০৬. রাত্রি একটানা

৬. রাত্রি একটানা

দিনের আলো নিভে যেতেই স্টটেন আইল্যাণ্ডের ওপর রাতের আঁধার নেমে এলো। বাতিঘরে আলো জ্বালানো হয়নি ব’লে অন্ধকার আরো নিবিড় ঘন। তার ওপর হিম কুয়াশা পড়ছে আজ। সাঁ-সাঁ ক’রে সমুদ্র থেকে ব’য়ে আসছে তীব্র হাওয়া। হয়তো ঝড় উঠবে। কী-রকম থমথম করছে সব! রাতটাকে মনে হচ্ছে ভয়াল-কিছু, করাল। বাকেথের চোখের সামনেই তো একটু আগে অতর্কিত মৃত্যু হানা দিয়ে গেছে—তার সহকর্মীরা সম্পূর্ণ অকারণে খুন হ’য়ে গেছে।

শীত শেষ হ’য়ে গিয়েছে, অথচ আজকের রাতটা বাস্কেথের কাছে ঘোর শীতের কোনো অন্ধকার রাত ব’লে মনে হচ্ছে। সে যে হি-হি ক’রে কাঁপছে, সে কি ঠাণ্ডার জন্যে, না কি এই কাঁপুনি উঠে আসছে আতঙ্ক থেকে? বাকেথের চারপাশে এক দুর্বোধ্য আঁধার রাত নেমে এসেছে। তার হতভাগ্য বন্ধুদের রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে জলে—তারও তো ঐ দশাই হ’তো যদি-না সে দৈবাৎ লণ্ঠনঘরে সে-সময় একটা জরুরি কাজে আটকে যেতো।

দারুণ মনখারাপ হ’য়ে গেলো বাকেথের। এই কিছুদিনের মধ্যেই সে তার নতুন বন্ধুদের ভালোবেসে ফেলেছিলো। তারা অনেক বছর একসঙ্গে কাজ করেনি সত্যি, কিন্তু, একসঙ্গে তারা বাতিঘরের কাজের জন্যে আবেদন করেছিলো, আর একসঙ্গেই বুঝে নিয়েছিলো বাতিঘরের ভার। কিন্তু এখন এই দ্বীপটায় সে-যে শুধু সঙ্গীসাথীহীন একা মানুষ তা-ই নয়, তার জন্যে ওৎ পেতে আছে নিশ্চিত মৃত্যু, জনাকতক মানুষমূর্তির ছদ্মবেশে।

কিন্তু স্কুনারটা কাদের? কেনই বা স্টটেন আইল্যাণ্ডে নোঙর ফেলেছে? কী মলব এই লোকগুলোর? বোম্বেটেগুলো এই দ্বীপে যে নতুন আসেনি, তা তাদের হাবভাব দেখেই বাস্‌কেথ বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু কী করতে চাচ্ছে এরা? কেন তারা দ্বীপে নেমেই বাতিঘরের আলো নিভিয়ে দিলে? বাতিঘরের সাথে তাদের এই দুশমনি কীসের? কোনো জাহাজ যাতে তাদের অনুসরণ ক’রে এখানে না-আসতে পারে, সেই জন্যেই কি তারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে?

এ-সব হিংটিংছট প্রশ্নের উত্তর বাস্‌কেথ জানে না। তাদের কাছাকাছি বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ-সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মানেই হ’লো অপঘাত মৃত্যুকে ডেকে আনা। তা সে করবে না। তবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা মস্ত ভুল সে ক’রে ফেলেছে এর মধ্যেই। বাতিঘর থেকে পালিয়ে-আসার সময় কোনো কাগজপত্র সে নিয়ে আসেনি। সেগুলো থেকে সহজেই জলদস্যুরা তার উপস্থিতির কথা জেনে যাবে। আর তারপর…

বাকিটা আর ভাবতে পারলে না বাস্‌কেথ। তীর থেকে দুশো গজ দূরে একটা প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো সে। সেখান থেকে জাহাজের ডেকে তীরের বালিয়াড়িতে আর বাতিঘরের দুর্বৃত্তদের আলোর নড়াচড়া চোখে পড়ছিলো তার। মাঝে-মাঝে জোর গলায় হাঁকডাকও শুনতে পাচ্ছিলো সে।

রাত দশটা নাগাদ আস্তে-আস্তে সব আলোই নিভে গেলো। স্টটেন আইল্যাণ্ডের বুকে সুষুপ্তি এসে জমাট বেঁধেছে এখন।

এখন সে যেখানে আছে সেখানে আর-কোনোমতেই থাকা চলে না : দিনের আলো ফোটবামাত্র তারা তার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। এবং তখন যে এই দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে সামান্যতম দয়াও পাওয়া যাবে না, সেটা সে ভালো করেই জানে। যে-ক’রেই হোক, এদের হাত থেকে তাকে রেহাই পেতেই হবে। কিন্তু যাবে কোথায়? দ্বীপের গভীরে? উপসাগরের প্রবেশমুখে? উঁহু, না, মিথ্যে এ-সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখান থেকে তাকে সটকে পড়তে হবেই—এবং সান্তা-ফে যদ্দিন-না ফিরে আসে, তদ্দিন তাকে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাড়াতাড়িতে সঙ্গে যে-রসদ নিয়ে এসেছে তাতে তো দিন তিনেকের বেশি চালানো যাবে না। তারপর কী করবে সে? যদি কোথাও লুকোতেও পারে, তার খাদ্য জুটবে কোত্থেকে? এ-অবস্থায় খোলামেলায় বেরিয়ে গিয়ে মাছ ধরার চেষ্টাও করা যাবে না। আর আগুনই বা জ্বালাবে কী ক’রে?

শেষ অব্দি সে সাহসে বুক বেঁধে ঠিক করলে যখন যা ঝামেলা পাকাবে, তখনই তার সমাধান করা যাবে। এখন তো সান হুয়ান অন্তরীপের বেলাভূমিতে রাতটা কাটানো যাক, পরে ভেবে-চিন্তে যা-হয় একটা-কিছু ঠিক করা যাবে। মনে-মনে এ-কথা ভেবে সে স্কুনারটির দিকে তাকালে। না, সেখান থেকে কোনো আলো বা আওয়াজের রেশ পাওয়া যাচ্ছে না। শয়তানগুলো নিশ্চয়ই নিজেদের নিরাপদ মনে ক’রে এখন আরাম ক’রে ঘুমুচ্ছে।

বাস্‌কেথ টিলার তলা দিয়ে উত্তরমুখো চলতে শুরু করলে। থমথম করছে রাত, হাওয়া আর জলের শব্দ ছাড়া আর-কোনো শব্দ নেই। সে যখন অন্তরীপের শেষ মাথায় এসে পৌঁছুলো, রাত তখন প্রায় এগারোটা। একটা সমতল জায়গা খুঁজে নিয়ে সে মাটিতে শুয়েই রাতটা কাটিয়ে দিলে। ঘুম ভাঙলো পরদিন সূর্য ওঠবার আগেই। প্রথমেই চোখ রগড়ে সে আশপাশে ভালো ক’রে তাকিয়ে নিলে। না, কোনোদিকেই কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রতীরেও কোনো কোনো নৌকো নেই। মউলের নিজস্ব নৌকো আর আলোকরক্ষীদের ডিঙি—দুইই এখন এই দুর্বৃত্তদের হাতে। দূর সমুদ্রেও কোনো নৌকো বা জাহাজের চিহ্ন নেই।

বাতিঘর তৈরির আগে এদিকটায় নৌচালনা যে কী ভয়াবহরকম কঠিন ছিলো, সেটা বাকেথের মনে প’ড়ে গেলো। বিড়বিড় ক’রে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সে নিজেকেই শোনালে, শয়তানগুলো বাতিঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছে। নিজেদের দরকার না-পড়লে সে-আলো আর কখনোই তারা জ্বালবে না। শয়তানের বাচ্চা!’

সত্যি, বাস্‌কেথের রাগ করার কারণ ছিলো। আলো নেভাবার পরিণাম ভয়ংকর হ’য়ে উঠতে পারে। একটা পাথরের ওপর ধপ ক’রে ব’সে প’ড়ে বাস্‌কেথ ফের পূর্বাপর ঘটনাগুলো তলিয়ে দেখলো, আর তক্ষুনি টের পেলে সে কী ভয়ংকর অবস্থায় এসে পড়েছে। কিন্তু কী করতে পারে সে এখন? একা-একা?

কিছুই না। সান্তা-ফের ফিরে-আসার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই আর তার করার নেই। কিন্তু তার ফিরতে-ফিরতে তো এখনও আরো দু-মাস। যদি এটা ধ’রেও নেয় যে এতদিনের মধ্যে সে দস্যুদলের হাতে পড়বে না, তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়—কী ক’রে সে এতদিন টিকে থাকবে?

প্রথমেই এক আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে। বাতিঘরের সবকিছু দেখে-শুনে দস্যুরা নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছে যে এখানে সবশুদ্ধু তিনজন আলোকরক্ষী ছিলো। নিরুদ্দেশ তৃতীয়জনকে খুঁজে বের করতে নিশ্চয়ই তারা হন্যে হ’য়ে উঠবে।

ভাবতে-ভাবতে বাস্‌কেথ শেষটায় তার স্বাভাবিক শক্তি ফিরে পেলে। হতাশায় দ’মে যাবার পাত্র বাস্‌কেথ নয়।

কিছুক্ষণ তন্নতন্ন ক’রে খোঁজবার পর পাহাড়ের গায়ে সে একটা সংকীর্ণ গুহা আবিষ্কার করলে। দশফিট গভীর আর পাঁচ-ছ ফিট চওড়া হবে গুহাটি। ভেতরে বিছিয়ে আছে মসৃণ মিহি বলির আস্তর। ভালো ক’রে খেয়াল ক’রে দেখে সে বুঝতে পারলে, জোয়ারের জল বা ঝড়ের আক্রমণ এই গুহায় পৌঁছুতে পারবে না। সেই সংকীর্ণ মুখটা দিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকে সে বাতিঘর-থেকে আনা তার যৎসামান্য জিনিশপত্র ভরা ব্যাগটা নামিয়ে রাখলে। গুহার পাশেই সে বরফ-গলা জল দিয়ে গ’ড়ে-ওঠা একটা ঝিলের খোঁজ পেয়েছিলো। অতএব পানীয় জলের অভাবে মরবার সম্ভাবনা আপাতত নেই।

কিছু শুকনো জারানো মাংস আর কয়েকটা বিস্কুট গলাধঃকরণ ক’রে সে কিছুটা চাঙা হ’য়ে উঠলো। তারপর জল খাবে ব’লে বাইরে যেতে গিয়ে কীসের একটা আওয়াজ শুনে সে থমকে দাঁড়ালে। বদমায়েশগুলো তাহ’লে তার খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়েছে! গুহার দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সে সাবধানে বাইরে তাকালে। দেখতে পেলে, একটা নৌকোয় ক’রে চারজন লোক দ্বীপের এদিকটায় আসছে। দুজন ব’সে আছে, আর বাকি দুজন নৌকো চালাচ্ছে। নৌকোখানা বাতিঘরের নয়। তার মানে, স্কুনারটিরই নিজস্ব ডিঙি। তারা যে এই দ্বীপে নতুন আসেনি, তা তাদের নৌকো চালাবার কায়দা থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

বাস্‌কেথ তার ঐ আড়াল থেকেই লোকগুলোকে ভালো ক’রে লক্ষ করতে লাগলো। যে-লোকটা হাল ধ’রে ব’সে আছে তাকেই তার সর্দার ব’লে মনে হ’লো : নিশ্চয়ই সেই স্কুনারটির কাপ্তেন। নৌকোটি তখন বাস্‌কেথ যেখানে আছে, তার প্রায় শ-খানেক গজ নিচে হবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। সর্দার লোকটি ইশারা করতেই নৌকোটা তীরে ভেড়ানো হ’লো। বেলাভূমির কাছে নোঙর ফেলবার পর তারা তীরে নামলে, এবার তাদের কথাবার্তাও কানে এলো বাস্‌কেথের।

‘এ-জায়গাটাই তো?’

‘নিশ্চয়ই। পাহাড়টার বাঁকে, এখান থেকে বিশগজটাক দূরে হবে।’

‘আলোকরক্ষীরা যে গুহাটি আবিষ্কার করতে পারেনি, সে আমাদের মস্ত সৌভাগ্য।’

‘এমনকী দেড় বছর ধ’রে যারা বাতিঘর তৈরি করছিলো তারাও ওটা আবিষ্কার করতে পারেনি।’

‘হ্যাঁ। সবসময় তারা নিজেদের কাজ নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিলো।’

‘তাছাড়া গুহার মুখটা যেভাবে আটকে রাখা হয়েছিলো তাতে সেটা আবিষ্কার করা খুব সহজ কাজ ছিলো না। ‘

‘চ’লে এসো।’ সর্দারগোছ লোকটার গলা।

কোনাকুনি বালিয়াড়ি পেরিয়ে দুজন সঙ্গীকে নিয়ে চলতে লাগলো সর্দার। লুকোনো জায়গা থেকে বাস্‌কেথ তাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখলে। তাদের কথাবার্তা শুনতেও এতক্ষণ তার কোনো অসুবিধে হচ্ছিলো না। খানিকক্ষণ বাদেই তাদের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেলো। শুধু দেখা গেলো, নৌকোর আশপাশে একটি লোক হাঁটাহাঁটি করছে।

তাহ’লে কাছেই এদের একটা গুহা আছে! এখন আর তার বুঝতে কোনোই অসুবিধে হ’লো না যে এরা একদল জলদস্যু এবং বাতিঘরের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই এরা স্টটেন আইল্যাণ্ডে ঘাঁটি গেড়ে ছিলো। দস্যুগুলো তাহ’লে এই গুহাটাতেই লুঠপাটের মাল লুকিয়ে রেখেছে। এবার কি তাহ’লে ঐ স্কুনারে ক’রে লুঠের মাল সরিয়ে ফেলার মতলবে আছে এরা?

হঠাৎ বাসকেথের খেয়াল হলো, আরে, সে তো গুহায় লুকিয়ে-রাখা এদের রসদপত্তরের সুযোগ নিতে পারে। নেয়াটা খুবই জরুরি। ভাবনাটা মনে জেগে উঠতেই সে যেন আশার আলো দেখতে পেলে এতক্ষণে। নৌকোটা চ’লে গেলে এদের ঐ গুহা থেকে কিছু খাবারদাবার এই গুহায় নিয়ে-আসা যাবে। সান্তা-ফের ফিরে আসা অব্দি খাবারের জন্যে তাহ’লে তার আর তেমন অসুবিধে হবে না। সে তখন মনে মনে প্রার্থনা করলে, সান্তা-ফের ফিরে-আসা অব্দি এই দস্যুগুলো যেন দ্বীপ ছেড়ে চ’লে না-যায়। তারপর দেখা যাবে তাদের কত ক্ষমতা! তার বন্ধুদের হত্যার জন্যে মাশুল এদের দিতেই হবে—এদের কিছুতেই ছেড়ে দেয়া চলে না।

সান্তা-ফে ফিরে-আসা অব্দি এরা দ্বীপে থাকবে কি না, সে-সম্বন্ধে খোঁজ নেবে বলে ঠিক করলে বাস্‌কেথ।

ঘণ্টাখানেক বাদে দস্যু তিনজন তাদের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে নৌকোর দিকে চলতে লাগলো। তার গোপন জায়গা থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে মনে-মনে খুশি হ’য়ে উঠলো বাস্‌কেথ।

‘আলোকরক্ষীরা বড়ো ভালো ছিলো হে! অন্যের ব্যাপারে মিথ্যে তারা নাক গলায়নি। মালপত্র সবই ঠিক আছে।’

‘যাত্রার সময় মউল একেবারে ঠাশাঠাশি বোঝাই হ’য়ে যাবে।’

‘অত রসদ আছে বলে অনেক ঝামেলা বেঁচে গেলো।’

‘প্যাসিফিক আইল্যাণ্ডস-এ পৌঁছুবার আগে সে-সব বেশি খরচ করা চলবে না আমাদের।’

এইসব কথা বলতে-বলতে প্রাণ খুলে হাসাহাসি করছিলো তারা। তাদের হাসির শব্দ শুনে বাস্‌কেথ রাগে যেন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছিলো, গুলি ক’রে এদের মুখের হাসি বন্ধ ক’রে দেয়। কিন্তু উত্তেজনা একটু প্রশমিত হ’লে সে বুঝতে পারলে যে ও-রকম পাগলামো না-ক’রে সে ভালোই করেছে।

দুনিয়ার শেষ সীমানার সবেধন বাতিঘরটি এবার অন্ধ হ’য়ে পড়লো— এই ব’লে একজন দস্যু হো-হো করে হেসে উঠলো।

‘মউল এখান থেকে যাত্রা করার আগেই আলো নেই ব’লে, আশপাশের পাহাড়গুলোয় ঘা লেগে দু-একটা জাহাজডুবি হবে ব’লেই মনে হচ্ছে আমার তাহ’লে সে-সব জাহাজের মালপত্রও আমাদের দখলে এসে যাবে।’

‘এবার আমাদের কপাল খুলে গেছে ব’লেই মনে হচ্ছে। একটা স্কুনার এসে সেন্ট বার্থোলোমিউর তীরে ভিড়লো, অথচ তাতে কোনো লোকজন নেই। সমস্ত ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।’

বা কেথের বুঝতে আর-কোনো অসুবিধে রইলো না কী ক’রে মউল এই জলদস্যুগুলোর হাতে গিয়ে পড়েছে।

একজন জিগেস করলে, ‘এখন তাহ’লে কী করা হবে, কন্‌গ্রে?’

বা কেথের যাকে সর্দার ব’লে ধারণা হয়েছিলো, সেই লোকটাই জবাব দিলে, ‘মউলে ফিরে-যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?’

‘তাহ’লে কি এক্ষুনি গুহা সাফ করতে শুরু করে দেবো?’

‘না, মেরামতি শেষ না-হওয়া অব্দি জাহাজে মাল তোলা চলবে না। মেরামত শেষ হ’তে কয়েক হপ্তা লেগে যাবে ব’লে মনে হচ্ছে।’

আরেকজন বললে, ‘তাহ’লে কিছু-কিছু যন্ত্রপাতি নৌকোয় তোলা উচিত, কী বলো?’

‘হ্যাঁ! মেরামতির জন্যে যা-কিছু লাগবে সবই নিয়ে যেতে হবে।’

‘তাহ’লে মিছেমিছি আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। শিগগিরই জোয়ার এসে যাবে। সেই সুযোগ আমাদের নেয়া উচিত।’

‘তাই ভালো।’ যার নাম কন্‌গ্রে, সে-ই জবাব দিলে। ‘স্কুনারটা সারাই হ’য়ে গেলেই মালপত্র বোঝাই করবো। এখন তো আর চুরির কোনো ভয় নেই।’

‘এ-কথা কিন্তু ভুলো না, ওস্তাদ, যে বাতিঘরে তিনজন লোক ছিলো, তাদের একজন আমাদের হাত এড়িয়ে পালিয়েছে।’

‘তাকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে, সের্‌সান্তে। সে-লোকটা না-খেতে পেয়েই অক্কা পাবে। এছাড়া আমরা তো গুহার আশপাশেই থাকছি।’

কিছুক্ষণ বাদে লোকগুলো কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়ে নৌকোয় তুললো। তারপরেই নৌকোটা তাদের নিয়ে টিলার আড়ালে অদৃশ্য হ’য়ে গেলো।

বাস্‌কেথ যখন বুঝতে পারলে যে আপাতত তার আর ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন সে তার গুহা থেকে বেরিয়ে বেলাভূমিতে এসে দাঁড়ালে। তার সামনে এখন দু-দুটো মস্ত কাজ। এক, কয়েক হপ্তা কাটাবার মতো খোরাক জোগাড় করা, আর দুই, যে-কোনো উপায়ে মউলের যাওয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা। প্রথমটি না-হয় করা যাবে, কিন্তু দ্বিতীয়টি কীভাবে সম্ভব হবে? কী ক’রে সান্তা ফে ফিরে না-আসা অব্দি মউলকে এখানে আটকে রাখা যাবে? সে-সম্পর্কে তার মাথায় কোনো ফন্দিই জোগালো না। হ্যাঁ, তবে আরেকটা কাজ সে করতে পারে। কখনও যদি সান হুয়ান অন্তরীপের ধার ঘেঁষে কোনো জাহাজ চলে, তবে সে সংকেতে তাকে থামতে বলতে পারে, অথবা সমুদ্রে সাঁতার কেটে সেই জাহাজে উঠে সবকিছু খুলে ব’লে হত্যার প্রতিশোধ নেবার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু আপাতত যেহেতু কোনো জাহাজই ধার-কাছ দিয়ে চলছে না, সে-কাজটা না-হয় মুলতুবি রাখা গেলো। আদৌ কোনো জাহাজ এর মধ্যে এখান দিয়ে যাবে কি না, তা-ই বা কে জানে। আর গেলেই যে বা কেথের সংকেত বুঝে থামবে, এমন-কোনো নিশ্চয়তাও নেই।

নিজের নিরাপত্তার জন্যে বাস্‌কেথ তেমন উদ্বিগ্ন হয়নি। দস্যুদের হাত এড়াবার জন্যে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে—আগে থেকে সে নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। এখন তার প্রধান কাজ : রসদ সংগ্রহ। তাই সে তক্ষুনি বোম্বেটেদের গুহার দিকে পা বাড়ালে।

কন্‌গ্রে আর তার দলবল চেষ্টা করছিলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মউলকে যাতে মেরামত ক’রে সাগরপাড়ির উপযোগী ক’রে তুলতে পারে। কাজটা এমনিতে কঠিন, এখানে তো আর জাহাজ মেরামতের জন্যে কোনো কারখানা নেই। তবে ছুতোর হিশেবে ভার্গাসের দক্ষতা আছে, সবরকম যন্ত্রপাতিও হাতে আছে, তাই বেশ ভালোভাবেই কাজ এগুতে লাগলো। প্রথমেই গোটা জাহাজটা খালি করা হ’লো। এতে খানিকটা সময় নষ্ট হ’লো বটে, কিন্তু কী আর করা যায়। অবশ্য হাতে তাদের অঢেল সময়, তাই কন্‌গ্রে মোটেই উদ্বিগ্ন হয়নি। বাতিঘরের সাহায্য আসতে এখনও প্রায় দু-মাস বাকি, কাজেই অত ভাবনার কিছু নেই।

বাতিঘরের লগবুকেই সে-সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য কন্‌গ্রে জানতে পেরেছিলো। প্রতি তিন মাস অন্তর বাতিঘরের সাহায্য আসার কথা লেখা ছিলো খাতায়।

সান্তা-ফে এখানে এসে পৌঁছুবে মার্চ মাসে, আর এখন সবে ডিসেম্বরের শেষ। ঐ খাতা থেকে তিনজন আলোকরক্ষীর নামও জানতে পেরেছিলো তারা—ফিলিপ, মরিস আর বাস্‌কেথ। কাজেই একজন যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে, তা বুঝতে কোনোই অসুবিধে হ’লো না। কিন্তু লোকটা যে কোথায় গেছে, তা নিয়ে কন্‌গ্রে আদৌ মাথা ঘামালে না। সে একা তাদের আর কী ক্ষতি করতে পারবে? তাছাড়া খাবারদাবারের অভাবেও বেশিদিন তাকে বাঁচতে হবে না। কিন্তু তাহ’লেও মেরামতের কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়িই সারতে হবে। সেইজন্যেই খুব তাড়াহুড়ো ক’রে তারা জাহাজ খালি করতে শুরু করেছিলো। এরই মধ্যে তেসরা জানুয়ারি রাত্রে আচমকা আবহাওয়া পালটে গেলো। আকাশের দক্ষিণ দিগন্তে হঠাৎই চট করে কালো-কালো মেঘ জ’মে উঠলো। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হ’লো ঝড়। তাপমাত্রা হু-হু ক’রে ষোলো ডিগ্রি বেড়ে গেলো। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মেঘ ছিঁড়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা জ্ব’লে উঠছে বিদ্যুৎ। সঙ্গে-সঙ্গে রাগে গ’র্জে উঠছে বাজ। আর তারই সঙ্গে তাল রেখে সমুদ্রও উন্মাদ হ’য়ে উঠেছে।

ভাগ্য যদি নিতান্তই ভালো না-থাকতো, তাহ’লে এই ঝড়ের আঘাতে মউল তীরে আছড়ে প’ড়ে টুকরো-টুকরো হ’য়ে যেতো। কিন্তু মউল এমন জায়গায় নোঙর ফেলেছিলো যেটা সরাসরি ঝড়ের প্রকোপের মধ্যে পড়েনি। তবুও এই দুর্যোগটিকে মোটেই উপেক্ষা করা চলবে না ভেবে দ্বিতীয়-একটি নোঙর ফেলে মউলকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলো কন্‌গ্রে। নিজেরা বাতিঘরে আশ্রয় নিয়েছিলো ব’লে নিজেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তাদের কোনো ভয় ছিলো না। রসদ সম্বন্ধেও ভাবনার কিছু ছিলো না। বাতিঘরের ভাঁড়ারে তারা প্রচুর খাবারদাবার পেয়েছিলো। নিতান্তই যদি টানাটানি পড়ে তখন গুহা তো আছেই।

বারোই জানুয়ারি অব্দি এই দুর্যোগ চললো, একটা গোটা হপ্তারও বেশি সময় হাত-পা গুটিয়ে বিনা কাজেই বসে থাকতে হ’লো তাদের। বারোই জানুয়ারি রাত্রে হঠাৎ হাওয়ার গতি পালটে গেলো, এবার হাওয়ার তোড় দক্ষিণপশ্চিম দিকে—অর্থাৎ এবার দ্বীপের অন্য দিকটায় ঝড়ের মাতামাতি শুরু হয়েছে।

এই দশ দিনে মাত্র একটা জাহাজই স্টটেন আইল্যাণ্ডকে পাশ কাটিয়ে গেছে, তাও আবার দিনের বেলায়। সুতরাং বাতিঘরের কাজ ঠিকভাবে চলছে কি না সেটা নিশ্চয়ই সে বুঝতে পারেনি। জাহাজটা মাইল তিনেক দূর দিয়ে চলেছিলো ব’লেই বাস্‌কেথের সংকেতও বুঝতে পারেনি।