ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

মিকেলাঞ্জেলো (১৪৭৫–১৫৬৪) – পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর শিল্পী

মিকেলাঞ্জেলো (১৪৭৫–১৫৬৪) – পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর শিল্পী

পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে অর্থাৎ ইউরোপের রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের যুগে চিন্তা- চেতনার ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছিল, তাকেই ইতিহাসে উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন ধর্মান্ধতার প্রভাবমুক্ত হয়ে দর্শন, কৃষ্টি, কলা, বিজ্ঞান, স্থাপত্য ও শিল্প-ভাস্কর্য অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবদিকেই এ সময় ব্যাপক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছিলে। এই সন্ধিক্ষণেই শিল্পচেতনার অগ্রযাত্রায় লেওনার্দো দা ভিঞ্চির পরই উল্লেখ করতে হয় মিকেলাঞ্জেলোর (Michelangelo) নাম।

মিকেলাঞ্জেলোর জন্ম ১৪৭৫ সালের ৬ মার্চ ফ্লোরেন্সের ক্যাপরিশ নগরীর এক অভিজাত পরিবারে। বাবা চাইছিলেন তাঁর আর পাঁচটা ছেলের মতো আঞ্জেলোও লেখাপড়া শিখে রাজকার্জে আত্মনিয়োগ করুক, আর না হয় ব্যবসা-বাণিজ্য করে দুপয়সা উপার্জন করতে শিখুক। কিন্তু আঞ্জেলোর লেখাপড়া শেখার চেয়ে ছবি আঁকা আর কাদামাটি দিয়ে মূর্তি গড়ার দিকেই আগ্রহ ছিল বেশি। একটু ফাঁক পেলেই তিনি পটুয়াদের বা পাথর-কাটা মিস্ত্রিদের বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে কাজ করতে লেগে যেতেন। শেষ পর্যন্ত বাবা ছেলের ভবিষ্যৎ কর্মপথটা কী হবে, তা বুঝে নিতে সক্ষম হলেন।

এরপর থেকে অ্যাঞ্জেলোকে তাঁর নিজের পথেই পা বাড়াতে দিলেন তিনি। তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো ফ্লোরেন্সের এক খ্যাতনামা শিল্পী ঘাররডিওর স্টুডিওতে।

অ্যাঞ্জেলোর বাল্যকাল থেকেই ছিল শিল্পকর্মে অপূর্ব দক্ষ হাত। এই বালকের কাজ দেখে ঘাররন্ডিও নিজেও বিস্মিত হয়ে যেতেন। আঞ্জেলো যে-কোনো জিনিস অবিকল নকল করতে পারতেন।

বালক আঞ্জেলোর তৈরি একটি গ্রিক মূর্তির নকল দেখে তৎকালীন ফ্লোরেন্সের শাসনকর্তা লরেঞ্জো ডি মেডিসি মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে অ্যাঞ্জেলোকে তিনি পাঁচশো ডুকাট বেতন দিয়ে নিজের রাজপরিবারের সদস্য হিসাবে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে অ্যাঞ্জেলোও খুবই খুশি হয়েছিলেন।

এদিকে মেডিসি নিজেও ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের প্রতি উৎসাহী। তাঁর কাছে আসতেন দেশের অনেক জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত ব্যক্তি। এঁদের সাহচর্যে এসে অ্যাঞ্জেলোও দিনে দিনে শিক্ষাদীক্ষায় নিজের মনকে আলোকিত করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কপালে এত সুখ সইল না। লরেঞ্জো ডি মেডিসি মারা গেলেন। পরবর্তী মেডিসি হলেন পিয়েরো। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের প্রতি পিয়ারোর কোনো আগ্রহ ছিল না।

তাই রাজবাড়িতে অ্যাঞ্জেলোর আর থাকা হলো না। তিনি ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে গেলেন বলোনিয়ায়। এখানে এসে তিনি ছোটবড় কয়েকটি মূর্তি তৈরি করেন। এরপর পরই তাঁর ডাক এল রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জার পক্ষ থেকে। এখানেই তিনি তৈরি করলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য পিয়েটা (মা মেরির কোলে মৃত যিশুর মূর্তি), যা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য বলে পরিচিত। এই মূর্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, অনেক শিল্পীই মেরির কোলে শিশু যিশুর মূর্তি গড়েছেন বা ছবি এঁকেছেন, কিন্তু তিনি তৈরি করলেন যুবতী মা মেরির কোলে পূর্ণাবয়ব যিশুর মূর্তি। পরবর্তীকালে সমালোচকেরা এই মূর্তির নাম দিয়েছিলেন প্রস্তরীভূত অশ্রু বা জমে পাথর হয়ে যাওয়া চোখের জল। আজও দর্শকেরা এই মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে।

১৫০১ সালে মিকেলাঞ্জেলো এলেন ফ্লোরেন্সে। এখানে এসে তিনি তিন বছর খেটে তৈরি করলেন বিখ্যাত ডেভিড। এই সময়ই তাঁর সাথে পরিচয় হয় শিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চির। তবে দুঃখজনক হলো এঁরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। একজন ছিলেন আর একজনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।

ডেভিডের মূর্তি শেষ হবার পরই রোমের পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর নিজের জন্য ঐতিহ্যমণ্ডিত সমাধিস্তম্ভ তৈরি করার আদেশ দিলেন তাঁকে। শিল্পী এই স্তম্ভের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষও করেছিলেন, কিন্তু সমাধি আর তৈরি হয়নি। শিল্পীর প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুরা পোপকে বিভ্রান্ত করে এই কাজ দিলেন বন্ধ করে। এতে করে অ্যাঞ্জেলোর প্রচুর ক্ষতি হলো। তিনি মর্মাহত হয়ে ফিরে এলেন ফ্লোরেন্সে।

কিন্তু এর কিছুদিন পরই আবার পোপের পক্ষ থেকে ডেকে পাঠানো হলো শিল্পীকে। এবার পোপ এক অদ্ভুত কাজের ভার দিলেন তাঁকে। তাঁর ওপর আদেশ হলো ভ্যাটিক্যানের সিসটিন চ্যাপেলের ছাদ ও দেয়ালে ছবি আঁকতে হবে।

পুরো চার বছর অবিরাম কাজ করে অ্যাঞ্জেলো শেষ করলেন এই দুরূহ কাজটি। ১৫১২ সালে তা শেষ হলে সবাই দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। চিত্রশিল্পী রাফায়েল এই ছবি দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এ ছবি দেখার সৌভাগ্য থেকে তিনি আমাকে বঞ্চিত করেননি।

কিন্তু ছবি উচ্চপ্রশংসিত হলে কী হবে, শিল্পীর দুর্ভোগের শেষ হলো না। এই সময়ই পোপ জুলিয়াস মারা গেলেন। এর পর যিনি পোপ হয়ে এলেন, তিনি তাঁর কাজের মজুরি দিতে অস্বীকার করে বসলেন। ফলে শূন্য হাতে রোম থেকে ফ্লোরেন্সে ফিরে এলেন মিকেলাঞ্জেলো।

কিন্তু বছর কয়েক পরে আবার রোমের গির্জা থেকে এল কড়া আদেশ। সিসটিন চ্যাপেলের প্রার্থনাগৃহের দেয়ালে আঁকতে হবে পৃথিবীর বৃহত্তম ফ্রেস্কো ‘লাস্ট জাজমেন্ট’ বা শেষ বিচার।

শিল্পীর বয়স তখন ষাটের ওপরে। সেই বুড়ো বয়সেই তিনি আবারো অক্লান্ত পরিশ্রম করে দীর্ঘ পাঁচ বছরে শেষ করলেন বিশ্বের বিস্ময় লাস্ট জাজমেন্ট ছবি।

বুড়ো বয়সে এত পরিশ্রম তাঁর সহ্য হলো না। তাঁর শরীর ভেঙে পড়ল। কিন্তু এই ভাঙা শরীর নিয়েও তিনি বেঁচে রইলেন আরও দীর্ঘদিন। অবশেষে ১৫৬৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঊননব্বই বছর বয়সে এই মহান শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।

মিকেলাঞ্জেলো ছিলেন একেবারেই ছন্নছাড়া মানুষ। জীবনে শিল্প ছাড়া আর কোনো দিকে তাকাবার অবসর পাননি তিনি। বিয়েও করেননি। মৃত্যুকালে তাঁর পাশে একমাত্র গৃহভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না।

তিনি অর্থ উপার্জন করতেন প্রচুর, কিন্তু সবই বিলিয়ে দিতেন। নিজে বাস করতেন নোংরা পরিবেশে কৃপণের মতো।

ষাট বছর বয়সে মাদাম ভিক্টোরিয়া চলোনা নামে এক সুন্দরী মহিলার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এই চলোনার সংস্পর্শে এসে তিনি শুধু ভাস্কর্য নয়, কাব্যচর্চাতেও মনোনিবেশ করেন। লেখেন কিছু কিছু কবিতা। যদিও তা ছেপে প্রকাশ করেননি কখনও।

মিকেলাঞ্জেলোর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লরেঞ্জো দ্যা মেডিসি। জুলিয়ান দ্যা মেডিসির স্মৃতিস্তম্ভ, বেলজিয়ামে দি ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড, রোমের দি পিয়েটা এবং ভাস্কর্যশিল্প দি হোলি ফ্যামিলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *