রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

লর্ড বায়রন (১৭৮৮–১৮২৪) – ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি

লর্ড বায়রন (১৭৮৮–১৮২৪) – ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি

লর্ড বায়রন ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কবিতার প্রভাবে তার সমকালীন সাহিত্য অঙ্গনে বিদ্যমান যাবতীয় পুরনো কাব্যিক রীতি আমূল বদলে গিয়েছিল। তাঁর সাহিত্য ছিল প্রচণ্ড আবেগময় এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধর্মী

তাঁরপুরো নাম লর্ড জর্জ গর্ডন নোয়েল বায়রন (Lord George Gordon Noel Byron)।

তাঁর জন্ম ১৭৮৮ সালে লন্ডনে। তাঁর জীবন ছিল খুবই বৈচিত্র্যময়। অনেকটা উচ্ছৃঙ্খল, কিছুটা খ্যাপাটে এবং রহস্যময়। আরেক অদ্ভুত ব্যাপার ছিল তাঁর, তিনি প্রেম করে বেড়াতেন ডজন ডজন সুন্দরী মেয়ের সাথে। এসব মেয়ের মধ্যে নাকি তাঁর নিজের একজন সৎবোনও ছিলেন। সৎবোনের সাথে তাঁর প্রেম ঘটনা নিয়ে চারদিকে পড়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড ছি ছি। এই অবৈধ প্রেম তাঁর নিজের জীবনটাকেই ওলটপালট করে দিয়েছিল। বোনের প্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর তাঁর উদ্দেশে তিনি রচনা করেছিলেন একটি কবিতা, যেটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।

মজার ব্যাপর হলো, বায়রনের নামে এই অবৈধ প্রেমের কুৎসা যতই রটনা হতে লাগল তাঁর প্রেমিকার সংখ্যাও। অগণিত মহিলা তাঁকে পাগলের মতো ভালবাসতে লাগল। শোনা যায়, অবশেষে স্বামীর এই প্রেমিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্ত্রী নিজেই তাঁকে তালাক দিয়ে চলে যান। তখন ইউরোপের সমস্ত মহিলা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর নামে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে লেগে গেল। অথচ এরাই তাঁকে প্রতিদিন প্রেমপত্র দিত, চুলের গোছা এবং অন্যান্য উপহার পাঠাত

একবার এক মহিলা বায়রনকে প্রেম নিবেদন করার জন্য এবং তাঁর নাগাল পাবার জন্য বালকের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন। আরেক প্রেমপাগলিনী মহিলার মাথা এমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি ইংল্যান্ড থেকে ইতালি পর্যন্ত গোটা পথটাই তাঁর পেছনে পেছনে ছুটে এসেছিলেন এবং এমনভাবে বায়রনকে চেপে ধরেছিলেন যে, তাঁকে বাধ্য হয়ে হার মানতে হয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই যে দুনিয়াসুদ্ধ মেয়ে লর্ড বায়রনের সাথে প্রেম করতে ছুটে আসতেন, তাহলে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? নিশ্চয়ই দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলেন?

আসলে লর্ড বায়রন দেখতে মোটেও সুপুরুষ ছিলেন না। তিনি বিশ্রীভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। একটা পা ছিল বিকৃত। আর বদঅভ্যাসের মধ্যে ছিল সবসময় আঙুলের নখ আর তামাক পাতা চিবোনো। কেউ তাঁর দিকে তাকালেই ভয়ানক রেগে যেতেন। তাঁর মনে হত, লোকটা হয়তো তাঁর বিকৃত পা নিয়ে উপহাস করছে।

মেজাজটাও ছিল তিরিক্ষি। যখন-তখন হাতে গুলিভরা পিস্তল নিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে ঘুরে বেড়াতেন। এই যে মেয়েরা তাঁর পেছনে ছুটত, তবু তিনি কিন্তু মেয়েদের দেখতে পারতেন না। তাদের ওপর অকারণে অত্যাচার করতেন। যেমন, বিয়ের মাত্র দুঘণ্টা পরই নববধূকে তিনি বলেছিলেন, দ্যাখো, তোমাকে আমি ঘৃণা করি আর ঘৃণা করি বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি। এটা শুধু তাঁর মুখের খেয়ালি কথা ছিল না, এ ছিল তাঁর অন্তরেরও কথা। তাঁদের বিয়ের শর্তাবলি তিনি এক বছরের মধ্যেই ভঙ্গ করেছিলেন। স্ত্রীর গায়ে অবশ্য তিনি হাত দেননি, কিন্তু যখন-তখন প্রেমিকাদের নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। শেষে তাঁর স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্বামীর মাথায় গোলমাল হয়েছে ভেবে ডাক্তার ডেকে এনেছিলেন তাঁকে দেখানোর জন্য।

লর্ড বায়রনের বাড়িতে সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী এবং মিষ্টি স্বভাবের অনেক যুবতী পরিচারিকা ছিল। তিনি যখন বন্ধুদের নিয়ে ঘরে বসে আড্ডা দিতেন, তখন এই সুন্দরী সেবাদাসীরাই তাঁদেরকে মদ পরিবেশন করত। সেও আবার যেমন-তেমন ভাবে নয়, মৃত মানুষের মাথার খুলিতে করে মদ্য পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দিত। এটা ছিল কবির খেয়াল।

বায়রনের চেহারা ছিল একহারা গড়নের। তাঁর গায়ের চামড়া ছিল ধবধবে সাদা। তাঁর প্রেমিকারা প্রশংসা করে বলত, তিনি একটা সুন্দর কারুকাজ করা উজ্জ্বল অ্যালবাস্টারের পাত্র।

তিনি নিজের স্বাস্থ্যকে অর্থাৎ এই একহারা গঠনকে ধরে রাখার জন্য ডায়েটিং বা খাবার নিয়ন্ত্রণ করতেন। খাবার খেতেন খুবই কম। দিনে একবার মাত্র ভিনিগার ছিটানো আলু বা মাঝেমধ্যে রুচি পরিবর্তনের জন্য শুকনো বিস্কুট চিবোতেন। অথবা পান করতেন এক গ্লাস সোডা। শরীরের মেদ কমানোর জন্য তিনি তরবারি যুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, ঘোড়ায় চড়া এবং সাঁতার কাটা অভ্যাস করতেন। তাঁর অদ্ভুত রকমের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তাঁর অনেক ক্ষতিও করেছিল। তাঁর খিদে পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছিল, যার জন্য তাঁকে প্রচুর ওষুধ খেতে হতো। ওষুধ খেতে খেতে গোটা ঘরখানাকে যেন ওষুধের শিশি- বোতল সাজানো দোকান বানিয়ে ফেলেছিলেন।

বায়রনের আরেকটা ব্যাপার ছিল। তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নানা রকমের দুঃস্বপ্ন দেখতেন। আর তাই সবসময় বিছানার পাশে দুটো গুলিভরা পিস্তল রাখতেন। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে তিনি ভয়ানক চিৎকার করে জেগে উঠতেন। দাঁত কড়মড় করতেন। আর তার পরই মাতালের মতো গুলিভরা পিস্তল দুটো দুহাতে চেপে ধরে ঘরময় ছুটে বেড়াতেন।

বায়রন যে-পুরনো বাড়িটায় থাকতেন এবং এ ধরনের ভয়ানক স্বপ্ন দেখতেন, সেখানে নাকি প্রতি রাতে এক সন্ন্যাসীর প্রেতাত্মা আসত। সন্ন্যাসী নাকি যখন জীবিত ছিলেন, তখন এ বাড়িতেই বাস করতেন। বায়রন এই ঘটনা সম্পর্কে শপথ করে বলেছিলেন সে, ওই প্রেতাত্মা প্রতি রাতেই কালো আলখেল্লা পরে এসে ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। তারপর একসময় গম্ভীর আর ধীর পদবিক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে যেত।

লর্ড বায়রনের জীবনের আর একটি অলৌকিক ঘটনা ছিল কবি শেলি সম্পর্কে তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী।

তিনি একবার ইতালিতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে শপথ করে বলেছিলেন যে, তিনি বিখ্যাত কবি শেলির প্রেতাত্মাকে একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছেন।

কৌতূহলের ব্যাপার হলো, তখনও কবি শেলি ব্রিটেনে বহাল তবিয়তে জীবিত আছেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বায়রন এই উক্তি করার অল্প কিছুকালের মধ্যেই কবি শেলি সত্যি সত্যি মারা যান এক দুর্ঘটনায় পড়ে। এই খবর শুনে লর্ড বায়রন খুব ব্যথিত হন। তিনি মনে করেন, হয়তো তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর মৃত্যু হয়েছে। আর তাই তিনি নিজে এসে শেলির মৃতদেহ কবর না দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন।

এ-ধরনের একটি ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কেও ছিল। একবার এক যাযাবর জ্যোতিষী তাঁর হাত দেখে আর রাশি গণনা করে বলেছিলেন, লর্ড বায়রন ছত্রিশ বছর বয়সে মারা যাবেন। হয়েছিলও তাই। তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিবসের মাত্র তিন মাস পরেই সত্যি সত্যি তিনি মারা যান। বায়রনের মৃত্যু হয় ১৮২৪ সালে। তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিবসের মাত্র মাস কয়েক পরে মিসলংহি নামক স্থানে তিনি মারা যান।

তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, এই ছত্রিশ বছর বয়সের অভিশাপ তাঁর গোটা পরিবারেই আছে। ছত্রিশতম জন্মদিনটা হল তাঁর বংশের লোকদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। তাঁর এই কথা হয়তো সত্যি। কারণ, তাঁর বাবাও মারা গিয়েছিলেন ছত্রিশ বছর বয়সে। তারপর তাঁর মেয়ে, যাঁর জীবনটাও ছিল অবিকল তাঁর বাবার মতোই। তিনিও মারা গিয়েছিলেন ছত্রিশ পার হবার সামান্য আগে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ (Childe Harold’s Pilgrimage), ‘ডন জুয়ান’ (Don Juan), ‘প্রিজনার অব চিলন’ (Prisoner of Chillon) এবং ‘গিয়াউর’ (Giaour) ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *