রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

জুল ভের্ন (১৮২৮–১৯০৫) – কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর স্রষ্টা

জুল ভের্ন (১৮২৮–১৯০৫) – কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর স্রষ্টা

উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অর্ধ শতাব্দীকাল আগেই যিনি হেলিকপ্টারের কথা বলেছিলেন, রেডিও আবিষ্কারেরও বহু আগেই যে-ব্যক্তি টেলিভিশনের কথা কল্পনা করেছিলেন, যেকালে চাঁদে যাবার কথাও কেউ চিন্তা করতে পারেননি, সেই তখন যিনি মানুষের চাঁদের বুকে বসতি স্থাপনের কথা বলেছিলেন, অথচ যিনি নিজে ছিলেন এক ঘরকুনো মানুষ—কল্পবিজ্ঞানের ওপর বিশ্বের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক সাড়াজাগানো গ্রন্থসমূহের সেই বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি লেখকের নাম জুল ভের্ন (Jule Verne)।

জুল ভেরে ছিল আশ্চর্য কল্পনাশক্তি। যেসব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত যার সম্পর্কে তখনও কোনো কল্পনাই করতে পারেননি, তখনই তিনি সেসব বস্তুর কথা বলে গেছেন এবং এমন নিখুঁতভাবে বলে গেছেন, যা পড়ে মনে হয়, হয়তো তিনি নিজেই সেসবের আবিষ্কারক।

তিনি আদৌ কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। আর যেসব কল্পকাহিনীর তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, সে সম্পর্কেও তাঁর কোনো বাস্তব ধারণা ছিল না। অথচ তাঁর কল্পকাহিনী সবগুলোই পরবর্তীকালে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে এবং আরও আশ্চর্যে ব্যাপার এই যে, তিনি যেভাবে কল্পনা করেছেন, জিনিসগুলো হুবহু তেমনিভাবেই রূপ লাভ করেছে। পরবর্তীকালে যেসব বিজ্ঞানী এগুলো আবিষ্কার করেছেন, তাঁরাও স্বীকার করেছেন যে, তাঁরা এই বস্তুটির আবিষ্কার সম্পর্কে জুল ভের্নের কল্পনা দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

বিখ্যাত বেতার আবিষ্কারক মার্কনি, সাবমেরিনের জনক সাইমন লেক, বেলুনিস্ট এবং ডিপ সি আবিষ্কারক অগাস্ট পিকার্ড, এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেছেন যে, জুল ভেই তাঁদের এসব আবিষ্কার করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।

এমনকি ফ্রান্সের বিখ্যাত মার্শাল লিয়াওটি বলেছেন, জুল ভের্ন যা তাঁর লেখার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, তা-ই পরবর্তীকালে পরিণতরূপে বাস্তবতার মুখ দেখেছে।

জুল ভের্নের নায়কেরা সাবমেরিন নিয়ে প্রবেশ করেছেন পাতালে, উড়ে গেছেন আকাশযানে চড়ে চাঁদের বুকে, যাত্রা করেছেন কত দুর্গম পথে; কিন্তু যিনি এসব দুঃসাহসিক অভিযানের কল্পনাকারী, তিনি সারাজীবনে কখনও ঘর থেকেই বের হননি। জীবনের চল্লিশটি বছরই কাটিয়েছেন বাড়ির একটি চিলেকোঠায়।

এই আশ্চর্য মানুষ জুল ভের্নের জন্ম ১৮২৮ সালে ফ্রান্সের নাঁতেস-এ। বাবা ছিলেন আইনজীবী। তাই তাঁর ইচ্ছে ছিল, তাঁর ছেলেও আইনব্যবসা করে দুপয়সা আয় করতে শিখুক, সুখে থাকবে।

কিন্তু জুল ভের্নের আইন পড়ার দিকে তেমন আগ্রহ ছিল না। আইন পড়ার চেয়ে তিনি মনোযোগ বেশি দিতেন বেশি সাহিত্যচর্চার দিকে। এতে বাবা ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে অপদার্থ ছেলের মাসিক ভাতা দিলেন বন্ধ করে। এ ছাড়া সেই অল্প বয়সেই তিনি মামাত বোন ক্যারোলিনের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিলেন, এ ঘটনাও তাঁর বাবা একদম পছন্দ করেননি।

এই অবস্থায় জুল ভের্ন আর কী করবেন, পেট চালানোর জন্য একটা থিয়েটারে কাজ জুটিয়ে নিলেন। পরে তিনি কাজ নেন এক কোম্পানির কাগজের দালালির।

একদিকে চলছিল দালালি, আর অন্যদিকে লেখার কাজ। তিনি তখন থেকেই বাস করতেন এক নির্জন চিলেকোঠায়, সেখানেই চলত তাঁর লেখালেখির কাজ।

সাহিত্যসাধনায় একান্ত নিমগ্ন থাকলেও ভাগ্য সহজে সুপ্রসন্ন হয়নি তাঁর। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ’ (Five weeks in a ballon)-র পাণ্ডুলিপি নিয়ে শুরু হলো প্রকাশকের দুয়ারে ঘোরাঘুরি। কিন্তু কেউ তাঁর এই উদ্ভট কাহিনী ছাপতে চাইলেন না। একে একে পনেরো জন প্রকাশক ফিরিয়ে দিলেন তাঁর পাণ্ডুলিপি।

এরপর প্রচণ্ড অভিমানে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পাণ্ডুলিপিটি পুড়িয়ে ফেলতে ছুঁড়ে দিলেন জ্বলন্ত আগুনে। কিন্তু রক্ষা করলেন তাঁর স্ত্রী। স্বামীকে সন্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, অন্তত আরেকজন প্রকাশককে দেখাও।

অবশেষে স্ত্রীর কথাই সত্যি হলো। বইটি ষোড়শতম প্রকাশক ছাপতে রাজি হলেন। এবং প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল অবিশ্বাস্য রকমের কাটতি। পেল বছরের বেস্ট সেলারের মর্যাদা। শুরু হলো অন্য ভাষায় বইটির অনুবাদের কাজ। ফলে জুল ভেরে সাহিত্যখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

এবার প্রকাশক নিজেই গদগদ হয়ে এগিয়ে এসে চুক্তি করলেন লেখকের সঙ্গে। কথা হল—জুল ভেন্ প্রতি বছর অন্তত দুখানা করে পাণ্ডুলিপি তাঁকে দেবেন।

এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে তিনি নিজের পুরনো দালালির ব্যবসা ছেড়ে শুরু করলেন একান্তমনে সাহিত্যসাধনা। টাকাও আসতে লাগল প্রচুর। কেটে গেল আর্থিক অনটন।

প্রকাশিত হলো তাঁর দ্বিতীয় বই ‘পাতাল অভিযান’ (A voyage to the center of the Earth). এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন, একটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে প্রবেশ করে একদল মানুষ কেমন দুঃসাহসিকভাবে পাতাল অভিযান সম্পন্ন করেছিলেন।

জুল ভের্নের হাতে তখন অনেক টাকা। তাই তিনি এবার চলে এলেন প্যারিস থেকে আমেরিকাতে। সেখানে এসে তৈরি করলেন সুন্দর এবং অনুপম স্থাপত্যশৈলীর একটি বাড়ি। প্রকাণ্ড এই বাড়িটির ওপরে ছিল একটি টাওয়ার। সেটা দেখতে ছিল অবিকল নাবিকদের কেবিনের মতো। আসলে সেটা ছিল একটা চিলেকোঠা। যে-চিলেকোঠায় তিনি আবদ্ধ থেকেছেন সারাটা জীবন। এটাও তার থেকে আলাদা ধরনের কিছু নয়। এখানেই চলতে থাকে তার লেখা আর পড়ার কাজ। এখানেই তিনি কাটিয়ে দেন তাঁর জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর।

জুল ভেরে জীবনের সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ’ (A round the world in 80 days)। এই বইটি যখন প্যারিসের ‘লা টেম্পস’ (La Temps) পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, তখন প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বইটির নায়ক বাজি ধরে সত্যি সত্যি ৮০ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবে কি না তা নিয়ে বহু পাঠকও বাজি ধরেছিল। জুল ভের্নের পাঠকদের এই প্রচণ্ড আগ্রহ ও উত্তেজনা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর নায়ক হাজার বিপদ অতিক্রম করে ৮০ দিনের মাত্র ৫ মিনিট বাকি থাকতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে বাজি জিতে যান।

জুল ভের্নের এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য ১৮৭২ সালে নিউ ইয়র্কের নেলি ব্লাই নামে একজন সাংবাদিকও বিশ্বভ্রমণে বের হন। তিনি জুল ভেরন রেকর্ড ভঙ্গ করে ৭২ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসেন। এরপর একজন ফরাসি সংবদাদাতা ৪৩ দিনে ভূ- প্রদক্ষিণ করেন।

জুল ভের্ন তাঁর ‘সাগরতলে’ (Twenty thousand leagues under the sea) গ্রন্থে নাটিলাস নামের যে সাবমেরিনটির কথা বলেছেন, তা ছিল বিদ্যুৎশক্তিচালিত, সে-বিদ্যুৎ সাগর তলদেশ থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করা হতো।

তারপর বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর যে-পারমাণাবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন তৈরি হয়, তার নামও রাখা হয় ‘নটিলাস’। আসলে জুল ভের্নের কল্পনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই এই বাস্তবের নাটিলাস তৈরি করা হয়েছিল।

তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম “দি ডিসকভারি অব দি আর্থ’ (The Discovery of the Earth), ‘মাইকেল স্ট্রোগোফ’ (Michael Strogoff), “দি সারভাইভারস অব দি চ্যান্সেলর’ (The Survivars of the Chancellor), ‘চাইল্ড অব দি ক্যাভার্ন’ (Child of the cavern), ‘দি বাগম’স ফাইভ হ্যান্ড্রেড মিলিয়নস’ (The Bagum’s Five Hundred Millions), ‘ক্যাস্‌ অব দি কারপেথিয়ানস’ (Castle of the Carpathians), ‘দি ফ্লোটিং আইল্যান্ড’ (The Floating Island), এবং ‘বিফোর দি ফ্ল্যাগ’ (Before the Flag) ইত্যাদি।

জুল ভে েশেষ জীবনটা খুব সুখের ছিল না। কারণ, বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে অবজ্ঞা করতেন। এর মূলে জুল ভেরে তাঁর সমকালীন লেখকদের তুলনায় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে পণ্ডিতেরা সহ্য করতে পারতেন না, যার জন্য তিনি এত বড় লেখক হওয়া সত্ত্বেও ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমির (French Academy) সদস্য মনোনীত হতে পারেননি।

১৯০৫ সালে বিশ্বের বিস্ময়কর সাহিত্যিক জুল ভের্নের মৃত্যু হয়। আজও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকু হ্রাস পায়নি। আজও তিনি বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *