রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

ব্যাডেন পাওয়েল (১৮৫৭–১৯৪১) – বয়স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা

ব্যাডেন পাওয়েল (১৮৫৭–১৯৪১) – বয়স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা

যে বয়স্কাউট আন্দোলন আজ সারা বিশ্বে এত ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, প্রতিটি দেশে গঠিত হয়েছে যার শাখা, যার কল্যাণ-আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বের কোটি কোটি শিশু-কিশোর, এই আদর্শবান সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন-পাওয়েল।

স্কাউটিং মানে খেলা। এই খেলা, যা পড়াশোনার চেয়ে আদৌ কম শিক্ষণীয় নয়। আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাডেন পাওয়েল নিজেই বলেছেন, ‘স্কাউটিং ইজ এ গেম ‘ স্কাউটিং হলো খেলা। খেলার মধ্য দিয়েই শিক্ষাদান এবং বিশ্বের সমস্ত শিশু-কিশোরকে ভ্রাতৃত্বের একসূত্রে বাঁধবার স্বপ্ন নিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল বয় স্কাউট আন্দোলন।

বয় স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন-পাওয়েলের জন্ম ১৮৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের স্ট্যানহোপ স্ট্রিটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পূর্ণাঙ্গ নাম রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ ব্যাডেন-পাওয়েল ( Robert Stephenson Smith Baden Powell )।

তাঁর বাবার নাম ছিল রেভারেন্ড টমাস ব্যাডেন পাওয়েল। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী। মাও ছিলেন আর এক বিজ্ঞানী অ্যাডমিরাল উইলিয়াম স্মিথের কন্যা হেনরিয়েটা স্মিথ।

বাল্যকালে পড়াশোনায় অবশ্য খুব একটা ভালো ছিলেন না পাওয়েল। কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল অন্যদিকে। নদীতে মাছ ধরা, ছবি আঁকা, নৌকা চালানো, ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা। পাশাপাশি অভিনয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ।

বাল্যকালেই তিনি একবার তাঁর ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা করে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছিলেন।

শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি যোগদেন সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে। প্রথমেই তাঁর পোস্টিং হয় ভারতে ১৮৭৬ সালে। সেনাবাহিনীতে অসীম সাহসিকতা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য শিঘ্রই তাঁর পদোন্নতি হয়।

এই সময় তাঁর জীবনে আসে আরেকটি সুযোগ। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি উপনিবেশ রক্ষা করা নিয়ে তখন ব্রিটিশশক্তি খুব বেকায়দায়। দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় আদিবাসী জুলুদের কিছুতেই দমন করা যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার শাফেকিং শহর জুলুরা দখল করে নিয়েছে। এই শাফেকিং শহর পুনরুদ্ধারের জন্যই অবশেষে ডাক পড়ল ব্যাডেন-পাওয়েলের। তিনি দীর্ঘ ২১৭ দিন যুদ্ধ চালিয়ে দুর্জয় উপজাতি জুলুদের হাত থেকে উদ্ধার করেন শাফেকিং শহর।

তাঁর এই যুদ্ধজয়ের পেছনে একটি রহস্য ছিল। যুদ্ধে তিনি একটি চমৎকার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এলাকার ছোট ছেলেমেয়েদেরকে সামান্য উপঢৌকন কিংবা মিষ্টির বিনিময়ে হাত করে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর তাদের কাজে লাগিয়েছিলেন গুপ্তচর হিসেবে। এই ছেলেরাই উপজাতীয়দের সম্পর্কে গোপনে খবর নিয়ে আসত। সম্ভাব্য আক্রমণ ও অবস্থানের কথা। এসব খবরের ওপর ভিত্তি করেই তিনি আক্রমণ চালাতেন। ধ্বংস করে দিতেন জুলুদের ঘাঁটি। এমনি করেই তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।

এই যুদ্ধই পরবর্তীকালে তাঁকে স্কাউট গঠনে উদ্দীপ্ত করে। এখান থেকেই তিনি একটি বালক সেনাদল গঠনে উৎসাহ পান। স্কাউট শব্দের অর্থ চর, গুপ্তচর।

তিনি তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা পরে তাঁর রচিত ‘স্কাউট ফর বয়েজ’ (Scout for Boys) বইতেও উল্লেখ করেছেন। শাফেকিং যুদ্ধ জয় করে বিশ্বখ্যাত হয়ে পাওয়েল ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন ১৯০১ সালে। এই যুদ্ধে থাকার সময়ই তিনি সৈন্যদের জন্য ‘এইডস টু স্কাউটিং’ (Aids to Scouting) নামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি এই বইতে দেখিয়েছিলেন গুপ্ত তপ্ত চরবৃত্তি অবলম্বন করে কীভাবে কাজ হাসিল করে নিরাপদে ফিরে আসা যায়। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে এসে দেখলেন অনেক ছেলেমেয়েই তাঁর বইয়ের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করছে।

পরে লন্ডনের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলাপ করে এবং শ্বশুর স্যার উইলিয়াম স্মিথের সহযোগিতায় তিনি এমনি একটি স্কাউট দল গঠনের পরিকল্পনা করলেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম স্কাউট ক্যাম্প স্থাপন করেন ব্রাউন সি আইল্যান্ডে।

তাঁর এই স্কাউট ক্যাম্পটি প্রথমবারেই চমৎকারভাবে সফলও হয়েছিল এবং এতে উৎসাহিত হয়েই তিনি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘স্কাউটিং ফর বয়েজ’ বইটি রচনা করেন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই চারদিকে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। এর পরই তিনি ১৯০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বয় স্কাউট প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাডেন পাওয়েলের এক ছোট বোন ছিলেন। তাঁর নাম ছিল অ্যাগনেস ব্যাডেন পাওয়েল (Agnes Baden Powell)। তিনিও ছিলেন এই বয় স্কাউট সংগঠক বড় ভাইয়ের প্রধান সহযোগী। পরে তিনি শুধু সহযোগী থাকলেন না, বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় বয় স্কাউটিং-এর অনুরূপ মেয়েদের জন্যও একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর নাম দেওয়া হল গার্লস গাইড মুভমেন্ট (Girl’s Guide Movement)। গার্লস গাইড স্থাপিত হয় ১৯১০ সালে। দেশে দেশে স্থাপিত হতে থাকে এর শাখা সংগঠন। আর ব্যাডেন-পাওয়েলের জন্য এনে দিতে থাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান।

এতদিন পর্যন্ত কিন্তু ব্যাডেন পাওয়েল চাকরিতেই ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁর সংগঠনের কাজও করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শিঘ্রই তিনি তাঁর জীবনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। তিনি রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের পরামর্শক্রমে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি স্কাউট আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সাফল্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পেরেছিলেন। তাই প্রতিজ্ঞা করলেন, আর যুদ্ধ নয়, এবার বিশ্বভ্রাতৃত্বের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের দিকে দিকে।

সার্বিকভাবে এই আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেই তিনি এর নানা দিক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে লাগলেন। তিনি ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেদের নিয়ে ১৯১৬ সালে স্কাউটিং-এর আরও একটি শাখা তৈরি করলেন। এর নাম দেওয়া হল কাবিং। কাব শব্দের অর্থ হল সিংহশিশু। সিংহশিশুর মতোই বিশ্বব্যাপী মানবশিশুরাও হবে সতর্ক, সাহসী, উৎসাহী ও উচ্ছল। এমনি করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের।

কাবিং-এর অনুকরণে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের জন্যও তৈরি হলো বুলবুল সংগঠন। এই কাবিং-এর ওপরও তিনি রচনা করেছিলেন একটি মূল্যবান বই—উল্‌ফ্ কাস্‌ হ্যান্ডবুক (Wolf cubs Handbook)। এরপর তিনি এদের চেয়েও একটু বেশি বয়সের ছেলেমেয়েদের অর্থাৎ তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গঠন করলেন রোভারস স্কাউট। যুবকদের জন্য গঠিত হল রোভার এবং মেয়েদের জন্য তৈরি হলো রেঞ্জারিং।

আসলে স্কাউট, কাব, রোভার, রেঞ্জার, বুলবুল ও গাইড—এর সবগুলো একই সংগঠন, শুধু বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য বিভিন্ন নামে।

১৯২০ সালে অলিম্পিয়াতে সারা পৃথিবীর স্কাউট ও গাইডদের এক আন্তর্জাতিক সমাবেশ অনুষিষ্ঠত হয়। এই মহামিলনের নাম জাম্বুরি। এখানেই লর্ড ব্যাডেন- পাওয়েলকে দেওয়া হল চিফ স্কাউট অব দি ওয়ার্লড-এর সম্মান।

এরপর ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডের অ্যারো পার্কে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাম্বুরিতে লর্ড পাওয়েলকে দেওয়া হল লর্ড ব্যাডেন-পাওয়েল অব দি গিলওয়েল উপাধি।

অবশেষে ১৯৩৮ সালে পাওয়েল তাঁর শেষ জীবন আফ্রিকার কেনিয়াতে কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে গেলেন তাঁর সহধর্মিনী ও সারা জীবনের উৎসাই দাতা ও কর্মসঙ্গী লেডি অলিভ ব্যাডেন পাওয়েল।

এই কেনিয়াতেই ১৯৪১ সালের ৮ জানুয়ারি বিশ্বের শান্তির দূত লর্ড ব্যাডেন- পাওয়েল পরলোকগমন করেন। তিনি আজ নেই। কিন্তু যে আদর্শ সঞ্চারী আন্দোলনের তিনি সূচনা করে গেছেন, তা আজও সর্বত্র ছড়িয়ে আছে—ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশ থেকে মহাদেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *