রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

মার্কো পোলো (১২৫৬–১৩২৩) – দুঃসাহসিক অভিযাত্রী

মার্কো পোলো (১২৫৬–১৩২৩) – দুঃসাহসিক অভিযাত্রী

কবি নজরুলের ভাষায়- “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে” বলে যাঁরা ঘরের মায়া কাটিয়ে বিশ্বের অজানা দুর্গম পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন, আবিষ্কার করেছিলেন কত অজানা পথের সন্ধান, রহস্যময় হাজারো ইতিহাস, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ঘটিয়েছিলেন সেতুবন্ধন, তাঁদেরই অগ্রপথিক ছিলেন অভিযাত্রী মার্কো পোলো।

মার্কো পোলো ছিলেন একেবারে বংশগতসূত্রেই অভিযাত্রী। যাযাবরের সন্তান যাযাবর। পিতা ছিলেন নিকোলো পোলো আর কাকা মোফিয়া পোলো। এঁরা ছিলেন ভেনিস শহরের বাসিন্দা। নিকোলো পোলোইর সন্তান এই মার্কো পোলো। জন্ম ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ভেনিস শহরে।

মার্কো পোলো যখন মাতৃগর্ভে, তখনই বাবা আর কাকা দু’জনই চলে গিয়েছিলেন চীনদেশে বাণিজ্য-সফরে। তারপর যখন বাণিজ্যশেষে ফিরে এলেন, তখন মার্কো নবীন যুবক।

ইতালির পোলো পরিবারের জীবনের ধারা ছিল এ-রকমেরই। এই পরিবারের সদস্যরা কখনও ঘরে থাকতেন না। বেরিয়ে পড়তেন ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে। তারপর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াতেন দেশ থেকে দেশান্তরে। ঘাটে ঘাটে চলত তাঁদের কেনাবেচা।

কেউ ভেনিস থেকে পালতোলা জাহাজযোগে যাত্রা করতেন সমুদ্রপথে, কেউ-বা স্থলপথে। পুরনো কনস্টান্টিনোপল ছিল সেকালের ইউরোপ ও এশিয়ার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্ৰ।

তুরস্কের ভেতর দিয়ে কেউ কেউ চলে আসত আরও পুর্বদিকে তেহরান, খোরাশান, বোখারা, পামির, খিরঘিজ এইসব শহরে। এসব দেশের রাজা-মহারাজা ও খান- সুলতানদের কাছে মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে ঘরে ফিরতেন বহু বছর পরে।

মার্কো পোলোর বাবা আর কাকাও এমনই এক দীর্ঘ বাণিজ্য-সফরে বেরিয়েছিলেন সেবার। তারপর যেতে যেতে পৌঁছেছিলেন তাতার সাম্রাজ্যের সম্রাট কুবলাই খাঁর দরবারে। তখন এ অঞ্চলে কুবলাই খাঁই ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট।

কুবলাই খাঁ এই ইউরোপীয় সওদাগরদের খুবই খাতিরযত্ন করলেন। এমনকি তাঁদের রাজ-প্রতিনিধি করে আবার নিজেই পাঠালেন ইউরোপের ধর্মগুরু পোপের কাছে। পোপের কাছে সম্রাট দুজন ধর্মপ্রচারক চেয়ে পাঠালেন তাঁর দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার জন্য। আর বললেন, তাঁরা আবার যখন তাঁর দরবারে ফিরে আসবেন, তখন যেন জেরুজালেমে খ্রিস্টের কবরের প্রদীপের পবিত্র তেল নিয়ে আসেন।

নিকোলো পোলো আর মোফিয়া পোলো আবার যখন সত্যি সত্যি দুবছর পর ধর্মপ্রচারক আর খ্রিস্টের কবরের তেল নিয়ে কুবলাই খানের দরবারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, তখন তাদের সহঅভিযাত্রী হলেন মার্কো পোলো।

এ-এভাবেই হলো মার্কো পোলোর অভিযাত্রী জীবনের সূচনা। মার্কো পোলো তাঁর যৌবনের প্রারম্ভের এই যাত্রা শুরু করেছিলেন ১২৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে।

তাঁরা যথারীতি পোপের কাছ থেকে ভিসেনজ ও গুয়েনমা নামে দুজন ধর্ম প্রচারক এবং যিশুর কবরের তেল নিয়ে করলেন যাত্ৰা।

কিন্তু সেই যাত্রাপথ তো সহজ ছিল না। হাজারো বিপদ আর রহস্য। পথে পড়েছে কখনও ধু-ধু তেপান্তরের মাঠ, কখনও খাড়াই পর্বতের সংকীর্ণ পথ। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম, গ্রাম ছাড়িয়ে দুর্গম পথ। উট, গাধা, কুকুর নিয়ে মাসের পর মাস তাঁরা চলেছেন এইসব পথ ধরে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। নদী-নালা ও জলাশয় বা মরুদ্যানের সংখ্যা ছিল এক্কেবারেই কম।

পথে পড়ে আর্মেনিয়া নামে এক বিশাল দেশ। আকাশছোঁয়া পাহাড়-পর্বতে ঘেরা চারিদিক। প্রবাদ আছে, সেখানকার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের ওপর হযরত নূহ নবীর (আঃ) নৌকা বা নোয়ার আর্ক অবস্থিত। পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরগুলো সবসময়ই ঢাকা থাকে বরফে।

আর্মেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে কুর্দিস্তান আর উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া পথ ধরে চলতে চলতে মার্কোরা সম্মুখীন হলেন এক অদ্ভুত ঘটনার।

কোথা থেকে উড়ে এল এক রাক্ষুসে পক্ষিরাজ। সে মার্কোদের তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের মাল টানার গাধা আর ঘোড়াগুলোকে ঠোকড় মেরে তুলে নিয়ে গেল শূন্যে। সবাই ভেবেছিলেন—এটাই হয়তো সিন্দাবাদের রক পাখি। কিন্তু মার্কোর বাবা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, না এটা কাল্পনিক রূপকথার রক পাখি নয়। এটা হলো বাস্তবের বড় জাতের রক্তপায়ী উইগি নামের শকুন। এরা যেমন হিংস্র তেমনি বিশাল। বড় বড় জন্তু শিকার করতে পারে।

এই জর্জিয়ার পাহাড়েই তাঁরা সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন আরেক আশ্চর্য বস্তুর। জ্বলন্ত জল, যে জল জ্বলে ওঠে। এই আশ্চর্য জল দেখে সেদিন তারা যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন। সেদিন তাঁরা চিনতে পারেননি। এখন অবশ্য আমরা সবাই জানি ওটা কী ছিল। ওটা ছিল পেট্রল–আজ যা সারা বিশ্বের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বস্তু এবং তরল সোনা নামে পরিচিত। এই পেট্রলকেই তারা সেদিন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন— আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে।

জর্জিয়ার কাছাকাছি আর্মেনিয়ার নিচে পারস্যের গায়ে ও কাস্পিয়ান সাগরের এধারে ওধারে অনেক জায়গাতেই এমন পেট্রলের স্বভাবিক ফোয়ারা পাওয়া যেত। কিন্তু সেখানকার লোক এর ব্যবহার জানত না, চিনতও না।

কুবলাই খানের দেশে পৌঁছানোর আগেই মার্কোরা পড়েছিলেন আরও হাজারো বিপদে। তাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন দিনদুপুরে অন্ধকার সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী জাদুকর দস্যুদলের কবলে।

তাঁরা সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন নদীতে জেসপার নামের একধরনের মূল্যবান পাথরেরও। কিন্তু সে বড় মায়াবি পাথর! সেই মায়াবি মণিমুক্তা খচিত পাথর সংগ্রহ করতে আসত রাশিয়া, চীন, কিরগিজ এবং মাঞ্চুরিয়া থেকে বহু লোক। কিন্তু এই মুক্তো যে নিতে এসেছে সে আর ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। মরুভূমির বুকে সবাই প্রাণ হারাত। আজও নাকি মরুভূমির ধু-ধু করা বুকে ভেসে বেড়ায় সেইসব মানুষের অশরীরী আত্মা। আজও তারা ডাকে পথহারা পথিককে।

এমনি করে বহু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মার্কোরা অবশেষে চলে এলেন কুবলাই খানের দেশে। তারপর তাঁর রাজদরবারে।

কুবলাই খান এবারও তাঁদের খুব সমাদরে গ্রহণ করলেন। বেশি মুগ্ধ হলেন দারুণ বুদ্ধিদ্বীপ্ত তরুণ সওদাগর মার্কো পোলোকে দেখে। মার্কোকে তিনি তাঁর একান্ত সহকারী নিয়োগ করলেন। মার্কো ক্রমশ তাঁর অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি দিয়ে সম্রাট কুবলাই খানকে সহযোগিতা করতে লাগলেন। তিনি সাহসিকতা ও বুদ্ধির জোরে দেখতে দেখতে একদিন দখল করে নিলেন কুবলাই খানের মন্ত্রীরপদ।

সে সময় তাতার দেশে নানরকম ভুয়া তন্ত্রমন্ত্রের প্রতাপ ছিল—ছিল অনেক জাদুকরের দাপট। এরা ভূতপ্রেতের খেলা দেখিয়ে, জাদুমন্ত্রের ছলাকলা দেখিয়ে নিজেদের ফায়দা লোটার চেষ্টা করত। দেশের সব লোক, স্বয়ং কুবলাই খাঁ পর্যন্ত এদের ভয় করে চলতেন। এদের ঘাঁটাতে সাহস করতেন না। এরা নাকি দেবতার দূত—অসীম ওদের ক্ষমতা।

কিন্তু মার্কো পোলো এসব জারিজুরি সব ধরে ফেললেন। একদিন তিনি সম্রাটকে হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখালেন যে, এসবই ফাঁকি কারবার।

ফলে ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ালো মার্কোর জন্য। স্বার্থান্বেষী এই লোকগুলো মার্কো পোলোর ওপরে খেপে উঠল। এমনিতেই রাজার সভাসদরা মার্কো পোলোকে খুব সুনজরে দেখত না। একজন বিদেশি সাদা চামড়ার লোক এসে তাদের সবাইকে ডিঙিয়ে সম্রাটের প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে, সবার ওপর দিয়ে ক্ষমতা দেখাবে, এটা তারা সহ্য করতে পারত না। তারা চেষ্টা করছিল মার্কো পোলোর ক্ষতি করার। এরপর যখন মার্কো তাদের তন্ত্রমন্ত্রের ব্যবসা নষ্ট করতে চাইল, তখন তারা রীতিমতো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

অবশ্য বুদ্ধি আর কৌশলে তারা পেরে উঠল না মার্কো পোলোর সঙ্গে। কিন্তু এসব হলে কী হবে এবার মার্কো নিজেই তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর আর মন চাইল না এদেশে থাকতে।

তা ছাড়া দিনও তো আর কম হলো না। এরই মধ্যে দেখতে দেখতে কেমন করে পার হয়ে গিয়েছিল দীর্ঘ উনিশটি বছর। এই দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দেশছাড়া। এবার তাই দেশে ফেরার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

সম্রাট কুবলাই খাঁ মার্কোকে ছাড়তে না চাইলেও, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে ছাড়তে বাধ্য হলেন। অবশেষে ১২৮৯ সালে এক ঘটনার সূত্রে মার্কোদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হলো।

এ-বছরই সম্রাটের ভাইপো এবং পারস্যের সম্রাট আরগন খাঁর পত্নীবিয়োগের ঘটনা ঘটে। তাই তাঁর বিয়ের জন্য আবারও রাজকন্যা চাই। সম্রাট তাঁরই বংশের বোগাতিন নামের এক সুন্দরী কন্যাকে ঠিক করেছেন। আরগন খাঁর জন্য তাঁকে নিয়ে পৌঁছে দিতে হবে পারস্যে—এই দায়িত্ব পড়ল মার্কো পোলোর ওপর।

অবশেষে মার্কো পোলোর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আয়োজন করা হলো। তৈরি করা হলো জাহাজ। সমুদ্রপথে যেতে হবে। সম্রাট তাঁর সঙ্গে লোকলস্কর দিলেন। দিলেন সবরকমের জিনিসপত্র। তারপর একদিন মার্কো পোলো রাজকন্যাকে নিয়ে শুরু করলেন তাঁর ফিরতি অভিযান।

দীর্ঘ তিন মাসে ১৫০০ মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা পৌঁছুলেন যবদ্বীপে। তারপর দক্ষিণ-পশ্চিমে জাভা সাগরের ভেতর দিয়ে সুমাত্রায় এবং মালাক্কা প্রণালীর ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগর, সেখান থেকে আন্দামান, সিংহল, মালাবার উপকূল ধরে ভারত মহাসাগর পার হয়ে পৌঁছুলেন পারস্য উপসাগরে শেষে দীর্ঘ কয়েক বছরের সমুদ্রযাত্রা। হরমোজার সমুদ্র বন্দরে তাঁরা পৌঁছুলেন ১২৯৩ সালে।

কিন্তু যাঁর জন্য এসেছিলেন, দেখলেন সেই আরগন খাঁরই মৃত্যু হয়েছে। অবশেষে আরগন খাঁর পুত্র কুমার গাজান খাঁ নিজেই বিয়ে করলেন বোগাতিনকে। মার্কো পোলোরও দায়িত্ব হলো শেষ।

পারস্যে থাকতে থাকতেই মার্কো পোলো পেলেন সম্রাট কুবলাই খাঁর মৃত্যুসংবাদ। মনে দারুণ দুঃখ পেলেন। তারপর তাঁরা ফিরে এলেন নিজের শহর ভেনিসে।

দেশে ফিরে আসার কয়েক মাস পরেই আর এক দুর্ঘটনা ঘটে মার্কো পোলোর জীবনে। তিনি একটি যুদ্ধে গিয়ে বন্দি হন শত্রুর হাতে—নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে।

অবসর মুহূর্তে তিনি তাঁর এই বহু বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের রোমাঞ্চকর কাহিনী নিয়ে একটি বই লেখেন। বিস্ময়কর সেই ভ্রমণ কাহিনী। তাঁর এই বই যখন প্রকাশিত হয়, তখন তাতে বর্ণনা করা আজগুবি সব ঘটনার কথা কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি; কিন্তু পরবর্তীকালে সবই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এই মহান অভিযাত্রীর মৃত্যু হয় ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে। আজও তিনি তাঁর এই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনিই বিশ্বের দুঃসাহসিক অভিযাত্রী, যিনি প্রায় অর্ধেকপৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন পায়ে হেঁটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *