১০. দুর্বিপাকে রবিনসন ক্রুসো

১০

পড়েছেন তো—রবিনসন ক্রুসো
নানান দুর্বিপাকে প’ড়ে ও
হারাননি তাঁর হুঁশও।

বেশ বেলা হয়েছে। সেইজন্যেই গডফ্রে ঠিক করেছিলো আজ নয়, কালকের দিন অব্দি নতুন আস্তানায় গিয়ে আশ্রয় নেবার ব্যাপারটা স্থগিত রাখবে। কিন্তু টার্টলেট যখন নাছোড়বান্দার মতো লেগে থেকে অনুসন্ধানের ফলাফল জানতে চাইলেন, তখন তাকে শেষ পর্যন্ত বলতেই হ’লো যে তারা যেখানে এসে এখন আশ্রয় নিয়েছে সেটা আসলে একটা দ্বীপ, ফিনা আইল্যাণ্ড। এবং এই মুহূর্তে মারকিন মুলুকে ফিরে যাবার কথা না-ভেবে এখানেই কোনোরকমে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করাই তাদের পক্ষে সমীচীন।

দ্বীপ! এটা একটা দ্বীপ?’ শুনেই টার্টলেটের হয়ে গেছে।

‘হ্যাঁ। এটা একটা দ্বীপ! ‘

‘যার চারপাশেই সমুদ্র?’

‘নিশ্চয়ই—তা নইলে আর দ্বীপ হবে কী ক’রে?’

‘কোন দ্বীপ এটা তাহলে?’

‘বলেছিই তো আপনাকে—ফিনা আইল্যাণ্ড। বুঝতেই তো পারছেন কেন এই নাম দিয়েছি।’

‘না তো—কিছুই বুঝতে পারছি না,’ মুখ বেঁকিয়ে বললেন• টার্টলেট, ‘তাছাড়া ফিনার সঙ্গে দ্বীপটার কোনো মিলই নেই। মিস্ ফিনার চারপাশে ডাঙা রয়েছে, জল নয়।’

এই বিষণ্ণ মন্তব্যের পর তিনি রাতটা যাতে যথাসম্ভব আরামে কাটে তারই চেষ্টা ব্যস্ত হ’য়ে পড়লেন। গডফ্রে চ’লে গেলো সমুদ্রে তীরে, বেলাভূমিতে : কেননা আবার কিছু পক্ষীডিম্ব সংগ্রহ করে আনা জরুরি। ফিরে এলো ক্লান্ত ও অবসন্ন। এসেই গাছতলায় টান হ’য়ে শুয়ে প’ড়ে ঘুম লাগালে। টার্টলেট তখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হননি ব’লেই অনেকক্ষণ সময় দর্শনচিন্তাতেই কাটিয়ে দিলেন। পরের দিন ঘুম ভাঙলো কুঁকড়োর ডাকে।

উঠেই চটপট ছোটোহাজরি সেরে নিলে দুজনে—সেই কাঁচা ডিমেই। কেবল ঝরনার জলের বদলে আজ একটা ছাগল পাকড়ে তার দুধ খেয়ে নেয়া গেলো।

ছোটোহাজরি শেষ হ’তেই গডফ্রে বললে, ‘চলুন, বেরিয়ে পড়ি।’

চললো দুজনে সমুদ্রতীর ধরেই। সঙ্গে তাড়িয়ে নিলে চললো কুঁকড়ো পরিবার ও পোষা চারপেয়েগুলোকে। গডফ্রের ইচ্ছে ছিলো দ্বীপের উত্তরদিকটায় একবার তদন্ত ক’রে আসে। উত্তরদিকে কাল সে কতগুলো মস্ত গাছ দেখেছিলো, যাদের ওপাশে তার আর চোখ যায়নি। ‘স্বপ্ন’র আরো- কোনো আরোহী হয়তো দ্বীপের ওদিকটাতেই সাঁৎরে গিয়ে উঠেছে—কিংবা হয়তো তাদের মৃতদেহ গিয়ে ঠেকেছে উত্তর তীরে-কারণ জাহাজডুবির ছত্রিশ ঘণ্টা পর তাদের কাউকে জ্যান্ত দেখবার আশা করা দুরাশা।

বালির উপর দিয়ে চলতে লাগলো তারা। কখনও ঢিবি পেরুতে হয়, কখনও দু-একটা ছোটো-বড়ো পাথরের চাঁই। মাঝে-মাঝে সমুদ্রে শ্যাওলার শুকনো স্তূপ প’ড়ে আছে : হয়তো কখনও কোনো মস্ত জোয়ারে জল অ্যাদ্দুর অবধি পৌঁছেছিলো, এ-সব তারই নিদর্শন।

আস্তে-আস্তে বেলাভূমি পেরিয়ে এলো তারা সদলবলে। গডফ্রে যাচ্ছে আগে-আগে পথ দেখিয়ে; যদিও পথটা তার মোটেই চেনা নয়, তবু সে-ই হচ্ছে বাহিনীর নেতা : পিছন-পিছন আসছেন টাৰ্টলেট, চেঁচিয়ে-মেচিয়ে হাত-পা নেড়ে সেই পোষা পশুপক্ষীকে তাড়িয়ে। হঠাৎ কতগুলো গাছের ডালে ঝলমলে কতগুলো গোল ফল ঝুলে থাকতে দেখে গডফ্রে থমকে দাঁড়ালে। দেখেই সে এদের চিনতে পেরেছে : ক্যালিফরনিয়ার কোনো-কোনো অংশে রেড-ইনডিয়ানরা এই ফলগুলো খায়—এদের তারা বলে ম্যানজানিলা’।

‘যাক,’ গডফ্রে স্বস্তির নিশ্বেস ফেললে, ‘শেষকালে ওই একঘেয়ে ডিমগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেলো।’

‘কেন? এই ফলগুলো লোকে খায় না কি?’ টার্টলেট যথারীতি তাঁর মুখ বেঁকালেন।

‘চেখে দেখলেই বুঝতে পারবেন,’ ব’লে গডফ্রে ওই ফলগুলো পেড়ে নিতে শুরু করে দিলে।

টার্টলেট একটু ইতস্তত ক’রে একটা ম্যানজানিলা চেখে দেখলেন; মন্দ লাগলো না। আসলে এগুলো বুনো আপেল, একটু অম্ল স্বাদ——কিন্তু ওই কাঁচা-ডিম-খাওয়া মুখে তাই ঠেকলো অতি সুস্বাদু।

কয়েকটা ফল খেয়ে নিয়ে আবার তাদের কুচকাওয়াজ শুরু হ’লো। বালির ঢিবিগুলো শেষ হ’য়ে গেলো একটু পরেই; বেলে মাটির পর এবার শুরু হয়েছে তৃণভূমি, আর পাশ দিয়ে গেছে একটা ছোটো স্রোতস্বিনী। আরেকটু এগুতেই সেই অতিকায় গাছগুলোর পাত্তা মিললো। প্রায় চার ঘণ্টা লাগলো তাদের এখানে পৌঁছুতে, প্রায় ন-মাইল পথ হেঁটেছে তারা এতক্ষণে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। কিন্তু তবু সব সত্ত্বেও গাছগুলোর আশপাশটা দেখে তারা অনেকটা আশ্বস্ত হ’লো।

মস্ত একটা প্রেইরির ধারে, আশপাশের ম্যানজানিলা ঝোপের লাগোয়া, অর্ধবৃত্তাকারভাবে উঠেছে অতিকায় গাছগুলো। গাছগুলো বিশাল, তলায় নরম ঘাসের সবুজ আস্তর, পাশেই গেছে সেই ছোটো জলের ধারা এবং তার পাশে ইতস্তত পাথর-ছড়ানো দীর্ঘ বেলাভূমি, সেখানে সমুদ্রের শুকনো শ্যাওলা প’ড়ে আছে।

এই মস্ত গাছগুলো এক ধরনের দেবদারু, লাতিন ভাষায় যাকে বলে ‘সেকুউইয়া গিগানতেয়া’। তারই মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড়ো সেটা গডফ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। তার গুঁড়িতে চার-পাঁচ ফুট চওড়া একটা ফোকর, উচ্চতায় ফোকরটা দশ ফুট; আর তার কোটরের মধ্যে ঢুকে পড়তে কোনো অসুবিধে হবারই কথা নয়।

‘কোনো গুহা বা গহ্বরের সন্ধান না-মিললে ভাবনা নেই,’ বললে গডফ্রে, ‘এই তো একটা রেডিমেড আস্তানা রয়েছে। কাঠের বাড়ি কিংবা একটা কেল্লাই বলতে পারেন এটাকে প্রকৃতি ঠাকরুনের নিজের হাতে গড়া। চলুন, টাৰ্টলেট, ভিতরটায় গিয়ে একবার দেখা যাক।’

ব’লে গডফ্রে তার মাস্টারমশাইকে পাকড়ে ধরে সেই সেকুউইয়ার মধ্যে টেনে নিয়ে গেলো।

কোটরটার মেঝেয় যত রাজ্যের লতাপাতা উদ্ভিদ্ শুকিয়ে আছে—সব শুদ্ধু প্রায় কুড়ি ফুট হবে মেঝের পরিধি। ছাদটা যে কত উঁচুতে, সেটা অবিশ্যি অন্ধকারে ঠিক ঠাওরানো গেলো না। এই বাকলের দেয়াল ভেদ করে কোনোদিনই বোধহয় এর মধ্যে রোদ ঢোকেনি। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বা বৃষ্টির ছাঁট ভিতরে ঢোকার ভয়ও নেই। আমাদের এই নবীন ক্রুসো দুজন অন্তত প্রকৃতির খামখেয়ালের সঙ্গে যোঝবার সুযোগ পাবে এর মধ্যে থেকে। কোনো গুহাই যেমন এ-রকম শুকনো খটখটে হ’তে পারতো না, তেমনি এত শক্ত বা দৃঢ়ও হ’তে পারতো না। এমনকী মানুষের গড়া কাঠের বাড়িও এমন সুদৃঢ় হ’তো কিনা খুবই সন্দেহ।

কী বলেন, টার্টলেট? প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া বাড়ি দেখতে কী-রকম লাগছে? এখন থেকে এটাই আমাদের বাড়ি হ’লো কিন্তু।’

‘কিন্তু চিমনি কই?’ টার্টলেট আপত্তি তুললেন।

‘চিমনির প্রশ্ন তোলবার আগে,’ গডফ্রে উত্তর দিলে, আগুন তো জ্বালি—আগুন জ্বললে পর চিমনির কথা ভাবা যাবে!’

গডফ্রের কথার যুক্তি এতই অকাট্য ও দুর্ভেদ্য যে এমনকী টার্টলেট শুদ্ধু চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন।

কোটরটার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে গডফ্রে আশপাশটা একবার অবলোকন ক’রে এলো। প্রেইরির পাশেই এই দেবদারুদের জটলা, এ-দৃশ্য আগেই দেখেছে গডফ্রে; ঘাসের জমির মধ্য দিয়ে গেছে ছোট্ট একটা স্রোতস্বিনী, যেটা একটা সতেজ শ্যামলিমা দিয়েছে পুরো তল্লাটটাকে, গজিয়েছে নানা ধরনের ঝোপঝাড় ও গাছ; মার্টল ঝোপ, ম্যানজানিলার ঝাড় আরো কত-কী। আরেকটু গিয়েই জমি ক্রমশ উঁচু হ’য়ে গিয়েছে—সেখানে রয়েছে ওক, বীচ, সিকামোর, কাঁটাঝোপ; আর প্রেইরির ওপাশে আরো অনেক ঝোপঝাড় দেখা গেলো দূর থেকে। গডফ্রে ঠিক করলে কাল সেদিকটায় গিয়ে দেখে আসবে।

মোটমাট, চারপাশটা দেখে সে বেশ তুষ্টই হ’লো। আর সে যতটা-না তুষ্ট হ’লো, তার চেয়েও বেশি পরিতোষ দেখা গেলো গৃহপালিত জন্তুগুলোর : ওই প্রেইরি দেখে তাদের ফুর্তি যেন আর ধরে না। আর কুঁকড়ো-পরিবারও জলের ধারে যথেষ্ট পোকামাকড় পেয়ে মহা আহ্লাদে তখন খুঁটে-খুঁটে খেতে শুরু ক’রে দিয়েছে।

গডফ্রে আবার তার নতুন আস্তানার কাছে ফিরে এলো। যে-গাছটায় তারা আশ্রয় নেবে ব’লে ঠিক করেছে, সেটাকে আরো ভালো ক’রে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সে। গাছটার উপরে চড়তে বেশ কষ্ট হবে—সবচেয়ে নিচু ডালপালাগুলোও বেশ উপরে, আর গাছের গায়ে এমন কোনো খাঁজ নেই, যাতে পা দিয়ে ডাল ধরে ঝুলে পড়া যায়। যদি পুরো গাছটাই ভিতরে-ভিতরে ফোঁপরা হয়ে থাকে, তবে হয়তো গাছে চড়ার পক্ষে অনেকটা সুবিধে হবে। বিপদ-আপদ দেখা দিলে গাছের উপরে গিয়ে ঘন ডালপালার আড়ালে আশ্রয় নিলে নিচে থেকে কারু সাধ্য নেই তাদের উপস্থিতি টের পায়।

কিন্তু সে-বিষয়ে পরে নজর দেয়া যাবে।

সব তদন্ত যখন তার শেষ হ’লো, সূর্য তখন দিগন্তে ঢ’লে পড়েছে। গৃহপ্রবেশের ব্যাপারটা কালকেই পুরোদস্তুর করা যাবে। আজ বরং কোটরের মধ্য গিয়ে টান হ’য়ে শুয়ে পড়াই ভালো।

রাতের ভোজটা ভালোই হ’লো : বুনো আপেল, কাঁচা ডিম, আর ছাগলের দুধ। ভূরিভোজ শেষ করে শুয়ে-পড়ার আগে গডফ্রে অবিশ্যি মস্ত গাছটার একটা নাম দিলে—’উইল-ট্রি’ : উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপের কথা মনে ক’রেই এই নামটা দিলে গডফ্রে, আর টার্টলেটও নামকরণের ব্যাপারে কোনো আপত্তি তুললেন না।

এই ক-দিনেই গডফ্রে একেবারে বদলে গিয়েছে। আর সেই হালকা চপল, খামখেয়ালি, নিশ্চিন্ত যুবকের পাত্তা নেই, তার বদলে এ যে একেবারে নতুন মানুষ : বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখে, মাথায় নানান সব ফন্দি ও উদ্ভাবনাশক্তি আনাগোনা করে, কখনও হাল ছেড়ে দেয় না, নির্ভর করতে পারে নিজের উপর, কাণ্ডজ্ঞান হারায় না, সব দায়িত্বও সে নিজের কাঁধে তুলে নিতে মোটেই দ্বিধা করেনি। ‘স্বপ্ন’ জাহাজটার সলিলসমাধি একদিক থেকে ভালোই করলো বলতে হয়—নইলে নিজের ভিতরকার এই ক্ষমতাগুলোর সন্ধান সে পেতো কী করে? চিনতো কী ক’রে নিজেকে—নিজের আসল স্বরূপকে?

এতদিন তার মধ্যে যে-দিকগুলো ঘুমিয়েছিলো, এই বিপদে-আপদে সেগুলো সব একসঙ্গে জেগে উঠে কোলাহল তুলে দিয়েছে। দুর্গতি আর দুর্দশার কাছে কিছুতেই সে হার মানবে না, এই তার পণ। তার মধ্যে যে এ-রকম তীব্র জেদ ছিলো, তাই বা মানগোমেরি স্ট্রিটের দুলালটিকে দেখে কে ভাবতে পেরেছিলো। যদি কোনোদিনও জ্যান্ত ফিরতে পারে এ-দ্বীপ থেকে, তাহ’লে এই দিনগুলোকে সে কখনো ভুলবে না—এরাই তাকে চিনিয়ে দিয়েছে আসলে সে কী-রকম মানুষ।

সকাল হ’তেই গডফ্রে উঠে পড়েছে। উদ্দেশ্য : কোটরের মধ্যেটায় সব; গোছগাছ করে ভালোভাবে আশ্রয় নেয়। খাদ্য, এবং সর্বোপরি আগুনের প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। তারপর দু-একটা ছোটোখাটো টুকিটাকি হাতিয়ার তৈরি ক’রে নিতে হবে, কাপড়-চোপড়ের প্রশ্নটাও ভুলে যাওয়া চলবে না।

টার্টলেটে অবিশ্যি তখনও শুয়ে-শুয়ে নাক ডাকাচ্ছেন। অন্ধকারে তাঁকে দেখা যায় না বটে কোটরের মধ্যে, তবে তার নাসিকার অবিরাম গর্জন কানে আসে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও, এত দুর্গতির মধ্যে প’ড়েও, বেচারার কোনো চারিত্রিক বদল হয়নি। এই দুরবস্থায় তাঁর মতো সঙ্গী কোনো দিক থেকেই খুব-একটা লোভনীয় নয়, বরং মাঝের থেকে তিনি কেবল ঝামেলাই বাড়াবেন। কিন্তু তবু তো একজন সঙ্গী, চেনা মানুষ। তাঁর সঙ্গে তো অন্তত দুটো কথা ক’য়ে বাঁচা যাবে। রবিনসন ক্রুসোর তোতাপাখির চেয়ে অধ্যাপক টার্টলেট যে অনেক ভালো, তাতে গডফ্রের সন্দেহ নেই।

তবে আজ, উনত্রিশে জুন সকালবেলায়, গডফ্রের বরং একা কাজ শুরু করতে পেরে ভালোই লাগলো। প্রথমে সব কটা দেবদারু গাছকে অত্যন্ত ভালো ক’রে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাইরে হয়তো কোনো নতুন মুখরোচক ফলের গাছ চোখে পড়ে যেতে পারে। নতুন ফল দেখে এবং চেখে অধ্যাপক টার্টলেট নিশ্চয়ই খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠবেন। তাই টার্টলেটকে তাঁর স্বপ্নের হাতে ছেড়ে দিয়েই গডফ্রে লাফিয়ে কোটর থেকে নেমে পড়লো।

হালকা কুয়াশা পড়েছে বাইরে : সমুদ্র আর বেলাভূমি তখনও কুয়াশা ঢাকা, কেবল পুবদিকে আর উত্তরদিকে—একটু-একটু করে আলো হচ্ছে। সকালবেলাটা এমনিতে যেন জ্যোতির্ময় হয়ে দেখা দিয়েছে। একটা ডাল ভেঙে ছড়ি বানিয়ে নিয়ে গডফ্রে বেলাভূমি ধরে রওনা হ’য়ে পড়লো।

ঝিনুক, পাখির ডিম আর বুনো আপেলে বেলাভূমিতেই ছোটোহাজারি সেরে নিলে গডফ্রে। তারপর ছোটো স্রোতস্বিনীটার ডান তীর ধরে বেলাভূমির দক্ষিণ-পুবদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এদিকটাতেই সে কাল দূর থেকে নানা ধরনের ঝোপঝাড় দেখেছিলো।

মাইল দু-এক পেরিয়ে এলো গডফ্রে। ছোটো নদীর জলে নানারকম জলের পাখি খেলা করছে; মাথার উপর গাংচিল ঘুরছে পাক খেয়ে-খেয়ে; পাখির ডাকে সারা পথ মুখর হয়ে আছে। যখন পর-পর দুটো মাছরাঙাকে সে নদী থেকে খপ করে ছোটো ছোটো ঝকঝকে রুপোলি মাছ তুলে নিতে দেখলে, তখন গডফ্রে একটু ভালো ক’রে জলের দিকে তাকালে। নানা ধরনের মাছ খেলা করে বেড়াচ্ছে জলে; নদী এখানে মাত্র চার-পাঁচ গজ চওড়া। দেখে-শুনে বুঝতে পারলে যে মৎস্য শিকারে তাকে মোটেই বেগ পেতে হবে না, কিন্তু মাছগুলো তারা রান্না করবে কী ক’রে? এই রান্নার প্রশ্নটাই সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দেখা যাচ্ছে। ঘুরে-ফিরে এই আগুনের কথাই ওঠে বারে বারে।

এগুতে-এগুতে দু-ধরনের উদ্ভিদ দেখে গডফ্রের ফুর্তি গিয়ে অসীমে পৌঁছুলো। একধারে সে এক ধরনের যব দেখতে পেলে, প্রায় যেন একটা ছোটো খেত। কিন্তু এ-ক্ষেত্রেও রান্নার প্রশ্নটাই সব আগে জেগে উঠলো। আরেক ধরনের ফল রেড-ইনডিয়ানদের ভারি প্রিয়, বেশ মুখরোচক, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।

এই আবিষ্কারগুলো ক’রে সে বেশ তুষ্ট চিত্তে ফিরে চললো। এতই তার মন ভালো লাগছিলো, কাউকে এদের কথা না-বললে তার যেন ঠিক স্বস্তি হবে না।

উইল-ট্রির কাছে এসে সে দেখলে টার্টলেট ততক্ষণে উঠে পড়েছেন— ছোটোহাজরি সারতে ব্যস্ত। গডফ্রেকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। গডফ্রে তাঁকে খুলে বললে সকালবেলায় কোন-কোন মহার্ঘ জিনিশ সে আবিষ্কার করেছে।

সব শুনে টার্টলেট বললেন, ‘কিন্তু আগুন? আগুন জ্বালবে কী করে?’ সবকিছুতেই বাগড়া দেয়া টার্টলেটের এক মস্ত বদভ্যেস।

‘এখনও জানি না বটে, তবে শিগগিরই একটা-না-একটা উপায় পাব ক’রে ফেলবো,’ উত্তর দিলে গডফ্রে।

শুনে মুখ বেঁকিয়ে টার্টলেট বললেন, ‘ভগবান তোমার সহায় হোন, গডফ্রে, কিন্তু আমি তো ভরসার কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কখনো ভেবেছিলে, গডফ্রে, আগুন এত দুর্লভ—এমন তপস্যার ফল—সাধনার ধন? কত লোক তো জুতোয় কাঠি ঘ’ষেই আগুন জ্বালে জগতে! মানগোমেরি স্ট্রিটে তোমার বাড়ি থেকে বেরুলেই তিন পা যাবার আগেই কাউকে-না-কাউকে দেখবে, মুখে চুরুট জ্বলছে, নাক-মুখ দিয়ে অনর্গল ধোঁয়া বেরুচ্ছে চিমনির মতো, যাকে বলতে না-বলতেই হাসিমুখে দেশলাই জ্বেলে তোমার মুখের চুরুটটাও জ্বালিয়ে দেবে। আর—হা হতোস্মি—এখানে কি না—’

‘এখানে আমরা সান ফ্রানসিসকোয় বসে নেই, টার্টলেট—মানগোমেরি স্ট্রিটেও নেই। এখানে হাজার পা বাড়ালেও সদয় কারু দেখা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’

‘কিন্তু রুটিমাংস খেতে গেলে কি রাঁধতেই হবে? রান্না—না—ক’রে কি খেতে পারবো না? প্রকৃতি আমাদের তো এমনভাবেও তৈরি করতে পারতো যে বেঁচে থাকার জন্যে কিছুই খেতে হয় না।’

‘একদিন হয়তো কিছু না—খেয়েই লোকে বেঁচে থাকবে,’ হাসলো গডফ্রে। ‘তোমার তা–ই মনে হয়?’

‘আমাদের বৈজ্ঞানিকরা তো শুনি এ-বিষয়ে নাকি দিনরাত্তির গবেষণা করছেন।’

‘তাও কি সম্ভব? আর কীভাবেই বা তারা গবেষণা চালায়? কিছুই না—খাইয়ে জীবজন্তুকে জিইয়ে রাখে কী করে?

‘আমরা যখন কিছু খাই, তখন তার অনেকটা হজম করে ফেলে আর বাকিটা দেহ থেকে বার ক’রে দিই; তার অনেকটা দেহের মধ্যে তাপের জোগান দেয়-আর ঘাম হ’য়ে খানিকটা বেরিয়ে যায়। কিন্তু রসায়ন যদি এমন কোনো-কিছু বার করতে পারে যা খেতে হয় না, বরং শ্বাস-প্রশ্বাসেই যা থেকে পুষ্টি ইত্যাদি পেয়ে যাওয়া যায়, তাহ’লে খাবার ঝামেলাটাই বাতিল করে দেয়া যাবে। হাওয়া থেকেই তখন আমরা পুষ্টি পাবো, দেহের মধ্যে তাপের জোগান হবে। ঘ্রাণেন আদ্ধেক ভোজন করেন এখন—তখন পুরোটাই দিব্যি নিশ্বেসে ভোজন করবেন।’ গডফ্রে জানালে।

‘আহা! এই আবিষ্কারটা আগে হ’য়ে গেলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যেতো!’ টার্টলেট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘তাহ’লে এক্ষুনি দিব্যি ডজনখানেক স্যাণ্ডুইচ আর মাংসের বড়া এক নিশ্বেসে ভোজন করা যেতো।’ ব’লেই অধ্যাপক টার্টলেট বৈজ্ঞানিকদের এই হাওয়া-নির্ভর গবেষণার স্বপ্নে বিভোর হ’য়ে রইলেন।

ঘোর কাটলো গডফ্রের ডাকে। গডফ্রেই তাঁকে চ্যাঁচামেচি ক’রে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন থেকে বর্তমানে দুর্গতির মধ্যে নিয়ে এলো। উইল-ট্রির মধ্যটায় ঠিকভাবে আশ্রয় নেবার জন্যে গডফ্রে ভারি ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছে। ভালোভাবে থাকবার একটা ব্যবস্থা বা উপায় করতে না-পারলে কোনো কাজই যে ঠিকভাবে করা যাবে না, এটা সে জানে।

প্রথমে কোটরটার মেঝেটা সাফ করতে হবে; ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হবে সব জঞ্জাল। ভিতরটায় লতাপাতা ঘাস শুকিয়ে-শুকিয়ে এমন হ’য়ে আছে যে প্রায় হাঁটু অব্দি ডুবে যায়। এই আবর্জনাগুলো বার ক’রে না-দিলে শোয়া-বসার ভারি অসুবিধে হবে তাদের। দু-ঘণ্টা ধ’রে খাটলেও কাজটা মনঃপূতভাবে শেষ করা যাবে কি না সন্দেহ।

মেঝেটা বেশ কঠিন আর সুদৃঢ়—মোটা-মোটা শেকড়ে তৈরি। বন্ধুর বটে, কিন্তু নিরেট ও শক্ত। দুটো কোনা বাছা হ’লো বিছানা পাতার জন্যে – বিছানা, মানে শুকনো নরম ঘাস-পাতা। আর আশবাবপত্র—অর্থাৎ বেঞ্চি, টুল, টেবিল ইত্যাদি—বানাতে হয়তো তেমন-একটা অসুবিধে হবে না, কারণ গডফ্রের বহুমুখী ছুরিকাঁটা একটা চমৎকার ব্যাপার, একাধারে করাৎ, ও তুরপুন— উপরন্তু ছুরি তো বটেই। আবহাওয়া খারাপ হ’লে দুজনকে তো কোটরের মধ্যে সারা সময় কাটিয়ে দিতে হবে : কাজ করতে বা খেতে এখানে কোনো অসুবিধেই হবে না। দিনের আলো যে একেবারে ঢুকবে না, তা নয় – কারণ কোটরের মুখটা তো বেশ বড়োই। পরে, যদি এই মুখটা নিরাপত্তার জন্য বন্ধ ক’রে দিতে হয়, তখন না-হয় গডফ্রে তার ছুরি দিয়ে গাছটার বাকল চিরে ইচ্ছেমতে দুটো ঘুলঘুলি তৈরি ক’রে নেবে।

কোটরটা যে কত উঁচু অব্দি গেছে, আলো ছাড়া তা বোঝবার জো নেই। একটা প্রায় বারো ফিট লম্বা ডাল দিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও সে কিছুতেই ছাদটার নাগাল পেলে না। নিশ্চয়ই ছাদটা আরো অনেক উঁচু। অবশ্য আপাতত ছাদের কথা না-ভাবলেও চলবে, পরে না-হয় দেখা যাবে কোটরটার ভিতরে বেয়ে-বেয়ে একেবারে গাছের মগডাল নাগাদ উঠে যাওয়া যায় কি না।

সূর্য ডুবে গেলো, কিন্তু তবু তাদের কাজ পুরোপুরি শেষ হলো না। দুজনেই বড্ড ক্লান্ত ও অবসন্ন হ’য়ে পড়েছিলো; খেয়ে-দেয়ে দুজনেই সে-রাতে শুয়ে পড়লো।

পরের কয়েকটা দিন দেখতে না-দেখতে নানান কাজে কেটে গেলো। ঘরের তদারকি ছাড়াও খাদ্যসংগ্রহেই কেটে গেলো অনেকটা সময়। তারপর ওই স্রোতস্বিনীর জলে কাপড়-চোপড় ধুয়ে তারা শুকিয়ে নিলে। কাপড়- চোপড় মানে দুটো শার্ট, দুটো রুমাল, দু-জোড়া মোজা। কাজকর্ম করার সময় শুধু পালুন আর ওয়েস্টকোটই থাকে তাদের পরনে, কারণ, বাপরে, দিনের বেলায় যা গরম পড়ে।

তেসরা জুলাই পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াই দিব্যি খটখটে শুকনো ঝলমলে দিন পেলে তারা। আর ততদিনে নতুন বাড়িতে বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে তাদের; যে-অবস্থায় তারা দ্বীপে এসে উঠেছিলো, তার সঙ্গে তুলনা করলে উইল-ট্রির কোটর তো প্রায় মানগোমেরি স্ট্রিটের ম্যানশনেরই খুদে-একটা সংস্করণ।

তবু গডফ্রে রোজই একবার ক’রে সমুদ্রের কাছে গিয়ে চেয়ে-চেয়ে দ্যাখে কোথাও কোনো জাহাজের পাল বা ধোঁয়া দেখা যায় কিনা।

কিন্তু ফেনিল নীল অসীম জল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না।

প্রশান্ত মহাসাগরের এদিককায় কখনও জাহাজ চলে না। জাহাজ তো দূরের কথা, কোনো জেলে ডিঙি অব্দি এদিকটার সমুদ্রে ঢুঁ মারে না। ফিনা আইল্যাণ্ড সম্ভবত সব সদাগরি রাস্তার বাইরেই অবস্থিত। কেবল ভগবান ভরসা : যদি তাঁর দয়ায় কোনো জাহাজ পথ ভুল ক’রে এদিকে আসে : ভগবানই তো দুর্বলের সহায়।

এদিকে যখনই দুজনে অবসর পায়, তক্ষুনি দুম করে আগুনের কথা উঠে পড়ে। শেষটায় গডফ্রে একদিন কোত্থেকে একটা চকমকি কুড়িয়ে পেয়ে ছুরির ইস্পাতের ফলায় ঠুকে-ঠুকে ফুলকি তোলবার চেষ্টা করতে লাগলো। ফুলকি যে ওঠে না, তা নয়; নীল একেকটা উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু মুহূর্তমাত্র আয়ু তাদের। শুকনো ঘাস-পাতা অব্দি কিছুতেই পৌঁছায় না, তার আগেই দপ ক’রে নিভে যায়। গডফ্রে আর টার্টলেট প্রায় মরিয়া হ’য়ে উঠেছে। এখন আর আগুন ছাড়া তাদের চলবে না। শুধু ফলমূল, কাঁচা ঝিনুক খেয়ে-খেয়ে অরুচি ও বিরক্তি ধ’রে গেছে। দু-বেলা এই খাদ্যতালিকার দিকে তাকালেই পেটের মধ্যেটা মুচড়িয়ে পাক দিয়ে ওঠে। উইল-ট্রির আশপাশে ছাগল-ভেড়া মুরগি-পাখি দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়, টার্টলেট তাদের দ্যাখেন, আর তাঁর জঠরের মধ্যে বুভুক্ষা জ্ব’লে ওঠে দাউ-দাউ। পারলে চোখ দিয়েই তাদের তিনি ঝলশে নিতেন।

নাঃ! এ ভাবে আর চলে না—কিছুতেই না!

কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে সাহায্য এলো তাদের—এতই অপ্রত্যাশিত যে প্রায় দৈবের দয়াই তাকে বলা যায়।

এক রাত্তিরে হঠাৎ আচম্বিতে মেঘ ক’রে এলো, তার পরেই উঠলো ঝড়। সারা দিন বিকট গুমোট গরম গিয়েছিলো : সেটাই ছিলো ঝড়ের পূর্বাভাস।

রাত্তির একটা নাগাদ গুম-গুম শব্দে গডফ্রে আর টার্টলেটের ঘুম ভেঙে গেলো। বাজের শব্দ। দূর থেকে গড়িয়ে-গড়িয়ে আসছে। তারপরেই চারপাশটা একেকবার বিদ্যুতের ঝলসানিতে আলো হ’য়ে যায়, আর কড়-কড় কড়াৎ ক’রে কানে তালা ধরিয়ে বাজ ফেটে পড়ে। তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি, কিন্তু যে-কোনো মুহূর্তে বর্ষণ শুরু হ’তে পারে।

আকাশের অবস্থা দেখবার জন্যে গডফ্রে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলো।

যেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, অমনি সেই অতিকায় দেবদারুগুলোর মগডালে ঘন পাতায় যেন দেয়ালি জ্বলে উঠছে, যেন কোনো আকাশ-প্রদীপ। জ্বলন্ত আকাশের গায়ে সেই ডালপালা যেন কোনো চিনে লণ্ঠনের ছায়ার খেলা।

আচম্বিতে সেই তুমুল তাণ্ডবের মধ্যে সমস্ত কিছু যেন ধাঁধিয়ে গেলো আলোয়। পরক্ষণেই গ’র্জে উঠলো বাজ, আর উইল-ট্রি যেন বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনিতে থরথর করে কেঁপে উঠলো।

গডফ্রে সেই ধাক্কায় মাটিতে প’ড়ে গিয়েছিলো। সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্যার্থে আগুন-বৃষ্টির মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে। বাজ প’ড়ে পাশের গাছটায় আগুন ধরে গেছে আর জ্বলন্ত পাতা ও ডালপালা ঝরে পড়ছে তার গায়ে।

গডফ্রে চেঁচিয়ে উঠলো : ‘আগুন! আগুন!’

‘আগুন!’ কোটরের মধ্য থেকে টার্টলেট বলে উঠলেন, ‘জয়, ভগবানের জয়!’

তক্ষুনি দুজনে কয়েকটা জ্বলন্ত ডালপালা কুড়িয়ে নিলে। পাশেই শুকনো ডালপালা স্তূপ করা ছিলো : সেই জ্বলন্ত মশাল থেকে তারা তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে। আশ্চর্য! পাশের গাছটায় বাজ পড়লো—কিন্তু উইল-ট্রির গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি।

তারা আগুন জ্বালিয়ে যেই কোটরের অন্ধকারে ফিরে এলো, অমনি শুরু হ’লো মুষল ধারে বৃষ্টি। যে-গাছটার উপরে আগুন ধরেছিলো, সেটা তক্ষুনি জলের ছাঁটে নিভে গেলো। তারা শুয়ে শুয়ে কেবল ভাবতে লাগলো তাদের জ্বালানো আগুনের দশা কী হলো।

১১

ভেবেছিলো গডফ্রে তো: ‘নেই কুছ পরোয়া’–
পেঁচিয়ে পাকিয়ে যেই ওঠে কালো ধোঁয়া

যা চেয়েছিলো, এই আচম্বিত ঝড় তাই দিয়ে গেলো। ভাগ্যিশ প্রমেথেউসের মতো গডফ্রে আর টার্টলেটকে আগুন আনতে আকাশে উড়তে হয়নি! টাৰ্টলেট বললেন, ‘আকাশ দেখছি বড্ড সদয়। বিদ্যুতের ঝলসানির সঙ্গেই আমাদের জন্য আগুন পাঠিয়ে দিলো।’

এবার এই আগুনকে জিইয়ে রাখার দায়িত্ব তাদের!

‘না! কিছুতেই এই আগুনকে নিভে যেতে দেয়া চলবে না!’

‘যতক্ষণ আগুনকে কাঠকুটো খাওয়ানো যাবে, ততক্ষণ অন্তত সে-ভয় নেই। টার্টলেটের পরিতোষ ক্রমেই ছোটো-ছোটো উল্লসিত আওয়াজে পরিস্ফুট হচ্ছে।

‘হ্যাঁ, কিন্তু সমানে আগুনের কুণ্ডে কাঠ গুঁজবে কে?’

‘কেন, আমি? দরকার হ’লে দিনরাত্রি ঠায় ব’সে থেকে আমি পাহারা দেবো।’ এবং সূর্যোদয় অব্দি সত্যি-সত্যিই টার্টলেট তা-ই করলেন।

দেবদারুগুলোর তলায় অজস্ৰ শুকনো কাঠকুটো ও লতাপাতা স্তূপ হ’য়ে ছিলো। সকালের মধ্যেই গডফ্রে আর টার্টলেট আগুনের পাশেই আরেকটা শুকনো জ্বালানির স্তূপ জড়ো করে সমানে আগুনের ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। একটা মস্ত দেবদারুর তলায় মোটা-মোটা শেকড়ের মাঝে সরু এক চিলতে জমিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা—অধ্যাপক টার্টলেটের চেয়েও ভালো নাচ জানে তারা। টার্টলেটের ফুশফুশ তো প্ৰায় যায় – যায়—ফুঁ দিয়ে-দিয়ে তিনি এমন করলেন। অথচ ফুঁ দেবার দরকার মোটেই ছিলো না। কুণ্ডলী পাকিয়ে-পাকিয়ে ধুসর ধোঁয়া উঠছে উপরের ঘন ডালপালার দিকে, যেন টার্টলেটের সধূম উল্লাস।

আগুনের পাশে ব’সে কেবল হাত-পা সেঁকবে ব’লেই তারা এমনভাবে আগুনের কামনা করেনি। তার চেয়েও জরুরি ও মুখরোচক কাজে তারা আগুনকে খাটাতে চাচ্ছিলো। এতদিনে ওই কাঁচা ডিম ও কাঁচা ঝিনুক ভক্ষণ করার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেলো : সেদ্ধ ক’রে, বা কেবল ঝলসে নিলেই তাদের স্বাদ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। সকালটা সেইজন্যেই ফূর্তিতে রন্ধনকর্মে কেটে গেলো।

‘দুটো-একটা কুক্কুটও ভক্ষণ করা যেতে পারে,’ টার্টলেটের গলায় ফুর্তি আর ধরে না, ‘অ্যাগুটির হ্যাম, ভেড়ার ঠ্যাং, ছাগলের মাংস, কি অন্য-আরো পক্ষীমাংসে বা টাটকা মাছে দিনগুলো বেশ ভালোই কাটবে বলে মনে হচ্ছে!’

‘উঁহু-উঁহু!’ গডফ্রে বাধা দিলে, ‘অত তাড়া নয়। উপোশ ভাঙছি ব’লে আকণ্ঠ গিলে বদ হজম বাঁধাবার কোনো দরকার নেই। তাছাড়া আমাদের ভাঁড়ারের দিকেও নজর রাখতে হবে, টার্টলেট। বরং গোটা দুই মুরগিই আপাতত যথেষ্ট, তাছাড়া এবার ওই যব দিয়ে রুটিও বানিয়ে নেয়া চলবে।

আর এই প্রস্তাবের ফলে দুই নিরীহ মুরগির প্রাণ গেলো। মুরগিগুলোকে জবাই ক’রে, পালক ছাড়িয়ে নিয়ে, কাঠিতে বিঁধে সহর্ষ আগুনের আঁচে ঝলসে নিলেন টার্টলেট। আর গডফ্রেও ততক্ষণে যবের রুটি বানাবার কাজে তন্ময় হ’য়ে আছে। ফিনা আইল্যাণ্ডের প্রথম সত্যিকার ছোটোহাজরি, তাই আর-সব কাজ রইলো স্থগিত।

সারা দিনটা নানা কাজে কেটে গেলো। অতি সযত্নে আগুনকে জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হ’লো সর্বাগ্রে, বিশেষ ক’রে রাতের জন্যে পাশেই জ্বালানি স্তূপ করে রাখা হ’লো। টার্টলেট অবিশ্যি ছাই ও অঙ্গার সাফ করে মাঝে-মাঝেই আগুনকে উশকে দিচ্ছিলেন। সারা রাত ধরে তিনি তা-ই করলেন : একেকবার আগুন নিভু-নিভু হ’য়ে আসে, আর বিছানা ছেড়ে উঠে তিনি এসে আগুনকে উশকে দিয়ে যান। গডফ্রে অবিশ্যি সারাদিনের খাটুনি ও উত্তেজনার ফলে সারাক্ষণ প’ড়ে-প’ড়ে ঘুমোচ্ছিলো।

হঠাৎ উইল-ট্রির ভিতরটায় ঠাণ্ডা খোলা হাওয়ার স্পর্শে গডফ্রের ঘুম ভেঙে গেলো। সে বুঝতে পারলে যে উইল-ট্রির ডালপালাগুলো যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানে নিশ্চয়ই আরেকটা ফোকর আছে—পুরো গাছটাই আসলে হয়তো ফোঁপরা। কিন্তু এখানে আশ্রয় নিতে হ’লে ও ভালোভাবে থাকতে হ’লে উপরের মুখটা বন্ধ ক’রে দিতে হবে—না হ’লে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।

‘কিন্তু ব্যাপারটা ভারি আশ্চর্য ঠেকছে,’ আপন মনেই বললে গডফ্রে, ‘গত কয়েকদিন তো এ-রকমভাবে হাওয়া ঢোকেনি। তাহলে কি বাজ প’ড়েই নতুন আরেকটা মুখ তৈরি হয়েছে?’

ব্যাপারটা ভালো ক’রে বোঝবার জন্যে সে বাইরে থেকে গাছের ডালপালাগুলো পর্যবেক্ষণ করবে ব’লে ঠিক ঠিক করলে।

খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করার পরেই ব্যাপারটা টের পাওয়া গেলো।

বাজের চিহ্ন গাছের গায়ে সুস্পষ্ট। মগডাল থেকে শেকড় অবধি বাজ নেমে গেছে—একটা দিকের বাকল একেবারে ঝলশে চিরে গিয়েছে।

বিদ্যুৎ যদি একবার গাছটার মধ্যে ঢুকতে পেতো তাহ’লে আর তাদের দেখতে হ’তো না –জীবন্ত ঝলশে যেতো তারা। একেবারে কান ঘেঁষে মৃত্যুদূত গেছে, সন্দেহ নেই।

‘নাঃ এ তো ভালো কথা নয়। ঝড়ের সময় দেখছি গাছের তলায় কিছুতেই আশ্রয় নেয়া যাবে না,’ গডফ্রে ভাবলে, ‘কিন্তু যারা অন্য-কোথাও মাথা গুঁজতে পারে, শুধু তাদের পক্ষেই বাছাই-করা মানায়। আমরা যারা গাছের কোটরে আশ্রয় নিয়েছি, আমরা এ-ক্ষেত্রে কী করতে পারি? হুম, দেখা যাক, কী হয়।

তারপর সেই দীর্ঘ বিদ্যুৎজ্বালার রেখা ভালো করে লক্ষ ক’রে গডফ্রে ভাবলে : ‘এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে যেখান দিয়ে বাজ পড়েছে গাছটা সেখানটায় একেবারে ঝলসে ফেটে চিরে গিয়েছে। আর যেহেতু তারফলেই ভিতরে হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে, তার মানেই হ’লো গাছটা নিশ্চয়ই আগাগোড়া ফোঁপরা, কেবল বাকলের জোরেই এতকাল বেঁচে আছে! কিন্তু ব্যাপারটা একটু বিশেষভাবে তদন্ত ক’রে দেখা যাক। ‘

কতগুলো পাইনের ডাল জড়ো ক’রে গডফ্রে মশালের মতো জ্বালিয়ে নিলে। তারপর সেই মশাল হাতে নিয়ে সে আবার কোটরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। তক্ষুনি কোটরের মধ্যেটা আলো হ’য়ে উঠলো : উইল-ট্রির ভিতরটা তার চোখের সামনে স্পষ্ট উদ্ভাসিত হ’য়ে উঠলো মুহূর্তে। মাটি থেকে প্রায় পনেরো ফিট উঁচুতে বন্ধুর একটা ছাত দেখা গেলো। মশালটা আরো উপরে তুলে ধরে গডফ্রে দেখতে পেলে সেই ছাদের মধ্যে একটা জায়গায় একটা ছোটো ফোকর দেখা যাচ্ছে—ততদূর অব্দি আলো পৌঁছোয় না ব’লে সেটা ছায়ায় ঢাকা। না, আর-কোনো সন্দেহ নেই। গাছটা একেবারে মগডাল অবধিই ফোঁপরা। সে-ক্ষেত্রে ওই অসমান খাঁজগুলোয় পা দিয়ে সহজে না-হ’লেও একটু কষ্ট ক’রেও একেবারে ওই ফোকর অবধি চ’লে-যাওয়া যাবে।

গডফ্রে যেহেতু ভবিষ্যতের ভাবনায় বেজায় উদ্বিগ্ন হ’য়ে পড়েছিলো, সেই জন্যেই ঠিক করলে যে আর কালবিলম্ব না-করেই ব্যাপারটা ভালো ক’রে তদন্ত করে দেখবে।

দুটো কাজ সে করতে পারে। এক : যে-ফাঁক দিয়ে হাওয়া বা বৃষ্টি আসছে, সেটা খুব ভালো ক’রে আটকে দিলে কোটরটা বেশ বাসযোগ্য ক’রে তোলা যাবে। দুই : বুনো জানোয়ার বা জংলিদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে উপরের মগডালে গিয়ে আশ্রয় নেয়া সম্ভব কিনা, সেটা যাচিয়ে দেখা জরুরি। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী। যদি দ্যাখে যে ওই সরু ফোকর দিয়ে উঠতে বিষম কষ্ট হচ্ছে, তখন না-হয় নেমে পড়া যাবে।

নিচে দুই শেকড়ের মাঝখানে ভালো ক’রে মশালটাকে আটকে রেখে গডফ্রে খাঁজগুলোয় পা দিয়ে উপরে বেয়ে ওঠবার চেষ্টা করলে। ক্ষিপ্র সে, হালকা ও সবল—তরুণ মারকিনদের মতো নানা ধরনের ব্যায়ামে সে অভ্যস্ত। কাজেই পুরো ব্যাপারটা তার কাছে খেলার মতো ঠেকলো। শিগগিরই সে ওই সরু ফোকরটার কাছে এসে পৌঁছুলো : এখন থেকে চিমনি-ঝাড়ুদারের মতো সে কেবল হাঁটুর ঠেলায় ও দেয়ালে পিঠ লাগিয়েই উঠতে পারবে। যেটা সবচেয়ে ভয়ের কথা তা হ’লো : যদি এইভাবেও শেষ অবধি ওঠা না-যায়?

গডফ্রে নাছোড়বান্দার মতো লেগেই রইলো। যেখানেই পা রাখবার মতো কোনো খাঁজ পাচ্ছে, সেখানেই একটু থেমে সে হাঁপ ছেড়ে নিচ্ছে। তিন মিনিটের মধ্যেই প্রায় ষাট ফুট সে বেয়ে উঠেছে, আর কেবল কুড়ি-পঁচিশ ফুট উঠলেই চলবে।

সত্যি-বলতে, এক্ষুনি নাকে-মুখে জোরালো হাওয়ার ঝাপটা টের পাচ্ছে সে। প্রায় লোলুপের মতো সে নাকমুখ দিয়ে টাটকা হাওয়া টেনে নিচ্ছে ফুশফুশে, কারণ কোটরের মধ্যেটায় বাতাস খুব-একটা টাটকা কখনোই থাকে না।

মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে গা থেকে কাঠের গুঁড়ো ঝেড়ে গডফ্রে আবার দেয়ালে ঘষটে-ঘষটে বেয়ে উঠতে লাগলো—এখানটায় ফোকরটা ক্রমে-ক্রমে খুবই সরু হ’য়ে আসছে।

কিন্তু হঠাৎ খোলা হাওয়া ঝাপটা মারলে মুখে, আর তারপরেই গডফ্রে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে ফোকরের মধ্য থেকে বার ক’রে নিয়ে এলো। ঘন পাতায় ঢাকা মগডাল—নিচে থেকে সে নিশ্চয়ই পাতার আড়ালে ঢাকা প’ড়ে গেছে—পশুপক্ষী যেমন ক’রে লতায়-পাতায় মিশে থাকে বনের মধ্যে।

চারপাশে তাকিয়ে দেখলে সে। তখনও সে হাঁপাচ্ছে; কিন্তু যেহেতু দ্বীপের অনেকটাই তার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ছে, সেইজন্য এই কষ্ট বা ক্লান্তিটা তার গায়ে লাগলো না।

আর তারপরেই আচম্বিতে দ্বীপের এক জায়গায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে সে বিস্ময়ে যেন সেই মগডালেই সেঁটে গেলো।

দূরে, বেলাভূমিতে, একটা জায়গা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে। সেখানে কোনো গাছপালাও নেই, যে, বাজ পড়ে গাছে আগুন লেগে যাবে। তাছাড়া যদি সেভাবেও আগুন লাগতো, বৃষ্টির জলে তা-কি একেবারেই নিভে যেতো না? দ্বীপে যেহেতু তারা দুজন ছাড়া আর-কেউ নেই, তখন তাদের মতো আর কেই বা প্রকৃতিদত্ত অগ্নিশিখাকে জিইয়ে রাখবে?

হতচকিত ভাবটা কেটে যেতেই গডফ্রে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসতে লাগলো। উপরে উঠতে যতটা সময় লেগেছিলো, নামতে কিন্তু মোটেই তত সময় লাগলো না। আসলে ওই রহস্যময় ধোঁয়া দেখেই তার তাড়াটা আরো বেড়ে গিয়েছিলো। ব্যাপারটার সন্ধান নেয়া আশু কর্তব্য। সেই জন্যেই তার আর কোনো তর সইলো না। কোন জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছিলো, মনে-মনে তার একটা আন্দাজ ক’রে নিয়েছিলো সে।

গাছের ডালে দাঁড়িয়ে গডফ্রে যে-ধোঁয়া দেখেছিলো, মাটিতে নেমে কিন্তু তার কোনো চিহ্নই দেখতে পেলে না। আরেক দিনও সে দ্বীপে এ-রকম রহস্যময় ধোঁয়া দেখেছিলো : সেদিন ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিলো এই দেবদারুগুলোর পাশ থেকেই। আজ কিন্তু সে বেশ ভালো ক’রেই আঁচ ক’রে নিয়েছে কোত্থেকে ধোঁয়া উঠেছে—তাই হনহন করে সেখানে এসে পৌঁছতে তার খুব-একটা দেরি হ’লো না।

বেলাভূমিতে পৌঁছেই গডফ্রে তার তদন্ত শুরু ক’রে দিলে। তীরের এদিকটায় সে সবগুলো কোনাখামচি খুঁজে দেখলে—কোত্থাও বাদ দিলে না। আশপাশে কোনো লোক আছে কি না জানবার জন্যে চেঁচিয়ে সে ডাকলে বারে-বারে; কারু সাড়া নেই। বেলাভূমিতে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। এই নতুন-জ্বলা আগুনের কোনো হদিশই সে পেলে না কোথাও! এমনকী কোত্থাও কোনো ছাইভস্মও দেখা গেলো না। নেই এমন কী কোনো ভস্মাবশেষই।

‘কিন্তু অসম্ভব! আমার মোটেই কোনো ভুল হয়নি। নিজের চোখকে আমি অবিশ্বাস করবো কী ক’রে! ধোঁয়া যে উঠেছিলো, তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আর তাছাড়া—’

কিছুতেই সেই কুণ্ডলিত ধোঁয়াকে গডফ্রে দৃষ্টিবিভ্রম বলে ভাবতে রাজি হ’লো না। তবে এমনও হতে পারে যে এদিকটায় কোনো গেইসার আছে, কোনো উষ্ণ প্রস্রবণ—কোথায় আছে তা সে এখনও খুঁজে বার করতে পারেনি বটে, তবে তার উষ্ণ বাষ্পস্রোতই সে হয়তো দেখে থাকবে।

দ্বীপে এ-পন্ত এ-রকম কোনো কূপ বা উষ্ণ প্রস্রবণ সে দ্যাখেনি বটে, কিন্তু তা যে একেবারেই নেই, এ-কথাও সে জোর ক’রে বলতে পারে না। পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে যে-ধোঁয়া উঠছিলো, তা হয়তো সেই অজ্ঞাত প্রস্রবণেরই চিহ্ন।

হতাশভাবে গডফ্রে বেলাভূমি ছেড়ে উইল-ট্রির দিকে ফিরে এলো। ফেরবার সময় সে চারপাশে আগের চেয়েও ভালোভাবে তাকাতে-তাকাতে এলো। তাকে দেখেই দু-একটা হরিণছানা ও ওয়াপিটি চমকে উঠে ছুটে পালিয়ে গেলো। কিন্তু না-পালালেও গডফ্রে আপাতত তাদের শিকার করতো না হয়তো। এ-নিয়ে সে মোটেই ভাবছিলো না।

প্রায় চার ঘণ্টা পরে উইল-ট্রির কাছে ফিরে এলো গডফ্রে। অধ্যাপক টার্টলেট তখন ব’সে-ব’সে তাঁর পকেট-বেহালায় টুংটাং আওয়াজ তুলছেন, আর মাঝে-মাঝে কাঠ গুঁজে দিয়ে তাঁর সেই পরম প্রিয় চঞ্চল আগুনকে উশকে দিচ্ছেন।

১২

সন্দেহ নেই, অতি তাজ্জব!
তবু সত্যটা এই—
জরুরি যা-কিছু চাচ্ছিলো, সব
মিলেছে সিন্দুকেই।

বিশেষ কোনো-মহৎ কর্ম সমাধা ক’রে ফেলার কোনো সাধু সংকল্প নেই গডফ্রের; সে কেবল ব্যাবহারিক বুদ্ধি খাটিয়ে কাণ্ডজ্ঞানের সাহায্যে ভবিষ্যৎ দিনগুলো নিরাপদ ও অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারলেই খুশি। দ্বীপে যদি থাকতেই হয়, দ্বীপ চেড়ে চ’লে যাবার যদি কোনোই উপায় না-থাকে, তাহ’লে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, এখানে যতটা সম্ভব আরামে থাকা যায়, তারই ব্যবস্থা করা। তারপর যদি কখনো দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাবার সুযোগ এসে উপস্থিত হয়, তাহ’লে তো অতি উত্তম। কিন্তু যতদিন সে-সুযোগ না-পাওয়া যায় ততদিন দ্বীপটাকেই বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা উচিত

কাজেই, কালবিলম্ব না করেই, গডফ্রে উইল-ট্রির ভিতরটাকেই মোটামুটি আরামপ্রদ ক’রে তোলবার কাজে লেগে পড়লো। ভিতরটা যাতে সবসময়েই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, সেদিকটায় খেয়াল রাখা দরকার। শুকনো ঘাসের বিছানাগুলোও মাঝে-মাঝেই বদলে ফেলা উচিত। গডফ্রে তার ছুরির সাহায্যে কোটরের ঠিক মাঝখানটায় চেঁছে-চেঁছে একটা টেবিল বসিয়েছে, আসলে গাছের একটা মোটা শেকড়কে চেঁছেই টেবিলটা তৈরি করা গেছে, খুব-একটা বেগ পেতে হয়নি। কতগুলো স্থূলকায় কাণ্ড চেঁছে-চেঁছে বানিয়েছে টুল—আরাম কেদারা হয়নি বটে, কিন্তু উপবেশন করার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট। আবহাওয়া খারাপ থাকলে, যখন বাইরে গিয়ে বসা সম্ভব হবে না, তখন আর হাঁটুর উপর রেখে তাদের খাবার খেতে হবে না।

বসন-সমস্যার সমাধান অবশ্য এখনও হয়নি। এখন অবিশ্যি গরম আছে, তাই অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু ঠাণ্ডার দিনে কী হবে? তাছাড়া পালুন, ওয়েস্টকোট, আর হালকা শার্টের দশাও বিশেষ ভালো নয়। যখন সব একেবারে ছিঁড়ে যাবে তখন তারা কী পরবে? তাহ’লে কি গাছের ছাল আর ছাগল-ভেড়ার চামড়াই তাদের সম্বল হবে? গতিক যে-রকম দেখা যাচ্ছে, তাতে তো ভবিষ্যতের ছবি সে-রকমই আদিম ও বর্বর। আপাতত অবিশ্যি গডফ্রে ও টার্টলেট তাদের কাপড়-চোপড় প্রায়ই ধুয়ে পরিষ্কার করে নেয়— তাদের ধোবিয়ানার তদারক করেন অধ্যাপক টার্টলেট স্বয়ং।

গডফ্রেই হচ্ছে খাদ্যসচিব—এবং প্রধানমন্ত্রী। যে-সব শেকড় সুস্বাদু, সে-সব জোগাড় করা, ম্যানজানিলা পেড়ে আনা—এতেই তার রোজকার কয়েক ঘণ্টা সময় কেটে যায়। মাঝে-মাঝে মাছ ধরতে গেলেও অনেকক্ষণ লেগে যায়-বিশেষ ক’রে মৎস্য-শিকারের উপায় তাদের একেবারেই আদিম—না আছে কোনো বঁড়শি, না-বা কোনো সূক্ষ্ম শক্ত জাল। কিন্তু মাঝে-মাঝে যখন উইল-ট্রির খাবার-টেবিলে ঝলসানো এক-আধখানা মুখরোচক মাছ আবির্ভূত হয়, তখন সব খাটুনিই সার্থক লাগে।

কিন্তু কোনো হাঁড়ি-কুড়ি না-থাকায় ঠিকমতো রান্নাই করা যায় না। শুধু ঝলসানো মাছ-মাংস ছাড়া আর-কিছুই জোটে না—একঘেয়ে ঠেকে, মুখে অরুচি ধ’রে যায়, কিন্তু হাঁড়ি-কুড়ি না-পাওয়া গেলে আর কীই-বা করা যাবে।

তাছাড়া গডফ্রের কি কাজের অন্ত আছে? দেবদারু গাছগুলোর মধ্যে আরেকটা গাছ সে আবিষ্কার করেছে, যার একটা কোটর আছে—অত বড়ো নয়, আর ও-রকম মসৃণও নয়—তবে একটা কোটর তো বটে। সেখানে গডফ্রে কুঁকড়ো-পরিবারের গৃহ-সমস্যার সমাধান করেছে। মুরগিরাও ক্রমে-ক্রমে সেই কোটরে থাকতে অভ্যস্ত হ’য়ে পড়ছে। সেখানে তারা ডিম পাড়ে, শুকনো ঘাসের স্তূপে ডিম লুকিয়ে রেখে তা দেয়, আর তাইতে কুঁকড়ো-পরিবারের ছানাপোনার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। রোজ সন্ধ্যাবেলা মুরগিদের ওই কোটরে উঠিয়ে কোটরের মুখটা বাইরে থেকে সে আটকে দেয়, যাতে বাজপাখি বা শিকারি প্যাঁচা ছোঁ মারতে না-পারে।

অ্যাগুটি, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদির জন্য আপাতত অবিশ্যি খোঁয়াড় তৈরি করার কোনোই তাড়া নেই। আবহাওয়া খারাপ হ’য়ে গেলে সেদিকটায় নজর দেয়া যাবে। এখন তো তারা দিব্যি সুখে আছে। প্রেইরিতে চ’রে বেড়িয়ে-বেড়িয়ে দিব্যি নধরকান্তি হয়েছে একেকজনের; দ্বীপে আসার পর সংখ্যাবৃদ্ধিও হয়েছে কিছুটা—আর তারা যত অল্পই দুধ পাক বাচ্চা চারপেয়েগুলোও চটপট বেশ তাগড়াই হ’য়ে উঠছে।

এত-সব প্রাণী উইল-ট্রির চারপাশটা সবসময়েই বেশ সরগরম রাখে। ইচ্ছেমতো চ’রে বেড়ায় এই গৃহপালিত জীবগুলো—আর রোদ কড়া হ’লে দেবদারু বীথিকার ছায়ায় এসে বিশ্রাম করে। ফিনা আইল্যাণ্ডে কোনো হিংস্র জীবজন্তু আছে ব’লে এখনও টের পাওয়া যায়নি। থাকলে কি আর অন্তত ছাগল-ভেড়ার উপর তাদের উপদ্রব হ’তো না? এইভাবেই দিন চলছিলো। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় যে বেশ সুখেই তাদের দিন কাটছিলো। হঠাৎ ২৯শে জুলাই একটা তাজ্জব ব্যাপার ঘটলো। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত বটে, কিন্তু তার ফলে তাদের অবস্থার অনেক বদল হ’লো এবং বেশ ভালোই হ’লো।

ঝিনুক, পাখির ডিম আর মাছের খোঁজে গডফ্রে সকালবেলায় ড্রিম বে-র কাছে গিয়েছিলো সেদিন। রোজই দ্বীপের একেক দিকে সে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ ক’রে আসে। সেদিন সে গিয়েছিলো এমন-একটা দিকে, যে-দিকে সে আগে কখনও আসেনি।

একেবারে উত্তর বিন্দুতেই সে চ’লে এলো হাঁটতে-হাঁটতে। সমুদ্রের ধারটাতেই একটা বালির ঢিবি, তার পাশেই সমুদ্রের উদ্ভিদের স্তূপ, আর তার পাশে একটা অদ্ভুত অতিকায় পাথর যেন কোনো জন্তুর মতো গুঁড়ি মেরে ব’সে সমুদ্র পাহারা দিচ্ছে।

পাথরটা যেন মন্ত্র জানে, যেন তাকে টান দিলে। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গিয়েই দ্যাখে আসলে সেটা পাথর নয়—একটা মস্ত সিন্দুক, অদ্ভুতভাবে সেটা বালির মধ্যে ব’সে গিয়েছে—ফলে দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন পাথরে-গড়া একটা জ্যামিতিক জন্তু!

‘স্বপ্ন’ জাহাজেরই কি সম্পত্তি এটা? ভেসে এসে তীরে ঠেকেছে? জাহাজডুবির পর থেকেই এই বালির চড়াতেই প’ড়ে আছে সিন্দুকটা? ভাঁটার টানে ভেসে যায়নি? না কি ইদানীং আবার একটা জাহাজডুবি হয়েছে এদিকে, আর এটাই তারই নিদর্শন? সে যাই হোক, সিন্দুকটা যে দৈবের একটা অমূল্য উপহার তাতে সন্দেহ নেই।

বাইরে থেকে ঘুরে-ঘুরে সিন্দুকটাকে নিরীক্ষণ করলে গডফ্রে। না, কোত্থাও কোনো নাম-ঠিকানা লেখা নেই। আশ্চর্য! দেখে মনে হচ্ছে মারকিন কারিগরের তৈরি সিন্দুক, কিন্তু মারকিন ছুতোররা তো সিন্দুকের গায়ে ধাতুর পাতে নিজেদের নাম খোদাই ক’রে দেয়! হয়তো ভিতরে ডালার গায়ে নাম লেখা কিংবা হয়তো ভিতরে কোনো কাগজপত্তর দেখে সব হদিশ পাওয়া যাবে। সিন্দুকের ডালাটা আঁটো করে লাগানো, প্রায় শীলমোহর করা। ভালোই হ’লো : ভিতরে জল ঢুকে সব জিনিশপত্র নষ্ট হ’য়ে যায়নি। ভারি শক্ত কাঠের সিন্দুক এটা, উপরে চামড়ার আস্তরণ, সবগুলো কোনায় তামার পুরু পাত লাগানো, তাছাড়া অনেকগুলো তামার পাত দিয়ে-দিয়ে সিন্দুকের কাঠকে আরো-মজবুত, আরো-টেকসই ক’রে তোলা হয়েছে।

সিন্দুকের মধ্যে কী আছে দেখবার জন্যে গডফ্রে ভারি অধীর হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু ডালাটা জখম না-ক’রে শুধু তালাটা ভেঙে ফেলে সিন্দুকটাকে খোলবার চেষ্টা করতে হবে। ড্রিম-বে-র শেষ প্রান্ত থেকে সিন্দুকটাকে উইল-ট্রি অবধি ব’য়ে নিয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না—একবার ধাক্কা দিয়ে নড়াবার চেষ্টা ক’রেই গডফ্রে বুঝে ফেলেছে সিন্দুকটা কী-রকম ভারি।

‘এখানেই সিন্দুকটাকে খালি করতে হবে আমাদের,’ আপন মনেই বললে গডফ্রে, ‘ভিতরকার সবকিছু নিয়ে যাবার জন্যে যতবার দরকার ততবারই এখানে আসতে হবে আমাদের।’

সোজা কথা নয়। দেবদারুবীথিকা থেকে জায়গাটা অন্তত চার মাইল দূরে। কাজেই কেবল যে অনেক সময়ই লাগবে তা-ই নয়, প্রচুর পরিশ্রমও করতে হবে। সময়ের অবশ্য অকুলোন হবে না—হাতে অঢেল সময় আছে। আর পরিশ্রম? তা তো করতেই হবে।

কিন্তু কী আছে এই সিন্দুকটায়? উইল-ট্রিতে ফিরে যাবার আগে গডফ্রে একবার সিন্দুকটার ডালা খোলবার চেষ্টা করলে। চামড়ার আস্তরণটা খুলে মস্ত ভারি তালাটাকে সে নিরীক্ষণ করলে কিছুক্ষণ। খোলে কী ক’রে সে তালাটা? ভাঙেই বা কী করে? নাঃ কাজটা খুব সহজ হবে না।

আশপাশে তাকিয়ে সে একটা ভারি পাথর তুলে নিলে। এটাই তার হাতুড়ি। তালাটার গায়ে পাথরটা দিয়ে ক’ষে খুব ক’রে বাড়ি মারলে একটা। কাজটা যে অতটা সহজ হবে, তা সে ভাবেনি। বাড়ি কষানো মাত্র তালাটা খুলে গেলো হয় তালাটা আদৌ চাবি দিয়ে লাগানো ছিলো না, নয়তো বলতে হয় যে প্রথম ঘাটাই মোক্ষম হয়েছে, ঠিক যেন কামারের একমাত্র ঘা। সিন্দুকের ডালাটা তুলতে গিয়ে উত্তেজনায় গডফ্রের বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো।

বেশ সহজেই ডালাটা উঠে গেলো। অবশ্য এমনিতে ডালা না-খুললে গডফ্রে শেষটায় ডালাটাকে জখম করতেও ছাড়তো না। আগাগোড়া দস্তার পাত দিয়ে সিন্দুকটার ভিতরটা মোড়া, আর সেইজন্যেই সমুদ্রের জল ভিতরে ঢুকতে পারেনি। ভিতরে যা-কিছু আছে, যত মোলায়েম ভঙ্গুর কি পলকাই হোক না-কেন, সব সেইজন্যেই একেবারে ঝকঝকে চকচকে ও নতুন রয়ে গেছে।

ভিতরে তাকাবামাত্র গডফ্রের হৃৎপিণ্ড যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। কিছুতেই সে আর তার ফুর্তি চেপে রাখতে পারলে না। সিন্দুকটা যে কোনো সাংসারিক সুবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানওলা যাত্রীর ছিলো, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। যা-যা জিনিশ লাগে লোকের আজকাল, এই বিজ্ঞান-নির্ভর সভ্যতার যুগে, সব সেখানে স্তূপ হ’য়ে আছে।

যত রাজ্যের কাপড়-শার্ট, কামিজ, টেবিলঢাকনা, বিছানাচাদর, জানলার পর্দা—কিছু বাকি নেই : আছে পশমে বোনা আঁটো গেঞ্জি, পশমে বোনা মোজা, সুতির মোজা, পালুন, মখমলের পাৎলুন, হাতে-বোনা ওয়েস্টকোট; এবং সর্বোপরি দু-জোড়া ভারি শক্ত জুতো, শিকারের জুতো, শোলার টুপি।

তারপর রয়েছে রান্নাবান্নার বাসনকোশন ও জিনিশপত্র; একটা লোহার কড়া যার অভাবে তারা রোজ হাহুতাশ করছিলো, কেলি, কফির পাত্র, চায়ের কেলি, কাঁটা-চামচে, ছুরি; এছাড়া আছে আয়না, চিরুনি, তিনটে পাত্র ভর্তি প্রায় পনেরো পাঁইট ব্র্যাণ্ডি, কয়েক পাউণ্ড ক’রে ভালো চা ও কফি।

তারপরে রয়েছে কতগুলো জরুরি হাতিয়ার : করাৎ, তুরপুন, কিছু পেরেক আর আংটা, শাবল, কোদাল কুড়ুল ইত্যাদি-ইত্যাদি।

এই শেষ নয়। কতগুলো অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে—চামড়ার খাপে ঢোকানো দুটি মস্ত ভোজালি, একটা দোনলা ও দুটো একনলা বন্দুক, তিনটে ছ-ঘড়া রিভলভার, প্রায় বারো পাউণ্ড কার্তুজ ও গুলি, কয়েকশো বুলেট। অস্ত্রশস্ত্রগুলো সবই ইংরেজ কম্পানির তৈরি। তাছাড়া রয়েছে ছোটো-একটা জরুরি ওষুধের বাক্স, একটা দূরবিন, একটা কম্পাস ও একটা ক্রনোমিটার। ইংরেজি ভাষায় লেখা কতগুলো বই, কয়েক দিস্তে কাগজ, কলম পেনসিল কালি, একটা পঞ্জিকা, নিউ-ইয়র্কে ছাপা একটা বাইবেল এবং একটি ‘সচিত্র রন্ধনপ্রণালী’।

সন্দেহ নেই, এই সিন্দুক দৈবের সবচেয়ে তাজ্জব ও মূল্যবান উপহার : ঠিক যা-যা তাদের কাজে লাগবে, সব যেন ভেবেচিন্তে মলব ক’রে এখানে কেউ জড়ো ক’রে রেখে গেছে।

গডফ্রে তার ফুর্তি চেপে রাখবে কী ক’রে, ভেবেই পেলে না। সে যদি আগে থেকে জানতো যে জাহাজডুবি হবে, এবং তারপরে একটা নির্জন দ্বীপে এসে উঠবে—তাহ’লেও সে কিছুতেই সব জিনিশ আগে ভেবে-চিন্তে এভাবে একটা বাক্সবন্দী করতে পারতো না। ভগবানের করুণায় সে একেবারে যেন বিগলিত হ’য়ে গেলো : কিছুতেই আর কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা সে খুঁজে পেলে না।

গডফ্রে তার এই কোষাগারের সব জিনিশ এক-এক ক’রে বালির উপর নামিয়ে রাখলে। প্রত্যেকটা জিনিশ সে হাতে তুলে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে, কিন্তু একটা ছোট্ট চিরকুটও পেলে না যেখান থেকে সে এই সিন্দুকের মালিকের নাম বা জাহাজের নাম জানতে পারে। আশপাশে কোনো সাম্প্রতিক জাহাজডুবির কোনো চিহ্নই নেই। হয়তো অনেক দিন ধ’রে জলে ভেসে-ভেসে শেষটায় জোয়ারের সময় সিন্দুকটা এসে এখানে বালির চড়ায় ঠেকেছে।

ফিনা আইল্যাণ্ডের দুই বাসিন্দার এখন আর কোনো-কিছুরই অভাব রইলো না। কপাল বলে একেই।

তক্ষুনি-তক্ষুনি সব জিনিশ উইল-ট্রিতে নিয়ে যাবার কথা গডফ্রে ভুলেও ভাবলে না। সব-কিছু গিয়ে উইল-ট্রিতে তুলতে বার-কয়েক আসা-যাওয়া করতে হবে এখানে। কিন্তু তাই ব’লে দেরি করলে চলবে না। আবহাওয়া খারাপ হবার আগেই সব কাজ চুকিয়ে ফেলতে হবে তাদের। একটা বন্দুক, একটা রিভলভার, কিছু গুলি ও কার্তুজ, একটা ভোজালি, দূরবিন, লোহার কড়া—এই ক-টা জিনিশ বাইরে রেখে বাকি সব জিনিশ সে সিন্দুকটায় আবার তুলে রাখলে। এই জিনিশগুলো সে এক্ষুনি—প্রথমবারেই—ব’য়ে নিয়ে যাবে। সিন্দুকের ডালাটা ভালো ক’রে এঁটে গডফ্রে ফুর্তির চোটে হনহন ক’রে পা চালিয়ে দিলে।

একঘণ্টা পরে টার্টলেটের কাছ থেকে সে-যে কী সাদর সম্ভাষণ ও আপ্যায়ন পেলে, তা আর কী বলবো! বিশেষ ক’রে লোহার কড়াটা দেখেই নৃত্যশিক্ষক চিল্লাচিল্লিওলা একটা লাফানে নাচ নাচলেন, তারপর তাঁর পকেট-বেহালায় দারুণ সব ফুর্তির সুর তুললেন।

তখন মাত্র বেলা দুপুর। গডফ্রে ঠিক করলে মধ্যাহ্নভোজের পরেই আবার তার কোষাগারে যাবে। সিন্দুকভর্তি জিনিশ এই উইল-ট্রিতে এনে হাজির না-করা অব্দি তার আর কোনো স্বস্তি নেই।

টার্টলেট এই প্রথম কোনো বাদ-প্রতিবাদ না করে তক্ষুনি যাবার জন্য একপায়ে ভর দিয়ে নাচতে লাগলেন। আর তাঁকে আগুন পাহারা দিতে হবে না, সিন্দুকে অনেক বারুদ আছে। এখন থেকে ইচ্ছেমতো আগুন জ্বালিয়ে নেয়া যাবে। তবে যাবার আগে লোহার কড়ায় টার্টলেট মাংসের সুরুয়া চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। আগুনের আঁচে কড়া-ভর্তি জল আপনা থেকেই দিব্য স্বৰ্গীয় সুরুয়ায় পরিণত হয়ে যাবে, যাবার আগেই এই কথাই তিনি বিশদ ক’রে বোঝালেন গডফ্রেকে।

সিন্দুকটার মধ্যে স্তূপ-করা জিনিশ দেখে টার্টলেটের ফুর্তি আর ধরে না। পঞ্চমুখে তিনি একেকটা জিনিশের প্রশংসা করলেন আর পরম আহ্লাদের সঙ্গে জিনিশগুলোর উপর হাত বুলোলেন। এবার তারা সব অস্ত্রশস্ত্র, গুলিবারুদ, কাপড়চোপড় নিয়ে এলো উইলট্রিতে।

বেশ ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছিলো দুজনে। মাংসের সুরুয়া আর স্টু-করা অ্যাগুটি তক্ষুনি তাদের চাঙ্গা ক’রে তুললো। ‘সচিত্র রন্ধনপ্রণালী’ আর কে চায়? এই তো যথেষ্ট সুখাদ্য, দিব্য মুখরোচক।

পরের দিনে ভোরবেলাতেই দুজনে বেরিয়ে পড়লো। আরো তিনবার যেতে হ’লো তাদের। শেষকালে সিন্দুক খালি ক’রে সব তারা নিয়ে এসে তুললো উইল-ট্রির কোটরে।

পয়লা আগস্ট খালি সিন্দুকটাকেই দুজনে মিলে ব’য়ে নিয়ে এলো—সেটাও উইল-ট্রির মধ্যে জায়গা পেলে। এখন থেকে এই সিন্দুকটাই হ’লো তাদের ওয়ার্ডরোব, ওরফে কাপড়চোপড় রাখার বাক্স

টার্টলেটের চোখে এর মধ্যেই ভবিষ্যৎ দিব্যি গোলাপি ঠেকছিলো। সেইজন্যেই সন্ধেবেলায় তাঁর পকেট-বেহালা হাতে তাঁর ছাত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর যেন মানগোমেরি স্ট্রিটেই আছেন এমনি ভঙ্গিতে বললেন, ‘এবার, গডফ্রে, তোমার নৃত্যচর্চা আবার শুরু করো। আজ তোমাকে একটা নতুন নাচ শেখাবো।’

১৩

গডফ্রে দ্যাখে রুদ্ধশ্বাসে
দূর সাগরে জাহাজ ভাসে!

ভবিষ্যৎ এখন আর ততটা বিমর্ষ বা তমসাবৃত নয়, অথচ তবু গডফ্রের মনে আর স্বস্তি নেই। ফিনা আইল্যাণ্ড থেকে কী ক’রে পাততাড়ি গোটানো যায়, এই চিন্তাতেই সে সারাক্ষণ অস্থির। টার্টলেট অবিশ্যি আজকাল খুবই নিশ্চিন্ত, কিন্তু গডফ্রে রোজই ভাবে গাছ কেটে-কেটে একটা ভেলা বানিয়ে ভেসে পড়লে কেমন হয়।

আগের চেয়ে কাজ এখন ঢের কম। যেহেতু সারাক্ষণ ব’সে-ব’সে আর আগুন পাহারা দিতে হয় না, তাই টার্টলেটও ছুটি পেয়ে গেছেন—তিনি সারাদিন ধ’রে কেবল যবের রুটি বানান আর রান্নাবান্নার তদারকি করেন, আর সময়-নেই অসময়-নেই পকেট-বেহালায় টুংটাং তোলেন। আর গডফ্রে এখন থেকে রোজ কুঁকড়ো-পরিবার ও গৃহপালিত জীবগুলোর তদারকি করে। বন্দুক থাকায় আজকাল আর পোষা প্রাণীগুলোকে বধ করতে হয় না : ফিনা আইল্যাণ্ডের হরিণ বা ওয়াপিটিরাই আজকাল কাবাব কি স্টু হিশেবে সুখাদ্যে রূপান্তরিত হ’য়ে উইল-ট্রির খাবার-টেবিলে এসে হাজির হয়।

সিন্দুকে অনেক পেরেক আর গজাল ছিলো, করাত আর তুরপুনও ছিলো। তাদের সাহায্যে উইল-ট্রির দেয়ালে অনেকগুলো তাক বানানো গেছে : রান্নাবান্নার বাসনকোশন সে-সব তাকেই থাকে। বাকি রসদপত্র সব দেয়ালের গায়ে খোপ ক’রে-ক’রে তুলে রাখা হয়েছে। তাছাড়া কতগুলো আংটা লাগানো হয়েছে, অস্ত্রশস্ত্রগুলো তাতেই ঝোলে। মোটমাট, উইল-ট্রির ভিতরটা আজকাল বেশ ভদ্রস্থ হয়েছে–বেশ ফিটফাট থাকে সবসময়।

কোটরের মুখে একটা দরজা বসাবার কথা ভাবছিলো গডফ্রে। নইলে নিশাচর আর রাতজাগাদের উৎপাতে রাতে ভালো করে ঘুমোনোই যায় না। করাত দিয়ে কাঠ চেরাই করা নেহাৎ সহজ কাজ নয়। তার চেয়ে গাছের মোটা-মোটা বাকল জুড়েই সে বেশ শক্ত একটা কবাট তৈরি ক’রে ফেললে, ঠিক উইল-ট্রির কোটরটার মুখের মাপমতো। পাল্লাটা লাগিয়েই সে থামলে না, কোটরের মধ্যে দুটো ছোটো জানলাও সে বানিয়ে নিলে—জানলা না-ব’লে তাদের অবিশ্যি ঘুলঘুলি বলাই ভালো। আলো-হাওয়ার ভাবনা নেই, ওই ঘুলঘুলি দিয়েই ভিতরে দিব্যি আলো-হাওয়া আসতে পারবে। রাত্তিরে খিল এঁটে দিলে তো উইল-ট্রি একেবারে মস্ত একটা কেল্লাই হ’য়ে যায় যেন। শীতের লম্বা রাতগুলোয় আলো পাবে কোত্থেকে, সেটা গডফ্রে এখনো ভেবে বার করতে পারেনি। শেষকালে হয়তো ভেড়ার চর্বি জমিয়ে-জমিয়ে লম্ফ তৈরি করতে হবে তাকে। কিন্তু সে-ভাবনা পরে ভাবলেও চলবে।

উইলট্রির মধ্যে একটা চিমনিও বানাতে হবে। আবহাওয়া যতদিন ভাবলেও চলবে। ততদিন না-হয় বাইরেই তারা রান্নাবান্না সারলে, কিন্তু বর্ষাবাদলার দিনে? কিংবা শীতকালে, যখন ঠাণ্ডায় হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে, তখন? উইল-ট্রির মধ্যেই তখন আগুন জ্বালতে হবে, কিন্তু তার ধোঁয়া বেরুবার একটা রাস্তা চাই তো।

আরেকটি জরুরি কাজ অবশ্য সে চুকিয়ে ফেলেছিলো। ছোটো নদীটার দুই পাড় থেকেই যাতে সহজে এই দেবদারুবীথিকায় আসা যায়, সেইজন্যে সে ডাঙা ডালপালা বেঁধে-বেঁধে ছোট্ট একটা সাঁকো বানিয়ে নিয়েছিলো। তার ফলে আজকাল চট করেই উত্তর তীরে চ’লে যাওয়া যায় –মাইল দু-এক কম ঘুরলেই চলে।

কিন্তু তবু থেকে-থেকেই যখন-তখন গডফ্রের মনে দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাবার ইচ্ছেটা হানা দেয়, আর সে ভারি ব্যাকুল হ’য়ে ওঠে। ফিনা আইল্যাণ্ডের আশপাশ দিয়ে যে কোনো জাহাজ যায় না, এটা সে অ্যাদ্দিনে মর্মান্তিকভাবেই টের পেয়ে গিয়েছে। যদি-বা দৈবাৎ কোনো জাহাজ দ্বীপের পাশ দিয়ে যায়, তাহ’লেও তারা দ্বীপটা সম্বন্ধে আদৌ কোনো কৌতূহল পোষণ করবে না। প্রশান্ত মহাসাগরে এমন কত অজানা-অচেনা ছোটো ছোটো দ্বীপ আছে, জাহাজগুলো অনেক সময়েই তাদের দিকে কোনো নজর দেয় না। কিন্তু যদি জাহাজগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার কোনো ব্যবস্থা করা যায়? যদি তাদের জানানো যায় যে এই দ্বীপে মানুষ থাকে, জাহাজডুবির পর নাজেহাল বেচারি মানুষ?

সেইজন্যে গডফ্রে দ্বীপের উত্তর অন্তরীপের শেষ মাথায় একটা মস্ত খুঁটি পুঁতে দিলে, আর তার মাথায় টাঙিয়ে দিলে একটা নিশেন। নিশেন অবিশ্যি নয়, একটা কাপড়। যেহেতু খটখটে রোদের দিন ছাড়া শাদা কাপড় সহজে কারু নজরে পড়বে না, সেইজন্যে কাপড়টাকে সে একরকম উদ্ভিদের রস দিয়ে টকটকে লালরঙে রাঙিয়ে দিয়েছে।

এইভাবে দিব্যি পনেরোই অগস্ট অবধি চ’লে গেলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধীরে আকাশ বেশ পরিষ্কার আছে : দু-একদিন রাতে অবশ্য বিষম ঝড় উঠেছিলো, কিন্তু এ-সব জায়গায় ঝড় যেমন আচম্বিতে আসে, তেমনি আচম্বিতে চ’লে যায়, অনেকক্ষণ ধ’রে ভোগায় না।

গডফ্রে আজকাল রোজ শিকারে যায় : পাখি বা হরিণ বা ওয়াপিটি শিকার ক’রে বেশ হৃষ্টমনে ফিরে আসে। কিন্তু শিকারে বেরিয়েও সে চোখকান সজাগ রাখে। দ্বীপটার একটা স্পষ্ট ছক সে মনে-মনে খাড়া করে নিতে চাচ্ছে ব’লেই একেক দিন একেক দিকে শিকারে যায়।

দ্বীপের মাঝখানকার বনে গিয়েছিলো একদিন। একদিন উঠেছিলো টিলার উপর। আরেক দিন গিয়েছিলো নদীর পাড় ধীরে-ধীরে তার উৎস কোথায়, খুঁজতে। ফিনা আইল্যাণ্ডে কোনো হিংস্র বন্য জন্তু নেই—এটা সে ইতিমধ্যেই নিশ্চিত ও নিশ্চিন্তমনে বুঝে নিয়েছে। এটাও এক মস্ত সৌভাগ্য বলতেই হয়। যদি নিত্য ও-সব হিংস্র জন্তুর আক্রমণের ভয়ে তাদের দিন কাটাতে হ’তো, তাহ’লে সব কাজকর্ম শিকেয় উঠতো। এমনকী উইল-ট্রির দুর্গও তাদের হাত থেকে খুব একটা নিরাপদ হ’তো না।

বন্দুকের শব্দ শুনেও যখন কোনো জংলি বা জাহাজ-ডোবা নাবিক এসে হাজির হয়নি, তখন এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে দ্বীপে আর-কোনো মানুষ থাকে না। কিন্তু তবু দ্বীপে গডফ্রে যে দু-দু-বার রহস্যময় ধোঁয়া দেখেছিলো, তার কথা একবারও ভুলতে পারছিলো না। সেই কুণ্ডলাকৃতি ধোঁয়ার কথা ভাবলেই তার কি-রকম বিমূঢ় ও হতভম্ব লাগে।

অথচ দ্বীপের কোথাও সে আগুনের কোনো চিহ্নই আবিষ্কার করতে পারেনি। ফিনা আইল্যাণ্ড যেহেতু অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়নি, তখন এখানে উষ্ণ প্রস্রবণ থাকারও সম্ভাবনা নেই। শেষটায় গডফ্রে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে তার চোখের ভুল বলেই ভাবতে বাধ্য হ’লো। তাছাড়া আর তো কখনও কোথাও কোনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী তার চোখে পড়েনি। টিলার চুড়োয় উঠে বা উইল-ট্রির মগডালে উঠেও সে কোনোদিকে সন্দেহজনক কিছু পায়নি দেখতে। শেষটায় সে ওই ধোঁয়ার কথা একেবারে ভুলেই গেলো।

বেশ দিন কাটছিলো, কাজে-কর্মে, চিন্তায়-ভাবনায়; টার্টলেট বেহালা বাজান, নাচের মহড়া দেন; গডফ্রে শিকারে বেরোয়, দরকারি কাজগুলো সারে। কিন্তু ১৩ই সেপ্টেম্বর এমন-একটা ঘটনা ঘটলো নির্জন দ্বীপে আশ্রয়-নেয়া যে-কোনো জাহাজ-ডোবা লোক যাকে নিষ্ঠুরতম ও চরমতম প্রতারণা ও পরিহাস বলে গণ্য করতে বাধ্য।

আর-কোনোদিনই গডফ্রে সেই রহস্যময় ও প্রহেলিকাভরা ধোঁয়া দ্বীপে দ্যাখেনি—কিন্তু ১৩ই সেপ্টেম্বর বেলা তিনটের সময় ধোঁয়ার একটা লম্বা রেখা দেখে তার উৎসটা আবিষ্কার করতে তার একটুও দেরি হলো না।

ফ্ল্যাগ-পয়েন্ট অবধি সে গিয়েছিলো সেদিন। যেখানে সে নিশেন পুঁতেছিলো, তারই নাম সে দিয়েছিলো ফ্ল্যাগ-পয়েন্ট। চোখে দূরবিন এঁটে দিগন্তের দিকে সে তাকিয়েছিলো, হঠাৎ দেখলে পশ্চিমা বাতাসে দিগন্ত থেকে ধোঁয়া ভেসে আসছে।

দেখবামাত্র তার হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক করে লাফিয়ে উঠলো।

‘জাহাজ! একটা জাহাজ!’

কলে-চলা জাহাজটা কি ফিনা আইল্যাণ্ডের পাশ দিয়ে যাবে? যদি যায়, তাহ’লে কত কাছে দিয়ে যাবে? এই পৎপৎ নিশেনটা দেখা যাবে জাহাজ থেকে? সংকেতটা তারা টের পাবে? না কি জাহাজটা উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তেই মিলিয়ে যাবে? সমুদ্রের এ-ধারটা কি আদৌ সে মাড়াবে না?

এই দোটানা গডফ্রেকে দু-ঘণ্টা ধ’রে ছিঁড়তে লাগলো।

ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ দীর্ঘ ও বড়ো হচ্ছে। বেলা চারটে নাগাদ সমুদ্র আর আকাশের মিলনরেখায় দেখা গেলো তার মস্ত চোঙ, একটা কালো ফুটকির মতো।

কলে-চলা বড়ো জাহাজ একটা। উত্তর-পুবদিক ধ’রে এগুচ্ছে। আর তা-ই যদি হয়, তবে ফিনা আইল্যাণ্ড যে তার পথে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

গডফ্রে গোড়ায় ভাবলে দৌড়ে গিয়ে উইল-ট্রিতে টার্টলেটকে খবর দিয়ে আসে। কিন্তু কী লাভ তাতে? একজন লোক সংকেত করলেও যা, দুজনে মিলে চ্যাঁচামেচি করলেও তা-ই-ফল একই। চোখে দূরবিন এঁটে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, যেন মুহূর্তে তার চলৎশক্তি হারিয়ে গেছে।

জাহাজটা কিন্তু সমানে এগিয়ে আসছে। এভাবে এগুলে ঠিক অন্তরীপের কাছে পৌঁছুবে। পাঁচটা নাগাদ পুরো জাহাজটাই গডফ্রের চোখে ভেসে উঠলো—এমন কী গলুইয়ের গায়ে কী রঙ মাখা, তা অবধি গডফ্রে স্পষ্ট দেখতে পেলে। নিশেনটার রঙও তার মোটেই অগোচর রইলো না। জাহাজটা মারকিন।

‘আমি যদি অ্যাদ্দুর থেকে জাহাজটার নিশেন দেখতে পারি, তাহ’লে তারা কি আমার নিশেনটা দেখতে পাচ্ছে না! হাওয়ায় দিব্যি পৎপৎ উড়ছে আমার নিশেন—দূরবিনে তো তা স্পষ্ট দেখতে পাবার কথা। নিশেনটা নামিয়ে বারেবারে নেড়ে-নেড়ে সংকেত করবো নাকি? বোঝাবো ওদের, যে আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই? হ্যাঁ, তা-ই ভালো। এক্ষুনি—আর-একটুও সময় নষ্ট করা চলবে না।’

গডফ্রে উঠে চ’লে গেলো অন্তরীপের ঠিক ডগায়। অনবরত দোলাতে লাগলো নিশেনটা। তারপর নিশেনটাকে সে খুঁটির গায়ে আদ্ধেক নামিয়ে রাখলে। নাবিকরা সাহায্য চাইতে হ’লে তা-ই করে সবসময়।

জাহাজটা তীর থেকে আর-মাত্র মাইল তিনেক দুরে—কিন্তু কই, তার নিশেন তো তেমনি মাস্তুলের ডগায় পৎপৎ ক’রে উড়ছে। গডফ্রে সংকেতের কোনো সাড়াই তো দিচ্ছে না! হতাশায় গডফ্রে প্রায় ভেঙে পড়লো। নিশ্চয়ই তার সংকেত জাহাজের চোখে পড়েনি। কিন্তু আর তো নজরে পড়বেও না! সাড়ে ছটা বাজে, সন্ধে হ’লো ব’লে।

জাহাজটা ফিনা আইল্যাণ্ডের অন্তরীপ থেকে যখন মাত্র দু-মাইল দূরে, ঠিক তখন সূর্য ডুবে গেলো। সন্ধ্যার ছায়ায় গডফ্রের সব চেষ্টাই নিষ্ফল হ’য়ে যাবে, আর তাকে জাহাজের লোকরা দেখতে পাবে না। গডফ্রে আবার নিশেনটা সমানে নাড়াতে লাগলো। না, কোনো সাড়া নেই।

তখন সে হাতের বন্দুকটা তুলে দু-তিনটে ফাঁকা আওয়াজ করলে। কিন্তু দূরত্ব তখনও অনেক, তাছাড়া হাওয়াও অন্য দিকে বইছে। জাহাজ থেকে বন্দুকের আওয়াজ শোনাই যাবে না!

ক্রমে রাত ক’রে এলো। স্টিমারটা ঢাকা প’ড়ে গেলো অন্ধকারে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাহাজটা নির্বিকারভাবে ফিনা আইল্যাণ্ড পাশ কাটিয়ে চ’লে যাবে।

কী করবে কিছুই ঠিক করতে না-পেরে গডফ্রে শেষটায় কিছু শুকনো ডালপালা জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে।

কিন্তু উত্তরে জাহাজ থেকে কোনো আগুনই জ্বললো না। অন্ধকারে কালো ভূতের মতো জাহাজটা ভেসে যাচ্ছে, কেবল দূর থেকে ঝাপশাভাবে ভেসে আসছে তার ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজ।

বিষণ্ণ বদনে উইল-ট্রিতে ফিরে এলো গডফ্রে। আর-কোনোদিনও তার এমন ব্যর্থ লাগেনি নিজেকে—এত ব্যর্থ, এত পরিত্যক্ত, এত বিমর্ষ লাগলো তার যে টার্টলেটকে সে কোনো কথা বলতেই পারলে না।

১৪

জংলিরা সব চড়াও দ্বীপে–
সামলে চলো পা টিপে-টিপে।

না, এ-রকম ভীষণ চোট আর কখনো খায়নি গডফ্রে। এই যে অপ্রত্যাশিত সুযোগটি তার হাতছাড়া হয়ে গেলো, আর কোনোদিনই কি তাকে সে পাবে? যে-রকম উদাসীনভাবে জাহাজটি দ্বীপের পাশ দিয়ে চলে গেলো, একবারও এমনকী দ্বীপে দৃপাত মাত্র না-করেই; তাতেই বোঝা যায় যে প্ৰশান্ত মহাসাগরের অজ্ঞাত দ্বীপগুলোর প্রতি সব জাহাজেরই এই মনোভাব। জাহাজ ভেড়াবার মতো কোনো জায়গাই নেই দ্বীপে, কাজেই তাকিয়ে দেখেই বা তারা কী করতো?

ভারি বিমর্ষ ও বিরস কাটলো রাতটা। যেন মস্ত কামান গ’র্জে-গ’র্জে উঠছে সমুদ্রে, আর তারই আওয়াজে বারে-বারে চমকে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে! কিংবা তার মনে হচ্ছে তার জ্বালানো ওই মস্ত আগুন কি অন্ধকারে জাহাজের চোখে পড়েনি? তাহ’লে কি কামান গর্জিয়েই তারা শেষকালে সাড়া দিতে চাচ্ছে?

উৎকর্ণ হ’য়ে রইলো গডফ্রে। শরীরে প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে সে যেন রাতের আওয়াজগুলোকে শুনতে চাচ্ছে। না, সবই তার অতি-উত্তেজিত মগজের সৃষ্টি, সবই শ্রুতিবিভ্রম। আস্তে-আস্তে যখন দীর্ঘ দুঃস্বপ্নে ছেঁড়া রাতটা শেষ হ’য়ে গেলো, ততক্ষণে সেই চলন্ত জাহাজটি তার কাছে ঠিক স্বপ্নের মতো ঠেকতে শুরু করেছে—দীর্ঘ একটি স্বপ্ন, কাল বিকেল তিনটের সময় সে এই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো।

কিন্তু না, ফিনা আইল্যাণ্ডের দু-মাইলের মধ্যে দিয়ে যে একটা কলে-চলা জাহাজ গেছে এ-বিষয়ে তার সন্দেহ নেই; আর জাহাজটি যে দ্বীপে নোঙরই ফ্যালেনি, এই তথ্যও মর্মান্তিকভাবেই সে অনুধাবন করেছে। করতে বাধ্য হয়েছে।

সবটাই যেন দৈবের এক মস্ত প্রতারণা। এই বঞ্চনার কথা টার্টলেটকে ব’লেই বা কী লাভ? গডফ্রে এ-সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্যই করলে না। তাছাড়া টার্টলেটের হালকা মন চব্বিশ ঘণ্টা পরেকার কোনো-কিছুই দেখতে পারে না। দ্বীপ থেকে যে চ’লে যাবার কোনো সুযোগ আসতে পারে এ-কথাটা আজকাল তিনি মোটেই ভাবেন না। সান ফ্রানসিসকোর স্মৃতি ক্রমেই তাঁর মন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। তাঁর তো কোনো ফিনা হলানি নেই ফিরে যাবার জন্যে, নেই কোনো মাতুল উইলিয়াম। জগতের এই শেষ প্রান্তে যদি তিনি নিয়মিত নাচ শেখাতে পারেন, তাহ’লেই তিনি খুশি।

চারটে নাগাদ অধ্যাপক টার্টলেট ফ্ল্যাগ-পয়েন্টের কাছে রোজকার মতো ঝিনুক আর পাখির ডিম জোগাড় করতে গিয়েছিলেন, হঠাৎ গডফ্রে দেখলে তিনি হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রাণপণে ছুটে আসছেন উইল-ট্রির দিকে, একটা পাও নাচের তালে পড়ছে না। মাথার চুলগুলো খাড়াখাড়া, চোখমুখে আতঙ্ক, একবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাবার সাহসটুকু পর্যন্ত তাঁর হচ্ছে না।

গডফ্রে একটু ভয়ই পেলে। সে ছুটে এসে চেঁচিয়ে জিগেস করলে : ‘কী ব্যাপার?’

‘ওইখানে! ওইখানে!’ উত্তরদিকের গাছপালার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন টার্টলেট।

‘কিন্তু ওখানে কী?’

‘একটা ক্যানু!’

‘ক্যানু?’

‘হ্যাঁ। জংলিরা…ক্যানু ভর্তি জংলিরা এসে চড়াও হয়েছে! নরখাদক হবে বা হয়তো!’

টার্টলেট যে-দিকটায় আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলেন, গডফ্রে সেদিকে তাকিয়ে দেখলে। ছোটো একটা ডিঙি ভেসে আসছে, তীর থেকে আধমাইল দূরে হবে হয়তো, ফ্ল্যাগ-পয়েন্ট পেরিয়েই দ্বীপে এসে ভিড়বে হয়তো।

‘তা নরখাদক হ’তে যাবে কেন?’ টার্টলেটের দিকে ফিরে গডফ্রে জিগেস করলে।

‘কারণ ক্রুসো দ্বীপগুলোয় একদিন-না-একদিন নরখাদকরা এসে চড়াও হয়!’

‘কোনো সদাগরি জাহাজের নৌকো নয়তো?’

‘জাহাজের নৌকো?

‘হ্যাঁ। কাল বিকেলেই তো এই দ্বীপের পাশ দিয়ে একটা কলে-চলা জাহাজ গেছে—হয়তো তারই নৌকো!’

‘আর তুমি এ-সম্বন্ধে টু শব্দটিও করোনি?’

‘ব’লে কী লাভ হ’তো?’ উলটে জিগসে করলে গডফ্রে, ‘তাছাড়া আমি ভেবেছিলুম জাহাজটা হয়তো চ’লেই গেছে! কিন্তু নৌকোটা হয়তো সেই জাহাজ থেকেই আসছে! আসুন, ভালো ক’রে দেখি।

উইল-ট্রির কাছে গিয়ে গডফ্রে তার দূরবিনটা নিয়ে এলো।

একটু ভালো করে লক্ষ ক’রেই তারও গলায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো, ‘জংলি! সত্যি, জংলিরাই!’ তার অবশ হাত থেকে দূরবিনটা খ’সে প’ড়ে গেলো।

টার্টলেটের মনে হ’লো তাঁর হাঁটুর জোড়া খুলে যাচ্ছে, পা দুটি বিবশ হ’য়ে আসছে। গডফ্রের কথাটা শোনবামাত্র আবার তাঁর গায়ের লোম খাড়া হ’য়ে উঠেছে।

গডফ্রে ভুল দ্যাখেনি। ডিঙিটায় জংলিরাই আছে—এবং এই দ্বীপের দিকেই তারা আসছে। পলিনেশিয়ার ক্যানুর মতো দেখতে, বাঁশের ডগায় একটা মস্ত পাল খাটানো। ডিঙিটার গড়ন দেখেই গডফ্রে বুঝতে পেরেছে যে ফিনা আইল্যাণ্ড মালয়েশিয়ার বেশি দূরে হবে না। কিন্তু ডিঙিটায় মালয়ের লোকেরা নেই–অর্ধনগ্ন কালো কতগুলো মানুষ ব’সে দাঁড় টানছে, তাদের সংখ্যা হবে দশ কিংবা বারো।

জংলিরা যদি তাদের দেখে ফ্যালে, তাহ’লেই সর্বনাশ। খুঁটির ডগায় নিশেন উড়িয়েছে ব’লে এখন বড্ড অনুতাপ হ’লো গডফ্রের। নিশেনটা জাহাজ থেকে কেউ দ্যাখেনি বটে, কিন্তু এখন এই জংলিদের চোখে তা ঠিকই পড়বে। কিন্তু, হায়রে, এখন আর নিশেন খুলে নেবারও কোনো অবসর নেই!

ভারি ঝামেলা হ’লো, সত্যি! হয়তো দ্বীপে কেউ থাকে না ভেবেই জংলিরা আসছিলো; ‘স্বপ্ন’ ডুবে যাবার আগে সত্যিই তো দ্বীপটা ছিলো পরিত্যক্ত ও জনমানবহীন। এখন খুঁটির ডগায় নিশেন উড়ছে দেখেই তারা টের পেয়ে যাবে যে দ্বীপে লোক থাকে। একবার যদি জংলিরা দ্বীপে নামে তো ওরা তাদের হাত থেকে রেহাই পাবে কী ক’রে? ফ্যালফ্যাল ক’রে ক্যানুটার দিকে তাকিয়ে রইলো গডফ্রে। কী যে সে করবে, কিছুই ঠিক করতে পারছে না। জংলিরা দ্বীপে নেমে কী করে না-করে, হয়তো সেটা লক্ষ করাই তার আশু কর্তব্য। পরে অবস্থা বুঝে সব ব্যবস্থা করা যাবে।

চোখে আবার দূরবিনটা এঁটে নিলে সে। অন্তরীপকে পাশ কাটিয়ে ক্যানুটা দ্বীপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে—উইল-ট্রির কাছ দিয়ে যে ছোটো নদীটা গেছে, সোজা তার দিকেই এগুচ্ছে ক্যানুটা।

জংলিরা যদি নদীর মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাহ’লে দেবদারুবীথিকায় এসে পৌঁছুতেও তাদের মোটেই দেরি হবে না। গডফ্রে আর টার্টলেট হুড়মুড় করে উইল-ট্রির দিকে ছুটলো। হঠাৎ যাতে এসে জংলিরা চড়াও না-হ’তে পারে, গোড়ায় তারই ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে ওদের ঠেকানো যায়, সেইজন্যেই তাদের তৈরি হ’তে হবে এখন। অন্তত গডফ্রে তা-ই ভেবেছিলো টার্টলেটের ভাবনা কিন্তু একেবারে উলটো মোড় নিলে।

‘হায়রে!’ আর্তনাদ করতে লাগলেন টার্টলেট, ‘এটাই হচ্ছে নিয়তির লিখন! কপালের লেখা খণ্ডাবে কে? দ্বীপে জংলিদের কোনো ক্যানু এসে ঠেকবে না, আর তুমি দিব্যি একজন রবিনসন ক্রুসো হ’য়ে যাবে, তা তো আর হয় না! নরখাদকেরা আসবেই— একদিন-না-একদিন! মাত্র তিন মাস হ’লো দ্বীপে এসে উঠেছি আমরা—আর তার মধ্যেই তারা এসে হাজির! সত্যি ডানিয়েল ডিফো বা ইয়োহোন হ্রিস-কেউই খুব একটা রঙ চড়ায়নি!’

উইল-ট্রির কাছে ফিরে এসেই গডফ্রে প্রথমে দেবদারুর তলাকার আগুনের কুণ্ডটা নিভিয়ে দিলে। অঙ্গার, ছাই, সব সে ঝেঁটিয়ে সাফ ক’রে দিলে, যাতে আশপাশে তার কোনো চিহ্নই না-থাকে। সন্ধ্যা আসন্ন ব’লে কুঁকড়ো- পরিবারকে আগেই তাদের কোটরে ওঠানো হয়েছিলো—কোটরের মুখটা এবার ডালপালা লতাপাতা দিয়ে যথাসম্ভব ঢেকে দেয়া হ’লো, যাতে বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া না-যায়। অন্য জীবগুলোকে প্রেইরির দিকে হাঁকিয়ে দেয়া হ’লো : তাদের জন্যে যে কোনো খোঁয়াড় নেই, এটাই ভারি দুঃখের। সব টুকিটাকি জিনিশপত্র উইল-ট্রিতে নিয়ে আসা হলো—বাইরে এমন-কিছুই রইলো না যা দেখে মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তারপর গডফ্রে আর টার্টলেট নিজেরা কোটরের মধ্যে ঢুকে প’ড়ে ভালো ক’রে কবাটটা এঁটে দিলে। ভাগ্যিশ কবাটটা দেবদারুর বাকলেই তৈরি ছিলো—তাই সেটাকে বাইরে থেকে চেনবার উপায় ছিলো না। ঘুলঘুলি দুটোরও উপর পাল্লা টেনে দেয়া হ’লো। তারপর সব আলো নিভিয়ে দিয়ে দুজনে মিশকালো নিরেট অন্ধকারে চুপচাপ ব’সে রইলো। রাতটা যেন আরো দীর্ঘ ও ভয়ংকর, শেষ হ’তেই চাচ্ছিলো না, একেকটা ঘণ্টাকে কে যেন টেনে লম্বা করে দিয়েছে। বাইরের ক্ষীণতম আওয়াজটুকু পর্যন্ত তারা উৎকর্ণ হ’য়ে শুনলো। ওই কোথায় মড়মড় ক’রে উঠলো একটা শুকনো খটখটে ডাল, হাওয়া এসে ঝাপটা দিলো ডালপাতায়, কোথাও একটা রাতজাগা পাখি ডুকরে কেঁদে উঠলো—আর প্রত্যেকটা আওয়াজেই তারা থেকে-থেকে চমকে উঠলো, আঁৎকে উঠলো।

একবার মনে হ’লো গাছতলায় কারা যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। যেন উইল-ট্রির চারপাশে কেউ চক্কর দিয়ে দেখছে। গডফ্রে একবার ঘুলঘুলির পাল্লা একটু ফাঁক ক’রে বাইরে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে।

কেউ নেই! কেবল অন্ধকারের মধ্যে সমুদ্রের খোলা হাওয়া ব’য়ে যাচ্ছে হা-হা।

কিন্তু শেষটায় সত্যিই শোনা গেলো পায়ের শব্দ। এবার আর গডফ্রের কান তাকে ঠকাতে পারলে না। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে—কেউ না, একটা ছাগল ফিরে এসেছে প্রেইরি থেকে, গাছতলায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে।

জংলিরা যদি এই দেবদারুর বাড়ি দেখে ফ্যালে তো গডফ্রে যে কী করবে তা সে এর মধ্যেই ঠিক ক’রে ফেলেছিলো। টার্টলেটকে টেনে সে চিমনি বেয়ে উপরে উঠে যাবে মগডালে, সেখান থেকে জংলিদের আরো ভালো ক’রে ঠেকানো যাবে। বন্দুক-রিভলভার আছে তাদের, গুলিবারুদও মোটেই কম নেই—জনা বারো জংলির সঙ্গে যুঝতে মোটেই তেমন বেগ পেতে হবে না। জংলিদের সঙ্গে যদি তীর-ধনুক থেকেও থাকে, তবু আগ্নেয়াস্ত্রর সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ। আর ডাল ধরে ঝুলে ঝুলে মগডালে পৌঁছুতে চাইলেও জংলিরা বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না, কারণ গডফ্রে অনেকবার বাইরে থেকে গাছটায় চড়বার চেষ্টা ক’রে দেখেছে, মোটেই কোনো সুবিধে করতে পারেনি।

ফন্দিটা অবশ্য সে ভেঙে বলেনি টার্টলেটকে। বেচারি সেই-যে ক্যানুটা দেখার পর থেকে আতঙ্কে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন, এখনও তেমনি ব’সে আছেন—চুপচাপ, ভীত, সন্ত্রস্ত ও বাক্শক্তিরহিত। এর পরে যদি শোনেন যে কখনো পাখির মতো গাছের ডালে গিয়ে আশ্রয় নিতে হ’তে পারে, তাহ’লে তিনি আরো কাবু’ও নিস্তেজ হয়ে পড়বেন। ভাববার কোনো অবসর না-দিয়েই তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে উপরে তুলে নিয়ে যাবে ব’লে গডফ্রে স্থির করেছিলো।

রাতটা এমনি আশা-নিরাশার দোটানায় কেটে গেলো। কেউ তাদের আক্রমণ করলে না। জংলিরা দেবদারুবীথিকার ধারে-কাছেই ঘেঁষেনি। হয়তো দ্বীপে ঢোকবার আগে দিনের আলোয় সব ভালো ক’রে দেখেশুনে নিতে চায়।

‘তা-ই নিশ্চয়ই তাদের মলব,’ বললে গডফ্রে, ‘নিশেনটা দেখে তো টের পেয়েছে যে দ্বীপে লোক থাকে! কতজন থাকে, তা যেহেতু জানে না, তাই সাবধানে রয়েছে। এটা কী ক’রে জানবে যে মাত্র দুজন জাহাজডোবা লোকের সঙ্গে তাদের যুঝতে হবে? না, দিন না-হ’লে তারা কিছুই করবে না—যদি দ্বীপে তারা নামতে চায় তো তা সেই দিনের বেলায়।’

‘যদি দিনের বেলা তারা চ’লে যায়?’ টাৰ্টলেট বললেন।

চ’লে যাবে? কেন? অত কষ্ট করে মাত্র এক রাত্তিরের জন্যে এই ফিনা আইল্যান্ডে তারা আসবে কেন তবে?’

‘তা জানি না। আমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছিলুম।’

‘কাল সকালে ওরা যদি উইল-ট্রির কাছে না-আসে তো আমরাই বেরুবো ওদের সন্ধানে।’

‘আমরা?’

হ্যাঁ! আমরা! আমাদের দুজনের মধ্যে একবারও ছাড়াছাড়ি হ’লে চলবে না—কখন কী হয়, কে জানে! হয়তো জঙ্গলে গিয়েই আমাদের আশ্রয় নিতে হবে—যতদিন জংলিরা দ্বীপে থাকে, ততদিন হয়তো বনে-জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। না, টার্টলেট! আমরা দুজনে একসঙ্গেই থাকবো!’

‘শ্ শ্ শ্…চুপ!’ ফিশফিশ ক’রে বললেন টার্টলেট, ‘বাইরে কিসের শব্দ হ’লো না?’

গডফ্রে আবার ঘুলঘুলি ফাঁক ক’রে বাইরে তাকিয়ে দেখলে। ‘না! সন্দেহজনক কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না! ওই ছাগল-ভেড়াগুলো ফিরে আসছে প্রেইরি থেকে!

‘হয়তো ভীষণ তাড়া খেয়েছে?’

‘তাহ’লে তাড়া খেয়েও তারা দেখছি ভারি শান্ত থাকে! আমার ধারণা বাইরে হিম পড়ছে বলে তারা গাছতলায় আশ্রয় নিতে এসেছে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন টার্টলেট। ‘তোমার মামাবাড়িতে—মানগোমেরি স্ট্রিটে—কিন্তু এ-সব কিছুই হ’তে পারতো না।

অত দুঃখের মধ্যেও হাসি চাপতে ভারি কষ্ট হ’লো গডফ্রের। ‘এক্ষুনি সকাল হ’য়ে যাবে। আর একঘণ্টার মধ্যে যদি জংলিদের দেখা না পাই তো আমরাই উইল-ট্রি ছেড়ে বেরুবো—সোজা দ্বীপের উত্তরদিকে চ’লে যাবো। আপনি অন্তত একটা বন্দুক সঙ্গে নিতে পারবেন তো, টাৰ্টলেট?’

‘কী? ব’য়ে নিতে হবে বন্দুক? তা পারবো।‘

‘যেদিকটায় গুলি ছুঁড়তে বলবো, সেদিকটায় টিপ করে গুলি ছুঁড়তে পারবেন তো?’

‘জানি না! কখনো তো বন্দুক ছুঁড়িনি। তুমি ঠিক জেনো, গডফ্রে, আমার বন্দুকের গুলি কখনো চাঁদমারিতে পৌঁছুবে না!

‘কে জানে! হয়তো বন্দুকের আওয়াজ শুনেই জংলিরা ভয় পেয়ে চম্পট দেবে!’

এক ঘণ্টা পরেই চারদিক আলো হ’য়ে উঠলো। সাবধানে ঘুলঘুলির ঢাকা খুলে বাইরে তাকালে গডফ্রে।

দক্ষিণদিকে তো অস্বাভাবিক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ছাগল-ভেড়াগুলি দিব্যি নিশ্চিন্তে চরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে ভয়ের কোনো লক্ষণই নেই। উত্তরদিকের ঘুলঘুলির ঢাকা খুলে তাকাতেই একেবারে সমুদ্রতীর পর্যন্ত চোখে প’ড়ে গেলো। এমনকী ফ্ল্যাগ-পয়েন্ট অব্দি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নদীর মুখটায় কাল যেখানে তারা জংলিদের ডিঙি দেখেছিলো, সেখানে এখন আর-কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব বেশ শান্ত চুপচাপ প’ড়ে আছে।

দূরবিনটা চোখে এঁটে গডফ্রে আবার ফ্ল্যাগ-পয়েন্টের দিকে তাকালে। কিছু নেই। হয়তো তাহ’লে টার্টলেটের ধারণাই ঠিক। জংলিরা হয়তো এখানে কেবল রাতটাই কাটাতে এসেছিলো! কিন্তু কেন?

অনেক ভেবেও গডফ্রে এই ধাঁধার কোনো উত্তর বার করতে পারলে না।