রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

ডি ভ্যালেরা (১৮৮২-১৯৭৫) – আয়ারল্যান্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট

ডি ভ্যালেরা (১৮৮২-১৯৭৫) – আয়ারল্যান্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেবাদের কবল থেকে পরাধীন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যে গোটা দেশবাসীর প্রাণপ্রিয় সংগ্রামী নেতা এবং স্বাধীনতার পর বলিষ্ঠ হাতে যিনি দিয়েছিলেন দেশগড়ার নেতৃত্ব তাঁর নাম ইয়ামন ডি ভ্যালেরা (Eaman De Valera)।

তিনি ছিলেন এক বিশাল ব্যক্তিত্ববান পুরুষ, দেশপ্রেম ছিল তাঁর অন্তরের ভূষণ। মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ছিল তাঁর অবিশ্বাস্য। ইয়ামন ডি ভ্যালেরার নিজের জন্মভূমি আয়ারল্যান্ড ছিল না। তাঁর জন্ম হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে ১৮৮২ সালের ১৪ অক্টোবর। বাবা ছিলেন স্পেনের অধিবাসী একজন চিত্রশিল্পী।

ডি ভ্যালেরার জন্মের কয়েক বছর পরেই তাঁর বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তাঁদের পারিবারিক অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে পড়ে। এরপর তাঁকে মায়ের সাথে ফিরে আসতে হয় মামার বাড়িতে।

ভ্যালেরার মামারা থাকতেন আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক নামক একটি ছোট্ট শহরে। তাঁদের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। এমন একটি পরিবারেই অবাঞ্ছিত বালকের মতো অনাদর আর অবহেলার ভেতর দিয়ে বড় হতে থাকেন ডি ভ্যালেরা।

স্থানীয় ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভ্যালেরার। তারপর স্কুলজীবন শেষে তিনি ভর্তি হন ডাবলিনের ব্ল্যাকরক কলেজে। স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে।

অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। এই সময়েই তিনি দেশের কাজে জড়িয়ে পড়েন এবং যোগ দেন স্বাধীনতাকামী একটি বিপ্লবীদের দলে। ১৯১৩ সালে তিনি আইরিশ স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এই দলই ইংল্যান্ডের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল।

স্বেচ্ছাসেবক দলের শুধু সদস্যপদ নয়, অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও দেশপ্রেমের জন্য তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে এই দলের স্থানীয় নেতার আসন লাভ করেন। তিনি কেমন দুঃসাহসিক বিপ্লবী ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই সময়কারই একটি ঘটনা থেকে।

১৯১৬ সালে তরুণ বিপ্লবী ডি ভ্যালেরার নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক একটি ব্রিটিশ ভবন জোর করে দখল করে নেন। কী দুঃসাহসিক অভিযান! ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকজন মুক্তিপাগল যুবকের এ ছিল এক মস্তবড় হঠকারিতাসুলভ কাজ।

পরিণাম যা হবার তা-ই হলো। ব্রিটিশ সৈন্যরা এসে ভবনটি ঘেরাও করে ফেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই দখলদারদের কাবু করে ফেলল। তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করল। ডি ভ্যালেরারও একই ভাগ্য বরণ করার কথা ছিল। কিন্তু হলো না, বেঁচে গেলেন। তাঁর জন্ম যেহেতু আমেরিকায়, তাই তিনি জন্মগতসূত্রে আইরিশ নন। এই ভেবে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাঁকে দেয়া হয় এক বছরের জেল।

তিনি ১৯২৭ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ইংল্যান্ডে নজরবন্দি করে রাখা হয় ১৯১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। আয়ারল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি বিপ্লবীদের সংগঠন সিন ফেইন পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই দলটি ওই একই বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত আয়ারল্যান্ডের সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করে এবং এক-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে।

কিন্তু তার পরেও রেহাই পেলেন না ডি ভ্যালেরা। পুলিশের লোকজন তাঁর পেছনে লেগে থাকত। ফলে তিনি ওই একই বছরই আবারও গ্রেফতার হলেন। তাঁকে রাখা হলো লিংকন জেলে। কিন্তু এই জেল থেকে তিনি পালিয়ে যান এক চমৎকার কৌশলে।

সে ঘটনা যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনই দুঃসাহসিক। তিনি একটি সামান্য লোহার টুকরো নিয়ে জেলের সেলে বসে সবার অলক্ষ্যে ঘষে ঘষে টুকরোটিকে একটি চাবিতে রূপান্তরিত করেন। তারপর নিজের তৈরি সেই নকল চাবি দিয়েই রাতের অন্ধকারে জেলের তালা খুলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন।

তিনি জেল থেকে পালিয়ে ছদ্মবেশে সোজা চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। পালিয়ে সে দেশে যাওয়ার পেছনে তাঁর একটি উদ্দেশ্যও ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্ৰাম চালাতে গেলে প্রচুর টাকার দরকার। তাই তহবিল গঠনের জন্যই তিনি আমেরিকা গিয়ে অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করেন।

তিনি আমেরিকা থেকে আবার আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসেন ১৯২১ সালে। এই সময় ব্রিটেন আয়ারল্যন্ডের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। নীতিগতভাবে সাময়িক স্বায়ত্তশাসন মেনে নেওয়া হয়।

আর ঠিক এ-রকম সময়ই ডি ভ্যালেরা দেশে ফিরে আসেন। এই স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে ব্রিটেনের সাথে আলোচনা করার জন্য ডি ভ্যালেরার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল লন্ডন গমন করে।

ব্রিটেন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা মেনে নেয় একটি শর্তে। আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে, তবে নীতিগতভাবে ব্রিটেনের রাজশক্তিকে মেনে নিতে হবে এবং এই স্বাধীনতা লাভ করবে শুধু দেশের একাংশ, দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড।

যা হোক, তবু আয়ারল্যান্ড মেনে নিল এই শর্ত। আপাতত যতটুকু পাওয়া যায়, ততটাই লাভ। দেশটির সংসদে এই চুক্তি সামান্য ভোটে অনুমোদন লাভ করে। যদিও ডি ভ্যালেরা এমন একটি স্বাধীনতা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু সবার চাপে তাঁকে সকলের সাথে একমত হতে হয়েছিল। এই আংশিক চুক্তি নিয়ে দেশে একটি গোলযোগেরও সূত্রপাত হয়।

আয়ারল্যান্ডে সরকার গঠিত হয়েছিল উইলিয়াম টমাস কসগ্রেভের নেতৃত্বে। ডি ভ্যালেরা রিপাবলিকানদের মতের সমর্থন করেন। এরপর গোলযোগের অভিযোগে তিনি ১৯২৪ সালে গ্রেফতার হন।

অবশ্য কয়েকদিন পরেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। বাইরে এসে তিনি রিপাবলিকান অপজিশন পার্টি গঠন করেন। এই পার্টির নাম ছিল ফিয়ান্না ফেইন পার্টি। তিনি তাঁর সমর্থকদের ব্রিটেনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে না চলতে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর দল সংসদে কয়েকটি আসনও লাভ করে। তাঁরা সংসদে এই চুক্তি বাতিল করার দাবি জানান।

এই অধীনতামূলক চুক্তির শর্ত মোতাবেক ব্রিটেনকে একটি বার্ষিক খাজনা দিতে হতো। ডি ভ্যালেরা এই বার্ষিক খাজনা বন্ধ করার এবং ব্রিটেনের গভর্নর জেনারেল প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানান।

১৯৩২ সালে আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন এবং এই নির্বাচনে ডি ভ্যালেরার ফিয়ান্না ফেইন পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তিনি সরকার গঠন করেই ব্রিটেনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং ব্রিটেন যে এতদিন বার্ষিক খাজনা পেয়ে আসছিল, তা বন্ধ করে দেন। তিনি ব্রিটেনের সাথে অধীনতামূলক চুক্তিগুলো বাতিল করে দেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা চালাতে থাকেন এবং দেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ম্ভর করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

তিনি ১৯৩৩ সালে আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার পর থেকে তিনি আজীবন ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৩৩ সাল থেকে একটানা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

এর মধ্যে অবশ্য তাঁকে মাঝে একবার কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। তাঁর দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় থাকাটা কেউ কেউ সহ্য করতে পারছিল না, তাই ১৯৪৮ সালে একবার তাঁর একনায়কত্বের বিরুদ্ধে দেশের কয়েকটি ছোটখাটো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে গোলযোগ বাধাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে গোলযোগ সৃষ্টিতে তারা খুব সুবিধা করতে পারেনি। তিনি কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করেন।

দীর্ঘদিন পর তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৯৭৩ সালে ক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় সড়ে দাঁড়ান। এই অসুস্থ অবস্থায় তিনি আরও দুবছর বেঁচেছিলেন। তিনি মারা যান ১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট। তিনি দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে আয়ারল্যান্ডকে শাসন করেছিলেন লৌহকঠিন দৃঢ়তার সঙ্গে। তিনি আয়ারল্যান্ডকে একটি পরাধীন উপনিবেশ থেকে মুক্ত করে পরিণত করে গেছেন উন্নত সমৃদ্ধিশালী একটি স্বাধীন দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *