-ভেবেই সে খোলা স্ট্রংরুমটার সিন্দুকে ছুঁড়ে দিয়েছে একটা পেটফোলা ব্রীফকেস, আর তিনটে প্যাকেট, সবগুলোর গায়েই লেবেল সাঁটা, লেখা আছে আজ কত টাকা জমা পড়েছে। ভারি দরজাটা ভোঁতা ভারি-একটা আওয়াজ ক’রে আটকে গিয়েছে; তারপর, তার জানলাটা বন্ধ ক’রে সে তার গারদ আটকানো ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর অভ্যস্ত হুঁশিয়ার-হাতে সেটা বন্ধ করতেও ভোলেনি, তারপর সোজা এগিয়ে গেছে ম্যানেজারের ঘরের দিকে। আগন্তুক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো, সে একপাশে স’রে দাঁড়িয়েছে, তারপর তার পেছন-পেছন ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে।

ভেতরে ঢুকেই স্টোর তাজ্জব হ’য়ে দ্যাখে যে-ম্যানেজার নাকি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, সে ভেতরে কোত্থাও নেই, ঘরটা ফাঁকা প’ড়ে আছে। কিন্তু রহস্যটার মীমাংসা করবার কোনো সুযোগই পায়নি বেচারা। পেছন থেকে আক্রান্ত, তার টুটিটা যেন লোহার সাঁড়াশির মতো শক্ত কার হাতের বাঁধনে আটকা প’ড়ে গেছে; সে যোঝবার চেষ্টা করেছিলো, ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ব’লে চ্যাঁচাবারও চেষ্টা করেছিলো… কিন্তু আততায়ীর হাতদুটো আরো আঁটো ব’সে গেছে তার টুটিতে, তারপর দম আটকে—সংজ্ঞাহীন-সে লুটিয়ে পড়েছে মেঝেয়।

এই হিংস্র হামলাটা পুরোটাই ঘটেছে নিঃশব্দে। বাইরের আপিশঘরে কেরানিরা যে-যার কাজ ক’রে চলেছে, তাদের চারজন সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরদের সামলাচ্ছে, ‘অন্যজন ঘাড় গুঁজে তার হিশেব নিয়েই ব্যস্ত।

অলেস্টার পরা লোকটা তার কপাল থেকে ঘাম মুছবার জন্যে থামলো একটু, তারপর তার শিকারের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালো। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখে কাপড় গুঁজে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে বেঁধে ফেলা হলো।

বাঁধাছাঁদা শেষ ক’রে সে টেনে দরজাটা খুলে মূল আপিশটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। যা দেখতে পেলে তাতে সন্তুষ্ট হ’য়ে খুক ক’রে অস্ফুট কাশলো একটু, যেন চারজন খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে সে, তারপর দরজাটা পুরোপুরি খুলে ফেলে চৌকাঠে এসে দাঁড়ালে।

এটাই বোধহয় ছিলো সংকেত, সন্দেহ নেই আগে থেকেই শলাপরামর্শ ক’রে ঠিক করা, কারণ তারপরেই দেখা গেলো আশ্চর্য-একটা দৃশ্য। অলেস্টার-পরা লোকটা যখন একলাফেই পেরিয়ে গিয়ে ঘাড়-গোঁজা হিশেবনবীশের ঘাড়ের ওপর পড়লো, এবং নির্দয়ভাবে গলা টিপে ধরলো তার, তার পাঁচজন সঙ্গীর দশাও তখন তেমনি-অসহায়। কাউন্টারের শেষদিককার মক্কেলটি কাউন্টারের ওপর ঢাকনা তুলে ততক্ষণে লাফিয়ে পড়েছে ভেতরে; যে-কেরানিটি তার তদারক করছিলো তার ঘাড়টা পেঁচিয়ে ধ’রে তাকে সে মেঝেয় আছড়ে ফেলেছে। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন ঝুঁকে প’ড়ে ফাঁসের মতো ক’রে ততক্ষণে পেঁচিয়ে ধরেছে তাদের সামনেকার কেরানিদের গলা, আর সজোরে ওকের কাউন্টারে ঠুকে দিয়েছে তাদের মাথা। চতুর্থজন, সে-ই সবচেয়ে বেঁটেখাটো, কাউন্টারের ওপর থেকে তার সামনের কোরানিটির গলা নাগালে পাবে না ব’লে সটান লাফিয়ে টপকেছে কাউন্টারটা, ডিঙিয়ে গিয়েই চেপে ধরেছে তার গলা, এমন ঝড়ের মতো লাফিয়ে গিয়ে কাজটা করেছে ব’লেই হয়তো চাপটা বোধহয় দশগুণ বেশি হ’য়ে গিয়েছিলো। কেউই একটা চিৎকার অব্দি করতে পারেনি, পুরো অতিনাটকটা ঘটতে সময় লেগেছে মাত্রই তিরিশ সেকেণ্ড।

শিকারের সবাই যখন চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে, দস্যুরা প্রথমেই তাদের নিষ্ক্রিয় করার কাজে লেগে গেলো। পরিকল্পনাটা সব খুঁটিনাটি সমেতই ভেবে ঠিক করা হয়েছিলো, সামান্যতম খিঁচ ছিলো না কোথাও। তারা কেউ দোনোমনা করেনি কোনো সময়। শিকারদের মুখে তারা তারপর কাপড় গুঁজে দিয়ে মুখ বেঁধে দিয়েছে, যাতে কেউ টু-শব্দটি করতে না-পারে, তারপর পিছমোড়া ক’রে বেঁধেছে তাদের হাত, পাগুলোও শক্ত ক’রে বেঁধেছে, তারপর মিহি একটা তারের জাল, দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছে তাদের শরীর। সকলেরই কাজ শেষ হয়েছে যেন কাঁটায়-কাঁটায়, ঘড়ি ধ’রে, কারণ এদের নিষ্ক্রিয় ক’রে ফেলে সবাই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে একেবারে-একসঙ্গেই।

যে-লোকটা ম্যানেজারের খোঁজ করেছিলো, সে বললে, ‘লোহার দরজাটা’– তার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিলো সে-ই বুঝি পালের গোদা

দস্যুদের তিনজন তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়েছে লোহার দরজাটার কাছে—আর টেনে নামিয়েছে সেটা, আর আস্তে-আস্তে বাইরের সব আওয়াজও মিইয়ে যেতে-যেতে মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দরজা তখনও পুরো নামেনি, এমন সময় আচমকা ঝনঝন ক’রে বেজে উঠেছে টেলিফোন।

দস্যুদের সর্দার চাপা গলায় ব’লে উঠেছে, ‘থামো!’

দরজাটা তখনও পুরো নেমে আসেনি, সে গিয়ে তুলে ধরেছে রীসিভারটা। তারপর শুরু হ’লো নিচের কথাবার্তা, অনড় দাঁড়িয়ে বাকি-চারজন দস্যু শুধু তার একতরফের কথাই শুনতে পাচ্ছিলো।

‘হ্যালো!’

‘হ্যাঁ, শুনছি।’

‘তুমি নাকি, ব্লেজন?’

‘হ্যাঁ।’

‘ভারি আশ্চর্য তো! আমি তোমার গলাটাই চিনতে পারিনি।

‘লাইনটা বোধহয় ঠিক নেই।’

‘আমাদের এদিকটায় তো ঠিকই আছে।’

‘তা হবে, তবে এদিকটায় কেমন যেন বিচ্ছিরি আওয়াজ করছে। আমিও তো

তোমার গলা চিনতেই পারছি না।’

‘আমি মিস্টার লেওনার্ড।’

ও-হ্যাঁ…হ্যাঁ, এবার চিনতে পারছি তোমার গলা।’

‘বলতে পারো, ব্লেজন, ভ্যানটা গিয়ে পৌঁছেছে কি না?’

‘এখনও তো আসেনি,’ মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করেছিলো দস্যুটি।

‘গিয়ে পৌঁছলেই সেটা এস্ ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিয়ো। ওরা এইমাত্তর ফোন করে জানিয়েছে তারা হিশেবটিশেব ক’রে নগদ টাকা সব পাঠিয়ে দেবার পর একগাদা টাকা নাকি জমা পড়েছে।’

‘বেশি টাকা-নাকি?’

‘তা, বেশ-মোটা অঙ্কই। প্রায় কুড়িহাজার পাউণ্ড।’

দস্যুটি বিস্ময়ে একটা অস্ফুট শব্দ ক’রে উঠলো।

‘তা, তুমি খবরটা দিয়ে দেবে তো? আমি তোমার ওপর ভরসা করতে পারবো নিশ্চয়ই?

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, তুমি আমার ওপর নির্ভর করতে পারো।’

‘আচ্ছা, শুভরাত্রি, ব্লেজন।’

‘শুভরাত্রি।’

দস্যুটি রীসিভারটা নামিয়ে রাখলে। একমুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবলে সে। তারপরেই মনস্থির ক’রে নিয়ে সে তার স্যাঙাৎদের তার কাছে ডাকলে, ‘আমাদের চটপট করতে হবে, বুঝলে?’ নিচুগলায় সে বললে তাদের, দ্রুতহারে সে তখন তার গায়ের পোশাক খুলে ফেলেছে। ‘শিগগির করো, কেউ-একজন আমায় ও-লোকটার পোশাক খুলে দাও তো।’ তখনও অজ্ঞান হ’য়ে প’ড়ে-থাকা স্টোরের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালে সে।

চক্ষের পলকে স্টোরের পোশাক গিয়ে আক্রমণকারীর গায়ে উঠলো – যদিও জামাগুলো তার গায়ে আঁটো আর খাটোই হচ্ছিলো। একটা পকেটে চাবির তাড়া খুঁজে পেয়ে সে প্রথমে খুললো খাজাঞ্চির আপিশ, তারপর স্ট্রংরুমের দরজা, তারপর সেখান থেকে নম্বর-আঁটা প্যাকেটগুলোই যে শুধু তুলে নিলে তা নয়, ব্রীফকেসটা এবং একগাদা বন্ধকি কাগজও তুলে নিতে ভুললো না।

সে তখনও শেষ করেনি, এমন সময় শব্দ ক’রে ফুটপাথের ধারে একটা গাড়ি এসে থামলো। প্রায়-তক্ষুনি একটা টোকা শোনা গেলো কাচের পাল্লাবসানো দরজায়, সেটা তখন ধাতুর পর্দা দিয়ে অদ্ধেক-ঢাকা।

‘হুঁশিয়ার!’ দস্যুসর্দার দ্রুতস্বরে বললে, কথাগুলো সে হাতের ভঙ্গি দিয়েও বোঝালে। ‘কোটগুলো সব খুলে ফ্যালো, ওরা এসে তোমাদের পোশাক দেখুক, যে-যার নিজের জায়গায় চ’লে যাও আর প্রস্তুত হ’য়ে থেকো! যে-ই আসুক না কেন, তোমরা যাতে সবাইকেই কবলে পাও, সেজন্যে তৈরি থেকো! আর মনে রেখো, কোনো আওয়াজ যেন না-হয়!…তারপর দরজাটা বন্ধ ক’রে দিয়ো, আর আমি ছাড়া অন্য-কারু জন্যেই যেন দরজা খুলো না, সাবধান!’

কথা বলতে-বলতে সে ব্রীফকেসটা আর কয়েক-বাণ্ডিল বন্ধকি কাগজ তুলে নিচ্ছিলো, এবার সে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে। ইশারা ক’রে তার তিন স্যাঙাৎকে বললে কেরানিদের জায়গায় চ’লে যেতে, আসল-কেরানিদের তারা কাউন্টারের তলায় জাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো; আর চতুর্থজন গিয়ে দাঁড়ালে দরজায়। হঠাৎ সে দুম ক’রে খুলে দিলে দরজার পাল্লা, আর অমনি ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো রাস্তার কোলাহল।

সত্যি-সত্যিই প্রবেশপথের সামনেটায় একটা ডেলিভারিভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে; অন্ধকারে তার আলোগুলো যেন ঝলসাচ্ছে। ড্রাইভার ব’সে আছে তার আসনে, আর ফুটপাতে-দাঁড়ানো কার সঙ্গে কথা বলছে! এই-ই হচ্ছে সেই লোক-সেনট্রাল ব্যাঙ্কের একজন খাজাঞ্চি–ক-মিনিট আগে এসে দরজায় টোকা দিয়েছিলো।

কোনোরকম তাড়া না-দেখিয়ে, রাস্তার জনস্রোতের পাশ কাটিয়ে, ফুটপাথ পেরিয়ে দুঃসাহসী দস্যুটি গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে।

‘গুডইভনিং,’ সে বললে।

‘ইভনিং,’ সঙ্গে-সঙ্গে দুজনে একসাথে সাড়া দিলে।

ড্রাইভার তারপর নবাগতের দিকে তাকিয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে, একটু অবাকভাবেই তাকিয়ে রইলো, ‘হ্যালো…আরে, এ-যে দেখছি অন্য-কেউ, স্টোর নয়!’

আজ ও ছুটি নিয়েছে, আমি ওর বদলি কাজ করছি।’ তারপর ফুটপাথে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘কী, একটু হাত লাগাবে নাকি?’

‘কীসে?’

‘একটা ব্যাগ নিয়ে। আজ বিস্তর নগদ টাকা এসেছে-ব্যাগটা ভারি।’

‘হ্যাঁ, তবে,’ একটু দোনোমনা ক’রে খাজাঞ্চি বললে, ‘আমার তো গাড়ি ছেড়ে একপাও যাবার কথা নয়।’

‘আরে ধূর! একমিনিটের তো মামলা! আর তাছাড়া, আমিই না-হয় তোমার বদলে এখানে দাঁড়াচ্ছি। কেরানিদের একজন তোমার সঙ্গে হাত লাগাবে-আমি বরং এইফাকে এই ব্রীফকেসটা আর বন্ধকি কাগজের বাণ্ডিলগুলো গাড়িতে তুলে দিই।’

আর-কোনো আপত্তি না-ক’রে খাজাঞ্চি গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকলো, আর অমনি তার পেছন-পেছন দরজাটা বন্ধ হ’য়ে গেলো।

‘এবার, দোস্ত,’ যে-লোকটা স্টোরের বদলি ব’লে দাবি করেছিলো, সে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘খোলো দরজাটা।’

‘ঠিক হ্যায়!’ ড্রাইভার সায় দিলে।

ভ্যানটার পেছনে, বা দুপাশে, কোনো দরজা নেই-শুধু কোচম্যানের বাক্সের পেছনে দু-পাল্লা ধাতুর পর্দা-দেয়া ভারি দরজা–ডাকাতির সম্ভাবনা যাতে একেবারেই না-থাকে। গাড়ির ভেতরে যেতে হ’লে, ড্রাইভারের আসনটা তুলে ধরতে হয়। তবে সে যেহেতু মাত্র-কটা বাণ্ডিলই রাখবে ঐ পায়রার খোপগুলোয়, ড্রাইভার তাই ভাবেনি এতটা ঝামেলা পাকাবার কোনো দরকার আছে। সে শুধু ঢাকনাগুলো তুলে দিলে খোপের। বললে, ‘দেখি ব্রীফকেসটা দেখি।’

ব্রীফকেসটা হাতে নিয়ে ড্রাইভার তার আসনের ওপাশে ঝুঁকে পড়লো, কোমর থেকে মাথা অবধি শরীরটা তার ঢাকা প’ড়ে গেছে গাড়ির ভেতর, শুধু ঠ্যাং- দুটো শূন্যে ল্যাগব্যাগ করছে তার রাখার চেষ্টায়। আর ওভাবে থাকার দরুনই তার পক্ষে আদপেই দেখা সম্ভব ছিলো না কখন সেই স্টোরের বদলি লোকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে আসনে ব’সে পড়েছে। ড্রাইভারের ওপর ঝুঁকে প’ড়ে জাল-খাজাঞ্চি—যেন ভ্যানের ভেতর কী আছে সেটা দেখবারই নিছক-একটা কৌতূহল জন্মেছে তার—তার শরীরের উর্ধ্বাঙ্গও ভেতরে ঢুকিয়ে দিলে, আর পরক্ষণেই আচমকা তার কনুই প্রচণ্ড-একটা ধাক্কা দিলে অন্ধকারে, আচমকা পথচলতি লোকজনের কেউ যদি সেইমুহূর্তে গাড়িটার দিকে তাকাতো তো দেখতে পেতো কোচোয়ানের পা-দুটো যেন আশ্চর্য আড় ধ’রে কাঠ-কাঠ হ’য়ে গেছে, তারপরেই তা অসাড় হ’য়ে প’ড়ে গেছে কোচবাক্সের মেঝেয়। দস্যু অমনি তার কোমরের বেলট ধ’রে তাকে যাবতীয় বাণ্ডিল আর ব্রীফকেসের মাঝখানে চালান ক’রে দিলে।

পর-পর ঘটনাগুলো এমন নিখুঁতভাবে আশ্চর্য দুঃসাহসের সঙ্গে সমাধা হ’লো যে তাতে সময় লাগলো মাত্র কয়েকটা মুহূর্তই। পথচলতি লোকেরা যে-যার নিজের ধান্ধায় পাশ দিয়ে গেছে, ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতেও পারেনি এমন-একটা বেপরোয়া কাজ এখানে, প্রায় প্রকাশ্য, ঘ’টে গেছে।

লোকটা আবার গাড়ির সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো, যাতে রাস্তার বাতির আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে না-যায়, তারপর গাড়ির ভেতরটা সে তাকিয়ে দেখলো খুঁটিয়ে। মেঝের মধ্যে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, মেঝেয় প’ড়ে আছে ড্রাইভার, অলক্ষে বিদ্যুৎবেগে তার ঘাড়ে সে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা ছুরি, বেচারা টু শব্দটিও করবার সুযোগ পায়নি। দেহটা আর ছটফটও করছে না এখন, প’ড়ে আছে অনড়, নিশ্চল; যেন আচমকা তার ঘাড়ে বাজ ফেটে পড়েছিলো।

রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় না প’ড়ে যায়! তারপর বেঞ্চিটা ডিঙিয়ে সোজা গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো; ড্রাইভারের গায়ের কোটটা খুলে সে ঐ মারাত্মক ক্ষতটা মুছে ঢেকে দিল। তারপর ঘাড় থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে সাবধানে সেটা আর নিজের রক্তরাঙা হাতটা মুছলো। যখন বুঝলো রক্ত মেঝেয় প’ড়ে কার্পেটের ওপর স্পঞ্জের গায়ে তরল জিনিশের মতো শুষে যাবে, তখন দরজাটা সে বন্ধ ক’রে দিলে।—সব সতর্কতা অবলম্বন ক’রে সে ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে ফুটপাথে, তারপর ফুটপাথ পেরিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কের দরজায় গিয়ে আগের ষড়মাফিক টোকা দিয়েছে। তক্ষুনি দরজাটা খুলে গেলো এবং সে ভেতরে ঢুকে পড়তেই আবার তা বন্ধ হ’য়ে গেলো।

‘ঐ-লোকটা?’ ঢুকতে ঢুকতেই সে জিগেস করলে।

কে-একজন কাউন্টারের দিকে আঙুল তুলে দেখালে। ‘অন্যদের মতো চিৎপাত প’ড়ে আছে।’

চমৎকার! এবার ওর পোশাকটা খুলে ফ্যালো। জলদি, চটপট! ‘

অন্যরা দ্রুতহাতে যেই কাজে লেগে গেছে, সে স্টোরের উর্দিটা খুলে এবার অন্য খাজাঞ্চির পোশাকটা প’রে নিলে। ‘তোমাদের মধ্যে দুজন এখানে থাকবে। বাকিরা আমার সঙ্গে চ’লে এসো, মালকড়ি হাতাতে।’

উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না-ক’রেই সে ফের দরজা খুলে তার দুই স্যাঙাৎকে নিয়ে চ’লে গেলো গাড়ির কাছে; সে গিয়ে উঠলো কোচবাক্সে, ড্রাইভারের আসনে, তারপর এক-এক ক’রে সে বাণ্ডিলগুলো নামিয়ে দিতে লাগলো তার সাগরেদদের। দরজা খোলা ব’লে একটু আলো এসে পড়েছে রাস্তায় ভ্যানটা থেকে, পথচারীরা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এই আলোর চৌহদ্দির মধ্যে দিয়ে চ’লে যাচ্ছে, কেউ একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না, কোন ভ্যান থেকে কে কী নামাচ্ছে তাতে তাদের কোনো কৌতূহল বা মাথাব্যথা নেই, অবশ্য সন্দেহ করার কথা ঘুণাক্ষরেও কারু মাথায় আসেনি।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভ্যানটা ফাঁকা হ’য়ে গেলো। দরজা বন্ধ ক’রে লুঠের মাল ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখা হ’লো। একদিকে গেলো দলিল-দস্তাবেজ, অন্যদিকে বাকি মাল। দলিলপত্তরগুলো তাদের চাই না, সেগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে রইলো মেঝেয়। ব্যাঙ্কনোটগুলো ভাগ করা হ’লো পাঁচ অংশে, একেকজনে একেকটা তাড়া তুলে নিলে।

আর এই ব্যাগগুলো?’ জিগেস করলে দস্যুদের একজন!

‘পকেটে ঢুকিয়ে নাও,’ সর্দার উত্তর দিলে, ‘ভ্যানের মধ্যে আর যা প’ড়ে আছে, আমিই সেগুলোর ব্যবস্থা করবো। হ্যাঁ, তবে আরেকটা কথা। প্রথমে সবকিছুর একটা ফয়সালা ক’রে নেয়া যাক। আমি চ’লে গেলে, তোমরা ফিরে এসে দরজার ঐ লোহার পর্দাটা ফেলে দিয়ো। তারপর করিডর দিয়ে যাবে সবাই। সবশেষে যে যাবে, সে যেন দরজায় ডবোল-তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবিগুলো নর্দমায় ফেলে দেয়। হলঘরটা বাড়িটার শেষপ্রান্তে-তোমরা তো বেরুবার রাস্তাটা জানোই।’ একটা আঙুল তুলে সে ম্যানেজারের আপিশটা দেখালে। ‘ও-লোকটার কথা ভুলো না কিন্তু। জানো নিশ্চয়ই আমরা কী ফয়সালা করেছিলুম।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ,’ একবাক্যে জানিয়েছে, দস্যুরা, ‘সে-সব আমাদের হাতেই ছেড়ে দাও।’

যেতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালে সর্দার। ‘যা চ্চ’লে! আমি তো কর্তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তার কাছে নিশ্চয়ই অন্যসব ব্রাঞ্চের একটা তালিকা আছে।’

একজন তাকে হলদে-হ’য়ে-যাওয়া একটা বিজ্ঞপ্তি দেখালে, সেটা কাচের গায়ে সাঁটা। চট করে সে তার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। ‘ও-হ্যাঁ, আর ওভারকোটগুলো।’ এস্ ব্রাঞ্চের ঠিকানাটা পেয়ে যাবার পর সে বললে, ‘ও-সব কোথাও একটা কোণায় ফেলে দিয়ো। সেগুলো কেউ পেয়ে গেলেও কিছু এসে-যায় না। মোদ্দা কথাটা হ’লো, ওগুলো যেন আমাদের গায়ে কেউ দেখতে না- পায়। জানো-তো কোনখানে আমাদের ফের দেখা হবে। এসো, এবার হাতের কাজ সব চটপট সেরে ফেলা যাক। ‘

সোনারুপোর বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে গিয়ে ঐ ভ্যানেই বোঝাই করা হ’লো। ‘এইই সব তো?’ জিগেস করলে একজন।

অন্যজন ছুটে গিয়ে প্রায়-তক্ষুনি ফিরে এলো পোশাকআশাক নিয়ে, স্টোরের গা থেকে জামাকাপড় খুলে নেবার সময় এগুলো ছেড়ে রাখা হয়েছিলো। পোশাকগুলো সে ভ্যানের মধ্যে তুলে দিলে।

‘তা’হলে এবার সব উঠেছে তো?’ আবার সে জিগেস করলে।

উত্তর এলো : হ্যাঁ। আর হাবার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না।’

লোকটা ব্যাঙ্কের মধ্যে গিয়ে উধাও হ’য়ে গেলো। লোহার পর্দা এবার নেমে এলো চৌকাঠ অব্দি। তারপর চটজলদি-সেজে-বসা কোচোয়ান লাগাম তুলে নিয়ে ঘোড়াদের পিঠে চাবুক কষালে। ঘোড়াগুলো জোরকদমে ছুটলো, এস্ ব্রাঞ্চের কাছে না-এসে তারা আর থামেনি। জাল-কোচেয়ানের বুকের পাটা আছে, সে সোজা গিয়ে হাজির হ’লো হিশেবখানায়

‘আমার জন্যে একটা চিঠি আছে ব’লে শুনেছি?

খাজাঞ্চি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো কে কথা বলছে। অস্ফুট স্বরে ব’লে উঠলো, বিস্ময়চকিত, ‘এ-কী! তুমি তো বোরুক নও।’

‘না, তা তো নয়ই,’ বিচ্ছিরি মুখ-বেঁকিয়ে হেসে উঠলো জাল-কোচোয়ান। ‘কর্তাদের মতিগতি কিছু বুঝি না বাপু,’ খাজাঞ্চি একটু বিরক্ত হ’য়েই বিড়বিড় করলে, ‘জানা নেই, শোনা নেই—সবসময় কেবল নতুন লোক পাঠাচ্ছে!’

‘এ শুধু এইজন্যে যে এদিকটায় আমার আসার কথা ছিলো না। আমি গিয়েছিলুম বি ব্রাঞ্চে—তখন আমায় ডেকে বলা হ’লো এখানে আসতে; হেডআপিশ থেকে নাকি টেলিফোন ক’রে তলব করা হয়েছে। ব্যাঙ্ক বন্ধ হ’য়ে যাবার পরে নাকি একটা মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়েছে এখানে।’ তার চোখের পাতা একবারও কাঁপলো না, যখন সে বানিয়ে-বানিয়ে এই সম্ভাব্য উত্তরটা খাড়া করলে।

‘হ্যাঁ,’ খাজাঞ্চি সায় দিলে, যৎকিঞ্চিৎ সন্দেহের উদ্রেক হওয়া সত্ত্বেও, ‘তবু ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে। আমি তো তোমাকে, বাপু, চিনি না।’

অন্য লোকটা তাতে বেশ অবাক হবারই ভান করেছে। ‘এতে তোমার কী?’

চারপাশে কত চোর-বাঁটপাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাক-গে, ব্যাপারটার এক্ষুনি সুরাহা হ’য়ে যেতে পারে। তোমার কাছে পরিচয়পত্র কিছু আছে তো?’

দস্যুকে যদি কোনো প্রশ্ন ঘাবড়ে দিতে পারতো, তবে সে এটাই : তার কাছে কোনো পরিচয়পত্র থাকবে কী ক’রে? পরিচয়পত্রটা দেখতে কেমন, তা শুদ্ধ সে জানে না। দস্যুকে তাই ব’লে কিন্তু মোটেই বিচলিত দেখালো না। যে এই ধরনের কোনো গা-শিউরে-তোলা অ্যাডভেনচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার নিশ্চয়ই মনের ধাতটা খুব কঠিন হয়, বিশেষ ক’রে সর্বাবস্থাতেই মুখে একটা নির্লিপ্ত নির্বিকারভাব ফুটিয়ে তোলাটা বুঝি রপ্ত করতে হয় তাকে। আর নির্বিকার ঔদাসীন্যের ভাবটা প্রচুর পরিমাণেই ছিলো সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এই জাল-খাজাঞ্চির। কাজেই আচমকা পরিচয়পত্র দাখিল করার তাগিদটা তাকে যদি ঘাবড়ে দিয়েও থাকে, তার মুখের একটা রেখাও কিন্তু কেঁপে যায়নি। খুব-সহজ সুরেই বললে, ‘হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। পরিচয়পত্র দেখিয়ে দিলেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়।’ খুব-সহজ একটা যুক্তি তক্ষুনি তার মাথায় খেলে গিয়েছে। এই তথাকথিত পরিচয়পত্র নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কের সব কর্মচারীকেই সবসময় কাছে রাখতে হয়। পকেট হাতড়ে দেখলেই তো সে সেটা পেয়ে যাবে। ‘দেখাচ্ছি,’ ব’লে সে নিরুদ্বেগে জাঁকিয়ে বসলো বেঞ্চিতে, তারপর তার পকেটে হাত ঢোকালে।

পকেট থেকে বেরিয়ে এলো অনেককিছু : জরুরি দলিল, চিঠিপত্র, চিরকুট আর নোটিস এবং আরো-কত-কী। সবই বিচ্ছিরিভাবে ভাঁজ-করা, ভাঁজে-ভাঁজে ছিঁড়েও গেছে, কোথাও-বা লেখাও মুছে গিয়েছে। যেন কাগজপত্তর নিয়ে কারবার নেই, শুধু কায়িক শ্রমই পারে, যেমন—ঘোড়ার গাড়ি চালাতেই সে যেন ওস্তাদ, এমনি-একটা ভঙ্গি ক’রে অপটু হাতে একটার পর একটা কাগজের ভাঁজ খুলতে লাগলো।

পরক্ষণেই তার হাতে উঠে এলো একটা ছাপা-কাগজ, তার ফাঁকা জায়গাগুলো কেউ লিখে ভরাট করেছে, এবং তার মোদ্দা বক্তব্যটা এইরকম : এতদ্বারা বোদরুক নামক কোনো ব্যক্তিকে সেনট্রাল ব্যাঙ্কের প্রধান খাজাঞ্চির দায়িত্ব অর্পণ করা হচ্ছে। এই পরিচয়পত্রটাই সে খুঁজছিলো, কিন্তু তাতে আদপেই তার মুশকিল আসান হয়নি। পরিচয়পত্রের গায়ে যে নাম লেখা সেটাই সমূহ- বিপজ্জনক—কেননা এই খাজাঞ্চি খোদ বোদরুককে চেনে এবং বোদরুক আসেনি ব’লেই সে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয়েছে। তাতেও কিন্তু এই বেপরোয়া দস্যুর মাথা খুব-ঠাণ্ডাই থাকলো, তক্ষুনি সে ভেবে বার ক’রে ফেলেছে একটা অমোঘ ফন্দি। খাজাঞ্চি একটু যেই অন্যদিকে তাকিয়েছে, সে পরিচয়পত্রটা দু-টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেলেছে; যে-অংশটায় বোকের নাম লেখা সেটা সে আর-সব কাগজের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে, শুধু তলার অংশটাই খাজাঞ্চির দিকে বাড়িয়ে ধরলে, একটু যেন বিরক্ত আর হতাশ ভাবেই বললে : ‘ধুর! কপালটাই খারাপ। পরিচয়পত্রের আদ্ধেকটাই শুধু আছে দেখছি, বাকিটা যে কোথায় ছিঁড়ে পড়েছে, কে জানে!’

‘আদ্ধেকটা?’ হাবার মতো কথাটা একবার আওড়ালে খাজাঞ্চি।

‘হ্যাঁ। পুরোনো কাগজ, সবসময় আমার পকেটে থাকে, ভাজগুলো ঘসা লেগে- লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে-তারপর হয়তো বাকি অংশটা আমার অন্য-কোটের পকেটেই থেকে গেছে।’

খাজাঞ্চি অস্বস্তিভরে শুধু ঘোঁৎ ক’রে একটা আওয়াজ ছাড়লে নাক দিয়ে। ‘যাক-গে, ঘাট হয়েছে আমার এসে,’ উঠে প’ড়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে দস্যু বললে, ‘আমাকে বলা হয়েছে তোমার এখানে এসে এখান থেকে মালকড়ি নিয়ে যেতে—তা আমি এসে হাজিরা দিয়ে গেলুম। তুমি আমাকে দেবে না তো? তাহ’লে ও-সব তুমি গুঁজেই রাখো তোমার কাছে। খোদ হেডআপিশের সঙ্গে তুমিই সামলে নিয়ো ঝামেলাটা। আমি বাপু চললুম-এ-তো আর আমার বাপের শ্রাদ্ধ নয়।’

যে-বিরক্তিমেশানো ঔদাসীন্য সে দেখালে, সেটা হাজার তর্কাতর্কির চাইতেও অনেক-বেশি ফল দিলে : তার ওপর সে আবার একটা মোক্ষম চাল চেলেছে। ‘আমি, বাপু, ঝামেলায় নেই—তুমিই হেডআপিশের ঠ্যালাটা সামলিয়ো,’ এর চেয়ে বড়ো হুমকি আর কী হ’তে পারতো?

‘সবুর, সবুর, একমিনিট,’ অমনি খাজাঞ্চি তাকে পেছন থেকে ডাক দিলে, ‘দেখি তোমার ঐ পরিচয়পত্রের আদ্ধেকটাই!’

‘এই-যে, দ্যাখো, দেখে নয়ন সার্থক করো।

হ্যাঁ, এই-তো দেখছি বড়োসায়েবের দস্তখৎ,’ খাজাঞ্চি সইটা মিলিয়ে দেখে বললে। তারপর মনস্থির ক’রে জানালে, ‘এই-যে নাও টাকার বাণ্ডিল,’ একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিলে সে তার দিকে। ‘যদি এই রসিদটায় একটা সই ক’রে দাও –’

কোচোয়ান যেন বড্ড চ’টে গিয়েছে। এমন-একটা ভঙ্গি ক’রে যা-খুশি একটা নাম লিখে দিয়ে যেতে-যেতে বিরক্তির স্বরে বলেছে : ‘চললুম, গুডনাইট!’ বাইরে এসেই অবশ্য হনহন ক’রে পা চালিয়ে ভ্যানটায় এসে উঠে ব’সেই জোরে চাবুক কষিয়েছে ঘোড়াগুলোর পিঠে, আর পরক্ষণেই দূর-পথ আর অন্ধকার তাকে গিলে খেয়েছে।

আর এইভাবেই শেষ হয়েছে ডাকাতিটা, যেটা এমন-তুলকালাম শোরগোল তুলেছিলো সে-সময়। পাঠকদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ডাকাতির ব্যাপারটার সেদিন সন্ধ্যার পরেই আবিষ্কার হ’য়ে যায়, দুষ্কৃতকারীরা যা ভেবেছিলো তার চাইতে অনেক তাড়াতাড়িই। ব্রাঞ্চ আপিশ তালাবন্ধ, কর্মচারীরা অসহায়ভাবে চিৎপাত হাত-পা বাঁধা প’ড়ে, ভ্যানগাড়ির কোচোয়ান খতম-অপরাধীরা ভেবেছিলো পরদিন সকালের আগে নিশ্চয়ই কিছুই ফাঁস হয়ে যাবে না। বরং, সকালবেলায়, কেয়ারটেকার যখন রোজকার মতো ঝাঁট দিয়ে সব সাফ ক’রে দিতে যাবে, তখন সে বিপদসংকেত বাজাবে, পাগলা ঘণ্টি, কিন্তু তার আগে অব্দি সবকিছু চাপা থাকবে ব’লেই বোধহয় তারা আশা করেছিলো। অথচ সত্যি বলতে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সে-রকম ঘটেনি।

সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ, হাইড পার্কের পেছনে, একটা নির্জন গলিতে ভ্যানগাড়িটাকে প’ড়ে থাকতে দ্যাখে সেনট্রাল ব্যাঙ্কের হেডআপিশেরই একজন কর্মচারী—সে তখন শর্টকাট ধ’রে হনহন ক’রে বাড়ি ফিরছিলো। ব্যাঙ্কের একটা ভ্যানকে এমন বিজনবিভুঁইতে অন্ধকারে অমনভাবে পরিত্যক্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভারি অবাক হ’য়ে গিয়েছিলো। ঠেলতেই দ্যাখে দরজাটা আটকানো নেই, খুলে গেছে, পকেট থেকে দেশলাই বার ক’রে আলো জ্বেলে সে দেখতে পায় মেঝেয় কোচোয়ানের মৃতদেহ প’ড়ে আছে, হিমঠাণ্ডা। সে তক্ষুনি হাঁকডাক শুরু ক’রে দেয়।

তারপর সবদিকেই ব্যস্ত হ’য়ে পড়ে টেলিফোনের পর টেলিফোন। আটটার অগেই একদল সেপাই এসে ফাঁকা ভ্যানগাড়িটাকে ঘিরে কর্ডন ক’রে দাঁড়ায়, আর ডি. কে. ব্রাঞ্চের সামনে জ’মে যায় কৌতূহলী জনতার ভিড়-সেখানেও একদল সেপাই ব্রাঞ্চটার সামনে কর্ডন ক’রে দাঁড়িয়েছে, আর শেষ-অব্দি এক কামারকে ডেকে এনে খুলতে হয়েছে দরজা।

তদন্ত শুরু হ’য়ে যায়, হন্তদন্ত তক্ষুনি। সৌভাগ্যই বলতে হবে, আর-কেউ মারা যায়নি, তবে কারু-কারু চোটজখম বড্ড বেশিই হয়েছে, ও-রকম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঠাণ্ডাহিম ঘরে সারারাত মেঝেয় গড়াগড়ি খেলে তাদেরও কেউ– কেউ অক্কা পেতো। ঘণ্টাখানেক ধ’রে সেবাশুশ্রূষা ক’রে তাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়েছে, আর ভাঙা-ভাঙা কথায় তারা যে-সব কথা জানিয়েছে সে-সব বড্ডই-অস্পষ্ট, প্রায়-অর্থহীন। পাঁচজন দাড়িগোঁফওলা লোক, অলেস্টারে সর্বাঙ্গ মোড়া, তাদের আক্রমণ ক’রে ঘায়েল করে ফ্যালে-তার বেশি তারা আর-কিছুই জানে না।

তারা যে মিথ্যে বলছে, এমন সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিলো না। তদন্তের একেবারে গোড়ার দিকেই পাঁচটা ভারি অলেস্টার পাওয়া গিয়েছে, যেন অপরাধীরা তাদের চিহ্ন রেখে যেতেই চেয়েছে। কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ঝানু এবং বাঘা-বাঘা গোয়েন্দারা তন্নতন্ন ক’রে অলেস্টারগুলো খুঁজে দেখেও কোনো সূত্র পায়নি। নেহাৎই সাধারণ পশমে তৈরি, তাদের গায়ে কোনো লেবেল নেই— না দোকানের, না-বা দরজির; আর সেইজন্যেই হয়তো এগুলো ফেলে রেখে গা ঢাকা দিয়েছে অপরাধীরা।

এ থেকে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝবার জো ছিলো না। অথচ পুলিশের ঘাগু ইন্সপেক্টর আর-যে কোন সূত্র ধরে এগুবেন, তা-ই ভেবে পাচ্ছিলেন না। নানারকমভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছেন তিনি সাক্ষীদের, তাদের কাহন হুবহু একই থেকেছে—কোনো গোঁজামিল বা কোনো দ্বিমত নেই, আর তাদের কাছ থেকে এর বেশি একটাও কথা বার করা যায়নি।

শেষ সাক্ষী ছিলো কেয়ারটেকার। তাকে অনেকগুলো আপিশের খবরদারি করতে হয়, ফলে কোনোটারই ওপর সে বিশেষ নজর দিতে পারে না। সেদিন সে এমনকিছুই লক্ষ করেনি, যা তার সন্দেহ জাগাতে পারতো। দস্যুরা যদি তার পাশ দিয়ে ছদ্মবেশে আনাগোনা ক’রেও থাকে-করেওছে হয়তো–তবু সে ভেবে নিতো এরা বুঝি ব্যাঙ্কেরই কর্মচারী। অনেক জোরজবরদস্তির পর, সে মাথা চুলকে বলেছে, ডাকাতির সময় বা তার একটু পরে, এ-বাড়িতে কাজ করে এমন চারজন লোক তার পাশ দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়। তদন্ত ক’রে দেখা যায়, এ চারজন সমস্ত সন্দেহেরই ঊর্ধ্বে, তারা এ-বাড়িরই অন্য আপিশে কাজ করে, তারা তখন দিনের কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরছিলো। কেয়ারটেকার আরো বলে যে সাড়ে- সাতটা নাগাদ এক কয়লাওলা এসেছিলো এখানে, পুলিশ আসার একটু আগেই; তার কাঁধে ছিলো মস্ত-এক বস্তা, আর কেয়ারটেকারের যে তার কথা মনে আছে, তার কারণ হ’লো তার তখন একটু অবাকই লেগেছিলো, কারণ এমন সময়ে সাধারণত কয়লা ডেলিভারি দিতে কেউ সচরাচর আসে না। কয়লাওলা পাঁচতলার একটা আপিশের কথা বলে, আর এতটাই চাপাচাপি ক’রে যে কেয়ারটেকার অগত্যা দরজা খুলে দিয়ে তাকে ওপরে যাবার সিঁড়িটা দেখিয়ে দেয়। কয়লাওলা ওপরে চ’লে গিয়েছিলো, ফিরে এসেছিলো পনেরো মিনিট বাদেই, বস্তাটা তখনও তার কাঁধে চাপানো; তারপর সে কৈফিয়ৎ দিয়ে বলে যে সে নাকি ঠিকানা ভুল করেছে। হাঁফাতে হাঁফাতে, যেন অনেক পইঠা সিঁড়ি বেয়ে কেউ একটা ভারি বোঝা নিয়ে নাস্তানুবাদ হয়েছে এমন ভঙ্গিতে, সে আস্তে-আস্তে চ’লে যায়।

‘তুমি কি খেয়াল করেছিলে, ইনসপেক্টর জানতে চেয়েছেন, ‘কয়লাওলা কোন দোকান থেকে এসেছিলো?’

কেয়ারটেকার উত্তরে জানায় যে সে সেটা লক্ষ করেনি।

পাঁচতলার ভাড়াটে অবশ্য সায় দিয়ে বলে যে, একটা লোক এসেছিলো বটে সাড়ে সাতটা নাগাদ, এই ওজুহাত দেখিয়ে যে সে নাকি একবস্তা কয়লা ডেলিভারি দিতে এসেছে। তখন যে-ভৃত্যটি দরজা খুলেছিলো সে তাকে জানায় যে তার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে, তখন সে কিছুই না-ব’লে চ’লে যায়। দুটো বক্তব্যের মধ্যে একটাই গরমিল ছিলো : ভৃত্যটি খুব-জোর দিয়েই বলে যে কেয়ারটেকার যা বলে বলুক, লোকটা যখন ওপরে এসেছিলো, তখন তার সঙ্গে কোনো বস্তা- টস্তাই ছিলো না।

ইনসপেক্টর সব শুনে অনুমান করেছেন : ‘সে-নিশ্চয়ই ওপরে উঠে যাবার সময় নিচেই কোথাও সেটা রেখে গিয়েছিলো।’

তৎসত্ত্বেও অনুমানটা সঠিক ছিলো ব’লে মনে হয় না, কেননা একটু পরেই খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছিলো মাটির তলায় ভাঁড়ার ঘরে যাবার সিঁড়ির কাছে একগাদা কয়লা স্তূপ হ’য়ে প’ড়ে আছে; কেয়ারটেকার জোর দিয়ে বারে বারে বলেছে যে কয়েকঘণ্টা আগেও ও-কয়লা ওখানে ছিলো না। এ থেকে আন্দাজ করা যায় যে ঐ রহস্যময় কয়লাওলা নিশ্চয়ই তার বোঝাইবস্তাটা এখানেই উপুড় ক’রে খালি ক’রে গেছে—কিন্তু যাবার সময় সে তবে বস্তায় ক’রে কী নিয়ে যাচ্ছিলো? কারণ—কেয়ারটেকার এই তথ্যটাও জোর দিয়ে বলেছে- বস্তাটা কিন্তু আগের মতোই ভরাট ছিলো, মোটেই হালকা ব’লে মনে হয়নি ওজনে, বস্তার ভারে কয়লাওলা প্রায় নুয়েই পড়েছিলো যাবার সময়, হাঁফাচ্ছিলো আর ধুঁকছিলো।

‘আপাতত এ নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে কোনো ফায়দা নেই,’ এই দুরূহ প্রহেলিকাটির কোনো অর্থ খুঁজে না-পেয়ে ইনসপেক্টর রায় দিয়েছেন, ‘এটা না- হয় পরে ভেবে দেখা যাবে।’ আপাতত তাঁকে বরং অন্য-একটা সূত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে—অন্তত এই সূত্রটাকেই তাঁর বেশি জরুরি ঠেকেছে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত থেকে তিনি একচুলও নড়তে চাননি।

ব্রাঞ্চের সব কর্মচারীকে খুঁজে-পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’লো এই তথ্য যে ম্যানেজারকে খুঁজে-পাওয়া যাচ্ছে না : মিস্টার লুইস রবার্ট ব্লেজন যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গিয়েছেন। অন্য কর্মচারীরা তাঁর কোনো হদিশই দিতে পারেনি। তারা শুধু জানে যে, পাঁচটার একটু আগে, একজন মক্কেল ম্যানেজারের ঘরে কী নিয়ে যেন আলাপ করতে ঢুকেছিলো, তারপরেই বেরিয়ে এসে সে স্টোরকে ডাকে, স্টোর ম্যানেজারের তলব শুনে (অন্তত লোকটা বলেছিলো যে ম্যানেজার তাকে ডাকছেন) সে-ঘরে গিয়ে ঢোকে, সে আর ঘর থেকে বেরোয়নি। তার কয়েক মিনিট বাদেই আসে হামলাটা। আর মিস্টার ব্লেজন; সেই থেকে এ-যাবৎ তাঁকে আর কেউ চোখেই দ্যাখেনি।

এ থেকে শুধু একটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যায়। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বাইরে থেকে পাঁচজন দস্যু এসে অতর্কিতে ব্যাঙ্কের এই শাখায় চড়াও হয়েছিলো, কিন্তু এও বোঝা যাচ্ছে যে ব্যাঙ্কের শাখাতেই তাদের দুষ্কর্মের একজন সহযোগী ছিলো, আর খোদ ম্যানেজার ছাড়া আর-কেউই সেই সহযোগী হ’তে পারে না—তাঁরই যোগসাজসে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ঘটেছে।

সেইজন্যেই, আরো-বিস্তারিত কোনো তদন্তের ফলাফল জানবার অপেক্ষা না- ক’রেই, সেনট্রাল ব্যাঙ্কের ডি. কে. ব্রাঞ্চের ম্যানেজার লুইস রবার্ট ব্লেজনের নামে একটা গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়ে যায়; সন্দেহটা এই যে : হত্যা ও দস্যুতায় তাঁরও হাত আছে। সেইজন্যেই তাঁর স্যাঙাৎদের চেহারার কোনো স্পষ্ট বর্ণনা না-পাওয়া গেলেও, তাঁর চেহারার বর্ণনা দিয়ে একটা হুলিয়া বেরিয়ে যায়—এবং টেলিগ্রাম ক’রে দিকে-দিগন্তে সে-খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়। তক্ষুনি।

অপরাধী যেহেতু এখনও ইংলণ্ড ছেড়ে চ’লে যাবার কোনো অবসর পায়নি, তাকে নিশ্চয়ই দেশের মধ্যেই কোনো শহরে বা বন্দরে পাকড়ে ফেলা যাবে- এবং এই ভাবী কৃতিত্বের কথা ভেবেই পুলিশ গোঁফে তা দিতে থাকে এবং মিথ্যে হয়রানির মধ্যে না-গিয়ে ইনসপেক্টর ও তাঁর সহকর্মী গোয়েন্দারা বাড়ি ফিরে গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

তারপর, সেই রাত্তিরেই, দুটো নাগাদ, পাঁচজন হট্টকট্টা লোক, কারু-কারু মুখ নিখুঁত কামানো, কারু-বা ব্রন্জ মুখে ইয়া-বড়ো তাগড়াই গোঁফ, লণ্ডন থেকে ট্রেনে ক’রে সাদামটন চ’লে যায়। ট্রেনের ব্রেকভ্যান থেকে কতগুলো পার্সেল আর একটা বিষমভারি মস্ত তোরঙ্গ নামিয়ে নিয়ে তারা একটা ভাড়াগাড়িতে ক’রে জাহাজঘাটায় চ’লে যায়; জাহাজঘাটায় দু-হাজার টনের একটা স্টীমার চোঙ দিয়ে ভলকে ভলকে ধোঁয়া ওগরাতে-ওগরাতে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হ’য়ে অপেক্ষা করছিলো। চারটের সময়, গোটা সাদামটন যখন নাকডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে, স্টীমারটি নোঙর তুলে ভরা জোয়ারে ভাসতে ভাসতে বারদরিয়ায় চ’লে যায়। তাকে আটকাবার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। খামকা, অকারণেই, কোনো স্টীমারকে কেউ সন্দেহ করতে যাবেই বা কেন? স্টীমারটা তো এ-ক-দিন নানা ধরনের মাল বোঝাই করছিলো তার খোলে সে দাহোমের বন্দর কোতোনুতে যাবে। স্টীমারটি, অতএব, তার মালপত্তর নিয়ে, তাঁর পাঁচজন যাত্রী এবং তাদের পার্সেল ও ভারি তোরঙ্গটা নিয়ে, বেশ নিশ্চিতেই পাড়ি জমিয়ে দেয় সাগরে। যাত্রীদের একজন সবচেয়ে-তাগড়াই, সবচেয়ে-লম্বাচওড়া যে-তার কামরায় গিয়ে যখন ঢোকে, পুলিশ তখন তাদের ক্লান্তিকর তদন্ত সেরে সু-উপার্জিত বিশ্রামের তোড়জোড় করছে।

এও নিশ্চয়ই পাঠকদের আজও মনে আছে যে তদন্তটা পরের দিন ফের পুরোদমে শুরু হ’য়ে যায়, এবং বেশ-কিছুদিন ধ’রেই চলে, কিন্তু কখনোই কোনো নির্দিষ্ট সমাধানসূত্রে গিয়ে পৌঁছুতে পারেনি। পাঁচজন অপরাধীর পরিচয় যে-তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই থেকে যায়; লুইস রবার্ট ব্লেজনেরও আর-কোনো হদিশ মেলেনি। এই দুর্ভেদ্য রহস্যজালের মধ্যে কোনো আলোকরেখাই দেখা যায়নি। কোন্-সে দোকান কয়লাওলাকে রাতের বেলা ওভাবে পাঠিয়েছিলে, সেটা অব্দি খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষটায় একটা অমীমাংসিত রহস্য হিশেবেই সেটা নথিবন্দী হ’য়ে প’ড়ে থাকে।

এই ধাঁধাটার সমাধান অবশ্য, আজই, এই প্রথম, এই উপাখ্যানের মধ্যে দেয়া হচ্ছে। পাঠককেই বিচার-বিবেচনা ক’রে বলতে হবে এর চেয়ে চমকপ্রদ, অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্য রহস্যের কথা তিনি কোনো কল্পনাতেও ভাবতে পারতেন কি না।