১৫. জংলিরা টের পেয়েছে

১৫

বুক ধুকপুক। বুক ঢিপ-টিপ।
বন্দুক তুলে ঠিক করো টিপ
বুক ঢিপঢিপ। বুক ধুকপুক
ঘোড়া টেপো : ছোঁড়ো গাদা বন্দুক।

কিন্তু হঠাৎ গডফ্রে এমনি একটা বিস্ময়ের ধ্বনি করলে যে টার্টলেট একেবারে আঁৎকে লাফিয়ে উঠলেন। দ্বীপে লোক থাকে, এটা যে জংলিরা টের পেয়েছে, তাতে আর-কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ফ্ল্যাগ-পয়েন্টের খুঁটির উপরে নিশেনটা আর নেই—নিশ্চয়ই জংলিরা সেটা নামিয়ে নিয়েছে। তাহ’লে আর দেরি করা যায় না। জংলিরা এখনো দ্বীপে আছে কিনা জানবার জন্যে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়া উচিত।

‘চলুন, বেরিয়ে পড়ি।’

‘বেরিয়ে পড়বো! কিন্তু—’ টাৰ্টলেট আমতা-আমতা করলেন।

‘তাহ’লে আপনি এখানেই থাকুন।’

‘তুমি যদি থাকো, গডফ্রে, তাহ’লেই—’

‘না, একাই থাকুন!’

‘একা! কখনো না! ‘

‘তাহলে চ’লে আসুন।’

টার্টলেট যখন বুঝতে পারলেন যে গডফ্রের সংকল্পের আর-কোনো নড়চড় হবে না, তখন তার সঙ্গে যাবেন ব’লেই ঠিক করলেন। একা-একা উইল-ট্রিতে প’ড়ে থাকবার সাহস তাঁর নেই।

বেরুবার আগে গডফ্রে অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করবার জন্যে বললে যে আগ্নেয়াস্ত্রগুলোয় গুলি ভরা আছে—ঘোড়া টিপলেই হ’লো : ‘গুড়ুম!’ টাৰ্টলেট নিলেন একটা বন্দুক, গডফ্রে আরেকটা। কোমরবন্ধে একটা ভোজালিও ঝোলালেন টার্টলেট, আর ঝোলালেন কার্তুজের থলি। একবার ভাবলেন বেহালাটাও সঙ্গে নেন- গানের সুরে যদি জংলিদের মন ভেজে! কিন্তু গডফ্রে বহু কষ্টে তাঁকে নিবারণ করলে।

সকাল তখন ছ-টা : দেবদারুগুলোর ডগায় প্রথম সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে। গডফ্রে সাবধানে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালে। একবার চারপাশে ভালো ক’রে তাকালে সে—সব স্তব্ধ, চুপচাপ। ছাগল, ভেড়াগুলো প্রেইরিতেই ফিরে গেছে, দিব্যি চ’রে বেড়াচ্ছে, ঘাস খাচ্ছে। এটা মোটেই মনে হ’লো না যে তাদের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হচ্ছে।

টার্টলেটকেও বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলে গডফ্রে। বন্দুক কাঁধে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন টার্টলেট : একটু ইতস্তত ক’রে তিনিও শেষটায় বেরিয়ে এলেন বাইরে।

গডফ্রে দরজাটা বন্ধ ক’রে দিলে—দেবদারুর বাকলটা যাতে মিশে যায়, বাইরে থেকে দেখে যাতে সহজে বোঝা না-যায় এটা একটা দরজা, সেদিকটায় সে ভালো ক’রে লক্ষ রাখলে। পায়ের ছাপ যাতে কারু চোখে না পড়ে সেইজন্যে তারপর গাছের তলায় কিছু ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিলে। তারপর সে এগিয়ে চললো নদীর দিকে। উদ্দেশ্য : নদীর পাড় ধরে-ধীরে একেবারে মোহানা অব্দি যাবে। টার্টলেটও ভয়ে ভয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন—একবার পা ফেলার আগে একটু থমকে চারদিক তিনি নিরীক্ষণ করেন, তারপর একা প’ড়ে থাকার ভয়ে আবার এগিয়ে যান।

নদীর ধারের গাছগুলোর কাছে এসে গডফ্রে চোখে দূরবিন এঁটে দ্বীপের উত্তর-পুব কোণে ফ্ল্যাগ-পয়েন্টের দিকে তাকালে। কোথাও কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই—কোত্থাও নেই। কোনো ধোঁয়ার রেখাও দেখা যাচ্ছে না।

অন্তরীপের ধারটায় কেউ নেই বটে, কিন্তু সেখানে যে টাটকা কতগুলো পায়ের ছাপ দেখা যাবে, সে-বিষয়ে গডফ্রের সন্দেহ ছিলো না। খুঁটিটায় সত্যিই নিশেনটা আর নেই। জংলিরা যদি সত্যিই দ্বীপ ছেড়ে-চ’লে গিয়ে থাকে, তবে লাল কাপড়টা দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি; যাবার আগে সেটাকেও সঙ্গে ক’রে নিয়ে গেছে।

পশ্চিমদিকের তীরটাও ফাঁকা প’ড়ে আছে—কোনো ছোটো-বড়ো ডিঙিই সমুদ্রে দেখা যাচ্ছে না। এক হতে পারে জংলিরা তীরের পাথরগুলোর আড়ালে ক্যানুটা এমনভাবে লুকিয়ে ভিড়িয়েছে যে দূর থেকে দেখে বোঝবার জো নেই।

কিন্তু জংলিরা দ্বীপে আছে কি না, সেটা ঠিকঠাক না-জানলেই বা চলবে কী ক’রে? সেটা বোঝবার জন্যেই তো তাকে যেতে হবে সেখানে, আগের দিন রাত্রে জংলিরা যেখানে নৌকো ভিড়িয়েছিলো—অর্থাৎ নদীর ঠিক মোহানায় গিয়ে তাকে খোঁজখবর করতে হবে।

নদীর পাড়ে মাঝে-মাঝে দু-একটা ক’রে গাছ জটলা পাকাচ্ছে- কোথাও-বা ঝোপঝাড় রয়েছে। তার আড়াল দিয়ে-দিয়েই এগুবে ব’লে ঠিক করলে গডফ্রে। হয়তো জংলিরা ক্যানুতেই ব’সে ব’সে জিরুচ্ছে। অতখানি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে তারা নিশ্চয়ই অত্যন্ত ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছে—অত সকালে হয়তো ঘুম থেকেই ওঠেনি। সে-ক্ষেত্রে উলটে তাদের উপরেই আচমকা চড়াও হওয়া যায় কি না, সেটাও বিবেচনা ক’রে দেখতে হবে।

সেইজন্যেও তাদের তাড়াতাড়ি করা উচিত। এ-সব ক্ষেত্রে সাধারণত গোড়ার দিকে যে-সুবিধেটা পাওয়া যায়, তা-ই ফলাফল ঠিক ক’রে দেয়। বন্দুকগুলো ভালো ক’রে দেখে-শুনে নিলে গডফ্রে, রিভলভারগুলিতেও গুলি ভরা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলে। তারপর নদীর বাম তীর ধরে তারা মোহানার উদ্দেশে রওনা হ’য়ে পড়লো। চারদিকে সব শান্ত হ’য়ে আছে মাথার উপরে জলের পাখিরা পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে, গাছের ডালে-ডালে পাখির ছানারা কিচির-মিচির করছে, কোথাও কোনো বিপদের চিহ্নমাত্র নেই।

পা টিপে-টিপে এগুচ্ছে গডফ্রে; পিছনে টাৰ্টলেট পা টিপে চলতে গিয়ে মাঝে-মাঝে জুতোর আওয়াজ ক’রে ফেলছেন। গাছপালার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে এগুচ্ছে ব’লে ধরা প’ড়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম—তবে টার্টলেট আরেকটু আস্তে চললেই পারেন। ও-রকম একজন সহকারী নিয়ে এসেছে ব’লে এর মধ্যেই তার আপশোশ হচ্ছিলো। টার্টলেট যে বিপদের সময় কতটা সাহায্য করবেন, সে-বিষয়ে তার আর সন্দেহ ছিলো না। উলটো একটা মস্ত দায়িত্ব চাপলো কাঁধে-বেচারিকে বাঁচাবার দায়িত্ব। তাঁকে উইল-ট্রিতে রেখে এলেই বরং ভালো হ’তো।

যাক গে, এখন আর পস্তাবার মানে হয় না। একঘণ্টায় তারা মাত্র একমাইল এগিয়েছে। এর মধ্যে সন্দেহজনক কিছুই তাদের নজরে পড়েনি। কিন্তু এখানে এসে নদীর তীর ফাঁকা হ’য়ে গিয়েছে—কোনো তীরেই শ’খানেক গজ পর্যন্ত কোনো গাছপালা নেই। নাঃ, আর গাছের আড়াল দিয়ে এগুবার উপায় নেই। গডফ্রে থেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নদীর দু-পাড়ের প্রেইরিগুলো ভালো ক’রে লক্ষ ক’রে দেখতে লাগলো।

…এখনও তো আশঙ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জংলিদের কোনো পাত্তাই নেই এখনও। হয়তো দ্বীপে লোক আছে জেনে তারাও খুব সাবধান হ’য়ে গেছে—গডফ্রেদের মতো তারাও হয়তো পা টিপে-টিপেই এগিয়ে আসছে। তারাও হয়তো গডফ্রেদের মতো তীরের গাছপালাগুলোকেই আড়াল হিসেবে ব্যবহার করছে।

টার্টলেটের অবিশ্যি এতক্ষণে ভয় ভেঙেছে। জংলিদের নিয়ে তিনি দু-একটা রসিকতা করারও চেষ্টা করছেন। কোথাও কিছু না-দেখেই এই হাম্বড়া ভাব জেগেছে তাঁর। গডফ্রে কিন্তু উলটে উদ্বিগ্ন হ’য়ে পড়লো। ফাঁকা জায়গাটা অতি সাবধানে পেরিয়ে সে আবার গাছপালার আড়ালে এসে পড়লো। আরো-একঘণ্টা পরে সমুদ্রের ধারে এসে পড়লো তারা। এদিকটায় নদীর তীরে কোনো বড়ো গাছ নেই—শুধু ছোটো-ছোটো কতগুলো গাছ ছড়িয়ে আছে। আড়াল চাইলে এখন আর হামাগুড়ি দিয়ে এগুনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। গডফ্রে নিজে হামাগুড়ি দিতে শুরু ক’রে দিলে—টার্টলেটকেও সেভাবেই এগুতে বললে সে।

‘আর-তো জংলিরা নেই কোত্থাও!’ টার্টলেট গডফ্রের পরামর্শে রাজি হ’তে পারলেন না, ‘তারা তো সব এতক্ষণে কেটে পড়েছে!’

‘আছে!’ চাপা গলায় গডফ্রে ব’লে উঠলো, ‘এখানেই আছে তারা— আশপাশে কোনোখানে ওৎ পেতে বসে আছে নিশ্চয়ই। নিচু হ’য়ে পড়ুন, টার্টলেট, নুয়ে পড়ুন। বন্দুক বাগিয়ে ধরুন, আমি বললেই তবে গুলি ছুঁড়বেন, তার আগে কিন্তু নয়।’

গডফ্রে এমন তীব্র সুরে কথাগুলো বলেছিলো যে ভয়ে টার্টলেটের হাঁটুর জোড় যেন খুলে গেলো। আর বাক্যব্যয় না-করে তিনি তক্ষুনি হাঁটু মুড়ে ব’সে পড়লেন।

ভালোই করলেন ব’সে প’ড়ে। কারণ গডফ্রে অকারণে তাঁকে ও-রকম ভয় দেখায়নি। যেখানে তারা ও-রকম গুঁড়ি মেরে বসেছিলো সেখান থেকে কতগুলো মস্ত পাথরের জন্যে সমুদ্র বা নদীর মোহানা স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু সেই পাথরগুলোর আড়াল থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে, সেটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।

গডফ্রে সটান লম্বালম্বি শুয়ে পড়েছে ঘাসের উপর, বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল চেপে।

‘আগে দু-বার তো এ-রকমই ধোঁয়া দেখেছিলুম। তাহ’লে কি দ্বীপের উত্তরে-দক্ষিণে আরো দু-বার নেমেছিলো জংলিরা, আর তাদেরই জ্বালানো আগুন থেকে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ধোঁয়া উঠেছিলো? কিন্তু না, তা তো সম্ভব নয়। কারণ কোথাও তো পোড়া কাঠ, অঙ্গার বা ছাইভস্ম দেখতে পাইনি। যাক, এবার আশাকরি এই হেঁয়ালিটার সমাধান হবে।’

এ-কথা ভাবতে-ভাবতেই বুকে-হেঁটে এগুচ্ছিলো গডফ্রে—টার্টলেটও যতটা পারেন সেইভাবেই তাকে অনুসরণ করছিলেন। একটু পরেই তারা নদীর বাঁকে পৌঁছুলো। এখান থেকে নদীর চারপাশে সে ভালো ক’রেই খেয়াল রাখতে পারবে।

অনেক কষ্টে সে তার নিঃশব্দ চমকটা গিলে ফেললে! টার্টলেটের কাঁধে হাত দিয়ে তাঁকে আর এগুতে বারণ ক’রে দিলে সে। আর এগুবার কোনো মানে হয় না! যা দেখবার জন্যে সে এদিকটায় এসেছে, সব বেশ স্পষ্টভাবেই তার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে আছে।

তীরের পাথরগুলোর উপর প্রচুর কাঠকুঠো জড়ো ক’রে মস্ত একটা আগুন জ্বালানো হয়েছে, আর ধোঁয়ার একটা চাঁদোয়া ঘুরে-ঘুরে উঠে যাচ্ছে আকাশে। আর আগুনের চারপাশে বসে আছে কালকের সেই জংলিরা। একটা মস্ত পাথরের গায়ে তাদের নৌকোটা বেঁধে রাখা—ঢেউ এলে নৌকোটা একটু-একটু ক’রে দুলে উঠছে।

দূরবিন ছাড়াই সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো গডফ্রে। ঐ আগুনের কুণ্ডের চেয়ে সে এমনকী দুশো গজও দূরে বোধকরি নেই। কাঠকুঠো পোড়বার শব্দ পর্যন্ত কানে আসছে। গুনে দেখলে যে আপাতত কোনো ভয় নেই—জংলিরা সব্বাই আগুনের পাশেই ব’সে আছে। বারোজনের মধ্যে দশজনে আগুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছে—এগারো নম্বরটি বোধহয় তাদের সর্দার, সে কেবল পায়চারি করছে আর ফিরে-ফিরে দ্বীপের ভিতর দিকে তাকাচ্ছে। তার কাঁধের লাল কাপড়টা দেখেই গডফ্রে চিনতে পারলে। আর বারো নম্বর জংলিটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে একটা খুঁটির গায়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

বেচারির অদৃষ্টে যে কী আছে, গডফ্রে তা তক্ষুনি স্পষ্ট বুঝতে পারলে। তারই জন্যে তৈরি হচ্ছে আগুনের কুণ্ড! তাকে জ্যান্ত ঝলসে মারা হবে! এদের নরখাদক হিশেবে বর্ণনা ক’রে টার্টলেট কাল মোটেই ভুল করেননি।

সব রবিনসন ক্রুসোই দেখা যাচ্ছে একইরকম : যেন একটা আরেকটার নকল! ডানিয়েল ডিফোর নায়কও তো এমনি এক অবস্থাতেই পড়েছিলো। ফ্রাইডেকে তো ক্রুসো জংলিদের হাত থেকেই রক্ষা করেছিলো। গডফ্রে বুঝতে পারলে যে তাদেরও এই লোকটাকে উদ্ধার করতে হবে—যে-খেলার যে-নিয়ম।

না, জ্যান্ত কাউকে ঝলশে মরতে দিতে সে পারবে না। তাদের সঙ্গে দুটো দো-নলা বন্দুক আছে—চারটে গুলি—দুটো রিভলভারে রয়েছে বারোটা গুলি—বাস, এই এগারোজন বর্বরের জন্যে তাই যথেষ্ট। বন্দুকের আওয়াজ শুনলেই তারা ঠিক ভির্মি খাবে। মনে-মনে এ-সব ঠিক ক’রে সে ওলিম্পুসের মহারাজা জেউস বা জুপিটারের হাতের বাজের মতো অপেক্ষা করতে লাগলো।

অবিশ্যি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’লো না।

মিনিট কুড়ি গেছে কি না-গেছে, জংলিদের সর্দার আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে—তারপর হাত বাড়িয়ে সে পেছমোড়া ক’রে বাঁধা বন্দীকে দেখিয়ে ইঙ্গিত করলে। জংলিরা যেন এতক্ষণ তারই ইশারার অপেক্ষা করছিলো।

অন্তত গডফ্রে অপেক্ষা করছিলো সেইজন্যেই। তক্ষুনি সে উঠে দাঁড়ালে। টার্টলেটও ব্যাপার কী না-বুঝেই উঠে দাঁড়ালেন। গডফ্রের মৎলব যে কী, তা তিনি কিছুই জানেন না।

গডফ্রে ভেবেছিলো তাকে দেখেই জংলিদের মধ্যে সাড়া প’ড়ে যাবে। হয় তারা ছুটে গিয়ে আশ্রয় নেবে তাদের ক্যানুতে নয়তো তাদের দিকে রে-রে ক’রে ছুটে আসবে।

তারা সে-সব কিছুই করলে না। কোনো পাত্তাই দিলে না তারা গডফ্রেকে। শুধু সর্দার কী-একটা ইশারা করতেই তিনজন জংলি বন্দীর দিকে এগিয়ে গেলো, আর বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে আগুনের দিকে নিয়ে আসবার চেষ্টা করতে লাগলো। বন্দীটি অবশ্যি খুব সহজে ঝলশে মরবে ব’লে মনে হলো না। এক ধাক্কায় সে তিনজনকে ঠেলে ফেলে দিলে—কিন্তু একা সে অত জনের সঙ্গে পারবে কী ক’রে? একটু পরেই তাকে কাবু ক’রে ফেললে সব্বাই, আর সর্দার এগিয়ে গেলো একটা পাথরের কুড়ুল হাতে—মাথাটা বুঝি ফাটিয়েই দেয়?

চীৎকার করে উঠলো গডফ্রে। বন্দুক গর্জালো : ‘গুড়ুম!’ আর সর্দার জংলি ছিটকে পড়লো মাটিতে—খুব-একটা মোক্ষম জায়গায় গুলি বিঁধেছে বোধহয়। বন্দুকের আওয়াজ শুনেই জংলিরা হতভম্ব হয়ে গেলো। জীবনে বোধহয় কখনোই তারা কোনো বন্দুকের শব্দ শোনেনি। ফিরে তাকিয়ে গডফ্রেকে দেখেই তারা বন্দীকে ছেড়ে দিলে।

বন্দী আর মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করলে না। প্রাণপণে ছুটলো তার অপ্রত্যাশিত উদ্ধারকর্তার দিকে।

ঠিক সেই সময়ে দ্বিতীয় আরেকটা বন্দুক গর্জে উঠলো : ‘গুড়ুম!’

টার্টলেট চক্ষু বুজেই গুলি ছুঁড়ে দিয়েছেন। ভয়ে তাঁর বুক ঢিপঢিপ করছিলো, বুক ধুকপুক করছিলো, চোখ বুজেই ঘোড়ায় চাপ দিতেই গুলি ছুটে গিয়েছে, আর বন্দুকের কুঁদো তাঁর কাঁধে এমন-এক উলটো ধাক্কা মেরেছে যে একবার পাক খেয়েই তিনি চিৎপটাং হ’য়ে পড়ে গিয়ে কাত্রাতে শুরু ক’রে দিয়েছেন।

কিন্তু কী তাগ! চোখ বুজে গুলি করেছেন, কিন্তু আরেকটা জংলি ঘুরপাক খেয়ে পড়েছে তার সর্দারের পাশে।

তাতেই কাজ হ’লো! জংলিরা বোধহয় ভাবলে যে দ্বীপে হয়তো অনেক লোক থাকে আর তারা সব্বাই এসেই চড়াও হয়েছে, কিংবা হয়তো বন্দুকের কাণ্ডকলাপ দেখেই তারা একেবারে বোমকে গিয়েছিলো—মোটমাট, জখম সঙ্গীদের ব’য়ে নিয়ে তক্ষুনি গিয়ে তারা পড়ি-মরি ক’রে উঠলো ক্যানুতে—আর হুড়মুড় ক’রে দাঁড় টেনে ক্যানুটা ছেড়ে দিলো।

ভালোই হ’লো। জয়ের গর্ব টার্টলেটেরই সবচেয়ে বেশি—জীবনের প্রথম গুলিই চাঁদমারিতে বিঁধেছে! বন্দুকের বাঁটের গুঁতো লেগে কাঁধে যে-ব্যথা হয়েছিলো, সে-কথা ভুলে গিয়ে তিনি উদ্বাহু হ’য়ে নৃত্য ক’রে উঠলেন।

ইতিমধ্যে বন্দীটি তার উদ্ধারকর্তাদের কাছে এসে হাজির হয়েছে। একবার কেবল বন্দুকের ঝিলিক দেখে ভয় পেয়ে সে আঁৎকে উঠেছিলো, কিন্তু পরক্ষণেই সেই দুই শ্বেতাঙ্গর কাছে এসে কৃতজ্ঞতায় মাটিতে লম্বালম্বি শুয়ে প’ড়ে মাটিতে চুমু খেয়ে গডফ্রের পায়ে মাথা রাখলে।

দেখে মনে হ’লো এমনকী পলিনেশিয়ার জংলিরা শুদ্ধু ডানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ প’ড়ে ফেলেছে।

১৬

সভ্যজগৎ ছাড়াও সব
বর্বরদের দ্বীপও
আদ্যোপান্ত পাঠ করেছে
শ্রী ডানিয়েল ডিফো

সাষ্টাঙ্গে শুয়ে-থাকা বেচারিটিকে টেনে তুললো গডফ্রে। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে ভালো ক’রে। লোকটার বয়েস পঁয়ত্রিশ হবে, পরনে কেবল একটা নেংটি। মাথার আকার ও চেহারা দেখে মালুম হলো লোকটি সম্ভবত কাফ্রি—ঠিক পলিনেশিয়ার মানুষ বলে মনে হ’লো না তাকে, বরং মনে হ’লো আফ্রিকার লোক।

সুদান কিংবা আবিসিনিয়ার মানুষ। সে যখন এসে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের জংলিদের হাতে পড়েছে, তখন এটা অনুমান করা যেতে পারে যে সম্ভবত সে ইংরেজি কিংবা গডফ্রের জানা ইয়োরোপীয় ভাষাগুলোর দু-একটি শব্দ বুঝতে পারে। কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেলো যে সে এমন-এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে, যার কোনো শব্দই গডফ্রে জানে না। হয়তো আদিবাসীদের ভাষাতেই সে কথা বলছে— গডফ্রে তার টু শব্দটিও বুঝতে পারলে না। গডফ্রে তক্ষুনি তাকে ইংরেজিতে নানা প্রশ্ন করলে, কিন্তু কোনো উত্তরই পেলে না তার কথার। তখন সে তাকে আকারে-ইঙ্গিতে তার নাম জিগেশ করলে। কাফ্রি লোকটা বেশ বুদ্ধিমান, তাছাড়া দেখে-শুনে তাকে ভালো মানুষ ব’লেই মনে হয়। অনেক চেষ্টার পর সে যখন বুঝলে গডফ্রে কী জানতে চাচ্ছে, তখন কেবল একটা কথাই বললে : ‘কারেফিনোতু!’

‘কারেফিনোতু!’ টার্টলেট ব’লে উঠলেন, ‘শুনলে একবার নামটা? আমি কিন্তু বলি ওকে বুধবার বলে ডাকা হোক—কারণ আজ হ’লো একটা বুধবার—ক্রুসো দ্বীপগুলোর ধরনই তাই : ক্রুশো শুক্কুরবারে পেয়েছিলেন ফ্রাইডেকে, তাই তার ওই নাম হয়েছিলো। ওকে কি আমাদের কারেফিনোতু নামে ডাকা উচিত?’

‘তা-ই যদি ওর নাম হয়, তাহলে ওকে ওই নামে ডাকতে আপত্তি কী?’ ব’লে সে নিজের বুকে হাত দিয়ে নিজের নাম বললে ‘গডফ্রে!’

কারেফিনোতু অনেক চেষ্টা করলে গডফ্রে কথাটা উচ্চারণ করতে-গডফ্রে নিজেই অনেকবার উচ্চারণ ক’রে শোনালে, কিন্তু সে কিছুতেই নামটাকে উচ্চারণ করতে পারলে না। তখন সে টার্টলেটের দিকে ফিরে তাকালে, যেন তাঁর নামটা সে জানতে চাচ্ছে।

‘টার্টলেট,’ নাচের মাস্টারমশাই মধুর কণ্ঠে বললেন।

টার্টলেট!’ কারেফিনোতু ফিরে উচ্চারণ করলে। তার বাগযন্ত্রে এই নামটা বেশ সহজেই খাপ খেয়ে গেলো। দেখে টার্টলেট বেশ আহ্লাদিতই বোধ করলেন।

গডফ্রে তখন কারেফিনোতুর বুদ্ধিকে কিছু কাজে খাটাবার চেষ্টা করলে। আকারে-ইঙ্গিতে এটাই সে তাকে বোঝালে যে সে এই দ্বীপটার নাম জানতে চাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে সে বন-জঙ্গল, প্রেইরি, টিলা-পাহাড়, বেলাভূমি দেখিয়ে চোখের ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলে। প্রথমটায় কারেফিনোতু বুঝতে পারেনি গডফ্রে কী জানতে চাচ্ছে। তাই আবারও তাকে ইঙ্গিতে সব দেখাতে হ’লো গডফ্রেকে। তার ভাবভঙ্গি হুবহু নকল করলে কারেফিনোতু, তারপর বললে, ‘আরনেকা!’

‘আরনেকা?’ আবার গডফ্রে মাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে জিগেশ করলে।

‘আরনেকা,’ আবার উত্তর দিলে কাফ্রি।

নামটা জেনে কোনোই লাভ হ’লো না গডফ্রের। দ্বীপটার ভৌগোলিক নাম কী, তাও জানা গেলো না—প্রশান্ত মহাসাগরের কোনখানে যে দ্বীপটা অবস্থিত, সে-তথ্যটাও অজ্ঞাত থেকে গেলো। অন্তত সে-তো এ-রকম কোনো নাম কস্মিনকালে কোথাও শুনেছে বলেও মনে করতে পারলো না। হয়তো এটা জংলিদের দেয়া নাম—ভৌগোলিকদের মোটেই জানা নেই।

কারেফিনোতু কিন্তু ভালো ক’রেই তার ত্রাণকর্তাদের লক্ষ করছিলো। বিশেষ ক’রে তাদের বন্দুক ও রিভলভার তাকে খুবই অবাক করে দিয়েছিলো, কিছুতেই সে আর বন্দুকের উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলো না। গডফ্রে সহজেই তার কৌতূহলের কারণটা বুঝে ফেললে। কারেফিনোতু যে কোনোকালে আগুনঝরানো হাতিয়ার দ্যাখেনি, তাতে সন্দেহ নেই। সে নিশ্চয়ই ভাবছে যে এই লোহার নলগুলো থেকেই বাজ ফেটে বেরিয়েছিলো, আর তাকে মুক্তি দিয়েছিলো।

‘গডফ্রে তাকে বন্দুকের ক্ষমতা ভালো ক’রে বোঝাবার জন্যেই একটা উড়ন্ত বালিহাঁস তাগ ক’রে গুলি ছুঁড়লো। বেশ উঁচু দিয়েই উড়ে যাচ্ছিলো বালিহাঁসটা—কিন্তু গুলির শব্দ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই একটা কাতর আর্তনাদ ক’রে রক্তাপ্লুত হাঁসটা মাটিতে আছড়ে পড়লো।

‘গুড়ুম!’ আওয়াজ শুনেই কারেফিনোতু তিড়িং ক’রে মস্ত লাফ দিয়েছিলো। কিন্তু যেই দেখলে যে ডানাভাঙা বালিহাঁসটা ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে অমনি সে ছুটে গিয়ে বেশ খানিকটা স্তম্ভিতভাবেই তাকে চেপে ধরলো ও গডফ্রেদের কাছে নিয়ে এলো!

টার্টলেটের ভারি ইচ্ছে করলো যে জাঁক দেখিয়ে বলেন ভগবান তাঁদের বজ্রপাতের ক্ষমতা দিয়েছেন। নদীর ধারে গাছের ডালে বসেছিলো একটা মাছরাঙা, তাকে লক্ষ্য ক’রে তিনি বন্দুক উঁচিয়ে ধরলেন। কিন্তু গুলি করার আগেই গডফ্রে তাঁকে বাধা দিলে : ‘না, না, গুলি করবেন না! ‘

‘কেন?’

‘ধরুন দৈবাৎ আপনার তাগ ফশকালো, মাছরাঙাটার গায়ে আঁচড়ও লাগলো না—তখন আমরা ওর চোখে বেশ নিচে নেমে যাবো না?’

‘কিন্তু তাগ ফশকাবেই বা কেন? আমি বুঝি যুদ্ধের সময় জীবনে প্রথমবার গুলি ছুঁড়েই একটা জংলিকে জখম করিনি?’

‘করেছেন যে তাতে আর সন্দেহ কী। সে-তো ধপাশ ক’রে পড়েই গিয়েছিলো। কিন্তু আমার পরামর্শ নিন, টার্টলেট। ভালো চান তো খামকা এভাবে ভাগ্যকে আর চটিয়ে দেবেন না।’

টার্টলেট একটু অপ্রসন্নই হলেন, কিন্তু আর-কোনো কথা না-ব’লে বন্দুকটা কাঁধে ফেললেন।

তারপর কারেফিনোতুকে নিয়ে দুজনে উইল-ট্রিতে ফিরে এলো।

ফিনা আইল্যাণ্ডের নতুন অতিথি তো দেবদারুর কোটরে বসবাস করার রাজসিক ব্যবস্থা দেখে তাজ্জব হ’য়ে গেলো। প্রথমে তাকে সব যন্ত্রপাতি বাসনকোশন জিনিসপত্র ব্যবহার ক’রে দেখাতে হলো এগুলো কোনটা কোন কাজে লাগে। একেকটা জিনিশ দেখে তার তাক-লেগে-যাওয়া থেকে বোঝা গেলো যে সে এতকাল খুব-একটা উন্নত ধরনের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেনি। কারণ আগুনের ব্যবহারটাই সে জানতো না। জ্বলন্ত কাঠের উপর চাপিয়ে দিলেও লোহার কড়াটাতে কেন যে আগুন ধ’রে যাচ্ছে না, এটা বুঝতে না পেরে সে ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রইলো। একটা আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তো তার চক্ষু ছানাবড়া। সে নিজে একবার ফিরে দাঁড়ালে, তারপর আরশিটার পিছনে উঁকি মেরে দেখলে কেউ লুকিয়ে আছে কি না—এতটাই সে অবাক হ’য়ে গিয়েছিলো।

‘মানুষ তো নয়, বনমানুষ!’ কাণ্ড দেখে মন্তব্য করলেন টার্টলেট।

‘মোটেই নয়, টার্টলেট। যেহেতু ও আরশিটার পিছনে উঁকি মেরে দেখেছে, তাতেই বোঝা যায় যে ওর মাথা আছে—যুক্তি খাটাতে পারে,’ বললে গডফ্রে। ‘না-হয় বনমানুষ নয়। কিন্তু ও যে আমাদের কোন কাজে আসবে, তা তো জানিনে।’

‘আমি ঠিক জানি, ও আমাদের অনেক কাজে আসবে।’

শুধু একটা ব্যাপারেই কারেফিনোতু তক্ষুনি তার ক্ষমতা দেখিয়ে দিল। তার সামনে ছোটোহাজারি ধরতেই সে এমন গোগ্রাসে সব খেয়ে ফেললে যে বোঝা গেলো তার জঠরে রীতিমতো অগ্নিকাণ্ড হচ্ছিলো।

‘দিব্যি খেতে পারে দেখছি। সাবধান, গডফ্রে! লক্ষ রেখো। ও হয়তো নরখাদক আসলে,’ টাৰ্টলেট বললেন।

‘তাহ’লে ওর সে-অভ্যেস ছাড়াতে হবে–-‘

‘পারবে না ছাড়াতে। শুনেছি তো মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে কেউ কখনো ভোলে না।’

ওরা কথা বললেই কারেফিনোতুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। তার সামনে কী বলা হচ্ছে, তার মর্ম সে বোধহয় ভালোই বুঝতে পারে। কারণ তক্ষুনি সে তড়বড় ক’রে কী-যে ব’লে যায়, তা ওরা আর ধরতে পারে না। কিন্তু কথায় পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান না-হ’লেও সে-যে তাদের নতুন সঙ্গী, তা তো অনস্বীকার্য। হয়তো তাকে অনেক কাজে লাগানো যাবে।

বেশ লম্বাচওড়া সে, সরল ও বুদ্ধিমান, কোনো কাজই তাকে দু-বার দেখিয়ে দিতে হয় না। একবার কিছু করতে দেখেই সে চট ক’রে শিখে নেয়। এইভাবেই গডফ্রে তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে লাগলো। প্রথমে সে কাজটা ক’রে দেখায়, তারপর কারেফিনোতুকে তা করতে ইঙ্গিত করে। গৃহপালিত জীবগুলোর যত্ন নেয়া, ফলমূল জোগাড় করা, ভেড়া বা অ্যাগুটি কেটে মাংস টুকরো করা, ম্যানজানিলা আপেল নিংড়ে রস বার করা—এ-সব কাজ তাকে একবার বৈ দু-বার ক’রে দেখাতে হলো না।

টার্টলেট যা-ই ভাবুন না কেন, গডফ্রে কিন্তু তাকে মোটেই অবিশ্বাস করেনি। তাকে আশ্রয় দিয়ে একবারও তার আপশোশ হয়নি। কেবল একটা চিন্তাই তাকে পীড়িত করছিলো : জংলিরা তো এখন ফিনা আইল্যাণ্ড চিনে গিয়েছে—যদি আবার কোনোদিন সদলবলে এসে চড়াও হয়!

গোড়া থেকেই উইল-ট্রির মধ্যে কারেফিনোতুর শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, কিন্তু বৃষ্টি না-পড়লে সে বাইরেই শুয়ে থাকতে পছন্দ করতো—যেন সে উইল-ট্রিকে পাহারা দিচ্ছে।

দ্বীপে আসবার দিন পনেরোর মধ্যে গডফ্রের সঙ্গে সে অনেকবারই শিকারেও বেরিয়েছে; বন্দুকের গুলিতে অনেক দূরের জন্তুগুলো দুমদাম জখম হ’য়ে যাচ্ছে দেখে কিছুতেই আর তার বিস্ময় কমতে চায় না। আস্তে-আস্তে অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্রর ব্যবহার সম্বন্ধে সে অভ্যস্ত হয়ে এলো।

গডফ্রে ক্রমেই এই কাফ্রির প্রতি আসক্ত হ’য়ে পড়ছিলো। কেবল একটা কাজেই কারেফিনোতু যেন সুবিধে ক’রে উঠতে পারছিলো না- সেটা হ’লো ইংরেজি ভাষা শেখা। কিছুতেই সে সহজ-সরল শব্দ পর্যন্ত ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। গডফ্রে অবশ্য তাকে শেখাবার চেষ্টা করতে ত্রুটি করে না—বেশ যত্ন নিয়েই তাকে ভাষা শেখায়।

এরই মধ্যে কারেফিনোতু একদিন বেলাভূমিতে একটা কাছিমের আস্তানা আবিষ্কার ক’রে বসলো—শুধু আবিষ্কার নয়, কাছিমগুলোকে সে এমন চক্ষের পলকে চিৎ ক’রে কাবু ক’রে ফ্যালে যে তার ক্ষিপ্রতায় গডফ্রে তো রীতিমতো মুগ্ধ। অনেকগুলো কাছিম শিকার ক’রে তারা শীতকালের জন্য সঞ্চয় ক’রে রাখলে। দ্বীপে যে শিগগিরই ঠাণ্ডা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই—কারণ অক্টোবর মাস শুরু হ’য়ে গেছে, আবহাওয়ায় এর মধ্যেই একটু-একটু বদল দেখা দিচ্ছে।

সেই দু-চার দিন কারেফিনোতুর কাছিমশিকারের কল্যাণে তাদের জীবনে যা একটু নতুনত্ব এসেছিলো, নয়তো সেই একইরকম নিত্য কর্মের অবিশ্রাম পুনরাবৃত্তিতে, দুঃসহ একঘেয়েমিতে, দিন কেটে যাচ্ছে। রোজ রুটিনমাফিক কতগুলো কাজ করতে হয়। শেষকালে শীতকালে যখন উইল-ট্রির মধ্যেই সারাদিন বন্দী হ’য়ে কাটাতে হবে, তখন যে কী-রকম বিচ্ছিরি আর একঘেয়ে লাগবে, তা ভাবলেই গডফ্রের ভারি মন খারাপ হ’য়ে যায়।

এমনিতে অবিশ্যি রোজই সে দ্বীপের নানাদিক ভালো ক’রে পর্যবেক্ষণ ক’রে আসে। আর সময় পেলেই বন্দুক বাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। সাধারণত কারেফিনোতু তখন সঙ্গে যায় : টার্টলেট থেকে যান উইল-ট্রির তদারকিতেই। শিকারি হবার কোনো গুণই নেই টার্টলেটের, যদিও তাঁর জীবনের প্রথম গুলিটা যাকে বলে একবারেই ষাঁড়ের চক্ষু’ ফুঁড়ে বেরিয়েছিলো।

এমনি একদিন শিকারে বেরিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যাতে উইল-ট্রির নিরাপত্তাই নষ্ট হ’য়ে যাবার জোগাড়।

গডফ্রে আর কারেফিনোতু টিলাগুলোর নিচে দ্বীপের ঠিক মাঝখানকার জঙ্গলটায় গিয়েছিলো শিকারে। সকাল থেকে ঘুরে বেড়িয়ে দূর থেকে দু-তিনটে হরিণকে ছুটে যেতে দেখেছে তারা—হরিণগুলো এতদূর দিয়ে যাচ্ছিলো যে তাগমাফিক গুলি করার বিশেষ সুবিধে তাছাড়া একদিক থেকে শিকার যে কিছু করতেই হবে, তেমন-কিছু বাধ্যবাধকতাও ছিলো না, কেননা উইল-ট্রিতে আপাতত খাবারের কোনো ভাবনাই নেই। কাজেই খালি হাতে শিকার থেকে ফিরলেও গডফ্রের কিছু এসে-যেতো না। বরং অহেতুক জীবহত্যার চাইতে মাঝে-মাঝে খালি হাতে ফিরতে তার ভালোই লাগতো।

বেলা তখন তিনটে হবে। বনের মধ্যেই তারা দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছে। মধ্যাহ্নভোজের পরেও কোনো শিকার জোটেনি তাদের। উইল-ট্রিতে ফিরে আসবে ব’লেই ঠিক করেছে, এমন সময় হঠাৎ কারেফিনোতু বিষম আঁৎকে উঠলো। সোজা লাফিয়ে এসে পড়লো সে গডফ্রের ঘাড়ে, তার কাঁধ চেপে ধ’রে হুড়মুড় ছুটে চললো উইল-ট্রির দিকে—ততক্ষণে তারা বন থেকে প্রায় ফাঁকা জায়গায় এসে পড়েছে। প্রায় কুড়ি গজ ছুটে গিয়ে থামলো কারেফিনোতু। হতভম্ব গডফ্রে কোনোরকমে হাঁপ ছেড়ে তার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে। কারেফিনোতু মুখে কোনো সাড়া না-দিয়ে ভীতভাবে আঙুল তুলে গজ পঞ্চাশেক দূরের একটা জানোয়ারকে দেখিয়ে দিলে।

গডফ্রে তাকিয়ে দ্যাখে মস্ত-একটা ভালুক, গাছের ডাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাদের দেখে মাথা দোলাচ্ছে—যেন এক্ষুনি তাদের তাড়া ক’রে আসবে। তক্ষুনি, কোনো-কিছু চিন্তা না-ক’রেই, গডফ্রে তার দোনলা তুলে গুলি ক’রে বসলো!

গুলি হয়তো লেগেওছিলো ভালুকটার বুকে, কারণ সে তক্ষুনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু মরেছে কি না কে জানে। দেরি করারও অবসর নেই। ও-রকম দুর্ধর্ষ হিংস্র জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করার দুঃসাহস না-থাকাই ভালো। ক্যালিফরনিয়ার জঙ্গলে এমনকী পেশাদার শিকারিরাও ভালুকদের খেপিয়ে দিতে সাহস পায় না।

কারেফিনোতু আর দৃকপাতও করলো না। গডফ্রের হাতটা চেপে ধরে সোজা উইলট্রির দিকে ছুটলো। খামকা অতিরিক্ত ঝক্কি নেবার যে কোনো মানে হয় না গডফ্রেও তা বুঝতে পারলে—তাই সে কোনো দ্বিরুক্তি না-করেই তার সঙ্গে-সঙ্গে জোর কদমে ছুটে চললো।

১৭

ঋক্ষ কেবল একাই নন, ব্যাঘ্র অধিকন্তু!
সয় না অত ধকল!
যত রাজ্যের হিংস্র জন্তু
দ্বীপ করেছে দখল!

ফিনা আইল্যান্ডে ও-রকম একটা হিংস্র জন্তু দেখে গডফ্রে এতই আঁৎকে উঠেছিলো যে তার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। তাই সে দুম ক’রে গুলি চালিয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু ভালুকটা অক্কা পেলে কিনা সেদিকে আর লক্ষ করার তার সাহস হয়নি। গোড়ায় ভেবেছিলো টার্টলেটের কাছে ঘটনাটা চেপেই যাবে, কিন্তু শেষটায় নানা কথা বিবেচনা ক’রে সেটা সে আর সমীচীন বোধ করলে না। কিন্তু ব’লে ফেলেই তার মনে হ’লো বোধকরি একটা মস্ত ভুলই করে ফেলেছে।

‘ভল্লুক!’ টার্টলেট একেবারে আঁৎকে উঠলেন, ‘অ্যাঁ, ভল্লুক! কিন্তু অ্যাদ্দিন তো দ্বীপে একটাও ভল্লুক ছিলো না? একটাই যদি দেখা যায়, তো অনেকগুলোর মুখোমুখি পড়তেও অবাক হবার কী আছে? আরো অনেক হিংস্র জন্তু তো দেখা যেতে পারে—জাগুয়ার, নেকড়ে, বাঘ, হায়েনা, সিংহ, পাইথন?’

এমন সভয়ে টার্টলেট চারপাশে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতে লাগলেন যে মনে হ’লো যেন একটা মস্ত চিড়িয়াখানার খাঁচা খুলেই যত রাজ্যের জানোয়ার এসে দ্বীপে চড়াও হয়েছে।

অত চেল্লাচেল্লি করার কিছু হয়নি—এ-কথাটাই গডফ্রে তাঁকে বোঝাতে চাইলে। এটা ঠিক যে দ্বীপে সে একটা ভালুক দেখেছে। কেন-যে আগে এতবার দ্বীপের যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েও তার মুখোমুখি পড়েনি, এটা সত্যি ভারি দুর্বোধ্য ও আশ্চর্য। কিন্তু তা থেকে এটাও ধ’রে নেয়া যায় না যে যত রাজ্যের হিংস্র জন্তু দ্বীপের মধ্যে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে এখন থেকে যে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে এবং কখনোই যে নিরস্ত্র থাকা চলবে না, এটা মনে রাখতে হবে।

কিন্তু টার্টলেট কিছুতেই আর অভয় পেলেন না। ভয়ে তাঁর একেবারে ভিমি খাবার দশা। অবশেষে অ্যাদ্দিনে দেশে ফেরবার জন্যে একটা প্রচণ্ড ব্যাকুলতা অনুভব করলেন তিনি! আতঙ্কে তিনি প্রায় আধমরা হ’য়েই পড়লেন। ‘ঢের হয়েছে—যথেষ্ট জানোয়ারের পাল্লায় পড়েছি, আর নয়—যথেষ্ট! এখন আমি চ’লে যেতে চাই,’ কেবল এই কথাই বারে বারে বলতে লাগলেন তিনি। কিন্তু বেচারি! যাবেন কী ক’রে? সে-ক্ষমতা কই তাঁর?

গডফ্রেদের এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। কেবল যে বেলাভূমি বা প্রেইরি থেকেই আক্রমণ আসতে পারে তা নয়—এই দেবদারুবীথিকাও মোটেই নিরাপদ নয়। আচমকা আক্রান্ত হ’য়ে যাতে ভ্যাবাচাকা না-খায়, সেইজন্যে এখন থেকেই তৈরি থাকতে হবে। প্রথমত উইল-ট্রির দরজাটাকে আরো-শক্ত, আরো-মজবুত করতে হবে—যাতে বুনো জানোয়ারের থাবা ঠেকাতে পারে। আর গৃহপালিত জন্তুগুলির জন্যেও একটা শক্ত খোঁয়াড় বানাতে হবে, অন্তত রাত্তিরে যাতে তারা ওই খোঁয়াড়ে আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু বললেই তো আর ও-রকম একটা খোঁয়াড় চট করে বানিয়ে নেয়া যায় না। আপাতত দেবদারু-তলার ডালপালা দিয়ে একটা বেড়া তৈরি ক’রেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হ’লো : বেড়াটা খুব শক্তও হ’লো না, কিংবা তেমন উঁচুও হ’লো না, অনায়াসেই কোনো ভালুক বা গোবাঘা বেড়াটা উলটে ভেঙে ফেলে বা লাফিয়ে ডিঙিয়ে এসে চড়াও হ’তে পারে।

আকারে-ইঙ্গিতে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও কারেফিনোতু কিন্তু কোনো বাধাই মানলে না—আগের মতোই রাতে সে বাইরে শোয়। একদিক থেকে ভালোই : আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা দেখলেই সে আগে থেকে সাবধান ক’রে দিতে পারবে। কিন্তু তাতে কাফ্রি বেচারির প্রাণের ভয়ও আছে; কিন্তু ওভাবে পাহারা দিয়েই সে বোধ করি তার ত্রাণকর্তাদের ঋণ শেষ করতে চাচ্ছিলো।

কিন্তু একটা সপ্তাহ কেটে গেলো নির্বিঘ্নে, সেই দুর্ধর্ষ বন্য জন্তুদের কোনো আবির্ভাবই হ’লো না। গডফ্রে অবশ্য আজকাল উইল-ট্রির আশপাশেই থাকে— খুব-একটা বেশি দূরে যায় না, বনের ধারটা তো পারতপক্ষে একেবারেই মাড়ায় না। ছাগল-ভেড়াগুলো অবশ্য কাছের প্রেইরিটায় চ’রে বেড়ায়, কিন্তু কিছুতেই তাদের চোখের আড়াল হতে দেয় না কারেফিনোতু—সে-ই আজকাল তাদের রাখাল। তার সঙ্গে অবিশ্যি বন্দুক থাকে না—কী ক’রে যে বন্দুক চালায়, সেটা সে এখনও ধরতে পারেনি—তবে তার কোমরে গোঁজা থাকে একটা ধারালো ভোজালি আর হাতে থাকে একটা কুড়ুল। এই দুটো অস্ত্ৰ‍ই অবশ্য তার কাছে যথেষ্ট—তা দিয়েই সে এমন কী বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি লড়তেও পেছ-পা হবে না।

এই ক-দিনে কোনো বুনো জানোয়ারের দেখা না-পেয়ে গডফ্রের আবার আস্থা ফিরে এসেছিলো। সে আবার শিকারে বেরুতে লাগলো, তবে খুব-একটা দূরে অবিশ্যি যাবার সাহস তার হয় না। মাঝে-মাঝে কারেফিনোতু তার সঙ্গে যায়। টার্টলেট তো কিছুতেই খোলা জায়গায় পা দেন না, সারাক্ষণই উইল-ট্রি খোঁদলে সশস্ত্র হ’য়ে ব’সে থাকেন। মাঝে-মাঝে যখন কারেফিনোতু উইল-ট্রিতেই থেকে যায়, তখন টার্টলেট তাকে ইংরেজি শেখাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষকালে দেখলেন সবটাই পণ্ডশ্রম : বেচারির আড়ষ্ট জিহ্বায় কোনো কথাই স্পষ্ট উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। তখন টার্টলেট ঠিক করলেন কারেফিনোতুর ভাষাই শিখে নেবেন। গডফ্রে অবিশ্যি বারণ করলে : ও-ভাষা শিখে কী-ই বা লাভ হবে? কিন্তু টার্টলেট নাছোড়বান্দা। হাত দিয়ে একেকটা ক’রে জিনিশ দেখান, আর কারেফিনোতুকে তার নাম বলতে ইঙ্গিত করেন। এভাবে দিন পনেরোর মধ্যেই তিনি পলিনেশিয়ার জংলিদের ভাষা বেশ শড়গড় করে ফেললেন—পনেরোটা কথাই শিখে ফেললেন তিনি। আগুনকে পলিনেশিয়ার ভাষায় বলে ‘বিরসি’, আকাশকে ‘আরাদোরে’, সমুদ্রকে ‘মেরভিরা’, গাছকে ‘ডোউরা’—ইত্যাদি কথাগুলো শিখে তাঁর কী জাঁক—যেন পলিনেশিয়ার ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে এক্কেবারে ডবোল প্রমোশন পেয়ে গেছেন।

ফলে তিনিও উলটে কারেফিনোতুকে এবার থেকে নাচ শেখাতে লাগলেন : ইওরোপের ভাষা তার রপ্ত হয়নি বটে, কিন্তু ইওরোপীয় নাচই না-হয় সে শিখুক। কাণ্ড দেখে গডফ্রে তো কিছুতেই হাসি চাপতে পারে না। কারেফিনোতু তো দাপাদাপি ক’রে ঘেমে-নেয়েই অস্থির, কিন্তু একেবারে প্রাথমিক মুদ্রাগুলো পর্যন্ত তার রপ্ত হতে চায় না। ভারি ইচ্ছে তার নাচ শিখতে, কিন্তু কাঁধের হাড় তার শক্ত, বুকটা হাজার চেষ্টাতেও কিছুতেই সামনে এগিয়ে আসে না, হাঁটুগুলোকে ঠিকমতো কায়দা করতে পারে না। টার্টলেট তবুও প্রায় প্রচণ্ডভাবেই শেখাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কারেফিনোতু বেচারির উৎসাহ যথেষ্ট, কিন্তু হ’লে কী হবে, কিছুতেই সে আর ঠিকমতো পা ফেলতে পারে না।

‘ওরে, দ্যাখ-দ্যাখ, গণ্ডমূর্খ!’ টাৰ্টলেট নিজেই নেচে দেখান, ‘পাটা বাড়িয়ে দে—আরো; দুটো গোড়ালি কাছে নিয়ে আয়। ওরে আহাম্মক, হাঁটু দুটো ফাঁক কর; কাঁধ পেছিয়ে নে, বোকা। মাথাটা সোজা করে রাখ—কনুই দুটো বাঁকিয়ে নে।’

‘কী আশ্চর্য! আপনি তো ওকে অসম্ভব কাজ করতে বলছেন,’ গডফ্রে হো-হো করে হেসে ওঠে।

‘বুদ্ধিমান লোকের কাছে আবার অসম্ভব কী? ‘

‘কিন্তু ওর শরীরের গড়নটাই অন্যরকম। হাড়গুলোও কত শক্ত, সেটা একবার ভেবে দেখুন।

‘কিন্তু ওকে শিখতেই হবে। একদিন তো ওকে লোকের ড্রয়িংরুমে যেতে হবে—তাই না? সেখানে তো আর অসভ্যতা করলে চলবে না!’

‘কিন্তু টার্টলেট, কস্মিনকালেও কোনো ড্রয়িংরুমে গিয়ে হাজির হবার সুযোগ ওর হবে না!

‘অ্যাঁ! তা তুমি কেমন ক’রে জানলে?’ টার্টলেট তেড়ে আসেন, ‘তুমি কি হাত গুনতে পারো না কি? আগে থেকেই ব’লে দিতে পারো ভবিষ্যতে কী হবে না-হবে?’

টার্টলেটের সঙ্গে ঠিকমতো কোনো আলোচনাই সম্ভব হয় না, কারণ সব তর্কই তিনি এই কথা ব’লে থামিয়ে দেন। শুধু যে থামিয়েই দেন, তা নয়, তারপরেই, তাঁর পকেট-বেহালায় টুংটাং তুলতে থাকেন। আর কারেফিনোতু যেহেতু তাঁদের আলোচনার কোনো সারমর্মই বুঝতে পারে না, সেইজন্যে সেই বেহালার সুরে তাল মিলিয়ে তিড়িং-তিড়িং ক’রে লাফিয়ে পলিনেশিয়ার নাচ শুরু ক’রে দেয়।

ইদানীং শিকারে বেরিয়ে গডফ্রে বুনো জানোয়ারদের কোনো চিহ্ন না-দেখে একটু-একটু ক’রে সাহস ফিরে পাচ্ছিলো। নদীর ধারে এমনকী জানোয়ারদের পায়ের ছাপ পর্যন্ত দেখা যায় না। রাত্তিরে কোনো রাগি গর্জন বা সন্দেহজনক আওয়াজ ওঠে না। আর গৃহপালিত জীবগুলোর হাবভাবেও কোনো চাঞ্চল্য বা আতঙ্কের ছাপ নেই।

গডফ্রে ভারি আশ্চর্য হ’য়ে গেলো। ‘তাজ্জব ব্যাপার দেখছি! কিন্তু আমি তো কোনো ভুল করিনি! কারেফিনোতুরও কোনো ভুল হয়নি—একটা ভালুককেই তো সে দেখিয়েছিলো আঙুল তুলে! আমি যে একটা ভালুককেই গুলি করেছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই! ধ’রেই না-হয় নিলুম যে আমি তাকে বধ করেছি—কিন্তু সেটাই কি হিংস্র জানোয়ারদের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলো নাকি?’

পুরো ব্যাপারটা সত্যি হেঁয়ালি ঠেকছে! তাছাড়া গডফ্রে যদি ভালুকটাকে বধ ক’রেই থাকে, তবে তো তার মৃতদেহটা গাছতলায় প’ড়ে থাকার কথা! কিন্তু, আশ্চর্য, সেখানটায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো জন্তুর মৃতদেহ তারা দেখতে পায়নি! এক হ’তে পারে যে জন্তুটা ভীষণভাবে জখম হ’য়ে সেখান থেকে চ’লে গিয়ে অন্য-কোনো জায়গায় গিয়ে ধপ ক’রে প’ড়ে গিয়েছে! কিন্তু তাহলে তো গাছতলায় রক্তের দাগ থাকার কথা—কিন্তু একফোটাও রক্তের দাগ নেই কোথাও! হেঁয়ালিটার কোনো সমাধান না-পেলেও সাবধানে থাকাই ভালো—আগেভাগেই সাবধান থেকে কেউ কখনো বোকামি করেনি।

নভেম্বর মাসও শুরু হ’লো, দ্বীপে বর্ষাও শুরু হলো। দ্বীপটা যে কোন দ্রাঘিমায়, তা তাদের জানা নেই। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা ঠাণ্ডা বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম। পরে হয়তো কনকনে ঠাণ্ডার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই একটানা কয়েকদিন ধ’রে বৃষ্টি পড়বে আর তাদের দশা অতীব কাহিল হয়ে যাবে। এক্ষুনি উইল-ট্রির মধ্যে একটা চুল্লির ব্যবস্থা করা উচিত। তাতে যে কেবল হাত-পা সেঁকাই যাবে, তা-ই নয়, বর্ষাবাদলার দিনে রান্নাও চড়ানো যাবে। কিন্তু, প্রশ্ন হ’লো, ধোঁয়া তাড়ানো যাবে কী ক’রে?

লম্বা একটা বাঁশ কেটে তার গিঁটগুলো চেঁছে নিলে অবিশ্যি দিব্যি একটা নল তৈরি হ’য়ে যাবে। এ-কাজে সবচেয়ে সাহায্য করলে কারেফিনোতু। অনেক হ্যাঙামা ক’রে অবিশ্যি ব্যাপারটা তাকে বিশদ ক’রে বোঝাতে হ’লো—কিন্তু একবার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই সে চটপট বাঁশের মধ্যকার গিঁটগুলো ছাড়িয়ে দিলে। একবার সেটাকে বসিয়ে আগুন জ্বেলে পরীক্ষা ক’রে দেখলো গডফ্রে : দিব্যি হয়েছে, একটুও ধোঁয়া হ’লো না উইল-ট্রির মধ্যে, সব ধোঁয়া বাঁশের নল দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কেবল একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে—বাঁশে যাতে কিছুতেই আগুন ধ’রে না-যায়।

তাড়াহুড়ো ক’রে চিমনিটা বসিয়ে ভালোই করেছিলো ওরা। কারণ নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ১০ তারিখ অব্দি একটানা মুষলধারে বৃষ্টি পড়লো। এই অবস্থায় বাইরে আগুন জ্বালানোও অসম্ভব হ’তো। এ-কদিন সারাক্ষণই উইল-ট্রির মধ্যেই তারা কাটিয়ে দিলে। কিন্তু অসুবিধে হ’লো একটা বিষয়ে : যতটা যব সংগ্রহ করে রেখেছিলো তাতে টান প’ড়ে গেলো। গডফ্রে তখন ১০ তারিখে জানালে যে আবহাওয়া একটু ভালো হ’লেই সে আর কারেফিনোতু গিয়ে বেশকিছু পরিমাণ যব জোগাড় করে নিয়ে আসবে। টার্টলেটকেও সে আসতে বলেছিলো—কিন্তু টার্টলেট জলে-কাদায় বেরুতে রাজি হলেন না।

১০ তারিখের সন্ধেবেলায় পশ্চিমা হাওয়া ভারি নিচু ঝোলা মেঘকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলো, আকাশ পরিষ্কার হ’য়ে গেলো, আর ঠিক সূর্যাস্তের সময় একটুক্ষণ সূর্যকেও দেখা গেলো আকাশে। আশা করা যায়, পরদিন সকালেই বৃষ্টি ধ’রে যাবে ও সূর্য উঠবে। এই শুকনো দিনটাকে কাজে খাটানোই সবচেয়ে ভালো। গডফ্রে ঠিক করলে পরদিনই সে বেরিয়ে পড়বে।

সন্ধের পর তারা খেয়ে-দেয়ে উঠলো। আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টি নেই— মেঘ নেই, দু-একটা ঝকঝকে তারা দেখা যাচ্ছে আজ রাতে। কারেফিনোতু বললে আজ রাত্রে আবার সে বাইরে গিয়ে শোবে। গডফ্রে তাকে অনেক বোঝালে- বুনো জানোয়ারের ভয় না-হয় তার নেই, খামকা স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ায় সারারাত বাইরে কাটাবার মানে হয় না। কিন্তু কারেফিনোতু নাছোড়বান্দা, শেষকালে তাদের রাজি হ’তেই হ’লো।

সকালবেলাটা দেখা দিলো জ্যোতির্ময় হ’য়ে। সময় নষ্ট না-ক’রে গডফ্রে আর কারেফিনোতু সশস্ত্র হ’য়ে কাঁধে দুটো মস্ত থলি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য : নদীর তীর ধরে যবের খেতে যাবে

পৌঁছেও গেলো একঘণ্টার মধ্যে বেশ নির্বিঘ্নেই। চটপট তারা থলিগুলোকে ভরে নিলে, তবে চটপট করা মানেই তিন-চার ঘণ্টার কাজ। এগারোটা নাগাদ তারা থলি দুটো কাঁধে ঝুলিয়ে ফিরে আসবে ব’লে রওনা হ’লো। পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে, বেশ সাবধানে চারপাশে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে—দুজনের মধ্যে কথা চলে না ব’লেই ভালো ক’রে চারপাশে লক্ষ রাখতে পারছে। নদী যেখানে মোড় বেঁকেছে, যেখানে কতগুলো গাছ জড়াজড়ি ক’রে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কী দেখে গডফ্রে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। এবার সে-ই আঙুল তুলে দেখালো গাছতলায় : একটা আমিষখোর ভীষণ জন্তু— চোখ হিংস্র ক্ষুধায় জ্বলন্ত!

‘বাঘ! সাবধান!’ চেঁচিয়ে বলে উঠলো গডফ্রে। এ-কথা ভুলেই গেলো যে কারেফিনোতু তার ভাষা বোঝে না।

গডফ্রের ভুল হয়নি। সত্যিই একটা মস্ত বাঘ, পিছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে—এক্ষুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ততক্ষণে গডফ্রের কাঁধ থেকে থলিটা খ’সে পড়েছে, হাতে উঠেছে গুলিভরা বন্দুক। মুহূর্তমাত্র দেরি না-ক’রে দ্রুত তাগ ক’রেই সে ঘোড়া টিপে দিলে।

এবারে আর-কোনো সন্দেহ নেই। গুলি খেয়ে বাঘটা একটা পাক খেয়েই প’ড়ে গেলো। প’ড়ে গেলো বটে, কিন্তু মরলো কি না কে জানে। জখম বাঘ সাংঘাতিক জানোয়ার : হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে এক্ষুনি। গডফ্রে আবার গুলি করবে ব’লে বন্দুক তুললো।

কিন্তু গডফ্রে হা-হা ক’রে বাধা দেবার আগেই খাপ-খোলা ভোজালি হাতে কারেফিনোতু ছুটে গিয়েছে সামনে। গডফ্রে হাঁক পেড়ে তাকে ফিরতে বললো। কিন্তু কারেফিনোতু তার ডাকে দৃপাতও করলে না। বাধ্য হ’য়ে গডফ্রেও ছুটে গেলো পিছন-পিছন।

নদীর পাড়ে গিয়ে দ্যাখে কারেফিনোতু বাঘটার সঙ্গে যুঝছে। এক হাতে তার গলাটা পাকড়ে ধরে কারেফিনোতু সজোরে তার ছোরাটা তার বুকে আমূল বসিয়ে দিলে।

বাঘটা গড়িয়ে পড়লো নদীতে। বৃষ্টির জলে নদীর চেহারাই পালটে গিয়েছে : জল ছুটেছে ঘুরে-ঘুরে, ভীষণ স্রোত। বাঘটার শরীর কেবল একবার পাক খেলে সেই জলের ঘূর্ণিতে, তারপরেই স্রোত তাকে টেনে নিয়ে চললো সমুদ্রের দিকে।

বাঘ! ভল্লুক! কে জানে এই দ্বীপে আরো কত হিংস্র জন্তু আছে! ফিনা আইল্যাণ্ডকে তারা যতটা নিরাপদ ভেবেছিলো, আসলে তা নয়, এটা তো আজ স্পষ্টই বোঝা গেলো।

কারেফিনোতুর কাছে গিয়ে গডফ্রে দ্যাখে বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের ফলে তার বিশাল কাফ্রি শরীরের কয়েক জায়গায় রক্তভরা আঁচড়!

ভবিষ্যতের কথা ভেবে অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে দুজনে আবার উইল-ট্রির পথ ধরলো।

সামান্যই জখম হয়েছে কারেফিনোতু, কিন্তু তবু তো বাঘের আঁচড়! অথচ সে তাতে মোটেই পাত্তা দিলে না।

১৮

যতই করে চেষ্টা
পায় না কোনো-কিছুর হদিশ, সব ভণ্ডুল শেষটা।
এই দ্বীপে আর নয়
নিত্য ভূতের নৃত্য দেখে কার সাহসে কুলোয়?

টার্টলেট যখন জানতে পেলেন যে দ্বীপে কেবল ভালুকই নেই, বাঘও আছে, তখন তাঁর প্রলাপ-বিলাপ প্রবল আকার ধারণ করলে। এখন তো আর কোটরের মধ্য থেকে কিছুতেই তিনি এক পাও বাড়াবেন না! আর আমিষখোর জন্তুগুলোও যে শেষ অব্দি উইল-ট্রি অবধি এসে ধাওয়া করবে, তাতেও তাঁর সন্দেহ নেই! না, কোত্থাও আর নিরাপত্তা নেই! হ’তো যদি একটা পাথরের দুর্গ, তাহ’লে না-হয় কথা ছিলো! কিন্তু দেবদারুর কোটর আবার কোনো নিরাপদ আশ্রয় নাকি? না, না, আর নয়—এক্ষুনি এই দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, এক্ষুনি!

‘যেতে তো আমিও চাই,’ শান্ত গলায় বললে গডফ্রে।

সত্যি-বলতে ফিনা আইল্যাণ্ডে ভালোয়-মন্দয় মিশিয়ে অ্যাদ্দিন যে-ভাবেই কাটুক না-কেন এখন আর অবস্থা সে-রকম নেই। প্রতি মুহূর্তে বন্যজন্তুর আক্রমণের প্রতীক্ষায় ভয়ে ভয়ে বসে-থাকা মোটেই কোনো আনন্দদায়ক অনুভূতি নয়।  

‘কিন্তু,’ গডফ্রে সেই থেকে কেবল একটা কথাই হাতুড়ির অবিরাম বাড়ির মতো ব’লে চলেছে, ‘আশ্চর্য! এই চারমাসে একটাও বুনো জানোয়ার চোখে পড়লো না—অথচ এই পনেরো দিনে বাঘ-ভালুকের সঙ্গে দেখা হ’য়ে গেলো! তাজ্জব কাণ্ড!’

সত্যি, ব্যাপারটা ভারি দুর্বোধ্য। যেন একটি দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা!

একেকটা সমস্যা দেখা দেয়, আর গডফ্রে সাহসের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের মুখোমুখি হয়। এবারও সে ভেঙে পড়লো না। জন্তুরা যদি দল বেঁধে দ্বীপে এসে দেখাই দেয়, তাহ’লে হাত-পা গুটিয়ে ব’সে না-থেকে তাদের মুখোমুখি হবার জন্যে তৈরি হওয়াই ভালো।

কিন্তু করবেই বা কী?

না-হয় বন-জঙ্গলের ধারকাছই মাড়ালো না বা সমুদ্রের ধারে গেলো না। না-হয় অস্ত্রশস্ত্র বিনা এক পাও বাড়ালো না কোত্থাও। কিন্তু তারপর? তারা যদি নিজেই এসে চড়াও হয়?

‘গত দু-বার ভাগ্য আমাদের সহায় ছিলো,’ গডফ্রে কেবলই বলে, ‘কিন্তু আর তো দৈব ও-রকম সহায় নাও থাকতে পারে!’

কেবল যদি বাইরে বেরুনো বন্ধ রাখলেই চলতো, তাহ’লেও না-হয় কথা ছিলো। কিন্তু উইল-ট্রিকেও রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। কুঁকড়ো- পরিবারের কথা বা গৃহপালিত চারপেয়েগুলোর কথাও ভুলে গেলে চলবে না।

টার্টলেটের প্রস্তাবেই রাজি হ’লো গডফ্রে। টার্টলেট বলেছিলেন দেবদারুগুলোকে খুঁটি হিশেবে ব্যবহার ক’রে একটা বেড়া দেয়া হোক। তাতে অন্তত আচম্বিতে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে। কিন্তু সেও তো আর চাট্টিখানি কথা নয়—যথেষ্ট খাটুনি আছে।

কিন্তু খাটুনির ভয়ে পেছিয়ে যাবার লোক গডফ্রে নয়; অন্তত আজকাল সে আর পরিশ্রমকে ভয় পায় না। তাছাড়া অন্তত এই ব্যাপারটায় টার্টলেটও ‘সশরীরে’ সাহায্য করবেন বলে কথা দিলেন। আর, কারেফিনোতু তো আছেই।

তক্ষুনি তারা কাজে লেগে গেলো।

উইল-ট্রি থেকে মাইলখানেক দূরে নদীর ধারে ছিলো একটা পাইনের ঝাড়। তার ডালপালা কেটে জুড়ে দিতে পারলে বেশ শক্ত একটা বেড়া তৈরি হয়ে যাবে। ১২ই নভেম্বর সকালবেলায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনজনেই পাইন বনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো।

তিন কাঠুরের আর মুহূর্তও হাঁপ ছাড়ার জো ছিলো না। কখন কোন দিক থেকে জন্তুগুলো হাজির হয় কে জানে। কাজেই যত শিগগির সম্ভব কাজটা সেরে ফেলতে হবে। সঙ্গে খাবার নিয়ে এসেছিলো তারা যাতে সারাদিন কাজ করতে পারে।

কিন্তু কাজটা মোটেই একদিনের নয়। ১৭ তারিখ অবধি রোজ সকালে তারা খাবার-দাবার নিয়ে বেরিয়ে যায়, সন্ধের সময় উইল-ট্রিতে ফিরে আসে। ওদিকে রোজই আকাশে একটু-একটু মেঘ জমছে। কখনও-কখনও বৃষ্টি ও পড়ে, তারপরেই আবার রোদ ওঠে। বৃষ্টির সময় তিন জনে গাছতলাতেই আশ্রয় নেয়—বৃষ্টি থামলেই আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দেয়। এমনকী অনভ্যস্ত টার্টলেট অব্দি যৎপরোনাস্তি কুঠার চালালেন।

১৮ তারিখে কাটা গাছগুলো উইল-ট্রিতে আনবার ব্যবস্থা করতে হ’লো তাদের। এই ক-দিন বেশ নিরুপদ্রবেই কেটেছে। নদীর ধারে কোনো বিকট গর্জন ওঠেনি বা কোনো বিষম আবির্ভাব ঘটেনি। তাতেও তারা একটু অবাক না-হয়ে পারলে না। তাহ’লে কি কেবল একটা বাঘ আর একটা ভালুকই ছিলো দ্বীপে? কিন্তু না, তা-ই বা কী করে হয়? তা কি কখনও সম্ভব না কি? কিন্তু এই হেঁয়ালির উত্তর খুঁজে বার করার চেষ্টা না-করে গাছগুলো উইল-ট্রিতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হয়।

কাজটা মোটেই সহজ নয়—বিস্তর পরিশ্রমসাপেক্ষ। কিন্তু গডফ্রে ভেবে- ভেবে একটা ফন্দি বার করে ফেললে। নদীর স্রোতকে কাজে লাগালে কেমন হয়? সাম্প্রতিক বর্ষায় নদীর ভোলটাই পালটে গেছে। স্রোত আছে, তাছাড়া জলের ধারাও এখন আর তেমন সরু নয়। ভেলা বেঁধে কাঠগুলো এখান থেকে ভাসিয়ে দিলো—আর উইল-ট্রির কাছে যেখানে গডফ্রে সাঁকো বেঁধেছিলো, সেখানে ভেলাটা থামিয়ে নিলো। সেখান থেকে উইল-ট্রির কাছে গাছগুলোকে ব’য়ে নিয়ে যেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না।

একাধিক ভেলা বেঁধে গাছগুলোকে নিয়ে আসতে-আসতে আরো সপ্তাহখানেক কেটে গেলো। অবশেষে ২৬শে নভেম্বর তারা প্রথম বেড়া বাঁধলে : দু-ফিট গভীর ক’রে ক’রে খুঁটি পুঁতে খুঁটিগুলোয় আড়াআড়ি কয়েকটা ক’রে রেলিং বসিয়ে দেয়া হ’লো।

‘একবার বেড়াটা তৈরি হ’য়ে গেলে আর ভয় নেই,’ টাৰ্টলেটকে একটু আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলে গডফ্রে।

‘একেবারে মানগোমেরি স্ট্রিটে না-পৌঁছুনো অব্দি ভয় সবসময়েই থাকবে,’ বিরস বদনে উত্তর দিলেন টার্টলেট। এবং এই মোক্ষম মন্তব্যের কোনো জবাব দেবার ক্ষমতা গডফ্রের ছিলো না।

বেড়া বাঁধা শেষ হ’লো চারদিনের দিন—এবার একটা শক্ত দরজা বসিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৭ নভেম্বর সকালে এমন-একটা দুর্বোধ্য ঘটনা ঘটলো যে ফিনা আইল্যাণ্ডের প্রহেলিকা আরো জটিল ঠেকতে লাগলো।

গডফ্রে তখন বেড়ার কাজে ব্যস্ত, বেলা তখন আটটা। হঠাৎ কারেফিনোতু খুব অদ্ভুতভাবে চেঁচিয়ে উঠলো। খুব গুরুতর ব্যাপার না-হ’লে যে কারেফিনোতু তাকে ডাকতো না, এটা গডফ্রে জানতো। কারেফিনোতু তখন উইল-ট্রির মগডালে উঠে ছাত বানাচ্ছিলো—যাতে ছাতের ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা না-ঢোকে। গডফ্রে তার দূরবিনটা নিয়ে ভিতর থেকে ফোঁপরা গাছটা বেয়ে-বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

গডফ্রে উপরে উঠতেই কারেফিনোতু আঙুল তুলে উত্তর-পুব দিকটা দেখালে। দেখেই গডফ্রে অবাক। দ্যাখে, পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে কালো ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে।

‘আবার!’ গডফ্রে এতই অবাক হয়ে গিয়েছিলো চোখে দূরবিন এঁটে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। না, তার ভুল হয়নি। সত্যি মাইল পাঁচেক দূরে, দ্বীপের অন্য প্রান্ত থেকে ধোঁয়া উঠছে—এবং বেশ বড়োশড়ো একটা অগ্নিকুণ্ড থেকেই যে ধোঁয়া উঠছে, তাতেও সন্দেহ নেই—কেননা অত ধোঁয়া কোনো সাধারণ আগুন থেকে উঠতে পারতো না। কারেফিনোতুকে দেখেও বোঝা গেলো যে সেও ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। কারণ সমুদ্রে এর মধ্যে কোনো জাহাজই দ্যাখেনি তারা। কোনো জাহাজ যে হঠাৎ এসে তীরে ভিড়েছে, তাও নয়।

‘হুম্! ওই ধোঁয়া কোন্ আগুন থেকে উঠেছে, এবার সেটা আমাকে জানতেই হবে!’ গডফ্রে ব’লে উঠলো। তারপর আঙুল দিয়ে ধোঁয়া ও গাছতলাটা দেখিয়ে কারেফিনোতুকে সে ইঙ্গিতে বোঝালে যে সে এক্ষুনি ওই ধোঁয়ার উৎস আবিষ্কার করতে বেরিয়ে পড়বে।

কারেফিনোতু সহজেই তার মনের ভাব ধরতে পারলে। তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেলো যে এটা তারও পরিকল্পনা।

গডফ্রে ভাবছিলো, ‘সত্যি যদি কোনো মানুষ ওখানে থেকে থাকে, তাহ’লে সে-যে কে, এটা জানা খুবই জরুরি। কখনই বা সে দ্বীপে আসে, আর লুকিয়েই বা থাকে কেন? আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই এটা জানা দরকার।’

তক্ষুনি তারা গাছ থেকে নেমে পড়লো। চটপট টার্টলেটকে সব কথা খুলে বললে গডফ্রে। তারপর টার্টলেট রইলেন উইল-ট্রির পাহারায়—আর গডফ্রে ও কারেফিনোতু অস্ত্রশস্ত্র খাবারদাবার নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়লো।

সাঁকো পেরিয়ে নদীর ডান তীরে গিয়ে প্রেইরি দিয়েই চললো তারা—এটাই শর্টকাট হবে। দ্বিতীয়বার অনুসন্ধানের সময় গডফ্রে যেখানে গিয়েছিলো, আজকে কিন্তু তার চেয়ে আরো-একটু পুবদিকে স’রে ধোঁয়া উঠছে।

একদিকে যেমন বিষম তাড়া ছিলো, তেমনি অন্যদিকে আবার জন্তুদের ভয়ে এগুতে হচ্ছিলো সাবধানে। পথে অবশ্য ভয়ের কিছুই ঘটলো না। বারোটা নাগাদ বেলাভূমির প্রথম সার পাথরগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছুলো তারা—মাঝখানে তারা এক জায়গায় চটপট মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছিলো। তখনও বেশ ধোঁয়া উঠছে। আরো প্রায় সিকিমাইল যেতে হবে তাদের।

গিয়ে কী দেখবে, জানে না। কে জানে কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে। কাজেই সাবধানতার সীমা ছিলো না। অথচ তরও সইছে না। হনহন ক’রে তারা এগিয়ে চললো।

কিন্তু দু-মিনিট পরেই হঠাৎ ধোঁয়ার রেখা মিলিয়ে গেলো। যেন চট ক’রে কেউ আগুন নিভিয়ে দিয়েছে।

গডফ্রে অবশ্য জায়গাটা ঠিক চিনে রেখেছিলো। পিরামিডের মতো মস্ত একটা তিনকোণা পাথরের আড়াল থেকে ধোঁয়াটা উঠেছিলো—চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়

পাথরটা যখন আর পঞ্চাশ পা দূরে, তখন তারা কৌতূহল চাপতে পারলে না—ছুটে গিয়ে হাজির হলো দুজনে।

কেউ নেই।

কিন্তু আধপোড়া কাঠ আর ছাইভস্ম প’ড়ে আছে। স্পষ্ট প্রমাণ—সত্যিই এখানে কেউ আগুন জ্বেলেছিলো।

‘কেউ একজন ছিলো এখানে—একটু আগেও ছিলো। কে ছিলো, তা আমাদের জানতেই হবে!’ ব’লে গডফ্রে গলা ফাটিয়ে হাঁক দিলে।

কারু সাড়া নেই।

কারেফিনোতুও একটা ভীষণ চীৎকার করলে। কিন্তু কারু দেখা মিললো না!

আশপাশের পাথরগুলোর আড়ালে গিয়ে তারা তন্নতন্ন ক’রে খুঁজলো। বেলাভূমির কোনো গুহা, গহ্বর গর্তে ঢুঁ মারতে তারা বাকি রাখলে না।

কিন্তু কেউ নেই—কাউকেই তার পেলে না। এমনকী সরু ছোট্ট ফাটলগুলো পর্যন্ত তারা খুঁজে দেখলো। কারু পাত্তা নেই—জাহাজ-ডোবা নাবিক, জংলি বা আদিবাসী—কেউ না।

‘কিন্তু এবার তো আর-কোনো সন্দেহই নেই,’ গডফ্রে ব’লে উঠলো, ‘এ-তো আর উষ্ণ প্রস্রবণের ধোঁয়া নয়-কাঠকুটোর আগুন। আর আগুন তো কখনো আপনা-আপনি দাউ-দাউ করে জ্ব’লে ওঠে না।’

গোরু খোঁজাই সার হ’লো—কারু চুলের ডগাটিও তারা আবিষ্কার করতে পারলে না। শেষটায় দুটো নাগাদ ক্লান্ত, ব্যর্থ ও হতভম্ব হ’য়ে দুজনে উইল-ট্রির রাস্তা ধরলে।

গডফ্রে বিষম ভাবিত হ’য়ে পড়েছিলো। ভূতুড়ে দ্বীপ না কি? না কি দ্বীপটাকে কেউ জাদু করেছে? আগুনের পুনরাবির্ভাব, রহস্যময় বন্য জন্তুর উপস্থিতি—সব কী-রকম প্রহেলিকার মতো ঠেকছে!

হঠাৎ কারেফিনোতুর এক ধাক্কায় ছিটকে এক পাশে স’রে গেলো গডফ্রে আরেকটু হ’লেই পড়তো চিৎপটাং মাটিতে!

‘সাপ! বাঘ-ভালুকের পরে শেষকালে সাপও এসে হাজির,’ কেন অমন প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে, একবার তাকিয়েই সেটা বুঝে নিতে দেরি হয়নি গডফ্রের আরেকটু হ’লেই সাপটার ছোবল পড়তো!

সাপটা পরক্ষণেই ঝমঝম শব্দ ক’রে সাঁৎ ক’রে চ’লো গেলো।

কিন্তু কারেফিনোতুর কুড়ুলটা র‍্যাটল সাপের চেয়েও ক্ষিপ্র—দু-টুকরো হ’য়ে সাপের শরীরটা এঁকেবেঁকে পেঁচিয়ে যেতে লাগলো। গডফ্রের মনে হ’লো ঠিক এ-রকম একটা প্রহেলিকাই বুঝি দ্বীপটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে।

ভাববার অবসর আর মিললো না। আরো কতগুলো সাপ দেখা গেলো ঘাসের মধ্যে।

‘দৌড়োও, দৌড়োও,’ কারেফিনোতুকে ছুটতে ইঙ্গিত করলে গডফ্রে। কি-রকম যেন অলুক্ষুণে আশঙ্কায় তার মন ভরে গিয়েছে। হঠাৎ এত সাপ এলো কোত্থেকে এই দ্বীপে? আরো-কোনো অজানা বিপদ ওৎ পেতে নেই তো তাদের জন্যে?

ছিলো ঠিকই। এবং বেশ গুরুতর বিপদ।

নদীর ধারে এসে শোনে উইল-ট্রির কাছ থেকে আর্তনাদ উঠছে একটানা! গলার স্বর চিনতে মোটেই দেরি হ’লো না।

‘এ-যে টার্টলেটের গলা! তাকে আবার কী আক্রমণ করলো। শিগগির কারেফিনোতু, শিগগির!’ উত্তেজনায় গডফ্রের গলা দিয়ে কথা বেরুতে চাচ্ছে না।

সাঁকোয় উঠেই দেখা গেলো দশ-বারো গজ দূরে টার্টলেট প্রাণের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন, আর তাঁর পিছন-পিছন হাঁ ক’রে ছুটছে এক মস্ত কুমির—নদী থেকে সেটা উঠে এসেছে ডাঙায়। ভয়ে টার্টলেট এতই দিশেহারা হ’য়ে গেছেন যে ডান-বাম ক’রে যে এঁকেবেঁকে ছুটবেন, তাও পারছেন না—সোজা ছুটছেন সরল রেখায়—আর তাতে কুমিরের কবলে পড়বার সম্ভাবনাটা আরো বেড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়লেন টার্টলেট, কিছুতেই টাল সামলাতে পারলেন না। আর তাঁর রক্ষে নেই।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো গডফ্রে। এই বিষম বিপদের সামনে পড়েও সে মাথা ঠাণ্ডা রাখলে। বন্দুকটা তুলে সে সাবধানে কুমিরটাকে তাগ করলে। কুমিরটা দুম করে লাফিয়ে উঠে একপাশে ছিটকে গিয়ে পড়লো। কারেফিনোতু ততক্ষণে ছুটে গিয়ে টার্টলেটকে কাঁধেই তুলে নিয়েছে অবলীলাক্রমে

মস্ত ফাড়া গেছে টাৰ্টলেটের—বিষম ফাঁড়া!

সন্ধে তখন ছ-টা, সূর্য তখনও ঠিক ডোবেনি।

পরক্ষণেই গডফ্রে তার সঙ্গীদের নিয়ে উইল-ট্রিতে পৌঁছুলো।

সেই সন্ধেটায় আর-কোনো কথা নেই—ঘুরে-ফিরে কেবল এই বাঘ-ভালুক-কুমির- সাপের কথাই চললো। আর ওই রহস্যময় আগুনই বা কে জ্বালে বারে-বারে? ফিনা আইল্যাণ্ডের বাসিন্দাদের কপালে আরো-কী দুর্ভোগ আছে কে জানে? কত-যে নিঝুম নির্ঘুম দীর্ঘ রাত কাটবে, তাই বা কে বলবে?

টার্টলেট সেই থেকে সারাক্ষণ কেবল গানের ধুয়োর মতো ব’লেই চলেছেন—’আর নয়! আমাকে এ-দ্বীপ থেকে নিয়ে চলো! আমি মানগোমেরি স্ট্রিটে ফিরে যেতে চাই। আমি আর এ-দ্বীপে থাকতে চাই না! চাই না!

যেন কোনো প্রহেলিকা সিরিজ–একটার পর একটা যা-সব এবং যে-সব কাণ্ড হচ্ছে দ্বীপে! গডফ্রে যেন কিছুতেই আর-কোনো থই পাচ্ছে না!

১৯

মাত্র একটা রাত—
তার মধ্যেই সব তছনছ,
সমস্ত চিৎপাত।

অবশেষে এলো শীত।

প্রশান্ত মহাসাগরের এ-সব অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে। প্রথম কয়েক দিনের হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডাতেই ভাবী কনকনে দিনগুলোর খানিকটা পূর্বাভাস পাওয়া গেলো। উইলট্রির মধ্যে চুল্লি বসাবার পরিকল্পনাটা দারুণ হয়েছিলো। তাছাড়া এর মধ্যেই চারপাশে বেড়া বাঁধা হ’য়ে গেছে, একটা শক্ত গাঁথুনির দরজাও বসানো হয়েছে।

পরের ছ-সপ্তাহ ধ’রে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত, এমন অনেক দিন গেলো যখন ঘর থেকে এক পাও বেরুনো গেলো না। প্রথমে কয়েকদিন ভীষণ ঝড় উঠেছিলো : সে কী দারুণ ঝড়, দেবদারুগুলোর শিকড়শুদ্ধু থরথর ক’রে কেঁপে উঠেছিলো, যেন একেবারেই বুঝি উপড়ে যাবে! ভাঙা ডালপালা প’ড়ে ছিলো সবখানে : তাণ্ডব-ঝড়ের নিদর্শন। ভালোই হ’লো : জ্বালানির সমস্যাটা তাতে অনেকখানি মিটে গেলো।

সিন্দুক থেকে বেরুলো পশমি কাপড়। শিকারে বেরুনো বন্ধ হ’য়ে গেলো। আর এমন বরফ পড়লো যে গডফ্রের মনে হ’লো তারা বুঝি সুমেরু মহাসাগরেই এসে পড়েছে। মেরু-হাওয়া বয়ে যায় ব’লে উত্তর আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা দেশগুলোর অন্যতম। সেখানে শীতকাল থাকে এমনকী এপ্রিল পর্যন্ত। আগে থেকেই সেখানে ঠাণ্ডার সঙ্গে লড়বার জন্যে তৈরি হ’তে হয়। এখানকার ঠাণ্ডার বহর দেখে গডফ্রের মনে হ’লো আসলে সে যা ভেবেছিলো, তা বুঝি ঠিক নয়—ফিনা আইল্যাণ্ড সম্ভবত আরো উঁচু দ্রাঘিমায় অবস্থিত।

আর সেই জন্যেই উইল-ট্রির ভিতরটা যাতে আরো আরামপ্রদ ক’রে তোলা যায়, সেদিকে নজর দেয়াটা জরুরি হ’য়ে পড়লো। ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির জন্যে কষ্ট নেহাৎ কম হচ্ছিলো না। আবহাওয়া যে অতটা খারাপ হ’য়ে যাবে, তা তারা ধরতে পারেনি। জমিয়ে-রাখা কাছিমের মাংসে ক্রমশ টান পড়তে লাগলো, কাজেই কয়েকটি ছাগল-ভেড়া বধ করতে হ’লো তাদের।

এদিকে আবার মাঝখানে দিন-পনেরো ভীষণ জ্বরে ভুগে উঠলো গডফ্রে সেই ছোটো ওষুধের বাক্সটা না-থাকলে এই জ্বর তার সহজে ছাড়তো কিনা সন্দেহ। টার্টলেট ঠিক সেবা-শুশ্রূষায় পটু নন, সারাক্ষণ তাকে দেখাশুনো করলে কারেফিনোতু। জ্বরের মধ্যে বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকেছে সে সারাক্ষণ। ফিনার নাম ধরে ডেকেছে বারে বারে, মামার কথাও বলেছে বার-বার! এই ক-মাসে রবিনসন ক্রুসো হবার শখ তার কেটে গিয়েছে। ছিলো ছেলেমানুষ, উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ-প্রিয়, বাস্তব জগতের দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু এই কয়েক মাসে তার স্বপ্ন ও কল্পনা দুইই প্রচণ্ড চোট খেয়েছে।

দুর্ভোগে ভরা ডিসেম্বর কেটে গেলো এইভাবেই। বড়োদিনের সময় গডফ্রের শরীর একটু-একটু ক’রে সেরে উঠতে লাগলো। টার্টলেট অবিশ্যি কখনো রোগে ভোগেননি। কিন্তু কী তাঁর বিলাপ সারাক্ষণ! সমস্ত সময় কী ফোঁশ-ফোঁশ হাহুতাশ! এমনকী আজকাল আর কখনো পকেট-বেহালাতেও ছড় টানেন না তিনি।

কেবল-যে বন্য জন্তুদের পুনরাবির্ভাবের ভয়েই গডফ্রে ঘাবড়ে ছিলো, তা নয়। জংলিদের ফিরে-আসার সম্ভাবনাটাও নেহাৎ কম নেই। বেড়া দিয়ে জানোয়ারদের না-হয় একটু ঠেকানো যাবে, কিন্তু জংলিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এই বেড়া মোটেই যথেষ্ট নয়। তখন হয়তো উইল-ট্রির মগডালে চ’ড়েই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ভিতর থেকে বেয়ে-বেয়ে ওঠা অবিশ্যি তেমন কঠিন হবে না–কিন্তু ঝামেলা তো বটে! কাজটা সহজ করবার জন্যে কারেফিনোতুর সাহায্যে সে গাছটার মধ্যে সিঁড়ির মতো ধাপে-ধাপে খাঁজ কেটে রেখে দিলে।

সিঁড়িটা তৈরি হ’য়ে গেলে একটু তদারক ক’রে সন্তুষ্ট চিত্তে গডফ্রে বললে, ‘যাক! নিচের বাড়িটা হ’লো শহুরে, আর গাছের উপরকার আশ্রয়টা হ’লো আমাদের গ্রীষ্মাবাস!

‘সে-ক্ষেত্রে মানগোমেরি স্ট্রিটের মণিকোঠাই আমার ঢের বেশি পছন্দ,’ তৎক্ষণাৎ মন্তব্য করলেন টার্টলেট।

বড়োদিন এলো। মারকিন মুলুকে বড়োদিনের সময় জাঁকজমকের অন্ত থাকে না। উইল-ট্রিতেও ভূরিভোজ হলো। টার্টলেটের নৃত্য বা বেহালাবাদনও ছিলো। কিন্তু তবু ঠাণ্ডা, বৃষ্টিভেজা, বরফ-ঢাকা নববর্ষের দিনগুলো তাদের মোটেই আশাপ্রদ ঠেকলো না। ‘স্বপ্ন’ জাহাজের যাত্রী দুজন ছ-মাস হ’লো এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছে—এই ছ-মাস ধ’রে জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই তাদের নেই। যে-ভাবে নতুন বছর শুরু হ’লো, তাতে বোঝা গেলো তাদের কপালে আরো দুর্ভোগ আছে। ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বীপে একটানা তুষারঝুরি ঝরলো। একটা বিষম ঠাণ্ডা ভেজা রাত নামলো দ্বীপে ১৮ তারিখে, কুয়াশায় চারদিক আবছা হ’য়ে আছে। টার্টলেট আর কারেফিনোতু বিছানায় শুয়ে এ-পাশ ও-পাশ করছে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। মশালের আলোর সামনে ব’সে গডফ্রে তার বাইবেলের পাতা ওলটাচ্ছে, এমন সময় দূরে কিসের একটা আওয়াজ হ’লো।

আওয়াজ নয়, গর্জন। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে সেই গর্জন। আর সন্দেহ নেই–ভুল হবার কোনো জো নেই। অবশেষে বুনো জানোয়ারদের আবির্ভাব হ’লো। শোনা গেলো বাঘের গলার চাপা রাগি তীব্র গরর্র্ গর্জন, হায়েনার হা-হা, চিতার চীৎকার, সিংহের সর্বনেশে ডাক—সব মিলে সে-এক ভয়াবহ ও দুর্ধর্ষ ঐকতান!

গডফ্রে, টার্টলেট আর কারেফিনোতু ধড়মড় ক’রে উঠে বসলো। উদ্বেগে উত্তেজনায় তাদের মুখে আর কোনো কথা সরছে না। হঠাৎ এত ধরনের এতগুলো জন্তুর গর্জন শুনে এমনকী কারেফিনোতু শুদ্ধু ভয় পেয়ে গিয়েছে—আর ভয়ের চেয়েও বেশি হচ্ছে তার বিস্ময়।

সাংঘাতিক দুটি দীর্ঘ ঘণ্টা গেলো। তিনজনেই প্রায় একপায়ে খাড়া—উৎকর্ণ ও প্রস্তুত। গর্জনগুলো শোনা যাচ্ছে একেবারে যেন কানের পাশে, এত কাছে। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ গর্জন থেমে গেলো। যেন জন্তুগুলো ঘুরে-ঘুরে অচেনা জায়গাটা ভালো ক’রে দেখে নিচ্ছে। তাহ’লে উইল-ট্রি বুঝি এ-যাত্ৰা বেঁচেই গেলো!

‘বাঁচুক, না-বাঁচুক, আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা,’ বললে গডফ্রে, ‘সব কটাকে না-মারতে পারলে এই দ্বীপে আর-কখনো আমরা নিরাপদ আর নিশ্চিন্ত হ’তে পারবো না।’

মাঝরাতের একটু পরেই সেই রাগি গর্জন আবার উইল-ট্রির কাছে ফিরে এলো!

নিজের ছায়ায় চেয়েও তারা সত্যি! কিন্তু কোত্থেকে এলো এই বাঘ সিংহ? তারা নিশ্চয়ই হঠাৎ এসে এই দ্বীপে হাজির হয়নি : গডফ্রেরা দ্বীপে পা দেবার আগে থেকেই নিশ্চয়ই তারা দ্বীপে ছিলো! অত বার গডফ্রে একা-একা সারা দিন ধ’রে দ্বীপটায় ঘুরে বেড়িয়েছে, বনে-জঙ্গলে ঢুঁ মেরেছে—কিন্তু একবারও তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। ভারি আশ্চর্য! কোথায় তারা লুকিয়েছিলো এত কাল? কোথায় তাদের সেই রহস্যময় ডেরা, যেটা আজকে এতগুলো ভীষণ জীব উগরে দিলো? আর এটাও আশ্চর্য : বাঘ, চিতা, নেকড়ে, হায়েনা, সিংহ—সব কিনা একসঙ্গেই এসে হাজির!

কারেফিনোতু যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। চুল্লির কম্পিত আলোয় দেখা গেলো তার মুখে জগতের বিস্ময় জেগে উঠেছে! টার্টলেট তো সেই থেকে এক কোনায় বসে-বসে বিলাপ করছেন আর কারাচ্ছেন। আর গডফ্রে একটা বিষম বিপদের ভয়ে একেবারে অস্থির হ’য়ে উঠেছে, যেন আগে থেকেই সে টের পেয়ে গেছে একটা সাংঘাতিক আক্রমণ আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী। এদিকে ছাগল-ভেড়াগুলো ভীষণ উত্তেজিতভাবে ডাকছে—তারা সব্বাই এসে উইল-ট্রির তলায় ভিড় ক’রে দাঁড়াতে চাচ্ছে!

‘বেড়ার দরজাটা খুলতেই হবে!’ বলে উঠলো গডফ্রে।

কারেফিনোতু ঘাড় নেড়ে সায় দিলে। গডফ্রে কী বলতে চাচ্ছে, তা বোঝবার জন্যে তাকে ভাষা জানতে হ’লো না।

গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় ক’রে আতঙ্কগ্রস্ত জীবেরা বেড়ার মধ্যে ঢুকে পড়লো। কিন্তু সেই মুহূর্তে দরজার ও-পাশে অন্ধকারে দেখা গেলো একজোড়া জ্বলন্ত চক্ষু!

আর এমনকী বেড়া বন্ধ করারও সময় নেই!

গডফ্রের উপর লাফিয়ে প’ড়ে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ ক’রে দিতে মাত্র এক পলক সময় লাগলো কারেফিনোতুর!

গর্জন শুনে তখন বোঝা গেলো তিন-চারটে জন্তু লাফিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।

ভীষণ সেই গর্জনের সঙ্গে ভীত কাতর প্রাণীদের আর্তনাদ মিলে জায়গাটা যেন ভৌতিক ও ভয়ংকর হ’য়ে উঠলো। গৃহপালিত জীবগুলো যেন ফাঁদে পড়েছে—বেড়ার বাইরে পালিয়ে যাবারও উপায় নেই—একেবারে সরাসরি যেন বলি দেয়া হ’লো ওদের।

গডফ্রে আর কারেফিনোতু তখন উইল-ট্রির মধ্য থেকে ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছে!

বাঘ, না সিংহ-কে জানে! কিন্তু নিরীহ ছাগল-ভেড়ার নিধন শুরু হ’য়ে গেছে তখন। রক্তারক্তি, আর্তনাদ, চাপা গর্জন অন্ধকারকে যেন আরো-ছমছমে ক’রে দিলে।

টার্টলেট ভয়ে-ভয়ে অন্ধ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন। ঘুলঘুলি দিয়ে ধুমধাড়াক্কা গুলিই চালিয়ে দিতেন নির্ঘাৎ, কিন্তু গডফ্রে বাধা দিলে। ‘অন্ধকারে মাঝখান থেকে গুলিটা নষ্ট হবে—তাগ ফসকাবে, গায়ে লাগবে না—গুলিটাই বেমক্কা বাজে-খরচ হবে। এখন আর একটা গুলিও নষ্ট করা চলবে না—দিনের আলোর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।’

ঠিকই বলেছিলো গডফ্রে। অন্ধকারে গুলি চালালে বুনো জানোয়ারের গায়ে না-লেগে পোষা জীবগুলোর গায়েও লেগে যেতে পারে—পোষা জীবদের সংখ্যা যেহেতু অনেক বেশি, সেইজন্যে সে-সম্ভাবনাটাই প্রবলতর। এখন আর তাদের রক্ষা করা অসম্ভব। হয়তো আকণ্ঠ ভোজন ক’রে সূর্য ওঠার আগেই বুনো জানোয়ারগুলো চম্পট দেবে। পরের বার আক্রমণ করলে কী করতে হবে, সেটাই এখন বিবেচ্য। হয়তো অন্ধকারের মধ্যে একবার যদি তারা টের পায় যে এখানে মানুষ আছে, তাহ’লে হয়তো উইল-ট্রিকেই বেমক্কা আক্রমণ ক’রে বসবে!

টার্টলেটের মাথায় তখন কোনো কথা ঢুকলে তো! ভয়ে ঠকঠক ক’রে কাঁপছেন, আর চোখ বুজেই বন্দুক বাগিয়ে ধরছেন! শেষটায় গডফ্রে বন্দুকটা তাঁর হাত থেকে কেড়েই নিলে। টার্টলেট তখন বিছানায় গিয়ে উপুড় হ’য়ে শুয়ে রইলেন। চোখ বুজে হয়তো ভাববার চেষ্টা করলেন এ-সব তাণ্ডব তাঁর দুঃস্বপ্নের মধ্যেই ঘটছে—মোটেই বাস্তব নয়।

বাইরে ইতিমধ্যে রক্তের গন্ধে-গন্ধে আরো কতগুলো আমিষখোর এসে জুটেছে। দাপাদাপি ক’রে তারা ছুটে বেড়াচ্ছে চারদিকে, উইল-ট্রির চারপাশে চক্কর দিচ্ছে, আর রাগি গর্জনে বারে বারে রাতটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে! ছাগল-ভেড়া বধ ক’রেই তাদের পরিতোষ হয়নি, তারা আরো রক্ত-মাংস চায়।

গডফ্রেরা একেবারে পাথরের মূর্তিরমতো স্থির হ’য়ে রইলো। হয়তো নড়াচড়ার আওয়াজ পেলে জন্তুগুলো উইল-ট্রিকেই আক্রমণ ক’রে বসবে! ঠিক এমন সময় একটা আচম্বিত দুর্ভাগা গুলি তাদের উপস্থিতি ফাঁস করে দিলে।

টার্টলেট যে কখন দুঃস্বপ্নের ঘোরে উঠে ব’সে রিভলভার তুলে নিয়েছিলেন, গডফ্রে তা লক্ষ করেনি। তাই সে কোনো বাধা দেবার আগেই, চোখ বুজেই দুমদাম গুলি চালিয়ে দিয়েছেন টার্টলেট! উইল-ট্রির দরজা ফুঁড়ে গুলিটা চ’লে গেলো।

‘বেওকুফ! আহাম্মক!’ ব’লে গডফ্রে তার নাচের মাস্টারমশাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আর কারেফিনোতু তক্ষুনি তাঁর হাত থেকে রিভলভারটা জোর ক’রে কেড়ে নিলে।

কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হ’য়ে গেছে। গুলির শব্দ হবামাত্র গর্জনটা আরো প্রচণ্ড ও ক্রুদ্ধ হ’য়ে উঠলো। উইল-ট্রির গায়ে নখের আঁচড় হ’লো হিংস্রভাবে। দরজায় পড়লো প্রচণ্ড থাবা! ওই প্রবল আক্রমণ সইতে পারে, দরজাটা মোটেই ততটা শক্ত নয়।

‘আর নয়—এবার প্রতিরোধ করতেই হবে!’ চেঁচিয়ে বললে গডফ্রে। বন্দুক কার্তুজের থলি তুলে নিয়ে সে তৈরি হ’য়ে নিলে। গিয়ে দাঁড়ালে একটা ঘুলঘুলির কাছে।

কারেফিনোতুও ততক্ষণে আরেকটা বন্দুক তুলে নিয়ে অন্য ঘুলঘুলিটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে কখনোই সে বন্দুক ব্যবহার করেনি! কী সর্বনাশ! কিন্তু তখন আর সেদিকে নজর দেবার সময় নেই।

গ’র্জে-গ’র্জে উঠতে লাগলো বন্দুক! ঝিলিক তুলে গুলি ছুটছে, শব্দ হচ্ছে কানে-তালা-লাগানো : ‘গুড়ুম! গুড়ুম!’ সেই সঙ্গে উঠছে রাগি ও আহত গর্জন! সিংহ আর বাঘ, হায়েনা আর চিতা—সংখ্যায় অন্তত বিশ-পঁচিশটা হবে! আর তাদের গর্জন শুনে দূর থেকে আরো জানোয়ার ছুটে আসছে। যেন কেউ একটা আস্ত পশুশালারই দরজা খুলে দিয়েছে—আর চাপা রাগে গজরাতে-গজরাতে জন্তুগুলো বেরিয়ে পড়েছে সবেগে!

টার্টলেট কী করছেন না-করছেন, তখন আর সেদিকে নজর দেবার সময় নেই। গডফ্রে আর কারেফিনোতু প্রাণপণে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে, সাবধানে তাগ ক’রে একেবারে নিশ্চিত না-হ’য়ে কিছুতেই গুলি ছুঁড়ছে না। ঠিক যখন বন্দুকের সামনে দেখা দেয় মস্ত মিশকালো ছায়া ও ভাঁটার মতো জ্বলন্ত চক্ষু, তক্ষুনি ঝিলিক দিয়ে ওঠে বন্দুক, আওয়াজ হয় গুড়ুম আর আহত রুষ্ট চীৎকার জানিয়ে দেয় যে গুলি বিঁধেছে।

হাঁপ ছাড়ার ফুরশৎ পাওয়া গেলো মিনিট কুড়ি পরে। জন্তুগুলো কি সাময়িকভাবে চম্পট দিয়েছে? ফিরে আসবে দিনের বেলায়? আক্রমণ করবে নতুন তেজে? কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর নেই। কিন্তু গডফ্রে আর কারেফিনোতু কিছুতেই আর ঘুলঘুলির কাছ থেকে নড়লো না। সবচেয়ে আশ্চর্য কারেফিনোতুর কাণ্ড! এই প্রথম সে বন্দুক চালাচ্ছে—কিন্তু, শাবাশ, কী তার টিপ—তার একটা গুলিও বোধহয় ফসকায়নি!

রাত দুটো নাগাদ আবার এলো আক্রমণ। এবার আগের চেয়েও অনেক প্রচণ্ড ও তীব্র। যেন তাণ্ডব শুরু হ’য়ে গেছে। উইল-ট্রির ভিতরটা পর্যন্ত আর নিরাপদ নয়। নতুন ক’রে উইল-ট্রির আশপাশ থেকে উঠছে বুনো জন্তুদের গর্জন। কিন্তু ঘুলঘুলি থেকে কোনো জন্তুকেই দেখা যাচ্ছে না ব’লে তারা গুলি করতেও পারছে না। ঘুলঘুলি দুটো পরস্পরের বিপরীত দিকে এমনভাবে বসানো যে সেখান থেকে সব দিক ভালো দেখা যায় না। এবার আবার জন্তুরা দরজায় থাবা আছড়াচ্ছে! পাল্লাটা কাঁপছে—ভেঙে পড়লো ব’লে! আর রক্ষে নেই! দরজাটা ভেঙে পড়লে জন্তুরা তাদের টুকরো-টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেলবে!

উঠে পড়ো উপরে-এক্কেবারে গাছের মগডালে!’ চেঁচিয়ে গডফ্রে ব’লে উঠলো। ভাগ্যিশ, সিঁড়িটা বানিয়ে রেখেছিলো! বন্দুক আর রিভলভার, গুলি আর কার্তুজ নিয়ে গডফ্রে আর কারেফিনোতু তৈরি হ’য়ে দাঁড়ালে

‘উঠুন! উঠুন!’ টাৰ্টলেটকে তাড়া দিলে গডফ্রে।

কিন্তু তাড়া দেবার দরকার ছিলো না। ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে টার্টলেট ততক্ষণে একেবারে মগডালে গিয়ে উঠে বসেছেন।

গডফ্রে আর কারেফিনোতু তিরিশ ফিটও ওঠেনি তখন—উইল-ট্রির দরজা ভেঙে পড়লো। এবার গর্জন উঠছে কোটরের মধ্য থেকে! আরেকটু দেরি হ’লেই গিয়েছিলো—আর দেখতে হ’তো না! চটপট তারা উপরে উঠে পড়লো।

ডালপালার আড়াল থেকে তাদের স্বাগত জানালে এক বিষম ভীত চীৎকার। টার্টলেট ভেবেছেন বুঝি-বা বাঘেরাই গাছে উঠে পড়েছে—তাই পরিত্রাহি চ্যাচাচ্ছেন। এমনভাবে ডাল ধ’রে ঝুলছেন যে, যে-কোনো মুহূর্তে নিচে প’ড়ে যেতে পারেন। কারেফিনোতু গিয়ে তাঁকে টেনে তুললো—একটা ডালে বেশ ভালো ক’রে ব’সে টার্টলেট এবার কোমরবন্ধ দিয়ে নিজেকে ক’ষে বেঁধে ফেললেন।

গডফ্রে আর কারেফিনোতু বসলো ছাতে ওঠার ফোকরটার মুখে—যাতে পর-পর নিচে গুলি করা যায়। যদি জন্তুগুলো উপরে,ওঠবার চেষ্টা করে শুধু তখনই তারা গুলি চালাবে।

নিচে কী কাণ্ড হচ্ছে, তা একবার নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলে গডফ্রে। কিন্তু রাতটা আবার বড্ড অন্ধকার! তবে নিচে জন্তুদের গর্জন মোটেই থামছে না—বোঝা গেলো যে বাঘ-সিংহরা খুব চটপট জায়গাটা ছেড়ে চ’লে যাবে না।

চুপচাপ ব’সে-ব’সে সেই গর্জনই তারা শুনতে লাগলো।

হঠাৎ চারটে নাগাদ গাছের তলায় দাউদাউ ক’রে আগুন জ্বলে উঠলো। দরজা-জানলা দিয়ে পরের মুহূর্তে আগুন ঢুকে পড়লো কোটরের মধ্যে—তারপরেই ছাতের ফোকর দিয়ে ধোঁয়া উঠতে লাগলো।

‘এ আবার কী কাণ্ড?’ গডফ্রে অবাক হ’য়ে জিগেশ করলে।

কাণ্ড আর-কিছুই নয়—ঘরের মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড করতে গিয়ে জন্তুরা চুল্লির আগুনটা চারদিকে ছিটিয়েছে—আর তাই থেকেই এই মস্ত দেবদারুতে আগুন ধরে গিয়েছে! পাথর বসিয়ে-বসিয়ে তারা চুল্লিটা তৈরি করেছিলো, তাই এতদিন কোনো অগ্নিকাণ্ড হয়নি। কিন্তু জন্তুরা ঘরে শিকার না-পেয়ে ভিতরকার সব জিনিশ নিশ্চয়ই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছত্রখান করে দিয়েছে—আর শুকনো গাছটার গায়ে তক্ষুনি আগুন ধ’রে গেছে।

এ-তো আরো শোচনীয় অবস্থা হলো তাদের! আগুনের শিখা লোলুপভাবে গাছটাকে ঘিরে নাচছে, চারদিক আলো হ’য়ে গেছে, আর সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে উইল-ট্রিকে লক্ষ্য করে জন্তুদের লম্ফঝম্প। হঠাৎ সমস্ত-কিছু কাঁপিয়ে একটা মস্ত বিস্ফোরণের শব্দে আস্ত গাছটা থরথর করে কেঁপে উঠলো! উইল-ট্রির মধ্যে বাক্সভর্তি যে-গুলিবারুদ ছিলো, তাই ফেটে পড়েছে, আর কোটরের মুখ দিয়ে প্রায় কামানের গোলার মতো বেরিয়ে পড়েছে।

আরেকটু হ’লেই গডফ্রে আর কারেফিনোতু ওই প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে টাল সামলাতে না-পেরে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়তো। ভাগ্যিশ, টার্টলেট কোমরবন্ধ দিয়ে নিজেকে একটা ডালের সঙ্গে শক্ত ক’রে বেঁধে নিয়েছিলেন, না-হ’লে তাঁর অবস্থাও হ’তো শোচনীয়!

কিন্তু সেই কামাননিনাদে ফল হলো। বিস্ফোরণের ফলে জন্তুরা কেউ-কেউ ভীষণভাবে জখম হ’য়ে পড়লো, অন্যরা ভয়ে অস্থির হ’য়ে পড়ি-মরি করে সে-তল্লাট ছেড়ে চম্পট দিলে। কিন্তু সেই সঙ্গে আগুনের প্রতাপও বেড়ে গেলো : দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে—আস্ত গাছটাই বুঝি পুড়ে যাবে। দাবানলের চেয়েও ভীষণ এই আগুন!

উইল-ট্রির ভিতরটা লকলকে হাজার জিহ্বায় চাটছে আগুন। মরা কাঠ শব্দ ক’রে ফাটছে। একটা লম্বা শিখা বুঝি ছাদের ফোকরটাই ছুঁয়ে ফ্যালে! একটা মস্ত দেওয়ালির জৌলুশ ঝলশে উঠেছে যেন দ্বীপে—শুধু দেবদারুতলাই আলো হ’য়ে ওঠেনি, ফ্ল্যাগ-পয়েন্ট থেকে স্বপ্ন-সাগরের দক্ষিণবিন্দু অব্দি আলোয় ভ’রে গিয়েছে।

পরক্ষণেই আগুন পৌঁছুলো একেবারে গডফ্রেদের কাছে। আগুনের সঙ্গে তারা যুঝবে কী করে? তবে কি তাদের জীবন্ত ঝলসে মরতে হবে এখানে? লাফিয়ে পড়বে নিচে? কিন্তু অত উঁচু থেকে লাফ দিলে তো হাড়গোড় ভেঙে দ হ’য়ে যাবে! কী করবে তবে তারা?

ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেছে, নিশ্বেস নিতে কষ্ট হয়। আগুনের আঁচ গায়ে লাগছে, সারা গা যেন ঝলসে যাচ্ছে।

এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ উঠলো মড়মড়ে। উইল-ট্রির শেকড়শুদ্ধু পুড়ে গিয়েছে, আর তার ফলেই আস্ত গাছটা ভেঙে পড়লো।

কিন্তু মাটিতে পড়লো না। বীথিকার অন্য দেবদারুগুলোর গায়ে ঠেকে গেলো গাছটা—মাটি থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকানো একটা দোলনার মতো উইল-ট্রির মগডাল শূন্যে ঝুলে রইলো

গাছটাকে পড়তে দেখে গডফ্রেরা ভেবেছিলো, আর বুঝি রক্ষা নেই! কিন্তু এই অবস্থায় হঠাৎ গডফ্রে শুনতে পেলে, কে যেন ইংরেজিতে ব’লে উঠলো ‘উনিশে জানুয়ারি!’

কে বললো এ-কথা?

কে আবার? কারেফিনোতু! হ্যাঁ, কারেফিনোতুই ইংরেজিতে কথা কটা ব’লে উঠেছে। যে-কথা এতকাল উচ্চারণ করা তো দূরের কথা, ঠিকমতো সে বুঝতেই পারতো না!

‘কী বললে? কী বললে তুমি?’ গডফ্রে হতভম্ব হ’য়ে গেলো!

‘বলছি যে,’ কারেফিনোতু বললে, ‘আজকেই আপনার মামা কোল্ডেরুপের এখানে পৌঁছুবার কথা, মিস্টার মরগান। আজ যদি উনি এখানে এসে না-পৌঁছোন তো আর দেখতে হবে না—আমাদের সবাইকে তাহ’লে মরতে হবে।’

২০

এ কোন দেশি হেঁয়ালি?
সব কি তবে সত্যি-সত্যি
উইল-মামার খেয়াল-ই?

ঠিক তক্ষুনি উইল-ট্রির কাছেই কতগুলো বন্দুকের আওয়াজ উঠলো।

আর সেই মুহূর্তেই, বলা নেই কওয়া নেই, আকাশ ভেঙে শুরু হ’লো মুষলধারে বর্ষণ! কে যেন আকাশে একটা মস্ত চৌবাচ্চা উপুড় ক’রে দিয়েছে, আর বৃষ্টির জলে তক্ষুনি উইলট্রির আগুন নিভে গেলো।

এই হেঁয়ালির কী ব্যাখ্যা দেবে গডফ্রে! কারেফিনোতু খাশ মারকিন উচ্চারণে ইংরেজি বলেছে, শুধু তা-ই নয়, নাম ধ’রে ডেকেছে তাকে, আরো বলেছে যে আজকেই উইল-মামা নাকি দ্বীপে এসে পৌঁছুবেন! এবং তারই কথায় সায় দিয়েই যেন গ’র্জে উঠেছে বন্দুক!

সে কি আতঙ্কে-ভয়ে শেষটায় পাগল হয়ে গিয়েছে? কিন্তু এই দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মাথমুণ্ডু বোঝবার আগেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে হন্তদন্ত হ’য়ে একদল নাবিককে ছুটে আসলে দেখা গেলো।

গডফ্রে আর কারেফিনোতু হুড়মুড় ক’রে নেমে পড়লো গাছ থেকে। মাটিতে পা দেবামাত্র গডফ্রে যে-দুটি গলা শুনলে, তাদের তার স্বপ্নেও

চিনতে ভুল হবার কথা নয়।

কী-হে ভাগ্নে? কী খবর?’

‘গডফ্রে!’—

‘উইল-মামা? তুমি! ফিনা? তুমি!’ গডফ্রে একেবারে স্তম্ভিত।

ততক্ষণে কাপ্তেন টারকটের নির্দেশে দুটি মাল্লা উইল-ট্রিতে উঠে পড়েছে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে তারা টুশটুশে মাকাল ফলের মতো টার্টলেটকে গাছ থেকে পেড়ে আনতে। ততক্ষণে নিচে হেঁয়ালিটার সমাধান হচ্ছে।

‘তুমি! উইল-মামা?’

‘হ্যাঁ, আমি!’

‘ফিনা আইল্যাণ্ডের কথা তুমি জানতে পেলে কী ক’রে?’

‘ফিনা আইল্যাণ্ড?’ উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপ বললেন, ‘বলা উচিত স্পেনসার আইল্যাণ্ড! তা, সেটা কী একটা কঠিন কাজ? ছ-মাস আগেই দ্বীপটা আমি কিনে নিয়েছি কি না—’

‘স্পেনসার আইল্যাণ্ড!’

‘তুমি দ্বীপটাকে ফিনা আইল্যাণ্ড বলে নাম দিয়েছিলে, গডফ্রে? ফিনা হলানির মধুর জিজ্ঞাসা শোনা গেলো।

‘নতুন নামটাই ভালো—ওই নামেই আমরা দ্বীপটাকে ডাকবো,’ মামা বললেন, ‘তবে ভূগোলের পণ্ডিতদের কাছে দ্বীপটার নাম স্পেনসার আইল্যাণ্ড—সান ফ্রানসিসকো থেকে মাত্র তিন দিনের পথ। আমি ভেবেছিলুম রবিনসন ক্রুসোর শাগরেদি করার জন্য এই দ্বীপটা তোমাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে!’

‘অ্যা? কী বললে তুমি, মামা? ক্রুসোর শাগরেদি?’ গডফ্রে বললে, ‘তা ঠিকই করেছো। এই দুর্ভোগ আমার প্রাপ্য ছিলো। কিন্তু মামা, ‘স্বপ্ন’র জাহাজডুবি?’

‘অভিনয়, ও একটা মিথ্যে অভিনয়,’ কোল্ডেরুপের অমন ফুর্তিবাজ চেহারা গডফ্রে আগে কখনো দ্যাখেনি, ‘স্বপ্ন’টাকে আদ্ধেক ডোবাবার ভান করেছিলেন কাপ্তেন টারকট—আমারই নির্দেশ ছিলো। তোমরা ভেবেছিলে বুঝি সত্যিই জাহাজটা ডুবে গেছে! টারকট যেই দেখলেন যে তোমরা বেশ বহাল তবিয়তেই দ্বীপে গিয়ে উঠেছো, অমনি তিনি জাহাজটা থেকে জল ছেঁচে ফেলে পুরোদমে চালিয়ে দেন—সোজা সান ফ্রানসিসকো চ’লে আসেন তিন দিনেই। কাপ্তেন টারকটই এই নির্দিষ্ট তারিখে আমাদের স্পেনসার আইল্যাণ্ডে নিয়ে এসেছেন।’

‘তাহ’লে মাল্লারা কেউ মরেনি?’

‘না। কেবল সেই-যে চিনে জাহাজের খোলে লুকিয়েছিলো, তার আর কোনো পাত্তা পরে পাওয়া যায়নি!’

‘কিন্তু জংলিদের ক্যানু?’

‘সেও অভিনয়। ক্যানুটা আমারই বানানো।’

‘আর জংলিরা?’

‘সেও নকল। ভাগ্যিশ তোমাদের গুলি ওদের লাগেনি।’

‘কিন্তু কারেফিনোতু?’

‘সেও অভিনয়। কারেফিনোতু হ’লো আসলে আমার অতিবিশ্বস্ত জাপ ব্রাস—দেখতে পাচ্ছি ক্রুসোর শুক্কুরবারের ভূমিকায় সে চমৎকার অভিনয় করেছে!’

‘হ্যাঁ।’ গডফ্রে সায় দিলে, ‘উনি দু-বার আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছেন। একবার এক ভালুকের হাত থেকে, আরেকবার এক বাঘের হাত থেকে।’

‘দুটোই নকল! কোনোটাই জ্যান্ত নয়।’ হো-হো ক’রে হেসে উঠলেন উইল-মামা, দুটোর মধ্যেই খড় পোরা। জাপ ব্রাস ও তার সঙ্গীদের সঙ্গেই ও-দুটো দ্বীপে অবতীর্ণ হয়।

‘কিন্তু বাঘ-ভালুকের তো থাবা-টাবা নড়ছিলো!’

‘ভিতরে স্প্রিং-বসানো পুতুল কিনা, তাই। দু-বারই জাপ ব্রাস আগে গিয়ে ওগুলোকে রাস্তায় রেখে দিয়ে আসে। সবই বানানো ব্যাপার!

‘অ্যা! সবগুলোই বানানো?’

‘বাঃ রে! তোমরা দিব্যি ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছিলে দ্বীপে—একটু-আধটু উত্তেজনা না-হ’লে মানাবে কেন ক্রুসোদের?’

এবারে গডফ্রেও আর হাসি চাপতে পারলে না। ‘কিন্তু তুমি যদি আমাদের জন্য সবই মসৃণ ও সহজ করতে চাওনি তাহ’লে সিন্দুক ভর্তি সব জরুরি জিনিশ রেখে গিয়েছিলে কেন? ‘

‘সিন্দুকভর্তি জরুরি জিনিশ!’ কোল্ডেরুপ তো অবাক! ‘কোন্ সিন্দুক! আমি তো কোনো সিন্দুক পাঠাইনি তোমাদের জন্যে—নিশ্চয়ই দৈবাৎ—’

বলতে-বলতে উইল-মামা ফিনার দিকে ফিরে তাকালেন, অমনি ফিনা মাথা নুইয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো।

হুম্! এই ব্যাপার! সিন্দুক! তাহ’লে ফিনার নিশ্চয়ই কোনো শাগরেদ—’ উইল-মামা কাপ্তেন টারকটের দিকে ফিরে তাকালেন।

টারকট হেসে বললেন, ‘কী করবো, বলুন, মিস্টার কোল্ডেরুপ? আপনাকে না-হয় অনেক ব্যাপারে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে পারি। কিন্তু মিস ফিনা—তাঁকে সামলানো বড্ড কঠিন ছিলো আমার পক্ষে। চারমাস আগে আপনি যখন আমাকে দ্বীপের খবরাখবর নিতে পাঠান, তখন ওই সিন্দুক-

‘ফিনা! তোমার এই কাণ্ড!’ গডফ্রে তার দিকে তাকালে। ‘কাপ্তেন টারকট! আপনি যে বলেছিলেন সব কথা গোপন রাখবেন,’ ফিনা কিন্তু লজ্জায় একেবারে আরক্তিম।

উইল-মামা রাগ করতে গিয়েও তার দশা দেখে হেসে ফেললেন।

সব কথা শুনে গডফ্রেও আর হাসি চাপতে পারেনি। কিন্তু টার্টলেট এবার আর সামলাতে পারলেন না, বললেন, ‘আপনি কি বলতে চান, মিস্টার কোল্ডেরুপ যে, যে-কুমিরটা আমাকে তাড়া করেছিলো, সেটাও কাগজের তৈরি আর স্প্রিং-এ চলা?’

‘কুমির!’

‘হ্যাঁ, মিস্টার কোল্ডেরুপ,’ কারেফিনোতু ওরফে জাপ ব্রাস বললে, ‘একটা আস্ত জ্যান্ত কুমির! সেটা কিন্তু আমি সঙ্গে নিয়ে আসিনি!’

তখন গডফ্রে হিংস্র জন্তুদের আক্রমণের কথা সব খুলে বললে। শুনে কোল্ডেরুপ বেশ শঙ্কিতই হ’য়ে পড়লেন। এ-কথা তো তাঁর জানা ছিলো না। অনেকদিন ধরেই সব্বাই জানে যে স্পেনসার আইল্যাণ্ডে এমনকী ছোট্ট কোনো আমিষখোর জন্তুও থাকে না। তাঁর দলিলে এ-কথা স্পষ্ট লেখা আছে। দ্বীপটা কেনবার সময় তিনি তন্নতন্ন ক’রে দলিলটা পড়েছেন!

তাছাড়া দ্বীপের মধ্যে রহস্যময় ধোঁয়াই বা বারে বারে উঠছিলো কেন, তাও তিনি বুঝতে পারছিলেন না। অভিনয়ের প্রযোজক হিশেবে সব তাহ’লে তিনি ঠিকমতো চালাতে পারেননি। তাহ’লে সত্যিই কোনো রহস্য আছে দ্বীপে।

টার্টলেট অবশ্য অভিনয়কেও অভিনয় ব’লে মানতে নারাজ। না-হ’লে জীবনের প্রথম গুলি তো লক্ষ্যে বিঁধেছিলো, এ-কথা ব’লে তিনি জাঁক করবেন কী ক’রে?

উইল-মামা কিন্তু দ্বীপের রহস্যটা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। সত্যিকার জ্যান্ত হিংস্র জানোয়ার কোত্থেকে এলো দ্বীপে? আর ওই ধোঁয়া? হেঁয়ালির উত্তরটা বার করতে না-পেরে আপাতত তিনি ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন; গডফ্রেকে জিগেস করলেন, ‘গডফ্রে! তুমি তো চিরকাল দ্বীপকে ভালোবেসে এসেছো! শুনে নিশ্চয়ই খুশি হবে যে এ-দ্বীপটা আমি তোমাকেই দিয়ে দিয়েছি। এখন এ-দ্বীপ নিয়ে তুমি যা খুশি করতে পারো। ইচ্ছে হ’লে রবিনসন ক্রুসো হ’য়ে সারা জীবনই এই দ্বীপে তুমি কাটিয়ে দিতে পারো—আমি কোনো আপত্তি করবো না।’

‘রবিনসন ক্রুসো হবে? আমি!’ গডফ্রে ব’লে উঠলো : ‘সারা জীবন! কখনো না।’

‘তাহলে চ’লে এসো সান ফ্রানসিসকোয়। আমি তোমাদের বিয়ে দিতে চাই শিগগিরই! তাহলে কালকেই আমরা রওনা হ’য়ে পড়বো তো?’

এই প্রস্তাবে গডফ্রে তক্ষুনি ঘাড় নেড়ে সায় দিলে।

তারপরে সে সবাইকে দ্বীপটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো।

বুনো জানোয়ারদের আক্রমণে উইল-ট্রির আশপাশে আর-কিছুই আস্ত নেই। পোষা জীবগুলো সব ছিন্নভিন্ন প’ড়ে আছে—আস্ত জায়গাটা লণ্ডভণ্ড। কোল্ডেরুপরা সময়মতো না-এলে এই ক্রুসোদের অবস্থা বেশ কাহিল হ’য়ে পড়তো।

‘উইল-মামা!’ গডফ্রে বললে, ‘দ্বীপটার নাম দিয়েছিলুম ফিনার নামে, কিন্তু আমাদের বাড়ির নাম দিয়েছিলুম উইল-ট্রি!’

‘চমৎকার! গাছটার বীজ নিয়ে যেতে হবে—সান ফ্রানসিসকোয় আমার বাগানে পুঁতে দেবো ‘খন।’

রাস্তায় দু-একবার যে-বুনো জানোয়াররা সামনে পড়লো না, তা নয়। কিন্তু অতজন লোককে একসঙ্গে দেখে জানোয়ারগুলো আর আক্রমণ করার কথা ভাবলে না—নিজেরাই ঝোপে-ঝাড়ে কেটে পড়লো। কিন্তু জন্তুগুলো যে কী ক’রে এই দ্বীপে এসে হাজির হয়েছে, সেই ধাঁধাটার আর সমাধান হ’লো না।

রাতটা সবাই ‘স্বপ্ন’ জাহাজেই কাটিয়ে দিলে।

পরদিন, অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি, সকালে ‘স্বপ্ন’ ছেড়ে দিলো। আটটা নাগাদ গডফ্রে দেখলে দিগন্তে স্পেনসার, ওরফে ফিনা আইল্যান্ড মিলিয়ে গেলো। বেশ কষ্টই হচ্ছিলো তার দ্বীপ ছেড়ে যেতে। এই দ্বীপেই সে জীবনের কাছ থেকে প্রথম পাঠ নিয়েছে। ফিনা আইল্যাণ্ড এই ছ-মাসে তাকে যা শিখিয়েছে, তা সে আর কখনো ভুলবে না!

বেশ তাড়াতাড়ি সান ফ্রানসিসকোয় ফিরে এলো ‘স্বপ্ন’। আগের মতো আর দিনে-রাতে দুই সময়ে দুই দিকে যাবার চেষ্টা করলে না ব’লেই ২৩ শে জানুয়ারি ‘স্বপ্ন’ এসে সান ফ্রানসিসকোর জেটিতে ভিড়লো।

জাহাজ ভিড়তেই—তাজ্জব কাণ্ড! দেখা গেলো দ্বিতীয়বার জাহাজের খোল থেকে লুকিয়ে থাকা সেংভু বেরিয়ে এলো।

কোল্ডেরুপের কাছে গিয়ে সেংভু বললে, ‘আশা করি মিস্টার কোল্ডেরুপ আমায় ক্ষমা করবেন। প্রথমবার যখন ‘স্বপ্ন’র খোলে গিয়ে লুকিয়েছিলুম, ভেবেছিলুম সে বুঝি শাংহাই যাবে! কিন্তু এবার ‘স্বপ্ন’ থেকে নেমে যাচ্ছি আবার সান ফ্রানসিসকোতেই!’

তাকে দেখেই সবাই অবাক হ’য়ে গিয়েছিলো। কী বলবে, না-বলবে, বুঝতে পারছিলো না।

অবশেষে কোল্ডেরুপ জিগেস করলেন, ‘এই ছ-মাস নিশ্চয়ই তুমি ‘স্বপ্ন’র খোলের মধ্যেই লুকিয়ে থাকোনি?’

‘না’, সেংভু উত্তর দিলে।

‘তাহ’লে কোথায় ছিলে তুমি?’

‘কেন? দ্বীপে!’

‘তুমি? দ্বীপে ছিলে?’ গডফ্রের আর বিস্ময়ের শেষ নেই।

‘হ্যাঁ।’

‘তুমিই তাহ’লে আগুন জ্বালতে দ্বীপে?’

‘বেঁচে থাকতে হলে লোককে তো আগুন জ্বালতেই হবে!’

‘তুমি কখনো আমাদের কাছে আসোনি কেন? তাহ’লে তো আমরা এক সঙ্গেই থাকতে পারতুম

সেংভু বেশ শান্তভাবেই বললে, ‘চিনেরা একা থাকতেই ভালোবাসে। একাই একজন চিনে যথেষ্ট—তার আর কাউকে কখনো দরকার হয় না।’

‘আবার তুমি জাহাজে উঠলে কী ক’রে?’

‘১৯ জানুয়ারি রাত্রে—সাঁৎরে জাহাজে এসে উঠেছিলুম,’ ব’লে নুয়ে সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে সেংভু সব হতভম্বদের সামনে থেকে চ’লে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে নেমেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো।

‘ও-ই ইচ্ছে সত্যিকার ক্রুসো হবার যোগ্য লোক।’ বললেন উইল-মামা, ‘পারবে ওর মতো থাকতে একা-একা একটা দ্বীপে!

‘যাক!’ গডফ্রে বললো, ‘একটা ব্যাপারের হদিশ মিললো। ধোঁয়ার রহস্যটা বোঝা গেলো অবশেষে–সেংভুই না-হয় আগুন জ্বেলেছিল! কিন্তু জানোয়ারগুলো? তারা যে কী করে দ্বীপে গিয়ে উঠলো, তা বোধহয় আর-কোনোদিনও আমরা জানতে পারবো না।’

‘আর আমার কুমির!’ টার্টলেট মরা কুমিরটাকে ফেরবার সময় জাহাজে নিয়ে তুলেছিলেন, ‘কুমিররহস্যই বা ভেদ করবে কে?’

উইল-মামা বেশ একটু লজ্জা পেলেন। কিন্তু এই রহস্য ভেদ করা তাঁরও কৰ্ম নয়।

+

কয়েকদিন পরে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গডফ্রে আর ফিনার বিয়ে হ’লো। বিয়ের পরে টার্টলেট একদিন তাঁর ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের মামাকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন। তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকেই তো সকলের চক্ষুস্থির! ওই মরা কুমিরটাকে তিনি ‘স্টাফ’ করিয়েছেন—দূর থেকে তবু একেবারে জ্যান্তই দেখাচ্ছে। কড়িকাঠ থেকে কুমিরটা তিনি ঝুলিয়ে দিয়েছেন ঘরের মধ্যে—থাবা ছড়ানো, হাঁ-খোলা এই বৃহৎ কুমিরটি তাঁর বৈঠকখানার অলংকার।

কথা প্রসঙ্গে টার্টলেট বললেন, ‘জানেন, মিস্টার কোল্ডেরুপ এই কুমিরটা কোত্থেকে এসেছিলো?’

‘না।’

‘কিন্তু তার গলার কাছে একটা লেবেল সাঁটা ছিলো।’

‘লেবেল ছিলো?’

‘হ্যাঁ। এই-যে সেটা,’ ব’লে একটা চামড়ার টুকরো বাড়িয়ে ধরলেন টার্টলেট।

সবাই অবাক হ’য়ে তাকিয়ে দেখলে, লেবেলটায় লেখা :

‘হামবুর্গের হাগনেবেক কম্পানি প্রেরিত
শ্রীযুক্ত জে. আর. টাসকিনার
বরাবরেষু—
স্টকটন, আমেরিকা।’

লেবেলটা প’ড়েই কোল্ডেরুপ হো-হো ক’রে হেসে উঠলেন। এবার তিনি সব বুঝতে পেরেছেন।

নিলেমে হেরে গিয়ে তাঁর চিরশত্রু টাসকিনার এক জাহাজভর্তি নানা হিংস্ৰ জন্তু আনিয়েছেন পৃথিবীর নানা চিড়িয়াখানা থেকে—তারপর জন্তুগুলোকে গিয়ে স্পেনসার আইল্যাণ্ডে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর শত্রু ঠ্যালা সামলান। প্রতিদ্বন্দ্বীকে জব্দ করতে গিয়ে বিস্তর খরচ করতে হয়েছে তাঁকে, কিন্তু তাতেও তিনি পেছ-পা হননি।

‘চমৎকার!’ কোল্ডেরুপ ব’লে উঠলেন, ‘আমার মাথায় কখনো এই ফন্দি খেলতো না।’

‘কিন্তু ও-সব জন্তুর জন্যে যে দ্বীপটায় গিয়ে আর থাকাই যাবে না,’ বললে ফিনা।

‘ব’য়ে গেলো! শেষ সিংহটা একেবারে শেষ বাঘটা খেয়ে না-ফেলা অব্দি আমরা না-হয় অপেক্ষাই ক’রে থাকবো,’ বললেন উইল-মামা।

‘তারপরে ফিনা যাবে তো আমার সঙ্গে দ্বীপটায়—কিছুদিন গিয়ে থেকে আসবো,’ জিগেশ করলে গডফ্রে।

‘তোমার সঙ্গে থাকলে, স্বামীমশাই, আমি কোত্থাও যেতে ভয় পাই না,’ ফুরফুরে গলায় ফিনা মরগান ব’লে উঠলো।