রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫) – যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্রীতদাসপ্রথা রহিত করেছিলেন

আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫) – যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্রীতদাসপ্রথা রহিত করেছিলেন

দাসপ্রথা ছিল আমেরিকার ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। এই দাসপ্রথা নিয়েই উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছিল মনকষাকষি। মতবিরোধ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠল। অবশেষে দক্ষিণ দিকের লোকেরা জানাল যে, তারা উত্তর দিকের অধিবাসীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে তাঁরা একাট স্বাধীন নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলবে।

এই সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন মহাপ্রাণ মনীষী আব্রাহাম লিংকন (Abraham Lincoln)। তিনি নিজেও এই কুখ্যাত দাসপ্রথাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতেন। তাই দেশের দক্ষিণ দিকের লোকদের বলে দিলেন, আমেরিকান সরকারের বাইরে গিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। দরকার হলে সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জোর করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ধরে রাখতেও কুণ্ঠিত হবে না।

আব্রাহাম লিংকন ছিলেন সত্যি এক দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। তাঁর জন্ম কেন্টাকি প্রদেশের হজেনভিল শহরের এক গরিব পরিবারের ঘরে ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি।

পিতা ছিলেন টমাস লিংকন। মায়ের নাম ছিল ন্যান্সি হ্যাংকাস লিংকন। আব্রাহম লিংকন পরবর্তী সময়ে তাঁর পিতা সম্পর্কে বলেছেন, “আমার পিতা ছিলেন একজন শ্রমিক। লেখা বা বই পড়া সম্পর্কে তাঁর কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন ভালো শিকারি, উত্তম মিস্ত্রি, কঠোর পরিশ্রমী, কিন্তু ব্যর্থ কৃষক।”

ছোট্টবেলায় আব্রাহাম লিংকনের দুষ্টু বলে কুখ্যাতি থাকলেও পড়াশোনার দিকে ছিল খুব মনোযোগ।

আব্রাহাম যে স্কুলে পড়তেন তার ঘরটা ছিল কাঠের তৈরি। মজার ব্যাপর হলো, স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে চেঁচিয়ে পড়তে হতো। এই স্কুলের প্রভাব থেকেই আব্রাহাম লিংকন পরিণত বয়সেও চেঁচিয়ে পত্রিকা বই পড়তেন।

১৮১৬ সালে লিংকন পরিবারকে তাঁদের পুরনো বসত ছেড়ে উঠে আসতে হলো লুইসভিল থেকে ৬৪ কিলোমিটার উত্তরে নব ক্রীক নামের অন্য একটা জায়গায়। এখানে এসে তাঁরা জঙ্গল কেটে গড়ে তুললেন নতুন বসত।

১৮১৯ সালে এই নতুন জায়গায় দেখা দিল মহামারী। এই মহামারীতেই আব্রাহামের মা ন্যান্সি মারা গেলেন। এর কিছুদিন পরেই পিতা টমাস তিন সন্তানের জননী সারাহ্ জনস্টন নামে এক বিধবা মহিলাকে আবার বিয়ে করেন। অবশ্য সমা হলেও মহিলা খুব ভালো ছিলেন। আব্রাহামকে খুব আদর করতেন।

বড় হয়ে লিংকন গাঁয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসা করতে নামেন। কিন্তু সেই ব্যবসা বেশিদিন চলল না। পাওনাদারেরা তাঁকেই বিব্রত করে তুলতে লাগল। তিনি এত সৎ প্রকৃতির ছিলেন যে, কাউকেই ফাঁকি দিতে পারতেন না। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে নিজে কষ্ট করে তিনি এই দেনা পরিশোধ করে দেন। এর মধ্যেই আইন পাস করে শহরে আইনব্যবসা করতে শুরু করেন।

১৮৩৭ সালে এপ্রিল মাস। আটাশ বছরের যুবক আব্রাহাম লিংকন আইনজীবী হওয়ার জন্য চলে আলেন স্প্রিংফিল্ড শহরে। এখানেই সুবিখ্যাত আইনজীবী জন টি. স্টুয়ার্টের সহকারীরূপে কাজ শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, রাজ্য আইন পরিষদে দলের নেতাহিসেবে জনসমাজে সমাদর ও প্রতিপত্তি লাভ করলেন।

১৮৪২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মেরি টড নামের এক মহিলার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

আব্রাহাম লিংকন আইনব্যবসার মাধ্যমে জীবিকার্জন করলেও রাজনীতিতেই তাঁর উৎসাহ ছিল বেশি। তিনি ১৮৪৭ সালের নভেম্বর মাসে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস্‌-এর আসন লাভ করেন।

কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে লিংকন দুটো গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটর নির্বাচনেও লিংকন প্রতদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ১৮৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি আইন পরিষদের সদস্যদের ভোটে তিনি পরাজিত হন। পরের বছর তিনি বুঝতে পারেন, রিপাবলিকান দলে যোগদান করা তাঁর কর্তব্য।

১৮৫৬ সালের ২৯ মে ইলিনয়ে রিপাবলিকান দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে তিনি দেশের প্রচলিত ঘৃণ্য দাসব্যবসা সম্পর্কে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দান করেন। তাঁর বক্তৃতা শুনে শ্রোতারা যারপরনাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

১৮৫৮ সালের নির্বাচনে তিনি বেশি ভোট পেলেও রাজ্য আইন পরিষদের অধিবেশনে সিনেটর নির্বাচনের ভোটসংখ্যায় দেখা গেল তিনি কম ভোট পেয়েছেন। কিন্তু আব্রাহাম পরাজিত হলেও সারা দেশে তাঁর মর্যাদা ও জননেতা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি অক্ষুণ্ণই থেকে যায়।

আব্রাহাম লিংকন তাঁর কর্মতৎপরতার দরুন ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন এবং প্রতিদ্বন্দী ক্ষমতাবান ধনী স্টিফেন ডগলাসকে পরাস্ত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যেদিন তিনি হোয়াইট হাউসে আসেন, তাঁর সেদিনের স্মৃতিটি ছিল খুবই চমৎকার।

আব্রাহাম সমস্ত বাক্সপেটরা নিজেই গুছিয়ে নেন। স্প্রিংফিল্ডের বাড়িটা বিক্রি করে দেন। দুটো গরু এবং একটি ঘোড়া ছিল, তাও বিক্রি করে দেন। কুকুরটা দিয়ে দেন এক বন্ধুকে। তার পরপরই তিনি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে উঠে আসেন হোয়াইট হাউসে। তাঁর মনে হয়তো এই বিশ্বাস ছিল যে, হোয়াইট হাউসের সরকারি বাসভবনই হবে তাঁর স্থায়ী বাসস্থান। এক অর্থে তা-ই হয়েছিল। কারণ মৃত্যুর পূর্বমূহূর্ত পর্যন্ত তিনি হোয়াইট হাউসের বাসিন্দাই ছিলেন। কারণ, ক্ষমতা হারিয়ে তাঁকে এখান থেকে বিদায় নিতে হয়নি।

আব্রাহাম লিংকন ছিলেন যুদ্ধ ও নিষ্ঠুরতার বিরোধী। দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে উত্তর আর দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে বেধে যায় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধের গতি ১৮৬৩ সালের দিকে দক্ষিণাঞ্চলের বিপক্ষে যেতে শুরু করে। প্রেসিডেন্টে লিংকন ঘোষণা করেন, যে এলাকা আমাদের দখলে এসেছে, সেই স্থানের ক্রীতদাসেরা আজ থেকে মুক্ত। ১৮৬৪ সালের দিকে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউলিসিস এস. গ্রান্ট নামক এক দুর্ধর্ষ সেনাপতিকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট লিংকন। ১৮৬৫ সালে ৯ এপ্রিল অ্যাপোমালটক্স কোর্ট হাউসে শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করে।

প্রেসিডেন্ট লিংকনের অমরবাণী শোনা গেল—

“ক্রীতদাসদের মুক্তি দিয়ে আমরা স্বাধীনতা রক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিত ভরসা দান করেছি। কারও প্রতি ঈর্ষা না রেখে সকলের প্রতি প্রীতি ও প্রেম নিয়ে, সত্যকে আশ্রয় করে, সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা, যা ঈশ্বর আমাদেরকে দান করেছেন, তাকেই পাথেয় করে, আসুন, মিলেমিশে আমাদের করণীয় কাজগুলো সমাধা করি।”

এমনি করে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রচেষ্টায় ও একাগ্রতায় একটি আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়।

আব্রাহাম লিংকন ছিলেন মানবতা ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর সেই অমর বাণী ‘Government of the people, by the people, for the people’ আজও শতাব্দীকাল ধরে প্রবাদবাক্যের মতো প্রচলিত। গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এমন নিখুঁত সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি।

কিন্তু এর কিছুদিন পরেই এলো সেই মর্মান্তিক ক্ষণটি। প্রেসিডেন্ট লিংকন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটনের ফোর্ট থিয়েটারে ‘আমাদের আমেরিকান প্রতিবেশী’ নাটকটি দেখছিলেন। ঠিক এমন সময় জন উইলকিস বুথ নামের এক উন্মাদ অভিনেতা প্রেসিডেন্টের বুক লক্ষ্য করে পিস্তলের গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লিংকনের রক্তাপ্লুত দেহ গড়িয়ে পড়ে। এমনি করে বিশ্বের সবচেয়ে মহান, দয়ালু ও হৃদয়বান ব্যক্তিটির জীবনাবসান হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ১৮৬৫ সালে।

আজও তিনি বিশ্বের স্মরণীয় ও বরেণ্য ব্যক্তিদের একজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *