রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

শেকসপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) – বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী নাট্যকার

শেকসপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) – বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী নাট্যকার

বিশ্বাসাহিত্যে আজও যিনি সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং অমর নাট্যকার ও কবি, সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব, সেই উইলিয়াম শেক্‌স্‌পিয়রকেই (William Shakespeare) বাল্যকালে পড়াশোনায় উদাসীন দেখে তাঁর শিক্ষক বলেছিলেন, বাবা, তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। প্রাইমারি স্কুলের সেই উদাসীন ছেলেটিই পরবর্তীকালে শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নয়, সারা বিশ্বসাহিত্যেরও মুখোজ্জ্বল করে গিয়েছিলেন একাই।

উইলিয়াম শেকসপিয়ার সম্পর্কে ইংল্যান্ডের আরেক মনীষী টমাস কার্লাইলকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তিনি ব্রিটিশ সম্রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী উপনিবেশ ভারতবর্ষ এবং শেকসপিয়ার—এই দুটোর মধ্যে কোনটিকে বেছে নিতে চান।

তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই বলেছিলেন, ভারত সাম্রাজ্য না থাকে না থাক, শেকসপিয়ারকে ছেড়ে দিলে আমার কিছুতেই চলবে না।

শেকসপিয়ার সম্পর্কে আজ বিশ্বজনের অপূর্ব মূল্যায়ন এবং শ্রদ্ধা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তাঁর প্রতি এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতি কেউই মনোযোগ দেয়নি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরেও তাঁর নাম ছিল প্রায় অজ্ঞাত। তারপর তাঁর সম্পর্কে লাখো লাখো শব্দ রচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত যত লেখক হাঁসের পালকের কলম দিয়ে তাঁদের বিদ্যা শানিয়েছেন, তাঁদের সবার চেয়ে শেপিয়ারের ওপরই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

প্রতি বছর হাজার হাজার লোক তাঁর জন্মস্থানে যেন তীর্থদর্শনে যান। যে খোলা মাঠের ওপর দিয়ে আজ তাঁর অজস্র ভক্ত সমাধিতে যান, সেই মাঠেরই মধ্য দিয়ে এককালে এক বালক তাঁর বালিকাবন্ধুর কাছে ছুটে যেত। সেদিন বালক শেকসপিয়ার ভাবতেও পারেননি যে, শতশত বছর পরেও লোকজন তাঁর বন্দনায় মুখর হবে।

সেকালেও শেকসপিয়ার সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানত। এমনকি তাঁর সাহিত্য যখন প্রচুর জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে, তখনও তাঁর সম্পর্কে ছিল নানা ধরনের গুজব। এমনকি অনেকে সন্দেহ করতেন, শেকসপিয়ার হয়তো একজনমাত্র লোক ছিলেন না। সম্ভবত শেক্সপিয়ার বলে কোনো লোকই নেই। হয়তো অনেক লোক মিলে রচনা করেছেন এই চমৎকার নাটকগুলো।

আবার কেউ কেউ বলেছেন, হয়তো প্রখ্যাত কবি ফ্রান্সিস বেকনই ছদ্মনামে লিখেছেন এই নাটকগুলো, নইলে অমন সুন্দর সুন্দর কথা শেকসপিয়ার পাবেন কোথা থেকে?

কিন্তু একদিন এই সন্দেহের ধূম্রজাল কেটে গেল। বিশ্ববাসী সত্যের পরিষ্কার আলোতে দেখলেন, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, এসব অবিস্মরণীয় সাহিত্যকর্মের জন্মদাতা একজনই। তিনি আর কেউ নন, উইলিয়াম শেকসপিয়ার।

এমনি হাজারো কিংবদন্তির জন্মদাতা যে-শেকসপিয়ার, তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৫৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ইংল্যান্ডের এক ছোট্টো মফস্বল শহর স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভনে। পিতার নাম জন শেকসপিয়ার আর মায়ের নাম মেরি অর্ডেন।

এই স্ট্রাটফোর্ড শহরেই বাল্যজীবন কেটেছে তাঁর। সমবয়সী আর দু-পাঁচটা ছেলে- মেয়ের মতোই ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে-পথে। সাত বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখানে কাটে তাঁর আটটি বছর।

শেকসপিয়ার জীবনে তাঁর বিয়েটা ছিল খুবই দুঃখজনক। তিনি অ্যান ওয়েটলি নামে এক তরুণীকে ভালবাসতেন। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে বিয়ে করতে হয়েছিল তাঁর চেয়েও বয়সে আট বছরের বেশি বয়সী অন্য এক মহিলাকে। প্রথম থেকেই তাঁদের বিয়েটা পরিণত হয়েছিল একটা নিদারুণ প্রহসনে। তাই শেকসপিয়ার তাঁর অনেক নাটকে ছেলেদেরকে নিজের চেয়ে বেশি বয়সের মহিলাদের বিয়ে করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। বিয়ের অত্যল্পকাল পরেই তাঁদেরর ঘরে এক মেয়ের জন্ম হয়। তারপর যমজ ছেলে সন্তান।

প্রথম দিকে তাঁর অবস্থা ভালোই ছিল। পরে খারাপ হয়ে যায়। ফলে জীবিকার জন্য ঘর ছাড়তে হয় শেকসপিয়ারকে। তিনি লন্ডনে এসে ভিড়ে যান নাটকের দলে। তারপর বাদবাকি জীবন তাঁর কেটেছে রঙ্গমঞ্চের সাথে জড়িত থেকেই। তিনি অভিনয় করেছেন, নাটক লিখেছেন,. শেষে গ্লোব থিয়েটারের মালিকদের একজন হয়েছিলেন।

শেকসপিয়ার যেমন সেকালে সেরা অভিনেতাদের একজন ছিলেন, তেমনি নাটকও লিখতেন চমৎকার। তাই তিনি নাটক লিখিয়ে হিসেবে যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগলেন, তেমনি হয়ে উঠতে লাগলেন কারও কারও হিংসার পাত্রও। তখনকার দিনের একজন নাট্যকার শেষ বয়সে প্রচণ্ড ক্ষোভে আর হিংসায় বলেছিলেন, একটা ভুঁইফোঁড় কাক হঠাৎ উড়ে এসেছে। আমাদের কাছ থেকে ধার করা পালক যার গায়, সে ভেবেছে কবিতায় বাঘের মতো গর্জন করবে। এই ভুঁইফোঁড় কাকটি আর কেউ নন, স্বয়ং শেকসপিয়ার।

কিন্তু সেকালের সবচেয়ে জ্ঞানী নাট্যকার বেন জনসন কিন্তু তাঁকে হিংসা করেননি। প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠ। স্বয়ং রাজা জেও খুবই আদর করতেন তাঁকে।

একটানা এগারো বছর লন্ডনে কাটিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন নিজের শহর স্ট্র্যাটফোর্ডে। তখন হাতে অনেক টাকা। সে টাকা দিয়ে তিনি একটি সুন্দর বাড়ি কিনলেন। মস্ত বড় বাড়ি। এই বাড়ি দেখে লোকে ঠাট্টা করে বলত, নাটকে শেকসপিয়ার রাজা-মহারাজাদের সাথে কাঁধ ঘেঁষাঘেঁষি করেছেন, তাল দিয়ে চাল দিয়েছেন, তারপর দৌড়ে গেছেন নিজের জন্য একটা বাড়ি কিনতে।

স্ট্র্যাটফোর্ড ফিরে এলেও বছরের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে কাটাতে হতো লন্ডনে। সেখানকার নাট্যশালা ছিল তাঁর পেশা ও নেশার আলোকিত বেদিমূল।

শেকসপিয়ার যখন মারা যান, তখন সে সময়কার বিচারে তিনি একজন রীতিমতো ধনী ব্যক্তি। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে লন্ডনে। এখানে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে একজন অভিজ্ঞ অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। উপার্জন করতে থাকেন অর্থও।

তিনি দুটো থিয়েটারের শেয়ার ক্রয় করেন। চড়া সুদে টাকা খাটিয়ে প্রতি বছরে আয় করতে থাকেন প্রায় বিশ হাজার ডলার। কিন্তু তিনি তাঁর উইলে স্ত্রীর নামে একটি সেন্টও লিখে যাননি। তাঁর স্ত্রীর কপালে ছিল তাঁর বিষয়সম্পত্তির মধ্যে শুধু একটি বড় পালঙ্ক। তাও তিনি ওটা স্ত্রীর নামে লিখেছিলেন বেশ কয়েকবার ভাবনার পর। কারণ, কথাটা উইল শেষ করার পর কোনো এক লাইনের ফাঁকে লিখে দিয়েছিলেন।

শেপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর গত হয়ে যাওয়ার পর তাঁর নাটকগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়। এখন যদি কেউ নিউ ইয়র্ক গিয়ে শেপিয়ারের নাটকের প্রথম সংস্করণটি কিনতে চান, তা হলে তাঁকে সিকি মিলিয়ন ডলার মূল্য দিতে হবে। কিন্তু শেকসপিয়ার নিজেও সম্ভবত ‘কিং লিয়ার’, ‘হ্যামলেট’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর মতো নাটকগুলোর জন্য ছয়শো ডলারের বেশি রয়ালটি পাননি।

শেপিয়ারের মৃত্যু হয় ১৬১৬ সালে ২৩ এপ্রিল। নিজ গ্রামের ছোট্ট এক গির্জার সামনে ধর্মপ্রচারের বেদির পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এ-রকম পবিত্র জায়গায় সমাধিস্থ করার অর্থ তাঁর প্রতিভার প্রতি সকলের সম্মান প্রদর্শনের স্মারকস্বরূপ ঘটনা। কিন্তু শেপিয়ারের বেলায় ব্যাপারটি তা ছিল না। তাঁকে সমাধিদানকারী ব্যক্তিরা তখন জানতেন না যে, এই সমাধি এককালে লাখো ভক্তের তীর্থস্থান হয়ে উঠবে।

তাঁরা শেকসপিয়ারকে এখানে সমাধিস্থ করেছিলেন এজন্য যে, তিনি নিজের শহরটাকে টাকা ধার দিয়েছিলেন। যদি শাইলক চরিত্রের স্রষ্টা তাঁর নিজের শহরে টাকা ধার না দিতেন, তা হলে হয়তো কোনো নাম-পরিচয়হীন সমাধিতে তাঁর হাড়গুলো পচে- গলে যেত। মানুষজন তাঁর সন্ধানই পেত না। শেপিয়ারের সমাধি তা হলে আর তীর্থস্থান হয়ে উঠতে পারত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *