রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

জন এফ কেনেডি (১৯১৭–১৯৬৩) – গুপ্তঘাতকের হাতে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল

জন এফ কেনেডি (১৯১৭–১৯৬৩) – গুপ্তঘাতকের হাতে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল

তিনি ছিলেন জীবনযুদ্ধের এক সফল ও সার্থক সৈনিক, বিস্ময়কর প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ, সর্বোপরি বিশ্বমানবতাবোধের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড. কেনেডি (John Fitzgerald Kennedy) জীবনকে দেশ ও মানুষের সেবায় উৎসর্গ করে আজও গোটা মানবজাতির ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালে, আমেরিকার সম্ভ্রান্ত কেনেডি পরিবারে। পিতা প্যাট্রিক কেনেডিও ছিলেন সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তিনি নিজের চেষ্টায় উপার্জন করেছিলেন অঢেল অর্থ। হয়েছিলেন অপরিমেয় ধনসম্পত্তির মালিক। পরে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। মা রোজ কেনেডিও ছিলেন এক অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত মার্জিতা মেয়ে। ১৯২৬ সালে এই বনেদি পরিবারটি বোস্টন ছেড়ে চলে আসেন নিউ ইয়র্কে।

কেনেডিরা ছিলেন নয় ভাইবোন। জো, জন (জন এফ. কেনেডি), রোজ মেরি, ক্যাথলিন, ইউনিসা, প্যাট, জিল, ববি এবং সবার ছোট টেডি।

এতোগুলো সন্তানকে বাবা শাসন করতেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব তিনি সার্থকভাবে সঞ্চারিত করেছিলেন তাঁর নয়টি ছেলেমেয়ের মধ্যেই। তিনি চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েরাও চিন্তাশীল ও কর্মী হোক।

বাবা তাঁর সন্তানদেরকে বলতেন, তোমরা জীবনে কী করবে, তা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। কিন্তু যা কিছুই কর না কেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো লোকের মতো তা করবে। যদি নর্দমাও খোঁড়, তবে সবচেয়ে ভালো নর্দমা খননকারী হবে। বাবা প্রতিদিন তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে পারিবারিক লাইব্রেরিতে বসতেন এবং দেশ- বিদেশের চলতি ঘটনাবলি সম্পর্কে আলোচনা করতেন।

মিসেস রোজ কেনেডি ব্যাখ্যা করে বলতেন, আমরা তাদের এমনভাবে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছি, যেন কোনো সুযোগই তারা নষ্ট না করে। বাবা প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে বলেছিলেন, তারা যদি একুশ বছর বয়স পর্যন্ত ধূমপান কিংবা মদ না খায়, তবে যেদিন একুশ বছরে পড়বে, সেদিন প্রত্যেককে দুহাজার ডলার করে পুরস্কার দেওয়া হবে।

প্রথমে ১৯৩০ সালে ১৩ বছর বয়সে কেনেডি মিলফোর্ড ক্যান্টারবেরি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। পরে ১৯৩৫ সালে জন কোয়েট থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। তার পরই বাবা তাঁকে লন্ডনে পাঠান ‘স্কুল অব ইকনমিস্’-এ জগদ্বিখ্যাত অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির কাছে পড়াশোনা করার জন্য। এখানেই তিনি নানারকম নতুন মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হন। পরিচয় ঘটে তাঁর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বহু পণ্ডিত, বিপ্লবী, অর্থনীতিবিদ এবং লেখকের সঙ্গে। ১৯৩৬ সালে জন আবার ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি বোস্টনে।

১৯৩৭ সালে কেনেডি পরিবার চলে যান লন্ডনে। এ সময় যুবক কেনেডি রাজনীতির ওপর একটি চমৎকার বইও লেখেন। শিরোনাম ছিল ‘ইংল্যান্ড কেন ঘুমিয়ে ছিল’। এই বই লিখে তিনি সবাইকে হতবাক করে দেন।

জাপান পার্ল হার্বারে আক্রমণ করলে ডেনেডি সৈন্যদলে ভর্তি হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। তাঁর বড় ভাই জো সহজেই বিমানবাহিনীতে সুযোগ পেয়ে গেলেন। কিন্তু ডেনেডি তাঁর শারীরিক ওজনের স্বল্পতার জন্য পারলেন না। তিনি শরীর ঠিক করার জন্য শুরু করলেন ব্যায়াম। অবশেষে তাঁর আশা পূর্ণ হল। তিনি নৌবহিনীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন।

১৯৪৩ সালে তাঁকে জাহাজে করে পাঠানো হলো দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে। দক্ষিণ রেলডোভা দ্বীপে একটি পি. টি. বোটের অধিনায়ক করা হয় তাঁকে। সেই সময় তিনি প্রচণ্ড যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধ করতে গিয়েই একবার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। একটি জাপানি জাহাজের গোলার আঘাতে তাঁর জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তার পরও তিনি অসীম মনোবল আর সাহসে ভর করে সাগরে ভেসে থেকে দিনের পর দিন অনাহারে কাটান। অবশেষে উপজাতীয়দের সহায়তায় উদ্ধার পান। এই দুঃসাহসিকতার জন্য মার্কিন সরকার তাঁকে পরে অনেক বড় সম্মানে ভূষিত করে ছিল।

যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি নিউ ইয়র্কে এসে প্রথমে আন্তর্জাতিক সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে সংবাদদাতার কাজ নেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন বসল না। এরপর তিনি বাবার পরামর্শে কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভের জন্য ভোটযুদ্ধে নামেন এবং নিজের দৃঢ় মনোবলের জোরে জীবনের প্রথম রাজনৈতিক যুদ্ধে তিনি জিতে যান।

শোনা যায়, কংগ্রেস সদস্য হয়ে যখন তিনি ওয়াশিংটনে আসেন তখন তাঁর অমন বাচ্চা-বাচ্চা চেহারা দেখে অনেকেই তাঁকে আইনসভার ‘বালকভৃত্য’ বলে ভুল করেছিলেন।

কেনেডি ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫০ সালে কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৫২ সালে তিনি প্রবীণ রাজনীতিবিদ হেনরি ক্যাবট লজকে পরজিত করে সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ সালে তিনি বিশ্বসুন্দরী জ্যাকুলিনকে বিয়ে করেন। এই সময় থেকেই তিনি ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। অসুখ বাড়তে বাড়তে তাঁর অবস্থা শেষে এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে, ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যু আসন্ন ভেবে পরিবারের সমস্ত সদস্যকে তাঁর বিছানার পাশে ডেকে এনেছিলেন। একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের পর তিনি অবশেষে ধীরে ধীরে আবার সেরে উঠতে থাকেন। সেই সময়ই তিনি আমেরিকার রাজনৈতিক ঘটনার ওপর ‘সাহসিকতার রেখাচিত্র’ নামে একটি বই লেখেন। বইটি দারুণ জনপ্ৰিয়তা লাভ করে। তিনি এই বইটির জন্য একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে পুলিৎ জার পুরস্কার লাভ করেন।

অবশেষে ১৯৬০ সালের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রবীণ রাজনীতিবিদ রিচার্ড নিক্সনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জন এফ. কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তাঁর এই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন ছিল সত্যি এক বিস্ময়কর ঘটনা। একে তো তাঁর অল্পবয়স, তদুপুরি তিনি ছিলেন একজন ক্যাথলিক। চোদ্দ বছর আগে যুক্তরাস্ট্রের জনৈক ধর্মযাজক উক্তি করেছিলেন, যত যোগ্যই হোন না কেন, বর্তমানে কোনো ক্যাথলিক আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না।

কিন্তু কেনেডির নির্বাচনী প্রচারণা ছিল ভিন্নরকমের। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম ও অন্য সবকিছুর ওপরে আমি আমার দেশ ও দেশের স্বার্থকেই বড় করে দেখি। তাঁর বক্তৃতা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন প্রাণখোলা কথা তারা বহুদিন ধরে শোনেনি। ধর্মযাজকের উক্তির অসারতা প্রমাণ করে জন কেনেডি নির্বাচনে জিতেই রাতারাতি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এতখানি ক্ষমতা ইতিহাসে কোনোদিন এত অল্পবয়স্ক তরুণের হাতে অর্পিত হয়নি। কিন্তু তিনি এই ক্ষমতার কখনোই অপব্যবহার করেননি।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল কিউবা সংকটের নিরসন করা। কিউবার কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী কাস্ত্রোর সহযোগিতায় রাশিয়া সেখানে শক্তিশালী ঘাঁট স্থাপন করে। তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে এই সমস্যার মোকাবেলা করেন।

তাঁর অপর কৃতিত্ব ছিল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা নিগ্রোদের যুগ যুগ ধরে সমাজের সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে। এই বর্ণবৈষম্য নীতি যে-কোনো সভ্য জাতির পক্ষে কলঙ্কস্বরূপ। তিনি এই বৈষম্যমূলক প্রথার বিলোপ সাধন করে আইন পাস করেন। এতে করে তাঁকে সারা দেশের মানুষ স্বাগত জানালেও কিছুসংখ্যক চরমপন্থি শ্বেতাঙ্গ খেপে যায়। শেষ পর্যন্ত এই চরমপন্থিদের হাতেই তিনি ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাসের ডালাস শহরের রাজপথ দিয়ে যাবার সময় গুলিতে নিহত হন। এমনিভাবে এক মহান নেতার কর্মময় জীবনের অবসান হয়।

একদা দেশের কুখ্যাত দাসপ্রথার উচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন মহাপ্রাণ আব্রাহাম লিংকন, তেমনি জন এফ. কেনেডিকেও নিজের জীবন দিতে হয় কৃষ্ণাঙ্গদের সমানঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *