০৫. শুরু হলো তবে সাগর পাড়ি

চেনা নেই, শোনা নেই, এক মহোদয়
কোত্থেকে ‘স্বপ্নে’ যে হয়েছে উদয়!

শুরু হ’লো তবে সাগর পাড়ি। স্বীকার করতেই হয় যে, এ-পর্যন্ত কোনো অসুবিধেই হয়নি। অধ্যাপক টার্টলেট অবশ্য দুর্ধর্ষ তার্কিক : ‘সব সাগর পাড়িই যখন-খুশি শুরু ক’রে দেয়া যায়। কীভাবে তা শেষ হয়, এটাই হ’লো সবচেয়ে জরুরি বিষয়,’ তাঁর এ-কথার সারবত্তা অনস্বীকার্য।

গডফ্রের কামরার দুয়ার খুললেই ‘স্বপ্ন’ জাহাজের ডাইনিং-সেলুন। দিব্যি আরামে-গরমে আছে গডফ্রে, স্বাচ্ছন্দ্যের এতটুকু কম হয়নি জাহাজে। কামরায় যেদিকের দেয়ালে সবচেয়ে আলো পড়ে, সেখানটায় সে ঝুলিয়েছে ফিনার ফোটো। দোলানো বিছানা আছে শোবার জন্যে, ঝকঝকে একটা স্নানঘর তার কামরার লাগোয়া, অনেকগুলো দেরাজ রয়েছে কাপড়চোপড় পোশাক-আশাক রাখার জন্য, লেখাপড়া করার জন্য টেবিল রয়েছে একটা, রয়েছে আরাম কেদারা –বাইশ বছর বয়সী যুবকের এর চেয়ে বেশি আর চাই কী? এ-রকম ব্যবস্থা থাকলে সে বাইশবার বিশ্বভ্রমণ করে আসতে রাজি। স্বাস্থ্য ভালো, মেজাজ ভালো—তার উপরে এ-সব এবং এত-সব হাতে পেলে এই বয়সে কে আর তত্ত্বচিন্তা করে?

টার্টলেটের অবিশ্যি মেজাজ তেমন ভালো নেই। গডফ্রের পাশের কামরার কাছেই তাঁর কামরা—বড্ড ছোটো লাগে কামরাটা, বিছানাটা লাগে বড্ড শক্ত, কামরার ছ-বর্গগজ জায়গা তাঁর নাচিয়ে পা ফেলার পক্ষেও যথেষ্ট ঠেকে না।

একসঙ্গেই বসেন দুজনে খাবার-টেবিলে। আর সঙ্গে বসে কাপ্তেন আর মেট।

রওনা হবার সময় জুন মাসে আবহাওয়া ছিলো চমৎকার, উত্তরপুব থেকে সুন্দর হাওয়া বইছিলো। কাপ্তেন টারকট পুরো দমে কল চালিয়ে ও সেইসঙ্গে আবার বড়ো পাল খাটিয়ে দিয়েছিলেন—যাতে জাহাজের গতি বেড়ে যায়। ‘স্বপ্ন’ মোটেই গড়াচ্ছে না জলের উপর, তরতর ক’রে ঢেউ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে রাজহাঁসের মতো হালকা ভাবে। আর সেইজন্যেই কারু সাগর -পীড়া হ’লো না : নাকের ডগা হ’লো না আরক্তিম, চোখদুটি বসলো না কোটরে, কপাল ঠেকলো না তপ্ত, দুই গাল হ’লো না বিবর্ণ। শান্ত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের উপর দিয়ে একটানা এগিয়ে চললো ‘স্বপ্ন’, আর শিগগিরই মারকিন উপকূল দিগন্তে আড়াল হ’য়ে গেলো।

প্রথম দু-দিন কিছুই ঘটলো না উল্লেখযোগ্য। বেশ তাড়াতাড়িই এগুচ্ছে ‘স্বপ্ন’। সাগর পাড়ির সূচনাটা এত নির্বিঘ্নে ও স্বচ্ছন্দ হয়েছিলো যে কাপ্তেন টারকট চেষ্টা ক’রেও মাঝে মাঝে তাঁর উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারছিলেন না। রোজ যখন সূর্য মধ্যরেখা পেরোয়, তিনি সাবধানে যাবতীয় তথ্য টুকে নেন। তারপর মেটকে নিয়ে ঢুকে পড়েন তাঁর কামরায়—সেখানে গোপনে তাঁদের মধ্যে সারাক্ষণ কী যে ফিশফিশ গুজুর-গুজুর মন্ত্রণা হয়, তা তাঁরাই জানেন, কিন্তু রকম দেখে মনে হয় তাঁরা যেন গভীর কী-একটা উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে। গডফ্রে অবশ্যি এ-সব কিছুই লক্ষ করেনি, কারণ জাহাজ চালাবার ব্যাপারে সে অ-আ-ক-খ-ও জানে না, কিন্তু মাল্লাদের তাতে বেশ কিছুটা আশ্চর্যই হ’তে দেখা গেলো। বিশেষ ক’রে প্রথম সপ্তাহে যখন কোনো ঝামেলাই ছিলো না, তখনও পর-পর কয়েক রাত্তিরে সাবধানে চুপিসাড়ে ‘স্বপ্ন’র গতিপথ বদলে ফেলা হ’লো, ও সকালে নতুন উদ্যমে আবার পাড়ি শুরু হ’লো। পাল-তোলা জাহাজ হ’লেও এই বিচিত্র ব্যাপারটির মর্ম হয়তো প্রকৃতির খেয়াল ব’লে অনুধাবন করা যেতো, কিন্তু কোনো কলে-চলা জাহাজের পক্ষে সত্যি ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়। মাল্লাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতোই ঠেকলো—অনেক ভেবেচিন্তেও তারা এর কোনো হদিশ পেলে না।

১২ই জুন সকালবেলায় হঠাৎ জাহাজে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। কাপ্তেন টারকট, মেট, আর গডফ্রে তখন সবে ছোটোহাজরি সারতে বসেছে, হঠাৎ ডেকে একটা মস্ত শোরগোল উঠলো। পরক্ষণেই সশব্দে খাবার-ঘরের দরজা খুলে উত্তেজিতভাবে একজন মাল্লা চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়ালে। চেঁচিয়ে বললে, ‘কাপ্তেন টারকট! ‘

‘কী ব্যাপার?’ টারকট ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন।

‘এক চিনে—জাহাজে পাওয়া গেছে!’

‘চিনে? জাহাজে!’

হ্যাঁ-হ্যাঁ! সত্যিকার একটা চিনেম্যান—জাহাজের খোলে লুকিয়েছিলো। দৈবাৎ লোকটাকে পাওয়া গেছে!’

‘জাহাজের খোলের মধ্যে লুকিয়েছিলো?’

‘হ্যাঁ, কাপ্তেন। পাটাতনের তলায়।’

‘তাহ’লে ওকে সমুদ্দুরের তলাতেই চালান করে দাও’, কাপ্তেন টারকট বলে উঠলেন।

মাল্লাটি বললে, ‘তাই হবে।’

চিন সাম্রাজ্যের প্রতি ক্যালিফরনিয়ার নন্দনদের যে-বিদ্বেষ আছে, তাতে মাল্লাটির কাছে হুকুমটা অতি স্বাভাবিকই ঠেকলো। এ-হুকুম মানতে তার একটুও দ্বিধা হবে ব’লে মনে হলো না।

কাপ্তেন টারকট অবিশ্যি মেট আর গডফ্রেকে নিয়ে তক্ষুনি সরেজমিনে তদন্ত করতে জাহাজের ফোরকালের দিকে হন্তদন্ত হ’য়ে ছুটে এলেন।

এসেই দ্যাখেন হাতকড়া বাঁধা এক চিনেম্যানকে দু-তিনটি খালাশি শক্ত ক’রে পাকড়ে রেখেছে-এবং মাঝে-মাঝে কনুইয়ের দু-একটা গুঁতো দিতেও ছাড়ছে না। চিনের বয়েস হবে পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ, চোখমুখে বুদ্ধির ছাপ আছে, গড়ন ভালো, ক্ষিপ্র চটপটে চেহারা—এখন অবশ্য এই ক-দিন ধরে খোলের মধ্যে আলোহাওয়াহীন খুপরিতে অন্ধকারে থেকে-থেকে তাকে বেশ-একটু কাহিল দেখাচ্ছে।

কাপ্তেন টারকট খালাশিদের ইঙ্গিত করলেন তাকে ছেড়ে দিতে।

‘কে তুমি?’ জিগেশ করলেন কাপ্তেন।

‘সূর্যের ছেলে।’

‘নাম কী!

‘সেংভু,’ উত্তর দিলে চিনে। চিনে ভাষায় নাকি এর অর্থ : ‘যে বাঁচে না।’

‘এই জাহাজে তুমি কী করছো?’

‘সাগর-পাড়ি দিতে চাচ্ছিলুম,’ ঠাণ্ডা গলায় বললে সেংভু, ‘আমি তো কারু কোনো ক্ষতি করিনি।’

‘ক্ষতি করিনি!…জাহাজ ছাড়বার সময় তুমি খোলের মধ্যে লুকিয়েছিলে বুঝি?’

‘হ্যাঁ, কাপ্তেন।’

‘যাতে আমরা বিনামূল্যে তোমাকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে মারকিন মুলুক থেকে চিনদেশে নিয়ে যাই!’

‘যদি দয়া ক’রে নিয়ে যান…’

‘আর যদি দয়া ক’রে নিয়ে যেতে না-চাই? বলি, ওহে হলদে ওরাংওটাং, আমি চাই যে তুমি সাঁৎরেই চিনদেশে চ’লে যাও!’

‘চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি,’ সেংভু হেসে বললে, ‘তবে পথে ডুবে মরবার সম্ভাবনাই বোধহয় বেশি!’

‘শোনো, ছোকরা,’ কাপ্তেন টারকট একটু রাশভারি রাগি গলাতেই বললেন, ‘ভাড়া ফাঁকি দেবার মজাটা তোমাকে আমি টের পাইয়ে দিতে চাই।’

আরেকটু হ’লেই কাপ্তেন টারকট তাকে জলে ছুঁড়ে ফেলতেই বলতেন। অথচ অতটা রাগ করার কোনো কারণই তাঁর ছিলো না। গণ্ডগোল দেখে শেষটায় গডফ্রে চ্যাঁচামেচিতে নাক গলালে, ক্যাপটেন, ‘স্বপ্ন’র উপর একজন ফালতু চিনেম্যানেই তো ক্যালিফরনিয়ায় একজন চিনে কমলো—আপনার কি মনে হয় না ক্যালিফরনিয়ায় এমনিতেই চিনেদের সংখ্যা বড্ড বেশি!’

‘বেশি মানে-ঢের-ঢের বেশি!’ বললেন কাপ্তেন টারকট।

‘হ্যাঁ, ঢের-ঢের বেশি! তা এই লোকটা যখন স্বেচ্ছায় তার উপস্থিতি থেকে ক্যালিফরনিয়াকে রেহাই দিতে চাচ্ছে, তখন তাকে মাফ ক’রে দেয়াই উচিত। আমরা তো ওকে শাংহাইয়ের তীরে নামিয়ে দিতে পারি—খামকা হইচই ক’রে আর কী হবে!’

ক্যালিফরনিয়ায় চিনেদের সংখ্যা বড্ড বেশি, এটা কেবল গডফ্রেরই একার কথা নয়, প্রতিটি মারকিনের তাই মনের ভাব। শুধু ক্যালিফরনিয়াতেই চিনেদের সংখ্যা ৫০,০০০; পুরো মারকিন মুলুকে তাদের সংখ্যা ৩০০,০০০, ০০০-এরও বেশি। চিনেরা এমনিতে ভারি খাটতে পারে, তাছাড়া তাদের অধ্যবসায়ও প্রচুর। একমুঠো ভাত, এক চুমুক চা আর একগুলি আফিম – বাস, এই দিলেই তাদের দিয়ে যদৃচ্ছা খাটিয়ে নেয়া যায়। মারকিনরা তাদের সঙ্গে যে খুব-একটা সদয় ব্যবহার করে তা নয়—রেড-ইনডিয়ান বা নিগ্রোদের মতোই তারা প্রায়ই লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়—আর সেইজন্যেই তারা দল বেঁধে বস্তিতে বাস করে। সান ফ্রানসিসকোয় তারা থাকে স্যাক্রামেনটা স্ট্রিটে—পুরো রাস্তাটাই চিনেতে গিশগিশ করছে; সেই ঢিলে আস্তিনওলা জামা, কানাতোলা টুপি, ডগা-উলটনো জুতা-সব দেখা যায় এই চিনেপট্টিতে; দেখা যায় চিনে লণ্ঠন, চিনে ঘুড়ি—সব-কিছু। এই চিনেদের মধ্যে কেউ-কেউ আবার সান ফ্রানসিসকোর ফরাশি থিয়েটারে কাজ করে।

এবং সেংভু হচ্ছে ফরাশি থিয়েটারেরই একজন অভিনেতা। সব মজার ভূমিকাগুলোয় অভিনয় করে সেংভু—অবশ্যি যদি কোনো চিনেকে কোনো প্রহসনের মধ্যে কল্পনা করা যায়; কারণ ক্যালিফরনিয়ার নামজাদা গল্পলিখিয়ে ব্রেট হার্ট লিখেছেন যে তিনি কস্মিনকালেও কোনো চিনেকে হাসতে দ্যাখেননি—এমনকী যখন তারা ফুর্তি করছে কি আমোদ জোগাচ্ছে, তখনও না—তার ফলে চৈনিক অভিনয় দেখলে তিনি বুঝতেই পারেন না কী দেখলেন— প্রহসন, না শোকান্তিক নাটক, না আর-কিছু।

সে যাক গে। মোদ্দা কথাটা হ’লো এই যে সেংভু হ’লো একজন কমেডিয়ান। সংবাৎসরিক অভিনয় শেষ হয়ে যাবার পর দেশে ফেরবার জন্য ভারি মন-কেমন করছিলো তার—আর সেই জন্যেই সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সে ‘স্বপ্ন’ জাহাজে উঠে পড়েছিলো। সঙ্গে খাবার-দাবারও নিয়েছিলো সে। হয়তো ভেবেছিলো খোলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে সকলের অজানতেই চিনে বন্দরে গিয়ে হাজির হবে। অন্তত প্রাণদণ্ড হবার মতো অপরাধ এটা নয়—ধরা পড়লে জাহাজের কাপ্তেন বড়োজোর কেবল জাহাজের ভাড়ার জন্যে ঝুলোঝুলি টানাহেঁচড়া করতে পারেন।

সেইজন্যেই আসলে গডফ্রে ব্যাপারটার মধ্যে মাথা গলালে। কাপ্তেন টারকট যতটা-না রাগ করেছিলেন, তার চেয়েও বেশি রাগের ভান করছিলেন। তিনি এমন ভঙ্গি করলেন যে যেন নেহাৎ গডফ্রের খাতিরেই তিনি সেংভুর সাজা মকুব ক’রে দিলেন।

সেংভু অবশ্যি আর খোলের মধ্যে গিয়ে লুকোলে না। তবে জাহাজের ডেকেও সে বিশেষ মুখর হ’লো না। মাঝি-মাল্লাদের সে এড়িয়েই চলে, আর নিজের খাবারই চিবোয় দু-বেলা, জাহাজের খাদ্য স্পর্শও করে না! রোগা মানুষ সেংভু, কাজেই এই অতিরিক্ত ওজন ‘স্বপ্ন’ জাহাজের প্রায় গায়েই লাগলো না। সে যাচ্ছে বটে, বিনা মাশুলে, তবে কোল্ডেরুপকে তার জন্যে কিছু খরচও করতে হচ্ছে না। আর এই সেংভু-ই কাপ্তেন টারকটের মাথায় এমন-এক ফন্দি জুগিয়ে দিলে যে-মেট ছাড়া যার সত্যিকার কোনো সমঝদার জুটলো না।

‘হতভাগা চিনে—মাঝখান থেকে আমাদের ঝামেলায় ফেললো। অবশ্য তার নিজের ঝক্কিটাও নেহাৎ কম নয়।’

‘কোন আক্কেলে লোকটা খোলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়েছিলো?’ জিগেশ করলে মেট।

‘বিনামূল্যে শাংহাই যাবে ব’লে!’ উত্তর দিলেন কাপ্তেন টারকট। ‘যত চৈনিক উৎপাত!’

কোল্ডেরুপের ক্ষতি
হ’লো না একতিলও,
যেহেতু ‘স্বপ্নে’র
বিমার জোগান ছিলো।

পরের তিন দিনে ক্রমেই ব্যারোমিটার নেমে এলো, একবারও এমনকী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কোনো চেষ্টা বা লক্ষণ দেখা গেলো না; আবহাওয়াও একেক সময় একেক রকম : কখনও বর্ষাবাদল কখন-বা বিষম হাওয়া, কখনও ঝড়। হাওয়ার তোড় বেশ বেড়ে গেছে, আর দিকও বদল করেছে হাওয়া— দক্ষিণ-পশ্চিমমুখো তার গতি। তাছাড়া ঢেউও ফুলে উঠেছে, মাঝে-মাঝে ‘স্বপ্ন’কে ফেনার মাথায় তুলে ধরে, কখনো-বা সবেগে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে আনে। পালগুলো সব ভাঁজ করা, নামানো; ‘স্বপ্ন’কে এখন পুরোপুরি কলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে—এবং পুরোদমেও যাওয়া যাচ্ছে না; অনর্থক বয়লারের উপর বেশি চাপ দেবার কোনো মানে হয় না।

জাহাজের এই অবিরাম আন্দোলন অবিশ্যি হাসিমুখেই সহ্য করলে গডফ্রে। তার ভাব দেখে বোঝা গেলো যে সমুদ্রকে তার ভালোই লাগছে। কিন্তু সমুদ্র টার্টলেটের চক্ষুশূল, সেই জন্যেই তিনি একেবারে নিস্তেজ ও কাহিল হ’য়ে পড়েছিলেন। নৃত্যশিক্ষকের পা পড়তে লাগলো উলটোপালটা চালে; কিন্তু নিজের কামরায় যে শুয়ে থাকবেন তারও বা জো কী—জাহাজ যেভাবে আপাদমস্তক দুলছে, তাতে কেমন একটা ভির্মি খাবার দশা। ‘হাওয়া! হাওয়া! ব’লে নিজের কামরায় তিনি চ্যাঁচাচ্ছিলেন গোড়ায়, শেষকালে সেই-যে ডেকে এসে আশ্রয় নিলেন সেখান থেকে পাদমেকং আর নড়লেন না। শুধু ঢেউয়ের তোড়ে জাহাজ যখন দোলে, তখন টাল সামলাতে না-পেরে তেনি হুড়মুড় ক’রে চ’লে যান একদিকে, আর জাহাজ যখন ও-কাৎ হয়, তখন দুম ক’রে এসে পড়েন ওদিকে। শেষকালে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন রেলিং, পাকড়ে ধরতে চাইলেন দড়িদড়া—এবং আধুনিক নৃত্যকলার সঙ্গে তাঁর এই অনিচ্ছুক দাপাদাপির কোনো সম্বন্ধই রইলো না!

হায়রে! একবার যদি বেলুনের মতো হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পায়ের তলার এই আন্দোলন এড়াতে পারতেন! কোল্ডেরুপের কী খামখেয়াল—শেষকালে তাঁকেই কিনা পাঠালেন এই চর্কিচলা জাহাজে! দিনে কুড়িবার ক’রে কাপ্তেন টারকটকে তিনি জিগেশ করেন, ‘আবহাওয়ার এই বদখেয়াল কদ্দিন থাকবে?’

‘কী জানি! ব্যারোমিটারের ভাবগতিক তো সুবিধের নয়,’ ভুরু কুঁচকে প্রতিবারই উত্তর দেন কাপ্তেন টারকট।

‘চটপট পৌঁছুতে পারবো তো ডাঙায়?’

‘চটপট, মিস্টার টার্টলেট? হুম্!’

‘লোকে কি না একে বলে প্রশান্ত মহাসাগর,’ বেচারি টার্টলেট শুনেই কাৎরে ওঠেন!

কেবল যে সাগর-পীড়াতেই টার্টলেট কষ্ট পাচ্ছিলেন, তা নয়—এক বিষম জলাতঙ্কও তাঁকে পেয়ে বসেছিলো! এই পাহাড়প্রমাণ ঢেউগুলো যদি একবার ‘স্বপ্ন’কে বেকায়দায় পায়, তাহলেই ভরাডুবি!

‘না,’ ছাত্রের দিকে নির্জীব চোখে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘আর বুঝি ভেসে থাকাও গেলো না!’

শান্ত হোন!’ উত্তর দেয় গডফ্রে, ‘জাহাজ বানানো হয় ভাসবার জন্যে— ডুববে কেন? ভেসে থাকার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে জাহাজের! ‘

‘আমি তোমাকে বলছি, গডফ্রে—কোনো যুক্তিই নেই ভেসে থাকার।’ এই ব’লে টার্টলেট একদম গোড়া থেকেই একটা লাইফ-বেল্ট বেঁধে নিয়েছেন। দিবারাত্র সেটা তাঁর কোমরে আঁটো ক’রে বাঁধা থাকে। সমুদ্র মুহূর্তের স্বস্তি দিলেই সেটাকে তিনি আরো আঁটো ক’রে বাঁধবার চেষ্টা করেন বা ফুঁ দিয়ে বেল্টাকে ফোলান। বেল্টা যথেষ্ট স্ফীত হয়েছে, এটা তাঁর কখনো মনে হয় না।

টার্টলেটের এই আতঙ্ককে ক্ষমা করাই উচিত। যারা কখনো সাগর পাড়ি দেয়নি, তাদের পক্ষে ঢেউয়ের এই প্রলয়নাচন সত্যি সহ্য করা ভারি কঠিন।

আবহাওয়া কিন্তু ক্রমেই খারাপ হ’য়ে পড়তে লাগলো। একটা ভীষণ ঝোড়ো হাওয়ারও আশঙ্কা ক্রমশ প্রবল হ’য়ে আসছে। ইঞ্জিনে যাতে চোট না-লাগে সেইজন্য আদ্ধেক গতিতে চলে ‘স্বপ্ন’, আর ঢেউ তার ঝুঁটি ধ’রে অবিরাম ঝাঁকুনি দেয়। চাকাগুলো একেকবার পুরো ডুবে যায় জলে, ঘুরতে-ঘুরতে আবার পরক্ষণে চারপাশে জল ছিটিয়ে ভেসে ওঠে। আর সারাক্ষণই জাহাজের খোলটা শুদ্ধু থরথর ক’রে কাঁপতে থাকে।

গডফ্রে একটা জিনিশ লক্ষ করেছিলো, যার কোনো মাথামুণ্ডুই গোড়ায় সে ধরতে পারেনি। দিনের বেলায় জাহাজ যতটা ঝাঁকুনি খায়, যতটা দোলে, রাতে কিন্তু তার সিকির সিকিও না। তাহ’লে সূর্যাস্তের পরেই আবহাওয়া আচমকা ভালো হ’য়ে যায়?

এই হেঁয়ালিটা তাকে এতটাই ভাবালে যে ২১ শে আর ২২ শে জুনের মধ্যের রাত্তিরে সে এর ব্যাখ্যাটা খোঁজবার জন্যে যথেষ্ট সচেষ্ট হ’য়ে উঠলো। দিনের বেলায় ‘স্বপ্ন’ ভয়ংকার ভাবে দুলছিলো, হাওয়ার জোর বেড়ে গিয়েছিলো খুব; লক্ষণ দেখে মনেই হয়নি যে রাত্তিরে অবস্থার কিছু উনিশ-বিশ হবে। কিন্তু রাত্তিরে হঠাৎ যেই সব ঠাণ্ডা ও চুপ হ’য়ে গেলো, তখন গডফ্রে আর থাকতে না-পেরে গরম কাপড়ে নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে নিয়ে ডেকে গিয়ে হাজির হ’লো।

পাহারার লোকেরা গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, কাপ্তেন টারকট রয়েছেন সিঁড়ির কাছে।

হাওয়ার তোড় মোটেই কমেনি বটে, কিন্তু ঢেউয়ের দাপাদাপি একটু কম। কিন্তু অবাক হ’য়ে সে দেখলে যে জাহাজের চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠে উলটো দিকে রেখা এঁকে চলে যাচ্ছে।

‘হাওয়ার গতি বদলেছে কি তাহলে?’ বিড়বিড় ক’রে গডফ্রে নিজেকে জিগেশ করলে।

টারকটের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে ডাক দিলে ‘কাপ্তেন টারকট! ‘

কাপ্তেন গোড়ায তাকে দেখতেই পাননি। হঠাৎ তাকে কাছে আবিষ্কার ক’রে তিনি যেন একটু উত্ত্যক্তই হলেন। ‘আপনি, মিস্টার মরগান, আপনি?—এতরাতে? এখানে?

‘হ্যাঁ, কাপ্তেন টারকট। আমি শুধু জিগেশ করতে এসেছি যে—’

‘কী?’ প্রায় বোমার মতো টারকটের জিজ্ঞাসা ফেটে পড়লো। ‘আমি শুধু জানতে চাচ্ছি যে হাওয়া হঠাৎ দিক বদলেছে কি না?’

‘না, মিস্টার গডফ্রে, না। বরং ঝড়ের সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে উলটে।’

‘কিন্তু এখন দেখছি ধোঁয়া জাহাজের পিছন দিকে যাচ্ছে!’

‘পিছন দিকে যাচ্ছে…ও-হ্যাঁ!’ কাপ্তেন এ-কথা শুনে একটু বিচলিতই হলেন। ‘কিন্তু সে-কী আমার দোষ!

‘তার মানে?’

‘জাহাজটাকে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে আমি একটু পেছিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি!’

‘বাঃ রে! তাতে-যে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যাবে!’

‘তা তো যাবেই! কিন্তু ভোরবেলায় সমুদ্র যদি একটু শান্ত হয়ে পড়ে তাহ’লে আবার পশ্চিমমুখোই এগুবো। আপনি বরং নিজের কামরাতে চ’লে গেলেই ভালো করবেন। আমার পরামর্শ শুনুন…একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করুন—নইলে পরে বড্ড কাহিল, বড্ড বেসামাল বোধ করবেন।’

গডফ্রে ঘাড় নেড়ে চ’লে এলো। আসতে-আসতে দেখলো নিচু, ঝোলা মেঘেরা দল বেঁধে হুড়মুড় ক’রে এগুচ্ছে। লক্ষণ ভালো নয় দেখে সে তার কামরায় ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়লো।

পরের দিন সকালবেলায় সত্যিই হাওয়ার জোর অনেকটা ক’মে গেলো—’স্বপ্ন’ও আবার পশ্চিমমুখো এগিয়ে চললো।

এইভাবে আরো আটচল্লিশ ঘণ্টা ধ’রে চললো দিনের বেলায় পশ্চিমমুখো, রাতের বেলায় পুবমুখো, চলাচল। ব্যারোমিটার ইতিমধ্যে কিঞ্চিৎ উন্নতির লক্ষণ দেখালে, আবহাওয়া বোধহয় শিগগিরই ভালো হ’য়ে যাবে, আর হাওয়া বইবে উত্তুরে।

হ’লোও তাই। পঁচিশে জুন সকালবেলায় আটটা নাগাদ গডফ্রে ডেকে এসে দাঁড়াতেই উত্তর-পুবের খোলা হাওয়া মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে গেলো, বেরিয়ে এলো সূর্য, মেঘের ফাঁকে-ফাঁকে যেন দপদপ ক’রে আগুন জ্বলছে। আর রোদ প’ড়ে গাঢ়-সবুজ সমুদ্রও ঝিকিয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের মাথায় শান্ত শাদা ফেনা নিচু পালগুলো সব এক-এক ক’রে খাটিয়ে দেয়া হ’লো জাহাজে।

চোখে দূরবিন এঁটে মেট দাঁড়িয়েছিলো গলুয়ের কাছে।

গডফ্রে তার কাছে এগিয়ে গেলো। ‘কালকের তুলনায় দিনটা আজ অনেক ভালো ঠেকছে।’

‘হ্যাঁ, মিস্টার গডফ্রে,’ মেট উত্তর দিলে, ‘আমরা এবার শান্ত জলে এসে পড়েছি।’

‘আর ‘স্বপ্ন’ও ঠিক পথ ধরে এগুচ্ছে?’

‘না, এখনও অবশ্য ঠিক পথে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না!’

‘এখনও না?—কেন—’

‘কারণ হাওয়ার তোড়ে আমরা অনেকটা উত্তর-পুবদিকে স’রে এসেছি –আগে ঠিক ক’রে জানতে হবে তো কোথায় আছি—’

‘কিন্তু দিব্যি তো আলো হয়েছে—দিগন্তও বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।’ দুপুরবেলায় সূর্য যখন মাথার উপরে আসবে, তখন আমরা ঠিকঠাক বুঝেতে পারবো কোথায় আছি। তার পরেই কাপ্তেন জাহাজ চালাবার নির্দেশ দেবেন।’

‘তা কাপ্তেন টারকট কোথায়?’

‘উনি তো চ’লে গেছেন।’

‘চ’লে গেছেন!’

‘হ্যাঁ, পাহারা এসে তাঁকে বলেছিলো পুবদিকে নাকি মস্ত সব ঢেউ দেখা যাচ্ছে—বোধহয় ডাঙা আছে কাছে—অথচ মানচিত্রে তার কোনো উল্লেখ নেই। কাজেই স্টীমলঞ্চে ক’রে চারজন মাল্লাকে নিয়ে কাপ্তেন সাহেব সরেজমিন তদন্ত ক’রে আসতে গেছেন।’

‘কতক্ষণ হ’লো গেছেন?’

‘তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হবে!’

‘আমাকে একবার খবর দিলে পারতেন—তাহ’লে আমিও সঙ্গে যেতুম!’ মেট বললে, ‘আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন, মিস্টার গডফ্রে। কাপ্তেন টারকট আপনাকে আর মিথ্যে জাগাতে চাননি।’

‘কোন দিকে গেছে লঞ্চ?’

‘ওই-যে, ওদিকে—উত্তরপুব দিকে।’

দূরবিনে দেখা যাচ্ছে লঞ্চটা?’

‘না, এতক্ষণে অনেক দূর চ’লে গেছে।’

তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন তো কাপ্তেন? না কি দেরি হবে?’

‘বেশি দেরি হবে ব’লে মনে হয় না। কারণ কাপ্তেন এসে নিজে সব হদিশ নেবেন—সূর্যের অবস্থান ইত্যাদি—আর সেজন্যে তাঁকে দুপুরের আগেই ফিরে আসতে হবে।’

আর-কোনো কথা না ব’লে গডফ্রে গিয়ে গলুইয়ের একেবারে ডগায় গিয়ে একটা দূরবিন হাতে বসলো। কাপ্তেন টারকটের ব্যবহারে সে অবিশ্যি মোটেই অবাক হয়নি। ও-রকম বড়ো-বড়ো ঢেউ কেন উঠছে, ডুবোপাহাড়ের জন্যেই নাকি—এটা আবিষ্কার করা কাপ্তেনের পক্ষে খুবই জরুরি, কারণ ‘স্বপ্ন’র নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা তাঁকেই তো দেখতে হবে, তাঁরই তো সব দায়িত্ব।

সাড়ে-দশটা নাগাদ দিগন্তে হালকা একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেলো। গডফ্রে বুঝতে পারলে যে সরেজমিন তদন্ত শেষ ক’রে অবশেষে লঞ্চটা জাহাজেই ফিরে আসছে।

দূরবিনের মধ্যে লঞ্চের আগমন দেখতে গডফ্রের ভারি মজা লাগলো। আস্তে-আস্তে লঞ্চটা যেন নিজেকে মেলে ধরছে, যেন সমুদ্রের উপরেই ধীরে-ধীরে সে গজিয়ে উঠছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন তার মালা।

চমৎকার একটি ছোট্ট লঞ্চ, প্রচণ্ড তার গতি; পুরোদমে এগুচ্ছিলো ব’লে একটু পরেই তাকে খালি চোখেই দেখা গেলো। সোয়া-এগারোটা নাগাদ লঞ্চটা এসে ভিড়লো জাহাজের গায়ে, আর কাপ্তেন টারকট লাফিয়ে নেমে পড়লেন ‘স্বপ্নে’।

‘কী খবর, কাপ্তেন?’ হাত-ঝাঁকুনি দিতে-দিতে গডফ্রে উৎসুকভাবে জিগেশ করলে।

‘সুপ্রভাত, মিস্টার গডফ্রে।’

‘ওই ঢেউগুলো?’

‘ও-কিছু না। সন্দেহজনক কিছুই তো চোখে পড়লো না। আমাদের লোক বোধহয় ভুল করেছে। তাহ’লেও আমার বেশ অবাক লাগছে।’

‘তাহ’লে আমরা এবার ঠিক পথেই এগুবো?’

‘হ্যাঁ, তবে তার আগে অবস্থানটা একটু জেনে নিতে হবে।’

এমন সময় মেট এসে জিগেশ করলে, ‘লঞ্চটাকে কি জাহাজের মধ্যেই তুলে নেবো?’

‘না,’ কাপ্তেন বললেন, ‘পরে আবার কাজে লাগতে পারে। বরং এখন জাহাজের সঙ্গে বেঁধে রেখে দাও।’

কাপ্তেনের নির্দেশ অনুযায়ী গাধাবোটের মতো লঞ্চটাকে জাহাজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হ’লো।

বারোটার সময় কাপ্তেন সেক্সটান্ট কম্পাস নিয়ে সূর্যের অবস্থান নিরূপণ ক’রে জাহাজ কোন দিকে যাবে, তার নির্দেশ দিলেন। তারপর একবার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মেটকে ডেকে নিজের কামরায় চ’লে গিয়ে কি-এক গোপন পরামর্শ শুরু ক’রে দিলেন।

ভারি চমৎকার ছিলো দিনটা। ‘স্বপ্ন’ পুরোদমেই এগিয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় তেমন জোর নেই ব’লে আর পাল খাটানো হয়নি।

গডফ্রের মেজাজ দিব্যি ভালো। সুন্দর আকাশের তলায় সুন্দর সমুদ্র দিয়ে জাহাজে ক’রে পাড়ি দেবার চেয়ে তৃপ্তিকর আর-কিছু নেই। অধ্যাপক টার্টলেটও বেশ সামলে উঠেছেন। তবে লাইফ-বেলটা কোমর থেকে তিনি হাজার অনুরোধেও খুলতে রাজি হলেন না। মধ্যাহ্নভোজেও তাঁর রুচি ফিরলো না।

সন্ধেবেলায় কিন্তু ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়লো। রাতটা যে এ-রকম ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে—অমন ঝকঝকে দিন দেখে তা কিন্তু আন্দাজ করা যায়নি। এ-তল্লাটে অবিশ্যি কোনো ডুবোপাহাড় নেই, তবে আচমকা কোনো-কিছুর সঙ্গে যে-কোনো সময়েই ধাক্কা লাগতে পারে আর কুয়াশাভরা রাতেই তার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি।

সূর্যাস্তের সঙ্গে-সঙ্গেই জাহাজের লণ্ঠনগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হলো। মাস্তুলে ঝুললো শাদা লণ্ঠন, ডান দিকে সবুজ আলো আর বাঁ-দিকে জ্বলন্ত-লাল।

একটু বিশ্রাম ক’রে নেবার জন্য সব দায়িত্ব মেটের উপর দিয়ে কাপ্তেন টারকটও নিজের কেবিনে গিয়ে ঢুকে পড়েছেন। কুয়াশা অবশ্যি পুরু হয়ে সমুদ্রে বিছিয়ে আছে, তবে ‘স্বপ্ন’র কোনো ভয় নেই।

গডফ্রে গিয়ে শোবামাত্রই ঘুমিয়ে পড়লো। অধ্যাপক টার্টলেটের চোখে অবিশ্যি ঘুম নেই—তিনি কেবল এ-পাশ ও-পাশ করছেন আর থেকে-থেকে মস্ত একেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।

হঠাৎ রাত একটা নাগাদ একটা ভীষণ আওয়াজে গডফ্রে ধড়মড় করে তার বিছানায় উঠে বসলো। লাফিয়ে নেমেই সে চটপট পোশাক-আশাক প’রে নিলে, আর পোশাক পরতে-পরতেই শুনতে পেলো ডেকে চীৎকার উঠেছে : ‘জাহাজ ডুবে যাচ্ছে! জাহাজ ডুবে যাচ্ছে!’

এক লাফে কামরা থেকে বেরিয়ে আসতেই খাবার ঘরে এক মূর্ছিত ব্যক্তির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগলো—ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, নৃত্যশিক্ষক অধ্যাপক টার্টলেট।

জাহাজ শুদ্ধু লোক তখন ডেকে ভিড় করে আছে। মেট আর কাপ্তেন ভীষণ উত্তেজিত।

গডফ্রে গিয়েই হন্তদন্ত হ’য়ে জিগেশ করলে, ‘ধাক্কা লাগলো?’

‘জানি না! জানি না…এই বিদঘুটে কুয়াশা…’ মেট বললে, ‘কিন্তু জাহাজ ডুবে যাচ্ছে!’

‘ডুবে যাচ্ছে?’

নিশ্চয়ই কোনো ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগেছে, কারণ সত্যি ‘স্বপ্ন’ ডুবে যাচ্ছে। এর মধ্যেই প্রায় ডেক অব্দি জল উঠে এসেছে। নিচে এতক্ষণ ইঞ্জিনে নিশ্চয়ই জল ঢুকে গেছে।

‘জলে-জলে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, মিস্টার মরগান!’ কাপ্তেন চেঁচিয়ে বললেন, ‘আর একমুহূর্তও নষ্ট করা চলবে না! জাহাজ ডুবে যাচ্ছে, দেখছেন—শেষকালে

জাহাজডুবির ঘূর্ণির টানে প’ড়ে যাবেন!

‘আর টার্টলেট?’

‘আমি ওঁকে দেখছি। …ডাঙা থেকে আমরা মাত্র সামান্য দূরে আছি!’

‘কিন্তু আপনি?’

‘আমাকে একেবারে শেষ পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে…সব লোক নিরাপদে চ’লে যেতে পারলো কিনা, সেটা দেখাই আমার কাজ! ঝাঁপিয়ে পড়ুন…লাফিয়ে পড়ুন!

গডফ্রে তবু জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইতস্তত করতে লাগলো—কিন্তু জল ততক্ষণে ডেক ছোঁয়-ছোঁয়।

গডফ্রে যে মাছের মতো সাঁত্রাতে পারে, এ-তথ্য কাপ্তেন টারকটের অজানা ছিলো না। তিনি আর বাক্যব্যয় না-ক’রে গডফ্রেকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিলেন।

ভালোই করলেন। আরেকটু দেরি করলে জাহাজ ডুবির দরুন জলে দারুণ ঘূর্ণি জেগে উঠতো, আর সেই ঘূর্ণিজল গডফ্রেকে পাকে-পাকে পেঁচিয়ে ধরতো।

গডফ্রে একটুক্ষণের চেষ্টাতেই ঘূর্ণিজল থেকে দূরে স’রে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হতাশ হইচই উঠলো ‘স্বপ্ন’য়—শাদা, লাল, সবুজ লণ্ঠনগুলো নিভে গেলো; আর-কোনো সন্দেহই নেই! ‘স্বপ্ন’র ভরাডুবি হয়েছে, সত্যিই!

গডফ্রে সাঁরে গিয়ে উঠলো ডাঙায়। অন্ধকারে তার হাঁক-ডাকের কোনো সাড়াই এলো না। এ কোথায় সে এসে পড়লো? এ কি কোনো ডুবোপাহাড়ের চুড়ো, না কি কোনো দ্বীপ? কিছুই বোঝবার জো নেই। এটাও বোঝবার জো নেই জাহাজের অন্য লোকেদের কী হ’লো। হয়তো এই ভরাডুবির হাত থেকে সে একাই রেহাই পেয়েছে!

উৎকণ্ঠায় ভ’রে গিয়ে গডফ্রে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়
চুলকে ওঠে পায়ের তলায়—
নইলে কি কেউ বাইরে বেরোয়,
বাড়ির আরাম ছেড়ে পালায়?
আত্মারাম যে চমকে ওঠে
সাগর-পাড়ির হাজার ঠ্যালায়।

দিগন্তে সূর্যের পুনরাবির্ভাবের আগে আরো তিন-তিনটে ঘণ্টা কাটাতে হবে। ঘণ্টা নয় তো, যেন একেকটা শতাব্দী।

ভাবগতিক খুব-একটা সুখের ঠেকছে না; তা, গডফ্রেও তো আর শখ ক’রে হাওয়া খেতে বেরোয়নি। অ্যাডভেনচারের খোঁজে বেরিয়ে শেষকালে এমন অবস্থায় এসে পড়লো যে কোনো দিন আর ঘরের আরাম জুটবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু মুষড়ে পড়লে বা হাল ছেড়ে দিলে তো আর চলবে না। —তাই গডফ্রে মনে-মনে সব বিপদ-আপদের সঙ্গে যোঝবার জন্যেই তৈরি হয়ে নিলে।

আপাতত তার অন্তত একটা আশ্রয় আছে। ফেনিল জল পিচকিরির মতো ছিটকে লাগছে ডাঙার গায়ে, তবে তাকে কিছুতেই আর সমুদ্রে টেনে নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু জোয়ারের সময় কী দশা হবে? এই পাহাড়ের চুড়োটাই আস্ত ডুবে যাবে না তো? শুক্লপক্ষের প্রতিপদ—অনেক ভেবে বুঝতে পারলে গডফ্রে—তারই ভরা জোয়ারের সময় জাহাজডুবি হয়েছে—কাজেই শিগগিরই আর জোয়ারের ভয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন একটাই। পাহাড়ের চুড়োটাই কি শুধু জলের মধ্যে থেকে জেগে উঠেছে, না কি এটা কোনো মস্ত ডাঙার উপকূল? কাপ্তেন টারকট কোন ডাঙার খোঁজে লঞ্চ নিয়ে বেরিয়েছিলেন? সে কি এটাই? কোন মহাদেশের ডাঙা? গত কয়েকদিনের ঝড়ে ‘স্বপ্ন’ যে নিজের পথ থেকে অনেকটাই স’রে গিয়েছিলো তাতে আর সন্দেহ কী! নিশ্চয়ই জাহাজের অবস্থান ঠিকমতো ধরা যায়নি। কিন্তু কাপ্তেন টারকট তো বললেন সমুদ্রের এ—অঞ্চলে কোনো ডাঙা নেই! এমনকী নিজে লঞ্চ নিয়ে বেরিয়ে তিনি ডাঙার খোঁজ ক’রে গেছেন—রাতের পাহারার কথা ঠিক কি না যাচাই ক’রে দেখবার জন্যে। ডাঙা অবিশ্যি সত্যিই আছে–হয়তো লঞ্চ নিয়ে আরেকটু গেলেই তিনি দেখতে পেতেন—যাননি বলেই এই দুর্ঘটনাটা ঘটলো। যাক—গে, অতীতের কথা ভেবে হা—হুতাশ ক’রে আর কী লাভ : গতস্য শোচনা নাস্তি।

এখন যেটা জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন, সেটা হ’লো এই; এটা যদি কোনো একলা পাহাড়ের চুড়ো হয়, তাহ’লে কাছে-পিঠে কোথাও কোনো ডাঙা আছে কি না। পরে না-হয় বের করা যাবে প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক কোনখানে সে আছে। সকাল হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে সর্বাগ্রে এই চুড়ো ছেড়ে চ’লে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। চুড়োটা যেখানে সবচেয়ে বড়ো সেখানেও নিশ্চয়ই কুড়ি বর্গগজের বেশি হবে না। কিন্তু অন্য জায়গার সন্ধান না-পেলে সে এই জায়গা ছেড়ে যাবে কোথায়? সেই অন্য জায়গা যদি কোথাও না থাকে? যদি চারদিকেই দিগন্তে আকাশ আর সমুদ্র এক জায়গায় এসে মিলে যায়?

গডফ্রের সব ভাবনা এখন কেবল এই নিয়েই! এই কালো রাতের দিকে তাকিয়ে সে দেখবার চেষ্টা করলে আশপাশে কোথাও অধিকতর মিশকালো কোনো বস্তু চোখে পড়ে কি না। নিজেকে সে মিথ্যে প্রবোধ দিতে চায় না। এটা সে ঠিক জানে এ-রকম অবস্থায় হাজারে একজনও বাঁচে কিনা সন্দেহ। আপাতত আর বিশ্বভ্রমণের কথা সে ভাবছে না, বরং মৃত্যুর কথাই তার মনে পড়ছে বার-বার। নির্ভীকভাবে সে দিনের অপেক্ষা করতে লাগলো। দিনের বেলায় বোঝা যাবে তার কপালে কি আছে : মৃত্যু, না জীবন।

পশমি ওয়েস্টকোট আর ভারি জুতোজোড়া ভিজে জবজব করছে এ-সব সে খুলে ফেললে; যে-কোনো মুহূর্তে যাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়, তার জন্যে তৈরি থাকতে হবে তো।

কিন্তু জাহাজ ডুবির পর আর-কেউ বাঁচেনি? ‘স্বপ্ন’ জাহাজের একজনও সাঁৎরে এখানে এসে ওঠেনি? তাহ’লে কি ওই জাহাজডুবির ঘূর্ণিতেই সবাই তলিয়ে গিয়েছে। শেষ যাঁর সঙ্গে গডফ্রে কথা বলেছিলো, তিনি হলেন কাপ্তেন টারকট—তিনি তো স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে শেষ মাল্লাটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা ক’রে তবেই তিনি জাহাজ ছাড়বেন। জাহাজটা যখন ডুবু-ডুবু তখনই তো কাপ্তেন তাকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলেছিলেন।

কিন্তু অন্যরা? দুর্ভাগা টার্টলেট, বেচারি সেংভু-তাদের কী দশা হ’লো? সমুদ্রই কি গিলে খেলো তাদের? ‘স্বপ্ন’ জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে কেবল কি সে-ই বেঁচেছে? আর বাষ্পে-চলা লঞ্চটা? সেটা কি শেষ পর্যন্ত ল্যাংবোটের মতো জাহাজের সঙ্গেই বাঁধা ছিলো? কেউ-কেউ তো সেই লঞ্চে করেই ভরাডুবির থেকে বাঁচতে পারতো। না কি ‘স্বপ্ন’ লঞ্চকে শুদ্ধু টেনে-হিঁচড়ে নিজের সঙ্গে-সঙ্গে পাতালে নিয়ে গেছে?

এই কালো রাতে কিছু দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু চেঁচিয়ে-মেচিয়ে নিজের গলা তো শোনাতে পারে? এই স্তব্ধতার মধ্যে তার হাঁকডাকে আপত্তি করবে কে? বরং তার গলা শুনে অন্য-কেউ হয়তো সাড়া দিয়ে উঠতে পারে!

বারে বারে সে টেনে-টেনে চেঁচিয়ে ডাকলে অন্ধকারে—জলের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই আওয়াজ অনেক দূরে চলে গেলো। কিন্তু মিথ্যেই সে গলা ফাটিয়ে ডাক দিলে—কোত্থাও কারু সাড়া নেই।

আবার সে ডাক দিলে চারদিকে ঘুরে-ফিরে।

উত্তরে স্তব্ধতা যেন আরো নিরেট ভারের মতো চেপে বসলো।

‘একা! একেবারে একা!’ ফিশফিশ করে নিজেকে শোনালে গডফ্রে। শুধু-যে কারু সাড়া সে পায়নি, তা-ই নয়, তার ডাকের কোনো প্রতিধ্বনিও ওঠেনি। আশপাশে যদি কোনো পাহাড়পর্বত থাকতো, তাহ’লে তাদের গায়ে ধাক্কা লেগে তার নিজের কণ্ঠস্বরই ফিরে আসতো। তার মনেই হচ্ছে এই যে পুবদিকে হয় উঁচু জমি নেই যে প্রতিধ্বনি হবে, নয়তো আদৌ কোনো ডাঙাই নেই সেদিকে।

এইসব উৎকণ্ঠার মধ্যেই তিন ঘণ্টা কেটে গেলো। কনকনে ঠাণ্ডায় গডফ্রের হাড়শুদ্ধু কেঁপে উঠছে। ঠাণ্ডার সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে পাথরের উপর হাঁটতে লাগলো গডফ্রে। অবশেষে মাথার উপরে অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে গেলো। দিগন্তের সূর্যোদয়েরই অগ্রিম সংকেত এটা।

যেদিকটায় ডাঙার থাকা সম্ভাবনা, গডফ্রে সেদিকটায় ফিরে তাকালে। যদি ছায়ার মধ্যে অন্তত কালো রেখার মতোও কোনো ডাঙা দেখা যায়! প্রথম সূর্যের আলোয় কাছে ডাঙা আছে কিনা তা নিশ্চয়ই স্পষ্ট চোখে দেখা যাবে।

কিন্তু সেই কুয়াশাভরা ঊষাবেলায় কিছুই দেখা গেলো না। সমুদ্রের উপরে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার একটা হালকা পর্দা প’ড়ে আছো—তার ফলে এমনকী ভালো ক’রে ঢেউয়ের ওঠানামাই দেখা যায় না।

কাজেই কেবল কতগুলো বিভ্রম নিয়েই তাকে তুষ্ট হ’তে হ’লো। সত্যি যদি গডফ্রে প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো একলা পাহাড়চূড়ায় এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে, তাহ’লে মৃত্যু তার অবশ্যম্ভাবী, কেবল একটু যা সময় লাগবে—ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে শেষকালে হয়তো সমুদ্রের তলাতেই তাকে শেষ আশ্রয় নিতে হবে!

অবশেষে কুয়াশা একটু-একটু ক’রে সরতে লাগলো। গডফ্রে দেখতে পেলে অতিকায় সামুদ্রিক জীবের মতো মস্ত কালো গা মেলে কালো পাথরের রেখা উঠে গেছে সমুদ্র থেকে—দীর্ঘ, বন্ধুর, অনিয়মিত কালো পাথরের সারি, অদ্ভুত আকার পাথরগুলোর, পুব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে আছে তারা। গডফ্রে যার উপর এসে আশ্রয় নিয়েছে, সেটা পশ্চিম দিকের একটা মস্ত পাথর। ঢেউয়ের গর্জন ও ভাঙচুরের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র এখানে খুব গভীর।

একবার তাকিয়েই অবস্থাটা সে টের পেলে : এদিকটায় কোনো নিরাপত্তা নেই। কুয়াশার পর্দা স’রে যেতেই এবার সে অন্য দিকটায় তাকিয়ে দেখলে। ওপাশে আরো পাথর দেখা যাচ্ছে—তাদের আকার আরো মস্ত, আরো উঁচু আর আরো চওড়া। মাঝখান দিয়ে খাড়ি গেছে, ছোটো ছোটো নোনা জলের ধারে। ওপাশে যদি সত্যি ডাঙা থাকে, তাহ’লে এই জল পেরিয়ে যেতে অবিশ্যি বিশেষ অসুবিধে হবে না। কিন্তু এ-পর্যন্ত উপকূলের কোনো হদিশ‍ই পাওয়া গেলো না। ওদিকে যে কোনো শুকনো ডাঙা আছে, এখনও তা বোঝা যাচ্ছে না। কুয়াশা অবিশ্যি ক্রমেই সরছে—আর ধীরে-ধীরে একটা শৈবালে-ভরা বেলাভূমিও উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে তার চোখের সামনে। অবশেষে চোখে পড়লো দীর্ঘ নিচু টিলার সারি, গ্র্যানাইট পাথরে মোড়া—আর এই টিলারাই পুব দিগন্ত আড়াল ক’রে রেখেছে চোখের সামনে থেকে।

‘ডাঙা! ডাঙা!’ গডফ্রের মুখে উল্লাস দেখা দিলো।

হাঁটু গেড়ে ব’সে সে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানালে প্রথমে।

সত্যি, ডাঙাই। প্রায় দু-মাইল লম্বা একটা বেলাভূমি প’ড়ে আছে—চঞ্চল জল আছড়ে পড়ছে তীরে। উত্তরে-দক্ষিণে দুটো খাড়াই টিলা—সব শুদ্ধ পাঁচ-ছ মাইল হবে দৈর্ঘ্যে। হয়তো মস্ত কোনো অন্তরীপের একপ্রান্ত এটা। কিন্তু তা যদি নাও হয়, তবু এখানে তো সাময়িকভাবে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে।

ডাঙার দিকে এগিয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো চারদিকে তাকিয়ে দেখলে গডফ্রে। না, কোথাও ‘স্বপ্ন’র কোনো চিহ্ন নেই—না তার লঞ্চকে দেখা যাচ্ছে কোথাও, না-বা তার কোনো যাত্রীকে। শুধু গডফ্রেই বেঁচে আছে একা : একাই তাকে সব বিপদ-আপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে নির্ভীকভাবে, কোনো ভয় পেলে চলবে না।

কিন্তু আসল ডাঙায় যাবার আগে জলের উপরকার ওই বড়ো-বড়ো পাথরগুলো তাকে পেরুতে হবে। কখনও-বা লাফিয়ে, কখনও-বা জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই গডফ্রে এগুতে লাগলো। শ্যাওলাভরা পিছল পাথর, চোখা ধারালো গা একেকটার। এর উপর দিয়ে তার যাত্রা খুব-একটা সহজ হ’লো না, তাছাড়া সময়ও লাগলো অনেক। প্রায় সিকি মাইল পথ এইভাবে পেরুতে হ’লো তাকে। কিন্তু গডফ্রে বেশ ক্ষিপ্র ও উৎসাহী, শেষকালে ওই মূল ডাঙায় গিয়ে পৌঁছে সে হাঁপ ছাড়লে। কিন্তু এখানে তার জন্যে কী অপেক্ষা ক’রে আছে, কে জানে! আশু মৃত্যুর যদি সম্ভাবনা নাও থাকে, তাহ’লে হয়তো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর কোনো দুর্দশা তার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছে। তৃষ্ণা, বুভুক্ষা, বসনহীনতা—আরো কত-কী, কে জানে! আত্মরক্ষার কোনো হাতিয়ার নেই, নেই কোনো বন্দুক বা ছোরা- প্রায় আদ্যিকেলে কোনো মানুষের মতোই সে নিঃসম্বল।

বোকা! বোকা! আকাট বোকা সে! বাড়িতে ব’সে-ব’সে ভেবেছে না-জানি রবিনসন ক্রুসোর জীবন কত মনোরম ও কত রোমাঞ্চকর ছিলো! এবার তো ভালো ক’রেই টের পাবে ক্রুসোর ভাগ্য সত্যি-সত্যি কতটা ঈর্ষণীয়! দিব্যি ছিলো সান ফ্রানসিসকোয়, কোল্ডেরুপের প্রাসাদে—আরামে-গরমে দিব্যি ছিলো। মনে পড়লো কোল্ডেরুপের কথা, ফিনার মুখ, বন্ধুবান্ধবদের গল্পগুজব! আর-কোনোদিনও তাদের সঙ্গে দেখা হবে না!,

এই কথা ভাবতেই তার বুকের ভিতরটা হঠাৎ কেমন ক’রে উঠলো, জল ভ’রে এলো দুই চোখে।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে গডফ্রে এগুতে লাগলো। পেরিয়ে এলো শ্যাওলা-জমা পিছল পাথর, বালির ঢিবি, উঁচুনিচু জমি। চারদিক বড্ড চুপচাপ—শুধু তার নিজের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কতগুলো গাংচিল পাক খেয়ে-খেয়ে উড়ছে মাথার উপর।

হঠাৎ কী-একটা দেখে গডফ্রে থমকে দাঁড়ালে।

ওই কী প’ড়ে আছে সামনে? কোনো সিন্ধুদানব? হয়তো ঝড় তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে এখানে! বালির ঢিবির ও-পাশে, তিরিশ পাও দূরে হবে না, কী-একটা জন্তু যেন কুঁকড়িমুকড়ি হ’য়ে পড়ে আছে।

ছুটে গেলো গডফ্রে তার দিকে।

যত কাছে এগুচ্ছে, তত তার বুকের মধ্যটা টিপ-টিপ করছে। জন্তু তো নয় –মানুষ! প্রায় দশ পা দূরে থাকতে গডফ্রে চমকে ব’লে উঠলো ‘টার্টলেট!’ সিন্ধুদানব ব’লে যাকে ভুল করেছিলো, সে আসলে তার নাচের মাস্টার-মশাই –অধ্যাপক টার্টলেট।

গডফ্রে তাঁর দিকে ছুটে গেলো। হয়তো এখনও তাঁর হৃৎপিণ্ড বিকল হ’য়ে পড়েনি।

কাছে গিয়েই আবিষ্কার করলো কোমরে বাঁধা হাওয়া-দিয়ে ফোলানো লাইফ-বেল্টটার জন্যই তাঁকে ও-রকম দেখাচ্ছিলো।

নিশ্চল প’ড়ে আছেন টার্টলেট। মারা গেছেন নাকি? গডফ্রে হুড়মুড় করে হাঁটু গেড়ে বসলো তাঁর পাশে, লাইফ-বেল্টটা আলগা ক’রে দিয়ে জোরে-জোরে ডলাই-মলাই করতে লাগলো তাঁর হাত-পা। অবশেষে আধ-খোলা ঠোঁটের ফাঁক থেকে হালকা নিশ্বেস বেরুলো। বুকে হাত দিয়ে দেখলো গডফ্রে। এখনও বুকে শব্দ হচ্ছে।

গডফ্রে কথা বললে, ডাক দিলে তাঁকে নাম ধ’রে।

টার্টলেট ঘোরের মধ্যে দু-একবার মাথা নাড়লেন, শুধু একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরুলো তাঁর গলা দিয়ে, অসংলগ্নভাবে কী-সব যেন বললেন তিনি অস্ফুট স্বরে।

গডফ্রে খুব জোরে ঝাঁকিয়ে দিলে তাঁকে।

আস্তে-আস্তে চোখের পাতা খুললেন টার্টলেট, বাঁ হাত বোলালেন একবার ভুরুর উপর, ডান হাত তুলে পকেট নেড়ে দেখলেন তাঁর সেই দামি পকেট- বেহালাটা যথাস্থানেই আছে।

‘টার্টলেট!’ চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকলো গডফ্রে।

টার্টলেট শুধু ঘাড় নাড়লেন।

‘এই-যে আমি-গডফ্রে!’

‘গডফ্রে?’ অধ্যাপক জিগেশ করলেন।

পাশ ফিরে হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে চারপাশে ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে দেখলেন টার্টলেট, ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে উঠলো তাঁর মুখে, তারপর আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলেন যে সত্যিই শক্ত নিরেট মাটির উপর পা পড়ছে! আর তাহ’লে জাহাজের ডেকে তাঁকে টালমাটাল হ’তে হবে না—সত্যিই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি শক্ত অনড় ডাঙার উপর! ভাবতেই এতদিন পরে আবার তাঁর চোখমুখে স্বাভাবিক জ্যোতি ফিরে এলো। নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলে তিনি পকেট-বেহালার তারে ছড় টানলেন : একটা বিষণ্ণ ঝমঝম সুর বেজে উঠলো বেহালায়।

চাইলেই ক্রুসো কিছু পেতো না যে হেসে-হেসে
দুঃখের সঙ্গে তা জানা গেলো অবশেষে।

ছাত্র ও মাস্টারমশাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো।

‘গডফ্রে!’

‘টাৰ্টলেট!’

‘শেষকালে তাহ’লে বন্দরে এসে পৌঁছেছি!’ যথেষ্ট সাগর পাড়ির পর কারু যে-রকম দশা হয়, টার্টলেটেরও মনের ভাব সে-রকম। না হ’লে এটাকে তিনি বন্দর পৌঁছোনো বলেন! গডফ্রে এ-কথায় কোনো আপত্তি করলে না, শুধু বললে, ‘আপনার লাইফ-বেল্টটা খুলে নিন। ওটা জড়িয়ে থাকলে চলাফেরায় ভারি অসুবিধে হবে! আর আপনার বেহালাটা রেখে আসুন, চার-পাশটা একবার ঘুরে দেখি!’

‘তাই চলো,’ বললেন অধ্যাপক টার্টলেট, ‘আর তুমি যদি কিছু মনে না-করো, গডফ্রে, তো চলো প্রথম যে রেস্তোরাঁটা চোখে পড়বে, তাতেই ঢুকে পড়ি। খিদেয় আমার নাড়িভুঁড়ি শুদ্ধু হজম হ’য়ে যাচ্ছে—ডজনখানেক স্যাণ্ডুইচ আর দু-এক গেলাশ পানীয় নইলে আর পায়ের উপর দাঁড়াতে পারবো না।

চলুন, তবে প্রথম রেস্তোরাঁটাতেই যাই,’ ঘাড় নেড়ে বললে গডফ্রে, ‘আর প্রথমটা পছন্দ না-হ’লে শেষ রেস্তোরাঁতে গিয়ে ঢুকে পড়তেও আমার আপত্তি নেই।

‘রেস্তোরাঁ থেকেই কাউকে কিছু বখশিশ দিয়ে তার-আপিশে পাঠিয়ে দেয়া যাবে, তোমার মাতুলকে একটা তারবার্তা পাঠানো সবচেয়ে দরকার। উনি নিশ্চয়ই মানগোমেরি স্ট্রিটে ফিরে যাবার রাহাখরচ পাঠাতে ইতস্তত করবেন না। আমি তো একেবারে কপর্দকশূন্য।’

‘হ্যাঁ, তাই ভালো। প্রথম টেলিগ্রাম আপিশেই পাঠাবো কাউকে। বললে গডফ্রে আর এ-দেশে যদি টেলিগ্রাম আপিশ না-থাকে তো প্রথম ডাকঘরেই না-হয় লোক পাঠাবো। আসুন, টার্টলেট চলুন, এবার এগোই।’

টার্টলেট লাইফ-বেল্টটা খুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলালেন, তারপর তীরের বালির ঢিবিগুলো পেরিয়ে গেলেন গডফ্রের সঙ্গে। গডফ্রে তখন হাঁটতে- হাঁটতে ভাবছে যে হয়তো ‘স্বপ্ন’র আরোহীদের মধ্যে আরো-কেউ জাহাজ – ডুবির হাত থেকে বেঁচেছে ও এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এতক্ষণে তার মনে বেশ আশা জেগে উঠলো।

মিনিট পনেরো পরে তারা উপকূলের খাড়িগুলো পেরিয়ে একটা ষাট-সত্তর ফিট উঁচু বালির ঢিবির উপরে এসে দাঁড়ালে। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। এতক্ষণ টিলাগুলোর আড়ালে পুব দিগন্তটা ঢাকা প’ড়ে ছিলো, এবার তাও দেখা গেলো। দু-তিন মাইল দূরে আরো-একসার টিলা উঠছে—তার ওপাশে কী আছে, তা আর দেখা যায় না। উত্তরদিকে উপকূল অনেকটা অন্তরীপের মতো সরু হ’য়ে এসেছে—তার ওপাশে আরো-কোনো অন্তরীপ আছে কিনা তা অবিশ্যি নজরে পড়লো না। দক্ষিণদিকে একটা ঝরনা গড়িয়ে এসে বেলাভূমিতে পড়েছে, তার পরেই সমুদ্র। যদি এই ডাঙা কোনো উপদ্বীপ হয়, তাহ’লে এর লাগোয়া দেশ থাকতে পারে কেবল উত্তরে বা উত্তর-পুবে।

জায়গাটা কিন্তু রুক্ষ বা ঊষর নয়। সবুজ তৃণভূমির মধ্য দিয়ে-দিয়ে গেছে ছোটো-ছোটো জলের ধারা—দূর থেকে দেখায় যেন চৌখুপি-কাটা সবুজ জামা বা শতরঞ্জ খেলার ছক। তৃণভূমির পরে যেন উঁচু, ঘন, গহন জঙ্গল, একেবারে পাহাড় পর্যন্ত গেছে মস্ত-মস্ত গাছগুলো।

কিন্তু কোথাও কোনো ঘর-বাড়ি, এমনকী কুঁড়েঘর অব্দি দেখা গেলো না। কী এটা? শহর, না গ্রাম, না ছোটো-কোনো গঞ্জ-তা বোঝবার কোনো উপায় নেই। কোথাও কোনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে না গাছপালার আড়াল থেকে, যা থেকে জনপদের আঁচ পাওয়া যেতো। না দেখা গেলো চিমনি, না বা কোনো হাওয়া-কল। এমনকী কোনো ভাঙাচোরা ঘর, বাড়ি, অ্যাজুপা বা পাহারা- কামরাও নজরে পড়লো না। যদি এই অজ্ঞাত ভূখণ্ডে মানুষজন থেকে থাকে, তবে তারা হয়তো ট্রগলোডাইটদের মতো মাটির তলাতেই আস্তানা গেড়েছে, কেননা কোনো রাস্তাঘাটের চিহ্ন কোথাও নেই, এমনকী পায়ে-চলা সরু পথের পর্যন্ত কোনো হদিশ মিললো না। মনে হ’লো কস্মিনকালেও বুঝি কোনো জন-মনুষ্যের পা পড়েনি এখানে।

টার্টলেট পায়ের ডগার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, ‘কই, কোনো শহর তো দেখতে পাচ্ছি না!

তার কারণ হয়তো এই যে এদিকটায় কোনো শহরই নেই। ‘

‘কিন্তু গ্রাম? এখানে কি গ্রাম-শহর কিচ্ছু নেই।’

‘তাহ’লে এ আমরা কোথায় এসে পড়েছি?’

তা তো আমি জানিনে।

‘কী? তুমি জানো না! কিন্তু, গডফ্রে, তাহ’লে তো আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হয়। কোথায় এসে পড়েছি, সেটা না-জানলে চলবে কী ক’রে?

‘কিন্তু বলবে কে? কাকেই বা আপনি জিগেশ করবেন!’

‘তাহ’লে? তা’হলে আমাদের কী হবে?’

‘কী আর হবে? আমরা না-হয় গোটা-দুই রবিনসন ক্রুসো হ’য়ে পড়বো।’ এ-কথা শুনেই নাচের মাস্টারমশাই তিড়িং ক’রে এমন-এক লাফ দিলেন, সার্কাসের কোনো ক্লাউনই যার ধারে-কাছে যেতে পারতো না।

গোটা-দুই রবিনসন ক্রুসো? তাঁরা! তিনি একজন ক্রুসো? সেলকার্কের সেই বংশধর, হুয়ান ফেরনানদেথ দ্বীপে যাকে অনেক বছর কাটাতে হয়েছিলো। ডানিয়েল ডিফো* আর ইয়োহান দে হিবস-এর অদ্ভুতকর্মা মানুষদের কথা কতবার তাঁরা বইতে পড়েছেন! আত্মীয়স্বজন,বন্ধু বান্ধব, দেশের লোক—সবকিছু থেকে অনেক দূরে কোনো নির্জন দ্বীপে বুনো জানোয়ার, বর্বর জংলি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, হাজারো অসুবিধের সঙ্গে লড়াই ক’রে যে-মানুষেরা অস্ত্র-শস্ত্র, যন্ত্রপাতি এমনকী বসনভূষণ ছাড়াই একেকটা পরিত্যক্ত বা নির্জন দ্বীপে দিব্যি দিন কাটিয়েছিলো, তাদের মতো এখানে তাঁদেরও এখন দিন কাটাতে হবে—সহায় নেই, সম্বল নেই, কিছু নেই! না, অসম্ভব! ভয়ে টার্টলেটের হাত পা একেবারে পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে চাইলো। না, না, গডফ্রে, ও-রকম ঠাট্টা আমি পছন্দ করি না। ও-রকম দশা কল্পনা করতেও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তুমি রসিকতা করতে চাচ্ছো, তাই না?’

[* ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ আর ইয়োহান হিবস-এর ‘সুইস ফ্যামিলি রবিনসন’ উপন্যাস দুটি জুল ভের্নকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিলো। তাই সুযোগ পেলেই নিজের রচনায় এদের কথা তিনি উল্লেখ করতেন; এমনকী তাঁর একাধিক উপন্যাস ওই দুটি উপন্যাসের ছায়া নিয়ে গ’ড়ে উঠেছিলো। তার মধ্যে ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যাণ্ড,’ ‘অ্যাড্রিফ্‌ট্ ইন দি প্যাসিফিক’, ‘আলবাট্রস’ ইত্যাদির নাম বিশেষ স্মরণীয়। ‘আলবাট্রস’-এ আবার দে হিবস-এর রবিনসন পরিবারের কথাই তিনি বর্ণনা করেছেন। আর সেটাকে তিনি বলেছেন ‘দি ফাইনাল অ্যাডভেনচার্স অভ সুইস ফ্যামিলি রবিনসন’।]

‘কিছু ভাববেন না আপনি’, গডফ্রে তাঁকে অভয় দিলে, ‘কিন্তু এক্ষুনি কতগুলো কাজ করা চাই আমাদের। এমনি আড্ডা দিলে চলবে না।’

অন্তত রাতের জন্যে একটা আশ্রয় বের করতে হবে তাদের গোড়ায়—গুহা, গহ্বর বা নিদেন একটা গর্ত। তারপরে জোগাড় করতে হবে কিছু খাদ্য—জ্বলন্ত জঠরকে কিছুটা শান্তি দিতে হবে তো।

টার্টলেট তো সব দুরবস্থা আঁচ ক’রে প্রায় ভির্মিই খান বুঝি। গডফ্রে অবশ্য বেশ উৎসাহের সঙ্গেই অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

‘কোনো লোকজন তো চোখে পড়ছে না। কিন্তু জন্তুজানোয়ার আছে কি না, তাও বুঝতে পারছি না,’ বললে গডফ্রে।

শুধু কয়েক ঝাঁক পাখি দেখা যাচ্ছে বেলাভূমিতে : গাংচিল, শঙ্খচিল, বুনো হাঁস, বালিহাঁসের মতো এক ধরনের জলের পাখি : তাদের ডানা ঝাপটানি, লম্বা একটানা ডাক ইত্যাদি ছাড়া আর-কিছু নেই।

পাখি থাকলেই পাখির বাসাও থাকে, আর যেখানে পাখির বাসা থাকে সেখানে পাখির ডিমও সুলভ—গডফ্রে চট ক’রে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছে গেলো। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে বাসা বেঁধেছে পাখিরা। আরো-একটু এগুতেই দেখতে পেলে ছোটো ছোটো জলের ধারে সারস আর তিতিরও রয়েছে দাঁড়িয়ে।

পাখি তো যথেষ্টই আছে, কিন্তু বন্দুক ছাড়া তাদের শিকার করা যাবে কী ক’রে? তার চেয়ে বরং পক্ষীডিম্বের খোঁজ করাই ভালো। কিন্তু ডিম না-হয় জুটলো, তাকে রান্না করবে কী ক’রে? কেমন ক’রেই বা আগুন জ্বালবে তারা? কিন্তু এ-সব প্রশ্নের সমাধান না-ক’রেই তারা ডিমের খোঁজে পাখিদের দিকে এগিয়ে গেলো। আর এগুতেই পেলো এক বিস্ময়কর পারিতোষিক। বেলাভূমিতে শুকনো শ্যাওলার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা-বারো মুরগি আর দু-তিনটে মোরগ—মারকিন কুঁকড়ো সন্দেহ নেই, তাদের দেখেই তারা কঁকর-কো ক’রে সম্ভাষণ জানালে। তার কাছেই তৃণভূমির উপর দেখা গেলো পাঁচ-ছটা ভেড়া, কতগুলো ছাগল, তার গোটা-বারো অ্যাগুটি। তক্ষুনি গডফ্রের মাথায় তড়িৎবেগে একটা ভাবনা খেলে গেলো : এই কুঁকড়ো ও নিরীহ চারপেয়ে জীবরা নিশ্চয়ই ‘স্বপ্ন’র সম্পত্তি। জাহাজটা যখন ডুবে যাচ্ছিলো, তখন তারা নিশ্চয়ই সাঁৎরে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ভালোই হ’লো : দ্বীপে যদি অনেক দিন থাকতে হয় তাহ’লে এক কুঁকড়োনিবাস ও খোঁয়াড় তৈরি করতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে না। গল্পের বইতে তো ক্রুসোরা খুবসহজেই পশুপালন পদ্ধতিতে রপ্ত হ’য়ে গিয়েছিলো। আপাতত অবশ্য সেই সুখস্বপ্ন বর্জন ক’রে ডিম্ব সংগ্রহে লিপ্ত হওয়াই ভালো। একটুক্ষণের চেষ্টাতেই তারা অনেক বালিহাঁসের ডিম জোগাড় ক’রে ফেললে। তার পরেই টার্টলেট দুম ক’রে জিগেশ করে বসলেন, ‘এখন আগুন পাবে কোথায়? ‘

এটাই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। দুজনে পকেট উলটে দেখলে তাদের পকেটে কী আছে। অধ্যাপকের পকেট প্রায় ফাঁকাই :কেবল পকেট-বেহালার জন্যে কতগুলো তার আর রজন ছাড়া আর-কিছু নেই। গডফ্রের পকেট থেকে অবশ্য বেরুলো চামড়ায় মোড়া একটা ছুরি-ধারালো ফলা ছাড়া তাতে আর রয়েছে একটা আংটা, ছোট্ট করাতের দাঁতওলা আরেকটা ফলা ও কর্ক-স্ক্র। এটা অবশ্যি খুবই কাজে লাগবে এখানে। কিন্তু আগুন জ্বালবার মতো কিছু নেই।

তাহ’লে দুটো শুকনো কাঠ ঘ’ষে-ঘ’ষে আদিম মানুষের মতো আগুন জ্বালবার চেষ্টা করা ছাড়া আর-কিছুই তাদের করণীয় নেই। পলিনেশিয়ার আদিবাসীরা অবশ্যি কাঠ ঘ’ষেই আগুন জ্বালে। কিন্ত তারা কি পারবে?

একটা পাথরের আড়ালে গিয়ে দুজনে দুটো শুকনো হালকা ডাল তুলে ঘষতে লাগলো; কিন্তু ঘেমে নেয়ে গেলেও আগুনের একটা ছোট্ট ফুলকিও বার করা গেলো না।

টার্টলেট তো রেগেই তিনটে হ’য়ে উঠলেন। গডফ্রে যখন দেখলে যে কিছুতেই আর আগুন জ্বালানো যাবে না, কিন্তু জঠর জ্বলছে দাউ-দাউ, তখন কাঁচা ডিমই খেয়ে ফেলবে ব’লে ঠিক করলে। টার্টলেট অবিশ্যি তাকে কাঁচা ডিম খেতে দেখে গোড়ায় ঠিক ক’রে উঠতে পারলেন না তিনিও তা-ই খাবেন কিনা, কিন্তু শেষটায় জঠর-জ্বালা এমন হ’য়ে উঠলো যে তখনকার মতো কাঁচা ডিম খেয়েই তিনিও ক্ষুধাকে ধামাচাপা দিলেন।

এই আদিম মধ্যাহ্নভোজের পরে দুজনে বেরুলো আশ্রয়ের খোঁজে। গুহা, গহ্বর কিংবা গর্ত—যা খুশি হ’লেই চলবে, তারা ভেবেছিলো। কিন্তু পেলে তো? হাঁটতে-হাঁটতে একেবারে বনের কাছে এসে পড়লো দুজনে—তবু কোথাও মাথা গোঁজবার কোনো আস্তানা পাওয়া গেলো না। সারা রাস্তা টার্টলেট আর-কোনো কথাই বললেন না, গম্ভীর ও বিরস বদনে গডফ্রের সঙ্গে-সঙ্গে চললেন। কোথাও জনমানবের চুলের ডগাও দেখা যাচ্ছে না—টাকও না। চারদিকে অদ্ভুত-ভারি একটা স্তব্ধতা। কস্মিনকালেও যে এখানে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছিলো, তা মনে হয় না।

বনের যেখানে শুরু, সেখানে কয়েকটা মস্ত গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে—মূল বন থেকে একটু আলাদা। সেই গাছগুলোর কোটরেও হয়তো আশ্রয় নেয়া যাবে। গডফ্রে তন্নতন্ন ক’রে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও সে-রকম কোনো কোটর দেখা গেলো না।

ওদিকে বেলা প’ড়ে আসছে, রাত ক’রে এলো। পেটের মধ্যে আবার আগুন জ্বলে উঠেছে। আবার কতগুলো ডিম গলাধঃকরণ ক’রে ক্লান্তিতে-অবসাদে শেষকালে তারা গাছের তলাতেই সটান লম্বালম্বি শুয়ে পড়লো। শোবামাত্রই ঘুম। রাতের মধ্যে সে-ঘুম আর তাদের ভাঙলো না।

জাহাজডুবি ঘটলে পরে
লোকজনেরা যে-কাজ করে।

উত্তেজনায় আর অবসাদে দুজনেই এমনি কাহিল হ’য়ে পড়েছিলো যে শোবামাত্র দুজনেই এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়লো, যেন তারা গাছতলায় শোয়নি, আছে মানগেমেরি স্ট্রিটের আরামে।

সকালবেলায় তাদের ঘুম ভাঙলো মোরগের ডাকে। গডফ্রে অবশ্যি ঘুম ভাঙবামাত্রই বুঝতে পারলে কোথায় আছে, কিন্তু টার্টলেটকে হালফিলের অবস্থা বুঝতে বেশ ক’রে চোখ রগড়ে সজাগ হ’য়ে নিতে হলো। এবং জেগেই তাঁর প্রথম কথা হ’লো এই : ‘আমাদের ছোটোহাজরিটাও কি কালকের নৈশভোজের মতো বিতিকিচ্ছিরি হবে নাকি?’

‘তা-ই তো মনে হচ্ছে,’ উত্তর দিলে গডফ্রে। ‘তবে আশা করি সন্ধে নাগাদ অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হবে।’

অধ্যাপক টার্টলেট বিশ্রী-একটা মুখভঙ্গি করলেন। এতকাল ঘুম ভাঙবামা পেয়েছেন ধোঁয়া-ওঠা সোনালি চা আর পুরু-পুরু স্যাণ্ডুইচ। আর এখন কিনা নিজের ছোটোহাজরি নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হবে! তাও আবার ও-রকম বদখৎ কাঁচা খাদ্য!

গডফ্রে দেখলো যে দেরি করার কোনো মানে হয় না। সব দায়িত্ব এসে তারই উপর বর্তেছে : কিছুতেই তার মাস্টারমশাইয়ের উপর কোনো-কিছুর জন্য নির্ভর করা যাবে না। অধ্যাপকের মাথায় নতুন-নতুন নাচের পরিকল্পনা জাগে বটে, কিন্তু কোনো ব্যাবহারিক জিনিশ বা সাংসারিক সুবুদ্ধি তাঁর কাছ থেকে আশা করাই অন্যায়। একবার মুহূর্তের জন্য বাগ্দত্তার কথা তার মনে প’ড়ে গেলো; মনে প’ড়ে গেলো মামা কোল্ডেরুপের কথাও। কিন্তু তক্ষুনি তাদের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সে কাঁচা ডিম গলাধঃকরণের ব্যবস্থায় লেগে গেলো। বললে, ‘অন্তত কিছু না-খাওয়ার চেয়ে তো এগুলো ভালো।’

টার্টলেট গোমড়া মুখে কেবল বললেন, ‘কিছুই-না ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই যথেষ্ট নয়।’

গডফ্রে ঠিক করলে আরো-একটু ভালো ক’রে সন্ধান চালাতে হবে— কোথাও কোনো আশ্রয় মেলে কিনা। আর এই ডাঙাটা যে প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক কোনখানে, তাও জেনে নিতে হবে। এই বেলাভূমির যে-দিকটায় লোকজন থাকে, সেখানটায় গেলে হয়তো ফেরবার ব্যবস্থা করা যাবে— কোনো জাহাজও পেয়ে যেতে পারে বন্দরে, কিংবা সমুদ্রের কোনো চলন্ত জাহাজকে থামিয়েও সাহায্য চাইতে পারে।

এইজন্যে দ্বিতীয় টিলার সারির উপরে ওঠাই সমীচীন ব’লে সে সাব্যস্ত করলে। ঘণ্টা দু-একের মধ্যেই ওই টিলাগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছানো যাবে, তারপর টিলার উপর উঠে চারপাশে তাকিয়ে দেখলে পরিস্থিতিটা কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হবে। ছোটোহাজরির পরে তা-ই করবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিলে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে সে।

কুঁকড়ো-পরিবার তখন ঘাসের জমির আশপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে—আর নিরীহ চারপেয়েগুলো একবার বনের মধ্যে যাচ্ছে আর তক্ষুনি আবার বন থেকে বেরিয়ে আসছে, যেন ভারি এক মজার খেলা পেয়ে গিয়েছে।

কুঁকড়ো ও চারপেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যাবার মলব ছিলো না গডফ্রের কিন্তু তারা যাতে হারিয়ে না-যায় বা নাগালের বাইরে চ’লে না-যায়, সেইজন্যে একটা পাহারার ব্যবস্থা করা দরকার। টার্টলেটই বরং তাদের দায়িত্ব নিয়ে এখানে থাকুন, আর সে গিয়ে আশপাশ থেকে একটা সরেজমিন তদন্ত ক’রে আসুক।

টার্টলেট কয়েক ঘণ্টার জন্য একা ব’সে ব’সে পশুপক্ষীর পাহারা দিতে রাজি হলেন। একটা ছোট্ট আপত্তি অবশ্যি তুলেছিলেন গোড়ায়, ‘যদি তুমি হারিয়ে যাও, গডফ্রে?’

‘মিথ্যে অত ভয় পাবেন না,’ গডফ্রে বললে, ‘কেবল তো এই বনটুকু পেরুবো—আর আপনিও তো এখান থেকে কোথাও নড়ছেন না—কাজেই হারিয়ে যাবার কোনো ভয়ই নেই।’

‘তোমার মামাকে তার পাঠাতে ভুলো না কিন্তু—আর কয়েকশো ডলারও চেয়ে পাঠিয়ো।’

‘টিলিগ্রাম কিংবা চিঠি—দুইই সমান!’ যতক্ষণ-না সে বার করতে পারছে ঠিক কোনখানে এসে পড়েছে, ততক্ষণ আর টার্টলেটের বিভ্রম ভেঙে কী লাভ–এই সে ভাবলে।

তারপর অধ্যাপকের সঙ্গে যথারীতি হাত-ঝাঁকুনি ক’রে বিদায় নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লো। মস্ত ঘন বন-ডালপালার ফাঁক দিয়ে রোদ কখনো ঢুকতেই পায় না।

কোনো পায়ে-চলা-পথ চোখে পড়লো না। তবে মাটিতে অবিশ্যি দেখা গেলো জীবজন্তুর চলাফেরার দাগ। দু-তিনবার আশপাশে ক্ষিপ্র চলার ভঙ্গি দেখে অনুমান করলে যে হরিণ বা ওয়াপিটি গেলো বুঝি—কিন্তু কোনো হিংস্ৰ বুনো জন্তুর সাড়া পাওয়া গেলো না—নেকড়ে বা জাগুয়ার, কিছুই নেই বলেই মনে হ’লো।

জঙ্গলের দোতলায়, অর্থাৎ গাছপালার ডালে, অগুতি পাখির বাসা। বুনো পায়রা, বনমোরগ, ঘুঘু—নানারকমের পাখি দেখতে পেলে গডফ্রে। কিন্তু পাখিগুলো এমন-কোনো বিশেষ জাতের নয়, যা দেখে জায়গাটার অক্ষাংশ অনুমান করা যেতে পারে। গাছপালার বেলাতেও তাই—ক্যালিফরনিয়া, নিউ-মেক্সিকো ইত্যাদি জায়গায় যে-ধরনের গাছপালা গজায়, এই বনের গাছগুলোও সেই জাতের। মেপল, বার্চ, ওক, চার-পাঁচ রকমের ম্যাগনোলিয়া, দক্ষিণ ক্যারোলাইনায় যে-রকম সিন্ধুসরল গাছ গজায় যে-সব, জলপাই, চেস্টনাট—সব গাছই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের, এবং তার চেনা। গাছপালার তলা দিয়ে যেতে অবশ্যি তার অসুবিধে হচ্ছিলো না, কেননা মাঝে-মাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে গোল, চৌকো, তিনকোনা রোদের টুকরো এসে পড়ছিলো, আর সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।

এঁকেবেঁকে গাছপালাগুলোর তলা দিয়ে পথ ক’রে-করে এগুতে লাগলো গডফ্রে। অজানা অচেনা জঙ্গল ব’লে তার যে খুব সাবধানে চলাফেরা করা উচিত এ-কথা কিন্তু তার একবারও মাথায় এলো না। কেবল বন পেরিয়ে ওই টিলাগুলো পৌঁছুতে পারলেই সে খুশি—আর-কিছুই সে চায় না। কেননা আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বোঝা যাবে কপালে কী আছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই সে জেনে নেবে কাছে-পিঠে কোনো জনপদে পৌঁছুবার সুযোগ হবে কিনা

সতেরো দিন ধ’রে ‘স্বপ্ন’ যে-রাস্তা ধরে গেছে, তাতে চিনদেশ বা জাপানের কাছাকাছি এসে পড়ার কথা। তাছাড়া সূর্য যেহেতু সবসময়েই দক্ষিণে ছিলো, তাতেই ভালো ক’রে বোঝা যায় যে বিষুবরেখা তারা মোটেই পেরোয়নি।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এলো গডফ্রে। কোনো সোজা রাস্তা ছিলো না ব’লে মাঝে-মাঝে তাকে ঘুরে আসতে হয়েছে— না-হ’লে তাকে আরো কম দূরত্ব পেরুতে হ’তো।

গাছপালাগুলো ক্রমেই ফাঁক-ফাঁক হ’য়ে আসছে—ছোটো ছোটো একেকটা দল বেঁধে যেন গাছগুলো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখছে। মস্ত ডালপালার ফাঁক দিয়ে বেশ আলো এসে পড়ছে এখন। একটু ঢালু পেরিয়েই জমিটা গিয়ে সোজা উত্রাইয়ে পৌঁছুলো।

বেশ ক্লান্ত হ’য়ে পড়লেও গডফ্রে তার তাড়া কমালে না। উৎরাই না-হ’লে সে ছুটতো হয়তো। চার-পাঁচশো ফিট উঁচু টিলাগুলো দাঁড়িয়ে আছে কাছেই—একটা জায়গায় একটা তেকোনা চুড়ো চোখে পড়লো। ওই চুড়োতেই সে উঠবে বলে ঠিক করলো।

‘উঠে কী দেখবো? শহর? গ্রাম? মরুভূমি? পরিত্যক্ত সবুজ বন?’

অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে টিলা বেয়ে উঠতে লাগলো গডফ্রে। বুক ঢিপ-টিপ করছে। এতই রুদ্ধশ্বাস যে হাঁপ ছাড়তেও পারছে না। চুড়ো পৌঁছে যদি মূর্ছিত হ’য়ে পড়তেও হয়, তবু সে রাজি—তবু পথে সে কিছুতেই জিরিয়ে নেবে না।

আর-তো মাত্র কয়েক মিনিট, তার পরেই পৌঁছে যাবে চুড়োয়। উৎরাইটা এমনিতে বেশ দুর্গম—প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি কোণ ক’রে জমি উঠে গেছে। গাছপালা ঝোপঝাড় ধ’রে-ধরে সে নিজেকে একরকম টেনেই তুলতে লাগলো উপরে।

শেষ চেষ্টা ক’রে সে কোনোমতে উঠলো চুড়োয়। হাঁটুর জোড়া যেন খুলে আসতে চাচ্ছে, এত সে ক্লান্ত। কিন্তু কী দেখতে পারে সে সামনে? বুকে ভর দিয়ে সে তাকালে পুব দিগন্তে।

দিগন্তে সমুদ্র ছাড়া আর-কিছু নেই—দূরে গিয়ে আকাশের গায়ে গোল রেখা এঁকে জল মিশে গেছে; সেখানে সমুদ্র আর আকাশকে আর আলাদা ক’রে চেনবার জো নেই।

ফিরে তাকালে গডফ্রে। সমুদ্র! চারপাশেই সমুদ্রের ফেনিল চঞ্চল জল খেলা করছে–উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে, সবদিকেই শুধু নীলিমা আর নীলিমা—আকাশের নীল আর সাগরের নীলে মেশামেশি। ডাঙার চারপাশে মস্ত এক মহাসমুদ্র!

‘দ্বীপ! একটা দ্বীপ তাহ’লে এটা!’

কথাটা উচ্চারণ করবার সঙ্গে-সঙ্গে গডফ্রে অনুভব করলে যেন তার বুকটা মুচড়ে গেলো। তারা যে একটা দ্বীপে এসে পড়েছে এ-কথাটা একবারও তার মাথায় খেলেনি। তার মনে হলো সে যেন ঘুমের মধ্যে একটা নোঙরহীন হালভাঙা নৌকোয় করে ভেসে বেড়াচ্ছিলো—হঠাৎ জেগে উঠে আবিষ্কার করেছে যে শুধু নোঙরই নয়, তার হালভাঙা নৌকোয় কোনো দাঁড় বা পালও নেই।

কিন্তু একটু পরেই গডফ্রে নিজেকে সামলে নিলে। পরিস্থিতির মুখোমুখি নির্ভীকভাবে দাঁড়ানো ছাড়া আর উপায় কী? যদি বাইরে থেকে সাহায্য না-আসে, তাহ’লে তাকেই চোখ-কান খোলারেখে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ক’রে নিতে হবে।

দ্বীপটা কত বড়ো, গোড়ায় তা-ই সে আন্দাজ ক’রে নেবার চেষ্টা করলে। উত্তরে-দক্ষিণে কুড়ি মাইল হবে দ্বীপটা, আর পুবে-পশ্চিমে বারো মাইল মতো। দ্বীপের ঠিক মাঝখানটায় ওই বনটা, যেটা সে পেরিয়ে এলো। বাকি সমস্তটাই ঘাসের জমি, ঢ্যাঙা-ঢ্যাঙা গাছপালা বা পাথুরে বেলাভূমিতে ভরা। দু-একটা ঝরনা বা ছোটো জলের ধারা ব’য়ে গেছে দ্বীপের মধ্যে দিয়ে—এতই ছোটো যে জেলে ডিঙির চাইতে বড়ো-কোনো নৌকো ও-জল দিয়ে চলবে ব’লে মনে হয় না।

কিন্তু দ্বীপটার নাম কী? কোথায়ই বা তার অবস্থান? কোনো দ্বীপপুঞ্জের একটা, না কি প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো একলা জনহীন দ্বীপ? কিছুই বোঝা গেলো না। কিন্তু এটা ঠিক যে ছোটো কি বড়ো, উঁচু কি নিচু, আর-কোনো ডাঙাই দিগন্তে দেখা যাচ্ছে না।

গডফ্রে উঠে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকালে। আকাশ আর সমুদ্র যে-বতুলরেখা এঁকে দিগন্তে মিশে গিয়েছে, কিছুই সেখানে দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে সত্যিই যদি আর-কোনো দ্বীপ থেকে থাকে, তাহ’লে সেটা যে নেহাৎ কাছে নেই, এটা ঠিক।

‘স্বপ্ন’ তো সতেরো দিন ধ’রে একটানা দক্ষিণ-পশ্চিমেই চলেছে—আর সতেরো দিনে সে যেতে পারে ১৫০ থেকে ১৮০ মাইল –তাতে অন্তত পঞ্চাশ ডিগ্রি সে পেরিয়ে এসেছে। অথচ তবু সে যে বিষুবরেখা পেরোয়নি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বীপের অবস্থান তাহলে ১৬০ থেকে ১৭০ ডিগ্রি পশ্চিমদ্রাঘিমার মধ্যে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের এদিকটায় তো স্যাণ্ডুইচ দ্বীপপুঞ্জ বা হাওয়াই দ্বীপমালা ছাড়া আর-কিছু নেই। অবশ্য ভূগোল বইতে উল্লেখ নেই এমন অনেক ছোটো ছোটো অজ্ঞাত দ্বীপও যে থাকতে পারে, তা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মানচিত্রে চিনদেশের আশপাশে অনেকগুলো ছোটো ফুটকি দেখেছিলো ব’লো গডফ্রের মনে পড়লো, যাদের নাম সে কখনো লক্ষ ক’রে দ্যাখেনি।

‘যাক গে,’ নিজেকে সে বললে, ‘দ্বীপটার নাম যখন জানিনে, তখন এটাকে এখন থেকে ফিনা আইল্যাণ্ড ব’লেই ডাকবো। ফিনা তো আমাকে বিশ্বভ্রমণে বেরুতে দিতে চায়নি—দেখা যাক, তার নাম কপাল ফেরায় কি না—হয়তো ওর নাম করায় চট ক’রে সব দুর্গতি কেটে যাবে।’

যেদিকটায় সে এখনও যায়নি, সেদিকটায় সত্যি কেউ থাকে কি না, সেটা এবার তাকে ভালো ক’রে জেনে নিতে হবে। চুড়ো থেকে অবিশ্যি কোথাও কোনো বসতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

দ্বীপটা যদি পরিত্যক্তই হয়, তাহ’লে সমুদ্রও তাই—কারণ সমুদ্রেও কোনো জাহাজের চিহ্ন মাত্র নেই। হয়তো এখানকার সমুদ্র দিয়ে কোনো জাহাজই যায় না।

এবার তাকে ফিরে যেতে হবে টার্টলেটের কাছে; চুড়ো থেকে নামতে যাবে এমন সময় তার নজর পড়লো উত্তরদিকে তৃণভূমির কাছে কতগুলো মস্ত গাছের দিকে, গাছগুলো জড়াজড়ি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলো অতিকায়—অত ঢ্যাঙা গাছ গডফ্রে কস্মিনকালেও দ্যাখেনি।

‘হয়তো ওখানে গিয়েই আমাদের আশ্রয় নেয়া উচিত, বিশেষত, দূর থেকে যখন মনে হচ্ছে যে গাছগুলোর কাছ দিয়ে একটা ঝরনা ব’য়ে যাচ্ছে,’ ভাবলে গডফ্রে। ‘কিন্তু কাল এ-বিষয়টায় নজর দেওয়া যাবে।’

দ্বীপটার দক্ষিণদিক একটু অন্য রকম। বেলাভূমি হলুদ, কোথাও-কোথাও অদ্ভুত-কিম্ভুত একেকটা উঁচু পাথর, তারপরেই তৃণভূমি আর বন। কিন্তু তার চেয়েও সে অবাক হ’লো—চমকেই গেলো বলা যায়—যখন দেখলো যে ওই উঁচু পাথরগুলোর আড়াল থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো-কালো ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে।

‘তাহলে কি জাহাজের আরো-কেউ উদ্ধার পেয়েছে।’ ভাবলে সে। ‘কিন্তু না, তা তো সম্ভব নয়। একদিনের মধ্যেই উপসাগরের কাছ থেকে অত দূরে তারা চ’লে যাবে কী করে? জেলেদের গ্রাম আছে নাকি ওখানে—নাকি জংলিরা থাকে?’

খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে গডফ্রে। ধোঁয়াই তো? নাকি কোনো গরম বাষ্প? কী, সেটা ভালো ক’রে বোঝবার আগেই কিন্তু সেই ধূম্রকুণ্ডলী মিলিয়ে গেলো—তার আর কোনোই চিহ্ন রইলো না।

মিথ্যেই সে আশা করেছিলো। সবই হয়তো তার চোখের ভুল। আরো-একবার ভালো ক’রে সেদিকে তাকিয়ে নিয়ে গডফ্রে ঢালু বেয়ে নামতে লাগলো। একটু পরেই বনের মধ্যে ঢুকে পড়লো সে।

বন থেকে বেরিয়ে এলো ঘণ্টাখানেক বাদে। বেরিয়েই দ্যাখে দ্বিপদ ও চতুষ্পদ বাহিনী; টার্টলেট ও তাঁর জিম্মাদারির পশুপক্ষী।

এতক্ষণ কী করছিলেন টার্টলেট? সারাক্ষণ দুটো শুকনো কাঠ ঘ’ষে-ঘ’ষে আগুন জ্বালবার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রে চলছিলেন।

গডফ্রেকে দেখেই দূর থেকে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী হ’লো? টেলিগ্রাম আপিশে গিয়েছিলে?’

‘তার-আপিশ এখনও খোলেনি,’ তাঁকে বিশদ ক’রে দুর্গতির কথা খুলে বলবার সাহস পেলে না গডফ্রে।

‘আর ডাকঘর?’

‘তাও বন্ধ। কিন্তু আসুন, কিছু খেয়ে নিই। খিদেয় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে। খাওয়া-দাওয়ার পর না-হয় কথা হবে।’

এবারও সেই পক্ষীডিম্বেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হ’লো। খেতে-খেতে গডফ্রে অবিশ্যি তারিফ ক’রে দু-একবার বললে, ‘আহ্! চমৎকার!’ কিন্তু টার্টলেট সারাক্ষণ গোমড়া মুখে ডিমগুলো গলাধঃকরণ করতে করতে বিড়বিড় ক’রে নিজের ভাগ্যকে আর বড়োলোকদের খামখেয়ালকে অভিশাপ দিতে লাগলেন।