রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

অটো ফন বিসমার্ক (১৮১৫–১৮৯৮) – জার্মান সাম্রাজ্যের স্থপতি

অটো ফন বিসমার্ক (১৮১৫–১৮৯৮) – জার্মান সাম্রাজ্যের স্থপতি

বিশ্বের মাত্র দশজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদের নাম করলেও তাঁদের মধ্যে একজন হবেন জার্মানির ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ অটো ফন বিসমার্ক (Otto Von Bismarck)। তিনি ছিলেন জার্মান সাম্রাজ্যের স্থপতি এবং প্রথম চ্যান্সেলর।

অটো ফন বিসমার্কের জন্ম ১৮১৫ সালে ১ এপ্রিল ব্রানডেনবার্গের নামক একটি শহরে। পিতা ছিলেন ফার্ডিনান্ড ফন বিসমার্ক। তিনি ছিলেন প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর একজন সামরিক কর্মকর্তা এবং ভূস্বামী। মা ছিলেন রাজা ফ্রিডরিশ উইলিয়াম তৃতীয়-র প্রিয়পাত্রী ও অজ্ঞাতনামা এক পুঁজিপতির কন্যা ভিলহেলমাইন মেনকেন।

পিতামাতা দুজনেই ছিলেন অভিজাত বংশোদ্ভূত। তাই এঁদের আভিজাত্য, ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ ও মেধা-সমস্ত গুণেরই প্রতিফলন ঘটেছিল বিসমার্কের মধ্যে।

বিসমার্কের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বার্লিনের একটি স্কুলে। এখানে বাল্যকালে মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি। বাল্যশিক্ষা শেষ করে তিনি গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন। পরে বার্লিনের একটি আইন কলেজে আসেন।

পড়া শেষ করে তিনি প্রুশিয়ান সরকারের অধীনে চাকরি নিলেন। বিসমার্ক ছোটবেলায় কিছুটা আবেগপ্রবণ ছিলেন। এই নতুন চাকরির সময়েই তিনি এক ইংরেজ মেয়ের প্রেমে পড়ে কাউকে কিছু না বলেই কয়েক মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।

এর পরও তিনি ইওহান্না ফন পুামার নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েন এবং ১৮৪৭ সালে তাঁর সাথেই তাঁর বিয়ে হয়।

কিন্তু পুকামারকে বিয়ে করলেও একই সঙ্গে আরো বেশ কযেকটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল।

ব্যক্তিজীবনে যা-ই হোন, কর্মদক্ষতায় তাঁর জুড়ি ছিল না। এবং এই গুণপনার জন্যই তিনি প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক উইলিয়াম চতুর্থ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং তিনি তাঁকে ফ্রাংকফুর্টে জার্মান কনফেডারেশনে প্রুশিয়ার রাষ্ট্রদূত হওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর এবং রাজনীতি বা কূটনীতি বিষয়ে ভালো ধারণাও ছিল না। এই অবস্থাতেও তিনি এই গুরুদায়িত্ব নিতে সম্মত হন। তিনি ফ্রাংকফুর্টে প্রুশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলেন ১৮৫১ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি ১৮৫৯ সালেই কিছুদিনের জন্য রাশিয়ায় প্রুশিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৮৬২ সালে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গমন করেন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়েই।

১৮৬২ সালে বিসমার্ক জার্মানির চ্যান্সেলর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হন।

ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর প্রুশিয়া তার হৃত অংশ ফেরত পেল বটে, কিন্তু দেশে কোনো শক্তিশালী রাজা বা নেতা না থাকায় প্রুশিয়া ও জার্মানি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ জড়িত থাকে। প্রুশিয়া তার একতা হারিয়ে ফেলেছিল। অস্ট্রিয়ার সম্রাট তখন জার্মানির ওপর আধিপত্য করতেন।

ঠিক এই সময়েই প্রুশিয়ায় বিচক্ষণ ও জবরদস্ত এক তরুণ রাজনীতিবিদ অর্থাৎ বিসমার্কের অভ্যুদয় ঘটে। বস্তুত বিসমার্ক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নয়।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অস্ট্রিয়াকে জার্মান কনফেডারেশন থেকে সরাতে না পারলে জার্মানি এক মিলিত দেশ হতে পারবে না। তিনি আরও বুঝেছিলেন—যুদ্ধ না করে অস্ট্রিয়াকে তাড়ানো যাবে না। কিন্তু শক্তিশালী অস্ট্রিয়াকে যুদ্ধে হঠানোও সহজ কথা নয়।

এই সময়ই অর্থাৎ ১৮৬২ সালে তিনি প্রুশিয়ায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি রাজাকে বোঝালেন পার্লামেন্ট ভেঙে না দিলে কিছু করা যাবে না। অস্ট্রিয়াকে তাড়াতে হলে প্রুশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য এমন কাজ করতে হবে যা প্রকাশ্যে জানাজানি করা যাবে না। পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আপন মনে কাজ করতে হবে। রাজাও তাঁর কথা বুঝতে পারলেন এবং তাঁর পরামর্শে পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন।

তাঁর পরই বিসমার্ক প্রচণ্ড প্রতাপে দেশশাসন করে প্রুশিয়াকে তৈরি করে নিলেন অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধে নামার উপযোগী করে। ১৮৬৪ সালে তিনি কৌশলে অস্ট্রিয়াকে ঠকিয়ে ডেনমার্কের কাছ থেকে স্লেজ উইগ ও হলস্টিন নামে দুটো প্রদেশ কেড়ে নিলেন। পরে এই নিয়েই অস্ট্রিয়ার সাথে প্রুশিয়ার বেধে গেল বিবাদ এবং যুদ্ধ।

বিসমার্ক ১৮৬৬ সালে ক্ষিপ্র গতিতে অস্ট্রিয়া আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করলেও তার কোনো ভূখণ্ড দাবি করলেন না। কেবল অস্ট্রিয়াকে জার্মান কনফেডারেশন থেকে বের করে দিলেন। কারণ, জার্মান জাতির মধ্যে ঐক্যপ্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেই তিনি জার্মানির উত্তরভাগের রাজ্যগুলোকে প্রুশিয়ার অধীনে সংঘবদ্ধ করে উত্তর জার্মান যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেন।

জার্মানির এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আয়োজন দেখে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন (১৮০৮–১৮৭৩) ভয় পেয়ে ভাবলেন, জার্মানি হয়তো ফ্রান্সকেও বিব্রত করে তোলার সুযোগ পাবে। এদিকে বিসমার্কও বুঝতে পেরেছিলেন, ফ্রান্সকে পরাজিত করতে না পারলে সমগ্র জার্মানিকে এক রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে না।

তাই তিনি ১৮৭০ সালে ফ্রান্স আক্রমণ করে দেশটির শক্তিশালী দুটো প্ৰদেশ, তথা আলসেস ও লোরেন কেড়ে নিলেন। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের নামে তিনি ফ্রান্সের কাছ থেকে বহু কোটি টাকাও আদায় করে দেন। আর এই বিপুল অর্থ দিয়ে দেশে গড়ে তুললেন তিনি শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের কাঠামো বা ভিত্তি ১৮৭১ সালে প্রুশিয়ার রাজা সম্মিলিত গোটা জার্মানির প্রথম সম্রাট হলেন। এতকাল পরে বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানি এক ঐক্যবদ্ধ দেশে পরিণত হল। বিসমার্কের ছিল অসাধারণ কূটবুদ্ধি, সেইসঙ্গে ছিল দেশের জন্য প্রচণ্ড ভালবাসা। রাজা প্রথম উইলিয়াম বিসমার্কের নীতি- আদর্শ বুঝতে পারতেন, তাই তাঁর কাজে কখনও বাধা দিতেন না।

দুর্ভাগ্যবশত তিনি ১৮৮৮ সালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে ফ্রিডরিশ কাইজার সম্রাট হন। কিন্তু তিনিও কয়েক মাস পর মারা গেলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় উইলিয়াম রাজা হন।

কিন্তু তরুণবয়সী এই দ্বিতীয় উইলিয়াম ছিলেন দাম্ভিক ও ভাবপ্রবণ। তিনি বিসমার্কের আধিপত্য ও খবরদারি ও মানতেন না। তাই তাঁর সাথে বিসমার্কের বনিবনা হলো না।

ফলে বিসমার্ক বেশি দিন আর জার্মানির প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারলেন না। যে জার্মানিকে তিনি তিলেতিলে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর সেই নিজের হাতে গড়া সেই সাম্রাজ্য ফেলে তাঁর নিজেকেই বিদায় নিতে হলো।

বিসমার্ক জার্মানির প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ান ১৮৯০ সালে। তাঁর এই বিদায় নেওয়ার ঘটনাটি আজও ইতিহাসে ‘ড্রপিং দি পাইলট’ (Dropping the Pilot) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও বিসমার্ক আরও আট বছর বেঁচেছিলেন। তিনি মারা যান ১৮৯৮ সালের ৩০ জুলাই। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।

মৃত্যুর পর বার্লিনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কবরে আজও খোদিত আছে তাঁরই একটি বাণী : “A True German Servant of the Emperor William” (সম্রাট উইলিয়ামের একজন একনিষ্ঠ কর্মচারী)। জার্মান সম্রাটের নন, বিসমার্ক ছিলেন প্রকৃতপক্ষে জার্মান জাতিরই একজন একনিষ্ঠ সেবক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *