রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) – মার্কিন সাহিত্যের যুগ-প্রবর্তক কবি

ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) – মার্কিন সাহিত্যের যুগ-প্রবর্তক কবি

কবি বা লেখক হিসেবে ওয়াল্ট হুইটম্যান (Walt Whitman) তখন একেবারেই নতুন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লীভস অব গ্রাস’ (Leaves of Grass) প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময় একজন লেখকের যা হয়, ওয়াল্ট হুইটম্যানেরও তা-ই হয়েছিল। কী হয় কে জানে? যদি কেউ পড়তে না চায়? যদি সমালোচকেরা ভাল চোখে না দেখেন? যদি বিক্রি না হয়—এই রকম ভাবনায় ভয়ানকভাবে আলোড়িত তিনি।

তিনি যা ভেবেছিলেন, সত্যি সত্যি তা-ই হলো। বইটির মোটেই কাটতি হল না। অবশেষে মর্মাহত হুইটম্যান বইগুলো সমালোচক ও লেখকদের কাছে সৌজন্য কপি হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। গ্রাহকেরা তো নিল না। লেখক আর সমালোচকেরা কী বলেন, এবার সেটাই দেখা যাক।

এর কয়েকদিন পরেই ঘটল বিস্ময়কর ঘটনা। যাঁদের কাছে তিনি বইটি পাঠিয়েছিলেন, সেইসব বিজ্ঞ মনীষীর কাছ থেকে আসতে থাকল অজস্র প্রশংসাপত্র। রাতারাতি হয়ে উঠলেন অবিস্মরণীয় খ্যাতির অধিকারী তিনি।

প্রশংসাকারীদের মধ্যে ছিলেন মনীষী রালফ এমারসন একজন। তিনি হুইটম্যানের এই গ্রন্থ পাঠ করে পঞ্চমুখে এর প্রশংসা করতে গিয়ে লিখলেন, “I find it the most extraordinary piece of wit and wisdom that America has yet contributed.”

হুইটম্যানের এই পাঠক-অবহেলিত গ্রন্থটিই হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম, যেটি সারাবিশ্বের এত অধিক সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। অবশ্য এর কারণও ছিল। বইটিরও মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর মানবিক মূল্যবোধ। হৃদয়ের চমৎকার অনুভূতি। মোট কথা, হুইটম্যানের ‘লিভস অব গ্রাস’ গ্রন্থে জীবনের প্রকৃত রূপটিই কবিতার পর কবিতার ভেতর দিয়ে ধরা পড়েছিল।

এই কাব্যের মূল্যবোধ সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল একটি ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনা। ১৮৬০-৬২ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের বিষাদময় চিত্র তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বচক্ষে।

এই যুদ্ধে আহতের আর্তনাদে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন, দুঃখ পেয়েছিলেন অত্যাচারীর উৎপীড়নে। তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সেই আর্ত- মানবতার সেবায়। মানুষের প্রতি মানুষের এই যে অত্যাচার আর উৎপীড়ন, মর্মান্তিক এইসব অনুভূতিই বিধৃত হয়েছে ‘লিভস্ অব গ্রাস’-এর কবিতার ছত্রে ছত্রে।

ভয়াবহ যুদ্ধের নির্মম বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে হুইটম্যানের আরও কয়েকটি গ্রন্থ আছে। এই সময়কার কাহিনী নিয়েই ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গদ্যগ্রন্থ ‘মেমোরেন্ডাম ডিউরিং দা ওয়ার’ (Memorandum during the war)। একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ড্রামস ট্যাপস’ (Drums Tapes) গ্রন্থ। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “লিভস অব গ্রাস’। পাঠক সমাদর না পেলেও যখন সুধী সমাজ কর্তৃক প্রশংসিত হতে থাকে, তখনই বইটি সম্পর্কে পাঠকদেরও কৌতূহল বেড়ে যায়। বৃদ্ধি পেতে থাকে এর পাঠকসংখ্যা। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় এর প্রথম সংস্করণ। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় অচিরকালের মধ্যেই। আর এমনই করেই গ্রন্থটি বিশ্বজুড়ে অর্জন করে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা।

কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সম্পর্কে পাঠকসমাজে কিছু ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়। তিনি আমেরিকানদের কাছে চরমপন্থি কবি বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এর ফলে তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বে কমিউনিস্ট কবি বলেও সমালোচিত হতে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। কমিউনিজমের সাথে তাঁর কোনো সংশ্রবও ছিল না। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন নির্যাতিত মানবতা ও সাম্যের পক্ষে।

বিশ্বমুখী প্রেমই আসলে হুইটম্যানকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। হৃদয়ে ছিল তাঁর অগাধ প্রেম আর ভালবাসা। সবার জন্য ভালবাসা। সেখানে কোনো সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো স্থান ছিল না। শুধু ছিল আর্তমানবতার প্রতি মমত্ববোধ।

তাঁর আরেকটি গদ্যরচনা ‘স্পেসিমেন ডেজ অ্যান্ড কালেক্ট’-ও (Specimen days and collect) দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

কবি হুইটম্যানের শেষ দিনগুলো তেমন সুখের ছিল না। ১৮৭০ সালের দিকেই তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। চারদিক থেকে অভাব-অনটন আর হতাশা ঘিরে ধরে কবিকে। সেই পঙ্গু অবস্থাতেও তাঁকে অর্থোপার্জনের জন্য চেষ্টা করে যেতে হয়।

১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গদ্যসমগ্র (Complete Prose)। এ বছরই তিনি ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নিউ জার্সি রাজ্যের ক্যাম্পডেন শহরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

এমনিতেও হুইটম্যান সারাজীবনই অর্থকষ্টে ছিলেন। তাঁর পারিবারিক অবস্থা কখনওই খুব একটা ভালো ছিল না। বাল্যে মাত্র ১১ বছর বয়সেই স্কুলের পড়া ছেড়ে তাঁকে এক ডাক্তারের বাড়িতে গৃহভৃত্যের চাকরি নিতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি টিকতে পারেননি সেখানে। পরে এক প্রেসে চাকরি করেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু সেখানেও সফল হতে পারেননি। সেখান থেকে চাকরি নেন এক অফিসে, সেখানে গিয়েই তিনি ‘লিভস অব গ্রাস’ প্রকাশ করেন।

তিনি বইটির একটি কপি পড়ে দেখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেন। পরের দিনই কর্মকর্তা তাঁকে ডেকে পাঠান। না, বই পড়ে তিনি খুশি হননি বা তাঁর প্রশংসাও করেননি। তিনি বরং ভয়ানক রেগে গিয়েছিলেন।

বইটিতে মানবতার ও সাম্যনীতির কথা ছিল। এতেই কর্মকর্তা মনে করেছিলেন হুইটম্যান নিশ্চয়ই কম্যুনিস্ট দলের লোক। আমেরিকার পুঁজিবাদী সমাজে বিশেষ করে তাঁরই অফিসে কমিউনিস্ট গুপ্তচরের অনুপ্রবেশ—ব্যাপারটাকে তিনি সুনজরে দেখতে পারেননি। তাই তখনি তাঁকে বের করে দেন অফিস থেকে।

এখান থেকে চাকরি যাওয়ার পর তিনি বেছে নেন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকতার পেশা। সেইসাথে শুরু করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা। এমন করেই তাঁকে সারাজীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে অভাবের সাথে।

তিনি জীবনে কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। স্থির হয়ে বসতে পারেননি। তিনি লেখক হিসেবে ছিলেন সফল কিন্তু কর্মজীবনে ছিলেন এক ব্যর্থ মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *