ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

অ্যারিস্টোফানিস (আনু. ৪৪৪–৩৮৫ খ্রি. পূ.) – যাঁর সাহিত্যকর্মে আর্তমানবতার কথা প্রতিফলিত

অ্যারিস্টোফানিস (আনু. ৪৪৪–৩৮৫ খ্রি. পূ.) – যাঁর সাহিত্যকর্মে আর্তমানবতার কথা প্রতিফলিত

যুদ্ধের বিভীষিকা এবং আর্তমানবতার দুঃসহ যন্ত্রণা যাঁকে সম্পূর্ণরূপে আবিষ্ট করে রেখেছিল, তিনি আর কেউ নন, প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফানিস (Aristophanes)।

এই মহান সাহিত্যিকের জন্ম আনু. ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বে। পিতার নাম ছিল ফিলিপ্পাস এবং মায়ের নাম জেনোদোরা।

অ্যারিস্টোফানিসের যৌবনকাল কেটেছে গ্রিক ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল সময়ে। এথেন্সের মহান শাসক পেরিক্লিসের (আনুমানিক ৪৯০–৪২৯ খ্রি. পূ.) জয়যাত্রা তখন সুখসমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে। শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক জয়যাত্রা নয়, এই সময় এথেন্স শিল্পসাহিত্যও সগৌরবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই এই স্বর্ণযুগটাকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন অ্যারিস্টোফানিস। কিন্তু যে স্বর্ণযুগের সোনার পরশে তিনি আবাল্য লালিত হয়েছিলেন, তার বিভীষিকাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন নিজের চোখেই।

তাঁর শাসনামলে এথেন্সে যে সুখসমৃদ্ধি নেমে এসেছিল, তা চিরস্থায়ী হতে পারেনি। পারিপার্শ্বিক লোভ আর লালাসা সেই পুষ্পিত কাননকে থাকতে দেয়নি অম্লান ও সুন্দর।

পেরিক্লিসের শত্রুদের ঈর্ষান্বিত ও লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছিল এই পুষ্পিত কাননের দিকে। রাজার অন্যতম প্রধান শত্রু স্পার্টা ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন এথেন্সের বিরুদ্ধে, যে যুদ্ধ ইতিহাসে পেলোপনেশীয় যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয় দীর্ঘ ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।

এই যুদ্ধই এথেন্সের সুখসমৃদ্ধি নষ্ট করে দিয়ে ডেকে আনে অবর্ণনীয় বিভীষিকা। সে অভিশাপ থেকে রেহাই পাননি অ্যারিস্টোফানিসও। যুদ্ধ শুরু হবার পরই শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভয়ে গ্রামঞ্চলের লোকজন দলে দলে এসে আশ্রয় নিতে থাকে এথেন্স শহরে। হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয় এক জায়গায়। ফলে বিপদ এল অন্য দিক থেকে। তারা শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এসে পড়ে যায় আরেক অদৃশ্য শত্রুর হাতে। সারা শহরে। মহামারী আকারে দেখা দিল ভয়াবহ প্লেগ রোগ। লোক মরতে লাগল হাজারে হাজারে। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য!

এই মারাত্মক রোগে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, স্বয়ং রাজা পেরিক্লিসও প্রাণ হারালেন। এসব মর্মান্তিক দৃশ্য নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেন অ্যারিস্টোফানিস।

দীর্ঘদিন পরে যুদ্ধের অবসান হলো। কিন্তু এথেন্স তার হারানো গৌরব আর ফিরে পেল না। অ্যারিস্টোফানিসের অধিকাংশ নাটকই লেখা হয়েছিল পেলোপনেশীয় যুদ্ধের সময়ে। তাই এর সবগুলোতেই যুদ্ধের ভয়াবহতা আর তার মর্মান্তিক দৃশ্য ফুটে উঠেছে এসবের পরতে পরতে।

এই সময় অ্যারিস্টোফানিসকে নিয়ে এথেন্সে কিছুটা বিভ্রান্তিরও সূত্রপাত হয়েছিল। যুদ্ধের এই অনিশ্চিত পরিবেশে কিছু পেশাদার দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল এথেন্সে। তাঁরা সন্দেহবাদ এবং বস্তুবাদের দর্শন প্রচার করে জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন। প্রসার ঘটেছিল জটিল কূটতর্কের। সত্যের সাধনার ওপর গুরুত্ব লাভ করল জাগতিক লাভের সম্ভাবনা। কিন্তু অ্যারিস্টোফানিস মনে করলেন, পরিবর্তিত এই ধারণাটি মানবতার জন্য ক্ষতিকর। তিনি মনেপ্রাণে যুদ্ধ-বিরোধী হলেও মনে করতেন, এথেন্সের দুর্দশার জন্য দায়ী হলো গণতান্ত্রিক নীতিসমূহ এবং এর বর্তমান নেতৃবৃন্দ।

এর ফলেই দেখা দেয় বিভ্রান্তি। শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। তিনি শত্রুপক্ষের অর্থাৎ আক্রমণকারী স্পার্টার গুপ্তচর বলে। কেউ কেউ এমনও বলতে শুরু করে যে, তিনি প্রকৃত এথেন্সীয়ই নন। অথচ তিনি এথেন্সেই জন্মেছিলেন এবং সারাজীবন কাটিয়েছিলেন এথেন্সে।

তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের আরেকটি কারণ ছিল—তিনি তাঁর রচিত নাটকগুলোতে তৎকলীন এথেন্সের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিদ্ধ করেছিলেন বিদ্রুপবাণে। নিজের কমেডিগুলোতেও তিনি এথেন্সের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শিল্পীসাহিত্যিককে চরম হাস্যকরভাবে চিত্রিত করেছিলেন। ভুল বোঝাবুঝির শুরু এখান থেকেই। অথচ তিনি তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে শান্তি, যুদ্ধবিরোধিতা, উত্তম সরকার এবং জাতীয় ঐতিহ্যের ধারাকে নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসী ছিলেন। এর মধ্যে অবশ্যই একটা রক্ষণশীলতা ছিল।

অ্যারিস্টোফানিস প্রায় ৪০টির মতো নাটক রচনা করেছিলেন। কিন্তু কালের করাল গ্যাস পার হয়ে তাঁর মাত্র গোটাকতক নাটক আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম তাঁর যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার নাম ‘দি একারনিয়নস’। এ নাটকে তিনি এথেন্সের যুদ্ধবাদী দলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ

করেছেন।

এরপর ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মঞ্চস্থ হয় তাঁর ‘দি পিস’ (The Peace) নাটকটি। এটিও একটি যুদ্ধ-বিরোধী নাটক। ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মঞ্চস্থ হয় তাঁর আরেকটি বিখ্যাত নাটক ‘লিসিসট্রাটা’ (Lysistrata)। এটিও একটি যুদ্ধ-বিরোধী নাটক। এখানে দেখানো হয়েছে নায়িকা লিসিসট্রাটার নেতৃত্বে গ্রিসের রমণীকুল যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।

নাটক রচনায় অ্যারিস্টোফানিসের নানা ধরনের কৌশল ছিল। যেমন, কমেডি সৃষ্টিতে যতরকমের পদ্ধতি আছে, তিনি তার সমস্তই ব্যবহার করতেন। হাস্যরস সৃষ্টির চরম আধিক্য ও আদিরস সৃস্টি-এর কোনোটাই তিনি বাদ দিতেন না। এর মধ্যে হাস্যরসের প্রধান্যই থাকত অতিমাত্রায়।

অ্যারিস্টোফানিসের নাটক রচনা শুরু হয়েছিল কমেডি নাটকের মধ্য দিয়ে। তখন এথেন্সে বছরে দুবার করে নাটোৎসব হত। এর একটি হত জানুয়ারি / ফেব্রুয়ারিতে এবং অপরটি হত মার্চ/এপ্রিলে।

এসব নাট্যোৎসবে হাস্যকৌতুকের নাটকই অভিনীত হতো বেশি। বস্তুত গ্রিক দেবতাদের আনন্দদানের জন্যই রাজধানীতে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করা হতো।

অ্যারিস্টোফানিসের প্রথম হাস্যরসাত্মক নাটক ‘ব্যাংকুয়েটারস’ (Banqueters) ক্যালিস্ট্রাটাস-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় ৪২৭ খ্রি. পূর্বাব্দে। এটি দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করে। পরের বছর অর্থাৎ ৪২৬ খ্রি. পূর্বাব্দে তাঁর ‘ব্যাবিলনিয়ানস’ (Babylonians) মঞ্চস্থ হয়। এটি ছিল ইতিহাস ও ধর্মভিত্তিক কৌতুক নাটক। এরপর মঞ্চস্থ হয় তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। যেমন ৪৩৫ খ্রি. পূর্বাব্দে মঞ্চস্থ হয় ‘অ্যাচারনিয়নস’ (Acharnions), ৪২৪ খ্রি. পূর্বাব্দে হয় ‘নাইটস’ (Knights)। তবে তাঁর সবচেয়ে মঞ্চসফল নাটক ‘ক্লাউডস’ (Clouds) ৪২৩ খ্রি. পূর্বাব্দে এবং ‘ওয়াসস্’ (Wasps) ৪২২ খ্রি. পূর্বাব্দে মঞ্চস্থ হয়।

তাঁর এর পরের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘বার্ডস’ ( Birds), ‘লাইসিস্ট্রাকা’ (Lysisratrata) ‘থেসমেফোরিয়া জুসা’ (Thesmophoria Zusae), “দি ফ্রস্‌’ (The Frogs). ‘উওম্যান ইন পার্লামেন্ট’ (Woman in Parliament) এবং ‘ওয়েল্থ্’ (Wealth)।

অ্যারিস্টোফানিসের নাটকে একদিকে যেমন থাকত হাস্যরসের প্রাধান্য, অন্যদিকে তেমনি থাকত কোমল ও স্পর্শকাতর হৃদয়ানুভূতিও। আসলে দুটো দিকই ছিল তাঁর নাটকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে।

এই মহান নাট্যকারের মৃত্যু হয় আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *