রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩) – আফ্রিকার আবিষ্কারক

ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩) – আফ্রিকার আবিষ্কারক

এককালে আফ্রিকাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলে অপবাদ দেয়া হতো। হয়তো আফ্রিকার স্থানীয় অরণ্য-সভ্যতার সাথে তখনও আধুনিক বিশ্বের পরিচয় ঘটেনি বলেই কথাটা অমন করে বলা হতো।

তবু সেইকালে যাঁরা আধুনিক বিশ্ব থেকে আলোর মশাল হাতে নিয়ে আফ্রিকার ঘন অরণ্যের দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলেন এবং বিশ্ব-সভ্যতার আলো নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন কালো মানুষদের কাছে, বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন সেই অচেনা জগতের রহস্যময় কাহিনীকে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তি ডেভিড লিভিংস্টোন (David Livingstone)।

আফ্রিকার নাম মনে হলেই লিভিংস্টোনের কথাও মনে আসে; সভ্যজগতের আধুনিক জীবনযাত্রায় লালিতপালিত হলেও তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছিলেন এই রহস্যময় অরণ্যঘেরা দেশ আফ্রিকায়। শুধু আবিষ্কারের নেশায় তিনি আফ্রিকায় কাটিয়েছিলেন প্রায় একত্রিশটি বছর।

এই মহান পুরুষের জন্ম ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের ছোট্ট শহর ব্লান্টাইরে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তাঁর জন্ম হয়নি বলে পাড়াশোনা শেষ হবার আগেই উপার্জনের আশায় কাজ নিতে হয়েছিল। তাঁর চাকরি-জীবন শুরু হয় একটা কাপড়ের মিলে। নাম ছিল মেসার্স মনটিথ অ্যান্ড।

প্রচণ্ড খাটুনির মধ্যেও তাঁর জ্ঞানস্পৃহা কমেনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চালিয়ে যেতেন কলেজের পড়া। অবশেষে পাস করলেন ডাক্তারি। যোগ দিলেন মিশনারিদের দলে। ইচ্ছে চীনে গিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু মিশনকর্তারা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন আফ্রিকায়।

এসময় তিনি ধর্মীয় বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করেন। ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি তিনি পড়তে লাগলেন বিখ্যাত ধর্মীয় লেখক টমাস ডিকের লেখা ‘দি ফিলোসফি অব রিলিজিয়ন’ (The philosophy of Religion) এবং “দি ফিলোসফি অব এ ফিউচার স্টেট’ (The philosophy of a future state) গ্রন্থ দুটি।

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার কেপটাউন থেকে যাত্রা করে পৌঁছুলেন তাঁর আস্তানায়। কিন্তু পৌছে যে অভিজ্ঞতা হলো তা প্রায় অবর্ণনীয়। ধর্মপ্রচারের নামে সেখানে চলছিল স্বার্থপরতা, দাসব্যবসা আর লুটতরাজ। আর এই নিয়ে নিজেদের মধ্যেও ছিল দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ

এসব ব্যাপার দেখে তিনি কর্মস্থল ছেড়ে চলে এলেন নতুন কর্মস্থল বেচুয়ানাল্যান্ডের কুরুমান নামক স্থানে। সেখানে ছিল পূর্বতন অভিযাত্রী ডাক্তার মোফাটের আশ্রম। ডাক্তার মোফাট তখন ইংল্যান্ডে। অগত্যা লিভিংস্টোনের কাজ হলো স্থানীয় অধিবাসী কাফ্রিদের গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা, তাদের সাথে মেশা, তাদের ভাষা শেখা ও আচার- আচরণ জানা। লিভিংস্টোনের মনটা ছিল বড় ভালো। আর ডাক্তারিশাস্ত্রে ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তাই অল্প দিনের মধ্যে তিনি স্থানীয় লোকদের মন জয় করে ফেললেন। তাদের সাথে হয়ে গেল তাঁর গভীর সম্পর্ক। এরপর ইংরেজ সরকারের অনুমতি নিয়ে তিনি নিজেই কুরুমানের উত্তর-পূর্বদিকে মোবাটসা নামক স্থানে স্থাপন করলেন মিশনারি আশ্ৰম।

তাঁর আশ্রমটি ছিল এখান থেকে তিনশো কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে লিপোপো নদীর উৎসমুখে। এখানেই তিনি তাঁর মিশন স্থাপন করলেন এবং নিজেও সংসার পাতলেন। ১৮৪৪ সালে বিয়ে করলেন রবার্ট মোফাটের মেয়ে ম্যারিকে।

লিভিংস্টোন কোলোবেঙ নামে যে গাঁয়ে তাঁর মিশন স্থাপন করেছিলেন, সেটা ছিল বাকউইন নামে একটি উপজাতীয়দের অঞ্চল। বাকউইন উপজাতির সর্দারের নাম ছিল সেচেলে।

সর্দার সেচেলের সাথে লিভিংস্টোনের অচিরে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সেচেলে তখন সাহেবের কাছে ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করেন। কাজের অবসরে লিভিংস্টোন তাঁকে এ-বি-সি-ডি পড়াতে লাগলেন। পরে সেচেলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দেখাদেখি বাকউইন সম্প্রদায়ের বহু লোক এসে লিভিংস্টোনের কাছে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। দেখতে দেখতে লিভিংস্টোন এবং তাঁর স্ত্রী ম্যারি গোটা বাকউইন অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

এই মিশনারিতে ডাক্তারি করতে করতেই তাঁর মনে আফ্রিকার অভ্যন্তরভাগ আবিষ্কারের বাসনা জাগে। আসলে ধর্মপ্রচার এবং ডাক্তারির চেয়ে দেশটার ভৌগোলিক আবিষ্কারের দিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।

এই ইচ্ছে থেকেই তিনি ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের একদিন বেরিয়ে পড়লেন পথে। দশটি বড় ষাঁড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তিনি রওনা দিলেন অজানার পথে। এই অভিযাত্রায় তাঁর সাথিদের মধ্যে ছিলেন ইংরেজ খেলোয়াড় উইলিয়াম অসওয়েল এবং মুঙ্গো মারে। ছয় মাস পর গিয়ে পৌঁছুলেন আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে। অনেকের ধারণা ছিল, এই মরুভূমি পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু লিভিংস্টোন এই অসম্ভবকে সম্ভব করে পাড়ি দিলেন দুস্তর মরুভূমি। তাঁরা কালাহারি মরুভূমি পার হয়ে ১৮৪৯ সালের ১ আগস্ট গিয়ে পৌছুলেন নগামি হ্রদের তীরে।

এ ছিল সত্যি এক ভয়ংকর জায়গা। মরুভূমির চারদিকে ছিল হাজারো হিংস্র জীবজন্তুর বাস। সিংহ ছিল অগণিত। তাদের ডাকে আকাশ-বাতাস কাঁপে। কিন্তু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি মরুভূমি সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে গোয়েন্ডা শহরে গিয়ে পৌঁছুতে সক্ষম হলেন। এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে সময় লাগে প্রায় মাস ছয়েকের মতো। আর এই ছয় মাসে তিনি কুড়িবার আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়া জ্বরে। তাঁর দেহ হয়ে যায় অস্থিচর্মসার।

সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি এই মর্মে খবর পান যে, কোলেবেঙ গাঁয়ে অবস্থিত তাঁর মিশন আক্রান্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী বোয়ের উপজাতীয়দের দ্বারা। বোয়েররা বাকউইন উপজাতীয়দের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং সর্দার সেচেলেও গুরুতর আহত হয়েছেন।

খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরে এলেন তাঁর মিশনারিতে। এসে দেখলেন, দুঘর্টনার খবর তিনি বাইরে থেকে যা পেয়েছিলেন প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। গোটা বাকউইন অঞ্চলকে তছনছ করা হয়েছে এবং তাঁর মিশনারি ভবন পর্যন্ত বিধ্বস্ত হয়েছে। তাঁর ওষুধপত্র, লাইব্রেরির সমস্ত বইপত্র পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ম্যারি শুধু কোনোমতে পালিয়ে গিয়ে তাঁর জান বাঁচিয়েছেন।

এই ঘটনায় তিনি প্রথমে ভেঙে পড়েছিলেন। পরে ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেন। আবার তিনি বাকউইন উপজাতীয়দের একত্র করে তাদের মনে সাহস ফিরিয়ে আনলেন। গড়ে তুললেন তাদের ঘরবাড়ি এবং নিজের মিশনারি।

এভাবে কেটে গেল বছরখানেক। তারপর সব ঠিকঠাক করে তিনি আবার বেরিয়ে পড়লেন তাঁর অভিযানে। আবার তিনি ফিরে এলেন নগামি হ্রদের তীরে তাঁর ঘাঁটিতে। নতুন উদ্যমে শুরু হলো তাঁর অভিযান। এবার তিনি অগ্রসর হতে লাগলেন জাম্বেসি নদীর পূর্ব দিকে।

এখানে ম্যাকোলোলো নামে একটি শক্তিশালী উপজাতি ছিল। তাদের সর্দার বা রাজার নাম ছিল সেবিটুয়ানে। তিনি আশপাশের অনেকগুলো উপজাতীয়দের গ্রাম দখল করে এক বিশাল ও শক্তিশালী রাজ্য পেতে বসেছেন।

লিভিংস্টোন এসে সাক্ষাৎ করলেন রাজার সঙ্গে। রাজা তাঁকে মিশন স্থাপনে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। কিন্তু বাস্তবে কিছু করার আগে হঠাৎ করেই রাজা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।

পরে রাজা হলেন সেবিটুয়ানের পুত্র সেকেলেটু। নতুন রাজা সেকেলেটুর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল লিভিংস্টোনের। পিতার সকল প্রতিশ্রুতি তিনিই পূরণ করলেন। সেকেলেটুর সহযোগিতাতেই লিভিংস্টোন লিমবাই নদীর তীরে সোয়াম্‌পি নামক স্থানে একটি মিশন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

কিন্তু কাজটি শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনার কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। শেষ করতে পারলেন না। কেননা, এই জঙ্গলে ছিল সিসি মাছি নামে একজাতের হিংস্র মাছি। আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে লিভিংস্টোনকে পালাতে হলো সোয়াম্‌পি ছেড়ে। তিনি আবার চলে এলেন কেপটাউনে।

এখানে এসে তিনি তাঁর স্ত্রী ম্যারি এবং ছেলেমেয়েদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপর নিজে সেকেলেটুর সাথে মিলিত হবার জন্য তাঁর রাজধানী শহর লিনিয়ান্টের দিকে যাত্রা করলেন।

তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা—সামান্য খুদে সিসি মাছির ভয়ে তিনি ফিরে এসেছেন? যেমন করে হোক মিশন তাঁকে স্থাপন করতেই হবে। এ ব্যাপারে সেকেলেটু তাঁকে সাহায্য করবেন। লিনিয়ান্টে এসে সেকেলেটুকে বললেন, তিনি এখান থেকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত একটি পথ খুঁজে বের করবেন। সেকেলেটু নিজেও এ ব্যাপরে উৎসাহী হলেন। তা যদি হয় তবে তাঁর রাজ্যেরও পশ্চিম তীরের দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যপথ খুলে যাবে, তাঁদের ব্যবসারও উন্নতি হবে। তাই তিনি লিভিংস্টোনকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে যাবার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন।

লিনিয়ান্ট থেকে লিভিংস্টোন যাত্রা করলেন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর। তাঁরা নৌকা করে চোবে নদী ধরে চলে গেলেন নিমবাই নদী পর্যন্ত এবং সেখান থেকে লিবা নামক স্থানে।

লিবা অঞ্চলের সবগুলো উপজাতির লোকজনই আগে থেকেই সাদাচামড়ার মানুষ লিভিংস্টোনের নাম শুনেছিল, এবার তারা তাঁকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি হলো এবং সবাই তাঁকে গ্রহণও করল সাদরে।

এখানে কিছুদিন থেকে আবার নতুন করে রসদ এবং লোকজন নিয়ে শুরু হলো তাঁর যাত্রা। তিনি ব্যারেন মরুভূমি পার হয়ে অপর পারে চলে গেলেন। সেখানেও তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের মন জয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন।

তিনিই আদিবাসীদের প্রথম শেখালেন কেমন করে ঝরনা ও নদীর জলকে কাজে লাগিয়ে শুকনো জমিতে প্রচুর ফসল ফলানো যায়। তাদের শেখালেন ধর্মীয় জ্ঞান ও সভ্যতার কথা। তিনি বহু উপজাতীয় লোককে খ্রিস্টধর্মেও দীক্ষিত করলেন।

তারপর প্রায় দুবছর পর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সেকেলেটুর রাজধানীতে ফিরে এলেন। তাঁর কাছে কিছুদিন কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো তাঁর। এবারে তাঁর লক্ষ্য জাম্বেসি নদীর উৎসমুখ আবিষ্কার।

এবারও তাঁর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করলেন তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু উপজাতীয় রাজা সেকেলেটু। যাত্রা শুরু হলো ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর থেকে। এবার তাঁর সাথে মাকোলোলো উপজাতির অনেক লোক।

এই মাকোলোলোদের কাছেই তিনি শুনলেন, সামনেই গভীর জঙ্গলে এমন এক ভয়ংকর স্থান আছে, যেখানে আকাশের অনেক ওপর থেকে ভীষণগর্জন করে জল গড়িয়ে নামে আর আকাশে ছড়িয়ে যায় সাদা ধোঁয়া।

তিনি বুঝলেন এটা কোনো বড় ধরনের জলপ্রপাত হবে। তাঁর অনুমান সত্য হলো। তিনি আবিষ্কার করলেন একটি বৃহৎ জলপ্রপাত। মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে এর নাম রাখা হলো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত বা ‘ভিক্টোরিয়া ফস্’। পরে মেপে দেখা গিয়েছিল এই ভয়ংকর প্রপাতের জল নিচের দিকে নামছে ৪৩০ ফুট উঁচু।

তাঁরা ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে কুলিম্যানের লিভিংস্টোন তাঁর সঙ্গীসাথিসহ তীরে উপস্থিত হন। এখানে আসারপর তাঁর চোখে পড়ে আরও অনেক অলৌকিক দৃশ্য। এর কয়েকদিন পরে চলতে চলতে দূরে দেখতে পেলেন কতকগুলো কুঁড়েঘরের মতো কিছু। কিন্তু কাছে গিয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, সেগুলো আসলে কুঁড়েঘর নয়, উইয়ের ঢিবি। এতবড় উইয়ের ঢিবি আর কোথাও নেই। এর এক-একটির বেড় ছিল প্রায় ২০/২৫ গজ এই সময় তাঁকে অনেক হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। একদিন এক সিংহ তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। তিনি অনেক কষ্টে রেহাই পেয়েছিলেন সে-যাত্রায়।

কিন্তু বন্য জন্তুর চেয়ে স্থানীয় কাফ্রিরাই তাঁকে বেশি জ্বালাতন করত। অনেক সময় স্থানীয় লোকেরা তাঁকে ভুল বুঝত। যেমন, একবার এক কাফ্রি সর্দারকে তিনি চিকিৎসা করেন। কিন্তু তাতে ওদের ধারণা হলো—তিনি হয়তো সর্দারকে বিষ খাইয়েছেন। অমনি তারা খেপে উঠল। পারে তো এই মেরে বসে। অবশ্য পরে তাঁর চিকিৎসাতেই সর্দার ভালো হয়ে যায় এবং কাফ্রিরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর অনুগত হয়।

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর লিভিংস্টোন দেশে ফিরে যান। দেশের লোক তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান।

তিনি তাঁর আফ্রিকা অভিযানের ওপর একটি চমৎকার তথ্যমূলক বই রচনা করেন ১৮৫৭ সালে। বইটির নাম ‘মিশনারি ট্র্যাভেলস অ্যান্ড রিসার্চেস ইন সাউথ আফ্রিকা’ (Missionary Travels and Researches in South Africa) |

বইটি প্রকাশের পর তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা ইংল্যান্ডে। মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকা আবিষ্কার বিষয়ক উপদেষ্টার পদে নিয়োগ করেন। তারপর এই কাজেই আবার রাজকীয় উদ্যোগে তাঁকে পাঠানো হয় আফ্রিকায়। স্ত্রীকে নিয়েই তিনি আবার ফিরে এলেন আফ্রিকায়। আবারও শুরু হলো তার অজানার পথে দুঃসাহসিক অভিযান। এবার তাঁর সঙ্গী আঠারো জন স্থানীয় লোক। এ যাত্রায় তাঁকে আগের চেয়ে ও অনেক বেশি দুঃখকষ্টে পড়তে হয়। স্থানীয় কাফ্রিরা পর্যন্ত তা সহ্য করতে পারল না। একদিন তাঁকে জঙ্গলের মধ্যেই ফেলে রেখে, এমনকি তাঁর যথাসর্বস্ব লুট করে নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। সবাই অবশ্য অমন খারাপ ছিল না। কাফ্রিদের মধ্যে একজন কিন্তু তাঁর সঙ্গ ছাড়ল না। তার নাম সুসি। এই সুসিই লিভিংস্টোনের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গী ছিল।

এই সময় ঘটে আরেক দুর্ঘটনা। তাঁর স্ত্রী ম্যারিওর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে দলত্যাগকারী কাফ্রিরা বাইরে এসে রটিয়ে দিল লিভিংস্টোন মারা গেছেন। কিন্তু তাতেও দমলেন না তিনি। একমাত্র অনুচর ও বন্ধু সুসিকে নিয়েই চলতে লাগলেন। অনেকদিন পর্যন্ত কেউ তাঁর খোঁজই পেল না। তাই অনেকে বিশ্বাস করল, সত্যি হয়তো তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সবাই কথাটা বিশ্বাস করল না। হয়তো তিনি বেঁচে আছেন, হয়তো কাফ্রিরা তাঁকে বন্দি করে রেখেছে।

তাই তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য আন্দোলন শুরু হলো। শেষে আমেরিকার এক পত্রিকার সম্পাদক ঘোষণা দিয়ে বসলেন, যে লিভিংস্টোনের খবর এনে দিতে পারবে তাকে তাঁর সমস্ত খরচ বাদে এক হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে। স্ট্যানলি নামে একজন আমেরিকান সাংবাদিক এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে। অবশেষে তিনি সত্যি সত্যি খুঁজে বেরও করলেন তাঁকে।

আট মাস ভ্রমণের পর মধ্য আফ্রিকার উজিজি নামক এক গ্রামে গিয়ে স্ট্যানলি শুনলেন, পাশের গাঁয়ে এক শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ ভদ্রলোক থাকেন। কিছু সময় পরে স্ট্যানলি দেখলেন, একজন জরাজীর্ণ শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ ভদ্রলোক এক কাফ্রিকে সাথে নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। স্ট্যানলি জিগ্যেস করলেন, আপনিই কি ডাক্তার লিভিংস্টোন?

বৃদ্ধ হেসে উত্তর দিলেন, আমিই লিভিংস্টোন।

স্ট্যানলি তাঁকে দেশে ফিরে যাবার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু লিভিংস্টোন রাজি হলেন না। তিনি নিজের ডায়েরিখানা স্ট্যানলির হাতে দিয়ে বললেন, জীবনের শেষ কয়েকটা দিনও আমি আফ্রিকাতেই থাকতে চাই।

স্ট্যানলি এই ডায়েরিখানা সভ্যজগতের সামনে উপস্থিত করলেন। এর ফলে লিভিংস্টোনের যাবতীয় অভিযান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, জানতে পারি আফ্রিকার অনেক অজানা রহস্যের কথা।

এর অল্প কয়েকদিন পরে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১ মে চিতাম্বো নামক এক গ্রামে তিনি প্রায় নিঃসম্বল অবস্থায় মারা যান। পরে অবশ্য তাঁর দেহাবশেষ যথাযোগ্য সম্মানের সাথে ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *