রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

মহাত্মা গান্ধি (১৮৬৯–১৯৪৮) – ‘সবকো সুমতি দে ভগবান’

মহাত্মা গান্ধি (১৮৬৯–১৯৪৮) – ‘সবকো সুমতি দে ভগবান’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ একদা সত্য ও অহিংসার সাধনা, মানবপ্রেম ও সমাজসেবার জন্য যাঁকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, আজও বিশ্বে তিনি সেই নামেই পরিচিত। তাঁর সত্যিকার নাম আজ হারিয়ে গেছে এই বিশাল উপাধির উজ্জ্বলতায়। আজও সমগ্র ভারত, তথা সারা বিশ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন বলে তিনি সম্মানিত।

অথচ তিনি থাকতেন অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে। পরনে থাকত সাধারণ ধুতি এবং তার আঁচলটি থাকত গায়ে জড়ানো। এ-ই তাঁর পোশাক। শরীর ছিল শীর্ণ। ইংরেজরা তাই তাঁকে চলন্ত কঙ্কাল (Walking Skeleton) বলে অভিহিত করতেন।

মহাত্মা গান্ধির সত্যিকার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। পিতা ছিলেন কাবা গান্ধি। তিনি ছিলেন রাজকোটের দেওয়ান। মা ছিলেন পুণ্যবতী রমণী—পুতলি বাঈ।

মহাত্মা গান্ধির জন্ম ১৮৬৯ সালে ২ অক্টোবর গুজরাট প্রদেশের পোরবন্দরের এক গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক বণিক পরিবারে।

পোরবন্দরেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গান্ধির। পরে রাজকোটে এক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে কিছুদিন ভবনগরে শ্যমলদাস কলেজেও পড়াশোনা করেছিলেন।

১৯ বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য যান বিলেতে। ১৮৯১ সালে বিলেতে থেকে ফিরে এসে বোম্বাই হাইকোর্টে শুরু করেন আইনব্যাবসা।

তিনি প্রথম বিলেতে গিয়ে খুব বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি তো মাছমাংস খেতেন না, কিন্তু বিলেতে কোথায় কোন্ হোটেলে নিরামিষ রান্না হয়, তাও জানতেন না। আসলে বিলেতে কেবল নিরামিষ রান্না করে, এমন হোটেল বলে তখনও কিছু ছিলনা। তাই নিরামিষ খাবার না পেয়ে প্রথম দিকে তারা প্রায় অনাহারে মারা যাবার দশা হয়েছিল।

পরে অবশ্য অনেক ঠেলাধাক্কা খেয়ে তিনি কিছুটা পাশ্চাত্য পোশাক পরতে এবং খাবার খেতে আরম্ভ করেছিলেন। চেষ্টা করছিলেন নিজেকে আধুনিক করে নিতে।

এর জন্য লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় তিনি কিছুদিন সংগীতচর্চা এবং নাচেরও তালিম নিয়েছিলেন। অবশ্য শিল্পী হওয়া তাঁর ভাগ্যে হয়নি। কিন্তু তাতে লাভ হয়েছিল একটি ব্যাপারে। তাঁর বাল্যকালের লাজুক ভাবটা কেটে গিয়েছিল, অর্জন করেছিলেন মানুষের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস।

লন্ডনে থাকার সময় তিনি সেখানে নিরামিষভোজীদের নিয়ে একটি সমিতিও গঠন করেছিলেন। তিনি ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে লন্ডনে ছিলেন তিন বছর। এই সময়ই তিনি ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ দাদাভাই নওরোজি ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এখান থেকেই তিনি জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হন।

এর দু’বছর পর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে তিনি একটি জটিল মামলার দায়িত্বভার নিয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সে-সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেক ভারতীয় বাস করত। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের হাতে সবসময় তারা নির্যাতনের শিকার হতো। ভারতীয়দের প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণে গান্ধির মন খুব ভারাক্রান্ত হয়। তাঁর মনে প্রবল হয়ে ওঠে আত্মসম্মানবোধ সেই সাথে দেশাত্মবোধও। পরাধীনতার কী মর্মজ্বালা, তিনি তখন থেকেই অন্তরে অনুভব করতে শুরু করেন।

দেশবাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি সেখানেই শুরু করে দেন আন্দোলন। এ আন্দোলনে কোনো হিংসা নেই, শত্রুতার কোনো স্থান নেই, শত দুঃখকষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করে অত্যাচারীর মন থেকে হিংসা দূর করার লক্ষ্যে এ ছিল এক আদর্শবাদী আন্দোলন।

তিনি আফ্রিকার ভারতীয় এবং স্থানীয় কৃষাঙ্গ আদিবাসীদের নিয়ে গঠন করেন একটি সমিতি। তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৪ সালের মে মাসে নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস। এই সমিতির মাধ্যমেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত ভারতীয় এবং কৃষাঙ্গদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাতে নির্যাতিত জুলুরা বিদ্রোহ করে। এই সময় গান্ধি জুলুদের পক্ষে কাজ করেন।

মহাত্মা গান্ধি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় কুড়ি বছর ছিলেন। তিনি সেখানে ভারতীয়দের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য করেছেন অবিরাম সংগ্রাম। অসংখ্যবার ভোগ করেছেন নির্যাতন, অত্যাচার। বহুবার তাঁর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁর আদর্শে অবিচল।

এই আফ্রিকাই ছিল তাঁর পরবর্তীকালের মহৎ ও বৃহৎ জীবনগঠনের আদি পীঠস্থান। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ভবিষ্যৎ ভারত রাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের প্রস্তুতিপর্ব।

তিনি আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯১৪ সালে। এই সময়ই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকেই তিনি ভারতবাসীর কাছেও মহাত্মারূপে অভিহিত।

তিনি ভারতে ফিরে এসে প্রথমে সবরমতি নামক স্থানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা। করে জনসেবা ও গঠনমূলক কাজে মনোনিবেশ করেন।

শুরু হয় প্রথম বিশযুদ্ধ। গান্ধিজি এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলেন। তবে তিনি তখন এই শর্তে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিলেন যে, যুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীদের স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তারা শুধু চুক্তিভঙ্গই করেনি, উপরন্তু তারা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে অগণিত নরনারী ও শিশুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যাও করে।

এই নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় সমগ্র ভারতবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন, মহাত্মা গান্ধিও তাঁর ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক প্রত্যাখ্যান করেন।

দেশব্যাপী শুরু হয় আন্দোলন। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত সমগ্ৰ দেশ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়। মহাত্মা গান্ধিও যোগদান করেন এই মুক্তিসংগ্রামে। পরবর্তীকালে তাঁর নেতৃত্বেই শুরু হয় ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার অনুষ্ঠিত সংগ্রাম।

১৯২১ সালে আহমেদাবাদে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন চালানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। সারা ভারত মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এটাই ছিল বৃহত্তম ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। এই যে সমগ্র দেশের মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় চেতনাবোধ সৃষ্টি করা, এটা মহাত্মা গান্ধিরই অবদান।

এই আন্দোলন চালাকালীন ১৯২২ সালের ২২ মার্চ হাজার হাজার সত্যাগ্রহীর সাথে মহাত্মা গান্ধিকেও গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাঁর ছয় বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু দুবছর পর অর্থাৎ ১৯২৪ সালে বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহী ভারতীয় জনতার চাপে ইংরেজ সরকার গান্ধিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৩০ সালে আবার গান্ধি অসহযোগ আন্দোলনের ডাকদেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে ভারত জুড়ে শুরু হয়ে যায় ধর্মঘট, ব্রিটিশ পণ্যবর্জন এবং ব্রিটিশ সরকারের আইন অমান্য আন্দোলন। এই সময়ই মহাত্মা গান্ধিসহ প্রায় ষাট হাজার লোক কারাবরণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিটিশ সরকার নিজেই এগিয়ে এসে গান্ধির সঙ্গে সন্ধি করে। ১৯৩১ সালে সম্পাদিত এই চুক্তিই ইতিহাসে গান্ধি-আরইউন চুক্তি নামে খ্যাত। এই চুক্তি হওয়ার পর কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯৪২ সালে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে আলোচনায় বসেন। কিন্তু ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব গান্ধি প্রত্যাখ্যান করেন। এই মিশন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরই গান্ধি চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমে পড়েন। শুরু হয় তাঁর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন।

এই আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য চলল দমননীতি। গান্ধী আবারও গ্রেফতার হলেন। ভারত জুড়ে শুরু হয়ে গেলো তীব্র আন্দোলন।

অবশেষে ১৯৪৪ সালে ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে শুরু হয় আলোচনা। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল গান্ধিকে মুক্তি দিলেন। ভারতের স্বাধীনতার কাঠামো নির্ণয়ের জন্য ১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ডে থেকে এল ক্যাবিনেট মিশন

কয়েক দফা আলোচনা চলার পর অবশেষে ১৯৪৭ সালের ৭ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটল। ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিল ব্রিটিশ সরকার। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টে যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে অখণ্ড ভারত উপমহাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে।

মহাত্মা গান্ধি ছিলেন যেমন সত্যনিষ্ঠ, তেমনি মানবপ্রেমিক। তাঁর জীবনের মূলমন্ত্রই ছিল সত্য, অহিংসা এবং প্রেম। হরিজন আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থার পরির্তন, কুটির শিল্পের প্রসার কামনায় তিনি ছিলেন সদাতৎপর। অস্ত্রহীন, সৈন্যহীন, মাত্র আত্মার বলে বলীয়ান এই মহান পুরুষ কতিপয় সাথি নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পদব্রজে হেঁটে বেড়িয়েছেন। মুখে ছিল তাঁর একমাত্র শন্তির বাণী : “সবকো সুমতি দে ভগবান (সকল মানুষকে সুমতি দাও ঈশ্বর)।” পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানবের সংখ্যা শুধু বিরল নয়, তিনি তার একমাত্র দৃষ্টান্তও।

কিন্তু তবু দ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ তাঁকে আকণ্ঠ পান করতে হয়েছিল, তাঁর মতো অহিংসবাদী মানুষকেও উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার শিকার হতে হয়েছিল। গান্ধিজির সাম্প্রাদায়িকতামুক্ত সত্যাশ্রয়ী উদার নীতিই এর কারণ। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এক বৈকালিক প্রার্থনাসভায় নাথুরাম গডসে নামক এক আততায়ীর পিস্তলের গুলিতে তিনি নিহত হন। অহিংসা ও প্রেমের পূজারি এই মহামানব তাঁর দেশবাসীর হাতেই নিহত হন। তবু তাঁর জীবনের সাধনা, তাঁর জীবনের আদর্শ সমগ্র ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসীর অন্তরে চিরদিন দেদীপ্যমান থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *