ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২–১৫১৯) – সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী

লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২–১৫১৯) – সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী

গোটা বিশ্বের শিল্পরসিক মানুষ যে শিল্পকর্মের দর্শনে আজও মুগ্ধ হয়, বিস্মাভিভূত হয়, যে ছবির রমণীর রহস্যময় হাসির মর্ম উদ্ধারে আজও শিল্পবোদ্ধারা অক্লান্ত, সেই কালজয়ী শিল্পকর্ম ‘মোনালিসা’র স্রষ্টার নাম লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (Leonardo da Vinchi)।

ভিঞ্চির মতো বিশ্বে আর কোনো কালে কোনো শিল্পীর একটিমাত্র ছবি এত আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, এত জনপ্রিয়তাও অর্জন করেনি। এই মোনাসিলাই শিল্পীকে দিয়েছে কালজয়ী খ্যাতি আর অমরতা।

মহান শিল্পী লেওনার্দোর জন্ম ১৪৫২ সালে ইতালির ভিঞ্চি গ্রামে। পিতা পিয়েরে দা ভিঞ্চি ছিলেন সরকারি কর্মচারি ও ধনী ব্যক্তি। তাঁর প্রেমিকা ক্যাটেরিনার গর্ভজাত সন্তান ছিলেন লিওনার্দো। কুমারী মায়ের গর্ভজাত সন্তান ছিলেন তিনি।

লেওনার্দোর যখন জন্ম তখন ইটালিতে শুরু হয়েছিল শিল্পের পুনর্জাগরণ। শিশুকাল থেকেই তাঁর মধ্যে সৃজনশীলতার স্ফুরণ হয়েছিল। পিতা পিয়ের দা ভিঞ্চিও ছেলের এই শিল্পপ্রতিভাকে উৎসাহিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, যে কিশোরের হাতে এমন জীবন্ত ছবি ও মূর্তি তৈরি হতে পারে, তার প্রতিভা নিশ্চয়ই স্পষ্ট করবে খ্যাতির শীর্ষচূড়া। এ ছেলে নগণ্য কেউ নয়। তিনি তখন থেকেই ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

এরপর ছেলের প্রতিভাবিকাশের সুযোগসৃষ্টির জন্যাই তিনি পাড়াগাঁ থেকে সপরিবারে ভিঞ্চি উঠে এলেন ফ্লোরেন্স শহরে। কারণ শিল্প-সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র হিসেবে তখন ফ্লোরেন্স শহর ছিল সকলের শীর্ষে। বাবার ইচ্ছে, তাঁর ছেলে এই উদার পরিবেশে শিল্পীজীবনকে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।

তখন ফ্লোরেন্সে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন ভোরেশিও। লেওনার্দোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর শিল্প-প্রতিভা লক্ষ্য করে ভোরেশিও কাছে টেনে নিলেন তাঁকে। সুযোগ দিলেন তাঁর স্টুডিওতে কাজ করার।

এরপর লেওনার্দো তাঁর জীবনের মূল্যবান বারোটি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন এই ভোরেশিওর স্টুডিওতেই। অবশ্য লেওনার্দো এসময় শুধু শিল্পকর্ম নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি গণিত, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, যন্ত্র-প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ের ওপরেও পড়শোনা করতে লাগলেন। এরপর তিনি ১৪৮৬ সালে মিলান শহরে চলে আসেন।

লেওনার্দোর মতো প্রতিভাধর শিল্পীদের কাছ থেকে হয়তো অজস্র ছবি আশা করা যেত, কিন্তু তা হয়নি। তাঁর ছবির সংখ্যা ছিল খুবই কম। এ ছাড়াও আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। তাঁর অনেক ছবিই ছিল অসমাপ্ত। এমনকি তাঁর যে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম মোনালিসা সেটিও তাঁর ভাষায় ছিল অর্ধসমাপ্ত।

তাঁর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ‘দি লাস্ট সাপার’ বা ‘শেষ নৈশভোজ’ ছবিটি অন্যতম। ইতালির মিলান শহরের মারিয়া দেল গ্রেজ নামে একটি গির্জার দেয়ালে তিনি এঁকেছিলেন ছবিটি। এতে দেখানো হয়েছে, যিশু তাঁর বরোজন প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে নৈশভোজ করছেন। ছবিটি আঁকতে সময় লেগেছিল চার বছর(১৪৯৪–৯৮)।

লিওনার্দোর আর একটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’ বা ‘মা ও শিশুর ছবিটি। এতে শিশু যিশুকে মায়ের কোলে দেখানো হয়েছে।

১৪৯৯ সালে লেওনার্দো চলে যান ভেনিস শহরে। কিন্তু সেখানেও তাঁর মন টেকেনি। তাই তিনি আবার ফিরে যান তাঁর পুরনো কর্মস্থল ফ্লোরেন্স শহরে।

এখানে অবস্থানকালেই তিনি এঁকেছিলেন তাঁর বিশ্বনন্দিত ছবি ‘মোনালিসা’। তখন তাঁর পরিণত বয়স।

এই সময়ই তিনি গিউলিয়ানো দা মেডিসি নামে জনৈক ব্যক্তির অনুরোধে তার প্রাক্তন প্রেমিকা এবং ফ্লোরেন্স শহরের ফ্রান্সিসকো গিয়োকোন্ডার স্ত্রী ম্যাডোনা লিসার আদলে আঁকেন মোনালিসা। মোনালিসা আঁকতে তাঁর সময় লেগেছিল দীর্ঘ চার চারটি বছর। ছবির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—একটি নারীর অপূর্ব ভঙ্গিমাযুক্ত মুখমণ্ডল। মোসালিসার সবচেযে বিস্ময়কর দিক হল এর মুখের রহস্যময় হাসি।

লেওনার্দো একসময় জেনারেল বোরজিয়ার অধীনে সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। সেই সময় তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের সমরাস্ত্রের কিছু কিছু ছবিও আঁকতে শুরু করেন।

লেওনার্দো তাঁর এ-জাতীয় ছবি আঁকার পাশাপাশি প্রচুর রেখাচিত্রও এঁকেছিলেন। তাঁর নোটবই ভর্তি ছিল অসংখ্য রেখাচিত্রে। তিনি এগুলো এঁকেছিলেন অধিকাংশই পেন্সিল আর কলম দিয়ে। আরও মজার ব্যাপার, এই রেখাচিত্রগুলো তিনি এঁকেছিলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

শুধু আঁকা নয়, আঁকা ছবির পাশাপাশি তিনি সেগুলোর বর্ণনাও দিয়ে গেছেন।

পাখি কেমন করে আকাশে ওড়ে তা তিনি গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতেন। আর এমনই কল্পনা করতে করতেই তিনি পেন্সিল দিয়ে এঁকেছিলেন প্রপেলারচালিত উড়োজাহাজের ছবি। অথচ তখনও উড়োজাহাজ আবিষ্কৃতই হয়নি। উড়োজাহাজ আবিষ্কৃত হয় তাঁর মৃত্যুরও অনেক পরে। নদী খননের যে আধুনিক যন্ত্র ড্রেজার, তা হাল আমলে আবিষ্কৃত। কিন্তু লেওনার্দো তা রেখাচিত্র এঁকেছিলেন কয়েকশো বছর আগেই।

তবে লেওনর্দোর সমস্ত শিল্পকর্মের মধ্যে তাঁর সেরা সৃষ্টি মোনালিসা।

লেওনার্দো তাঁর কর্মজীবনের ১৫০৫ থেকে ১৫১৩ সাল পর্যন্ত মিলান শহরেই কাটান। ১৫১৩ সালে তিনি আসেন রোমে। তাঁর জীবনের শেষ আড়াই বছর তিনি চাকরি করেন ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের অধীনে।

এই মহান শিল্পীর মৃত্যু হয় ১৫১৯ সালের ২মে তারিখে। তাঁকে সমাহিত করা হয় রাজকীয় সমাধিক্ষেত্রে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *