রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

আইসেনহাওয়ার (১৮৯০-১৯৬৯) – দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক

আইসেনহাওয়ার (১৮৯০-১৯৬৯) – দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক

তিনি যে একদা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সেটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। তাঁর সে পরিচয় ঢাকা পড়ে গেছে। তিনি ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছেন অন্য কারণে। অন্য ঐতিহাসিক কারণে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের কৃষিখামার থেকে উঠে আসা এক ছেলে, যিনি বাল্যকালে নিজেদের খামারবাড়িতে হাঁড়ি-বাসন ধুয়ে সাফ করতেন, মোষের দুধ দোহন করতেন, তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সমগ্র সেক্টরে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইসেনহাওয়ার। প্রকৃত নাম ডোয়াইট ডেভিড আইসেনহাওয়ার (Dweight David Eisenhower)। বাল্যকালে বন্ধুরা তাঁকে ডাকত ‘আইক’ বলে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাঁকে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল যে, ইতিহাসে তাঁর নজিরই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর কমান্ডের অধীনে এত বৃহৎ সামরিক বাহিনী ছিল যা নেপোলিয়ন, জুলিয়াস সিজার ও শার্লিমান-এর সম্মিলিত বাহিনীর চাইতেও বহু গুণে বড় ছিল। তিনি এমন এক বিশাল নৌবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, যা নেলসন, হকিন্স, ড্রেক, জুয়ান, পার্ল, জোন্স, অ্যাডমিরাল ও ডিউকের সম্মিলিত নৌবহরের চেয়েও ছিল বিশাল।

এই মহাশক্তিধর সামরিক জেনারেলের জন্ম ১৮৯০ সালে যুক্তরাস্ট্রের টেকসাসে। আইসেনহাওয়ারের পিতামহ ছিলেন একজন পাদরি—ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদারহুড নামের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কর্মকর্তা। তাঁর বাবা-মাও ছিলেন এই সংঘেরই সদস্য- সদস্যা। তাঁরাও গোঁড়াপন্থি ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তাই আইসেনহাওয়ার যখন ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হতে চাইলেন, তখন বাবা-মা বাধা দিলেন। কারণ, তাঁরা ছিলেন ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদারহুডের সদস্য। এই ধর্মসম্প্রদায়টি সব ধরনের যুদ্ধ এবং খুনখারাবির ঘোর বিরোধী ছিল। আর তাঁদের ছেলে হয়ে কিনা সে মানুষ-মারার বিদ্যা শিখতে যাবে? তাই তাঁরা ছেলেকে সোজা নিষেধ করে বসলেন।

কিন্তু আইসেনহাওয়ার ছিলেন তাঁর সংকল্পে অটল। তিনি বাবা-মায়ের নিষেধ ও শত উপদেশ সত্ত্বেও মত পরিবর্তন করলেন না। ভর্তি হলেন সামরিক অ্যাকাডেমিতেই মজার ব্যাপার হলো, তাঁর আসলে ভর্তি হবার ইচ্ছে ছিল অ্যানাপোলিস নেভাল অ্যাকাডেমিতে। কারণ, সুইডি হ্যাজলেট নামের তাঁর এক বন্ধু এই কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল শেষোক্ত সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারলে দুবন্ধু একত্রে থাকতে পারবেন। কিন্তু একটি হিসেবের ভুলের জন্য তাঁর এ কলেজে পড়া হল না।

তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর দ্বাদশতম জন্মদিবস পালন করেও সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু জন্মদিনের পরে দেখা গেল তাঁর ভর্তি হওয়ার বয়স পার হয়ে গেছে। সুতরাং তিনি আর সেখানে ভর্তি হতে পারলেন না।

তিনি কেন পিতামাতার আদেশ অমান্য করেও সামরিক অ্যকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন, তারও একটি ইতিহাস আছে। ঘটনাটা তাঁর স্কুলে পড়ার সময়েই ঘটেছিল। তিনি টেকসাস রাজ্যের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলেন একবার এক বন্ধুর সঙ্গে। সেখানেই তিনি সম্পাদকের টেবিলের ওপর পেয়েছিলেন একটি বই। সেটা ছিল বিখ্যাত সমরবিদ হ্যানিবলের সংগ্রামবহুল একটা জীবনী। এই বীরপুরুষ হাতির পিঠে চড়ে আস্‌ পর্বতমালা অতিক্রম করেছিলেন এবং পনেরো বছর পর্যন্ত ইতালিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। বালক আইসেনহাওয়ার বইয়ের পাতা উল্টিয়েই হ্যানিবলের রোমাঞ্চকর সংগ্রামবহুল জীবনকাহিনীটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেললেন এক নিশ্বাসে।

শুধু তা-ই নয়, তিনি এর পর কয়েক মাস পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাস পড়তে থাকেন। লি গ্রান্ড, ওয়াশিংটন, জ্যাকসন প্রমুখ ব্যক্তির জীবনকাহিনী তাঁর মনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। ইতিহাসপাঠের প্রতি তাঁর এত ঝোঁক ছিল যে, স্কুলের বার্ষিক রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, এই ছেলে ভবিষ্যতে ইতিহাসের অধ্যাপক হতে পারবে।

কিন্তু সেই বালক পরবর্তীকালে ইতিহাসের অধ্যাপক হননি, বরং তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস, যে ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি এমনভাবে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছিলেন যে, হ্যানিবল এবং তাঁর হস্তীযূথ অপেক্ষাও তা বিশ্বের মানবজীবনে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

আইসেনহাওয়ারের বাল্যকালে আরেকটি বড় গুণ ছিল। তিনি ছিলেন একজন চৌকস ফুটবল খেলোয়াড়। ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পড়ার সময় একজন স্বনামধন্য ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর নাম কলেজে পেতলের পাত্রে লেখা হয়েছিল। তবে তাঁর পা ভেঙে যাওয়ার পর তিনি আর খেলতে পারেননি।

কিন্তু ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলেও তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমরক্ষেত্রে বিশ্বত্রাস হিটলারকে পরাজিত করে তাঁর গৌরবময় সামরিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।

মিলিটারি অ্যাকাডেমির পড়া শেষে তিনি যথারীতি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। চাকরিতে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় টেক্সাসের সান অ্যান্টোনিও ক্যান্টনমেন্টে। তখন তিনি সুদর্শন চেহারার একজন সামরিক অফিসার। এই ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করার সময়েই একদিন এক অনুষ্ঠানে কলোরাডোর বাসিন্দা ম্যামি নামে এক শিক্ষিতা ও সুন্দরী মহিলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তারপর ঘনিষ্ঠতা। কয়েক মাসের মধ্যেই ম্যামির সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় আইসেনহাওয়ারের। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নিষ্ঠা আর সাহসিকতার জন্য দ্রুত তাঁর পদোন্নতি ঘটতে থাকে। তারপর তাঁর জীবনে আসে তাঁর সামরিক জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় যুগ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আক্রমণকারী সৈনিকদের সুপ্রিম কমান্ডার মনোনয়নের প্রশ্ন উঠলে আইসেনহাওয়ারের নামই সর্বপ্রথম প্রস্তাবিত হয়। রুজভেল্ট ও চার্চিলই নন, স্ট্যালিনও এই প্রস্তাবকে সমর্থন দেন এবং অতঃপর আইসেনহাওয়ারকেই মিত্রবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি বলে ঘোষণা করা হয়।

অথচ কলেজজীবনে তিনি তেমন কোনো মেধার পরিচয় দিতে পারেননি। ১৬৫ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি মেধা তালিকার ৬১তম স্থানে ছিলেন। ওয়েস্ট পয়েন্টে মেধার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখাতে না পারলেও আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর কৃতিত্ব সকল মেধাবী ছাত্রের কৃতিত্বকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল আর সেটা ছিল তাঁর দূরদর্শিতা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগেই তিনি বাধতে যাওয়া যুদ্ধের ধরনধারণ সম্পর্কে ধারণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, এই যুদ্ধে বিমান এবং ট্যাংকবহরই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পদস্থ একজন অফিসারের বিরোধিতার জন্য তা হয়নি। শেষে তিনি ট্যাংকবাহিনীতে যোগদান করেন।

তিনিই সর্বপ্রথম মার্কিন সৈন্যবাহিনীতে ট্যাংক ডিভিশন পুনর্গঠন করেন। ২৮ বছর বয়সে তিনি ট্যাংক ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর তিনি তাঁর ট্যাংকবহর নিয়ে ইউরোপ রওনা হতে যাবেন, এমন সময় প্ৰথম মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সেনাবাহিনীতে তিনি যে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তার মূলে ছিল তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা, সুষ্ঠ প্রশিক্ষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি, কর্মতৎপরতা এবং নেতৃত্বদানের ব্যাপারে যথার্থ যোগ্যতা।

প্রত্যেকটি লোক তাঁকে শ্রদ্ধা করত। যাকে সাধারণ কথায় আমরা ‘ব্যক্তিত্ব’ বলে থাকি, তিনি এ জিনিসটির পরিপূর্ণ অধিকারী ছিলেন।

তাঁর সামরিক বিজয়ের মূলমন্ত্রটি ছিল খুব সাদামাঠা। তিনি বলতেন, ছোট্ট বিষয়গুলোরও বিস্তারিত পর্যালোচনা করে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে, তারপর জীবনপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউরোপ আক্রমণের সময় নৌবাহিনী যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল, তার মধ্যে ছিল আটশত পৃষ্ঠার বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং সেই আক্রমণ সম্বন্ধে নৌবাহিনীর তৈরি ম্যাপগুলোর ওজন ছিল তিনশত পাউন্ড।

আইসেনহাওয়ারের স্ত্রী তাঁর স্বামী সম্পর্কে বলতেন, “আইকের ঠোঁটে সর্বক্ষণ হাসি লেগেই আছে। প্রায় সব ব্যাপারেই তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সহধর্মিণী হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, অথচ আজও আমি তাঁর প্রতি সেই প্রথম দিনকার মতো আকর্ষণ অনুভব করি।”

তাঁর সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেছেন, “আইক, তোমার মধ্যে সবচেয়ে ভাল গুণ হচ্ছে এই যে, তুমি নামের কাঙাল নও।” বাস্তবিক, আইসেনহাওয়ার খ্যাতির লোভী ছিলেন না। জ্ঞানত তিনি সামনে আসার চেষ্টাই করতেন না। আব্রাহাম লিংকনের মতো তিনিও যশ-খ্যাতির তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর সামরিক তকমাগুলোও তিনি পরতেন না।

তিনি মদ পান করতেন না। তিনি বলতেন, তাঁর ভিতরে এত গোপন কথা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রক্ষিত আছে যে, মদ্যপানজনিত মাতালমির প্রভাবে মুখের বাঁধন আলগা হয়ে তা বেরিয়ে পড়া বিচিত্র কিছু নয়।

আইসেনহাওয়ারের ছেলে তাঁর বাবা সম্পর্কে বলেছেন, “বাবা একজন জবর পড়ুয়া। শান্তির সময়ে এক-এক রাতে তিনি কয়েকটি বই পড়ে শেষ করেন। কিন্তু তিনি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন, তখন তাঁর কাছে মাত্র একটি বই থাকত, আর সেটি ছিল বাইবেল।” আইসেনহাওয়ার প্রতিদিন ষোল থেকে আঠারো ঘণ্টা কাজ করতেন। পাঁচ ঘণ্টা ঘুমই তাঁর জন্য ছিল যথেষ্ট।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘রিপোর্ট বাই দি সুপ্রিম কমান্ডার টু দি কম্বাইন্ড চিফ অব (Report by the Supreme Commander to the Combined Chief of Staff)। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সম্পর্কে এটি একটি প্রামাণ্য দলিল বিশেষ।

যুদ্ধের পর বিজয়ের পুরস্কারস্বরূপ রাজা ষষ্ঠ জর্জ তাঁকে ‘অর্ডার অব মেরিট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

তবে তিনি অবসর গ্রহণ করার পর একবার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নিউইয়র্কে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যক্ষ হবেন। কিন্তু সেটা হওয়া তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। তাঁকে বরং আবার নতুন করে সামরিক দায়িত্বই নিতে হলো। ১৯৫০ সালে তাঁকে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে ‘ন্যাটো’-র দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর তিনি রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরনায়ক আইসেনহাওয়ারের মৃত্যু হয় ১৯৬৯ সালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *