রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) – বাংলার বিদ্রোহী কবি

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) – বাংলার বিদ্রোহী কবি

ধূমকেতুর মহাবিস্ময় নিয়ে বাংলার কাব্যসাহিত্যের আকাশে যাঁর আবির্ভাব, যিনি রবীন্দ্রোত্তর কাব্যসাহিত্যে ঘটিয়েছিলেন রীতিমতো বিপ্লব, তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বাংলা) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। পিতা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। পরপর চার পুত্রের অকালমৃত্যুর পর কবির জন্ম। তাই মা অনেক দুঃখে পাওয়া ধন ছেলের নাম রেখেছিলেন দুখু মিয়া। কবির পারিবরিক অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না। পিতা ছিলেন স্থানীয় মাজার এবং মসজিদের খেদমতগার। মাত্র আট বছর বয়সে নজরুল পিতৃহীন হন। ফলে তাঁদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। গ্রামের মক্তব থেকেই নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন (১৩১৬) তিনি। পিতার মৃত্যুর পর তাঁকে ছাড়তে হয় লেখাপড়া।

এই সময় তিনি মাত্র বারো বছর বয়সে যোগ দেন লেটো গানের দলে। তখন গ্রামের মুরুব্বিরা কবিকে রানীগঞ্জের শিয়ারশোল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু স্কুলের চারদেয়ালের গণ্ডি এবং তার বাঁধাধরা নিয়মনীতি তাঁর সহ্য হলো না। কবি একদিন স্কুল ছেড়ে উধাও হলেন।

স্কুল ছেড়ে আসানসোলে এসে এক রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি নেন তিনি। এখানে তাঁকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কবি-প্রতিভা ছিল নজরুলের আজন্ম। লেটোর দলে থাকতেই তিনি মুখে-মুখে গান তৈরি করে দিতেন। রুটির আটা মাখতে মাখতেই তিনি সঙ্গীদের মনে আনন্দ দেওয়ার জন্য গাইতেন :

ঘামেতে ভিজলো আমার গা-টা মাখতে মাখতে গমের আটা। এই রুটির দোকানের পাশের বাড়িতেই থাকতেন আসানসোল থানার দারোগা কাজী রফিজউদ্দিন। দারোগা কবির কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের বাড়ি ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে এনে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু এখানেও কবি বেশিদিন টিকতে পারলেন না। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর পরই স্কুল থেকে পালিয়ে যান। ঠিক এই সময়ই বেধে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ সরকার তখন যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য সৈন্যদলে নতুন লোক ভর্তি করছিল।

একদিন কবি কাউকে কিছু না বলে সোজা গিয়ে নাম লেখান ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। সালটা ১৯১৭। পরে তিনি বাঙালি রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে উন্নীত হন।

কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও তিনি কাব্যচর্চা ছাড়েননি। এই সময়েই রচিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকথা’, এবং মুক্তি’, ‘স্বামীহারা’, ‘ব্যথার দান’ ও ‘হেনা’ নামের অন্যান্য গল্প। এ ছাড়া তাঁর ‘রিক্তের বেদন’ গ্রন্থের গল্পগুলোও এই সময়েরই রচনা।

সওগাতের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় (১৩২৬) তাঁর প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকথা’ প্রকাশিত হয়। এবছরই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘মুক্তি’ এবং সওগাতের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় প্রথম প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলো’।

যুদ্ধ থেমে গেলে কবি দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় তাঁর একনিষ্ঠ কাব্যচর্চার জীবন। বাংলা ১৩২৭ সালে কবি মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় মোসলেম ভারত’ পত্রিকা। কবি এই পত্রিকার সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। তাঁর একের পর এক গল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে এই পত্রিকায়।

১৯২০ সালের শুরুতে বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হলে তিনি করাচি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে আশ্রয় নেন।

সেসময় দেশে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২) চলছিল। সেই অগ্নিঝরা আন্দোলনের পটভূমিকায় পূর্ণোদ্যমে চলতে থাকে নজরুলের একাগ্র সাহিত্য সাধনা।

১৯২১ সালে কবি কুমিল্লার আলী আকবরের সাথে তাঁদের বাড়িতে আসেন। এখানেই তিনি আলী আকবরের ভাগিনী নার্গিস আরা খানমকে বিয়ে করেন। কিন্তু এ বিয়ে সুখের হয়নি। তিনি বিয়ের রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে আসেন।

১৯২১ সালে রচিত হয় কবির চিরস্মরণীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’, যাতে যিনি ঘোষণা করেন-

বল বীর—
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর—
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সুর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক-দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর
আমি চির-উন্নত মম শির!

কবিতাটি প্রথম মুদ্রিত হয় বাংলা ১৩২৮ সালের কার্তিক সংখ্যায় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। প্রকাশ হওয়া মাত্রই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। কোনো একটিমাত্র কবিতাকে কেন্দ্র করে এমন অকুণ্ঠ প্রশংসা ও নিন্দা প্রাপ্তির ঘটনা বাংলা সাহিত্যে অন্য আর কোনো কবির ভাগ্যের ঘটেনি।

কবি ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট তারিখে প্রকাশ করেন অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’। এই পত্রিকাতেই ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতাটি। এই কবিতার জন্যই তিনি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর রুদ্ররোষে পতিত হন এবং রাজদ্রোহের অভিযোগে কারারুদ্ধ হন। কারাগারে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কোরাস গান—’শিকল পরার গান’।

হুগলী জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালে কয়েদিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের প্রতিবাদে কবি অনশন ধর্মঘট পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম ও পত্র প্রেরণ করেন। প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন সেটা ছিল এরকম : Give up hunger strike our literature claims you। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ সেই টেলিগ্রাম নজরুলকে দেননি। তারা Addresee not found সিল মেরে রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রামটি কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। অবশেষে কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে ৩৯ দিন পরে কবি অনশন ভঙ্গ করেন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘অগ্নিবীণা’। কবি জেলে থাকতেই প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। তিনি জেল থেকে ছাড়া পান ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বছরই তাঁর জীবনে ঘটে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি প্রমীলা সেনগুপ্তের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর কবি সস্ত্রীক হুগলিতে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।

১৯২৫ সালে তিনি ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে গান্ধীজীর সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটে। নজরুলের কণ্ঠে তাঁর চরকার গান শুনে গান্ধীজী মুগ্ধ হন। এরপর কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন মজুর স্বরাজ পার্টির (১৯২৫) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নজরুল। একই বছর তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫) পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯২৬-এর ২ এপ্রিল রাজরাজেশ্বরী মিছিলকে কেন্দ্র করে কলকাতায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যায়। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে তিনি ঘৃণা আর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি কামনা করে ‘লাঙল’ পত্রিকায় অগ্নিবর্ষী প্রবন্ধ, গান ও কবিতা প্রকাশ করেন। একই বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুর থেকে বঙ্গীয় বিধান সভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তমিজুদ্দীন খানের কাছে হেরে যান।

১৯২৬ সাল থেকে কবি গান-রচনায় মেতে ওঠেন। চলতে থাকে অজস্র ধারায় গান রচনার পালা।

কবি প্রথমবার ঢাকায় আসেন ১৯২৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় বার আসেন ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে। সাহিত্যসমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অনুষ্ঠানে গেয়ে শোনান তাঁর অতিবিখ্যাত ‘চল, চল চল’ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটি, যেটি বর্তমানে আমাদের দেশের রণসঙ্গীতের মর্যাদার অধিকারী।

কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা ও গানের সংকলন ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। এই সময় নজরুলের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী।

ইতিমধ্যেই কবির জীবনে নেমে আসে পরপর কয়েকটি দুর্যোগ। আর্থিক অনটন তো ছিলই, প্রথম পুত্র আজাদ কামালের অকালমৃত্যু হয়, ১৯৩০ সালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল। এ মৃত্যু তাঁর মনে দারুণ আঘাত হানে।

১৯২৯ সালেই গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে কবির যোগাযোগ হয়েছিল, পরে ১৯৩৫ সালে তিনি কোম্পানির এক্সক্লুসিভ কমপোজার নিযুক্ত হন।

১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে দেয়া হয় ব্যাপক সংবর্ধনা। সংবর্ধনা সভায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে প্রতিভাবান বাঙালি কবি বলে আখ্যায়িত করেন। একই সভায় সুভাষচন্দ্র বসু কবিকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলেন, আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।

‘প্রলয় শিখা’ কাব্যগ্রন্থে রাজদ্রোহমূলক কবিতা থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করা হলে আদালত তাঁকে ছয়মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে। ১৯৩১ সালের ৪ মার্চ গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে জেল খাটার দায় থেকে তিনি মুক্তি পান।

১৯৩১ সাল থেকে কবি চলচ্চিত্র ও রঙ্গমঞ্চের সাথেও জড়িয়ে পড়েন। তাঁর ‘আলেয়া’ নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৩৩৮ সালের ৩ পৌষ এবং ‘ধ্রুব’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি। এই ছবিতে তিনি সঙ্গীত রচনা ও পরিচালনা ছাড়াও নারদের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন।

১৯৪০ সালে স্ত্রী প্রামীলা নজরুল আক্রান্ত হন পক্ষাগাত রোগে। এর মাত্র দুবছর পর ১৯৪২ সালে ১০ই জুলাই থেকে কবি নিজেও পিস্‌ ডিজিস নামে দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন চিরদিনের জন্য। বিদেশে পাঠিয়েও কবিকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রমহান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টায় নির্বাক কবি ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবদান অনন্য সাধারণ। বাংলা কাব্য-জগতে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে খ্যাত। রবীন্দ্রযুগে যেসব কবি রবীন্দ্র প্রভাব অতিক্রম করে স্বাধীনভাবে কবিতা রচনা করে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তাঁর স্থান শীর্ষে। জনপ্রিয়তার আলোকে রবীন্দ্রনাথের পরই নজরুলের স্থান।

‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘জিঞ্জির’ (১৯২৮), ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) ও ‘প্রলয়-শিখা’ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থে কবির বিদ্রোহীরূপ পরিস্ফুট।

পৌরুষ ও শক্তির চিত্তচাঞ্চল্যে, জগচেতনা ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় স্বজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহায়, মানবতা ও সাম্যবাদের বাণী বিন্যাসকাব্যের কবিতাবলী সমুজ্জল।

‘রুদ্রবীণা’র ঝঙ্কারময় কবিতার পাশাপাশি তিনি কোমল-মধুর মানবিক প্রেমের কবিতাও রচনা করেন। ‘দোলন চাঁপা’ (১৯২৩), ‘ছায়ানট’ (১৯২৪), ‘পূবের হাওয়া’ (১৯২৫), ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ (১৯২৭) এবং ‘চক্রবাক’ (১৯২৯) কাব্যে নজরুলের প্রেমিকরূপ প্রকাশ পায়। ‘মরু-ভাস্কর’ (১৯৫৭) তার আরেকটি বিশেষ কাব্যগ্রন্থ। ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬) ও ‘সাতভাই চম্পা’ ছোটদের কবিতা গ্রন্থ।

তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ‘বাঁধনহারা’ (১৯২৭), ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (১৯৩০) এবং ‘কুহেলিকা’ (১৯৩১) তাঁর উপন্যাস। ‘ব্যথার দান’ (১৯২২), ‘রিক্তের বেদন’ (১৯২৫) ও ‘শিউলিমালা’ (১৯৩১) গল্পগ্রন্থ। তিনি ‘ঝিলিমিলি’ (১৯৩০), ‘আলেয়া’ (১৯৩১) ও ‘মধুমালা’ (১৯৫৯) নামে তিনটি নাটক রচনা করেন। ‘যুগবাণী’ (১৯২২), ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ (১৯২৩), ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬) ও ‘রুদ্রমঙ্গল’ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ।

গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসেবেও তিনি কিংবদন্তিতুল্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। দেশাত্মবোধক গান, কোরাস গান, প্রেম সঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামি সঙ্গীত, পল্লীগীতি ও হাসির গানের তিনি ছিলেন দক্ষ স্রষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর দেশাত্মবোধক গান ছিল মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস। ‘বুলবুল’ (প্রথম খণ্ড ১৯২৮, ২য় খণ্ড ১৯৫২), ‘চোখের চাতক’ (১৯২৯), ‘চন্দ্রবিন্দু’ (২য় সংস্করণ ১৯৪৬), ‘নজরুলগীতিকা’ (১৯৩০), ‘নজরুল স্মরণিকা’ (১৯৩১), ‘সুরকাসী’ (১৯৩১), ‘জুলফিকার’ (১৯৩২), ‘বনগীতি’ (১৯৩২), ‘গুলবাগিচা’ (১৯৩৩), ‘গীতিশতদল’ (১৯৩৪), ‘স্বরলিপি’ (১৯৩৪), ‘সুর-মুকুর’ (১৯৩৪) ও ‘গানের মালা’ (১৯৩৪) তাঁর রচিত সঙ্গীত গ্রন্থাবলি।

তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘যুগবাণী’ ও ‘চন্দ্ৰবিন্দু’ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক জগত্তারিনী স্বর্ণপদক (১৯৪৫), ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ (১৯৬০), রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি-লিট (১৯৬৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি-লিট (১৯৭৪) ও বাংলদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক (১৯৭৬) প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

1 Comment
Collapse Comments
হারুন-অর-রশিদ July 23, 2023 at 3:33 am

আমাৱ প্ৰিয় কবি, জাতীয় কবি, বিদ্ৰোহী কবি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *