নেলসন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela) আজ আর কেবল একটি নাম নয়। আজ তিনি আফ্রিকা, তথা গোটা বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত কোটি কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।
তাঁরই নেতৃত্বে আজ দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েকশো বছরের শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান ঘটেছে এবং তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার মহানায়ক। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ নয়, শ্বেতাঙ্গদেরও রয়েছে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সকেই শহরে। পিতা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ থিম্বু উপজাতীয় গোত্রের সর্দার হেনরি গাডিলা ম্যান্ডেলা। তাঁর যখন মাত্র বারো বছর বয়স, তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়।
তবে সচ্ছল ছিল তাঁদের পারিবারিক অবস্থা। বাল্যকালটা সুখেই কেটেছে। বাকি জীবনটাও সুখেই কেটে যাবার কথা ছিল। এসব গোত্রপতিদের সন্তানদের জীবন যেরকম আনন্দের ভেতর দিয়ে কাটে, তেমনই বাল্যকাল সেভাবেই কেটেছে।
ম্যান্ডেলার প্রথম জীবনও কেটে যাচ্ছিল ভোগবিলাসে। কিন্তু অচিরেই তাঁর জীবন মোড় নিল ভিন্ন খাতে। স্বাধীন প্রকৃতি তাঁকে নিয়ে গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সংকটময় পথে। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি নিয়মমতো ভর্তি হয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত স্কুল ফোর্ট হেয়ার কলেজে। কিন্তু পড়াশোনা বেশিদূর এগোতে পারেনি। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৪০ সালে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন।
কলেজের পড়াশোনা হল না বলে পরিবার থেকে চাপ এল বিয়ে করার জন্য। কিন্তু ম্যান্ডেলা এত শিগিরই দাম্পত্যজীবনে জড়িয়ে পড়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই বিয়ের ব্যাপারে পারিবারিক চাপ এড়ানোর জন্য তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এলেন জোহান্সবার্গে। সেখানে এসে তিনি পুলিশের চাকরি নিলেন।
চাকরি করার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি করসপন্ডেন্স কোর্সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন।
ডিগ্রি পাস করার পর পুলিশের চাকরি ছেড়ে জোহান্সবার্গের একটি আইন প্রতিষ্ঠানে নতুন করে চাকরি নিলেন।
রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তখনও ছিল। তবে জোহান্সবার্গে এসে তিনি রাজনীতির সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস (African National Congress), সংকেক্ষপে এ এন সি। দেশপ্রেম, সংগ্রামী চেতনা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য তিনি অচিরেই হয়ে উঠলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা
এ সময়ই তিনি ইভেলিন নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে বিয়ে করেন।
তিনি রাজনীতিতে জড়াবার পর এত অল্পদিনের ব্যবধানে যে এতটা সাফল্য অর্জন করবেন, কেউ সেটা ভাবতে পারেননি। অবশ্য এই সাফল্যের পেছনে কারণও ছিল। তিনি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন একরোখা, দৃঢ়চেতা চরিত্রের মানুষ। অভিনব ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনা। তাই অনেকে ভেবেছিল, তিনি হলেন ধনাঢ্য গোত্রপতির এক বখাটে ছেলে দুদিন পরেই তাঁর এই খেয়ালিপনা বদলে যাবে। তিনি বুঝতে পারবেন তাঁর ভুল। ফিরে যাবেন তাঁর নিজের জগতে।
কিন্তু ম্যান্ডেলা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই এক ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি অটল রইলেন তাঁর নিজের লক্ষ্য ও আদর্শে। তাঁর আদর্শ ছিল দেশে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন তথা কৃষ্ণাঙ্গদের পরিপূর্ণ মুক্তি।
১৯৫০ সালে তিনি আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের যুব শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা এবং নিষ্ঠা যেমন তাঁকে একদিকে দেশবাসীর কাছে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলতে থাকে, তেমনি বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারেরও সতর্ক দৃষ্টি পড়ে তাঁর প্রতি।
প্রথমে বর্ণবাদী সরকার ম্যান্ডেলাকে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাঁর সংগ্রামী পথ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ম্যান্ডেলাকে তাঁর আন্দোলন ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র সরাতে না পেরে সরকার তাঁর ওপর শুরু করে জোর-জুলুম আর নির্যাতন।
এই জুলুমের প্রতিবাদে ম্যান্ডেলাও ১৯৫২ সালের জুন মাস থেকে আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলেন। ফলে তিনি গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর নয় মাসের কারাদণ্ড হয়।
শুধু তা-ই নয়, এবছরেরই ডিসেম্বর মাসে জারি করা আরেক আদেশে শ্বেতাঙ্গ সরকার তাঁর নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় এবং তাঁর জোহান্সবার্গের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বর্ণবাদী সরকার ক্রমাগত একের পর এক বৈষম্যমূলক আইন জারি করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়েই যেতে থাকে। নির্যাতন ক্রমে চরম আকার ধারণ করে।
১৯৫৮ সালে ম্যান্ডেলা দ্বিতীয়বার আবার বিয়ে করেন। তাঁর এই দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিলেন উইনি ম্যাডিকিজিলা। পরে ম্যান্ডেলাকে বিয়ে করে ইনিই পরিচিত হন উইনি ম্যান্ডেলা নামে। উইনি শুধু ম্যান্ডেলার স্ত্রীই ছিলেন না, ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ও সংগ্রামী জীবনেরও সার্বক্ষণিক সহকারিণী।
১৯৬০ সালে সংঘটিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল নামক স্থানে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। শ্বেতাঙ্গ সরকারের পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ৭০ জন কৃষ্ণাঙ্গ এবং আহত হয় ১৭৬ জন। পুলিশ এক শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
এতদিন দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। চলছিল অহিংস সংগ্রামের ধারা অনুসরণ করে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সরকার যখন হিংস্রতার পথ বেছে নিল, তখন বাধ্য হয়েই আফ্রিকানরাও তার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিল।
ম্যান্ডেলা এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন। আন্দোলন ক্রমে সশস্ত্ররূপ নিতে শুরু করল। ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে আগে থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ঝুলছিল। ১৯৬১ সালের ২ মার্চ তিনি একটি ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেলেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন শান্ত হলো না। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু আন্দোলন চালিয়ে শ্বেতাঙ্গদের মোকাবেলা করা যাবে না। নামতে হবে সশস্ত্র সংগ্রামে। ১৯৬১ সালের ৩০ মে ম্যান্ডেলা ঘোষণা করলেন, “অহিংসনীতির অধ্যায়টি আমরা শেষ করেছি বলে আমি মনে করি।”
কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রাম করতে গেলে চাই সামরিক প্রশিক্ষণ, চাই অস্ত্রশিক্ষা। তাই তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চলে গেলেন বিদেশে। তবে বিদেশে যাবার আগেই তিনি নিজের হাতেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্বোধন করে দিয়ে গেলেন। সেই থেকেই শুরু হলো দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের সশস্ত্র সংগ্রাম।
এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ১৯৬২ সালে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের সামরিক শাখার প্রধান হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।
এর পরই ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গরা শুরু করল সহিংস পালটা প্রতিরোধ। শুরু হলো শ্বেতাঙ্গ সরকারের অফিস ও কলকারখানা ইত্যাদির ওপর হামলা। গঠন করা হলো উমুখোস্তো উয়ে সিজউলে (জুলু ভাষায় যার অর্থ জাতির বর্শা) নামে একটি গোপন সংগঠন। এই সংগঠনই চালাতে লাগল সশস্ত্র হামলা।
দীর্ঘ দুবছর আত্মগোপন করে রইলেন ম্যান্ডেলা। রইলেন ছদ্মবেশে। ছদ্মবেশেই তিনি সাহায্য ও সমর্থন আদায়ের জন্য সফর করতে লাগলেন পৃথিবীর বহু দেশ। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তাঁর আহ্বানে কোনো সাড়া দিল না।
১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট নাটাল নামক স্থানে সাতজন সহকর্মীসহ ম্যান্ডেলা ধরা পড়েন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই. এ-র সহায়তায় শ্বেতাঙ্গ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল, তাঁরা জনগণকে ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করতে উসকানি দিচ্ছেন এবং বৈধ পাসপোর্ট ছাড়াই দেশত্যাগে প্ররোচিত করছেন।
আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে পাঠাল আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটি কারাগারে। দুবছর পর রাষ্ট্র উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার আরেকটি সাজানো অভিযোগে ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোরেন দ্বীপের কারাগারে।
ম্যান্ডেলা জেলে গেলেও কৃষ্ণাঙ্গদের সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ হলো না। তিনি কারাগারের ভেতর থেকেই গোপনে যোগাযোগ করে সশস্ত্র লড়াই পরিচালনা করে যেতে লাগলেন। তাঁর বিবৃতি এবং পত্রাদি বোরেন দ্বীপ থেকে গোপনে পাচার করা হতে লাগল বাইরে।
১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পি. ডব্লিউ. বোথা একটা চালাকির আশ্রয় নিলেন। লোভ দেখিয়ে আন্দোলনে ভাঙন ধরানোর মতলব আঁটলেন। বোথা ম্যান্ডেলাকে মুক্তিদানের প্রস্তাব দিয়ে বললেন, সরকার ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে রাজি আছে। তবে সেটা এই শর্তে যে, তাঁকে (ম্যান্ডেলাকে) সশস্ত্র আন্দোলন পরিত্যাগ করতে হবে এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে।
বোথার ধারণা ছিল, কৃষ্ণাঙ্গ ম্যান্ডেলা মুক্তির লোভে তাঁর প্রস্তাব সানন্দে মেনে নেবেন। আর ম্যান্ডেলাকে যদি আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তবে অন্য কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের কাবু করা সহজ হবে।
কিন্তু ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গ সরকারের এই টোপ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন, বরং তিনি আরও তীব্র বেগে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর সংগ্রামী সাথিদের আহ্বান জানালেন। দিতে লাগলেন সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশনা।
১৯৮৭ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। সেই বছরের মে মাসে ‘সি সোয়েটান’ সংবাদপত্রের পাঠকরা তাদের প্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করল।
এর পরের বছর ১৯৮৮ সালের ১১ জুন উইমব্লেতে অনুষ্ঠিত হয় ‘নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই’ শীর্ষক এক সেমিনার।
অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ সরকারও ম্যান্ডেলার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য জঘন্য সব। কূটকৌশল অবলম্বন করতে লাগল। যেমন ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্টমপি মইকেটজি নামে ১৪ বছর বয়সের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করা হয় ম্যান্ডেলার স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে।
কিন্তু তাতেও ম্যান্ডেলাকে দুর্বল করা গেল না। বিফল হলো কূটকৌশল। অগত্যা ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসতে লাগলেন শ্বেতাঙ্গ সরকার প্রধান বোথা নিজেই।
তিনি এবার ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন যে, দমননীতি চালিয়ে আর কালোচামড়ার লোকগুলোকে দমন করা যাবে না। ওদের শরীরটাই শুধু লোহার বর্ণ নয়, মনটাও লোহার মতো শক্ত—বিশেষ করে ওদের নেতা ম্যান্ডেলা সত্যি যেন এক লৌহমানব।
শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও দলমত নির্বিশেষে সবাই যে কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী ছিলেন, তা নয়। তাদের মধ্যেও অনেক বিবেকবান ও রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ছিলেন, তাঁদের অনেকেরই সহানুভূতি ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি। তাঁরা জানতেন, এখানে অন্যায়কারী শ্বেতাঙ্গরা, কৃষ্ণাঙ্গরা নয়। শ্বেতাঙ্গরাই দখলদার। কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের দেশের স্বাধীনতা চায় মাত্র। এটা তাদের মৌলিক দাবি। এই দাবি খর্ব করার কী অধিকার আছে শ্বেতাঙ্গদের?
এ-রকমই নরমপন্থি রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এফ. ডব্লিউ. ডি. ক্লার্ক। তিনিই উদ্যোগী হয়ে প্রেসিডেন্ট বোথার সঙ্গে বৈঠক করে এই মর্মে প্রস্তাব দিলেন যে, কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে না গিয়ে তাদের আলোচনা বৈঠকে ডাকা হোক। তাদের দাবির প্রতি সহানুভূতি দেখানো হোক।
এই আলোচনা সফল হলো। তার পর থেকেই শ্বেতাঙ্গদের মনের বরফ গলতে শুরু করল। তারা বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে লাগল।
এই আলোচনার কিছুকাল পরেই উগ্রপন্থি বোথা রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন উদারপন্থি ডি. ক্লার্ক। এবার কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়ার পরিবেশ তৈরি হলো। ডি. কার্ক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই দক্ষিণ আফ্রিকাকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতাদানের কথা ঘোষণা করলেন।
কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের স্মারক হিসেবে ক্লার্ক সরকার মুক্তি দিলেন ম্যান্ডেলার অন্যতম প্রধান সহকর্মী এবং তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মামা ওয়াল্টার সিসুলুকে। সিসুলু ২৫ বছর কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে।
এর কিছু দিন পরই অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে কেপটাউনে রাষ্ট্রপতি ডি. ক্লার্ক আলোচনায় মিলিত হন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ম্যান্ডেলার সঙ্গে। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার আশু স্বাধীনতাদানের প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে দু নেতার মধ্যে আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হয়।
এই আলোচনার মাস দুয়েকের মধ্যেই ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ২৭ বছর কারা-ভোগের পর মুক্তিলাভ করেন ম্যান্ডেলা। এটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের একটি স্মরণীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত সাফল্যসূচক ঘটনার পরিচায়ক। এই ঘটনার ভেতর দিয়েই শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৫৭ বছরের শ্বেতাঙ্গ শাসনের পতনের সূচনা।
কারামুক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকার লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসতে থাকে। মুক্তির পর ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের এক সমাবেশে তিনি ভাষণ দেন।
১৯৯০ সালের ২ মার্চ তিনি আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের (ANC) ডেপুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ম্যান্ডেলাকে মুক্তিদান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাদানের প্রশ্নে ডি. ক্লার্ক সরকার কর্তৃক আশ্বাসদানের প্রেক্ষিতে এএনসি তাদের দীর্ঘ ২৯ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম স্থগিত ঘোষণা করেন।
১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলার সভাপতিত্বে ৩৯ বছরের মধ্যে এএনসি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রথম বৈধ সম্মেলন করে।
এএনসির সভাপতি ছিলেন প্রবীণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা অলিভার ট্যাম্বো। এবার ট্যাম্বো তাঁর আসন ছেড়ে দিলেন প্রিয় নেতা ম্যান্ডেলাকে। ম্যান্ডেলা এএনসির সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালের ৭ জুলাই।
১৯৯২ সালের ১৩ এপ্রিল ম্যান্ডেলার জীবনে ঘটে একটি দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী ও ব্যক্তিজীবনের একান্ত সহচরী তাঁর দ্বিতীয় পত্নী উইনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। উইনি ১৯৮৯ সালের কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এই ঘটনার পর থেকেই ম্যান্ডেলার সঙ্গে তাঁর ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়।
প্রিটোরিয়ার বিরুদ্ধে অবশিষ্ট অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবিতে ম্যান্ডেলার আহ্বানে ১৯৯২ সালের ৪ আগস্ট সারা দেশে পালিত হয় দুদিন ব্যাপী ধর্মঘট এবং প্রিটোরিয়ার লাখো মানুষের মিছিলে নেতৃত্ব দেন নেলসন।
১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ডি. ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ম্যান্ডেলা।
১৯৯৪ সালের ২ জানুয়ারি নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্যোগে দক্ষিণ আফ্রিকার ২৬টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আলোচনা করে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা ঘোষণা করে। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয় ২৭ এপ্রিল (১৯৯৪)।
এই নির্বাচনে (২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল) দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় অবর্ণবাদী গণতান্ত্রিক নির্বাচন। নির্বাচনে ম্যান্ডেলার দল এএনসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৯ মে তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম অবর্ণবাদী পার্লামেন্টের বৈঠক বসে এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা।
তিনি শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নন, আজও সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।