১২. বিপদের সংকেত

১২. বিপদের সংকেত

বোম্বেটেদের মনের ভাব আন্দাজ করতে কোনো মুশকিল হবার কথা নয়। যখন তাদের এতদিনের স্বপ্ন সফল হ’তে চলেছে, ঠিক তখনই আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে এলো আক্রমণ —যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! এতে কার না রাগ হয়? এদিকে আবার শিরে-সংক্রান্তি, আর চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই সান্তা-ফে ইগোর উপসাগরে এসে পৌঁছুবে! এর চাইতে বড়ো-কোনো বিপদের কথা এই মুহূর্তে তারা ভাবতে পারছিলো না।

রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো কন্‌গ্রে। তেরিয়া মেজাজ খাঞ্জা খাঁর মতো যাকেই সামনে পায় তাকেই বুঝি মেরে বসে!

স্কুনারের ক্ষতির বহরটা আরেকটু কম হ’লেই কন্‌গ্রে অন্য-কোনো জায়গায় গিয়ে জাহাজের নোঙর ফেলতে পারতো। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ আর ধরনটা গুরুতর, সেটাকে কিছুতেই অবহেলা করা গেলো না। আর এই দ্বীপে ছাড়া, জাহাজটাকে নিরাপদে রাখবার মতো তেমন-কোনো ভালো জায়গাই বা কোথায়, আশপাশে? কাজেই শুড়শুড় ক’রে পুরোনো আস্তাবলেই ফিরে আসা ছাড়াই বা উপায় কী তার?

সের্‌সান্তে তো বারুদের স্তূপের মতো জ্বলছে—পারলে নিজের হাতটাকেই চিবিয়ে খেতো। সে অবশ্য কনগ্রেকে ব’লেও ছিলো, কারা দ্বীপ থেকে কামান ছুঁড়লো, তাদের একবার তন্নতন্ন করে খুঁজে-দেখা উচিত। কিন্তু কন্‌গ্রে তার প্রস্তাবটি আদৌ আমল দিলে না। বললে যে, তারা ক-জন তাদের কাছে কতরকম অস্ত্রশস্ত্র আছে তার কিছুই যখন জানা নেই তখন ও-রকম দুঃসাহস না-করাই ভালো। অনেক ভেবেচিন্তে সের্‌সান্তেও অগত্যা সে-কথায় রাজি হ’লো। বললে——সেটা সত্যি কথা। আর, লোকগুলোকে যদি কুকুরের মতো গুলি ক’রেও মারি, তাতেও আমাদের বিশেষ-কোনো লাভ হবে না। এখন আমাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ হ’লো যত-শিগগির সম্ভব এই হতচ্ছাড়া দ্বীপটা ছেড়ে চ’লে যাওয়া।’

কন্‌গ্রে বললে—’যেমন ক’রেই হোক দুপুরবেলার মধ্যেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।

এখানে অবশ্য জনান্তিকে এটা ব’লে নেয়া ভালো যে, বোম্বেটেরা দল বেঁধে বাসকেথ আর ডেভিসের খোঁজে সান্ হুয়ান অন্তরীপে গেলেও তাদের কোনো হদিশ করতে পারতো না। আগের দিন বিকেলে, পরিকল্পনাটা অনুযায়ী, দুজনে উৎসুকভাবে একটা টিলার ওপর সময় কাটিয়েছিলো। একটা পাথরের ওপর কামান বসাতে তাদের তেমন-কিছু বেগ পেতে হয়নি। এটা ঠিক যে কামানটা ঠেলে নিয়ে যেতে তারা একেবারে গলদঘর্ম হ’য়ে গিয়েছিলো, কিন্তু কোনো বিশেষ বাধা পেরুতে হয়নি তাদের। সন্ধে ছ-টা নাগাদ কামানটাকে তারা অতিকষ্টে সেখানে এনে বসিয়েছিলো। কামানটার নলটাকে তারা উপসাগরের দিকেই তাগ ক’রে রেখেছিলো, তারপর বারুদ ভরেছিলো নলে। তৈরি হয়ে নিতে তারপর আর বেশি সময় লাগেনি, উৎসুক হ’য়ে অধীরভাবে তারা তাকিয়েছিলো সমুদ্রের দিকে। এবার শুধু আসল সুযোগটার অপেক্ষা— তারপরেই কেল্লা ফতে।

ডেভিস বলেছিলো বাস্‌কেথকে—’আমি অনেক মাথা ঘামিয়ে ঠিক করেছি আমাদের কী করা উচিত। বোম্বেটেদের জাহাজ একেবারে ডুবিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ তাহ’লে পাজিগুলো সাঁৎরে তীরে এসে আমাদের ওপর চড়াও হবে—তখন আমরা অতগুলো বেপরোয়া লোকের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবো না। তার চেয়ে আমাদের এমন ভাবে গোলা ছুঁড়তে হবে যাতে সাগরপাড়ির মলব তাদের বাতিল ক’রে দিতে হয়, অথচ জাহাজটাও পুরোপুরি ধ্বংস হয় না—তাতে ওরা জাহাজটাকে মেরামত করতেই ব্যস্ত হ’য়ে পড়বে।’

–’বেশ, তা-ই না-হয় করা যাবে। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ যদি নেহাৎ অল্প হয়? তাহ’লে তো তারা সহজেই মেরামত করে পাততাড়ি গোটাবে।’

–’না, তা পারবে না। আমরা এমনভাবে গোলা ছুঁড়বো যাতে বাছাধনেরা মালপত্র না-নামিয়ে কিছুতেই মেরামত করতে না-পারে। তাতে কম করেও দু-তিনদিন লেগে যাবে।

—’কিন্তু ধরো যদি সান্তা ফে হপ্তাখানেকের মধ্যেও না-আসে, তাহ’লে?’ বাস্‌কেথ খারাপ সম্ভাবনাটার কথা তুলেছিলো।—’আমার মতে ক্ষতির পরিমাণ হবে গুরুতর, অথচ এমন-ক্ষতি যাতে জাহাজটা ডুবে না-যায়। অর্থাৎ আমাদের নিখুঁত তাগ ক’রে গুলি ছুঁড়তে হবে।’

আলোচনা ক’রে সেটাই তারা শেষ অব্দি ঠিক করেছিলো। আর সবকিছু প্রস্তুত ক’রে নিয়ে অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছিলো কখন দেখা দেয় বোম্বেটেদের জাহাজ। দুজনে যেন পুরোদস্তুর গোলন্দাজ, এমনি ভাবেই কামানের পাশে সটান দাঁড়িয়ে ছিলো তারা সজাগ, আর তৎপর।

তাদের কামান ছোঁড়ার পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা আগেই দেখেছি। যতক্ষণ-না বোম্বেটেদের জাহাজ ফের স্টটেন আইল্যাণ্ডের দিকেই চলতে শুরু করলে, ততক্ষণে দুজনে অনিমেষ লোচনে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর সেটাকে দ্বীপের দিকে ফিরে আসতে দেখে দ্বীপের একবারে অন্য দিকটায় একটা আস্তানার খোঁজে ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছিলো। যদি ঐ বদমায়েশগুলো তাদের খোঁজে এদিকটায় আসবার মতলব করে, তাহ’লে এবার আর তারা রেহাই পাবে না। কাজেই তাদের এক্ষুনি কী করতে হবে, তা তারা ঠিক ক’রে ফেলেছিলো।

ঐ ছোট্ট গুহাটি ছেড়ে মাইল দু-এক দূরে উত্তর দিকে এক্ষুনি নতুন-একটা আস্তানা খুঁজে বার করা দরকার। তাতে যেমন দস্যুদের হাত থেকে রেহাই পাবার একটা ভরসা থাকবে, তেমনি ওদিক থেকে কোনো জাহাজ আসে কি না সেটাও নজর রাখা যাবে। খাবার-দাবার, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এককথায় যাবতীয় রসদ নিয়েই দুজনে মাঝরাতে নয়া আস্তানার খোঁজে রওনা হ’য়ে পড়েছিলো।

মাইল পাঁচ-ছয় দূরে, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর, তীরের ধারে একটা ডেরা পাতবার মলব আঁটলে তারা। এই আশ্রয় থেকে অনায়াসেই সমুদ্রের ওপর নজর রাখা যাবে, সান্তা-ফে আসছে কি না তাও দেখা যাবে।

পয়লা মার্চের গোটা দিনটাই দুজনে আড়াল থেকে-দস্যুদের ওপর নজর রাখলে। এছাড়া বোম্বেটেরা তাদের ওপর চড়াও হবার মলবে আছে কি না, সেটাও হুঁশিয়ার হ’য়ে দেখা দরকার।

কন্‌গ্রেরা অবিশ্যি আপাতত তাদের ওপর হামলা চালাবার কোনো মলব না-এঁটে তড়িঘড়ি জাহাজের মেরামতি শেষ করবার জন্যে ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছিলো। যত শিগগির মেরামত শেষ হয়, ততই তাদের পক্ষে মঙ্গল। কন্‌গ্রে সেজন্য ভার্গাসের ওপর জোর তাড়া লাগালে। ভার্গাস সব দেখেশুনে জানালে যে সবাই মিলে হাত লাগিয়ে খুব ক’রে খাটলে হয়তো সন্ধের মধ্যেই মেরামত সেরে ফেলতে পারবে। অবশ্য সব কাজ ভালো ক’রে শেষ করতে হ’লে একদিনে পারা যাবে না, পরের দিনটাও লেগে যেতে পারে।

পয়লা মার্চ, কাজে-কাজেই, নিঃশব্দেই কাটালে ডেভিস আর বাস্‌কেথ, কিন্তু সময় যে কত দীর্ঘ হ’তে পারে সেটাও যেন তারা এবার মর্মে-মর্মে টের পেয়ে গেলো। সন্ধের সময় যখন বুঝতে পারা গেলো যে সেদিন আর বোম্বেটের রওনা হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন তারা তাদের নতুন আস্তানায় ফিরে গিয়ে অনেকদিন বাদে অনেকটা নিশ্চিন্তে ঘুম লাগাতে পারলে।

পরদিন ভোর হ’তে-না-হ’তেই তারা আবার বেলাভূমিতে এসে দাঁড়ালে- দিগন্তে কোনো জাহাজের চিহ্ন পাওয়া যায় কি না দেখবার জন্যে। কিন্তু না, কোনো জাহাজেরই চিহ্ন নেই কোথাও। সান্তা-ফের তো কোনো পাত্তাই নেই, কোনো ধোঁয়ার চিহ্নও নেই দিগন্তে।

বোম্বেটেরা আজ রওনা হবে কি না কে জানে! হয়তো সে-চেষ্টাই করবে যাতে সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সান্তা ফে আসছে না কেন? খুবই অস্থির লাগছিলো তাদের। এবার যদি বোম্বেটেরা ফের জাহাজ ছাড়ে, তবে খুব হুঁশিয়ার হ’য়েই জাহাজ চালাবে। কাজেই আবার কামান ছোঁড়া যাবে কি না কে জানে।

অশান্ত এক উদ্বেগের মধ্যে তাদের সময় কাটতে লাগলো। যখন সকালবেলার জোয়ার এসে চ’লে গেলো, তখন তারা খানিকটা ভরসা পেলে। অর্থাৎ, এখন আর সন্ধ্যার জোয়ার না-এলে বোম্বেটেরা জাহাজ ছাড়তে পারবে না।

আবহাওয়া ভারি শান্ত হ’য়ে আছে। কিছুকাল আগে যে ভয়ংকর-একটা তুফান প্রলয়কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিলো, এখন সমুদ্র দেখে তা কল্পনাও করা যায় না। চারদিকে মিঠে রোদ্দুর, সমুদ্রের জলে ঝিলিক দিচ্ছে সোনালি আলো।

বাস্‌কেথ আর ডেভিস দোসরা মার্চও তারপর নিশ্চিন্তে কাটালো। দস্যুরা সারা দিনটাই জাহাজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হ’য়ে আছে।

বাস্‌কেথ বললে—বদমায়েশগুলো আদানুন খেয়ে কাজে লেগে পড়েছে দেখছি—’ এবার আর তাদের আটকে রাখা যাবে না। কী আর করা যাবে? আমাদের যতটা সাধ্যে ছিলো, তা আমরা করেছি। বাকিটুকু এখন ঈশ্বরের হাতে।’

দাঁতে দাঁত চেপে বাস্‌কেথ বললে—’ঈশ্বর নিশ্চয়ই পাপীর সাজা দেবেন।’

সমুদ্রের দিকে নজর রাখতে-রাখতে ডেভিস পায়চারি শুরু করলে। দেখে বোঝা গেলো কী যেন গভীরভাবে ভাবছে সে। দিগন্তে কোনোকিছুরই কোনো চিহ্ন নেই। ডেভিস কিন্তু তবু উত্তেজিতভাবে পায়চারি ক’রেই চলেছে।

হঠাৎ একবার থমকে থেমে পড়লো সে, বাসকেথের দিকে এগিয়ে এলো। বললে—’আচ্ছা আমরা যদি কাছে গিয়ে দেখি ওরা কী করছে, তাহ’লে কী হ’তে পারে?’

-’কী সর্বনাশ! তুমি কি দস্যুদের কাছে যাবার কথা ভাবছো না কি?’

—’হ্যাঁ! এক তো তাহ’লে জানতে পারবো ওদের কাজ শেষ হয়েছে কিনা, আর দুই তখন বুঝতে পারবো সন্ধ্যার জোয়ারেই ওরা রওনা হবে কি না।’

–’কিন্তু সেটা জেনে আমাদের লাভ কী হবে?’

—’লাভ একটা হবেই।’ ডেভিসের উত্তেজনা ফেটে পড়লো।——না, আমি আর পারছি না। এ-রকম অধীরভাবে হাঁ ক’রে কতক্ষণ কাটানো যায়? একটা কিছু হেস্তনেস্ত না-হলে আমার মন আর শান্ত হবে না।’ সত্যি, ডেভিস যেন খেপে উঠেছিলো।—’এখান থেকে বাতিঘর কত দূরে হবে?’

–’যদি ঐ পাহাড়টা ডিঙিয়ে যাও তাহ’লে মাইল তিনেক হবে।’

——হুঁ। আমাকে যেতেই হবে, বাস্‌কেথ। চারটের সময় রওনা হ’লে ছটা নাগাদ সেখানে পৌঁছে-যাওয়া যাবে। তখন অবশ্য আলো থাকবে, তবে আমাকে যে কেউ দেখতে পাবে না, সে-বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমি তাহ’লে কাছে থেকে ওদের ওপর নজর রাখতে পারবো।’

ডেভিসকে থামাবার কোনো চেষ্টাই করলে না বাস্‌কেথ। বুঝতে পেরেছিলো যে তাকে বাধা দিয়ে কোনো লাভই হবে না। তার নিজেরও কেমন অস্থির লাগছিলো।

ডেভিস বলেই চলেছে, ‘তুমি এখানেই থেকো। তুমি সমুদ্রের ওপর নজর রাখবে। আমি বেশি রাত হবার আগেই ফিরে আসবো।’

তাকে তার প্রস্তাবটা শেষ করতে না-দিয়ে বাসকেথ ব’লে উঠলো— আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।’

এ-অবস্থায় যে নিজেদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হওয়া ভালো হবে না, সেটা বুঝতে পেরেই ঠিক হ’লো যে দুজনে একসঙ্গে বাতিঘরের কাছে যাবে।

চারটে বাজতে তখনো অনেক দেরি। বেলাভূমিতে ডেভিসকে অপেক্ষা করতে ব’লে বাস্‌কেথ নতুন আস্তানায় ফিরে গেলো। সেখানে গিয়ে সে একটা জামা ফালা ফালা ক’রে ছিঁড়ে গিঁট দিয়ে-দিয়ে একটা দড়ির মতো তৈরি করলো, কোমরের বেল্‌টে গুঁজলো ধারালো একটা ছুরি। তারপর দুটো রিভলভার আর কিছু খাবার নিয়ে ডেভিসের কাছে ফিরে এলো। একটা রিভলভার আর কিছু কার্তুজ সে ডেভিসের কাছে দিলে। তারপর দুজনে মিলে কিছু খেয়ে নিলে। খেতে-খেতে ডেভিস বাস্‌কেথের কাছে দড়িটার রহস্য কী জানতে চাইলে। বাস্‌কেথ ভাসা-ভাসা জবাব দিয়ে বললে যে সন্ধের সময় সে সব কথা ভালো ক’রে বুঝিয়ে বলবে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ ক’রে রিভলভার দুটো ভালো ক’রে পরীক্ষা করে নিয়ে দুজনে রওনা হ’য়ে পড়লো। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কথা বলতে-বলতে চলেছে দুজনে। মাইল খানেক হাঁটার পর বাতিঘরের চূড়া নজরে এলো। তখন নতুন উৎসাহে হনহন করে চললো দুজনে। একদমে প্রায় আধ ঘণ্টার বেশি ঐ ভাবে হেঁটে এলো। এখনও অন্তত আধমাইল পথ বাকি। এবার তারা হুঁশিয়ার হ’য়ে সন্তর্পণে চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলতে শুরু করলে। আলোকস্তম্ভের লণ্ঠনঘর থেকে কেউ যদি এদিক পানে তাকায়, তাহ’লে স্পষ্ট দেখতে পাবে তাদের।

লণ্ঠনঘরটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিলো। তখন অবশ্য সেখানে কেউ ছিলো না, তবে কেউ যদি উঠে চারপাশে নজর রাখার জন্যে একবার চোখ বোলায় তাহলেই সর্বনাশ।

ডেভিস আর বাস্‌কেথ পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে চলতে লাগলো। ফাঁকা জায়গায় এলে হামাগুড়ি দিয়ে সে-জায়গাটুকু পার হ’য়ে চললো তারা। তখন প্রায় ছটা বাজে, তারা পাহাড়টার কিনারে এসে পৌঁছুলো। সামনেই বাতিঘর। তীরের কাছে বোম্বেটেদের মধ্যে একটা কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ করলে তারা, একটা তাড়াহুড়োর ভাব, একটা শশব্যস্ত ছুটোছুটি। মেরামতের কাজ প্রায় শেষই হ’য়ে এসেছে তখন, তাই মালপত্র তোলবার উদ্‌যোগ চলেছে দস্যুদের মধ্যে।

রাগে ডেভিসের সর্বাঙ্গ জ্ব’লে যাচ্ছিলো। দাঁতে দাঁত ঘষে সে বললে— শয়তানগুলো দেখছি যাত্রার জন্যে তৈরি।’ তার দু-চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।

–’এরা এক্ষুনি রওনা হয়ে যাবে, অথচ আমাদের আর-কিছুই করবার ক্ষমতা নেই।’ কেমন-একটা অসহায় আক্রোশ ফুটে উঠছিলো তার কথায়।

ভার্গাস তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলো। শুধু-যে ভালোভাবেই সব সারিয়ে দিয়েছে তা-ই নয়, এত তাড়াতাড়ি সে কাজ সেরেছে যে তার ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হ’তে হয়। জাহাজের গায়ে জখমের কোনো চিহ্নই নেই আর। মালপত্র তোলা হ’য়ে গেলেই সের্‌সান্তে ফের সাগর পাড়ি দিতে পারবে।

সময় কখনও বিশেষ-কারুর জন্যে আটকে থাকে না। সময় কেটেই যাচ্ছিলো। সূর্য ডুবে গেলো দিগন্তে, সমুদ্রের জলে। আস্তে-আস্তে অন্ধকার নামতে লাগলো। অথচ—এখন আশ্চর্যই লাগলো দেখে—বোম্বেটেরা যে এক্ষুনি রওনা হবে, তেমন-কোনো লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। টিলার ওপরে, পাথরের আড়ালে, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে, বাস্‌কেথ আর ডেভিস কিছুই স্পষ্ট ক’রে দেখতে পারছিলো না, তবে শুনতে পাচ্ছিলো সবকিছুই। শুনতে পাচ্ছিলো বোম্বেটেদের হৈ-হট্টগোল, চ্যাঁচামেচি, হাসির হুল্লোড় আর ভারি- ভারি জিনিশপত্র টেনে নেবার শব্দ। রাত দশটার পর সে-সবও আর শোনা গেলো না—সব চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তাহ’লে মালপত্র সব তোলা হ’য়ে গেছে? যাত্রার সময় তাহ’লে এগিয়ে এসেছে?

অথচ—কী আশ্চর্য—নোঙর তো তখনো তোলা হ’লো না। পালও খাটানো হয়নি। তখনও তেমনই স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে সের্‌সান্তে-জাহাজ। কী ব্যাপার?

ক্রমে আরো-একটি ঘণ্টা কেটে গেলো। হঠাৎ ডেভিস সজোরে বাকেথের হাতে চাপ দিয়ে বললে—’জোয়ার শুরু হ’লো—ঐ শোনো জলের শব্দ!’

–’এরা কি এখন তবে রওনা হবে না?’

–’আজ না-হোক কাল তো যাবেই।’

–’কালও রওনা হ’তে পারবে না, কোনোদিনই না—’ এই বলেই বাস্‌কেথ হঠাৎ পাথরের আড়াল থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালে।

ডেভিস কী-রকম হতভম্ব হ’য়ে নীরবে তার অনুসরণ করলে। দুজনেই এখন বাতিঘরের দিকে চলেছে। কয়েক মিনিট পরেই দুজনে আলোকস্তম্ভের কাছে এসে দাঁড়ালে। বাস্‌কেথ হাড়ে হাড়ে কী যেন খুঁজলো মাটিতে তারপর একটা জায়গা থেকে একটা পাথর তুলে ফেললো—অমনি মাটির মধ্যে একটা গহ্বর দেখা গেলো। অতিকষ্টে দুজন মানুষ সেই গহ্বরের মধ্যে ঢুকতে পারে। বাস্‌কেথ ফিশফিশ ক’রে ডেভিশকে ভেতরে ঢুকতে বললে। আরো বললে—’বাতিঘরে থাকবার সময় দৈবাৎ আমি এই গহ্বরটা আবিষ্কার করেছিলুম। তখনই আমার মনে হয়েছিলো এ-জায়গাটা একদিন হয়তো কাজে আসবে আমার। ‘

নীরবে তার নির্দেশ-মতো ডেভিস গহ্বরটার ভেতরে ঢুকে পড়লো। তারপর বাস্‌কেথও এসে ঢুকলো তার পেছনে। গায়ে-গা ঠেকিয়ে কোনোমতে দুজন লোক সেখানে গুটিশুটি হ’য়ে থাকতে পারে। ফিশফিশ ক’রে বাস্‌কেথ বললে—’তুমি এখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করো। আমি চটপট কাজ হাসিল ক’রে ফিরে আসছি।

—’অপেক্ষা করবো? কাজ হাসিল করবে?’ জন ডেভিস ভারি অবাক হ’য়ে গিয়েছে তখন।

—’হ্যাঁ আমার জন্যে অপেক্ষা ক’রে থাকবে। আমি দস্যুদের জাহাজে যাচ্ছি।’

—’বোম্বেটে জাহাজে যাবে?’ ডেভিস হতভম্ব।

—’হ্যাঁ।’ দৃঢ় স্বরে বাস্‌কেথ বললে—’বদমায়েশগুলো দ্বীপ ছেড়ে যাতে চ’লে যেতে না-পারে, আমাকে এখন তারই ব্যবস্থা করতে হবে।’

ব’লেই বাস্‌কেথ পকেট থেকে দুটো পুঁটুলি বার করলে। তারপর কোমরের বেল্ট থেকে খুলে নিলে ছুরিটা। পুঁটুলি দুটো দেখিয়ে ডেভিসকে বললে, ‘বারুদ দিয়ে ডাইনামাইটের মতো বিস্ফোরক তৈরি করেছি আমি। ডাইনামাইটের মতো জোরালো অবশ্য হবে না, তবে নেহাৎ সাধারণ বিস্ফোরকও এ নয়। আর শার্ট ছিঁড়ে দড়ির মতন যা বানিয়েছি তা হ’লো সলতে। মাথায় পুঁটুলি দুটো বেঁধে, সাঁতার কেটে ঐ জাহাজে গিয়ে উঠবো। মাস্তুলের কাছে এই বিস্ফোরকটা রেখে সলতেটা জ্বেলেই চ’লে আসবো। যে-ক’রেই হোক আমাকে এ কাজ করতেই হবে।’

—’চমৎকার, কৌশলটা চমৎকার করেছো।’ ডেভিসের হতাশ গলায় এবার উল্লাসের সুর।—’কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এই বিস্ফোরক তুমি তৈরি করলে কখন।’

–’দুপুরবেলা তোমায় যখন তীরে পাহারায় বসিয়ে আমি আমাদের আস্তানায় গিয়েছিলুম, তখনই এগুলো তৈরি ক’রে নিয়েছি—’

–’কিন্তু, কোম্পানিয়েরো, এমন বিপজ্জনক কাজে তোমাকে তো একা ছেড়ে দিতে পারবো না। আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।’

—’খামকা কী দরকার? এ আমি একাই পারবো। যে-কাজ করতে চলেছি, তাতে একজনই যথেষ্ট।’

ডেভিস বাস্‌কেথের কথার দৃঢ় সুর শুনেই বুঝতে পারলে এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই : বাস্‌কেথ কিছুতেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে না—এটা যেন বাকেথের নিজের লড়াই। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বাকেথের প্রস্তাবে রাজি হ’লো।

অন্ধকার এতক্ষণে ঘন হ’য়ে এসেছে। বাস্‌কেথ গা থেকে জামা খুলে জরুরি মাল-মশলা নিয়ে গহ্বরটি থেকে বেরিয়ে প’ড়ে হনহন করে সমুদ্রের দিকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। তারপর সাবধানে জলে ভেসে সে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে জাহাজের দিকে এগুতে লাগলো। জোয়ারের জন্যে ঢেউয়ের শব্দ হচ্ছিলো ব’লে তার সাঁতার কাটার সামান্য যা শব্দ হচ্ছিলো তাও চাপা প’ড়ে গেলো।

অন্ধকারের মধ্যে একটা নিরেট-কালো ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে জাহাজটা। প্রথমে কাউকে সে জাহাজের ডেকে দেখতে পেলো না। কেউ নেই ভেবে বাস্‌কেথ যখন জাহাজে ওঠবার চেষ্টা করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ তার নজর এলো কে যেন জাহাজের রেলিঙের ধারে বসে পাহারা দিচ্ছে। তক্ষুনি সে থমকে গেলো। কী করবে ভাবছে, এমন সময় একটা বেসুরো কর্কশ গলার গানের আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠলো। পাহারাওলা পরমানন্দে গান ধ’রে দিয়েছে।

বাস্‌কেথ জাহাজের নোঙর ধীরে ওপরে ওঠবার চেষ্টা করলে। প্রথমটায় ঝাঁকুনি খেয়ে শেকলটা ন’ড়ে-ওঠার একটা আওয়াজ হ’লো। বাস্‌কেথ তাড়াতাড়ি জাহাজের গায়ে গা লাগিয়ে অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে দিলে। সে-শব্দে পাহারাদারটির কিন্তু রসভঙ্গ হয়নি—সে একটানা চেঁচিয়েই চলেছে।

এবার নিঃশব্দে, আস্তে-আস্তে, নোঙরটা ধ’রে ওপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগলো বাস্‌কেথ। অনেক হয়রানির পর সে শেষটায় রেলিঙের ধারে গিয়ে পৌঁছুলো। পাহারাদারটি গান গেয়েই চলেছে।

বিস্ফোরকের বাণ্ডিল দুটো সন্তর্পণে মাস্তুলের কাছে ডেকের ওপর রাখলে বাস্‌কেথ। তারপর তাতে সলতে লাগিয়ে দেশলাইটা বার করলে পুঁটুলি থেকে। না, জলে ভেজেনি দেশলাইটা।

সবকিছু ঠিক ক’রে অতি সন্তর্পণে, নিঃশব্দে, আস্তে দেশলাই জ্বেলে সে সলতেটায় ধরিয়ে দিলে। তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না-ক’রে সে নোঙরের শেকল বেয়ে নামতে লাগলো। এত সহজে কাজটা করা যাবে ব’লে সে ভাবতে পারেনি।

ঝপাং ক’রে আচমকা একটা আওয়াজ হ’লো। শেকল থেকে হাত ফসকে জলে প’ড়ে গিয়েছে বাস্‌কেথ!

তক্ষুনি পাহারাদারটির সংগীত থেমে গেলো। বাস্‌কেথ জল থেকে লক্ষ করলে লোকটা রেলিং ধ’রে ঝুকে প’ড়ে দেখবার চেষ্টা করছে কীসের শব্দ হ’লো। বাস্‌কেথ নিঃশব্দে ডুবসাঁতার দিয়ে ফিরে চললো তীরের দিকে।

মিনিট খানেক জলের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে না-পেয়ে পাহারাদারটি ফের তার জায়গায় গিয়ে বসলো।

এদিকে গহ্বরটার মধ্যে ব’সে-ব’সে ডেভিস ভাবছিলো যে অনন্তকাল ধরে সে একা-একা ব’সে আছে তো ব’সেই আছে। আধ ঘণ্টা—পৌনে-এক ঘণ্টা—একটি ঘণ্টাই কাবার হয়ে গেলো। আর সে থাকতে পারলে না। গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে উদ্বিগ্ন চোখে সমুদ্রের দিকে তাকালে। ঈশ্বর না-করুন, বাসকেথের ভালোমন্দ কিছু-একটা হ’লো নাকি! কী হ’লো তবে? তবে কি সে জাহাজে উঠতে পারেনি? চেষ্টাটা কি তাহ’লে জলে মারা গেছে? কিছুই সে বুঝতে পারছিলো না।

হঠাৎ একটা সাংঘাতিক বিস্ফোরণের শব্দে স্তব্ধ রাত্রির অন্ধকার ভেঙে- চুরে গুঁড়িয়ে গেলো। সঙ্গে-সঙ্গে ভেসে এলো হৈ-চৈ, চ্যাঁচামেচি, শোরগোল, আর্তনাদ।

আর ঠিক তক্ষুনি জল থেকে উঠে এলো একটি লোক! ছুটে ডেভিসের কাছে এসে তার হাত ধ’রে ঢুকে পড়লো গহ্বরটার মধ্যে। গহ্বরের ভেতরে ঢোকবার আগে সেই পাথরটাকে সে এমনভাবে রাখলে যাতে বাইরে থেকে সহজে এই গহ্বরের কোনো হদিশ পাওয়া না-যায়।

একটু পরেই তারা শুনতে পেলে কার যেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। ‘জলদি, শিগগির চলো। এবার হতভাগাটাকে নাগালে পেয়েছি।’

–’ঠিক তোমাকে যেমন দেখতে পাচ্ছি, তেমনি ঐ লোকটাকেও আমি দেখতে পেয়েছিলুম।’ হাওয়ায় অন্য একটা স্বর ভেসে এলো—’লোকটা একা ছিলো—একেবারেই একা।’

—’এতক্ষণে নিশ্চয়ই একশো গজও যেতে পারেনি—’

—’একবারে যেন শয়তানের বাচ্ছা! যে-ক’রেই হোক, ওর মুণ্ডুটা আমার চাইই—’ ক্রমশ শোরগোল দূরে মিলিয়ে গেলো।

ফিশফিশ ক’রে ডেভিস বললে—’কাজ হাসিল হয়েছে ব’লে মনে হ’লো?’ -’মনে তো হচ্ছে। তবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কতটুকু ক্ষতি হয়েছে।’

বিস্ফোরণের আওয়াজটা এমনই সাংঘাতিক হয়েছিলো যে ক্ষতির বহরটা গুরুতর বলেই মনে হচ্ছিলো তাদের। কিন্তু এখানে ব’সে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছিলো না।

-’ঈশ্বর করুন, ঐ বদমায়েশগুলোকে যেন আরো-একমাস দ্বীপে থাকতে হয়।’

—’শ্‌শ্‌শ্‌! চুপ!’ বাস্‌কেথ সজোরে ডেভিসের হাতে চাপ দিলে। কয়েকজন লোকের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এদিক পানেই আসছে। সারাটা রাত আর সকাল জুড়েই বাস্‌কেথদের খোঁজে প্রায় পাগলা কুকুরের মতো হন্যে হ’য়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বোম্বেটেরা। তারপর কিন্তু খোঁজাখুঁজিতে ঢিলে পড়লো। কাঁহাতক আর আন্দাজে-আন্দাজে ঘুরে মরা যায়? বাস্‌কেথ আর ডেভিস ঐ গহ্বরের মধ্যে থেকেই লোকগুলোর পায়ের আওয়াজ আর কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিচ্ছিলো।

হঠাৎ একসময়, অনেকক্ষণ যখন চারপাশে কোনো আওয়াজ শোনা গেলো না, তখন তারা ধরে নিলে যে লোকগুলো এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাদের খুঁজে-পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছে। এ-রকম মনে হ’তেই তারা গহ্বরটা থেকে বেরুবার চেষ্টা করবে ব’লে যেই মুখের কাছের পাথরটা সরাতে গেছে, অমনি আবার কার গলা শোনা গেলো। ‘না। সত্যিই লোকটাকে কোখাও খুঁজে পাওয়া গেলো না! তাজ্জব ব্যাপার! লোকটা যেন একেবারে হাওয়ায় মিশে গেছে।’

-–‘বাদ দাও।’ অন্য কার গলা।—’আর-সবাই জাহাজে গিয়ে উঠেছে। চলো, এবার আমরাও গিয়ে উঠি।’

—’হ্যাঁ। আমাদেরও জাহাজে গিয়ে ওঠা উচিত। শয়তানটার তাগ ফসকেছে ব’লেই বাঁচোয়া। আরেকটু হ’লেই জাহাজটা একদম গুঁড়িয়ে যেতো।’

তাহ’লে জাহাজের গুরুতর-কোনো ক্ষতি হয়নি! বোম্বেটেরা তাহ’লে দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাবে!

বাস্‌কেথ আর ডেভিস উৎকর্ণ হ’য়ে তাদের কথা শুনতে লাগলো।

–’সত্যিই, কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছে জাহাজটা। বরাত ভালো ছিলো ব’লেই শয়তানটার মতলব ভেস্তে গিয়েছে। সে কিনা জাহাজের মাস্তুলটাই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো।’

—’সত্যি, বড়োজোর বেঁচে-যাওয়া গেছে এ-যাত্রায়!’

—’হ্যাঁ। বিস্ফোরকটা হাউইয়ের মতো জাহাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে ব’লেই এবারকার মতো রক্ষা পাওয়া গেছে। শুধু ডেকের কিছুটা অংশ উড়ে গিয়েছে। তাতে এমন-কিছু সাংঘাতিক ক্ষতি হয়নি।’

-’আজ আর-কোনো গোল হবে ব’লে মনে হয় না।’

হঠাৎ আরেকজনের রূঢ় কর্কশ গলা ভেসে এলো, ‘কী? তোমাদের বিশ্রাম করা হ’লো! খামকা ওখানে বসে বক্তৃতা করলে চলবে? শিগগির চ’লে এসো।’

গহ্বরের মধ্যে ব’সে মুখ চাওয়াচাউয়ি করছিলো বাস্‌কেথ আর ডেভিস। কী ব’লে গেলো দস্যুরা?

বাস্‌কেথের চোখ দুটো জলে ভরে গেলো। ভাঙা গলায় বললে—’সব আশাই যে নষ্ট হ’য়ে গেলো, কোম্পানিয়েরো।’

ডেভিস নিজেও বিষম মুষড়ে পড়েছিলো। সে আর সান্ত্বনা দেবে কী? কী হবে সান্ত্বনা দিয়ে? আর কী সান্ত্বনাই বা সে দিতে পারে?

কী লাভ হ’লো এই মরিয়া চেষ্টায়, এই বিষম দুঃসাহসে? প্রাণ তুচ্ছ করে বাস্‌কেথ যে জন্যে গিয়েছিলো, তাতে কতটুকু ক্ষতি হ’লো জলদস্যুদের? মাত্র কয়েক ঘণ্টাই দেরিই হলো শুধু! কালই ওরা রওনা হ’য়ে পড়বে!

গহ্বরটা থেকে আর বেরুবার সুযোগ পেলে না তারা। একটু পরেই আকাশ পরিষ্কার হ’য়ে উঠলো। ভোর হলো ব’লে।

বাস্‌কেথ জানতো রাতের আঁধারে বোম্বেটেরা তাদের দেখতে না-পেলেও দিনের আলোয় নির্ঘাৎ তাদের দেখে ফেলবে। সে তখন ডেভিসের সাহায্যে পাথরটাকে আরো ভালো ক’রে গহ্বরের মুখে টেনে দিলে। ভেতর থেকে পাথরটাকে গহ্বরের মুখে এনে চাপা দিতে বেশ হয়রানই হ’তে হয়েছিলো তাদের। অবশেষে অনেকবারের চেষ্টায় পাথরটাকে জায়গামতো এনে বসানো গেলো। শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে হাওয়া যাতে ঢোকে, সেজন্যে সামান্য একটু ঘুলঘুলির মতো ফাঁক রেখে পাথরটা দিয়ে তারা গহ্বরের মুখে চাপা দিয়ে ফেললো।

ক্রমে বেলা বেড়ে গেলো। তারা আন্দাজ করলে যে বোম্বেটেরা নিশ্চয়ই এবার রওনা হবার জন্যে তোড়জোড় শুরু করেছে। সন্ধের পর জোয়ার এলেই জাহাজ ছেড়ে দেবে।

বেলা গড়িয়ে এলো।

এত ধকলে, আর রাতে একফোঁটাও না-ঘুমুবার ফলে, তাদের একটু ঢুলুনি মতো এসেছিলো, হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় আওয়াজে তাদের চটকা ভেঙে গেলো। তাহ’লে নোঙর তোলা হচ্ছে এখন! একটু বাদেই জলদস্যুরা দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাবে। বাস্‌কেথ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলে না। পাথরটাকে সরিয়ে একটু উঁকি দিলে বাইরে।

অস্তসূর্য যখন পাহাড়ের চূড়ার আড়ালে ঢলে পড়েছে; একটু বাদেই সন্ধ্যা হ’য়ে যাবে, অন্ধকার নামবে।

না, এখনও জাহাজের নোঙর তোলা হয়নি। তবে তোলবার জন্যে উদ্‌যোগ-আয়োজন চলছে বটে। বিস্ফোরণের দরুন কোনো জায়গা ভেঙে গেছে কি না, অ্যাদ্দুর থেকে বোঝা গেলো না। না, লোকগুলো ঠিকই বলেছে : বিস্ফোরণে তেমন-কোনো ক্ষতি হয়নি জাহাজের। সব ঠিকঠাক, দুরস্ত দেখাচ্ছে। এখন আর বিপদের আশঙ্কা করে কী লাভ? কপালে যা আছে, তা-ই ঘটবে। গহ্বরটা থেকে বেরিয়ে এলো বাস্‌কেথ। পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে সে লুকিয়ে দাঁড়ালে। তার পেছন থেকে তার কাঁধের ওপর দিয়ে ডেভিসও তাকালে জাহাজের দিকে। তার মনে সাংঘাতিক তোলপাড় চলেছে উত্তেজনায়।

বোম্বেটেদের প্রায় সকলেই গিয়ে জাহাজে উঠেছে, শুধু জনাকয়েক এখনও তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তীরে যারা ছিলো, তাদের মধ্যে কন্‌গ্রে আর সের্‌সান্তেকে চিনতে পারলে বাস্‌কেথ। কন্‌গ্রে আর সের্‌সান্তে তখন বাতিঘরের দিকে যাচ্ছে।

বাস্‌কেথ নিচু স্বরে ডেভিসকে সাবধান ক’রে দিলে—হুঁশিয়ার! ওরা বাতিঘরের দিকে আসছে কিন্তু।’

দুজনে তক্ষুনি গহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়লো।

সের্‌সান্তে শেষবারের মতো চারদিক দেখে নেবার জন্যে বাতিঘরে আসছিলো, এক্ষুনি তারা রওনা হবে, জাহাজ তৈরি। যাত্রার আগে আরেকবার দিগন্তের উপর নজর বোলাতে চায় নিশ্চয়ই–হয়তো দেখতে চাচ্ছে কোনো জাহাজ চোখে পড়ে কি না।

রাতটা ভালোই যাবে বলে মনে হচ্ছিলো তার। হাওয়ায় তেমন উদ্দাম গতি নেই, সমুদ্রও শান্ত

সের্‌সান্তে যখন আলোকস্তম্ভের ভেতর ঢুকলো, ডেভিস আর বাস্‌কেথ তখন তাকে ভালো ক’রেই দেখতে পেলে। লণ্ঠনঘরের প্রত্যেকটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলো সের্‌সান্তে। চোখে দুরবিন এঁটে সবকিছু দেখছিলো ভালো ক’রে।

সমুদ্র দিগন্তে গিয়ে আকাশের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। নজরে পড়ে শুধু কালো একটি রেখা যেখানে আকাশ নেমে এসে মিলেছে সমুদ্রের সঙ্গে। পৃথিবীকে তখন দিনশেষের অভিনন্দন জানাচ্ছে যেন সূর্য। সাদা হালকা মেঘগুলো রঙিন হ’য়ে উঠেছে, লাল। সমুদ্রের নীল জলে যেন আবিরের গুঁড়ো ঝ’রে পড়ছে। দিনের আলো ক্রমেই নিভে যাচ্ছে। কিন্তু নিভতে গিয়েও যেন পুরোপুরি নিভে যেতে চাচ্ছে না। তাই অস্তসূর্যের লালসোনালি আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শান্ত-নীল সমুদ্রকে অপরূপ লাগছিলো দেখতে। কিন্তু সে-দৃশ্য দেখবার অবসর নেই সের্‌সান্তের আচমকা সে তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। কন্‌গ্রে আর অন্যান্যরা নিচে থেকে তার দিকে তাকালে অবাক হয়ে। কী ব্যাপার!’

সর্বজনবোধ্য ভাষায় সুস্পষ্ট স্বরে সের্‌সান্তে যা ঘোষণা করলে, সকলেই তা ভালো ক’রে শুনতে পেলে।

সের্‌সান্তে বললে :—সান্তা-ফে! সান্তা-ফে এসে পড়লো ব’লে!’

সান্তা-ফে! বোম্বেটেদের মাথায় বিনামেঘেই যেন বাজ ভেঙে পড়লো।