রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) – ইতিহাসের কিংবদন্তির মহানায়ক

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) – ইতিহাসের কিংবদন্তির মহানায়ক

বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় আজও যাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে, এক সময় যাঁর ভয়ে সারা ইউরোপ কাঁপত, যাঁর নাম বলে এককালে ইউরোপের মায়েরা দুষ্টু ছেলেদের ভয় দেখাতেন, ইতিহাসবিখ্যাত সেই সমরনায়ক এবং এককালের ফ্রান্সের সেই সম্রাটের নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

একেবারে সাধারণ ঘরের ছেলে হয়েও তিনি নিজের প্রতিভাবলে হয়েছিলেন ফ্রান্সের সম্রাট। জয় করেছিলেন বহু দেশ। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশাল এক ফরাসি সাম্রাজ্য।

ইতিহাসের কিংবদন্তির মহানায়ক এই মহাবীর নেপোলিয়নের জন্ম ভূমধ্য সাগরের উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত কর্সিকা নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট।

পিতা ছিলেন কাউন্ট বোনাপার্ট। তিনিও ছিলেন সামরিক অফিসার। কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তাই অভাব-অনটন লেগেই থাকত। নেপোলিয়নরা পাঁচ ভাই এবং তিন বোন। নেপোলিয়ন ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান।

ছোটবেলায় লেখাপড়ার প্রতি খুব মনোযোগ ছিল নেপোলিয়নের। ইতিহাস, ভূগোল আর অঙ্কের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। ষোলো বছর বয়সে প্যারিসে মিলিটারি স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এবং তাঁর পরিবারবর্গকে হত্যা করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পরও দেশের গোলযোগ বন্ধ হলো না।

এই সময় নেপোলিয়ন ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সেনাবাহিনীতে বিরাট কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন, ফলে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। এরপর ১৭৯৯ সালে ফরাসিরা বিজয়ী যোদ্ধা নেপোলিয়নকেই ক্ষমতায় বসানো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তাঁকে প্রথম কনসাল বলে সবাই মেনে নিল।

এর পরই নেপোলিয়ন নতুন সংবিধান রচনা করে ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন।

নেপোলিয়ন তাঁর সারা জীবন বহুযুদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে ছিল ১৮০৫ সালে অস্টার-লিজের যুদ্ধ ও ১৮০৬ সালে প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে জেনার যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮০৮ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপে তাঁর ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহত। কিন্তু ১৮১২ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে তাঁর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের পক্ষে মস্তবড় ভুল। তিনি এই অভিযানে গিয়ে মহাবিপদে পড়েন। প্রচণ্ড শীতে আর খাদ্যের অভাবে মারা পড়তে থাকে তাঁর সৈন্য হাজারে হাজারে। রাশিয়া থেকে নেপোলিয়নের এই ‘পশ্চাদপসরণ’ ইতিহাসে ‘মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তন’ নামে খ্যাত হয়ে আছে।

এরপর ইউরোপের বিভিন্ন রাজা নেপোলিয়নকে প্রতিহত করার জন্য সম্মিলিতভাবে ফ্রান্স আক্রমণ করেন। অবশেষে ১৮১৫ সালে বেলজিয়ামের অন্তর্গত ওয়াটারলু যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটনের হাতে পরাজিত ও বন্দি হন।

নেপোলিয়নকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূরবর্তী সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি করে রাখা হয়। এই দ্বীপেই ইংরেজরা তাঁকে সুকৌশলে আরসেনিক বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে। সম্রাট নেপোলিয়ন বিষের ক্রিয়ায় মারা যান ১৮২১ সালের ৬ মে।

নেপোলিয়ন একসময় বিশ্ব জয় করতে চেয়েছিলেন। অনেক বড় বড় যুদ্ধে আশ্চর্য কক্ষমতা প্রদর্শন করে জয়ী হয়েছিলেন। তাই অনেকের হয়তো জানতে ইচ্ছে করে, তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন।

তাঁর প্রাত্যহিক জীবন ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন কিন্তু বিছানা ত্যাগ করতেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাইরের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতেন। এটা ছিল তাঁর শখ।

তারপর ব্যক্তিগত চাকর নিয়ে আসত একগাদা চিঠি। তিনি বিছানায় শুয়ে-বসেই সেগুলোর ওপর চোখ বোলাতেন। যেগুলো দরকারি, সেগুলো রেখে দিতেন, আর বাকিগুলো ঘরময় ছড়িয়ে ফেলতেন।

এরপর চা-পান পর্ব এবং দৈনিক পত্রিকা পাঠ। ঠিক এই সময়ই ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ঘরে ঢুকতেন। তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো। কিন্তু সম্রাট নেপোলিয়নের ওষুধ খাওয়ার প্রতি ছিল দারুণ অনীহা। পারতপক্ষে তিনি ওষুষ খেতে চাইতেন না।

এরপর শুরু হতো দাড়ি কামানোর পালা। না, কোনো নাপিত নয়, তিনি নিজের দাড়ি নিজেই কামাতেন। নিজের হাতে দাড়ি কামানো সম্পর্কে তিনি রসিকতা করে বলতেন, অপরের হাতে, অমন ধারালো অস্ত্রটির সামনে নিশ্চিন্তে গাল-গলা এগিয়ে দেব, তেমন বোকা আমি নই।

তাঁর দাড়ি নিজে কামালেও সাহায্যকারী লোক লাগত বেশ কয়েকজন। একজন সামনে ধরে থাকত আয়না; আর একজন ধরত জলের পাত্র। তিনি সারা ঘরময় হেঁটে হেঁটে দাড়ি কামাতেন। এটাই ছিল তাঁর অভ্যাস!

দাড়ি কামানোর পর শুরু হতো স্নান পর্ব। এটা ছিল তাঁর একটা মস্ত বড় বিলাসিতা। কাজের তাড়া না থাকলে তিনি এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে স্নান করতেন।

সকালের আহার গ্রহণের সময় নটা হলেও নাস্তার টেবিলে আসতে আসতেই কখনও কখনও এগারোটা-বারোটাও বেজে যেত।

খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে নেপোলিয়ন একেবারেই কোনো নিয়মকানুন মেনে চলতেন না। এ ব্যাপারে তাঁর তেমন কোনো জাঁকজমকও ছিল না। কয়েক টুকরো ফল, একটুখানি চিজ আর স্যুপ। আর তার সাথে সামান্য কিছু মাংস। এরপর রাতে এক কাপ গরম কফি, এনা হলে তার চলত না।

তারপর প্রথমে যেতেন পাঠাগারে। চিঠিপত্র লেখা, নানারকম পত্র ও দলিলে স্বাক্ষর করা—এর সবই হতো এই সময়ের মধ্যে। এই সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করত চার থেকে পাঁচজন সেক্রেটারি। তিনি তাদের প্রত্যেককে সমানভাবে ডিকটেশন আর কাজের নির্দেশ দিতেন। আশ্চর্য ছিল তাঁর স্মরণশক্তি, কোনো কাজে তাঁর ভুল হতো না। তিনি কোনো কাজই রাজসিংহাসনে বসে করতেন না। অফিসকক্ষের টেবিলে পা তুলে বসে সারতেন সমস্ত কাজ।

লাইব্রেরি থেকে আসতেন দরবারকক্ষে। এখানেই তিনি সারা দিন ডুবে থাকতেন কাজের মধ্যে। কাজের নেশায় এমন বিভোর থাকতেন যে, রাত দশটার আগে খাবার ফুরসত মিলত না।

নেপোলিয়নের খাওয়া দাওয়া নিয়েও অনেক মজার গল্প প্রচলিত। যেমন তাঁর প্রিয় খাবার ছিল মুরগির রোস্ট। আর তা গরম হওয়া চাই। কিন্তু তিনি কখন খাবার খাবেন তা নির্দিষ্ট না থাকায় পাচকেরা প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর একটি করে মুরগি রোস্ট করে যেত। কখন খাবার ডাক পড়বে, তার ঠিক নেই বলেই এই ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, এর সবই যেত তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের পেটে।

ডিনার খাবার পর তিনি কিছুক্ষণ হয় গল্প করতেন, আর না হয় তাস খেলতেন। কিন্তু খেলা শেষ হতো না। হঠাৎ করেই খেলা ছেড়ে দিয়ে আবার গিয়ে মারতেন কাজের মধ্যে।

তিনি অনেক রাতে ঘুমুতে যেতেন। কিন্তু দেরিতে ঘুমাতে গেলেও দু-এক ঘণ্টার বেশি ঘুমুতেন না। দুপুররাতে উঠে আবার শুরু হতো কাজ। শোনা যায়, অনেকবার যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠেই নাকি তিনি আধ ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিতেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ এক সেনাপতি। কড়া নিয়মনীতি মেনে চলতেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একেবারেই অগোছালো।

খেতে বসলে তাঁর জামাকাপড় তরকারির ঝোল লেগেটেগে একাকার হয়ে যেত। ছুরি-কাঁটা সামলাতে পারতেন না। কাপ-ডিশ-গেলাস অনবরত ভেঙে ফেলতেন। অনেক সময় ছুরি-কাঁটা ফেলে হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করতেন।

তবু নেপোলিয়ন নেপোলিয়নই ছিলেন। প্রয়োজনের সময় তাঁর ছিল বলিষ্ঠ মূর্তি। সংকল্পে দৃঢ় এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *