১৩. সান্তা-ফে

১৩. সান্তা-ফে

মানুষের গলা যে বাজের মতো শোনাতে পারে, সের্‌সান্তের এই কথাই তার নজির। ছোট্ট একটা কথার মধ্যে যে কতখানি ভয়ংকরতা লুকিয়ে থাকতে পারে তা যেন এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলে বোম্বেটেরা। তাদের কানে তখনও যেন গুমগুম করে ফেটে পড়ছে বাজ—’সান্তা-ফে!’

সাত্তা-ফে এসে পড়লো বলে! ক্রমশ যেন বাড়তে লাগলো সেই আওয়াজ! কী প্রচণ্ড যে শব্দ সেটা! কন্‌গ্রের ঠিক ধুকধুকিটাতেই যেন সেই বাজ ফেটে পড়েছে! দীর্ঘ বিলম্বিত গর্জন ক’রে ফেটেছে যেন বাজ! যেন সারা আকাশ ভেঙে পড়েছে তার মাথার ওপর।

মুহূর্তে ফ্যাকাশে হ’য়ে গেলো কন্‌গ্রের মুখ। স্তম্ভিত হ’য়ে দাঁড়িয়ে রইলো জলদস্যুরা। মনে হ’লো পায়ের তলায় কোন-এক ভূমিকম্পে সারা পৃথিবী যেন দুলে উঠেছে!

সান্তা-ফে! সান্তা-ফে এসে পড়লো ব’লে!

কিন্তু সের্‌সান্তের ভুল হয়নি তো? সত্যিই কি সান্তা-ফে এসে পড়ছে? যে-জাহাজটি আসছে, সেটা কি সত্যি আরহেতিন প্রজাতন্ত্রের মানোয়ারি জাহাজ সান্তা-ফে? সেটা কি এদিকেই আসছে?

সংবিৎ ফিরে পেতেই কন্‌গ্রে প্রায় ছুটে লণ্ঠনঘরে উঠে এলো।—কই? কোথায় জাহাজ?’

–’ঐ-যে, উত্তর-পুবে।’

–’কত দূরে ব’লে মনে হচ্ছে?’

–’মাইল দশেক—কিছু কম-বেশি হ’তে পারে।’

—’তাহ’লে অন্ধকার হবার আগে এখানে পৌঁছুতে পারছে না?’

–’না। এখানে আসতে-আসতেই রাত নেমে পড়বে।

কন্‌গ্রে সের্‌সান্তের হাত থেকে দূরবিনটা যেন প্রায় ছিনিয়েই নিলে।

চোঙ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে তরতর করে একটা জাহাজ দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাঙা গলায় স্বীকার করলে কনগ্রে——হ্যাঁ, সান্তা-ফেই বটে! কোনো সন্দেহই নেই।’

—’কী-রকম অভিশপ্ত ভাগ্য, দেখেছো!’ সের্‌সান্তের গলায় প্রচণ্ড একটা ক্ষোভ—’ঐ জ্যান্ত শয়তানগুলো যদি দু-দুবার ব্যাঘাত না ঘটাতো, তবে এতক্ষণে আমরা প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পৌঁছে যেতুম।’

——এখন আর সে-কথা ব’লে কোনো লাভ নেই। এখন বরং ভাবো, আমরা কী করবো।’

—’কী? ‘

—’এক্ষুনি রওনা হ’য়ে পড়তে হবে আমাদের।’

—’এক্ষুনি? ‘

‘—হ্যাঁ, এক্ষুনি!’

‘কিন্তু আমরা বেশিদূর যাবার আগেই সান্তা-ফের মুখোমুখি প’ড়ে যাবো। সে তো এসে পৌঁছে যাবে।’

–’না, পৌঁছুবে না।’

–’তার মানে।’

–’এর মধ্যে কোনো ধাঁধা নেই। বাতিঘরের আলো জ্বলবে না, কেন জ্বলছে না তা তারা জানে না। অন্ধকারে এখানে জাহাজ ভেড়াতে সাহস করবে না কাপ্তেন।’

কাপ্তেন লাফায়েৎ অন্ধকার দেখে ব্যাপার না-বুঝে এখানে জাহাজ ভেড়াবেন না—এটা বাস্‌কেথ আর ডেভিসও বুঝতে পেরেছিলো। এখন সূর্য ডুবে গিয়েছে। নিয়মমাফিক এক্ষুনি বাতিঘরে আলো জ্ব’লে ওঠবার কথা। আলো না-দেখে দ্বীপে জাহাজ ভেড়াতে নিশ্চয়ই ইতস্তত করবেন কাপ্তেন লাফায়েৎ। কেন আলো জ্বললো না—বুঝতে না-পেরে খোলা সমুদ্রেই তিনি রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নেবেন। যদিও অনেকবারই এই দ্বীপে এসেছেন, তবে সে তো দিনের বেলায়, ঝলমলে আলোয়। অন্ধকারে কী ক’রে আসবেন? তাছাড়া, তিনি এও ভাবতে পারেন যে, এই দ্বীপে নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে, তাই বাতিঘরের রক্ষীরা আলো জ্বালতে পারেনি। সে বিপদের ধরন আর ভেতরের সবকিছু ভালো ক’রে না-জেনে অন্ধকারে দ্বীপে এসে জাহাজ ভেড়ানো তিনি সমীচীন মনে করবেন না নিশ্চয়ই

–’কিন্তু সেনচুরির বরাতে যা ঘটেছে সান্তা-ফের বরাতেও তো তা ঘটতে পারে। আমাদের এক্ষুনি অন্তরীপের মুখে গিয়ে ওদের সাবধান ক’রে দেয়া উচিত।’

ডেভিস শুধু তার কাঁধ ঝাঁকালে। এটা সেও জানে, বেলাভূমির পাথরে আচমকা ঘা খেয়ে সান্তা-ফে গুঁড়ো হ’য়ে যেতে পারে।

বাস্‌কেথ ব’লে চললো— চলো, বেলাভূমিতে ছুটে যাই। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অন্তরীপের মুখে গিয়ে পৌঁছুতে পারবো। তখনও আলো জ্বেলে সংকেত করা যাবে ব’লে মনে হয়।’

ডেভিস উত্তর দিলে—’না, তাতে দেরি হয়ে যাবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সান্তা-ফে উপসাগরের মুখটায় পৌঁছে যাবে।’

—’তাহ’লে? আমরা তাহ’লে কী করবো?’

—’এখন আর অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।’

সন্ধের অন্ধকার ঘন হ’য়ে আসছে। বোম্বেটেরা জাহাজ ছাড়বার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সকাল অব্দি আর ব’সে থাকবে না তারা। যেমন ক’রেই হোক, এক্ষুনি পালাতে হবে।

তখন তাদের অনুকূলেই উত্তরদিক থেকে হাওয়া বইছে। এই অনুকূল হাওয়ায় জাহাজ ভাসিয়ে দিয়ে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সমুদ্রে পড়তে হবে—তারপর সামনে থাকবে কেবল জল, বারদরিয়া-সান্তা ফে পেছন-পেছন ধাওয়া করলেও আত্মরক্ষার একটা সুযোগ থাকবে। কনগ্রে সব্বাইকে তাড়া লাগালে।

জলদস্যুদের মলব বুঝতে ডেভিস বাস্‌কেথ—কারুই কোনো অসুবিধে হয়নি। বোম্বেটেরা এক্ষুনি রওনা হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে—এমন অবস্থায় পড়লে তারাও তা-ই করতো। কিন্তু কী ক’রে তারা জলদস্যুদের সব প্ল্যান ভেস্তে দেবে? কী করতে পারে তারা? নিজেদের অসহায় দশায় তারা নিদারুণ হতাশায় ভরে গেলো।

একটু পরেই কন্‌গ্রে তার দলবল নিয়ে জাহাজে উঠে পড়লো। সবাই উঠে গেলে নোঙর তুলতে হুকুম দিলে কন্‌গ্রে। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা, ডেভিস আর বাস্‌কেথ পাথরের আড়ালে ব’সে-ব’সেই শুনতে পেলে নোঙর তোলবার আওয়াজ।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নোঙর তোলা হয়ে গেলো। সঙ্গে-সঙ্গে দুলে উঠলো জাহাজ। সবগুলো পাল তুলে দেয়া হয়েছে—হাওয়ার ধাক্কায় পালগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। খুব আস্তেই উপসাগরের মধ্যে গিয়ে পৌঁছুলো জাহাজ। হাওয়ার বেগ ক’মে আসছে—হাওয়া চাই পালে—চাই হাওয়ার ঝাপটা। একটু পরেই জাহাজ চালানো বেশ মুশকিল হ’য়ে পড়লো। নিস্তরঙ্গ নীল জলে কোনো স্রোত নেই। হাওয়াও থেমে গিয়েছে যেন। অসম্ভব, এ-অবস্থায় কোনো স্কুনারই চালানো যায় না। মাঝরাত্তিরের আগে কিছুতেই সান্ হুয়ান অন্তরীপ পেরুনো যাবে না। ঘণ্টা কয়েক বাদে যখন জোয়ার আসবে, তখন জাহাজ চলবে; এখন শুধু জোয়ারের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর-কিছুই করার নেই। জোয়ার এলে তাকে যদি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়, তাহ’লে অবশ্য কোনো ভাবনা নেই। সকাল হওয়ার আগেই তাহলে সান্ হুয়ান অন্তরীপ পেরিয়ে বারদরিয়ায় গিয়ে পড়া যাবে।

জাহাজ তখন ইগোর উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলের দিকে চলেছে। এদিককার উপকূলের খবর কন্‌গ্রে ভালো জানে না। তবে এ-কথা জানে যে এদিককার উপকূল ‘জাহাজমারি উপকূল’ নামেই কুখ্যাত।

এদিকে রাত যত বাড়ছে, হাওয়ার বেগও ততই কমছে। এ-অবস্থায় অন্যদিকে জাহাজ চালানোও কিছুতেই সম্ভব নয়। যা করতে হয়, এক্ষুনি করা দরকার। কন্‌গ্রে বিপদের গুরুত্ব বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলো। সামনে তখন শুধু একটা পথই খোলা আর তা-ই করলে সে। জাহাজ থেকে ডিঙি নামানো হ’লো, জনা সাতেক লোক গিয়ে উঠলো সেই ডিঙিতে। তারপর অনেক চেষ্টায় বিস্তর হয়রানির পর কোনোরকমে গুণ টেনে জাহাজটাকে মাঝদরিয়ায় নিয়ে-যাওয়া হ’লো।

ঘেমে-নেয়ে মাঝদরিয়ায় পৌঁছে দেখা গেলো একফোঁটাও হাওয়া নেই। বাতাস নেই ব’লে পালগুলো নেতিয়ে পড়েছে। ডিঙি ক’রে গুণ টেনে, .জাহাজটাকে উপসাগরের মুখে নিয়ে-যাওয়ার কল্পনা করাই এখন বাতুলতা। সুতরাং জোয়ারের জন্যে হাঁ ক’রে ব’সে-থাকা ছাড়া আর-কোনো উপায়ই নেই এখন। তবে জোয়ারের চাঞ্চল্য এর মধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এখনও অস্ফুট আওয়াজ উঠছে জল থেকে, কিন্তু জাহাজ এখন যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে ভরা জোয়ারের সময়ও সেখান থেকে জোয়ারের খুব-একটা সাহায্য পাওয়া যাবে না। আর জোয়ারের টানের উলটো দিকে জাহাজ চালাবার কথা যে ভাবে সে হয় জন্ম-আহাম্মক আর নয়তো ডাহা-পাগল। তাহ’লে মাত্র মাইল দু-এক এসেই কি জাহাজের নোঙর ফেলে ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পণ ক’রে বসে থাকতে হবে?

বোম্বেটে জাহাজ দূরে গিয়ে নোঙর ফেলবার পর ডেভিস আর বাস্‌কেথ তাদের গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে সমুদ্রতীরে দাঁড়ালে। উদ্দেশ্য : জাহাজটার গতিবিধির ওপর নজর রাখবে। হাওয়ার অবস্থা দেখে বুঝতে পারলে যে কনগ্রেকে অন্তত বেশ-কিছুক্ষণ থেমে থাকতে হবে। ভাঁটার টান, শুরু না-হ’লে কোনোমতেই সে জাহাজ চালাতে পারবে না। কিন্তু তবুও ভোর হবার আগেই সে-যে বারদরিয়ায় গিয়ে পৌঁছুতে পারে, তারও ভালোরকম সম্ভাবনা আছে।

হঠাৎ বাস্‌কেথ চেঁচিয়ে উঠলো : ‘এতক্ষণে দস্যুদের বাগে পেয়েছি!’

বিস্মিত জন ডেভিস জিগেস করলে—’কী ক’রে?’

–’কী করে, তা এক্ষুনি দেখতে পাবে।’ ব’লে, বাস্‌কেথ ডেভিসের হাত ধ’রে টানতে-টানতে হন্যে হ’য়ে ছুটতে শুরু করলে বাতিঘরের দিকে।

তার হিশেবমতন সান্তা ফে এখন উপসাগরে ঢোকবার মুখটায় দাঁড়িয়ে ভোর হবার অপেক্ষা করছে। কাপ্তেন লাফায়েৎ কিছুতেই রাতের অন্ধকারে জাহাজ চালাবার ঝুঁকি নেবেন না।

কন্‌গ্রেও সে-কথা বুঝতে পেরেছিলো, তাই তার মনে তখনও আশা ছিলো, একবার সমুদ্রমুখে ভাঁটার টান শুরু হ’লেই আর তাকে পায় কে? একঘণ্টার মধ্যেই খোলা সমুদ্দুরে গিয়ে পৌঁছুতে পারবে।

রাত তখন নটা বেজে গেছে। জোয়ারের ঠ্যালা সামলাবার জন্যে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে জলদস্যুদের জাহাজ সের্‌সান্তে। অপেক্ষা ক’রে আছে ভাঁটার জন্যে। রাত তিনটের আগে সে-আশা নেই। তাই সমুদ্রের দিকে মুখ ক’রে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের জাহাজ।

ডিঙি দুটো এর মধ্যেই ওপরে টেনে তোলা হয়েছে, কারণ ভাঁটার টান শুরু হ’লে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে রাজি নয় কন্‌গ্রে।

আচমকা কে যেন চীৎকার ক’রে উঠলো—’আলো। বাতিঘরে আলো জ্ব’লে উঠেছে!’

সত্যিই তাই। বাতিঘর থেকে একটি তীব্র আলোকরশ্মি বেরিয়ে এসে অন্ধকার ছিন্নভিন্ন ক’রে ফেলেছে। আলোয়-আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠেছে। বাতিঘরের মিনার থেকে আলোর ছটা প’ড়ে দ্বীপ, সমুদ্র, আর আকাশকে আলোয় আলো ক’রে দিয়েছে!

—’উঃ! বদমায়েশ!’ চেঁচিয়ে উঠলো সের্‌সান্তে।—’বদমায়েশগুলো বাতিঘরে গিয়ে আলো জ্বেলে দিয়েছে!’

—’শিগগির তীরে চলো—’ খ্যাপা জাগুয়ারের মতো গ’র্জে উঠলো কন্‌গ্রে।

—’এক্ষুনি তীরে যেতে হবে, উঠতে হবে বাতিঘরের মিনারে, ঢুকতে হবে লণ্ঠনঘরে, তারপর আলোকরক্ষী আর তার সাথী যে বা যারা আছে তাদের খুন ক’রে ফেলে নিভিয়ে দিতে হবে আলো।’ কনগ্রে বাংলায় তার প্ল্যান।

—কিন্তু এর মধ্যে সান্তা ফে যদি চলতে শুরু করে?’ জিগেস করে সের্সান্তে।

সের্‌সান্তের কথায় একটু দমে গেলো কন্‌গ্রে। সত্যিই তো! সান্তা-ফে যদি তীরের দিকে এগিয়ে আসে! কিন্তু না, ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।

কন্‌গ্রে আবার ডিঙি নামাতে হুকুম করে।

হুড়োহুড়ি করে ডিঙি নামানো হ’লো জলে। সঙ্গে-সঙ্গে জলদস্যুদের দল লাফিয়ে উঠলো ডিঙিটায়। সকলেই সশস্ত্র। কারু হাতে বন্দুক, কারু হাতে রিভলভার, আর কারু-বা হাতে কুঠার। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা তীরে পৌঁছুলো। পড়ি-মড়ি করে ছুটলো সবাই বাতিঘরের দিকে। বাতিঘর সে-জায়গা থেকে দেড় মাইল দূরে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই সে-দূরত্বটা অতিক্রম করলে তারা।

জন ডেভিস আর বাস্‌কেথ তখনও লণ্ঠনঘরেই রয়েছে। বাস্‌কেথ গোড়ায় ভয় পেয়েছিলো। কনগ্রে লণ্ঠনের আতসকাচ আর যন্ত্রপাতি নষ্ট ক’রে ফ্যালেনি তো? কিন্তু লণ্ঠনের ঘরে ঢুকে সে-ভয় দূর হয় তাদের। না, লণ্ঠন ঠিকই আছে। যন্ত্রপাতি কিছুই নষ্ট করেনি কন্‌গ্রে। তাই আবার বাতিঘরের লণ্ঠন অকস্মাৎ জ্ব’লে উঠেছিলো। আতসকাচের ভেতর দিয়ে ঝলসে উঠেছিলো তীব্র আলোর ছটা।

দূরন্ত গতিতে এসে দস্যুরা বাতিঘরে ঢুকলো। কিন্তু এ কী? সিঁড়িঘরের দরজা যে বন্ধ!

কন্‌গ্রে হুকুম দিলে—এক্ষুনি দরজা ভেঙে ওপরে উঠতো না-পারলে আর-কারু রেহাই নেই।

কিন্তু সিঁড়িঘরের দরজা ইস্পাতের চাদরে তৈরি, খুব শক্ত। কিছুতেই সে-দরজা আর ভাঙা যাচ্ছে না। পরিশ্রম ক’রে সবাই প্রায় ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কিন্তু খামকাই এই চেষ্টা! কুঠারের সাহায্যেও সে-দরজা ভাঙবার সাধ্য নেই কারু। সের্‌সান্তে দরজার নাট-বলটু খুলে ফেলবার জন্যে দরজাটাকে খুঁটিয়ে দেখলে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হ’লো না। দরজার বলটুগুলো ভেতর থেকে এঁটে দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে খোলা অসম্ভব।

এখন তাহলে কী করবে তারা? মিনারে ওঠবার জন্যে কোনো পথ আছে কি? যদি না-থাকে, তাহ’লে দ্বীপের গহনে গিয়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা ছাড়া তাদের আর কিছুই করবার নেই। জাহাজে ফিরে গিয়ে এখন আর কোনো লাভ নেই। তাছাড়া হাতে তো একফোঁটাও সময় নেই। সান্তা-ফে নিশ্চয়ই এতক্ষণে দ্রুতগতিতে তীরের দিকে ছুটে আসছে। এখনও যদি কোনোরকমে আলো নিভিয়ে দেয়া যায় তাহ’লে হয়তো বাঁচবার একটা উপায় হ’তে পারে। কিন্তু ওপরে উঠবে তারা কী ক’রে? মিনারে ওঠবার একটাই মাত্র পথ, আর সেটাও বন্ধ! কী করা যায় তাহ’লে?

হঠাৎ সের্‌সান্তে চেঁচিয়ে উঠলো—’এদিকে একটা লোহার মই আছে!’

—’নিয়ে এসো শিগগির! জলদি!’

মইটা অনেক কষ্টে দেয়ালে লাগানো হ’লে দেখা গেলো মিনারের অর্ধেকও পৌঁছোয় না!

রাগে, ক্ষোভে, তেরিয়া আক্রোশে মরিয়ার মতো হ’য়ে উঠলো ক ে আর, এমনি সময়ে, হঠাৎ তার নজরে পড়লো একটা লোহার পাইপ একেবারে মিনারের চুড়ো অব্দি উঠে গিয়েছে। শেষ চেষ্টা তাহ’লে এই পথেই করতে হবে! সের্‌সান্তে আর ভার্গাস অমনি পাইপ বেয়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছে।

অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে তারা। আর মাত্র সামান্যই বাকি! এমনি সময় পর-পর কতগুলো রিভলভারের আওয়াজ শোনা গেলো। এবার আক্রমণের ভূমিকা নিয়েছে ডেভিস আর বাস্‌কেথ।

সের্‌সান্তে আর ভার্গাসের গুলি-বেঁধা দেহ নিচে আছড়ে পড়লো।

ওদিকে সান্তা-ফের সিটি বেজে উঠেছে তীব্র শব্দে। তীরের একেবারে কাছে এসে পড়েছে সান্তা-ফে!

পালাবারও সময় নেই আর। আর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সান্তা-ফে তীরে নোঙর ফেলবে।

এবার তবে নিশ্চিত মরণ! আর তাদের রেহাই নেই!

গভীর আতঙ্ক যেন চোখের সামনে ঘনিয়ে তুলেছে অন্ধকার।

আর-কিছুই করবার নেই, কিছু না।

কন্‌গ্রে আর তার দলবল প্রাণের ভয়ে ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

এর খানিকক্ষণ পরেই স্টটেন আইল্যাণ্ড সচকিত হ’য়ে উঠলো সান্তা ফের নোঙর ফেলবার শব্দে।

আর তারই একটু পরে বাস্‌কেথ আর ডেভিসকে দেখা গেলো সান্তা-ফের ডেকের ওপর।