রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২–১৭৯৯) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট

জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২–১৭৯৯) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট

জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তাঁর মতো লোকের জন্য এটা খুব বড় সম্মান নয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরও অনেক বড় কিছু ছিলেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমেরিকানদের মুক্তিদাতা বীর সেনানী। এটাই ছিল তাঁর বড় পরিচয়।

জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন ভার্জিনিয়া উপনিবেশের এক ধনী জমিদারের সন্তান। তাঁদের ছিল অঢেল জমি, ধনসম্পদ। সে জমিতে ফলত প্রচুর তামাক। এর থেকে বছরে আয় হতো হাজার হাজার ডলার। এমনি এক ধনীর ঘরেই ১৭৩২ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় ওয়াশিংটনের।

ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, সত্যবাদী এবং কর্মঠ। তাঁর বয়স যখন মাত্র এগারো বছর, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। একুশ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধবিদ্যা শিখতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতিতেও যোগ দিতে আরম্ভ করেন এবং অচিরেই সারা দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হন।

এই সময় মার্কিনিদের খুবই দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা যে শাসন-শোষণ আদিবাসীদের ওপর চালিয়ে আসছিল সেটাই আবার নতুন করে চালানো হতে লাগল তাদেরই স্বজাতির ওপর। যারা একদা ইউরোপ থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে সাগর পাড়ি দিয়ে এসে এদেশকে নিজেদের দেশ ভেবে স্থায়ীভাবে বসবাস কতে শুরু করে, ইংরেজ বেনিয়ারা তাদেরকেও আদিবাসীদের কাতারে ফেলতে শুরু করে। একইভাবে নতুন নতুন কৌশলে তাদের ওপর শুরু হল শোষণ শাসন ও নির্যাতন। ইংরেজরা ইচ্ছে করে নানা কৌশলে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে গোলযোগ বাধিয়ে তাদের দুর্বল করে রাখতে চেষ্টা করছিল। আর সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে লক্ষ লক্ষ ইংরেজ সৈন্য পোষা হচ্ছিল তাদের, অর্থে, তাদের মাটিতে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করত আমেরিকা হলো ইংল্যান্ডের উপনিবেশ মাত্র। সব বিষয়েই তারা সর্বদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুখাপেক্ষী থাকবে। তা হলে তাদের যাবতীয় আদেশ তারা মাথা পেতে মেনে নেবে না কেন? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এ ধরনের অত্যাচারে দেশের লোক যখন জর্জরিত, তখন ১৭৬৪ সালে প্রবর্তন করা হলো স্ট্যাম্প আইন। এর আগে দলিলপত্র ও আদালতের আবেদনপত্রাদি সাদা কাগজে লেখা হতো, কিন্তু এই আইনের ফলে এখন থেকে সাদা কাগজের পরিবর্তে স্ট্যাম্পযুক্ত কাগজ ব্যবহার করার নির্দেশ জারি করা হলো। এ ছাড়া আরও নানাধরনের কর আরোপ করতে লাগল তারা।

১৭৬৪ সালের ৩১ অক্টোবর, তারিখে সারা দেশে এতসব কিছুর বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত হলো প্রতিবাদ সভা। আর তার পর থেকেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

শাসক ইংরেজরা বিদ্রোহ দমন করার জন্য শুরু করে দেয় আরো দ্বিগুণ উৎসাহে নির্যাতনের স্টিম রোলার। সেই সাথে গ্রহণ করে নানা ধরনের কূটকৌশল। এদিকে আমেরিকাবাসীও আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। আমেরিকানদের সেনাপতি নিযুক্ত হলেন জর্জ ওয়াশিংটন।

এই সময় ব্রিটিশ সেনাপতি গোজ বোস্টন নগরীতে অবস্থান করছিলেন। পাছে তিনি সৈন্য নিয়ে আমেরিকার ভেতরে ঢুকে পড়েন, তাই ওয়াশিংটন বোস্টন নগরী অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই খবর যখন বোস্টন নগরীতে পৌঁছয়, তখন ব্যাপারটিকে সবাই হেসেই উড়িয়ে দেন। তারা বরং এই হাস্যকর খবরটিকে আরও মজা করে উপভোগ করার জন্য বিদ্রোহীদের সেনাপতি জর্জ ওয়াশিংটনকে ব্যঙ্গ করে মঞ্চস্থ করে ফেললেন একটা প্রহসনমূলক নাটক পর্যন্ত।

ঠিক এমন সময় এক ব্যক্তি রঙ্গালয়ে ছুটে এসে খবর দিল যে, জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা সত্যি সত্যি এগিয়ে আসছে। এরপর ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে বোস্টন নগরী সত্যি সত্যি অবরোধ করা হলো। আর তার পরেই এল সন্ধির প্রস্তাব ইংরেজরা বলল, যদি তাদেরকে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে যেতে দেওয়া হয়, তবে তারা বিনাশর্তে নগরী ছেড়ে চলে যাবে। ওয়শিংটন প্রস্তাবে রাজি হলে ইংরেজরা ১৭৭৬ সালের ১৭ মার্চ বোস্টন নগরী ছেড়ে চলে যায়।

কিন্তু এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৭৭৬ সালেরই ২২ আগস্ট নিউ ইয়র্কের এক যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যেদের হাতে আমেরিকানরা পরাজিত হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা নিউ ইয়র্ক দখল করে শুরু করে অত্যাচার আর লুটতরাজ। এই সময় তারা ঘোষণা করল যে, যেসব বিদ্রোহী ষাট দিনের মধ্যে অস্ত্র পরিত্যাগ করবে, তাদের, ক্ষমা করা হবে।

এই রকম চরম হতাশার মধ্যে আমেরিকানদের কাছে একমাত্র আশার প্রদীপ ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর অধীনস্থ স্বাধীনতাকামী আমেরিকান সৈন্যদের দুর্গতির শেষ ছিল না। তাদের পেটে খাবার, পায়ে জুতা পর্যন্ত ছিল না। এমন অবস্থায়ও তারা তাদের মহান সেনাপতি জর্জ ওয়াশিংটনের আদেশে এগিয়ে গেছে সামনে। তাদের উত্তম প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না। এই অবস্থায় জর্জ ওয়াশিংটন শুরু করলেন গেরিলা পদ্ধত্রি আক্রমণ। গোপনে ব্রিটিশ সৈন্যদের শিবিরে হামলা চালিয়ে সংগ্রহ করতে লাগলেন খাবার আর অস্ত্রশস্ত্ৰ।

এভাবে অস্ত্রসংগ্রহ করে তাঁরা কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করলেন এবং কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে জয়লাভও করলেন। কিন্তু তা হলেও তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, বাইরের কোনো দেশের সাহায্য ছাড়া ইংরেজদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়।

ফ্রান্সের সাথে ইংরেজদের শত্রুতা তখনও চলছে। কানাডা হারিয়ে ফরাসিরা ইংরেজদের ওপর ভীষণ চটে রয়েছে। ফলে আমেরিকানরা ফরাসিদের সাহায্য চাইতেই তারা রাজি হয়ে গেল, কিন্তু এই সাথে তারা দাবি করল যে, তাদের সাহায্য নিতে হলে আমেরিকাকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হবে। আমেরিকানরা সহজেই এই শর্ত মেনে নিল এবং ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো।

এই সময় ইংল্যান্ডেরও খুব দুঃসময় যাচ্ছিল। ইউরোপেরও প্রায় সবগুলো দেশ তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্স, স্পেন, প্রুশিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, নেপস্‌, পর্তুগাল এবং হল্যান্ড তখন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।

এই সময় লাফায়েৎ নামে একজন ফরাসি জেনারেলের নেতৃত্বে ফ্রান্সের একদল স্বেচ্ছাসেবক আমেরিকানদের হয়ে যুদ্ধ করতে আসেন। ইংল্যান্ডের জাহাজ যাতে আমেরিকায় ঢুকতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন লাফায়েৎ, আর ভেতরে সংগ্রামরত ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর সৈন্য বাহিনী নিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তে লাগল ইংরেজদের।

দুদিক আক্রমণাত্মক যুদ্ধে অবশেষে হেরে গেল ইংল্যান্ড। এরপর ১৭৮৩ সালে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে এই সংগ্রামের হল অবসান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিল ইংল্যান্ড। আর ও-ভাবেই জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে সৃষ্টি হলো বিশ্বের বুকে একটি অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রের। জর্জ ওয়াশিংটন স্বদেশভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য ১৭৭৫ সালে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধে নেমেছিলেন, ১৭৮৩ সালে সেই যুদ্ধের অবসান হলে তিনি সেই অস্ত্র পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মতো আবার ফিরে এলেন তাঁর নিজের গ্রামে। এবার যেন তাঁর বিশ্রামের পালা। কিন্তু বেশিদিন বিশ্রাম করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আবার তাঁর ডাক এল। অস্ত্রধারণ করে যে-দেশ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, আবার ডাক এল সেই দেশ গড়ে তোলার দায়িত্বগ্রহণ করার।

যাই হোক, আমেরিকা তো স্বাধীন হল; কিন্তু তার শাসনতন্ত্র কী হবে, তা-ই নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলছিল মন-কষাকষি। তেরোটি উপনিবেশ এব্যাপারে একমত হতে পারছিল না। চার বছর ধরে চলল এই নিয়ে গোলযোগ। তাই ১৭৮৭ সালে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ফিলাডেলফিয়া নামক শহরে আমেরিকার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য বৈঠক বসল।

এই সভাতেই আমেরিকার শাসনতন্ত্র রচিত হয়। শাসনতন্ত্র রচনায় আমেরিকার যেসব নেতা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, রবার্ট মরিস, জেমস্ ম্যাডিসন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন এবং জর্জ ওয়াশিংটন।

এবার দেশশাসনের জন্য সৃষ্টি করা হলো প্রেসিডেন্টের পদ। জর্জ ওয়াশিংটন সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হলেন দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তিনি এই পদে তিনবার মনোনীত হয়েছিলেন।

জর্জ ওয়াশিংটনের মৃত্যু হয় ১৭৯৯ সলে ১৪ ডিসেম্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজও তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই দেশের রাজধানীর নামকরণ করা হয়েছে ওয়াশিংটন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *